পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
অভিযোগের সাবধানতা
বেশির ভাগ মানুষই অন্যদের স্বমতে আনতে গিয়ে বড় বেশি রকম কথা বলেন। বিশেষ করে সেলসম্যানরা এই দোষে দোষী। অন্যদের কথা বলতে দিন। নিজের ব্যাপার আপনার চেয়ে অবশ্যই তিনি ভালো জানেন। অতএব তাকে প্রশ্ন করুন। তাকে কিছু বলতে দিন।
আপনার সঙ্গে তাঁর মতের মিল না হলে আপনি হয়তো বাধা দিতে চাইবেন। কিন্তু তা করবেন না। এটা মারাত্মক। তিনি আপনার কথায় কানই দেবেন না যতক্ষণ না তিনি নিজের কথাটা বলতে পারছেন। অতএব ধৈর্য ধরে শুনে যান আর মন ভোলা রাখুন। একটু আন্তরিকতা রাখাও চাই। অপরকে তাঁর মনোভাব খুলে বলতে সুযোগ দিন।
ব্যবসার ক্ষেত্রে এই কৌশল কাজে আসবে? দেখা যাক। এখানে এমন একজনের কথা উল্লেখ করছি যাকে এটা জোর করেই করান হয়।
কয়েক বছর আগে আমেরিকার অন্যতম এক মোটর গাড়ি তৈরির প্রতিষ্ঠানের মোটর গাড়ি সাজানোর কিছু মালমশলার দরকার হয়। তিনটি বড় প্রতিষ্ঠান-এর জন্য কিছু কাপড়ের নমুনা তৈরি করেন। এগুলো সবই মোটর কোম্পানীর পদস্থ কর্মীরা পরীক্ষা করেন। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে এবার জানানো হয় তারা যেন নির্দিষ্ট কোন দিনে ওই জিনিসের অর্ডার পাওয়ার জন্য আবেদন করে।
এক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি জি. বি. আর, প্রচণ্ড রকম গলা ব্যথায় আক্রান্ত হয়ে এসে পৌঁছলেন। মোটর প্রতিষ্ঠানের পদস্থ অফিসারদের সঙ্গে দেখা করার সময় আসতেই, মি. আর-আমার ক্লাসে বলেছিলেন, ‘আমার কথা বলার শক্তি ছিল না, গলার স্বর বন্ধ। ফিসফিসও করতে পারছিলাম না। আমাকে যে কামরায় নিয়ে যাওয়া হল সেখানে টেকসটাইল ইঞ্জিনিয়ার, পারচেজিং এজেন্ট, সেলসের প্রধান আর কোম্পানীর প্রেসিডেন্টের মুখোমুখি হলাম। আমি উঠে দাঁড়িয়ে প্রাণপণে কথা বলতে চাইলেও একটু শব্দ ছাড়া কিছুই করতে পারলাম না।
‘তাঁরা সবাই আমার সামনে একটা টেবিলের ওপাশে উপবিষ্ট ছিলেন তাই আমি এটা কাগজে লিখে দিলাম : ভদ্র মহোদয়গণ আমার কথা বলার শক্তি নেই। আমি বাকশক্তিহীন।‘
প্রেসিডেন্ট বললেন, ‘আমিই আপনার হয়ে কথা বলছি।’ তিনি আমার নমুনাগুলো দেখিয়ে সেগুলোর প্রশংসা করলেন। বেশ চমৎকার কথাবার্তার মধ্য দিয়ে তিনি আমার জিনিসের গুণাগুণ বুঝিয়ে দিলেন। আর প্রেসিডেন্ট যেহেতু আমার হয়ে কথা বলছিলেন তাই আমার পক্ষ নিলেন। আমি কেবল একটু হেসে মাথা নাড়তে থাকলাম। আর কিছু করিনি।
ওই আশ্চর্য সভার পর আমাকেও সরবরাহের দায়িত্ব দান করা হলো, যার অর্থ আমাকে প্রায় ১,৬০০,০০০ ডলারের কাপড় অর্ডার দেয়া হল, আমার জীবনের সব চেয়ে বড় অর্ডার।
‘আমি জানতাম আমার গলার স্বর বন্ধ না হয়ে গেলে ওই অর্ডার আমি পেতাম না যেহেতু আমার কতগুলো ভুল ধারণা ছিলো। আমি আচমকা আবিষ্কার করলাম দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে কি রকম কাজ হতে পারে অপরকে যদি শুধু কথা বলতে দেওয়া হয়।’
ফিলাডেলফিয়া ইলেকট্রিক কোম্পানীর যোশেফ এস, ওয়েব ঠিক এই আবিষ্কার করেন। মিঃ ওয়েব পেনসিলভানিয়ার ওলন্দাজ কৃষকদের গ্রামে ভ্রমণ করছিলেন।
‘এরা বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে না কেন?’ মিঃ ওয়েব জেলার প্রতিনিধিকে ভ্রমণের সময় প্রশ্ন করলেন।
‘এরা অদ্ভুত মানুষ। ওদের কিছুই বিক্রি করতে পারবেন না, বিরক্ত হয়ে জবাব দিলেন জেলার প্রতিনিধি। তাছাড়া ওরা আবার কোম্পানীর উপর চটে আছে। আমি চেষ্টা করেছি, কিন্তু সব বৃথা।
তা হতে পারে ভাবলেন মিঃ ওয়েব। তবুও তিনি একবার চেষ্টা করবেন ঠিক করে খামারবাড়ির দরজায় ধাক্কা মারলেন। দরজাটা একটু ফাঁক হলো, আর বৃদ্ধা মিসেস ড্রাকেব্রড মুখ বের করলেন।
‘তিনি যেই আমাদের প্রতিনিধিকে দেখতে পেলেন অমনি দরজাটা বন্ধ করে দিলেন মিঃ ওয়েব
see ঘটনার কথা আমাদের এইভাবেই বলেন। আমি আবার ধাক্কা মারলাম। অনেকক্ষণ পরে তিনি আবার দরজা খুলে আমাদের কোম্পানী আর আমাদের তিনি কি ভাবেন সেটাই বললেন।
‘মিসেস ড্রাকেড’, আমি বললাম, আমি দুঃখিত যে আমরা ঝামেলায় সৃষ্টি করছি। তবে এবার আমি বিদ্যুৎ বেচতে আসিনি। আমি কটা ডিম চাইছিলাম।’
তিনি দরজাটা আর একটু ফাঁক করে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেন।
‘আমি আপনার চমৎকার কটা ডমিনিক জাতের মুরগী দেখলাম, আমি বললাম। তাই কয়েক ডজন টাটকা ডিম কিনতে চাই।’
দরজা আরও একটু খুলল। আপনি কি করে জানলেন এগুলো ডমিনিক জাতের?’ ভদ্রমহিলার আগ্রহ জেগে উঠলো।
আমি জবাব দিলাম আমি নিজে যে মুরগি পালন করি, আমাকে স্বীকার করতেই হবে এমন চমৎকার ডমিনিক মুরগী আর দেখিনি।
তাহলে নিজের ডিম ব্যবহার করেন না কেন? ভদ্রমহিলার তবুও সন্দেহ গেল না।
কারণ আমার লেগহর্ণগুলো সাদা ডিম পাড়ে। আর আপনার অবশ্যই জানা আছে সাদা ডিমের চেয়ে লাল ডিম কেক তৈরির পক্ষে ভালো। আমার স্ত্রী আবার চমৎকার কেক বানান।
ইতিমধ্যে মিসেস ড্রাকেড বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন, বেশ ভালো মন নিয়েই। ইতিমধ্যে আমি চারিদিকে তাকিয়ে চমৎকার একটা ডেয়ারী দেখতে পেলাম।
‘আমার কিন্তু মনে হয়’, আমি এবার বললাম, আমি বাজি ধরতে পারি আপনি আপনার স্বামীর ডেয়ারীর চেয়ে এই মুরগীর থেকে ঢের বেশি রোজগার করেন।
ব্যাস্! আর বলতে হলো না। নিশ্চয়ই তিনি বেশি আয় করেন এবং আমাকে সেটা বলতেও চাইলেন। তবে দুঃখের কথা তার স্বামীর মোটা মাথায় তা ঢোকে না।
তিনি আমাদের তার মুরগীর খোঁয়াড়ে নিয়ে গেলেন। পরীক্ষা করে দেখতে পেলাম মহিলা নানা ধরনের সব ব্যবস্থা গড়েছেন। আমি সে সব দেখে খুব প্রশংসা করতে লাগলাম বেশ আন্তরিকভাবে। আমি কিছু খাবার আর তাপের উপদেশও দিলাম এবং মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম কিছু বিষয়। অচিরেই বেশ আলাপ জমে উঠলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি মন্তব্য করলেন, তার কিছু প্রতিবেশী বিদ্যুতের আলো মুরগীর খাঁচায় ব্যবহার করে বেশ সুফল পেয়েছেন। তিনি আমার কাছে আন্তরিকভাবে জানতে চাইলেন এটা তিনি ব্যবহার করবেন কিনা …।
দু সপ্তাহ পরে মিসেস ড্রাকেডের মুরগির খোঁয়াড়ে মুরগিগুলো আনন্দে কঁকর কে করে চলেছিলো। আমিও অর্ডার পাই আর তিনিও বেশ ডিম পেতে থাকেন। প্রত্যেকেই সুখী, প্রত্যেকেরই লাভ হয়েছে।
কিন্তু কাহিনীটির উদ্দেশ্য হলো–ভদ্রমহিলাকে কিছুতেই বিদ্যুৎ বিক্রি করতে পারতাম না যদি প্রথমে আমি তাকে বিদ্যুৎ বিক্রি করার কথা বলতাম। তাকে তাই তাঁর কথাই বলতে দিই।
এ ধরনের মানুষকে কিছুতেই বিক্রি করা যায় না! তাদের কিনতে দিতে হবে। সম্প্রতি নিউইয়র্ক হেরাল্ড ট্রিবিউনে অর্থনৈতিক পাতায় একটা বড় বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল। তাতে একজন অসামান্য যোগ্যতা আর অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লোক চাওয়া হয়। চর্লি, টি কুবেলিশ ওই বিজ্ঞাপনের উত্তর একটা বক্স নম্বরে পাঠান। কদিন পরে তাকে একটা চিঠিতে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়। তিনি যাওয়ার আগে ওয়াল স্ট্রীটে খোঁজ নিয়ে জেনে নেন ভদ্রলোকের সম্বন্ধে সব কিছু। সাক্ষাৎকারের সময় কুবেলিশ বললেন, আপনার মত এরকম বিরাট সুনামের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিজেকে জড়িত করতে পারলে সৌভাগ্যবান বলে মনে করবো। আমি শুনেছি আঠাশ বছর আগে আপনি মাত্র একটা ডেস্ক আর একজন স্টেনোগ্রাফার নিয়ে শুরু করেছিলেন। এটা সত্যি?
প্রায় প্রত্যেক মানুষই অতীতের স্মৃতিচারণ করতে ভালোবাসেন। ভালোবাসেন তার আগের লড়াইয়ের কথা ভাবতে। এই লোকটিও এর চেয়ে আলাদা ছিলেন না। তিনি অনেকক্ষণ ধরে জানালেন তিনি মাত্র সাড়ে চারশ ডলার আর একটা পরিকল্পনা নিয়ে কাজ আরম্ভ করেন। তিনি জানালেন তিনি কেমন করে হতাশা আর অপমানের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন আর টানা ষোল ঘন্টা ধরে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন রবিবারেও। তিনি বললেন কীভাবে তিনি ওয়াল স্ট্রীটের সবচেয়ে বিখ্যাত মানুষ হন। এ ধরনের রেকর্ডের জন্য তিনি গর্বিত। এতে তার অধিকার আছে।
শেষ পর্যন্ত তিনি মি. কুবেলিশকে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা জিজ্ঞেস করলেন, তারপর একজন ভাইস প্রেসিডেন্টকে ডেকে বললেন : আমার মনে হয় এমন একজনকেই আমরা খুঁজছিলাম।’
মিঃ কুবেলিশ বেশ সহজভাবেই তার ভবিষ্যৎ নিয়োগকর্তার সম্পর্কে সব বিষয় জেনে নিয়েছিলেন আর তাঁর সমস্যা সম্বন্ধে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি অপর জনকেই সব কথা বলতে দেন–আর বেশ চমৎকার ধারণাও সৃষ্টি করেছিলেন।
আসল সত্য হলো আমাদের বন্ধুরাও নিজের সম্পর্কে অহঙ্কার করতে ভালবাসে। আমার কোন অহঙ্কার তারা শুনতে চায় না।
একজন ফরাসী দার্শনিক লা রোশফুঁকো বলেছিলেন : আপনি যদি শত্রু চান তাহলে গুণে বন্ধুদের অতিক্রম করুন। আর যদি বন্ধু চান তাহলে তাদের আপনাকে অতিক্রম করতে দিন।
কথাটা সত্যি কেন? কারণ আমাদের বন্ধুরা যখন আমাদের অতিক্রম করে থাকেন তখন তাঁদের গুরুত্ব অনুভব করতে দিই, আর আমরা যখন অতিক্রম করি তখন তাদের একটা হীনমণ্যতা চেপে ধরে, সঙ্গে ঈর্ষা।
জার্মানদের একটা প্রবাদ আছে। সেটা হলো এই রকম : ‘অন্য লোকদের বিপদে আমরা যে আনন্দ পাই তা হলো আসল আনন্দ।’ বা অন্যভাবে বললে : অন্যের বিপদেই আমরা আসল আনন্দ পাই।
হ্যাঁ, আপনাদের কোন কোন বন্ধু আপনাদের ঝামেলায় যত বেশি আনন্দ পান আপনাদের সুখে তত পান না।
অতএব, আমাদের জয়কে কম করেই দেখাই আসুন। আমরা নম্র হই আসুন। তাতে সব সময়েই কাজ হবে। আর্ভিন কবের আসল কৌশলটা জানা ছিল। একজন আইনজ্ঞ কবকে সাক্ষীর কাঠগড়ায় বলেন : আমি শুনেছি আপনি আমেরিকার একজন বিখ্যাত লেখক, মি. কব। এটা সত্যি?
‘আমার যোগ্যতার চেয়ে আমি আশাতীত পেয়েছি, কব জবাব দেন।
আমাদের নম্র হওয়া উচিত, কারণ আমার বা আপনার তেমন দর নেই। আগামী এক শতকের মধ্যেই আমাদের সবাই একেবারে ভুলে যাবে। নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করার ক্ষেত্রে আমাদের জীবন বড়ই ক্ষণস্থায়ী। তাই অন্যকে কথা বলতে দিন। ভেবে দেখুন সত্যিই বড় করে বলার মত আমাদের কিছু আছে কি? আপনার সঙ্গে একজন মূর্থের পার্থক্য কতটা জানেন? বেশি নয়, থাইরয়েড গ্ল্যাণ্ডে এক নিকেল মাপের আয়োডিন। কোন চিকিৎসক আপনার থাইরয়েড গ্ল্যাণ্ড থেকে ওই আয়োডিন বের করে নিলে আপনি একজন বোকা লোক হয়ে যাবেন। এই সামান্য আয়োডিনই সব বদলে নিতে পারে। তাই গর্ব করে লাভ কি বলুন?
অতএব, অপরকে স্বমতে আনতে চাইলে ৬ নম্বর নিয়ম হল :
‘অপর ব্যক্তিকেই বেশি কথা বলতে দিন।’