১.৪ আপন ঘরে পরের আমি

‘আপন ঘরে পরের আমি’

সব জিনিসের মতো লোকসংস্কৃতি চর্চাতেও ভেজাল থাকে। হয়তো দেখা গেল ফিটফাট অধ্যাপক বা সপ্রতিভ সাংবাদিক গ্রামের মেলায় হঠাৎ হাজির। অজ পাড়াগাঁ-র কোনও গ্রাম্য দেবতার পার্বণী বা দিবসী অনুষ্ঠান হচ্ছে। কস্মিনকালেও কেউ এ সব উৎসবে যেত না। গত কয়েক দশক কেন যেন এ সব দিকে সংস্কৃতিসেবীদের একাংশ ঝুঁকে পড়েছে। একজন কেটো সংস্কৃতিবিদ্‌ একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘মশায়, এখন দু’বিষয়ে খুব ক্রেজ, ফোক আর ফরেন। যে কোনও ফরেন জিনিসে দেখবেন লোকের খুব আস্থা। তেমনই ফোক এলিমেন্ট থাকলেই তার আদর। বাঁকুড়ার ঘোড়া, পুরুলিয়ার ছৌ-মুখোশ, মধুবনী এপ্লিক, বীরভূমের বাউলগান, সাঁওতালি নাচ সব গর গর করে চলেছে।’

কিন্তু এইসব ফোক এলিমেন্টেও যে কত ভেজাল থাকে তা জানতাম না তেমন। বহু বছর ধরে বহুরকম বাউল-ফকির-সহুজে বোষ্টম ঘেঁটে এখন বুঝেছি ওই সব লোকজনের মধ্যে দু-নম্বরি চিজ বহুৎ আছে। হয়তো নিতান্তই গেঁজেল কিংবা কাম-পাগল, ম-কারান্তবাদী বা স্রেফ পারভার্ট অনেকে আছে। কিছু জিজ্ঞেস করলেই শিবনেত্র হয়ে বলে, ‘ও সব নিগুঢ় ব্যাপার কি সহজ?’ কতকগুলো বস্তাপচা কথাও আছে। যেমন— দমের কাজ, পঞ্চভূত, ইড়াপিঙ্গলা সুষুম্না, ত্রিবেণী, পিড়েয় বসে পেঁড়োর খবর, গুপ্তচন্দ্রপুর, মুর্শিদাবাদ, গুপ্তিপাড়া, ছটা ছুঁচো, বাহান্ন বাজার তিপান্ন গলি। এ সব কথা শুনতে শুনতে কান পচে গেছে। মুশকিল যে, এই ধরনের ক্লিশে বাউল-ফকিরদের লাইনে এত আছে যে একআধটা ঝকঝকে শব্দ বা বাক্যবন্ধও অনেক সময় ঘুলিয়ে যায়; হারিয়ে যায়। বাংলাদেশের এক অনামা মাজারে বাউলের গানে শুনেছিলাম: ‘আপন ঘরে পরের আমি’। শুনে একেবারে সারা গায়ে ঝিলিক খেলে গেল। সব শিল্পে, বলতে গেলে, এই ঝিলিকই আমরা খুঁজি। পাই অবশ্য ক্কচিৎ।

আরেক রকমের অভিজ্ঞতাও হয়। প্রথম শুনে যে সব সরল লোকগান মনে হয় কী আর এমন, হয়তো দশ-পনেরো এমনকী বিশ বছর পরে সে গানের অন্তঃপুর সহসা খুলে যায়। যেন বইয়ের পাতায় শুকিয়ে-যাওয়া চাঁপাফুল। গন্ধ নেই বর্ণ নেই তবু যেন মন-কেমনিয়া। আসলে রূপকথার গুপ্তধনের দরজা খুলতে গেলে যেমন বলতে হয় সাংকেতিক মন্ত্র তেমনই বেশ কিছু বাউল বা ফকিরি গানের মর্ম লুকিয়ে থাকে আশ্চর্য সব গূঢ় শব্দে। সেই শব্দ ভেদ করতে দশ-বিশ বছর লাগাও বিচিত্র নয়। এই ফকিরদের জগতে ‘পীর-মুরিদ’ বলে একটা সম্পর্ক চলিত আছে। অর্থাৎ কিনা গুরু আর চ্যালা। এই নিয়ে মারফতি ফকিরদের সঙ্গে মোল্লাদের লড়াই চলছে বহুদিন। কট্টর মোল্লারা বলেন আল্লাকে পেতে গেলে সরাসরি পেতে হবে। ওসব গুরু মুর্শেদ হল হিন্দুয়ানির প্রভাব। মারফতিরাও কোরান খুলে দেখিয়ে দেন যে এক জায়গায় মুর্শেদ গ্রহণের ইঙ্গিত রয়েছে তাতে। আমার অতশত বাহাসে যাবার দরকার কী? তবে আমি এইটা সার বুঝেছি যে ফকিরি গান আর বাউল গানের অনেক অংশ, বহু শব্দ আমি বুঝতে পারতাম না যদি না কোনও কোনও ফকির তাত্ত্বিক আমাকে বোঝাতেন।

যেমন ধরা যাক ইমানালী। মানুষটা প্রথম দিনই আমায় হকচকিয়ে দেন এই বলে যে, ‘বাবা, নামের কোনও শক্তি নেই যদি না তার ভেতরের বস্তু আর সেই বস্তুর স্বরূপ তুমি জেনেছ। শব্দ কী? শব্দ তো একটা ভাব। সেই ভাবের আড়ালে আছে বস্তু। বস্তুকে জানো, তা হলেই শব্দের খোসা খুলে শাঁস বেরিয়ে যাবে।’

: যেমন?

: যেমন একটা কাগজে লেখো ‘আগুন’| কাগজ কি পুড়বে? পুড়বে না, কারণ আগুন শব্দে তো দাহ্যগুণ নেই। তেমনই নাম জপ করলে নামীকে পাবে কি? পাবে না। তার বস্তুত্ব বুঝতে হবে। কোথায় তিনি, কেমন তিনি, আমি কোথায়, তাঁর আর আমার সম্পর্ক কী? সেইজন্যেই আমরা ফকিররা সব জিনিস কানে শুনে, হৃদয় দিয়ে বুঝে, তার পর চোখে দেখে, তবে মানি।

এর পর ইমানালী বলেছিলেন আরেক চমকদার বাক্য। বলেছিলেন, ‘তুমি বাবা যেমন গানের পেছনে ছুটছ এখন, এরপর সেই গানের ভাবের নিরাকরণ করতে চাইবে তো? আমি বলি কি জানো, তুমি আগে শব্দের পেছনে ছোট। তারপরে গান খোঁজো। শব্দ হল মাছের টোপ, মাছ হল গান। শব্দেরও আগে কিন্তু আছে নিঃশব্দ। তুমি লালনের সেই গানটা শুনেছ? তাতে বলছে,

যখন নিঃশব্দ শব্দেরে খাবে

আমি এক অতলান্ত চেতনার স্রোতে একেবারে ডুবে যাই। থই পাওয়াতো দূরের কথা, ঘাই মারবার ক্ষমতা থাকে না। ইমানালী শাহজির দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছি দেখে তিনি বলেন, ‘কী গো, আমাকে এমন করে নেহার করছ কেন?’

‘নেহার’ মানে তো দৃষ্টির গভীরে ডুব দেওয়া, চেতনার অতলে। সে ক্ষমতা কি আছে আমার? আমি শুধু ভাবি যে, মেটাফিজিকাল কবিতা চেখেছি, সুররিয়ালিজম ঠুকরেছি, কিন্তু দুশো বছর আগেকার গ্রাম্য গীতিকার বাংলা ভাষায় লিখে গেলেন এমন অন্তর্গহন বাক্য ‘যখন নিঃশব্দ শব্দেরে খাবে?’

ইমানালী মুচকি হেসে বলেন, ‘শেষপর্যন্ত সেই নিঃশব্দই সার। সেই সৃষ্টির পয়লা দিনে ছিল নিঃশব্দ, আখেরি দিনেও থাকবে নিঃশব্দ। মাঝখানে এই কদিন আমরা তৈরি করেছি শোরগোল—শব্দ। শব্দও থাকবে না। মানুষকে ধরো তবে মানুষ কী তা জানবে।

ধরো ধরো মানুষ ভগবান

মানুষ ভজলে পাবি নন্দের নন্দন

সে যে সদা বর্তমান।

আমি বললাম, ‘কোথায় বর্তমান?’

ইমানালী বললেন, ‘মানুষের মধ্যেই বর্তমান। সবই মানুষে আছে। সেইজন্যেই বলেছে,

মানুষরূপে গুরু

মানুষ কল্পতরু

মানুষ রত্ন পায়।

আবার মানুষ ডুবুরি মানুষের কাছে—

ও তুমি মানুষের গুরু

মানুষকে জানো।

আমি পড়ে গেলাম ধন্দে। এ যেন সেই লালনের গানের মতোই, ‘কথা কয় দেখা দেয় না’ গোছের। এ সব ফকিরদের বাক্য বোঝা ভার। বেশ বুঝছি বেশ বুঝছি, হঠাৎ গহিন জল। আসলে আমি তো বুঝতে চাইছি আমার উচ্চশিক্ষালব্ধ লজিকে। ইমানালী বোঝাচ্ছেন তাঁর বোধবুদ্ধির নিজস্ব ধরনে ও ভাষায়। যে জায়গাটা বুঝছি না ভাবছি সেটা মিস্টিক অতীন্দ্রিয়। ওটাও পুঁথিপড়া লেবেল। এঁটে দিয়ে নিশ্চিন্দি।

এইরকম ধন্দকার নির্বোধ গুমোটে অনেক সময় গান দিয়ে দুদণ্ডের স্বস্তি আনা যায়। তাই বললাম, ‘বরং একটা গান করুন।’

লোকায়ত স্বভাবের মানুষটি সোজা সুরে ধরলেন অকপট গান—

চলো সখী দেখিতে যাই

শ্যাম আছে যেখানে।

শুনি নাথ বিরাজ করে

হা হে হু ভুবনে ॥

গানে বাধা দিয়ে বললাম, ‘কী বললেন? হা হে হু ভুবনে? এ সব শব্দের কি কোনও মানে আছে?’

নিরুত্তরে গান চলল,

অচিন চিনিবার তরে

আমি গিয়েছিলাম শ্যামনগরে।

বসে কালা নিগম ঘরে মুরলী বাজায়—

হুহুহুহুহু-এর ধ্বনি মধুর শোনা যায়।

অচিন দেশে শ্যাম নিশানা

হা হে হু-র বারামখানা।

শুরু হল শব্দের পেছনে ছোটাছুটি। হাহা-হুহু-হেহে। এ সব তবে ধ্বন্যাত্মক শব্দ নয়? মন আমার হুহু করছে। হাহা করে হাসি। এইসব শব্দ প্রয়োগ কি তা হলে ভুল করেই করলাম এতদিন?

আমি যেন ‘গুপ্তধন’ গল্পের মৃত্যুঞ্জয়ের মতো আমার চারপাশের নির্বোধ গুমোটে করাঘাত হেনে বলতে চাইলাম—‘সন্ন্যাসী দরজা খোলো।’ ইমানালী বললেন, ‘প্রথমেই কি আর শব্দের মানে পাবে? এ কি অভিধান? খুললে আর পেয়ে গেলে? সব শব্দ কি অভিধানেই থাকে? পড়ো দেলকেতাব।’

যেন যুগান্ত পেরিয়ে একটা গান হঠাৎ স্মরণে এল। খুব ছোটবেলায় শুনতাম দিগনগর গ্রামে একজন ভিখিরির গলায়:

হুহু করে আসিয়াছি

হাহা কইর‍্যা যাব।

কিশোর মন তখনকার মতো এ গানের এক লাগসই মানে করে নিয়েছিল। অর্থাৎ কিনা মনের মধ্যে একটা হুহু শূন্যতাবোধ নিয়ে আমাদের আসা এই জগতে, আবার যাবার কালেও সেই হাহাকার। এবারে সব ছেড়ে যাবার দুঃখ।

কিন্তু গোঁজামিল ধরা পড়ল এতদিনে। একটা মস্ত ফাইল একেবারে। তাই বলে এই ‘হা হে হু-র বারামখানা’ এতদূর? মানে কী ধ্বনিগুলোর? কলেজে কতদিন পড়িয়েছি কেতাবি ভাষাতত্ত্ব। ফনোলজি, মরফোলজি, সেমান্‌টিকস্‌। সুসান ল্যাংগারের বই। আর আজ?

আমার আপন খবর আপনার হয় না।

কিংবা

হাতের কাছে হয় না খবর

ঘুরে বেড়াও দিল্লি লাহোর।

তবে কি এই অবস্থাকেই বলা যাবে আপন ঘরে পরের আমি? আমার বাঙালি শরীরে হরেক দেশের কেতাব পড়া একটা অন্য মানুষ পুষছি নাকি?

আমার বিপন্নতা বুঝে ইমানালী বললেন, ‘শব্দের রাস্তা খুলে যাবে। নাও লিখে নাও—হা মানে আদম বনিয়াদ, হে মানে আল্লা, হু মানে নবী। কিছু বুঝলে?

:না।

: মানে বুঝলেই তা হলে সব নয়। চা-পাতা আছে, চিনি আছে, দুধ আছে। কিন্তু তিনটে মেশালে তবে চা তৈরি হবে। কিন্তু ঠাণ্ডা জলে হবে না। গরম জল চাই। তেমনই ফকিরি বুঝতে গেলে দেহ চাই আগে। তৈরি দেহ, পক্ক দেহ।।

: কেমন করে দেহ তৈরি হবে?

: জল কীসে গরম হল? আগুনে তো? তোমার দেহ তৈরি হবে গুরুর উপদেশের আগুনে। মুর্শেদ ধরো। পণ্ডিত সেজে ভ্যানতারা কোরো না। এটা কী, ওটা কী। ছাড়ো সব বুজরুকি।

সত্যি বলতে কী সেই থেকে ফকিরদের এড়িয়ে চলতাম। একে ইসলামি শাস্ত্র ভাল পড়া নেই, আরবি-পারসি শব্দও ভাল জানি না, তায় আবার শব্দের ভেতরের ধন্দ। আরও গোলমাল আছে। মারফতি ফকিররা শরিয়ত-বিরোধী। কলমা, রোজা, হজ, জাকাত, নামাজ সবই তারা অগ্রাহ্য করে। আত্মমৌন। আচরণবাদী। বস্তুবাদী শুধু নয়, লালন নিজেকে তো ‘বস্তু ভিখারি’ বলেছেন। এই বস্তুবাদের অতিকৃতি থেকে বাউলরা অনুমানমার্গ ত্যাগ করে। কল্পনার কোনও ভিত্তিই স্বীকার করে না। কথাটা ‘সখের বাউল’ নামে প্রসিদ্ধ কাঙাল হরিনাথ এইভাবে বলেছিলেন যে,

যদি কল্পনা ক’রে অরূপীর সে রূপ দেখা যেত

তবে সাধন ভজন ছেড়ে লোকে

কল্পনা করিত।

কত জল্পনা করিত ॥

এই বস্তুবিশ্বাস থেকে তারা দেহবাদী। পূর্বজন্ম ও পুনর্জন্ম দয়েই অবিশ্বাসী। তারা মানে পঞ্চভূত থেকে দেহের পুষ্টি। জীবনাবসানের পর পঞ্চভূত মিশে যায় আবার পঞ্চভূতে। যুক্তির শস্ত্র তুলে লালন প্রশ্ন করেন:

মলে ঈশ্বরপ্রাপ্ত হবে কেন বলে।

মলে হয় ঈশ্বরপ্রাপ্ত

সাধু অসাধু সমস্ত

তবে কেন জপতপ এত

করে রে জলেস্থলে।

যে পথে পঞ্চভূত হয়

মলে তা যদি তাতে মিশায়

ঈশ্বর অংশ ঈশ্বরে যায়

স্বৰ্গনরক কার মেলে॥

এতসব যুক্তিতর্কের উতোর চাপানো ভজকট ব্যাপার। তাই ওইসব গোলমালে যেতে চাইনি। তবে একেবারে ছাড়িওনি। যাকে বলে তক্কে তক্কে থাকা তাই ছিলাম।

এমন সময়ে একদিন এলেন বহরমপুর থেকে আকবর আলী শেখ নামে এক উদ্যমী যুবা। অধ্যাপক শক্তিনাথ ঝা তাঁকে পাঠিয়েছেন আমার কাছে। বাউল ফকির সংঘের তৃতীয় বার্ষিক সম্মেলনে নেমন্তন্ন সামনের জানুয়ারিতে। সংঘের সভাপতি শক্তিনাথ ঝা, সম্পাদক আকবর আলী। বাউল ফকির সংঘ ব্যাপারটা কী?

প্রথমে আকবর আলী হাতে ধরালেন এক লিফলেট। তাতে সার কথা এই;

ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, খ্রীস্টান বা ইসলামের মতো বাউল ফকির মতবাদ কোনো ধর্ম বা সম্প্রদায় নয়। এ এক জীবন দর্শন ও জীবন চর্চা পদ্ধতি। যে কোনো ধর্মের মানুষ স্বধর্মে থেকে এ মতবাদকে স্বীকার ও পালন করতে পারেন।

যে-সমস্ত কল্পনা বা চিন্তার বস্তুগত কোনো ভিত্তি নেই; পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে যা পাওয়া যায় না—এমন সমস্ত চিন্তাকে ফকির-বাউল অনুমান বলে অগ্রাহ্য করে।…কাল্পনিক দেবতায় তার অনীহা। জীবিত মানুষ সৃষ্টির সর্বোচ্চ বিকাশ, তার অনুসন্ধেয় ও মান্য।…

জাত, পাত, ধর্মের বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রবল বাষ্পে ভারতবর্ষ আজ মুহ্যমান। আমরা বাউল-ফকিরগণ যা-কিছু মানুষকে বিভক্ত করে তার বিরোধী। আসুন আমরা আমাদের মহান মানবতাবাদের বাণীকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরি।

কথাগুলি তো সুন্দর। এবারে শুরু করি প্রশ্নমালা আকবর আলীকে।

: আপনাদের সংঘের প্রথম সম্মেলন কবে হয়েছিল? কোথায়?

: ১৯৮৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর আমাদের সংঘের সূচনা। প্রথম সম্মেলন হয় মুর্শিদাবাদের স্বরূপপুরে। ১৯৮৪-র ১২ মার্চ।

: দ্বিতীয় সম্মেলন?

: মুর্শিদাবাদের হরিহর পাড়ায় ১৭ মার্চ ১৯৮৫।

: এবারে?

: এবারে নদীয়া সীমান্ত করিমপুরের সন্নিকট গোরাডাঙ্গা গ্রামে হবে ২৫ আর ২৬ জানুয়ারি। যাবেন তো?

‘যাবার ইচ্ছে তো খুবই’ আমি বললাম, ‘কিন্তু তার আগে সব ব্যাপারটা তো জেনে নিতে হবে। আচ্ছা, আপনাদের বাউল-ফকির সংঘ হঠাৎ গড়ে উঠল কেন?’

আকবর আলী শান্তভাবে কিছু স্পষ্ট করে বললেন, ‘সত্যিকারের কারণ হল সংঘবদ্ধ হবার দরকার ছিল তাই। বলতে পারেন মারপিটের জবাবে বাধ্য হয়ে এক হওয়া। শুনেছেন কি গত ক বছরে বাউল ফকিরদের ওপরে কী রকম অত্যাচার করে চলেছে কট্টর ধর্মান্ধরা?’

: শুনেছি বললে ভুল হবে, বলা উচিত পত্র-পত্রিকায় পড়েছি। বিশেষ করে মুর্শিদাবাদেই বোধহয় বেশি।

: হ্যাঁ। ওই জেলাতেই তো বাউল-ফকিরদের সংখ্যা বেশি, মসজিদ মৌলবীর সংখ্যাও বেশি। ঘটনা তাই ওই দিকেই বেশি ঘটে। তবে ছোটখাটো ঘটনা এদিক ওদিকেও হয়, খবর আসে না। তবে আমরা খবর পাই। রুখে দাঁড়াই। প্রশাসনকে বলি।

: সম্প্রতি বছর দুয়েকের মধ্যে ঘটে যাওয়া কোনও বিশেষ অত্যাচারের খবর বলতে পারেন?

‘পারি।’ আকবর আলী ডাইরি খুলে পড়তে লাগলেন, ‘১৯৮৪ সালের ১২ এপ্রিল মুর্শিদাবাদের নওদা থানার দুর্লভপুরে লতিফ বলে এক ফকিরকে বল্লম দিয়ে মেরেছে। ১৯৮৫ সালে ১৩ জুলাই জলাঙ্গী থানার ফরাজি পাড়ায় আমাদের সভা করতে দেয়নি, মারধোর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। ১৪ জুলাই সারগাছির অন্তর্গত বাণীনাথপুরের মীর্জাপুর পাড়ায় আমাদের রুহুল আমিনের ওপর অত্যাচার করে। তাকে মেরে চুল-দাড়ি কেটে, গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। ১৫ জুলাই বেলডাঙা থানার গোপীনাথপুরে অত্যাচার হয়েছে আবদুর রহিমের ওপরে। এ ছাড়া গালমন্দ, শাসানি, চোখরাঙানি এ সব তো সর্বদাই লেগে আছে। এর পরও যদি আমরা সংঘবদ্ধ না হই…’

‘হ্যাঁ, ঠিক কাজই করেছেন’ আমি বললাম, ‘অবশ্যই যাব আমি। ২৪ তারিখেই পৌঁছে যাব। গোরাডাঙা গ্রামে অবশ্য যাইনি কখনও। ওখানে আবার সভাসমিতি করা যাবে তো?’

: কোনও ভয় নেই। ফকিরদের শক্ত ঘাঁটি। গাঁয়ের মানুষজন ভাল।

মাঘ মাসের শেষ বেলায় পৌঁছে গেলাম ধুলোডোবা গ্রাম গোরাডাঙায়। নামেই নদীয়া জেলা, আসলে ভাষাভঙ্গি কথার টানে পাক্কা মুর্শিদাবাদ। ছোট্ট গ্রাম। শ-দেড়েক পরিবার বাস করেন। একচেটিয়া মুসলমান। চাষবাস একমাত্র জীবিকা। এ সব নানা খবর হাঁটতে হাঁটতেই সংগ্রহ হয়ে যায়। অবশেষে সম্মেলনের জায়গায় পৌঁছে যাই। উদ্যোক্তাদের করতলের উষ্ণ আহ্বানে সাড়া দেয় আমার করতল। শ্রান্তভাবে বসে পড়ি সামিয়ানার নীচে। চারপাশে ইতস্তত জটলা বাউল-ফকিরদের। এখনই গাঁজাসেবা শুরু হয়ে গেছে। শক্তিবাবু আলাপ করিয়ে দেন মযহারুল খাঁ-র সঙ্গে। এই গ্রাম আর এই চত্বরের প্রধান ব্যক্তি। দোহারা চেহারা। ধুতি আর শার্ট পরনে। লাজুক হেসে একবার মযহারুল দেখা দিয়ে যান। সবাই পাকে সাকে ব্যস্ত। শ্রান্তি কাটতে না কাটতেই এসে যায় চা আর মুড়ি। শুরু করি মযহারুল ফকিরের সঙ্গে আলাপচারি। উদার স্বভাবের গৃহী ফকির। সম্পন্ন চাষি-পরিবার। সম্মেলনের ঝুঁকি আর গুরু দায়িত্ব প্রধানত তাঁরই চওড়া কাঁধে। সংলগ্ন বড় বাড়িটাও তাঁর। তাঁর ছেলেরাও ফকিরি ধর্ম মেনে চলে। ফকিরি গান গায়।

জিজ্ঞেস করলাম, ‘এ গাঁয়ে ফকির সম্মেলন করছেন, কোনও বাধা হবে না তো? কোনও হাঙ্গামা?

একগাল হেসে মযহারুল বললেন, ‘কে করবে হাঙ্গামা? কেন করবে? কারুর সঙ্গে তো বিরোধ নেই। আসলে কী জানেন, এ গাঁয়ের দেড়শো ঘর মুসলমানের মধ্যে একশো ঘরই ফকিরি মতে চলে।’

: কী করে এমন হল?

: আমি করেছি ক্রমে ক্রমে সহজে কি হয়েছে? সময় লেগেছে।

: একটু বলুন, শুনি।

: আমার বয়স এখন ষাট। ছোটবেলা থেকে আমার ফকিরি মতে আগ্রহ। তখন থেকে ওদের সঙ্গে ঘোরাফেরা। বাড়িতে কত ঝগড়া হয়েছে বাপজানের সঙ্গে। তাড়িয়ে দিয়েছেন। খাঁটি শরিয়তি মুসলমান ছিলেন তো। তর্ক বাধত। আমিও ইসলামি শাস্ত্র পড়েছি। আরবি জানি, কোরান আর হাদিসের মর্ম বুঝি। এ দিগরে কোনও আলেম মোল্লা আমার সঙ্গে বাহাসে পারেনি। এখন আর ঘাঁটায় না।

আত্মপ্রত্যয়ী মানুষটিকে ভাল লাগল। বুঝলাম মযহারুলের ব্যক্তিত্বে, বিচারে আর প্রভাবে গোরাডাঙা গ্রামের মানুষজন সবাই ফকির না বনে গেলেও ফকিরদের বিষয়ে অসহিষ্ণু নন, বরং সহযোগী। এই তো একপাশে বটগাছতলায় যে শত শত মানুষের জন্যে রান্না হচ্ছে তাতে হাত লাগিয়েছে কত গ্রামবাসী। রাতে ফকিরি গানের আসরে মনপ্রাণ দিয়ে গান শুনবে যারা তারা হিন্দু না মুসলমান? শরিয়তি না মারফতি? কোনওটাই নয়। তখন তারা মানবরসিক। গান পাগল। কিন্তু খাঁটি ইসলামি ধর্মতত্ত্ব নাকি বলে গান জিনিসটা হারাম, বেয়াদাত। কটাক্ষ করে আসাদ্‌উল্লা নামে এক নীতিবাগীশ একবার লেখেন,

কোন কোন পীর তোক বাজনা বাজায়।

সুর দিয়া গান করে হাততালি দেয় ॥

জবাবে আবদুর রসিদ চিস্তি তাঁর ‘জ্ঞান-সিন্ধু বা গঞ্জে তৌহিদ ইত্যাদি’বইতে লেখেন,

যে গানের সাহায্যে আল্লাহ্‌ ও রসুলের প্রতি আসক্তি জন্মে, তাহাকে ধর্মসঙ্গীত বলে। কিন্তু মৌলভী সাহেবদিগের ফতাওয়া অনুসারে যদি তাহাও বেয়াদাৎ হয় তবে মৌলবী সাহেবরা ওয়াজের মজলিশে মওলানা রূমের মসনবী, দেওয়ান হাফেজ, দেওয়ান শামন তবরেজ, দেওয়ান লোক, দেওয়ান মইনুদ্দিন চিস্তি, দেওয়ান জামী প্রভৃতি সিদ্ধ পুরুষদিগের দেওয়ান ও মসনবীর বয়াত গাহিয়া ওয়াজ করেন কেন? যত দোষ কি কেবল বাঙ্গলাগানের বেলায়?

আসলে গানই মারফতিদের ভাষা। একতারাই তাদের জীবনের প্রতীক। সেই একতারা যদি কেউ কেড়ে নিয়ে ভেঙে দেয়, গান গাইতে না দেয়, তবে মারফতিদের ধর্মসাধনাতেই তো হাত পড়ে। প্রতিরোধ তো করতেই হবে সে অন্যায়।

ইতিমধ্যে একজন ধরে আনেন রুহুল আমিনকে। এই সেই রুহুল যার কথা শুনেছিলাম আকবর আলীর কাছে। গত বছরে জুলাই মাসে মীর্জাপুরে এই রুহুলের দাড়িগোঁফ কামিয়ে, একতারা ভেঙে দিয়ে, বাড়ি পুড়িয়ে ধর্মান্ধৱা তাড়িয়ে দিয়েছে তার স্বগ্রাম থেকে। রুহুল এখন আর দাড়ি রাখেন না ঘৃণা আর গ্লানিতে। চোখে গাঢ় অভিমান। কেউ যেন খুব বড় ধরনের বিশ্বাসভঙ্গ করেছে তাঁর সঙ্গে, মুখের ভাষা তেমনতর থমথমে। একখানা সাদা ধুতি পরনে, সাদা চাদর গায়ে জড়িয়ে রুহুল সামনে বসে আছেন চুপ করে। আমার অন্তরে মর্মান্তিক বিবেক দংশন।

আমি কেবল রুহুলের হাতদুটো ধরি গভীর মমতায়। রুহুল তাকায় ব্যথিত চোখে। আশ্বাস খোঁজে এতগুলি মানুষের সান্নিধ্যে।

ইতিমধ্যে ছোট এক জটলায় দোতারা বেঁধে গান ধরেছে এক অজানা বাউল। গানটা এই মুহুর্তের গুমোট কাটাতে খুব প্রাসঙ্গিক মনে হল:

সাঁই রাখলে আমায় কূপজল করে

আন্দেলা পুকুরে।

হবে সজল বরষা

রেখেছি এই ভরসা

আমার এই দশা যাবে

কত দিন পরে॥

কূপজলের বদ্ধতায় আটকে আছে বহতা সমাজের ধারা। ধর্মান্ধতা, হানাহানি, ঈর্ষা আর অসূয়া সব দিকে।

সন্ধের পর শুরু সম্মেলন। গান আর গান, ভাষণ আর ঐক্যবদ্ধতার প্রতিজ্ঞা। সবকিছুর মধ্যেও কিন্তু আমার মনের পর্দায় কেবলই সুপার ইম্পোজের মতো ভেসে থাকছিল রুহুলের বেদনাবিদ্ধ অভিমানী মুখ। অথচ কত বাউলের সঙ্গে কত দরবেশি ফকিরের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হল সে রাতে। খাওয়ার অভিজ্ঞতাও খুব নতুন রকমের। পাটকাঠি পাতা মর্‌মর্‌ শব্দের আসনে বসে গরম খিচুড়ি খাওয়া সরষের তেল দিয়ে। তখন মাঘের মধ্যরাত। শিরদাঁড়া পর্যন্ত কাঁপছে থরথরিয়ে। কোনও রকমে খেয়ে উঠেই দৌড় রাতের আশ্রয়ে। একজন সম্ভ্রান্ত মুসলমানের দলিজে শোওয়া গেল। আশ্রয়দাতা শরিফ মানুষটিকে বললাম, ‘এই বাড়ি আপনার?’

ফকিরি ধাঁচে উত্তর দিলেন, ‘গ্রামের সবাই তাইতো বলে।’

ওদিকে মাইকে শোনা যাচ্ছে অবিশ্রান্ত ফকিরি গান। সারা রাত চলবে। পাশে বকবক করে চলে আধপাগল মানুষ মানউল্লা। এক সময়ে নাকি ফকিরি করত। গাঁজার মাত্রাভ্রমে মাথার গণ্ডগোল। নিবাস মাদারিপুর। আমাকে বলে, ‘লোকে আমাকে পাগল বলে। কিন্তু আমি পাগল নই। আমি খ্যাপা। অসহ্য সইতে পারি না। এই যে রুহুল ফকিরের ওপর অত্যাচার তার প্রতিবাদে আমি গান বেঁধেছি। জানেন, আমি প্রবেশিকা পর্যন্ত পড়েছি। আমার ছদ্মনাম নিজামী। ওই নামে আমি লিখি।’

আমি জিজ্ঞেস করি, ‘নিজামী মানে কী?’

: নিজামী শব্দের মানে হল সজ্জাকর বা প্রসাধক। কিন্তু ভাবার্থ হল—কলুষনাশক, পবিত্রকারী, সংস্কারক। যেমন কিনা ধরুন সূর্য। পৃথিবীর সব আবর্জনা, পাঁক, মালিন্য তিনি লেহন করে নিচ্ছেন।

হঠাৎ বিছানার ওপর দাঁড়িয়ে উঠে নিজামী বলে উঠল নাটকীয়ভাবে হাত নেড়ে, ‘যখন মানবসমাজ সম্পূর্ণভাবে কলুষকুণ্ডে তলাইয়া যাইতে থাকে, যখন ওই ঘুণধরা শতছিদ্র ডিঙ্গাখানি পাপ-সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গের মুখে নিমজ্জিত হইতে বসে, তখনই হয় বজ্রমুষ্টি কাণ্ডারীর প্রয়োজন। নিজামীর প্রয়োজন। যখন সমাজ তথা জনসাধারণ স্বার্থবাদী মুষ্টিমেয় কতকগুলি নরপশু, পণ্ডিত মোল্লার হস্তে নিষ্পেষিত হইতে থাকে, তখনই হয় নিজামীর প্রয়োজন।’

যেমন হুট করে উঠে দাঁড়িয়েছিল তেমনই হুস করে বসে পড়ল নিজামী। আমি হতভম্ব হয়ে সেই প্রায়ান্ধকার ঘরে নিজামীর ছায়াবাজি দেখতে লাগলাম। সে এই ওঠে এই বসে আর আউড়ে চলে:

হে প্রভু, তুমি যে ছবি এঁকেছ আমায়

সেই ছবি পৃথিবীতে জন্ম রূপান্তর

তাই আমি নিজেই সেই ছবি দেখছি।

যাঁর যত চিন্তা তাঁর ততই নিঃসঙ্গ

বেঁচে থাকতে ইচ্ছা জাগে, প্রকৃতিকেই

কেন্দ্র করে মনের গোপন প্রতীক্ষায়।

চিন্তায় রয়ে গেছে আমার মুক্তি পথ

যতই চিন্তা করি আমি নিঃশব্দ থাকি

প্রকৃতির নিঃশব্দ সাধনায় ধর্ম কী?

প্রেমের মধ্য দিয়ে মানুষ সৎ ভাবে

বেঁচে থাকতে পারে, মানুষের অপ্রেম

মধ্যে বেঁচে থাকতে সৎগুণের মৃত্যু।

মুশকিল যে, নিজামীর রচনা নিতান্ত ফেলনা নয়। শুনেই বুঝছি তার মর্মরস আছে। কেমন করে এমন লেখে আধা পাগল আধা ফকির নিজামী? আমার সঙ্গে আলাপ হওয়া থেকে এই মধ্যরাত পর্যন্ত সে অবিশ্রাম গাঁজা খাচ্ছে। বুঝছি তার মাদকেই এই বকে যাওয়া নিজামীর। কিন্তু এ সবই তার অপূর্বকল্পিত রচনা মুখে মুখে? সত্যিই ফকিরদের জগৎ খুব আধো রহস্যে নিমীল। বিশেষ করে নিজামীর সঙ্গে রাত কাটানো এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। বাকি রাতটুকুতে যখনই ঘুম ভাঙে দেখি নিজামী বসে আছে আর বিড় বিড় করছে। মাঝে মাঝে প্রচণ্ড জোরে আঙুলে তুড়ি মেরে বলে উঠছে ‘আল্লা আল্লা’। আগের সন্ধেবেলা সে আরেক কাণ্ড করেছিল। সম্মেলনে তখন একজন অধ্যাপক বক্তৃতা দিচ্ছিলেন লোকসংস্কৃতি বিষয়ে। তাঁর ভাষণে লোকজীবন-অভিজ্ঞতার ছাপ ছিল না বরং কেতাবি বিদ্যে বড় জাহির হচ্ছিল। টোটেম, জাদু বিশ্বাস, ফার্টিলিটি ওয়ারশিপ, কাল্ট, সেক্‌ট্‌ এ সব খুব কপচাচ্ছিলেন। সভ্যভাবে বসে সবাই তা শুনছিলেন, নিরুপায়। হঠাৎ শ্রোতাদের মধ্যে থেকে খাড়া উঠে দাঁড়িয়ে তুড়ি মেরে নিজামী বলে উঠল, ‘আল্লা আল্লা, জ্ঞান দে জ্ঞান দে।’ অধ্যাপক হতচকিত, আমরা তো অবাক। অবশ্য কাজ হল। অধ্যাপক জ্ঞানদানে বিরত হলেন।

এক এক সময়ে ভাবছিলাম রোজকার জীবনে এমন এক-আধটি নিজামী থাকলে মন্দ হয় না। সবরকম ভণ্ডামি আর বক্তৃতা, অহংকার আর তাত্ত্বিকতার মধ্যে এমন করে ঠাণ্ডা জল ফেলার দরকার খুব। যাই হোক শেষ রাতের দিকে নিজামীকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি সারা রাত ঘুমোও না?

নিজামী বলল, ‘রাতেই তো তাঁর সঙ্গে আমার কথাবার্তা হয়। যা-কিছু চিন্তাভাবনা, বয়েত রচনা সবই আমার রাতে। রাতেই তাঁকে দেখা যায়। সবাই তখন ঘুমিয়ে থাকে। আর ঘুম জিনিসটা কী বলুন তো? নিজামী তার বয়েতে বলছে,

আমার ঘুম এসে যায় যখন চিন্তা

করার যুক্তি থাকে না। যুক্তি নিয়ে বেঁচে

থাকাটাই ঠিক জীবনের জ্ঞান শক্তি।

নিজের রচনাপ্রতিভায় আত্মমুগ্ধ নিজামী তুড়ি মেরে বলল, ‘হা হা হা, আল্লা আল্লা, নিজামী ঠিক লিখেছে। আপনি ঘুমোন, কাল জ্ঞান দেবেন মিটিঙে। ততক্ষণ আমি একটু স্মোকিং করি। স্মোকিং মানে রাজার অভ্যেস জানেন তো? স্মো-কিং, কিং মানে রাজা, হা হা আল্লা আল্লা।’

খুবই আশ্চর্য অস্তিত্ব সন্দেহ নেই। একজন ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের যুবা বেঁচে আছে মাদক আর শব্দের মাদকতায়। অনায়াসে লেখে গাঢ় ভাবনার বয়েত। কেমন করে হয়? আহার নিদ্রার ঝোঁক একেবারে নেই। শুনেছি সুফি সাধকদের সাধনার দুই স্তর—‘ফানা’ আর ‘বাকা’। ঈশ্বর বা উপাস্যের সঙ্গে লীন হয়ে থাকার অদ্বৈত অবস্থাকে বলে ফানা। আর উপাস্যের সঙ্গে অবিশ্রান্ত ভাব বিনিময়ের স্থায়ী দ্বৈতলীলাকে বলে বাকা। নিজামীর কোন অবস্থা? ফানা না বাকা?

হয়তো কোনওটাই নয়, নিতান্ত বায়ুরোগী বা অর্ধোন্মাদ। সেদিক থেকে সব বাউল ফকিরই তো অর্ধোন্মাদ। নিজের ঘর গেরস্থালি ছেড়ে ব্রাত্যজীবনে এই যে আত্মানুসন্ধান দেহের দিক থেকে, সেও কি কম পাগলামি? ‘বা’ মানে আত্ম, ‘উল্‌’ মানে সন্ধানী—এই থেকেই নাকি বাউল শব্দের সৃষ্টি। আবার কেউ বলে বাতুল থেকে বাউল। কে জানে? ফকির কথাটার মানে অবশ্য সে তুলনায় অনেক স্পষ্ট। সব কিছু ছেড়ে ফকির বনে যাওয়া। সব কিছু বলতে বেশির ভাগ মানুষ ভাবেন ভোগ সুখ বিত্ত ঐশ্বর্য। তা কিন্তু নয়, সবকিছু মানে সব রকমের সংস্কার বর্জন, জন্ম মৃত্যু-পুনর্জন্ম-লোকলজ্জা-সমাজ। নিজামী বলেছিল যখন চিন্তা করার যুক্তি থাকে না তখন ঘুম এসে যায়। আপাতত আমার চিন্তা করার যুক্তি এত প্রবল যে ঘুম ছুটে গেল। ভোরও একটু একটু করে মাঘের কুয়াশা ভেদ করে উঠতে চাইছে। নিজামী বিড় বিড় করছে। আমি বললাম, ‘নিজামী কী করছ?’

অর্ধনিমীল চোখে সে বলল, ‘ফজরের নামাজ কায়েম করছি।’

আমি বললাম, ‘দুঃখিত, তোমার নামাজে বাধা দিলাম।’

: কিছু না। আমাদের বাতুনে (অপ্রকাশ্য) নামাজ। অন্তরের গভীরে চলছে। সেখানে মানুষের স্বর পৌঁছায় না।

তুড়ি মেরে আল্লা আল্লা বলে নামাজ শেষ হল। একগাল হেসে বলল, ‘খুব ঘুমোতে পারেন দেখলাম। বেলান্তই ঘুমোচ্ছেন, চোপর রাত।’

: চোপর রাত আর কোথায়? শুতেই তো এলাম দুপুর রাতে।

: হা হা, আল্লা আল্লা। কখন যে দুপুর কখন যে চোপর কে জানে। সব সমান নিজামীর কাছে। আল্লার কাজ-কারবার সারাদিন ধরে চোখ মেলে দেখি আর তাজ্জব বনে যাই। রাতে কিছু দেখা যায় না। দেখুন আল্লার হেকমৎ। তখন গোরু আর গোলাপ সবই আঁধার। ঠিক তখনই রুহু মানে আত্মার আলো জ্বলে ওঠে। আল্লা রাতস্মরণীয়। হা হা। আল্লা রাতস্মরণীয়।

: প্রাতঃস্মরণীয় নন?

: প্রাতঃকালে মানুষের থাকে জঠরের চিন্তা, বিষয় চিন্তা। খেজমতের গলায় গান শোনেননি? শুনুন,

আমার এই পেটের চিন্তে

এমন আর চিন্তে কিছু নাই।

চাউল ফুরাল ডাউল ফুরাল

সদাই গিন্নি বলেন তাই।

যখন আমি নামাজ পড়ি

তখন চিন্তা উঠে ভারী

কীসে চলবে দিনগুজারী

সেজদা দিয়ে ভাবি তাই।

আমার পেটের জ্বালা জপমালা

আমি তসবী মালায় জপি তাই॥

হা হা, আল্লা আল্লা!

আমি গান শুনতে শুনতে পোশাক পালটে নিয়ে বললাম, ‘বেশ। এবারে সম্মেলনে যাব। তুমি যাবে না?’

‘যাব, তবে এখন আমার মনে মহাসম্মেলন চলছে’ নিজামী বলল, ‘সেই সম্মেলনের ভাষণ মানে একটা বয়েত এখনই লিখে ফেলতে হবে নইলে ভুলে যাব। খুব কাকভোরে যখন ঘুলঘুলি দিয়ে আলো আসছিল, নিজামীর আলো, তখন একটা বয়েত বানিয়েছি, শুনবেন?

ভূমণ্ডলীর প্রত্যেকটা বালিকণার

মূল্য আছে। কারণ প্রতিটি বালিকণা

আলোর উজ্জ্বলতায় চিক চিক করে।

আমি প্রভাতসূর্যের প্রসন্নতা নিয়ে নিজামীর দিকে চেয়ে রইলাম সস্নেহে আর তার দুরবগাহ মনের সন্ধান করতে লাগলাম। নিজামী উঠে দাঁড়িয়ে নাটকীয় আবৃত্তির ঢঙে বলল,

আমি যা চেয়েছি তা পেয়েছি

তুমি শ্রেষ্ঠ।

এবার আমায় নিয়ে চলো শেষ যুগে

দ্বার খুলে দাও।

আমি বললাম, আমাকে কি ফেরেস্তা ঠাউরেছ না কি?

: আপনিই ফেরেস্তা, আপনিই জিব্রিল, আপনিই নবী। আপনিই খদ্‌, আপনিই খোদা। আপনার মধ্যেই হা হে হু-র ধ্বনি শুনছি।

বিচিত্র ভাষা, বিচিত্র জগৎ। আমি সেখানে কতটাই পরবাসী, পরভাষাভাষী। অথচ আশ্চর্য যে এই নিজামী আর আমি কাল পাশাপাশি বসে তেল-খিচুড়ি খেয়েছি। মানুষের বিশ্বাসের জগৎ কি এতটাই আলাদা? আপন ঘরে নিজের আমি নাকি পরের ঘরে আপন আমি?

সম্মেলনের প্রাতঃকালীন অধিবেশনে বসলাম মযহারুল ফকিরের পাশে। আলাপ করিয়ে দিলেন ছেলে মনজুরের সঙ্গে। কাল তার গলায় চমৎকার তত্ত্বগান শুনেছিলাম। বক্তৃতা আর প্রস্তাব গ্রহণের মাঝখানে কিছুক্ষণ বসে আমি গুটিগুটি উঠে যাই মাঠের দিকে বেড়াতে। শস্যকীর্ণ সবুজ মাঠে তখনও কুয়াশার ঘেরাটোপ। মুগ্ধ একা দাঁড়িয়ে কত কিছু দেখছি। কিছু দূরে একটা বানে খেজুর রসের তাতারসি জ্বাল হচ্ছে। জমিতে লাফিয়ে পড়ছে দুটো-চারটে ফিঙে। এই কনকনে সকালে আধাউলঙ্গ দুটি শিশু তাতারসির লোভে ঘুরছে। হঠাৎ সামনে এসে অভিবাদন করে দাঁড়ালেন একজন গ্রামবাসী, মাঝবয়সি। লুঙ্গি, গেঞ্জি পরনে। নাম বললেন দেলদার হোসেন খাঁ। জিজ্ঞেস করলাম, এ গাঁয়ে যাদের সঙ্গেই আলাপ হচ্ছে তাদেরই নামের শেষে খাঁ, কী ব্যাপার? আত্মতুষ্ট হেসে বললেন দেলদার, ‘বলতে পারেন খানদানি গ্রাম। সবাই খাঁ। আশরফ অর্থাৎ কিনা শরিফ আদমি’।

: সত্যিই?

: এককালে নিশ্চয়ই ছিল। এখনও গর্বটুকু আছে। তবে সবাইয়ের চাষবাস এখন। সেই কথাটা কি শুনেছেন? সেই যে বলে,

গায়ে গন্ধ আতর আলী

চোখ কানা নজর আলী

একটাও বাক্স নেই দেদার বক্স

আমাদের অবস্থা তেমন ধারা। অবস্থা যাই হোক আমরা এক একজন খয়ের খাঁ। তবে হ্যাঁ, মযহারুল চাচা সত্যিকারের খাঁ বটে। কী বুকের পাটা। চারপাশের শরিয়তিদের মাঝখানে মারফতি ফকিরদের নিশেন ধরে আছে।

: আচ্ছা, মুসলমানদের কী শ্রেণী বর্ণ আছে?

: জাহেরে নেই, বাতুনে আছে। মানে ভেতর ভেতর। দেখুন আল্লার এই দুনিয়া চলছে দু নিয়া অর্থাৎ দুটো জিনিস নিয়ে। সে দুটো কী? বড়লোক আর গরিব লোক। ধনী আর দরিদ্র। আশরাফ আর আতরাপ।

: আরেকটাও তো আছে—আরজল?

: ওটাকে মুসলমানদের মধ্যে ধরবেন না। আরজল কারা জানেন? এই বেদে বাজিকর পোটো চামার এইসব। পতিত শ্রেণী।

: আশরাফ কারা?

: আশরাফ হল উচ্চশ্রেণীর মুসলমান—সেখ সৈয়দ মোগল পাঠান। এদের মধ্যে সৈয়দরা সবচেয়ে খানদানি। তাদের আবার দুটো গোষ্ঠী, ফাতেমীয় আর উলবি। এদের আবার উপগোষ্ঠী আছে—হুসেনী, হাসনী, মুসাবী, রাজভী, কাজিমী, তাকাবী, নাকাৰী এইসব। কিন্তু এ সব শুনতে কি আপনার ভাল লাগছে?

: কেন লাগবে না? আমাদের পাশাপাশি এই বাংলায় যারা শতশত বৎসর বাস করছে তাদের প্রায় কিছুই জানি না এটা কি ভাল? এর থেকেই তো অবিশ্বাস দলাদলি কাটাকাটি। কিন্তু এত সব জানলেন কী করে?

: মুখে মুখে শেখাতেন আব্বা। তো শুনুন, সেখদের মধ্যে সেরা হল কোরেশী কেন না ওই বংশেই হজরত মহম্মদের জন্ম। সেখদের অন্য শাখার নাম—সিদ্দিকি, ফারুকি, আলমানী, আব্বাসী খালেদী—আরও কী সব আমার মনে নেই। মোদ্দা কথা সেখ ও সৈয়দরা এসেছিল আরব থেকে। শুনেছি মধ্য এশিয়ার তুর্কীরা ভারতে এসে মোগল নাম পায়। আফগানরা হল পাঠান। এই পাঠানদেরই বংশধর আমরা অর্থাৎ খাঁ।

খেয়াল করিনি কখন নিজামী এসে দাঁড়িয়েছে চুপিসারে। দেলদার খাঁর কথা শেষ না হতেই নিজামী বলল, ‘তবে তোমরাও খানদানি খাঁ নও। আতরফ খাঁ।’

‘কেন?’ আমি জানতে চাইলাম।

: কারণ বিদেশি মুসলমানদের সঙ্গে এদেশীয়দের সাদি হয়ে যে মিশ্র শ্রেণী হয়েছিল তারাও আতরাফদের মধ্যে খানদান। তাদের টাইটেল কাজী, চৌধুরী, শেখ, খাঁ, মালিক।

দেলদার রাগ করে বললে, ‘আর তুমি কী?’

: আমি আশরফও নই, আতরাফও নই। আমি হক। মানাউল্লা হক। হক মানে সত্য, হকিকৎ। জাত বিভেদে আমি নেই। দুদ্দুর গানে শোনোনি?

এ দেশেতে জাত বাখানো সৈয়দ কাজী

দেখি রে ভাই।

যেমন বঙ্গদেশের ব্রাহ্মণ সবাই।

ব্রাহ্মণের দেখাদেখি

কাজী খোন্দকার পদবী রাখি

শরীকী কওলায় ফাঁকি দিয়ে সর্বদাই।

জোলা কলু বা জমাদার যারা

ইতর জাতি বানায় তারা

এই কি ইসলামের শরা

করিস তারই বড়াই?

যেন একটা স্বস্তিকর জায়গায় পা রাখতে পারলাম এতক্ষণে। মুসলমান সমাজেই প্রতিবাদ উঠেছিল তা হলে? লালনের শিষ্য দুদ্দু ইসলামের শরা বা শরিয়তবিরোধী এই শ্রেণী বিভেদের প্রতিবাদে ব্যঙ্গ করেছেন। এতে তো একটা সমাজসত্যও আছে বোঝা যাচ্ছে। ব্রাহ্মণের শ্ৰেণীবৈষম্যের আদলেই কি তবে বাংলার মুসলমান সমাজে আশরাফ-আতরাফ-আরজল? দেলদারের মুখ থমথমে। নিজামী খুব খুশি। সম্মেলনে ফেরার পথটুকু সে সঙ্গ নেয়। অনর্গল বলে চলে, ‘আমাকে সবাই গাঁজাখোর পাগল বলে। কিন্তু আপনাকে বলছি আমাদের বাউল-ফকিরদের জন্ম এই জায়গা থেকে—এই বিভেদের প্রতিবাদে। বৈদিক ধর্ম আর বামনাই সবার সর্বনাশ করল।’

আমি বললাম, ‘আচ্ছা তোমরা যে নিজেদের মারফতি বললো তার মানে তুমি অর্থাৎ নিজামী কী করেছ?’

: শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা জানেন তো? পীর মুরিদি ব্যাখ্যা আরেক রকম আছে। সেটা পয়ারে। যেমন—

শরিয়ত বৃক্ষ জানো হকিকত ডাল

তরিকত বৃক্ষপত্র মারফত ফল ॥

মারফত পূর্ণ নহে বিনা শরিয়তে।

শরিয়ত পুরা নহে বিনা মারফতে ॥

শরিয়ত গাছ কিন্তু নিষ্ফলা গাছের মূল্য কী বলুন? হকিকত হল পথ অর্থাৎ ডাল, যাতে ফল ধরবে। তরিকত পাতা অর্থাৎ আইনকানুন, যার ছায়ার আওতায় ফল ধরবে। ফল ধরাটাই আসল। কিন্তু গাছ তো চাই। সেটুকুই শরিয়ত। আমাদের মুর্শেদ আবার আরেক রকম করে বোঝাতেন। বলতেন,

শরিয়ত মানে হল দল।

দলকে পরিচালনার রাস্তা হল তরিকত।

ওই রাস্তা চলতে হলে হক্‌ ধরো, সেটাই হকিকত।

যাবে কোথায়? মারফত।

মারফত মানে গোপনতত্ত্ব।

এবারে নিজামীর নিজের ব্যাখ্যা শুনবেন? মারফত মানে গোপনতত্ত্ব—সেই তত্ত্ব নিজে নিজে জানা যায় না। জানতে হয় গুরুর মারফত, বুঝতে হয় দেহের মারফত, সে সাধন করতে হয় শ্বাসের মারফত। একেই আমি বলি মারফত।

আমি বললাম, ‘তোমার সবটাই যে ভুল তা শোধরাবে একদিন মোল্লাদের মারের মারফত। বুঝেছ?’

‘হা হা, আল্লা আল্লা’ নিজামী তুড়ি মেরে বুকে দুটো ঘুষিও বসাল। তারপর বলল, ‘কেবল মার, কেবল মার। সারা দেহে আমায় মারো আল্লা, কেবল লা-মাকান বাদে।’

: সে আবার কী? লা-মাকান কাকে বলে?

: কোনও পয়গম্বর সে পয়গম আপনাকে শোনায়নি বুঝি? তবে নিজামীর মুখে শাস্ত্র শুনুন, পাগলের পাঁচালি। আল্লা যখন মানুষের ধড় বানালেন তখন আত্মাকে পাঠালেন তার ভেতরে। আত্মারাম ছটফট করে বেরিয়ে এল ধড়ের ভেতর থেকে। বলল উরেব্বাস্‌ জ্বালা জ্বালা। ধড়ের মধ্যে সব জায়গায় শয়তান রয়েছে। তখন আল্লা মানুষের ধড়ের যেখানে হৃৎপিণ্ড তার দু-আঙুল নীচে বানালেন লা-মাকান্‌। ওইখানে শয়তান কিছুতেই যেতে পারে না। ওইখানে আত্মা থাকেন।

: আর নফ্‌স?

: নফ্‌স বলতে আমরা ফকিররা বুঝি বীর্য বা শুক্র। এই নফ্‌সকে রোখা কঠিন। তাকে রুখতেই আল্লা সৃষ্টি করেছেন নবীর। কিন্তু মানুষ অন্ধ তাই নিজের পরিণাম দেখে না। মানুষ কালা তাই নবীর উপদেশ শোনে না। নফ্‌সকে ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করলেই খোদা মিলবে। নফ্‌সের গোলামি করলেই শয়তান এসে ধরবে। মনসুরের পদ শোনেন,

নফ্‌সে খোদা নফ্‌সে শয়তান

করি নফসের তাঁবেদারি।

মায়া-বেড়ি পায়ে পরেছি,

নারীর ফাঁদে ঘুরিফিরি।

: নফ্‌স রক্ষার জন্যে তোমরা আল্লার মেহেরবানি চাও না?

: আল্লার মেহেরবানি তো সবসময়ই দোয়া করি। তবে মারফতি পথে বড় কথা আপ্ত সাবধান। নিজের অসাবধানতার জন্যে খোদাকে টানা কি ঠিক? সেইজন্যেই বলেছে,

আপন হাতে জন্মমৃত্যু হয়

খোদার হাতে হায়াৎ মউৎ কে কয়?

বীর্যরস ধারণে জীবন

অন্যথায় প্রাপ্তি মরণ

আয়ুর্বেদ করে নিরূপণ করি নির্ণয়।

নিজে বীর্যক্ষয় করে

পশুর মতো পথে পড়ে

কতজনে যায় মরে খোদার দোষ দেয়॥

হা হা, আল্লা আল্লা, জীয়নকাঠি আর মরণকূপ দুটোই সামনে রেখেছ। হা হা, এখন নিজামী কোন্‌টা নেয়। আল্লা কী বলছেন জানেন তো? ফাজকুরুনি ওয়াসকুরুকুম অর্থাৎ আমাকে যে স্মরণ করে আমি তাকে স্মরণ করি। হাহা, আল্লা, নিজামীরও মাঝে মাঝে বিস্মরণ হয়।

যেন ঘোরের মধ্যেই কেটে যায় কতটা সময়। সম্মেলন বিরতিতে খাওয়াদাওয়া চলছে। সবাই অভিযোগ তুললেন, ‘তেমন করে আপনাকে পেলাম না।’ আমি কী আর বলি? নতুন জগতে দিশাহারা। সহজিয়া বাউলদের জগৎ যদি বা জানি ফকিরদের জগৎ একেবারে অজানা। একটু-আধটু বেনোয়ারি ফকিরের সঙ্গ করেছি বই তো নয়। সে আর কতটা? আমি শুধু চোখ মেলে দেখছি অজানা এক জগতের মানুষজনের।

সামনে বসে সেবা করছেন কত অজানা অনামা ফকির। জানতে হবে এদের করণ কারণ। আধ-পাগল নিজামীর কারবার নয়। ও তো রসখ্যাপা। মনজুর এসে বলল, ‘আব্বাজি ডাকছেন আপনাকে’। গেলাম মযহারুল খাঁর ঘরে। বললেন, ‘কথাবার্তা কই হল না তো? এ সব মেলা মচ্ছবে কি কথার হবার জো আছে? আজ আছেন তো? রাতে কথা হবে।’

বললাম, ‘না। আজ দুপুরেই চলে যাব। মনে দুঃখ রাখবেন না। আসব আবার খুব শিগগির। আসতেই হবে। জানতে চাই অনেক কিছু। বলবেন তো?’

আমার দুটো হাত দু হাতে চেপে ধরে চাপ দিয়ে মযহারুল বললেন, ‘আজকে যে চলে যাচ্ছেন বুকে দাগা দিয়ে তার শোধ হবে আবার এখানে এলে। সত্যিই আসবেন তো? ফকিররা ফাঁকা কথায় আর পোশাকে ভোলে না।’

যাব বললেই কি যাওয়া যায়? তার প্রস্তুতি নেই? আমার ক্ষেত্রে অবশ্য বিশেষভাবে মানসিক প্রস্তুতির কথাও ওঠে। মযহারুল ফকিরের কাছে যাবার আগে ফকিরদের বিষয়ে একটু লেখাপড়া সেরে নিতে সময় লাগল। মানুষটার কাছে জানতে চাই তো অনেক কিছুই, কিন্তু কোন কোন বিষয়ে? সেইটা ঠিক করবার জন্যে রফিউদ্দিনের লেখা বাঙালি মুসলিমদের সম্পর্কে বিখ্যাত ইংরিজি বইটা পড়ে নিলাম। ফরাজি আর ওয়াহাবি আন্দোলনের পটভূমি ও পরিণতির ইতিহাস নানা বই থেকে চেখে নিলাম। সেই সঙ্গে এই শতকের গোড়া থেকে শুদ্ধ মুসলমানদের সঙ্গে মারফতি ফকিরদের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কিছু বিবরণ জানা গেল। শুদ্ধতাবাদীদের লেখা কিছু বুকলেট নানা লাইব্রেরির ইতিউতি মিলে গেল। পীরবাদ আর ফকিরি মতের সঙ্গে নৈষ্ঠিক মুসলমানদের সংগ্রাম ও সংঘর্ষ বেশ পুরনো।

১৯৩৫ সালে এনামুল হক তাঁর ‘বঙ্গে সুফী প্রভাব’বইতে সরাসরি লিখেছেন, ‘উনিশ শতকে চারিদিক হইতে বাউলদিগকে ধ্বংস করিতে আয়োজন চলিতে লাগিল। এই সময় মুসলমানদের মধ্যে দুইজন খ্যাতনামা সংস্কারক দেখা দিলেন। ইহাদের নাম মৌলানা কিরামৎ’অলী (মৃত্যু ১৮৭৩) ও হবাজী শরী’ অতুল্লাহ্‌। মৌলানা কিরামৎ’ অলীর প্রধান কর্মক্ষেত্র ছিল উত্তরবঙ্গ এবং হবাজী শরী’ অতুল্লাহ্‌-এর বাড়ি ও কর্মক্ষেত্র ছিল পূর্ববঙ্গ (ফরীদপুর)।’

এখানে বাউল বলতে বুঝতে হবে ফকিরদেরও। শুদ্ধতাবাদীদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিলেন লালন ফকির ও তাঁর আচরিত মত। মৌলানা রেয়াজুদ্দিনের ‘বাউল ধবংস ফৎওয়া’সবচেয়ে কড়া বই এ ব্যাপারে। এ ছাড়া মহম্মদ আলীর ‘মিথ্যা পীর’, ফজলে রহিমের ‘পীর মুরিদ’মহম্মদ সৈয়দের ‘মারফত নামা’—এ সব বইতে ধরা আছে নানা ঝাঁঝালো বক্রভাব। একটি পুঁথিতে ইসলামের শেষ অবস্থায় (কিয়ামত) বিষয়ে আশঙ্কা করে লেখা হয়েছে:

ইমাম গাজ্জালি লেখেন কিতাবে।

কিয়ামতের তিন নিশান জানিবে ॥

বেশরা দরবেশ হবে যেই কালে।

কিয়ামত হবে যেন সেই কালে ॥

দলিল মতে আলেম নাহি চলিবে

কোরাণ ও হাদীস কেবল পড়িবে॥

আমীর সর্দার যত দুনিয়ার।

জাহেল হইবে তারা একেবার ॥

এই তিন গোরো যবে হইবে।

মুসলমানী আর নাহি রহিবে॥

সেই অক্ত এবে বুঝি আসিল।

বেশরা ফকির বহুত হইল॥

জাহিল সর্দার যত আছিল।

বেশরার কাছে মুরিদ হইল ॥

বেদাতী আলেম যত দুনিয়ার।

ঝুটা দরবেশের তারা হয় ইয়ার ॥

মুসলমানী এবে গেল হায় হায়।

কিয়ামত আসিল এবে বোঝা যায়॥

একজন ধর্মভীরু মুসলমান সমাজের আরেক দুর্লক্ষণ আবিষ্কার করে লেখেন:

যুবতী আওরত যত ফকির হইল কত

স্বামী ছাড়ি পীরের সঙ্গে যায়।

পূর্ববঙ্গ থেকে প্রকাশিত রশিদের পদে নতুন ফকিরদের করণ সম্পর্কে কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়। রশিদ বলছেন:

হয়েছে এ জগতে ভেদে-ফকির কতজনা।

বেদ-ছাড়া সেই ভেদে-ফকির বেদ বিধি কিছু মানে না।

এই মূল ভেদের কথা বলো না যথাতথা

নরনারী মিলে কর উপাসনা—

রস ধরে উপরে চালাও নীচেতে স্থিতি ক’রো না।

পঞ্চরস সাধনেতে পাক না-পাক নাই তাতে

গরলচন্দ্র ধরে লয়ে করেঙ্গাতে

বীজ ধরে ভক্ষণ করে জন্মমৃত্যু আর হবে না॥

এখানে স্পষ্টতই পরকীয়া রসরতির সাধনা, রজবীর্য পান সম্পর্কে ইঙ্গিত ঘোষিত হয়েছে। ফকিরদের আচরিত দেহযোগ সম্পর্কে উল্লেখ আছে। এরপরে রশিদ বলেন,

তোমার সেবাদাসী গুরুসেবায় দিলে

পারের ভয় রবে না।

সেই সময়ে ফকিরি মতের প্রবলতা আর নানা ধারা সম্পর্কেও রশিদের লেখা অন্য এক পদে কিছু ইঙ্গিত আছে। যেমন,

কলির ভাব দেখে ভাই ভেবে ভেবে মরি

কতজনে কত মতে করতেছে ফকিরী।

কেউ বলে বাতাস আল্লা কেউ বলে আগুন আল্লা

কেউ বলে পানি আল্লা আল্লা হলো ভারী।

কেউ বিন্দুমণি খোদা জেনে করতেছে ফকিরী।

কেউ বলে সাঁই নিরাকারে ভেসেছিল ডিম্ব ভরে

বিন্দু ছুটে ডিম্বের গঠন করছে আইন জারি।

কেউ বলে ফাতেমা হয় আল্লার জননী।

তবে হজরত আলী আল্লার বাবা ভাবে বুঝতে পারি॥

ফকিররা এ সব গানের জবাবি গান খুঁজে নিত লালনের রচনায়, দুদ্দুশা’র রচনায়। তারা গাইত,

কলমা আর নামাজ রোজা জাকাত হজ—

এই পড়িয়ে আদায় কর শরীয়ত।

আমি ভাবে বুঝতে পাই

এসব আসল শরীয়ত নয়।

আরো কিছু অর্থ থাকতে পারে ॥

বে-এলেম বে-মুরিদ জনা

শরীয়তের আক চেনে না

কেবল মুখে তোড় ধরে॥

এ লড়াই আজকের নয়। এক দিনেরও নয়।

কেউ যেন না ভাবেন যে পীর ফকিরবাদের সঙ্গে শরিয়ত-পন্থীদের এই মতাদর্শের সংঘাত কেবল পশ্চিমবাংলাতেই আবদ্ধ। আসলে বাংলাদেশে এই সংঘর্ষ সংঘাত খুব চরম পর্যায়ে। ইসলামি রাষ্ট্র হিসাবে সেখানে শরিয়তি আইনের দাবি অনেক জোরালো এবং মারফতিদের সেখানে আত্মরক্ষার সংগ্রাম অনেক জটিল। ‘আল্‌ সাদীদ’ নামে এক পুস্তিকার শেষে লেখক আতিয়ার রহমান ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে লিখছেন: ‘সমাজবাদ-মার্কসবাদ-ওয়াশিংটনবাদে বাংলার মুক্তি নেই। বৃহত্তম মুসলিম জাতির দেশ—এই বাংলাদেশে শরীয়তী সমাজবাদ প্রতিষ্ঠাতেই দেশ ও জাতির উন্নতি নিহিত রয়েছে।’ ম. আ. সোবহান তাঁর ‘জালালী ফয়সালা’বইয়ে লালনের মাজার ধ্বংস করার আবেদন করেছেন।

এই সোবহান সাহেব ১৯৮৬ সালে কুষ্টিয়ার ‘পীর মুরিদী অবৈধ’ এই মর্মে যে ভাষণ দেন তা ছাপা হয়ে বেরিয়েছে। সেখানে তিনি বলেছেন,

আমরা এমন একটা দেশের বা অঞ্চলের মুসলমান যে ভূখণ্ডে পীর-মুরিদী কলমিলতার মতো ছেয়ে গেছে অনেক কাল হতেই।…

আপনারা জানেন যে আমি একজন বিতর্কিত লোক। পীর-মুরিদী, মিলাদকিয়াম, ইছলে-ছওয়াব, ওরশ ইত্যাদি বেদাতের বিরুদ্ধে কঠিন যুক্তি ও বাহাছ চালিয়ে যাচ্ছি আজ অর্ধযুগ ধরে।..বাংলার বুকে এমন পীর নেই যে আমি তার বিরুদ্ধে বাহাছ করি নি। ফুরফুরার পীরদেরকে আমরা পান্টি, ভায়লা, মুন্সীপুর-কুতুবপুর, কীর্তিনগর এবং যশোরের বেণিপুর হতে মুকাবিলা ক’রে হটিয়ে দিয়েছি। আজকের সবচেয়ে বড় পীর সরকারি পীর অর্থাৎ জবরদস্ত গরুখের আটরপীর পীরের প্রায় এক ডজন আলেমদের বিরুদ্ধে কুষ্টিয়ার শহরতলী জুগিয়া গ্রামে বাহাছ করেছি। এই বাহাছে তাদের যে কি ন্যক্কারজনক অবস্থা হয়েছিল তা আপনারা অনেকেই দেখেছেন।…অনেককে দাড়ি চেঁছে পলায়ন করতে হয়েছে। শম্ভুগঞ্জের পীর, রাজশাহীর ওলাউলাহ পীর, বগুড়ার পীর, দহগ্রামের পীর, রংপুর, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, ঢাকা, টুঙ্গী এলাকায় এবং বিশেষ করে পাবনা জেলার সকল পীরদের বিরুদ্ধেই আমার মুকাবিলা হয়ে গেছে।

আসলে এত যে লড়াই, বাহাস আর মুকাবিলা এর পেছনে যত না ধর্মের উন্মাদনা ও অন্ধতা তার মূলে কিন্তু প্রধানত গ্রাম্য মনোভাব কাজ করছে। নগরজীবনের দুটি মূল লক্ষণ হল উদারতা ও উদাসীনতা। রফিউদ্দিন আমেদ তাঁর ‘The Bengal Muslims 1871-1906’ বইতে এক দিকনির্দেশী মন্তব্যে জানিয়েছেন: ‘As a community, the Muslims were overwhelmingly rural in character and they contributed only a fraction of the urban population’ রফিউদ্দিন আরেক অসমতার দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন: ‘Equally interesting and significant is the pattern of distribution of Hindus and Muslims in the various professions. Whenever the Muslims formed the bulk of the population, as in eastern Bengal, they belonged pre- dominantly to the cultivating classes, while land-holding, professional and mercantile occupations were dominated by the high-caste Hindus.’

এইখানে রয়ে গেছে বঞ্চনা আর ধন-বৈষম্যের এক দীর্ঘ ইতিহাস। গ্রাম্য জীবনের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সমাজ চিরকাল থেকে গেছে গরিব চাষির ভূমিকায় আর আচার-অনুষ্ঠান, আর্থিক সমুন্নতি ও সাংস্কৃতিক উচ্চাসন অধিকার করে রেখেছে বর্ণহিন্দুগগাষ্ঠী। তার ফলে মুসলিম সমাজ রয়ে গেছে অপেক্ষাকৃত নিরক্ষর ও গ্রাম্য। তাঁদের কাছে উদারতা ও স্বধর্মের উপগোষ্ঠী বিষয়ে উদাসীনতা কি ব্যাপকভাবে আশা করে চলে? তা ছাড়া দেশের একটা নিজস্ব ধারাও তো আছে। একসময়ে যাঁরা ছিলেন হিন্দু তাঁরাই তো হয়েছেন ধর্মান্তরিত মুসলমান। হিন্দু আচার অনুষ্ঠান, সংস্কার ও সামাজিক রীতিনীতি কি তাঁরা সম্পূর্ণ ভুলতে পারেন? সেকালের গ্রাম্য মুসলমানদের হোলি, দেওয়ালি, ভাইদ্বিতীয়া, বাউনি-বাঁধা, গোমাতাপূজা, লক্ষ্মীবার মেনে চলা এইসব হিন্দুয়ানি দেখে পরম দুঃখে মুনসী সমীরুদ্দিন লিখেছিলেন,

দেশের বেদাত হোড়া হৈল ফের মনে।

তাহার বয়ান কহি শুন সর্বজনে॥

হুলি দেওলি আর জিতিয়া দুতিয়া।

বাউনি সাঁকরাত করে এছলাম হইয়া ॥

ভাইফোঁটা গরু পরব করে মোছলমানে।

লক্ষ্মীবারে কর্জ দিবা লিবাতে বারণ।

দেশের বেদাত এইছা কি কহিব কায়॥

ওয়াহাবি আর ফরাজি আন্দোলনের মূলে শুদ্ধ ইসলামি-করণের পাশাপাশি আন্দোলনকারীরা চেয়েছিলেন পীর ফকিরদের কবর-মাজার পূজার উচ্ছেদ, মারফতিদের পরকীয়া সাধনা ও গানবাজনাকে খর্ব করতে। গুরুশিষ্যবাদকে তাঁরা মানেননি। তাঁদের আর এক প্রতিবাদ ছিল ফকিরদের এই ঘোষণায় যে আল্লাকে দেখা যায়। আন্দাজি সাধনায় ফকিরদের আপত্তি ছিল। শক্তিনাথ ঝা তাঁর এক নিবন্ধে (‘বাউল দর্শনে ভারতীয় বস্তুবাদের উপাদান’, অনীক, ডিসেম্বর ১৯৮৫-জানুয়ারি ১৯৮৬) আলেপ নামে এক পদকারের দুটি চমৎকার উদ্ধৃতি এই প্রসঙ্গে দিয়েছেন। যেমন:

১) না দেখে রূপ মহম্মদার কি করে ভজি

কেবল শুনি কর্ণেতে দেখিনিকো চোখেতে।

২) অনুমান সাধন কোন হবে রে ঠিক

রূপ দেখে সাধো তাকে তবেত হইবা রসিক।

ইসলামে ‘সেজদা’ বা প্রণাম খুব গুরুতর বিষয়। আল্লা ছাড়া কাউকে সেজদা দেওয়া হারাম। নামাজে সেজদা এক উল্লেখ্য পর্যায়। অথচ অদৃশ্য আল্লাকে সেজদা দিতে চান না মারফতি ফকিররা। তাঁদের বক্তব্য, যেমন আবেদের পদে,

না দেখে সেজদা করা মেহন্নত বরবাদ গুণায় ধরা

না দেখে তার নামে সেজদা করে যত ধোপার গাধা।

উলটে ফকিররা সেজদা করেন গুরু মুর্শেদকে, শ্রদ্ধেয় আর পূজ্যদেরও। তাঁরা ব্যক্তির (খদ্‌) মধ্যে দেখেন খোদাকে। আসলে মারফতিদের প্রধান প্রতিবাদ ইসলামি বাহ্য আচরণবাদের বিরুদ্ধে। তাই কলমা, নামাজ, রোজা, জাকাত, হজ, এই পাঁচ শরিয়তি কৃত্য তাঁদের টানে না। এইখানে উদ্যত হয় তীব্র ভুল বোঝাবুঝি। বাহাস বা বিতর্ক দিয়ে যে সংঘাতের শুরু হয় তার পরিণাম ঘটে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে বা রুহুলের মতো বাধ্যতামূলক বাস্তুত্যাগে।

ইসলাম সমাজ নারীদের পর্দাপ্রথায় যেমন সতর্ক তেমনই তাদের যথেচ্ছ আচার আচরণ সম্পর্কে সচেতন। বেনামাজি নারী বা ফকিরদের সঙ্গিনীদের গোঁড়া মুসলমান কখনও ক্ষমা করেনি। ‘যুবতী আওরত যত/ফকির হইল কত/স্বামী ছাড়ি পীরের সঙ্গে যায়’—এই বর্ণনায় ধরা আছে এক সময়কার গ্রাম্যসমাজের পীর মুর্শেদদের অপ্রতিহত বিজয়বার্তা, বিশেষত অন্তঃপুরে।

প্রতিবাদে কট্টর সমাজ নির্দেশ দেয় :

বেনামাজি আওরত যদি কাহার ঘরে হয়।

তালাক দেনা মস্তাহাব কেতাবেতে কয়॥

তালাক দিয়া করিবে দূর সেই দুরাচার

ঝাড়ু মারিবেক তার শিরের উপর॥

এইসব সংঘাত, বিদ্বেষ ও সংঘর্ষের ইতিহাস মাথায় রেখে আমি মযহারুল ফকিরের সঙ্গে গূঢ় আলোচনার প্রসঙ্গ তৈরি করতে থাকি। হঠাৎ খেয়াল হয় সহজিয়া বৈষ্ণব আর বাউলদের সঙ্গে মারফতি ফকিরদের বহু রকম পার্থক্য থাকলেও একটা জায়গায় খুব বড় মিল আছে। এই তিন দলই ‘দুই চন্দ্র’ অর্থাৎ মলমূত্র এবং কেউ কেউ ‘চারচন্দ্র’ অর্থাৎ মল মূত্র রজ বীর্য মিশিয়ে পান করেন ও গায়ে মাখেন। এই আপাত ঘৃণাযোগ্য আচরণ বহু মানুষকে অবাক করেছে। কিন্তু এই পদ্ধতি তলিয়ে বুঝতে চাননি। শিবাম্বু বা মূত্রপান এখন অবশ্য শিষ্ট সমাজকে নাড়া দিয়েছে। এর শারীরিক উপকারিতা বিষয়ে বই বেরিয়েছে অনেক। স্বমূত্র পানের মতো স্ববীর্য পানের ধারাও এদেশে বেশ পুরনো। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত ‘গণস্বাস্থ্য’ পত্রিকায় বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ১৩৯১ সংখ্যায় ‘বাউলদের যৌন জীবন ও জন্ম নিয়ন্ত্রণ’ নিবন্ধে এক আশ্চর্য বিশ্লেষণ চোখে পড়ল, তাতে বিশেষ প্রতিবেদক লিখেছেন,

একটি সত্য এই যে, মানুষের শরীরে দুটি চেতক এন্টিজেন আছে যা শরীরের প্রতিরোধ পদ্ধতির (Immunological system) অন্তর্ভুক্ত নয়। এই দুটি হ’ল চোখের জলের জলীয় পদার্থ বা অশ্রু এবং বীর্য। আমাদের চোখের জলীয় অংশ বা শুক্রের অংশ কোনক্রমে রক্তে মিশলে বিশেষ এন্টিবডি উৎপন্ন করতে পারে। সম্ভবত ঐ বীর্যপানরত পুরুষ নিজের বীর্যদ্বারাই শরীরে এন্টিবডি উৎপন্ন করবে এবং তাতে শুক্রাণুর উৎপাদন অবশ্যই অল্প হবে। তাই দেখা যায়, বাউলদের সন্তান সংখ্যা অত্যন্ত অল্প। তবে স্মরণযোগ্য, নারী কখনো এই বীর্যপান করে না।

এমনতর তথ্য জেনে বিশ্লেষণ করে মনে হয় আমাদের লোকায়তিক জীবনে দেহকে ঘিরে একটা আলাদা সমাজতত্ত্ব চালু আছে। তার আচার সংস্কার খুব জটিল আব গোপ্য। এই গোপন চন্দ্র-সাধনার নানা সাংকেতিক নামও আছে। কেউ বলে রসরতির সাধনা, কেউ বলে মাটির কাজ। সাধারণভাবে রস মানে মূত্র, রতি মানে শুক্র, রক্ত মানে রজ, মাটি মানে মল। গানে এদের আদ্য চন্দ্র, সরল চন্দ্র, গরল চন্দ্র, রুহিনী চন্দ্র এইসব শিষ্ট নামের আড়ালে লুকিয়ে রাখা হয়। মযহারুল খাঁ-র কাছে যাবার আগে হঠাৎ মনে পড়ল বিমল বাউলের কথা। আমাদের মফস্বল শহরের একটেরে চামারপাড়ায় বিমল আর তার সঙ্গিনী থাকে। বাউল মতে সাধন ভজন করে। শান্ত নির্বিরোধ মানুষ। চুল দাড়ি আছে, পরনে গেরুয়া আলখাল্লা, কাঁধে ঝোলা, ঝোলায় নারকেল মালার করোয়া। বিমলের সাধনা আর জীবিকায় মিল নেই। সে একটা দেশি পাউরুটি কারখানার হেডমিস্ত্রি। আমি যে দিন আগে থেকে খবর দিয়ে বিমলের বাড়ি যাই সেদিন সে স্পেশাল কেক নিজের হাতে বানিয়ে আনে বেকারি থেকে। সত্যি বলতে কী, বাউল বৈরাগীদের বাড়ি কেক-সেবা যেমন আশ্চর্য অভিজ্ঞতা তেমনই আশ্চর্য বিমলের খোলামেলা স্বভাব। সে আমার কাছে কিছুই গোপন করে না।

সেই কথা ভেবে একদিন হঠাৎ গেলাম বিমলের আশ্রমে। তার সঙ্গিনী চা-বিস্কুট খাওয়াল, সাধন ভজনের কথা কিছু ওপর-ওপর হল। তারপরে বাড়ির উঠোনে এক তমাল গাছের নীচে শান বাঁধানো চত্বরে আমি আর বিমল বসলাম। সন্ধে ঘনিয়ে এল। আমি তখন বললাম, ‘কোনওদিন তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি, আচ্ছা তুমি চারচাঁদ সেবা কর?’

বিমল কোনও কিছুই প্রায় আমার কাছে গোপন করে না তাই কাঁধের ঝোলা থেকে কালো রঙের করোয়া বার করে দেখিয়ে বলল, ‘এই দেখুন এতে করেই আমি রসপান করি।’

: দিনে রাতে কতবার?

: যতবার ইচ্ছে। সবটাই তো উবগার।

: আমাকে বেনোয়ারি ফকির বলেছিল, রাতে শুয়ে পড়ে যে ভাত-ঘুম আসে সেই তার পরে যে প্রস্রাব তাতে নাকি গন্ধ থাকে না। শরীরের পক্ষে উপকারী খুব।

: এ বিষয়ে নানা মত আছে। তবে চারচাঁদ খুব কঠিন সাধনা। শরীর মন খুব বশে থাকলে তবেই এ সব করা চলে। নইলে ক্ষতি হয়।

: ঠিক বলেছ। একবার বেনোয়ারি বলেছিল, চারচাঁদ করলে বাইরে বেরোনো একেবারে নিষেধ। শরীরে রোদ লাগানো মানা। তবে চারচাঁদ যদি একবার ধাতস্থ হয়ে যায় তবে অঙ্গ হবে গৌরকান্তি। আচ্ছা বিমল, তুমি চারচাঁদ করছ বা কর এখন?

বিমল বলল, ‘আপনার কাছে অজান রাখব না। আমি মাটিটা সেবা করতে পারি না। ঘিন্না লাগে। অন্য তিন চাঁদ চলে। তার পদ্ধতি আছে, মাত্রা আছে। আর কিছু জানতে চাইবেন না। একটা গান শুনুন বরং।

আমাদের চিরকালের এই ধারা

মানি না কেতাব কোরান নবীজির তরিক ছাড়া।

মশরেকী তরিক ধ’রে চন্দ্র-সূর্য পূজা ক’রে

পঞ্চরস সাধন করে চন্দ্রভেদী যারা।

সরল চন্দ্র গরল চন্দ্র রুহিনী চাঁদ ধারা—

রজে বীজে মিলন ক’রে, পান করেছি সারা ॥

আমি বললাম, ‘তোমাকে বেশি বিব্রত করতে চাই না। রজ বীজের মিশ্রণ তোমরা কী ভাবে খাও?

: ওই দুই পদার্থ জলে মিশিয়ে কপ্পুর আর চিনি দিয়ে শরবতের মতো খাই।

মানুষের সংস্কার আর রুচিবোধ খুব নিয়ন্ত্রক সন্দেহ নেই। বছরের পর বছর এদের মধ্যে ঘনিষ্ঠভাবে ঘুরছি তবু ঠিক মিশে যেতে পারিনি। বিমল আর আমি বসে আছি পাশাপাশি তবু অস্পর্শ ব্যবধান। সে কি ঘৃণা? অখাদ্য আর খাদ্যের শ্রেণীকরণ কে করেছে? রুচিবোধই কি খাদ্যাখাদ্যের সীমা ঠিক করে?

মনে পড়ল এলা ফকির আমাকে বলেছিলেন, ‘আমাদের এই পথ বড় কঠিন। আগে মন তৈরি কর তবে দেহ সাড়া দেবে। আমরা তাই বলি, লজ্জা ঘৃণা ভয় তিন থাকতে নয়। মনেই লজ্জা ঘৃণা ভয়। যা জানি না তাতেই ভয় থাকে। যা রুচিতে মেলে না তাতেই ঘৃণা। লজ্জা মানে লোকলজ্জা।’

খুব সত্যি কথা। আমার পাশে বসা পাউরুটির কারিগর বিমল এই মুহূর্তে আসলে এক নিরঞ্জন জায়গায় বসে আছে। সে সামাজিক মানুষ অথচ লজ্জা ঘৃণা ভয়ের ঊর্ধ্বে। সে কিছু গোপন করছে না। গোপনীয় মনে করছে না। অবিবাহিতা সাধনসঙ্গিনীকে সে মর্যাদা দেয়, ভালবাসে। তার সমাজ ভয় নেই। ঘৃণা নেই। তাই কিছু হারাবার ভয়ও নেই তার। আমিই শুধু সিটিয়ে যাচ্ছি। কার জীবনদর্শন সঠিক?

যাকে স্পষ্টতই তেমন জানি না, যার রুচিবোধ বিষয়ে ঘৃণা বোধ করছি, তার সম্পর্কে উদাসীনও থাকতে পারছি না কিন্তু। সে অবশ্য আমাদের উচ্চ ভোগসুখের জীবন বিষয়ে খুব নিস্পৃহ। সমাজনীতি সুস্থ জীবনধারণ বিবাহবন্ধন পুজো-আচ্চা কিছুই সে মানে না। তবু আত্মস্থ ও আনন্দিত। তার সঙ্গিনী বয়স্থা আর অসুন্দরী। সবই আশ্চর্য। সভ্য শিক্ষিত মন দাবি করছে বিমল পারভার্ট। মযহারুল খাঁও কি তবে বিকৃতিরুচি? কী করে হবে তা? তিনি তো বিবাহিত, সংসারী, সন্তানের পিতা। ফকিরি মানেই বিকৃতি কে বলেছে? বাউল মানেই কামনাকলুষিত?

সাত-পাঁচ উথাল-পাথাল ভাবনার ঝাপটায় মন দোলে আমার। শেষপর্যন্ত বিমলকে বহুক্ষণ ধরে চেপে রাখা কথাটা বলে ফেলি, ‘আচ্ছা, বলো তো, তোমাদের রসরতির সাধনা আমি বুঝি, সে তো নিজের কাছেই শরীরের মধ্যে আছে। রজ তোমরা কোথায় পাও বলো তো?’

বিমল খুব নিচু গলায় বলল, ‘এটা খুব গোপন ব্যাপার। আচ্ছা বলুন তো আমি কেন চামারপাড়ার এদিকে থাকি?

: সে তো সোজা উত্তর। তুমি অসামাজিক জীবন যাপন কর। তোমার বিবাহিতা স্ত্রী নেই, অন্য সঙ্গিনী নিয়ে থাক। বনেদি পাড়ায় কি তা চলবে?

: হুঁ। সেটা একটা কারণ। আসল কারণ হল, এটা যাকে আপনারা বলেন ছোটলোকের পাড়া। ছত্রিশ জাতের বসতি? এখানে সমাজের অত বন্ধন নেই। খোঁজ নিয়ে দেখবেন বেশির ভাগ স্বামী স্ত্রী আসলে বিয়ে করা নয়। হয়তো কালীবাড়িতে একটা মালা-বদল হয়েছে। ভাব-ভালবাসা হয়েছে। থাকে একসঙ্গে। সন্তান হয়। ছাড়াছাড়িও হয়। এরা কিন্তু বাউলবৈরাগীদের খুব মান্যতা দেয়। খুব ভক্তি খুব সেবা দেয় ডেকে নিয়ে গিয়ে।

: কেন?

: ওদের তো বামুন পুরুত নেই। উঁচু সমাজে যাতায়াত নেই। অথচ খুব পাপের ভয়। সব দেখবেন গুরুর কাছে দীক্ষা নেয়। পরকালের ভয় আছে তো? খুব গুরুসেবা দেয়। কেউ না কেউ গুরু একটা আছেই ওদের। গুরু যা বোঝায় তাই বোঝে। তবে কী জানেন, সব গুরুর দৃষ্টি তো ভাল নয়, সবাই সাধকও নয়। সুযোগ নেয় অনেকে। গুরুসেবার নামে ব্যভিচার আকছার।

আমি বললাম, ‘তার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কী? তুমি তো আর গুরুগিরি কর না।’ লম্বা জিভ কেটে বিমল বলল, ‘ছি ছি, আমি গুরু হব কি? আমার ষোলো-আনা শিক্ষাই যে হয় নি। আসলে আমরা কিছু ওষুধ বিষুধ জানি। তুকতাক, মুষ্টিযোগ, জড়িবুটি। বিপদে আপদে দিই, ওরাও আমাকে দেয়।’

উত্তেজনা চেপে বললাম, ‘তোমাকে দেয় মানে? আমি যা ভাবছি, যাকে বলে রজ, তোমাকে দেয়?’

: দেয়। আমি না চাইলেও দেয়। বাড়িতে এসে গোপনে দিয়ে যায়। সেটাই ধর্ম।

: কীসের ধর্ম? কে বলেছে?

: উঁহু, অত চটবেন না। ওরা ওটাকেই ধর্ম বলে মানে। আপনি বাধা দিতে পারবেন? ওদের শিখিয়েছে এই ভাবেই।

: কে শিখিয়েছে?

: কেন বাউল-ফকিরেরা। সে কি আজ? শতশত বছর এমন চলছে। বাউলদের কাছে ওরা দেহের কত কী শেখে জানেন? আর একটা কথা বলি। জেনে রাখুন, এই সব পরিবারে কোনও কুমারী মেয়ে যখন প্রথম রজ দেখে তখন তা দান করে আমাদের। দান করবেই। আমরা তা সেবা করব। অনেক তপস্যাতে ওই সব মেলে। সেবা করলে বিরাট শক্তি আসে। এবারে বুঝেছেন তো কেন এখানে থাকি?

বলতে গেলে অনেকটাই বুঝে ফেলে আমার ভেতরে বিপ্লব চলছে। মানুষের অজ্ঞতা একটা আশীর্বাদ সন্দেহ নেই। জীবনের বেশ কিছু রহস্য অপ্রকটিত থাকাই ভাল। তাতে স্বস্তি। নিম্নবর্গের সমাজজীবনে এখন থেকে একটা অস্বাক্ষরিত চুক্তির লেনদেন আমার আর গোপন থাকবে না। শ্রমজীবী পুরুস-নারী দেখলেই উদ্যত হবে সন্দেহের তীর: এরাই কি? এরাও কি? রাজনীতি সমাজতত্ত্ব নির্বাচন রাষ্ট্রবিপ্লব আর আণবিক যুদ্ধের আশঙ্কার আড়ালে বয়ে যাবে এক চোরা স্রোত। দেহ, দেহ-সংস্কার, যৌনতা, বিন্দুধারণ, নিয়ন্ত্রণ, শরীরী ভাবনা। রাত যেমন করে দিনের আলোর মধ্যে লুকিয়ে রাখে তার অন্ধকার, তেমনই বৈরাগ্যের অন্তঃশীল গৈরিকে ভরে আছে কামনাকুসুম।

*

চৈত্রের এক সকালে পৌছলাম সেই গোরাডাঙা। সেবার সমস্ত জমিজিরেতে মোড়া ছিল শীতের ধূসর চাদর, এবার তকতকে ঝকঝকে সূর্যের সংসার। উদভ্রান্ত বসন্ত বাতাস আর লাফিয়ে চলা ফড়িং। গ্রামবাসীরা জানতে চাইছে গন্তব্য। মযহারুল খাঁর নাম বলতে সবাই বলছে: ‘চলে যান, সোজা সরান।’

শেষপর্যন্ত সোজা রাস্তা অবশ্য বাঁক নেয় আর আমার চোখে পড়ে ফকিরের বড় দালানকোঠা। বাইরে অড়হরের কেটে আনা স্তৃপা এক পাশে ঘুট ঘুট ঘুট ঘুট শব্দে মেশিনে চলছে গম ঝাড়াই। সেখানকার তদারকি করছে মনজুর। হেসে এগিয়ে এল, ‘সত্যিই এলেন তা হলে। আসুন। বসুন ঘরে। আব্বাকে ডাকি।’

আব্বা আসার আগেই অবশ্য বাড়ির খুদে ছেলেমেয়েগুলো জটলা করে। অবাক হয়ে দেখে শহরবাসী আজব জীবটিকে। আমার চোখ ততক্ষণে উঠোনে। সরষে শুকোচ্ছে। ছোলা গাছ এক পাঁজা আনা রয়েছে। এখনও মাড়াই হয়নি। বাড়ির বউরা বেগুনফুলি আর কটকটে সবুজ শাড়ি পরে গেরস্থালি সামাল দিচ্ছে। সম্পন্ন সংসার। বিস্তারধর্মী গৃহস্থী। ধানের তিনটে মরাই কিন্তু গোরু নেই তো। গোয়ালই বা কই? মনজুর এসে বলল, ‘আব্বা আসছেন নাস্তা সেরে। একটু বসুন।’

আমি বললাম, ‘মনজুর, তোমাদের এতবড় সংসারে গোরু নেই কেন?’

: ছিল তিন-চারটে। বেচে দেওয়া হয়েছে।

: কেন?

: লোকের অভাব। আজকাল তো কিষাণ মেলাই ভার। বাড়িতে কাজের লোক পাওয়া যায় না। গোরু রাখলে জানেন তো গোরুর মতো খাটতে হয়। বাড়ির বউরা সব দিক সামাল দিয়ে আর পারে না। তাই…সব দিক ভেবে…আজ থাকবেন তো? গান-বাজনা হবে। সবাইকে খবর দেব।

ইতিমধ্যে মনজুরের মামা খৈবর এসে পড়ে। আগের বার শুনেছি তার বাঁশি-বাজানো। আসলে মযহারুল খাঁ ছেলেদের নিয়ে আর শ্যালক খৈবরকে নিয়ে এক ফকিরি গানের দল বানিয়েছেন। নানা গ্রামে গেয়ে বেড়ায় এই দল। মযহারুল গান লেখেন। জমায়েতে গানের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন। কবার বাংলাদেশে লালন শাহের মাজারেও গেয়ে এসেছে এরা।

প্রায় সমস্ত দরজা জুড়ে মযহারুল ঢুকলেন ঘরে। ছ ফুটের ওপর লম্বা মানুষ, তার সঙ্গে মানানসই রকমের চওড়া। পরনে সাদা শার্ট ধুতি। চেহারা দেখলে ফকির বলে মনে হয় না। আসলে ফকিরি তো একটা দেহগত জীবন পদ্ধতির নাম, সেইসঙ্গে মনেরও উন্নত প্রকর্ষ। বাহ্যিক পোশাক-আশাক চুল দাড়ি যে রাখতেই হবে এমন তো কোনও কথা নেই। তা ছাড়া মযহারুল পুরো গৃহী মানুষ। এখন অবশ্য ছেলেরা লায়েক হয়ে গেছে। তারাই দেখে সব দিক। বাবাকে মুক্তি দিয়েছে তাঁর নিজস্ব বৃত্তে।

রসে ধাতস্থ হয়ে কথা চালাচালি শুরু হতে একটু সময় লাগল। তার মধ্যে চিঁড়ে-দুধ এল। মনজুর বলল, ‘এমন আমাদের গ্রাম যে একটা মিষ্টির দোকান নেই। মিষ্টি আনতে যেতে হয় ছ মাইল দূরে সেই নাজিরপুরে। আপনাকে আদর-আপ্যায়ন করতে পারলাম আগে খবর পেলে…’

তার কথা থামিয়ে বলি, ‘মানুষের কাছেই তো আসা। খাওয়াটা গৌণ। শুধু দেহরক্ষা বই তো নয়।’

বাধা দিয়ে মযহারুল বললেন, ‘কথাটা ঠিক বললেন না। এই জগতের নাম দুনিয়া। দুটো জিনিস নিয়ে জগৎ চলছে। কী কী বলুন তো?’

নিজামী বলেছিল, বড়লোক-ছোটলোক, ধনী-দরিদ্র, মনে পড়ল। কিন্তু সে কথা এখানে খাটবে না। তাই চুপ করে জিজ্ঞাসু চোখে চাইলাম কেবল।

মযহারুল বললেন, ‘দুনিয়া মানে দু-নিয়া। সেই দুই হল জিহ্বা আর লিঙ্গ। এই দুই দিয়ে যাবতীয় আস্বাদন। আস্বাদনই তো বেঁচে থাকা।’

বলতে গেলে প্রথমেই চমকে গেলাম। প্রথমত, তাঁর বস্তুবাদী চিন্তার স্বচ্ছতায় আর দ্বিতীয়, মনজুরের উপস্থিতিতেই তাঁর এই স্পষ্ট কথা বলার ভঙ্গিতে। মনজুরকেও অবশ্য কিছুমাত্র অপ্রতিভ বা বিব্রত দেখাল না। সেটাও আমার উচ্চবর্গীয় জীবনযাপনের ধ্যানধারণায় চমকে যাবার মতোই। যাই হোক ক্ষণিক চমক কাটিয়ে উঠে আমি বললাম, ‘ওই আস্বাদনের ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করুন একটু।’

: হ্যাঁ, সেটা বোঝা দরকার। দেখুন মানুষের শরীরে আস্বাদন করবার জন্য আল্লা ওই দুটোর সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু তার মধ্যে মজা আছে একটা। দুটোর দ্বারা একসঙ্গে আস্বাদনসুখ পাবেন না। আলাদা আলাদা।

: কেন?

: ভেবে দেখুন, যখন পোলাও কালিয়া রাজভোগ খেয়ে জিভের সুখ পায় মানুষ তখন কি তার দেহসঙ্গমের ইচ্ছা হয়? আবার যে সময়ে কেউ সঙ্গম করে তখন মুখের সামনে পোলাও কালিয়া দিলেও মুখ ফিরিয়ে নেবে। অদ্ভুত আইন। যখনকার যা তখনকার তা। আর ওই যে বললেন আহার মানে দেহরক্ষা ওটাও হিন্দুয়ানির কথা। উপপাস-ব্রত-পার্বণ, দেহকে সংযমে রাখা, ও সব বাজে। মনের সংযম আসল। আর দেহরক্ষাই তো আসল ধর্ম। আমাদের ফকিরি মতে বলে, পঞ্চভূত ভর করে ফলমূল দানা শস্যে। সেই খাদ্য থেকে শুক্রের জন্ম। শুক্রই জীবন। তার পতনেই মৃত্যু। বিন্দু রক্ষাই তো আমাদের করণ।

খুব স্পষ্ট কথা। স্বচ্ছ চিন্তা। তবু একটু রন্ধ্র খুঁজতেই যেন আমি বললাম, ‘বিন্দুর ক্ষয় তো দেহধর্ম। তা কি অস্বাভাবিক?’

: কেন অস্বাভাবিক হবে? রিপু ইন্দ্রিয়াদিকেও কিছু দিতে হবে বইকী। রিপুদমন ব্রহ্মচর্য এ সব বস্তুবাদীদের কথা নয়। আমার কি সন্তান হয়নি?

চা খেতে খেতে মযহারুল শুরু করলেন আবার, ‘আমার এখন বয়স ষাট। কুড়ি বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে। কুড়ি থেকে তিরিশ এই দশ বছর আমি সন্তানের জন্ম দিয়েছি। ব্যস। আমার দুই বিবি। তিন ছেলে এক মেয়ে। বড় বউয়ের কোলে ছেলে, ছোট বউয়ের কোলে মেয়ে। ব্যস। আর জন্ম দিইনি।’

: এমনভাবে বলছেন যেন জন্মদান আপনার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপার?

: বস্তুবাদে তো তাই। পুরুষ ক্ষেত্র, নারী ক্ষেত্র। বীজ খাঁটি হলে জমি উর্বর হলে ফল হবে। আবার বীজ বিনা শুধু কর্ষণে ক্ষতি নেই। ফকির বিন্দুধারণ ও বিন্দুচালন জানে। তার পতনের ভয় নেই। আমার ছেলেরাও ফকিরি মতে আছে।

একেবারে তো বিনাযুদ্ধে আত্মসমর্পণ করা চলে না, তাই ফকিরকে একটু টোকা মারবার জন্যে বললাম, ‘দুবার বিয়ে করলেন কেন? ইসলামে প্রশস্ত বলে?’

‘আরে না মশাই’ মযহারুল একগাল হেসে বললেন, ‘নিতান্ত প্রয়োজনে। আমার বড় বউ খুব সুন্দরী আর খুব ভাল মানুষ। সংসার যখন বড় হয়ে গেল, চারটে-পাঁচটা সন্তান হল, সে ন্যাকা বোকা মানুষ, সব দিক সামাল দিতে পারত না, তাই আবার বিয়ে করলাম। আমার ছোট বউ খুব খাটিয়ে আর খুব হিসেবি। আমার সংসার সেই মাথায় করে রেখেছে। ছেলেদের তো সে-ই মানুষ করেছে। তাকে কিন্তু দেখতে ভাল নয়। যাকগে ও সব ভ্যানতারা কথা। কী সব যেন জানতে চান জিজ্ঞেস করুন দেখি।’

: যা জানতে চাইব সব বলবেন? গোপন করবেন না তো?

: যা জানি তা সব বলব। যা আমার ভানে নেই তা বলতে পারব না। জানেন তো রসিদের পদে বলছে, সাজিয়ে আলেম হইলে জালেম/লান্নাতের তৌক পড়িবে গলায়।’

: তার মানে?

: আলেম মানে জ্ঞানী, জালেম মানে অন্ধকারাচ্ছন্ন অজ্ঞানী। অজ্ঞানী হয়েও যদি কেউ জ্ঞানী সাজে তবে তার গলায় পড়বে পাপ বন্ধন। তো আপনি এবার প্রশ্ন করুন।

আমি বললাম, ‘আপনারা তো বর্তমানবাদী। তার মানে কী?’

: এক কথায় লালনের গানে কথাটা বোঝানো আছে—‘যারে দেখলাম না নয়নে তারে ভজিব কেমনে। যার বস্তুরূপ নেই তাকে অনুমানে আমরা বুঝতে চাই না। ইন্দ্রিয় দিয়ে যা প্রমাণ করা যায় না তা আমরা মানি না। সেইজন্য আমরা আগে রূপ দেখি তবে সেজদা দিই। আবার এই রূপ নেই বলে আমরা পুনর্জন্ম মানি না। প্রমাণ নেই। যে রূপ নিয়ে মানুষ জন্মায় মরণের পর তো সেই রূপ আর ফেরে না। লালন তাই বলেছেন, ֹ‘নামের তুল্য নাম পাওয়া যায়/ রূপের তুল্য রূপ কোথা পাই?’

: বাউলরাও তো বর্তমানবাদী, তাদের সঙ্গে আপনার তফাত কোনখানে?

: তফাত কোথায় জানেন? বাউলরা মেয়েছেলে সাধনসঙ্গিনী নিয়ে সব জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। ওটা ঠিক নয়।

: কেন?

: আমার যে সঙ্গিনী বা স্ত্রী সে তো আমাকে একমনে ভালবাসে। তাকে বাইরে সবার সামনে বার করা কি ঠিক? তার মন তাতে তো চঞ্চল হতে পারে। সে তো আমাকে না-ভালবেসে অন্য কাউকে ভালবাসতে পারে। নারীর মন চঞ্চল করতে নেই। তারাই আমাদের সুখ-শান্তি দেয়। সংসার সমাজে তারাই সব দিক ঠিক রাখে। তারাই সন্তান ধারণ করে। তাদের চাঞ্চল্য এলে জগৎ টলে যায়।

আমি বলতে যাচ্ছিলাম যে, মযহারুলের চিন্তায় রয়েছে মুসলমানদের পর্দা প্রথার প্রভাব, এমন সময় একজন গরিব গ্রামবাসী ঘরে ঢুকল তার কিশোর সন্তানকে নিয়ে। ছেলেটা রাতে খোয়াব দেখে হাসে, লাফিয়ে ওঠে। ফকির সাহেব যদি তাকে কোনও কবচ তাবিজ দেন।

মযহারুল আমার কাছ থেকে একটুকরো কাগজ নিয়ে তাতে কী-সব আঁকিবুকি কাটলেন, তারপরে সেটা মুড়ে, তাতে দুবার ফুঁ দিয়ে মাদুলিতে ভরে লোকটিকে দিয়ে বললেন, ‘কালো সুতো দিয়ে বাঁ হাতে বেঁধে দেবে।’ গরিব মুসলমান ভরসা রাখে গ্রামীণ ফকিরের ওপর। কৃতজ্ঞ মুখে চলে গেল সে। হঠাৎ আবার ফিরে এসে বলল, ‘খাওয়া দাওয়ার কোনও বাধা নিষেধ মানতে হবে?’

: কিছু না, কিছু না। কেবল যদ্দিন রোগ না সারে বাড়িতে গোরুর মাংস খাবে না।

লোকটি চলে যেতেই আমি বললাম, ‘এটা কেমন হল? মাদুলির সঙ্গে গোমাংসের সম্বন্ধ কী?’

এটা হল ফকিরি বুদ্ধি? মযহারুল হেসে বলেন, ‘জানেন তো মসজিদের ইমাম নানা বিধান দেয়। মুসলমানে তা মানে। ওরা কেমন বলে জানেন তো? বেশরা ফকিরদের বাড়ি পাত পাড়বে না। গান শোনা গান গাওয়া হারাম। ফকিরি গান শুনবে না। ওরা এদিকে গান ভালবাসে। কী-যে করে। আমাকে বলে ফকিরি গান পাক না না-পাক? শুনতে মন চায় এদিকে মৌলবী মানা করে। আমিও সুযোগ পেলে একটু আধটু বদলা নিই। এই যেমন বলে দিলাম গোরুর মাংস খাবে না। আর জীব কি কোনও ধর্মে পড়ে? সবাই সব খেতে পারে।

: ঈশ্বর কি কোনও ধর্মে পড়েন?

: একদম নয়। শোনেন নি সেই গান?

মুসলমানে ভাবে আল্লাহ্‌ আমাদের দলে

এমন বোকা দেখেছ কে কোন কালে।

আল্লাহ্‌ কারো নয় মেসো খুড়ো

এ কথাটির পেলি নে মুড়ো

চুল পেকে হলি রে বুড়ো খবর না নিলে।

: তার মানে আল্লা আমারও?

: হ্যাঁ, কেন নয়? কৃষ্ণও তো আমার। আপনি কুবির গোঁসাইয়ের গানে শোনেননি, ‘আল্লা আলজিহ্বায় থাকেন আত্ম সুখে/ কৃষ্ণ থাকেন টাকরাতে?’

: কৃষ্ণকে তো আপনারা শুক্র বলেও মানেন।

: হ্যাঁ, নরনারীর দেহ মিলনে তাঁর রাসলীলা/ নারীর শরীরে থাকে রাধাবিন্দু। সেখানেই মেলেন কৃষ্ণ।

: তা হলে চুম্বন আলিঙ্গন স্পর্শন এ সব কী?

: ওরা কৃষ্ণের সহচর দ্বাদশ গোপাল। শ্রীদাম সুদাম বসুদাম এঁদের নাম শুনেছেন তো?

: নারী শরীরে কি তবে কৃষ্ণ থাকেন না?

: হ্যাঁ, সেখানে তাঁর কাজ আলাদা। কৃষ্ণ সেখানে পালনকর্তা। তাই নারীর গর্ভসঞ্চার হবার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি আসন নেন গর্ভফুলে। সেই ফুল থেকে রসরক্ত পান করে শিশু বেঁচে থাকে। তারপর শিশু জন্মেই সেই কৃষ্ণকে হারায় আর কাঁদে শুধু ‘কাঁহা কাঁহা’ বলে। এই কাঁহা মানে আমি কোথায়? কৃষ্ণই বা কোথায়?

খানিকক্ষণের স্তব্ধতা নামে গোরাডাঙার ঘুঘু ডাকা মধ্যদিনে। আমি অবাক হয়ে ভেবে চলি কেমন করে এমন সব বিচিত্র ভাবনা বয়ে চলেছে আমাদের সকলের অগোচরের জগতে! এদের কি ভ্রান্ত বলব না কি বাতুল? এ কথাও তো ভাবতে হবে, এমন সৃষ্টিছাড়া ভাবনা ধারণা নিয়ে এই যে বেঁচে-থাকা তাতে চলমান জীবনের সঙ্গে কোনও সংঘাত হচ্ছে না। জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ ঘটে যাচ্ছে, উন্নত সার ব্যবহারে জমি হচ্ছে অতিপ্রজ, গভীর নলকূপের জল পাচ্ছে চাষি, আধুনিক যন্ত্রে ঝাড়াই হচ্ছে মাঠের পর মাঠ ভরা গম। তার মধ্যেই ফকির তত্ত্ব চলছে, শরিয়ত-মারফতে চলছে অন্তৰ্গঢ় রেষারেষি। মনজুর খৈবররা ফকিরি নিচ্ছে, গাইছে তত্ত্বগান। এই মযহারুল খাঁ-ই বাউল-ফকির সংঘের সংগঠনে এগিয়ে আসছেন। বস্তুবাদে বিশ্বাসী মানুষটি নির্বিকার চিত্তে রোগ আরোগ্যের ভাববাদী মাদুলি দিচ্ছেন। যাকে চোখে দেখেন তাকে অনুমান বলে মানেন না যিনি, তিনিই কিন্তু শরীরে কৃষ্ণের অবস্থিতি মানেন চোখে না দেখেও। তবে কি কৃষ্ণ এদের চিন্তায় কোনও ভাববিগ্রহ নয়, প্রবাহিত জায়মান জীবনের অন্য নাম?

ভাবনার ভরকেন্দ্র টলে গেল সহসা, কেননা দুপুরের খাওয়া দাওয়ার সময় হল। যে খাটে আমি আর মযহারুল কথা বলছিলাম সেই বিছানাতেই একটা গামছা ভিজিয়ে নিংড়ে লম্বা করে পাতা হল। তার একপ্রান্তে মযহারুলের ভাতের থালা, আরেক প্রান্তে আমার। নিরামিষ রান্না। ঝাল-মশলা একটু খর। কোনও মহিলা এলেন না, মনজুরই সব দেওয়া নেওয়া করল। খাওয়ার শেষে জানতে চাইলাম কেমন করে ফকিরি লাইনে গেলেন মানুষটি।

: খুব ছেলেবেলা থেকেই আমি জ্ঞানী। মানে ন-দশ বছর বয়স থেকেই জানতে আগ্রহ হত খুব, আল্লা কোথায় থাকেন। বাবার সঙ্গে মসজিদে যেতাম, আরবি-পারসি পড়তাম, কোরান পড়তাম, কিন্তু মন ভরত না। আন্দাজি ধর্ম তো। তখন আমাদের গাঁয়ের আশেপাশে অনেক আলেম ফকির থাকতেন। তাঁদের কাছে খুব গোপনে যাতায়াত করতাম। গোপনে, কেননা বাবা জানলে মারধোর করতেন। তিনি ছিলেন খাঁটি নামাজি মুসলমান। শরিয়ত-মানা এলেমদার। শেষপর্যন্ত অবিশ্যি খুব গোলমাল বেধে গেল। আমি নমাজ রোজা এইসবে নারাজ হলাম। বলতে পারেন মন সায় দিল না। বাবা খুব মারধোর করতেন। গ্রামের লোকজন গালমন্দ শত্রুতা অনেক করেছে। সে সব কথা এখন আর মনে নেই।

: গ্রামের লোক আপনাকে মেনে নিল শেষপর্যন্ত?

: দেখছেনই তো। আসলে আমি তো কারুর সঙ্গে মারপিট করতে যাইনি, বলিনি ‘ফকিরি কর’। আমি আমার মতো সাধন ভজন করতাম, গান গাইতাম। মোল্লা মৌলবীরা ডাকলে বাহাস করতাম। কেউ আমার সঙ্গে তর্কে পারেনি বা আজও পারে না এ দিগরে। আমি তো একসময়ে টানা দশ বছর এই বাড়ির একটা ঘর থেকেই বেরোইনি।

: কেন?

: ফকিরি সাধনা কি সোজা নাকি? সে কি লোক-দেখানি? দমের কাজ, দেহযোগ অনেক রকম আছে। সে সব মুর্শেদের কাছে শিখে নিজের দেহে কায়েম করতে হয়। তবে দখলে আসে।

আমি বললাম, ‘তারপরে সবাই আপনাকে মেনে নিল?’

মযহারুল খাঁ প্রত্যয়ী হাসি হেসে বললেন, ‘না মেনে আর কী করবে? এককালে এ গাঁয়ে আমি ছিলাম বলতে গেলে একঘরে। আর আজ একচেটিয়া সব ফকিরি মতে টেনে এনেছি। নিজেরাই এসেছে। যারা আসেনি তারা শত্রুতা করে না। ব্যস, ভালই আছি।’

আমি বললাম, ‘বাংলাদেশে তো গেছেন। ওই দিকে ফকিরি মতের কেমন অবস্থা?’

: খুবই রবরবা। আর বিরাট বিরাট সব ফকির আছে। ভাল ভাল গাহক আছে। জালাল রশিদ এদের তত্ত্ব গান খুব চালু ওখানে। কুষ্টিয়া যশোর ফরিদপুর আর রংপুরে অনেক ফকির থাকেন। জ্ঞানী। আরবি চর্চা করেছেন সব।

: আমি এবারে একটা অন্য ধরনের প্রশ্ন করব। আমার কাছে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত একটা লেখা রয়েছে, ‘বাউলদের যৌনজীবন ও জন্মনিয়ন্ত্রণ’। লেখাটা সঙ্গে আছে। ওর মধ্যে দু-একটা জায়গা আপনার কাছে বুঝে নেব, সত্যি কথা লিখেছে কি না। খুব অস্বাভাবিক ব্যাপার তো?

কৌতুহলী হয়ে ফকির বললেন, ‘কী লিখেছে পড়ন তো?’

আমি লেখাটা বার করে একটি জায়গা পড়তে লাগলাম, মযহারুল খুব আগ্রহ নিয়ে শুনতে লাগলেন।

তাদের মতে যক্ষ্মা ও অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী অসুখে নারীর বুকের দুধ বিশেষ উপকারী। নিয়মিত বুকের দুধ পান করলে যৌবন ও তারুণ্য সহজেই ধরে রাখা যায় এবং দুধ প্রদানকারী নারীর সন্তানও জন্মে না। আমি একজনকে জানতাম যিনি এভাবে তার তারুণ্য ও যৌবনকে দীর্ঘস্থায়ী করেছিলেন এবং বাউল গানে ছিলেন অদ্বিতীয়। আশি বছরের অধিক বয়সে তাঁর মৃত্যু হলেও তাঁকে কখনো বৃদ্ধ জরাজীর্ণ ও ভেঙে পড়া শরীরের মানুষ মনে হয়নি। মূলতঃ এগুলো সবই হচ্ছে বাউল ধর্মের অত্যন্ত গোপন প্রক্রিয়াসমূহ যা বাউলসমাজের বাইরে খুব অল্প লোকই জানেন।

সবটা শুনে মযহারুল একটু গম্ভীর হলেন। তারপর বললেন, ‘এ সব লিখে দিয়েছে? কথাগুলো সত্যি। আপনি বাউলদের দলে দেখবেন নানা বয়সের মেয়ে থাকে। নানা উদ্দেশ্যে তাদের রাখা হয়। বুকের দুধ খাওয়ালে স্ত্রীলোকের সন্তান হয় না এ কথা সত্যি। হ্যা, আর কী লিখেছে পড়ুন তো, জানতে মন চাইছে।’

আবার পড়তে লাগলাম,

সঙ্গিনী ছাড়া বাউলধর্ম অন্তঃসারশূন্য। স্বামী স্ত্রী অথবা বিশেষভাবে নির্বাচিত সঙ্গিনীর সাহায্যে এই ধর্মের পালনীয় ক্রিয়াসমূহ নিষ্পন্ন করা হয়।

বাউলদের মধ্যে শ্বাস নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই জীবনের চরম আনন্দ ও শান্তি লুকিয়ে আছে। নিজের স্বাসকে যদি ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করা যায় তবেই সকল সমস্যা ও যন্ত্রণা থেকে মুক্তি সম্ভব। এই শ্বাস পদ্ধতিকে ভিত্তি করেই বাউলদের যৌনজীবন গড়ে উঠেছে।

পুরুষ বাউল নারীকে সাধনার ক্ষেত্র হিসেবে মনে করে। নিজের তৃপ্তির সঙ্গে নারীকেও তৃপ্তিদানে তারা সচেষ্ট হয় যা গ্রামীণ আর দশজন পুরুষের মধ্যে লক্ষণীয় নয়। এই হেতু সাধারণ সংসার অপেক্ষা বাউলদের জীবন সুখী অন্তর্মুখী ও তৃপ্তিপূর্ণ।

প্রতিটি বাউল দম্পতিই নিয়মিতভাবে তাদের মাসিক খুঁটিনাটি বিষয়গুলো যত্ন সহকারে পর্যবেক্ষণ করে। এই পর্যবেক্ষণের মধ্যে রয়েছে একটি দৃঢ় ধর্মীয় বোধ। যা লালনের একটি গানে বিধৃত। গানটি হল: সব গাছেরই ফুল ফোটে কিন্তু সব ফুলেরই ফল হয় না। অর্থাৎ মাসিক হলেই যে নিয়মিত ডিম্ব স্ফোটন ঘটবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই ডিম্ব স্ফোটন নির্ণয়ের পন্থা হলো—মাসিকের স্বাদ গ্রহণ। এই স্বাদের তিনটি পর্যায় আছে। মধুর মতো মিষ্টি, নোনতা ও টক। যদি মিষ্টি হয় (যা মধুর ন্যায়) তা হলে বুঝতে হবে নারী অবশ্যই উর্বর।।

এই রজঃ বা মাসিক পরীক্ষার আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে এর উজ্জ্বলতা বা রং পরীক্ষা করা। একটি সাদা কাগজ বা সাদা কাপড়ের ওপর এক ফোঁটা রজঃ নিয়ে সূর্যালোকে ধরলে এক যথার্থ রং প্রকাশিত হয়। রজের রং চার ধরনের হতে পারে। লাল, হলুদ, কালো এবং সাদা। বাউলদের ভাষায় লাল, জরদ, সিয়া ও সফেদ। এই চার রং-এর মধ্যে গভীর অর্থ বিদ্যমান। এখানেও লাল রং-এর অর্থ নারী উর্বর।

বাউলদের মতে নারী ও চাঁদের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই।…এখানে বলা দরকার, বাউলদের মতে, পুরুষরা সব সময়ই উর্বর থাকে না। পূর্ণিমার সময় পুরুষদের উর্বরতা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়।

সব শুনে মযহারুল বললেন, ‘সব কথাই ঠিক লিখেছে। আর এসব কথা তো বাউল গানেই আছে। ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে’ শোনেননি? আরেকটা গান আছে ‘অমাবস্যায় চাঁদের উদয়’ শুনেছেন।

: শুনেছি কিন্তু মানে বুঝিনি?

:নারীর রজঃস্রাবের সময়কে বলে অমাবস্যা। এই সময় বাঁকা নদীর বাঁকে অধর মানুষ মহামীন রূপে খেলতে আসেন। তাঁকে ধরতে হয় সেই সময়। সেই হল মহাযোগ। কিছু বুঝলেন না, তাই নয়? আচ্ছা লালনের একটা গান শুনুন,

তিন দিনের তিন মর্ম জেনে

রসিক সাধলে ধরে তা একই দিনে।

অমাবস্যা প্রতিপদ।

দ্বিতীয়ার প্রথমে সে তো

দরবেশ লালন বলে তাই তার আগমন

সেই যোগের সনে॥

এর মানে হল নারীর রজঃস্রাবের প্রথম ও দ্বিতীয় দিনের মাঝামাঝি সময়ে নারী-শরীরে আলেখের খেলা। তাঁকে ধরতে পারলে পাওয়া যাবে কোটিজন্মের সুখ আর উলটে যদি ঘটে যায়, বিন্দুপতন তবে সাধককে চিবিয়ে চুষে খাবে কাম-কুমির। সাধকের পতন হবে।

: বেশ বুঝলাম। কিন্তু পূর্ণিমাটা বোঝান, ওই যে তখন বললেন ‘অমাবস্যায় চাঁদের উদয়’?

: ও, আকাশে যখন পূর্ণিমা তিথি তখন পুরুষের জোয়ার আর সেই সময়ই যদি নারী সঙ্গিনীর ঘটে অমাবস্যা তবে সেই সংযোগ হল সেরা সাধনসময়। খুব কম ঘটে সচরাচর।

আমি বললাম, ‘এবারে বুঝলাম বাউল ফকিরদের দেহযোগ আসলে এক লুকোচুরি খেলা। ওদিকে কামনার দারুণ টান, মহামীনের পাশেই আছেন কুমির। ঠিকভাবে মীনকে খেলাতে পারলেই অধর মানুষ ধরা পড়বে অটলের সাধনে আর ভুল করলেই কুমিরের মুখে পতন। ঠিক বুঝেছি তো? আচ্ছা এবারে বলুন তো জীবজগতে দেখেছি দেহসঙ্গমের নির্দিষ্ট বিশেষ ঋতু আছে অথচ মানুষের শরীরীতৃষ্ণা তিনশো পঁয়ষট্টি দিন এমনকী সর্বদাই। তা হলে কি মানবজীবন সবচেয়ে হীন আর কলুষিত নয়? মানুষে ঈশ্বর এতখানি দেহের দাসত্ব দিলেন কেন?

: প্রথমেই বলি, যাকে বলছেন দাসত্ব, তাকেই যদি বলি প্রভুত্ব। জীবজগৎ এই প্রভুত্ব পায় না। তারা কামনার টানে মিলিত হয়। জন্মদানই তার লক্ষ্য। তাদের আনন্দ নেই, প্রেম নেই, আপনার কথায় ‘লুকোচুরি খেলা’ নেই। একমাত্র মানুষকেই আল্লা এই মনের আনন্দ, দেহের সুখ, প্রেমের অনুভূতি দিয়েছেন কেন না মানুষকেই তিনি সবচেয়ে ভালবাসেন।

এবারে আমি গভীর দৃষ্টিতে মযহারুল খাঁ-র দিকে তাকালাম। জীবনের একটা নতুন ভাষা এত দিনে পেলাম লোকধর্মের মধ্যে। কামনা ও প্রেমের দুই উত্তাল সমুদ্রের মাঝখানে এক চিলতে বালুবেলার মতো এই জীবন, কখন কীসের দ্বারা যে ভেসে যাবে কে জানে।।

ভাবনার মাঝখানে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন গৃহী ফকির বলে উঠলেন, ‘মানুষের উপভোগের ক্ষমতা খুব বেশি সেইজন্য আল্লা তার জন্যে এত খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন। খাদ্য থেকে পুষ্টি আর তৃপ্তি। তার থেকেই বীর্যের জন্ম। সেই বিন্দুই জীবন। তাকে ধরে রাখতে পারাই মানুষের সবচেয়ে বড় কায়দা। আবার সেই কাজে যারা ব্যর্থ তারাই কামুক, তাদেরই পতন। তাদের জীবন জানোয়ারের মতো। জানোয়ারের মতোই পরনির্ভর, গরিব। জানোয়ারের মতোই তারা সকাল সকাল মরে। তারাই পাপের ভয়ে তীর্থব্রত উপোস করে মরে। অপদেবতা, কাঠের ছবি, মাটির ঢিবি পুজো করে। সেইজন্যেই গানে বলে, ‘মানুষের করণ কর’। মানুষের করণ হল আত্মজ্ঞান, দেহের ওপর প্রভুত্ব আনা। আমাদের পথে তার নিশানা আছে। শুধু মুর্শিদ ধরে বুঝে নিতে হয়।’

আমি তর্কের ভঙ্গিতে বললাম, ‘এতক্ষণ আপনি যা বলে গেলেন সবই পুরুষের দিক থেকে। রোজকার জীবনে আর যৌনতায় কি মেয়েদের কোনওই ভূমিকা নেই?’

মযহারুল বললেন, ‘কী করে থাকবে? মেয়েদের যে কামনা নেই।’

‘কী বললেন?’ আমি আমূল চমকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘মেয়েদের কোনও দৈহিক কামনা নেই?’

মযহারুল খুব অনায়াসে বললেন, ‘আপনি তো বিবাহিত। বলুন তো সত্যি করে, কামনা আপনারই তরফে আগে আসে না কি?’

চুপ করে গেলাম।

মযহারুল আর একটু উজিয়ে দিয়ে বললেন, ‘শরীরের দিকে যে প্রথম আকর্ষণ সে কি স্ত্রীর প্রতি স্বামীর নয়? শরীরের সম্পদও কি তাদের বেশি নয়? পুরুষ কি দস্যু ডাকাতের মতো নারীকে ভোগ করে না?’

আমি দারুণ বিভ্রান্ত হয়ে যেন খানিকটা অসহায়ের মতো বললাম, ‘তবে নারী কামনাময়ী হয় কী করে? তার দেহ কি সাড়া দেয় না?’

: পুরুষ স্ত্রীলোকের মধ্যে কামনা জাগিয়ে দেয়। মূলে তাদের দেহের কামনা থাকে না। তারা কামনাশূন্য।

: তা হলে নারী কী চায় পুরুষের কাছে?

: সবচেয়ে বেশি চায় সঙ্গ আর সান্নিধ্য। সব স্ত্রী চায় স্বামীকে সেবা করতে। চায় ভাল মন্দ রেঁধে খাওয়াতে। বাইরে থেকে এলে দেখবেন স্ত্রী স্বামীকে ঘাম মুছে দেয়, পাখার বাতাস করে। কোনও স্বামী কি তার স্ত্রীকে পাখার বাতাস করে? আপনি সব মেয়েছেলেকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন তারা চায় স্বামী তার সামনে সর্বদা হাজির থাকুক, তাকেই শুধু ভালবাসুক। বাইরের জগৎ সম্পর্কে বউদের খুব ভয়। পাছে তার পুরুষ আর না ফেরে—যদি তার দেহ অন্য কাউকে চায়? মেয়েরা যে সন্তান চায় তার একটা কারণ তো মা হবার নেশা, আরেকটা কারণ স্বামীর একটা চিহ্ন ধরে রাখা। কী ঠিক বলছি?

সন্ধের আগেই চলে যাব শুনে সবাই মনঃক্ষুন্ন হলেন। মনজুর এনে দিল চালের গুঁড়োর রুটি, খেজুর গুড়ের পায়েস। খেতে খেতে বললাম, ‘বাড়িতে তো গোরু নেই, পায়েসের দুধ কিনতে হল তো?’

মনজুর লাজুক মুখে মাথা নিচু করল।

: কত করে দাম নিল?

: সাত টাকা লিটার।

: এই অজ পাড়াগাঁয় সাত টাকা লিটার দুধ? আমরা শহরে এর চেয়ে সস্তায় ভাল দুধ পাই। আচ্ছা মনজুর, এদিককার বাগানের আম সবই কাঁচাই ভেঙে নিয়ে যায় ভেণ্ডারে, তাই নয়?

: হ্যাঁ, গাছে আম থাকার জো নেই। সব চুরি হয়ে যাবে।

: মাছ যা ওঠে তা-ও তো চলে যায় শহর-বাজারে?

: হ্যাঁ, টানা বাস আছে তো! তা ছাড়া শহরে ভাল দাম পায়। গ্রামের মানুষ তো অত দাম দিয়ে কিনতে পারবে না।

: আর কেরাসিন তেল?

: রেশনে সামান্য পাওয়া যায়। ব্ল্যাকে কিনতে হয়।

মযহারুল খাঁ আবার এসে বসলেন। বললেন, ‘এভাবে এলে কি হয়? ভাবলাম থাকবেন অন্তত রাতটুকুন। মনজুর-খৈবরদের গান শোনাব। যাকগে। আবার আসবেন যখন বলছেন তখন সে ভরসায় থাকবে বসে এই গরিব ফকির মানুষটা। আপনি এলেন তাই তত্ত্বকথা দুটো হল। এখানে আলাপ-আলোচনার তেমন মানুষজন কই? তা আপনি যা সব জানতে চান তার জবাবে সন্তুষ্ট হলেন তো? আমরা তো লেখাপড়া করিনি, কথাও গুছিয়ে বলতে পারিনে। অবশ্য জিজ্ঞাসারও শেষ নেই মানুষের। কী একেবারে চুপ মেরে গেলেন যে?’

বললাম, ‘না চুপ করছি না। প্রশ্নেরও শেষ নেই। কিন্তু একনাগাড়ে তো সকাল থেকে শুধু জিজ্ঞেস করে যাচ্ছি। শুধুই বকাচ্ছি আপনাকে।’

‘কিছু না, কিছু না’ মযহারুল বললেন, ‘আমি সে রকম জ্ঞানী নই যে সব ভেতরে লুকিয়ে রাখব। আমি জানি যেটুকু বলতে সবসময়ে রাজি, তবে পাত্র বুঝে। বলুন আর কী প্রশ্ন? আপনার যাবার সময়ও তো ঘনিয়ে এল এদিকে।’

আমার মাথায় ছিল বিমল বাউলের বলা সেই কুমারী মেয়ের প্রথম রজঃ দানের কথাটা। বলতে গেলে লোকধর্মের সবচেয়ে নিগূঢ় গোপন প্রসঙ্গ। তবে বিমল খবরটাই শুধু দিতে পেরেছিল, বিশ্লেষণ করতে পারেনি। তার পক্ষে তা সম্ভবও ছিল না। মযহারুলের মতো তত্ত্বজ্ঞানীর কাছে প্রশ্নটা রাখতে লোভ লাগল। খুব গুছিয়ে ভেবে চিন্তে সম্রম নিয়ে প্রশ্ন করতেই মযহারুলের মুখটা বিচিত্র উদ্ভাসে ভরে উঠল। খুব অনুচ্চ স্বরে বললেন,

‘কোটি জন্মের যায় পিপাসা

বিন্দুমাত্র জলপানে।’

বলেই একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন।

‘কী হল?’ আমি বললাম, ‘আপনার মনে কোনও আঘাত দিলাম নাকি অজান্তে? তা হলে থাক ওই প্রসঙ্গ।’

: না ও সব কিছু নয়। আমার মনের একটা খুব নরম জায়গায় ঘা লেগেছে। না না, তাতে আপনার কোনও দায় নেই। যাক গে, যে কথা আপনি বলছিলেন। কুমারী মেয়ের প্রথম রজস্নানের কথা বলছিলেন না? সে খুব পবিত্র জিনিস। অনেক ভাগ্যে সেই বস্তু মেলে বাউল-ফকিরের কপালে।।

বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘সত্যি? কথাটা তা হলে অলীক নয়?’

: অলীক? হ্যাঁ, একদিক থেকে ভাবলে অলীকই তো। বিনা মেঘে বর্ষণ বলে কথা। শুনবেন লালনের সেই গান?

বিনা মেঘে বরষে বারি

শুদ্ধ রসিক হলে মর্ম জানে তারি।

ও তার নাই সকাল বিকাল

নাহি তার কালাকাল

অবধারি।

মেঘ মেঘেতে সৃষ্টির কারবার

তারাও সকল ইন্দ্ররাজার

আজ্ঞাকারী।

নীরসে সুরস ঝোরে

সবাই কি তা জানতে পারে

সাঁইর কারিগুরি।

ও তার এক বিন্দু পরশে।

সে জীব অনায়াসে

হয় অমরী।

কিছু বুঝলেন?

: কিছু বুঝলাম। কিছু অস্পষ্ট থেকে গেল। বিনা মেঘে যে বারিবর্ষণের কথা বলা হয়েছে তাই কি কুমারী মেয়ের প্রথম রজঃ। সেই জন্যেই বুঝি বলা হল ‘তার নাই সকাল বিকাল নাই তার কালাকাল?’

: হ্যাঁ, ঠিকই বুঝেছেন। এ কথাটাও বোধহয় বুঝলেন, ‘মেঘ মেঘেতে সৃষ্টির কারবার?’

: এবারে বুঝলাম। দেখুন তো বুঝলাম কিনা। বলা হচ্ছে ইন্দ্রের আজ্ঞায় মেঘ বৃষ্টি দেয় তবে সৃষ্টির কারবার চলে। তেমনই সাইয়ের কারিগরিতে যে রসের সঞ্চার হয় তার থেকেই তো জীবনসৃষ্টির কারবার। নারীর রজঃ প্রবৃত্তির শুরু মানেই তার জন্মদানের সম্ভাবনারও শুরু। তাই নয়?

এইভাবে বিশ্লেষণ করে চলেছি আর রোমাঞ্চ হচ্ছে ভেতর ভেতর। খুবই কি আশ্চর্য নয় যে পুঁথি পড়া বিদ্যে সম্বল করে আমি কেমন অনায়াসে বুঝে যাচ্ছি লোকধর্মের কঠিনতম অতল রহস্য! এইখানেই বোঝা যাচ্ছে গুরুর প্রয়োজন এই ধর্মে কতটা। আগে শুনেছিলাম বাউলতত্বে ‘বরজখ’ বলে একটা শব্দ আছে। ‘বরজখ’ মানে স্বর্গমর্তের মাঝামাঝি একটা জায়গা। শেষ বিচারের অপেক্ষায় আত্মারা সেইখানে বাস করে। মারফতিরা গুরুকে বলেন ‘বরজখ’। কেন না গুরুই মানুষ আর ঈশ্বরের মধ্যে সংযোগ করেন। আজকে সকাল থেকে এত গাঢ় জীবনের তাপ মনে লাগছে তার মূলে মযহারুল খাঁ-র সঙ্গ আর ইঙ্গিত। এ সব গান তো ‘লালন গীতিকা’য় আগেই পড়েছি কিন্তু বুঝিনি একবিন্দু। মযহারুল খুব বড় বরজখ সন্দেহ নেই।

বরজখের মতো দৃঢ়মূল বিশ্বাসের স্বরে মযহারুল বললেন, ‘সেই পবিত্র রজের এক বিন্দু স্বাদস্পর্শ পেলে মানুষ হয় অমর এই বিশ্বাস আমাদের। সেইজন্যেই বাউল-ফকিররা তাদের দলে সর্বদাই রাখে কিশোরী মেয়েদের। সদাসর্বদা নজর রাখে তাদের দিকে। রজ শুরুর প্রথম বিন্দু পান করতে পারলে বিপুল শক্তি আসে শরীর মনে। তাই আমরা বলি, কোটি জন্মের যায় পিপাসা/ বিন্দুমাত্র জল পানে।’

মযহারুল হঠাৎ হয়ে গেলেন আনমনা। এবারকার উদগত দীর্ঘনিশ্বাসটা ততটা স্পষ্ট হল না। বুঝলাম অনেক প্রয়াসেও সেই দুর্লভ পবিত্র বিন্দু তিনি জীবনে পাননি। ঘনায়মান আসন্ন সন্ধ্যার ছায়াই কি তাঁর মুখকে ম্লান করল? না কি সে অন্যতর কোনও বেদনা?

গোরাডাঙা গ্রামের প্রান্তে বাসস্টপ। দাঁড়িয়ে আছি একা। হঠাৎ এগিয়ে এলেন এক গ্রামবাসী। নাম বললেন রমজান খাঁ। বাসস্টপের কাছে একটা ঘর নিয়ে হোমিওপ্যাথি করেন। দেখলেই বোঝা যায় আত্মতুষ্ট মানুষ। প্রাথমিক আলাপ-পরিচয়ের পর বললাম, ‘কেমন আছেন আপনারা এই গ্রামে?’

‘খুব ভাল’ বললেন রমজান, আমরা খুব মিলে মিশে আনন্দে থাকি। খুব একটা অভাব নেই। রাজনৈতিক গোলমাল নেই। মানুষজন শান্তিপ্রিয়।’

: কিন্তু আমরা যে শুনি গ্রামে লোকে খুব কষ্টে বাস করে? খুব দারিদ্র্য, দারুণ কষ্ট।

: সে কী? আমরা তো শহরে গেলে আপনাদের জন্যেই কষ্ট পাই। গাদাগাদি করে ঘিঞ্জির মধ্যে বাস করেন। পথঘাট দারুণ নোংরা। কেউ কাউকে দেখেন না। একজন খেতে না পেলেও খবর নেন না। মারামারি খুন জখম ছিনতাই ধর্মঘট বিদ্যুৎ বিভ্রাট। সত্যি আপনাদের নিয়ে আমরা আলোচনা করি মাঝে মাঝে। কত কষ্টে বেঁচে আছেন।

ইতিমধ্যে মনজুর এসে দাঁড়িয়েছে সাইকেল নিয়ে। সে পাশের গ্রামে যাবে। আমায় দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। রমজান বললেন, বুঝলে মনজুর, এঁকে এতক্ষণ বলছিলাম যে শহর কত খারাপ। কী সুখে এঁরা সব থাকেন সেখানে। তোমার মনে আছে মনজুর, গত পৌষ মাসে পশ্চিম পাড়ার আলতাফের বুড়ি দাদী শীতে কষ্ট পাচ্ছিলেন, আমরা সব চাঁদা তুলে লেপ বানিয়ে দিলাম? বুঝলেন, আমাদের গ্রামে কেউ উপোসী থাকে না। কেউ খেতে পায়নি শুনলে আমরা কোনও-না-কোনও বাড়ি থেকে তার খাওয়ার বন্দোবস্ত করে দিই। আর আপনাদের শহরে?’

আমি খুব অবাক হয়ে রমজানকে কিছুক্ষণ দেখলাম। লোকটা তার্কিক না ঝগড়াটে? সরল ভাল মানুষ না অতি চতুর? নাঃ মুখে তো কোনও শয়তানি ছাপ নেই। বেশ সহজ আত্মতুষ্ট ভাব।

বললাম: ‘বেশ আছেন তা হলে। খুব ভাল। কিন্তু মনজুরদের মতো সচ্ছল গেরস্থ বাড়িতে গোরু রাখার উপায় নেই, সাত টাকা দিয়ে দুধ কিনতে হয়। আম নেই। মাছ পাওয়া যায় না। কেরোসিন মহার্ঘ। বাড়িতে কাজের লোক মেলে না। খবর নিয়েছি গ্রামে ডাক্তার নেই, লাইব্রেরি নেই। খবরের কাগজ আসে না। মিষ্টি কিনতে হলে যেতে হয় সেই নাজিরপুরে। আচ্ছা, রমজানভাই, আমরা তো গ্রাম বলতে শুনি প্রাচুর্য, অপচয় আর বিস্তার। আচ্ছা বলুন তো, মানুষের জীবনের ধর্ম গুটিয়ে যাওয়া না বিকশিত হওয়া সব দিকে? এই যে আপনারা মেনে নিয়েছেন কখনও দুধ খাবেন না, মাছ খাবেন না, আম পাবেন না, মিষ্টি পাবেন না, বই পড়বেন না, কাগজ পাবেন না এটাই কি জীবন? একেই ভাল থাকা বলে? এর একটাও তো আমরা মেনে নিইনি। আপনারা সত্যিই ভাল আছেন বলছেন?’

মনজুর খাঁ আর রমজান খাঁ খানিক মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তারপরে মনজুর বলল, ‘তাই তো রমজান চাচা, আমরা তো মোটেই ভাল নেই। কিন্তু সেটা তো বুঝতে পারি না।’

কথা শেষ হবার আগেই বাস এসে গেল। তাতে উঠে বসে শেষবারের মতো চাইলাম গোরাডাঙা গ্রাম আর বিভ্রান্ত রমজান ও মনজুরের দিকে। ধাবমান বাস দ্রুত ছিন্ন করল আলোহীন নিস্তব্ধ নিস্তেল বাংলার লক্ষ গ্রামের একটির সঙ্গে আমার শীর্ণ সম্পর্ক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *