1 of 3

২২ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার ১৯৭১

২২ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার ১৯৭১

সময় মনে হচ্ছে থেমে আছে গতকাল থেকে। গতকাল এই সময় নাসিরের বাড়িতে। আমি ও রুমী। কি বলেছিলাম আমি? নাসির, লীনা, রুমী সবাই ক্ষণকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। রুমীও নিশ্চয় এতটা নাটকীয়তা আশা করে নি তার মায়ের কাছ থেকে। তবু সে উজ্জ্বল হাসিমুখে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেছিল আমাকে। যেন ছোট ছেলে অনেক কসরত করে মার কাছ থেকে আইসক্রিম খাবার পয়সা আদায় করে নিয়েছে। নাসির ফ্যাকাসে মুখে হাসবার চেষ্টা করে শুধু বলেছিল, বুবু!লীনা তার বাচ্চাকে বুকে চেপে পাশের ঘরে চলে গিয়েছিল।

রাতে ঘুম হয় নি। কাউকে কিছু বলতেও পারছিনা। সকালে নাশতা খাবার টেবিলে কাসেম আবার বলল, সে বাড়ি যাবে। এর আগে দুবার ছুটি চেয়ে পায় নি। একজন যুদ্ধে যেতে চেয়ে অনুমতি পেয়েছে, কাসেম তো শুধু চারদিনের জন্য বাড়ি যেতে চায়। বললাম, ঠিক আছে, যাবে।

তারপরই তৎপর হয়ে উঠলাম। শরীফকে বললাম, অফিসে গিয়ে গাড়িটা পাঠিয়ে দাও, ঠাটারী বাজারে যাব।

শরীফ বলল, তার চেয়ে তুমি এখনই তৈরি হয়ে গাড়িয়ে চল। আমাকে নামিয়ে দিয়ে ওইদিক দিয়ে বাজারে চলে যেয়ো।

আজকাল রাস্তায় খালি গাড়ি দেখলেই আর্মির লোক থামিয়ে কয়েক ঘণ্টা নিজের কাজে ব্যবহার করে নেয়। সারা শহরে এ একটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু গাড়িতে মহিলা থাকলে থামায় না।

ঠাটারী বাজারের অবস্থাও অন্য জায়গার চেয়ে এমন কিছু ভালো না। ২৫ মার্চের রাতে পুড়ে যাবার পর এখন এখানে-ওখানে কিছু কিছু মেরামত করে বাজার বসছে। আমি ড্রাইভারকে বললাম, গাড়ি বন্ধ করে আমার সঙ্গেই এসো।

বাজারের পরিবেশ মোটেও ভালো লাগল না। দগ্ধ, বিধ্বস্ত বাজারের মাঝে-মাঝে দোকানী লোকগুলো কেমন যেন অস্বাভাবিক নির্বিকারভাবে বসে আছে। চোখে বোবা দৃষ্টি। সারা বাজারজুড়ে পানি থইথই করছে। এত পানি কেন? এরমধ্যে আর তো বৃষ্টি হয় নি। মনে হচ্ছে সকালে প্রচুর পানি ঢেলে পুরো বাজারটা ঘোয়া হয়েছে। কেন? হালে আবারো কিছু হয়েছে নাকি? কেমন যেন গা ছমছম করতে লাগল। তাড়াতাড়ি কিছু গোশত আর কিমা কিনে চলে এলাম। দরকার নেই বাবা। নিউ মার্কেটে যা পাওয়া যায় তাই দিয়েই চালাবো।

দুপুরে খেতে বসেছি এমন সময় লুলু এল। সেও একটা প্লেট নিয়ে খেতে বসে গেল। খেতে খেতে বলল, জানেন মামী, গতকাল নাকি বিহারিরা ঠাটারী বাজারে কয়েকজন বাঙালি কসাইকে জবাই করেছে।

ঠাটারী বা-জা-রে! দূর! বাজে কথা, আমি তো আজ সেখানে গিয়েছিলাম, কই, লোক জবাই হলে দোকানীদের মধ্যে যে রকম ভয়চকিত হাবভাব হওয়া উচিত ছিল, সে রকম তো কিছুই দেখলাম না। লোক জবাই হলে ওরা কি ওরকম নির্বিকার হয়ে বসে থাকতে পারতো? তোরা কোথা থেকে যে এসব গুজব ধরে আনিস।

কথাটা উড়িয়ে দিলাম বটে কিন্তু গা শিরশির করতে লাগলো।

খেয়ে উঠে কাসেমকে বললাম, নিউ মার্কেট থেকে গোটা কতক মুরগি আর কিছু মাছ কিনে আন। ওগুলো কুটে বেছে দিয়ে তারপর বাড়ি যেয়ো।