মণিকেই আজ বাজারে যেতে হবে। সেইজন্য সে আজ সকালে উঠেই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়া শুরু করেছে। বাজারে যেতে তার একটুও ভালো লাগে না। বাসন্তী থলিটা হাতে নিয়ে দরজার কাছে দাঁড়াতেই সে বলল, আজ ডিমসেদ্ধ দিয়ে চালিয়ে দাও-না।
ওমা, তরকারিপাতি কিছু নেই যে!
আলুওয়ালা আসবে না একটু বাদে?
তার কি কোনো ঠিক আছে? যা একটু চট করে ঘুরে আয়।
-তোমরা কি আমাকে পড়াশুনো করতে দেবে না?
-ইস, কত পড়াশুনোয় মন। এই শনিবারই তো আমরা ফিরে যাচ্ছি মুনশিগঞ্জে, তখন আবার পড়বি। ভালো দেখে চিংড়ি মাছ নিয়ে আয় তো—আমাদের ওদিকে তো তেমন ভালো পাওয়া যায় না।
মণিকে উঠতেই হল। বারান্দায় এসে চটি খুঁজছে, তখন নিভা বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। তিনি বললেন, মণি বাজারে যাচ্ছিস নাকি? দাঁড়া টাকা দিচ্ছি।
বাসন্তী বলল, আমি টাকা দিয়ে দিয়েছি মা!
তুই টাকা দিবি কেন? আমার কাছে তো বাজারের টাকা রেখে গেছেন উনি।
বাসন্তী খুব সন্তর্পণে বলল, একদিন আমি টাকা দিতে পারি না? একদিন আমার ইচ্ছে করে না তোমাকে কিছু ভালো-মন্দ খাওয়াতে!
বাবা থাকলে বাসন্তী টাকাপয়সার কথা উচ্চারণ করতেই ভয় পায়। সে নিজে থেকে কিছু জিনিস কিনলেই নিশানাথের তীক্ষ্ণদৃষ্টি তা ধরে ফেলে। তিনি রাগ করেন। মেয়ে বাপের বাড়ি বেড়াতে এসেছে। সে টাকা খরচ করবে কেন?
তা ছাড়া বাসন্তীর আরও একটা সংকোচ আছে। তার স্বামী সঞ্জয় গত কয়েক বছরে হঠাৎ অনেক টাকাকড়ি করেছে। বিয়ের সময় তার সাধারণ অবস্থা ছিল। চাকরি ছেড়ে সে এক বন্ধুর সঙ্গে পার্টনারশিপের ব্যবসায় নেমে সার্থক হয়ে উঠেছে খুব তাড়াতাড়ি। নিশানাথ ব্যাপারটা সুনজরে দেখেননি। গতবছর সঞ্জয় এসে খানিকটা বড়লোকি চাল দেখাবার চেষ্টা করেছিল বলে বিরক্ত হয়েছিলেন রীতিমতন।
বাসন্তী আর একটা ব্যাপারেও ভয় পায়। বাবাকে সে ভালোরকম চেনে। তার মনে হয় বাবা বোধহয় জামাইকে আজকাল সন্দেহ করতে শুরু করেছেন। বাসন্তীও স্বামীর ব্যবহারে বিশেষ ভরসা পায় না। সঞ্জয়কে প্রায়ই নেপালে যেতে হয়, যখন-তখন সবসময়েই একটা ব্যস্ত ভাব। সঞ্জয় যতবারই নেপাল থেকে ফেরে, মুখ-চোখের চেহারা ঠিক স্বাভাবিক থাকে না, চোখের দৃষ্টি চঞ্চল, ছেলে-মেয়েকে সেই সময় বেশি আদর করে—অনেকটা আদিখ্যেতা মনে হয়, এমনকী সে রান্নাঘরেও গিয়ে উঁকি মারে, কী কী রান্না হচ্ছে তার খোঁজ নেয়—যেন সে সংসারজীবনটাকে বেশি ভালোবেসে ফেলেছে। সঞ্জয় জামা খোলার সময় বুকপকেট থেকে খুচরো পয়সা পড়ে গেলে সেগুলো আর নিজে তোলে না। বাসন্তী বুঝতে পারে, তার স্বামী বদলে যাচ্ছে, এখন আর সঞ্জয়কে বাসন্তী ঠিক চিনতে পারে না। সঞ্জয় ব্যাঙ্কে টাকা রাখে না, আজকাল প্রায়ই বাসন্তীর জন্য সোনার গয়না উপহার আনে, আগে কখনো এসব কিনত না। বাসন্তীর ভয় হয়, বাবা যদি এসব জানতে পারেন!
বাসন্তীর বিয়ে হয়েছিল খুব অল্প বয়সে। তখন সব কিছু বোঝার মতন অবস্থা ছিল না, বাধা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না, কিন্তু এখন ভাবলেই কান্না পায়। বাবা তার বিয়ে দেওয়ার জন্য প্রায় সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন। মায়ের সমস্ত গয়না বিক্রি করে, প্রভিডেন্ট ফাণ্ড থেকে ধার করে তার জন্য সংগ্রহ করা হয়েছিল একটি স্বামী। অনেক দেখেশুনে পাত্র নির্বাচন করেছিলেন নিশানাথ, গরিব ঘরের ছেলে, কিন্তু পড়াশুনোয় ভালো, সচ্চরিত্র, সদ্য রেলে চাকরি পেয়েছে। এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার দরকার ছিল না—কিন্তু বাসন্তী তখন ফাস্ট ইয়ারে পড়ে, কলেজের একটি ছেলের পীড়াপীড়িতে সে একদিন তার সঙ্গে পাবলিক রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল চা খেতে। ছেলেটার নাম কমল, বড্ড আবোল-তাবোল বকত, আর সিগারেট খেত কী, একটা শেষ হতে-না-হতেই আর একটা। চা খাওয়ার পর মশলা চিবোতে চিবোতে বাসন্তী কমলের সঙ্গে বেরোচ্ছিল রেস্টুরেন্ট থেকে, এমন সময় বাবার সামনে পড়ে গিয়েছিল। যেন সামনে একটা বাঘ।
এখন বাসন্তীর নিজের গালেই চড় মারতে ইচ্ছে করে। কেন সে ওই পাগলা ছেলেটার কথা শুনে গিয়েছিল চায়ের দোকানে? বাবা-মাকে সে কিছুতেই বোঝাতে পারেনি যে মাত্র সে ওই একদিনই গিয়েছিল, আগে আর কোনোদিন যায়নি, কোনো পর্দাঘেরা ক্যাবিনেও বসেনি। কমলের সম্পর্কে তার কোনো দুর্বলতাও ছিল না, নেহাত ছেলেটা নাছোড়বান্দা, তাই ভদ্রতা করে শুধু। ওই বিচ্ছিরি ব্যাপারটা না হলে বাসন্তী আরও পড়াশুনো করতে পারত। বি এটা অন্তত পাস করলে কোনোরকম চাকরি জুটিয়ে নিজেদের সংসারে সাহায্য করতে পারত অন্তত কিছুদিন। বাসন্তীর অত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে দাদা ঝগড়া করেছিল বাবার সঙ্গে। কিন্তু নিশানাথ দারুণ একগুঁয়ে, কারুর কথাই শুনলেন না।
বিয়ের পর স্বামীর সংসারে গিয়ে বাসন্তী খুশিই হয়েছিল। ছোট্ট সংসার, শাশুড়ি, আর একটি অল্পবয়েসি দেওর-কেউ একদিনের জন্যও একটু খারাপ ব্যবহার করেনি। আর সঞ্জয় এত ভালোবাসত যে এক-এক সময় হাঁপিয়ে উঠত বাসন্তী, তার ভয় হত, এই সুখ কী সইবে? সুখ কি বেশিদিন থাকে এক জায়গায়?
সঞ্জয়ের স্বভাবে কোনো খাদ ছিল না। সে তার সহকর্মীদের মতন তাস খেলে বেশিরাত্রে বাড়ি ফিরত না, কুৎসিত কথা উচ্চারণ করত না। দু-টি ছেলে-মেয়ে হওয়ার পর তাকে প্রায়ই টাকাপয়সার জন্য চিন্তিত দেখা যেত। ছেলে-মেয়ে দু-টিকে মানুষ করতে হবে, টাকাপয়সায় ঠিক মতন কুলোয় না। আলাদা রোজগারের জন্য কিছুদিন সন্ধ্যের দিকে একটা কোচিং ক্লাস চালাতে শুরু করেছিল সঞ্জয়। আস্তে আস্তে জেগে উঠল তার লোভ। তাকে ছুঁয়ে দিল স্বর্ণবিষ।
বাসন্তীর জীবনে তার বাবার প্রভাবই বেশি। ছেলেবেলা থেকেই সে জানে, যেকোনো একটা শাড়ি হলেই মেয়েদের চলে যায়। নতুন একটা শাড়ি পরলে বেশ ভালো লাগে ঠিকই, বাসন্তীর খুব ভালো লাগে নতুন শাড়ির গন্ধ, কিন্তু নতুন শাড়ি না পেলেও দুঃখ করার কিছু নেই। মনে আছে, অনেকদিন আগে, তখন তাদের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল, মায়ের কঠিন অসুখের জন্য চিকিৎসাতেও অনেক টাকা লেগেছিল, সে-বছর পুজোর সময় বাবা বলেছিলেন, তিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে মাত্র একজনকে নতুন জামা কিনে দিতে পারবেন। কে নেবে সেটা লটারি করা হোক। অতিউৎসাহে কাগজে নাম লিখে লিখে লটারি করেছিল খোকন। বাসন্তীরই নাম ওঠায় বাসন্তী খুব দুঃখিত হয়েছিল। দাদার সব কটা জামা ছেঁড়া, দাদারই একটা নতুন জামা দরকার। বাসন্তী বলেছিল, দাদা, আমি শাড়ি কিনব না, তুই বরং একটা জামা কেন। দাদা দারুণ অহংকারী, ঠোঁট উলটে বলেছিল, যা, যা!
বিয়ের আগে বাসন্তী কোনোদিন গয়না পরেনি, স্নো-পাউডার মাখেনি। সে বিশ্বাস করত, খুব ভালো করে পেঁয়াজ-পেঁয়াজ দিয়ে ধোঁকা রান্না করলে ঠিক মাংসের মতন লাগে। মাসে একদিন অন্তত দুধ না খেলে কুকুর-রুচি হয়ে যায় বলে, মাসের সেই একদিনটা ছিল কত আনন্দের। কোলাপুরি চটি ছেলে-মেয়ে সবাই পরতে পারে বলে নিজের চটি ছিঁড়ে গেলে সে ছোটো ভাইয়ের চটি পরেই রাস্তায় বেরোতে পারত। প্রথম যেদিন সে দাদাকে সিগারেট খেতে দেখে সেদিন সে আঁতকে উঠেছিল একেবারে। সিগারেট খাওয়া মানে তো টাকাপয়সা ইচ্ছে করে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা! তার বিস্মিত মুখ দেখে তার দাদা খিচিয়ে বলেছিল, যা, যা, তুই তো বাবার আদুরে মেয়ে, এক্ষুনি নালিশ করে আয়। যা না—
এবার বাপের বাড়িতে আসবার সময় তার স্বামী তাকে পাঁচশো টাকা সঙ্গে দিয়েছে হাতখরচার জন্য। তার হাতবাক্স ভরতি গয়না, সুটকেশ ভরতি ডজন ডজন শাড়ি। কোনো টাকাই তার খরচ হয়নি। তিনখানার বেশি শাড়ি বার করেনি। তার লজ্জা করে। সে চায় এই সংসারে কিছু সাহায্য করতে, তার ঋণ শোধ করতে। কিন্তু করবার উপায় নেই।
নিভা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বাজারের জন্য তিন টাকা, সব হিসেব করা।
মণি গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কী আনব?
নিভা বললেন, যা ভালো বুঝিস, নিয়ে আয় না। একটু তরকারি, একটু মাছ—
বাসন্তী হেসে বলল, ও বাজার করার কী বোঝে? ভাগলপুরে ও কোনোদিন বাজারে যায় নাকি? তার চেয়ে বরং আমি যাই!
না, না, তোর যাওয়ার দরকার নেই। ও যা পারে আনুক, তাই দিয়ে চালিয়ে দেব। কাল তো উনিই বাজার করবেন।
বাসন্তী ভাবল, ওই তিন টাকার মধ্যে মাছ আনতে গেলে তেলাপিয়া ছাড়া আর কোনো মাছ জুটবে না। মণি ওইসব আজেবাজে মাছ একদম খেতে পারে না। বেচারা ছেলেমানুষ, বাজারে গিয়ে দিশেহারা হয়ে যাবে।
বাসন্তী মৃদুভাবে বলল, মা, আমার বুঝি তোমাকে একদিন একটু ভালো-মন্দ খাওয়াতে ইচ্ছে করে না? আমি তোমার জন্য আজ ক-টা বড়ো চিংড়ি মাছ আনব।
না, না। চিংড়ি মাছের অনেক দাম আজকাল।
তা হোক-না, একদিন তো! তুমি তো চিংড়ি খেতে খুব ভালোবাসতে। সেই মনে আছে, বড়োমামা একবার ক্যানিং থেকে গলদা চিংড়ি এনেছিলেন, কী বিরাট, জানিস মণি, পা গুলোই এত বড়ো বড়ো, মাথা ভরতি ঘি—সেবার যা হইচই হয়েছিল!
নিভা ক্লান্তভাবে হেসে বললেন, আজকাল আর আমার অত মাছ খেতে ভালো লাগে না।
হঠাৎ থেমে গিয়ে নিভা বাসন্তীর মুখের দিকে তাকালেন। কিছু একটা মনে পড়ে গেল। তিনি বললেন, তোদের মুনশিগঞ্জে ভালো চিংড়ি মাছ পাওয়া যায় না, নারে?
বাসন্তী কিছু বলবার আগেই মণি বলল, অতবড়ো চিংড়ি আমরা কখনো দেখিইনি।
বাসন্তী একেবারে শিউরে উঠল। কিন্তু আর বুঝি কিছু করার নেই। নিভা আবার ঝট করে ঘরে ঢুকে গেলেন। ফিরে এলেন আগেকার আমলের বড়োসাইজের একটা মলিন দশ টাকার নোট হাতে নিয়ে।
মণিকে বললেন, যা তো মণি, আজ ক-টা বড়ো দেখে চিংড়ি নিয়ে আয়। যত বড়ো পাবি–তরকারিপাতি বেশি আনতে হবে না।
বাসন্তী মায়ের হাতটা চেপে ধরে বলল, মা, তুমি টাকাটা রাখো। আজ আমি দিই…আমি নিজে খাওয়ার জন্য বলিনি!
নিভা বিস্মিতভাবে বললেন, তুই দিবি কেন? আমার কাছে রয়েছে তো; মণি তুই যা
মণি বেরিয়ে গেল। ধড়াম করে দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ শোনা গেল নীচে।
ওরকম যখন-তখন পয়সা খরচ করিস না। ছেলে-মেয়েরা এখনও ছটো, দুটো পয়সা যদি বাঁচাতে পারিস, তাই দেখবি। জামাইটা তো খেটে খেটে মুখে রক্ত তুলছে।
বাসন্তী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার কান্না এসে যাচ্ছে। তার বোকামির জন্য মায়ের জমানো আরও দশটা টাকা খরচ হয়ে গেল। কেন সে চুপি চুপি আগেই মণিকে পাঠিয়ে দেয়নি। মা কী ভাবলেন, সে তার নিজের লোভানির জন্য চিংড়ি মাছের কথা তুলেছিল।
মণির তোপইতে দিবি, তখন তো আমরা ভাগলপুরে যাবই! তখন তোর যত ইচ্ছে খাওয়াবি আমাদের।
বাসন্তী মায়ের দিকে তাকাতে পারছে না। মুখ ফিরিয়ে আছে। শুধু পইতে উপলক্ষ্যে কেন, সে কি এমনিতে তার মাকে-বাবাকে-ভাইদের নিয়ে যেতে পারে না নিজের বাড়িতে? আগে সে প্রত্যেক চিঠিতে অনুরোধ করত। এখান থেকে ফেরবার সময় জোরাজুরি করত, একবার তো মাকে নিয়েও গিয়েছিল। খোকন গেছে তিন বার। কিন্তু আজকাল আর বাসন্তী নিজেই চায় না তার বাপের বাড়ির কেউ মুনশিগঞ্জে যাক।
সঞ্জয় ইদানীং মদ ধরেছে। নিজে খুব বেশি খায় না, তবে প্রতিদিনই খেতে হয় এবং ব্যাবসার বন্ধুবান্ধবদের খাওয়াতে হয়। সঞ্জয় বাসন্তীকে বুঝিয়েছে যে ব্যাবসার সুবিধের জন্য এটা করা দরকার, আজকাল প্রায় সবাই করে।
কয়েকদিনের জন্য সঞ্জয়ের মদের আসরটা বন্ধ রাখা গেলেও আরও অনেক দিকে যে সঞ্জয়ের অনেক বদল হয়েছে, তা মা ঠিকই বুঝে যাবেন। মা চুপচাপ থাকলেও সব বোঝেন। বাবার সবরকম খামখেয়ালিপনা মা মেনে নেন। এমনকী নিজের ছেলে-হারানোর দুঃখও মেনে নিয়েছেন।
বাসন্তীর বেশি রাগ হয় দাদার ওপর। দাদা যদি অত গোঁয়ারগোবিন্দ না হত, সব সময় মাথাগরম না করত, তাহলে সব কিছুই বদলে যেতে পারত। দাদাকে সবাই বলত প্রতিভাবান, পড়াশুনো কোনোদিন মন দিয়ে না করলেও সব পরীক্ষায় পাশ করে যেত টপটপ করে। দাদা জীবনে উন্নতি করতে পারত ঠিকই, কিন্তু রাগের সময় একেবারে পাগলা কুকুরের মতন হয়ে যায়, একমুহূর্তে সব বদলে ফেলে! কাপুরুষের মতন দাদাটা পালিয়েই গেল। দাদাই একমাত্র পারত মায়ের মনে শান্তি এনে দিতে। ইন্দ্রাণীর মতন মেয়ে যদি আসত এবাড়িতে তাহলে বাসন্তী দূর থেকেও নিশ্চিন্তে থাকত যে, তার বাড়ির লোকেরা স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে আছে। বাবার কোনো আশাই জীবনে ঠিকমতো মিলল না। সঞ্জয়ের সব কথা জানতে পারলে বাবা যে আরও কত দুঃখ পাবেন, সেকথা ভাবলেই বাসন্তীর বুক মুচড়ে ওঠে।
দুপুরের খাওয়াটা জমল না। মণি বারো টাকা দিয়ে তিনটে বড়ো গলদা চিংড়ি কিনে এনেছিল। কিন্তু ঘিলু পচা। ছেলেমানুষ পেয়ে তাকে ঠকিয়েছে। একমাত্র মণিই গন্ধওয়ালা মাছ মহাআহ্লাদে চেটেপুটে খেল। ঝুমাকে সেই মাছ খেতেই দিল না বাসন্তী।
খাওয়া সদ্য শেষ হয়েছে। তখনও হাত ধোওয়া হয়নি, এমন সময় দরজায় কড়া নড়ে উঠল।
দরজা খুলে দিতে গিয়ে মণি চেঁচিয়ে উঠল, বাবা এসেছে, বাবা এসেছে!
ছেলের হাত ধরে সঞ্জয় ওপরে উঠে এল। সঙ্গে একগাদা জিনিসপত্র। সঞ্জয়ের আসার কথা ছিল না। ট্রেনে তুলে দিলে বাসন্তী ছেলে-মেয়েদের নিয়ে অনায়াসে চলে যেতে পারে।
সঞ্জয় হাসিমুখে বলল, হঠাৎ চলে এলাম, তোমাদের নিয়ে যেতে। ঝুমা কোথায়? ঝুমাকে দেখছি না।
নিজের স্বামীকে প্রায় একমাস পরে দেখেও খুশি হতে পারল না বাসন্তী।
এই একমাসে আরও অনেকটা যেন বদলে গেছে সঞ্জয়। মুখ-চোখে একটা ধূর্তের ভাব ফুটে উঠেছে। বোধ হয় এরমধ্যে আরও অনেক টাকা রোজগার করেছে।
বাসন্তীর বুক থেকে একটা ভয়ের দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।