ইন্দ্রাণীর বাবা-মা এমনকী জড়ভরত কাকাটি পর্যন্ত জেগে উঠেছে। ডাক্তারের বাড়িতে অধিক রাতে তোক ডাকতে আসা আশ্চর্য কিছু নয়, কিন্তু চেঁচামেচি স্বাভাবিক নয়। চাকর দরজা খুলে দিতেই ভাস্কর পাড়ার লোকের কৌতূহলী চোখ যতদূর সম্ভব এড়াবার জন্য তাড়াতাড়ি মণীশের পিঠে ঠেলা দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল।
ইন্দ্রাণীর বাবা বললেন, একী, মণীশ? কী হয়েছে?
ভাস্কর শুকনো গলায় বলল, ও একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
অমরনাথ একটু গম্ভীরভাবে বললেন, তা তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু এই অসুখের জন্য তো কেউ ডাক্তারের কাছে আসে না।
একমাত্র ইন্দ্রাণীই নীচে আসেনি। সীমন্তিনী সিঁড়িতে এসে দাঁড়িয়েছেন। এত রাত্রেও তিনি নেমে আসবার সময় সোনালি ফ্রেমের চশমাটা পরে আসতে ভোলেননি।
মণীশ দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে অল্প অল্প দুলছে। কর্কশভাবে বলল, আমি ইন্দ্রাণীর সঙ্গে দেখা করতে চাই।
ভাস্কর এমনভাবে অমরনাথের দিকে তাকাল যেন চোখের ভেতর থেকে দুটো হাত বেরিয়ে এসে জোড়া হয়ে ক্ষমা চাইছে। মৃদুগলায় বলল, আমি ওকে আটকাবার চেষ্টা করেছিলাম।
মণীশ আবার বলল, আমি… আমি ইন্দ্রাণীর সঙ্গে দেখা করতে চাই! সে কোথায়?
সীমন্তিনী শান্তভাবে বলল, ঠিক আছে, তুমি বোসা মণীশ, আমি ইন্দ্রাণীকে ডেকে দিচ্ছি।
সিঁড়ির কাছে কয়েকটা লম্বা লম্বা গদিমোড়া বেঞ্চ আর দু-একটা চেয়ার পাতা। একটা গোলটেবিলে কয়েকটা পত্রপত্রিকা ছড়ানো। সকাল বেলা রোগীরা ওইখানে বসে।
ভাস্কর মণীশকে নিয়ে বসাবার চেষ্টা করল। তার হাত ছাড়িয়ে মণীশ নিজেই বসতে গেল একটা চেয়ারে। অমরনাথ ঠিক সময় ধরে না ফেললে সে চেয়ারসুদ্ধই উলটে পড়ে যেত। তিনি একটা ধমক দিয়ে বললেন, বোসো চুপ করে।
মণীশ ঘোলাটে চোখ মেলে ধমকের উত্তর দিয়ে বলল, আমি আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে আসিনি। আপনি চোখ রাঙাচ্ছেন কী! ইন্দ্রাণী কোথায়?
অমরনাথ এবার মৃদুহাস্যে বললেন, একটা সিডেটিভ দিলেই ঠিক হয়ে যাবে!
ভাস্কর তাড়াতাড়ি সিঁড়ির ওপর উঠে গিয়ে বলল, ছোটোমাসি তুমি ইন্দ্রাণীকে এখন ডেকো না।
কেন?
ওর কী এখন মাথার ঠিক আছে? কী যা তা বলবে।
ও কি এমনিতে শান্ত হবে?
মেসোমশাই ওকে ঘুম পাড়িয়ে দেবেন?
মাথাটা বুকের কাছে ঝুঁকে পড়েছিল মণীশের, আবার মাথাটা তুলে হেঁড়েগলায় বলল, কোথায় ইন্দ্রাণী কোথায়? এখানে কি মানুষের সঙ্গে মানুষের কথা বলারও স্বাধীনতা নেই?
ভাস্কর শুধু ব্যাকুলভাবে বলল, ও যা খুশি বলুক। তুমি ইন্দ্রাণীকে ডেকো না।
একবার না-হয় দেখা দিয়ে যাক।
না, না। আমি বারন করছি। ও যা-তা বলবে, তুমি জানো না। এমনসব মিথ্যেকথা বলতে পারে, তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না!
অমরনাথ বললেন, মণীশ, এত রাত্রে বাড়ি ফিরবে কী করে? এই অবস্থায় বাড়ি ফেরা যায়?
আমার কোনো বাড়ি-ফাড়ি নেই। আমি হোটেলে যাব। কারুর বাবার হোটেল নয়!
আজ রাতটা তুমি এখানেই শুয়ে থাকবে।
ভাস্কর সীমন্তিনীকে বলল, ছোটো মাসি, তুমি ওপরে যাও! ওই তো মেসোমশাই বললেন —আমি আর উনি দু-জনে মিলে ওকে ঠিক ঘুম পাড়িয়ে দেব।
সঙ্গে সঙ্গে ভাস্কর মুখ তুলে দেখল, ওপরের সিঁড়িতে ইন্দ্রাণী দাঁড়িয়ে। হয়তো অনেক আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছে। সে হাত নেড়ে ইশারায় বলল, তুমি চলে যাও, তুমি চলে যাও।
ইন্দ্রাণী শুনল না, নেমে এল। একেবারে মণীশের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সে রাত-পোশাক পরেছিল, তার ওপরেই একটা শাড়ি জড়িয়ে এসেছে।
মণীশ তাকে দেখল কয়েক মুহূর্ত অপলকভাবে। যেন চোখের সামনে একটা পর্দা, সেটা সরাবার চেষ্টা করছে হাত দিয়ে। তারপর বলল, কে, ইন্দ্রাণী? আমায় চিনতে পারছ?
ইন্দ্রাণী বলল, হ্যাঁ।
না, চিনতে পারছ না। বাজেকথা। ঠিক করে বলল, চিনতে পারছ?
হ্যাঁ।
ফের বাজে কথা? এই কি আমার চেহারা?
তোমার কী হয়েছে মণীশ?
মণীশ? আমার নাম মণীশ নয়, আমার নাম দেবদাস, হ্যা, হ্যা, হ্যা, হ্যা।
তীব্র চিৎকারে হাসতে লাগল মণীশ। এ-রকম মজা যেন সে বহুদিন পায়নি। হাসতে হাসতেই বলল, তোমার বাবা-মা শকড, তাই না? হ্যা হ্যা হ্যা হ্যা। শোনো, তোমাকে আমি বলতে এসেছি, আমি তোমার কেউ না! আমি কেউ না তোমার
অমরনাথের ঠোঁটেও হাসি। তিনি রসিক পুরুষ। কখনো মুখ গোমড়া করে থাকেন না। ইতিমধ্যে তিনি একটা ইঞ্জেকশন তৈরি করে এনেছিলেন। ফিসফিস করে বললেন, দেবদাসই বটে!
তারপর জোরে বললেন, বাঃ, কথা শেষ হয়ে গেছে তো,। ডান হাতটা ধর তো!
ভাস্করই সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নেমে এসে মণীশের একটা হাত চেপে ধরল। মণীশ তখনও বলল, আমি তোমার কেউ না। এই যে, এই ছোকরা, এই যে ভাস্কর, তুমি ওর দিকে তাকাচ্ছ না কেন? আমি বলছি, ও—
ইঞ্জেকশনটা প্যাট করে ঢুকে যেতেই মণীশ বিকট চিৎকার করে উঠল। তারপর অমরনাথের দিকে এমনভাবে তাকাল যেন খুনই করে ফেলবে। কিন্তু সে আর কিছু বলার আগেই ভাস্কর তার মুখে হাত চাপা দিল।
অমরনাথ বলল, ওকে এই বেঞ্চটায় শুইয়ে দাও!
সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করলেন, ওখান থেকে পড়ে যাবে না?
একটু পরে ঘরের মধ্যে শুইয়ে দিলেই হবে। জুতোটা খুলে দিলে ভালো হয়। জামার বোতামগুলোও।
ভাস্কর নীচু হয়ে মণীশের জুতোর ফিতেয় হাত দিতেই মণীশ বলল, আমি বাড়ি যাব!
বাড়ি?
আমার যেখানে খুশি।
আজ আর নয়, কাল সকালে।
মণীশের শরীর অবশ হয়ে আসছে, আর জোর করতে পারছে না। নিজেই এলিয়ে পড়ল বেঞ্চে। বিড়বিড় করে বলতে লাগল, কেউ না, কেউ না। কেউ না।
সে একেবারে ঘুমিয়ে পড়তে ভাস্কর অমরনাথের দিকে তাকিয়ে বলল, খুব স্যাড, এত ব্রাইট ছেলে ছিল। শিলং-এ গিয়ে বাজে লোকজনের সঙ্গে মিশে মিশে
ইন্দ্রাণী তখনও দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে তাকিয়ে বলল, ওকে আটকাবার যে কত চেষ্টা করেছি, প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে।
অন্য সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। কেউই যেন মণীশের প্রসঙ্গে কোনো কথা বলতে চায় না। ভাস্কর ইন্দ্রাণীর দিকে ভয়ে ভয়ে আড়চোখে তাকাল।
ইন্দ্রাণী বলল, বুগোনদা, তুমিও থেকে যাও!
ভাস্কর শশব্যস্ত হয়ে বলল, অসম্ভব। বাড়িতে কোনো খবর দেওয়া নেই, বাবা-মা এতক্ষণ কী যে ভাবছেন! আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে।
ভাস্করের মুখের দীন কাঁচুমাচু ভাবটা কেটে গেছে, বরং খানিকটা উৎফুল্ল, কারণ সে শেষমুহূর্তে মণীশের মুখে হাত চাপা দিতে পেরেছিল।
মোটরবাইকের গর্জন তুলে ভাস্কর চলে গেল।
অমরনাথ চাকরের সাহায্য নিয়ে মণীশকে ধরাধরি করে এনে শুইয়ে দিলেন বসবার ঘরের টেবিলের ওপর। সীমন্তিনী বললেন, একটা বালিশ নিয়ে আয় তো ওপর থেকে।
টেবিলের ওপর হাত-পা ছড়ানো অবস্থায় মণীশের লম্বা চেহারাটা পড়ে রইল। পা দুটো একটু বাইরে বেরিয়ে এসেছে। ঝুলেপড়া একটা হাত সীমন্তিনী তুলে দিলেন বুকের ওপর। আলোটা নিভিয়ে দিতে দিতে অমরনাথ বললেন, কাল আটটার আগে আর ওর ঘুম ভাঙবে না।
বাইরে বেরিয়ে এসে সীমন্তিনী মেয়েকে বললেন, তোর মন খারাপ লাগছে?
ইন্দ্রাণী ফ্যাকাসেভাবে হাসল। তারপর বলল, না, মন খারাপ হবে কেন? আমি তো জানতাম!
অমরনাথ বললেন, এক-একজন মানুষের এ-রকম হয়। নিজেকে ধ্বংস করার একটা নেশায় পেয়ে বসে।
ওপরে যে-যার ঘরে শুতে চলে গেল। ইন্দ্রাণীর এখন ঘুম আসবে না। অনেকটা নিয়মরক্ষার মতন সে একটা বই খুলে রাখল বুকের ওপর। প্রতিটি শব্দ সে বানান করে পড়তে শুরু করল, যে করে হোক মন বসাতেই হবে। আশ্চর্য, মণীশের চেয়ে ভাস্করের কথাই তার মনে পড়ছে বেশি। ভাস্করের নীরব বিষণ্ণ মুখ। মণীশকে সে কখনো বিষণ্ণ হতে দেখেনি। ইন্দ্রাণী যখন মণীশকে সব কিছু দিতে চেয়েছিল, তখনও ভাস্করের জন্য তার মনের মধ্যে একটা ব্যথা ব্যথা ভাব হত।
ইন্দ্রাণী আর একটা কথা ভেবেও অবাক হল। মণীশ যতই বদলে যাক, শুধু তাকে একবার চোখের দেখাতেই যে সে এত আনন্দ পাবে, সে তা জানত না। নীচে নেমে গিয়ে সে যখন মণীশের সামনে দাঁড়াল, সে তখন এত নেশাগ্রস্ত যে মানুষই বলা যায় না। তবু, তাকে সেই অবস্থাতে দেখেও ইন্দ্রাণীর শরীরে একটা চাপা আনন্দ বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। তিন বছর বাদে, শুধু চোখের দেখা।
ভোররাত্রির দিকে ইন্দ্রাণী আবার বেরিয়ে এল ঘর থেকে। ঘুম যখন আসবেই না, তখন আর শুধু শুধু শুয়ে থেকে লাভ কী! শেষরাত্রির গাঢ়ঘুমে সারাবাড়ি নিস্তব্ধ। ইন্দ্রাণী নেমে এল নীচে।
মণীশের পাশে দাঁড়িয়ে দেখল সে ঠিক একভাবেই শুয়ে আছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় শরীরে প্রাণ নেই। ইন্দ্রাণী তার বুকে হাত রাখল, নিশ্বাসে দুলছে ঠিকই এবং উষ্ণ শরীর।
মণীশের চিবুকে হাত রেখে ইন্দ্রাণী ডাকল, এই, এই!
কয়েকবার তাকে ধরে ঝাঁকাতেও সে জাগল না। জাগবেও না এখন। সে এখন ওষুধে নিদ্রিত।
ইন্দ্রাণী মণীশের ঠোঁটে, গালে, গলায় হাত বুলোতে লাগল। বেশ রোগা হয়ে গেছে মণীশ, সে টের পায়। হাড়গুলো বেরিয়ে এসেছে। বুকের জামাটা অনেকখানি ফাঁক করে বুকটা দেখতে লাগল। তারপর ইন্দ্রাণী সেখানে এমনভাবে হাত বুলোতে লাগল যেন সে একটা স্লেটের ওপর থেকে লেখা মুছে দিতে চাইছে। মণীশ বলেছিল।…
মোটা বেল্ট পরে আছে মণীশ। বেল্টটা আলগা করে দিল ইন্দ্রাণী, তারপর চোখের পাতায় আলতো করে হাত বুলোতে লাগল, যদি সে জাগে। কিছুতেই জাগল না। যেন টেবিলের ওপর শুয়ে আছে চুম্বকে তৈরি এক নীরব দেবতা।
আবার অবাক হল ইন্দ্রাণী। মণীশকে শুধু ছুঁয়েই তার এত আনন্দ? তিন বছর পর, সামান্য একটু স্পর্শ, তাও চেতনাহীন শরীরে, তাতেই ইন্দ্রাণীর ভেতরটা ঝনঝন করে বাজছে। নিজে থেকে সে তো মণীশকে কখনো কিছু দেয় নি। এখন মণীশ কিছু জানবে না বলেই সে তাকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিল। চুমু খেল ঠোঁটে, গলায়, বুকে। মণীশের হাতটা তুলে রাখল নিজের বুকে। অসহ্য ভালো লাগায় তার যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে। মণীশের পায়ে সে চেপে ধরল তার মুখ।
একটু পরে ইন্দ্রাণী মণীশের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।