কোরআন ও বিজ্ঞান
ওহীর মাধ্যমে ৬১০ থেকে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোরআন মোহাম্মদের (দঃ) উপরে নাজিল হয়। তখন শুধু প্রাচ্যে নয়, পাশ্চাত্যেও জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে বিরাজ করছিল অজ্ঞানতার এক নিদারুণ অন্ধকার। সেই অন্ধকারে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো জ্বালাবার পথেও ছিল হাজারটা প্রতিবন্ধকতা। সময়ের উদাহরণ হিসেবে ফ্রান্সের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ফ্রান্সে তখন রাজত্ব করছিলেন রাজা ডগোবার্ট–মেরোভিঙ্গায়ান বংশের শেষ নরপতি।
এখন কোরআনের বিজ্ঞান-সংক্রান্ত বক্তব্য সম্পর্কে সাধারণ শিক্ষিতমহলে যে ধারণা গড়ে উঠেছে, উপস্থিত ক্ষেত্রে অনেকের নিকট তা যৌক্তিক’ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময়ের প্রেক্ষাপট বিচার-বিবেচনা করে দেখলে স্পষ্ট হয় যে, তাদের ওই ধারণা শুধু অমূলক নয়, অবান্তরও বটে। তদুপরি, কোরআনের বিজ্ঞান-সংক্রান্ত বিভিন্ন বক্তব্য সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে আধুনিক তথ্য-জ্ঞানের সহায়তায় বিচার-বিশ্লেষণ করলে এটাও পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে যে, কোরআন সম্পর্কে আধুনিক শিক্ষিত মহলের ওইসব তথাকথিত ধারণার অবস্থান আসল সত্য থেকে বহুদূরে। পরবর্তী পর্যালোচনায় বিষয়টি আরো বিশদভাবে ফুটে উঠবে।
কোরআনের বিজ্ঞান-সম্পর্কিত কোন বক্তব্য যখন আধুনিক জ্ঞান-গবেষণার নিরিখে সত্য হিসেবে প্রতিভাত হয় এবং একইসঙ্গে বাইবেলের বা অন্যকোন ধর্মের ধর্মগ্রন্থের অনুরূপ কোন বক্তব্য বিজ্ঞানের অনুরূপ কষ্টিপাথরে অগ্রহণযোগ্য বলে প্রতিপন্ন হয়, তখন আধুনিক শিক্ষিত মানুষমাত্রই একধরনের মর্মবেদনায় ভুগতে শুরু করে দেন। তখন তারা তড়িঘড়ি এই মর্মে জবাব দিয়ে বলেন যে, বাইবেলের বা অন্যধর্মের ধর্মগ্রন্থের অনেক পরে কোরআন রচিত এবং সেই মুদ্দতে আরব বিজ্ঞানীরা গবেষণা ও বিজ্ঞানে বহু উন্নতি সাধন করেছিলেন। ফলে, কোরআনের বক্তব্য বৈজ্ঞানিক সত্যের অত কাছাকাছি হতে পেরেছে, ইত্যাদি।
অথচ, এই বক্তব্য রাখতে গিয়ে ওইসব শিক্ষিত ব্যক্তি বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের ইতিহাস একেবারেই ভুলে যান। সত্য বটে, মহান ইসলামী সভ্যতার আমলে মুসলিম বিজ্ঞানীরা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে ও গবেষণায় প্রভূত উৎকর্ষ অর্জন করেছিলেন। কিন্তু সেইসঙ্গে একথা আরো বেশি সত্য যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মুসলিম মনীষীদের সেই তরী সাধিত হয়েছিল কোরআন নাজিল হওয়ার শতাব্দী কয়েক পরে। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞানের ইতিহাস আরও জানায় যে, এই পুস্তকে মানুষের আবির্ভাব সম্পর্কিত যে বিষয়টি বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার জন্য গ্রহণ করেছি, অন্যধর্মের ধর্মীয়গ্রন্থের সময়কাল থেকে তো বটেই এমনকি বাইবেলের আমল থেকে শুরু করে কোরআন নাজিলের সময়কাল পর্যন্ত ওই। বিষয়ে আদৌ জ্ঞান-বিজ্ঞানের তেমন কোন গবেষণা কিংবা আবিষ্কার সাধিত বা সম্পাদিত হয়নি।
কোন কোন শিক্ষিত মহলকে আরো একটি কথা বলে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে দেখা যায়। কথাটা হল, কোরআনের বিজ্ঞান-সংক্রান্ত বাণী ও বক্তব্য সম্পর্কে এখন যে-সব কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো যদি সত্যি হয়ে থাকে, তবে কোরআনের। অনুবাদকর্মে কিংবা টীকা ভাষ্যমূলক গ্রন্থে সেগুলো উল্লেখ নেই কেন? এমনকি কোরআনের আধুনিক যে-সব অনুবাদ, তাফসীর ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণমূলক গ্রন্থ সেগুলোতেও এসবের কোন ইঙ্গিত-ইশারা তো দেখা যায় না। এর জবাব কোথায়?
অস্বীকার করার উপায় নেই, আধুনিক শিক্ষিত মহলের এসব বক্তব্য যুক্তিসঙ্গত এবং বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের নিকট এ ধরনের যুক্তি গুরুত্বপ্রাপ্তিরও হকদার। কোরআনের ফরাসী অনুবাদকর্মের কথাই ধরা যাক। অমুসলিম কোন পণ্ডিতের এমনকি বিজ্ঞ-অভিজ্ঞ কোন মুসলিম ভাষাবিদ-কর্তৃক সম্পাদিত কোরআনের ফরাসী অনুবাদেও বিজ্ঞান-সম্পর্কিত তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোন টীকা ভাষ্য, মন্তব্য কিংবা পর্যালোচনা অনুপস্থিত। (অপরাপর ভাষার অনুবাদকর্মেও এ কথা খাটে)। কারণ, আর কিছুই নয়, মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে ওইসব অনুবাদক ও ভাষ্যকার মূলত বিজ্ঞ-বিদগ্ধ ভাষাবিদ পণ্ডিত (কিন্তু আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের গবেষণা ও আবিষ্কার সম্পর্কে বলতে গেলে অনবহিত)। তাই দেখা যায়, কোরআনের যে-সব অনুচ্ছেদে বা অধ্যায়ে বিজ্ঞানের বিষয় বিদ্যমান বেশিরভাগক্ষেত্রে সে-সবের অনুবাদ হয় ভ্রান্তিপূর্ণ; নতুবা সে-সবের ব্যাখ্যা বিভ্রান্তিকর। সত্যি কথা বলতে কি, কোরআনের মত বিজ্ঞানময় একটি ধর্মগ্রন্থের অনুবাদের জন্য যা অত্যাবশ্যক, তাহল, আরবী ভাষার সুগভীর জ্ঞানের পাশাপাশি আধুনিক বিজ্ঞানের সবকয়টি শাখা-প্রশাখা সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। কোরআন-পাঠককে সর্বাগ্রে বুঝে নিতে হবে যে, কোরআনের মূল আরবীতে সঠিক কোন্ বক্তব্য ব্যক্ত করা হয়েছে; তারপর আসবে অন্যভাষায় বিজ্ঞান-বিষয়ক সেই বক্তব্যের যথাযথ রূপান্তর ও পরিস্ফুটনের প্রশ্ন।
কোরআনের বিজ্ঞান-বিষয়ক আয়াত বা অনুচ্ছেদের ভুল তরজমা ও বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের আরো একটি কারণ বিদ্যমান। সে কারণটি হল, আধুনিক অনুবাদক কর্তৃক আদিযুগের অনুবাদক ও ব্যাখ্যাকারদের অন্ধ-অনুসরণ। প্রচলিত ঐতিহ্যের ধারায় প্রাচীনযুগের অনুবাদক ও তফসীরকারদের টীকা টিপ্পনী, মন্তব্য, বক্তব্য ও বিশ্লেষণকে প্রায়ক্ষেত্রেই অভ্রান্ত, অলঙ্ঘনীয় ও অপ্রতিরোধ্য হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু প্রাচীনযুগের ওইসব তর্জমাকারী ও তাফসীরকারদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও মনীষার প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও বলতে হয় যে, তারা আধুনিক যুগের জ্ঞান-বিজ্ঞানের তথ্যানুসন্ধান, গবেষণা ও আবিষ্কার থেকে বহুদূরে অবস্থান করতেন। সেই প্রাচীনযুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আধুনিক যুগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, আবিষ্কার ও গবেষণা ছিল একেবারেই অভাবিত। ফলে, আধুনিক যুগের সেকুলার জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুশীলন ও চর্চা মানবজাতিকে যা-কিছু উপহার দিয়েছে তার আলোকে সে-যুগে বসে কোরআনের বিজ্ঞান-সম্পর্কিত কোন বাণী বা বক্তব্যের অর্থ ও তাৎপর্য উদ্ধার আক্ষরিক অর্থেই ছিল অকল্পনীয়। সে কারণে সে যুগের অনুবাদে ও ব্যাখ্যায় কোরআনের বিজ্ঞান বিষয়ক মূল শব্দের সঠিক অর্থ ও যথাযথ তাৎপর্য অনধিগত থাকাটা অস্বাভাবিক ছিল না মোটেও। আর এসব কারণে কোরআনের প্রাচীন ও আধুনিক অনুবাদ ও তফসীরসমূহ সম্পূর্ণ ভুল তরজমা ও অযথার্থ ব্যাখ্যা না হলেও কোন কোন বিষয়ে ও ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর অনুবাদ ও অসম্পূর্ণ ব্যাখ্যা হিসেবে চালু রয়েছে। বিভ্রান্তির এই বেড়াজাল থেকে কোরআনের বিজ্ঞান বিষয়ক বাণী ও বক্তব্যকে মুক্ত করতে চাইলে অনুবাদককে মূল আরবী ভাষায় কোরআন বুঝার মত ভাষাজ্ঞান ও পারদর্শিতা যেমন অর্জন করতে হবে; তেমনি তাঁকে একইসঙ্গে হতে হবে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সবিশেষ বিজ্ঞ ও যথার্থ অভিজ্ঞ।
কোরআনের অনুবাদ প্রসঙ্গ
প্রকৃতপক্ষে, আরবী ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করে মূল আরবীতে কোরআন অধ্যয়ন ও অনুধাবন করার পূর্বপর্যন্ত শুধু অনুবাদের মাধ্যমে কোরআনের বহু শব্দের ও আয়াতের অর্থ ও তাৎপর্য ড. মরিস বুকাইলির নিকট সুস্পষ্ট হয়নি। এরপর ড. মরিস বুকাইলি কোরআনের মূল আরবী শব্দের সঠিক অর্থ জেনে নেয়ার ব্যাপারে ব্রতী হলেন। আরবী ভাষা শিখলেন। অতঃপর আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের আলোকে কোরআনে ব্যবহৃত বিভিন্ন আরবী শব্দের মূল অর্থ ও তাৎপর্য অনুসন্ধানে মনোনিবেশ করলেন। এভাবে, শেষপর্যন্ত এই কোরআন থেকে বিজ্ঞান-বিষয়ক এমনসব তথ্য ও বক্তব্য তিনি পেয়েছেন–যেকোন বিচারে তা গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ বলে তার নিকট মনে হয়েছে।