1 of 3

১ মার্চ, সোমবার ১৯৭১

১ মার্চ, সোমবার ১৯৭১

আজ বিকেলে রুমী ক্রিকেট খেলা দেখে তার বন্ধুদের বাসায় নিয়ে আসবে হ্যামবার্গার খাওয়ানোর জন্য।

গোসল সেরে বারোটার দিকে বেরোলাম জিন্না এভিনিউয়ের পূর্ণিমা স্ন্যাকবার থেকে ডিনার-রোল কিনে আনার জন্য।

দুডজন ডিনার-রোল কিনে সোজা চলে এলাম বাড়ির কাছের নিউ মার্কেটে। গত দুই সপ্তাহ ধরে প্রায় প্রায়ই বিভিন্ন দোকানে খোঁজ করি পূর্ব পাকিস্তানের তৈরি সাবান, তেল, টুথপেস্ট, বাসন-মাজা পাউডার; কিন্তু পাই না। একমাত্র ইভা বাসন-মাজা পাউডারটাই এখানকার তৈরি–বলা যেতে পারে সবে ধন নীলমণি। পিয়া নামের এক ঢাকাই টুথপেস্ট বাজারে বের হবো-হবো করে এখনও বের হতে পারছে না, আল্লাই মালুম কি কঠিন বাধার জন্য!

বাড়ি ফিরতে ফিরতে দেড়টা। দরজা খুলে দিয়েই বারেক জানাল : সাবরে ফুন করেন আম্মা। খাবার-দাবার কিন্যা রাখতে কইছে। কই জানি গুণ্ডগোল লাগছে।

গণ্ডগোল? তা লাগতেই পারে। গত দুমাস থেকেই তো ঢাকা তপ্ত কড়াই হয়ে রয়েছে। অফিসে ফোন করতেই শরীফ জানাল : প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বেলা একটার সময় রেডিওতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে শহরে সব জায়গায় হৈচৈ পড়ে গেছে। লোকেরা দলে দলে অফিস-আদালত ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা বন্ধ হয়ে গেছে। ওখানকার সব দর্শক শ্লোগান দিতে দিতে মাঠ থেকে বেরিয়ে পড়েছে। এখানে মতিঝিলে তো দারুণ হৈচৈ হচ্ছে চারদিকে। কেন, নিউ মার্কেটের দিকে কিছু দেখ নি?

আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, ঐসময়টা আমি পেছন দিকের দোকানগুলোয় ছিলাম, ঠিক খেয়াল করি নি। ওখানকার লোকেরা হয়ত এখনো শুনে ওঠে নি। তারপরেই চেঁচিয়ে উঠলাম, রুমী-জামী যে স্টেডিয়ামে।

শরীফ বলল, চিন্তা করো না। ওরা বেরিয়েই আমার অফিসে এসেছিল। জামীকে এখানে রেখে রুমী ওর বন্ধুদের কাছে গেছে। শোনো, বেশ গোলমাল হবে। এখানে অলরেডি মিছিল বেরিয়ে গেছে। বায়তুল মোকাররম, স্টেডিয়ামের দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, খবর পেলাম। গোলমাল বাড়লে কারফিউ দিয়ে দিতে পারে। ঘরে খাবার-দাবার আছে কিছু না থাকলে এক্ষুণি কিনে রাখ।

তক্ষুণি আবার বেরোলাম। এলিফ্যান্ট রোডে উঠতেই দেখি দুপাশের ছোট ছোট দোকানগুলোতে লোকজনের অস্বাভাবিক ভিড়। সবাই উর্ধ্বশ্বাসে কেনাকাটা করছে। দোকানীরা দিয়ে সারতে পারছে না। আমিও দুতিনটে দোকান ঘুরে, ভিড়ের মধ্যে তোতি করে, টোস্ট বিস্কুট, চানাচুর, দেশলাই, মোমবাতি, গুড়ো দুধ, ব্যাটারি এসব কিনলাম। বাড়িতে এসেই বারেকের হাতে খালি কেরোসিনের টিন আর সুবহানের হাতে খালি বস্তা ধরিয়ে পাঠিয়ে দিলাম কেরোসিন আর চাল কেনার জন্য।

এইসব করতে করতে শরীফ আর জামী এসে গেল অফিস থেকে। প্রায় তিনটে বাজে। টেবিলে বেড়ে রাখা খাবারের ঢাকনা তুলে যেতে বসে জিগ্যেস করলাম, আর খবর কি?

শেখ মুজিব হোটেল পূর্বাণীতে প্রেস কনফারেন্স ডেকেছেন। আসার সময় দেখি হোটেলের সামনে তিনটে রাস্তাই একেবারে মেইন রোড পর্যন্ত লোকে ঠাসা। সবার হাতে লোহার রড় আর বাঁশের লাঠি। অফিস থেকে বেরিয়ে দৈনিক পাকিস্তানের দিক দিয়ে গাড়ি নিতে পারলাম না ভিড়ের চোটে। শেষে গভর্নমেন্ট হাউসের পাশের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে গুলিস্তান ঘুরে এসেছি। রুমী এখনো ফেরেনি?

এবার আমিই শান্তস্বরে বললাম, এই হৈচৈতে কোথাও আটকে গেছে মনে হয়। খেলার শেষে বন্ধুদের নিয়ে হ্যামবার্গার খেতে আসার কথা। এখন খেলা যখন বন্ধ হয়ে গেছে, হয়ত আগেই আসবে।

চারটে বাজল, পাঁচটা বাজল। রুমীর দেখা নেই। সাড়ে চারটের মধ্যে দুই ডজন হ্যামবার্গার বানিয়ে আয়ে মৃদু গরমে রেখে দিয়েছি।

সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত এসে গেল। রুমী এল আটটারও পরে। একা। বিকেল-সন্ধ্যে বাগানে পায়চারি করতে করতে আমার রাগ উপে উদ্বেগ দানা বাঁধছিল মনে। রুমীকে দেখেই রাগ আবার ঝাপিয়ে এল সামনে। রুমী আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে দুই হাত তুলে, মুখে হৃদয়-গলানো হাসি ভাসিয়ে বলল, আগে শোনো তো আমার কথা। কত কি যে ঘটে গেল একবেলায়। সবকিছুর স্কুপ-নিউজ এখুনি দিতে পারি তোমায়। নাকি, কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবে খবর কাগজের জন্য?

আমি হাসি চেপে কুটি বজায় রেখে বললাম, কি তোমার স্কুপ-নিউজ, শুনি?

অনেক, অনেক। একেবারে গোড়া থেকে বলি। একটার সময় স্টেডিয়ামে ছিলাম। অনেক দর্শকই সঙ্গে রেডিও নিয়ে গিয়েছিল। অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা যেই না কানে যাওয়া, অমনি কি যে শোরগোল লেগে গেল চারদিকে। মাঠ-ভর্তি চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার দর্শক–সবাই জয়বাংলা শ্লোগান দিতে দিতে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। আমি জামীকে আব্দুর অফিসে রেখে ছুটলাম ইউনিভার্সিটিতে। ওখানেও একই ঘটনা। রেডিওর ঘোষণা শোনামাত্রই ছেলেরা সবাই দলে দলে ক্লাস থেকে, হল থেকে বেরিয়ে বটতলায় জড়ো হতে শুরু করেছে। আমি যখন পৌঁছলাম, তখনো ছেলেরা পিলপিল করে আসছে চারদিক থেকে। মনে হল সমুদ্রের একেকটা ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে বটতলায়। তখুনি ছাত্রলীগ আর ডাকসুর নেতারা ঠিক করল বিকেল তিনটেয় পল্টন ময়দানেমিটিং করতে হবে।

পল্টনে মিটিং হল? দেড়টা-দুটোয় বলল আর তিনটেয় মিটিং হল?

হল মানে? সে তুমি না দেখলে কল্পনাও করতে পারবে না আম্মা। এ্যা-তো লোক! এ্যাতো লো-ক! উঃ আল্লারে। কিন্তু মিটিংয়েরও আগে তো পূর্বাণীতে শেখ মুজিব প্রেস কনফারেন্স ডাকলেন। উনি অবশ্য সকাল থেকেই ওখানে ওঁদের দলের পার্লামেন্টারি বৈঠকে ছিলেন। ইয়াহিয়ার ঘোষণার এক ঘণ্টার মধ্যে পঞ্চাশ-ষাট হাজার লোক বাশের লাঠি আর লোহার রড ঘাড়ে নিয়ে পূর্বাণীর সামনে সবগুলো রাস্তা জ্যাম করে ফেলল। সেকি শ্লোগান। পাকিস্তানি ফ্ল্যাগ আর জিন্নার ছবিও পুড়িয়েছে। শেখ তক্ষুণি সাংবাদিকদের ডেকে ঘোষণা দিলেন হরতালের আর ৭ মার্চ রেসকোর্সে মিটিংয়ের।

মনটা আস্তে আস্তে নরম হয়ে আসছে। শরীফও বলেছে পূর্বাণীর সামনে ভিড়ের কথা। তবু মুখের বেজার ভাবটা বজায় রেখে বললাম, এত ঝঞ্ঝাটের মধ্যে দুডজন হ্যামবার্গার ঠিকই বানালাম। কিন্তু তোদের কারো মনে নেই সে কথা।

মনে থাকার যো আছে আম্মা? কি যে খই ফুটছে সারা শহরে! গুলিস্তানের মোড়ে কামানের ওপর দাঁড়িয়ে মতিয়া চৌধুরী যা একখানা আগুন ঝরানো বক্তৃতা দিলেন না, শুনলে তোমারও গায়ে হলকা লাগত। সাধে কি আর ওঁকে সবাই অগ্নিকন্যা বলে।

আমি আবার ক্ষেপে উঠলাম, এইবার গুল মারছিস। তুই একা এতোগুলো জায়গায় এক বিকেলে গেলি কেমন করে?

রুমী খুব বেশি রকম অবাক হয়ে বলল, খুবই সিম্পল। বন্ধুর হোন্ডার পেছনে চড়ে সবখানে টহল দিয়েছি। আমরা কি এক জায়গায় বসে নেতাদের বক্তৃতা শুনেছি নাকি? স্টেডিয়াম থেকে ইউনিভার্সিটি, সেখান থেকে পূর্বাণী, পূর্বাণী থেকে গুলিস্তান মোড়ের কামান, সেখান থেকে পল্টন–এমনি করে চরকিঘোরা ঘুরেছি না?

সারাদিন খাওয়া হয়নি নিশ্চয়?

কেই-বা খেয়েছে? ঐ একটার আগে যে যা খেয়েছে চা-বিস্কুট–ব্যস। আর খাওয়া-দাওয়া নেই। বাঁশের লাঠি, লোহার রড–যে যা পেয়েছে, একেকখানা ঘাড়ে নিয়ে সবাই রাস্তায় নেমে গেছে। তবে এতক্ষণে টের পাচ্ছি সারাদিন খাওয়া হয়নি।

চল চল, আগে খেতে বস। খাওয়ার পর বাকিটা শুনব।

ঐহ্যামবার্গারই দাও আমায়। নষ্ট করে কি লাভ? তোমরাও সবাই ঐদিয়েই রাতের খাওয়া সেরে ফেল।

গুষ্ঠিসুদ্ধ খেয়েও কি সব ফুরোনো যাবে? চিন্তা করো না। আমি একাই ছয়টা খেয়ে ফেলব।

শেখ মুজিব আগামীকাল ঢাকা শহরে, আর পরশুদিন সারাদেশেহরতাল ডেকেছেন। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে গণজমায়েতের ঘোষণাও দিয়েছেন। জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিতের কি পরিণাম হতে পারে, তা নিয়ে বহুরাত পর্যন্ত আলাপ-আলোচনা চললো খাবার টেবিলে বসে। রাত প্রায় বারোটার দিকে শুতে গিয়েও ঘুম এল না। অনেক দূর থেকে শ্লোগানের শব্দ আসছে। বোঝা যাচ্ছে এত রাতেও অনেক রাস্তায় লোকেরা মিছিল করে শ্লোগান দিচ্ছে। কেবল জয় বাংলা ছাড়া অন্য শ্লোগানের কথা ঠিক বোঝা যায় না। কিন্তু তবু ঐ সম্মিলিত শত-কণ্ঠের গর্জন সমুদ্রের ঢেউয়ের মত আছড়ে এসে পড়ছে শ্রুতির কিনারে। শিরশির করে উঠছে সারা শরীর। গভীর রাতে আধো-ঘুমে, আধো-জাগরণে মনে হল যেন গুলির শব্দও শুনলাম।