এই মোহ মায়া
১
বেজার মুখে ট্যাক্সির ভাড়া মেটাচ্ছিল দেবরাজ। উফ, শহরটা সেই একইরকম যাচ্ছেতাই রয়ে গেছে। সেই ভাঙাচোরা রাস্তা, ধোঁয়া ধুলো ভিড় জ্যাম মিছিল…। উঁহু, এবার মিছিল পড়েনি পথে। তবুও হাওড়া স্টেশন থেকে লেক গার্ডেন্স পৌঁছতে পাক্কা দেড় ঘণ্টা লেগে গেল!
গোটা যাত্রাটাই এবার ভারী বিশ্রী হল দেবরাজের। শুরু থেকেই ভোগান্তি। কাল তো নিউ দিল্লি স্টেশনে রীতিমতো হইহই রইরই। প্ল্যাটফর্ম একেবারে পুলিশ মিলিটারিতে ছয়লাপ। কী, না রাজধানী এক্সপ্রেসে নাকি বোমা রাখা আছে! ব্যস, ঠেলা বোঝো। দিনকাল যা পড়েছে, এখন এমন একটা গুজব রটলে তো সাড়ে সর্বনাশ। কুকুর ঘুরছে কামরায় কামরায়, বোমা ডিটেক্টর নিয়ে ছোটাছুটি করছে জলপাইরং উর্দি, মাথায় কালো ফেট্টিধারীরা শ্যেন চোখে জরিপ করছে প্রতিটি লাগেজ…। মিলল তো ঘেঁচু, লাভের মধ্যে ট্রেন ছাড়ল আড়াই ঘণ্টা লেটে। তাও আশা ছিল, রাতে হয়তো খানিক তেড়েফুঁড়ে ছুটে দেরিটা পুষিয়ে দেবে। কোথায় কী, সাড়ে দশটার ট্রেন প্রায় একটা বাজিয়ে ইন করল হাওড়ায়। কপাল মন্দ হলে যা হয়, এর সঙ্গে রাত্রিভর প্রায় জাগরণ। সামনের বার্থের সর্দারজি অবিরাম স্যাক্সোফোন বাজিয়ে গেল নাকে। কোনও মানে হয়? তাড়া না থাকলে পারতপক্ষে দেশের মধ্যে আকাশপথে পাড়ি জমায় না দেবরাজ। বড্ড যান্ত্রিক লাগে উড়ান সফর। তুলনায় ট্রেনে সে অনেক স্বচ্ছন্দ। ইচ্ছেমতো চলাফেরা করো, বসো, নয়তো গড়াগড়ি খাও… এবার বুঝি খ্যাপামিটা গোক্ষুরি হয়ে গেছে। ফ্লাইট ধরলেই বোধহয় ভাল হত।
ফুটপাথ ঘেঁষে চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ি। পাঁচিল ঘেরা। মাধবীলতা আর বোগোনভিলিয়ার জড়ামড়ি কালো লোহার ফটকের মাথায়। দেওয়ালে সাদা ফলকে বাড়ির নাম। মঞ্জিল।
সূর্য পশ্চিমে হেলে গেছে। কলকাতার আকাশ আজ পুরোপুরি নির্মেঘ। অঘ্রান প্রায় ফুরিয়ে এল, এখনও এ শহরে শীতের পাত্তা নেই। বাতাস বইছে মৃদু মৃদু। তাতেও তেমন হিমের ছোঁয়া কোথায়!
ভারী কিটসব্যাগ কাঁধে দেবরাজ শব্দ করে গেট ঠেলল। নীচে পুরোটাই গ্যারেজ। এখন ফাঁকা। শুধু একটা ধুলোমাখা শ্যাওলাসবুজ অ্যাম্বাসাডার দাঁড়িয়ে আছে একা। গাড়িটা গতবারও ঠিক ওই জায়গাতেই ছিল না? ওই দশায়? সম্ভবত। এই শহরে সবই তো স্থবির।
শুনসান চাতাল থেকে দেবরাজ হেঁকে উঠল, “দিলীপ…অ্যাই দিলীপ?”
পিছন দিকের ঘর থেকে তরতরিয়ে বেরিয়ে এসেছে এক যুবক। বছর তিরিশ বয়স, রোগাসোগা বেঁটেখাটো, পরনে জিনসের ঢোলা হাফপ্যান্ট আর টিশার্ট, মুখে একটা চোয়াড়ে চোয়াড়ে ভাব। ব্যস্ত স্বরে বলল, “এসে গেছেন স্যার? এত দেরি হল যে?”
খাজুরা প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মুড নেই দেবরাজের। ব্যাগখানা ধরিয়ে দিল দিলীপের হাতে, “খবর পেয়েছিলি তো ঠিক সময়ে?”
“হ্যাঁ স্যার। অসীমবাবু গেল রোববার বলে গেছেন।”
“তা আমার ঘরদোরের কী হাল?”
“ঝকঝক করছে স্যার। সুনীতা হর হপ্তা ঝাড়ু লাগায়, মোছে…।” বলতে বলতে সিঁড়ি অভিমুখে এগোচ্ছে দিলীপ, “শুধু পাখাগুলোই যা নোংরা ছিল। কাল ঘড়াঞ্চি নিয়ে গিয়ে ঘষে ঘষে রং ফেরালাম। ফ্রিজ চালু করে দিয়েছি সকাল থেকে। গ্যাস-ট্যাস সব ঝেড়েমুছে…। কেব্লও চলছে, দেখে নিয়েছি। দুখিয়ার মাকে দিয়ে বাথরুমও সাফা করালাম…”
কাজের ফিরিস্তি দিয়েই চলেছে ছোকরা। প্রাপ্তিযোগ যদি একটু বাড়ে, এই আশায়? দেবরাজ মনে মনে হাসল। ছেলেটা বেশ ছোঁক ছোঁক টাইপ। ফ্ল্যাট দেখভালের জন্য বরাদ্দ টাকা তো পায়ই, সঙ্গে উপরিও জোটে মাস মাস। টেলিফোন, ইলেকট্র্রিসিটি, কর্পোরেশন, কমন মেনটেনেন্স, কেব্লের ভাড়া ইত্যাদি বাবদ দেবরাজ থোক যা পাঠায়, সেখান থেকেও কি দু’-চারশো বাঁচে না? এ ছাড়া মাঝেমধ্যে বাড়তিও মিলছে। এই তো, জুলাইয়ে নাটকের শো করতে পুনম এসেছিল কলকাতায়, ছিল দিন দশেক, তখনও ভালই বাগিয়েছে ছোকরা। নিজের নতুন শার্টপ্যান্ট, বউয়ের শাড়ি, বাচ্চার খেলনা এবং নগদ হাজার বকশিশ। আগে মঞ্জিলের কেয়ারটেকার ছিল ছেলেটার বাপ, ফ্ল্যাট দেখাশোনার কাজটা সে যথেষ্ট যত্ন নিয়ে করত। তবে তার খাঁই ছিল কম। পঞ্চাশ একশোতেই গলে জল। যাক গে, কী আর করা, দিনকাল বদলাচ্ছে।
সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে দেবরাজ আলগা প্রশ্ন করল, “সুবল এখন আছে কেমন?”
“বাতের বেদনায় কাহিল খুব। লেংচে লেংচে হাঁটে।”
“দেশেই রয়েছে তো? সেই ঘাটালে?”
“হ্যাঁ স্যার। ভাইয়ের কাছে। যতটুকু পারে, চাষবাস দেখে। এবারও ভাদ্রের শেষে শিলাইতে বন্যা হল, তখন চলে এসেছিল। পুজোটা কাটিয়ে গেল।”
“হুম।”
“দিল্লিতে সব ভাল তো স্যার?”
“চলছে।”
“ম্যাডাম?”
“আছে একরকম।”
“এবার স্যার থাকছেন তো ক’দিন?”
“দেখি।”
“অনেকদিন পর এলেন কিন্তু।”
“হুঁ। প্রায় সাড়ে তিন বছর।”
বলতে গিয়ে হঠাৎই একটা ছোট্ট শ্বাস পড়ল দেবরাজের। কেন যে পড়ল? কলকাতার ওপর তার তো আর তেমন কোনও মায়া নেই, বরং সে এখন একরকম অপছন্দই করে শহরটাকে। কিংবা তার চেয়েও বেশি কিছু। কী দিয়েছে তাকে এই শহর? শুধু কাঁড়িখানেক অস্বস্তিকর স্মৃতি ছাড়া?
দেবরাজের ফ্ল্যাট তিনতলায়। ছোট। তার লক্ষ্মীনগরের অ্যাপার্টমেন্টের অর্ধেকও হবে কিনা সন্দেহ। তবে মোটামুটি খোলামেলা। উত্তরে তো অনেকটাই ফাঁকা। ফালি ব্যালকনিতে দাঁড়ালে, লাইনের ওপারে, লেকের সবুজ দেখা যায়। ঘর মাত্র দু’খানা। একটা রীতিমতো পুঁচকে, অন্যটা মাঝারি। তুলনায় ড্রয়িং ডাইনিং স্পেসটা যা একটু পদের। বলা যায়, সেটাই এ ফ্ল্যাটের বড় ঘর।
অন্দরে ঢুকে জুতো-টুতো ছাড়ল না দেবরাজ। সটান এলিয়ে পড়েছে সোফায়। শরীর আর বইছে না, চোখদুটো টানছে, সর্দারজির স্যাক্সোফোন যেন বাজছে মাথায়।
দিলীপ ঘরে ব্যাগ রেখে এল, “কিছু খাবেন তো স্যার?”
“সে আর বলতে। পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে।” দেবরাজ একখানা জাম্বো সাইজের হাই তুলে সিধে হল। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলল, “কী পাবি এখন?”
“যা চাইবেন। রুটি তড়কা, মাংস, চাইনিজ…। কাছেই একটা নতুন দোকান খুলেছে। দারুণ কাবাব বানায়। খুব বিক্রি।”
“ফ্রেশ হবে তো?”
“খেয়েই দেখুন।”
কলকাতার এই একটাই তো প্লাস পয়েন্ট। যেখানেই যাও, যখন চাও, টুসকি বাজালেই কোনও না কোনও সুখাদ্য জুটবে। ফুটপাথে তো দু’হাত অন্তর অন্তর ভোজনের পশরা। সত্যি বলতে কী, লকলকে জিভ আর সর্বগ্রাসী পাকস্থলী ছাড়া এ শহরের আর কিস্যু নেই।
এক সময়ে মধ্যরাতে এই শহর টহল দিতে বেরোত দেবরাজরা। কত ছপ্পরে কত কী যে মিলত তখন। কষকষে শুয়োরের মাংস, খুনে রং ঘুগনি, কালচে লাল বিফকষা, চাঁদি ফাটানো আলুর দম, তেল চুপচুপে চাঁপ…। ম্যাঙ্গো লেনের কাছে, গলির গলি তস্য গলিতে, খোদ ক্যান্টনিজ স্বাদের খানা বানাত এক চিনে দম্পতি। ইশারা মাত্র বোতলও এসে যেত টপাটপ। ওয়াংয়ের সেই ব্যবসা নাকি উঠে গেছে, গতবারই কে যেন বলছিল। তালতলার সেই গলতায় এখনও কি সেই বড়া গোস্তের কাবাব মেলে?
ঈষৎ স্মৃতিমেদুর দেবরাজ পার্স খুলে একটা পাঁচশো টাকার নোট বার করল। হেসে বলল, “কাবাব পরোটাই হোক তা হলে। আর শোন, আরও কয়েকটা জিনিস লাগবে। মনে করে আনতে পারবি তো?”
“লিস্ট আমার মুখস্থ আছে স্যার। চা চিনি কফি দুধ, ডিম পাউরুটি, মাখন বিস্কুট…”
“বাহ, বেড়ে ওস্তাদ বনে গেছিস তো!”
লাজুক মুখে প্রশংসাটা গায়ে মেখে নিল দিলীপ। ঘাড় চুলকোচ্ছে।
“হবে কি ওই টাকায়?” দেবরাজ আরও কয়েকটা একশো টাকার নোট বার করল, “দু’প্যাকেট সিগারেটও আনিস। খাওয়ার জলের কী ব্যবস্থা?”
“ফিলটার চলছে। চারখানা বোতল ধুয়ে ভরে রেখেছি। যদি চান তো মিনারেল ওয়াটার…”
“হ্যাঁ। একটা বড় জার এনে রাখ। জলটুকু অন্তত সামলেসুমলে খাই।”
দিলীপ মাথা নেড়ে চলে যাচ্ছিল, কী ভেবে দাঁড়াল। উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এখন একটু চা চলবে স্যার? সুনীতা বানিয়ে দেবে। ম্যাডাম ওর হাতের চায়ের খুব তারিফ করতেন।”
প্রস্তাবটা মন্দ নয়। মগজের জং ধরা ভাব ছাড়ে একটু। কিন্তু পুনমের পছন্দসই চা মানে তো স্রেফ গরম সরবত। ওই একটিমাত্র পানীয়ের ব্যাপারে দেবরাজ বেজায় খুঁতখুঁতে। যথাযথ ফ্লেভার চাই, নিখুঁত লিকার, চিনি মেপে সিকি চামচ…। নির্দেশ দিলেও পারবে কি দিলীপের বউ?
দেবরাজ মাথা ঝাঁকাল, “ছেড়ে দে। খানাটাই জলদি জলদি আন।”
“যাব আর আসব। দশ মিনিট।”
এবার আয়েশ করে সিগারেট। একটাই ছিল, ধরাল দেবরাজ। আশেপাশে অ্যাশট্রে নেই, উঠতে ইচ্ছে করছে না, ফাঁকা প্যাকেটেই ছাই ঝাড়ছে। অনেকক্ষণ পর সুখটান, মস্তিষ্কে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকছে ধোঁয়া, বেশ লাগছে। নিমীলিত চোখে ভাবার চেষ্টা করল এই মুহূর্তে কাকে কাকে তার পৌঁছ-সংবাদটা জানানো প্রয়োজন। অসীমকে? এই বেখাপ্পা সময়ে সে কি আছে বাড়িতে? ব্যাটার তো মোবাইলও নেই। মোবাইল ফোন না রাখাটা নাকি অসীমের নীতির প্রশ্ন। বলে, ওই যন্ত্র নাকি শব্দদূষণের পকেট সংস্করণ। অসীমকে যদি সত্যি কারও দরকার থাকে, তো বাড়িতে খুঁজবে, নয় প্রতীক্ষায় থাকবে, যত্রতত্র খিচখিচ করবে কেন! অসীমটা ভিজিটিং কার্ডের ওপরেও হাড়ে হাড়ে চটা। নিজের পরিচিতি নিজে বহন করার পিছনে নাকি অস্তিত্বের সংকট লুকিয়ে থাকে। পাগল একেবারে। এই সব ভাবনা-টাবনা আজকাল আর চলে নাকি? চিরন্তনকে একটা টেলিফোন করা উচিত। আট বছর আগে কলকাতায় শেষ সোলো এগ্জিবিশনের সময়ে মোনালিসা আর্ট গ্যালারির সঙ্গে সম্পর্কটা শীতল হয়ে গিয়েছিল দেবরাজের। মোটেই ভাল পাবলিসিটি করেনি, ছবির দাম নিয়েও দেবরাজের সঙ্গে আঁশটে খেলা খেলেছিল মধু বিরানি। দেবরাজ তো খেপে-মেপে কলকাতায় আর প্রদর্শনী করবেই না ঠিক করেছিল। চিরন্তনই ফের জুড়ে দিল সুতোটা। চিরন্তনের মাধ্যমেই রূপরেখা গ্যালারির সঙ্গে প্রাথমিক কথাবার্তা। এদের চুক্তি মোটামুটি সম্মানজনক। চার বছর অন্তর দেবরাজের প্রদর্শনী ফেলবে এবং কখনওই দেবরাজের অনুমতি বিনা ছবির দাম আন্ডারকাট করবে না। কমিশন অবশ্য একই নেবে। আড়াই টাকায় এক টাকা। তা নিক, আবার শুরু তো হোক। চিরন্তন যোগাযোগটা করিয়েছে, একটা ধন্যবাদ নিশ্চয়ই ওর প্রাপ্য।
অন্যমনস্কভাবে পকেট থেকে ক’দিন আগে কেনা ফোনটা বার করল দেবরাজ। বোতাম টিপতে গিয়েও কী ভেবে রেখে দিল টেবিলে। ল্যান্ডলাইন তো পড়েই আছে, ভাড়াও গুনছে নিয়মিত, ক’টা দিন তো ব্যবহার হোক।
আলস্য ঝেড়ে, সাইডটেবিলে রাখা হ্যান্ডসেটটা তুলে দেবরাজ টানটান হল সোফায়। মোবাইল থেকে নম্বর খুঁজছে চিরন্তনের।
হঠাৎই পরিকল্পনায় বদল। উঁহু, চিরন্তন নয়, আগে রূপরেখা।
নম্বর লাগতেই ওপারে সুরেলা বামাকণ্ঠ, “নমস্কার। আপনি রূপরেখায় পৌঁছেছেন।”
অভ্যর্থনার কায়দা আছে তো! কণ্ঠটিও ভারী মধুর। দেবরাজও সুর আনল গলায়, “আমি কি মিসেস আগরওয়ালকে পেতে পারি?”
“অবশ্যই। আপনার পরিচয়টা…”
“অধমের নাম দেবরাজ সিংহরায়। একটু-আধটু ছবি আঁকি।”
“ও…। আপনি…। ধরুন ধরুন, ম্যামকে দিচ্ছি।”
সুভাষিণী কি ডাকতে ছুটল মালকিনকে? কেমন দেখতে মেয়েটি? স্বর শুনে সুরত আন্দাজ করলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বেকুব বনতে হয়। তবু খেলাটায় মজা আছে। ক্বচিৎ কখনও লেগে গেল, তো জ্যাকপট। মেয়েটার মুখের আদল মনে হয় কাঁঠালপাতার মতো। ভরাট, কিন্তু সামান্য লম্বাটে। ঠোঁট অবশ্যই পাতলা পাতলা। চোখ বড়ই হবে, পাতাগুলোও ঘন। থুতনিতে একটা তিল থাকলেও থাকতে পারে। উঁহু, থুতনিতে নয়, গলায়। কণ্ঠার কাছে। কপাল একটু চওড়া কি? ফিগার নিশ্চয়ই ছিপছিপে। যাকে বলে বেতসলতার মতো দেহকাণ্ড।
কল্পনায় ছেদ পড়ল। ও প্রান্তে এবার হাস্কি ভয়েস, “নমস্কার দেবরাজবাবু। ওয়েলকাম টু কলকাতা। সুসোয়াগতম।”
“থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ।”
“কখন এলেন?”
“এই তো…। এসেই বান্দা হাজিরা দিচ্ছে।”
“বাঁদী ভি আপকে লিয়ে হাজির।”
“আপনার অ্যারেঞ্জমেন্ট কদ্দূর?”
“অলমোস্ট কমপ্লিট। প্রেস ইনভিটেশন ওভার, ক্যাটালগ রেডি, অল ল্যুমিনারি কালেক্টরস হ্যাভ বিন ইনফর্মড। …খুশি কি বাত, কাল সঞ্জয় গানোরিওয়াল ভি আসতে পারেন। লেটস হোপ টুমরোজ প্রিভিউ উইল বি আ গ্র্যান্ড সাকসেস।”
সঞ্জয় গানোরিওয়াল কলকাতার বিখ্যাত শিল্পপতি। নামী চিত্রসংগ্রাহকও বটে। দেবরাজ মনে মনে সন্তুষ্ট হল। মুখে অবশ্য জানান দিল না। আলগোছে বলল,“হরিপ্রসাদদা আসছেন তো?”
“কাল উনি কেন? হি উইল বি অন দি ওপেনিং ডে। আপনার কথা মতো হরিদাকে স্পেশাল ইনভিটেশন জানিয়েছি। কার্ডও বানিয়েছি সেই ভাবে।”
প্রিভিউতে অবশ্য শিল্পসংগ্রাহকদের ডাকাই রেওয়াজ। দিল্লিতেও। ঝপাঝপ লাল টিপ পড়ে যায় ছবিতে। হরিপ্রসাদ দাশগুপ্ত ওপেনিংয়ের দিন এলেই বরং প্রচারটা জমকালো হবে। দেবরাজ তো আলাদাভাবে হরিদাকে অনুরোধ করেছেই। মাস্টারমশাই আসবেনও নির্ঘাত।
তৃপ্ত মেজাজে দেবরাজ বলল, “এখানকার আর্টিস্টদেরও ডেকেছেন নিশ্চয়ই? শরণদা, মন্মথ, অরিন্দম, কেশব…?”
“পুরো লিস্ট বানিয়ে কার্ড ছেড়েছি দাদা। আপনার কনটেম্পোরারিরা কেউ বাদ পড়েনি।”
“কেমন রেসপন্স আশা করছেন?”
“জানেনই তো, ছবির বাজার এখন একটু ডাউন। তবু সে তুলনায় ভালই হবে মনে হয়। এত বছর পর কলকাতায় আপনার এগ্জিবিশন হচ্ছে, সো দেয়ার ইজ লট অফ কিউরিয়োসিটি।”
“বলছেন?”দেবরাজের স্বরে ঈষৎ সংশয়।
“হ্যাঁ দাদা। তা আপনি গ্যালারিতে আসছেন কখন?”
“যখনই হুকুম করবেন।” দেবরাজ গলাটা তরল করল, “আফটার অল, আপনি এখন আমার অন্নদাতা। আই মিন, অন্নদাত্রী।”
“কেন লজ্জা দিচ্ছেন দাদা? আপনারা আছেন বলেই না আমাদের দু’মুঠো জুটছে।” পেশাদারি বিনয়ে মম্তাও কম দড় নয়, “কাইন্ডলি ডিসপ্লে দেখে যান। যদি আপনার কিছু সাজেশন থাকে…”
“বড্ড থকে গেছি। একটু রেস্ট নিয়ে নিই?”
“অ্যাজ ইউ প্লিজ। ন’টা পর্যন্ত আমি গ্যালারিতে থাকব। আপহি কি ইন্তেজারমে।”
কোনও নারী তার প্রতীক্ষায় আছে, শুনলে এখনও দেহমন চনমন করে ওঠে দেবরাজের। এই ছাপান্ন বছর বয়সেও। হোক না সেই প্রতীক্ষা নেহাতই কেজো এবং সেই নারী রূপরেখা আর্ট গ্যালারির আধবুড়ি মম্তা আগরওয়াল। কত বয়স হবে মম্তার? পঞ্চাশের ওপরে তো বটেই। চেহারায় কিন্তু এখনও পালিশটা রেখেছে। ত্বক শিথিল হয়ে গেলেও মোমে মাজা, থ্রেডিংয়ের কেরামতিতে ভুরু নিখুঁত, ঠোঁট ওষ্ঠরঞ্জনীতে জ্বলজ্বল, চোখের পাতায় বর্ণিল ছায়া। হাঁসের মতো মাল টানে মম্তা, দিল্লিতে দেখেছে দেবরাজ। এই কিসিমের মহিলারা তাকে আর আকৃষ্ট করে না, তবে এদের আহ্বান শুনতে বেশ লাগে।
শিস দিতে দিতে মোবাইলের ফোনবুকটা ঘাঁটল দেবরাজ। ধুস, অসীম, চিরন্তন আর রূপরেখা গ্যালারি ছাড়া কলকাতার আর একটি নম্বরও নেই। গত সপ্তাহে ত্রিবেণী কলাসঙ্গমে আশিস পারেখের এগ্জিবিশন ছিল, সেখানে গল্পে আড্ডায় ফেলে এসেছিল মোবাইলখানা, ব্যস চোট। ওমনি চেনাজানা নম্বরগুলোও বেবাক উধাও। ভাগ্যিস পুনমের কাছে অসীমের নাম্বারটা ছিল, তারই দৌলতে কলকাতার সঙ্গে আবার স্থাপিত হল যোগাযোগ। কেন যে অসীমের কাছ থেকে সব ক’টা নম্বরই নিয়ে রাখেনি! জীবনে কোনও কিছুই কি ঠিকঠাক গুছিয়ে করতে পারবে না দেবরাজ? এদিকে ছটফটানিও তো বাড়ছে। এতদিন পর পা রাখল কলকাতায়, জানাতে কি তর সয়? এবার একটা বড়সড় হল্লাগুল্লা হওয়া দরকার। দেদার পয়সা ওড়াবে, মদের ফোয়ারা ছোটাবে, প্রমত্ত উল্লাসে মাতবে, তবেই না কলকাতায় আসা সার্থক। একদিন এই শহর ছেড়ে সে পরাজিতের বেশে চলে গিয়েছিল। খোলামকুচির মতো পয়সা ছড়িয়ে যতটা শোধ তোলা যায় আর কী! দেখুক সবাই, দেবরাজ সিংহরায় আর নগণ্য গ্রহ নেই, সে এখন রইস নক্ষত্র।
কিন্তু কাকে কীভাবে ধরবে? অসীমকে রিং করা বেকার, এক চিরন্তনই ভরসা। পুট পুট নাম্বারটা টিপল দেবরাজ। যাহ বাবা, সুইচড অফ। আর্ট কলেজে পড়ায় তো, সম্ভবত ক্লাস-টাস নিচ্ছে। কোনও মানে হয়?
চলভাষ রেখে দেবরাজ উদাস বসে রইল একটুক্ষণ। চোখ দেওয়ালে টাঙানো নিজেরই এক পুরনো পেন্টিংয়ে। এক অর্ধশায়িতা নগ্ন নারী। বড় ক্যানভাসের ছবি, তেলরঙে আঁকা। একেবারে প্রথম জীবনের। সেই যখন কলেজ থেকে বেরিয়ে অন্ধের মতো নিজের পথ হাতড়াচ্ছে। ছবিটায় বড় বেশি মাতিস মাতিস গন্ধ। রং নিয়ে শিশুর মতো খেলা করার চেষ্টা। বেঢপ মোটা মোটা পা এঁকে দেওয়াল মেঝের সঙ্গে মেলানোর প্রয়াস। অ্যাকাডেমিতে প্রদর্শিত হয়েছিল ছবিটা। পিঠও চাপড়েছিল কেউ কেউ। কিন্তু ক্রেতা জোটেনি।
নগ্নিকার ঘন পিঙ্গল আঁখিতে চোখ রেখে দেবরাজ আবার একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলল। এই ছবির সঙ্গে তার এখনকার আঁকাজোকার কী আকাশ পাতাল তফাত। হবেই তো। মাঝে কম ভাঙাগড়া গেল। জীবন এক পাহাড়ি নদী, মাটি পাথর ভেঙে ভেঙে সে নিজের রাস্তা করে নেয়। কখনও ছোটে লাফাতে লাফাতে, কখনও বিপজ্জনকভাবে আছড়ে পড়ে, কখনও বা তিরতির বয়। ছবি তো ওই নদীরই নীচের নুড়িপাথর, বহতা ধারার ঘর্ষণে যার রূপ বদলায় অবিরাম।
এ সবই তো জানে দেবরাজ, বোঝে, তবু কেন যে আজকাল এমন শ্বাস পড়ে হঠাৎ হঠাৎ? সে কি বুড়িয়ে যাচ্ছে? কেন যে মাঝে মাঝে পাঁজর থেকে ঠেলে ওঠা এক অসহ্য চাপ তাকে জাগিয়ে রাখে রাতভর? মনে হয়, কিছুই যেন করা হল না, অথচ ঘণ্টা বাজছে দিনশেষের।
ধুস, যত সব মরবিড চিন্তা। দেবরাজ তো এখন মোটামুটি সফল চিত্রকর। দেশে তো বটেই, বিদেশে প্রদর্শনী হয় তার ছবির। এবং দিব্যি বিকোয়। ছাপ্পান্ন বছর বয়সেও সে যথেষ্ট তরতাজা, অসুরের মতো খাটতে পারে। অতৃপ্তি তাকে মানায় কি? কিংবা মৃত্যুভয়?
দেবরাজ উঠে গিয়ে টিভিটা চালিয়ে দিল। নতুন। এল সি ডি। ছাব্বিশ ইঞ্চি। পুনমই কিনে দিয়ে গেছে, কেব্ল কানেকশনের বন্দোবস্ত সমেত। আগে একটা পুরনো পড়েছিল, ভাল ছবি আসত না, সেটি দাতব্য করেছে দিলীপকে। এটার ছবি বেশ ঝকঝকে। পুনমটা টিভির পোকা। দু’দণ্ড ঘরে থাকলে খুলে বসবেই। এদিকে হাই ফান্ডার নাটক করছে, ওদিকে কী যে ছাইপাঁশ সিরিয়াল দেখার নেশা। দেবরাজের পক্ষে অবশ্য ভালই হয়েছে, ফ্ল্যাটে থাকার সময়টুকু এবার সে বোর হবে না। মাসে ক’টা তো টাকার ব্যাপার, ওইটুকু অপচয় হলেই বা কী।
রিমোট হাতে ফের সোফায় আধশোওয়া হল দেবরাজ। ঘুরছে এ চ্যানেল, ও চ্যানেল। যত সব হাবিজাবি প্রোগ্রাম। ডিসকভারিতেও কী সব গাড়ির কলকবজা দেখাচ্ছে, টি এল সিতে রান্না। একটা বাংলা চ্যানেলে এসে আঙুল থামল দেবরাজের। খবর চলছে। সঙ্গে টুকরো টুকরো ক্লিপিংসে গণ্ডগোলের দৃশ্য। পেল্লাই এক শিল্পতালুক গড়ার পরিকল্পনা গড়া হয়েছে এ-রাজ্যে, তাই নিয়ে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে বিক্ষোভ দানা বেঁধেছে। দিল্লিতেও সমাচারটা দেখেছে দেবরাজ। জমি অধিগ্রহণ নিয়ে এখানে এখন ঘোরালো পরিস্থিতি। ক’দিন আগে এক শিল্পপতির কারখানা গড়া নিয়ে জোর এক প্রস্থ হয়ে গেছে, এখনও নাকি অশান্তিটা থামেনি। আজও কোথায় কোন মিছিলে নাকি লাঠি চালিয়েছে পুলিশ। কী যে ছাই হচ্ছে? সাধে কি দিল্লিতে সবাই ওয়েস্টবেঙ্গল নিয়ে হাসাহাসি করে!
ধুস, ভাল লাগছে না। টিভি অফ করে ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মতো সটান হল দেবরাজের ছ’ফুট এক ইঞ্চি দেহটা। এখন কষে একটা স্নান দরকার।
ঘরে গিয়ে ব্যাগের জিপার খুলে বার করল পাজামা পাঞ্জাবি তোয়ালে সাবান। তারপর শিস দিতে দিতে বাথরুম। উদোম দাঁড়িয়েছে শাওয়ারের তলায়, রোমকূপে শুষে নিচ্ছে জলকণা। দিল্লিতে এখন ঠান্ডা জল গায়ে ঢালাই যায় না, এখানকার ঝরনাধারায় কী নরম আমেজ। নাহ, এই শহরের সবটাই মন্দ নয়।
স্নানবিলাস সাঙ্গ হতেই ফের সেই চনচন অনুভূতি খিদের। ওফ, দিলীপটা এখনও ফেরে না কেন?
খানিক অসহিষ্ণু পায়ে দেবরাজ ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। শেষ হেমন্তের দুপুর গড়াচ্ছে বিকেলের দিকে। উঁচু বাড়ির মাথায় সূর্যমুখী হলুদ। পিচরাস্তায় পাতলা বাদামি ছায়া। একদল কিশোর ক্রিকেট খেলছে সামনের পার্কটায়। কমলা-সাদা সালোয়ার কামিজ এক তরুণী হেঁটে যাচ্ছে আপন মনে। কানে মোবাইল। চলতে চলতে দাঁড়াল ক্ষণেক। তাকাল এদিক ওদিক। আবার শুরু হয়েছে চলা।
মেয়েটার হাঁটার ছন্দের সঙ্গে কার যেন খুব মিল?
ভাবতে গিয়ে হৃৎপিণ্ড ছলাৎ। আঁচল। আশ্চর্য, প্রায় তিন ঘণ্টা হল সে পা রেখেছে কলকাতায়, এতক্ষণে কিনা আঁচলকে মনে পড়ল?
দেবরাজ দৌড়ে গিয়ে টেলিফোন তুলল। বোতাম টিপছে। প্রায় অভ্যাসের মতো। এই একটা মাত্র নম্বর দেবরাজকে ভাবতে হয় না। সংখ্যাগুলো তার মস্তিষ্কে গেঁথে থাকে যে।
২
খেতে বসেও মানসী আড়চোখে লক্ষ করছিল বড়মেয়েকে। এখনও ভারী দূরমনা হয়ে আছে মেয়ে। হাতে একখানা গল্পের বই, তবে পড়ছে না, দৃষ্টিই শুধু নিমগ্ন অক্ষরে। পড়লে কি চোখের মণি অমন স্থির থাকে?
দিদির উলটো দিকের চেয়ারে অলি। বরাবরই সে বকে বেশি, এখন কলেজে ওঠার পর মুখ যেন তার লাগামছাড়া। প্রতিটি দিন তার কাছে রোমাঞ্চকর, রাত্তিরের এই খাওয়ার টেবিল তার সারাদিনের অভিজ্ঞতা উজাড় করে দেওয়ার জায়গা। প্রসঙ্গের কোনও ঠিকঠিকানা থাকে না অলির। এই এক কথা বলছে, এই অন্য কিছু। এক এক সময়ে তো মাথা ঝিমঝিম করে মানসীর।
আজ অলি শোনাচ্ছিল পথে হঠাৎ মোবাইলের চার্জ ফুরিয়ে যাওয়ার উপাখ্যান। কাকে যেন কল করার ভয়ংকর দরকার ছিল, পারছিল না…। আচমকা মাঝপথে প্রসঙ্গ ঘুরে গেল, “জানো বাপি, আজ কলেজে না একটা সাংঘাতিক মজার কাণ্ড হয়েছে।”
শান্তনু ভাতে খোদলা করে ডাল ঢালছিল। সকালে ন’টার মধ্যে জলখাবার খেয়ে কারখানায় বেরিয়ে যায়, রাত্তিরটাই তার আয়েশ করে অন্নগ্রহণের সময়। এবং বাড়ির সবার সঙ্গে খানিক হালকা গল্পগাছা করার অবসরও বটে। মুচকি হেসে শান্তনু বলল,“কীরকম সাংঘাতিক? কালকের মতো?”
“কাল?” অলির চোখ পিটপিট, “কী হয়েছিল কাল?”
“ওই যে বলছিলি… একটা লোক নাকি বহুক্ষণ ধরে তোকে ফলো করছিল… বাসে… মেট্রোয়… কলেজেও পিছন পিছন ঢুকেছিল… শেষমেশ নাকি জানতে পারলি লোকটা তোদের কলেজের রিটায়ার্ড হেডক্লার্ক…”
“হ্যাঁ তো। ভদ্রলোক পেনশনের জন্য হাঁটাহাঁটি করছেন। কিন্তু আমি কী করে বুঝব বলো!”
“আজ বুঝি আরও সিরিয়াস ব্যাপার?”
“একদম অন্য টাইপের কেস।” বাবার ব্যঙ্গ গায়েই মাখল না অলি। উচ্ছ্বাসভরা গলায় বলল, “আমাদের ক্লাসের দীপাঞ্জনটা না… হিহি হিহি।”
“আহা, কী হয়েছে বলবি তো?”
“রবিবার আমাদের সোশিয়োলজির রিইউনিয়ন আছে না… আমরা ফার্স্ট ইয়াররা হেব্বি একটা স্কিট নামাচ্ছি। স্কিট বোঝো তো? ওই যাকে বাংলায় বলে কী যেন… কী যেন…? অ্যাই দিদিভাই বল না?”
আঁচল মুখ তুলল না। বুঝি শুনতেই পায়নি কথাটা।
অলি ফের খোঁচাল, “অ্যাই, স্কিটের বাংলাটা বলতে পারছিস না?”
“কৌতুক নকশা।” আঁচলের চোখ উঠতে উঠতেও নেমে গেল, “বা সংক্ষিপ্ত প্রহসন।”
“কী সন?”
“প্র-হ-স-ন।”
শব্দটা দু’-তিন বার জিভে পাকাল অলি। তারপর বলল, “ওই আর কী। ব্যাপক ফানি। বীভৎস হাসির।”
মানসী মুখ বেঁকাল। উপমার কী ছিরি!
শান্তনু কিন্তু হেসেই চলেছে মিটিমিটি। বড় একটা গরাস মুখে তুলে বলল, “বীভৎস হাসিটা কীরকম? যাত্রাপার্টির ভিলেনদের মতন?”
“তুৎ, শোনই না…। স্কিটের একটা সিনে হিরো হিরোইন ফিফটি ফিফটি ঘনিষ্ঠ হয়ে ডায়ালগ বলবে…”
“ফিফটি ফিফটি ঘনিষ্ঠ?” শান্তনুর প্রায় বিষম খাওয়ার জোগাড়।
“ওফ বাপি, তুমি না গাঁইয়াই রয়ে গেলে।” অলি বিচিত্র মুখভঙ্গি করল, “মানে জাস্ট ফেস টু ফেস। কাঁধে হাত।”
“অ। তারপর?”
“তো হয়েছে কী, ঈশিতা দীপাঞ্জনকে যেই একটা ফাটাফাটি রোম্যান্টিক ডায়ালগ দিয়েছে, ওমনি দীপাঞ্জন…”
ব্যস, অলি ফের হেসে কুটিপাটি। মাথা ঝাঁকাচ্ছে পাগলের মতো।
রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে মানসী বিরক্ত চোখে অলিকে দেখল। বড্ড ফাজিল হয়েছে মেয়েটা। সারাক্ষণ খালি হাহা হিহি। থালায় কপি চচ্চড়ি নিতে নিতে বলল, “আহ অলি, হচ্ছেটা কী?”
“হিহি হিহি। দীপাঞ্জনটা তখন কী বলে উঠল জানো? ‘অ্যাই ঈশ, কোন পেস্টে দাঁত মাজিস রে? তোর মুখে এত বদবু কেন?’”
“ছিঃ, মেয়েটাকে ইনসাল্টিং কমেন্ট করল, আর তুই কিনা…! তোকে বললে কেমন লাগত?”
“সাহস হবে বলার? এমন স্ক্রু টাইট দেব…। স্ট্রেট বলব, মাল্লু ছাড়, মাউথফ্রেশনার কিনে আনি।”
“শুনছ? মেয়ের কথা শুনছ?”
“না শুনে উপায় আছে?” শান্তনু ঘাড় হেলাল, “কী রে আঁচল, তোর কোনও কমেন্ট নেই যে?”
আঁচল যেন চমকে তাকিয়েছে। ফ্যালফেলে চোখে বলল, “কী বিষয়ে?”
“শুনলি না তুই…?”
“দিদিভাইকে এখন ডিসটার্ব কোরো না বাপি। ও এখন ধ্যানে আছে। সরি, পড়ছে। …ওটা কী বই রে দিদিভাই? সেই তখন থেকে গিলছিস?”
ইংরেজি পেপারব্যাকখানা তুলে বোনকে দেখাল আঁচল। ঠোঁটে অপ্রতিভ হাসি। আবার নামিয়ে নিয়েছে চোখ। খুঁটছে রুটি। চিবোচ্ছে ধীর লয়ে।
মানসীর অস্বস্তিটা বাড়ছিল। খেতে বসে আঁচল কমই কথা বলে, তবে আজ যেন অস্বাভাবিক রকমের চুপচাপ। ওই বইয়ে মুখ গুঁজে থাকাটা যে এখন দৃষ্টিকটু লাগতে পারে, সে বোধটাও কি হারিয়ে ফেলেছে আঁচল?
নাহ, ওই হতচ্ছাড়া লোকটার ফোন আসাটাই কাল হয়েছে। মোবাইলে কী যেন গুজুর গুজুর হল, তারপর থেকেই মেয়ে ভাবের ঘোরে। শুধিয়েও তো লাভ হল না তেমন, ছাড়া ছাড়া উত্তর দিল।
কলকাতা এলেই কী যে উৎপাত শুরু করে লোকটা। কেমন যেন নেড়েঘেঁটে দেয় মেয়েটাকে। মাঝে ক’বছর এ শহরে পা মাড়ায়নি, মেয়েটা বেশ ছিল। এবার কী উপদ্রব বাধাবে কে জানে!
ওদিকে অলির মেলট্রেন ছুটছে সাঁ সাঁ। এক কহানি থেকে অন্য কিসসা, সেখান থেকে আর এক। সঙ্গে সঙ্গে চলছে হাত মুখ। কচকচ তিনখানা রুটি শেষ, লাফ দিয়ে বেসিন, পরক্ষণে প্রায় ঊধ্বর্র্শ্বাস বসার ঘরে। উচ্চগ্রামে বেজে উঠল টিভি। নির্ঘাত কোনও রিয়্যালিটি শো আরম্ভ হচ্ছে।
কান পেতে একটুক্ষণ আওয়াজটা নিল শান্তনু। মুখের হাসিটা আর নেই। ভুরু কুঁচকে বলল, “অলি কখন পড়াশোনা করে বল তো? সারাক্ষণ তো হয় টিভি, নয় ফেসবুক খুলে বসে আছে, নয়তো কানে মোবাইল!”
“ঈশ্বর জানেন কখন পড়ে।” মানসী ঠোঁট উলটোল, “বললেই তো মেয়ের বাঁধা জবাব, রেজাল্ট দেখে নিয়ো!”
“হুঁঃ, পরীক্ষা তো উতরে দেয় প্রাইভেট টিউটররা। নোট গিলিয়ে গিলিয়ে।” শান্তনুর মুখে ঈষৎ অপ্রসন্ন ভাব, “কেন যে অলিটার পড়ার অভ্যেস গ্রো করল না? দিদিকে দেখেও তো শিখতে পারত।”
পদে পদে দুই বোনের তুলনা করে শান্তনু। হয়তো বা সাদা মনেই করে, আর পাঁচটা বাবার মতো। প্রশংসা হয় আঁচলেরই, তবু কেন যেন মানসীর ভেতরটা খচখচ করে। এখনও। মনে হয়, আঁচলের সামনে আঁচলের গুণগান গাওয়ার মধ্যে বুঝি বা একফালি দূরত্বের আভাস লুকিয়ে আছে।
বিরস মুখে মানসী বলল, “চব্বিশ ঘণ্টা বইয়ে মুখ গুঁজে রাখাই বা কী এমন আহামরি হ্যাবিট?”
“ওইটে থাকলে অলি তরে যেত। লেখাপড়ায় সিরিয়াস হত।” বলতে বলতে শান্তনুর দৃষ্টি আঁচলে, “কী রে, তোর কী সমাচার? ছাত্রছাত্রীরা আজ ক্লাসে আওয়াজ টাওয়াজ দিয়েছে?”
“আজ তো কলেজ ছিল না বাপি।”
“ও হ্যাঁ, তোর তো সোম শুক্কুর। মাথায় থাকে না।” শান্তনু আলগা হাসল, “তা তুই কি গেস্ট লেকচারারের চক্করেই আটকে থাকবি? রিসার্চ জয়েন করার কী হল?”
আঁচল বইটা মুড়ে রাখল। এক ঢোক জল খেয়ে বলল, “এগোচ্ছে।”
“অনেক গেঁতোমি হয়েছে, আর নয়। এবার উঠে পড়ে লাগ। তোদের তো আবার কী সব নতুন নিয়মকানুন হবে বলছিলি? পরীক্ষা না দিয়ে রিসার্চে নাকি ঢুকতেই পারবি না…”
“এখনও রুলটা চালু হয়নি। বোধহয় কামিং ইয়ার, কিংবা তার পরের বছর থেকে…”
“তা হলে দেরি করছিস কেন?”
“না না, কালই তো ইউনিভার্সিটি গিয়েছিলাম। স্যার, মানে রথীন স্যারের সঙ্গে আলোচনাও হল। উনি কয়েকটা টপিক চুজ় করে নিয়ে যেতে বলেছেন।”
“ভেরি গুড। তোর তো মিডিভাল পিরিয়ড, কোনও একটা বংশ-টংশ ধরে কাজ শুরু করে দে। দাসবংশ, খিলজিবংশ, তুঘলক বংশ, কিংবা আকবর-টাকবর।”
“ওসব নিয়ে লাখো পেপার বেরিয়ে গেছে বাপি। আমি নতুন কিছু ধরতে চাই।”
“যেমন?”
“আমি একটা স্পেশাল চরিত্র নিয়ে ভাবছি। নূরজাহান।”
আঁচলের আনমনা ভাব কেটেছে অনেকটা। স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গিতেই বলছে কথা। মানসী সামান্য হালকা বোধ করল। কৌতুকের সুরে বলল, “নূরজাহান তো খুব দাপুটে মহিলা ছিল রে!”
“দাপট বলে দাপট!” শান্তনু মাথা দোলাল, “বাদশা জাহাঙ্গির পর্যন্ত তার কাছে কেঁচো হয়ে থাকত। আমির ওমরাহদের তুড়ি বাজিয়ে নাচাত।”
“ওই ফেজ়টা নিয়ে আমার কোনও আগ্রহ নেই বাপি। আমি ধরতে চাই, রাইজ অফ নূরজাহান। ফ্রম মেহেরউন্নিসা। নূরজাহানের ওই যে ক্ষমতার খিদে, সেটা এল কোত্থেকে!”
“ভেরি ইন্টারেস্টিং? হঠাৎ এটা মগজে এল যে?”
“অনেক দিন ধরেই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই যে, গত বছর পুজোর পর রানিগড় গিয়ে একদিন বর্ধমান টাউনে গেলাম… অম্বরদা আমায় শের আফগানের সমাধিটা দেখাল, তখন থেকেই নূরজাহান আমায় হন্ট করছে। ভাবো, কোত্থেকে কোথায় উঠেছিলেন মহিলা!”
“বটেই তো।” শান্তনু সায় দিল, “তা আইডিয়া যখন পেয়ে গেছিস, নেমে পড়।”
“দাঁড়াও, স্যারের মতটাও শুনি।”
আঁচল আলতো হাসল। আর কোনও বাক্য নেই, মাথা নামিয়ে শেষ করছে আহার। অলি থালা তোলে না কস্মিনকালে, টেবিল ছাড়ার সময়ে আঁচলই বোনেরটা নিয়ে গেল সিঙ্কে। রান্নাঘরে খুটখাট করছে কী যেন। ওয়াটার পিউরিফায়ার চালাল। বাজনা বাজছে টুংটাং। টিভির প্রগলভ চিত্কারে চাপাও পড়ে গেল ধ্বনিটা।
জগে জল ভরে টেবিলে রেখে গেল আঁচল। শান্তনুর ভোজন শেষ, আঁচাচ্ছে। মানসী পড়ে থাকা খাবারদাবারগুলো ঢাকা দিল। ফ্রিজে তুলতে গিয়েও থমকেছে, “আমি কিন্তু আর বাইরে কিছু রাখলাম না।”
“দাও ঢুকিয়ে।” ঘাড় বেঁকিয়ে দেওয়ালঘড়ি দেখল শান্তনু, “অম্বর ফিরলে দশ’টার মধ্যে চলে আসত। এখন তো পৌনে এগারো।”
“অম্বরের কিন্তু একটা ফোন করা উচিত ছিল।”
“বোধহয় মোবাইলে ব্যালান্স নেই। ব্যাটা পয়সা ভরেনি।”
“তুমি কি একটা রিং করবে?”
“করেছিলাম। সুইচড অফ বলছে।”
“আশ্চর্য, ও তো লোকাল বুথ-টুথ থেকেও…”
“অত বোধগম্যি থাকলে তো চিন্তাই ছিল না। টোটালি ক্যালাস।”
“জানোই যখন অকম্মা, তখন তাকে হরিনগর পাঠানো কেন?”
“এটা কী বলছ? শুয়ে শুয়ে কড়িকাঠ গোনার জন্য তো আমি ওকে রানিগড় থেকে আনিনি। খাটুক একটু। নিদেনপক্ষে দৌড়োদৌড়িটা তো করুক।”
ওই দৌড়োদৌড়িই সার। কাকার কোনও উপকারে লাগবে না ওই ছেলে। কথাটা প্রায় মুখে এসে গিয়েছিল, তবে বলল না মানসী। অম্বরের ওপর তার কণামাত্র আস্থা নেই। একে তো উড়ু উড়ু, দায়দায়িত্বের বালাই নেই, তার আবার কবিতা লেখার নেশা…।
শান্তনুদের হিসেবি পরিবারে এরকম একটা ভাবুক যে কী করে জন্মাল! অম্বরের বাবা তো চাষবাস জমিজমা ইউরিয়া ফসফেট ছাড়া কিসুই বোঝে না। শান্তনুর পরের ভাই বাংলার মাস্টার। তবে সেও সর্বক্ষণ সম্পত্তির ভাগ, নিজের প্রাপ্য, নিজের ছেলে-বউ আর টিউশনি নিয়ে মহা ব্যস্ত। আর সবার ছোটটি বিয়েশাদি করেনি বটে, জমিবাড়িতেও তার তেমন আসক্তি নেই, তবে সেও নিতান্তই অকবি। স্থানীয় রাজনীতিতে তার ভালই প্রভাব, ক্ষমতাদখলের কুটিল প্যাঁচপয়জারে সে মেতে থাকে দিনরাত।
ওই বংশের ছেলে হয়ে অম্বরের রক্তে কী করে যে বায়ুরোগ ঢোকে!
ঠাট্টার ছলে শান্তনুকে কথাটা দু’-একবার শুনিয়েছে মানসী। দেখেছে, শান্তনু খুব একটা প্রীত হয় না। নিজের আত্মীয় পরিজন সম্পর্কে মানুষটা অদ্ভুত রকম স্পর্শকাতর। অথচ শান্তনু-মানসীর বিয়েটা একসময়ে রানিগড়ের কেউই মেনে নেয়নি। পাত্রী ডিভোর্সি জেনে শান্তনুর বাবা তো ছেলের মুখদর্শনেও রাজি ছিলেন না। তখন কিন্তু একটি ভাই দাদাও শান্তনুর পাশে দাঁড়ায়নি।
বাবার মৃত্যুর পর সম্পর্ক অনেক সহজ হয়েছে, তবু এখনও বছরে এক-দুপুরের বেশি রানিগড় মাড়ায় না শান্তনু। কিন্তু দুর্বলতাটা আছেই। নইলে দাদা ঠারেঠোরে মনোবেদনা প্রকাশ করতেই তার নিষ্কর্মা পুত্তুরটিকে কাছে এনে পুষে রাখে?
শান্তনু দাঁতের ফাঁক থেকে খাবারের কুচি বার করছে। খড়কে করতে করতে উঠে গেল দোতলায়। সিঁড়ির দরজা বন্ধ করবে। এ অঞ্চলে চোরের উপদ্রব বেড়েছে ইদানীং, তাই সতর্কতা। অম্বর থাকে ওপরে, সারাদিন কামরাটা খোলা পড়ে থাকে, সে ঘরেও তালা মারবে মনে হয়।
বাইরে হিম পড়ছে। বাতাসে শিরশিরে ভাব। রেল লাইনের এদিকটা এখনও ফাঁকা ফাঁকা, অল্প গাছপালাও আছে, তাই ঠান্ডাটাও বেশি। মশাও খুব। বিকেল নামতে না নামতে বন্ধ করতে হয় দরজা জানলা। তাতেও নিস্তার নেই, সন্ধে থেকে মশকবিতাড়ন যন্ত্র জ্বালতে হয় ঘরে ঘরে। শীত পড়লে ভনাভনানি কমবে ক্রমশ, ততদিন জোরদার রাখতে হবে এই প্রতিরোধ।
নীচে নেমে শোওয়ার ঘরে এল শান্তনু। বসেছে কোণের চেয়ারটায়। টেবিলময় ফাইলপত্র। ব্যবসার। চোখে রিডিং গ্লাস চাপিয়ে চালু করল ল্যাপটপ। ডুবে যাচ্ছে কাজে।
মানসী পাতলা কম্বল বার করল। বালিশ মশারিও। জগ গ্লাস আগেই এনেছে। গলায় জল ঢালল খানিকটা। আয়নার সামনে বসেছে। শুকনো বাতাসে টান ধরছে চামড়ায়, তেলোয় ক্রিম নিয়ে ঘষছে গালে গলায় ঠোঁটে।
সহসা বসার ঘরে টিভির নিনাদ। প্রচণ্ড গুলিগোলার শব্দ, কে যেন কড়া গলায় শাসাচ্ছে কারওকে। অলি এবার সিনেমা চালিয়েছে!
শান্তনু বিরক্ত স্বরে বলল, “ওফ, এর মধ্যে কাজ করা যায়?”
মানসীরও অসহ্য লাগছিল। গলা ওঠাল, “অলি, ভলিউম কমাও।”
কোনও প্রতিক্রিয়া নেই।
মানসীর স্বর আরও চড়ল, “কী হচ্ছে অলি? কথা কানে যায় না?”
এবার অলি উঁকি দিয়েছে দরজায়, “ডাকছ?”
“বলছি, রাতদুপুরে কোনও ভদ্র বাড়িতে এরকম গাঁকগাঁক টিভি চলে? এবার বন্ধ করো। শুতে যাও।”
অলি পরদা ধরে গা মোচড়াল, “আর পাঁচ মিনিট। এরপর একটা গান হবে, ওটা দেখেই…”
“এক মিনিটও নয়। তোমার দিদিটি কী করছেন?”
“ও তো লেটে গেছে বিছানায়।”
“দয়া করে মশারিটা টাঙিয়ে নিয়ো। কালও তোমাদের হুঁশ ছিল না, ভোঁস ভোঁস ঘুমোচ্ছিলে। যথেষ্ট ধাড়ি হয়েছ, রোজ বাপি গিয়ে তোমাদের মশারি টাঙিয়ে দিয়ে আসবে না।”
“বাপি তো এ ঘরেরটাও টাঙায় মা। তুমি কবে মশারি টাঙিয়েছ? হিহি হিহি।”
“মারব এক থাপ্পড়। যাহ।”
অলি পলকে উধাও। থেমেছে টিভির গর্জন। আহ, শান্তি।
মানসী উঠে জানলার একটা পাল্লা খুলে দিল। অল্প করে। বেশি খুলতে সাহস হয় না, বন্ধ রাখতেও অস্বস্তি। জানলার ফাঁকটুকু দিয়ে কিছুই প্রায় দেখা যায় না, ধোঁয়া ধোঁয়া অন্ধকার ছাড়া, তবু তাকিয়ে আছে।
হঠাৎই শান্তনুর গলা, “আঁচল এত তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল?”
মানসী অস্ফুটে বলল, “হুঁ।”
“শরীর টরির ঠিক আছে তো? ওকে আজ কেমন শুকনো শুকনো দেখাচ্ছিল…”
মানসী অনুচ্চ স্বরে বলল, “লোকটা এসেছে যে।”
শান্তনুর ভুরুতে পলকা ভাঁজ, “কে লোকটা?”
“দেবরাজ সিংহরায়। আজ তিনি পা রেখেছেন কলকাতায়।”
“ও।” শান্তনু স্বাভাবিক স্বরে বলল, “আঁচলকে ফোন করেছিল বুঝি?”
“হুঁ। বিকেলে।”
ব্যস, আর কোনও জিজ্ঞাসা নেই, শান্তনু মাথা নামিয়ে কাজ করছে ল্যাপটপে।
সত্যিই কি শান্তনু এত নির্বিকার? বুঝতে পারে না বলেই মানসী আচমকা রেগে গেল। ক্ষোভটা আছড়ে পড়ল দেবরাজের ওপর। খরখরে গলায় বলল, “আলগা পিরিত দেখলে গা জ্বলে যায়। সাতজন্মে মেয়ের খোঁজ নেয় না, এখানে এলেই দরদ উথলে ওঠে!”
“তা কেন। মাঝে মাঝেই তো দিল্লি থেকে ফোন করে।”
“কেন করে? কেন করবে? দরকারটা কী, অ্যাঁ? আঁচলের সঙ্গে ওর কীসের সম্পর্ক?”
“জানো না?”
“না। জানলেও মানি না। যে লোক বেলেল্লাপনা করার জন্য দু’বছরের মেয়ে ফেলে ভেগে যায়, তার কোনও ধরনের ন্যাকাপনা সাজে না। অনেককাল সহ্য করেছি, এখন আঁচল বড় হয়েছে, এবার ওসব বন্ধ হোক।”
“তা বললে চলে? আঁচলের ওপর তারও তো একটা রাইট আছে।”
“এক কণা নেই। আঁচল আমাদের মেয়ে। আমরা ওকে মানুষ করেছি।” ‘আমরা’ শব্দটার ওপর বাড়তি জোর দিল মানসী। তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “কোনও দিন সে কোনও দায়িত্ব নিয়েছে মেয়ের?”
“দায়িত্ব না নিলে কি অধিকার মুছে যায়? নাকি দায়িত্ব গ্রহণ করলে বেশি রাইট এসে যায় হাতে?”
শান্তনুর স্বর একান্তই ভাবলেশহীন। তবু যেন কোথাও একটা খোঁচাও আছে। আঁচলের বাবা হওয়ার একচ্ছত্র অধিকার সে অর্জন করতে পারেনি, এই রূঢ় বাস্তবটাই কি স্মরণ করিয়ে দিল মানসীকে?
অবশ্য শান্তনুর অভিমান অসংগত নয়। আদিখ্যেতা কি দেবরাজের একতরফা? আঁচলেরও যথেষ্ট প্রশ্রয় আছে। অথচ শান্তনুর কাছ থেকে কী পায়নি ওই মেয়ে? সেই এতটুকু থেকে কোলেপিঠে করে বড় করল, অলি হওয়ার পরও তার আদর কমেনি বিন্দুমাত্র, অতি বড় শত্রুও বলতে পারবে না অলি আর আঁচলে কোনও প্রভেদ রেখেছে শান্তনু। অলি তো তাও সময় সময় বাবার ধমক খায়, আঁচল তো কদাপি নয়। তার পরেও, যে তাকে অবহেলা ছাড়া কিছু দেয়নি, তার ফোন পেয়ে কেন উন্মনা হবে আঁচল?
মানসী গুম হয়ে গেল। ড্রয়ার থেকে চিরুনি বের করে চেপে চেপে মাথা আঁচড়াচ্ছে। একগোছা চুল উঠল, চিরুনির দাঁড়া থেকে চেপে চেপে ছাড়াচ্ছে মরা চুল। নাকি মরা স্মৃতি, যা এখনও যথেষ্ট মরেনি? দু’ যুগ আগের সেই লজ্জামাখা অপমানভরা দিনগুলো কি আদৌ মরবে কখনও?
তবু উঠে জানলার ফাঁকটুকু দিয়ে মরা চুলের গোছাটা থু থু করে ওড়াল মানসী। এসে শুয়ে পড়ল বিছানায়। হালকা কম্বলখানা টানল গায়ে। চোখ বুজেছে।
কিন্তু ঘুম আসে কই? বারবার মনে পড়ছে বিকেলের ছবিটা। ফোন পেয়ে পলকে উদ্ভাসিত আঁচলের মুখ। প্রাথমিক উচ্ছ্বাসের পরই অস্বাভাবিক নিচু স্বরে দেবরাজের সঙ্গে আলাপচারিতা! মানসীর সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ামাত্র দৃষ্টি সরিয়ে নিল আঁচল!
মানসী দেওয়ালের দিকে পাশ ফিরল। আজও সকালে বনানী ফোন করেছিল। আঁচলের বিয়ের সম্বন্ধটা নিয়ে। শান্তনুকে ব্যাপারটা জানানো দরকার। ভেবেছিল, কারখানা থেকে ফিরলেই বলবে শান্তনুকে। কিন্তু মেয়ে এমন মেজাজটা বিগড়ে দিল!
এখন কি বলা যায়? শান্তনুকে কি ডাকবে মানসী?
৩
ফুরফুরে মেজাজে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল দেবরাজ। নীচে স্ট্রিট লাইটের বাতি, খানিক দূরে লেকের অন্ধকারের আভাস, বাতাসে উত্তুরে হিমের আলগা ছোঁয়া, তেমন একটা উচ্চকিত আওয়াজ নেই কোত্থাও, সব মিলিয়ে শহরটা ভারী মনোরম এখন। সন্ধেবেলা পেগ দুয়েক হুইস্কি মাথাটাকে যেন আরও হালকা করে দিয়েছে।
কলকাতায় আসার পর থেকে দেবরাজের সময়টা মন্দ যাচ্ছে না। পরশু সন্ধেয় তো রূপরেখায় ভালই খাতির করল মম্তা। রাত্রে একসঙ্গে ডিনার করার কথাও বলছিল। খুব একটা অনীহা ছিল না দেবরাজের, শরীরে তেমন জোশ পাচ্ছিল বলে রাজি হল না শেষমেশ। রাতে একটা চমৎকার ঘুম দিয়ে কাল সকাল থেকে দেহমন পুরো তরতাজা। প্রিভিউটাও কাল ভালই উতরেছে। তিন তিনখানা ছবি হাতেগরম বিক্রি হয়ে গেল। এই মন্দার বাজারে তো শুভসূচনাই বলা যায়। প্রেসও তো প্রায় ঝেঁটিয়ে এসেছিল। দু’খানা টিভি চ্যানেলও এগ্জ়িবিশনটা কভার করে গেল। এর চেয়ে বেশি আর কী চাইতে পারে দেবরাজ? সবচেয়ে আনন্দের কথা, একটা ইংরেজি খবরের কাগজে আজই বেরিয়ে গেছে তার ছবির রিভিউ। নির্মল না বিমল নামের চিত্রসমালোচকটি খুব একটা পাকামি করেনি। মোটামুটি দেবরাজের কথাগুলো আর ক্যাটালগটা মিলিয়ে মিশিয়ে স্তুতিবাক্যেই ভরিয়ে দিয়েছে আলোচনাটা। কৃতিত্বটা বোধহয় মম্তারই, কিন্তু দেবরাজের প্রচারটা তো হল!
দুপুরে আজ একবার আর্ট কলেজে ঢুঁ মেরেছিল দেবরাজ। চিরন্তন তো বটেই, পুরনো আরও দু’-চারজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হল, আড্ডাও জমেছিল বেশ। এখানে এখন সকলেই রাজনীতি নিয়ে ভারী আলোড়িত, হুটহাট এর সঙ্গে তার তর্ক বেধে যাচ্ছে। কেউ সরকার পক্ষের সমালোচনায় মুখর, কেউ বা বিরোধীদের জঙ্গিপনায় উত্তেজিত। রাজনীতিতে কোনও দিন তেমন আকর্ষণ বোধ করে না দেবরাজ, তবে বন্ধুদের বাকবিতণ্ডা উপভোগই করছিল আজ। জোরালো হট্টগোলে যৌবনটাই যেন ফিরে আসছিল আবার। এই না হলে কলকাতাকে মানায়? মাঝে বড্ড ম্যাদামারা হয়ে গিয়েছিল, আবার বুঝি প্রাণ ফিরছে শহরটার। শুধু অসীমটার সঙ্গে যা দেখা হল না এখনও। অসীম নাকি এখন কষে রাজনীতি করছে, সেই উপলক্ষে গেছে যেন কোথায়। পারেও বটে।
“স্যার, খানা হাজির।”
বড় ঘর থেকে দিলীপের ডাক। দেবরাজ পায়ে পায়ে ফিরল অন্দরে। চোখ নাচিয়ে বলল, “কী এনেছিস আজ?”
“পরোটা, কষা মাংস আর হরিয়ালি কাবাব।”
“তোর সেই নতুন রেস্তোরাঁ থেকে?”
“হ্যাঁ স্যার। ওদের খানা আপনার তো খুব পছন্দ হয়েছে।”
“হুম। ব্যাটারা রাঁধে ভাল। তবে রোজ রোজ আমায় এত রিচ খাবার খাওয়াস না। পেটের বারোটা বেজে যাবে।”
“ওবেলা তো আজ সেদ্ধভাতই খেলেন।”
“সেও তো ঘি মাখন দিয়ে।” দেবরাজ চেয়ার টেনে বসল, “কাল থেকে মাছ-টাছ নিয়ে আয়। সুনীতাকে বল, যেন পাতলা পাতলা করে রেঁধে দেয়। পারলে একটু ডাল-টালও…”
বলতে বলতে দেবরাজ আপন মনে হেসে ফেলল। তার এই ডাল-ভাত-মাছ প্রীতির জন্য কী ঠাট্টাটাই না করে পুনম! বলে, বাঙালি নাকি চামড়া বদলাতে পারে, কিন্তু জিভ তার বদলায় না। দেবরাজ অবশ্য ওসব বিদ্রুপ গায়ে মাখে না। স্রেফ গোবি-ছোলে-সরসোঁ কি শাক, আর মোটা মোটা রোটি-তড়কা খাওয়া পাঞ্জাবি তনয়া পুনম বাঙালি রসনার কী বোঝে?
সুরার ফাঁকা গ্লাস সিঙ্কে ধুয়ে টেবিল সাজানোয় মন দিয়েছে দিলীপ। ছোট্ট ক্রকারি কেস থেকে কোয়ার্টার প্লেট বার করে আজও নকশা বানাচ্ছে পেঁয়াজ-শসা-টোম্যাটোর। নাহ, এই ছোকরাকে মোটা টিপস দিতেই হয়। সাধে কী পুনম ফিরে গিয়ে পঞ্চমুখ ছিল!
দেবরাজ এক টুকরো শসা পুরল মুখে। চিবোচ্ছে কচকচ। তেরচা চোখে বলল, “এত সব কেতা তুই শিখলি কোত্থেকে?”
“একটা কেটারিং কোম্পানিতে পার্ট টাইম করছি স্যার। এখানে কেয়ারটেকার হিসেবে যা পাই, তাতে তো…”
“ভাল করেছিস। যা মাগ্গি গন্ডার বাজার, শেয়ালের পলিসি ছাড়া তো টেকা মুশকিল।”
দিলীপ অর্থটা ঠিক বুঝল না বোধহয়। দু’খানা পরোটা তুলে দিল প্লেটে। হঠাৎই একটু ভীতু ভীতু গলায় বলল, “একটা কথা ছিল স্যার।”
“কী রে?”
“আমি একটা অন্যায় করে ফেলেছি।”
দেবরাজ খাওয়া থামিয়ে তাকাল।
দিলীপ ঘাড় চুলকোচ্ছে, “একদম বলতে ভুলে গেছি স্যার। এক ভদ্রমহিলা একদিন আপনার খোঁজে এসেছিলেন। উনি নাকি বারবার চেষ্টা করেও আপনাকে ফোনে ধরতে পারছেন না।”
“স্বাভাবিক। ফোন নাম্বার তো পালটে গেছে।” সামান্য তাচ্ছিল্যের সুরে দেবরাজ বলল, “কে মহিলা?”
“সম্পর্কে বোধহয় আপনার বোন।”
এবার দেবরাজ চমকেছে, “বোন?”
“তাই তো বললেন। কী যেন নাম…! হ্যাঁ হ্যাঁ, বনানী সরকার।”
বনো! ছোড়দাকে তার এত কীসের দরকার পড়ল, যে একেবারে ফ্ল্যাটে এসে হানা?
দেবরাজ কপাল কুঁচকোল, “কেন খুঁজছে কিছু বলেছে?”
“না তো।”
“কবে এসেছিল?”
“তা ধরুন, দিন দশেক হবে।”
“বলেছিলি, আমি কলকাতায় আসছি?”
“তখন তো খবরটা পাইনি।”
দেবরাজ একটু ভাবনায় পড়ল। বনোর আকস্মিক আগমন মোটেই স্বাভাবিক ঘটনা নয়। বোনের সঙ্গে তার সম্পর্ক বরাবরই কাঠে কাঠে। বনোটা বড্ড পিসিমা পিসিমা টাইপ। মানসীর সঙ্গে দেবরাজের ডিভোর্সটা একেবারেই মেনে নিতে পারেনি বনো। কথায় কথায় শোনাত, “তোর দোষেই ভাঙল, তোর দোষেই ভাঙল…। আর্টিস্ট হয়ে কি সাপের পাঁচ পা দেখেছিস? যা ইচ্ছে করবি, যেমন খুশি চলবি, কোনও রাখঢাক থাকবে না..!” দেবরাজ কোনও কালেই লুকোছাপার মানুষ নয়। সে নিজের জন্য বাঁচে। এবং নিজের মতো করেই বাঁচতে চায়। আর এই ব্যাপারটাই বনোর একদম সহ্য হয় না। দেবরাজ আর পুনম যে বিয়েশাদি না করেই একত্রে বাস করছে, এতেও তো বনো ছোড়দার ওপর হাড়ে হাড়ে চটা। গত বছর দিল্লি গিয়ে কী বিশ্রী একটা সিন করে এল। শিমলা যাওয়ার পথে দিনকয়েক পাহাড়গঞ্জের হোটেলে ছিল, ফোনে ‘হাই হ্যালো’ও করল, কিন্তু কিছুতেই দেবরাজের ডেরায় পা রাখল না। পুনম পর্যন্ত অনুরোধ করেছিল, তা সত্ত্বেও না। অথচ নিজের ধান্দার বেলায় তার অন্য রূপ। “টাবলু মাস্টার ডিগ্রিটা জে এন ইউতে করতে চায়, অ্যাডমিশন টেস্টে বসবে… তোর তো দিল্লিতে প্রচুর চেনাজানা… তোকে কিন্তু হেল্প করতে হবে ছোড়দা…!” সেই সেবার দেবরাজ যখন ফ্রান্স থেকে ফিরল, বিদেশে ছোড়দার কেমন নামযশ হল তা নিয়ে বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই, অথচ প্রথম দর্শনেই চোখ চকচক। “আমার জন্য কী কী কসমেটিক্স এনেছিস রে…!”
তা বনো তো এরকমই। গালমন্দ করবে, আবার নিজের স্বার্থে ছুটেও আসবে। ছোড়দা লম্পট, ছোড়দা মদ্যপ, ঝোড়দা আত্মসুখী, ছোড়দার মুখ দেখতে ইচ্ছে করে না, অথচ প্রয়োজন পড়লে ছোড়দার কাছেই যত বায়না। রক্তের সম্পর্কে এটাই বুঝি গেরো। দাবি আর অধিকারবোধের কোনও সীমারেখা থাকে না।
অন্যমনস্কভাবে পরোটা ছিঁড়ল দেবরাজ। টাবলুর ভরতির পরীক্ষা তো এখনও বেশ কয়েক মাস বাকি, বনো কি এখনই উতলা হয়ে পড়ল? লাগাবে একটা ফোন? কত যেন নাম্বারটা? থাক গে, এখন তো আছে কয়েকটা দিন, সময় করে ঘুরে এলেই হবে।
খাওয়া সেরে দেবরাজ সিগারেট ধরাল। দিলীপ একটা কাচের ছোট ছাইদান বার করে দিয়েছে, হাতে তুলে দেখল পাত্রটা। পিঠে গর্তওয়ালা কচ্ছপ। প্রুশিয়ান ব্লু। আগে ছিল না এটা, পুনম কিনেছে বোধহয়। একা থাকলে সিগারেট একটু বেশিই খায় পুনম। দেবরাজ বেখেয়ালি মানুষ, হরবখত হাত থেকে জিনিস ভাঙে, পুনমের বস্তুটি সন্তর্পণে ব্যবহার করাই শ্রেয়।
ফের মাথায় বনানীর টোকা। ছেলে ছাড়া বনোর আগমনের আর কী কারণ থাকতে পারে? ফোনটা করেই ফেলবে? নম্বরটা সম্ভবত টু ফোর নাইন সেভেন… তারপর আমেরিকার স্বাধীনতার বছর…
এই হল রক্তের টান। যতই বিরক্তি জমুক, দেবরাজ টানটাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করতে পারে কই!
যন্ত্রের মতো মোবাইলটা তুলেছিল দেবরাজ, নিজেই বেজে উঠেছে চলভাষ। “কী রে, এসেছিস তা হলে?”
আরে, অসীমের গলা না? দেবরাজ আয়েশি মেজাজে হেলান দিল সোফায়, “ইয়েস বস। টেম্পোরারিলি ব্যাক টু প্যাভেলিয়ান।
“উঁহু। বল, বন কি চিড়িয়া পুরনো খাঁচায়।”
“বেড়ে বলেছিস তো! হা হা হা।”
“আছিস তো ঠিকঠাক?”
“দেবরাজ সিংহরায় কখনও খারাপ থাকে না। এমনকী তোদের কলকাতায় এসেও হি ইজ হেইল অ্যান্ড হার্টি।”
“আমাদের কলকাতা? তোর নয়?”
“অবশ্যই না। আমি এখন পুরোপুরি দিল্লিওয়ালা।”
“বটে? তা তোর দিল্লির কী সমাচার? শীতে কাঁপছে?”
“অন্তত বিয়ার ফ্রিজে রাখতে হয় না।”
“পুনমকে এনেছিস?”
“আমরা তো কেউ কারওকে আনাআনিতে নেই ভাই। তা ছাড়া সে এখন ড্রামা ফেস্টিভ্যাল নিয়ে দারুণ বিজি।”
“নতুন কিছু নামাচ্ছে নাকি?”
“সম্ভবত। ঠিক জানি না।”
“আশ্চর্য, কেমন একসঙ্গে থাকিস রে তোরা? কেউ কারওর খবর রাখিস না?”
“উই বিলিভ ইন অ্যাবসোলিউট প্রাইভেসি। একে অন্যের প্রফেশনাল স্ফিয়ারে নাক গলাই না। এবং সেই জন্যই বোধহয় রিলেশনটা টিকে আছে।”
“কী জানি রে ভাই, তোদের ব্যাপার স্যাপার আমার মাথায় ঢোকে না। লিভটুগেদারই হোক, আর যা-ই হোক, আছিস তো এক ছাদের নীচে। দু’জনে দু’জনের সুখ দুঃখ, আশা নিরাশা শেয়ার করবি না?”
“সত্যিই কি ওগুলো শেয়ার করা যায়?”
“তুই ব্যাটা এখনও সেই এক টাইপের রয়ে গেছিস।”
“কীরকম? বুনো ষাঁড়? পাগলা হাতি?”
“তার চেয়েও খারাপ। ক্যাডাভ্যারাস।”
“কী করা যাবে বন্ধু? এই বয়সে নিজেকে তো আর বদলাতে পারব না।” সেলফোনটা অন্য কানে নিল দেবরাজ। দু’-এক সেকেন্ড থেমে থেকে বলল, “কোত্থেকে কথা বলছিস? মিউজিকের আওয়াজ পাচ্ছি যেন?”
“আমি এখন পার্ক স্ট্রিটের বারে নওলকিশোর। কাউন্টার থেকে বাতচিত চালাচ্ছি।”
“রাত দশটায় শুঁড়িখানায়? সঙ্গে বিধুমুখী-টুখি আছে বুঝি?”
“আমার কি তোর মতো ক্যালি আছে রে ভাই? এক পিস গাণ্ডুকে নিয়ে ফেঁসে আছি।”
“কে রে? মালটা কে?”
“শ্রীমান কপিধ্বজ দত্ত। রোজনামচা-র।”
কপিধ্বজকে বিলক্ষণ চেনে দেবরাজ। শান্তিনিকেতনে স্কুল না লাইব্রেরি কোথায় যেন চাকরি করত। নেশা ছিল নামী দামি লোকদের গা ঘেঁষে বসে থাকা। হরিপ্রসাদদাকে ধরে করে কাজ জুটিয়েছিল রোজনামচা-য়। ব্যাটা নাকি ক্লিপটোম্যানিয়াক। কার বাড়ি থেকে যেন ব্রোঞ্জের গণেশ চুরি করে ধরা পড়েছিল। একবার এক অখ্যাত কবির কবিতা নিজের নামে চাপিয়ে ধোলাই খেয়েছিল খুব। এখন সে মহা হেক্কড়, রোজনামচা-র শিল্প সংস্কৃতি পাতাটার কর্তা। কাল প্রিভিউতে নিশ্চয়ই নিমন্ত্রিত ছিল। আসেনি। দেবরাজ কোনও কালেই ওই দু’নম্বরি মালকে পাত্তা দেয়নি বলেই কি…?
দেবরাজ হাসতে হাসতে বলল, “তা তুই ওর সঙ্গে কেন?”
“আর বলিস না, একজনের পাল্লায় পড়ে…। উৎপলকে মনে আছে?”
“কোন উৎপল? ঘোষ? আমাদের পরের ব্যাচের?”
“না। সেন উৎপল। ডান্সট্রুপের পান্ডা। ওর শালিটা ভাল নাচে। ওড়িশি। রোজনামচা-য় শ্যালিকার একটা ভাল রিভিউয়ের জন্য কপিধ্বজকে ধরেছে। আমি জাস্ট মিডিয়াম। উৎপল এখন গাণ্ডুটাকে মাল খাওয়াচ্ছে, আমি শুধু সঙ্গ দিচ্ছি।”
এবং নিজের লাইনটাও একটু ঝালাই করে নিচ্ছ, অ্যাঁ? দেবরাজ মনে মনে বলল। কাজটা অবশ্য দোষের কিছু নয়। দিল্লিতেও তো একই রেওয়াজ। এ ধরনের জনসংযোগ দেবরাজের বিলকুল না-পসন্দ। তবে এই নিয়ে ঠাট্টাতামাশা জোড়াও তো শোভন হবে না। অসীম তার আর্ট কলেজের সহপাঠী, সেই কবেকার বন্ধু। এক সময়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারা একটা গ্রুপও করেছিল। নিউ হরাইজন। কিন্তু এই মধ্যবয়সে পৌঁছে তার মুখফোড় মন্তব্য অসীমের পছন্দ না-ও হতে পারে। জীবনে বন্ধু তো কমেই এসেছে, শত্রু বাড়িয়ে কী লাভ।
দেবরাজ হালকা চালে বলল, “আমাকে কিন্তু তুই খুব ঝুল দিলি।”
“কেন?”
“ভেবেছিলাম, প্রিভিউতে তুই থাকবি। তোর বাড়িতে ফোন করে শুনলাম, তুই নাকি মেদিনীপুর গেছিস।”
“উঁহু। চণ্ডীপুর। পূর্ব মেদিনীপুর ডিস্ট্রিক্টে। শুনেছিস নিশ্চয়ই, ওদিকে জমি নিয়ে স্টেট গভর্নমেন্ট ভার্সেস লোকাল পিপল একটা ফাইট চলছে।”
“ওরে বাবা, কলকাতায় ঢোকার পর থেকে তো ওই শুনতে শুনতেই কান পচে গেল। তা তুই ওই সব বখেড়ায় কেন?”
“সারাটা জীবন শুধু ছবি এঁকে আর নোট কামিয়ে কাটিয়ে দেব? শিল্পী হিসেবে আমার সামাজিক দায়িত্ব নেই?”
“কিন্তু তুই তো কোনও কালেই রাজনীতি-ফাজনীতিতে ছিলি না?”
“এখনও নেই। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর একটু চেষ্টা করছি, এই যা। বারবার ওদের কাছে ছুটে যাচ্ছি, সাধ্যমতো ওদের সাহস জোগাচ্ছি, প্রয়োজনে গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে ফোঁসও করছি…। রাজ্যের এখন ঘোর দুঃসময়। সাধারণ মানুষের অধিকার বিপন্ন। এই সময়ে যদি সুখী গৃহকোণে মুখ গুঁজে লুকিয়ে থাকি, তা হলে বেঁচে থাকাই তো বৃথা।”
“তুই তো জ্বালাময়ী ভাষণ শুরু করে দিলি রে।”
“ঠাট্টা করছিস? আমার সঙ্গে চল একদিন, স্বচক্ষে দেখ ওদের অবস্থা… তখন তুইও…”
“রক্ষে করো। আমি আমার ভুবনে খাসা আছি। সুরা, নারী আর ইজেলে তুলি বুলিয়েই এ জীবনটা আমার তোফা কেটে যাবে।”
ও প্রান্ত ক্ষণকাল নিশ্চুপ। ফের স্বর ফুটেছে, “তা তোর প্রিভিউ কেমন হল?”
“নট ব্যাড। ও-কে।”
“মম্তাকে ট্যাক্টফুলি ডিল করিস। মহিলা মহা ধুরন্ধর। মাত্র আড়াই তিন বছরে গ্যালারিটাকে দাঁড় করিয়ে দিল।”
“জানি। ফ্যান্টাসটিক একটা এগ্জিবিশন করেছিল। ট্রাইবাল আর্ট নিয়ে। দিল্লির পেপারেও কভারেজ দিয়েছিল।”
“তখন গোটা ইন্ডিয়া ঢুঁড়ে ঢুঁড়ে ছবি কালেক্ট করেছে ওই মহিলা। তার থেকেই তো ওর উত্থান।”
“রেপুটেশন তৈরি করেছে বলেই না এদের প্রোপাজালে ইন্টারেস্ট দেখালাম।” গলা অনাবশ্যক ভারী করল দেবরাজ। যেন তার ছবির মান স্বরের ওজনের ওপর নির্ভরশীল। ও প্রান্তের প্রতিক্রিয়ার জন্য তিলেক অপেক্ষা করে বলল, “কাল ইভনিংয়ে ফ্রি আছিস তো?”
“কেন রে?”
“আমার ফ্ল্যাটে চলে আয়। পরশু তো আমার ওপেনিং, তাই অনেককে ডেকেছি। জমিয়ে নরক গুলজার করব।”
আবার ও প্রান্তে ক্ষণিক নীরবতা। তারপর অসীম বলল, “যাব। তোকে বুঝিয়েই আসব, আমরা কী করছি।”
“দেখিস, পার্টিটা মাটি করিস না।”
ফোন রেখে স্থির বসে রইল দেবরাজ। বনানী উবে গেছে মাথা থেকে। আলগা দৃষ্টি আটকেছে দেওয়ালে আঁকা নিজের ছবিটায়। দেখছে নগ্ন নারীদেহের রঙিন উদ্ভাস।
আপনাআপনি দেবরাজের ঠোঁটের কোণে বিচিত্র এক হাসি ফুটে উঠল। নারী। তার নেশা। তার আবেগ। রিপু। নিয়তি। নারী তাকে সুখ দিয়েছে, আবার নারীই তাকে বিষণ্ণ করেছে। দেবরাজের আজ যেটুকু সাফল্য, যতটুকু সচ্ছলতা, তার পিছনেও তো ওই নারীই।
মানসীর সঙ্গে দেবরাজের বিয়েটা ছিঁড়েছিল চন্দ্রিমার কারণে। মেয়েটার মধ্যে অদ্ভুত এক বুনো আকর্ষণ ছিল, জন্তুর মতো তাকে আঁচড়ে কামড়ে ভালবাসত চন্দ্রিমা। ডিভোর্সটা হতে না হতেই সেই চন্দ্রিমার মূর্তি বদলে গেল আমূল। আজব আব্দার, তক্ষুনি তাকে বিয়ে করতে হবে! অর্থাৎ ঘোমটা টেনে সতীসাবিত্রী হতে চায়, আঁচলের খুঁটে বাঁধতে চায় দেবরাজকে। সিনেমায় ছুটকোছাটকা রোল করত চন্দ্রিমা, দেবরাজের জন্য সেই ছায়াছবির জগৎকেও সে বিসর্জন দিতে রাজি। কিন্তু কাঁহাতক ওই মস্তিষ্কবিহীন, দেহসর্বস্ব, বোদা মেয়েটাকে সহ্য হয়!
আচমকা সুযোগ জুটে গেল পালানোর। ফ্রেঞ্চ স্কলারশিপ পেয়ে দেবরাজ পাড়ি জমাল নিসে। সেখানে পিয়েরে ক্লেমোঁর ছত্রচ্ছায়ায় শিক্ষানবিশী করার সময়ে জীবনে মারিয়ানের আবির্ভাব। ভূমধ্যসাগরীয় নীল আঁখি, সোনালি চুল অপরূপ এক দেবকন্যা। প্রথম দর্শনেই প্রেম। মডেলিং করত মারিয়ান, একের পর এক ধনী ক্লায়েন্টদের বাড়িতে ম্যুরালের কাজ জোগাড় করে দিয়েছিল দেবরাজকে। স্কলারশিপের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও মারিয়ানের ভরসায় দেবরাজ বছর তিনেক রয়ে গেল ফ্রান্সে। তবে সেই মেয়ে পাকাপাকি বাঁধা পড়ার পাত্রী নয়, দেবরাজেরও বন্ধন সয় না, সহজভাবেই দু’জনে একদিন দাঁড়ি টেনে দিল সম্পর্কে। ইউরোপে আর মনও টিকছিল না দেবরাজের, শিকড় তাকে টানছিল, অতএব জমানো টাকাকড়ি নিয়ে, পাততাড়ি গুটিয়ে, সোজা কলকাতায় প্রত্যাবর্তন। অভিজ্ঞতার পুঁজি আছে তার ভাঁড়ারে, টুসকি বাজিয়ে সে কলকাতাকে জয় করবে!
কিন্তু হায়, এ শহর দেবরাজকে আর সেভাবে গ্রহণ করল কই? পরপর দুটো প্রদর্শনী করল, দুটোই সুপার ফ্লপ। ঠিক ঠিক জায়গায় লাইন করতে পারলে হয়তো কিছুটা হলেও সাফল্য আসত। তবে দেবরাজের এক গোঁ… কাউকে তেল মারব না, নিজের ঢাক নিজে পেটাব না…! কিছুতেই মানল না, ক’বছর চোখের আড়াল হয়ে সে তখন শহরের শিল্পরসিক মহল থেকে অনেকটাই দূরে সরে গেছে, একটু আধটু ধরাকরা না করলে সে ফের জমি পাবে কেন?
তবু বেশ কিছুদিন একবগ্গার মতো লড়াইটা চালিয়েছিল দেবরাজ। দাদা বউদির আটপৌরে গেরস্থ সংসারে বাস করতে করতে হাঁপিয়ে উঠছিল, সঞ্চয় ভেঙে কিনে ফেলল এই ফ্ল্যাটখানা। বাসস্থান কাম স্টুডিয়ো। প্রাণভরে ছবি আঁকছে, কিন্তু নো বিক্রি। শেষে আঁকার টিউশনি করে পেট চালাতে হয়, প্রায় সেই দশা।
এমত গহ্বর থেকেও তাকে উদ্ধার করল এক নারী। দিল্লির এক ফ্যাশান ম্যাগাজিনের এডিটর লতা ভার্গব। এসেছিল কলকাতাসুন্দরী বাছাইয়ের বিচারক হয়ে, অ্যাকাডেমিতে ছবি দেখতে গিয়ে দেবরাজের প্রেমে হাবুডুবু। লতা তাকে প্রায় হরণ করে নিয়ে গেল রাজধানীতে। রূপের চটক ছিল লতার, পরিচিতির জগৎটাও বিশাল। ব্যবসা-রাজনীতি-শিল্পমহলের অনেক রথী মহারথীর সঙ্গে তার ওঠাবসা। দেবরাজ মজা করে বলত, শোওয়াবসা। হ্যাঁ, শরীর নিয়ে কোনও ছুঁতমার্গ ছিল না মিসেস লতা ভার্গবের। তা সেই লতার চেষ্টাতেই পায়ের নীচে খানিকটা মাটি পেল দেবরাজ। ছবির একটা বাজার তো মিললই, জুটল আরও নানান ধরনের কাজ। দিল্লিতে তো মেলা, প্রদর্শনী লেগেই থাকে, সেখানে সরকারি বেসরকারি প্যাভিলিয়নের অন্তর্সজ্জা, হরেক কিসিমের দেওয়াল চিত্র নির্মাণ…। জীবনে পুনম আসার পর লতার সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষীণ। তবে পুরোপুরি মরেনি। বহতা ধারায় জল নেই, আছে বালি। হয়তো বা কিছুটা কাদাও। ঘৃণা আর ভালবাসার মিশ্রণে মজে আসা সেই সম্পর্কের চেহারা একটু বা অপ্রাকৃত।
তা সে যেমনই হোক না কেন, সব কিছু মিলিয়ে দেবরাজ তো খারাপ নেই। আর এক নারী মম্তার দৌলতে কলকাতার প্রদর্শনীটাও ভালই উতরোবে মনে হয়। আঁচল বলেছে, ওপেনিংয়ের দিন আসতে পারে। সেও তো এখন এক নারী। তার সঙ্গে দেখা হলে দেবরাজের কলকাতা আসাটা ষোলো আনা সার্থক হয়।
দেবরাজ আর একটা সিগারেট ধরাল। যদি আরও ক’টা ছবি বিক্রি হয়, তা হলে দিল্লি ফিরে প্রথম কাজ হবে গাড়িটা বদলানো। পাক্কা পাঁচ বছর হয়ে গেল, কেমন যেন পুরনো পুরনো লাগে, স্টিয়ারিংয়ে বসে তেমন সুখ নেই। এবার কি টয়োটার কোনও মডেল নেবে? নাকি হন্ডাতেই থাকবে?
হঠাৎ নিজের মনে হো হো হেসে উঠল দেবরাজ। এই সব নির্ভেজাল ভাবনা ছেড়ে অসীম কিনা তাকে দেশোদ্ধারে ভেড়াতে চায়। কাল দেবরাজের মগজ ধোলাই করবে? হা হ্।
৪
ক্লাস শেষ করে স্টাফরুমে পা রাখতেই আবার ফিরে এল দোলাচল। আঁচল কি আজ যাবে দেবরাজ সিংহরায়ের চিত্রপ্রদর্শনীর উদ্বোধনে? নাকি যাবে না?
আঁচল কষে ধমকাল নিজেকে। সিদ্ধান্ত তো নিয়েই ফেলেছে, কেন অহেতুক বাসনাটাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে সে?
চক ডাস্টার, অ্যাটেন্ডেন্স রেজিস্টার যথাস্থানে রেখে চেয়ারে বসল আঁচল। রুমালে হাতমুখ মুছতে মুছতে মন ঘোরাল অন্য দিকে। স্যারের কাছে কবে যাওয়া যায়? কাল মঙ্গলবার তো রথীন স্যার আসেন না, বুধবার সুপর্ণার বিয়ে, সকাল থেকে সেখানে বডি ফেলার কথা, গোটা দিন সেখানেই কাটবে। বেশি হাহা হিহি পোষায় না আঁচলের, কিন্তু ছাড়ান পেলে তো। স্কুলের বন্ধুরা যা জোর করছে। ইদানীং পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশার পাট তো চুকেই গেছে, গড়িয়া যাওয়া ইস্তক আর দেখাশোনাই হয় না। এইরকম কোনও উপলক্ষেই যা হঠাৎ হঠাৎ একত্র হওয়া। খারাপ লাগে না, তবে দিনটা তো বরবাদ। পরের দিনও কি আর বেরোতে ইচ্ছে করবে? শুক্রবার ফের কলেজ, শনি রবি ইউনিভার্সিটি বন্ধ, ব্যস সপ্তাহটা গন। বাপি যা ভয় পাচ্ছে, তা-ই ঘটবে নাকি? যেভাবে ছোট্ট ছোট্ট অজুহাতে দিন গড়িয়ে যাচ্ছে, আঁচল সত্যি সত্যি গেঁতো হয়ে যাবে না তো? ওদিকে পিসিমণি তো বিয়ে বিয়ে করে খেপেছে। সত্যিই যদি আঁচলকে ছাদনাতলায় যেতে হয়, তা হলে তো সব ভাবনারই ইতি।
চারটে বাজে। প্রকাণ্ড স্টাফরুম প্রায় ফাঁকা। জানলার ধারের টেবিলে দুই মাঝবয়সি অধ্যাপক আড্ডায় মশগুল। এ বছর এখনও কেন ভাল ফুলকপি উঠল না, তাই নিয়ে গবেষণা চলছে। দু’জনেই বাণিজ্য বিভাগের, জানে আঁচল, তবে কারও সঙ্গে তেমন পরিচয় নেই। দরকার না পড়লে ফুলটাইমারদের সঙ্গে আঁচলের মতো অতিথি অধ্যাপকদের বাক্যবিনিময় হয় না বড় একটা।
আঁচলের বেশ খিদে পাচ্ছিল। আজ তিনটে ক্লাস ছিল পরপর, তিনটেই অনার্স, ধকল তো কম নয়। ব্যাগ খুলে টিফিনবক্স বার করল আঁচল। মেনুটা আজ মন্দ দেয়নি মা। চিকেন স্যান্ডউইচ আর ডিমসেদ্ধ। ভালই হয়েছে, প্রদর্শনীতে যদি যায় আঁচল, ফিরতে তো একটু দেরি হবেই, পেট মোটামুটি ভরা থাকবে।
ফের আঁচল শাসাল নিজেকে। হচ্ছেটা কী? সেই ঘুরেফিরে আনসান ভাবনা? কোত্থাও যেতে হবে না। টিফিন সেরে সোজা বাড়ি।
স্যান্ডউইচে সবে কামড় বসিয়েছে আঁচল, দুপদাপ পায়ে পিয়ালির প্রবেশ। লাইব্রেরি থেকে এল মনে হয়, হাতে দু’খানা গাবদা গাবদা বই।
টেবিলে বই দু’খানা রেখে আঁচলের পাশটিতে বসল পিয়ালি। অমনি আঁচল বাড়িয়ে দিয়েছে টিফিনবক্স। ঝুঁকে টিফিনে চোখ বোলাল পিয়ালি, “না রে, ডিমে আমার অ্যালার্জি।”
“তো স্যান্ডউইচ নাও।”
পিয়ালির তাতেও উৎসাহ নেই। বলল,“না, তুই খা।”
“মুড অফ?”
“হবে না? যা সব শুনছি!”
“কী গো?”
“আমাদের ভাতে মারার ষড়যন্ত্র চলছে। লাইব্রেরিতে বলাবলি করছিল।”
আঁচলের চেয়ে বয়সে পিয়ালি খানিকটা বড়ই। বিষয়ও আলাদা। পিয়ালি অঙ্ক। তবে একই দিনে ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পাওয়ার সুবাদে দু’জনের একটা সখীত্ব গড়ে উঠেছে।
আঁচল চোখ কুঁচকে বলল, “ষড়যন্ত্র?”
“নয়তো কী? এমনিতে তো পার ক্লাস দেড়শো ঠেকায়, সেটুকুও আর নাকি জুটবে না।”
“কেন? আঁচলের মুখ নড়া থেমে গেল, “টাকার অ্যামাউন্ট কমিয়ে দেবে?”
“উঁহু। বেলপাতা শোঁকাবে।” গলা সামান্য চড়ে গিয়েছিল পিয়ালির, ঘরে উপস্থিত দু’জন সিনিয়ারকে দেখে নিয়ে স্বর নামাল, “নেক্সট গভর্নিং বডির মিটিংয়ে কী প্রস্তাব আসছে জানিস? দু-হাত্তা ছাঁটাই করবে গেস্ট লেকচারারদের।”
“যাহ, তা হয় নাকি?”
“হবে। প্রতি তিনজন গেস্ট লেকচারারের জায়গায় আসবে একজন কনট্র্যাক্টচুয়াল। তাকে থোক হাজার দশ পনেরো ধরিয়ে ফুল টাইমারের ডিউটি করিয়ে নেবে।”
“আমরা কী দোষ করলাম?”
“আমরা নাকি কোনও দায়িত্ব নিই না, ক্লাসটুকু করেই পালাই… খাতা দেখা, পরীক্ষা হল সামলানোর ঝক্কি এড়াতে চাই…”
“এ তো রং অ্যালিগেশন! এগ্জ়্যামের হ্যাপা তো অনেকটাই আমাদের ঘাড়ে চাপে।”
“আরে বাবা, কলেজ তো এখন আমরাই চালাই। হিসেব কর, কলেজে এখন ফুলটাইমার ক’জন? বোধহয় তেইশ জন। এদিকে পার্টটাইমার আর গেস্ট মিলিয়ে আমরা অন্তত পঞ্চাশ। তোদের হিস্ট্রির কী রেশিয়ো?”
“অনুপবাবু আর রীতাদি, দু’জন ফুলটাইমার। আর আমরা পাঁচজন।”
“অর্থাৎ টু ইজ টু ফাইভ। আমাদের অঙ্কে টু ইজ টু সিক্স। বাংলা, ইংলিশ ফিজিক্স কেমিস্ট্রি, সব ডিপার্টমেন্টে তো এক ছবি। ঘটা করে ভূগোল আর ইলেকট্রনিকস খোলা হল, সেখানে তো কোনও ফুলটাইমারই নেই।”
চাকরিটা আঁচল করে বটে, তবে ডানা না ভিজিয়ে। এই সব ব্যাপারস্যাপার নিয়ে সে মাথা ঘামায় না বড় একটা। এড়ানোর ভঙ্গিতে বলল, “কী করা যাবে বলো? সরকার যদি নতুন লোক না দেয়…”
“তা হলে নতুন নতুন বিভাগ খোলা কেন?”
“আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছ? আমি কী করে বলব?”
“তোকে নয়, নিজেকেই প্রশ্ন করছি। কী আহ্লাদের কথা তুই ভাব, এদিকে টাকার অভাবে গভর্নমেন্ট ফ্রেশ অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেবে না, ওদিকে কলেজ প্যাঁচ কষছে কীভাবে আমাদের ছেঁটে ফেলা যায়। বল তো, আমাদের তা হলে কী করে চলে?”
“কলেজে তো সমিতির লোকজন আছে। প্রবলেমটা তাদের বোঝানো যায় না?”
“তুৎ, স্যারদের ইউনিয়ন তো গভর্নমেন্টের ধামাধরা। আমাদের জন্য কেউ কিচ্ছু করবে না। নিজেদের মাইনেটা নাকি অনেক বাড়ছে, ওঁরা এখন তাতেই বিভোর।”
“অত গজগজ করছ কেন? আর একটা কলেজে তো পার্টটাইম করছ। সেখান থেকে তো হাজার ছয়েক পাও।”
“এবার হয়তো সেটাও যাবে।”
“তখন নয় দু’পা ছড়িয়ে কেঁদো।”
“টিজ় করছিস, অ্যাঁ? পিয়ালি রীতিমতো আহত, “অবশ্য তোর আর কী! তোর তো চাকরিটাই শখের। টাকা পেলেও হয়, না পেলেও চলে…।”
কথাটা মিথ্যে নয়। আবার পুরোপুরি সত্যিও তো নয়। চাকরি না করলে আঁচল অসুবিধেয় পড়বে না, এটা যেমন সত্যি, আবার প্রতিটা পদে বাপি বা মা’র কাছে হাত পাততে এখন বাধো বাধো ঠেকে, এটাও তো সমান সত্যি। রোজগার যত সামান্যই হোক, চাকরিটা আঁচলের কাছে আত্মনির্ভরতার একমাত্র উপায়ও তো বটে। ভেতরে ভেতরে একটা আর্তি অনুভব করছিল বলেই না কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে এখানে আবেদন ঠুকেছিল। গড়িয়া থেকে বাদুড়ঝোলা হয়ে শেয়ালদা, সেখান থেকে আধা ঘণ্টা ট্রেন, কতটা রাস্তা যে তাকে ঠেলে আসতে হয়। এভাবে দু’দফা ট্রেন ঠেঙানোটা মোটেই প্রসন্ন মনে মেনে নেয়নি মা। আর বাপির তো প্রথম দিন থেকেই ঘোর আপত্তি। এই চাকরির কোনও দরকার নেই, কাছেপিঠে কোথাও কিছু পেলে করো, নইলে পড়াশোনা চালিয়ে যাও…। অলি পর্যন্ত ঠাট্টা জোড়ে, কেন এক বাড়ি ঠিকে কাজের জন্য এত খেপে উঠলি রে দিদিভাই! এত প্রতিরোধ উপেক্ষা করে চাকরি করা কি নিছক শখশৌখিনতা? পিয়ালি যা বলছে, চাকরিটার আয়ু বুঝি ফুরোল। কী যে হবে!
মিহি উদ্বেগটুকু চাপা দিতেই যেন ঈষৎ প্রগলভ হল আঁচল। লঘু সুরে বলল, “তোমার চাকরিও তো শখের। নিশ্চয়ই তোমার টাকায় বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে না!”
“আমার সঙ্গে তোর তুলনা? তুই আছিস বাপের হোটেলে। আর আমি প্রতিপালিত হচ্ছি শ্বশুরের অন্নে। দু’টোতে কত তফাত, বিয়ে হলে বুঝবি।”
উত্তরে চাট্টি কথা শুনিয়ে দিতে পারত আঁচল। তোমার বর যখন চাকরিবাকরি করছে না, তোমারও রোজগার টলমলে, এমত অবস্থায় তোমরা গাঁটছড়া বাঁধলে কেন? বর যখন পিএইচ ডি করেও থামল না, জয়েন করল পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চে, কেন বাধা দিলে না তুমি? বলতেই পারতে, বিয়ের যদি সাধ জেগে থাকে, তো একটা পাকাপাকি বন্দোবস্ত করো। পিয়ালি নিজেই বা কী করছে? নেট তো দূরস্থান, কলেজ সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষাতেও বসছে না, স্কুলে চাকরির চেষ্টা করে দু-দু’বার গাড্ডু মারল -এমন মেয়েকে তো খানিকটা চাপে থাকতেই হবে। কর্মস্থলে। বাড়িতেও। কাঁদুনি গেয়ে লাভ আছে কোনও?
আঁচল অবশ্য কিছুই বলল না। তাকেও যদি বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়, একেবারে উপার্জনহীন হয়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়াটা কি ঠিক হবে? ছেলেটা নাকি মোটা মাইনে পায়, তবু ওই হাতেতালা হয়েই থাকা…
তিরতিরে ভাবনা নিয়ে টিফিনবক্স খালি করল আঁচল। টয়লেটে গিয়ে মুখেচোখে অল্প জল ছেটাল! রুমালে চেপে চেপে ঘষল মুখখানা। আয়নায় দেখছে নিজেকে। দর্পণে বিম্বিত আঁচলে মানসী প্রায় নেই-ই। না গায়ের রঙে, না মুখের আদলে। অমন টকটকে রং, পাতলা ঠোঁট, টানা টানা চোখ, দিঘল দেহকাণ্ড, মেয়েকে দেবে কোত্থেকে মানসী! সাদামাঠা গড়পড়তা চেহারা মানসীর। এই রূপসী কন্যাটি যে একান্তই দেবরাজের, তা যেন এক লহমায় ধরে ফেলা যায়।
আয়না থেকে দেবরাজের সেই মেয়ে আচমকা প্রশ্ন করে বসল, কী রে, যাচ্ছিস তো?
আঁচল চমকে উঠল, কোথায়?
নেকু। জানিস না যেন!
কেন যাব?
যাবি না-ই বা কেন? বড় মুখ করে তোকে ডাকল…
ওফ, আবার সেই টানাপোড়েন। আঁচল আয়না থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। যাবে? নাকি যাবে না? বাবার এগ্জিবিশন… কিন্তু… নামেই তো শুধু বাবা, আদতে বাপ মেয়ের কোনও সম্পর্ক আছে কী? যোগাযোগ বলতে মাসে দু’মাসে হাজার মাইল দূর থেকে ফোন, ক্বচিৎ কখনও কলকাতায় এলে ঝলক মুখ দেখিয়ে যাওয়া, ব্যস। এবার তো এল প্রায় চার বছর পর। না না, তেতাল্লিশ মাস। দার্জিলিঙে ওয়ার্কশপ সেরে ফেরার পথে একবার দর্শন দিয়ে গিয়েছিল আঁচলকে। তারিখটা ছিল এগারোই মে। মাঝে এই লম্বা সময়ে সাকুল্যে সতেরোটা ফোন। শুধু এইটুকুতে কতটুকু টিকে থাকে সম্পর্ক?
আঁচল কড়া চোখে আয়নার আঁচলকে দাবড়াল, একদম নয়। খেয়ালখুশি মতো আসবে, টুসকি বাজিয়ে ডাকবে, অমনি ল্যাল ল্যাল করে ছুটতে হবে? আঁচল অত সস্তা নয়।
খানিক সুস্থিত মেজাজে আঁচল স্টাফরুমে এসে দেখল, পিয়ালি যাওয়ার জন্য তৈরি। আঁচলকে তাড়া লাগাল, “কী রে, বেরোবি তো?”
আঁচল ব্যাগ কাঁধে তুলল, “চলো।”
কলেজ থেকে স্টেশন হাঁটাপথে মিনিট সাতেক। এই কলেজটা বয়সে প্রবীণ, তবে আকারে তেমন বিশাল নয়। মাত্র দু’খানা দোতলা বিল্ডিংয়ে গুঁতোগুঁতি করে বিজ্ঞান, কলা বাণিজ্য। দৃষ্টিসুখের জন্য একখানা মাঠ আছে কম্পাউন্ডে। কয়েকটা গাছপালাও। শীতের পদধ্বনি পেয়ে কেমন যেন শুকনো মেরে গেছে গাছগুলো। গেটের মুখে ঘোড়ানিমটাই যা ঝাঁকড়া এখনও। পড়ন্ত সূর্যের আলো মেখে সে ভারী মায়াবী এখন।
কলেজ চত্বরের বাইরে এসে পিয়ালির এতক্ষণের ক্ষোভ দুঃখ সহসা উধাও। ফিসফিস করে বলল, “এই আঁচল, ফুচকা খাবি?”
সামনেই ফুচকাওয়ালা। একদল ছেলেমেয়ে ঘেরাও করে রেখেছে আধবুড়ো লোকটাকে। অকারণ হাসির ফোয়ারা উঠছে ঘনঘন। সম্পর্কে ছাত্রছাত্রী হলেও আঁচল-পিয়ালির থেকে তারা কতই বা ছোট, তবু তাদের পাশে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়া কি মানায়? বিশেষত কলেজের সামনে?
চোখ পাকিয়ে আঁচল বলল, “তোমার না খিদে নেই? স্যান্ডউইচ খেতে বললাম, নিলে না!”
“তুৎ, কোথায় ফুচকা, কোথায় স্যান্ডউইচ! …বেশি নয়। জাস্ট চার পাঁচটা।”
“একটাও না। হাঁটো তো। এখানে দাঁড়ালেই আওয়াজ খাবে।”
অগত্যা হতাশ মুখে এগোল পিয়ালি। মোবাইল বার করে ঝট করে বরের সঙ্গে একটু প্রেমালাপ সেরে নিল। তারপর গোটা পথ একাই বকে চলেছে। অবিশ্রান্ত একঘেয়ে শাশুড়িনিন্দা। কত বিচিত্র পদ্ধতিতে তাকে হেয় করেন মহিলা, কীভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পিয়ালির রান্নার খুঁত বার করেন, শরীর খারাপের ছুতো দেখিয়ে কতবার ছেলে, ছেলে বউয়ের বেড়াতে বেরনো আটকে দিয়েছেন… শুনতে শুনতে আঁচলের কান ঝালাপালা। পিয়ালি যা বলে, সবটাই কি সত্যি? শাশুড়িমাত্রই পুত্রবধূর প্রতিপক্ষ? নাকি এ নেহাতই পিয়ালির হীনমন্যতার প্রতিফলন? রোজগারপাতির জোর না থাকলে অনেক সিধে আচরণও বাঁকা ঠেকে।
পলকের জন্য একটা চোরা আশঙ্কা দুলে গেল আঁচলের বুকে। আঁচলও ক’দিন পরে পিয়ালি হয়ে যাবে না তো?
তুৎ, যত সব আজেবাজে চিন্তা। বিয়েটা আদৌ হবে কিনা তারই স্থিরতা নেই। তা ছাড়া ছেলের মা তো নাকি অতি ব্যস্ত মানুষ, রাজনীতিতে ডুবে থাকেন অষ্টপ্রহর, পুত্রবধূর পিছনে ট্যাঁকট্যাঁক করার তাঁর সময় মিললে তো!
স্টেশনে পৌঁছে পিয়ালির হা-হুতাশ থেকে মুক্তি। প্ল্যাটফর্মে পা রাখতে না রাখতে ট্রেনও হাজির। অনেকটা লেট করেছে বলে ডাউন গাড়িতেও ভীষণ ভিড়। পরবর্তী গাড়ির প্রতীক্ষার প্রশ্নই নেই, আঁচল আর পিয়ালি ঠেলেঠুলে উঠে পড়ল মহিলা কামরায়। পিয়ালি নেমে গেল দমদমে, যাত্রীদের মাঝে একা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আঁচল। চতুর্দিকে এত মানুষ, আঁচল দেখছে না। কামরায় এত কোলাহল, আঁচল শুনতে পাচ্ছিল না।
কেন আবার এই উদাসীনতা? কোন চিন্তায় ফের ডুবল আঁচল? অতীত? বর্তমান? ভবিষ্যৎ? রিসার্চ? কলেজ? বিয়ে? নাকি দেবরাজের কথাই ভেবে চলেছে আবার?
সেই দেবরাজ, যাকে দু’-আড়াই বছরের পর দীর্ঘকাল আর চোখেই দেখেনি আঁচল। সজ্ঞানে যার সঙ্গে প্রথম মোলাকাত আট বছর বয়সে। দেবরাজ বিদেশ থেকে ফেরার পর। তার পিসিমণির বাড়িতে। প্রথম দর্শনে আঁচল তো মানুষটাকে চিনতেই পারেনি। কোন শৈশবে হুস করে উবে গিয়েছিল, নামের পাশে পদবিটুকু লেগে থাকা ছাড়া আঁচলের কাছে তার কোনও অস্তিত্বই ছিল না যে। বরং অনেক বেশি উজ্জ্বল হয়ে তখন ফুটে উঠেছে শান্তনু, যাকে ‘বাপি’ বলে ডাকতে শিখিয়েছে তার মা। এবং প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে তাকে মন থেকে পুরোপুরি মেনেও নিয়েছে আঁচল।
তো সেই প্রথম দিনই কী দেবরাজ ঝাঁকিয়ে দিয়েছিল আঁচলকে? বোধহয়। উঁহু, বোধহয় নয়, অবশ্যই। চেনাচিনির ধার ধারেনি, পাঁচ মিনিটেই উড়িয়ে দিল আঁচলের আড়ষ্টতা। একটা বিশাল লম্বাচওড়া মানুষ, অসম্ভব রূপবান, হাহা হাসছে, ঘর কাঁপিয়ে গমগমে গলায় গান গাইছে, আট ছুঁইছুঁই আঁচলকে একটা পুঁচকে টেনিস বলের মতো শূন্যে ছুড়ে দিয়ে লুফে নিল, চকাস চকাস চুমু খাচ্ছে, নাক ঘষে ঘেঁটে দিচ্ছে আঁচলের রেশম রেশম চুল…। মোড়ায় বসিয়ে পাঁচ মিনিটে আঁচলকে এঁকেও ফেলল অবলীলায়। এমন এক দুরন্ত বিস্ময়ের সামনে কতক্ষণ গুটিয়ে থাকতে পারে ওই বালিকা?
তারপর থেকে অবশ্য দেখা হত ঘনঘন। মানসীকে ফোন করে দিত দেবরাজ, বলেকয়ে এদিক সেদিক নিয়ে যেত মেয়েকে। চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, গঙ্গার পাড়, বোটানিকাল গার্ডেন…। লেক গার্ডেন্সের ফ্ল্যাটেও। নিজের হাতে কেক বানিয়ে খাওয়াত, চকোলেট, কোল্ড ড্রিংকসও চলত দেদার। অলি তখন এসে গেছে মানসীর কোলে, তাকে নিয়ে অনেকটা সময় উদ্ব্যস্ত থাকে আঁচলের মা। আঁচল টের পেত, মা বাপির ওপর আর তার একচ্ছত্র অধিকার নেই। তখনই বুঝি আঁচলের মনে হতে শুরু করে, দেবরাজের ভালবাসা কখনও ভাগাভাগি হবে না। দেবরাজ শুধুই আঁচলের একার।
সেই ধারণাই বা অটুট থাকল কই? দুম করে তো চলেও গেল দেবরাজ। দিল্লিতে। আঁচলের কতটা খারাপ লাগতে পারে তার তোয়াক্কা না করেই।
তারপরও গঙ্গা দিয়ে কোটি কোটি কিউসেক জল বয়ে গেছে। এক সময়ে দেবরাজের গুণপনা কিছুই জানত না আঁচল। কিন্তু তার কোনও কীর্তিকলাপই এখন আর মেয়ের কাছে গোপন নেই। দাদাই বলেছে, দিদুন বলত, মামা মামি কার মুখ থেকে না শুনেছে আঁচল! এমনকী পিসিমণিও তো কখনও সখনও…। মানুষটার হৃদয়ে মায়া মমতার বালাই নেই, নেশাড়ু, আত্মম্ভরী, রমণী দোষ আছে পুরো মাত্রায়, তার মাকে কুত্সিত অপমান করেছিল, বিনা কারণে তাকে পরিত্যাগ করে এক বাজে মহিলার সঙ্গে চলে গিয়েছিল আচমকা…। এখনও কাকে নিয়ে যেন দিব্যি ফুর্তিতে আছে। এমন একটা মানুষের প্রতি আঁচলের কি কণামাত্র দুর্বলতা শোভা পায়?
তবু আছে তো। তা সে আঁচল মানুক, ছাই না মানুক। এখনও শুধু গলাটা শুনলেই কেন যে হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে যায় আঁচলের? মুখোমুখি হলে তো বাক্যই হারিয়ে ফেলে। কতদিন তো ভেবেছে এবার সামনে পেলে তর্জনী তুলবে, কৈফিয়ত চাইবে প্রতিটি কুকীর্তির। ফোন করলেই কটকটিয়ে কথা শোনাবে। পেরেছে কী? লোকটা যে কী জাদু জানে! ডাক পাঠালেই কেন যে আঁচল বেভুল?
আজও কি আঁচল দমন করতে পারবে নিজেকে? সত্যি বলতে কী, আজ এগ্জ়িবিশনে যাওয়ার তো কোনও মানেই হয় না। ছবি দেখে তার কী মোক্ষ লাভ হবে? চিত্রকলার সে বোঝেটা কী? আর প্রদর্শনীর উদ্বোধন যদি সিনেমার প্রিমিয়ার গোছের কিছু হয়, তা হলে তো নিশ্চয়ই দেবরাজের নিজের জগতের লোকজন থাকবে। আঁচল তো সেখানে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়ে যেতে পারে। কে কী কৌতূহলী প্রশ্ন ছুড়বে, তার ঠিক আছে? এবার তো কলকাতায় নাকি থাকছে ক’দিন। পরে একসময়ে দেখা করলে হয় না?
শেয়ালদা এসে গেছে। ট্রেন থামার আগেই রে রে করে ধেয়ে আসছে মানুষজন। হিংস্র জন্তুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল কামরায় কামরায়। লেডিজ কম্পার্টমেন্টও ব্যতিক্রম নয়, বাঘিনীর ক্ষিপ্রতায় লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে মেয়েরা।
সরে দাঁড়িয়ে তাদের জায়গা করে দিচ্ছিল আঁচল। সাইক্লোন থামার পর নামল ধীরেসুস্থে। মানুষের জঙ্গল কাটিয়ে কাটিয়ে হাঁটছে।
বেশ খানিকটা গিয়ে সংবিৎ ফিরল। আরে, এ তো সাউথ স্টেশনের রাস্তা নয়! একদম বিপরীত পথে চলে এসেছে সে! শেয়ালদার বাইরে! ফ্লাইওভারের পাশে! এ কি সম্মোহিত দশা তার? কোথায় চলেছে বেহুঁশ পায়ে?
বড়সড় একটা শ্বাস ফেলল আঁচল। নাহ, অসম লড়াই চালিয়ে যাওয়া নিরর্থক। পার্ক স্ট্রিটের প্রদর্শনীতে যাওয়াটাই আজ তার নিয়তি।
দ্বিধাদ্বন্দ্ব মুছে যেতেই অদ্ভুত এক ভারহীনতার অনুভূতি। পাখির মতো উড়তে উড়তে বাসস্টপ অভিমুখে চলেছে আঁচল। বাবা সাতটা নাগাদ যেতে বলেছিল, সবে পৌনে ছ’টা। পার্ক স্ট্রিট এখান থেকে বড়জোর আধঘণ্টা, সে একটু বেশি তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবে না? তবে আর্ট গ্যালারিটাও তো খুঁজতে হবে। কাজটা সোজা নয়, বিশেষত সন্ধের পর। যা সব চিজ ঘোরে অঞ্চলটায়!
সাতপাঁচ ভাবনার মাঝে হঠাৎ পিছন থেকে হাঁক। আঁচল চমকে ঘুরেছে। অম্বরদা!
হা কপাল, এক্ষুনি বাড়ির কারও সঙ্গে দেখা না হলে চলছিল না?