২২. অন্যের দোষ ধরতে হলে এইভাবে শুরু করুন

দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
অন্যের দোষ ধরতে হলে এইভাবে শুরু করুন

আমার একজন বন্ধু ক্যালভিন কুলিজের শাসনের সময় সপ্তাহ শেষে কিছুদিন হোয়াইট হাউসে অতিথি ছিলেন। প্রেসিডেন্ট কুলিজের ব্যক্তিগত অফিসে আসতে গিয়ে তিনি একদিন কুলিজকে তাঁর সেক্রেটারিকে বলতে শোনেন, আজ সকালে ভারি সন্দুর পোশাক পরেছ তুমি, তোমাকে খুবই সুন্দর লাগছে।’

অল্পকথার মানুষ ক্যালভিন বোধ হয় এমন প্রশংসা জীবনে আর কাউকে করেন নি। ব্যাপারটা এমনই অভাবিত যে সেক্রেটারি লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। কুলিজ এবার বললেন, ‘ঘাবড়ে যেও না। তোমার ভালো লাগার জন্যেই বললাম কথাটা। এবার থেকে আশা করবো তুমি ব্যাকরণের দিকে একটু নজর দেবে।’

তাঁর পদ্ধতিটা সম্ভবত একটু সোজাসুজি রকমই তবে তাঁর মনস্তাত্ত্বিক জ্ঞান চমঙ্কার। প্রায় সব সময় ভালো কিছু শোনার পরেই খারাপ কথা শোনা বোধহয় ভালো।

নাপিত দাড়ি কামানোর আগে সাবান ঘসে দাড়ি নরম করে নেয়। ১৮৯৬ সালে ম্যানিলে ঠিক এই রকমই করেছিলেন প্রেসিডেন্টপদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগে। ওই সময়ের একজন বিখ্যাত রিপাবলিকান একটা বক্তৃতার খসড়া এনেছিলেন যেটা তার মনে হল সিনেরো বা প্যাট্রিক হেনরি বা ড্যানিয়েল। ওয়েবন্টারের চেয়ে ভালো আর সকলে এক সঙ্গে জড়ানো। বেশ আনন্দিত হয়ে তিনি সেটা ম্যাকিনলেকে পড়ে শোনাতে লাগলেন। ম্যাক্ৰিলে বললেন, বক্তৃতাটি বেশ ভালো তবে এটা চলবে না কারণ এটায় বেশ সমালোচনার ঝড় উঠতে পারে। ম্যাকিনলে কাউকে আঘাত করতে চাইলেন না। এবার দেখুন কেমন কৌশলে তিনি কাজটা করলেন।

‘প্রিয় বন্ধু, বক্তৃতাটা চমৎকার, দারুণ’ ম্যাকিনলে বললেন। এরচেয়ে ভালো আর কেউ লিখতে পারতো না। অনেক ক্ষেত্রেই এ বক্তৃতা দিলে ভালো হতো, কিন্তু এই ক্ষেত্রে কি এটা যোগ্য হবে? তোমার দিক থেকে এটা যোগ্যতম মনে হলেও আমাকে দলের কথাও ভাবতে হবে। এবার বাড়ি গিয়ে আমি যেমন বললাম ঠিক সেই ভাবে আর একটা বক্তৃতা লিখে আনো।

তিনি ঠিক তাই করলেন। ম্যাকিনলে এ ব্যাপারে লেখককে সাহায্য করলেন। আর ওই নির্বাচনে তিনি হয়ে উঠলেন চমৎকার বক্তৃতাকারী।

এখানে একটা চিঠি দেওয়া হচ্ছে। দ্বিতীয় এই বিখ্যাত চিঠিটি আব্রাহাম লিঙ্কন লিখেছিলেন। (তাঁর প্রথম বিখ্যাত চিঠিটি তিনি লিখেছিলেন একজন মহিলাকে যুদ্ধে তাঁর পাঁচটি সন্তান হারানোর শোকে সান্ত্বনা জানিয়ে) লিঙ্কন সম্ভবত পাঁচ মিনিটের মধ্যে চিঠিটা লেখেন অথচ ১৯২৬ সালে সেটা সাধারণের কাছে নিলামে প্রায় বারো হাজার ডলারে বিক্রি হয়। সে টাকা লিঙ্কন অর্ধ শতাব্দীর কঠিন পরিশ্রমে যা সঞ্চয় করেন তার চেয়েও বেশি।

চিঠিটি ১৮৬৩ সালের ২৬শে এপ্রিল গৃহযুদ্ধের অন্ধকারময় দিনগুলোয় লেখা। আঠারো মাস ধরে লিঙ্কনের সেনাধ্যক্ষরা ইউনিয়ন বাহিনীকে পরিচালনা করলেও ভাগ্যে জুটছিল শুধু একটার পর একটা বিষাদময় পরাজয়। যা ঘটছিল তা কেবল অর্থহীন মূর্খের মত হত্যাকাণ্ড। সারা দেশ শিহরিত হচ্ছিল। হাজার হাজার সেনা সৈন্যবাহিনী ছেড়ে চলে যায় আর এমনকি রিপাবলিকান সদস্যরাও সিনেটে বিদ্রোহ করে লিঙ্কনকে হোয়াইট হাউস থেকে তাড়াতে চাইছিলেন। লিঙ্কন সে সময় বলেন, আমরা ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি। আমার মনে হচ্ছে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরও আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। আমি কণামাত্র আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না। অন্ধকার মাখা এমনই এক দুঃখের আর বিপদের দিনেই চিঠিটা লেখা হয়।

আমি চিঠিটা ছেপে ছিলাম কারণ এটার মধ্য দিয়ে দেখা যাবে লিঙ্কন কি করে একজন দুর্দান্ত সেনানায়ককে পরিবর্তিত করার চেষ্টা করেন যখন সেই জেনারেলের উপরেই নির্ভর করছিল সারা দেশের ভাগ্য।

প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর আব্রাহাম লিঙ্কন বোধহয় এই একটি মাত্র কড়া ভাষায় চিঠি লিখেছিলেন। আপনারা হয়তো লক্ষ্য করবেন তিনি জেনারেল হুঁকারকে তার মারাত্মক ভুলের কথা বলার আগে কিভাবে প্রশংসা করেছিলেন।

হ্যাঁ, ভুলগুলো মারাত্মকই ছিল। কিন্তু লিঙ্কন তা বলেন নি। লিঙ্কন ছিলেন ঢের বেশি রক্ষণশীল আর অনেক বেশি কূটনীতিক। লিঙ্কন লেখেন : ‘এমন কিছু ব্যাপার রয়েছে যাতে আপনার সম্বন্ধে আমি সন্তুষ্ট নই। কৌশল কূটনীতি কাকে বলে!’

মেজর জেনারেল হুঁকারকে যে চিঠি লেখা হয় সেটা এই রকম :

‘আমি আপনাকে পটোম্যাকের সেনাবিভাগের প্রধান আসনে বসিয়েছি। অবশ্য আমার একাজ করার মধ্যে উপযুক্ত কারণ ছিল, তা সত্ত্বেও আমার ধারণা, আর সেটা আপনারও জানা দরকার যে অনেক ব্যাপারেই আপনার কাজে আমি সন্তুষ্ট নই।’

‘আমি বিশ্বাস করি আপনি একজন সাহসী আর দক্ষ সৈনিক। সেটা অবশ্যই আমার পছন্দ। আমার আরও বিশ্বাস আপনার কাজের মধ্যে আপনি রাজনীতি মেশান না, যেটা ঠিক পথ। আপনার নিজের উপর বিশ্বাস আছে সেটা অতি দামী গুণ হলেও একান্ত প্রয়োজনীয় নয়।

‘আপনি উচ্চাকাঙ্ক্ষী, যেটা বিশেষ সাধনার মধ্যে মন্দ করার বদলে ভালোই করে থাকে। তকে আমার মনে হয় জেনারেল বার্নসাইডের সেনাপতিত্বের সময় আপনি আপনার ওই উচ্চাকাঙক্ষা উপরেই নির্ভর করেছিলেন আর তার পরিচালনা বানচাল করতে চেয়েছিলেন, এটা করতে গিয়ে আপনি দেশের প্রভূত ক্ষতি করেছেন। আর ক্ষতি করেছেন একজন দক্ষ সম্মানিত সহ-অফিসারেরও।‘

‘আমি শুনেছি আর সেটা বিশ্বাস করার মতই যে আপনি সম্প্রতি বলেছেন সেনাবাহিনী আর সরকারেরও এই দুয়েরই একজন নায়ক দরকার। অবশ্য এর জন্য নয়, এটা জানা সত্ত্বেও আমি আপনাকে সেনাধ্যক্ষ করেছি।’

‘একমাত্র সেইসব জেনারেলরাই একনায়ক হতে পারেন যারা সফল হন। আমি এখন যা চাই ত৷ হলো সামরিক সাফল্য আর তাই আমি ওই একনায়কত্বের ঝুঁকি নেব।’

‘সরকার আপনাকে তার সমস্ত ক্ষমতা দিয়েই সাহায্য করবে, এর আগে সরকার সেনাধ্যক্ষদের যে সাহায্য করেছে সেইরকম সাহায্য। আমার ভয় হচ্ছে যে আপনি আপনার সেনাদলের মধ্যে সেনাপতিকে সমালোচনা করার প্রবৃত্তি জাগিয়েছেন আর তাঁর বিশ্বাস হারিয়েছেন, এবার সেটাই আপনার উপর পরিচালিত হবে। এ রকম ব্যাপার যাতে না ঘটে তার জন্য আমি আপনাকে সাহায্য করবো।’

‘আপনি বা নেপোলিয়ন, তিনি যদি এখন বেঁচে থাকতেন, দুজনের কেউই এ ধরনের মনোভাব থাকলে সেনাবাহিনীর কাছ থেকে কোন ভালো কাজ আদায় করতে পারতেন না। তাই হঠকারিতা করবেন না। হঠকারিতা থেকে সর্তক থাকুন। কিন্তু ক্ষমতা আর দ্রিাবিহীন সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে গিয়ে আমাদের জয় এনে দিন।

আপনি কুলিন, ম্যাকিনলে বা একজন লিঙ্কন নন। আপনি জানতে চাইবেন প্রতিদিনের ব্যবসায়িক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই দর্শন চলবে কিনা। চলবে কি? দেখা যাক। এবার ফিলাডেলফিয়ার ওয়ার্ক কোম্পানীর ডব্লিউ. পি. গকের ব্যাপারটাই দেখা যাক। মি. গক আমার বা আপনার মতই একজন সাধারণ নাগরিক। তিনি ওখানে আমার ক্লাসের এক ছাত্র থাকার সময় এই ঘটনার কথা বলেছিলেন।

ওয়ার্ক কোম্পানীর ফিলাডেলফিয়ায় একটা বিরাট অফিস বাড়ি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তৈরি করার কথা ছিল। বাড়ির কাজ ঠিক মতই হয়ে চলেছিল আর প্রায় শেষও হয়ে এসেছিল। আচমকা একজন সরবরাহকারী জানালো যে সে কারুকাজ করা ব্রোঞ্জের জিনিসগুলো নির্দিষ্ট সময় মত সরবরাহ দিতে পারবেন না। কি! সারা বাড়িটা আটকে যাবে? প্রচুর জরিমানা হবে! প্রচুর ক্ষতিও হবে! আর সেটা মাত্র একজনের জন্য।

শুরু হলো দূরগামী টেলিফোন কথাবার্তা। তর্কাতর্কি। বেশ গরম কথাবার্তা। সবই বৃথা। এরপর মিঃ গককে ব্রোঞ্জের সিংহকে তার গুহাতেই রাখবার জন্যে পাঠানো হলো নিউইয়র্কে।

‘আপনি কি জানেন ব্রুকলীনে আপনার নামে একমাত্র আপনিই আছেন?’ প্রেসিডেন্টের অফিসে ঢুকতে ঢুকতে মিঃ গক বললেন। প্রেসিডেন্ট একটু আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘না, এটা তো জানতাম না।’

মিঃ গক এবার বললেন, ‘আজ সকালে যখন ট্রেন থেকে নামলাম, টেলিফোন বইয়ে আপনার ঠিকানা দেখছিলাম। দেখলাম ব্রুকলীনে আপনিই ওই নামের একমাত্র মানুষ।‘

টেলিফোন বইটা দেখে নিয়ে প্রেসিডেন্ট আগ্রহের সঙ্গে বললেন, কই আমার তো জানা ছিল না, হ্যাঁ, নামটা একটু অসাধারণ তা ঠিক। আমাদের পরিবার আসে হল্যাণ্ড থেকে আর নিউইয়র্কে বাস করতে থাকেন প্রায় দুশ বছর আগে। তিনি তাঁর পরিবারের নানা কাহিনী বেশ কিছুক্ষণ ধরে শোনাতে চাইলেন। তাঁর কথা শেষ হলে মিঃ গক তাকে প্রশংসা করে বললেন তাঁর কারখানাটি কত বড় আর যে সব কারখানা দেখেছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো। মিঃ গক বললেন, আমার দেখা ব্রোঞ্জ কারখানাগুলোর মধ্যে এ কারখানাই সবচেয়ে সুন্দর আর পরিষ্কার।

‘সারা জীবনের প্রচেষ্টায় এ কারখানা গড়ে তুলেছি প্রেসিডেন্ট বললেন, এ নিয়ে তাই আমার গর্ব আছে। একবার কারখানাটা ঘুরে দেখবেন?’

দেখার সময় মিঃ গক জিনিসপত্র তৈরির কৌশল দেখে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। তিনি জানালেন অন্যান্য সব কারখানার চেয়ে এটি কত ভালো। মিঃ গক মেশিনগুলি দেখে প্রশংসা করতেই প্রেসিডেন্ট জানালেন এসব তাঁরই আবিষ্কার। তিনি অনেকক্ষণ ধরে মিঃ গককে সব কাজের পদ্ধতিগুলো দেখিয়ে দিলেন। তিনি মিঃ গককে মধ্যাহ্ন ভোজে নিমন্ত্রণ করলেন। এতক্ষণ পর্যন্ত মনে রাখবেন, মিঃ গক তাঁর এখানে আসার কারণ সম্পর্কে একটিও কথা বলেননি।

মধ্যাহ্নে ভোজের পর প্রেসিডেন্ট বললেন, হ্যাঁ, এবার কাজের কথায় আসা যাক। স্বাভাবিক ভাবেই আমি জানি আপনি কেন এসেছেন। আমি ভাবিনি আমাদের সাক্ষাত্তার এত সুন্দর হবে। আপনি ফিলাডেলফিয়ায় আমার এই আশ্বাস নিয়ে ফিরে যেতে পারেন যে সমস্ত জিনিস তৈরি করে ঠিক মতই পাঠিয়ে দেওয়া হবে, আর সেটা অন্য কাজ চেপে দিয়ে।

চাইতেই মিঃ গক যা দরকার সবই পেয়ে গেলেন। সমস্ত জিনিস সময় মত পৌঁছে গেল আর বাড়ি তৈরীর কাজও চুক্তির ঠিক দিনেই শেষ হল।

এটা কি হতে পারতো মিঃ গক যদি এ রকম ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মত তর্কাতর্কি করতেন?

অতএব মানুষের মনে আঘাত না দিয়ে বা দোষ না দিয়ে তাকে বদলাতে হলে এক নম্বর নিয়ম হল :

প্রশংসা আর আন্তরিকতা দিয়েই শুরু করুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *