বিহারী পর্ব

২৭. পুরস্কার

পুরস্কার

জীবনে কখন প্রথম পুরস্কার জুটেছে আমার ভাগ্যে, বলতে পারবো না। পরীক্ষায় ফল ভালো করে পুরস্কার পাওয়ার মত ছাত্র কোনোদিনই ছিলাম না।

তারপরও খুব সম্ভবত দশ-বারো বছর বয়সে পাড়ার স্পোর্টসে অঙ্ক দৌড়, আর বিস্কুট দৌড়ে জিতে পুরস্কার জুটেছিল দু’একবার। একটা পুরস্কারের চেহারাটা মনে পড়ছে-সাবানদানী! এরপর আর খেলাধুলায় জোটেনি পুরস্কার। যদিও সব সময়ই খেলার সাথে থাকতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও ক্লাস ক্রিকেটের কম্পিটিশনে ছিলাম। নাহ! পুরস্কারের ঝুলি খোলেনি আমার জন্যে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনে শেরেবাংলা হলের বাসিন্দা ছিলাম। একবার হলের সাধারণ সম্পাদক ও হয়েছিলাম। সেটা ১৯৬৪তে বোধকরি। সে সময় অনেক কিছুর দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে ওই পদের কারণে। বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ছিল তার একটি প্রধান কার্যক্রম।

কী কারণে যেন সেবার আমি বেশ ক’টা আইটেমে নাম দিয়ে বসলাম-যেমন, ধারাবাহিক গল্প বলা, রস গল্প বলা এবং উর্দু কবিতা আবৃত্তি। এই উর্দু কবিতা আবৃত্তি নিয়ে সবাই সে কী হাসাহাসি, কিন্তু আমার এক উর্দু ভাষী ক্লাসমেট বকশীষ আলী আমাকে খুবই অনুপ্রাণিত করে নামটা দিতে বাধ্য করেছিল। ধারাবাহিক গল্পটায় শখ করেই দিয়েছিলাম নাম, আর চুটকি বলার একটা নেশা আমার সবসময় ছিল (এখনও বিদ্যমান)। কিন্তু আবৃত্তি— ওরে বাপরে, আমার ঠ্যাং কাঁপার ভয় ছিল এই কাজটায়। আজ অবধি সেই ভয়টা আছে এবং ওর থেকে একশ’ হাত ফারাকে অবস্থান করি আমি।

কিন্তু ওই যে বকশীষ আলী, ও আমাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিলো, আর বাকআপ করে উত্তেজিত করে দিল— প্রথম যে কবিতাটা আবৃত্তি করেছিলাম সেটা ছিল মীর্জা গালিবের। ‘জিন্দেগীভর গালিবনে এহী ভুল করতা রাহা

ধূল চেহারা পর থা আওর আয়না সাফ করতা রাহা।’

আমাদের শিক্ষক যাঁরা বিচারকের ভূমিকায় ছিলেন, তাঁরা তো রীতিমতো মুগ্ধ, বিশেষ করে আমার উর্দু উচ্চারণে।

দ্বিতীয় যে কবিতটা ছিল বকশীষ আলীর সেটা হলো—

মায়নে তুমকো দেখা থা ঘুম ঘুম কে,
জাওয়াব দিয়া থা তেরে বাপনে চপ্পল মার মার কে॥

সুপারহিট! পুরস্কার কে নেয় আমি ছাড়া। তিনটিতেই আমি পেলাম প্রথম পুরস্কার। এতগুলো বই। তা হোক বই, পুরস্কার তো, আর আমি সেই ছোট্টবেলা থেকে পড়ার পোকা। আসলে পুরস্কার বলতে যা বোঝায় তা পেলাম ১৯৭৪ সনে অভিনয় করে। তখন আমি থিয়েটার করি নিয়মিত। আমরা নাগরিকে যে নাটকটি ১৯৭৩-এ মঞ্চায়ন করলাম, বাদল সরকার রচিত ও আলী যাকের নির্দেশিত বাকি ইতিহাস যা এদেশে দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাট্য মঞ্চায়নের পথিকৃত প্রযোজনা সেটি। সেই নাটকের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করে পেলাম জীবনে প্রথম একটি প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পুরস্কার। দিয়েছিল SEQUENCE MAGAZINE। এইটি ছিল অত্যন্ত উঁচুমানের একটি সাংস্কৃতিক মাগাজিন যা সম্পাদনা করতেন প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক আলমগীর কবীর, ফজল শাহাবুদ্দীনের মতো ব্যক্তিত্ব। এই পুরস্কারটিকে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার মানি আমি। এঁকদমই আনকোরা নতুন অভিনেতা, কেউ তাকে চেনে না, বা আমি এদেরকে চিনতাম না-সেই রকম পরিস্থিতিতে পুরস্কারটি আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ অর্জন অবশ্যই। বিশেষ করে পুরস্কারের টাইটেলটি “SEQUENCE AWARD OF MERIT FOR INTRODUCING NATURAILSTIC ACTING ON BANGLADESH STAGE”

এরপর অসংখ্য পুরস্কার এসেছে নানান প্রতিষ্ঠান থেকে আমার অভিনয়ের, লেখার এবং নির্দেশনার জন্যে। সম্মাননা, বিশেষ সম্মাননা, আজীবন সম্মাননা, পদক, শ্রেষ্ঠ বাবা, নাটকের শ্রেষ্ঠ বাবা ইত্যাদি অগুনতি স্বীকৃতি এসেছে। কিন্তু ওটার মত মন ভরে যাওয়া আনন্দ কোনোটিই দিতে পারেনি আমাকে। এক সময় জাতীয় একুশে পদকও দিলেন সরকার-সেটাও অনেকের মতামত “পেলেন তাহলে?” জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের ব্যাপারে ও তাই— শংখনীল কারাগারে বাবার চরিত্রে শুনলাম পেয়ে গেছি— কিন্তু না, আবার জয়যাত্রার ব্রাহ্মণের চরিত্রের অবস্থাও তথৈবচ। যা হোক শেষ পর্যন্ত তৌকিরের দারুচিনি দ্বীপে খুললো কপাল।

হিসেব ধরলে, মেলাই হয়েছে স্বীকৃতি, তবে ওই যে, মন ভরানো কয়টি? আমি নিজেও বলতে পারবো না।

তবে যার চেয়ে বড় পুরস্কার আর কিছুই হতে পারে না, সেটি পেয়েছি আমি, দর্শকের ভালোবাসা। অফুরন্ত ভালোবাসা। এর যেন শেষ নেই। এটাই আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ পাথেয়।

হঠাৎ সেদিন ফোন এল পশ্চিম বঙ্গের একটি প্রতিষ্ঠান (Bangla Film & Television Chamber of Commerce) এর তপন রায়ের কাছ থেকে। আমাকে তাঁরা আজীবন সম্মাননা দিতে আগ্রহী; গেলাম, পেলাম, ফিরলাম। অনেকটা স্বপ্নের মতো লাগলো। জন্ম পশ্চিমবঙ্গে তো, তাই সেখানকার একটি পুরস্কার আমার মনটাকে সত্যিই ভরিয়ে দিয়েছে— ওখানকার বাঙালিরা আমাদের নাটকের কট্টর দর্শক। তাঁরা একটি পুরস্কার দিলেন। আমি আনন্দিত আপ্লুত।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *