মার্কনীর বেতার তরঙ্গে আমি
THE CONNECTION AND INTIMACY OF LISTENING TO A VOICE THAT IS SPEAKING DIRECTLY TO YOU.
আমি মোটামুটি অভিনয়-এর সব ক’টি মাধ্যমেই জড়িয়ে পড়েছিলাম এক সময়। টেলিভিশন তো এল সেই ১৯৬৪তে। তখন প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আমি।
সেই আমার সিনিয়র এক ছাত্র আমার দৃষ্টি কেড়েছিলেন, তাঁর নাম সিরাজুল মজিদ মামুন। প্রথম বর্ষে নাটক করতে গিয়েই তাঁর সাথে পরিচয়। পাতলা টিংটিঙ্গে শরীর, চোখে মোটা লেন্সের চশমা, কণ্ঠটা ছিল কিন্তু দরাজ। ওঁর কণ্ঠ শুনে কে একজন যেন বলেছিল-এতটুকু যন্ত্র হতে এত শব্দ আসে কী ভাবে!!
সেই মামুন ছিলেন ঢাকা বেতারের একজন জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ঘোষক। প্রতিদিনই শোনা যেত তাঁর কণ্ঠ বেতারে। আর সত্যিই হিংসায় জ্বলতাম-আহা যদি বেতারে কণ্ঠ দিতে পারতাম! এর মধ্যে আরও কয়েকটি নাটক আমরা এক সাথে করেছি। সে সময় নাটকের ব্যাপারে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ছিল খুব। আমি, মামুন, গোলাম রাব্বানী, জামালুদ্দিন হোসেন এবং আবুল কাশেম— এ ক’জনের একটা ছোটখাট দল হয়ে গিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্ররা মজা করে আমাদের বলতো ঘেঁটুপার্টির সদস্য। তো কোনো এক নাটকে মামুন আর আমি নানা নাতির অভিনয় করেছিলাম, আর তখন থেকে আমাদের সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল নানা-নাতি। দু’জন দুজনার নানা। নানা অবশ্যি আর নেই বিদেশের মাটিতে চির শান্তির রাজ্যে প্রস্থান করেছেন। (ইন্না লিল্লা…)
নানার মত রেডিওতে ঢোকার প্রবল ইচ্ছায়, একবার ছুটিতে চট্টগ্রাম গিয়ে দরখাস্ত দিয়েছিলাম চট্টগ্রাম বেতারে নাট্য শিল্পী হিসেবে অর্ন্তভূক্ত হওয়ার জন্য। চিঠিও পেয়ে গেলাম। সময়মত হাজির হলাম আগ্রাবাদে বেতার অফিসে। আমার সঙ্গে বেশ ক’জন এসেছিলেন অভিনয়ে অংশ গ্রহণ করতে।
যাওয়ামাত্র আমাদের দু’পাতার একটি Script ধরিয়ে দেয়া হলো পড়ার জন্য। পড়ে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে পরীক্ষায় দাঁড়াতে, মাইক্রোফোনের সামনে। এক সময় ডাক এল। নার্ভাস হলেও মনে হলো বেশ ভালই দিয়েছি পরীক্ষা। দুটো চরিত্রের কথোপকথন ছিল Script-এ। একজন বৃদ্ধ অসুস্থ, অন্যজন যুবক, সামান্য উত্তেজিত। কণ্ঠে এই পার্থক্যটা কে কতটা আনতে পারে সেটাই ছিল পরীক্ষকের লক্ষ্য। সেদিন অডিশন নিয়েছিলেন প্রোগাম ম্যানেজার নুরুন্নবী খান। পরবর্তীতে কত কাছের মানুষ ছিলেন আমার।
আমাকে, পড়া শেষ হওয়া মাত্র বলা হলো, অন্য এক কক্ষে অপেক্ষা করতে। অপেক্ষার ফল ফলল। আমি পাশ অভিনয় শিল্পী হিসেবে। সেটা বোধকরি ১৯৬৩ কি চৌষট্টিতে। কিন্তু ওই পাশ করা পর্যন্তই। প্রোগ্রাম তো পাই না। কি করে পাবো, আমি তো থাকি ঢাকায়, চট্টগ্রামে আমাকে ওরা ডাকবে কেন? সে রকম কেউকেটা আর্টিস্টএর ক্ষেত্রে অবশ্য অন্য ব্যাপার।
পয়ষট্টিতে লেগে গেল পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ। বেশ কিছুদিন চললো হৈ হৈ কাণ্ড। দুপক্ষই দাবী করছে— তারা জিতছে, হারছে প্রতিপক্ষ। আমাদেরও নানা রকম ভারত বিরোধী সব সভা, প্রসেশন, বক্তৃতা চলছে— যুদ্ধ কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানেই চলছিল, কিন্তু এখানে সিভিল ডিফেন্সের নানারকম মহড়া চলছিল নিয়মিত।
যুদ্ধ একসময় শেষ হলো। মনে হলো উভয় পক্ষই বিজয়ী! তাই নিয়ে নানান উৎসব আনন্দানুষ্ঠান। আমি তখন বেড়াতে গেছি চট্টগ্রামে, ছুটিতে। আমার বন্ধুরাও একটি অনুষ্ঠান করছে— যুদ্ধে আমাদের সৈন্যদের বাহাদুরী নিয়ে-ভারতীয়দের পরাজয় হয়েছে কীভাবে— সেটি ছিল অনুষ্ঠানে মূল লক্ষ্য। এটা ছিল একটি ‘শ্যাডো ড্রামা’, সাদা পর্দা লাগিয়ে, পেছন থেকে আলো ফেলে— শারীরিক নড়াচড়া Sound effect ইত্যাদি।
বন্ধু মনসুর বললো— ‘রবি তুমি পেছন থেকে ধারাবর্ণনা দেবে।’ ওকে তাই সই। পোলোগ্রাউন্ডে ওয়াজিউল্লাহ ইন্সটিটিউটের মিলনায়তনে হলো অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান শেষে চট্টগ্রাম বেতারের সংবাদের প্রযোজক মি. জামান এলেন আমার কাছে এক প্রস্তাব নিয়ে- বেতারে খবর পড়বেন?
আমি? খবর পড়বো?
হ্যাঁ, আপনার কণ্ঠ খবরের জন্য খুব সুইটেবল।
এরপর নানান কথাবার্তার পর হয়ে গেল Contract। সাতদিন সন্ধেয় আমি খবর পড়বো চট্টগ্রাম বেতারে, অফিসে গিয়ে সব সই-সাবুদ হলো।
তখন বোধকরি শীতকাল। খবর ছিল সাতটায়। যেতে হলো ৪টায়। কারণ টেলিপ্রিন্টারে যে খবর আসতো, তা ছিল ইংরেজিতে। আর আমি খবর পড়বো বাংলায়। সুতরাং আমাকেই অনুবাদ করতে হবে। আমি তো মাথায় হাত দিলাম। এ কঠিন সংবাদের ভাষা অনুবাদ করা তো চাট্টিখানি কথা নয়।
কিন্তু করতে হবেই। দলিল সই করেছি যখন। English to Bengali ডিকশনারী চাইলাম। প্রযোজক বললেন— ডিকশনারি তো নেই, কাল রাওয়ালপিন্ডিতে রিকুইজিশন দিয়ে দেব। এসে যাবে।
পরবর্তী সাত দিনে সেটা আসেনি এবং আমি আগ্রাবাদের আমার বন্ধু নাসিরের বাসা থেকে প্রতিদিন ডিকশনারি নিয়ে যেতাম-দিয়ে যেতাম।
যেভাবেই হোক ভালোই ভালো পার করে ফেললাম ছ’দিন। বন্ধুমহলে আমার একটু বাড়লো স্ট্যাটাস। সবাই প্রশংসা করলো। অফিসিয়ালিও নন্দিত হলাম ভাল খবর পাঠের জন্য। কিন্তু বিপদ ঘটলো সপ্তম ও শেষ দিন। সেদিন খবর একটু বেশি ছিল, আর খবর পৌঁছাচ্ছিল শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। আমাকে সাহায্য করছিলেন প্রযোজক স্বয়ং। শেষ মুহূর্তে হুড়োহুড়ি করে রওয়ানা হলাম নিউজ বুথের দিকে।
একটু বলে রাখি, খবরগুলো আসতো, টেলিপ্রিন্টারে থিন (পাতলা) কাগজে। আমরাও (আমি আর এক উর্দু সংবাদ পাঠক) অনুবাদ করে লিখতাম থিন পেপারেই। তারপর সেই থিন পেপারটি জেমস ক্লিপের সাহয্যে আটকাতাম একটি হার্ড পেপার বোর্ডে। এভাবে সাত থেকে দশটা বোর্ড হতো আমাদের। যাতে সহজে পৃষ্ঠা বদল সম্ভব হতো কোনো রকম শব্দ বা কসরৎ ছাড়া।
সেদিনও ন’দশটা বোর্ড ছিল। তিন তলা (কিংবা দোতলায়)য় ছিল নিউজ বিভাগ। লেখা হয়ে গেলে আমাদের সংবাদ পাঠ করার জন্য আসতে হতো গ্রাউন্ড ফ্লোরে সংবাদ বুথে। বুথে যখন ঢুকলাম তখন ৭টা বেজে কয়েক সেকেন্ড পেরিয়ে গেছে। ঝটপট ঢুকে শুরু করলাম পাঠ। প্রায় হাঁফাতে হাঁফাতেই।
ঠিক ঠাক পড়ছিলাম। সবই যথাযথ অবস্থানে, কিন্তু শেষ পাতাটি যখন পড়ার জন্যে হাতে নিলাম— দেখি দরজায় ক্যাচ শব্দ করে বুথে ঢুকলেন প্রযোজক। অবাক আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে-তিনি ঢুকেই আমার বোর্ডটি (শেষটা) টেনে নিতে চাইলেন। আমিও টেনে ধরলাম দেব না। দুজনের মধ্যে নিশব্দ টানহেঁচড়া। বিজয়ী আমিই হলাম এবং ধীরকণ্ঠে শেষ পাতাটি পড়ে ফেললাম।
প্রযোজক সাহেব নিজ কপালে একটি চপেটাঘাত করে মাথায় হাতদিয়ে বসে পড়লেন। অবাক আমি, হলো কী?
সর্বনাশ হলো হায়াত সাহেব।
আমি না বুঝে বোকার মত তাঁর দিকে হাঁ করে চেয়ে রইলাম।
তারপর শুনলাম বৃত্তান্ত। সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় আমার হাত থেকে একটি বোর্ড স্লিপ করে পড়ে গিয়েছিল। সেটা ছিল শেষের আগের পাতা (উনশেষ পাতা)। এই উনশেষ আর শেষ পাতা মিলে একটি খবর ছিল চট্টগ্রামের কোনো এক জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বের মৃত্যু ও জানাজার খবর। তার আগের খবরটি ছিল, গভর্ণর মোনেম খানের। তিনি কোনো অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেছেন বা কিছু উদ্বোধন করেছেন সেখানে প্রচুর মানুষ জড়ো হয়েছিল।
খবরটি এমন ছিল— অনুষ্ঠানের শেষে প্রচুর মানুষ একত্রিত হন মাননীয় গভর্নরকে এক ঝলক দেখতে। তার পরের পাতায় চট্টগ্রামের ব্যক্তিত্বের গুনগান ইত্যাদি। সেই পাতা পড়ে গিয়েছিল হাত থেকে।
শেষ পাতায় ছিল— সবাই দুহাত তুলে এক যোগে তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন। যার অর্থ দাঁড়ায়— গভর্ণর মোনেম খান উদ্বোধন করেন অনুষ্ঠান। সেখানে প্রচুর জনসমাগম হয় তারা সকলে দুহাত তুলে তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামরা করেন।
ওই শেষ খবর পড়া। কান ধরে ক্ষমা চেয়েছি। ভাই এ আমার কর্ম নয়। ছোটবেলা থেকে রেডিওর প্রতি একটা আকর্ষণ আমার ছিল, হয়তো সবার বেলায় তাই-ই হয়। বাসায় তো ছিল না। পাড়ার রেস্টুরেন্টে একটা ছিল আমরা ক্রিকেট কমেন্ট্রি শুনতাম। মালিক ছিলেন রেলেরই কর্মচারি মালেক চাচা। তাঁর হাতে পায়ে ধরে কমেন্ট্রি শুনতে হতো— কারণ সাধারণ গ্রাহকরা তো আর এটা শুনতেন না,-তাঁরা হিন্দি সিনেমার গান— বিবিধ ভারতী স্টেশন, আর রেডিও সিলোন। সারাদিন গান চলতো এসব স্টেশনে।
একদিন হঠাৎ দেখি আব্বা একটি রেডিও নিয়ে এলেন। ফিলিপস। খুব সুন্দর দেখতে। সঙ্গে আবার একটি টেবিল। যার ওপর রেডিওটি একটি বাক্সের মত খোপে থাকবে, তখন বোধহয় সেভেন কি এইটে পড়ি। সে কী আনন্দ রেডিও পেয়ে। বিনাকা গীতমালার ভক্ত তখন আমি। পাশের বাসায় আমাদের আগেই রেডিও এসেছিল-সেখানে গিয়ে বুধবার রাত দশটায় (?) এক ঘণ্টার অনুষ্ঠান শুনতাম। আর ক্রিকেট কমেন্ট্রির কথা তো বললামই।
আব্বা রেডিওটি কিনেছিলেন কোনো রেল অফিসারের কাছ থেকে। সেকেন্ড হ্যান্ড। হোক পুরোন, রেডিও তো, তাতেই আনন্দে আটখানা। আমার পড়ার টেবিল হয়ে গেল ওই রেডিওর টেবিলটা। এমনিতে পড়াশুনার প্রতি আজন্ম অনীহা, তারপর রেডিও, বুঝতেই পারছেন! পড়ার টেবিলের চেহারাটাও যেন গেল পাল্টে।
সেই রকম একটা যন্ত্রের ভেতর থেকে আমার কণ্ঠ শোনা যাবে-সে যে কী এক মানসিক অবস্থা! আমি যেদিন খবর পড়তাম, শুনেছি— আম্মা আমি বাসা থেকে বেরুনোর সঙ্গে সঙ্গেই রেডিও চট্টগ্রাম খুলে বসে থাকতেন!
তো হ্যাঁ, খবর পড়ার ওই বিপদের পর আর ওপথে যাইনি। ঢাকা বেতারে নাটকের অডিশন দিতে চেয়েছিলাম— ওরা বললো, তোমার অডিশন প্রয়োজন নেই, কারণ চট্টগ্রাম বেতারে তুমি ইতিমধ্যে অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেছ।
ব্যাস, এই পর্যন্তই। নাটকে তো কেউ ডাকে না। ডাকবে কেন? কেউ কি আমাকে চেনে? চেনাজানা না হলে ওসব যায়গায় শুরু করাটা সত্যিই কঠিন। একবার ঢুকে গেলে— তারপর আপনি আপনার নিজস্ব মেধা আর দক্ষতায় স্থান করে নিতে পারবেন।
কেউ না ডাকলেও একটি নাটকে অভিনয়ের সুযোগ পেলাম। ওই যে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় আমার থিয়েটার গ্রুপ-সেখান থেকে রেডিওতে একটি নাটক প্রযোজিত হলো-কবি নাট্যকার জিয়া হায়দার রচিত ও নির্দেশিত নাটক-শুভ্রা সুন্দর কল্যাণী আনন্দ, এইটি আমার প্রথম নাট্যাভিনয় রেডিওতে।
এর মধ্যে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। তখন তো প্রায় গৃহবন্দী আমরা। অসুস্থতার কারণে যুদ্ধে যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না বলেছি আগে।
শশুরবাড়ি ছিলাম জুন পর্যন্ত। তখন বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন সবার সাথেই ছিলাম যোগাযোগহীন। এমনকি একটি রেডিও না থাকায় খুবই অসহায় মনে হতো— যে, অন্তত আকাশবানী কলকাতার অনুষ্ঠান শুনলেও তো দেশের খবরটা পাওয়া যায়। দোকান বা অন্য কারো বাড়িতে তো নিশ্চয় ছিল, কিন্তু আমি একদমই বেরোতাম না।
ঢাকায় এলাম জুনের প্রথম দিকে, আম্মা আমার স্ত্রীর হাতে ২০০ টাকা দিয়ে বললেন, তোমরা একটা রেডিও কেনো। আম্মা তখন আব্বার অফিস থেকে পেনশন পেতেন। কিনলাম একটা ট্রানজিষ্টার। মনে আছে— দাম ছিল একশ’ নব্বই টাকা। আসলে মনটা ছটফট করতো আমাদের স্বাধীন বাংলা বেতার শোনার জন্য। সেটাই শুরু হলো। দরজা জানালা বন্ধ করে খুব নীচু ভলিয়ুমে কাঁথার তলে ঢুকে শুনতাম এই কেন্দ্রের অনুষ্ঠান।
জল্লাদের দরবার খুব জনপ্রিয় নাটক ছিল তখন, আর শুনতাম এম আর আখতার মুকুলের ‘চরমপত্র’। উহ্ সেকী উন্মাদনা এই দুটো প্রোগ্রাম শুনে। তারপর বিজয় দিবসের প্রাক্কালে— যখন ভারতীয় বিমান এলোপাথাড়ি বোম ফেলতে শুরু কালো ঢাকায়-আমরা মালিবাগের বাসা থেকে বেরিয়ে আশ্রয় নিলাম শান্তিনগরে আমার এক মামার (ঠান্ডু) বাসায়। বাসা ছাড়ার কারণ মালিবাগের পাশেই ছিল মগবাজার ওয়ারলেস। যেটা দখলে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের। সুতরাং এখানে বোম পড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকায় আমরা গিয়েছিলাম এলাকা ছেড়ে।
শুধু বাসা ছেড়ে যাওয়াটার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ওই ট্রানজিস্টারটি বগলে পুরে নিয়েছিলাম-এবং তখনকার উত্তেজনা-কী আর বলবো? একদিকে মামার বাসার TVতে দেখছি ভারতীয় বিমানবাহিনীর (ধরাপড়া) ছবি ও কথা, অন্যদিকে স্বাধীনবাংলা বেতার-এর মুক্তিযোদ্ধাদের এগিয়ে আসার সংবাদ— তার ওপর আকাশবানীতে ভারতীয় জেনারেলের হুশিয়ারী-পাকিস্তানি জেনারেলকে আত্মসমর্পণ করার জন্য-
সে যে কী একটা উত্তেজনাকর পরিস্থিতি— কিন্তু আমরা প্রতিটি মুহূর্তে আপডেট হচ্ছিলাম। তারপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ— রেসকোর্সের ময়দানের জেনারেল নিয়াজীর আত্মসমর্পণ! সবই তাৎক্ষণিকভাবে জেনেছি রেডিওতে।
আহা রেডিও! বেতার! মার্কনী সাহেবের প্রতি সেলাম।
দেখেন ধান ভাঙতে শিবের গীত গাইতে বসেছি আমি।
হ্যাঁ, এরপর আমি রেডিওতে তালিকাভুক্ত হলাম। বিজয় অর্জনের ক’দিন পরই টিভিতে আব্দুল্লাহ আল মামুনের কাছ থেকে ডাক পেলাম নাটকের জন্য-ঠিক সমসাময়িক সময়ে রেডিওর নাটকেও ডাক এলো— অভিনেতা নির্দেশক সিরাজুল ইসলামের কাছ থেকে। সেই আমার প্রথম রেডিওতে আগমন জানুয়ারি ১৯৭২-এ।
তারপর আর কী, তার আর পর নেই। চলতে লাগলো সব মিডিয়াতেই পদচারণ। এক সময় তালিকাভুক্ত হলাম নাট্যকার এবং নির্দেশক হিসেবেও। এখনও কাজ করি বেতারে, তবে সংখ্যায় নেহায়েতই কম— অন্যতম কারণ হচ্ছে সম্মানী। অতি সামান্য সম্মানী দেন তাঁরা, শিল্পীদের সহজে কেউ যেতে চান না ওদিকে। তারপরও ভালোবাসা বলে একটা কথা তো আছে। শিল্পীর একটা ভালোবাসার সম্পর্ক তো আছে বেতারের সাথে। সেই টানেই এখনও যাই মাঝে মধ্যে— এবং বেশ একটা আনন্দঘন পরিবেশে কাজ করি কয়েক ঘণ্টা।
আসলে রেডিও হয়তো আগের মত অতটা জনপ্রিয় না এখন, তার পরেও মানুষ রেডিও শুনতে চায়— শুধু গান বাজনা শোনার জন্য নয়, আজ রেডিও জীবন যাপনে অতি প্রয়োজনীয়, সকল তথ্য বিতরণ করে চলে একইভাবে— বাসা, অফিস, পথে ঘাটে, ক্ষেতে খামারে। মানুষ প্রতিমুহূর্তেই এই সেবা পেয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশে বেতারও মানুষের কাছে টিভির পাশাপাশি অপরিহার্য হয়ে আছে। মোবাইল ফোন মানুষের নিত্য সময়ের সঙ্গী হলেও তাতে মানুষ রেডিও-ও শুনতে চায়।
এফএম রেডিও এখন এক জনপ্রিয় ও প্রয়োজনীয় মাধ্যম।
তবে এফ এম বেতার দেশের ভাষায় একটা নতুন সংযোজন করেছে এটা অস্বীকার করবেন কীভাবে! অদ্ভুত বাংলার আবিষ্কার তাঁদেরই। বাংলায় বলছেন না ইংরেজিতে বলছেন সেটা বুঝতেই আপনার চলে যাবে কয়েক মিনিট।
আর আজ আমি যতই সমালোচনা করি এই ভাষা ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে। বিশেষ করে টিভির টক শোতে— যেখানে জনপ্রিয় ব্যক্তিদের নিয়ে অদ্ভূত উচ্চারণে-আরও উদ্ভট সব প্রশ্ন করা হয়।