বিহারী পর্ব

২৪. বোকার বাক্স

বোকার বাক্স

টেলিভিশনকে অনেকে কেন বোকার বাক্স বলেন, আমার সঠিক ধারণা নেই। যারা এই বাক্সর অনুষ্ঠান দেখে তারা বোকা নাকি এই বাক্সর ভেতর যাদের দেখা যায় বোকা তারা। তা সে যেটাই হোক, আজ প্রমানিত যে এই বোকার বাক্সটার প্রতিই মানুষের অনেক টান। প্রায় সব ঘরে ঘরেই এর অবস্থান। দিনে একবার হলেও মানুষ এই বাক্সতে কি দেখাচ্ছে— সেটা দেখার জন্য যথেষ্ট আগ্রহ দেখায়।

একশ’ বছর আগে আমেরিকার স্যান ফ্রান্সিসকোতে যখন Philo Taylor Farnswath প্ৰথম টেলিভিশন ডেমন্সট্রেট করেছিলেন, তখন কি একবারো তাঁর মনে হয়েছিল যে এই যন্ত্রটি বিশ্বের ঘরে ঘরে স্থান করে নেবে একদিন!

এই দেশে টেলিভিশন এল ১৯৬৪তে। পাকিস্তান সরকার এই উপমহাদেশে প্রথম টিভি আনলেন এই দেশে। ঢাকা হলো বিশ্বের প্রথম বাংলা টিভি কেন্দ্র। আমি তখন বুয়েটের ছাত্র। পরিস্কার মনে আছে পাকিস্তান সরকার সর্ব প্রথমে হাজার বারোশ’ টিভি সেট বিনামূল্যে বিতরণ করেছিল-বাছাই করা কিছু প্রতিষ্ঠানে— তার মধ্যে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলোও। আমাদের শেরে বাংলা হলেও এল একটি। সন্ধেয়, সবাই জড়ো হলাম কমনরুমে টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখার জন্য। মনে পড়ে ফেরদৌসী রহমানের গানের অনুষ্ঠানের কথা!

ক্রমে ক্রমে নানান অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হলো। এক সময় নাটকও নিয়মিত প্রদর্শিত হতে লাগলো। এবং খুবই স্বাভাবিক কারণে আমারও মনে বাসনা জাগ্রত হলো আহা! যদি টিভিতে অভিনয় করতে পারতাম।

ইচ্ছা তো হলো কিন্তু সাহস তো হয় না। সাহস জাগতে জাগতে ১৯৬৭ পর্যন্ত সময় লাগলো। ফাইনাল ইয়ারে তখন আমি। দিলাম একটা দরখাস্ত আল্লার নাম নিয়ে। অডিশনের চিঠিও এসে গেল হাতে। দূরু দুরু বক্ষে হলাম হাজির ডিআইটি বিল্ডিং-এ টিভি স্টেশনে (পাকিস্তান টেলিভিশন কর্পোরেশন)। অভিনয় পরীক্ষার জন্য একটা পাতা ধরিয়ে দিল। মুখস্ত করলাম, কিন্তু বাতাসে একটা খবর উড়ে এলো-অডিশন নেবেন— জামান আলী খান। সেই সময়কার এক জাঁদরেল অনুষ্ঠান প্রযোজক। ওটা শোনার পর হার্টবিট রীতিমত গেল বেড়ে।

তারপর তো মোটামুটি বেশ অনেকটা সময় অপেক্ষার পর এল আমার পালা। TV Studio তে ঢুকে ক্যামেরা ট্যামেরা দেখে বেশ ভয় পেলাম সেটা অস্বীকার করবো না। তার পরেও আমার ধারণা audtion খারাপ দিইনি। হ্যাঁ, ভাল কথা, আমি যে অডিশনে গেছি, এ খবর মোটামুটি নিকটজনদেরও জানতে দিই নি। ভয় ছিল মনে মনে হয় কি না হয়। ফল এল মাস খানেক পরে। পাকিস্তান টেলিভিশন কর্পোরেশনের খামে সুন্দর প্যাডের কাগজে আমার নামে পত্র এল— ‘আমাদের কেন্দ্রে অভিনয়ের অডিশন দেয়ার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ, অনুগ্রহপূর্বক ছয় মাস পরে আবার চেষ্টা করুন।’

বড্ড হতাশ হয়েছিলাম সেদিন, কারণ নিজের অভিনয় ক্ষমতা সম্বন্ধে দারুণ কিছু ধারণা ছিল আমার! হা-হা-হা

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো আর কোনোদিন অডিশন দিতে হয়নি আমাকে— চেষ্টাও করিনি। BUET থেকে পাশ করে বেরুনোর পর ১৯৬৮ তে নাগরিক থিয়েটারের সাথে যুক্ত হয়ে যাই, (সেটা অন্যত্র ব্যাখ্যা করা হয়েছে) এবং সেই সূত্রে নাগরিকের প্রথম প্রযোজনা সফোক্লেসের ইডিপাস নাটকে অভিনয় করি, যা টিভিতে প্রচারিত হয় ১৯৬৯-এ। নাগরিকের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কবি জিয়া হায়দার তখন ঢাকা টেলিভিশন-এর অন্যতম প্রযোজক,– তিনিই আমাকে নিয়ে গেলেন একদিন প্রযোজক আতিকুল চৌধুরীর কাছে— এবং তখন থেকেই আমার নাম উঠলো ঢাকা টিভির অভিনয় শিল্পী হিসেবে। নাটকের নাম ছিল পান্ডুলিপি ও গহনার বাকস। আমার সাথে অভিনয়ে ছিলেন ফেরদৌসী মজুমদার এবং আলতাফ হোসেন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত দুতিনটে নাটকে খুচরা চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পাই, তবে স্বাধীনতার পর প্রথম যে নাটকটি বিটিভিতে প্রচার হয়— (ড. এনামুল হক রচিত আব্দুল্লাহ আল মামুন প্রযোজিত) তাতে একটি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। যদিও নিয়ম ছিল কোনো শিল্পী মাসে একটির বেশি নাটকে অভিনয় করতে পারবে না,— তারপরও দেখা যেত বিভিন্ন প্রযোজক বিশেষ অনুমোদন নিয়ে আমাকে তাঁদের নাটকে অভিনয় করাতেন, যার ফলে প্রায় প্রত্যেক মাসে দু-তিনটি নাটকেও আমি অভিনয় করেছি।

সে সময় যাঁদের কাজ করে আমি টিভি শিল্পী হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলাম— তাঁরা হলেন আব্দুল্লাহ আল মামুন, আতিকুল হক চৌধুরী, সৈয়দ সিদ্দিক হোসেন, মোহাম্মদ জাকারিয়া, মুস্তাফিজুর রহমান, মোস্তফা কামাল সৈয়দ-এবং বিশেষ করে মোস্তফা মনোয়ার।

সে সময় অসাধারণ সব নাটক নির্মিত হতো ঢাকা টেলিভিশনে। যেগুলো মনে আছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য— নীল দর্পন, মুক্তধারা, ডাকঘর, শেষ রক্ষা, রূপার কৌটা, নয়ন সমূখে তুমি নাই, নন্দিত নরকে, আগন্তুক, পদ্ম গোখরা, শিকার প্রভৃতি। আর একজনের কথা বলতেই হয়— মোমিনুল হক-যিনি তাঁর নাটকে (১৯৭২) এ প্রথম আমাকে প্রধান এবং কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ দেন।

টেলিভিশন কেন্দ্র চলে এলো ডি.আই.টি (রাজুক) ভবন থেকে রামপুরা, ১৯৭৩-এ সম্ভবত। এই টিভি স্টেশনের স্থান বদলের কারণে সেই সময় কয়েকটি নাটকে আমাদের সরাসরি (Live)-অভিনয় করতে হয়েছে। কারণ রেকর্ডিং মেশিনগুলো খুলে ফেলা হয়েছিল DIT থেকে, আর তখন ও নতুন মেশিন বসে নাই রামপুরায়।

এই সূত্রে মনে পড়ে গেল রামপুরা স্টুডিওর recording testing এর কথা। একদিন জি-এম মোস্তফা মনোয়ার আমাকে বললেন-

অমুকদিন একটু চলে আসবেন তো স্টুডিও তে।

কি জন্যে সেটা বললেন না।

গিয়ে দেখি তিন নম্বর Studio-র control room-এ তিনি অপেক্ষায়। অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার মেকআপ নিচ্ছেন।

ব্যাপারটা কি?

কিছুক্ষণ পরে বুঝলাম ঘটনা।

তিনি আমাদের বললেন-

আজ সারাদিন Studio আপনাদের। যা খুশি বলবেন দু’জনে ফিসফিস থেকে শুরু করে চিৎকার চেঁচামেচি সব, কাছে দূরে যেখানে থেকে খুশি।

মহা আনন্দে আমরা দু’জনে তাই করলাম। কখনও স্বাভাবিক কথা, কখনো উচ্চস্বরে ঝগড়াবিবাদ আবার কখনো প্রেমালাপ। প্রয়োজনীয় চলাফেরা সহ অবশ্য।

মোস্তফা মনোয়ার Control room থেকে নির্দেশনা দিচ্ছেন— আমাদেরকে ক্যামেরাম্যানদের, Sound recording, আলোক নিক্ষেপণকারীদেরকে।

সে এক মজার ব্যাপার হয়েছিল। সারাটা দিন হৈ হৈ করে কাটিয়ে একটা চেক নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম আমরা।

তারপর কমিশন হয়েছিল স্টুডিও-৩।

টেলিভিশনে অভিনয়ের জন্য হঠাৎ করে একবার ঘোষণা দেওয়া হলো জাতীয় পুরস্কার দেয়া হবে। সাল মনে করতে পারছি না। দু’বছর পরে অবশ্য তা অজানা কারণে বন্ধ হয়ে যায়।

তখন বিশেষ সূত্রে জেনেছি দু’বছরই আমার নাম মনোনীত হয়েছিল ওই পুরস্কারের জন্য। যদিও কপালে জোটেনি! নাম যে এসেছিল সেটাই বা কম কি? এ্যাঁ!

১৯৭৮ সনে হঠাৎ করেই লিবিয়া চলে গেলাম।

ফিরলাম ১৯৮১-র ডিসেম্বরে। তিন বছর পর। ফিরে এসে প্রথম দিনই গিয়ে হাজির হয়েছিলাম রামপুরা টিভি ভবনে। সবাইকে তাক লাগানোর জন্যে হয়তো বা, কিন্তু আসলে প্রানের টানে। নাটকের প্রতি আকর্ষণ আমার সেই ছোটবেলা থেকেই, কিন্তু টিভির প্রতি একটা আলাদা ভাল লাগা— আজও সেটা অনুভব করি আমি।

৮২ থেকে ১৯৯৬ অন্যান্য অনেক ঘটনার সাথে টিভির সাথে সম্পৃক্ততা ও বেড়েছে অনেক গুণ। প্রথমেই সরকারি চাকরি ছেড়ে বেসরকারি চাকরিতে প্রবেশ করলাম। ব্যাংকে ডলার, মোটা বেতন কোম্পানির সহায়তায় নিজে গাড়ির মালিক হলাম (লিবিয়াতেও মালিক ছিলাম), মঞ্চের ব্যস্ততা বাড়লো, সিনেমাতেও এক সময় পেশাজীবি হলাম, এক সময় বেসরকারি চাকরি ছেড়ে নিজেই পরামর্শক কোম্পানির মালিক হলাম-আবার ফিরে এলাম বেসরকারি কোম্পানির পরামর্শক প্রকৌশলী হিসেবে। কিন্তু সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো টেলিভিশনে অভিনয়ে ব্যস্ততাটা বেশি বেশি ঘটলো— নানান রকম সব চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেলাম— এই সময়টা টেলিভিশনে আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন নাওয়াজীশ আলী খান। অত্যন্ত সজ্জন একজন ব্যক্তি, তাঁর প্রায় সব কাজেই আমার উপস্থিতি অবশ্যই ছিল। আজও নাওয়াজীশ আমার খুবই কাছের মানুষ। খুব সম্ভবত ৮৪ সনের দিকে হুমায়ুন আহমেদ এলেন আমেরিকা থেকে। নওয়াজীশ তাঁর প্রথম নাটক প্রযোজনা করলেন যার প্রধান চরিত্র ছিল আমার। এবং ওই নাটক থেকেই হুমায়ুনের সাথে আমার পরিচয়। প্রথম নাটকেই সাড়া পড়ে গেল দর্শক মহলে। অন্যান্য প্রধান শিল্পীগণ ছিলেন— লাকী ইনাম, আরিফুল হক এবং রানী সরকার।

সেই সময় থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত অর্থাৎ প্যাকেজ নাটকের জন্ম পর্যন্ত বাংলাদেশ টেলিভিশনে অনেক সুন্দর সুন্দর নাটক প্রযোজিত হয়েছে— এবং আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজগুলোও (TV তে) ওই সময়ের মাঝেই করেছিলাম বা করার সুযোগ হয়েছিল। বিভিন্ন ধরনের নাটকে বিভিন্ন রকমের চরিত্র। কম বয়সের রোমান্টিক হিরো থেকে শুরু করে ৯০ বৎসরের বৃদ্ধ— কোনো কিছুই বাদ যায়নি। আমার অভিনয় জীবনে আমি টেলিভিশনের এই সময়ে যতটা ঋদ্ধতা লাভ করেছি, তা অন্য কখনো হয়নি। আমার অত্যন্ত প্রিয় যেসকল প্রযোজকদের কাজ আমি ওই সময়টাতে করেছি, তাঁরা হলেন আব্দুল্লাহ আল মামুন, আতিকুল হক চৌধুরী, নওয়াজীশ আলি খান, মুস্তাফিজুর রহমান, মোস্তফা কামাল সৈয়দ, মোহাম্মদ বরকতউল্লাহ। বলতে গেলে বিটিভির স্বর্ণযুগের নাটকের একজন অন্যতম প্রধান সৈনিক ছিলাম। প্রযোজক বরকত উল্লাহর সকাল-সন্ধ্যা নাটকের মাধ্যমে ধারাবাহিক নাটকেরও শুরু হয়েছিল রবরবা জনপ্রিয়তা। ঢাকায় থাকি, এই সব দিন রাত্রি, বহুব্রীহি, অয়োময়, কেউ কোথাও নেই, বারো রকমের মানুষ সবগুলো সিরিয়ালই মানুষের মন কেড়ে নিয়েছিল। আমার অভিনয় ছিল এই সব দিন রাত্রি, বহুব্রীহি, অয়োময়, বারো রকমের মানুষ এ। প্রথম তিনটি হুমায়ুন আহমেদের লেখা। হুমায়ুন তখন বিটিভির দর্শকের হটকেক। প্রতিটি নাটকই সুপার হিট। নানান ধরনের নাটক লিখেছেন তিনি। কমেডি থেকে শুরু করে কঠিন মর্মস্পর্শী কাহিনি তিনি লিখেছেন বিটিভির জন্যে। প্রায় সবই মধ্যবিত্তের জীবন কাহিনী।

ও হ্যাঁ, আর একটি ধারাবাহিকের কথা বলতেই হয়— সংশপ্তক-আব্দুল্লাহ আল মামুনের তৈরি এপিক প্রযোজনা। আর একটি তারও আগে অভূতপূর্ব সাড়া জাগানো— হুমায়ুন ফরিদীর অসাধারণ অভিনয় সমৃদ্ধ সেলিম আলদীনের লেখা নাটক। নামটা একদম মনে করতে পারছিনা। আরও হয়তো অনেক নাটকের নাম উল্লেখ করতে পারলাম না। স্মৃতি তো দুর্বল হয়েছে-ম্যালা! তবে আমার অভিনীত দর্শকনন্দিত নাটক ছিল যেগুলো-ডাকঘর, আগন্তুক, শেষরক্ষা, মুক্তধারা, মুহূর্ত, খেলা, শিকার, তার মধ্যে মনে পড়ছে-খেলা, দ্বিতীয় জন্ম, একাএকা আরও অনেক অনেক। মনে নেই একদম মনে পড়ছে না! ১৯৯৫ এ এল প্যাকেজ শিল্প, নাটকের জন্য বিশেষভাবে। অর্থাৎ সরকারি স্টুডিওর বাইরে নাটক নির্মাণ করে, বিটিভিকে দিলে তারা গুনাগুন বিচার করে কিনে নিয়ে প্রচার করবে। আমার সুযোগ হয়েছিল প্রথম প্যাকেজ নাটকটিতে অভিনয় করার। মাসুদ রানার লেখক সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের রচনায় প্রাচীর পেরিয়ে নাটকটি পরিচালনা ও প্রযোজনা করেছিলেন আরেফিন বাদল, (প্রকৃতপক্ষে পরিচালক ছিলেন আতিকুল হক চৌধুরী)

এক সময় আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম প্যাকেজ TV নাটকের শিল্পে। একধারে অভিনয় এবং নাট্যরচনা এবং এক সময় পরিচালনায় ও হাত দিলাম। ও হ্যাঁ, আমি এক সময় বিটিভিতেও নাটক লিখতে শুরু করি। আমার লেখা বন্দী নাটক অত্যন্ত জননন্দিত হয়েছিল— যাতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিল আসাদুজ্জামান নূর, লতা, হৃদি হক এবং নাতাশা হায়াত— এটা সেই ১৯৮৬-র দিকের কথা।

প্যাকেজে চ্যানেল আই-এর কল্যাণে আমি পরিচালক হলাম এবং ক্রমেই নাট্যকার হিসেবেও জনগণের কাছে পরিচিত হলাম। আমার পরিচালিত প্রথম নাটক-প্রণব ভট্টের লেখা হারজিৎ। অভিনয়ে ছিল আলী যাকের, শর্মিলী আহমেদ, তৌকির, ঈশিতা ও বিপাশা। ইস্। সুপার হিট। ব্যাস চ্যানেল পেয়ে গেল আমাকে। আমিও একটি জায়গা পেলাম নিয়মিত কাজ করার। চাকরি বাকরি ছেড়ে দিয়ে ফুলটাইম ভিডিও মিডিয়ার ফ্রিলান্সার হয়ে গেলাম। সেই সময় আমার লেখা ও পরিচালিত কয়েকটি নাটক বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল—।

—হারজিৎ, প্রত্যাশা, আপদ, ধিক লক্ষবার, চখাচখি প্ৰভৃতি।

জীবনের চাকা ঘুরতে লাগলো দ্রুতই। আমি ক্রমেই চলচিত্র হতে সরতে শুরু করলাম। রাতদিন ব্যস্ত হয়ে পড়লাম Vidio তে। একের পর এক নাটকে অভিনয় চলেছে— সঙ্গে নাট্য রচনা আর পরিচালনা।

যোগাযোগ হয়ে গেল ইউনিসেফের সঙ্গে— তাদের জন্য ধারাবাহিক নাটক বানালাম জোৎস্নার ফুল, শুকনো ফুল রঙ্গীন ফুল, আলো আমার আলো, বেবী জিংক, তেরো পাতার বুদ্ধি, সাত সমুদ্র, সবশেষে বনফুলের গান (৭৫ পর্ব)।

প্রথম ধারাবাহিক ছিল আমার পরিচালায় –দোলা, আখতার ফেরদৌস রানার লেখা, এরপর করলাম মইনুল আহসান সাবেরের লেখা দূরের আকাশ, পঞ্চাশ পর্ব। তারপর সাড়া জাগানো বন্ধন। তখন অভিনেত্রী মিমি প্রোডাকশন হাউজ খুলে নাটক প্রযোজনা শুরু করে। বন্ধন যাদের পরিচালনা করার কথা ছিল, তারা ৩০ পর্ব পর্যন্ত করে পিঠটান দেয়ায় মিমি আমাকে অনুরোধ করে। আমি তখন ওই নাটকের অভিনেতাও ছিলাম। রাজী হলাম এবং একটানা ১৪৪ পর্ব পর্যন্ত পরিচালনা করলাম, মাঝে আবার অসুস্থতার (হার্ট অ্যাটাক) কারণে মিমি এবং অম্লান বিশ্বাস দু-চার পর্ব চালিয়ে নিয়েছিল। ব্যস্ততা যখন দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পেতে শুরু করলো, এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যখন আমকে পরিচালক হিসেবে চাইতে শুরু করলেন তখন আমি আর আমার প্রধান সহকারি গোলাম হাবিব লিটু, একটা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান খুলে ফেললাম ‘কারিগর’ নির্মাতা গ্রুপ। আমার নির্মিত বেশিরভাগ কাজই বিশেষ করে ইউনিসেফের সব কাজই আমরা ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেই নির্মাণ করি। কাজ এখনও করছি এই প্রতিষ্ঠানের নামে। প্রতিষ্ঠান চলমান এখনও, তবে কাজের পরিমাণ কম। আমার নিজের লেখা অভিনয় এবং নির্মাণ-মূলত কাজের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য দ্বিতীয় বাসর, শেষ পত্র, মধ্যাহ্ন ভোজ কি হবে, শোধ, টাইম ব্যাংক, আমি কান পেতে কই, খাঁটি সোনা, সাক্ষাৎকার, হাত বাড়িয়ে দাও ইত্যাদি। ধারাবাহিক-বকুলপুর কতদূর, মোহর, পলাতক, প্রভৃতি, শান্তিলয় নির্মাণ করেছে অম্লান বিশ্বাস।

কথাটা খুবই ক্লীশে শোনাবে, তবুও বলি কাজ করি শুধু আনন্দ পাওয়ার জন্যে এবং আনন্দ দেওয়ার জন্যও অবশ্যই। সংখ্যাটা কখনো হিসেব করার কথা মনেও হয় না। তাও বলি টিভি নাটকে অভিনয় অসংখ্য, নির্মাণ ও দেড়শ দুশো তো হবেই। রচনাও অনেক-সংখ্যা বলতে পারবো না।

চ্যানেল আই-এর ফরিদুর রেজা সাগর আর শাইখ সিরাজের অনুরোধে তাদের অনুপ্রেরণায় নাটক (ইমপ্রেস টেলিফিল্ম) নির্মাণ শুরু করেছিলাম। এখনও সেটা করে যাচ্ছি। বিশেষ করে Channel আই-এর জন্য ঈদ-বকরী ঈদে অবশ্যই আমার নাটক প্রচারিত হচ্ছে— আমি ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ তাদের প্রতি, বিশেষ করে ফরিদুর রেজা সাগরের প্রতি।

দেশের মোটামুটি সব শিল্পীই আমার সাথে কাজ করেছেন— সেই বরেণ্য শিল্পীবৃন্দ-গোলাম মুস্তফা, সৈয়দ হাসান ইমাম, সিরাজুল ইসলাম, আবুল খায়ের থেকে এই সেদিনকার নতুন নায়ক নায়িকারাও আমার সহশিল্পী।

আর একগুচ্ছ নায়িকাও রয়েছেন আমার – যাঁদের কথা বিশেষ ভাবেই বলতে হয়। দিলারা জামান, শর্মিলী আহমেদ, ডলি জহুর, ওয়াহিদা মল্লিক জলি, চিত্রলেখা গুহ, বিশেষভাবে উল্লেখ্য।

আমার টেলিমিডিয়ার কাজের (নির্মাণ) ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে আমি কৃতজ্ঞ আমার প্রধান সহকারি (পরে পার্টনার) গোলাম হাবিব লিটু, এবং তারই অনুজ— অন্য সহকারি গোলাম মওলা পুটুর কাছে। তাদের অনেক অনেক অবদান আমার কাজগুলোতে।

আর কার কথা বলবো-‘মিডিয়ার প্রতিটি ব্যক্তিই’ আমার সকল কাজের অংশীদার। সেই প্রোডাকশন বয় থেকে শুরু করে editor পর্যন্ত সবাই আমার সহকর্মী তিরিশ বছরের প্যাকেজ লাইফে। সবার কাছে আমি ঋণী আর কৃতজ্ঞ তাদের প্রতি। সবার সাথেই আমার সবসময় আন্তরিক সম্পর্ক, সবার ভালোবাসাই আমার সকল কাজের সহায়ক। আর দেশের মানুষ, তাঁদের আকুণ্ঠ ভালোবাসায় আজ আমি এখানে!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *