থ্রি: থার্টিফোর এএম
প্রারম্ভিক
আবার ঐ সাদা ঘরটাতে আমি। মা সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। উজ্জ্বল সবুজ চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে যেন। ধূসর চুল পনিটেইল করে বাঁধা। ডান হাতটা ওপরে ওঠালে দেখলাম শক্ত করে একটা হাতুড়ি ধরা সেখানে, যার হাতলটা শুকনো রক্ত জমে খয়েরি বর্ণ ধারণ করেছে। হাতুড়ির মাথা অবশ্য একদম চকচক করছে। নিয়মিত ব্যবহার করা হয়। বোঝাই যায়। বাঁধন থেকে মুক্ত হবার বৃথা চেষ্টা করলাম আরেকবার।
আমার বামহাতের ওপর সজোরে নেমে এল হাতুড়িটা। হাড্ডি ভাঙার শব্দ কানে আসল। কয়টা ভেঙেছে বুঝতে পারলাম না।
দ্বিতীয়বার নেমে আসল হাতুড়িটা।
এরপর তৃতীয়বার।
বাম হাতের প্রতিটা হাড্ডি না ভাঙা পর্যন্ত বাড়ি দিতেই থাকলেন তিনি। একটা রক্তাক্ত মাংসের দলায় পরিণত হল ওটা।
ব্যথার পরিমাণ ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। অকল্পনীয়। আপনি ধারণাও করতে পারবেন না, এই ধরণের ব্যথার অস্তিত্ব আছে।
এবার হেঁটে অন্যপাশে চলে আসলেন তিনি। তার পুরো ল্যাবকোট আমার রক্তের ছিটায় ভিজে গেছে। কিছু রক্ত তার গলায় আর গালে লেগে আছে এই অত্যাচারের প্রমাণস্বরূপ।
“এই শেষবারের মত জিজ্ঞেস করছি,” যান্ত্রিক স্বরে বললেন তিনি, “ফ্ল্যাশড্রাইভভটা কোথায়?”
মাথা ঝাঁকালাম কেবল। জানি না আমি। আর কতবার এ কথা তাকে বলতে হবে আমার? প্রেসিডেন্ট আমাকে কোন ফ্ল্যাশড্রাইভভ দেননি। সত্যি বলছি।
আবার হাতুড়িটা ওঠালেন তিনি। নামিয়ে আনলেন সর্বশক্তিতে।
ধড়মড়িয়ে জেগে উঠলাম।
বিশ সেকেন্ড সময় লাগলো বুঝতে যে, স্বপ্ন দেখছিলাম আমি। ঐ সাদা ঘরটাতে দু-সপ্তাহ ধরে পা পড়েনি আমার। যেখানে মাকে দেখেছিলাম তিরিশ বছর পর।
উঠে বসে নাইটস্ট্যান্ডের ঘড়িটার দিকে তাকালাম।
তিনটা এক।
.
৭ জুলাই।
৬৯ ডিগ্রি।
যে বিছানায় ছেলেবেলার বেশিরভাগ দিনগুলো কাটিয়েছি সেই বিছানায় আমি। বাবার বাসায়।
আমার অ্যাপার্টমেন্ট এখনও বসবাসের অনুপযোগি। পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল ওটাকে ফ্ল্যাশড্রাইভটার খোঁজে। সামনাসামনি দেখিনি আমি, কিন্তু ইনগ্রিড ছবি দেখিয়েছে ফোনে। প্রতিটা ক্যাবিনেট ভেঙে ফেলা হয়েছে, প্রতিটা খাবারের ক্যান খুলে দেখা হয়েছে, ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে প্রতিটা কুশন। প্রতিটা কোনায় কোনায় ফ্ল্যাশড্রাইভটার খোঁজে চিরুনি অভিযান চালানো হয়েছে।
আমার মার লোকেদের হাতে সময়ের অভাব ছিল না। জুনের আঠার তারিখের রাত চারটা থেকে পরদিন রাত দশটা পর্যন্ত সময় পেয়েছিল তারা ফ্ল্যাশড্রাইভটার খোঁজ করার জন্যে। প্রায় আঠারো ঘন্টা। চেতনানাশকের প্রভাব কাটতে এতটাই সময় লেগেছিল ইনগ্রিড আর ল্যাসির।
ওরা যখন অচেতন অবস্থায় গাড়িতে পড়ে ছিল আমাকে তখন প্লেনে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অচেনা কোন জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রে। ঐ সাদা ঘরটাতে, যেখানে আমাকে রাসায়নিকের প্রভাবে প্রায় তেইশ ঘন্টা দুঃস্বপ্ন দেখতে বাধ্য করা হয়। ঐ তেইশ ঘন্টাকে তেইশ দিন মনে হয়েছিল আমার-তেইশ দিন আলাস্কার বুনো অঞ্চলে বেঁচে থাকার চেষ্টা।
ঘটনা কাল্পনিক ছিল। কেবল আমার মস্তিষ্কের সৃষ্টি। ভূমিকম্প, কেবিন, ওপিক, ভালুক, সবকিছু মিথ্যা! স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের অংশ ওগুলো। আমার নিজের মা আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, আবার!
চোখ বন্ধ করলে এখনও ওপিকের অসাড় দেহটার ছবি ভেসে ওঠে। ধীরে ধীরে শ্বাস নিচ্ছে, পেটের ক্ষত থেকে রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। ল্যাসির অসহায়ভাবে নৌকায় বসে থাকার দৃশ্যটা বারবার মাথায় ঘোরে।
বামদিকে তাকালাম, যেখানে আমার কোমরের কাছে ঘুমিয়ে আছে বেড়ালটা।
আদর করে দিলাম ব্যাটাকে। ওকে আসলেই হারিয়ে ফেললে কি হত?
যাই হোক, চেতনা ফিরে আসার পর প্রাইভেট এয়ারফিল্ড থেকেই পুলিশে ফোন করে ইনগ্রিড। প্লেনটা ততক্ষণে উধাও হয়ে গেছে। আরো কিছুক্ষণ অনুসন্ধানের পর দেখা যায় একদম যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে ওটা। কোন রাডারেই অস্তিত্ব নেই ওটার।
আর তার সাথে হেনরি বিনস।
ইনগ্রিড অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে না আসা পর্যন্ত এখানকার ধ্বংসযজ্ঞের কথা কেউ জানতো না। কিন্তু অ্যাপার্টমেন্টটা নিয়ে বেশি ভাবেনি কেউ।
কারণ আমাকে পাওয়া যাচ্ছিল না।
জন্যে। রাজ্য পুলিশ, এফবিআই যাকে যেখানে পেয়েছে, বলেছে। আমার উধাও হওয়ার চব্বিশ ঘন্টা পর থেকে আশেপাশের দু-শ মাইলের মধ্যে প্রতিটা পুলিশ অফিসার খোঁজ করেছে আমার জন্যে। কিন্তু বেশিক্ষণ খুঁজতে হয়নি তাদের। পরদিন সকাল আটটায় হদিস মেলে আমার। জুনের বিশ তারিখে। একজন কৃষক তার টমেটো ক্ষেতে ঘুমন্ত অবস্থায় পায় আমাকে।
ল্যানসিংয়ের একট হাসপাতালে ঘুম ভাঙে আমার। এর আগেও বেশ কয়েকবার বিভিন্ন কারণে চোখ খুলে নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করেছি। আমি, তবুও চিৎকার করা থেকে নিজেকে থামাতে পারিনি। আমি ভেবেছিলাম তখনও ঐ সাদা ঘরটাতেই আছি।
ঘুমিয়ে পড়ার আগে সর্বশেষ যে স্মৃতিটা ছিল আমার, তা হল, মা আমাকে ফ্ল্যাশড্রাইভভের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছেন। আর তার পাশে একটা লোক গোলাপি রঙের তরল ভর্তি সিরিঞ্জ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি আশা করছিলাম, হয়ত আমাকে আবার ঐ তেইশ ঘন্টার দুঃস্বপ্নের ভেতর দিয়ে যেতে হবে।
কিন্তু আমার কথা বোধহয় বিশ্বাস হয়েছিল ওদের কিংবা আমার প্রতি করুণা অনুভব করেছিলেন মা। আমার ওরকম পাগলপ্রায় অবস্থা দেখে অপরাধবোধও জেগে উঠতে পারে তার মনে। এতগুলো বছর ঠকিয়েছেন আমাকে, এটুকু তো আশা করতেই পারি।
আবার এটাও হতে পারে, ছেড়ে দেয়াটা একটা চাল। তাদের ধারণা মুক্তি পেয়ে সরাসরি ফ্ল্যাশড্রাইভটার খোঁজে লেগে যাব আমি। তাই আমকে ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। এক কৃষকের টমেটো ক্ষেতে ফেলে গেছেন।
সৌভাগ্যবশত ঘুম থেকে জেগে ওঠার সময়টাতে হাসপাতালেই ছিলেন বাবা, ইনগ্রিড আর ল্যাসি। তবুও আমার হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিক করতে প্রায় বিশ মিনিট সময় লাগে।
এরপর যখন আসল ঘটনা প্রকাশিত হল, সবাই জানতে পারল, আমাকে সিআইএ’র সবচেয়ে নামকরা টর্চার স্পেশালিস্ট তুলে নিয়ে গিয়েছেন, যে কিনা এ মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় পলাতক আসামিদের একজন, তখন সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল আমার সাথে কথা বলার জন্যে।
ইনগ্রিডের অনেক প্ররোচনার পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে রাজি হই আমি। তিন ঘন্টা, মানে তিনদিন আমাকে একটা ভিডিও ক্যামেরার সামনে প্রশ্ন করে ইনগ্রিড, সিআইএ’র নতুন পরিচালক আর প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রধান রেড।
সিআইএ’র নতুন পরিচালকের বিশেষ আগ্রহ ছিল আমার মা স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের ব্যাপারে কি কি বলেছেন তার ওপর। যদি আসলেও ওটার কোন অস্তিত্ব থেকে থাকে, তবে সেটা তার কিংবা তার কোন সহকর্মির জানা নেই।
সাদা ঘরটা সম্পর্কে ভালোমত বর্ণনা করি আমি। কিন্তু বলার মত বেশি কিছু ছিল না। যেহেতু আমাকে মিশিগানে পাওয়া যায়, তাই এর আশেপাশের অঞ্চলগুলোতেই খোঁজ চালায় সিআইএ। যদিও সাদা ঘরটার অবস্থান আলেক্সান্দ্রিয়া থেকে আকাশ পথে চার ঘন্টার যেকোন দূরত্বে হতে পারে। প্রায় দু’হাজার বর্গমাইল সেদিক দিয়ে চিন্তা করলে।
সিআইএ পরিচালক চলে যাওয়ার পরে আমি ইনগ্রিড আর রেডের কাছে খোলাসা করে বলি, মা কোন সাধারণ ফ্ল্যাশড্রাইভের খোঁজ করছিলেন না। তিন এমন একটা ফ্ল্যাশড্রাইভভের খোঁজে ছিলেন যেটা স্বয়ং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আমাকে দিয়েছেন। রেড, যে কিনা ইউনিভার্সিটি থেকে প্রেসিডেন্টের বন্ধু, আমাকে নিশ্চিত করে বলে, এরকম কোন ফ্ল্যাশড্রাইভভ আমাকে দেননি প্রেসিডেন্ট। আর কনর সুলিভানের সাথে অল্প সময়ের আলাপচারিতায় তিনিও এই কথার পুণরাবৃত্তি করেন।
এই তথ্যটা বাদে আমি অন্য যা যা বলেছি সব কিছু রেকর্ড করে বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থার কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয় জরুরি ভিত্তিতে।
সিআইএ তার পেছনে লেগেছে। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি তার পেছনে লেগেছে। এমনকি এফবিআই’র লোকজনও হন্য হয়ে খুঁজছে তাকে।
কিন্তু তাদের চেয়েও আমি বেশি তাগাদা অনুভব করছি মা’কে খুঁজে বের করার জন্য। তার কারণেই আজ আমার এই অবস্থা। তাকে পেলে হয়ত এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ মিলবে।
আর তাকে খুঁজে পাওয়ার একটা রাস্তাই মাথায় আসছে আমার। ফ্ল্যাশড্রইভভটা আমাকে তার আগে উদ্ধার করতে হবে।
তাহলেই আমার কাছে আসতে বাধ্য হবেন তিনি।
*
অধ্যায় ১
“কিরে?”
ল্যাসি ওর হলুদ চোখদুটো খুব কষ্ট করে খুলে আমার দিকে তাকাল, এরপর থাবা বাড়িয়ে ধরার চেষ্টা করল আমাকে। ওর মুখে একটা ফুঁ দিলাম, জানি এতে খুবই বিরক্ত হয় ও। জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাতে লাগল জবাবে।
“উঠে পড়।”
মিয়াও।
“দুঃস্বপ্ন দেখেছিস তুই? কি নিয়ে?”
মিয়াও।
“জাস্টিন টিম্বারলেক মারা গেছে? এই তোর দুঃস্বপ্ন?”
মিয়াও।
“ওহ্, মারা যায়নি। শুধু প্যারালাইজড হয়ে গেছে, তাই আর নাচতে পারছে না। হ্যাঁ রে, আসলেও অনেক ভয়ের স্বপ্নটা। এটার কাছে আমার হাড্ডি ভাঙার দুঃস্বপ্নটা তো কিছুই না।”
“মিয়াও।”
“হ্যাঁ, তখনও নাচার সুযোগ থাকবে বটে আমার।”
ওকে উল্টিয়ে দিয়ে পেটে কাতুকুতু দিতে লাগলাম। আরো এক মিনিট হুটোপুটি চালিয়ে গেলাম ওর সাথে। এরপরে নেমে গেল ও বিছানা থেকে। ঘড়ির দিকে তাকালাম, তিনটা চার বাজছে। কম্বল সরিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।
আমার ছেলেবেলার ঘরটা আমি চলে যাওয়ার এক যুগ পরেও খুব একটা বদলায়নি। ঘর ভর্তি ছবি,ট্রফি কিংবা পুরনো ভিডিও গেম কন্সেল নেই কিন্তু। ওসবের জন্যে কোন সময় ছিল না আমার। তবে প্রিন্সের একটা বড় পোস্টার ঝোলানো আছে এক পাশে। আর আছে একটা হোয়াইট বোর্ড। আমি যখন অনলাইন ট্রেডিং শুরু করেছিলাম তখন যে স্টকগুলো কিনব সেগুলো লিখে রাখতাম, দামের তারতম্যের গ্রাফ আঁকতাম ওটাতে। এদুটো জিনিসস ছাড়া বাকি দেয়ালগুলো পুরো ফাঁকা।
আসবাব বলতে একটা ছোট ড্রেসার, বিছানা, ক্লোজেট আর একটা নাইটস্ট্যান্ড। ক্লোজেটের পাশে দুটো ডাম্বল রাখা।
অনেকটা দমবন্ধ করা পরিবেশ।
আমার নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে যেতে তর সইছে না।
যে কন্ট্রাক্টর রিমডেলিংয়ের কাজ করছে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টটার, তার মতে আরো দু-সপ্তাহ লাগবে সব কাজ শেষ হতে। দু-সপ্তাহের আগে আমি আর ইনগ্রিড ওখানে ফিরে যেতে পারছি না।
অধীর হয়ে অপেক্ষা করছি কখন দু-সপ্তাহ পার হবে। প্রতিটা সেকেন্ড গুণছি। অবশ্য সারাটা জীবনই আমি সেকেন্ড গুণে গুণে পার করেছি। এটা নতুন কিছু না।
ল্যাসিকে তুলে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম। বাবার ঘরটা আমারটা থেকে বের হয়েই বামদিকে, একবার উঁকি দিলাম ভেতরে। বিছানার ডানপাশে গভীর ঘুমে অচেতন তিনি। আর বামপাশে শুয়ে আছে তার একশ ষাট পাউন্ড ওজনের বিশাল কুকুর, মারডক।
একটা বক্স ফ্যান ঘুরছে ঘরটাতে। তবুও ভার্জিনিয়ার এই চিটচিটে গরম খুব কমই দূর করতে পারছে ওটা।
আলেক্সান্দ্রিয়ায় নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে যেতে চাওয়ার আরেকটা কারণ হল ওটা পুরোপুরি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।
ল্যাসি লাফ দিয়ে আমার হাত থেকে নেমে বিছানায় মারডকের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। মারডক ওর বিশাল চোখগুলোর একটা খুলে দেখল ল্যাসিকে, এরপর থাবা দিয়ে কাছে টেনে নিল।
দরজাটা ভিড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে থাকলাম।
এখানে আসার পর প্রথম সপ্তাহে প্রতিদিন ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখতাম বাবা একটা কফির মগ নিয়ে রান্নাঘরের টেবিলটাতে বসে আছেন।
“কেমন ঘুম হল, হেনরি?” তিনি জিজ্ঞেস করতেন। “দুঃস্বপ্ন দেখনি তত বেশি?”
হেনরি বিনসে ভোগার এটাই একটা সমস্যা। খুব খারাপ দুঃস্বপ্ন দেখলেও ঘুম থেকে জেগে ওঠা যায় না।
প্রথমদিকে কিছু মনে না করলেও কয়েকদিন পরে ঐ একই প্রশ্ন শুনতে আর ভালো লাগছিল না। কারণ প্রতি রাতে ঘুম থেকে জাগার পর দেখা যেত স্বপ্নটা নিয়ে কথা বলতে বলতেই পুরো এক ঘন্টা (আমার জন্যে পুরো একদিন) চলে যাচ্ছে।
ভাগ্য ভাল যে গত দু-দিন যাবত আমার জেগে থাকার সময়টা ঘুমিয়েই পার করছেন বাবা। তাই আমারো হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সময় নষ্ট করতে হচ্ছে না।
হাসপাতালে যেদিন জেগে উঠেছিলাম, এক লাফে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল ইনগ্রিড। দু-জনের চোখেই পানি ঝরছিল। কিন্তু সেদিন আর বেশি সময় একসাথে কাটাতে পারিনি আমরা। এরপরের তিনদিন চলে যায় জিজ্ঞাসাবাদে। চতুর্থ দিনে কিছুটা একান্ত সময় পাই নিজেদের মত করে কাটানোর জন্যে। ঐদিন ঘুম থেকে জেগে উঠে যখন ওকে পাশে আবিষ্কার করি, তখন আলাস্কার ঘটনাটা মনে পড়ে যায়। ও প্রেগন্যান্ট শোনার পর কিভাবে আমি ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিলাম।
যে এক ঘন্টা জেগে থাকি আমি ঐ এক ঘন্টা বাচ্চার পেছনে দিতে হবে এটা ভেবেই অস্থির হয়ে উঠেছিলাম।
“আমি দিনে মাত্র এক ঘন্টা জাগি!” চিৎকার করে বলেছিলাম। “এটা কি মাথায় ঢোকে না তোমার? মাত্র ষাট মিনিট! আর এখন আমাকে একটা বাচ্চার ভরণপোষণ করতে হবে?”
হ্যাঁ, ওটা হয়ত বাস্তব ছিল না। কিছু রাসায়নিক আর স্টিমুলেশনের প্রভাব ছিল মাত্র, কিন্তু কথাটা যদি আসলেও সত্যি হত তাহলে একই ব্যবহারই করতাম আমি।
এরপর ঐ ভূমিকম্পের ব্যাপারটা তো আছেই। আর আছে ওপিক।
ওপিকের ব্যাপারে কাউকে কিছু বলিনি আমি। একটু বেশিই বেদনাদায়ক ব্যাপারটা আমার জন্যে। তাছাড়া আমি এটাও বুঝতে পারছিলাম না, আমার দুঃস্বপ্নটাতে এই ছোট্ট এস্কিমোর আগমন ঘটল কিভাবে। আর তার নাম ওপিকই বা দিলাম কেন আমি? এরকম হাজারটা প্রশ্ন মাথায় ঘোরে।
যাই হোক, ঐ কাল্পনিক ছেলেটাই আমার মানসিক অবস্থার ওপরে অনেক প্রভাব ফেলেছে।
দুঃস্বপ্নটা দেখার পর অবশ্য একটা ব্যাপার পরিস্কার হয়ে গেছে আমার কাছে, বাবা হতে আর কোন আপত্তি নেই আমার।
এই ব্যাপারটা আমার ভালোবাসার মানুষটার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু ওকে কিছু বলার আগে উত্তর চাই আমার।
আমার মার ব্যাপারে।
আর বাবার ব্যাপারে।
.
প্রতি দু-দিন অন্তর অন্তর ইসাবেল একবার করে বাবার বাসায় এসে সবকিছু ঠিকঠাক করে দিয়ে যায়। প্রথমদিকে ব্যাপারটা নিয়ে খুব বিরক্ত হচ্ছিলেন বাবা, অবশ্য যুক্তিও ছিল। ইসাবেলের এখানে আসায় তার হয়ত মনে হচ্ছিল, তিনি তার নিজের ছেলের খেয়াল রাখতে পারেন না। অথচ এই কাজটাই সাতাশটা বছর নির্বিঘ্নে করেছেন তিনি। কিন্তু ইসাবেলের পাস্তা একবার মুখের দেয়ার পর আর ঘুম থেকে জেগে উঠে পুরো বাসা চকচকে অবস্থায় দেখে তার কথার সুর পাল্টে গেছে। এখন তিনি ইসাবেলের সবচেয়ে বড় গুণমুগ্ধদের একজন।
ফ্রিজ খুলে ইসাবেলের একটা বিখ্যাত রুবেন স্যান্ডউইচ বের করে রান্নাঘরের টেবিলে গিয়ে ল্যাপটপ খুলে বসলাম।
তিনটা সতেরোয় আমার ইমেইল অ্যাড্রেস এ লগইন করে দেখলাম এএসটি (AST) থেকে একটা ইমেইল এসেছে। এএসটি হচ্ছে অ্যাডভান্সড সার্ভেইলেন্স অ্যান্ড ট্র্যাকিং, যে প্রাইভেট কোম্পানিটা আপনাকে টাকার বিনিময়ে যে কারো সম্পর্কে তথ্য বের করে দেয়। হ ওদের কাছ থেকে শেষ ইমেইলটা পেয়েছিলাম গত অক্টোবরে, যেটা পাঠিয়েছিল স্বয়ং ওদের মালিক, মাইক ল্যাং। গত তিন বছর ধরে ওদেরকে টাকা দিয়ে আসছিলাম আমি। আমার মাকে খুঁজে বের করার জন্যে। আর সেটা পেরেছিল ওরা।
পটোম্যাক থেকে উদ্ধার করা একটা অচেনা মহিলার লাশকে আমার মায়ের বলে মনে হয়েছিল তাদের। আমি আর খোলাসা করে কিছু বলিনি মাইককে। বলিনি যে, লাশের আঙুলের ছাপ আর আমার মায়ের আঙুলের ছাপের সাথে পুরোপুরি মিলে গেলেও ওটা প্রেসিডেন্ট সুলিভনের একটা চাল ছিল মাত্র। ব্ল্যাক সাইটগুলোকে খুঁজে বের করতে আমাকে ব্যবহারের একটা চাল।
এবার অবশ্য মা’র ব্যাপারে খোঁজ নিতে মাইকের সাথে যোগাযোগ করিনি আমি। করেছি বাবার ব্যাপারে খোঁজ নিতে।
একটা জিনিস ভেবে অবাক হয়েছিলাম। মা যখন আমার ওপর এক্সপেরিমেন্ট চালাচ্ছিলেন তখন বাবা কোথায় ছিলেন? তিনি কি প্রেমে এতটাই অন্ধ হয়ে গেছিলেন যে, চোখের সামনে যা ঘটছে সেটা দেখেও দেখেননি? কিভাবে সম্ভব এটা?
তাছাড়া আরেকটা ব্যাপারে খটকা লাগতে শুরু করেছে আমার। বাবা সবসময়ই এটা বলে আসছেন, জন্মের পরের দিনই আমাকে বাসায় নিয়ে এসে তারা বুঝতে পারেন, মাত্র একঘন্টার জন্যে ঘুম থেকে জেগে উঠছি আমি। তারমানে, জন্ম থেকেই হেনরি বিনস কন্ডিশনে ভুগছি। কিন্তু সিআইএ’র প্রাক্তন পরিচালক আর আমার মার কথা বিবেচনা করলে এটা ভুল তথ্য।
কিছু একটা গোলমাল আছে।
ইমেইলের রিপ্লাই বাটনে ক্লিক করে লিখলাম :
মাইক,
নতুন একটা কাজ আছে তোমার জন্যে। বাবার জন্মদিন উপলক্ষে সারপ্রাইজ হিসেবে একটা স্ক্র্যাপবুক বানানোর কথা ভাবছি আমি। এজন্যে তার জন্মসনদটা দরকার আমার, সেই সাথে আমারটাও, যদি পাও তাহলে আরো ভালো (ওটা কোথাও খুঁজে পাচিছ না আমি)। আর আমার দাদা-দাদি সম্পর্কে কোন তথ্য পেলে সেগুলোও পাঠিয়ে দিও। বাবার পুরো নাম রিচার্ড উইলিয়াম বিনস। জন্ম-৮/১/১৯৫০, ডেস মোইনেস, আইওয়া অঙ্গরাজ্যে (যতদূর জানি কত খরচ হবে আমাকে জানিও।
হেনরি
পাঠিয়ে দিলাম মেইলটা।
এরপর আমার ঘরে গিয়ে বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে ম্যাট্রেসটা সরিয়ে একটা লুকোনো জুতোর বাক্স বের করে নিলাম। এখানেই লুকোনো আছে লাল রঙের খামটা যেটা প্রেসিডেন্ট সুলিভান আমাকে দিয়েছিলেন।
ইনগ্রিড যখন আমাকে বলেছিল, লাল খামটা আমার বাসার সেইফে সহি-সালামত আছে তখন কিছুটা অবাক না হয়ে পারিনি। সব কিছু লণ্ডভণ্ড অবস্থার মাঝে সেইফটার মধ্যে অক্ষত অবস্থায় পড়ে ছিল খামটা!
সেইফে খামটার সাথে ছিল ল্যাসির দুটো বল (ঝুনঝুনি লাগানো)। কিন্তু কোন এক শয়তান তল্লাশি করার সময়ে নিয়ে গেছে ওদুটো।
যদি বলি ল্যাসি শুধু কষ্ট পেয়েছিল ব্যাপারটাতে, তাহলে কম বলা হবে। এর আগে আমি জানতামও না যে, ওর পক্ষেও কাঁদা সম্ভব।
নিচে গিয়ে ফ্রিজ থেকে একটা পিনাট বাটার স্মৃদি বের করে বাবার পুরনো কাউচটাতে গিয়ে বসলাম আরাম করে।
ল্যাসি হেলেদুলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে আমার কোলে উঠে বসল।
“কিরে?” ওর কানের পেছনে চুলকে দিয়ে বললাম। “আরামেই তো ছিলি এতক্ষণ। নামলি কেন?”
মিয়াও।
“মারডক খালি নাক ডাকে?”
মিয়াও।
“বাবাও?”
মিয়াও।
“হ্যাঁ, ওভাবে ঘুমানোর কারণে হতে পারে এটা।”
মিয়াও।
“ঘুমানোর আগে মারডক সাতটা রুবেন স্যান্ডউইচ খেয়েছে? বাহ্, এটা তো জাতীয় রেকর্ড হয়ে যাবে!”
ওকে একটু পিনাট বাটার স্মৃদি দিলে চেটেপুটে শেষ করল ওটুকু। এরপরের পাঁচ মিনিট ওকেই খাওয়ালাম। খেয়েদেয়ে আবার আমার কোলের ওপরেই ঘুমিয়ে পড়ল ব্যাটা।
খালি গ্লাসটা পাশের ছোট টেবিলটার ওপরে রেখে লাল খামটা তুলে নিলাম ওখান থেকে। ভেতরে একটা বড় ফাইল। গত সাতদিন ধরে প্রতিদিন দশ মিনিট এটা পড়ে কাটিয়েছি আমি।
প্রথম পাতায় আমার মা’র আট বাই দশ ইঞ্চির একটা বড় ছবি। ছয়জন লোকের সামনে বড় একটা সবুজ মাঠের মত জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। লোকগুলোকে দেখে দক্ষিণ আমেরিকান মনে হচ্ছে, কারো গায়েই শার্ট নেই। মা একটা বন্দুক তাক করে রেখেছেন তাদের দিকে। তার পরনে জিন্সের প্যান্ট আর সাদা শার্ট। ক্যামেরার দিকে দৃষ্টি তার, সবুজ চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করছে পড়ন্ত বিকেলের সূর্যালোকে। চেহারায় পূর্ব ইউরোপিয় একটা ছাপ আছে।
ফাইলটা থেকে এটা জানতে পেরেছি, ছবিটা হন্ডুরাসে ভোলা হয়েছিল ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮’র মধ্যবর্তি কোন এক সময়ে। যেসময়টা তিনি হন্ডুরাসের সরকারকে শেখাচ্ছিলেন কিভাবে বন্দিদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে হয়।
উল্টিয়ে ফাইলের পরের পাতায় চলে গেলাম।
আমার মা, এলেনা জানেভের জন্ম ১৯৪৮ সালের ২৩শে এপ্রিল, তল্কালীন যুগোস্লাভিয়ায়, এখনকার মেসোড্ডানিয়া। এগার বছর বয়সে একটা জাহাজে চড়ে আমেরিকার ভারমন্টে পাড়ি জমান তিনি। তার এক চাচা ছিলেন এখানে, যে তার ভাঙা ভাঙা ইংরেজিকে ঘষে মেজে চলনসই করে তোলেন। হাইস্কুলে নিজের ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবি শিক্ষার্থি ছিলেন তিনি। সব পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে এমআইটিতে পড়ার জন্যে ফুল স্কলারশিপ জোগাড় করে ফেলেন। সেখানে রসায়ন নিয়ে পড়াশোনা করেন, সেই সাথে মাইনর করেন সাইকোলজিতে। ১৯৭০ সালে সেখান থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন তিনি, ভিয়েতনাম যুদ্ধের শেষ দিকে। ওরকম অসাধারণ রেজাল্টের কারণে চাকরির সুযোগের অভাব ছিল না তার সামনে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে ইউনাইটেড স্টেটস সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ)। ১৯৭১ সালে ভার্জিনিয়ায় ল্যাংলিতে সিআইএ প্রশিক্ষণ শুরু করেন তিনি।
প্রশিক্ষণ শেষ করার পর তাকে নিয়োগ দেয়া হয় এক্সট্রাঅর্ডিনারি রেন্ডিশন প্রোগ্রামে, যেটা শত্রুপক্ষের সৈন্যদের ধরে জিজ্ঞাসাবাদের একটা বাহারি নাম মাত্র। সোজা কথা, নির্যাতন করে তথ্য আদায় করা।
১৯৭৩ থেকে ১৯৮১’র মধ্যবর্তি সময়টা খালি, কিছু নেই ওটুকুতে। কিন্তু আমার ধারণা করতে বেশি অসুবিধা হয় না, কি ঘটে থাকতে পারে ঐ সময়ে। এজন্যে সিআইএ’র প্রাক্তন পরিচালকের একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য।
আমার মা একটা গোপন প্রজেক্টে যোগদান করেন, যেটার লক্ষ্য ছিল বন্দিদের কাছ থেকে তথ্য আদায়ের জন্যে সবচেয়ে কার্যকর উপায়টা খুঁজে বের করা। যার নাম স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম।
আর ঠিক ঐ সময়গুলোতেই সিআইএ তার ব্ল্যাক সাইটগুলো তৈরি করছিল-গোপন জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্র-দেশের ভেতরে এবং বাইরে। এতে করে মা’র হাতে বড় সুযোগ আসে নতুন নতুন পদ্ধতিগুলো প্রয়োগ করে দেখার।
এরপর, বাবার ভাষ্যমতে, তার সাথে মার দেখা হয় ১৯৭৬ সালে। তিনি তাকে চিনতেন স্যালি পেট্রাকোভা নামে। এর একবছর পরে তার নাম হয় স্যালি বিনস। আমার জন্ম হয় ১৯৭৮ সালে ডিসেম্বরের বার তারিখে।
বাবার কথা অনুযায়ি, এই অদ্ভুত কন্ডিশনটা নিয়েই জন্মেছিলাম আমি। কিন্তু লে’হাই আর মা’র কথা অনুযায়ি এই তথ্যটা প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।
ফাইলে এর পরে যে তারিখটা সম্পর্কে লেখা আছে সেটা হল ১৯৮১ সালের এপ্রিলের ১৫ তারিখ, যেদিন তিনি আফগানিস্তানের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন। ঐ সময় সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ চলছিল পুরোদমে আর মা সেখানে ছয় সপ্তাহ কাটান। আমার মা প্রায়ই লম্বা সময়ের জন্যে বাসার বাইরে থাকতেন, কিন্তু ছয় সপ্তাহ নিজের তিন বছরের ছেলেকে ফেলে আবছা মনে আছে সেই সময়কার কথা (আমার অবশ্য এতদিন ধারণা ছিল তিনি একটা তেল কোম্পানির হয়ে কাজ করতেন। এটা আমার মাথাতেও আসেনি যে, তিনি ঐ সময়টা শত্রুপক্ষের সৈন্যদের ওয়াটার বোর্ডিং করে তথ্য আদায়ে ব্যস্ত)।
পরবর্তি চার বছর আবার ফাঁকা। এরপরের তথ্য অনুযায়ি ১৯৮৫ সালের জানুয়ারিতে হন্ডুরাসে পাড়ি জমান তিনি, যেখানে এর পরের তিন বছর থাকতে হয় তাকে।
এটা আমার ব্যক্তিগত জীবনের তথ্যের সাথেও মিলে যায়। কারণ তাকে আমি শেষ দেখেছিলাম আমার ষষ্ঠ জন্মদিনে, ১৯৮৪ সালের ডিসেম্বরে।
১৯৮৮ থেকে ২০০১ এর মধ্যবর্তি সময়টুকু ফাঁকা।
এরপর ২০০১ সালের নভেম্বরে, টুইন টাওয়ারের ঘটনাটার দু-মাস পর মা’কে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানো হয়। নিশ্চয়ই আল-কায়েদার লোকদের কাছ থেকে তথ্য বের করে লাদেনকে ধরার উদ্দেশ্যে। তিনি আমেরিকায় ফিরে আসেন পনের মাস পর।
ফাইলে এর পরের তারিখটা ২০০৭ সালের ১৯ শে আগস্ট।
লে’হাইয়ের ভাষ্যমতে আমার মা একটা কমবয়সি ছেলেকে টর্চার করে মেরে ফেলেন, কিন্তু পরে জানতে পারেন, ছেলেটা আসলেই নির্দোষ ছিল। পরদিন উধাও হয়ে যান তিনি।
এরপরে আর কেউ দেখেনি তাকে।
একমাত্র আমি বাদে।
.
তিনটা আটান্নর সময় ল্যাসিকে তুলে নিয়ে ফিরে গেলাম আমার ঘরে।
যাওয়ার পথে বাবার ঘরে আরেকবার উঁকি দিয়ে গেলাম। নাক ডাকার আসর বসেছে যেন ওখানে। ল্যাসি হাসার মত একটা শব্দ করল।
বিছানায় উঠে ইনগ্রিড মেসেজ দিয়ে বললাম, কাল দেখা হচ্ছে। দ্রুততর হতে লাগলো। ঘুমাতে চাই না আমি। আমি জানি, আগামি তেইশ ঘন্টা আবারো মানসিক অশান্তির মধ্যে দিয়ে যাবে।
আমার মা আমাকে তাড়া করে বেড়াবেন।
*
অধ্যায় ২
গত এক বছরের মধ্যে প্রথমবারের মত নির্ধারিত সময়ের চেয়ে আগে জেগে উঠলাম।
দুটো সাতান্ন বাজছে ঘড়িতে।
তিন মিনিট বাড়তি।
আগে হলে খুশিতে আত্মহারা হয়ে চিন্তা করা শুরু করতাম, এই তিন। মিনিট কিভাবে খরচ করব। গোসলে বাড়তি তিরিশ সেকেন্ড, ব্যায়ামে বাড়তি এক মিনিট কিংবা এক মিনিট বেশি গেম অব থ্রোনস দেখতাম। কিন্তু আজ নয়। দুঃস্বপ্নটার রেশ কাটতে কাটতেই বাড়তি সময়গুলো চলে গেল।
এবারের স্বপ্নে আমার শরীরে আবার ঐ ভয়ঙ্কর তরল ইনজেক্ট কর হয়েছিল।
সমুদ্রে হারিয়ে গেছিলাম। একটা ছোট নৌকায়। সাথে একটা বাঘ।
হুম জানি, লাইফ অব পাই-এর সাথে অদ্ভুত মিল আছে স্বপ্নটার। বইটা আমি পড়েছিলাম অনেক আগে (প্রতিদিন চার মিনিট করে দুইশ ছয় দিন যাবত)। কিন্তু একটু পার্থক্য আছে, বাঘটা আসলে অন্যান্য বাঘের মত ছিল না। ল্যাসিরই একটা বড় প্রতিকৃতি ছিল মাত্র।
আশেপাশে তাকিয়ে খুঁজলাম বিলাই মহাজনকে।
নিঃশ্বাস একটু স্বাভাবিক হয়ে আসার পরে হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার মুখ আর দু-হাত কেমন যেন জ্বালাপোড়া করছে।
উঠে বসে আলো জ্বালিয়ে নজর দিলাম হাতে। নখের আঁচড়ে ভরে আছে ওদুটো। লাফ দিয়ে নেমে বাথরুমের আয়নার সামনে দৌড়ে গেলাম। আমার মুখ, কান, ঘাড়ে, সব জায়গায় একই অবস্থা। লাল হয়ে ফুলে আছে আঁচড়ের কল্যাণে। একটা দানবের মত দেখাচ্ছে আমাকে।
“ল্যাসি!”
দুই মিনিট লাগলো ওকে খুঁজে বের করতে। লন্ড্রিরুমের কাপড়ের তলায় লুকিয়ে ছিল ব্যাটা। আমাকে দেখে কাপড়ের আরো গভীরে গিয়ে পালানোর চেষ্টা করতে লাগল, কিন্তু তার আগেই কলার ধরে টেনে উঠালাম ওকে।
মিয়াও।
“আমি পাগল? আমি পাগল?” বললাম, “তুই আমাকে খামচে শেষ করে ফেলেছিস! আর বলছিস আমি পাগল?”
মিয়াও।
“আমি আগে তোকে আক্রমন করেছিলাম? কি বলছিস এসব?”
মিয়াও।
“আমি মোটেও এটা বলিনি, ‘তোকে এখন খাব আমি’-এরপর তোর কানেও কামড় দেইনি!”
জবাবে আমাকে দেখাল ও। কানের কাছে শুকনো রক্ত।
এরপরেই সব মনে পড়ে গেল আমার।
দুঃস্বপ্নটা! কিভাবে দু-সপ্তাহ অনাহারে থাকার পরে বাঘটা, ওরফে বড় ল্যাসিকে খাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই আমি। ঝাঁপিয়ে পড়ি ওটার ওপর, একটা কামড়ও বসাই। কিন্তু আমাকে থাবা দিয়ে ফেলে দেয় ওটা, এরপর খেয়ে ফেলে।
“ওহ্ ঈশ্বর!”
আমি ওকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম, আসলে কি ঘটেছিল। ঘুমের ঘোরে ওসব করেছি আমি।
“আমি দুঃখিত, তোকে খাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম।”
আমাকে মাফ করে দিল ও। প্রতিদানস্বরূপ একটা স্লিম জিম বিফ জার্কির টুকরো দিলাম ওকে। বিশেষ বিশেষ দিনের জন্যে ভোলা থাকে লাগালাম
তিনটা সাতে নাস্তা করতে বসলাম।
এক মিনিট পরে দরজা খুলে ইনগ্রিড ঢুকল বাসার ভেতর। একটা জিন্স আর নীল রঙের ট্যাঙ্ক টপ পরনে। চুলগুলো পনি টেইল করে বাঁধা, কাজের সময়ের স্টাইল। একটা মাঝারি সাইজের কার্ডবোর্ডের বাক্স ধরে আছে দু হাতে। চোখদুটো স্বাভাবিকের তুলনায় ফুলে আছে।
লাফিয়ে উঠলাম। “কি হয়েছে? কোন সমস্যা?”
বাক্সটা টেবিলের ওপর রেখে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ও, নাক টেনে বলল, “মা স্ট্রোক করেছে।”
“কি বলল? কখন?”
“এই তো, একটু আগেই বাবার সাথে কথা হল আমার। এক গ্লাস পানি খাবার জন্যে উঠেছিল মা, এরপরেই বাবা জোরে একটা আওয়াজ শুনতে পায়।”
আমাকে দুই ইঞ্চি সরিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল ও কিছুক্ষণ, “তোমার মুখে আবার কি হয়েছে?”
“ল্যাসির সাথে লেগে গেছিল একটু।”
“কি নিয়ে?”
“ঐ, ওকে খেয়ে ফেলা আর আমার দুঃস্বপ্নটা নিয়ে। লম্বা কাহিনী,” ও ব্যাপারে আর কিছু না বলে জিজ্ঞেস করলাম, “এখন তোমার মা কোথায়?”
“আটলান্টার এক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে।”
“কি হয়েছে?” নীল রঙের একটা নাইট রোবের ফিতা বাঁধতে বাঁধতে নেমে এসে জিজ্ঞেস করলেন বাবা।
“ওর মা স্ট্রোক করেছে,” বললাম আমি।
“আহ্-হা, বেচারি,” তিনি বললেন।
ইনগ্রিড আমাকে ছেড়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরল।
“ঠিক হয়ে যাবে সব,” বাবা নরম সুরে বলতে লাগলেন, “আটলান্টায় দেশের সবচেয়ে ভালো ডাক্তাররা আছেন। তোমার মা’র ভালো যত্ন নেবেন ওনারা।”
ইনগ্রিডের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আমার দিকে মনোযোগ দিলেন এবার, “আর তোমার কি হয়েছে?”
“ল্যাসি আমার মুখটাকে নখ ধার করার জন্যে ব্যবহার করেছে।”
জোরে একটা শব্দ হল, এরপর মারডক লাফিয়ে নেমে আসল ওপর থেকে। এতক্ষণ ঘুমানোর পরে বেশ সজীব মনে হচ্ছে ওকে। ইনগ্রিডকে আমার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে দেখে ওর মুখটাও কালো হয়ে গেছে। যেন বলতে চাইছে, কি হয়েছে? সবাই এত দুঃখি কেন? কি কি…
দৌড়ে গিয়ে ইনগ্রিডের গায়ে মাথা ঘষতে লাগল ও। ইনগ্রিডও নিচু হয়ে বসে চোখের পানিগুলো চেটে পরিস্কার করতে দিল ওকে।
“থ্যাংকস মারডক,” হাসি আর কান্নার মাঝামাঝি অবস্থা থেকে বলল।
আমি একটা চেয়ার টেনে ওটায় বসিয়ে দিলাম ইনগ্রিডকে। ল্যাসি লাফ দিয়ে কোলে উঠে গেল ওর।
“তো, ডাক্তাররা কিছু বলেছেন?”
“বেশি কিছু না। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন তারা এখন। বাবা বলল মা’র অবস্থা নাকি এখনও আশঙ্কাজনক।
“হ্যান কিভাবে সামলাচ্ছে সব কিছু?” বাবা জিজ্ঞেস করলেন।
দু-মাস আগে থেকে নিয়মিত ফোনে যোগাযোগ করা শুরু করেন। ইনগ্রিড আর আমার বাবা। ব্যাপারটা একটু কেমন যেন ঠেকে আমার কাছে। আমার গার্লফ্রেন্ডের বাবার সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলেছেন বাবা, অথচ আমার একটা কথাও বলা হয়নি তার সাথে।
“ভালোই সামলাচ্ছেন আপাতত। আমার রিটা ফুপি পাশেই থাকেন। তিনিই শান্ত রেখেছেন তাকে।”
“তোমার ওখানে যাওয়া উচিত,” আমি বললাম।
“হ্যাঁ, যাব,” মাথা নেড়ে সায় দিল ও। এরপর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি যদি আমাকে এয়ারপোর্টে ড্রপ করে দিয়ে আসেন তাহলে সকাল পাঁচটার ফ্লাইটটা ধরার চেষ্টা করতাম আমি।”
“অবশ্যই, মা।”
“ওটা কিন্তু ডালাসের বাইরে,” ইনগ্রিড বলল। ওখানে পৌঁছাতে চল্লিশ মিনিটের মত লাগবে। চার মাইল দূরে অবস্থিত রিগান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তুলনায় প্রায় আধঘন্টা বেশি।
“কোন সমস্যা নেই,” বাবা মাথা নেড়ে বললেন। “আমাদের এখনই বেরিয়ে পড়া উচিত তাহলে।”
ঘড়ির দিকে তাকালাম। তিনটা তেইশ বাজছে।
বাবা ঘরে কাপড় বদলাতে গেলেন।
“কি একটা দিন!” বলল ইনগ্রিড। এরপর উঠে দাঁড়িয়ে আমার গালে আলতো করে একটা চুমু দিল।
আমাকে বলতে লাগল কিভাবে ওকে সব কেস থেকে সরিয়ে নিয়ে ৩৫ বছরের পুরনো অমীমাংসিত একটা কেসে লাগিয়ে দিয়েছেন ওর ক্যাপ্টেন। “আমাকে প্রায় পাঁচঘন্টা কাটাতে হয়েছে কাগজপত্র ঘাটতে আর বর্তমান কেসগুলো সম্পর্কে নতুন অফিসারদের বুঝিয়ে বলতে।”
“বিলি করতে পারত না ওটা?”
বিলি হচ্ছে ওর পার্টনার, অল্প বয়সি আন্তরিক একটা ছেলে। বেশ লাগে আমার ওকে।
“তোমাকে বলিনি আমি? বিলিকে দু’সপ্তাহের জন্যে সাসপেন্ড করা হয়েছে। এক সন্দেহভাজন আসামির মুখে ঘুষি মেরেছিল ও।”
“ঐ লোকটার নিশ্চয়ই পাওনা ছিল ওটা?”
“মেয়েটার।”
“একটা মেয়েকে ঘুষি মেরেছে ও?”
“হ্যাঁ। আর ওটা পাওনাই ছিল মেয়েটার। বিলির দু-পায়ে মাঝে জোরে লাথি কষিয়েছিল মেয়েটা। এরপর মুখে থুতু দিতে যাচ্ছিল। বিলি ঘুষি দেয়নি ওকে, কেবল সরিয়ে দিতে চেয়েছিল জোরে। ভুলে হাত লেগে গেছিল মুখে। কিন্তু মেয়েটা বলেছে, ওকে ঘুষি মেরেছে বিলি, দু-জন সাক্ষিও নাকি ছিল। তাই বিলিকে সাসপেন্ড করেছে অফিস থেকে।”
“ধুর।”
“আর আমাকে যেহেতু আগামি দু-সপ্তাহ পার্টনার ছাড়া কাজ করতে হবে তাই এই অমীমাংসিত কেসটা দিয়ে ফাঁসানোর জন্যে আমার চেয়ে ভালো কোন অফিসার নেই এমুহূর্তে অফিসে।”
“ঠিক আছে তাহলে, বাবা নেমে এসে বললেন, “যাওয়া যাক এখন।”
উঠে দাঁড়িয়ে ইনগ্রিডকে লম্বা একটা চুমু খেয়ে ওদের দুজনকে সামনের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম।
ঘড়ির দিকে তাকালাম। তিনটা ঊনত্রিশ।
মারডক আর ল্যাসি দু-জনেই আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
“মনে হচ্ছে, পুরো বাড়িটা কিছু সময়ের জন্যে আমাদের দখলে,” এই বলে ওদের দুজনকে তাড়া করা শুরু করলাম।
.
দুই মাস্তানের সাথে তিন মিনিট দৌড়াদৌড়ি করার পরে বাবার ঘরে চলে গেলাম। যেটা খুঁজছিলাম সেটা পেতে বেশি সময় লাগলো না। ওটা একটা খামে পুরে উঠোনের একটা ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রাখলাম। ইসাবেলকে মেসেজ দিয়ে কি কি করতে হবে বলে সাথে আরো যোগ করলাম, ওর যদি কষ্ট না হয় তাহলে যেন স্প্যাগেটি আর মিটবল রান্না করে আমাদের জন্যে।
তিনটা চল্লিশের সময় বেজমেন্টের সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে গেলাম। আগের অবস্থাতেই আছে জায়গাটা। আমার বাবার সর্বশেষ শখটা হচ্ছে ওনার আগের শখের জিনিসগুলোকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা। ওনার মতে, বেজমেন্ট সাজানো পরিকল্পনা। কিন্তু আশেপাশে পরিকল্পনার কোন ছাপ চোখে পড়ল না। শুধু একটা জিনিস থেকে অন্যটা যতদূরে সম্ভব সরিয়ে রাখা হয়েছে মাত্র।
ওগুলোর মাঝে দিয়ে হাঁটার একটা সরু পথ। জিনিসপত্র মাড়িয়ে খুব সাবধানে হাঁটতে লাগলাম ওখান দিয়ে।
শেষবার এখানে এসেছিলাম সাত মাস আগে। দু’জন লোক পিছু নিয়েছিল আমার, ওদের থেকে বাঁচার জন্যেই বাবার শরণাপন্ন হতে হয়েছিল। বাবার গাড়িটা ঢাকার মত একটা পর্দা দরকার ছিল আমার, একটা পেয়েছিলাম এখানে। আর ঐ নীল পর্দাটার নিচে ঢাকা ছিল দুটো বাক্স। এত সুন্দরভাবে গোছানো যে, আমার বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছিল, ওগুলো বাবার।
ওগুলো পরীক্ষা করে দেখার জন্যে বাবার বাসায় আসার পর থেকে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। গত দু-দিনে উনি যখন ঘুমাচ্ছিলেন তখন ভেবেছিলাম আসব, কিন্তু নিঃশব্দে কাজ সারতে পারব কিনা সন্দেহ ছিল সে ব্যাপারে। যেন এই কথা প্রমাণ করতেই আমার পায়ের গুঁতো লেগে একটা বাক্স পড়ে গেল বিকট শব্দ করে।
ওপরতলা থেকে মারডক ডেকে উঠল জোরে।
ওর ডাকাডাকি থামতে থামতে আমি বেজমেন্টের অন্যপাশে চলে আসলাম। নিচু হয়ে বসে খেয়াল করলাম আশেপাশের ধুলোবালির মধ্যে দুটো ফাঁকা জায়গা চকচক করছে।
বাক্সগুলো নেই।
.
বাকি সময়টুকু বেজমেন্টে বাক্স দুটোর খোঁজে কাটালাম, কিন্তু কোথাও পেলাম না ওগুলো।
তিনটা আটান্নর সময় হাতঘড়ির অ্যালার্মটা বেজে উঠল। কোনমতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এসে রান্নাঘর থেকে একটা এনার্জি বার নিয়ে দুই কামড়ে শেষ করে ফেললাম। এরপর দৌড়ে গিয়ে শুয়ে পড়লাম বিছানায়।
শেষ কয়েকটা সেকেন্ড বাক্সগুলো নিয়ে ভাবতে লাগলাম।
সরিয়ে ফেলা হয়েছে ওদুটো?
নাকি লুকিয়ে রাখা হয়েছে?
*
অধ্যায় ৩
“কি করছেন?” বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম।
অনেকগুলো কাগজপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রান্নাঘরের টেবিলটায় বসে আছেন তিনি।
“শুভ সকাল,” নাকের ওপর চশমাটা ঠিক করতে করতে বললেন তিনি, “ঘুম কেমন হল?”
“ভালোই,” সত্যি কথাটাই বললাম। দুঃস্বপ্ন দেখলেও ওটার কথা মনে পড়ছে না আজকে। আর ল্যাসির মতে আজ ওকে কামড় বসানোরও কোন চেষ্টা করিনি।
“গতকাল, এয়ারপোর্ট থেকে ফিরে তোমার গায়ে আরেকবার নিওম্পোরিন লাগিয়ে দিয়েছিলাম।
এজন্যেই খামচির দাগগুলো এত তাড়াতাড়ি চলে গেছে। বোঝাই যাচ্ছেনা কিছু।
“ধন্যবাদ।”
“গায়ে দাগ বসে গেলে ভালো দেখাত না।”
আমি হেসে জিজ্ঞেস করলাম, “কি করছেন আপনি? কোন ফাইনাল পরীক্ষা আছে নাকি সামনে?”
“ওহ্, এটা?” টেবিলের ওপর হাত ঘুরিয়ে বললেন তিনি, “এটা একটা কেসের কাগজপত্র, অমীমাংসিত। ইনগ্রিড এটা নিয়েই কাজ করছিলো এখন। কাল এয়ারপোর্টে যাবার পথে আমাকে যখন বলল তখন ওকে কথা দিয়েছিলাম যে ওর অবর্তমানে আমি একবার দেখব সবকিছু। যদি কিছু পাওয়া যায়?”
আমি মাথা নাড়লাম কেবল। বাবার নতুন শখ। অমীমাংসিত কেসের ডিটেক্টিভ।
“সবকিছু গুছিয়ে রেখেন আবার,” একটু থেমে বললাম, “আপনি তো মাঝে মাঝেই ভুলে যান ব্যাপারটা।”
গত দিনের বেজমেন্ট তল্লাশির কথা মনে হল এ সময়।
বাক্সগুলো নেই।
ভাবছিলাম বাবাকে জিজ্ঞেস করব ওগুলোর কথা, কিন্তু তার মাঝেই বলে উঠলেন, “ইসাবেল কিছু খাবার দিয়ে গেছে,” ফ্রিজের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন তিনি, “নিয়ে এখানে এসে বসো। এগুলোর ব্যাপারে কিছু কথা আছে।”
ঐ দুই সিআইএ এজেন্টের চোখে ধুলো দিতে সাহায্য করার পর থেকে তাকে এতটা উৎসাহি হতে দেখিনি কোন কাজে।
ফ্রিজ খুলে স্প্যাগেটিরর বাটিটা বের করে ওভেনে গরম করতে দিলাম।
ওটা গরম হতে হতে ইসাবেলকে ধন্যবাদ’ লিখে একটা মেসেজ পাঠালাম। আরো জানতে চাইলাম, অন্য কাজটা করতে পেরেছে কিনা।
সাথে সাথে সে জবাব দিল, করেছে কাজটা।
এরপর ইনগ্রিডের কয়েকটা মেসেজ পড়লাম আমি। আটলান্টায় পৌঁছেছে ও, কিন্তু ওর মার অবস্থা এখনও আশঙ্কাজনক। ওর বাবা সাহস হারিয়ে ফেলছেন। প্রচন্ড গরম ওখানে আর আমাকে মিস করছে
আমিও জবাব দিলাম মেসেজগুলোর আর বললাম কি ঘটছে জানাতে।
ল্যাসি আর মারডক খাবারের গন্ধে হাজির হল ওপর থেকে। ওদের দু জনকেও স্প্যাগেটি ভাগ করে দিলাম যার যার প্লেটে। ল্যাসি ওর অংশটুকু দেখে আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাল।
মিয়াও।
“তোকে কম দিয়েছি কেন? কারণ তোর আকার মারডক থেকে অনেক ছোট।”
মিয়াও।
“তুই আসলেই ছোট। কাঠবিড়ালির চেয়েও।”
মিয়াও।
“হ্যাঁ, আমার আঁচড়ের দাগগুলো কেবল শুকোতে শুরু করেছে। কি বলতে চাচ্ছিস?”
মিয়াও।
“না, ওরকম কিছু করবি না তুই।”
মিয়াও।
“প্রমিস?”
আমার একটা আঙুলের সাথে থাবা চুঁইয়ে প্রমিস করল ও। এরপর আমার প্লেট থেকে বেশ খানিকটা স্প্যাগেটি নিয়ে ওর প্লেটে তুলে দিলাম।
“আমি যদি জেগে উঠে একটা আঁচড়ের দাগও পাই শরীরে, তাহলে মেওয়েদারকে দিয়ে খাওয়াব তোকে,” মেওয়েদার হচ্ছে বড় একটা ব্যাকুন, যে প্রায়ই জ্বালায় ল্যাসিকে।
মিয়াও।
“চেষ্টা করে দেখিস কি হয়।”
বড় এক গ্লাস দুধ ঢেলে নিয়ে টেবিলে বাবার পাশে গিয়ে বসলাম।
তিনটা ছয় বাজছে ঘড়িতে।
“পাঁচ মিনিট আছে আপনার হাতে।”
হেসে শুরু করলেন তিনি।
.
জেনিফার নিউবার নিখোঁজ জানিয়ে তার বাবা ১৯৮৫ সালের ১১ই জানুয়ারি রিপোর্ট করেন পুলিশে। এর একদিন পরে একটা পার্কে মেয়েটার মৃতদেহ পাওয়া যায়। মাত্র ষোল বছর বয়স ছিল তার। ওয়াশিংটনের কলম্বিয়া হাইটসে থিওডোর রুজভেল্ট হাই স্কুলের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রি ছিল জেনিফার। তাকে শেষবার দেখা গেছিল জানুয়ারির ১০ তারিখে স্কুল থেকে বের হয়ে যেতে। প্রত্যক্ষদর্শীর নাম মেগান নিউবার। জেনিফারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং কাজিন।
মেয়েটার বাবা-মার কিছুদিন আগেই ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছিল, তাই সে এবং তার ভাই কিছু সময় মায়ের সাথে কাটাত আর কিছু সময় কাটাত বাবার সাথে। দুটো বাসা তিন মাইলেরও কম দূরত্বে হওয়াতে রবিবার থেকে বুধবার পর্যন্ত মা’র বাসায় এবং বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত বাবার ওখানে থাকতো ওরা দুজন।
জেনিফার যখন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরল না তখন তার মা ধারণা করেছিলেন সে হয়ত বাবার বাসায় চলে গেছে, যেটা প্রায়ই করত মেয়েটা। মহিলা একবার ফোন করে খোঁজও নেননি, তার মেয়ে ঠিক আছে কিনা।
এরও চব্বিশ ঘন্টা পরে নিখোঁজ হওয়ার রিপোর্টটা করে তার বাবা।
খুনের মোটিভ বের করতে তৎকালীন ডিটেক্টিভদের বেশি সময় লাগেনি। তার কাজিন, মেগানের মতে বিপজ্জনক একটা অভ্যাস ছিল জেনিফারের, যেটা করতে প্রায়ই নিষেধ করত সে।
শুরুটা অবশ্য হয়েছিল বিপদের সম্ভাবনা ছাড়াই। জেনিফার ছবি তুলতে খুব পছন্দ করত। একদিন ডাউনটাউন ওয়াশিংটনের রাস্তা দিয়ে হাটার সময় একটা ঝর্ণার ছবি তুলছিল সে-এটা ছিল তার খুবই পছন্দের একটি জায়গা। তো, সেই সময় এক ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলাকে চোখে পড়ে তার। আসলে তাদেরকে পরকিয়ারত অবস্থায় দেখে ফেলে সে। সেই যুগলকে প্রায় দু-মাইল অনুসরণ করে মেয়েটা। সাথে ক্রমাগত ছবি তুলতে থাকে। একটা মোটেলে প্রবেশের আর বের হবার অনেকগুলো ছবি তুলে ফেলে এভাবে। এর দু-দিন পর আগের জায়গায় গিয়ে ভদ্রলোকের অফিস থেকে বের হবার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে ধৈর্য ধরে। যখন লোকটা বের হয় তখন তার কাছে গিয়ে জেনিফার বলে, “আপনার বিয়ের আঙটিটা কিন্তু খুব সুন্দর।”
অন্যমনস্কভাবে মাথা নেড়ে লোকটা জবাব দেয়, “ধন্যবাদ।”
“একটা জিনিস না খেয়াল করে পারিনি। দু-দিন আগে আপনার সাথে যে ভদ্রমহিলা ছিলেন তার হাতে কিন্তু কোন বিয়ের আঙটি ছিল না।”
“কোন্ ভদ্রমহিলা?”
“ইনি,” এই বলে একটা ম্যানিলা খাম তার দিকে বাড়িয়ে ধরে সে।
ছবিগুলো কিছুক্ষণ দেখে লোকটা গম্ভীরভাবে বলে, “কি চাও তুমি?”
“দুইশ ডলার।”
এমন কোন বড় অঙ্কের টাকা ছিল না ওটা। আর লোকটাও বিন্দুমাত্র দেরি না করে মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে ফেলে।
“আমি কিভাবে নিশ্চিত হব, টাকার জন্যে তুমি আবার আসবে না?” টাকা দেয়ার আগে জিজ্ঞেস করে সে।
“আসবো না,” নির্লিপ্তভাবে উত্তর দেয় মেয়েটা। এরপর লোকটাকে ঐ অবস্থায় রেখে চলে আসে।
জেনিফারের এই ব্ল্যাকমেইলের অভ্যাসটা খুব তাড়াতাড়ি লাভজনক ব্যবসায় রূপ নেয়। সব সময় সুযোগের খোঁজে থাকতো সে। খুব সাধারণ কয়েকটা নিয়ম মেনে চলত এ কাজে-এক, অল্প পরিমাণে টাকা দাবি করা। দুই, একজনের কাছে দ্বিতীয়বার দাবি না করা। তিন, যদি কেউ টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায় তাহলে কোন ঝামেলা না করে পরবর্তি শিকারের খোঁজে লেগে পড়া।
মেগানের মতে একবছরে প্রায় চার হাজার ডলার কামাই করে জেনিফার।
“তোমার কি ভয়ডর বলতে কিছু নেই?” মেগান বেশ কয়েকবার বলেছিল তাকে।
প্রতিবারই সোনালি চুলের মেয়েটা জবাব দিত, “আমার মত ছোট্ট, নিষ্পাপ একটা মেয়ের কে ক্ষতি করবে?”
কিন্তু কেউ একজন ভালোমতই ক্ষতি করেছিল তার। মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা আছে, করোটির নিচে জোরে আঘাত করা হয়েছে।’
.
“সময় শেষ,” এই বলে হাত নেড়ে থামতে ইশারা করলাম।
বাবা ফাইলটা নিচে নামিয়ে রাখলেন। দাঁত বের হয়ে এসেছে তার খুশিতে। এতক্ষণ একটানা কথা বলার ফলস্বরূপ হাঁপাচ্ছেন কিছুটা।
“এই বাচ্চা মেয়েটার খুনের কেসে এত মজা পাচ্ছেন দেখে ভালো। লাগল।”
জবাবে মাথা নেড়ে হাসি থামানোর চেষ্টা করলেন তিনি।
“না, না,” বললেন আমাকে। “মেয়েটার সাথে যা ঘটেছে তা নিঃসন্দেহে খারাপ। কিন্তু এইটুকুন একটা মেয়ে, এত বড় বড় ব্যবসায়িদের ঘোল খাইয়েছে…তুমিই বলো, একটু তো মজা লাগবেই।”
“তা ঠিক, কিন্তু একারণেই মারা গেছে মেয়েটা।”
আমি জানি, তিনি মেয়েটার খুনিকে বের করতে হবে ভেবে খুশি হচ্ছেন। কিন্তু তার চেয়েও বেশি খুশি হচ্ছেন কাউবোর্ডের বাক্সটার ফাইলগুলোতে আরো কত রহস্য লুকোনো আছে সেটা ভেবে।
এই বাক্সটার কথা ভাবতে ভাবতে আমার গতরাতের ঘটনা মনে পড়ে গেল আবার।
“তো বাবা, আমি এখনও নিশ্চিত নই, পরের কথাগুলো কিভাবে বলব, “মনে আছে, আমার পেছনে লেগে থাকা দু’জন লোককে ঘোল খাইয়ে দেবার জন্যে এখানে এসেছিলাম আমি?”
“কি বলো? কেন মনে থাকবে না? আতশবাজিগুলো যেভাবে ফুটেছিল! আর মারডক তো সামনের বাম্পারে বসে ছিল। এখনও হাসি পায় আমার, এই বলে হাসতে হাসতে বলতে লাগলেন তিনি কিভাবে ভেসপায় চড়ে ঐ দু-জনকে সরিয়ে নিয়ে গেছিলেন এখান থেকে।
তার মাঝখানেই বললাম আমি, “হ্যাঁ। সেদিন গাড়িটা ঢাকার জন্যে যখন পর্দা খুঁজছিলাম তখন দুটো বাক্স চোখে পড়ে আমার।”
তিনি মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
“কালকে বেজমেন্টে গেছিলাম আপনার বেজমেন্ট সাজানো পরিকল্পনা কতদূর বাস্তবায়িত হয়েছে তা দেখার জন্যে। তখন কিন্তু বাক্সদুটো চোখে পড়েনি আমার।”
“বাক্স, বাক্স,” বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন তিনি। জোড়া কুঁচকে গেছে। “বাক্স…”
আমি চোখ সরু করে তার চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তার সাথে গত বিশ বছর ধরে পোকার খেলছি আমি, তাই সব জারিজুরি জানা আছে আমার। অপেক্ষায় থাকলাম, তিনি নাক চুলকাবেন একবার, টেবিলে আঙুলগুলো দিয়ে আস্তে আস্তে বাড়িও দেবেন।
কিন্তু কোনটাই করলেন না।
“হ্যাঁ, মনে পড়েছে,” জোরে বলে উঠলেন, “সরিয়ে ফেলেছি ওগুলো।”
“সরিয়ে ফেলেছেন?”
“হ্যাঁ, অসুবিধা হচ্ছিল ওগুলোর কারণে।”
জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম, কিসে অসুবিধা হচ্ছিল ওগুলো কারণে। গোটা বেজমেন্টে একমাত্র ওদুটোই গোছানো অবস্থায় রাখা ছিল।
তা করলাম না। কোথায়?” মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করলাম তাকে। “কোথায়?”
“কোথায় সরিয়েছেন?”
“ওহ্,” হেসে জবাব দিলেন তিনি, “বাগানের শেডে রেখে দিয়েছি ওগুলো।”
“শেডে?” একমাত্র ওখানটাই দেখা হয়নি।
“হ্যাঁ। তোমার মার অন্যান্য জিনিসগুলোর সাথে।”
*
অধ্যায় ৪
“কি?!” এত জোরে চিৎকার করে উঠলাম যে, মারডক পর্যন্ত ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগল।
“তোমার মার অন্য জিনিসগুলোর সাথে শেডে রেখে দিয়েছি বাক্সদুটো,” আবারো বললেন তিনি।
“প্রথমবারেই শুনেছিলাম। কিন্তু এতদিনে আমাকে একথা বলছেন কেন? আপনি জানেন, তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি আমি ঐ ব্ল্যাক সাইটগুলোর ঘটনাটার পর থেকে। কিভাবে আমাকে না জানিয়ে থাকতে পারলেন আপনি?”
“আমি আসলে ভাবিনি…”
“কি? আপনি ভাবেননি যে, মা’র জিনিসপত্র ভর্তি শেডের কথা আমার জানতে ইচ্ছে করবে? গত বছর যখন তার ব্যাপারে কথা বলতে এসেছিলাম তখনও তো এই শেডের ব্যাপারে কিছু বলেননি।”
উঠে দাঁড়ালেন তিনি টেবিল ছেড়ে, মুখটা লাল হয়ে গেছে।
“আমি চাইনি তুমি আবার ওগুলো নিয়ে ভাব। তোমার জীবনে এসবের পেছনে নষ্ট করার মত যথেষ্ট সময় নেই।”
“আমার সময় আমি কিভাবে নষ্ট করব সেটা তো আপনি ঠিক করে দিতে পারেন না। আমি যদি বাকিটা জীবন মা’র ওপর রাগ করে কাটাতে চাই, তাহলে সেটাও আমার ব্যাপার।”
লম্বা করে একটা শ্বাস নিলাম। ল্যাসি এসে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল।
মিয়াও।
এখন মজা করার মত মানসিক অবস্থা নেই আমার।
“আপনি কি জানেন ঐ মহিলাটা আমার সাথে কি করেছে? তার জন্যেই এই ফালতু কন্ডিশনটায় ভুগছি আমি। আমাকে গিনিপিগ বানিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছে সে।” রাগের চোটে কথা বলতে পারলাম না আর। “একটা ফ্ল্যাশলাইট এনে দিন আমাকে।” অবশেষে বললাম তাকে।
বাবার চোখ ভিজে গেছে দেখলাম। কিন্তু ওসবের পরোয়া করি না এখন।
“যান, একটা ফ্ল্যাশলাইট নিয়ে আসুন,” হুকুমের মত করেই বললাম।
মাথা ঝাঁকিয়ে ফ্ল্যাশলাইট খুঁজতে লাগলেন তিনি। তিন-চারটা ড্রয়ারে খোঁজার পর একটা থেকে ফ্ল্যাশলাইটটা বের করে আমার হাতে দিতে দিতে বললেন, “আমি শুধু-”
আমি মাথা নাড়াতেই চুপ করে গেলেন সাথে সাথে।
ল্যাসিকে তুলে নিয়ে ফ্ল্যাশলাইটটা জ্বালিয়ে পেছনের উঠোনে বেরিয়ে এলাম। ল্যাসি আমার ঘাড়ের কাছে গিয়ে কান চেটে দিতে থাকলো। কোন এক কারণে ব্যাপারটা কিছুটা হলেও শান্ত করল আমাকে। এখন আর মনে হচ্ছে না, মগজ বিস্ফোরিত হতে চলেছে। শেডটার কাছে পৌঁছে গেলাম। কোন তালা লাগানো নেই, দরজাটা খুলে ফেললাম অনায়াসে।
একটা ভ্যাপসা গন্ধ এসে লাগল নাকে। বাবা নিশ্চয়ই বেশ কয়েক সপ্তাহ আগে বাক্সদুটো সরিয়েছেন।
একবার কেশে উঠে দুই কদম সামনে এগোলাম। এরপর পনের ফুট বাই দশ ফুট বদ্ধ জায়গাটায় ফ্ল্যাশলাইটের আলো ফেলে দেখতে লাগলাম। একটা লন-মোয়ার আর বাগানের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি রাখা ভেতরে। বেশিরভাগই কাজ করে না এখন।
কিছু একটা নড়ার আওয়াজ পেলাম। শেডের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল ওটা।
মিয়াও।
“না, আমার মনে হয় না কোন বেজি আছে বাগানে।”
মিয়াও।
“র্যাকুনও না।”
ও যখন নিশ্চিত হল, ওর সবচেয়ে বড় দুই শত্রুর কেউ নেই তখন হাত থেকে নেমে তাড়া করতে বেরিয়ে গেল বাইরে। বাক্সদুটো চোখে পড়ল এই সময়। অন্য তিনটা বাক্সের পাশে গাদাগাদি করে রাখা।
আমার মা’র জিনিসপত্র।
এক নম্বর বাক্সের টেপ খুলে ফেললাম।
কাপড়-চোপড়।
আটটা সোয়েটার আর দুটো জ্যাকেট।
দুই নম্বর বাক্সেও একই ধরণের জিনিস।
কয়েকটা জিনস আর টপস।
আবার ভেতরে ভরে রাখলাম ওগুলো। এই জিনিসগুলো রেখে দেয়ার মানে কি? তিনি কি এখনও আশা করেন, তিরিশ বছর আগে তাকে ছেড়ে যাওয়া মহিলাটা আবার ফিরে আসবে?
তিন নম্বর বাক্সটা জুতোর। হিল, ফ্ল্যাট আর বুট। মোটমাট বারো জোড়া। একটা বাদামি রঙের বুট বের করলাম ওগুলোর ভেতর থেকে। শেষবার এটাই পরে থাকতে দেখেছিলাম তাকে। এটা পরেই আমাকে সাইকেল চালাতে শিখিয়েছিলেন।
জুতোগুলো বাক্সে ঢুকিয়ে রেখে পরবর্তি তুলনামূলক ছোট বাক্সগুলোর দিকে মনোযোগ দিলাম।
একটার ভেতরে দুটো বিশাল ব্যাগ ভর্তি টুটসি রোল ক্যান্ডি। ভেবেছিলাম ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় ওগুলোর গায়ে ছত্রাকের আবরণ দেখতে পাব। কিন্তু ঠিকঠাকই মনে হল। যে প্রিজারভেটিভই ব্যবহার করা হয়ে থাকুক না কেন, এখনও কাজ করছে।
এগুলো নিশ্চয়ই চলে যাবার আগের বছর হ্যালোউইনের জন্যে কিনেছিলেন তিনি। আমার বয়স ছিল তখন পাঁচ। মা’কে পাইনি সেবার, যদিও স্বাভাবিকই লেগেছিল ব্যাপারটা। কারণ ততদিনে তার দীর্ঘ সময়ের অনুপস্থিতির সাথে মানিয়ে নিয়েছি। মনে করার চেষ্টা করলাম সেবার হ্যালোউইনে কি সেজেছিলাম আমি।
একটা কঙ্কাল।
আমি ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় মুখে রঙ করে দিয়েছিলেন বাবা। আর একটা কালো রঙের ড্রেস পরিয়ে দিয়েছিলেন ঘুমাবার আগে। জেগে উঠেই রাস্তায় নেমে পড়ি আমি। বাবা আশেপাশের প্রতিবেশিদের টাকা দিয়ে জাগিয়ে রেখেছিলেন যাতে রাত তিনটার সময়ও আমি চকলেট নিতে যেতে পারি। অবশ্য বিনে পয়সায় সানন্দে কাজটা করতেও রাজি হয়েছিলেন অনেকে।
ঘাড় ঘুরিয়ে শেডের দরজাটা দিয়ে মূল বাড়ির দিকে তাকালাম। ঐ লোকটার সাথেই কিনা বেয়াদবের মত ওভাবে চিৎকার করলাম আমি?
ক্যান্ডিগুলো ভেতরে ঢুকিয়ে রেখে শেষ ছোট বাক্সটার দিকে হাত বাড়ালাম। নিশ্চয়ই আমার ইস্টারের ঝুড়িটা থাকবে এর ভেতর।
না।
আরো সোয়েটার।
“ধুর।”
ফোনের ঘড়িটা দেখলাম এসময়। তিনটা ছেচল্লিশ। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো অজান্তেই। পুরো দিনটাই নষ্ট।
একটা ছায়া নড়ে উঠল দরজার কাছ থেকে।
ল্যাসি।
মিয়াও।
“নাহ, কিছু জামা কাপড় আর তিরিশ বছরের পুরনো ক্যান্ডি ছাড়া কিছু নেই। তুই যাকে খুঁজছিলি পেয়েছিস?”
মিয়াও।
“কিন্তু তোর কাছে তো মেয়ে খরগোশদের ভালো লাগে বলেই জানতাম।”
মিয়াও।
“ওহ্, ওর বয়ফ্রেন্ড আছে।”
লাফ দিয়ে একটা বাক্সের ওপর উঠে গেল ও।
জুতো ভর্তি বাক্সটা। নামতে বললাম ওকে। নেমে গেল।
ইনগ্রিড যখন আমার বাসায় উঠে এসেছিল তখন ওর সবকিছু বাক্স থেকে বের করতে সাহায্য করেছিলাম আমি-যদিও মাত্র দশ মিনিটের জন্যে, তবুও, আর আমার দায়িত্ব ছিল ওর জুতোর বাক্সগুলো খোলা। অনেকগুলো জুতোর বাক্স। সবগুলো বুটের মধ্যে খবরের কাগজ ঠেসে রেখেছিল ও। পরে আমাকে বলেছে ওতে করে চামড়ার জুতোয় ভাঁজ পড়ে না।
একের পর এক বাক্সগুলো খুঁজে দেখার তাগিদে এটা আমার চোখ এড়িয়ে গেছিল যে, আমার মা’ও একই কাজ করেছেন।
বাক্সটা ঠিকমত খুলে মা’কে যে বুটজোড়ায় শেষবারের মত দেখেছিলাম সেটা বের করলাম। ওগুলোর ভেতরে হাত দিয়ে দলা পাকানো খবরের কাগজ পেলাম, বের করে আনলাম ওগুলো। অন্য তিন জোড়া বুটের ভেতর থেকেও দোমড়ানো খবরের কাগজগুলো বের করলাম। আমার সামনে কাগজের ছোটখাট একটা স্তূপ জমে গেল।
ওগুলোর ভাঁজ খুলে সমান করলাম। পাতাগুলো ওয়াশিংটন পোস্টের ১৯৮০ এবং ১৯৮৪ সালের দুটো পত্রিকার।
আমার মা চলে গেছেন ১৯৮৫ সালে।
তাহলে প্রায় পাঁচ বছরের পুরনো কাগজগুলো দিয়ে জুতো ভরে রেখেছেন কেন তিনি?
নিশ্চয়ই এগুলো যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন। কোন এক বিশেষ কারণে।
১৯৮০ সালের পত্রিকাটার সবগুলো পাতা খুঁজে বের করে শিরোনামগুলো পড়তে থাকলাম। একদম প্রথম পাতাটা খুঁজে পাওয়ার পর বুঝতে পারলাম কেন এটাকে রেখে দিয়েছিলেন তিনি। প্রধান শিরোনামে জায়গায় লেখা ‘সিআইএ’র গোপনীয় এমকে-আলট্রা (MK-Ultra) প্রজেক্টের গোমড় ফাঁস।”
ধুলোময় মেঝেতে বসেই লেখাটার ওপর নজর বোলাতে লাগলাম :
… প্রজেক্ট এমকে-আলট্রা হচ্ছে সিআইএ’র একটি গোপন প্রোগ্রাম যার লক্ষ্য বন্দিদের কাছ থেকে তথ্য আদায়ের জন্যে বিশেষ বিশেষ কৌশল উদ্ভাবন করা। তারা এমন অনেক পদ্ধতি প্রয়োগ করে যাতে করে একজন মানুষের স্বাভাবিক মানসিক অবস্থার তারতম্য ঘটে। মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের কাজ নিয়ন্ত্রনের জন্যে অনেক সময় কিছু ড্রাগ, যেমন এলএসডি ব্যবহার করা হয়। আবার স্লিপ অ্যামপ্লিফিকেশন, আইসোলেশন কিংবা মানসিক ও যৌন নির্যাতনের মত কৌশলাদি প্রয়োগ করা হয় বন্দিদের ওপর।
“সিপ অ্যামপ্লিফিকেশন,” আপনমনে বলতে লাগলাম।
মনে হচ্ছে মা’র হারানো বছরগুলোর খোঁজ পেয়ে গেছি আমি।
*
অধ্যায় ৫
পরদিন জেগে উঠে বাবার সাথে দেখা হল না। তার পরের দিনও না। ঐ দু’দিন প্রায় পুরোটা সময় কম্পিউটারের সামনে বসে কাটালাম ইন্টারনেটে প্রজেক্ট এমকে আলট্রা সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে।
আসলে এমকে আলট্রা প্রজেক্ট গড়ে উঠেছিল বেশ কয়েকটা অবৈধ সিআইএ প্রোগ্রামের সমন্বয়ে। সরাসরি মানুষের ওপর এক্সপেরিমেন্ট চালানো হত পোগ্রামগুলোতে, যার উদ্দেশ্য ছিল এমন ডাগ কিংবা পদ্ধতি আবিষ্কার করা যার সহায়তায় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা যায় একজনের ইচ্ছেশক্তিকে। এতে করে বন্দিদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় কম সময়ে আর কার্যকরভাবে স্বীকারোক্তি কিংবা তথ্য আদায় করা যাবে।
প্রজেক্টটা শুরু হয়েছিল পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে। অফিশিয়ালভাবে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয় ১৯৫৩ সালে। ১৯৬৪ সালে কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এক্সপেরিমেন্টের পরিমাণ কমিয়ে আনা হয় আর সরকারি নির্দেশ অনুযায়ি বন্ধ করে দেয়া হয় ১৯৭৩ সালে।
এমকে আলট্রার অতীত এবং তার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা বেশ কঠিন কাজ ছিল, কারণ এই সংক্রান্ত সকল ফাইল ধ্বংস করে ফেলা হয়। কিন্তু ১৯৫৫ সালের একটা ফাইল হঠাৎ ফাঁস হয়ে গেলে হৈচৈ পড়ে যায়। ওখানকার লেখাগুলো ছিল ভীতিকর। এমকে আলট্রার প্রোগ্রামের কিছু সাবজেক্ট এবং এক্সপেরিমেন্ট সম্পর্কে ধারণা দেয়া ছিল ওটাতে। আর লেখা ছিল ওগুলোর মাধ্যমে কি উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায় সিআইএ।
সাবপ্রজেক্ট ১৯-এমন রাসায়নিক আবিষ্কার করা যার সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে ভিক্টিমের বয়স বেড়ে যাওয়ার গতি। ক্ষেত্র বিশেষে কমিয়েও দেয়া যাবে।
সাবজেক্ট ২৭-এমন রাসায়নিক উদ্ভাবন করা যা ভিক্টিমের মস্তিষ্কে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে এবং স্মৃতি মুছে দেবে।
সাবজেক্ট ৩৪-এমন রাসায়নিক উদ্ভাবন করা যা একজনের টর্চার সহ্য করার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেবে এবং মগজ ধোলাইয়ের হাত থেকে বাঁচাবে।
সাবজেক্ট ৩৯-এমন রাসায়নিক আবিষ্কার যা প্রয়োগের সময়কালীন তৈরি হবে অ্যামনেশিয়া।
সাবজেক্ট ৪৯-এমন রাসায়নিক আবিষ্কার করা যা প্রয়োগে দেহের বিভিন্ন জায়গায় ফোস্কার মত আস্তরণের সৃষ্টি হবে।
সাবজেক্ট ৫৩-এমন রাসায়নিক উদ্ভাবন করা যা প্রয়োগে ভিক্টিম জিজ্ঞাসাবাদের সময় বিভ্রান্ত বোধ করতে থাকবে এবং আপনা আপনি তথ্য বলতে থাকবে।
যেহেতু এসব প্রজেক্ট ১৯৭৩ সালে বন্ধ করে দেয়া হয় সুতরাং আমি এসবের কোনটার অংশ ছিলাম না। আর মা-ও এসবের কোনটাতে অংশগ্রহণ করেননি।
দু-দিনের গবেষণার পরে একটা সম্ভাব্য দৃশ্যপট দাঁড় করিয়েছি আমি।
১৯৭০-এ মা সিআইএ’তে যোগদান করেন। প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময়টাতে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি।
১৯৭৩ সালে প্রজেক্ট এমকে আলট্রা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ওটার ধ্বংসাবশেষ থেকে একটা প্রোগ্রাম ধীরে ধীরে সবার চোখের আড়ালে বেড়ে উঠতে থাকে। তিন বছরের বিশেষ প্রশিক্ষণ এবং রসায়ন ও সাইকোলজি বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশনের ফলে সেই প্রোগ্রামের জন্যে একদম সঠিক একজন ক্যান্ডিডেট ছিলেন আমার মা। এভাবেই জন্ম নেয় স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম।
এটাই মা’র ফাইলে ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৮১ সালের মধ্যবর্তি অজ্ঞাত আট বছরের যুক্তিযুক্ত ব্যাখা।
এই সময়টাতে তিনি জিজ্ঞাসাবাদ বিশেষজ্ঞ এবং গোপন স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের প্রধান হিসেবে দ্বৈত দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। আমার জন্ম। এর মাঝামাঝি সময়ে এবং আমাকেও তিনি এক্সপেরিমেন্টের কাজে ব্যবহার করেন। যার ফলে এই অদ্ভুত কন্ডিশন নিয়ে জন্ম হয় আমার।
১৯৮৫ সালে কিছু একটা ঘটায় এখান থেকে চলে যান তিনি। তারপর দু-মাস পর পাড়ি জমান হন্ডুরাসে।
কি হয়েছিল ১৯৮৫ সালে? কেউ না কেউ তো জানেই।
কিন্তু সিআইএ’র বর্তমান পরিচালকের কথা যদি বিশ্বাস করতে হয়, তাহলে স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম সম্পর্কে তার প্রতিষ্ঠানের কেউ কিছু জানে না। অবিশ্বাসের কোন কারণ নেই, কারণ বহু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তাকে নিয়োগ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট সুলিভান।
আর এমকে আলট্রা সম্পর্কেও খুব বেশি কিছু বিস্তারিতভাবে জানা যায়নি। ১৪৯টা সাবজেক্ট ছিল এই প্রোগ্রামের অন্তর্ভুক্ত। ওগুলো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রাইভেট রিসার্চ ল্যাবে পরিচালনা করা হয়। একটা পরিসংখ্যান মোতাবেক ৮০টি প্রতিষ্ঠান এবং ১৮৫ জন গবেষক অংশ নেয় এইসব সাবজেক্টে, যার মধ্যে দুটো নাম বারবার উঠে এসেছে।
অ্যালেন জনসন এবং সিডনি ওয়েন।
অ্যালেন জনসন ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত সিআইএ’র পরিচালক ছিলেন এবং কাজ করেছেন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার ও প্রেসিডেন্ট কেনেডির অধীনে। সিআইএ তার নেতৃত্বাধীন থাকাকালীন সময়েই চালু হয় প্রজেক্ট এমকে আলট্রা। এই প্রজেক্টের স্পন্সর হিসেবে কাজ করে সিআইএ’র টেকনিক্যাল সার্ভিসেস স্টাফের সদস্যবৃন্দ।
জনসন এই প্রজেক্টের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত করেন সিডনি ওয়েন নামের এক অফিসারকে। ওয়েনের জন্ম ১৯২৬ সালে ব্রনক্সের এক অভিবাসি হাঙ্গেরিয়ান ইহুদি পরিবারে। ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি থেকে ১৯৫১ সালে রসায়নে পিএইচডি সম্পন্ন করেন তিনি। বিষের ওপর বিশেষ পারদর্শিতার কারণে টেকনিক্যাল সার্ভিস স্টাফের রসায়ন বিভাগে ‘জাদুকর’ নাম ছড়িয়ে পড়ে তার।
১৯৫৩ সালে সিআইএ পরিচালক জনসন তাকে প্রজেক্ট এমকে আলট্রার প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। এরপরের বিশ বছরে তার অধীনে প্রায় ১৫০ এক্সপেরিমেন্ট পরিচালনা করা হয়। তার অধীনেই বিভিন্ন অবৈধ এবং ন্যাক্কারজনক কাজ চলতে থাকে এই প্রোগ্রামগুলোতে। বেশ কয়েকটি এক্সপেরিমেন্টে আমেরিকান এবং কানাডিয়ান নাগরিকদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করা হয় যার ফলে তাদের অনেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল বিভিন্ন সময়ে ওয়েনের নামে বিভিন্ন মামলা হলেও কোনটাতেই শেষ পর্যন্ত দোষি সাব্যস্ত করা যায়নি তাকে।
১৯৭২ সালে সিআইএ থেকে অবসর গ্রহণ করেন তিনি। সেই সাথে বলেন যে, তার কাজের ফলাফল তখন পর্যন্ত পুরোপুরিভাবে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।
আমি নিশ্চিতম এই দু-জন লোক অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে। অ্যালেন জনসন মারা যান ১৯৮৯ সালে। কিন্তু যা কিছু পড়েছি এই দু-দিনে সেগুলো মোতাবেক এখনও বেঁচে আছেন সিডনি ওয়েন।
.
সিডনি ওয়েনের সাথে যোগাযোগ করার কোন উপায় আছে কিনা খোঁজ করতে লাগলাম, কিন্তু পেলাম না। সন্দেহ নেই লোকচক্ষুর আড়ালেই থাকতে চাইবেন তিনি এতগুলো মানুষের জীবন নিয়ে খেলার পর। কেউ হয়ত প্রতিশোধ নিতে চাইতে পারে কিংবা ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে।
আমার মত কেউ।
অনলাইনে যেসব আর্টিকেল পড়েছি ওগুলোর মধ্যে অনেকগুলোতেই ওয়েনকে ডক্টর জোসেফ মেনগেলের সাথে তুলনা করা হয়েছে। মেনগেলকে দায়ি করা হয় ইহুদিদের ওপর ঘৃণ্য সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর জন্য। কিন্তু এখানে বড় একটা অসঙ্গতি থেকে যাচ্ছে, কারণ ওয়েন নিজেই একজন ইহুদি।
তিনি হয়ত মেনগেলের তুলনায় কম অপরাধ করেছেন, কিন্তু করেছেন যে, সে-ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। একজন মানুষরূপি দানবে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। আর তৈরি করেছিলেন তার চেয়েও নিষ্ঠুর আরেক দানবের।
আমার মা।
ল্যাপটপের কোণার দিকের ঘড়িতে তাকালাম।
তিনটা ছাপ্পান্ন।
ইমেইল অ্যাকাউন্ট খুলে অ্যাডভান্সড সার্ভেইলেন্স অ্যান্ড ট্র্যাকিং-এর মাইক ল্যাংয়ের কাছে একটা ইমেইল লিখলাম সিডনি ওয়েন সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়ার জন্যে। কিন্তু না পাঠিয়ে ডিলিট করে দিলাম মেইলটা। কারণ এখনও বাবা সম্পর্কে কিছু জানায়নি ওরা।
বাবা!
সিডনি ওয়েনের বয়স এখন ৮৯ এবং একথা আমি হলফ করে বলতে পারি, বাবার মতই একঘেয়ে তার জীবন। বাবার হয়ত অদ্ভুত অদ্ভুত কিছু শখ আছে, কিন্তু যখন তিনি ওসবে ব্যস্ত থাকেন না তখন তার হাতে একটা কাজই থাকে। ইন্টারনেটে নিত্যনতুন ওয়েবসাইট ব্রাউজ করা। বেশিরভাগ সময়ই ফেসবুকে কাটান তিনি। একটু পরপরই মারডকের অদ্ভুত অদ্ভুত সব ছবি পোস্ট করেন। আর না-হলে নতুন আরেকটা পছন্দের কাজ আছে তার, ডাবস্ম্যাশ।
ওটা সম্পর্কে কিছু বলার মত রুচিও আমার নেই। আমি আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ঢুকে সিডনি ওয়েন লিখে সার্চ দিলাম। সাতটা রেজাল্ট এলো। এর মধ্যে চতুর্থজন হচ্ছে কমলা রঙের একটা বিড়াল কোলে নিয়ে বসে থাকা বেশ বয়স্ক এক লোক।
পেয়ে গেছি!
দ্রুত একটা মেসেজ লিখে তাড়াতাড়ি শোবার ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম আমি।