বিহারী পর্ব

২৫. বিজ্ঞাপন একটি সৃজনশীল শিল্পকলা

‘বিজ্ঞাপন একটি সৃজনশীল শিল্পকলা’

বিজ্ঞাপনের সাথে পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। চট্টগ্রাম শহরে বাস করেছি জ্ঞান হওয়ার আগে থেকেই। রাস্তাঘাটে কত ব্যানার, কত পোস্টার হোরডিং দেখেছি— বিশেষ করে মনে পড়ে সিজার আর ক্যাপস্টান সিগারেটের। তারপর তিব্বত স্নো। হরহামেশাই চোখে পড়তো আমাদের।

এসব নিয়ে কখনো আলাপও হয়নি। আলোচনা তো দূরের কথা। তারপর এক সময় চলচ্চিত্রের পর্দায় দেখলাম, বেশ কিছু চলমান বিজ্ঞাপন— যেমন চা পাতা, সিগারেট, স্নো, রেল কোম্পানীর ইত্যাদি। রেডিওতেও শুরু হলো এক সময় কমার্শিয়াল সার্ভিস আর তাতে অগুণতি বিজ্ঞাপন।

আর এখন যে কত প্রকারের বিজ্ঞাপন প্রচার হয় তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কোনো কোনো বিজ্ঞাপন ভাল লাগে, কোনোটা মনে দাগ কাটে আবার কোনোটা খোরাক জোগায় হাসি-ঠাট্টার।

বিজ্ঞাপন যে একটি সৃষ্টিশীল শিল্প— এটা বুঝেছি অনেক পরে। কত রকমভাবে মানুষকে আপনি আকর্ষণ করতে পারেন আপনার দিকে, সেটাই মূল ব্যাপার। কতটা সংক্ষিপ্ত আকারে সৌন্দর্য বজায় রেখে বিশাল বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারেন-তার ওপর আপনার সাফল্য। আগে যাই হতো— এখন তো নাচ-গান, হৈ হল্লা সবই থাকে বিজ্ঞাপনে। সুন্দরীদের দিয়ে বিজ্ঞাপন নির্মাণের প্রবণতা সবসময়েই ছিল। যেমন ধরেন শেভ করার ব্লেড সেটাও মেয়েদের দিয়ে করা হয়— মডেল তার স্বামীর গালে হাত বুলিয়ে ব্লেডের প্রশংসা করছে। দুটো বিজ্ঞাপনের কথা আমার খুব মনে পড়ে। নির্মাতার বুদ্ধিমত্তা সত্যিই অতুলনীয়।

০১. এ্যারোমা চা। এটা পাকিস্তান আমলের বিজ্ঞাপন। সিনেমা হলে দেখতাম, ছোট নাটিকা হত এ্যারোমা চায়ের প্রশংসায়-তারপর বিশাল অক্ষরে টেলপ দেখাতো “এ্যাবোমা চা”। সঙ্গে অদৃশ্য কণ্ঠে শোনা যেত, এ্যারোমা চা, সেরা চা। এখানে আলোচনার খোরাক হয়েছিল এ্যারোমা বানানটা। র-এর ফোঁটা দেয়া হয়নি। প্রচুর, আলাপ আলোচনার পরও নয়। যতবার মানুষ বিজ্ঞাপনটি দেখতো ততবারই বলতো-এহ্, বানানটা ভুল করলো। এই যে ইচ্ছাকৃত ভুল এটাই বিজ্ঞাপনের সৃষ্টিশীল উদ্ভাবন।

০২. বেনসন এ্যান্ড হেজেস সিগারেট। এটা অবশ্যি আমার দেখা নয়, শোনা। ইংল্যান্ডে যখন ধুমপান বিরোধী ক্যামপেইন চালু হয়— সরকার আইন করেছিল সিগারেটের কোনো বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না। তখনই বেনসন এ্যান্ড হেজেস বিশাল বিশাল হোরডিং ঝুলিয়েছিল— যাতে বেনসনের প্যাকেটের ছবি দিয়ে লেখা ছিল— SMOKING CAUSES CANCER EVEN IF IT IS BENSEN & HEDGES! বুঝুন সৃষ্টিশীলতার দুরন্তপনা!! নিকট অতীতেও তো বিজ্ঞাপনের কার্যকারিতা দেখেছি আমরা FAIR & LOVELY-এর বিজ্ঞাপনের জেরে। মেয়েরা ফর্সা হবার জন্য দলে দলে ব্যবহার করছে তো বটেই, পুরুষরাও এই প্রডাক্টের বিক্রয় কয়েকগুন দিয়েছিল বাড়িয়ে।

বিজ্ঞাপন নিয়ে এত কথা বলার কারণ হলো— আমি নিজেও প্রচুর অনীহা সত্ত্বেও মডেল হয়ে গেলাম একসময়। টেলিভিশনে সেই আশির দশকে বলতে গেলে আমি জনপ্রিয়, নানান প্রোডাক্টের বিজ্ঞাপনের মডেল হবার প্রস্তাব আসতে শুরু করে। আমি একের পর এক প্রত্যাখ্যান করে চলেছি। কেন যেন এটাকে অপছন্দই করতাম। অনেকেই বলতো ভদ্র ফেরিওয়ালা। সেটাই হয়তো আমার মনকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল।

এক সময় রাজী হলাম। বিশেষ প্রয়োজনে। ১৯৮৮তে আমাদের গ্রুপ থিয়েটার নাগরিক লন্ডন যাবে নাটক করতে। সব ঠিকঠাক, কিন্তু আমার সে সময় একটু অর্থনৈতিক সমস্যা চলছিল— ব্যবসা করতে গিয়ে হাত প্রায় খালি-সে সময় প্রস্তাবটা এল Cute টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনের। সে সময় দশ হাজার টাকার প্রস্তাব। বেশ ভাল প্রস্তাব। হয়ে গেলাম রাজী— বোধহয় বিটিভির ক্যামেরাম্যান সমীর কুশারী নির্মাণ করেছিল বিজ্ঞাপনটি। অনেকেই প্রশংসা করেছিল বটে তবে অনেক বন্ধুবান্ধব টিটকারী দিল— শেষ পর্যন্ত ফেরিওয়ালা হলে বন্ধু!

মাঝে মধ্যে মন খারাপ হতো— কেন এটা করলাম— তবে সময়ের সাথে সাথে বদলে যায় সবই, আমার ধারণা আমাকে দেখে অনেকে লজ্জার বেড়া ডিঙ্গিয়ে মডেল হতে শুরু করলো। আমারও একটা সময় এল যখন আমি অন্যতম প্রধান মডেলে পরিণত হলাম। মনে হয় প্রয়োজনীয় এমন কিছু ছিল না যার মডেল আমি হইনি— একাধারে প্রকৌশল কাজে ব্যবহৃত প্রায় প্রতিটি নির্মাণ সামগ্রীরই মডেল হয়েছি আমি।

একবার উকিল নোটিশও পেলাম বিজ্ঞাপন করে। আমি বলেছিলাম-আমি প্রকৌশলী হিসেবে বলছি…..। ব্যাস প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানী একটি উকিল নোটিশ দিয়ে বসলো-উনি কি এটা ব্যবহার করেছেন? তাহলে কীভাবে বলেন এটা।

কেস বেশিদূর এগোয় নি। কারণ আমার প্রোডাক্টের মালিক যাঁরা, তাঁরা দ্রুত ওই লাইনটি বাদ দিয়ে দিলেন বিজ্ঞাপন থেকে। উকিল নোটিশ ওঁরাও হজম করেছিলেন।

অগুণতি বিজ্ঞাপনে অংশ নিয়েছি আজ অবধি। কোনোটা খুব ভালো হয়েছে আবার কোনোটা মোটেই ভাল হয়নি। এসবেরই দায়িত্ব হলো নির্মাতার। সে মডেলকে কীভাবে ব্যবহার করে সেটাই আসল ব্যাপার!

আমার প্রথম সুপারহিট বিজ্ঞাপন এ্যারাবিয়ান হর্স-মার্কা টিন বানিয়েছিলেন— মুনীর, Unitrend বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠানের অন্যতম কর্ণধার। আমার কথা ছিল— জালে গাব দিলে যেমন পানিতে পচে না, টিনে দস্তার ল্যাপ দিলে তেমনি জং ধরে না। এ ধরনেরই কিছু একটা ছিল, এরপর থেকে আমি Arabian Horse এর Brand Ambassador হয়ে গেলাম। অলিখিতভাবে অবশ্য। এই সেদিনও আবার নতুন বিজ্ঞাপন করা হলো। তবে দর্শক মনে রেখেছে “জিনিস যেটা ভালো, দাম তার একটু বেশি।’ এটাও Arabian Horse-এর বিজ্ঞাপন।

ও হ্যাঁ, আর একটি অত্যন্ত সহজ সরল কোনো জাঁকজমক ছাড়া বিজ্ঞাপনও সুপারহিট হয়েছিল— Mega Weighing মেশিন!

যাই হোক বিজ্ঞাপন নির্মাতা এবং প্রোডাক্টের মালিক সব সময় মডেল হিসেবে খোঁজেন জনপ্রিয় এবং বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তিদের-যেমন এখন আমরা দেখি খেলাধুলার জগতের অতি জনপ্রিয় খেলোয়াড়কে অত্যন্ত ব্যয়বহুল বিজ্ঞাপনে কাজ করতে। বর্তমান সময়ে প্রায় সকল চলচ্চিত্র এবং নাটকের (বিশেষ করে OTT-র শিল্পী) অভিনেতা অভিনেত্রীরাও ঝুঁকছেন এই শিল্পে কাজ করার জন্য। একটি কথা বলতেই হয়-বিজ্ঞাপন একটি কঠিন শিল্পমাধ্যম। কারণ— কম সময়ে কম কথায় দর্শককে কোনো বিশেষ প্রডাক্টের প্রতি আগ্রহী করতে হয় তাদের। আর যারা আমরা নাটক-সিনেমা করে বিজ্ঞাপনে যাই তাদেরও অভিনয়ের ধরণ পাল্টাতে হয়— ওই সময়ের মধ্যে সফলভাবে কথাগুলোকে তুলে ধরতে-সুন্দর ও কার্যকরী ভাবে।

বিজ্ঞাপন নিয়ে অনেক কথাই হলো— শেষে বলি— আমার মেয়েটিও (বিপাশা) যখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে— নানান প্রস্তাব এসেছিল বিজ্ঞাপনের জন্য-ক্রমাগত ভাবে এসেছিল। এক সময় সেও প্রবেশ করলো ওই জগতে। সবচেয়ে সফল ছিল তার LUX-এর বিজ্ঞাপন। এখনও তাকে নিয়মিত ডাকছে সবাই বিজ্ঞাপনের জন্য। সে এখন নিউইয়র্কে চিত্রশিল্পের জগতে নিমগ্ন, নতুন নতুন ভাবনাকে ক্যানভাসে রূপ দেয়া তার এখন প্ৰধান কাজ। চিন্তা-ভাবনা সবই অঙ্কন শিল্প নিয়ে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *