২০. হালকা প্রস্তুতি সেরে

২০

হালকা প্রস্তুতি সেরে আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিচ্ছিল আঁচল। আয়নাতেই নজরে পড়ল, নির্বাণ এখনও শয্যায়। সেই এক বাঁধা ভঙ্গি, ডান হাতে আড়াআড়ি ভাবে ঢেকে আছে দু’ চোখ। জাগ্রত কিনা বোঝার জো নেই, কারণ ঘুমোয়ও প্রায় ওই কায়দায়। কিন্তু কেন? চারপাশের জগৎটাকে আঁখি মেলে দেখতে অনীহা? না এ নিছকই ছেলেবেলা থেকে গড়ে ওঠা অভ্যেস?

যা খুশি হোক, এই মুহূর্তে নির্বাণকে নিয়ে ভাবার সময় নেই আঁচলের। কিন্তু বেরোতে হবে জেনেও কেন এভাবে পড়ে আছে নির্বাণ? আঁচলের জেঠুর বাড়ি যেতে নির্বাণ মোটেই আগ্রহী নয়, তাকে ঘাড়ে করে নিয়ে যেতে আঁচলেরও বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না। নেহাত পিসি পইপই করে বলল, এদিকে বিদিশাদেবীও নির্দেশ জারি করে গেছেন, তাই না যুগলে তারা…। তা বলে এখন বেরোনোর মুখে সাধ্যসাধনা করতে হবে নাকি? সাড়ে তিনটে বাজে, অপেক্ষাই বা করবে কতক্ষণ?

আঁচল নীরস স্বরে ডাকল, “শুনছ? আমি কি একাই রওনা দেব?”

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে স্প্রিংয়ের পুতুলের মতো উঠে বসেছে নির্বাণ। চোখ সরু করে বলল, “তুমি রেডি? বলবে তো? এত প্লেন ড্রেসে যাচ্ছ যে? একটু সাজগোজ করলে না?”

বাড়তি জবাবে গেল না আঁচল। বলল, “আমি তো সাজি না।”

“তা ঠিক। তুমি তো যোগিনী প্যাটার্ন।” তরল সুরেই বলল নির্বাণ, “তবু বিয়ের পর জ্যাঠা-জেঠির সঙ্গে পহেলা মোলাকাতে যাচ্ছ, একটু তো অন্তত…”

“এটা তো প্রমোদ ভ্রমণ নয়। একজন অসুস্থ মানুষকে দেখতে যাওয়া।” একটু শক্ত গলাতেই বলল আঁচল। কবজিঘড়ি দেখে নিয়ে শান্তিনিকেতনি ভ্যানিটি ব্যাগ চাপাল কাঁধে। শাশুড়ির রেখে যাওয়া প্লাস্টিক প্যাকেটখানা হাতে তুলে বলল, “আমি নীচে ওয়েট করছি।”

আঁচল ঘর থেকে বেরিয়ে সুছন্দ পায়ে নামল একতলায়। বসতে গিয়ে থমকেছে। ঢাউস সোফাটায় মণিকাকা। লম্বা হয়ে শুয়ে। বুকের ওপর একখানা পাতলা মতো বই। দুপুরে খাওয়ার সময়েও তো দেখেনি, এল কখন? কী কাজে? না জানি বেচারা লোকটাকে কোনও ফরমাস করে গেছেন শাশুড়ি ঠাকরুন?

আঁচল স্মিত মুখে আলগা কৌতূহল দেখাল, “এত মন দিয়ে কী পড়ছেন মণিকাকা?”

মণিলাল উঠে বসেছে। সামনের টেবিলে বইখানা উলটে রেখে বলল, “প্রতিস্বর। একটা লিটল ম্যাগাজিন। আটজন কবিকে নিয়ে বিশেষ কবিতা সংখ্যা।”

“আপনি কবিতা পড়তে ভালবাসেন বুঝি?”

“মন্দ লাগে না। তবে এটা উলটোচ্ছিলাম অন্য কারণে। সজলের আটখানা কবিতা ছেপেছে কিনা।”

আঁচল বিড়বিড় করল, “স-জ-ল… মানে…”

“হ্যাঁ। সজল চৌধুরী। তোমার স্বর্গত শ্বশুরমশাই।” মণিলাল যেন সামান্য উদাস, “কবিতাগুলো পড়তে পড়তে মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল, বুঝলে।”

“কেন মণিকাকা? দুঃখের কবিতা বুঝি?”

“না। প্রতিবাদের। জীবনকে নিংড়ে চারপাশের কুশ্রীতাকে আঘাত করতে চেয়েছে কবিতায়।” মণিলাল ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল, “এমন একজন জোরালো কবিকে পার্টি চিনলই না। কাঁচা ভাষায় স্লোগান মারতে পারে না বলে পুরো হুট আউট করে দিল। আর সজলই বা কী? অত যার কলমের জোর, সে কিনা হতাশায় ভুগে…”

সজল চৌধুরী যে আত্মহত্যা করেছিল, আঁচল জানে। অম্বরই বলেছিল, বিয়ের আগে। এ বাড়িতে অবশ্য ওই প্রসঙ্গ কেউ তোলে না। শাশুড়ির ঘরে একটা ছবি আছে, এই সংসারে ওইটুকুই যা তার অস্তিত্ব। আজ হঠাৎ মণিলালের মুখে মানুষটার কথা শুনে বেশ বিস্মিতই হচ্ছিল আঁচল।

ঈষৎ দ্বিধা নিয়ে আঁচল জিজ্ঞেস করে ফেলল, “হতাশা থেকেই কি উনি…?”

মণিলাল কয়েক পল স্থির চোখে দেখল আঁচলকে। তারপর আচমকাই এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, “তোমরা তো এখন বেরোবে। বান্টি কোথায়?”

আঁচল আরও অবাক। মণিকাকা কথাটা ঘুরিয়ে দিলেন যে বড়? তবে আর খোঁচালও না আঁচল। বলল, “নির্বাণ রেডি হচ্ছে। আসছে।”

“আমি তা হলে ট্যাক্সি ডেকে আনি?”

“ছি ছি, আপনি কেন? আমরাই ধরে নেবখন।”

“কিন্তু বিদিশা যে আমায় বলেছে তোমাদের ট্যাক্সিতে তুলে দিতে।”

আহা রে, মণিকাকা কি সেই জন্যেই এসে বসে আছেন? সত্যি, বিদিশাদেবী পারেনও বটে লোকটাকে চাকরের মতো খাটাতে। পলকের জন্যে আঁচলের এও মনে হল, ছেলের অনিচ্ছা বোধহয় লক্ষ করেছে মা, আর তার যাওয়াটা নিশ্চিত করতেই আজ নিযুক্ত হয়েছেন মণিকাকা। মহিলা যে যথেষ্ট প্যাঁচোয়া, নিজের প্রতিটি হুকুম-ইচ্ছে-অনিচ্ছে যথাযথভাবে তামিল হচ্ছে কিনা দেখার জন্যে সদা তত্পর এবং আটঘাট বেঁধেই তার বন্দোবস্ত করেন, আঁচল তা টের পায় বই কী।

আঁচল অল্প হেসে বলল, “চিন্তা করবেন না মণিকাকা। সামনেই তো বড় রাস্তা, ওখানে দাঁড়ালেই তো ট্যাক্সি…. আপনি বরং বিশ্রাম নিন।”

“বলছ?” কী যেন ভাবল মণিলাল। তারপর সোফার পাশে রাখা একটা পলিথিনের ব্যাগ তুলে বলল, “এটা নিয়ে রাখো তা হলে।”

“কী আছে এতে?”

“তোমার শাশুড়ি কিছু ফল কিনে আনতে বলেছিল। আপেল বেদানা আঙুর মুসুম্বি…। তোমার জেঠুর জন্যে।”

আশ্চর্য, আঁচল কি এইটুকুও কিনতে পারে না? আদরে গোবর বান্টির মতো সেও কচি শিশু নাকি? তা ছাড়া জেঠু এখন কী খায়, আদৌ ফল চলবে কিনা তাই বা কে জানে!

নির্বাণ নেমেছে। জিনস টিশার্ট চড়িয়ে। মণিলাল বলল, “এগোও তা হলে। ট্যাক্সিতেই ঘুরে এসো। জুলাই মাস থেকে অবশ্য বাড়ির গাড়িই ইচ্ছেমতন ব্যবহার করতে পারবে।”

আঁচল ঠিক বুঝল না। জিজ্ঞেস করল, “কেন?”

“বা রে, জুলাই থেকে বিদিশা ভাইস চ্যান্সেলারের চার্জ পাচ্ছে না? তখন তো ইউনিভার্সিটিই ওকে আলাদা গাড়ি দেবে।”

নির্বাণ পুট করে বলে উঠল, “জানি। জানি। মায়ের লেজ আরও এক ইঞ্চি মোটা হতে চলেছে। তা সেই বাসি খবরটা নানান অছিলায় বারবার ঘোষণা করার কী আছে?”

নির্বাণের ব্যঙ্গে ভ্রুকুটি করল মণিলাল। গ্রাহ্য না করে নির্বাণ হাঁটা দিয়েছে। ফলের ঝোলাটা নিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে আঁচলও।

ট্যাক্সিতে উঠে আঁচল বলল, “মায়ের সম্পর্কে ওরকম কমেন্ট না করলেই পারতে। মণিকাকা হয়তো হার্ট হলেন।”

নির্বাণের চোখ উলটোদিকের জানলার বাইরে। তাচ্ছিল্যের স্বরে কথা ভাসিয়ে দিল, “ছাড়ো তো। মণিকাকা একটা মানুষ নাকি?”

“তা বটে। মানুষ তো তুমি। প্রবল প্রতাপশালী…”

প্রতিক্রিয়া নেই। নিচু গলায় বলল বলে নির্বাণ কি শুনতে পায়নি? বুঝতে পারল না আঁচল। তবে আর কথাও বাড়াল না। সত্যি বলতে কী, নির্বাণের সঙ্গে কথা বলতেই তার ইচ্ছে করে না। কী নিয়েই বা বলবে? ইতিহাস ভূগোল শিল্প সাহিত্য রাজনীতি সমাজনীতি, কোনও বিষয়েই কিছু জানে বলে মনে হয় না। দুটোর বেশি তিনটে বাক্য উচ্চারণ করলেই অমার্জিত রূপটা প্রকাশ হয়ে পড়ে। অতএব অসহ্য সংলাপের চেয়ে ঠোঁট বুজে থাকাই তো ঢের ঢের ভাল।

ভার ভার মুখে আঁচল দৃষ্টি মেলল বাইরে। দুপুর গড়িয়ে একটা সোনালি বিকেল ফুটেছে। দেখছিল না আঁচল। কিছুই যেন বিম্বিত হচ্ছে না চোখে। মন যদি না চায়, প্রকৃতির সাধ্য কী তার রূপ-রস-গন্ধ পৌঁছে দেয় নয়নে!

মনটা কি ক্রমশ মরে যাচ্ছে আঁচলের? হয়তো বা। মনের আর দোষ কী, যা উত্পীড়ন চলছে মনের ওপর। গ্যাংটকের সেই বিভীষিকাময় রাতেই তো তার সমাপ্তি ঘটেনি, কলকাতায় ফিরেও তো সে বারবার শিকার হচ্ছে সেই নিষ্ঠুরতার। নির্বাণের বাসনার চেহারাটা যে কী উত্কট! অভাবিতও বটে। হয়তো পরপর দু’-তিন দিন একেবারে নিরীহ, শান্তশিষ্ট… অফিস থেকে ফিরে গানটান শুনল… যেচে আঁচলের পড়াশোনা, কলেজ নিয়ে এতাল-বেতাল প্রশ্ন করল দু’-চারটে… তারপর খেয়েদেয়ে এসে দিব্যি নির্বিবাদে তলিয়ে গেল ঘুমে। আঁচলকে একবার স্পর্শ পর্যন্ত করল না। আবার এক একদিন হয়তো একটু দেরি করে ফিরল। থমথমে মুখ, ব্যালকনিতে পায়চারি করছে অবিরত, কিংবা হয়তো ছাদেই উঠে গেল…। রাতেও বিছানায় এসে শুচ্ছে না, দোতলার ড্রয়িংরুমে ঠায় বসে। ঘর অন্ধকার করে। টিভি না চালিয়েই। তারপর হঠাৎ বিছানায় হানা। বিকারগ্রস্ত এক পশুর মতো আঁচলকে ছিঁড়েখুঁড়ে দলিত মথিত করে তবে যেন শান্ত হয় তার কামের তাড়না। ওই প্রত্যেকটা রাতই তো মরণের আহ্বান শোনাচ্ছে আঁচলকে, নয় কী?

বুকের গভীরে পাহাড়ের ভার। আঁচল ঘাড় হেলিয়ে একবার দেখল নির্বাণকে। কী নির্বিকার মুখ। নাকি বোধহীন? ভাবামাত্র আরও যেন ভারী হয়ে গেল বুকটা। প্রেম বিয়ে বর সংসার, এসব নিয়ে কোনও কালেই মনে তেমন রোমান্টিক ছবি ছিল না আঁচলের। জগত্সংসারের নিয়মমতোই কখনও বিয়েটা ঘটবে, রীতিমাফিক নারী-পুরুষের মধ্যে একটা জৈবিক সম্পর্ক তৈরি হবে, এ তো সে জানতই। সেই সম্পর্কে হৃদয় না থাকলেও শরীর যে থাকবেই, এও তো তার অজানা নয়। হয়তো সে জন্য কিছু দ্বিধা সংকোচ কুণ্ঠা ছিল। তবু সেই আড়ষ্টতা কাটানোর জন্যে নিজেকে তো সে প্রস্তুতও করেছিল। মনকে বুঝিয়েছিল নারী-পুরুষের বন্ধন শরীরের পথেই আসে। পছন্দ অপছন্দকে সরিয়ে রেখে তাকে মেনে নিতে হয়। কিন্তু তারও তো একটা স্বাভাবিক চেহারা থাকে। একজন বেমানান পুরুষের এই কুৎসিত বিকৃতি সে কীভাবে সইবে? দিনের পর দিন? তার চেয়েও বড় কথা, এই বিশ্রী অশান্তিটা তো সে কারও সঙ্গে ভাগাভাগিও করতে পারবে না। কার কাছে সে অকপট হয়ে উজাড় করবে মন? মা? ভয়ংকর ধাক্কা খাবে। বাপি? তাকে তো সম্ভবই না। যদি বা ঠারেঠোরে আন্দাজ করে, ভীষণ ভীষণ দুঃখ পাবে। হয়তো মনে মনে নিজেকে দায়ী করতে শুরু করবে। অলিও কি আঁচলকে বুঝবে? জীবন সম্পর্কে কোনও বোধই তৈরি হয়নি অলির। বড় জোর আলুভাতে মার্কা জামাইবাবু আস্ত একখানা হিম্যান হয়ে উঠবে তার চোখে। হয়তো হিহি হেসে বলবে, ও যদি বুনো হয় দিদিভাই, তুইও বন্যা হয়ে ওঠ না রে।

ইস, বাবাকে যদি বলা যেত? পরক্ষণে নিজেকে ধমক দিল আঁচল। লাভটা কী? বাবা হয়তো নির্বাণের কলার ধরে ঝাঁকিয়ে তাকে সজুত হওয়ার জন্যে শাসাতে পারে। কিন্তু তাতে আঁচলের সমস্যার সমাধান হবে কী? তখন হয়তো বাবাই হয়ে দাঁড়াবে সকলের আক্রমণের চাঁদমারি। বিশেষত মা। বাইরে থেকে এসে জোর করে নাক গলিয়ে মেয়ের বিবাহিত জীবন নষ্ট করে দিচ্ছে, এ বলে বাবাকেই আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেবে। আঁচল কি তা চাইতে পারে কখনও?

তা ছাড়া আঁচল কী দেবরাজ সিংহরায়কে এসব কথা মুখ ফুটে বলতে পারবে? পারে কখনও? বাবার মর্যাদা যাতে ক্ষুণ্ণ না হয়, তার জন্যে বিয়েতে তাকে আসতে নিষেধ করতে পারে আঁচল। তা বলে একান্ত ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে…

অসম্ভব। আঁচল আর দেবরাজ সিংহরায়ের মধ্যে সেই নৈকট্য তো তৈরি হয়নি কোনওদিন।

কার সঙ্গেই বা হয়েছে? মা? বাপি? অলি? সবার সামনেই তো সংকোচের পরদা দোলে অহরহ। আর পরদার এপারে তো আঁচল একাই। কেন যে হল এমনটা? কেন আর পাঁচটা মেয়ের মতো সহজ সরল হতে পারল না আঁচল? মায়ের সঙ্গে তার তো দূরত্ব থাকার কথাই নয়, বাপিও তাকে কম ভালবাসেনি, অলিও তার এত আপন, তবু তো ঘুচল না ব্যবধান। সে কি শুধু দেবরাজ সিংহরায়ের কারণে? নাকি আঁচল নিজেই পুঁতেছে এই দূরত্বের বীজ? নিজের অজান্তেই?

সন্তর্পণে একটা শ্বাস ফেলল আঁচল। সে ছাড়া আর যেন কেউ টের না পায়। গাঢ় বিষাদের মাঝেও হাসি পেল অচমকা। বুঝি বা একাকিত্ব থেকে নিষ্কৃতি পেতেই এক কথায় রাজি হয়েছিল বিয়েতে, এখন সেই বিয়েই হয়েছে গলার ফাঁস। ঠেলছে আরও গভীরতর একাকীত্বের গহ্বরে। কপাল বটে।

নির্বাণ নড়াচড়া করছে। বলে উঠল, “টালার ট্যাংক তো দেখা যাচ্ছে, আর কদ্দূর?”

আঁচল সোজা হয়ে বসল, “এসে গেছি প্রায়।”

“ওখানে কতক্ষণ থাকতে হবে?”

“তোমার যতক্ষণ ইচ্ছে। ভাল না লাগলে দেখা দিয়েই বেরিয়ে যেয়ো।”

নির্বাণ বুঝি সামান্য থতমত। আঁচলের নিষ্প্রাণ স্বরে চোরা উষ্মা টের পেয়েছে যেন। হঠাৎই বাড়তি সপ্রতিভতা ফুটেছে তার গলায়। উপদেশের ঢঙে বলল, “অত গোমড়া হয়ে থেকো না, বুঝলে।”

আঁচল ঘাড় হেলাল। ভুরুতে প্রশ্নচিহ্ন।

একটু আমতা-আমতা করে নির্বাণ বলল, “না মানে… বলছিলাম কি… অসুখ-বিসুখের বাড়ি যাচ্ছি বটে, তবে মুখ অমন ভেটকে থাকলে তোমার জ্যাঠা-জেঠির কি ভাল লাগবে?”

জবাব দিল না আঁচল। প্রয়োজনই বোধ করল না। অল্প গলা উঁচিয়ে পথনির্দেশ দিচ্ছে ড্রাইভারকে।

ট্যাক্সি থেকে নেমে গলি ধরে জেঠুর বাড়ির সদরে এসে থামল আঁচল। জানে, ভেজানো দরজা ঠেললেই যথেষ্ট, তবু কড়া নেড়েছে।

পাল্লা খুলে গেল। অমনি লক্ষ ভোল্টের ইলেকট্রিক শক। বাবা!

দেবরাজ হাসছে মিটিমিটি, “খুব অবাক হয়েছিস তো?”

“ভীষণ।” ক্ষণপূর্বের মনখারাপ ছাপিয়ে আঁচলের কণ্ঠে উচ্ছ্বাস ঠিকরে এল, “কবে এলে? এসে ফোন করোনি কেন?”

“তা হলে কি আমার সুইটি মেয়ের বিউটি চমকটা দেখতে পেতাম?” বলতে বলতে আঁচলের পিছনে দাঁড়ানো নির্বাণের উপর দৃষ্টি পড়েছে দেবরাজের। অমনি হাত বাড়িয়ে দিল। থাবায় নির্বাণের হাতটা চেপে ধরে বলল, “ওয়েল ইয়াং ম্যান, তুমি নিশ্চয়ই আঁচলের ওয়ার্স হাফ? আঁচলের পাণিপীড়নের সৌভাগ্যের জন্য অভিনন্দন।”

দেবরাজের গমগমে স্বরের ধাক্কায়, আর হাতের ঝাঁকুনিতে রীতিমতো বিপর্যস্ত নির্বাণ। বোকা বোকা মুখে হাসছে। দেখে মজা লাগছিল আঁচলের। অনুচ্চ স্বরে নির্বাণকে বলল, “আমার বাবা।”

শুনেই ঢিপ করে প্রণাম করতে যাচ্ছিল নির্বাণ। ছিটকে সরে গেছে দেবরাজ, “আরে করছটা কী? আঁচল তোমায় বলেনি, আমি কারওর গুরুজনটন নই, প্রণাম-টোনাম নিই না? …এসো এসো ভিতরে এসো।”

বনানী শুভ্রাও বেরিয়ে এসেছে। বনানী প্রায় টানতে-টানতে আঁচল আর নির্বাণকে নিয়ে গেল দেবপ্রিয়র ঘরে। শুয়ে ছিল দেবপ্রিয়, হইচই শুনে উঠে বসেছে। তাকে দেখেই আঁচলের বুক ধক করে উঠল। এই তো পুজোর পর এসেছিল, মাত্র কয়েক মাসেই জেঠুর চেহারা এত খারাপ হয়ে গেল? কণ্ঠা ঠেলে বেরিয়েছে, দেহে যেন হাড় আর চামড়া ছাড়া কিচ্ছু নেই। আঁচলকে দেখলেই চোখ জ্বলজ্বল করত জেঠুর, সেই দৃষ্টি এখন কী নিষ্প্রভ।

গা শিরশির করছিল আঁচলের। এক পা এক পা করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, এমন মানুষকে দেখে কি এই অনুভূতিই হয়?

অস্বস্তি লুকিয়ে দেবপ্রিয়র কাছে এল আঁচল। মুখ দিয়ে প্রায় বেরিয়ে যাচ্ছিল, কী গো, কেমন আছ… বলতে গিয়েও গিলে নিল। স্বাভাবিক কুশল প্রশ্নটা কি নিষ্ঠুর ঠাট্টার মতো শোনাবে না? জেঠুর শীর্ণ হাতখানা ধরে কোমল স্বরে বলল, “রোজই ভাবি আসব আসব, কিছুতেই হয়ে উঠছিল না…”

“মিছে কথা। ডাকলাম বলে তবে এলি।” দেবপ্রিয়র ভাঙা ভাঙা গলায় শিশুর অভিমান। জুলজুল চোখে দেখছে নির্বাণকে। জীর্ণ মুখে ধীরে ধীরে একটা হাসি ফুটে উঠল, “বাহ, জামাই আমাদের খাসা হয়েছে তো।”

বনানী বলল, “দেখতে কী সুন্দর না?”

শুভ্রা যেন বলার জন্যেই বলল, “দু’জনকে চমৎকার মানিয়েছে।”

আঁচলের কানদুটো জ্বালাজ্বালা করে উঠল। প্রসঙ্গ পালটানোর জন্যে হাতের প্যাকেটগুলো বাড়িয়ে দিয়েছে শুভ্রাকে। বলল, “আমার শাশুড়ি পাঠিয়েছেন। তোমার প্রণামীর শাড়ি আর জেঠুর ধুতি-পাঞ্জাবি। আর কিছু ফল।”

দেবপ্রিয় ক্ষীণ স্বরে বলল, “আমার জন্যে আবার এসব কেন? আর কি আমি পরতে পারব?”

দেবরাজ লঘু ধমক দিল, “কেন পারবি না? কালই পরবি। আমি এসে কাল তোকে নিয়ে হাঁটতে বেরোব।”

“যাহ, পরশু আমার হসপিটাল অ্যাডমিশন…”

“তো কী? পরশু মানে তো কালকের পরের দিন। পরশুর কথা ভেবে কালকের দিনটা নষ্ট করবি কেন?”

বাবার এই কথাগুলোই ভিতর থেকে নাড়িয়ে দেয় আঁচলকে। কী অদম্য প্রাণশক্তি, কিছুতেই যেন হার মানবে না। জীবনের প্রত্যেকটা দিন যেন আলাদা করে বাঁচে দেবরাজ সিংহরায়। তার মেয়ে হয়ে আঁচল যে কেন ডুবে যাচ্ছে নিরাশায়?

বনানী বকবক জুড়েছে নির্বাণের সঙ্গে। বিষয়ের তার অন্ত নেই। কখনও নির্বাণের মা, কখনও তার অফিস, আবার কখনও বা আঁচল-নির্বাণের দাম্পত্য জীবনে উঁকি মারার নিছক মেয়েলি কৌতূহল। শুভ্রা চলে গেছে রান্নাঘরে, তাদের খাতিরদারির আয়োজন করতে। প্লেট মিষ্টিতে সাজছে, ছ্যাঁকছোঁক ভাজা হচ্ছে লুচি, এ বাড়ির বাতাসে ভাসমান মৃত্যুর গন্ধ বদলে যাচ্ছে অচেনা সুরভিতে। হয়তো এ বদল নেহাত সাময়িক, তবু দেবপ্রিয়-শুভ্রার পাঁশুটে জীবনে এর মুল্যও কি খুব কম এখন?

তবে পিসি-জেঠির একঘেয়ে আলোচনায় হাঁপিয়ে উঠছিল আঁচল। নির্বাণকে তাদের জিম্মায় রেখে টুকুস সরে এসেছে পাশের ঘরে। দেবরাজের সঙ্গে। বাপ-মেয়েতে চলছে কথা। কবে কলকাতায় এল দেবরাজ, এবার কদ্দিন থাকবে এইসব। জেঠুর শারীরিক অবস্থা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানছিল আঁচল।

হঠাৎই দেবরাজ বলল, “তোকে একটা কথা বলব বলে ভাবছিলাম।”

দেবরাজ যেন ঈষৎ দ্বিধাগ্রস্ত। আঁচল হাঁ। বাবার মধ্যে দোনামোনা ভাব তো দেখে না বড় একটা। জিজ্ঞাসু চোখে বলল, “কী?”

“জানিস তো, তোর শ্বশুরমশাইকে আমি চিনতাম।”

“ওমা তাই? কীভাবে?”

“আর্ট কলেজ থেকে পাশ করে আমরা একটা গ্রুপ ফর্ম করেছিলাম। সাত আটজন মিলে। তখন কনটেম্পোরারি কবিদের কবিতার সঙ্গে ছবি এঁকে আমরা এগ্‌জ়িবিশন করেছিলাম একটা। কবিদের মধ্যে সজল চৌধুরীও ছিল। তোর পিসির মুখে নামটা শুনেই মাথায় স্ট্রাইক করেছিল। অসীম স্মরণ করিয়ে দিল। আমি অবশ্য ওঁর কবিতা নিয়ে ছবি আঁকিনি, এঁকেছিল মনোজ। তবু আমার সজলকে মনে পড়ে গেল। তখন সে এক্কেবারে ইয়ং, তোর বরের বয়সিই হবে বড় জোর। ওরকমই গোলগাল মুখ, তবে চোখে চশমা ছিল। রোজই এগ্‌জ়িবিশন চলার সময়ে অ্যাকাডেমির ফোয়ারাটায় এসে বসে থাকত। একাই। তখনই আলাপ। শুনেছিলাম পার্টি করে, কিন্তু ভীষণ শাই। সেই মানুষটাই এগ্‌জ়িবিশনের শেষদিন…”

দেবরাজ থেমে গেল আচমকা। আঁচল মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল, হঠাৎ ছেদ পড়ায় তার চোখ পিটপিট। জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছিল গো?”

“সে এক কাণ্ড। আমরা সেদিন সবাই মিলে ঠিক করলাম, জোর একটা ফুর্তি করব। কোথায় যাব, কোথায় যাব… চলো দলবল নিয়ে বারদুয়ারি।”

“সেটা আবার কী?”

“আমাদের গ্র্যান্ড ঠেক। হা হা হা। বাংলা মালের একটা পানশালা।”

দেবরাজকে অনেকটাই চিনে গেছে আঁচল, ভালমতোই জানে লুকোছাপা করার মানুষ নয় বাবা। নির্বাণ গোছের কারওর মুখে এহেন উক্তি শুনলে সে নির্ঘাত নাক কুঁচকোত, কিন্তু দেবরাজের ক্ষেত্রে ছদ্মকোপই ফুটল শুধু। হাসি চেপে চোখ পাকিয়ে বলল, “এ মা, তোমরা দিশি মদ খেতে?”

“আরে, বিলিতির পয়সা তখন পাব কোথায়? সাতদিনে একটা ছবিও বিক্রি হয়নি, সকলেরই পকেট ঢনঢন, নো রেস্ত, সুতরাং কালিমার্কাই ভরসা।” দেবরাজ এক গাল হাসল, “তা হয়েছে কী, ওই সজলকেও নিয়ে যাওয়া হল সেই আসরে। ও গড, দেখি কি… বোতলে চুমুক মেরেই সজল বিলকুল চেঞ্জ। নাড়ুগোপাল টু গামা পালোয়ান। নিরীহ লোকটার তখন কী দাপানি! বিশ্বসুদ্ধু সব্বাইকে বেপরোয়া গাল ঝাড়ছে। বাবা, মা, পার্টি এমনকী বউকেও!”

“কেন? কী নিয়ে?”

“অত কি আর আমার মনে আছে? সেই কবেকার ঘটনা। কম সে কম পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর। তার ওপর আমিও কি তখন পুরো সজ্ঞানে আছি? তবে মনে হচ্ছিল ও যেন সব কিছু ভেঙেচুরে শেষ করে ফেলতে চায়। ইন ফ্যাক্ট, ও বোধহয় সেদিন একটা মারপিটও করেছিল…” দেবরাজকে সহসা একটু গম্ভীর দেখাল, “দেখিস, তুই যেন বরকে এসব গল্প করিস না। আমি কিন্তু সজল চৌধুরীর নিন্দে করছি না, তাকে আমার মোটেই খারাপ লোক বলে মনে হয়নি। ইন ফ্যাক্ট, হি লুকড ভেরি সেনসিটিভ। তবু আমি কাহিনিটা বলেছি শুনলে ও হয়তো…”

আবার থামল দেবরাজ। থামতেই হল। তন্ময় এসেছে।

বরকে দেখেই বনানী নতুন উদ্যম পেল যেন। বিয়ের জল গায়ে পড়তেই আঁচলের রূপ আরও কতটা খুলেছে, বিদিশা উপাচার্য হয়ে কতটা মান বাড়ল আঁচলদের পরিবারের, তারই ব্যাখ্যান করছে নানান রকম।

কাঁহাতক এসব গেলা যায়? যা উচ্ছ্বাসের বান ডেকেছে পিসির, বাবাকে আর একান্তে পাওয়া অসম্ভব। অগত্যা উঠেই পড়ল আঁচল। নির্বাণও অনেকক্ষণ ধরে পালাই পালাই করছিল, সেও যেন বাঁচল হাঁফ ছেড়ে।

রাতে খাওয়ার টেবিলে বিদিশা জিজ্ঞেস করল, “কেমন দেখলে তোমার জেঠুকে?”

দেবরাজের স্বপ্নিল আবির্ভাবে এখনও আবিষ্ট আঁচল। তবু শুকনো মুখেই বলল, “ভাল না। তবে কেমোথেরাপিতে জেঠু যদি রেসপন্ড করে, তা হলে হয়তো এ যাত্রা… মানে আরও হয়তো কয়েকটা বছর…”

“বাহ, এ তো অতি উত্তম সমাচার। …তা তোমার জেঠি একা হাতে সামলাতে পারবেন তো সব কিছু?”

“একা কোথায়? পিসি-পিসেমশাই রয়েছেন, বাবাও এসে গেছে…”

“ও। উনি এখন কলকাতায়?”

“হ্যাঁ। পরশু এসেছে। এখন কিছুদিন থাকবে।”

বিদিশার হাত থামল ক্ষণেক। প্লেটে চোখ রেখে বলল, “বুঝেছি। পার্লামেন্ট ইলেকশন না চোকা পর্যন্ত উনি ফিরছেন না।”

শাশুড়ির স্বরে কেমন অন্যরকম গন্ধ। ‘বলব না বলব না’ করেও আঁচল বলে ফেলল, “ইলেকশনের সঙ্গে বাবার কী সম্পর্ক? জেঠুর কেমোথেরাপি মনিটর করার জন্যে বাবাকে রয়ে যেতে হচ্ছে।”

“স্ট্রেঞ্জ! মেয়ের বিয়েতে এলেন না, অথচ এখন দাদার অসুখে…।” বিদিশার গলায় যেন সন্দেহের সুর, “বনানীর কাছে যতটুকুনি শুনেছি, উনি নাকি দাদা বোন কারওর সঙ্গে তেমন যোগাযোগ রাখেন না…”

“বাবা একটু আপনভোলা টাইপ। কখন যে কী করে…”

“হুঁ। আর্টিস্ট বলে কথা!” বিদিশার কণ্ঠে পলকা শ্লেষ উঁকি দিয়েও যেন মিলিয়ে গেল। হাসিমুখেই বলল, “তা একদিন এখানে আসতে বলেছ?”

“না।”

“ডাকো। টিভিতে খালি গরম গরম কথা শুনেছি, সামনাসামনি আলাপ করি।”

ঘাড় নাড়তে গিয়েও আঁচলের দোলাচল। শাশুড়ির আমন্ত্রণটা কেমন যেন সুবিধের মনে হচ্ছে না। কেন আসবে বাবা এখানে? বিদিশাদেবীর সঙ্গে পলিটিকাল তর্ক করতে?

ক্ষমতাগর্বী মানুষদের ঘোরতর অপছন্দ করে বাবা। আঁচল জানে। তারপরেও কি দেবরাজ সিংহরায়কে বিদিশা চৌধুরীর বাড়িতে ডাকতে পারে আঁচল? অসম্ভব।

২১

বৈশাখের শুরু থেকেই এ বছর সূর্যদেবের মেজাজ গরম। দিনভর রক্তচক্ষু দেখাচ্ছেন রোজ। শুকনো খোলায় গনগনে আঁচে ঝলসাচ্ছেন শহরটাকে। মাসের মাঝামাঝি হয়ে গেল এখনও ঝড়বৃষ্টির কোনও লক্ষণ নেই। সামনেই লোকসভার ভোট আরও যেন বাড়িয়ে দিয়েছে তাপ। মিটিং মিছিল মারপিট আর গালাগালির চাপানউতোরে উত্তেজনার পারদও চড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ভোট না বৃষ্টি, কোনটা যে স্বস্তি দেবে বুঝি ঠাহর করতে পারছে না মানুষ।

পুরনো একটা উপন্যাসের পাতা উলটোতে উলটোতে ঘুমিয়ে পড়েছিল মানসী। এই গরমেও শোওয়ার ঘরে এখন তার আরামই আরাম। ঘোরতর এসি বিরোধী শান্তনুকেও এবার ঠান্ডা মেশিন বসাতে হয়েছে যে। মানসীর চাপে পড়ে নয়, ছোটকন্যের আবদারে। তবে রাতটুকু ছাড়া অলি কতক্ষণই বা বাড়ি থাকে, লাভটা হয়েছে মানসীরই। এসি চালিয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়লেই দু’ চোখ জড়িয়ে আসে আমেজে। দুপুর পেরিয়ে কখন যে বিকেল এসে যায়, হুঁশও যেন থাকে না তখন।

আজ অবশ্য ছিঁড়ে গেল তন্দ্রা। কলিংবেলের আওয়াজে। তিনটে চল্লিশ। কুসুম এত তাড়াতাড়ি? নাকি পেটের দায়ে টো টো করে বেড়ানো কোনও সেলসম্যান?

শীতল কক্ষ থেকে বেরোতেই আগুনে হলকার ঝাপটা। বসার জায়গাটুকু পেরোতেই যেন গায়ে ফোসকা পড়ছে। মেঝেতেও কী তাত!

ঈষৎ বিরক্তিভরেই মানসী দরজা খুলেছিল। সঙ্গে সঙ্গে জোর ঝাঁকুনি। বিতনু। শান্তনুর ছোটভাই। পরনে চিরাচরিত বেশ। পাজামা-পাঞ্জাবি, কাঁধে ঝোলাব্যাগ।

মানসী তাড়াতাড়ি বলল, “এসো এসো, ভিতরে এসো।”

বিতনু ঢুকল। ঈষৎ দ্বিধান্বিত পায়ে। দরজার পাশে চটি ছাড়তে ছাড়তে বলল, “অসময়ে এলাম।”

“দাদার বাড়ি আসবে তার আবার সময় অসময় কী?” মানসী পাখা চালিয়ে দিল, “রোদ্দুরে তো একেবারে ভাজা ভাজা হয়ে গেছ।”

“ও আমাদের অভ্যেস আছে। গাঁয়েগঞ্জে তো রোদবৃষ্টি মাথায় নিয়েই ঘুরতে হয়।”

বিতনুর এই ধরনের কায়দা মারা কথাবার্তা মানসীর পছন্দ নয়। পার্টির এই খুদে নেতারা কত আজকাল হাটে মাঠে ঘোরে, মানসীর জানা আছে। সাধে কী সাধারণ মানুষ আর এদের পুঁছছে না!

তবু মানসী হেসেই বলল, “আগে একটু জল দিই? নাকি সরবত খাবে?”

“না না, প্লেন জল।”

“ঠান্ডা?”

“মিশিয়ে। পুরো ঠান্ডা সহ্য হবে না।”

ট্রে-তে গ্লাস সাজিয়ে জল আনল মানসী। সেন্টার টেবিলে রেখে বলল, “কলকাতায় কোনও কাজে এসেছিলে বুঝি?”

“হ্যাঁ। শহিদ মিনারে একটা সমাবেশ ছিল। খেতমজুর ইউনিয়নের।”

নিজে জীবনে চাষ করতে খেতে নামল না, খেতে কাজ করা লোকগুলো পাঁচটাকা মজুরি বাড়াতে বললে বিতনুর বড়দা হাঁ-হাঁ করে, খেতমজুররা আজকাল কত ফাঁকিবাজ হয়েছে তার লম্বা ফিরিস্তি শোনায়, অথচ তাদের নিয়েই ইউনিয়নবাজি চালাচ্ছেন শ্রীমান। হিপোক্রেসির চূড়ান্ত! প্রায় অনপড় মানুষগুলোকে লড়াই-লড়াই স্লোগানে বুঁদ করে জাগতিক সব ক্ষমতা পার্টির দখলে রাখার জন্যেই বুঝি সার্ভিস দিয়ে চলেছেন বিতনুবাবুরা। একেই বুঝি বলে আদর্শের মোড়কে নিঃস্বার্থ বোকামি!

হাসি চেপে মানসী বলল, “মিটিং শেষ হয়ে গেল বুঝি?”

“চলছে। রুদ্ররূপ মুখার্জি বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। আমি বেরিয়ে এলাম। …ভাবলাম এসেছি যখন, একবার আপনাদের সঙ্গে দেখা করে যাই।”

মানসীর কেমন খটকা লাগল। দাদা-বউদির ওপর এত টান আছে বিতনুর এ তো জানা ছিল না। আর শান্তনুর সঙ্গে মোলাকাত করতে কাজের দিনের ভরদুপুরে গড়িয়ায় আসবে এটাও তো অস্বাভাবিক। বিয়েথা না করলে নিশ্চয়ই মানুষের এতটা বুদ্ধিভ্রংশ হয় না! আর শুধু মানসীর সঙ্গে খাজুরা করতে হাজির হয়েছে এটাও কী ভাবা সম্ভব?

গলায় ঘরোয়া সুরটাই বজায় রেখে মানসী বলল, “খুব ভাল করেছো। …তা তোমাদের রানিগড়ের কী খবর?”

“ওই চলছে আর কী। বোরো চাষটা তেমন যুতের হল না, তাই বড়দা একটু চিন্তিত। ছোড়দা চুটিয়ে মাধ্যমিক আর হায়ার সেকেন্ডারির খাতা দেখছে। আর বউদিরা বাচ্চারা অ্যাজ় ইউজুয়াল।” বিতনু অল্প হাসল, “আমাদের গাঁয়ের লোকদের লাইফে কি খুব একটা ওঠাপড়া থাকে? সারা বছরই একরকম। কঠোর জীবন সংগ্রাম।”

আবার সেই বুলি কপচানো! মানসী প্রসঙ্গটা এড়িয়ে বলল, “চা খাবে তো? জল চড়াই?”

“তাড়া নেই। বসুন না।”

মানসী সোফায় হেলান দিল। বড্ড গরম লাগছে। পলকের জন্য ভাবল, বিতনুকে তাদের বেডরুমে নিয়ে যাবে কি না! কিংবা অলির ঘরে। পরক্ষণে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলেছে। কলকাতায় এসি এখন জলভাত, কিন্তু ঠান্ডাঘরে বসালে এই বিতনুকুমার টকাস করে কী মন্তব্য করে বসে কে জানে!

বিতনু যেন সামান্য উশখুশ করছে। মানসীরও কৌতূহল হচ্ছিল। জিজ্ঞেস করে ফেলল, “কিছু বলবে মনে হচ্ছে?”

“হ্যাঁ মানে… মেজদার সঙ্গে একটা দরকার ছিল…” বিতনু গলা ঝাড়ল, “ফোন করলাম, মোবাইল সুইচড অফ…। ভাবলাম একবার সরাসরি কারখানায় চলে যাই। কিন্তু লোকেশানটা তো ঠিক জানি না। কলকাতার ওই সাইডটা আমি ভাল চিনি-ও না। ফ্যাক্টরির নাম্বারটাও আমার কাছে নেই…”

“অম্বরকে ফোন করলে পারতে। ও তো আজ কাকার সঙ্গেই বেরিয়েছে।”

“তার ফোনও বন্ধ। কী ব্যাপার ঠিক বুঝলাম না।”

“খুব জরুরি দরকার?”

“তা একটু ছিল বই কী… একটা ফ্যামিলি ম্যাটার…। মেজদা ফিরবে কখন?”

“মোটামুটি সাড়ে সাতটা আটটা তো বাজেই। তুমি আজ থেকে যাও না।”

“উপায় নেই। কাল সকাল আটটায় রানিগড়ে একটা কর্মী সম্মেলন আছে। যদি মেজদা সাতটার মধ্যেও ফেরে, তা হলে নয় কথাবার্তা বলে একটু রাত করেই ট্রেন ধরব।”

“এক সেকেন্ড।”

মানসী উঠে ঘরে গিয়ে মোবাইল থেকে সরাসরি ফোন করল কারখানার নম্বরে। হ্যাঁ, বাজছে। একটু বেশিক্ষণই ধ্বনিত হওয়ার পর ও প্রান্তে শান্তনুর গলা, “কী হল?”

“তোমার মোবাইল অফ কেন? লোকে ফোন করে করে পাচ্ছে না?”

“আহ, দরকারটা কী বলো?”

“আজ কি একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবে? বিতনু এসেছে। তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।”

“সম্ভব নয়। একটু ব্যস্ত আছি, যেতে রাত হবে।”

“বিতনু বলছিল দরকারটা খুব আরজেন্ট। ও কি ওভার ফোন তোমার সঙ্গে কথা বলবে?”

“আহ, বললাম না, ব্যস্ত আছি। …ছাড়ছি।”

মানসী হতভম্ব। এমন কাঠ কাঠ স্বরে তো কদাচ কথা বলে না শান্তনু! ফ্যাক্টরিতে কোনও গোলমাল হচ্ছে নাকি? কিংবা বড় কোনও ব্রেকডাউন?

চিন্তিত মুখে ফিরল মানসী। তার বয়ান শুনে বিতনুরও ভুরুতে ভাঁজ। কী ভাবছে যেন।

মানসী ‘বলবে না বলবে না’ করেও বলে ফেলল, “দরকারটা আমাকে জানাতে অসুবিধে আছে?”

“নাহ। আপনাকে তো বলাই যায়।” বিতনু মাথা দোলাল, “আসলে হয়েছে কী জানেন তো… গত বারই তো রানিগড়ে দেখেছিলেন আমাদের বাড়িটার কী হাল। একতলার ঘরগুলোয় ড্যাম্প লেগে গেছে, সিলিংয়েরও ঝুরঝুরে দশা, বাড়িটা চোদ্দ পনেরো বছর রং হয়নি, বাথরুমগুলোও রেনোভেট করতে হবে… সেই ব্যাপারেই মেজদার সঙ্গে একটু আলোচনা ছিল আর কী।”

এতক্ষণে খোলসা হয়েছে ব্যাপারটা। টাকার প্রয়োজন পড়েছে বলেই এ বাড়িতে পায়ের ধুলো দিয়েছেন কমরেড। ধন্যি লোক বটে সব। রানিগড়ে যে বাসই করে না, তার কাছে এসে বাড়ি মেরামতের টাকার ধান্দা করে কোন আক্কেলে?

অপ্রসন্ন ভাব গোপন রেখে মানসী বলল, “ও। তা খরচাপাতি কেমন হবে?”

“সে কী কাজে হাত না দিলে পরিষ্কার বোঝা যায়? তবে ছোড়দা পি ডব্লু ডি-র এক ইঞ্জিনিয়রকে দিয়ে মোটামুটি এস্টিমেট করিয়েছে। উনি বলছেন অন্তত দেড় লাখ মতো পড়বে। এনেছি হিসেবটা। দেখবেন?”

“আমি কী বুঝব বলো?”

“তবু আপনার কাছে রাখা থাক।” ঝোলা থেকে একটা সাদা খাম বের করে মানসীকে দিল বিতনু, “মেজদা চোখ বুলিয়ে নিক। আপনিও দেখুন। তারপর নয় সবাই মিলে ডিসকাস করে…”

হঠাৎ কী যেন মনে হল মানসীর। জিজ্ঞেস করল, “তোমার মেজদা কি বাড়ি সারানোর প্ল্যানটা জানে?”

“আরে, মেজদাই তো তুলেছিল কথাটা। ওই আপনার বড়মেয়ের বিয়েতে এলাম, তখনই তো বলছিল…”

কথাটা খট করে কানে লাগল মানসীর। ‘আপনার মেয়ে’ মানে? আঁচল কি শান্তনুর মেয়ে নয়? যারা এখনও এরকম ভাবে, তাদেরই প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে শান্তনু? স্বেচ্ছায় হাঁড়িকাঠে গলা দিয়ে বাহাদুরি ফলাতে চায়? টাকার বেলায় এই ছোটজন তো গোড়াতেই হাত উলটে দেবে, অম্বরের বাবা রাশি রাশি কাঁদুনি গেয়ে নমো নমো করে কিছু ঠেকাবে, আর একজন তো মাদুর পেতে যতই কামাক, ভাগের বরাদ্দর বেশি এক পয়সাও ছাড়বে না। সুতরাং দায়ের সিংহভাগটি চাপবে শান্তনুরই ঘাড়ে। শান্তনুর মতো পাইপয়সার হিসেব রাখা লোক কি তা জানে না? আশ্চর্য, শান্তনু এসব কথাও যে কেন পেটে চেপে রাখে! সে যদি ভাইদের টাকা বিলিয়ে মহত্ত্বের ধ্বজা ওড়াতে চায়, থোড়াই তাতে বাধা দেবে মানসী! বলার মুখ কোথায় মানসীর, শান্তনু তাকে কৃতজ্ঞতার নাগপাশে বেঁধে রেখেছে না!

মেজাজটা তিতকুটে মেরে গেল মানসীর। তবু মুখে ইলাস্টিক হাসি টেনে চা করে দিল বিতনুকে। কুসুম আসা মাত্র তাকে দিয়ে লুচি ভাজাল, না না করা সত্ত্বেও বিতনুকে খাওয়াল পেট ঠেসে। সে বিদায় নিতে কুসুমের ওপর অকারণ রাগারাগি করল খানিক। রান্নায় কেন বেশি তেলমশলা ঢালছে কুসুম, রুটি কেন নরম হচ্ছে না, কুসুমও সমানে সাফাই গেয়ে যাচ্ছে পুটুর-পুটুর…। একসময়ে হাল ছেড়ে বেজার মুখে বারান্দায় গিয়ে বসে রইল মানসী। বিকেল আস্তে-আস্তে মিশে গেল সন্ধেয়। তবু মানসী বসেই আছে।

অলি ফিরল সাতটারও পরে। মাকে বারান্দায় দেখে পলকের জন্যে থমকাল, তারপর ঢুকে গেছে অন্দরে।

মানসী ডাকল পিছন থেকে, “অ্যাই শোন।”

অলি ঘাড় বেঁকাল, “কী?”

“পার্ট টু পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে না?”

“হ্যাঁ। পরশু থেকে।”

“তা হলে তোদের ক্লাস তো এখন বন্ধ?”

“হ্যাঁ।”

“তবে সারাদিন করছিলিটা কী?”

“ক্লাস না থাকলে বুঝি পড়াশোনা ডকে উঠে যায়? গ্রুপ স্টাডি থাকে, নোট দেওয়া-নেওয়া করতে হয়…”

“যা বোঝাবে তাই তো বুঝব। আমি তো কোনওদিন কলেজে পড়িনি। ক্লাস বন্ধ হলে লোকে বাড়িতেই পড়াশোনা করে।”

কী যেন একটা বলতে গিয়েও অলি চুপ করে রইল। তারপর কথা না বাড়িয়ে চলে গেছে ভিতরে। মানসী একটু অবাকই হল। ইদানীং অলির হাবভাব কেমন সুবিধের ঠেকছে না। সেই টগবগে হুল্লোড় করা স্বভাব যেন পালটে গেছে দুম করে। দিদি চলে যাওয়ার পর একা হয়ে পড়ার কারণেই কি এই বদল? অসম্ভব নয়। দুই বোন দু’ মেরুর, তবে দিদিকে ঘিরেই লতার মতো বড় হয়েছে কিনা। ফাঁকা ফাঁকা তো লাগবেই। তাও দু’মাস তো হয়ে গেল, এখনও দিদির বিহনে কাতর থাকা কি অলিকে মানায়? অলি মোটেই একলষেঁড়ে ঘরকুনো টাইপ নয়, বরং বাইরে বাইরেই তার বেশি সময়টা কাটে। বাড়িতে এই শান্তশিষ্ট বনে যাওয়াটা কি খুব স্বাভাবিক? এখন মেয়ের ঘরে উঁকি দিলেও মানসী নির্ঘাত দেখবে অলি শুয়ে আছে বিছানায়, কিংবা ল্যাপটপ মোবাইল কিছু একটা নিয়ে খুটুরখাটুর করছে আপনমনে। আগে অলির অবিশ্রান্ত উচ্ছলতা নিয়ে পদে পদে মুখঝামটা দিত মানসী, তবে মেয়ের মনটাকে কাকচক্ষু জলের মতো পড়তে পারত তখন। কিন্তু এই নেতানো অলি যেন মানসীর একেবারে অচেনা।

ব্যাপারখানা কী? মেয়ে প্রেমে পড়েনি তো? মোটেই অস্বাভাবিক নয়, এ তো প্রেমে পড়ারই বয়স। তবু ভাবলে বুকটা কেমন ধক করে ওঠে মানসীর। এরকমই একটা বয়সে সে মোক্ষম ভুলটা করেছিল যে। নিজেকে তো কম ঝড়ঝাপটা পোহাতে হয়নি, মা-বাবার মনের ওপরও যা ধকল গেছে তখন। বিয়েতে বাবার একটুও সমর্থন ছিল না, কিন্তু ঘরভাঙা মেয়েকে দেখে সেই বাবাই যেন বেশি বেসামাল। মেয়েঅন্তপ্রাণ ছিল কিনা। মাত্র কয়েক বছরের ফারাকে বিয়ে আর বিয়ে ভাঙা বুঝি আয়ু কমিয়ে দিয়েছিল মানুষটার। সিজন চেঞ্জের সময়ে একটু হাঁপের টানে ভোগা ছাড়া আর তেমন অসুখবিসুখ ছিল না বাবার, হঠাৎ সুগার ধরে গেল। তারপর আচমকাই স্ট্রোক। এবং এক ধাক্কাতেই শেষ। অথচ চিরকালের দুবলা ভীতু ভীতু মা মানসীর বিপর্যয়টা কীভাবে যেন সামলে নিয়েছিল। মেয়েদের বোধহয় বাড়তি জীবনীশক্তি থাকে, সেই জোরেই। তবু ভিতরে ভিতরে উদ্বেগ তো ছিলই। নইলে শান্তনুর সঙ্গে মানসীর বিয়ের পর অত আশঙ্কিত থাকত কেন সবসময়ে? এমনি এমনি মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলেও কী নার্ভাস! শুধু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন, শান্তনুর সঙ্গে কোনও অশান্তি হয়নি তো মানসীর! কেন শান্তনুকে ছাড়া সে বাপের বাড়ি এল! বারবার উপদেশ দিত আঁচলকে নিয়ে সে যেন শান্তনুর সামনে বেশি আদিখ্যেতা না করে!

অজান্তেই একটা শ্বাস পড়ল মানসীর। নির্মলা নামের সেই মহিলার দুশ্চিন্তা তখন ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে কতবার। আশ্বস্ত করার পাশাপাশি কখনও-সখনও বকাঝকাও করেছে সেই পুরনো কালের মহিলাকে। কিন্তু এখন এই বয়সে পৌঁছে টের পায়, মায়েদের কোনও যুগ নেই, কাল নেই, হয়তো বা কোনও দেশও নেই। ছেলেমেয়েদের বিপন্নতার সামান্যতম সম্ভাবনাও বুঝি মায়েদের কুরে কুরে খাবে চিরকাল। এ যেন নিছকই এক জৈবিক অনুভূতি। নইলে আজকালকার দিনে তো ছেলেমেয়ে অহরহ সংসার গড়ছে, ভাঙছে, আবার গড়ছে। দেবরাজের মতো বেপরোয়া না হয়েও দিব্যি বিয়ে না করে একসঙ্গে বাস করছে, অবলীলায় একে অপরকে টা টা করে দিচ্ছে… তবু অলি-আঁচলকে নিয়ে মানসীর ভাবনা ঘোচে কই!

দরজা থেকে কুসুমের গলা, “বউদি, তোমার চা কি এখানে দিয়ে যাব?”

“নাহ, বাইরের ঘরেই রাখ।” মানসী উঠে দাঁড়াল। এগোতে এগোতে বলল, “অলিকে জলখাবার দিয়েছ?”

“বললাম তো লুচি ভাজা আছে। খেল না। বলল, পেট টাইট।”

“তোমার কাজ শেষ? আজ রান্নাঘর ধুয়েছ?”

“হ্যাঁ। এবার আমি যাব।”

মানসী সোফায় এল। বিতনুর রেখে যাওয়া খাম এখনও সেন্টার টেবিলে পড়ে। খুলে দেখবে কিনা ভাবল একবার। থাক, বাড়তি কৌতূহল দেখানোর কী দরকার। সে রানিগড়ের কে? এখনও তো শান্তনুর ভাইদের চোখে সে আঁচলের মা। এবং হ্যাঁ, শান্তনুর সঙ্গে বিবাহসূত্রে অলিরও। অর্থবান শান্তনুর ওপর এক ধরনের নির্ভরতা আছে বলেই তারা আঁচলের বিয়েতে এসেছিল, তাতেই ধন্য হয়েছে মানসী। গত বিশ বছরে যারা মানসীর আপন হয়নি, তাদের কোনও কিছু সম্পর্কেই তার বেশি আগ্রহ না দেখানোই শ্রেয়।

বরং আঁচলের একটা খোঁজ নেওয়া যাক। দু’-দুটো দিন মেয়েটার গলা শোনা হয়নি। নিজে থেকে তো সে ফোন করবে না, দায় তো মায়েরই।

চা শেষ করে মানসী মেয়ের মোবাইল নম্বরটা ডায়াল করল। রিং হতে না হতে আঁচলের গলা, “হ্যাঁ মা, বলো।”

আঁচলের স্বরে যেন ম্যাজিক আছে, শুনেই মন খানিক সমে ফিরল। সহজ সুরে মানসী বলল, “পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত?”

“না গো। এবার বসব। এইমাত্র তো ফিরলাম।”

“কোথায় বেরিয়েছিলি?”

“একটু ক্যানসার হসপিটালে গিয়েছিলাম। আজই তো জেঠুর ফার্স্ট কেমোটা হল।”

“ও।” মানসী সামান্য হোঁচট খেয়েও সামলে নিল, “এখন কেমন আছেন?”

“ডাক্তাররা তো বললেন মোটামুটি স্টেবল। অবস্থা ঠিক থাকলে কাল হয়তো ছেড়ে দেবেন।”

“পিসি গিয়েছিল?”

“হ্যাঁ। পিসি পিসেমশাই জেঠি… বাবাও ছিল।”

আবার একটা হোঁচট সামলাল মানসী। জিজ্ঞেস করে ফেলল, “তোর বাবা বুঝি এখন কলকাতায়?”

“হ্যাঁ। গত সপ্তাহে এসেছে। বাবাই তো জেঠুর সব দেখাশোনা করছে এখন।”

সংবাদটায় মানসীর অখুশি হওয়ার কোনও হেতু নেই, তবু যেন আহত বোধ করল একটু। বনানী যেচে নাও বলতে পারে, কিন্তু আঁচলের সঙ্গে তো সোমবারও কথা হল, কই বাবার আগমনবার্তা তো ঘুণাক্ষরেও উল্লেখ করল না মেয়ে! আজ হাসপাতালে ছুটে যাওয়াও কি শুধুই জেঠুর জন্যে? জেঠুর ওপর এত দরদ তো জন্মে দেখেনি মানসী! উঁহু, মেয়ে ছুটেছিল বাবার শ্রীমুখ দর্শনে। নাহ, বিয়ে দিয়েও শান্তি নেই। দেবরাজের কবল থেকে মুক্ত করা গেল না আঁচলকে।

তা এসব তো মেয়েকে বলা যায় না। এমনিতেই তো মানসীকে দেবরাজের প্রতিপক্ষ বলে ধরে রেখেছে আঁচল। আর সেই ধারণা হয়তো পুরোপুরি ভুলও নয়। তাও তো মানসীর নিষেধেই যে দেবরাজ বিয়েতে আসেনি এটা আঁচল জানে না।

বাবা যে আদতে কী চিজ, তাও কি মেয়ে জানে? বিয়ের বছরটা ঘুরুক, আঁচল তার সংসারে আর একটু থিতু হোক, তারপর মানসী ভাঙবে দেবরাজ কী করে বিয়েটা কাঁচিয়ে দেওয়ার তাল করেছিল।

স্বরে অবশ্য দেবরাজের প্রতি বিদ্বেষটা ফুটতে দিল না মানসী। আলগা তারিফের সুরে বলল, “ভাল। খুব ভাল। দাদার বিপদে ভাইবোনরা পাশে দাঁড়াবে এটাই তো উচিত কাজ।”

“হ্যাঁ, পিসি বাবা দু’জনেই খুব করছে। বাবা তো এখানেই থাকবে এখন। অন্তত জেঠুর তিনটে কেমো হওয়া পর্যন্ত।”

হয়তো স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলল আঁচল, কিন্তু মানসী যেন উচ্ছ্বাসের আভাস টের পেল গলায়। ভাল লাগে না। একদম ভাল লাগে না। আঁচলের বিয়েটা দিয়ে ভেবেছিল দেবরাজের চেয়ে অন্তত এক কদম কাছে এগোতে পেরেছে মেয়ের। এখন মনে হচ্ছে আবার বুঝি পিছিয়ে পড়ছে মানসী।

দেবরাজই বা হঠাৎ এত কলকাতামুখো হল কেন? লোকাল পলিটিক্সে নাক গলাচ্ছে, গরম গরম ভাষণ ঝাড়ছে টিভি-নিউজ পেপারে, দাদার জন্যে বেজায় উতলা হয়ে পড়ল… কী অর্থ এসবের? দিল্লিতে কি আর মন টিকছে না? নাকি সেখানে আর হালে পানি পাচ্ছে না দেবরাজ? এখানে তাই একটা নতুন ভাবমূর্তি গড়ার চেষ্টা? গোবেচারা দাদার জন্যে প্রাণ কেঁদে উঠবে, দেবরাজ তো মোটেই ওই ধাতের মানুষ নয়! তা হলে হঠাৎ মহানুভব সাজার বাসনা চাগিয়ে উঠল যে বড়?

ঠিক কী যে চায় দেবরাজ? তার কোনটা যে আসল রূপ, কোনটা যে ভান, সেটাই তো আজ পর্যন্ত স্পষ্ট বুঝে উঠতে পারল না মানসী।

কথা ঘুরিয়ে মানসী বলল, “শাশুড়ি ফিরেছেন?”

“নাহ।”

“নির্বাণ?”

“না।”

“ও এত দেরি করে কেন? খুব চাপ থাকে বুঝি অফিসে?”

“বোধহয়।”

“নির্বাণকে একটু বকতে পারিস না? বলতে পারিস না, সারা সন্ধে ভূতের মতো একা একা বাড়িতে বসে থাকব কেন?”

“আমার তো অসুবিধে হয় না মা। আমি তো ব্যস্তই থাকি। বইপত্র পড়াশোনা… কখনও মণিকাকার সঙ্গে গল্প করি…”

“এক আধ দিন তো বেরোতেও পারিস। সিনেমা-থিয়েটারে যা, এদিক ওদিক বেড়া, হোটেল-রেস্তোরাঁয় খা…”

“ছাড়ো না মা। জানোই তো, ওসবে আমার ইন্টারেস্ট নেই।”

“বিয়ের পর নেচারটা একটু একটু বদলাতে হয় আঁচল। একটা নতুন সম্পর্ক বলে কথা, সে কী এমনি এমনি গড়ে ওঠে?”

আঁচলের সাড়াশব্দ নেই। বোধহয় পরামর্শটা মনঃপূত হয়নি। মানসী হাসল মনে মনে। মেয়েটা বুঝি বদলাবে না। ঘরকুনোই রয়ে যাবে চিরকাল।

আরও দু’-চারটে কথা বলে মানসী ফোন রেখে দিল। আঁচলের সঙ্গে কথা বলে সুখ নেই। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির গল্প করার জন্যে মেয়েরা মুখিয়ে থাকে। আর আঁচলকে কিনা অনবরত খোঁচাতে হয়। তারপরেও কেমন যেন ভাসা ভাসা জবাব। ওবাড়ির পরিবেশটাও কেমন ছাড়া ছাড়া। মা এক জগতে, ছেলে আর এক দুনিয়ায়। আর আঁচল যে কোন পৃথিবীতে থাকে, তা তো ঠাহর করাই মুশকিল। অন্তর্মুখী মেয়েটা কি আরও ডুবে যাচ্ছে নিজের ভিতরে? তাড়াতাড়ি একটা বাচ্চাকাচ্চা হয়ে গেলে হয়তো ভাল হয়। তাতে যদি খোলস ছেড়ে বেরোয় আঁচল।

কিন্তু মেয়েকে কি এমন উপদেশ দেওয়া এখন সংগত হবে? মেয়ে-জামাই কীভাবে ভবিষ্যৎটাকে প্ল্যান করবে, সে ব্যাপারে খবরদারি করা কি সাজে মানসীর?

টিপটিপ ভাবনা নিয়েই টিভি চালাল মানসী। খবরের চ্যানেলগুলোতে যথারীতি বাকযুদ্ধের আসর। নানান কিসিমের সেলিব্রিটিরা রাজনৈতিক নেতাদের পাশে বসে গাঁকগাঁক চেল্লাচ্ছে। লালপার্টির প্রতিনিধিরা রীতিমতো কোণঠাসা, এবার নির্ঘাত লোকসভা ভোটে জোর ধাক্কা খাবে। যা মৌরসিপাট্টা গেঁড়ে বসেছে, এদের একটু শিক্ষা পাওয়া দরকার। কিন্তু সারাক্ষণ এই তর্কাতর্কি কী ভাল লাগে! মাথাটা যেন আরও ধরে যায়। কিন্তু দেখবেটা কী? একটা ভাল সিরিয়ালও তো ছাই হচ্ছে না! চড়া মেলোড্রামা, রবারের মতো টানছে, কাঁহাতক সহ্য হয়?

বাইরে গাড়ির আওয়াজ। মানসী বেশ চমকেছে। শান্তনু বলল দেরি হবে… সবে সাড়ে আটটা বাজে… এখনই ফিরল যে বড়?

অম্বর ঢুকল। পিছন পিছন শান্তনু। একটুও দাঁড়াল না অম্বর, মানসীকে বিস্মিত করে সোজা উঠে গেছে দোতলায়।

শান্তনু সোফায় বসে জুতো ছাড়ছে। অন্যদিন এই সময়টায় একবার হাই হ্যালো করে শান্তনু। চোখের ইশারায় জানতে চায় অলির সমাচার। আজ শান্তনু আশ্চর্য রকমের নীরব। মুখখানা থমথম করছে। হলটা কী?

২২

মাথাটা এখনও ঝিমঝিম করছিল শান্তনুর। ফ্যাক্টরি ছেড়েছে প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে, এখনও নিজেকে স্থিত করতে পারছে না। নিজের হাতে গড়া কারখানায় তাকে এইভাবে অপদস্থ হতে হল আজ? এত লড়ে লড়ে এখনও টিকিয়ে রেখেছে ব্যবসাটা, তার পরেও অমন বিশ্রী গাল খেতে হল শান্তনুকে? হজম করতে হল লেবারদের খিস্তিখেউড়? এটাই কি তার প্রাপ্য ছিল?

মানসীর গলা পেল শান্তনু, “কী গো, শুয়ে রইলে যে বড়? স্নান করবে না?”

শান্তনু চোখ খুলল। অস্পষ্ট স্বরে বলল, “হুম। যাচ্ছি।”

জবাব পেয়েও নড়েনি মানসী। তার দৃষ্টিতে যত না কৌতূহল, তার চেয়ে বেশি যেন উদ্বেগ। শান্তনুর অস্বস্তির ভাবটা বেড়ে গেল। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “আর কিছু বলবে?”

“তেমন কিছু না। বলছিলাম… আজ বড্ড গরম তো, গায়ে মাথায় জল পড়লে হয়তো একটু বেটার ফিল করতে।”

আর বেটার! নাউ প্রিপেয়ার ফর দা ওয়র্স। আক্ষেপ ঝরাতে গিয়েও শান্তনু গিলে নিল। অল্প মাথা নেড়ে শুধু বলল, “হুউম।”

মানসী আস্তে আস্তে বেরিয়ে যাচ্ছে ঘর ছেড়ে। তার চলে যাওয়াটা দেখে, এই বিপর্যস্ত মুহূর্তেও, শান্তনুর খারাপই লাগল। সে বাড়ি ঢোকার পর মানসী একটাও প্রশ্ন করেনি। অথচ মানসী যে যথেষ্ট বিচলিত তা তো বোঝাই যায়। শান্তনুর এমন বেহাল দশা আগে কবেই বা দেখেছে বেচারা!

নাহ, শক্ত হতে হবে। শান্তনু ধমকাল নিজেকে। ব্যবসা চালাতে গেলে সমস্যা আসবেই, অনেক ঝড়ঝাপটাও সইতে হবে, তা বলে বাড়ির লোকদের বিব্রত করলে চলবে কেন! এভাবে মুখে বিপন্নতার সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তা আছে কোনও?

শান্তনু বিছানায় উঠে বসল। তারপর একটু সময় নিয়ে সোজা বাথরুমে। অন্যদিনের মতো বালতি বালতি জল গায়ে ঢালল না, খুলে দিয়েছে শাওয়ার। ট্যাঙ্কের জল এখন আর তেমন তপ্ত নেই, তবু যেন আরাম হচ্ছে না। রগড়ে রগড়ে সাবান ঘষল গায়ে, তাও যেন মুছছে না ক্লেদ। লেগে থাকছে সর্বাঙ্গে। পাঁকের মতো।

দৃশ্যটা আবার হানা দিল মগজে। চণ্ডীপুর থেকে নিখিল ভুঁইয়া নামের এক সিভিল কনট্রাক্টরকে ধরে এনেছিল অম্বর, হরিনগরের সাইট প্ল্যানটা খুলে কোথায় কী নির্মাণ হবে তাকে বোঝাচ্ছিল শান্তনু। হঠাৎই হইহই করে চেম্বারে ঢুকে পড়ল যতীন সুজন পরেশরা। অনুমতির তোয়াক্কা না করে ঝপাঝপ বসে পড়ল চেয়ারে।

তিন ইউনিয়ন নেতার আচরণ স্বাভাবিক ঠেকেনি শান্তনুর। একটু বিরক্তভাবেই বলেছিল, “ব্যাপার কী, অ্যাঁ? দেখছ না একটা জরুরি কাজে ব্যস্ত আছি।”

যতীন গলা ভারী করে বলল, “কারখানায় থাকার সময়ে আমাদের ডিম্যান্ডগুলো শোনাটাই আপনার সবচেয়ে জরুরি কাজ।”

শান্তনু রুক্ষভাবে বলেছিল, “সে আমি জানি। কিন্তু তার তো একটা সময় অসময় আছে। টিফিন টাইমও হয়নি, এরমধ্যে ঝান্ডাবাজি শুরু হয়ে গেল? কাজের নামগন্ধ নেই, খালি দাবি আর দাবি!”

আচমকা সুজন খেঁকিয়ে উঠল, “অ্যাই, কপচাপেন না তো। আপনিই তো কাজ করতে দিচ্ছেন না।”

“মানে? র’ মেটিরিয়াল কি শর্ট পড়েছে? নাকি কোনও মেশিন ব্রেকডাউন?”

“ওসব তো আপনার ব্যাপার। সব ঠিকঠাক থাকলে চাকা ঘুরবে, তার বেরোবে…। কিন্তু আমাদের পেটে লাথি মারার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে?”

“কী বাজে কথা বলছ? এই তো পুজোর পরেই তোমাদের সঙ্গে এগ্রিমেন্ট হল। স্যালারি বাড়ল…”

“সে তো ভুজুং-ভাজুং দিয়ে তখন ম্যানেজ করেছিলেন। ফরিদাবাদ আর কানপুরে যে বিশাল দু’খানা অর্ডার পেয়েছেন, সেটা তো চেপে গিয়েছিলেন।”

“তার সঙ্গে তোমাদের কী? চুক্তিমতো মাইনে বোনাস ওভারটাইম দিচ্ছি কিনা শুধু সেটুকুই দেখবে। তার বেশ কিচ্ছু না।”

“ইল্লি রে। ওসব ধান্দাবাজি ছাড়ুন। দু’খানা অর্ডারই অনেক বেশি রেটে পেয়েছেন, আমরা জানি।”

“তো?”

“বাড়তি রেটের ফয়দাটা বুঝি আপনি একাই লুঠবেন? আমরা চাক্কা জ্যাম করে দেব।”

চড়াং করে মাথা গরম হয়ে গেল শান্তনুর। নতুন অর্ডারগুলো সে কী দরে পেয়েছে, তা তো ইউনিয়নের জানার কথা নয়। খবরটা কে তাদের কানে তুলল? যদি বা কোনও ভাবে লিক হয়েও থাকে, ইউনিয়ন তা নিয়ে ব্ল্যাকমেল করে কোন সাহসে? দাবিও জানাচ্ছে কী কদর্য ভাষায়! সবচেয়ে বড় হল, এই রকম ভাবে এরা কক্ষনও কথা বলে না। হঠাৎ হলটা কী? বাইরে থেকে কেউ উশকানি দিচ্ছে? হরিদেবপুরের এই শেডে আরও দু’খানা ফ্যাক্টরি ছিল, কবেই তারা লালপার্টির উপদ্রবে লালবাতি জ্বেলেছে। একমাত্র শান্তনুর মেটালিক ওয়্যার্স চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। সুদিনের একটা ক্ষীণ রেখা সবে দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল, তখনই এই আক্রমণ কেন? তাও কিনা ঠিক ইলেকশনের মুখে মুখে? বাইরে রাজনীতির প্রভাবেই কি…? যে পার্টির ইউনিয়ন, শুধু তাদের পার্টিফান্ডেই চাঁদা দিয়েছে শান্তনু, অন্য কারওকে নয়, এ কী তারই পরিণাম?

সে যা-ই হোক, যতীন-সুজনদের এই অমার্জিত আবদার মেনে নেওয়া চরম গোক্ষুরি হবে। একবার লাই পেলে মাথায় চড়ে বসবে এরা।

কোনও মতে স্নায়ু নিয়ন্ত্রণে এনে শান্তনু কঠোর গলায় বলেছিল, “লেবার-ল অনুযায়ী সামনের অক্টোবর অবধি তোমরা এই চুক্তি মানতে বাধ্য।”

“ওসব আইন-ফাইন বেশি মারাবেন না। নতুন অর্ডার মোতাবেক ওয়েজ যদি না বাড়ান, প্রোডাকশন বন্ধ। আমরা যদি লাভের বখরা না পাই, আপনিও শালা ভোগে যাবেন।”

ফের সেই কদর্য ভাষা! হুমকি! যতীন-সুজনরা এমন বদলে গেল কী করে? এই সুজনকেই না তার বিয়ের সময়ে অ্যাডভান্স দিয়েছিল শান্তনু! বিনা সুদে! ছত্রিশ মাসে টাকাটা শোধ করার সুযোগ পেয়েছিল সুজন। আর পরেশের বাবাকে তো নিজে উদ্যোগ নিয়ে হাসপাতালে ভরতি করেছিল শান্তনু। এই কি তার প্রতিদান? মেটালিক ওয়্যার্সে স্টাফ মাত্র তেত্রিশ জন। একটা বড়সড় পরিবারের মতোই এতদিন কারখানাটা চালিয়ে এসেছে শান্তনু। প্রত্যেকের হাঁড়ির খবর সে রাখে নিয়মিত। ভুলেও কখনও মালিক সুলভ চালবাজি দেখায় না। এই তো আঁচলের বিয়েতেও সে সব স্টাফকে ঘরের লোকের মতোই আপ্যায়ন করেছে। তার পরেও এই শাসানি শুনতে হবে?

কাজ থামিয়ে অনেকেই উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল দরজায়। নিখিল ভুঁইয়াও কেমন হতভম্ব মুখে তাকিয়ে। অম্বর নিথর। শান্তনুর মস্তিষ্কে অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ বাড়ছিল দ্রুত। চোয়ালে চোয়াল ঘষে নিখিলকে বলেছিল, “আপনি আজ আসুন। আমি আপনার সঙ্গে নেক্সট উইকে যোগাযোগ করে নেব।”

নিখিল বুঝি হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। পালাল তড়িঘড়ি। যেতে যেতেও ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছিল সভয়ে। বুঝি ধরেই নিয়েছে, আজ একটা বিস্ফোরণ ঘটবে কারখানায়।

রাগটাকে শীতল হিংস্রতায় পরিণত করে সুজনের চোখে চোখ রেখেছিল শান্তনু। চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিল, “বেশি রেটে কাজের জন্যে তোমাদের বাড়তি মজুরি দিতেই হবে, তাই তো?”

সুজন টেবিলে মুঠো ঠুকল, “আলবত। নইলে গেটে তালা ঝুলিয়ে দেব।”

“সে তো আমিই ঝোলাতে পারি। কিন্তু একটা প্রশ্ন আমায় করতেই হচ্ছে। তোমরা হঠাৎ এমন ইতরের মতো আমার সঙ্গে কথা বলছ কেন?”

সুজন গলা চড়িয়ে বলল, “মালিকরা এই ভাষাটাই বোঝে কিনা।”

“বটে? …ঠিক আছে, আমি তোমাদের দাবি মেনে নিচ্ছি।”

সুজন সগর্বে পিছন পানে ঘুরে হাত নাড়ল। দরজার ওপারে চড়া উল্লাসের ধ্বনি।

শান্তনু বলল, “তবে আমার কয়েকটা শর্ত আছে। কান খুলে শুনে নাও।”

“প্রোডাকশন বাড়াতে হবে তো?”

“না। বাড়তি রেটটা যেমন জেনেছ, কোম্পানির গত তিন বছরের ব্যালেন্সশিটটাও তোমাদের দেখতে হবে। গত বছর চার পারসেন্ট প্রফিট হয়েছে। তার আগের বছর সাত। এ বছর মাইনাস ওয়ান। অর্থটা নিশ্চয়ই বোঝো? লস। ভাগের শেয়ার যদি চাও, লোকসানের ভাগও তো নিতে হবে।”

“মানে?”

“প্রফিট-লস বিচার না করে প্রতি বছর ফিফটিন পারসেন্ট বোনাস দিয়ে আসছি। যেটুকু তোমাদের প্রাপ্য হয়, সেটা বাদ দিয়ে বাকিটুকু তো আমি এবার কেটে নেব। থোক ডিডাক্ট করব, না কিস্তিতে, তা তোমরা জানিয়ে দিয়ো।”

কথাটা হৃদয়ঙ্গম করতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল তিন নেতার। তার পরেই যতীন চেঁচিয়ে উঠেছে, “খচড়ামি হচ্ছে, অ্যাঁ? আমাদের টাকা মারার মতলব?”

“সে তোমরা যা খুশি ভাবতে পারো।” শান্তনু উঠে দাঁড়াল, “চল অম্বর, আমার ব্যাঙ্কের কাজটা সেরে আসি।”

সঙ্গে সঙ্গে সুজন পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে, “কেটে পড়া অত সোজা? আগে লিখে দিন, কোনও প্যাঁচপয়জার ছাড়াই আমাদের দাবি মেনে নিচ্ছেন। তারপর আপনি ছাড়া পাবেন।”

ব্যস, শুরু হয়ে গেল ঘেরাও। সঙ্গে স্লোগান। কুৎসিত কটুকাটব্য। ঠায় ছ’ঘণ্টা বসে থাকতে হল চেয়ারে। এক গ্লাস জল চেয়েছিল বলে কী খ্যাকখ্যাক হাসি!

শান্তনুরও কেমন গোঁ চেপে গিয়েছিল তখন। এই কারখানা তার প্রাণ। একটা ভাঙাচোরা শেড ছাড়া কিছুই তো ছিল না এখানে, তিলে-তিলে মেটালিক ওয়্যার্সকে সে গড়েছে। কী-ই বা এমন পুঁজি ছিল তখন? হপকিন্স ইন্ডিয়ায় ডেপুটি প্রোডাকশন ম্যানেজারের চাকরি করত, মাইনেকড়ি মন্দ ছিল না, কিন্তু সঞ্চয় বলতে তো স্রেফ একফালি জমি। এখানে লেবার ট্রাবল লেগেই ছিল, তা ছাড়া পূর্বভারতে ব্যবসাবাণিজ্যের অবস্থাও কাহিল, কোম্পানি তাই গুটিয়েই ফেলল হাইড রোডের অত বড় ফ্যাক্টরিখানা। আর সব অফিসারদের মতোই শান্তনুকে প্রস্তাব দিয়েছিল, হয় নয়ডা চলো, নয়তো স্বেচ্ছাবসর নাও। দ্বিতীয়টাই বেছেছিল শান্তনু। আর দাসত্বে যায়নি, শিবপুরে পড়ার সময় থেকেই যে স্বপ্নটা দেখত, সেটাই সাকার করতে নেমে পড়েছিল কোমর বেঁধে। হপকিন্স ইন্ডিয়া থেকে যা টাকা পেয়েছিল, সেটুকু নিয়েই। ব্যাংক লোন নিয়ে দেশি মেশিন কিনল, মাত্র আটজন লোক নিয়ে শুরু হয়ে গেল মেটালিক ওয়্যার্স। অর্ডার ধরার জন্য নিজেই কত ছোটাছুটি করেছে সেইসময়। আজ শিলিগুড়ি-গুয়াহাটি তো কাল পটনা-রাঁচি পরের দিন হয়তো কটক-ভুবনেশ্বর। তাও পায়ের নীচে জমি পেতে-পেতে পাক্কা পাঁচ বছর। এই সুজন-যতীন হয়তো তখন ছিল না, অনেক পরে এসেছে, কিন্তু পরেশ তো সেই প্রথম দিন থেকেই আছে মেটালিক ওয়্যার্সে। তার লড়াইটা একদম কাছ থেকে দেখেছে। এক পা এক পা করে উত্থানের একজন সাক্ষী হয়েও সে কিনা আজ রক্তচক্ষু দেখায়! যা হয় হোক, কিছুতেই পিছু হটবে না, এদের ঔদ্ধত্যের আজ শেষ দেখতে চায় শান্তনু।

সন্ধে সাতটায় পর কী যে হল, একটু বুঝি মচকাল ইউনিয়নের পান্ডারা। একতরফাই ছেড়ে দিল শান্তনুকে। অবশ্য শুনিয়েও রাখল, রাত্তিরে বাড়ি গিয়ে ভাবুন, কারখানা চালাবেন, না উঠিয়ে দেবেন। আমাদের দাবি না মানলে আপনার কত লাখ টাকা লস, সেটাও হিসেব করুন ঠান্ডা মাথায়।

হায় রে, সব লাভ-ক্ষতি কী টাকায় মাপা যায়! কর্মচারীদের চোখের সামনে আজ তার যে অসম্মানটা ঘটল, কত টাকায় তা পূরণ হবে? আর কোনওদিন কি তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে কোনও নির্দেশ ছুড়তে পারবে শান্তনু? মনে হবে না কী ভালমানুষের মতো মুখ করে থাকা অ্যাকাউন্ট্যান্ট কিংবা প্রোডাকশন সুপারভাইজ়ারটি ভিতরে ভিতরে হাসছে? অম্বরের কাছেই বা আর কতটুকু মর্যাদা রইল শান্তনুর? যা হেনস্তাটা সে দেখল বড়কাকার?

গা হাত পা মুছে বাথরুম থেকে বেরিয়ে শান্তনু দেখল, মানসী কোনের চেয়ারে আসীন। স্বর যথাসম্ভব সহজ রেখে শান্তনু বলল, “কী হল, প্রায় দশটা তো বাজল। এবার খেতে দাও।”

“থালা সাজিয়েই তো বসে আছি। তুমিই তো স্নান সারতে দেরি করলে।”

“আচ্ছা আচ্ছা, দাও। আমি চুল আঁচড়েই আসছি।”

ডাইনিং টেবিলে একা মানসী। চেয়ার টানতে টানতে শান্তনু অন্যদিনের মতোই একটা তরল সুর আনতে চাইল গলায়। বলল, “অলি কোথায়? অম্বর? ওরা খাবে না?”

“সবাই আসবে। তুমি আগে শুরু করো তো।”

“না না, ছেলেটাকে ডাকো। ওর ওপর দিয়ে আজ সারাদিন যা গেল…”

“কী হয়েছিল?”

“তেমন সাংঘাতিক কিছু নয়। লেবার ট্রাবল।” এমনভাবে শব্দদুটো উচ্চারণ করল শান্তনু, যেন আজকের যাবতীয় অশান্তি অপমান অতি তুচ্ছ হয়ে যায়। আরও যেন লঘু করার জন্যই বলল, “আমি তো এসবে অভ্যস্ত। ও তো খুব একটা দেখেনি…”

অম্বর নামছে সিঁড়ি বেয়ে। ভার মুখে এসে বসল টেবিলে। তাকে টেরিয়ে দেখে নিয়ে থালায় ভাত নিল শান্তনু। হালকাভাবে জিজ্ঞেস করল, “ঘুমিয়ে পড়েছিলি নাকি?”

“নাহ, শুয়েছিলাম একটু।”

“উলটোপালটা চিন্তা করে রাতের নিদ্রাটা নষ্ট করিস না। তোর কাজ বেড়ে গেল, বুঝলি। কাল সকালেই তোকে হরিনগর ছুটতে হবে।”

অম্বর যেন চমকাল। ভুরুতে প্রশ্নচিহ্ন এঁকেছে।

শান্তনু চোখ কুঁচকে বলল, “কারণটা কী বলে দিতে হবে? ওরে, শ্যামাপদর জায়গা কি ফাঁকা থাকবে? গিয়ে লোকালি কাউকে একটা অ্যাপয়েন্ট করে আয়। নিখিলবাবুকেও মিট কর। একটা এস্টিমেট নে।”

“কিন্তু তুমি যে বলেছিলে ইলেকশন হয়ে যাওয়া অবধি… শ্যামাপদর খুন নিয়ে এখনও তো ওখানে টেনশন চলছে… দু’পার্টিই ক্লেম করছে শ্যামাপদ তাদের লোক ছিল… এক্ষুনি কারওকে নিলে যদি আমরাও জড়িয়ে যাই…”

“ও হ্যাঁ, তাই তো। থাক গে, এখন তা হলে গিয়ে কাজ নেই। ক’দিন পড়ে পড়ে ঘুমো আর কবিতা লেখ।”

“কেন?” একটু ইতস্তত করে অম্বর বলল, “কারখানা যেতে হবে না?”

কথাটা যেন কানেই তুলল না শান্তনু। সদ্য টেবিলে আসা অলিকে নিয়ে পড়েছে, “কী রে, টিভি চালাসনি যে আজ?”

অলি বলল, “অন্য একটা কাজ করছি।”

“সে কী রে? তোর অন্য কাজও থাকে নাকি? নিশ্চয়ই পড়াশোনা নয়?”

“পড়াশোনাই।” অলির উদাস উত্তর, “একটা নোটে চোখ বোলাচ্ছিলাম।”

“বলিস কী রে? আমি তো ধন্য হয়ে যাচ্ছি। তো পরীক্ষার তো এখনও ঢের দেরি।”

“হুঁ। প্রায় দু’মাস।”

“এত তাড়াতাড়ি পড়া শুরু করলি? হাঁপিয়ে যাবি যে?” নিজের জোলো রসিকতায় নিজেই হেসে উঠল শান্তনু। প্রিয় ভেটকিমাছের ঝাল রেঁধেছে মানসী, কিন্তু জিভে কোনও স্বাদ পাচ্ছিল না। টেস্ট বাডগুলো শুকিয়ে গেছে যেন। তবু উচ্ছ্বাসটা নিভতে দিল না। কৌতুকের সুরেই বলল, “তা আজকের দিনটা কেমন কাটল বলছিস না তো? বন্ধুরা কে কী কেলো করল… ফুচকা খাওয়ার সময়ে কী ঘটেছে… কিংবা কেউ তোকে প্রোপোজ করল কিনা…”

“আহ, বাপি। ডোন্ট বি রিডিকিউলাস।”

“ভুল কী বললাম? জানিস, আমাদের সময়েও একটা মেয়ে মাসে তিন থেকে চারটে প্রোপোজাল পেত? শিবপুরে আমাদের এক ক্লাসমেট ছিল… প্রত্যেক শনিবার সে আমাদের কাউন্ট করে বলত, ক’খানা উড়ো চিঠি পেয়েছে, কিংবা কতগুলো অচেনা গলার টেলিফোন এসেছে বাড়িতে…। কোনও সপ্তাহে সংখ্যাটা কম হলে মনমরা হয়ে যেত মেয়েটা।”

অলি মুখখানা হাসি-হাসি করল, কিন্তু কিছুই বলল না।

শান্তনুরও একা একা কৃত্রিম কথা বলার উৎসাহ নিভে গেল ঝুপ করে। নীরবে শেষ করল আহার। ঘরে ফিরে আর ল্যাপটপ খুলল না। খবরের কাগজের পাতা উলটোচ্ছে এলোমেলো। নানান চিন্তা পাক খাচ্ছিল মাথায়। ফ্যাক্টরিটা কী বন্ধই করে দেবে? জোহানন কেবলসের মালিক অশোক পারুলিয়া বছর খানেক আগে মেটালিক ওয়্যার্স কিনতে চেয়েছিল। দরও মন্দ দেয়নি। কিন্তু বেচার কোনও বাসনা নেই বলেই তাকে হাঁকিয়ে দিয়েছিল শান্তনু। এখন যদি নতুন করে নেগোসিয়েশন শুরু করা যায়? এখানকার ছোট্ট মার্কেটে কোনও খবরই চাপা থাকে না, শ্রমিক অশান্তির সমাচারটিও পারুলিয়ার কানে পৌঁছবেই। পারুলিয়া কি তাতে পিছিয়ে যাবে? নাকি রেট নামিয়ে দেবে? নিজে চাপে থাকলে দর কষাকষির ক্ষমতাও তো কমে যায়। তা ছাড়া সুজন-যতীনরা জানতে পারলে রে রে করে উঠবে নির্ঘাত। তাই বলে কী ঘাড় হেঁট করে কাজ করা শান্তনুর পক্ষে সম্ভব? টাকাপয়সার ব্যাপারটা বড় নয়, কিন্তু মালিক সুলভ কোনও কর্তৃত্ব সে যদি বজায় রাখতে না পারে তা হলে স্রেফ মুনাফার জন্যে ব্যবসা চালিয়ে যাবে এমন মানুষ তো শান্তনু নয়।

আচমকা শান্তনুর মন আরও ভার হয়ে গেল। সে তো কখনও কারও খারাপ চায়নি। না তার পরিবার পরিজনের। না কর্মক্ষেত্রে কারও। রাগ দুঃখ ঘৃণা অভিমান সরিয়ে রেখেই তো প্রাণপণে সাহায্য করতে চেয়েছে সকলকে। দাদা ভাইদের নিন্দে টিটকিরি ঝেড়ে ফেলতে দ্বিধাবোধ করেনি। মানসীর মনের বাধো বাধো ভাব সরিয়েছে সযত্নে। মানসীর ভালবাসা নিখাদ নয় টের পেয়েও সে তো একচুল দূরে সরেনি। আঁচল তাকে যে চোখেই দেখুক, সে তো মন থেকেই আপন করতে চেয়েছে আঁচলকে। তার পরেও কেন যে পদে পদে তাকেই দুশ্চিন্তা বয়ে বেড়াতে হয়? ওদিকে দেবরাজ নামের লোকটা চিরকাল হাওয়ায় ভেসে ভেসে দিব্যি তো সুখে আছে। একেই কি বলে কপাল?

চিন্তায় ছেদ পড়ল। মানসী ঘরে ঢুকে সোজা খাটে এসে বসেছে।

শান্তনু কাগজখানা মুড়ে রাখল। আলগোছে বলল, “এসি অন করে দেব?”

জবাব না দিয়ে মানসীর পালটা প্রশ্ন, “তোমার কী হয়েছে বলো তো?”

“তেমন কিছু নয়। কারখানায় ঝামেলা, তাই একটু ডিসটার্বড…”

“উঁহু। ফ্যাক্টরিতে অশান্তি কি এই প্রথম? আগে একবার স্ট্রাইকও তো হয়েছিল, তখন তো এমনটা দেখিনি?”

“কীরকম?”

“এই যে… যা সব করছ। বাড়ি ঢুকে গোঁজ, আবার খেতে বসে তোমার বকবকানির ঠেলায় অলি পর্যন্ত চুপ মেরে গেল।” শান্তনুর হাত ছুঁল মানসী, “আজ খুব সিরিয়াস কিছু ঘটেছে?”

“আহ বললাম তো, তেমন কিছু নয়।”

“একটু খোলসা করে বলো না বাপু। তাতে মন হালকা হবে।”

শান্তনু ধূসর হাসল। দুনিয়ায় কেউ কি তার মনের খবর রাখে? মানসীও? এই যে তাপসের বোনটাকে সে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় থেকেই ভালবাসত, মানসী তখন দেবরাজের প্রেমে পাগল জানতে পেরে টুঁ শব্দটিও করেনি, পরে যখন পাকেচক্রে কিছুটা ঘনিষ্ঠতা জন্মাল, তখনও সে সংগোপনে লুকিয়ে রাখা সেই ভালবাসার কথা উচ্চারণ করেনি কখনও। কিন্তু মানসীর তো সেটা অনুভব করা উচিত ছিল, নয় কী? কেমন করে সে ধরে নিল একটা বিয়েভাঙা মেয়েকে করুণা করতে করতে তার প্রেমে পড়েছে শান্তনু। করুণা থেকে যে সত্যিকারে প্রেম জন্মাতে পারে না, স্রেফ দায়িত্ব-কর্তব্যের শিকলেই তাদের সম্পর্কটা বাঁধা নেই, এটা কি মানসী এখনও উপলব্ধি করেছে? বিয়ের এত বছর পরেও?

তবু এই মুহূর্তে মানসীর কথাগুলো যেন শান্তির প্রলেপ বোলাচ্ছে প্রাণে। আর ঢাকঢাক গুড়গুড় করল না শান্তনু। নিরাবেগ সুরেই আনুপূর্বিক বিবরণ দিল দিনটার। কী করতে চায় এখন, তাও গোপন করল না।

চুপটি করে শুনল মানসী। তারপর উঠে গেছে বাথরুমে। ফিরে হালকাভাবে এসি চালিয়ে আবার বসেছে বিছানায়। কী যেন ভাবল একটু। হঠাৎ বলল, “কারখানা বন্ধ করে দেওয়া মানে তো একধরনের হেরে যাওয়া, নয় কী?”

“হারজিৎ বুঝি না। আজ খুব ধাক্কা খেয়েছি।”

“সেই জন্যই তো বলছি। পালটা ধাক্কা দাও। চাইলে কারখানা তুমি বেচতে পারো, তবে এভাবে নয়। সেটা হবে তোমার সময় আর সুযোগ মতো। আপাতত ওই ইউনিয়ন লিডারগুলোকে একটা জোর কড়কানি দাও।”

“কীভাবে? পুলিশ ডাকব? ওদের যা মূর্তি দেখলাম, ওরা ডান্ডা নিয়ে তেড়ে আসবে।”

“আরে দূর, বাঁকা আঙুলে ঘি ওঠাও।” মানসী চোখ ঘোরাল, “বিদিশা চৌধুরীর তো পার্টির উঁচুমহলে খুব দহরম-মহরম… উনি যদি বলে দ্যান… পার্টির মাথারাই তোমার ইউনিয়ন লিডারদের সিধে করে দেবে।”

শান্তনু যেন বিদ্যুতের শক খেল। বিদিশাকে সে যতটুকু দেখেছে, মহিলাকে তার একটুও পছন্দ হয়নি। যে মানুষ সর্বক্ষণ নিজেকে কেউকেটা প্রমাণ করতে ব্যস্ত, তার শিরদাঁড়া কি কখনও শক্তপোক্ত হয়? পার্টির সাপোর্ট নিয়ে একটা ইউনিভার্সিটির ভিসি হচ্ছে, এটাই তো একটা গা ঘিনঘিনে ব্যাপার। ওই মহিলা যদি বা কোনও নেতাকে বলে-কয়ে সুজনদের সজুত করতে পারে, শান্তনুকে তার ফল ভুগতে হবে না আজীবন? কথায় কথায় শোনাবে না, সে ছিল বলেই না শান্তনুর পরিবার এক গভীর বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে?

শান্তনু তীব্র স্বরে বলল, “যাহ, তা হয় নাকি? আমি ওরকম রিকোয়েস্ট করতে পারবই না।”

“আহা, তুমি বলবে কেন? আঁচল আছে না? তাকে দিয়ে স্বচ্ছন্দে বলানো যায়।”

“ছিঃ। আঁচলকে এর মধ্যে জড়াব?”

“তোমার আবার বেশি বেশি। বাবা-মায়ের বিপদে ছেলেমেয়েদেরই তো এগিয়ে আসতে হয়। তা ছাড়া সারাজীবন তার জন্য তুমি এত করলে, সে তোমার জন্য এটুকু করবে না?”

শান্তনুর কানমাথা ঝাঁঝাঁ করছিল। বাবার কর্তব্যপালনকে ‘এত কিছু করা’ বলে কেন মানসী? তবে কি এখনও সে ভাবে আঁচল শান্তনুর মেয়ে নয়?

গোমড়া গলায় শান্তনু বলল, “সরি মানসী। তুমি যা খুশি ভাবতে পারো। কিন্তু বাবা-মেয়ের ভালবাসার মধ্যে বিনিময়-প্রথাকে ঢুকিয়ো না। আশা করব, আমার কারখানার ব্যাপারে আঁচলকে তুমি কিছু বলবে না।”

মানসী ঝুম মেরে গেল। একটুক্ষণ বসে থেকে শুয়ে পড়েছে, উলটো দিক ফিরে।

শান্তনুও মাথা রাখল বালিশে। সে কী একটু বেশ কঠোরভাবে বলল কথাগুলো?

বেডসুইচ টিপে আলো নিভিয়ে দিল শান্তনু। হিম হিম অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চাইল মানসীকে। পারছে না। বিছানায় এক ফুটের ব্যবধানও মাঝে কেন যে দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর হয়ে যায়!

২৩

শান্তনুকে খবরটা দেওয়ার জন্য ছটফট করছিল অম্বর। ঘুম ভাঙার পর থেকেই। দাঁতটাত মেজে নীচে এসে দেখল বড়কাকা এসে গেছে টেবিলে। পাউরুটিতে সর মাখাচ্ছে। শান্তনু ছাড়া বাড়িতে সবাই মাখন-চিজই খায়। সর দেখলে অলি তো ওয়াক তোলে। কেন যে দেশের বাড়ির অভ্যেস এখনও ছাড়তে পারল না বড়কাকা! তাও যদি রানিগড়ের মতো খাঁটি গরুর দুধের হত। প্যাকেটের দুধের সরে কোনও স্বাদ নেই, অম্বর চেখে দেখেছে। কে জানে অভ্যেসটার মধ্যেই হয়তো বড়কাকা রানিগড়কে খুঁজে পায়।

কিন্তু কথাটা কীভাবে পাড়া যায়? চেয়ারে বসতে বসতে কাকার মুড বোঝার চেষ্টা করল অম্বর। এখনও তেতে আছে কী? মুখ দেখে আন্দাজ করা শক্ত। কাল তো রাগে জমাট পাথর হয়ে ছিল। ফেরার পথে বিমল গাড়িতে যেই এফ এম চালিয়েছে, ওমনি তাকে কী ধমক। তারপর গোটা রাস্তা ঠোঁটে কুলুপ। অসহ্য গুমোট কাটাতে অম্বর একবার শুধু বলেছিল, দিনটা আজ যা গেল, বাব্বা… সঙ্গে সঙ্গে বড়কাকা এমন একটা চোখ করে তাকাল, অম্বরের তো নাড়িভুঁড়ি হজম হওয়ার জোগাড়। রাগ চাপতেই না রাতে খাওয়ার টেবিলে কেমন অদ্ভুত আচরণ করছিল। এখন মাথা খানিক ঠান্ডা হয়েছে, তবু কাকিমার সামনে কথাটা তুললে ফের চটে যেতে পারে। একে অফিসের প্রসঙ্গ, তায় এমন স্পর্শকাতর বিষয়…

দোলাচলের মাঝেই মানসীর প্রশ্ন, “কী খাবে অম্বর? পোচ, না ওমলেট?”

অম্বর হাত উলটোল, “যা খুশি।”

“তা হলে টোস্ট ওমলেটই আনছি।”

অম্বর ঘাড় নাড়ল। মানসী রান্নাঘরে যেতেই মরিয়া হয়ে গলা নামিয়ে বলল, “একটা জরুরি কথা ছিল বড়কাকা।”

মাথা না তুলে শান্তনু বলল, “কী?”

“কাল রাতে ফ্যাক্টরির ইউনিয়ন লিডার পরেশ পাল ফোন করেছিল।”

“তোকে?”

“হ্যাঁ। প্রায় রাত্তির সাড়ে এগারোটায়।”

শান্তনুর স্বর পলকে গম্ভীর, “কেন?”

“বলছিল যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে… স্যার যেন উত্তেজনার বশে কোনও ড্রাসটিক স্টেপ না নেন। দাবিদাওয়ার ব্যাপারটা নাকি সহজেই মিটে যেতে পারে।”

“কীভাবে?”

“পরেশ বলছিল, মাইনেকড়ি বাড়ানোর প্রয়োজন নেই, অর্ডারগুলো ওঠানোর জন্যে কিছু থোক ধরে দিলেই চলবে। রিওয়ার্ডের মতো। স্পেশাল বোনাসও বলতে পারো।”

শান্তনু কিছু বলল না। একটা সিঙ্গাপুরি কলার খোসা ছাড়াচ্ছে।

অম্বর ফের বলল, “ওরা আজও নাকি স্লোগান-ফোগান দেবে। তখন শুধু ওদের ডেকে তুমি যদি ঘোষণাটা করে দাও, তা হলে নাকি এভরিথিং উইল বি নরমাল।”

“ওরকম টাকা তো আমি আগেও দিয়েছি। ওরা না চাইতেই। এবার এই অসভ্যতা কেন?”

“এ ছাড়া নাকি ওদের উপায় ছিল না। বাইরে থেকে জোর পলিটিকাল প্রেশার আসছিল। ইউনিয়ন নাকি দু’ভাগ হওয়ার দশা। লেবারদের সামনে তাই একটা মিলিট্যান্ট আন্দোলনের শো করল। এখন তাদের কিছু পাইয়ে দিতে পারলে ইলেকশন অবধি মোটামুটি নিজেদের খুঁটি বজায় রাখতে পারবে। লোকাল পার্টি নাকি নির্দেশ দিয়েছে, কারখানাকে গরম করে রাখো।”

“তোকে এত সব কথা বলল?”

“হ্যাঁ মানে… বলল তো।”

“সরাসরি আমাকে ফোন করল না কেন?”

“আমিও তো সেই প্রশ্ন করেছি। পরেশ বলল, স্যারের সঙ্গে কথা বলার মুখ নেই। নেহাত চাপে পড়ে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে হয়েছে বলে ওরা খুব অনুতপ্ত। সবাই তোমার কাছে মাপ চেয়ে নেবে। প্রকাশ্যে নয় অবশ্য। আড়ালে। আলাদাভাবে দেখা করে।”

“শুধু আন্দোলন আন্দোলন খেলার জন্য এই অপমান? ভবিষ্যতে আবার যে করবে না তার কী গ্যারান্টি?” শান্তনু দু’দিকে মাথা নাড়ল, “উঁহু। দিস থিং ক্যান নট বি টলারেটেড।”

“পরেশ কিন্তু খুব কাকুতিমিনতি করছিল কাকা। বলছিল, ‘স্যারকে তো জানি, উনি খুব বুঝদার, নিশ্চয়ই আমাদের প্রবলেমটা…’ ”

মানসী চোখ কুঁচকে শুনছিল। টেবিলে খাবার রেখে বলল, “আর অশান্তি বাড়িয়ো না তো বাপু। ক্ষ্যামাঘেন্না করে দাও। এটা তো মানবে, তোমার লেবাররা স্বর্গভ্রষ্টা দেবতা নয়। তারা কখনও মানুষ, তো কখনও অসুর। কখনও তারা তোমার পায়ে পড়বে, কখনও বুকের ওপর চেপে দাপাবে।”

“আর আমাকে সব মুখ বুজে মেনে নিতে হবে, তাই তো?”

“হ্যাঁ তাই। এত বছর কারখানা চালাচ্ছ, লেবারদের এখনও চেনোনি? এ রাজ্যের বড় বড় ফ্যাক্টরিগুলো কি এমনি এমনি পাততাড়ি গুটিয়েছে? তাদের তো তাও যাওয়ার জায়গা ছিল, গেছে। গণ্ডগোল জিইয়ে রেখে তোমার কী সুসার হবে শুনি?”

“কারখানা বন্ধও করে দিতে পারি।”

“তারপর? হরিনগরে গিয়ে সুখে শান্তিতে মাছচাষ করবে? হুঁহ। সেখানেও কি কম তুলকালাম চলছে? তোমার কর্মচারীকেই সেখানে মেরে দিল…”

মানসীর যুক্তিবান হানা উপভোগ করছিল অম্বর। বড়কাকার প্রতিটি কাজেই যে তার একটা নিজস্ব মতামত আছে, বড় একটা জাহির করে না কাকিমা। কিন্তু বলতে শুরু করলে বড়কাকার মতো ঝানু লোককেও রণে ভঙ্গ দিতে হয়। এখনই তো কাকা আস্তে-আস্তে মিইয়ে যাচ্ছে। ওফ, হরিনগরের ব্যবসাটাও যদি কাকিমা কাঁচিয়ে দিতে পারে, তা হলে তালিতের একশো আটটা শিবমন্দিরে গলবস্ত্র হয়ে পুজো চড়িয়ে আসবে অম্বর।

শান্তনু গোঁজ হয়ে মানসীর উপদেশ শুনছিল। ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, “অনেক জ্ঞান মেরেছ, এবার চা দাও। আমায় স্নানে ঢুকতে হবে।”

“দিচ্ছি। …অম্বর, তুমিও তৈরি হয়ে নাও।”

একবার শান্তনুকে দেখল অম্বর, একবার মানসীকে। দ্বিধান্বিত স্বরে বলল, “আমি যাব?”

শান্তনু কিছু বলার আগে মানসীর স্বর, “নিশ্চয়ই। আবার যদি কোনও কেয়স হয়। যা দিনকাল… তুমি কাকার সঙ্গে-সঙ্গে থাকলে তাও আমি একটু ভরসা পাই।”

তার ওপর কাকিমার এত আস্থা জেনে কি পুলকিত হল অম্বর? মোটেই না। উলটে বাঁশ গেল যে! আচ্ছা, কী এমন গুণের কাজ করেছে সে? একমাত্র আঁচলের বিয়েতে গায়েগতরে খেটে দেওয়া ছাড়া? আর হ্যাঁ, মাঝে মাঝে হরিনগর ভ্রমণ। তা অম্বর যে সেখানে কোনও কম্মেই লাগেনি, এ কথা অম্বরের চেয়ে বেশি আর কে জানে! যাই হোক, আপাতত কয়েক দিন ছুটি মিলছে ভেবে নিজের মতো করে ছকে ফেলেছিল দিনগুলোকে। ভেবেছিল ভোটের ক’দিন আগেই যাবে রানিগড়। শুধু ভোট দিয়ে ছোটকাকাকে ব্যথিত করতে নয়, পুরনো কিছু খাতাপত্র আছে, খুঁজেপেতে সেগুলো উদ্ধার করা দরকার। কোথাও না পাঠানো কবিতাগুলো ঝাড়াই-বাছাই করে দেখবে, কোনটা কোনটা নতুন করে লিখলে দাঁড়াবে মোটামুটি, কোনটাই বা চিরতরে বাতিল। বিস্তর সময় লাগবে, রানিগড়ে হপ্তাখানেক থেকে নিশ্চিন্তে সারা যেত কাজটা। ধুস, সব বোধহয় গুবলেট হয়ে গেল! কাকার লেজুড়বৃত্তি থেকে অতটা মুক্তি মিলবে না।

মানসী চা এনেছে। কাপ রেখে নিজেও বসল টেবিলে। শান্তনুকে বলল, “বিতনু কাল কিছু কাগজপত্র দিয়ে গেছে তোমাকে। দেখবে?”

“কী কাগজ?”

“তোমাদের বাড়ি সারানোর কত খরচখরচা পড়বে, এই সব।”

অম্বর বিস্মিত হল। আঁচলের বিয়ের সময়ে রানিগড়ের বাড়ি মেরামতির ব্যাপারে বড়কাকার কাছে খুব ঘ্যানঘ্যান করছিল বাবা। তখন বড়কাকা নিমরাজি মতো হয়েছিল বটে, কিন্তু অম্বর তো বাবাকে পইপই করে বলল ভাইয়ের ওপর এক্ষুনি চাপ তৈরি না করতে। মেয়ের বিয়ে দিয়ে তার এখন হাবুডুবু দশা। তা সত্ত্বেও ছোটকাকা কিনা বাড়ি বয়ে এসে…!

অম্বর উপযাচক হয়ে মানসীকে বলল, “মোট কীরকম পড়তে পারে… ছোটকাকা আন্দাজ দিল কিছু?”

“দেড় লাখের নাকি কম নয়।”

“তার মানে কাজে নামলে তো নির্ঘাত আড়াই-তিনের গল্প।” অম্বর গলা ঝাড়ল, “না বড়কাকা, বাবা-কাকারা যা ইচ্ছে বলুক, তুমি এখন একদম ওসবে যেয়ো না।”

“তা বললে চলে? তোর বাবাকে কথা দিলাম কাজটা এবার সবাই মিলে তুলে ফেলব…”

“সে কোরো এখন। আগে বর্ষাটা যাক। কয়েক মাসে তো বাড়ি ধসে পড়বে না। পুজোর পর মিস্ত্রি লাগিয়ো।”

“থাম তো। তোকে এ নিয়ে কে ভাবতে বলেছে?” অম্বরকে মৃদু দাবড়ানি দিয়ে শান্তনু মানসীকে বলল, “আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখো। অফিসে দেখে নেব।”

অম্বর আর কথা বাড়াল না। শান্তনুকে সে যতই দেখছে, ততই অবাক হচ্ছে। ছোটবেলায় বড়কাকা ছিল অনেক দূরের মানুষ। ক্বচিৎ কখনও পা দিত রানিগড়ে, শহুরে ভারিক্কি চালে অল্প দু’-চারটে কথা বলত, রাতে তো থাকতই না, বুকের মধ্যে একটা গুড়গুড়ে সম্ভ্রম জাগিয়ে বিকেলবেলা ফিরে যেত কলকাতায়। তারপর একসময়ে তো বাড়িতে জোর কানাকানি। কলকাতায় কোন এক ডিভোর্সি নাগিনীর পাল্লায় পড়ে নাকি বিচ্ছিরিভাবে ফেঁসেছে কাকা। দাদুর মুখ থমথম সারাক্ষণ, ঠাম্মা কথায় কথায় চোখ মুছছে…। তারপর তো রানিগড়ে আসা বন্ধই হয়ে গেল বড়কাকার। এল সেই দাদুর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে। কী আশ্চর্য, মাত্র ক’দিনে অবলীলায় ফের মিশে গেল ভাই-দাদাদের সঙ্গে। যেন মাঝের এতগুলো বছরের কোনও অস্তিত্বই নেই। তখনই প্রথম রানিগড়ে নিয়ে গেছিল বড়কাকিমাকে। আঁচল অলি সমেত। এত মসৃণভাবে জুড়ে গেল সম্পর্কটা। এবং তারপর থেকে কীভাবে যেন বড়কাকা অভিভাবক হয়ে উঠল ওবাড়ির। কেউ বিপদেআপদে পড়লে বড়কাকার নামই সবার ঠোঁটে আসে সর্বাগ্রে। বাবার কিডনিতে স্টোন? অপারেশন হল কলকাতায়। নার্সিংহোম থেকে ছাড়া পেয়ে পাক্কা দু’সপ্তাহ গড়িয়ার বাড়িতে রইল বাবা। সঙ্গে মা। আর ঠাম্মার চিকিত্সায় তো জলের মতো খরচা করেছে বড়কাকা, ভাইরা কেউ কিছু দেবে কি না, জানতেও চায়নি কখনও। এই বাড়ি মেরামতি যে বড়কাকারই ঘাড়ে চেপে সারবে ভাইরা, তা কী জানে না অম্বর!

কিন্তু বড়কাকা করেই বা কেন? কর্তব্যবোধ? বড়লোকি দেখানোর লোভে? নাকি অদৃশ্য ঋণপাশে জড়িয়ে রাখতে চায় সবাইকে? অথবা সবাই তার ওপর ভরসা করছে, এতেই আনন্দ পায়? কাকার মতো হিসেবি মানুষকে এর কোনও ভূমিকাতেই মানায় কী? কাকার মনটা আদতে কঠিন না কোমল, তাই তো এখনও ঠাহর করে উঠতে পারল না অম্বর।

যাক গে, মরুক গে, ফালতু ফালতু মগজ খুঁড়ে কী লাভ!

স্নান-টান সেরে অম্বর তৈরি হয়ে নিল। বেরিয়ে পড়েছে শান্তনুর সঙ্গে। গড়িয়া বাসস্ট্যান্ডের কাছে এসে শান্তনু হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “তোকে আজ কী কাজ দিই বল তো?”

অম্বরের মুখ দিয়ে প্রায় বেরিয়ে যাচ্ছিল, অন্যদিনই বা কী করি! শেডময় এলোমেলো ঘুরে বেড়ানো, মাঝে মাঝে চা খাওয়া, দুপুরে ভরপেট গেলা আর অ্যাকাউন্ট্যান্টের পাশে বসে হাই তোলা… এই তো আমার ডিউটি।

ঢোক গিলে অম্বর বলল, “তোমার কাছে কাছেই থাকব। ফের যদি আজ ঝামেলা হুজ্জোত হয়…”

“ও আমি সামলে নেব। তুই কেটে পড়।”

অম্বর হাঁ, “কোথায় যাব?”

“সেটা তোর মর্জি। দয়া করে বাড়ি ফিরিস না, তোর কাকিমা বেজায় খচে যাবে।”

ভিড়রাস্তায় অম্বরকে নামিয়ে চলে গেল শান্তনুর গাড়ি। হতভম্ব মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে অম্বর। কারখানায় তাকে কেন যে নিয়ে গেল না বড়কাকা? পরেশদের সঙ্গে কোনও ফাটাফাটি করতে চায়? নাকি নিভৃত আলোচনা চলাকালীন অম্বরের উপস্থিতি বাঞ্ছনীয় মনে করছে না? কিন্তু কেন? অম্বরকে না তার রাইটহ্যান্ড ম্যান ভাবে! নাহ বড়কাকার থই পাওয়া ভার।

তা অম্বর এখন করেটা কী? সারাদিন গিয়ে বসে থাকবে কফিহাউসে? ফাঁকা তাওয়ায় খই ভাজবে? এখন আনোয়ার শাহ রোডের শপিংমলটায় যেতে পারে অবশ্য। ওখানে একটা বিশাল বইয়ের দোকান আছে, অক্ষর ঘেঁটেই স্বচ্ছন্দে কেটে যাবে বেলা।

ভাবনা মতোই ঢিমেতেতালা এগোচ্ছিল দিনটা। বিমল করের একখানা গল্পসংকলনে ডুবে গিয়েছিল অম্বর। মানুষের মনকে যে কত কোণ দিয়ে দেখা যায়, পড়ছিল সম্মোহিতের মতো।

মনোনিবেশে ব্যাঘাত ঘটল। কানের গোড়ায় এক চেনা মহিলাকণ্ঠ, “আরে, তুমি এখানে?”

ঘুরে তাকাল অম্বর। আঁচলের পিসি। সঙ্গে দশাসই চেহারার এক সুদর্শন ভদ্রলোক। দেবরাজ সিংহরায় না?

ফোমের গদি ছেড়ে ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়াল অম্বর। কৈফিয়ত দেওয়ার সুরে বনানীকে বলল, “একটা বই কিনতে ঢুকেছিলাম… তারপর একটু জমে গেছি আর কী।”

“ও। …এসো তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।” বনানী ঘুরে দেবরাজকে বলল, “এ হল গিয়ে অম্বর। শান্তনুদার ভাইপো। গড়িয়ায় আঁচলদের বাড়িতেই থাকে। …আর ইনি হলেন…”

“আমি ওঁকে চিনি পিসি।” অম্বর তাড়াতাড়ি বলল, “টিভিতে দেখেছি। আঁচলের মোবাইলেও ওঁর ছবি আছে। একটা আর্ট এগ্‌জিবিশনে… উনি নিজের পেন্টিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে…”

“ও হ্যাঁ। তুলেছিল বটে।” দেবরাজ ঘাড় দোলাল, “তোমার নামও আমি আঁচলের মুখে শুনেছি। তুমি তো কবিতা লেখো, তাই না?”

আঁচল তার ওই পরিচয়ও দিয়েছে? পলকের জন্যে হৃদয়ে এক বিপুল উল্লাস। পলকে কুঁকড়ে গেছে অম্বর। কুণ্ঠিত স্বরে বলল, “ও কিছু না। একটু-আধটু চেষ্টা করি, তেমন দাঁড়ায় না।”

“কাম অন ইয়াং ম্যান, এত কনফিডেন্সের অভাব কেন?” অম্বরকে চমকে দিয়ে তার কাঁধে মৃদু চাপড় মারল দেবরাজ। প্রায় সমবয়সির সুরে বলে উঠল, “দ্যাখো ভাই, মানুষ শুধু চেষ্টাটাই করতে পারে। আর সেই চেষ্টা অনেস্ট হওয়াই তো যথেষ্ট। শেষমেশ কী হল, না হল, ভেবে কোনও লাভ আছে?”

অম্বর আরও লজ্জা পেল। কোথায় উৎসাহিত বোধ করবে, উলটে গুটিয়ে গেল যেন। নিজের প্রসঙ্গ থেকে সরে আসতেই বুঝি জিজ্ঞেস করে ফেলল, “আপনিও বুঝি বই কিনতে…?”

“নাহ। চার্লি চ্যাপলিনের ফিল্‌মের একটা কালেকশন বেরিয়েছে। ডি ভি ডি-গুলো নিতেই আসা।”

অম্বর একটু সপ্রতিভ হওয়ার চেষ্টা করল, “আপনি বুঝি কমেডি ছবি ভালবাসেন?”

“চার্লি চ্যাপলিনকে কমেডিয়ান মনে হয়? স্ট্রেঞ্জ! আমি তো ওঁকে একজন ট্রু রেবেল ভাবি। যিনি হাসির মোড়কে মানুষকে কাঁদিয়ে ছাড়েন।”

কথাটা দারুণ মনে ধরেছে অম্বরের। বটেই তো, হালকা ছলে গল্প বললেও চ্যাপলিন তো বিষাদেরই কবি।

বনানী পাশ থেকে বলল, “আসলে আঁচলের জেঠুর জন্যে এগুলো কেনা হচ্ছে। উনি দেখতে চেয়েছেন তো…”

“জেঠু মানে যাঁর…।” অসুখের নামটা উচ্চারণ করতে পারল না অম্বর। জিজ্ঞেস করল, “উনি এখন কেমন আছেন?”

“গতকাল তো ফার্স্ট কেমো হল। আজ রিলিজ। এই তো, বিকেলে নিয়ে আসব হসপিটাল থেকে।”

দেবরাজ বনানীকে বলল, “তোরা এখানে ওয়েট কর। আমি চটপট কাজটা সেরে আসি।”

হনহনিয়ে ভিতর দিকে চলে গেল দেবরাজ। অম্বরকে অস্বস্তিতে ফেলে। ঘটের মতো বনানীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কি সোজা কাজ? চুপ থাকা ভাল দেখায় না, আবার কী যে বলবে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তা ছাড়া মহিলা একটু বেশি কৌতূহলপ্রবণ, অম্বরের বাবা মা কাকা কাকিমাদের সম্পর্কে এক একসময়ে যা প্রশ্ন জোড়ে।

তাকে সুযোগ না দেওয়ার জন্যই অম্বর বলে উঠল, “শুনেছেন তো আঁচলের শাশুড়ির খবরটা?”

“অনেকদিন। আমি তো কনগ্র্যাচুলেটও করে দিয়েছি।” বনানীর গলার গর্বের সুর, “দেখেছ তো, আঁচলের বিয়ে আমি হেঁজিপেঁজি ঘরে সেট করিনি! আঁচলের ভবিষ্যৎ পুরো তৈরি হয়ে গেল। পিএইচ ডি করা, কলেজ কিংবা ইউনিভার্সিটিতে পড়ানো, সব সুযোগ এখন আঁচলের হাতের মুঠোয়।”

তেমন কোনও কারণ নেই, তবু কেন যেন গায়ে লেগে গেল অম্বরের। ফস করে বলে দিল, “আঁচল কোনও সুযোগ নেওয়ার মেয়ে নয়। ও নিজের ক্যালিবারেই উঠবে।”

বনানী যেন সামান্য হোঁচট খেল, “তা ঠিক। তবু হাতের নাগালে একটা মই তো রইল।”

“মই কি শুধু ওঠায় পিসি?” অম্বর নরম সুরে বলল, “মই তো নামতেও সাহায্য করে।”

কথাটা বনানীর পছন্দ হয়নি। একটু গম্ভীরভাবে বলল, “এই তো মানুষের দোষ। কিছুতেই সন্তুষ্টি আসে না। বিদিশাদির মতো শাশুড়ি পাওয়া যে কোনও মেয়ের পরম সৌভাগ্য।”

প্রকাণ্ড এক প্লাস্টিকের ব্যাগ হাতে ফিরছিল দেবরাজ। বনানীর শেষ বাক্যটি বুঝি তার কানে গেছে। অমনি অবহেলার সুরে বলল, “থাম তো। বিদিশা চৌধুরী কী এমন তালেবর? চামচাগিরি করে একটা বড় পোস্ট বাগিয়েছে বই তো নয়। তারই বরং কপাল ভাল। আমার মেয়ের মতো একপিস বউ পেয়েছে ঘরে।”

বনানী চুপসে গেছে। ক্ষীণ স্বরে কী যেন বলতে যাচ্ছিল, তাকে আমল না দিয়ে ফের দেবরাজের গলা বেজে উঠেছে, “ওয়েল ইয়াং ম্যান, আমাদের প্রথম আলাপটা সেলিব্রেট করা যাক। চলো, একটু কিছু খাই।”

প্রস্তাবটা শুনেই অম্বর টের পেল, পেট বেশ চুঁইচুঁই করছে। কিন্তু কেমন যেন বাধো বাধো ঠেকছে। শান্তনুর ভাইপো শান্তনুর বউয়ের প্রথম পক্ষের বরের সঙ্গে বসে ভোজন করবে, এটা কি শোভন? বড়কাকি শুনলে ক্ষুব্ধ হবে না তো? বড়কাকাও কি…? মহিলাটির যা স্বভাব, গল্পের ছলে কাকা-কাকির কানে লাগাতেই পারে।

অম্বর গলায় জোর ফুটিয়ে বলল, “থ্যাংকস। পরে একদিন হবে। আজ আমার একদম খিদে নেই।”

“সো হোয়াট? মানুষ কি জন্তু, যে শুধু খিদে পেলেই খায়?” অম্বরের কাঁধে আবার চাপড়, “কক্ষনও পরের দিনের ভাবনায় থেকো না, বুঝলে। আজই চলো।”

অম্বর আর আপত্তি করল না। মনকেও বুঝ দিয়ে ফেলল একটা। দেবরাজ তো আঁচলের বাবা, তার সঙ্গে একত্রে আহার কি দোষের হতে পারে? তা ছাড়া ভদ্রলোকের আহ্বান ভারী আন্তরিক, অকারণে অম্বরই বা অভব্য হবে কেন।

দোকানের বাইরেই একটা মিনি রেস্তোরাঁ। সামনে থমকেছে দেবরাজ। প্রশ্ন জুড়ল, “কী খাওয়া যায় বলো তো? কফি উইথ ড্রাই স্ন্যাকস? পিত্জা? বারগার?”

অজান্তেই অম্বরের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “দুপুরবেলা পিৎজা?”

“তুমি তো একদম আমার মনের কথা বলেছ হে।” অম্বরকে তারিফ ছুড়ে দিয়ে দেবরাজ বনানীকে বলল, “দেখেছিস তো, এখনও এমন ছেলেপুলে আছে, যাদের জিভ পুরো পলিউটেড হয়নি। চল, ওপরের ফুডকোর্টে গিয়ে রুটিমাংস সাঁটাই।”

বনানী ভ্রুভঙ্গি করল বটে, কিন্তু হাসিমুখেই চলেছে সঙ্গে। খেতে খেতে গল্প জুড়ে দিল দেবরাজ। দাদার অসুখ, কলকাতার হাসপাতাল, ডাক্তার, নার্স, রাজ্যরাজনীতি, আসন্ন নির্বাচনে পরিবর্তনের সম্ভাবনা, ফিল্‌ম, এখনকার লেখালেখি, …অজস্র বিষয় আসছে ঘুরে ফিরে। আধঘণ্টার মধ্যে অম্বর ভুলে গেল এই মানুষটার সঙ্গে আজই তার প্রথম পরিচয়। লিটল ম্যাগাজিনের ভবিষ্যৎ নিয়ে তর্কও জুড়ল প্রায় কফিহাউসের ভাষায়। আশ্চর্য, বনানী আজ কথা বলছে কম, শুনছে বেশি। মাঝে-সাঝেই উশখুশ করছে। একসময়ে বলে ফেলল, “অ্যাই ছোড়দা, সময়ের হুঁশ আছে?”

দেবরাজ সবে তার আর্ট কলেজের ঝাঁপি খুলছিল। থেমে বলল, “কেন রে?”

“পৌনে তিনটে বাজে। আমাদের তো এবার যেতে হয়। চারটের মধ্যে না পৌঁছলে দাদাকে বাড়ি নিয়ে যেতে রাত হয়ে যাবে না?”

“হ্যাঁ, তাই তো। রিলিজ করাতে ঘণ্টা দুয়েক তো লাগবেই।” অম্বরের দিকে ফিরল দেবরাজ, “আজ তা হলে আসি। চমৎকার কাটল দুপুরটা। আঁচলকে বলব, কবিবরকে আমার পছন্দই হয়েছে। ওর বরটার মতো ম্যাদামারা নয়।”

আকস্মিক তুলনাটায় কি অম্বরের চিত্তে একটু শিহরন জাগল? শুধু এইটুকু মনছোঁয়া প্রশংসার জন্যেই দেবরাজের ভক্ত হয়ে যেতে পারে না অম্বর? দেবরাজের চরিত্র সম্পর্কে সমস্ত নিন্দেমন্দ উপেক্ষা করে?

দেবরাজ আর বনানী চলে গেছে। অম্বরও প্রায় উড়তে উড়তে ছুটল শহরের অন্যপ্রান্তে। বাসের ভিড়, মেট্রো রেলের গুঁতোগুঁতি, কিছুই যেন লাগছে না গায়ে। ভোটের রণদামামা তুঙ্গে, কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে যথারীতি নির্বাচনী প্রচারে গাঁকগাঁক চেল্লাচ্ছে কোনও নেতা, তার কর্কশ কণ্ঠস্বরও বিরক্তকর ঠেকল না আজ। কফিহাউসেও কী কপাল, টেবিল আলো করে বসে আছে তাদের দলবল।

সাড়ে আটটা নাগাদ তৃপ্ত মনে বাড়ির পথে রওনা দিল অম্বর। শেয়ালদা অভিমুখে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল, এক একটা দিন খারাপ ভাবে শুরু হয়েও কেমন আচমকা বদলে যায়। হরিদেবপুরে কাকার কারখানা যেন এই মুহূর্তে এক অলীক দুনিয়া। কিংশুক একটা নতুন পত্রিকা বার করার জন্যে অনেকদিন ধরে ঘ্যানঘ্যান করছে। শুধু কবিতা নয়, সেখানে সিরিয়াস প্রবন্ধও থাকবে নিয়মিত। প্রথমে ত্রৈমাসিক, পরে বিজ্ঞাপন জুটলে মাসিকও করা যেতে পারে। আজও কফিহাউসে কথাটা পেড়েছিল কিংশুক, টেবিলে কেউ তেমন গা করল না। এখন মনে হচ্ছে নেমে পড়লেই হয়। চেষ্টা করতে দোষ কী। দেবরাজ সিংহরায় বলছিল, মানুষ শুধু চেষ্টাই করতে পারে। আর চেষ্টা যদি সৎ হয়, যদি আত্মবিশ্বাস থাকে…

শেয়ালদা সাউথ সেকশনে থই থই মানুষ। একটা ট্রেন ঢোকামাত্র উন্মত্তের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে লোকজন। যাত্রীরা নামার আগেই চলছে সিট দখলের বেপরোয়া প্রতিযোগিতা।

সামান্য তফাতে দাঁড়িয়ে অম্বর দৃশ্যটা দেখছিল। তাও সুস্থির হয়ে খাড়া থাকার জো নেই, এমন ধাক্কা আসছে অবিরাম।

হঠাৎ দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল অম্বরের। ভিড় ঠেলে কে আসছে ও? নির্বাণ না! একা নয়, সঙ্গে একটা মেয়ে! জিনস-টিশার্ট পরা মেয়েটার কাঁধ বেড় দিয়ে রেখেছে নির্বাণের বাহু?

মানুষের একটা ঢেউ আছড়ে পড়ল গায়ে। ছিটকে পড়তে পড়তেও কোনওমতে নিজেকে সামলেছে অম্বর। কিন্তু সেই যুগল গেল কোথায়? আর নজরে পড়ছে না তো!

হারিয়ে গেল জনসমুদ্রে? নাকি অম্বরের দৃষ্টিভ্রম? অম্বর কী করে এখন? দৌড়ে গিয়ে খুঁজবে দুজনকে? যদি না মেলে, তার দেখাটা কি মিথ্যে হয়ে যাবে?

আর যদি দেখাটা সত্যি হয়? কথাটা মনে আসামাত্র অম্বর থরথর কেঁপে উঠল। আশঙ্কায়? আতঙ্কে? নাকি অচেনা বেদনায়? আঁচলের দাম্পত্য জীবন মিথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে, ভাবলেই বুকটা ব্যথিয়ে উঠছে যে!

হায় রে, একই দিন যে কতভাবে তার রং বদলায়!

২৪

তিতকুটে মেজাজে পরীক্ষার হলে নজরদারি চালাচ্ছিল আঁচল। ভোটের জন্যে দিন দশেক বন্ধ ছিল পার্ট টু। নির্বাচনী ফলাফল বেরনোর পর এখন শুরু হয়েছে দ্বিতীয় দফা। অনার্স পেপারগুলো আগে চুকেবুকে গেছে, এবার শুধুই পাস। অর্থাৎ আঁচলদেরও হয়রানির চূড়ান্ত। একেবারে খাজা খাজা ছেলেমেয়েরাই এখন সংখ্যায় বেশি, কোশ্চেন পেপার পাওয়ামাত্র শুরু হয় হট্টগোল, তাদের থামাতে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে গলা চিরে যাওয়ার জোগাড়। একটু বসে থাকার জো নেই, হাঁটতে হচ্ছে অবিরাম। টানা তিন ঘণ্টা কি এই ঝক্কি পোষায়? এর চেয়ে পরপর চার পাঁচখানা ক্লাস নেওয়া ঢের ঢের ভাল।

রুমে আঁচল ছাড়াও আরও দু’জন মজুত। বাণিজ্য বিভাগের নরেশ মাইতি নির্বিকার মুখে চেয়ারে আসীন, একটা ইংরেজি খবরের কাগজের আগাপাশতলা মুখস্থ করছে। সংস্কৃতের জয়শ্রীদি প্রথম ঘণ্টার বেল পড়ার পর টিফিন সারতে দৌড়েছিল, মিনিট চল্লিশ স্টাফরুমে কাটিয়ে ফিরেছে এইমাত্র। তবে টুকলি ধরায় জয়শ্রী ব্যানার্জি বেজায় দক্ষ, এসেই পটাপট পাকড়াও করল কয়েকজনকে। পুঁচকে পুঁচকে মিনি জেরক্সগুলো কেড়ে নিয়ে চোয়াড়ে মার্কা দু’-তিনটে ছেলেকে শাসাল কড়া গলায়। মেয়েদেরও ছাড়ছে না। হাতেনাতে ধরামাত্র কেড়ে নিচ্ছে খাতা। পাক্কা দশ মিনিট ঠুঁটো জগন্নাথটি হয়ে বসে থাকার পর তারা ফেরত পাচ্ছে উত্তরপত্র। জয়শ্রীদির দৌলতে এবার খানিকটা শান্তি বিরাজ করছে ঘরে।

জাঁদরেল জয়শ্রী এইবার ধরেছে আঁচলকে। ছেলেমেয়েদের কান বাঁচিয়েই বলল, “এই মেয়ে, পরীক্ষাহলে এত মিনমিন করিস কেন? একটু গলা তোল।”

আঁচল অল্প হাসল, “আপনি তো একাই যথেষ্ট জয়শ্রীদি।”

“খুব মজা, অ্যাঁ? ছেলেমেয়েগুলো বাইরে বেরিয়ে আমায় গাল পাড়বে, আর তোরা হয়ে যাবি ভাল দিদিমণি।” নরেশের দিকে চোখের ইশারা করল জয়শ্রী, “এই যে একজন, পরীক্ষার হলে ঢুকে ধ্যানী বুদ্ধ হয়ে যান। অথচ স্টাফরুমে কিন্তু তাঁর বুলির কামাই নেই।”

খবরের কাগজের ওপার থেকে নরেশের স্বর উড়ে এল, “সব কিন্তু শুনতে পাচ্ছি জয়শ্রী। কচি মেয়েটাকে আমার সম্পর্কে ভুল ইনফরমেশন দিয়ো না। তোমাদের বয়সে আমিও বাঘের মতো দাপাতাম।”

জয়শ্রী মুচকি হাসল, “কী জানি নরেশদা, আঠেরো বছর চাকরি হয়ে গেল, পরীক্ষার হলে কোনওদিন তো আপনাকে মিয়াও মিয়াও করতেও দেখলাম না।”

দুই ফুলটাইমারে খুনসুটি বেধেছে। এরপর নানান খোশগল্প হবে দু’জনের। সংসার ছেলে মেয়ে বর বউ…। সুযোগ বুঝে আঁচল বলল, “আমি তা হলে একটু ঘুরে আসি দিদি?”

নরেশই জবাব দিল, “হ্যাঁ হ্যাঁ যাও। তবে এই দিদিটির মতো অতক্ষণ বাইরে থেকো না।”

জয়শ্রীর পালটা বচন না শুনেই টুকুস বেরিয়ে এল আঁচল। তক্ষুনি ফিরেছে সেই বিশ্রী অস্বস্তিটা। গত সপ্তাহে গড়িয়া গিয়েছিল, তখন থেকেই একটা আশঙ্কা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। পরীক্ষার হলে ঘণ্টা দুয়েক ভাবনাটা তাও চাপা ছিল, আবার নতুন করে চাগিয়ে উঠছে যেন। শরীরে ঘটলটা কী? নিছক স্বাভাবিক কোনও মেয়েলি উপসর্গ? নাকি সে যা ভয় পাচ্ছে, তাই?

দুশ্চিন্তার পাহাড় বুকে নিয়ে আঁচল নামছিল সিঁড়ি বেয়ে। পিছন থেকে পিয়ালীর ডাক, “অ্যাই অ্যাই, স্টাফরুমে যাচ্ছিস?”

বেশ কিছুদিন পর দেখা হচ্ছে পিয়ালীর সঙ্গে। আগের পরীক্ষাগুলোয় ডিউটি দেয়নি, কী জন্য যেন ছুটি নিয়েছিল।

আঁচল দাঁড়িয়ে গেল ল্যান্ডিংয়ে। বলল, “হ্যাঁ গো। তুমিও যাবে নাকি?”

“চল, একবার টয়লেট ঘুরে আসি।” পিয়ালীও সিঁড়ি ধরল, “দাঁড়া, বেশি তাড়াহুড়ো করিস না। আমি একটু আস্তে আস্তে নামব।”

“কেন? পায়ে চোট-টোট লেগেছে নাকি?”

“উঁহু।” আঁচলের পাশে এসে থামল পিয়ালী। চোখ ঘুরিয়ে বলল, “আরও গভীরে।”

“মানে?”

পিয়ালী ফিসফিস করে বলল, “আমি প্রেগনেন্ট।”

অবাক হওয়ার মতো কোনও ঘটনা নয়, তবু চমকাল আঁচল। সখীর এহেন সমাচারে তার তো পুলকিত হওয়া উচিত। কিন্তু হতে পারছে কই? সামান্য ঠোঁট ফাঁক করে শুধু বলল, “ও। খুব ভাল খবর। কনগ্র্যাচুলেশনস।”

“থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ।”

গোটা কয়েক ছেলেমেয়ে কলকল করতে করতে নামছে। নীচেও ঘোরাফেরা করছে ছাত্রছাত্রীরা। কথা বলতে অসুবিধে হচ্ছিল আঁচলদের, পায়ে পায়ে স্টাফরুমে এল। চেয়ারে বসে ব্যাগ খুলল, টিফিনবক্স বার করেছে। অনিমাদি আজ পরোটা আর আলুপটলের চচ্চড়ি দিয়েছে। সঙ্গে দু’খানা সন্দেশ। অনিমাদি ভালই রাঁধে, আঁচলের কলেজের টিফিন বাড়তি যত্ন নিয়ে বানায়। বিদিশাদেবীর নির্দেশ, পুত্রবধূর জলখাবার যেন স্বোয়াদের হয়। কিন্তু চারখানা পরোটা দিয়েছে কেন অনিমাদি? আঁচল কি রাক্ষস?

স্টাফরুমে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সাত-আটজন মজুত। কেউ বা আহারে ব্যস্ত, অনেকে আজ মেতে আছে তর্কে। ভোটে রীতিমতো ভরাডুবি হয়েছে লাল পার্টির, তারই কারণ নিয়ে যে যার মতামত জাহির করছে। লালের সমর্থকই বেশি, তবে তাদের সাময়িক বিপর্যয়ের তত্ত্ব নস্যাৎ করে দিচ্ছে বিরোধীরা। রসিয়ে রসিয়ে নুন ছেটাচ্ছে কাটা ঘায়ে, বিধানসভা ভোটে নাকি আরও বেশি কুপোকাত হবে লালদল।

আলোচনাটা তেমন টানছিল না আঁচলকে। তবু শুনতে তো হচ্ছেই। শাশুড়ির মুখখানা মনে পড়ে গেল। সেদিন সকাল থেকে কী উৎসাহ নিয়েই না বসেছিলেন টিভির সামনে। বেলা যত গড়ায়, মুখ ততই থমথমে। শেষমেশ তো উঠেই গেলেন। নিজের ঘরে গিয়ে অনবরত কল করছেন মোবাইলে। বিকেল নাগাদ তো গাড়ি নিয়ে বেরিয়েই গেলেন। ফিরলেন অনেক রাতে। খেলেন না কিছু, সোজা শুয়ে পড়েছেন। বেচারি, পার্টিঅন্তপ্রাণ হলে যা হয়!

টয়লেট ঘুরে পিয়ালী পাশে এসে বসেছে। খুশি খুশি গলায় বলল, “কী ফেঁসে গেলাম বল তো। এখন আরও ছ’মাস যা আতান্তর যাবে… ডেট পড়েছে সেই নভেম্বরের শেষে।”

“এই জন্যেই ডুব দিয়েছিলে?”

“শাশুড়িই বললেন, এখন ক’দিন বেরিয়ো না। আমিও দিব্যি বাড়িতে শুয়ে শুয়ে ওঁর সেবা নিলাম।”

“ভালই তো। এখন কয়েক মাস তোমায় তোলা তোলা করে রাখবেন।”

“ঠিক বলেছিস। আমার কী মনে হচ্ছে জানিস তো? বাচ্চাটা আরও আগে এলে মজা হত। শাশুড়িকে আগেই টাইট দিতে পারতাম।” পিয়ালী ফিক ফিক হাসছে, “মা অবশ্য বারবার বলছে, সিঁথি চলে আয়। তবে আমি এক্ষুনি নড়ছি না।”

“কেন?”

“মায়ের শরীরটা তো তেমন জুতের নয়, কেন বাড়তি লাগেজ হয়ে এতগুলো মাস তার ঘাড়ে চাপব? একেবারে শেষের দিকে বরং…”

আঁচল সামান্য আনমনা। সে তো বহু বছর ধরেই মায়ের কাছে বাড়তি বোঝা। তাকে বিদিশা চৌধুরীর বাড়ি চালান করে মা তো হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে।

মৃদু স্বরে আঁচল জিজ্ঞেস করল, “তুই খুব খুশি, না রে?”

“আমি আর কী এমন! আমার বরের আহ্লাদ যদি দেখতিস!” পিয়ালীর চোখে পুলকের হিল্লোল, “আগে তো আমায় ধর্মের নামে ছেড়ে দিত। সারাদিন কী করছি না করছি খোঁজই রাখত না। এখন কত প্রেম! ঘনঘন ফোন করছে। এই, ভিড় ট্রেনে উঠো না কিন্তু! তেমন বুঝলে এক-দু’টো ট্রেন ছেড়ে দিয়ো! বলে কয়ে কলেজে একটু হালকা ডিউটি ম্যানেজ করো! কী হল, এখনও টিফিন খাওনি?”

পিয়ালীর উচ্ছ্বাস রীতিমতো সংক্রামক। কখনও-কখনও মনখারাপও দিব্যি সেরে যায়। কিন্তু আজ কী জানি কেন সহ্য হচ্ছিল না আঁচলের। বরের প্রসঙ্গে নির্বাণ কি ভেসে উঠছে চোখে? ছিহ, বিয়েতে সায় দিয়ে কী ভয়ংকর ভুলটাই না করেছে আঁচল।

পিয়ালীর বাক্যস্রোত থামাতে আঁচল বলে উঠল, “বেশ তো, আমিও জিজ্ঞেস করছি। “খেয়েছ টিফিন?”

“অনেকক্ষণ।”

“কী ছিল?”

পাউরুটি মাখন, ডিমসিদ্ধ, কলা, আঙুর…। পিয়ালী চোখ টিপল, “বংশের প্রদীপ জ্বালাব বলে হেব্বি তোয়াজ করছে শ্বশুর-শাশুড়ি।”

“পরোটা শেয়ার করবে?”

“দে দে। আমার এখন হাতির খিদে। ক’দিন আগেও কিছু মুখে তুললে বমি এসে যেত, এখন সারাক্ষণই পেট খাই খাই করছে।”

আঁচল যেন রক্ষা পেল। টিফিনের কণামাত্র ফেরত গেলে অনিমাদির যা মুখভার হয়! বারবার জানতে চাইবে, তার তরফে কোনও গলতি হয়েছে কিনা।

খাবারের অর্ধেক নয়, প্রায় তিন ভাগই পিয়ালীকে তুলে দিল আঁচল। নিজে একখানা পরোটা চিবোচ্ছে, তাও অতি কষ্টে। জিভে কোনও স্বাদ নেই, সুমিষ্ট সন্দেশও যেন মাটির ঢেলা। টেনশনের জন্য হচ্ছে এমন? নাকি…

“ওরকম খুঁটে খুঁটে খাচ্ছিস কেন রে?” পিয়ালী আলগা ঠেলল, “তোকেও আমার মতো টেম্পোরারি অরুচি রোগে ধরল নাকি?”

রসিকতাই করছে পিয়ালী, তবু জোর করেও হাসতে পারল না আঁচল। শিরদাঁড়া বেয়ে আবার সেই বিদ্যুতের শক টের পেল যেন। কোনও মতে বলল, “না, কই না তো। জাস্ট চোরা অম্বল মতো হয়েছে।”

“তাই বল। দেখিস বাবা, এক্ষুনি কিছু বাঁধিয়ে বসিস না। তোর তো আমার মতো সিচুয়েশন নয়, রানির হালে আছিস। এক-দু’টো বছর চুটিয়ে এনজয় করে নে।” গলা খাদে নামাল পিয়ালী, “বাট উইথ প্রোটেকশন।”

আঁচলের কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। রানির হাল… চুটিয়ে এনজয়… প্রোটেকশন… শব্দগুলো যেন নিষ্করুণ ব্যঙ্গের মতো শোনাচ্ছে। একটা সাজানো-গোছানো বাড়িতে শৌখিন আসবাব হয়ে বিরাজ করাটা কী বড় গৌরবের? জীবনকে উপভোগ মানে কি কাঁটা হয়ে থাকা রাত্রিভর? আর একটা ভদ্রসভ্য চেহারার বুনো জন্তুর হাত থেকে আত্মরক্ষার বর্মই বা সে পাবে কোত্থেকে?

তা এসব কথা কি উচ্চারণ করা যায়? আঁচল খালি টিফিনবক্স নিয়ে উঠে গেল বাথরুমে। একটু সময় নিয়েই ধুলো, যাতে চলে যায় পিয়ালী। বেরিয়ে আবার ফিরছে পরীক্ষার হলে। করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সুইচড অফ মোবাইল খুলল একবার। তিনখানা মিসড কল। একটা অলির, দুটো সুপর্ণার। অলির ফোনের কোনও সময় অসময় নেই। রাত এগারোটাতেও করে, ভোর পাঁচটায় হাঁক মারাও কিছু বিচিত্র নয়। কিন্তু সুপর্ণা কেন? এখন একটা ফোন করবে সুপর্ণাকে? নাকি ফাইনাল বেল পড়ার পর?

সামান্য দোনামোনা করে আঁচল আঙুল ছোঁয়াল মোবাইলে। ওপারে সুপর্ণা হইহই করে উঠেছে, “কী রে, ভরদুপুরে ঘাপটি মেরে আছিস কেন?”

“এগজ়াম হলে রয়েছি তো, তাই…”

“ও। সরি সরি।” পলকের জন্যে দমে গিয়েও সুপর্ণা ফের সরব, “হ্যাঁ, যা বলছিলাম। তুই এত আনসোশাল বনে গেলি যে বড়?”

ঈষৎ লঘু হওয়ার চেষ্টা করল আঁচল, “কেন রে? কী করলাম?”

“আরে বাবা, বিয়ে তো অনেকেই করে। তাই বলে বরপাগল হয়ে বন্ধুদের এমন ভুলে যায় ক’জন? একটা গ্যাদারিংয়েও তুই অ্যাটেন্ড করছিস না? তৃণা বলছিল ডাকলেই নানান অজুহাত দিচ্ছিস…”

“সত্যিই ব্যস্ত আছি রে। সামনের মাসে নেটে বসব, তার প্রিপারেশন চলছে…”

“ওই ঢপ অন্যকে দিস। একটা সন্ধে বন্ধুদের সঙ্গে কাটালে কী এমন সর্বনাশ হয় রে? বড়জোর খানিকক্ষণ বরের সঙ্গে কুজন কাকলি হবে না।” সুপর্ণা খরখর করে উঠল, “তোর বরের নাম্বারটা দে তো। কষে একদিন ঝাড়ি।”

আঁচল প্রমাদ গুনল। কী করে বলে, নির্বাণের ফোন নাম্বারটা পর্যন্ত তার কাছে নেই। অবশ্য থাকলেও সে থোড়াই দিত। ওই পাষণ্ডের সঙ্গে তার কোনও বন্ধু কথা বলছে, ভাবতেই যেন বিবমিষা জাগে।

সূক্ষ্মভাবে আঁচল এড়িয়ে গেল প্রসঙ্গটা, “তোর দরকারটা কী বল তো? ঝেড়ে কাশ।”

“তৃণা কি তোকে বলেছিল আমি হায়দরাবাদ চলে যাচ্ছি?”

“কই না তো। কবে?”

“জুনের ফার্স্ট উইকে। অয়ন একটা ফ্যাবুলাস ব্রেক পেয়েছে। কিন্তু ও আমাকে ছাড়া নড়বে না। সুতরাং তল্পিতল্পা গোটাতেই হচ্ছে।”

“তোর চাকরিটার কী হবে?”

“দেখি কী করি। বি এড আছে, মাস্টার ডিগ্রিটাও তো করেছি, ওখানেও একটা স্কুলটুলে কিছু জুটে যাবে নিশ্চয়।” একটু থেমে সুপর্ণা বলল, “হ্যাঁ যে কথা হচ্ছিল, আমার সঙ্গে কোনও চালাকি চলবে না। সামনের রোববার একটা গেটটুগেদার মতো করছি… স্কুলের ব্যাচের বন্ধুরা মিলে… সো… কাম ইউ মাস্ট। এক্সকিউজ দেওয়ারও স্কোপ নেই, কারণ ম্যারেড বন্ধুরা বর সহ আমন্ত্রিত। অতএব বুঝতেই পারছ, তাকেও বগলে করে আনবে।”

হায় রে, যে বন্ধুদের আঁচল প্রাণপণে এড়িয়ে এড়িয়ে চলছে, তাদের মাঝে যেতে বলবে নির্বাণকে? ভাবনাটা দূরতম কল্পনাতেও ঠাঁই দেওয়া সম্ভব নয়। আঁচল তবু শান্ত স্বরে বলল, “আচ্ছা সে হবেখন। ছাড়ি রে। রুম থেকে ডাকছে।”

“ওকে। আসিস কিন্তু। যুগলে। আমরা তোর আর তোর কিউট বরটার পথ চেয়ে থাকব।”

ফোনকে ফের ঘুম পাড়িয়ে দিল আঁচল। বিরক্তিতে জ্বলে যাচ্ছে সর্বাঙ্গ। এক অক্ষম ক্রোধ ডাঙশ মারছে মাথায়। পরীক্ষাহলের বাকি সময়টুকু আঁচল কীভাবে কাটাল সে বুঝি আঁচলও জানে না। উত্তরপত্রের ডাঁই জমা করল অফিসে। ওবেলা আজ ডিউটি নেই, তবে এক্ষুনি তো বেরোতেও পারবে না। হলফেরতা পরীক্ষার্থীরা থাকবে স্টেশনে, তারা তো এ কলেজের ছাত্রছাত্রী নয়, কে কী মন্তব্য ছুড়বে তার ঠিক আছে?

অগত্যা আবার স্টাফরুম। ঝুম হয়ে বসে থাকা। পাথরচাপা বুকে। পিয়ালী ক্ষণিকের জন্য ঢুকেও কোথায় যেন বেরিয়ে গেল, দেখে আঁচল স্বস্তি পেল একটু। কানের কাছে বকরবকর আজ একটুও ভাল লাগছে না। বাড়ি ফিরেই আজ শোবে একটু, তারপর খুলবে বইপত্র।

কিন্তু… কিন্তু… এমন একটা উদ্বেগ নিয়ে কি মন বসানো সম্ভব? নিশ্চিত হওয়ারই বা কী উপায়? ঋতুচক্রের হিসেব অনুযায়ী আট-ন’দিন আগেই তার পিরিয়ড হওয়া উচিত ছিল, এখনও তো কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আর ক’দিন সে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে? কলেজে পড়ার সময়ে একবার তিন চার মাস ডেটের গণ্ডগোল হয়েছিল। তখন একটা ওষুধ দিয়েছিল মা, ওটাই খেয়ে আবার স্বাভাবিক হয়েছিল সাইকল। সেটাই ট্রাই করে দেখবে নাকি? দূর ছাই, ওষুধের নামটাও তো মনে নেই। মাকে তো জিজ্ঞেস করা যাবে না, প্রশ্নে প্রশ্নে পাগল করে দেবে মা। অলি হয়তো নামটা জানতেও পারে, কিন্তু তাকে কিছু বলা মানেই তো গোটা দুনিয়ায় রাষ্ট্র হয়ে যাওয়া। যা পেট পাতলা মেয়ে! হয়তো নাচতে নাচতে নির্বাণকেই ফোন করে বসবে! আঁচলের জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদের সম্ভাবনা একটা সুসমাচারের আগাম বার্তা হয়ে ছড়িয়ে পড়বে, ভাবতেই তো গা ঘিনঘিন করছে আঁচলের। ওহ, কী জাঁতায় যে পড়ল আঁচল?

সরাসরি কোনও গাইনির কাছে গেলে কেমন হয়? একেবারে অজানা অচেনা? ওষুধটার নামও মিলবে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে নিলে উদ্বেগেরও অবসান? কিন্তু যার তার কাছে তো যাওয়া যায় না, পছন্দসই মহিলা গাইনিই বা সে পায় কোথায়? মৌলালির মোড়ের কাছে একটা বড় নার্সিংহোম আছে, ওখানেই যদি যায়…

দ্বিধা ঝেড়ে চেয়ার ছাড়ল আঁচল। আর সময় নষ্ট করার মানে হয় না, যা করার আজই করতে হবে। এক্ষুনি।

পিয়ালীর প্রতীক্ষায় না থেকে আঁচল বেরিয়ে পড়ল। দু’টো বাজে, জৈষ্ঠ্যের আগুনের তাপে ঝলসাচ্ছে পৃথিবী। একটা রিকশা নেই রাস্তায়। অগত্যা চরণই ভরসা। বাহারি ছাতায় বাগ মানছে না রোদ্দুর। স্টেশন কতটুকুই বা দূর, ওই পথটুকু পেরোতেই চামড়া যেন পুড়ে খাক।

তারই মধ্যে সদ্য জাগ্রত মোবাইলের টুংটাং। চলতে চলতেই দেখল, মনিটরে রথীনবাবু। একটু অবাক হয়ে ফোন কানে চাপল, “হ্যাঁ স্যার, বলুন…”

“তুমি একদম আসছ না কেন? সিনপসিস তো দেখা হয়ে গেছে। নিয়ে যাও।”

“যাব স্যার। নেট পরীক্ষা নিয়ে এখন একটু চাপে আছি।”

“তাই বুঝি। গুড, গুড। বসে যাও, সিরিয়াসলি দাও। যদি নেটের রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাও, নাথিং লাইফ ইট। নিশ্চিন্তে পাঁচ বছর ধরে কাজ করতে পারবে। …তোমার ব্যাপারটা অবশ্য আলাদা, তুমি হয়তো ইউনিভার্সিটি থেকেই কিছু একটা পেয়ে যাবে…”

রথীন মৈত্রের ইঙ্গিতটা মোটেই অস্পষ্ট নয়। রোদে তেতে থাকা আঁচলের কান দু’খানা যেন আরও তপ্ত হয়ে গেল পলকে। মাত্র দু’-তিন মাসেই দুনিয়াসুদ্ধু লোক, এমন কি রথীনবাবুরও মাথায় গেঁথে গেছে, আঁচল একজন যে কেউ নয়, মহামান্য বিদিশা চৌধুরীর পুত্রবধূ।

শেষের বাক্যটি যেন শুনতেই পায়নি, এমন ভাব করে আঁচল জিজ্ঞেস করল, “আমার টপিকের সামারি কেমন লাগল স্যার?”

“ভালই তো। বেশ ভাল। তবে নূরজাহানের প্রথম জীবন সম্পর্কে আরও ডিটেলে স্টাডি করতে হবে। কোনও অ্যাসাম্পশন নয়, হার্ড ফ্যাক্ট চাই। তবেই বিষয়টা দাঁড়াবে। …আমি কমেন্টস লিখে দিয়েছি, পড়ে নিয়ো।”

“থ্যাংক ইউ স্যর। …আমি তা হলে কবে যাব?”

“তেমন কিছু তাড়া নেই। মাথা ঠান্ডা করে পরীক্ষা দাও, তারপর এসো।”

ফোন রাখল আঁচল। স্টেশনও এসে গেছে। একটা ডাউন ট্রেন বেরিয়ে গেল এইমাত্র, রুমাল বার করে কপাল মুছতে মুছতে আঁচল শেডের নীচে এসে দাঁড়াল। এখানেও নিস্তার নেই, তাপ যেন মাটি ফুঁড়ে উঠছে। রুমাল রেখে জলের বোতলটা হাতে নিল, গলায় ঢালল ঢকঢক। তাও যেন মিটছে না তেষ্টা। এই তাপ মাথায় নিয়ে এখন শিয়ালদা গিয়ে টো টো করে ঘোরা, তাও কিনা একটা বিশ্রী ব্যাপারে…

আবার টুংটাং ধ্বনি। কে রে বাবা, একটু শান্তিমতো দাঁড়াতে দেবে না!

মনিটরে এবার অম্বরদা! এই সময়েই তার খাজুরা করার বাসনা জাগল?

গলা থেকে বিরক্তিটা পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলতে পারল না আঁচল, “কী ব্যাপার? হঠাৎ এখন?”

অম্বর যেন ঈষৎ বিব্রত, “তোমাকে ডিসটার্ব করলাম? তা হলে পরে কল করব।”

যাক, বুঝেছে তা হলে। একটু নরম হল আঁচল, “বলো কী বলবে? তুমি তো ভোটের সময় রানিগড়ে গিয়েছিলে? কবে ফিরলে?”

“যেদিন ভোটের রেজাল্ট বেরোল। বাস- ট্রেন সব ফাঁকা ফাঁকা ছিল… তুমি বোধহয় তার আগের দিনই…”

“হ্যাঁ। চলে এসেছিলাম। ভোট দিতে গিয়ে আর ক’দিন থাকব?”

“কী কাণ্ড বলো তো। তুমি গড়িয়ায় এলে, থাকলে, অথচ তোমার সঙ্গে দেখাই হল না।”

“আমার দুর্ভাগ্য। বাবার প্রিয় কবির সঙ্গ মিস করলাম। …তা ওখানে কী সব যেন খুঁজতে গিয়েছিলে? মিলল?”

“কিছু কিছু। অনেক খাতাপত্র মিসিং। …চৈত্রমাসে ঘরদোর সাফ হচ্ছিল, তখন হয়তো ফেলে দিয়েছে।”

“এটা তোমার দুর্ভাগ্য।”

“আরে দূর, কবিরা তো ইন-বর্ন কপালপোড়া।”

“হয়তো। তা আমাকে স্মরণ করলে কেন?”

“বিপদে পড়ে। আমাকে একটু হেল্প করবে?”

আঁচল জোর নাড়া খেল। তার মতো চরম বিপন্ন অন্যকে কী সাহায্য করবে? অস্ফুটে বলল, “কী ব্যাপারে?”

“আমি একটা অন্যায় করে ফেলেছি। একটা ম্যাগাজিন বার করছি আমরা। অতি নগণ্য প্রচেষ্টা। তা কী হয়েছে… বন্ধুদের কথা দিয়ে ফেলেছি পত্রিকার প্রচ্ছদ আঁকবেন দেবরাজ সিংহরায়।” অম্বর বুঝি একটু দম নিল, “তুমি কাইন্ডলি ওঁকে একটু বলে দেবে?”

“আমাকে উকিল ধরছ? বাবা তো এখন তোমার অচেনা নয় অম্বরদা। তুমিই তো স্বচ্ছন্দে অ্যাপ্রোচ করতে পারো।”

“কিন্তু… উনি যদি কিছু মাইন্ড করেন… হয়তো ভাববেন পরিচয়ের ফয়দা তুলছি…”

“বাবাকে কি তোমার ওইরকম মানুষ মনে হয়েছে? আর যাই হোক, আমার বাবা কিন্তু মোটেই মিন নয়।”

“যাহ, তাই কখনও ভাবতে পারি। ওঁর মতো খোলামনের লোক আজকাল মেলেই না।”

“একদম ঠিক। হি ইজ ডিফারেন্ট। স্ট্রেটকাট পার্সন। তুমি বলে দ্যাখো, বাবা এককথায় রাজি হবে।”

“তথাস্তু। …কিন্তু তোমার গলাটা আজ অন্যরকম শোনাচ্ছে কেন আঁচল? কীরকম শুকনো শুকনো লাগছে?”

“কই না তো। এত গরম… পরীক্ষার ডিউটি ছিল… খুব টায়ার্ড…”

“ও। সরি, সরি। আমার মনে হল… হয়তো তুমি… আচ্ছা ছাড়ছি।”

ফোন কাটতেই আঁচলের মনে হল একটু বুঝি শীতল হয়েছে প্রকৃতি। অম্বরদার সঙ্গে কথা বললে মনটা যেন হালকা হয় খানিকটা। কী যেন একটা জাদু আছে ওই পাগলা-পাগলা ছেলেটার। আঁচল তো সহজ সুরেই কথা বলছিল, তবু বুঝল কী করে সে আজ সমে নেই? কবির অন্তর্দৃষ্টি?

একটা গাড়ি ঢুকছে। ভাবনা ছেড়ে ট্রেনে উঠল আঁচল। লেডিজ কামরায় হালকা ভিড়, গেটের কাছেই দাঁড়িয়েছে। গুমোট বড় দুঃসহ, তারচেয়ে গরম হাওয়াও ভাল।

মাথার দপদপটা ফিরে আসছিল, আচমকা মগজে বিদ্যুতের ঝিলিক। আজকাল কী সব কিট বেরিয়েছে না? সব ওষুধের দোকানেই তো মেলে, কিনে নিয়ে গেলেই হয়। তা হলে নিজেই তো টেস্ট করে নিতে পারে আঁচল?

আশ্চর্য, অম্বরদার সঙ্গে কথা বলার পরেই মনে পড়ল? কাকতালীয়? নাকি মাথাটা ক্ষণিক স্থিত হয়েছিল বলেই উজ্জীবিত হল স্মৃতিকোষ?

সাড়ে পাঁচটা বাজে। গ্রীষ্মের ভোর সবে পা ফেলছে সকালে। বিদিশা চৌধুরীর প্রায় নির্জন বাড়িটা ঝিম মেরে পড়ে। শব্দহীন। ছায়ামলিন।

আঁচল উঠেছে। একটু বুঝি সন্ত্রস্ত। অন্দরের ভারী বাতাসে এখনও যেন শোকের আবহ। সোজা উঠে এল আঁচল। বসল বিছানায়। শ্বাস পড়ছে জোরে জোরে, যেন নিজের সঙ্গেই যুদ্ধ চলছে।

মাত্র কয়েক পল। বোঝাপড়ার পালা শেষ। ব্যাগ নিয়ে দৃঢ় পায়ে ঢুকল বাথরুমে।

মাত্র কয়েক মিনিট। খুলে গেল দরজা। বেরোচ্ছে আঁচল। স্খলিত চরণে। চোখের সামনে ভাসছে এক অমোঘ চিহ্ন। প্লেটে জ্বলজ্বল, একটা নয়, দু’-দুটো গোলাপি দাগ।

কাটা কলাগাছের মতো লুটিয়ে পড়ল আঁচল। বালিশে মুখ গুঁজেছে। আছাড়িপিছাড়ি খাচ্ছে। হা ঈশ্বর, সর্বনাশ তবে ঘটেই গেল!

পাঁচ মিনিট। দশ মিনিট। পনেরো মিনিট। ধীরে ধীরে উঠল আঁচল। আঁখির কোল থেকে মুছল অশ্রুর রেখা। কৃতকর্মের সাজা যদি থাকে, মুক্তির উপায়ও আছে নিশ্চয়ই! সে না দেবরাজ সিংহরায়ের মেয়ে! এত সহজে সে কেন ছেড়ে দেবে হাল?

আঁচলের চোখের মণিদুটো জ্বলছে। ক্রোধে নয়, নতুন সংকল্পে। ফের নামল শয্যা ছেড়ে, স্টাডি টেবিলে গিয়ে বসেছে। খুলল ল্যাপটপ।

ইন্টারনেট ঘাঁটছে আঁচল। নিবিষ্ট মনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *