২. অজয় নদের ব্রিজের ওপর

বর্ধমান জেলা শেষ, অজয় নদের ব্রিজের ওপর দিয়ে গাড়ি যাবার সময়, গতি অনেক কমে গেল। উদিত দেখল, অজয়ের চেহারা ভয়াল। কে যেন বলে উঠল, উরে বাবা রে বাবা, অজয়ের মুত্তি দেখ্যা মনে লেয় কী, ই বারে আমাদের বীরভূমটা গোটা ভাইসবে।

অজয়ের চেহারা দেখে, কথাটা মিথ্যা মনে হয় না। মনে হচ্ছে যেন, লাল রক্তের ধারা হা হা করে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। গঙ্গা আর পদ্মার অবস্থা কী হয়ে উঠেছে কে জানে। উদিত ঠিক করেছিল বোলপুরে দুপুরের খাবারের অর্ডার দেবে। কিন্তু তার আগেই, রায় পরিবারের বিশাল, লুচি তরকারি আর মিষ্টির পাহাড় বেরোল, এবং এ ক্ষেত্রে যা হয়, উদিতকে সাগ্রহে তাদের সঙ্গে খেতে বলা হল। উদিত নানাভাবে আপত্তি জানাল। সে বোলপুর থেকে ক্যাটারিং-এর ভাত নেবে, কোনও অসুবিধা নেই।

তার অসুবিধা না থাকতে পারে, রায় পরিবারের সহৃদয়তা এবং আগ্রহের পক্ষে অসুবিধা। কৃষ্ণা মীনা খাবার বেড়ে দেবার ব্যবস্থা করল। মীনা প্রথমেই অতিথির হাতে কলাপাতায় খাবার তুলে দিয়ে বলল, আপনি বেশ স্বার্থপর লোক। আমরা খাব লুচি, আর আপনি খাবেন দুপুরে গরম গরম ভাত, আমাদের নজর লাগবে না?

মীনার কথায় সবাই হেসে উঠল। রায়মশাই বললেন, তুই বড় মুখফোড় মীনা।

 উদিতকে বললেন, কিছু মনে করো না উদিত।

উদিত হেসে বলল, না না মনে করবার কী আছে। ওঁকে আমি আগেই চিনে নিয়েছি।

উদিতের কথায় সবাই আর একবার হেসে উঠল। কৃষ্ণার হাসি এবার জোরে বেজে উঠল। স্বয়ং রায়মশাইয়ের হাসিটিও বেশ চড়া। বললেন, চিনে নিয়েছ তো। তা হলেই হল। তোমাকে বলব কী, মীনা আপন পর সকলের পেছনে তো লাগেই। আমার পেছনে লাগতেও কসুর করে না।

মীনা ওর বাবার দিকে তাকিয়ে, চোখ বড় করে বলল, আমি আপনার পেছনেও লাগি, এ কথা বলতে পারলেন?

রায়মশাই হেসে বললেন, কেন বলতে পারব না বল। তুই তো কথায় কথায় আমার পেছনে লাগিস। এই আজকে বেরোবার জন্য তুই আমার পেছনে কম লেগেছিলি?

মীনার সঙ্গে আর একবার চোখাচোখি হতে, মীনার মুখে আবার রং লাগল। উদিত মনে মনে বলল, মেয়েটা পাজি আর ভাল, দুই-ই।…

বীরভূম অতিক্রম করার আগেই, দু-তিনবার গাড়ি দাঁড়াল। এক-এক জায়গা দিয়ে, গাড়ি অত্যন্ত মন্থরভাবে চলল। সে সব জায়গায় জল প্রায় রেললাইন ছুঁই ছুঁই করছে। অনুমান করতে অসুবিধা হয় না, বীরভূমের কোথাও কোথাও, ইতিমধ্যেই বন্যায় ভেসে গিয়েছে। অবস্থা মোটেই ভাল নয়। আকাশ মেঘলা। মাঝে মাঝে বৃষ্টি, মাঝে মাঝে বন্ধ। কিন্তু আবহাওয়া পুরোপুরি মেঘলা এবং বৃষ্টির।

বীরভূম ছাড়িয়ে যাবার পরে, প্রথম দুঃসংবাদ শোনা গেল, পাকুড় আর ধুলিয়ানের রাস্তা, অনেকখানি গতকালই নাকি ডুবে গিয়েছে, এবং যেটা একেবারেই আশা করা যায়নি, রাজমহলের পরে লাইন নাকি ডুবে গিয়েছে। সাধারণত এ কথা কখনও শোনা যায়নি, এই অঞ্চলে বন্যার বিস্তার এতটা হতে পারে। ধুলিয়ানের রাস্তা ডুবতে পারে, গঙ্গা খুব কাছেই, কিন্তু পাকুড়ের পরে রাস্তা রেললাইন ডুবে যাওয়াটা সাংঘাতিক ব্যাপার।

রায়মশাই বললেন, তাই যদি হয়, তবে আমি তো মনে করি, শরিগলি ঘাট অবধি যাওয়াই হবে না। আর যদিও যাওয়া হয়, সেখানে গঙ্গার পাড়ে আটকে যাওয়া, আরও ভয়ের। জল কখন কতটা বাড়বে, কে জানে।

কামরার মধ্যে অধিকাংশ মানুষের একই দুশ্চিন্তা। মীনার মতো মেয়েও, রীতিমতো উৎকণ্ঠিত। উদিত চিন্তিত। তবে একটাই ভরসা, গাড়িতে এত লোক। একলার জন্য চিন্তা করেই বা কী লাভ। কত দূর যাওয়া যায়, দেখা যাক।

পাকুড় থেকে নতুন যাত্রী প্রায় উঠলই না। বরং স্টেশনে কিছু বন্যার্তদের দেখা পাওয়া গেল, যারা এসে স্টেশনে আশ্রয় নিয়েছে।

হাড়োয়ায় কয়েকজন যাত্রী যারা উঠল, তাদের মুখে শোনা গেল, গঙ্গার ওপারে, পূর্ণিয়া ভাগলপুরের অনেক জায়গা ভেসে গিয়েছে। মহানন্দার অবস্থা খারাপ, কিষাণগঞ্জের অনেক আগেই রেললাইন নাকি ডুবে গিয়েছে। এমনকী, শোনা গেল, কাটিহার বারসই-এর মাঝখানে, কিছু রেললাইন নাকি জলমগ্ন। আর এবারের খবরও আগের মতোই, রাজমহলের কাছেই রেললাইনে জল উঠেছে। তার মানে একটাই, গাড়ি আর তার বেশি যেতে পারছে না।

উদিত একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে চাইল, তিনপাহাড় থেকে মালদহে যাবার ফেরি লঞ্চ এখনও চালু আছে কি না। জানতে পারল, এখনও আছে। ওপারে মালদহ জেলার মানিকচক সড়ক যদি ডুবে যায়, তা হলে আপনা থেকেই ফেরি বন্ধ হয়ে যাবে। মানিকচক সড়কের অবস্থাও নাকি খুব ভাল না। যে কোনও মুহূর্তেই ডুবে যেতে পারে। কালিয়াচকের সড়ক ইতিমধ্যেই ডুবে গিয়েছে।

উদিত ভাবতে আরম্ভ করল। এদিকে যদি আটকে যেতেই হয়, তবে গঙ্গা পেরিয়ে মানিকচক হয়ে, মালদহ পশ্চিম দিনাজপুর, কিংবা পশ্চিম দিনাজপুর দিয়ে না গিয়ে যদি পূর্ণিয়ার সড়ক দিয়ে শিলিগুড়ি পর্যন্ত যাওয়া যেতে পারে। অবিশ্যিই, যদি সড়কগুলোর অবস্থা ভাল থাকে।

.

রাজমহলে এসে স্পষ্টই বোঝা গেল, গাড়ির পক্ষে এই মুহূর্তে আর বেশি দূর যাওয়া চলবে না। আকাশ মেঘলা বটে, বৃষ্টি নেই। একটা ঝোড়ো ভাবের বাতাস আছে। আকাশের চেহারা দেখে মনে হয়, হঠাৎ বৃষ্টি আসবে না। উদিত ওর প্রস্তাবটা রায়মশাইকে জানাল। এখানেই আটকা পড়ে থাকার চেয়ে, ফেরি পেরোবার ঝুঁকি নিয়ে যদি মালদহ হয়ে যাওয়া যায়।

রায়মশাই একটু চিন্তা করলেন। তাঁর উত্তর শোনবার জন্য, পরিবারের সকলেই উৎকণ্ঠিত উৎসুক চোখে চেয়ে রইল। উদিত আবার বলল, অবিশ্যি যদি মালদহের যাত্রীরা যায়, তা হলেই আমরা যাব, তা না হলে যাব না।

রায়মশাইয়ের চোখ একটু উজ্জ্বল হল। বললেন, তাই যদি যাই, তবে মালদহে ইংরেজবাজারে আমাদের আত্মীয় আছে, তাঁদের বাড়িতেই কয়েক দিন থেকে যাব।

উদিত গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। খবর নিয়ে জানল, একটা গাড়ি তিনপাহাড়ের দিকে এখনই যাবে। কিছু মালদহগামী লোকজনের সঙ্গে ও কথা বলল। যাত্রীর সংখ্যা খুব কম না। এদের মধ্যে অনেকেই অবিশ্যি গঙ্গা পার হতে ভয় পাচ্ছে। কিন্তু পথের মাঝখানে অনিশ্চিত অবস্থায় কেউ বসে থাকতেও চাইছে না।

রায়মশাই গোটা পরিবার নিয়ে গাড়ি বদলালেন। উদিতের সাহায্য ছাড়াও, কুলিরা যতটা পারল, টাকা আদায় করল। কোনও উপায়ও নেই। তিনপাহাড়ে এসে, গঙ্গার অবস্থা দেখে সত্যি ভয় লাগে। ফেরির লঞ্চ প্রস্তুতই ছিল। লঞ্চে ওঠবার সময়ে উদিত প্রথম লক্ষ করল, হাওড়া স্টেশনে দেখা সেই মেয়েটিকে, স্টল থেকে যে অনেক টাকার কাগজ কিনেছিল।

মেয়েটি তা হলে মালদহের যাত্রী। হাতে একটি বড় ব্যাগ, কাঁধে রংচঙে বর্ষাতি, আর এক হাতে সেই কাগজগুলো। এখন আর তাকে অতটা তাজা দেখাচ্ছে না। ইতিমধ্যেই, চুল রুক্ষু হয়ে উঠেছে, মুখে উদ্বেগের ছাপ পড়েছে। একটা ব্যাপার লক্ষ করা গেল, মেয়েটি ফাস্টক্লাসের যাত্রী হলেও, রায় পরিবারের কৃষ্ণা মীনার কাছ ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকতে চাইছে।

উদিত ভাবল, ও না হয় পুরুষমানুষ, বন্যা পরিস্থিতির কথা কিছু চিন্তা না করেই বেরিয়ে পড়েছে। রায়মশাইয়ের না হয় কন্যাদায়ের দুশ্চিন্তা, তাই এই ঝুঁকি নিয়ে বেরিয়ে এখন পস্তাচ্ছেন। কিন্তু এরকম একলা একটি মেয়ে, এবং বেশ অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে বলেই মনে হয়, বয়সটাও মোটেই বেশি না, এমন দিনে বেরোল কী করে! উদিত ভেবেছিল, শান্তিনিকেতনে বা কাছাকাছি কোথাও যাবে। ফার্স্টক্লাসের টিকেট কেটে এ যাত্রিণী যে এত দূরের পথে পাড়ি দিচ্ছে, ও এক বারও বুঝতে পারেনি।

লঞ্চেই এক সময়ে উদিত দেখল, সেই মেয়েটি কৃষ্ণা মীনার সঙ্গে কথা বলছে। উদিত দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল, যদিও মীনা ওকে ঠিক চোখে রেখেছিল।

কিন্তু উদিতের দৃষ্টি নদীর দিকেই বেশি। রক্তাভ গঙ্গা যেন একটা রক্তাক্ত সমুদ্র হয়ে উঠেছে। কোথাও তার পারাপার দেখা যায় না। রেলিং-এর কাছে গিয়ে দাঁড়াতে ভয় লাগে। লঞ্চের কর্মচারীদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারল মানিকচকের রাস্তায় নাকি ইতিমধ্যেই জল উঠে পড়েছে। তবে, এখনও সেরকম খারাপ অবস্থা না। মোটর গাড়ি এখনও চলছে। তবে রাত্রের মধ্যে কী হবে, কিছুই বলা যায় না। এবং এও জানাল, আপাতত এটাই লঞ্চের শেষ ফেরি। অবস্থা ভাল না হলে, লঞ্চ আর যাতায়াত করবে না।

কিন্তু প্রায় সন্ধের মুখে, মানিকচকে পৌঁছে দেখা গেল, রাস্তায় জল আরও বেশি উঠে গিয়েছে। মোটর বাস নেই, কোনও গাড়িই কোথাও নেই। জল প্রায় হাঁটুর কাছে। রাস্তার আশেপাশের অধিবাসীরা দুপুর থেকেই, নিরাপদ জায়গার দিকে রওনা হয়ে গিয়েছে। মোটর বাসের না আসার কারণ হিসাবে শোনা গেল, আটগমের কাছে কালিন্দীর জল রাস্তায় এসে পড়েছে। মোটর বাস সেখান থেকেই ফিরে গিয়েছে।

কিন্তু মানিকচকে আটকে পড়াটা আরও বিপজ্জনক। যে কোনও মুহূর্তেই জীবননাশের সম্ভাবনা। অধিকাংশ লোকই, উত্তরে মথুরাপুর বা দক্ষিণে নুরপুরের দিকে হাঁটা ধরল। একসময়ে উদিতের মনে হল, রায় পরিবার, ও নিজে আর সেই মেয়েটি ছাড়া, অধিকাংশই চলতে আরম্ভ করেছে। রায়মশাইয়ের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। কারোর মুখের দিকেই প্রায় তাকানো যাচ্ছে না। রায়মশাইয়ের ছোট ছেলে আর মেয়ে, দুজনে তো কান্নাকাটিই শুরু করে দিয়েছে। এখন উদিতের নিজেকেই কেমন যেন অপরাধী বলে মনে হচ্ছে। ও রায়মশাইকে বলল, আমিই বোধ হয় আপনাদের আরও বিপদে ফেললাম।

রায়মশাই বললেন, তুমি আর কী বিপদে ফেলবে বাবা? যাঁর ফেলবার, তিনিই ফেলেছেন। তুমি নিজেও তো আর নিরাপদে নেই। এখন কী করা যায়, তাই ভালো। এভাবে তো দাঁড়িয়ে থাকা যায় না।

সবাই একসঙ্গে, উদিতের মুখের দিকে তাকাল। যেন ও ঠিক এই বিপদে রক্ষা করতে পারবে। লজ্জিত আর বিব্রত হয়ে উঠল ও। এমনকী হাওড়া স্টেশনে দেখা সেই মেয়েটিও, উদিতের মুখের দিকে তাকাল। সমস্ত জায়গাটাকে একটা সাক্ষাৎ নরকের মতো মনে হচ্ছে। ক্রমে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। আশেপাশে, জল ঠেলে ঠেলে, দু-একজন লোক যাতায়াত করছে। ভাগ্য একটু প্রসন্ন বলতে হবে, বৃষ্টি হচ্ছে না। তা হলে আর দেখতে হত না।

ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখানে জল নেই। কয়েক পা সামনেই জল। রাস্তার খানিকটা হেঁটে গেলে, সামনে আবার রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে, যেখানে জল নেই। সেখানে আরও দু-একজন লোক দেখা যাচ্ছে, অস্পষ্ট ছায়া ছায়া। উদিত বলল, চলুন, আমরা সবাই ওখানে যাই। আরও দু-একজন রয়েছে, বোধ হয় নৌকার ব্যবস্থা হচ্ছে।

নৌকার নামে, সকলেই যেন একটু আশার আলো দেখতে পেল। কিন্তু এত মালপত্র নিয়ে চলাফেরাই দুষ্কর। মালপত্র যা কিছু সবই রায় পরিবারের। রায়মশাই বললেন, আমি মালপত্র নিয়ে এখানে থাকি, তুমি এদের নিয়ে ওখানে গিয়ে দ্যাখ, ব্যাপারটা কী। মনে হচ্ছে ওখানে রাস্তার ধারে এখনও কিছু বাড়িঘর বেঁচে আছে। লোকজন পাওয়া যায় কি না দেখো।

উদিতের সেটা মন্দ মনে হল না। এই সময়ে, জলে পা দেবার আগেই, একটা গলা ভেসে এল, মিহির, মিহির এলি নাকি?

সকলেই তাকিয়ে দেখল, একজন রাস্তা দিয়ে এদিকে এগিয়ে আসছে। উদিতের দিকে তাকিয়েই লোকটা মিহির মিহির বলে ডাকছে। উদিতের ভুরু কুঁচকে উঠল। গলাটা যেন কেমন চেনা চেনা লাগছে। শিলিগুড়ির নারায়ণের মতো লাগছে। কিন্তু সেটা তো বিশ্বাস করাই কঠিন, নারায়ণ আসবে মানিকচকে। মিহির নামটাও সে হিসাবে চেনা চেনা লাগছে। যদি লোকটা সত্যিই শিলিগুড়ির নারায়ণ হয়, তা হলে মিহিরও চেনা। যদিও মিহির বলে এ দলে কেউ নেই।

মীনা বলল, দাঁড়ালেন কেন, চলুন।

উদিত বলল, দাঁড়ান, লোকটিকে আমার চেনা চেনা লাগছে। আর একটু কাছে আসুক, দেখে নিই। লোকটি জল ভেঙে আর একটু কাছে আসতে, উদিতের আর কোনও সন্দেহ রইল না। সে বলে উঠল, নারাণ নাকি রে?

আগন্তুকও অবাক হয়ে বলল, একী উদিত, তুই এখানে?

উদিত বলল, আর বলিসনে, গঙ্গা ওদিকে মারমুখী, দেখছি এদিকেও মারমুখী। ভেবেছিলাম, এদিক দিয়ে বাইরোড যাবার চেষ্টা করব। কিন্তু তুই এখানে কী করছিস?

নারায়ণ ততক্ষণ কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। বয়স উদিতের মতোই হবে। তবে ঘাড়ে গর্দানে মোটা বলে, তাকে একটু বেশি বয়স্ক লাগছে। নারায়ণ বুঝতে পারছে না, উদিতের সঙ্গে এরা কারা। তাকে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। উৎকণ্ঠিত স্বরে বলল, আর বলিস না মিহির আমাকে ডুবিয়েছে!

মিহির মানে, তোদের ড্রাইভার তো?

হ্যাঁ। এসেছিলাম ইংলিশবাজারে একটা কাজে। সঙ্গে একটা মাঝারি ট্রাক রয়েছে, কিছু মালপত্র নিয়ে এসেছিলাম। সে সব খালাস হয়ে গেছে। বন্যার কথা শুনে মিহির বলল, মানিকচক থেকে এক বার ওপারে যাবে, কোথায় কাদের বাড়ি আছে, ওদের আত্মীয়, ধুলিয়ানে না কোথায় থাকে। ফিরতি লঞ্চেই খবর নিয়ে চলে আসবে বলেছিল। সেই দুপুর থেকে অপেক্ষা করছি, মিহির এখনও এল না। এদিকে জল যেভাবে বাড়ছে, এর পরে ট্রাক ফেলে রেখে আমাকে চলে যেতে হবে।

উৎকণ্ঠায় আর উত্তেজনায়, নারায়ণ তাড়াতাড়ি অনেকগুলো কথা বলে ফেলল। আর উদিতের চোখে একটা ঝিলিক খেলে গেল। নারায়ণ আবার বলল, আমি যদি গাড়ি চালাতে পারতাম, তা হলে এতক্ষণে চলে যেতাম।

উদিত প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, সেজন্য ভাবতে হবে না। ইংলিশবাজার অবধি যাওয়ার মতো তেল মবিল আছে তো?

নারায়ণ প্রায় চিৎকার করে উঠল, ওহহ, উদিত, তুই তো চালাতে পারিস!

সকলের চোখেই যেন আলো দেখা দিল। বড় বড় চোখে উদিতের দিকে তাকাল। উদিত বলল, সেইজন্যই বলছি। তোর ট্রাক ঠিক আছে তো?

ঠিক আছে।

আটগমের কাছে রাস্তায় জল কী রকম হবে?

এই রকমই, এখানে যেরকম দেখছিস।

উদিত জলের দিকে তাকিয়ে বলল, তা হলে ঠিক আছে। ট্রাক কোথায়?

নারায়ণ সামনের দিকে দেখিয়ে বলল, কাছেই। লোকগুলো দাঁড়িয়ে আছে, ওর সামনেই বাঁকের মুখে।

উদিত বলল, চল গাড়িটা এখানে নিয়ে আসি, এদের সবাইকেই তুলতে হবে।

 নারায়ণ বলল, কিন্তু গাড়ি ঘোরাতে পারবি না, ব্যাক করে নিয়ে আসতে হবে।

তা নিয়ে আসব, চল।

বলে ও রায়মশাইয়ের দিকে ফিরে তাকাল। রায়মশাই উত্তেজনায় বোধ হয় কাঁপছিলেন, বলে উঠলেন, জয় মা দুর্গতিনাশিনী। বাবা উদিত, তোমাকে আজ মা দুর্গাই মিলিয়ে দিয়েছিলেন। আর তোমার বন্ধুটিও সাক্ষাৎ নারায়ণ।

সকলের চোখেমুখেই আশা আর হাসি ঝিলিক দিচ্ছে। রায়মশাইয়ের প্রশস্তিতে, নারায়ণের ফরসা প্রকাণ্ড মুখটা লাল হয়ে উঠল। সেই মেয়েটির সঙ্গে উদিতের চোখাচোখি হল। মেয়েটি যেন কিছু বলতে চাইল। তার রং উঠে যাওয়া ঠোঁট এক বার নড়ে উঠল, কিন্তু কিছু বলতে পারল না। উদিত দেখল, মীনা ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তেই, মীনা ঠোঁটের কোণে হেসে, মেয়েটির দিকে চোখের কোণ দিয়ে তাকাল। উদিত বুঝতে পারল, মীনা একটু দুষ্টুমি করছে। ও নারায়ণের সঙ্গে চলে গেল।

যেতে যেতে নারায়ণের সঙ্গে উদিতের কথা হল, রায়মশাইদের সম্পর্কে। কিন্তু আর একটি মেয়ের পরিচয় ও জানে না। নারায়ণ বলল, বড়লোকের মেমসাহেব মেয়ে বলে মনে হচ্ছে।

উদিত বলল, তা তো বটেই। হাওড়া স্টেশনেই আমি দেখেছি!

হাতের বড় ব্যাগটা তো ফরেনের।

মেয়েটাও ফরেন মার্কা, পোশাক দেখেছিস।

দেখিনি আবার। কিন্তু মেয়েটাকে আমার চেনা চেনা মনে হচ্ছে।

উদিত ধমক দিয়ে বলল, দ্যাখ নারাণ, গুল মারিস না। মেয়ে দেখলেই তোর চেনা চেনা লাগে। এ মেয়ে মালদহের, তুই চিনবি কী করে।

নারায়ণ বলল, তা ঠিক, কিন্তু মাইরি, মিথ্যা বলছি না, কেমন যেন চেনা চেনা মুখ লাগছে। বোধ হয় কখনও শিলিগুড়িতে গেছল তখন দেখেছি।

হ্যাঁ, এক বার দেখেই মনে রেখে দিয়েছিস। ও সব বাদ দে, তোকে যে এভাবে পেয়ে যাব, এক বারও ভাবিনি।

তোকেও যে পাব, ভাবিনি। আমি তো এই ফেরিটা দেখে, চলে যেতাম। আমি নিশ্চিন্ত মনে, ট্রাকে বসে আছি, ভাবছি মিহির নিশ্চয় এই ফেরিতে আসছে। তারপরে দেখছি, সবাই পালাচ্ছে, মিহির আর আসে না। তাই দেখতে এলাম এক বার, যদি এই দলের মধ্যে মিহির থেকে থাকে। কিন্তু মিহিরটা এল না-ই বা কেন?

শেষের দিকে ওর গলায়, চিন্তা ফুটে উঠল। উদিত বলল, আমার মনে হয়, কোনওরকমে আটকে গেছে। কিন্তু ভেবে দ্যাখ নারাণ, চলে যাবি, তারপরে যদি মিহির এসে খোঁজাখুঁজি করে?

নারায়ণ বলল, কোনও উপায় নেই, তা হলে আর ট্রাক ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না। মিহির আসে তো, কোনও না কোনওভাবে চলে যাবেই। অবস্থা দেখেই বুঝতে পারবে, ট্রাক থাকলে পড়ে থাকত। আমার তো মনে হয়, আজ সারারাত্রি ট্রাক এখানে থাকলে কাল ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।

যোগাযোগটা সত্যি বিস্ময়কর। নারায়ণদের শিলিগুড়িতে বিরাট কনট্রাক্ট ফার্ম। সিভিল মিলিটারি দুই রকম কনট্রাক্ট বিজনেসই ওদের আছে। নারায়ণদের বাড়ি জলপাইগুড়ি, ব্যবসার ক্ষেত্র শিলিগুড়ি। শিলিগুড়িতেও তাদের বাড়ি আছে। তারা তিন ভাই শিলিগুড়িতেই থাকে। উত্তরবঙ্গ, আসাম, সমতলে এবং পাহাড়ে, সবখানেই ওদের কাজ হয়। আজ এমন দুর্দিনে যে, মানিকচকে ওদের গাড়ির দেখা পাওয়া যাবে, এটাকে দৈবঘটনা ছাড়া কিছু ভাবা যায় না।

উদিত বলল, আজ মনে হচ্ছে, তুই গাড়িটা না চালাতে শিখে ভালই করেছিস। তা হলে, এতক্ষণে তুই নিশ্চয় গাড়ি নিয়ে চলে যেতিস।

নারায়ণ বলল, না। চালাতে জানলেও, এই ফেরিটা দেখে যেতাম। মিহিরের জন্য শেষ অবধি দেখতাম।

সেটাও দেখা হয়েছে। অতএব মিহিরের আর কিছু বলবার নেই।

.

মিহির আগেই, ট্রাকের মুখ ঘুরিয়ে রেখে গিয়েছিল। উদিত গাড়ি ব্যাক করে নিয়ে এল। গাড়ি থেকে নেমে, ও আর নারায়ণ হাত লাগিয়ে রায়মশাইদের মালপত্র নিয়ে পিছন দিকে তুলে দিল। বৃষ্টি না এলে, কোনও ভাবনা নেই। বৃষ্টি এলে, খোলা ট্রাকে ভিজতে হবে। মানিকচকে আটকে পড়ার থেকে, সেটা অনেক ভাল। রায় পরিবারের সবাইকে হাত ধরে টেনে তুলে দেবার পরে, সেই মেয়েটি উদিতের দিকে তাকাল। উদিতও জিজ্ঞাসু চোখে মেয়েটির দিকে তাকাল।

এখন আর বলাবলির কিছু নেই। মেয়েটি করুণ চোখে ওর দিকে চেয়ে বলল, আমাকে দয়া করে আপনাদের সঙ্গে একটু নিয়ে চলুন।

উদিতের হাওড়া স্টেশনের কথা মনে পড়ে গেল। কিন্তু মেয়েটির কথার পরে, আর মুখের চেহারা দেখে, করুণ মনে হল। বেকায়দায় পড়লে, সকলেই এরকম করে। তখন তো, মহারানির মতো ওয়াটারপ্রুফের জল দিয়ে, উদিতকে ভিজিয়ে, বই কিনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ও গম্ভীরভাবে, তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবেন আপনি?

মেয়েটা বলল, আপাতত আপনাদের সঙ্গে একটা নিরাপদ জায়গায় তো পৌঁছুনো যাক।

 রায়মশাই বলে উঠলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, তা ছাড়া উপায় কী। একলা একটি বাঙালির মেয়ে, তাকে তো আর এখানে ওভাবে ছেড়ে চলে যাওয়া যায় না।

বলে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, তবে বাপু, ওই যা বলছিলাম, অমন সোমথ বয়সে, একলা বেরোনো তোমার ঠিক হয়নি।

মেয়েটি কৃষ্ণা মীনার দিকে তাকাল। ওরা দুজনেই মেয়েটির দিকে চেয়ে হাসল। ভাবখানা, বাবার কথায় কান দেবেন না। মেয়েটি বলল, বেরিয়ে পড়েছি, এখন আর কী করি বলুন।

উদিত হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আসুন।

মেয়েটি উদিতের হাত ধরল। তার আগে ব্যাগটা নারায়ণের হাতে দিল। উদিত সবাইকেই এভাবে হাতে ধরে তুলে দিয়েছে। তবু, সেই মুহূর্তেই মীনার সঙ্গে ওর চোখাচোখি হল। মীনা ঠোঁট কুঁকড়ে একটু হাসল। উদিত মনে মনে বলল, মেয়েটা ফাজিল আছে।

নারায়ণ ব্যাগটা মেয়েটির হাতে তুলে দেবার সময়ে, মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, বলতে পারেন, শিলিগুড়ির সঙ্গে কি কলকাতার টেলিফোন কেটে গেছে?

নারায়ণ বলল, আমি যখন এসেছি, তখনও কাটেনি বলেই জানি। এতক্ষণে কী হয়েছে, বলতে পারি না।

সবাইকে তুলে দিয়ে উদিত আর নারায়ণ সামনে গিয়ে বসল। ড্রাইভারের সিটের পিছনের পার্টিশনের জানালা দিয়ে, পিছনটা দেখা যাচ্ছে। উদিত তাকিয়ে দেখল, কৃষ্ণা মীনার কাছেই মেয়েটি বসেছে। কথাবার্তা বলছে। এঞ্জিনের শব্দ উঠল, উদিত গাড়ি স্টার্ট দিল। এমন সময়, জনা দুয়েক লোক কোথা থেকে ছুটে এসে বলল, বাবু, আমাদের একটু নিয়ে যান।

কোথায় যাবে?

 যেখানে আপনারা নিয়ে যাবেন। এখানে আমাদের আর কিছু নেই।

রায়মশাইয়ের গলা শোনা গেল, উঠে পড়ো তাড়াতাড়ি, এখন আর কথা বাড়িয়ো না।

লোক দুটো উঠে পড়ল। একজনের হাতে একটা জ্বলন্ত হ্যারিকেন ছিল। সেটা আর নেভাতে দেওয়া হল না। গাড়ি এগিয়ে চলল। নারায়ণ বারে বারেই পিছনের জানালা দিয়ে দেখছিল। তার চোখে একটা জিজ্ঞাসু কৌতূহল।

উদিত গাড়ি চালাতে চালাতেই জিজ্ঞেস করল, কী দেখছিস, কাকে দেখছিস এত?

নারায়ণ কোনওরকম চমকে না উঠেই বলল, মেয়েটিকে আমার চেনা চেনা লাগছে।

কোন মেয়েটিকে?

 মেমসাহেবকে।

 ওদের সকলের চেহারা একরকম। সাজগোজ চুলের ফ্যাশান দেখলে মনে হয়, সবাই এক। আমি তো মেয়েটাকে প্রথমে অবাঙালি ভেবেছিলাম। কথা শুনে বুঝতে পারলাম বাঙালি।

নারায়ণ চুপ করে রইল। মেয়েটিকে বোধ হয় মনে করবার চেষ্টা করছে। উদিত নিজেই আবার বলল, এমনিতে ডাঁটের শেষ নেই। দায়ে পড়ে, এখন দয়া চাইছে।

নারায়ণ জিজ্ঞেস করল, তোকে ডাঁট দেখিয়েছে নাকি?

ওরা সবাইকে ডাঁট দেখায়।

কিন্তু মেয়েটাকে আমার চেনা চেনা লাগছে কেন? মনে হচ্ছে, এ মুখ আমার চেনা। কোথায় যেন দেখেছি।

দার্জিলিং কালিম্পং-এর হোটেলে টোটেলে কখনও দেখেছিস হয়তো।

 হতে পারে।

আর না-হয় তো, তোদের তো অনেক মিলিটারি আর সিভিল অফিসারদের সঙ্গে মিশতে হয়, তাদের বউদের ভেটও দিতে হয়। সেরকম কেউ হবে।

নারায়ণ যেন একটু আশান্বিত হল। বলল, সেটা হতে পারে। বলতেই আবার ভুরু কুঁচকে উঠল। বলল, কিন্তু কোনও বাঙালি অফিসারের বউ হলে তো সিঁথেয় সিঁদুর থাকবে। এর তা নেই।

উদিত ঠোঁট উলটে বলল, অফিসারের বউয়েরা আবার সিঁদুর পরে নাকি?

 সিথেয় অন্তত পরে।

আরে রাখ। দেখা আছে। ওই যে তোদের এক অফিসার, চক্রবর্তী, তার বউয়ের সিঁথেয় কোনওদিন সিঁদুর দেখিনি আমি। গেলাস গেলাস মদ ওড়াতে দেখেছি।

মিসেস চক্রবর্তীর কথা আলাদা। ওরকম মেয়েমানুষ।

নারায়ণ কথাটা শেষ করল না। উদিত মুখ টিপে হাসল। বলল, বল, ওরকম মনের মতো মেয়েমানুষ জীবনে কোনওদিন দেখিসনি। তুই তো আবার মিসেস চক্রবর্তীর সঙ্গে মজেছিস।

নারায়ণ হাসির শব্দ করে বলল, যাঃ।

যাঃ? তোদের দুজনকেই আমি মাতাল অবস্থায় দেখেছি।

 নারায়ণ যেন লজ্জা পেয়ে বলল, সে হয়তো এক-আধদিন।

এক-আধদিন? প্রায়ই তো মিসেস চক্রবর্তীকে নিয়ে তুই এদিক ওদিক পালিয়ে যাস। রাত্রি কাটিয়েও আসিস। চক্রবর্তী কিছু বলে না?

কী বলবে? সারাদিন মদ খায়, আর কোলা ব্যাং-এর মতো পড়ে থাকে।

 কী জীবন এদের আমি ভাবতে পারি না।

এদের জীবন বলে কিছু নেই।

দুজনেই চুপ করল। রাস্তার অধিকাংশ জুড়েই জল। মাঝে মাঝে শুকনোও পাওয়া যাচ্ছে। উদিতকে প্রতি মুহূর্তেই সাবধানে চালাতে হচ্ছে। যেখানে জল, সেখানেই রাস্তা মাঠ একাকার। যে কোনও মুহূর্তেই, মাঠের গভীর জলে গিয়ে পড়তে হতে পারে। খানপুর, রহিমপুর পার হওয়ার পরে, জলের গভীরতা বাড়তে আরম্ভ করেছে। পিছনের যাত্রীদের বিশেষ কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। উদিত আরও সাবধান হল। রাস্তার ধারে ধারে, যে সব গাছপালা আছে, তার সীমারেখা ধরেই, গাড়ি চালাবার চেষ্টা করছে।

আটগমের কাছাকাছি এসে, গাড়ি ঘণ্টায় তিন মাইল বেগ নিল। জল অনেক বেশি। কারবোরেটারে জল ঢুকলে আর দেখতে হবে না। গাড়ি এখানেই থেকে যাবে। দুদিকেই আম বাগান, ঘন অন্ধকার। মাঝখানে রাস্তাটা যে কোনদিক দিয়ে গিয়েছে, কিছুই বোঝা যায় না। নিরুপায় হয়ে গাড়ি দাঁড় করাতে হল। এভাবে গাড়ি চালানো যায় না।

যে দুজন লোক পরে উঠেছিল, তারা নিজেরাই যেচে জলে নামল। দুজনের হাতেই বড় বাঁশের লাঠি। তারা বলল, আমাদের আলো দেখান। আমরা রাস্তার দু পাশ দিয়ে হেঁটে যাই, তা হলে নিশেন পাবেন, পিছু পিছু আসতে পারবেন। মনে হয়, গোটা একটা মাইল এরকম রাস্তা হবে।

কথাটা মিথ্যা না। লোক দুটো কোমর-ডোবা জলে, সেইভাবে হেঁটে চলল, আর তাদের দুজনের মাঝখান দিয়ে, আস্তে আস্তে গাড়ি এগোল। প্রায় ঘণ্টাখানেক চলে, শুকনো রাস্তা পাওয়া গেল। তাদের মধ্যে একজন বলল, এবার নেয়ামতপুর হয়ে ইংরাজবাজার চলেন, রাস্তা বোধ হয় ভালই আছে।

কথাটা তারা মিথ্যা বলেনি। তারপরে ইংরাজবাজার পর্যন্ত রাস্তাটা ভালই পাওয়া গেল। রায়মশাই তো দুহাত তুলে আশীর্বাদ। ইংরাজবাজারে এসে, শহরের আর আলোর মুখ দেখে, সকলের মুখেই আলো দেখা দিল।

উদিত জিজ্ঞেস করল, কোন পাড়ায় আপনার আত্মীয়ের বাড়ি?

 রায়মশাই বললেন, সেখানে তোমার এ গাড়ি ঢুকবে না। এখন গাড়িটা কোথায় রাখবে বলো, তারপরে আমাদের সঙ্গে চলো। আমাদের কাছেই তুমি থাকবে।

উদিতের সঙ্গে নারায়ণের চোখাচোখি হল। নারায়ণ নিচু স্বরে বলল, মিছিমিছি থাকব কেন, চল রাতে রাতেই চলে যাই। রাস্তার জল বাড়বে ছাড়া তো কমবে না। কোনওরকমে এক বার শিলিগুড়ি পৌঁছুতে পারলে হয়।

উদিতের তা-ই ইচ্ছা। সেই কথাই ও রায়মশাইকে বলল, আমরা বরং চলেই যাই। আপনারা তো এখন নিরাপদেই থাকবেন। অবস্থা ভাল হলে, ধীরেসুস্থে যাবেন।

মীনা বলে উঠল, তা হলে, আমরাও আপনাদের সঙ্গে চলে যাই না কেন?

রায়মশাই দুহাত নেড়ে বলে উঠলেন, না না, এই রাত করে, তোদের নিয়ে যাওয়া যায় নাকি। ওরা জোয়ান ছেলে, গাড়িটা রয়েছে।

তবু কৃষ্ণা মীনা উদিতকে ওদের আত্মীয়ের বাড়ি খেয়ে যেতে বলল। উদিত বলল, এখান থেকেই কিছু খেয়ে নেব, ভাববেন না। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়তে চাই।

রায় পরিবার এবং অন্য দুটি লোক নেমে গেল। কিন্তু সেই মেয়েটি তখনও বসে রয়েছে। রায়মশাই তাকে ডাকলেন, কই গো মা, তুমি আমাদের সঙ্গে এসো।

মেয়েটি উদিতের দিকে এক বার তাকাল। উদিত বলল, হ্যাঁ, আপনিও এঁদের সঙ্গেই যান। আপনার কেউ আছে এখানে, কোনও আত্মীয় বা চেনাশোনা লোক।

মেয়েটি উদ্বেগভরা চোখে ঘাড় নেড়ে বলল, না।

রায়মশাই বললেন, তাতে কী হয়েছে, আমাদের সঙ্গেই থাকবে।

মেয়েটি বলল, আপনারা শিলিগুড়ির দিকেই যাচ্ছেন। আমাকে সেদিকেই যেতে হবে। আমি আপনাদের সঙ্গে গেলে আপত্তি আছে?

জবাব দিলেন রায়মশাই, আপত্তির কারণ তো আছেই। তুমি একলা একটি মেয়ে, এই দুর্যোগের মধ্যে এদের সঙ্গে কোথায় যাবে?

মেয়েটি তবু উদিতের দিকে তাকিয়ে রইল। মীনা বলে উঠল, আপনার খালি এক কথা বাবা, উনি একলা কোথায়। ওঁরা দুজন তো আছেনই।

রায়মশাই হতাশ বিরক্তিতে বললেন, তা হলে আমার কিছু বলার নেই। ওর যদি সাহস থাকে, যাবে।

মেয়েটি মীনার দিকে সকাতর কৃতজ্ঞতায় তাকাল। তারপরে উদিতের দিকে। উদিত নারায়ণের দিকে।

নারায়ণ বলল, তুই কথাবার্তা বল, আমি দু-একজনের কাছে রাস্তাঘাটের খবর নিয়ে আসি।

উদিত মেয়েটির দিকে ফিরে বলল, বিপদের ভয় যদি আপনার না থাকে চলুন।

 মীনা ফোড়ন কাটল, আপনি আছেন কী করতে?

গাড়ি সুদ্ধ ডুবলে তো আর আমি বাঁচাতে পারব না।

 মীনা ঠোঁট মুচকে হেসে বলল, ডুবলে একসঙ্গেই ডুববেন, কারোর কিছু বলার থাকবে না।

কয়েকটি রিকশা ডেকে রায়মশাই মালপত্র চাপিয়ে, সপরিবারে রওনা হলেন। যাবার আগে, উদিতকে আবার আশীর্বাদ করে গেলেন। সকলেই উদিতের কাছ থেকে বিদায় নিল। মীনার ঠোঁটের হাসিটা সেইরকম। এমনকী একবার কানের কাছে মুখ নিয়ে চুপিচুপি বলেও ফেলল, আপনাকে খুব পছন্দ হয়েছে।

উদিত থমকে হেসে উঠেছে। মীনা খিলখিল করে হেসে উঠেছে।

.

সবাই চলে যাবার পরে, উদিত নারায়ণের জন্য, চারদিকে তাকাল। এ সময়ে, উদিতের চোখে পড়ল, রাস্তার এক পাশে একটা জিপ। দু-তিনজন লোক, ওকে আর মেয়েটিকে দেখছে, নিজেদের মধ্যে কী যেন বলাবলি করছে। হয়তো উদিতদের অবস্থা দেখেই, কিছু বলাবলি করছে। তবু, লোকগুলোর দৃষ্টি ওর ভাল লাগল না। তিন জনেই বেশ ভাল পোশাক পরে আছে। তাদের দেখলে মনে হয় না, কোনওরকম দুশ্চিন্তায় আছে। তাদের প্রত্যেকের হাতেই একটা করে গেলাস। সামনেই একটা পানের দোকানে টিম টিম করে আলো জ্বলছে। লোকগুলো বোধ হয় মদ খাচ্ছে। বাঙালি না অবাঙালি, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তাদের লক্ষ্য বেশি, মেয়েটির দিকেই।

মেয়েটি সে সব দেখছিল না। সে উদিতের দিকে তাকিয়ে, কিছু বলতে চাইছে। লজ্জায় বা সংকোচে পারছে না বোধ হয়। উদিত এবার নিজেই জিজ্ঞেস করল, আপনি ঠিক কোথায় যাবেন বলুন তো?

মাটিয়ালি।

উদিত চমকে উঠে বলল, মেটুলি!

হ্যাঁ।

সে তো শিলিগুড়ি থেকেও অনেক দূর। এই দুর্যোগ দেখে, এত দূরের পথে আপনি বেরোলেন কী করে?

বুঝতে পারিনি।

 সেখানে আপনার কে আছে?

মেয়েটি যেন একটু থমকে গেল। তারপর বলল, আমার আত্মীয়ের বাড়ি আছে।

 কথাটা উদিতের ঠিক বিশ্বাস হল না। তবে, ওর জানবার দরকারই বা কী।

ও আর কিছুই জিজ্ঞেস করল না, এমনকী মেয়েটির নামও না।

এমন সময়ে জিপের কাছ থেকে একটি লোক এগিয়ে এসে উদিতকে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কোথায় যাবেন?

লোকটির লক্ষ্য আসলে মেয়েটি, আড়চোখে সে তাকেই দেখছিল। উদিত তীক্ষ্ণ চোখে লোকটাকে দেখল। মদের গন্ধও পেল। বলল, কোথাও যাব কি না, এখনও বলতে পারি না।

গেলে কোথায় যাবেন?

উদিত বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, সে খোঁজে আপনার কী দরকার?

 লোকটি একটু নরম হবার চেষ্টা করল, না সেরকম হলে, আমাদের একজন আপনার ট্রাকে যেত!

উদিত পরিষ্কার জানিয়ে দিল, অচেনা কোনও লোককেই আমরা নেব না।

লোকটি মেয়েটির দিকে এক বার ভাল করে দেখল। বলল, অ! আচ্ছা, ঠিক আছে।

কেমন যেন একটা চ্যালেঞ্জের সুর আছে লোকটার গলায়। যেতে যেতেও, বারে বারে মেয়েটির দিকে ফিরে দেখল। ওর দলের লোকেরা সবাই এদিকেই তাকিয়ে ছিল। লোকটা ওদের কাছে যাবার পরে, সবাই একযোগে মেয়েটির দিকে তাকাল, আর নিজেদের মধ্যে কী সব বলাবলি করতে লাগল।

উদিতের কী মনে হতে, ও মেয়েটির দিকে তাকাল। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার বলুন তো। ওরা কি আপনার চেনা লোক?

মেয়েটি অবাক চোখে চকিতে একবার জিপ গাড়ির সামনে লোকগুলোকে দেখল। উদিতের দিকে ফিরে, ঘাড় নেড়ে বলল, না তো।

উদিত আবার লোকগুলোর দিকে দেখল। ওর মনের সন্দেহ ঘুচল না। বলল, লোকগুলো আপনাকে ওভাবে তাকিয়ে দেখছে কেন?

মেয়েটির মুখ একটু রক্তাভ হল। বলল, তা কী করে জানব বলুন। ওদের একটা লোককেও তো আমার চেনা মনে হচ্ছে না।

উদিত চিন্তিত হল, ওর ভুরু বেঁকে রইল। লোকগুলোকে ওর মোটেই ভাল লাগছে না। ওরা মেয়েটির দিকেই বারে বারে তাকিয়ে দেখছে। এমনিতেই দুর্যোগ, তারপরে যদি মেয়েটিকে নিয়ে, কোনও ঝামেলায় পড়তে হয়, সেটা মোটেই ভাল হবে না। লোকগুলো কারা হতে পারে, কেনই বা মেয়েটিকে এভাবে দেখছে, কে জানে। ও আবার মেয়েটির দিকে ফিরে তাকাল। মেয়েটির চোখও তখন ওর ওপরেই। চোখাচোখি হতেই, মেয়েটি চোখের পাতা নামাল। আবার তৎক্ষণাৎ উদিতের দিকে চেয়ে বলল, আপনার কি সন্দেহ হচ্ছে, আমি ওদের চিনি?

উদিত বলল, তা বলছি না। তবে ওদের ধরন ধারণ যেন কী রকম। আপনার কিছু মনে হচ্ছে না?

মেয়েটি চকিতে আর একবার জিপের দিকে দেখল। বলল, হ্যাঁ, খুবই ডাউটফুল। কিন্তু কেন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

উদিত বলল, ওদের একজন আমাদের সঙ্গে ট্রাকে যেতে চাইছে।

 মেয়েটি বলল, সে কথা তো শুনলাম।

তাতেই মনে হয়, ওদের একটা কিছু উদ্দেশ্য আছে।

বলতে বলতেই উদিত মাথায় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, থাকলেই বা আর কী করা যাচ্ছে। দেখা যাক কী হয়।

উদিতের কথা শুনে, মেয়েটি যেন একটু স্বস্তিবোধ করল।

.

বেশ খানিকক্ষণ বাদে, নারায়ণ ফিরল। ওর হাতে মস্ত বড় খাবারের ঠোঙা আর ভাঁড়। এসে বলল, এখানকার থানার খবর হচ্ছে, আদিনা পান্তুয়া দিয়ে গাজোল পর্যন্ত রাস্তা ঠিকই আছে। শামসী পর্যন্ত রাস্তায় খানে খানে জল উঠেছে, খুব বেশি না। চাঁচলের অবস্থা খুব ভাল না, তবে পার হওয়া যেতে পারে। সেখান থেকে হয় পূর্ণিয়া ঢুকতে হবে, না হয় তো পশ্চিম দিনাজপুর দিয়ে পূর্ণিয়ায় গিয়ে পড়তে হতে পারে। পুলিশ বলছে, না যাওয়াই ভাল। এখন কী করবি?

উদিত ভাবল খানিকক্ষণ। মেয়েটিকে এক বার দেখল। বলল, চলেই যাই। দেখি না কী হয়।

নারায়ণ বলল, আমারও তাই ইচ্ছা।

বলে নারায়ণ এবার মেয়েটির দিকে তাকাল। উদিতকে জিজ্ঞেস করল, উনি তা হলে থেকে গেলেন?

 হ্যাঁ।

 নারায়ণ বলল, ঠিক আছে, আপনি একটু কিছু খেয়ে নিন আমাদের সঙ্গে।

মেয়েটি বলল, থাক, খেতে ইচ্ছে করছে না।

 নারায়ণ বলল, সে তো ইচ্ছে করবেই না। তবে মন খারাপ করে কী করবেন, যা তোক একটু খেয়ে নিন।

ইতিমধ্যে একটা ছেলে জলের কুঁজো আর কয়েকটা গেলাস নিয়ে এল। পাতায় খাবার ভাগ করে, মেয়েটির দিকে বাড়িয়ে দিতেই, মেয়েটি বলল, আমাকে একটু ভেতরে গিয়ে বসতে দেবেন?

নারায়ণ বলল, আসুন।

সে দরজা খুলে দিল। মেয়েটি পাশে দাঁড়ানো উদিতের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। উদিত মেয়েটির হাত ধরে নামিয়ে নিয়ে এল। বলল, আমার ব্যাগটা পিছনে রয়েছে।

উদিত সে কথায় কান দিল না। মেয়েটি ভিতরে ঢুকল। নারায়ণ তার হাতে খাবার তুলে দিল।

উদিত পিছন থেকে মেয়েটির ব্যাগ তুলে নিয়ে এসে, ভিতরে তার পাশে রেখে দিল। মেয়েটি সেই মুহূর্তেই মুখে খাবার তুলতে যাচ্ছিল। যেন লজ্জা পেয়ে গেল। বলল, শুনুন, উদিতবাবু।

উদিত থমকে দাঁড়িয়ে বলল, বলুন।

আমার দু হাতই জোড়া হয়ে গেছে। ব্যাগের ভিতরে একটা ছোট ভোয়ালে আছে, একটু বের করে দেবেন?

উদিত মেয়েটির দিকে তাকাল।

মেয়েটিও ওর দিকেই তাকিয়ে। বলে উঠল, বিরক্ত হচ্ছেন না তো?

উদিত বলল, না, বিরক্তি আর কীসের।

এই একটু আগেই, ট্রাকের পিছন থেকে, হাত ধরে নামিয়ে দেবার সময়ে, মেয়েটির ভঙ্গি ওর মনে পড়ে গেল।

তবু উদিত যেন খানিকটা অনিচ্ছায় ব্যাগ খুলল। ভিতর থেকে একটা সুন্দর গন্ধ বেরোল। ব্যাগের মুখের কাছে ম্যাগাজিনগুলো। তারপরেই তোয়ালে। সেটা বের করে দিল। তারপরে ও আর নারায়ণ, রাস্তায় দাঁড়িয়ে ট্রাকের গায়ে হেলান দিয়ে পাতার ঠোঙা থেকে খাবার খেতে লাগল।

নারায়ণ জিজ্ঞেস করল, মেয়েটার নামধাম পরিচয় কিছু জানলি?

না। খালি বলল, ও মেটেলি যাবে।

মেটেলি! তা হলে আর যাওয়া হয়েছে। কিন্তু মেটেলি কার বাড়ি যাবে?

বললে, কে নাকি আত্মীয় আছে।

 তুই তো আচ্ছা ছেলে। নামধাম পরিচয়টা তো জেনে নিতে হয়।

উদিত খেতে খেতে বলল, কী হবে পরিচয় জেনে? শিলিগুড়ি অবধি পৌঁছে দিলেই হল। তারপরে যে যার রাস্তায়।

নারায়ণ বলল, নামটা তো অন্তত জানা দরকার।

তোর দরকার থাকে, তুই জেনে নিস।

নারায়ণ মুখের খাবার চিবোতে চিবোতে অদ্ভুত স্বরে বলল, তোর কোনও রসকষ নেই। এ রকম একটা মেয়ে সঙ্গে যাচ্ছে। কোথায় খুশি হবে, তা না, যেন ব্যোমকে বসে আছিস।

ব্যোমকে বসে থাকব কেন। যা করবার, তা-ই করছি। তোর রস বেশি হয়ে থাকে, তুই যা খুশি তাই কর।

উদিত তাকাল নারায়ণের দিকে। নারায়ণ মুখে খাবার নিয়ে হাসল। বলল, করব আবার কী। করার কিছু নেই। তবে এ রকম জানি, একটা ওরকম মেয়ে সঙ্গে থাকলে, আমার বেশ ভালই লাগে।

উদিত অবিশ্যি এক বারও বলেনি, ওর খারাপ লেগেছে। নারায়ণের কথা শুনে, ওর মনে হল, খারাপ আর কী। বাজে কোনও ঘটনা না ঘটলেই হল। নারায়ণ আবার বলল, মেয়েটাকে যত বারই দেখলাম, কেবল তোর দিকে চেয়ে আছে। তোকে বোধ হয় ভাল লেগেছে।

উদিত ভুরু কুঁচকে নারায়ণের দিকে তাকাল। নারায়ণের প্রকাণ্ড মাংসলো মুখটা দেখলে বিশেষ কিছু বোঝা যায় না। কিন্তু উদিত নারায়ণকে ভাল চেনে। ছেলেবেলার বন্ধু। এক সঙ্গে এক শহরে ওরা বড় হয়েছে, মেলামেশা করেছে। নারায়ণদের অবস্থা ওদের থেকে বরাবরই ভাল। তাতে মেলামেশা আটকায়নি। কলেজ ছেড়ে দেবার পরেও, মেশামেশিটা একরকমই আছে। উদিত বলল, দ্যাখ নারাণ, পেছনে লাগার তাল করিস না।

নারায়ণ হেসে ওঠার মতো শব্দ করে বলল, পেছনে লাগব কেন। যা সত্যি, তাই বলছি। যত বারই দেখেছি, ঠিক তোর দিকে তাকিয়ে আছে। কথাটা তোকে বলব ভেবেছিলাম।

উদিত নারায়ণের মুখ থেকে চোখ না তুলেই বলল, তোকে আমি চিনি না, না?

নারায়ণ এবার হেসে উঠল। বলল, মাইরি বলছি, আমি একটুও মিথ্যে বলিনি।

উদিত বলল, বেশ, সত্যিই বলেছিস। তাতে কী এল গেল? মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়েছিল তো কী হল।

তাকানোর মধ্যে একটু বিশেষত্ব আছে।

উদিত ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ, আমার প্রেমে পড়ে গেছে।

তুই একটু ঝোঁক দিলেই পড়ে যাবে।

উদিত বিরক্ত হতে গিয়ে হেসে ফেলল। নারায়ণও ওর সঙ্গে হেসে উঠল।

উদিত বলল, ওরে গাধা, বিপদে পড়লে ওরকম সবাই মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। হাওড়া ইস্টিশনে কেমন ডাঁট দেখিয়েছিল, তা তো দেখিসনি।

নারায়ণ নতুন করে উৎসাহী হয়ে উঠে জিজ্ঞেস করল, তাই নাকি? কী রকম?

উদিত হাওড়া বুকস্টলের কথা বলল। নারায়ণ শুনে বলল, ওরকম হয়ে থাকে। ওটা ডাঁট দেখাবার জন্য নয়, এমনি আপন মনে কাগজ কিনছিল, তোর গায়ে বর্ষাতির জল লেগে গেছল। তারপরে মানিকচকের বান দেখে প্রেমে পড়ে গেল।

উদিত হো হো করে হেসে উঠল। তারপরে গলা নামিয়ে বলল, বুঝেছি, মেয়েটাকে দেখে তুই মজেছিস। তা চেষ্টাচরিত্র করে দ্যাখ না।

নারায়ণ একরাশ খাবার মুখে পুরে দিয়ে, মুখটাকে ফুলিয়ে তুলল। খাবার চিবোতে চিবোতে হাউ হাউ করে বলল, এরকম চেহারার লোকের সঙ্গে মেয়েরা প্রেম করে না।

উদিত বলল, তবু যদি তোকে না জানতাম। শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি হিসেবে কম করে দু ডজন। মেয়ে ছাড়া তোকে আমি আজকাল ঘুরতেই দেখি না।

নারায়ণ বলল, সঙ্গে ঘোরা আর প্রেম করা এক কথা না।

উদিত ঠোঁট মুচকে হেসে বলল, আমি তো অন্যরকম জানি।

কী রকম?

নারায়ণ সিনহা যে মেয়ের সঙ্গে ঘোরে, সে মেয়েই তার প্রেমিকা।

 নারায়ণ খাবার চিবোতে চিবোতে উদিতের মুখের দিকে তাকাল। চোখে তার ভ্রকুটি অনুসন্ধিৎসা। কেবল উচ্চারণ করল, তার মানে?

উদিত বলল, তার মানে, মনে করে দ্যাখ, এরকম কথা তুই-ই আমাকে বলেছিলি বছর খানেক আগে, নারায়ণ সিনহা রোজ একটা করে প্রেম করতে পারে।

নারায়ণ মুখের মধ্যে খাবার নিয়ে, হাঁ করে কয়েক মুহূর্ত উদিতের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপরে যেন অবাক হয়ে, লজ্জা পেয়ে বলল, বলেছিলাম নাকি! যাঃ, বাজে কথা।

উদিত বলল, তবে স্বাভাবিক অবস্থায় বলিসনি, পেটে তখন তোর প্রচুর মাদকদ্রব্য ছিল।

নারায়ণ গাল ফুলিয়ে হাসবার ভঙ্গি করল। কিছু বলল না। উদিত মুখ টিপে হাসল। কথাটা ও মিথ্যা বলেনি। নারায়ণের পানের ব্যাপারে মাত্রাধিক্য ঘটলে, ওরকম অনেক কথাই সে বলে থাকে। মানুষ তার নিজের ইচ্ছা বা রুচিতেই পান করে। তথাপি পরিবেশের একটা ব্যাপার বোধ হয় আছে। নারায়ণ যে-পরিবেশে থাকে, অধিকাংশ সময় চলাফেরা করে, মদ্যপানটা সেখানে নিয়মিত এবং অপ্রতিরোধ্য ভাবে চলে। তাদের ব্যবসার জগতে, যা কিছু করণীয় এবং যাদের সঙ্গে উঠতে বসতে হয়, খাতির করে চলতে হয়, সেই জগতে এবং ব্যক্তিদের কাছে মদ গলা ভেজাবার পানীয় হিসাবে ব্যবহৃত হয়। নারায়ণ যতকাল দাদাদের সঙ্গে ব্যবসায়ে নামেনি, ততকাল তার ও সব ছিল না। আস্তে আস্তে শুরু হয়েছিল। তার আগে, ওর দাদারা শুরু করেছিল। এখন ওরা তিন ভাই একসঙ্গে বসেই মদ্যপান করে। এটা একটা নারায়ণদের স্বাভাবিক পারিবারিক চিত্র। তবে এই চিত্র শিলিগুড়ির বাড়িতেই। জলপাইগুড়ির বাড়িতে নারায়ণের বাবা থাকেন। সেখানে ও সব নিষিদ্ধ। আজকের এই বিরাট কন্ট্রাক্টরি ব্যবসা একদা নারায়ণের বাবা-ই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখন নারায়ণের দুই দাদা আর সে, সব দেখাশোনা করে। বাবা বিশ্রাম নিয়েছেন। হয়তো নারায়ণের বাবাও জানেন, তাঁর ছেলেরা পানাসক্ত। তাঁর মনোভাবটা বোধ হয় এইরকম, ব্যবসা ঠিক মতো বজায় রেখে, দূরে বসে ছেলেরা একটা মোটামুটি স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারে। যদিও সেটা মাত্রাতিরিক্ত হবে না, এবং তাঁর সীমানার মধ্যেও সম্ভব নয়।

অবিশ্যি, নারায়ণের মদ্যপানটা লুকোচুরির কিছু না। সকলেই জানে। নারায়ণ সকলের ছোট, সে হিসেবে একটু রোমান্টিক। শিলিগুড়ির যে সব পরিবারের সঙ্গে ওদের ওঠাবসা, তারা সরকারি মিলিটারি কসমোপলিটান সমাজ। ভারতের সব প্রদেশের লোকই তার মধ্যে আছে। নারায়ণ মেয়েদের সঙ্গে মিশতে ভালবাসে। ওর নিজের একটা গাড়ি আছে। টাকাও পকেটে থাকে। গুরুদায়িত্বপূর্ণ কাজের ভারটাও কম বহন করতে হয়। অতএব, আজ একে নিয়ে দার্জিলিং, কাল ওকে নিয়ে কালিম্পং, পরশু তাকে নিয়ে গ্যাংটক ছুটোছুটিতে ওর অসুবিধে নেই। অসুবিধে একটি মাত্র, আজ অবধি ভাল করে গাড়ি চালাতে শেখেনি। উদিতকে তার প্রয়োজন হয়, এই কারণেই বেশি। নারায়ণের অনেক অভিসার ভ্রমণেরই সঙ্গী উদিত।

অভিসার নারায়ণের ভাষায়। যে-মেয়ে ওর সঙ্গে বেড়াতে যায়, সে মেয়েই ওর প্রেমিকা। নারায়ণ নিজেও জানে, কথাটা সত্যি না। ভাবতে ভালবাসে। আসলে নারায়ণ সরল হৃদয়, ফুর্তিবাজ। কোনও কোনও সময় বোকা বলে মনে হয়। কিন্তু সে বোকা নয়। আবেগের সময় যা মনে আসে, তা-ই বলে। তখন বোকা বোকা মনে হতে পারে। কাজের বেলায় কেবল বুদ্ধিমান না, সে রঙ্গ ব্যঙ্গও জানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *