মনের মানুষের গভীর নির্জন পথে
শোনা যায় যান্ত্রিক সভ্যতা যত এগোয় সভ্য মানুষ তত কৃত্রিম হতে থাকে। তার মুখে এঁটে বসে যায় এক মুখোশ—শিষ্টতার, সৌজন্যের। পরে অনেক চেষ্টা করলেও তার সত্যিকারের মুখশ্রী আর দেখা যায় না, সে নিজেও এমনকী দেখতে পায় না। বলা হয় গাঁয়ের মানুষ নাকি অন্যরকম। সভ্যতার কৃত্রিমতার আঁচ যদিও তাদের গায়ে লাগছে একটু আধটু, তবু তারা সরল প্রাণবন্ত আতিথ্যপ্রবণ।
এ সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা মিশ্র ও ভিন্নতর। অন্তত শতকরা আশিভাগ গ্রামবাসীর মনের কথা টের পাওয়া যে খুব কঠিন তা আমি বলতে পারি। তাঁদের মুখে মুখোশ নেই কিন্তু আছে এক কাঠিন্যের আবরণ। আপাত সারল্যের অন্তরালে সেই কঠিনতা প্রায় দুষ্প্রবেশ। তবে একবার সেই শক্ত খোলা ভাঙতে পারলে ভেতরে নারকোলের মতোই বড় স্নিগ্ধ শাঁসজল। কয়েক শতাব্দীর তিক্ত লেনদেন, ব্যর্থ আশ্বাস আর নির্লজ্জ শোষণ গাঁয়ের মানুষকে শহুরে বাবুদের সম্পর্কে করে তুলেছে সন্দিহান। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তাঁদের দেখা-জানা আর শহরের মানুষের বইপড়া-তত্ত্বে এত ফাঁক তাঁরা দেখতে পান যে আমাদের জন্যে তাঁরা সবসময়ে রেখে দেন এক অন্তর্লীন করুণাবোধ। তাঁদের মৃঢ় ম্লান মূক মুখে ঢাকা আছে এক দারুণ কৌতুক, যার বিনিময় তাঁরা নিজেদের মধ্যে করেন অবসর সময়ে। তাঁদের এই কৌতুক আর করুণা প্রকাশ পায় বাক্যে। ‘বাবুর কি আমাদের মোটাচালে পেট ভরবে?’ ‘এ গেরামে কী আর দেখবেন? গরমকালে ধুলো আর বর্ষাকালে কাদা’—কিংবা ‘বাবু হঠাৎ টেপ রেকর্ডার যন্তর নিয়ে অ্যালেন যে? আমাদের গেঁয়ো গানে কি আপনাদের মন ভরবে?’ অথবা ‘আপনারা এদিকে ঘন ঘন এলে আমাদের ভয় লাগে, হয়তো ভোট বা অন্য কোনও তালে আসছেন কে জানে?’ এ সব বাক্যবন্ধে খুব কায়দা করে মেশানো আছে চাপা কৌতুক আর নীরব অট্টহাসি।
লোকসংস্কৃতি বিষয়ে যাঁর সরেজমিন ঘোরার অভিজ্ঞতা আছে তিনিই বুঝবেন আমার ধারণার মূল কথা। একটা দারুণ প্রতিরোধ আর অবিশ্বাস তাঁদের পার হতে হয়েছে। সেখানে, অভ্যর্থনা জোটে, আহার বাসস্থানও। কিন্তু সন্দেহ থাকে সদা উদ্যত। একটা ভয়—এই বুঝি কিছু বেরিয়ে গেল তাঁদের। ‘জানেন আমাদের গাঁয়ের কুবির গোঁসাইয়ের গান টুকে নিয়ে যষ্ঠী ডাক্তার রেডিওতে দিয়েছিল, কত টাকা পেয়েছে!’ ছেঁউরিয়ায় লালন ফকিরের মাজারে আমাকে একজন বলেছিলেন, ‘জানেন, আপনাদের রবি ঠাকুর আমাদের লালন শা-র গান টুকে নোবেল প্রাইজ না কি যেন একটা পেয়েলো। সে নাকি শতাবধি টাকা!’
এ যদি হয় সাধারণ মানুষের বক্তব্য আর ধারণা তবে অসাধারণদের অব্যক্ত বিশ্বাস আর নাই বা বললাম। কিন্তু আমার কাজটা ছিল আরও কঠিন জায়গায়। উদাসীন ফকির বাউলদের সঙ্গে। সময়টা পুরো ষাটের দশক। নদীয়া-বর্ধমান-মুর্শিদাবাদ এ বাংলায়, মেহেরপুর-কুষ্টিয়া ও বাংলায়। অনেক অগণন গ্রাম। তার মধ্যে আত্মগোপন করে থাকা কত উপধর্ম। এইচ. এইচ. উইলসন যাঁদের একশো বছরেরও আগে বলেন ‘মাইনর রিলিজিয়াস সেক্টস’, অক্ষয়কুমার দত্ত যাদের বলেন ‘উপাসক সম্প্রদায়’। একশো বছর আগে লেখা তাঁদের বিবরণ পড়ে জানতে ইচ্ছে হয় এখন কী অবস্থায় আছে এ সব সম্প্রদায় বা উপধর্ম? শুরুতে আমার সম্বল বলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পুঁথিপড়া ডিগ্রি আর জানবার প্রবল আগ্রহ। কিন্তু ভাষা যে জানি না! সত্যিই তাই। লোকধর্মের ভাষা বুঝতে আমার লেগেছে ঝাড়া পাঁচটা বছর। কেননা তাদের ভাষ্যটাই ‘সন্ধা’ অর্থাৎ বাইরের মানে আর ভেতরের মানে একেবারে আলাদা। প্রথমদিকের হোঁচট খাওয়ার কিছু নমুনা বলি।
১.
একজন সাধককে আমার প্রশ্ন: আপনি বাউল?
উত্তর: আমি সংসার করি নাই।
প্রশ্ন: আপনি তো ফকির? আপনার ছেলেমেয়ে?
উত্তর: সন্তান? পাঁচ হাজার। আমার পাঁচ হাজার শিষ্যশাবক। তারাই সন্তান।
জানেন না ফকিরি দণ্ড নিলে আর সন্তান হয় না?
শিষ্যসেবক নয় শিষ্যশাবক। ফকিরি দণ্ড বস্তুটি কী? বাউল কি সংসার করে না?
২.
একজন উদাসীনকে আমি জিজ্ঞেস করি: আজ কী খেলেন?
উত্তর: খাওয়া নয়, বলুন সেবা। আজ সেবা হল পঞ্চতত্ত্ব।
প্রশ্ন: পঞ্চতত্ত্ব মানে? সে তো চৈতন্য নিত্যানন্দ অদ্বৈত…
উত্তর: আরে না না, পঞ্চতত্ত্ব মানে চাল ডাল আর তিন রকমের আনাজ।
৩.
এক আখড়ায় খুব ফিসফিস করে এক গুরুস্থানীয় উদাসীনকে জিজ্ঞেস করলাম: একটা গানে শুনলাম ‘ভগলিঙ্গে হলে সংযোগ/সেই তো সকল সেরা যোগ॥’ তার মানে? এখানে কি মৈথুনের কথা বলা হচ্ছে?
একগাল হেসে উদাসীন বললেন: মৈথুন? হ্যাঁ মৈথুনই তো? তবে কী জানেন, এর মানে আলাদা। শুনুন তবে: ‘গুরুবাক্য লিঙ্গ হয় শিষ্যের যোনি কান।’ এবারে বুঝলেন?
বুঝলাম যে আগে ভুল বুঝেছিলাম।
এ তো গেল ভুলবোঝা। মুশকিল আসতে পারে আরেক দিক থেকে। যদি প্রশ্ন করা যায়, আপনি কি বাউল সম্প্রদায়ের? উত্তর পাওয়া যাবে, তা বলতে পারেন। আবার যদি ওই উদাসীনকে জিজ্ঞেস করি, আপনি ফকির? উত্তর হবে, হ্যাঁ ফকিরও বটে। এবারে অসহিষ্ণু হয়ে প্রশ্ন করতে হয়, আমি যা-ই জিজ্ঞেস করি আপনি হ্যাঁ বলেন। আপনি সত্যিই কী বলুন তো? উত্তর মিলবে, আমি মানুষ। মানুষভজা।
এ সব কথার স্পষ্ট মানে কী? আমরা কী সিদ্ধান্ত করব? আসলে এ সব উদাসীনদের সাধনের মূল কথা গোপনতা। অসম্প্রদায়ীদের কাছে হয় কিছু বলেন না, কিংবা উলটো-পালটা বলে বিভ্রান্তি এনে দেন। ওঁরা একে বলেন আপ্ত সাবধান। এর মূল বক্তব্য হল: আপন সাধন কথা/না কহিও যথা তথা/আপনারে আপনি তুমি হইও সাবধান।
আরেক রকম আছে ধন্দবাজি। সেবার যেমন ধাপাড়ার ইমানালি শাহজি ফকির তার খাতা খুলে বললে: লিখুন বাবু কারের খবর। অন্ধকার, ধন্ধকার, কুয়াকার, আকার, সাকার, ডিম্বাকার, নিরাকার, শূন্যাকার, হাহাকার, হুহুকার, নৈরাকার—এই হল একুনে এগারোকার আর চারকার গোপন।
আমি জানতে চাইলাম, এ সবের মানে কী?
মুরুব্বির চালে মাথা নেড়ে শাহজি বললে, এ সব নিগূঢ় তত্ত্ব। আপনি বুঝবেন না।
আসলে শাহজিও কিন্তু কিছু জানে না। কথাগুলো কোথা থেকে টুকে রেখেছে। শহুরে পণ্ডিতম্মন্যরা যেমন ক্রফো-গদার আওড়ায়!
এখন ভাবি, প্রথম যখন এইসব উপধর্মের সন্ধানে গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি তখন উলটো-পালটা সব দেখে শুনে চমকে যেতাম। সবচেয়ে বেকুব বনতে হত গানের আসরে। হয়তো মচ্ছবের শেষে সারারাত চলল গানের আসর। শ’য়ে শ’য়ে মানুষ বসে সে গান শুনছে মৌজ করে, গায়ক গাইছে প্রাণ খুলে। আর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ তকমাধারী, অথচ সে গানের বিন্দুবিসর্গ বুঝছি না।
এ সব গানকে বলে ‘শব্দ গান।’ একজন প্রথমে গানে তত্ত্বকথা তোলে প্রশ্নের আকারে, আরেক গায়ক তার জবাব দেয় আরেক গানে। প্রথম গানকে বলে ‘দৈন্যতা’, জবাবি গানকে বলে ‘প্রবর্ত’। এ সব আমি ক্রমে ক্রমে শিখে নিই। পরে দেখেছি এ সব নিগূঢ় ভাষার প্রয়োগ লাগসই করতে পারলে ফলও মেলে হাতেনাতে। সেবার যেমন আমাদের মফস্বল শহরে পানের দোকানে এক গ্রাম্য বাউল জনপ্রিয় সব রেকর্ডের গান গাইছিল। আমি ফস করে বলে বসলাম, ‘ও সব ফক্কিকারি রসের গান গেয়ে কী হবে সাঁই, একটা দৈন্যতার গান হোক।’
ব্যস্, কেল্লাফতে! গায়কের চোখমুখে আমার সম্পর্কে সে কী শ্ৰদ্ধার জানান! যেন দরদী পেয়েছে মরমীকে। বলেই বসল: আহা কী মান্যমান মহাশয়। শোনেন তবে ‘আগে শান্তিপুরে চলোরে মন তবে গুপ্তিপাড়ায় যাবি।’
আমি সেই ভিড়ের দিকে সগর্বে তাকালাম। ভাবখানা যেন, দেখলে আমার এলেম! কী না আমি জানি এ গানের মর্ম। এ গানে বলা হচ্ছে দেহমনকে শান্ত করলে তবে গুপ্তিপাড়া অর্থাৎ গুপ্ততত্ত্ব জানা যাবে। এমনই করে আমি জানতে পারি অমাবস্যা মানে নারীর ঋতুকাল, বাঁকানদী মানে স্ত্রী যোনি। কুমির মানে কাম। লতা মানে সন্তান। চন্দ্ৰসাধন মানে মল মূত্র পান ইত্যাদি।
গোট পল্লীর আর্জান শানু ফকির বলেছিল: নিজের শরীরের বস্তু কি ঘেন্নার জিনিস? বস্তু রক্ষা আমাদের ধর্ম, শুক্ররক্ষা। অযথা শুক্রক্ষয় আর সন্তানজন্ম মানে আপ্তমরণ, নিজেকেই মারা। সন্তানজন্ম দেওয়া চলবে না। তবে পতন কি নেই? আছে। যাদের কাম মরেনি তারা বারে বারে জন্মদ্বারে যায়। আমরা তাকে বলি ‘যোনিতে পতন’। তাই বলে নারী আমাদের ত্যক্ত নয়। নারীকে নিয়েই আমাদের সাধনা। বিন্দু সাধন। যাকে বলে রসের ভিয়ান। দুধ জ্বাল দিয়ে দিয়ে যেমন ক্ষীর তেমনই। আর ওথলায় না। কামকে তেমনই পাকে চড়িয়ে শান্ত করতে হবে। আমাদের আপ্তজ্ঞানে বলে:
আপন জন্মের কথা যে জানে রে ভাই
সকল ভেদ সেই তো জানে তার তুলনা নাই।
রজ বীর্য রসের কারণ
এ দেহ হইল সৃজন
যারে ধ’রে সৃজন পালন তারে কোথা পাই?
সেই আসল মানুষ সাঁইকেই আমরা খুঁজি। বুঝলেন এবার?
লোকধর্ম আর লোকসংগীত নিয়ে গ্রামে গ্রামে বছরের পর বছর একটানা ঘুরে বুঝেছি তার অনেকটা হেঁয়ালি, বেশ কিছুটা শহুরে অজ্ঞ লোককে বোকা বানানোর চটকদারি, কিন্তু ঠিক জায়গায় ঠিক মানুষটিকে ঘা দিতে পারলে বেরিয়ে আসে চাহিদার অতিরিক্ত রসদ। এ জন্যে শিখতে হয় তাদের সাংকেতিক ভাষা। জানতে হয় লোকধর্মে ‘দীক্ষা’ আর ‘শিক্ষা’ আলাদা জিনিস। কাউকে তার নিজস্ব ধর্মমত বলাতে গেলে ‘আপনি কি বাউল?’ ‘আপনি কি ফকির?’—এভাবে জিজ্ঞেস না করে বলতে হয় ‘আপনার কি সতীমার ঘর না দীনদয়ালের?’ বা ‘আপনি কি পাটুলী স্রোতের?’ সঙ্গে সঙ্গে উদাসীনের চোখে খেলে যাবে সুপরিচয়ের ঝলক। একবার এক বাউল আমাকে পরীক্ষা করার জন্য প্রশ্ন করেছিল: মাটির কাজ বোঝো।
আমি বলেছিলাম: হ্যাঁ। নালের কাজও বুঝি।
আমার দ্বিতীয় কথাটিতে কাজ হল খুব। তখন বাউল আরও অনেক কথা আমাকে জানিয়ে দিল।
লোকধর্মের গুপ্ত ঘরানায় তার মানে, আলাদা কতকগুলি ‘বন্দিশ’ আছে। তার কেতা সহবৎ না জানা থাকলে ওস্তাদ মুখ খুলবেন না। লোকধর্মের ‘আস্লি চিজ’ সংগ্রহ করা কঠিন, আবার সময় বিশেষে খুব সহজ। আমার এমন একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি তখন মারফতি ফকিরদের মূল রহস্যগুলো বুঝতে চেষ্টা করছিলাম।
সেবার শেওড়াতলার মেলায় প্রায় নিশিরাতে দুই ফকিরের তত্ত্ব আলোচনা শুনছিলাম। অম্বুবাচীর ক্ষান্তবর্ষণ রাত। জাহান ফকির আর শুকুর আলি কথা বলছিলেন। আমি চুপ করে শুনছিলাম। পরে দিনের আলো ফুটতে জাহান ফকিরের সঙ্গে আলাপ হল। বাড়ি বর্ধমানের সাতগেছিয়ায়। লেখাপড়ার হিসাবে প্রায় মূর্খ। একেবারে গরিব। পোশাক-আশাক আলখাল্লা তেমনই মলিন। কিছুতেই আমার কাছে মন খুলবে না। কেবল ধানাই পানাই। শেষকালে চটিয়ে দেবার জন্যে বলে বসলাম: আপনারা তো বেশরা। শরিয়ত একেবারে বাদ দিয়ে, ভুলে গেলে, তবে কি মারফতি কবুল হবে?
মুখচোখ প্রথমে ব্যথায় ভরে উঠল। তারপর হঠাৎ সত্যের ঝিলিকের মতো আলো খেলে গেল মুখে। আস্তে আস্তে জাহান বললেন: আপনি পণ্ডিত লোক, এ সব কী বলছেন? শরিয়ত ভুলে মারফত! আচ্ছা বাবু, আপনি তো প্রথমে বর্ণপরিচয়ের প্রথমভাগ পড়েছেন, তারপরে তো দ্বিতীয়ভাগ? তা হলে কি আপনি প্রথমভাগ ভুলে গেছেন?
বিদ্যুচ্চমকের মতো কথা এবং লেখাপড়া বিষয়ে মূর্খ লোকের মুখে! আমি অনেকক্ষণ অবাক হয়ে রইলাম। চকিতে বুঝলাম শরিয়ত হল means আর মারফত হল end। সাহস পেয়ে বললাম: আপনারা শাস্ত্র মানেন না বুঝলাম। জাতি মানেন না কেন? তার যুক্তি কী?
খুব ধীর কণ্ঠে গুনগুন করে জাহান গাইতে লাগল:
বামুন বলে ভিন্ন জাতি
সৃষ্টি কি করেন প্রকৃতি?
তবে কেন জাতির বজ্জাতি করো এখন ভাই।
বল্লাল সেন শয়তানি দাগায়
গোত্র জাত সৃষ্টি করে যায়
বেদান্তে আছে কোথায় আমরা দেখি নাই।
বেশ ভাল লাগল। মন ভরে উঠল। জাহান যেন বেশ মেজাজ পেয়ে বলে যেতে লাগলেন আপনমনে: শাস্তর মানুষ তৈরি করেছে। জাতও মানুষ তৈরি করেছে। হিন্দুদের মধ্যে বামুন কায়েত, মুসলমানদের মধ্যে সৈয়দ খোন্দকার এ সব বড় রটালে কে? আমাদের দুদ্দুর গানে বলে:
অজ্ঞ মানুষে জাতি বানিয়ে
আজন্ম ঘুরিয়া মরে স্বজাতি খুঁজিয়ে॥
শিয়াল কুকুর পশু যারা
এক জাতি এক গোত্র তারা
মানুষ শুধু জাতির ভারা মরে বইয়ে॥
সেই জন্যেই আমরা সত্যিকারের মানুষ খুঁজি। সে মানুষ বৈধিকে নেই, শরায় নেই, শালগ্রাম শিলায় নেই—নোড়ায় নেই, মন্দিরে মসজিদে নেই। যে খোঁজে মানুষে খোদা সেই তো বাউল।
আমি বললাম: তা হলে উচ্চবর্ণ বাতিল? শাস্ত্র কোরান খারিজ?
: আজ্ঞে হ্যাঁ। আমাদের কাছে বাতিল। আপনারা থাকুন আপনাদের জাতিত্ব নিয়ে, শাস্তর আউড়ে, মৌলবী আর বামুনের বিধান মেনে। আমরা জাতি মানিনে। আমরা বিশ্বাস করি সাধারণ মানুষের মধ্যে, দীনদরিদ্রের মধ্যে আছেন দীনবন্ধু। শুনুন এই গান:
ছোট বলে ত্যাজো কারে ভাই
হয়তো ওর রূপে এলেন ব্রজের কানাই।
শূদ্র চাঁড়াল বাগদি বলার দিন
দিনে দিনে হয়ে যাবে ক্ষীণ
কালের খাতায় হইবে বিলীন দেখছি রে তাই॥
এ গানের ভবিষ্যৎ-বাণী আজকে প্রায় সত্য। শূদ্র চাঁড়াল বাগদি বলার দিন সত্যিই শেষ হয়ে এসেছে। কিন্তু এ সব গানে যে প্রতিবাদ, যে রুখে দাঁড়ানো, তার মধ্যেও একটা জাতিত্বের নেশা আছে।
বেদ কোরান পুরাণ ব্রাহ্মণ মৌলবী মন্দির মসজিদ বৈধী সাধনা সবকিছু খারিজ করতে করতে আঠারো শতকের শেষদিকে আমাদের এই বাংলায় যত উপধর্ম জেগে উঠেছিল তার তালিকা বিচিত্র ও রোমাঞ্চকর ‘বৈষ্ণব ব্রতদিন নির্ণয়’ বইয়ে উদ্ধৃত সেই তালিকা এই রকম: বাউল, ন্যাড়া, দরবেশ, সাঁই, আউল, সাধ্বিনীপন্থী, সহজিয়া, খুশিবিশ্বাসী, রাধাশ্যামী, রামসাধনীয়া, জগবন্ধু-ভজনীয়া, দাদুপন্থী, রুইদাসী, সেনপন্থী, রামসনেহী, মীরাবাঈ, বিত্থলভক্ত, কর্তাভজা, স্পষ্টদায়িক বা রূপ কবিরাজী, রামবল্লভী, সাহেবধনী, বলরামী, হজরতী, গোবরাই, পাগলনাথী, তিলকদাসী, দর্পনারায়ণী, বড়ী, অতিবড়ী, রাধাবল্লভী, সখিভাবুকী, চরণদাসী, হরিশ্চন্দ্ৰী, সাধনপন্থী চুহড়পন্থী, কুড়াপন্থী, বৈরাগী, নাগা, আখড়া, দুয়ারা, কামধেন্বী, মটুকধারী, সংযোগী, বার সম্প্রদায়, মহাপুরুষীয় ধর্মসম্প্রদায়ী, জগমোহনী, হরিবোলা, রাতভিখারী, বিন্দুধারী, অনন্তকুলী, সৎকুলী, যোগী, গুরুদাসী বৈষ্ণব, খণ্ডিত বৈষ্ণব, করণ বৈষ্ণব, গোপ বৈষ্ণব, নিহঙ্গ বৈষ্ণব, কালিন্দী বৈষ্ণব, চামার বৈষ্ণব, হরিব্যাসী, রামপ্রসাদী, বড়গল, নস্করী, চতুর্ভুজী, ফারারী, বাণশয়ী, পঞ্চধুনী, বৈষ্ণব তপস্বী, আগরী, মার্গী, পল্টুদাসী, আপাপন্থী, সৎনামী, দরিয়াদাসী, বুনিয়াদদাসী, অহমদ্পন্থী, বীজমার্গী, অবধূতী, ভিঙ্গল, মানভাবী, কিশোরীভজনী, কুলিগায়েন, টহলিয়া বা নেমো বৈষ্ণব, জোন্নী, শার্ভল্মী, নরেশপন্থী, দশামার্গী, পাঙ্গুল, বেউড়দাসী, ফকিরদাসী, কুম্ভপাতিয়া, খোজা, গৌরবাদী, বামে কৌপীনে, কপীন্দ্র পরিবার, কৌপীনছাড়া, চূড়াধারী, কবীরপন্থী, খাকী ও মুলুকদাসী।
এত উপধর্ম সম্প্রদায় ছিল এ দেশে? তারা গেল কোথায়? সম্ভবত উনিশ শতকের হিন্দু ও মুসলিম সংস্কার আন্দোলন, মিশনারিদের প্রচার, ব্রাহ্মধর্মের উত্থান এবং শ্রীরামকৃষ্ণ-বিজয়কৃষ্ণদের জীবন সাধনা এমন প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে যে এইসব উপসম্প্রদায়ী পিছোতে পিছোতে গ্রামের প্রত্যন্তে লুকিয়ে পড়ে। একদিকে উচ্চ ধর্মাদর্শ আরেকদিকে কট্টর মুসলমানদের সক্রিয় দমননীতি বাউল ফকিরদের ধ্বংস করে দিল অনেকটা। শ্রীরামকৃষ্ণ তো এ সব লোকায়ত ধর্মসাধনাকে সরাসরি অভিযুক্ত করে বললেন: বাড়িতে ঢোকার দুটো পথ—সদরের খোলা দরজা আর পায়খানা দিয়ে ঢোকা। সদর দিয়ে ঢোকাই ভাল, পায়খানা দিয়ে ঢুকলে গায়ে নোংরা লাগা স্বাভাবিক। তাঁর মতে কামিনীকাঞ্চনের সাধনা বিপজ্জনক।
‘শ্রীসদগুরুসঙ্গ’ দ্বিতীয় খণ্ডে ১২৯৭ সালের ডাইরিতে বিজয়কৃষ্ণ বলেছেন:
বাউল সম্প্রদায়ের অনেকস্থলে বড়ই জঘন্য ব্যাপার। তা আর মুখে আনা যায় না। ভাল ভাল লোকও বাউলদের মধ্যে আছেন। তাঁরা সব চন্দ্রসিদ্ধি করেন। শুক্র চান্, শনি চান্, গরল চান্, উন্মাদ চান্, এই চার চান্ সিদ্ধি হলেই মনে করেন সমস্ত হলো।…আমি বললাম “ওটি আমি পারব না। বিষ্ঠামূত্র খেয়ে যে ধর্ম লাভ হয়, তা আমি চাই না।” মহান্ত খুব রেগে উঠে বললেন, “এতকাল তুমি আমাদের সম্প্রদায়ে থেকে আমাদের সব জেনে নিলে, আর এখন বলছো সাধন করব না। তোমাকে ওসব করতেই হবে।” আমি বললাম, “তা কখনই করব না।” মহান্ত শুনে গালি দিতে দিতে আমাকে মারতে এলেন: শিষ্যরাও “মার্ মার্” শব্দ ক’রে এসে পড়ল। আমি তখন খুব ধমক দিয়ে বললাম, “বটে এতদূর আস্পর্ধা, মারবে? জানো আমি কে? আমি শান্তিপুরের অদ্বৈত বংশের গোস্বামী, আমাকে বলছো বিষ্ঠামূত্র খেতে?” আমার ধমক খেয়ে সকলে চমকে গেল।
উচ্চস্তরের হিন্দু সাধকদের এইসব প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ নানা ধরনের উপধর্মের লোকদের যতটা কমজোরী করে দিয়েছিল তার চতুর্গুণ লড়াই হয়েছিল ফকির দরবেশদের সঙ্গে নিষ্ঠাবান মুসলমানদের। বাংলার সামাজিক ইতিহাস যাঁরা লিখেছেন তাঁরা এ সব ঘটনা, কেন জানি না, এড়িয়ে গেছেন।
হিসেব নিলে দেখা যাবে শেষ আঠারো শতকে পূর্ব ও উত্তরবঙ্গের বিপুল পরিমাণ শূদ্র ও গরিব মুসলমান বাউল বা ফকিরি ধর্মে দীক্ষা নিয়ে বৃহত্তর হিন্দু ও মুসলিম সমাজ ত্যাগ করতে থাকে। দেখা যায়, বাউল ফকিরদের মধ্যে মুসলমান ধর্মত্যাগীদের সংখ্যা ছিল খুব বেশি। লালন শাহ থেকে আরম্ভ করে বহুসংখ্যক উদাসীন ধর্মগুরু তাঁদের সৎ জীবনযাপন, অসাম্প্রদায়িক আদর্শপ্রচার এবং সমন্বয়বাদী চিন্তাধারায় বহু সাধারণ মানুষকে আকর্ষণ করে নেন তাঁদের উপধর্মে। এতে বৃহত্তর হিন্দু মুসলমান ধর্ম, বিশেষ করে নৈষ্ঠিক বৈষ্ণব সমাজ এবং কট্টর ইসলামি সমাজ খুব বড় রকমের আর্থনীতিক ও সামাজিক ধাক্কা খায়। স্বভাবত প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া জাগে। ‘পাষণ্ড দলন’ জাতীয় বৈষ্ণবীয় বুকলেট বেরোয় অজস্র, যাতে কর্তাভজা ও অন্যান্য উপসম্প্রদায়দের আক্রমণ করা হয় ‘অনাচারী’, ‘ভ্রষ্ট’, ‘নিষিদ্ধাচারী’ আখ্যা দিয়ে, তাদের নারীভজন ও সহজিয়া সাধনতত্ত্বকে অপব্যাখ্যা করে। উনিশ শতকে দাশরথি রায় তাঁর পাঁচালিতে গালমন্দ করলেন এ সব সম্প্রদায়কে, কলকাতায় জেলেপাড়ার সং বেরোল কর্তাভজাদের ব্যঙ্গ করে।
শাস্ত্রবিরোধী বাউলদের সবচেয়ে বড় সংগ্রাম শুরু হল উনিশ শতকে নদীয়া, যশোহর ও উত্তরবঙ্গের শরিয়তি মুসলমানদের সঙ্গে। বাউলদের অন্যান্য আচরণের, যেমন চারচন্দ্রের সাধনা, ঘৃণ্যতার বিবরণ দিয়ে শরিয়তবাদীরা বেশি জোর দিলেন বাউলদের গান গাওয়ার বিরুদ্ধে। ইসলাম ধর্মের একদল ব্যাখ্যাকারী জানালেন, ইসলামে গান গাওয়া জায়েজ নয়। বাউলদের গানের আসরে তাঁরা দাঙ্গা বাধালেন। আলেম সম্প্রদায়ের নির্দেশে বাউলদের উপর নানারকম দৈহিক নিপীড়ন শুরু হল এবং প্রায়শ তাদের ঝুঁটি কেটে নেওয়া হতে লাগল।*
ভয়ে বাউলরা আত্মগোপন করল বা বহির্বাস ত্যাগ করল। এই সময়কার ওহাবী, ফারায়জী ও আহলে হাদীস আন্দোলন মুসলমান বাউলদের খুব ক্ষতি করল। তাদের জোর করে শরিয়তমতে ফেরানো হতে লাগল। বহু মুসলমান সংস্কারক এই সময় বাউলদের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করে লড়াইয়ে নামলেন। সে সময়কার কিছু লেখকের রচনায় বাউলফকির-বিরোধী ভাষ্য চোখে পড়ে। যেমন মীর মশার্রফ হোসেন লিখেছেন:
ঠ্যাঁটা গুরু ঝুটা পীর
বালা হাতে নেড়ার ফকীর
এরা আসল শয়তান কাফের বেইমান।
লোককবি জোনাবালী হুংকার দিয়ে লেখেন:
লাঠি মারো মাথে দাগাবাজ ফকীরের।
রংপুরের মৌলানা রেয়াজউদ্দীন আহমদের লেখা ‘বাউল ধ্বংস ফৎওয়া’ বইটি কট্টর মুসলিম সমাজে খুব জনপ্রিয় হয়। ১৩৩২ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত তার দ্বিতীয় সংস্করণে তিনি লিখেছেন:
এই বাউল বা ন্যাড়া মত মোছলমান হইতে দূরীভূত করার জন্য বঙ্গের প্রত্যেক জেলায়, প্রত্যেক গ্রাম, মহল্যা জুমা ও জমাতে এক একটি কমিটি স্থির করিয়া যতদিন পর্যন্ত বঙ্গের কোন স্থানেও একটি বাউল বা ন্যাড়া মোছলমান নামে পরিচয় দিয়া মোছলমানের দরবেশ ফকীর বলিয়া দাবী করিতে থাকিবে ততদিন ঐ কমিটি অতি তেজ ও তীব্রভাবে পরিচালনা করিতে হইবে। মোট কথা মোছলমানগণের কৰ্ত্তব্য এই যে মোছলমান সমাজকে বাউল ন্যাড়া মত হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত না করা পর্যন্ত বিশেষরূপে চেষ্টা করিতে হইবে।
এমন বিবরণ প্রচুর মেলে। বাউল ফকিরদের বিরুদ্ধে আক্রমণ ও অপপ্রচার উনিশ শতকের সীমান্ত পেরিয়ে বিশ শতকেও ব্যাপ্ত হয়েছে। ‘বাউল ধ্বংস ফৎওয়া’ বই থেকে জানা যায় অবিভক্ত বাংলায় যাট-সত্তর লক্ষ বাউল ছিল। উৎপীড়ন ও অত্যাচারে তারা সম্প্রদায়গতভাবে শীর্ণ ও কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। লিখিত প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে ১৩৫৩ বঙ্গাব্দে মওলানা আফছারউদ্দীনের নেতৃত্বে একদল ব্যক্তি কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়া আশ্রমে সমবেত লালনপন্থী সমস্ত বাউলদের চুলের ঝুঁটি কেটে নেয়।
তবে সব মুসলমান বাউল-বিরোধী ছিলেন এমন ভাবারও কারণ নেই। ১৯২৭-এ ফরিদপুরে মুসলিম ছাত্র সমিতির বার্ষিক অধিবেশনে মুক্তবুদ্ধি মনীষী কাজী আবদুল ওদুদ বলেন:
ইসলাম কিভাবে বাঙালীর জীবনে সার্থকতা লাভ করবে, তার সন্ধান যতটুকু পাওয়া যাবে বাংলার এই মারফৎ-পন্থীর কাছে, ততটুকুও পাওয়া যাবে না বাংলার মওলানার কাছে, কেননা, সমস্ত অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও মারফৎ-পন্থীর ভিতরে রয়েছে কিছু জীবন্ত ধর্ম, সৃষ্টির বেদনা, পরিবেষ্টনের বুকে সে এক উদ্ভব; আর মওলানা শুধু অনুকারক, অনাস্বাদিত পুঁথির ভাণ্ডারী—সম্পর্কশূন্য ছন্দোহীন তাঁর জীবন।
এই মারফৎ-পন্থীর বিরুদ্ধে আমাদের আলেম-সম্প্রদায় তাঁদের শক্তিপ্রয়োগ করেছেন, আপনারা জানেন।…আলেমদের এই শক্তি প্রয়োগের বিরুদ্ধে কথা বলবার সব চাইতে বড় প্রয়োজন এইখানে যে সাধনার দ্বারা সাধনাকে জয় করবার চেষ্টা তাঁরা করেননি, তার পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত দুর্বলকে লাঠির জোরে তাঁরা দাবিয়ে দিতে চেয়েছেন। এ দেশে মারফৎ-পন্থীদের সাধনার পরিবর্তে যদি একটি বৃহত্তর পূর্ণতর সাধনার সঙ্গে বাংলার যোগসাধনের চেষ্টা আমাদের আলেমদের ভিতরে সত্য হ’তো, তাহলে তাঁদের কাছ থেকে শুধু বাউল ধ্বংস আর নাসারা দলন ফতোয়াই পেতাম না।
প্রায় এক শতাব্দী ধরে এই দলন পীড়ন বাউল-দরবেশ-ফকিরদের দুর্বল ও দলছুট করে দিলেও একেবারে লুপ্ত করে দিতে পারেনি। কারণ নিচুসমাজের মানুষ অসাম্প্রদায়িকভাবে গ্রাম্যসমাজে সহজে মিলতে মিশতে পারে। খোঁজ করলে দেখা যাবে অখণ্ড বাংলায় যত উপধর্ম সম্প্রদায় গজিয়ে উঠেছিল তাদের বেশির ভাগ প্রবর্তক একজন মুসলমান অথবা হিন্দু-মুসলমান যৌথভাবে। কর্তাভজাদের স্রষ্টা আউলেচাঁদ একজন মুসলমান আর তাঁর প্রধান শিষ্য রামশরণ পাল একজন সদগোপ। সাহেবধনী সম্প্রদায়ের প্রবর্তক একজন মুসলমান উদাসীন এবং এ ধর্মের প্রধান সংগঠক চরণ পাল জাতে গোয়ালা।
আসলে বাংলার লৌকিক উপধর্মগুলির ভিত্তিতে আছে তিনটি প্রবর্তনা—মুসলমান বাউল ফকির দরবেশদের প্রত্যক্ষ প্রভাব, শোষিত শূদ্রবর্ণের ব্রাহ্মণ্যবিরোধ এবং লোকায়ত বৈষ্ণব ধর্মের উদার আহ্বান। এই শেষ বিষয়টির একটি সামাজিক ব্যাখ্যা দরকার।
শ্রীচৈতন্য আমাদের দেশে এসেছিলেন এক সময়োচিত ভূমিকায় পরিত্রাতার রূপে। তখন ষোড়শ শতকে শাসক মুসলমানের ব্যাপক হিন্দু ধর্মান্তরকরণ রুখতে এবং শূদ্রবর্ণের উপর আচারমার্গী শুদ্ধ ব্রাহ্মণদের অত্যাচার ঠেকাতে তিনি এক উদার সমন্বয়বাদী বৈষ্ণব ধর্মের পরিকল্পনা নেন। তাঁর ধর্মসাধনের সরলতম পন্থা ছিল ‘হরেনামৈব কেবলম্।’ এক বিপুল জনসন্নিবেশ বৈষ্ণব ধর্মকে বেগবান করে তোলে। কিন্তু শ্রীচৈতন্যের তিরোধানের পরেই বৈষ্ণবধর্মে ভেদবাদ জেগে ওঠে। বৃন্দাবনের গোস্বামীরা সংস্কৃত শাস্ত্রগ্রন্থ লিখে চৈতন্যতত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় বেশি মনোযোগী হলেন। তাঁর লোকশিক্ষা আর সাধারণ মানুষের সংরক্ষণের দিকটি হল উপেক্ষিত। সাধারণ বৈষ্ণব মানুষ আর তাদের মুক্তিদূত শ্রীচৈতন্যের মাঝখানে এসে দাঁড়াল রাশি রাশি শাস্ত্র আর পুঁথি। অসহায় শূদ্ররা তখন ভ্রষ্টাচারে মগ্ন হল। সেই সংকটকালে নিত্যানন্দের ছেলে বীরচন্দ্র বা বীরভদ্র আরেকবার নেতা আর ত্রাতারূপে দেখা দিলেন। পলাতক ভ্রষ্টাচারী বৌদ্ধ সহজিয়া, মৈথুন সাধক মূর্খ তান্ত্রিক আর অজ্ঞ মুমুক্ষু মানুষদের বীরভদ্র আবার বৈষ্ণব করলেন। এবারকার বৈষ্ণবায়নে এল নানা লৌকিক গুহ্য সাধনা, নিশ্বাসের ক্রিয়া ও গোপন জপতপ। গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠল নতুন নতুন আখড়া ও শ্রীপাট। গঙ্গার ধারে ধারে পাটুলী কাটোয়া অগ্রদ্বীপ ধরে আস্তানা পাতল সহজিয়া বৈষ্ণবরা। বীরচন্দ্রকে তারা দেখল চৈতন্যের অবতার রূপে। নতুন নেতার জয়ধ্বনি দিয়ে তারা ঘোষণা করল নতুন বাণী:
বীরচন্দ্ররূপে পুনঃ গৌর অবতার।
যে না দেখেছে গৌর সে দেখুক এবার॥
কালক্রমে লোকগুরুরা গীতার ‘যদাযদাহি ধর্মস্য’ শ্লোকটি সামনে রেখে এমন একটা স্বতঃসিদ্ধ বানিয়ে ফেললেন যাতে নির্জিত শোষিত মানুষরা বিশ্বাস করে নিল কৃষ্ণের অবতার গৌরাঙ্গ, গৌরাঙ্গের অবতার বীরচন্দ্র। এই সূত্র অনুসরণ করে আমরা সকৌতূহলে দেখতে পাই কর্তাভজা ধর্মের প্রথম দিকের ঘোষণা ছিল: ‘কৃষ্ণচন্দ্র গৌরচন্দ্র আউলেচন্দ্র/তিনেই এক একেই তিন’। তার মানে বীরচন্দ্র সরে গিয়ে এলেন আউলেচন্দ্র। তৈরি হল বৈষ্ণববিশ্বাসী এক নতুন উপধর্ম। অচিরে সেই উপধর্ম অর্থাৎ কর্তাভজাদের নেতৃত্বে এলেন দুলালচন্দ্র পাল, যাঁর মা-র (মূল নাম সরস্বতী) নতুন নামকরণ হল সতী মা। সতী মা নামে শচী মা ধ্বনির আভাস তো স্পষ্ট। এর গায়ে গায়ে তৈরি হল নতুন উচ্চারণ:
তিন এক রূপ।
শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র শ্রীগৌরচন্দ্র ও শ্রীদুলালচন্দ্র
এই তিননাম বিগ্রহস্বরূপ॥
কেমন সুপরিকল্পিতভাবে আউলেচন্দ্রকে সরিয়ে দুলালচন্দ্র লোকমানসে আসন পাতলেন।
একশো বছর আগে অক্ষয়চন্দ্র দত্ত যখন ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ বইটি লেখেন তখন বাংলার বিভিন্ন উপধর্মের হদিশ দেন এবং একটা মোটামুটি প্রতিবেদন খাড়া করেন। মুশকিল যে, অক্ষয়কুমার নিজে সরেজমিন খুঁজে পেতে ঘুরে প্রতিবেদন লেখেননি। মোটামুটি খবর এর-তার কাছ থেকে সংগ্রহ করে লিখেছিলেন। তাতে ভুল আছে, খণ্ডতা আছে। বরং অনেকটা ঘুরে বিবরণ লিখেছিলেন বিদ্যাভূষণ যোগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তাঁর ‘Hindu Castes and Sects’ বই লেখার সময়। মেহেরপুরের বলরামী সম্প্রদায়ের বিবরণ অক্ষয়কুমার নিতান্ত রৈখিকভাবে দিয়েছেন, অথচ বিদ্যাভূষণ স্বয়ং মেহেরপুরে গিয়ে বলরামের বিধবা স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তবে লেখেন।
ষাটের দশকের শেষে আমি যখন উপধর্ম সম্পর্কে খোঁজ করতে শুরু করি তখন বিদ্যাভূষণের পদ্ধতিই শ্রেয়তর মনে হল। এ লেখার পরবর্তী অংশ সেই পায়ে-হাঁটা, চোখে-দেখা আর কানে-শোনার সত্য বিবরণ। এতে আছে লৌকিক উপধর্মের সেই পরাক্রান্ত স্বরূপ, সভ্যতা-রাজনীতি-বিজ্ঞান-শাস্ত্র-নিপীড়ন যাকে আজও মারতে পারেনি।
*
‘সাহেবধনী’ কথাটা কোনওদিন শুনিনি। এই বিশাল জনপদে যে বৃত্তিহুদা বলে একটা গ্রাম আছে, এ ব্যাপারটাও ছিল অজানা। মফস্বলের এক কাগজে একজনের ধারাবাহিক লেখা পড়ে জানতে পারি নদীয়ায় গত শতকে কুবির সরকার বলে এক বড় লোকগীতিকার ছিলেন। নিবন্ধে ব্যবহৃত তাঁর গানের উদ্ধৃতি দেখে মনে হল কুবিরের গান সংগ্ৰহযোগ্য। চিঠিতে যোগাযোগ করে একদিন হাজির হলাম নদীয়ার চাপড়া থানার বৃত্তিহুদা গ্রামে। সেখানেই রামপ্রসাদ ঘোষের বাড়িতে স্বচক্ষে দেখলাম তাঁর ঠাকুর্দা রামলাল ঘোষের অনুলিখনে কুবির গোঁসাইয়ের ১২০৩ খানা গান। পরে তাঁরা উৎসাহ করে দেখালেন কুবির গোঁসাইয়ের সমাধি মন্দির, সেখানে তাঁর স্ত্রী ভগবতী আর সাধনসঙ্গিনী কৃষ্ণমোহিনীর সমাধিও রয়েছে। উঁকি মেরে কুবিরের সমাধি ঘরে দেখলাম একটি মাটির ঢিবি, একটি সজ্জিত চৌকি ও বিছানা, ফুলের সাজি, ফকিরী দণ্ড, বাঁকা লাঠি, ত্রিশূল, খড়ম আর কাঠের পিঁড়ি।
: এ সব তেনার ব্যবহার করা জিনিস, বললে গোপালদাস। এখানকার সেবাইত। কুবিরের অধস্তন চতুর্থ স্তরের বংশধর।
কখনও সহজিয়া বৈষ্ণবদের সমাধি তো দেখিনি। কৌতূহল হল। জিজ্ঞেস করলাম মাটির ওই উঁচু ঢিবিটা কেন?
: ওইখানে রয়েছে তেনার মাথা। জানেন তো আমাদের সমাধি হয় মাটি খুঁড়ে তাতে শরীরকে হেলান দিয়ে সামনে পা ছড়িয়ে বসিয়ে।
আরও জানা গেল, ওই রামলালের খাতা থেকেই, যে কুবিরের জন্ম ১১৯৪ বঙ্গাব্দে ফাল্গুনী পূর্ণিমায়, মৃত্যু ১২৮৬-র ১১ আষাঢ় মঙ্গলবার রাত চারদণ্ডে শুক্লপক্ষে ষষ্ঠী তিথির মধ্যে। এবারে তাঁরা দেখালেন কুবিরের গুরু চরণ পালের ভিটে। সবই দেখা হল। শুধু বোঝা গেল না ১২০৩ খানা গানের লেখক কুবির গোঁসাইয়ের নাম কেন সর্বসাধারণের কাছে এতটা অজ্ঞাত।
বাড়ি ফিরে বিদ্যুচ্চমকের মতো দুটো ব্যাপার চোখের সামনে ধরা পড়ল কয়েক মাসের মধ্যে। প্রথমত, ‘শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’ পড়তে পড়তে হঠাৎ আবিষ্কার করলাম প্রসিদ্ধ গান ‘ডুব ডুব ডুব রূপসাগরে আমার মন’ কুবিরের লেখা। দ্বিতীয়ত, ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ (১৮৭০) পড়ার সময় চোখ পড়ল ‘সাহেবধনী’ সম্প্রদায় সম্পর্কে। এই সম্প্রদায়ের স্রষ্টা দুঃখীরাম পাল। তাঁর পুত্র ‘চরণ পাল এই সম্প্রদায়ের মত বিশেষরূপে প্রচার করিয়া অতিশয় বিখ্যাত হইয়া উঠিয়াছেন।…কিছুদিন হইল চরণ পালের মৃত্যু হইয়াছে।’
আরও দু-একবার নিজে নিজে বৃত্তিহুদা গ্রামে ঘুরে বুঝলাম জলাঙ্গী নদীর পশ্চিম পাড়ে দোগাছিয়া গ্রাম, পুবে বৃত্তিহুদা। চরণের পিতা ছিলেন দোগাছিয়ার মানুষ। জনৈক উদাসীনের কাছে তিনি দীক্ষা নেন এবং গড়ে ওঠে সাহেবধমী ধর্মমত। তাঁর ছেলে চরণ পাল দোগাছিয়া থেকে বাস্তু তুলে আনেন পরপারে বৃত্তিহুদায়। এখানেই সাহেবধনীদের সাধনপীঠ আর আসন। চরণের শিষ্যদের মধ্যে প্রধান ছিলেন কুবের সরকার, জাতে যুগী, পেশায় কবিদার। চরণের কাছে দীক্ষা নিয়ে কুবের হলেন গোঁসাই, বনে গেলেন তাত্ত্বিক গীতিকার। আর নদীয়ার নিজস্ব স্বরসঙ্গতির নিয়মে কুবেরের উচ্চারণ হল কুবির। একজন গায়ক কুবিরের গান শোনালেন। সযত্নে টুকে নিলাম:
ওরে বৃন্দাবন হতে বড় শ্রীপাট হুদা গ্রাম
যথা দিবানিশি শুনি দীনবন্ধু নাম।
হেরি নীলাচলে যেমন লীলে
এখানে তার অধিক লীলে
হিন্দু যবন সবাই মিলে স্বচক্ষে দেখতে পেলাম।
দ্যাখো গোঁসাই চরণচাঁদ আমার
বসিয়েছে চাঁদের বাজার
ভক্তবৃন্দ আসছে যাচ্ছে অবিশ্রাম।
আমার চরণচাঁদের নামের জোরে
কত দুখী তাপী পাপী তরে
হাঁপ কাশি শূল গুড়ুম ব্যথা
মহাব্যাধি হয় আরাম ॥
গানের শেষ স্তবক বেশ লক্ষণীয়। চরণ পালের তা হলে ভেষজবিদ্যায় বেশ হাতযশ ছিল। সাহেবধনী মতে হিন্দু যবন যে সমান মর্যাদায় রয়েছে তা বুঝতে দেরি হল না। পরিসংখ্যান ঘেঁটে আদমসুমারি মাফিক এইরকম বিবরণ তৈরি করা গেল—
গ্রামের নাম: বৃত্তিহুদা। থানা: চাপড়া। জেলা: নদীয়া। অবস্থান: কৃষ্ণনগর শহর থেকে ১৬ মাইল উত্তর-পূর্বে। মৌজা নং ২৯। অধিবাসীদের জীবিকা: কৃষিকর্ম, ব্যবসায় ও শিক্ষকতা। মোট জনসংখ্যা ৩৪৫০ জন। মুসলমান ৫২৫ ঘর। ঘোষ ৬০ ঘর। কর্মকার ৮ ঘর। দাস ৪০ ঘর। প্রামাণিক ৬ ঘর। গড়াই ১০ ঘর। সূত্রধর ১ ঘর।
যে গ্রামে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সেখানে বৈষ্ণব সহজিয়াকেন্দ্রিক একটা উপধর্ম কীভাবে টিকে আছে বিপুল গৌরবে তা জানতে ইচ্ছে হল। গ্রামের প্রাইমারি ইস্কুলের হেডমাস্টার দ্বিজপদ প্রামাণিক বললেন বৈশাখী পূর্ণিমায় আসতে। ওই দিন চরণ পালের ভিটেয় মহোৎসব হবে।
গেলাম সেই মহোৎসবে। দেখলাম বৃত্তিহুদা আর আশপাশের অনেক কটা গ্রামের মানুষ বিপুল উৎসাহে মেতে উঠেছে হিন্দুমুসলমান নির্বিশেষে। তবে উচ্চবর্ণের কেউ যে নেই সেটাও চাক্ষুষ হল। সন্ধের পর সারারাত চলল শব্দগানের আসর। লালনের ‘দৈন্যতা’র গানের জবাবে কুবিরের ‘প্রবর্ত’ গান অনেকগুলি শোনার সুযোগ হল। দেখলাম কবিরের গান বেশিরভাগ গাইছে মুসলমান ফকির। জহরালি আর ছামেদ আলি। লোকে গানের ফাঁকে ফাঁকে হুংকার দিয়ে উঠছে: ‘জয় দীনদয়াল জয় দীনবন্ধু।’
আমি ভাবছি লোকগুলো বুঝি হরিধ্বনি দিচ্ছে। দ্বিজপদবাবু ভুল ভাঙিয়ে জানালেন, ‘সাহেবধনীদের উপাস্যের নাম দীনদয়াল। এদের সম্প্রদায়কে বলে দীনদয়ালের ঘর। কখনও কখনও দীনদয়ালকে এরা দীনবন্ধুও বলে। এটা ওদের কোড ল্যাঙ্গুয়েজ।’
তা হলে সেদিন কুবিরের গানে যে শুনেছিলাম ‘ওরে বৃন্দাবন হতে বড় শ্রীপাট হুদাগ্রাম/ যেথা দিবানিশি শুনি দীনবন্ধু নাম’—সে তা হলে এই দীনদয়াল-দীনবন্ধু। ক্রমে জানা গেল দীনদয়ালের ঘরে হিন্দু-মুসলমান প্রায় সমান সমান। মচ্ছবের সময় দেখলাম যে হিন্দুকে পরিবেশন করছে মুসলমান, মুসলমানকে হিন্দু। আসলে গেরুয়া বা কোনও বর্হিবাস তো পরে না। গৃহী ধর্ম। যে কেউ নিতে পারে। আমাদের সাদা চোখে যাকে হিন্দু বা মুসলমান ভাবছি তারা কিন্তু এখানে বর্ণ হিন্দু বা শরিয়তি মুসলিম নয়। সকলেই সাহেবধনী। ততক্ষণে জহরালি নেচে নেচে গাইছে:
এই ব্রজধামের কর্তা যিনি
সেই ধনী এই সাহেবধনী।
রাইধনী এই সাহেবধনী॥
আশ্চর্য তো! ব্রজের রাইকে এরা সাহেবধনী বানিয়েছে। তার মানে এরা নারীভজা-সম্প্রদায়। এদিকে ছামেদ আলি গান ধরেছে:
একের সৃষ্টি সব পারি না পাকড়াতে।
আল্লা আলজিহ্বায় থাকেন আপনসুখে
কৃষ্ণ থাকেন টাকরাতে।
এ সবই নাকি কুবিরের গান। আশ্চর্য সমন্বয়বাদের গান। এ গানের মূল তো দেখতেই হবে।
পাশ থেকে ধারাবিবরণীর মতো দ্বিজপদ মাস্টারমশাই বলে যাচ্ছেন: চরণ পালের প্রধান শিষ্য ছিলেন তিনজন। রুকুনপুরের প্রহ্লাদ গোঁসাই, বামুনপুকুরের রামচন্দ্র গোঁসাই আর এই হুদোর কুবির গোঁসাই। এদের মধ্যে গান লিখেছে শুধু কুবির। আহা কী গান!
জানতে চাইলাম: কুবিরের গানের শিষ্য নেই?
: সে কী? আপনি যাদুবিন্দুর গান শোনেননি? এখুনি শুনিয়ে দিচ্ছি। মস্ত বড় ভাবের কবি। কুবিরের প্রধান শিষ্য যাদুবিন্দু গোঁসাই। বাড়ি ছিল বর্ধমানের পাঁচলখি গ্রাম। সে বাড়ি এখনও আছে। ওই দেখুন যাদুবিন্দুর দৌহিত্রের ছেলে দেবেন গোঁসাই। ও দেবেন, বলি এদিকে এসো।
বিনীত হেসে হাত জোড় করে দেবেন গোঁসাই এসে দাঁড়ালেন। শীর্ণ চেহারায় টকটকে ফর্সা রং। বাবরি চুল। সাদা পাঞ্জাবি পরনে। জিজ্ঞেস করলাম: আপনাদের পাঁচলখি গ্রামটা কোথায়?
: আজ্ঞে, নবদ্বীপের হিমায়েৎপুর মোড় থেকে বর্ধমান যাবার রাস্তা। সেই রাস্তায় নাদনঘাট ছাড়িয়ে ধাত্রীগ্রামের আগে নাদাই ব্রিজ। তারই গায়ে আমাদের পাঁচলখি। একদিন যাবেন তো?
: কী দেখব সেখানে?
: যাদুবিন্দুর সমাধি আছে আর তাঁর গানের খাতা। শত শত গান।
দ্বিজপদ বললেন: ওহে দেবেন্দ্র, গোপালের মাকে ডাকো তো। এঁকে একখানা যাদুবিন্দুর গান শোনাব।
দেবেন্দ্র সেই ভিড়ে পথ খুঁজতে লাগলেন। দ্বিজপদবাবুকে সেই ফাঁকে জিজ্ঞেস করলাম: যাদুবিন্দু আবার কীরকম নাম? যাদবেন্দ্রের স্বরসঙ্গতি নাকি?
: আরে না না, যাদু আর তার সাধনসঙ্গিনী বিন্দু, এই দুইয়ে মিলিয়ে যাদুবিন্দু। ওই একখানা গানে আছে শুনেছেন, ‘সর্বচরণে পাপীর এই নিবেদন’ তার মধ্যে আছে, ‘যাদু বিন্দু এরাই দুজনা/পাঁচলখি গাঁয় তার ঠিকানা’। এবারে বুঝলেন তো যাদুবিন্দু নামরহস্য?
ইতিমধ্যে এসে গেল গোপালের মা! মধ্যবয়সী বিধবা। খুব লজ্জা পেয়ে গেছেন। ‘আমি কী গান করব বলো দিনি বাবা? আমার কি আর সে গানের গলা আছে?’
দ্বিজপদ বললেন, ‘যা আছে ওতেই চলবে, নাও ধরো।’ আমাকে বললেন: কুবিরের পোষ্যপুত্র কেষ্টদাস। এ তারই ছেলের বিধবা। বুড়ির গলা খুব মিঠে। যাদুবিন্দুর সঙ্গে এর খুব ভাব ছিল। যাদুবিন্দুর অনেক গান এর জানা আছে।
গোপালের মা মধুর কণ্ঠে গান ধরল:
যে ভাবেতে রাখেন গোঁসাই সেই ভাবেতেই থাকি
অধিক আর বলবো কি?
তুমি খাও তুমি খিলাও
তুমি দাও তুমি বিলাও
তোমার ভাবভঙ্গি বোঝা ঠকঠকি।
গুরু দুখ দিতে তুমি সুখ দিতেও তুমি
কুনাম গুনাম সুনাম বদনাম সবই তোমারই
ও কুল্ আলম্ তোমারই ও কুদরতবিহারী
তুমি কৃষ্ণ তুমিই কালী তুমি দিলবারি।
কখনও দুগ্ধ চিনি ক্ষীর ছানা মাখন ননী
কখনও জোটে না ফ্যান আমানি
কখনও আ-লবণে কচুর শাক ভখি।
কহিছে বিন্দু যাদু তুমি চোর তুমিই সাধু
তুমি এই মুসলমান এই হিঁদু
তাই তোমারে কুবিরচাঁদ বলে ডাকি॥
গানের পরে গান। কখনও ‘আমার কাদা মাখা সার হলো’, কখনও ‘যাসনে মন বাঁকানদীর বাঁকে’ গোপালের মা গেয়ে যায়। তার দু’চোখ ভরা জল।
সকলের অলক্ষে গানের আসর থেকে আবছা অন্ধকারে বেরিয়ে পড়ি। এবারে চরণ পালের বাস্তুভিটার ভেতরে। আমাকে দেখতে পেয়ে চরণ পালের বংশের তখনকার কর্তা শরৎ ফকির নেমে আসেন—‘আসুন আসুন, আপনার খবর পেইছি। ভেতরে উঠে আসুন, দীনদয়ালের আসন দেখবেন।’
একটা পুরানো পঙ্খের কাজ করা দালান। তার মধ্যে প্রায়ান্ধকার প্রকোষ্ঠ। বাইরে অন্তত একশো পুরুষ আর নারী ভক্ত মানসিক করে হত্যে দিয়ে আভূমি প্রণত। প্রকোষ্ঠের ভেতরে টিমটিম করে জ্বলছে প্রদীপ। অনেকক্ষণ ঠাওর করে চোখে পড়ে একটা ত্রিশূল, চিমটে, পিঁড়ে আরও যেন কীসব।
‘দণ্ডবত করুন’, শরৎ ফকির কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন, ‘আমাদের বংশের বাইরে কেউ কখনও দীনদয়ালকে দেখেনি। আপনি সেই সুযোগ পেলেন।’
আবেগের তাৎক্ষণিকতায় চোখ বুঁজে গেল। ভাবলাম আমার মতো জ্ঞানপাপী অভাজনদের প্রতি এত কৃপা! শরতের চোখ অবনত। হাত বদ্ধমুষ্টি। তাতে ফকিরি দণ্ড। যেন প্রত্যাদেশের মতো বললেন: আমার সঙ্গে আসুন।
তাঁর পেছন পেছন লণ্ঠনের আলোয় গিয়ে দাঁড়ালাম এজমালি বাড়ির বিরাট ছাদে। শূন্য খাঁ খাঁ ছাদ। বৈশাখী পূর্ণিমার আলোকিত রাত। শন শন হাওয়া বইছে। ফকির হাতে দিলেন পরমান্ন প্রসাদ। দীনদয়ালের নিশিভোগ। অমৃতের মতো লাগল।
ছাদের কার্নিশে বুক ঠেকিয়ে ফকির তাকালেন জ্যোৎস্নাজড়িত জলাঙ্গী নদীর জলের দিকে। চোখের দৃষ্টি সুদূর। বলতে লাগলেন: অনেকদিন থেকে আপনার মতো একজনের জন্যে অপেক্ষা করছি। লক্ষ করছি মাস কয়েক আপনি এ গাঁয়ে ঘুরছেন। কখনও আমার কাছে আসেননি। রামপ্রসাদ, দ্বিজপদ মাস্টার এদের কাছে ঘুরছেন। কী আছে ওদের কাছে? কুবিরের কখানা গান? কী হবে সে গান নিয়ে? গানের মর্ম কিছু বুঝবেন? এ কি রেডিওর লোকগীতি? কিসসু বুঝবেন না যতক্ষণ না সাহেবধনী ঘরের তত্ত্ব বোঝেন। আমার কাছে সেই তত্ত্ব, সেইসব মন্ত্রের খাতা আছে। চরণ পালের বস্তু। আপনাকে সব দেব।
বৈশাখের মধ্যরাতে এমন একটা আচম্বিত প্রাপ্তি একেবারেই ভাবনার মধ্যে ছিল না, তাই বিহ্বলতায় খানিকক্ষণ কথা বেরোল না। বেশ খানিক পরে শুধু বলতে পারলাম: আমাকে দিয়ে কী কাজ হবে আপনার?
: আমার কাজ নয়, দীনদয়ালের কাজ। এ বাড়ি ভেঙে পড়ছে। দীনদয়ালের ঘরের ছাদ পড়ো-পড়ো। ভক্ত শিষ্যরা গরিব। আমার মন বলছে আপনাকে দিয়ে দীনদয়ালের প্রচার হবে। গভর্নমেন্ট হয়তো দীনদয়ালের ঘর নতুন করে বানিয়ে দিতে পারে।
: কিন্তু আপনাদের ধর্মমত তো গোপন। তার এত প্রচার কি ঠিক হবে?
: সে কথা আমি অনেক ভেবেছি। কিন্তু আমি আর সেবাপূজা সামাল দিতে পারছি না। প্রত্যেক বেস্পতিবারের ভোগরাগ, নিত্যপূজার খরচ, অন্ন মচ্ছবের বিরাট ব্যাপার, আসুনে ফকিরদের সম্বৎসরের হুঁকো পাটি দেওয়া, এ কি আর সম্ভব হবে? তাই ভাবছি আপনি যখন এসে গেছেন, আসলে দীনদয়াল আপনাকে পাঠিয়েছেন, তখন তাঁর কাজ তিনি করিয়ে নেবেন। চলুন, রাত হল। কাল দুপুরে আপনাকে সব দেব।
বাকি রাতটা কাটল দারুণ উত্তেজনায়। দ্বিজপদবাবুর বাইরের বারান্দায় শুয়ে ঘুম আর আসে না। কাউকে বলতেও পারছি না সামনের দিন আমি কী পেতে চলেছি। অবশেষে সকাল হল। আস্তে আস্তে সকালটা গড়িয়েও পড়ল। মচ্ছবের লোকজন দীনদয়ালের নাম করতে করতে যে যার বাড়িমুখো রওনা দিল। দুপুরে কথামতো হাজির হলাম শরৎ ফকিরের ভিটেয়। তিনি যেন আমার অপেক্ষাতেই ছিলেন। বললেন, ‘এইমাত্র দীনদয়ালের ভোগ নিবেদন শেষ হল। আজ তো বিষ্যুদ্বার। আজকেই দীনদয়ালের বার। দীনদয়ালের সব আসনে আজ ভোগরাগ নিবেদন।’
আমি না জিজ্ঞেস করে পারলাম না যে ‘আসন’ ব্যাপারটা কী? ‘আসুনে ফকির’ কথাটা, যা আগের রাতে শুনেছিলাম, তার মানেই বা কী?
শরৎ ফকির বলে চললেন: আমাদের এখানেই দীনদয়ালের মূল আসন। কিন্তু আমাদের ঘরে যারা দীক্ষা নিয়েছে তাদের মধ্যে যারা সিদ্ধ তাদের বাড়িতেও আসন পাতার হুকুম দেওয়া আছে। কয়েক পুরুষ ধরে রয়েছে সে সব আসন। তারা দীক্ষা দেবারও অধিকারী। তাদের বলে আসনে ফকির। চৈতী একাদশীতে অগ্রদ্বীপে আমাদের বারুণী মেলা হয়। ওইখানে চরণ পাল বাক্সিদ্ধ হয়েছিলেন। সেই থেকে প্রত্যেক বছর অগ্রদ্বীপে দীনদয়ালের আসন পাতা হয়। আমি যাই। হাজার হাজার ভক্ত শিষ্য আসে। তিনদিন আমাদের পুজো মান্সা মচ্ছব হয়। আসুনে ফকিররা এক একটা গাছতলায় আসন পাতে। মন্ত্র দীক্ষা হয়। সামনের চোত মাসে আসুন। আমার সঙ্গে থাকবেন গাছতলায় তে-রাত্তির। কত কী দেখবেন, জানবেন। যাকগে, এবারে ভেতর বাড়িতে আসুন। আপনাকে কতকগুলো সামগ্রী দেব। কিন্তু কাউকে বলবেন না। অন্তত আমার জীবিতকালে নয়। কী, কথা দিলেন তো?
নীরবে সম্মতি জানিয়ে তাঁকে অনুসরণ করি। বুকের মধ্যে টগবগে উত্তেজনা। বাড়ির একেবারে ভেতরের মহলে ছিল এক বিশাল সিন্দুক। বিরাট এক চাবি দিয়ে তা ক্যাঁচকোঁচ শব্দে খুললেন ফকির। ভেতরে হাত ডুবিয়ে লাল শালুতে মোড়া কী সব বেরোল। তাতে মাথা ঠেকিয়ে খুলে ফেললেন শালুর আবরণ। বেরোল কতকগুলি কালজীর্ণ পুঁথি আর খাতা। হলদে কাগজ। তাতে ভুষো কালির উজ্জ্বল হস্তাক্ষর। ‘এইগুলোতে আমাদের ঘরের সব গুহ্য খবর আছে। আর এই নিন আসল পুঁথি।’
থরথর উত্তেজনায় হাতে নিলাম একটা পুঁথি। আদ্যন্ত লাল কালিতে লেখা সাহেবধনী ঘরের গুপ্তমন্ত্র আর সাধনরীতি।
ফকির বললেন: এই হল সাহেবধনী ঘরের সত্য মন্ত্র আর গুপ্তনাম। একজন মুসলমান নারী উদাসীন এ মন্ত্র আর আমাদের ঘরের শিক্ষা দেন। এগুলো আচরণমূলক। এর সমস্ত শিক্ষা পুরো জানতেন চরণ পাল। তাঁর ছেলে ছিলেন তিলক। তিলকের ছেলে ফটিক। ফটিকের চার ছেলে—রামভদ্র, বীরভদ্র, প্রাণভদ্র আর মনমোহন ভদ্র। সেই রামভদ্রের বড় ছেলে আমি। এ সব খাতা পুঁথি শিক্ষা পাঁচপুরুষ পেরিয়ে আমার হাতে পড়েছে। খুব গুপ্ত সাধনা আমাদের। মাটির কার্য, নালের কার্য, করোয়া সাধন। এ সব আপনাকে আমি বুঝিয়ে দেব। কুবিরের গানে আমাদের ঘরের তত্ত্বই ব্যাখ্যা করা আছে। তার বাইরের অর্থ আর ভেতরের কথা আলাদা।
আমি চোখ বোলাতে লাগলাম অদ্ভুত ভাষায় লেখা সে সব মন্ত্রে, বিড় বিড় করে পড়তে লাগলাম:
আল্লাতালা ব্ৰহ্মসাঁই তোমার নেহার ধরে
মাটির বস্তুকে পান করিলাম।
ক্লিং মন্ত্র অনঙ্গ মুঞ্জরী হিঙ্গলবরণ গা হরিতেল বরণে সাধি।
শুক্র খাই।
পলকে পলকে গুরু যেন তোমায় দেখতে পাই।
গোঁসাই আলেকসাঁই তুমি থাকো সাক্ষী।
যে বয়সে খাইলাম চারিবস্তু সেই বয়সে থাকি।
দোহাই দীননাথ। ৩ বার।
বুঝলাম, এখানে যে চারিবস্তুর কথা বলা হয়েছে তা হল মল মূত্র রজ বীর্য। তার মানে এ এক দারুণ গুহ্যমন্ত্র।
ফকির বললেন: কুবিরের গানে এই কথাটাই আছে অন্যভাবে। চরণ পালের শিক্ষায় তিনি লিখেছেন:
শনি শুককুল বীজরূপে এক
আর আতস খাক বাদ চারে এক চারের মধ্যে এক।
বুঝে দেখো সৃষ্টির বিষয়।
আল্লা আত্মারূপে সব শরীরে বিরাজে সর্বময়।
এখানে ‘শনি শুককুল’ মানে বুঝলেন? শনি মানে শোণিত, স্ত্রীরজ। শুককুল মানে পুরুষের শুক্র। এইবারে আমাদের ঘরের সত্য মন্ত্র শুনুন:
ক্লিং শিং দীনদয়াল সাহেবধনী সহায়।
গুরু সত্য। চারিযুগ সত্য। চন্দ্রসূর্য সত্য।
খাকি সত্য। দীননাথ সত্য। দীনদয়াল সত্য। দীনবন্ধু সত্য।
আরেক মন্ত্র শুনুন—
ক্লিং সাহেবধনী আল্লাধনী দীনদয়াল নাম সত্য।
চারিযুগ সত্য। কাম সত্য। করণ সত্য। ঠাকুর সত্য।
দীনদয়াল সত্য। দীননাথ সত্য। দীনবন্ধু সত্য।
গোঁসাই দরদী সাঁই/তোমা বই আর আমার কেহ নাই।
আরেক গুহ্য মন্ত্র নিগূঢ়:
গুরু তুমি সত্যধন। সত্য তুমি নিরঞ্জন।
খাকি তোমার নাম সত্য। কাম সত্য। সেবা সত্য।
ঠাকুর সত্য। বাক সত্য। গুরু সত্য।
ফকির থামলেন, কিন্তু আমার মনে শুরু হল ধন্দ। এ কোথায় এসে পড়লাম আমি? এ সবের মানে কী? অনেক শব্দ যে জীবনেই শুনিনি। এ সব নিয়ে আমি কী করব? যেন মুক্তি পাবার জন্যে বললাম, আমি এর কোনও মানে বুঝছি না। করণ মানে কী? খাকি মানে কী? আল্লা বলছেন আবার ঠাকুর বলছেন। দীনদয়াল কে? দীনদয়াল কী?
প্রসন্ন মুখে হাসলেন শরৎ, ‘একদিনে সব বুঝে ফেলবেন? এ সব অনেক দিনের করণ। এখন খাতা থেকে টুকে নিন সব। এখানে থাকুন আজ, এই ঘরে। কেউ জানবে না। সব টুকে নিন। তারপরে দেব কবজ তাবিজের খাতা। রোগ সারাবার ভেষজ বিবরণ।’
: কুবিরের গানের খাতা দেবেন না?
: সকলেরই দেখি এক চাহিদা। কুবিরের গানে কী আছে বলুন তো? আগে তো চরণ, তবে তো কুবির। তার গানে তো আমাদেরই মন্ত্র আর বিশ্বাসের ব্যাখ্যা। এমনি এমনি সে সব বুঝতে পারবেন! যদি বোঝেন তবে সে হবে বাইরের মানে।
: তাই নাকি?
: হ্যাঁ। অবশ্যই। আচ্ছা কুবিরের গানটাই শুনুন। গাইতে তো পারি না, মুখে মুখেই বলি—
আগে ছিল জলময় পানির উপর খাকি রয়
খাকির উপর ঘরবাড়ি সকলরে।
ভাই রে যে আল্লা সেই কালা সেই ব্ৰহ্মবিষ্টু
ও সেই বিষ্টুর পদে হল গঙ্গার সৃষ্টিরে।
এবারে একটু মানে বুঝে নিন। খাকি মানে মাটি, ফারসি শব্দ। বিষ্ণুর পাদপদ্মই মাটি। সেইখান থেকে গঙ্গার সৃষ্টি। গঙ্গা মানে পানি। পানি মানেও মাটি। মাটি মানেও পানি। আব আর খাক। হিন্দু মলে গঙ্গা। মুসলমান মরলে মাটি। দুইই এক। কিন্তু যখন প্রলয় হবে?
ভাইরে হিন্দু মলে গঙ্গা পায় যবন থাকে জমিনায়
শাস্ত্রমতে বলি শোনো স্পষ্টরে।
যখন এই খাকি একাকী সরে দাঁড়াবে
তখন সব নৈরাকার হবে।
সংসার যাবে রে গঙ্গা গঙ্গাজলে মিশাবে।
বুঝে দেখো দেখি হবে কি খাকি পালাবে
যবন মলে কব্বর কোথা পাবে রে।
এই সংসার অসার হবে ঘরবাড়ি কোথা রবে
এই কথাটির বিচার করো সবে রে।
পানি আছেন কুদরতে খাকি আছেন পানিতে
খাকির ওপর স্বর্গমর্ত্য পাতালের এই কথা
আব আতস খাক বাদ চারে কুলে আলম্ পয়দা করে
হিন্দু যবন জানে না কিছু বোঝে না বিরাজে এই সংসারে ॥
কুদরতি মানে দৈবীশক্তি। কুলে আলম্ মানে ঈশ্বর। তা হলে কথাটা কী দাঁড়াল। হিন্দুর গঙ্গা, মুসলমানের মাটি, এ সব কিছুই থাকবে না। থাকবেন কুলে আলম্ আর তাঁর কুদরতি। থাকবে আব আতস খাক বাদ। হিন্দু মুসলমান তোমরা সব ভেদবুদ্ধি ত্যাগ করে দীনদয়ালকে ডাকো।
কথাটা স্পষ্ট হল। তারই টানে আমি বললাম: আপনাদের ধর্মবিশ্বাসে রয়েছে সমন্বয়ের কথা। আল্লাধনী রাইধনী এই দুইয়ে মিলিয়ে আপনাদের সাহেবধনী। বড় আশ্চর্য। এর কারণ আমার মনে হয় প্রথম যে উদাসীনের কাছে আপনাদের দীক্ষাশিক্ষা হয়েছিল তিনি ছিলেন কাদেরিয়া সুফি সম্প্রদায়ের।
ফকির বললে: তা হতে পারে। দীনদয়ালের ঘরে গেলে আমরা ঘোমটা দিই জানেন তো?
: ঘোমটা দেন? তা হলে আর সন্দেহ রইল না।
শরৎ ফকিরের সঙ্গে আমার ভাবের লেনদেন এইভাবেই শুরু। মাঝে মাঝেই বৃত্তিহুদায় যাই। রাতে থাকি। মাঝরাতে কথাবার্তা হয়। একবার অগ্রদ্বীপের মেলায় আমগাছ তলায় পাশাপাশি দুটো শতরঞ্জি পেতে দুজনে শুয়ে নানা কথা বলি। ওঁর পরনে সাদা থানধুতি আর সাদা সুতি চাদর। বুকে সবসময় কালো রঙের ফকিরি দণ্ড ধরে আছেন। ওইটি কাছছাড়া করতে নেই। ওতে নাকি আছে ঐশী শক্তি।
কখন গাঢ় ঘুমিয়ে পড়েছি চৈতী হাওয়ায়। রাত তিনপ্রহরে হঠাৎ গায়ে হাত দিয়ে ডাকেন শরৎ—‘উঠুন, উঠুন, আমার ক্রিয়াকলাপ দেখবেন তো?’
সমস্ত মেলা ঘুমোচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ সমস্ত দিনের চিঁড়ে-মহোৎসবের পর ক্লান্ত নিদ্রাতুর। আকাশে একাদশীর ক্ষীণ চাঁদ। আবছা অন্ধকারে দেখলাম গোপালের মা আর তিনজন বিধবা, ফকিরের চারপাশে চারটে ধুতি দিয়ে আবরণ তৈরি করেছে। তার মধ্যে চুপিসাড়ে বসে ফকির ভাত খাচ্ছেন। আমার হতভম্ব ভাব দেখে গোপালের মা বললে ফিসফিস করে, ‘দুপহর রাতে আমরা ফকিরের অন্ন পাক করেছি। উনি তিন পহরে তা সেবা কচ্চেন। এ খাওয়া কাউকে দেখতে নেই। কাল চোপর দিন আর উনি অন্ন কি কোনও খাদ্য ছোঁবেন না। সংযমে থাকবেন। কথাবাত্তাও নয়। সারাদিন আসনে বসে থাকবেন। আবার কাল রাত তিন পহরে অন্ন সেবা হবে। অগ্রদ্বীপে ওঁর এই নিয়ম। জয় দীনদয়াল। চারযুগ এই চলছে।’
এরপরে ভোর থেকে আমার শুধু দেখে যাওয়া। কেননা ফকির নির্বাক। সকালে সদলে গঙ্গাস্নান সেরে আসনে বসলেন ফকির। সাদা বেশবাস। মাথায় চাদরের ঘোমটা। একহাত দিয়ে বুকে ধরে আছেন ফকিরি দণ্ড। সামনে সিঁদুৱলিপ্ত এক বিরাট ত্রিশূল, তার সামনে রক্তাম্বরধারী এক সেবক। ‘জয় দীনদয়াল গোপ্ত বাবাজী’ হুংকার দিয়ে রাশি রাশি পুজোপচার নিয়ে পুরুষ নারীরা ভুলুণ্ঠিত হয়ে প্রণাম জানাচ্ছে। দেখতে দেখতে জায়গাটা বিশ্বাসী ভক্তে ছেয়ে গেল। কয়েকশো লোক ভেজা কাপড়ে হত্যে দিয়ে পড়ে রইল। জায়গাটা কাদায় কাদা। উঁকি মেরে দেখলাম ফকির সংযত ভঙ্গিতে বসে আছেন। সামনে পাতা একটা নতুন পাটি। তাতে জমা পড়ছে খুচরো পয়সা আর টাকা, কাঁচা আর নোট। লাল খেরোর খাতা খুলে এক গোমস্তা হিসেব লিখছেন।
গোপালের মাকে জিজ্ঞেস করে পরে জানলাম ওই খাতায় আসুনে ফকিররা খাজনা জমা দিচ্ছে।
: খাজনা কীসের? আমার প্রশ্ন।
গোপালের মা বলে, ‘কেন বাবাঠাকুর, ওনাদের দেহমন তত দীনদয়ালের ঘরে বাঁধা। তার খাজনা দিতে হবে না?’
: কত করে খাজনা?
: তার কি কোনও ঠিক আছে? যার যেমন ক্ষমতা। টাকা আধুলি চাল ডাল মটর খন্দ কলাই। ওই দিয়েই তো অন্ন মচ্ছব হবে। আবার বোশেখী পুন্নিমেতে হুদোয় হবে মচ্ছব। তখন এখানকার সব আসুনে ফকির সেখানে যাবে। দীনদয়ালের ঘর থেকে তাদের দেওয়া হয় পাটি আর হুঁকো।
ভাবতে লাগলাম বিচিত্র ধর্ম, বিচিত্র তার রীতি আর আচার। কিন্তু কতদিন আর থাকবে? গুরুকুলে টাকার টান পড়েছে। মন্ত্রতন্ত্র জমাবন্দি হয়ে আছে সিন্দুকে। চর্চার অভাবে ভেষজ বিদ্যা ভুলে গেছে পালেরা। শরৎ ফকিরের ছেলেরা পড়ছে স্কুল কলেজে। কৌলিক ফকিরি তারা নেবে না। বড়জোর বছরে একবার আসবে অগ্রদ্বীপে কিছু রোজগারের ভরসায়।
দেখতে দেখতে বেলা গড়াল। ফকিরের সামনের মাদুরে স্তূপের মতো জমা হতে লাগল টাকা পয়সা আর চাল ডাল আলু এঁচোড়। একদল সম্প্রদায়ী দশ-পনেরোটা মাটির হাঁড়িতে চড়িয়ে দিল রান্না। গাছতলা ধোঁয়ায় ধোঁয়াকার। তার মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গায় গোপালের মা পরম নিষ্ঠায় পাতল এক বিচিত্রিত মানুষ সমান কাঁথা। তাতে রাখল একটা বালিশ। কাঁথার মাথার কাছে পাটের কাঠি দিয়ে ছোট্ট একখানা ঘর বানিয়ে সেটা ঢেকে দিল লাল কাপড়ে। কঞ্চিতে এক গেরুয়া নিশান লাগিয়ে দিল পুঁতে।
ব্যাপার দেখে আমি তো অবাক। তা বুঝতে পেরে গোপালের মা বললে, ‘ও ছেলে, এটা হল কুবির গোঁসাইয়ের আসন। তেনার প্রকট কালে চরণ পাল আসন পাততেন ওইখানে যেখানে ফকির বসেছেন আর এইখানে বসতেন কুবির বাবাঠাকুর। তাঁর বংশে তো শিক্ষাদীক্ষা রইল না। আমার ছেলে গোপাল তো অবোধ। তাই আমি বাবাঠাকুরের আসনটুকু পেতে রাখি। উনি এসে দুদণ্ড বসেন গুরুর সামনে। ওই তো এখন শরৎ ফকিরের মধ্যে চরণ পাল এয়েচেন। এখন ওঁর চোপর দিন কথাবাত্তা জ্ঞানবুদ্ধি বাহ্যে পেচ্ছাব সব বন্ধ। এখানেও কুবির বসে বসে গুরুকে নেহার করছেন। বাবা চরণ পালের নামে একবার হরি হরি বল। জয় দীনদয়াল গোপ্ত বাবাজী।’
সমস্ত মেলার মানুষ যেন জোকার দিয়ে উঠল। দারুণ এই বিশ্বাসের জগতে আত্মবিচ্ছেদে জর্জর আমি এক সংশয়ী। ভয়ানক বেমানান। তার থেকে ত্রাণ পাবার জন্যই বোধহয় গোপালের মাকে বললাম: এই সময় তুমি বরং কুবিরের একখানা গান ধরো।
: ঠিক বলেছো বাবা। তবে তাঁর সেরা গানখানাই শোনো। এ গানে আমাদের দীনদয়ালের ঘরের আসল কথা কটা আছে। শোনো—
মানুষের করণ করো
এবার সাধন বলে ভক্তির জোরে মানুষ ধরো।
হরিষষ্ঠী মনসা মাখাল
মিছে কাঠের ছবি মাটির ঢিবি সাক্ষীগোপাল
বস্তুহীন পাষাণে কেন মাথা কুটে মরো?
মানুষে কোরো না ভেদাভেদ
করো ধর্মযাজন মানুষজন
ছেড়ে দাওরে বেদ।
মানুষ সত্যতত্ত্ব জেনে মানুষের উদ্দেশে ফেরো।
ঘটে পটে দিওনারে মন
পান করো সদা প্রেমসুধা অমূল্যরতন।
গোঁসাই চরণ বলে কুবির চরণ যদি চিনতে পারো ॥
ঘুরতে ঘুরতে দেখা হয়ে যায় যাদুবিন্দুর নাতির ছেলে দেবেন গোস্বামীর সঙ্গে। ‘কই আমাদের পাঁচলখিতে তো এলেন না’—অনুযোগ ফুটল। সেইসঙ্গে আক্ষেপ, ‘আর যাবেনই বা কোথায়? ভিটেটুকু আর যাদুবিন্দুর সমাজ ঘর ছাড়া আর আছে কী? সেবাপুজো করার পয়সা জোটে না। নতুন শিষ্যশাবক হয় না। পুরনোরা গরিব। আর চলে না।’
: রোজগারের অন্য পথ কিছু নেই?
: সামান্য বিদ্যে সম্বল। সাতজন পোষ্য। প্রায়ই অসুস্থ থাকি। জ্বরজারি। যেদিন শরীর ভাল থাকে কালনা কোর্টে গিয়ে দলিল দরখাস্ত লিখে দুচার টাকা পাই। তবু যাবেন একদিন। যাদুবিন্দুর গানের খাতা আছে পাঁচখানা। বাবু, ও সব বিক্রি হয় না? কোনও দাম নেই?
দেবেন গোঁসাইয়ের চোখমুখ লাল টকটকে। রোদে না জ্বরের তাড়সে?
রাতে শরৎ ফকিরকে দেবেনের প্রসঙ্গ তুলতেই বললেন, ‘মানুষটা ভাল, তবে বড় দুঃখী। বিরাট বংশের ছেলে। যাদুবিন্দুর তো অনেক শিষ্য ছিল। ধরে রাখতে পারল না। দীনদয়ালের ঘরের শিক্ষা ঠিকভাবে ধরে রাখতে না পারলে ধ্বংস হয়ে যেতে হবে। ওর তো পাঁচ-ছজন সন্তান। সংযম নেই। জন্ম-পাকে পড়ে গেছে। তবু দেখবেন যদি কিছু করতে পারেন। টাকার খুব টানাটানি বেচারার। আমার সমস্যা অন্য। দীনদয়ালের ঘরই বোধহয় রাখতে পারব না। আধুনিক যুগে নতুন শিষ্য আসছে না। নেহাত পঞ্চাশ বিঘে দেবোত্তর জমি আছে, তাই ঠাকুর সেবাটা চলবে।’
সে রাতে ফকির দুপ্রহরে ডাকলেন। বললেন, ‘আর এক প্রহর পরে সেবা করে মৌনী হয়ে যাব, তার আগে আমাদের ঘরের কবচ তাবিজের খাতাখানা দেখাই। লণ্ঠনের আলোতেই দেখুন।’
সত্যিই অদ্ভুত আশ্চর্যজনক কতকগুলো কাগজের ছক। নানা রকমের চতুষ্কোণ আর শব্দ বা অক্ষর বা সংখ্যা। কোনও ছকের তলায় ‘বাণ কুজ্ঞান লাগে না। লাগিলে আরোগ্য হয়’, কোনটায় লেখা ‘তারকব্রহ্ম কবচ স্বপ্নদোষ নাশ হয়’, একটায় ‘স্বামী ভালবাসে’, একটায় ‘ঋতুরক্ষা হয়’। পানের আকারে আঁকা ছকে লেখা মায়াধরার কাগজ’, এমনকী দুখানা কবচের বিষয় ‘পিরিতি লাগে’ এবং ‘পিরিতি ছাড়ে’। তা ছাড়া অনেক মন্ত্র আর মাপের নির্দেশ।
ফকির বললেন, ‘এ সবও আমাদের ঘরের জিনিস। এককালে এ সব থেকে অনেক কঠিন রোগারোগ্য হয়েছে। সব স্বপ্নে পাওয়া। কাগজে লিখে তাবিজ করে পরতে হয়।’
: আপনি এ সব কবচ দেন?
: না। প্রয়োগ জানি না। শিখিনি। বাবা হঠাৎ মারা গেলেন। শিখিয়ে যেতে পারলেন কই?
: তার মানে এগুলোও বাতিল? শুধু কাগজের পুঁথি?
হতাশার দীর্ঘ নিশ্বাস পড়ল ফকিরের। কী আশ্চর্য মায়াময় মনে হল সমস্ত জগৎ! ওদিকে মেলায় হাজার হাজার বিশ্বাসী মানুষ পরম আশ্বাসে ঘুমোচ্ছে। ঘুম নেই শুধু তাদের গুরুবংশের প্রধান মানুষটার। তাঁর চিন্তা কেমন করে ভেঙে-পড়া দীনদয়ালের ভিটেটুকু বাঁচবে। কেমন করে আরও শিষ্য বাড়বে।
এক ঘুমে রাত কাবার। যখন ঘুম ভাঙল তখন রোদের তেজ হয়েছে। বারুণীর স্নান চলছে গঙ্গায়। আজ ভাঙা মেলা। শরৎ বসেছেন মৌনী আসনে। গঙ্গা পেরিয়ে সোজা দুমাইল হেঁটে একেবারে অগ্রদ্বীপ স্টেশন। স্টেশনে গিয়ে দেখি সিমেন্টের বেঞ্চিতে অঘোরে পড়ে আছে ধুম জ্বরে দেবেন গোঁসাই। গা পুড়ে যাচ্ছে। মাথায় হাত রাখি। ক্লিষ্ট হেসে গোঁসাই বলে: শেষ রাত থেকে এমনি জ্বর। ট্রেনে চেপে সমুদ্রগড় নেমে পাঁচলখি গিয়ে শয্যা নেব। মাথায় থাক আমার দীনদয়াল।
সাহেবধনী ঘরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক তেমন করে যে গড়ে উঠল না তার কারণ আমারই শৈথিল্য। সত্যিই তো তাদের জন্যে কিছু করতে পারতাম না আমি। তবে বিশ্বাসভঙ্গ করিনি। শরৎ ফকির যতদিন জীবিত ছিলেন তাঁদের ঘরের গুপ্তকথা কাউকে বলিনি বা লিখিনি। হয়তো নিতান্ত হতাশায় কিংবা সুগভীর দুশ্চিন্তায় হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন তিনি। সে খবর পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ওইখানেই এ অধ্যায়ের ইতি।
কিন্তু হঠাৎ দশ মাস পরে দিল্লির এক প্রতিষ্ঠান লোকসংগীত সংগ্রহের জন্য কিছু আর্থিক অনুদান পাঠাল। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল দেবেন গোঁসাই আর তার কাছে সংরক্ষিত যাদুবিন্দুর খাতার কথা। পুরনো ডাইরির পাতা খুঁজে পাঁচলখির ঠিকানায় দেবেন গোঁসাইকে এক চিঠি পাঠালাম রিপ্লাই পোস্টকার্ডে। অভিজ্ঞতায় জেনেছি গ্রামের লোক অনেক সময় স্রেফ উদ্যমের অভাবে চিঠি লেখে না। তাই জবাবি চিঠি। তাতে দিন সময় জানিয়ে লিখে দিলাম আমার যাবার খবর। যেন এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে বাসস্টপে কেউ থাকে আমার জন্য। শ’পাঁচেক টাকা পাবার সম্ভাবনার কথাটুকুও ইঙ্গিতে লিখে দিলাম।
নির্দিষ্ট দিনে একখানা চটের সাইড ব্যাগ নিয়ে রওনা দিলাম। তার আগেই জবাবি-চিঠি এসে গেছে দেবেন গোঁসাইয়ের। তিনি লিখেছেন:
পূজনীয় দাদা,
আপনার একখানি পত্র পাইয়া সকল সমাচার অবগত হইলাম। আপনি যে আমার মতন হতভাগাকে মনে রেখেছেন এইটাই ধন্যবাদ। যাহা হউক, আপনি আমার এখানে ও পাঁচলখিতে আসার ইচ্ছুক, আমার সৌভাগ্য। দয়া করিয়া গরিবের বাড়িতে আসিবেন। আসিতে যেন কুণ্ঠিত হইবেন না। বাসস্টপে লোক থাকিবে জানিবেন। ইতি
আপনার হতভাগ্য দেবেনবাবু।
নবদ্বীপের হেমাইৎপুর, মোড় থেকে উঠেছি কালনা-চুপী রুটের বাসে। পৌষের শীতের বেলা এগারোটা। ভাবছি, খাতাগুলো পাব তো? আগে ভাগে টাকার কথাটা না লিখলেই হত। অবশ্য টাকাটা পেলে গোঁসাইয়ের অন্তত চিকিৎসা খানিকটা হবে।
‘নাদাই ব্রিজ ধোবা…বাবু নামবেন তো?’ কন্ডাকটার হাঁকে।
নামলাম। একটা বছর বারো বয়সের ছেলে এগিয়ে আসে তরতর পায়ে, ‘আমার সঙ্গে আসুন। আমাদের বাড়ি যাবেন তো?’
এক্কেবারে দেবেন গোঁসাইয়ের ছাঁচ। টানা টানা চোখ নাক। উজ্জ্বল রং। তাতে একপোঁচ দারিদ্র্যের ম্লানিমা। ‘তুমিই বড় ছেলে বুঝি? এত রোগা কেন?’
ছেলেটি জবাব দেয় না। তরতরিয়ে হাঁটে আগে আগে। কালো ইজের। ময়লা গেঞ্জি। মাথায় চাদর জড়ানো। গমক্ষেত পেরিয়ে, আলু ক্ষেতের পাশ দিয়ে পায়ে চলা পথ। ছেলেটা বেশি কথা বলে না। হাঁ হুঁ দিয়ে চালায়। আমার প্রশ্ন তা বলে থামে না। ‘হ্যাঁরে, তোর বাবা এখন কালনা কোর্টে যায়?’ ছেলেটা মাথা হেলায়। ‘হ্যাঁরে, তোরা ক ভাই-বোন?’ আঙুল দিয়ে দেখায় পাঁচ। ‘দিদির বিয়ে হয়ে গেছে?’ মাথা নাড়ে। একনাগাড়ে মিনিট দশ হাঁটার পর হঠাৎ বলে, ‘ওই আমাদের বাড়ি।’ বলেই একদৌড়ে আমাকে ছেড়ে পালায় বাড়ির দিকে। একখানা মেটে ঘর, তাতে ভাঙা টালির ছাউনি। একটুখানি উঠোন। সন্ধ্যামণি আর গাঁদা ফুলের গাছ। ততক্ষণে আমার আসার সংবাদ পৌঁছে গেছে।
নিচু চালা। মানুষজনের পা দেখা যাচ্ছে। ‘কই দেবেনবাবু কই?’ হাঁক ছাড়ি। ছেলেটা জলের গাড়ু গামছা নিয়ে চট করে নেমে আসে, ‘পা ধুয়ে নিন।’ অপাঙ্গে দেখছি হতশ্রী দরিদ্র এক অপরিকল্পিত পরিবার। ধূলিধূসর দুটো রোগা ছেলে, দুটো মেয়ে আমাকে অবাক চোখে দেখছে। ময়লা শাড়ি পরা এক নতনেত্র মহিলা, নিশ্চয়ই দেবেন গোঁসাইয়ের স্ত্রী, নিচু হয়ে মেটে দাওয়ায় আমার জন্যে আসন পাতছেন। কিন্তু দেবেনবাবু কই? অস্বস্তি চাপতে না পেরে বলি: কোথায় গেলেন দেবেনবাবু?
সামনের সবচেয়ে ছোট্ট ছেলেটি বলে উঠল, ‘বাবা মরে গেছে।’
: সে কী? কবে? কী ভাবে? এই যে পরশু তাঁর চিঠি পেলাম?
অঝোর কান্নায় ঢলে পড়ল আমার পায়ে এক অসহায় স্ত্রীলোক। তারপরে চোখ মুছে বলল, ‘উনি দেহ রেখেছেন কার্তিক মাসে। টি. বি. হয়েছিল তিন বচ্ছর, চিকিচ্ছে করাননি। অপরাধ নেবেন না বাবা। চিঠিখানা আমিই লিখিয়েছি ধম্মো ভাইকে দিয়ে।’ একটু থেমে বলল, ‘মরণের খবরটা আপনাকে দিইনি, তা হলে তো আসতেন না। বাবা, আমরা বড্ড গরিব অসহায়। টাকাটা পাব তো? সব খাতা নিয়ে যান।’
এখন যখন মাঝে মাঝে কুবির গোঁসাইয়ের গানের খাতা খুলি, মনে পড়ে ভেঙে পড়া দীনদয়ালের ঘর, ক্ষীয়মাণ এক ধর্মসম্প্রদায়ের করুণ আত্মনিঃশেষ। যখন যাদুবিন্দুর গান পড়ি তখন চোখের সামনে ভাসে বেহুঁশ জ্বরে আরক্ত দেবেন গোঁসাইয়ের ম্লান মুখ আর সেই সঙ্গে নারীকণ্ঠে কানে বাজে; ‘মরণের খবরটা আপনাকে দিইনি, তা হলে তো আসতেন না।’ খুব সত্যি কথা।
*
এবারে একেবারে আলাদা রকমের ব্যাপার। উনিশ শতাব্দীর মাঝামাঝি একটা সময়। আশ্বিন মাসে পিতৃপুরুষের নামে তর্পণ করছেন ব্রাহ্মণরা। জায়গাটা হল অবিভক্ত বাংলার মেহেরপুরের ভৈরব নদী। অঞ্জলি ভরে নদীর জল নিয়ে পবিত্র মন্ত্র উচ্চারণ করে ব্রাহ্মণরা ভক্তিনতচিত্তে পিতৃপুরুষের ধ্যান করতে করতে হঠাৎ দেখেন অনতিদূরে বুকজলে দাঁড়িয়ে একজন অন্ত্যজ মানুষ তর্পণ করছে। ভাল করে নিরিখ করে তাঁরা চিনতে পারলেন মালোপাড়ার বলরাম হাড়িকে। কী স্পর্ধা! গলায় পরিহাসের সুর মিলিয়ে একজন বলে উঠলেন: কী রে বলা, তোরাও কি আজকাল আমাদের মতো পিতৃতর্পণ করচিস্ নাকি?
কিছুমাত্র কুণ্ঠিত না হয়ে বলা হাড়ি জবাব দিলে: আজ্ঞে না ঠাকুরমশাই, আমি আমার শাকের ক্ষেতে জলসেচ করচি।
বিস্মিত ব্রাহ্মণ বললেন: বলিস কী? এখানকার জল তোর জমিতে যাচ্ছে কী করে? আকাশ দিয়ে নাকি?
বলরামের সপ্রতিভ জবাব: আপনাদের তর্পণের জল কী করে পিতৃপুরুষের কাছে যাচ্ছে আজ্ঞে? আকাশ দিয়ে? বুঝলেন ঠাকুরমশায়, আপনাদের জল যেমন করে পিতৃপুরুষরা পাচ্ছেন আমার জলও তেমনি করে জমিনে যাচ্ছে।
মুহূর্তে আবহাওয়া থমথমে। অপমানিত ব্রাহ্মণরা বলরামের দিকে বিষদৃষ্টি হেনে চলে গেলেন। ছোটলোকের এত বড় আস্পর্ধা? ব্যঙ্গের হাসিতে দর্পিত মুখখানা ভরিয়ে বলরাম হাড়িও বাড়ির পথ ধরল।
কে এই বলরাম? কেন তার এহেন প্রতিবাদ? উচ্চবর্ণের প্রতি কীসের তার এত ক্রোধ?
উনিশ শতকের নদীয়া জেলার মেহেরপুর। ছোট শহরের পশ্চিমদিকে অন্ত্যজ শ্রেণীর বসবাস। সেখানে মালোপাড়ায় জন্মেছিল বলরাম ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে। বাবা গোবিন্দ হাড়ি, মা গৌরমণি। সেকালে হাড়িদের জীবিকা ছিল শুয়োর চরানো, গাছগাছড়ার ওষুধ বিক্রি, লাঠিয়ালগিরি কিংবা বড়লোকের দারোয়ানি। বলরাম ছিল মেহেরপুরের বিখ্যাত ধনী পদ্মলোচন মল্লিকের দারোয়ান। বেশ কেটে যাচ্ছিল দিন। হঠাৎ একরাতে মল্লিকদের গৃহদেবতার সমস্ত অলংকার গেল চুরি হয়ে। সন্দেহ পড়ল বলরামের ওপর। তাকে গাছে বেঁধে প্রচণ্ড প্রহার চলল। শেষপর্যন্ত সকলের পরামর্শে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল তাকে। এই ঘটনায় বৈরাগ্য এসে গেল বলার মনে। ছিঃ এত নিচু মানুষের মন? নিচু জাতি বলে বড়লোকদের এত ঘেন্না? সহসা তার মধ্যে জন্ম নিল এক প্রতিবাদী মানুষ। এই অসহায় জীবন, সমাজের এই অন্যায়, বিশ্বাসের এই স্খলন তাকে টলিয়ে দিল।
বেশ কবছর পরে আবার যখন মেহেরপুরে ফিরে এল বলরাম তখন একেবারে অন্য মানুষ। জটাজূটসমাযুক্ত, সাত্ত্বিক চেহারার সাধকের মধ্যে কোথায় সেই পুরনো ‘বলা’? ভৈরব নদীর ধারে তৈরি করল আসন। ইতিমধ্যে অলংকার চোর ধরা পড়েছিল। তাই অনুতপ্ত মল্লিকমশাই দিলেন জমি আর অর্থ। গড়ে উঠল মন্দির। তারপরে দলে দলে দীর্ঘদিনের ব্রাহ্মণশোষিত অন্ত্যজ মানুষ—কৈবর্ত, বেদে, বাগদি, নমঃশূদ্ররা এসে বলরামের কাছে শরণ নিল। বলরাম হল তাদের পরিত্রাতা। তৈরি হল এক নতুন ধর্মমত আর বিশ্বাস। চলতি কথায় তাকে বলে ‘বলা হাড়ির মত’। দেখতে দেখতে বিশ হাজার ভক্তশিষ্য জমে গেল। বলরামের সাধনসঙ্গিনী হল ব্রহ্ম মালোনী।
একশো বছরেরও আগে লেখা অক্ষয়কুমার দত্তের ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ বইয়ে হাড়ি সম্প্রদায় সম্পর্কে অনেকটা খবর মেলে। তার চেয়ে বেশি খবর আছে পণ্ডিত যোগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের লেখা ‘Hindu Castes and Sects’ বইতে। তিনি ১৮৯২-এ মেহেরপুর গিয়ে বলরামের বিধবা স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে নানা কথা বলেছিলেন। বলরামের স্ত্রী প্রথমেই যোগেন্দ্রনাথকে তাঁর জাতি পরিচয় দিতে বলেন। তাদের ব্রাহ্মণ-বিদ্বেষের কথা আগেই জানা ছিল বলে যোগেন্দ্রনাথ বলেন, তিনি মানুষ। তখন মহিলা তাকে বসতে বলে এবং এমনকী জাতে হাড়ি হয়েও অন্নগ্রহণে আহ্বান করে। বিস্মিত যোগেন্দ্রনাথ অবশ্য তাতে রাজি হন না, তবে মুগ্ধ হন সেই অশিক্ষিত মহিলার অনর্গল বাক্পটুতায় ও নেতৃত্বে। তাঁর মতে বলরামী সম্প্রদায়ের কোনও বিশেষ ধর্মীয় চিহ্ন বা বেশবাস ছিল না। তাদের অনেকে ছিল ভিক্ষাজীবী। আর একটা জিনিস তিনি লক্ষ করেছিলেন, তারা কখনওই কোনও ঠাকুর দেবতার নাম উচ্চারণ করে না। তবে সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এই ধর্মের, যা তাঁর মনে হয়েছিল, তা হল, ব্রাহ্মণবিদ্বেষ। ব্যাপারটা তিনি এইভাবে লিখেছেন:
Bala Hari…in his youth employed as a watchman in the service of local family of zeminders, and being very cruelly treated for alleged neglect of duty he severed his connection with them. After wandering about for some years, he set himself up as a religious teacher, and attracted round him more than twenty thousand desciples. The most important feature of his cult was the hatred that he taught his followers to entertain towards Brahmans. He was quite illiterate but he had a power of inventing puns by which he could astonish his audience whenever he talked or debated.
বলরামের বাক্শক্তি ও শব্দশ্লেষের যে উল্লেখ যোগেন্দ্রনাথ করেছেন তার কিছু ছাপা নমুনা পাওয়া গেছে পুরনো বই থেকে যেমন—
১. রাধুনি নেই তো রাঁধলে কে? রান্না নেই তো খেলেন কি?
যে রাঁধলে সেই খেলে এই দুনিয়ার ভেল্কি।
২. যেয়েও আছে থেকেও নাই
তেমনই তুমি আর আমি রে
আমরা মরে বেঁচে বেঁচে মরি।
৩. তিনি তাই তুমি যাই
যা তিনি তাই তুমি।
৪. যম বেটা ভাই দুমুখো থলি তাই জন্যে ওর আঁৎটা খালি
ও কেবল খাচ্ছে খাচ্ছে
ওর পেটে কি কিছু থাকচে থাকচে থাকচে?
৫. চক্ষু মেলিলে সকল পাই চক্ষু মুদিলে কিছুই নাই
দিনে সৃষ্টি রেতে লয় নিরন্তর ইহাই হয়।
বলরাম প্রতিভাবান ব্যক্তি ছিলেন সন্দেহ কী? কিন্তু নিছক ব্রাহ্মণ্যবিদ্বেষের জন্য তিনি একটা ধর্মবিশ্বাস সৃষ্টি করেছিলেন এ কথা ঠিক নয়। আসলে আঠারো শতকের শেষের দিকে এদেশের সাধারণ শূদ্রজাতি নানা কারণে অসহায় হয়ে পড়েছিল। তাদের জীবনে কোনও সামাজিক নিরাপত্তা ও নিশ্চিন্ততা ছিল না। ফলে যে কোনও সময়ে নেমে আসত উচ্চবর্ণের দমনপীড়ন বা ফতোয়া। যেমন বলরামকে করতে হয়েছিল গ্রামত্যাগ। কল্যাণীর রামশরণ পাল, কুষ্টিয়ার লালন শাহ, হুদোর চরণ পাল, ভাগা গ্রামের খুশি বিশ্বাস, মেহেরপুরের বলরাম হাড়ি এঁরা সকলেই উচ্চবর্ণের ভ্রুকুটির বাইরে সাধারণ ব্রাত্যজনের বাঁচবার জন্য একটা জায়গা তৈরি করতে চেয়েছিলেন। নিছক প্রতিবাদ নয়, টিকে থাকাও। সংকীর্ণ শাস্ত্র ব্যাখ্যা করে বাঁচা নয়, উদার মানবতা নিয়ে সহজ করে বাঁচা। তাই মূর্তিপূজা, অপদেবতা পূজা, অকারণ তীর্থভ্রমণ, দেবদ্বিজে বিশ্বাস, শাস্ত্র নির্ভরতা ও আচার সর্বস্বতার বিরুদ্ধে এঁদের অস্ত্র ছিল জাতিভেদহীন সমন্বয় এবং নতুন মানবতাবাদী সহজ ধর্মাচরণ। কিন্তু কর্তাভজা সাহেবধনীরা অবতারতত্ত্ব মানেন। বলরাম সেটাও মানেননি। তিনি যুগলভজনও মানেননি। বলরাম ছিলেন বৈষ্ণবতারও বিরোধী। এখানেই বলা হাড়ির অভিনবত্ব।
কিন্তু বলরাম কী বলতে চেয়েছিলেন তাঁর ধর্মমতে? তিনি অবতারতত্ত্ব না মেনে নিজেকে বলেছিলেন: ‘হাড়িরাম’। হাড়ি বলতে তিনি কোনও জাতি বোঝাননি। তাঁর ব্যাখ্যা ছিল, যিনি হাড়ের স্রষ্টা তিনিই হাড়ি। হাড় মানে স্ট্রাকচার, তাতে চামড়ার ছাউনি। ভেতরে বল অর্থাৎ রক্ত। এই হল মানবদেহ। তার মধ্যে হাড্ডি, মণি, মগজ, গোস্ত, পোস্ত। সব মিলিয়ে আঠারো মোকাম।
‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ বইতে বলরামী সম্পর্কে এক বিচিত্র প্রশ্নোত্তর পাওয়া যায় বলরামের জবানিতে। তা এইরকম:
প্রশ্ন: পৃথিবী কোথা থেকে এলো?
উত্তর: ক্ষয় হতে।
প্রশ্ন: ক্ষয় থেকে কিরূপে?
উত্তর: আদিকালে কিছুই ছিল না। আমি আমার শরীরের ‘ক্ষয়’ করে এই পৃথিবী সৃষ্টি করি সেইজন্য এর নাম ক্ষিতি। ক্ষয় ক্ষিতি ও ক্ষেত্র একই পদার্থ। আমি কৃতদার গড়নদার হাড়ি। অর্থাৎ যে ব্যক্তি ঘর প্রস্তুত করে সে যেমন ঘরামী সেইরূপ আমি হাড়ের সৃষ্টি করিয়াছি বলিয়া আমার নাম হাড়ি।
হাড়িরাম তত্ত্ব শুনতে যতই অদ্ভুত লাগুক এর ভেতরের মৌলিক চিন্তার রহস্যটুকু খুব চিত্তাকর্ষক।
১৯৭১-এ স্বাধীন বাংলাদেশ জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গে আমি মেহেরপুর যাই বলরামী তত্ত্বের খোঁজে। এতদিন সে দেশ পাকিস্তান থাকায় আমার কৌতুহল মেটাতে হচ্ছিল পুঁথির পাতা থেকে। অবশেষে সেই ভৈরব নদীর ধারের মেহেরপুর গিয়ে সেই মল্লিকবাড়ি দেখে, মালোপাড়ায় বলরামের মন্দিরের সামনে বসি। সম্প্রদায়ের লোক এখনও আছে কিছু। বৃন্দাবন এখনও নিত্য সেবাপূজা করে হাড়িরামের। তাদের এখনকার নেতা বা ‘সরকার’ আমাকে বোঝাতে লাগলেন: শুনুন আজ্ঞে, আমাদের বিশ্বাসে বলছে—
হাড় হাড্ডি মণি মগজ গোস্ত পোস্ত গোড়তালি।
এই আঠারো মোকাম ছেপে আছেন আমার বলরামচন্দ্র হাড়ি ॥
আমি জিজ্ঞেস করলাম: আপনাদের এই আঠারোর তত্ত্বটা কী?
: আজ্ঞে গুণে ন্যান। মানবদেহ গড়ে উঠেছে একুনে আঠারোটা পদার্থ নিয়ে। তার মধ্যে কারিগরের দেওয়া দশ পদার্থ, যেমন দুই নাক, দুই কান, দুই চোখ এই ছয়—আর মুখ, এক নাভি, এক পায়ু, এক উপস্থ এই হল দশ। এবার শুনুন পিতা দেন চার পদার্থ— হাড়, হাড্ডি (মানে মজ্জা) মণি (মানে বীর্য) আর মগজ। আর জননী দেন চার পদার্থ— কেশ, ত্বক, রক্ত আর মাংস। এই হল আঠারো মোকাম। আর এই সব ছাপিয়ে রয়েছেন আমাদের হাড়িরাম।
: হাড়িরাম কি কারুর অবতার?
: তিনি বলে গেছেন, সত্য ত্রেতা দ্বাপর কলি এই চার যুগের আগে ছিল দিব্যযুগ। সেই সময়ে তেনার জন্ম। তার মানে সব অবতারের আগে তিনি। আমাদের সদানন্দের গানে বলছে—
দিব্যযুগে যে হাড়িরাম
মেহেরপুরে তার নিত্যধাম ॥
লক্ষ করলাম, বলা হাড়ি ত্রেতাযুগের রামচন্দ্র বা দ্বাপরের বলরামের অবতার বলে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেননি। নিজেকে বসিয়েছেন এ সবের ঊর্ধ্বে। নিজের নাম দিয়েছেন ‘রামদীন’। রামদীন মানে কী?
বৃন্দাবন গাইতে লাগল:
‘রা’ শব্দে পৃথিবী বোঝায়
‘ম’ শব্দে জীবের আশ্রয়।
‘দীন’ শব্দে দীপ্তাকার হয়
নামটি স্মরণ করলে তার॥
জানতে চাই বলরামীরা কার পুজো করে। কাউকে তো তারা ডাকে? উপাস্য তো কেউ আছে? সে কে?
বৃন্দাবন বলে: আমরা কোনও ঠাকুর দেবতা, কোনও মূর্তি বা ছবি কি কোনও ঢিবি বা গাছকে পূজি না আজ্ঞে। আমরা কাউকে প্রণাম করিনে। আমরা শুধু রামদীনকে ডাকি। তিনিই তো কারিকর। সদানন্দ নিকেছে—
হাড়িরামতত্ত্ব নিগূঢ় অর্থ বেদবেদান্ত ছাড়া।
করে সর্ব ধর্ম পরিত্যাজ্য সেই পেয়েছে ধরা।
এই তত্ত্ব জেনে শিব শ্মশানবাসী।
এই তত্ত্ব জেনে শচীর গোরা নিমাই সন্ন্যাসী ॥
যেন অলীক সব কথাবার্তা। কিমাকার সব বিশ্বাস। দেখতে দেখতে সূর্য ঢলে পড়ে বলরামের মন্দিরের পশ্চিমে। আমার চোখে পড়ে মন্দিরের একটা সিল্যুট। চারিদিকে ভক্ত নরনারী। তাদের চোখে মুখে স্থির বিশ্বাসের দৃষ্টি। গর্বোজ্জ্বল মুগ্ধতা। মেহেরপুরের জনসমাজের একেবারে পরিত্যক্ত অংশে এই মালোপাড়া। গাছগাছালির জঙ্গল আর মরা গরিবদের ভাঙা বাড়ির হতশ্রী। তার মধ্যে দাঁড়িয়ে বৃন্দাবন হেঁকে বলতে লাগল: আপনারা যাদের ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর বলেন, তেনাদেরও সৃষ্টি হাড়িরাম হতে।
: বলো কী? কীভাবে তা হল?
: দেখুন, আমরা বিশ্বাস করি যে হাড়িরামের হাই হতেই হৈমবতীর সৃষ্টি। সেই হৈমবতী হতেই ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর। ঠিক কিনা বলুন?
ভৈরব তীরে রাত নামল। মনে মনে প্রণতি জানিয়ে বিদায় নিলাম হাড়িরামের মন্দির চত্বর থেকে। মনে বিস্ময় আর সন্ত্রম। বৃন্দাবনকে জিজ্ঞেস করলাম: হাড়িরাম সম্পর্কে আরও অনেক কথা জানতে ইচ্ছে করছে। আর কোথায় যাব?
হতাশ ভঙ্গিতে বৃন্দাবন বললে: দেশ ভাগ হয়ে কে কোথায় ছিটকে পড়েছে আজ্ঞে। তবে আপনাদের ওপারে নদীয়া জেলার তেহট্ট থানার নিশ্চিন্তপুরে যদি যান তবে অনেক খবর পাবেন। সেখানে সিদ্ধপীঠ বেলতলায় হাড়িরামের খড়ম জোড়া আছে। তাতে নিত্য তেলজল দেয় রাধারাণী। তাকে গিয়ে আমার কথা বলবেন। বলবেন, মেহেরপুরের বেন্দাবন পেটিয়েছে আপনারে। আর ওই নিশ্চিনপুরেই আছে পূর্ণ হালদার, বিপ্রদাস হালদার। দুজনেই বুড়ো হয়েছে। তবে বিপ্র ডাঁটো আছে এখনও। হাড়িরামের অনেক গান সে জানে। শুনে নেবেন। তা ছাড়া ধা’পাড়ায় আছে আমাদের এখানকার ‘সরকার’ চারু। সাহেবনগরে আছে ফণী দরবেশ। বাবু, যাবেন কিন্তু অবশ্যই।
*
পাঠকদের নিশ্চিন্তপুরে নিয়ে গিয়ে বলরামীদের মুখোমুখি করার আগে বরং হাজির করা যাক আরও কয়েকটা জরুরি অনুষঙ্গ। মানুষজন ব্যাপারটি কী? মেহেরপুরের সঙ্গে নিশ্চিন্তপুরের যোগাযোগ হল কবে, কেমন করে? বলরামীদের সাধনা কী ধরনের?
আর পাঁচটা উপাসক সম্প্রদায়ের সঙ্গে বলরামীদের খুব একটা মিল নেই। গুরুবাদে এরা বিশ্বাসী নয়, কাজেই মন্ত্রদীক্ষা বা শিক্ষা নেই। সহজিয়া বৈষ্ণবদের মতো প্রবর্ত-সাধক-সিদ্ধ এসব স্তরপরম্পরার সাধনমার্গ এদের নেই। বেশির ভাগ লৌকিক সাধনার যা সামান্য লক্ষণ, অর্থাৎ নারীসঙ্গী নিয়ে কায়াসাধন তা এরা করে না। তাই এ ধর্মে বিকৃতি কম। গুরুবাদ নেই বলে ভক্তের উপর শোষণ কম। এদের ধর্মের আচরণবিধি খুব সহজ সরল। সম্প্রদায়ে উচ্চবর্ণের কেউ নেই। একেবারে নিম্নবর্ণের হিন্দু, অন্ত্যজ ব্রাত্য সব মানুষ আর কিছু দলছুট মুসলমান এদের দলের অংশীদার। মুসলমান থেকে বলরামী হয়েছে যারা, তারা হাড়িরামকে বলে হাড়িআল্লা। এদের মুরুব্বিদের অত্যাচার নেই, উচ্চবর্ণ, গুরু নেই। তাই গদি নেই, খাজনা নেই, মন্ত্রতন্ত্রের অভিচার নেই, আখড়া নেই, আসন নেই। আসন মোট দু’জায়গায়। এ বাংলায় নিশ্চিন্তপুর, ও বাংলায় মেহেরপুর। আলখাল্লা, জপমালা, তসবি বা খেলকা এদের নেই।
আসলে বলরামীরা মানুষভজনে বিশ্বাসী। মানুষ, তাদের মতে, কারিকর হাড়িরামের সৃষ্টি। ঈশ্বরের নয়। সংসারে থেকে এ ধর্মের সাধনা করতে হয়। এরা মনে করে, হাড়িরাম যেমন আঠারো তত্ত্ব দিয়ে মানবদেহ গঠন করেছেন, তেমনই সেই দেহ চালাচ্ছেন তিনি। একটা গানে বলছে:
হাড়িরাম কলমিস্তিরি হেকমতে চালাচ্ছে এ কল।
আর একটি গানে রয়েছে:
হাড়িরাম মানবদেহ বানিয়েছে এক আজব কল।
বলের সৃষ্টি বলে করায় মন আমার
বল বিনে চলবে না কল।
এখানে ‘বল্’ মানে রক্ত।
যদিও এরা অবতারবাদে বিশ্বাসী নয়, তবু সম্ভবত বৈষ্ণব ভাবাপন্নদের মনে প্রতীতি আনার জন্য তারা বলে: ‘নবদ্বীপে এসে ছিন্নবেশে কেঁদে গেল শচীর গোরা’ এবং তারই পরিপূরকভাবে কলিকালে মেহেরপুরে পূর্ণমানুষ দ্যাখ সে তোরা।’ আবার মুসলমানদের মনে হাড়িরাম সম্পর্কে প্রতীতি আনতে গায়
অসম্ভবে কথা শুনে লাগলো জীবের দিশে।
আল্লাতালা মেহেরাজে মানুষরূপে আসে ॥
কিন্তু কেন এই ব্যক্তিভজন? কেন এমন করে একজন মানুষকে দাঁড় করাবার চেষ্টা?
আসলে বাঙালির লৌকিক ধর্মসাধনার দুই রূপ; অনুমান আর বর্তমান। লৌকিক সাধক বলেন: রাধা-কৃষ্ণ-বৃন্দাবন-মথুরা-কুব্জা-কংস-চন্দ্রাবলী এ সব কল্পনায় অনুমান করে যে সাধনা তাকে বলে অনুমানের সাধনা। আর বর্তমানের সাধনা হল মানবদেহ নিয়ে। সেই দেহেই আছে বৃন্দাবন, সেখানেই মান-বিরহ-বিপ্রলম্ভ-শৃঙ্গার। মন্ত্রদীক্ষা নিয়ে গুরুর নির্দেশিত পথে দেহতত্ত্বের মধ্যে দিয়ে যুগলভজনে যে ঐশী উপলব্ধি সেটাই সঠিক পথ।
বলরামীদের সাধনা আবার ওই অনুমান-বর্তমানেরও বাইরে আরেক রকমের। ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে সাহেবনগরের ফণী দরবেশ আমাকে বলেছিলেন: ও সব রাধাকৃষ্ণ দুর্গাকালী আমরা ভজি না। আমরা বলি—‘যাহা দেখি নি নয়নে/তাহা ভজিব কেমনে?’ তাই আমরা হাড়িরামকে ডাকি। তাঁরই জন্যে কাঁদি। মানুষটা তো আমাদের জন্যেই মানুষরূপে জন্ম নিয়েছিল, না কি বলেন বাবু?
কিন্তু মেহেরপুরের সঙ্গে তেহট্টের নিশ্চিনপুরের যোগাযোগ ঘটল কেমন করে? আসলে আগেকার দিনে নদীয়া যখন ভাগ হয়নি তখন মেহেরপুর ছিল একটা মহকুমা শহর। আশপাশের গ্রামগঞ্জ থেকে কেনা বেচা বা মামলা মকদ্দমার কাজে মেহেরপুর আসত মানুষজন। এই রকম কোনও কাজে নিশ্চিনপুরের তনু মণ্ডল সেখানে এসেছিল একবার। নেহাতই দৈবঘটনায় তার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় বলরামের। বলরামের বাক্পটুতা, ঐশীক্ষমতা আর ব্যক্তিত্বে আকৃষ্ট হয়ে তনু তাঁর শিষ্যত্ব নেয়। এই তনু থেকেই নিশ্চিনপুরে বলরাম-ভজনার শুরু। আস্তে আস্তে ওই গাঁয়ের মৎস্যজীবী নমঃশূদ্ররা বলরামভজা হয়ে ওঠে। তনুর নির্বন্ধে মেহেরপুর থেকে হাঁটাপথে বলরাম বোধহয় নিশ্চিনপুরে আসেনও কবার। সেখানে তাঁর কাছে সরাসরি দীক্ষা নেয় মহীন্দর, রামচন্দ্র দাস, জলধর, সদানন্দ, শ্ৰীমন্ত আর রাজু ফকির। মেয়েদের মধ্যে দীক্ষা নেয় নটু, দক্ষ আর জগো। দেখতে দেখতে ধরমপুর, সাহেবনগর, আরশিগঞ্জ, নাটনা, ধা’পাড়া, হাউলিয়া, গরিবপুর, পলাশীপাড়ায় ছড়িয়ে পড়ে বলা হাড়ির মত।
এরা নিজেদের প্রচ্ছন্ন রেখে ধর্মসাধনা করত। কেননা সমাজে এরা ছিল অন্তেবাসী আর মরা গরিব। তা ছাড়া বৈষ্ণব আর সহজিয়ারা বলরামীদের দেখত খারাপ চোখে। বলরাম ভজন ব্যাপারটা তাদের বরদাস্ত হত না, কেননা তারা ছিল অবতারবাদী। কুবির গোঁসাই তাঁর গানে লিখেছেন: ‘বলরামের চেলার মতো/ কৃষ্ণকথা লাগে তেতো।’ বোঝাই যাচ্ছে, সাহেবধনীরা বলরামীদের খাতির করত না।
অবশ্য তাতে বলরামের কিছু এসে যায় নি। তাঁর জীবিতকালেই তো সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাঁর মতাদর্শ। তাঁকে সবাই বলত ‘বাচক’। তার মানে তাঁর ছিল অসাধারণ বাকচাতুর্য এবং জগৎ ও জীবনের নানা বিষয়ের তিনি নিগূঢ় ব্যাখ্যা করতে পারতেন। সমস্ত শিষ্যকে সম্মিলিত করে তিনি বছরে তিনবার মহোৎসব করতেন। চৈত্র একাদশীতে বারুণী, জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তি আর কার্তিকী একাদশী। তার মধ্যে বারুণীতে জাঁক হত বেশি। শিষ্যরা বলরামকে দোলমঞ্চে বসিয়ে আবির খেলত। ১২৯৭ বঙ্গাব্দে ৩০ অগ্রহায়ণ (১৮৯০) বলরাম মারা যান পঁয়ষট্টি বছর বয়সে। তাঁর মৃত্যুর পরও বলরামভজাদের রমরমা কিছুমাত্র কমেনি। কিন্তু দেশবিভাগের ফলে এ সম্প্রদায়ের মানুজন নানাস্থানী হয়ে পড়ে। তবু নিশ্চিন্তপুরে এখনও এদের বড় ঘাঁটি। সেখানে পালাপার্বণ আর বেলতলার নিত্যপূজা একভাবেই চলছে। সে গ্রামে অনেক মানুষই বলরামভজা।
এ সব খবর আমি আগেই জোগাড় করে নিই সাহেবনগরের ফণী দরবেশের কাছে। মানুষটা বড় নরম। শুধু একগাদা সন্তান হয়ে একেবারে মুষড়ে পড়েছে। কেবলই খেদ করে আর বলে, ‘কারিকর এ আমার তুমি কী করলে!’
ফণী দরবেশ আমাকে ঠেলে পাঠাল নিশ্চিন্তপরের দিকে।
১ নম্বর তেহট্ট ব্লকের অন্তর্গত ৫২ নম্বর মৌজা, পোশাকি নাম নিশ্চিন্তপুর। লোকের মুখে মুখে দাঁড়িয়েছে নিশ্চিনপুর। খুব নিশ্চিন্ত জায়গা অবশ্য নয় প্রশাসনের পক্ষে। গ্রামে ঢোকার আগে ব্লক আপিসের একজন বললেন: খুব সাবধানে ঘোরাফেরা করবেন। এককালে গ্রামটা ছিল টেরর। ডাকাতে ভর্তি। ও আপনার যতই বলরামী-ফলরামী হোক, সাবধানের মার নেই।
আমি অবশ্য অকুতোভয়ে গ্রামে ঢুকলাম। মনে মনে জপতে লাগলাম: মেহেরপুরের বেন্দাবন আমাকে পাঠাচ্ছে ভক্ত্যা রাধারাণী সকাশে। আমার তা হলে ভয় কোথায়?
*
মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে পাটকেবাড়ির বাস এক পাকুড়গাছ তলায় দম ছাড়ল। কনডাক্টর হাঁক পাড়ল: নেমে পড়ুন—নিশ্চিনপুর।
অন্তত আধঘণ্টা মেঠো পথে হেঁটে তবে গ্রাম। হদিশ নিয়ে প্রথমে গেলাম বেলতলায় রাধারাণীর কাছে। পরিচয় পেয়ে সে সমাদর করে বসাল। সত্যিই দেখবার মতো বিশাল বেলগাছ। তার একটা বড় ডাল ঝুলে পড়েছে। একেবারে পড়ো-পড়ো। তাই ইটের গাঁথনি দিয়ে ডালটাকে ঠেকিয়েছে। আদ্যিকালের লক্ষণযুক্ত বেলগাছ। এখানে হাড়িরাম এসেছেন কত! তাই পবিত্র। গাছের গুঁড়ির কাছে ভক্তিভরে রাখা আছে হাড়িরামের একজোড়া খড়ম। রাধারাণী এগিয়ে এসে বলল: কী দেখচো ছেলে, হাড়িরামের ছিচরণের খড়মজোড়া? দ্যাখো ভক্তি করে। রোজ বেলা বারোটায় এই খড়মজোড়া তেলে জলে ছ্যান করাতে হয়। সরকারের সেইরকম হুকুম।
: সরকার মানে গভরমেন্ট?
: না গো ছেলে। সরকার আমাদের প্রধান। ধা’পাড়ায় থাকেন। চারুপদ নাম।
: তা খড়মজোড়া স্নান কে করায়?
: আমিই করি? তেনার সেবাপুজোর ভার এখন আমাতেই বত্তেছে। আমি চোপর দিন রাত এখানেই থাকি। আমার ভাগ্য।
: হাড়িরামের ভোগরাগ কী দিয়ে হয়?
: ওঁর সেবায় সেদ্ধপক্ক ভোগ চলে না। শুধু কাঁচাভোগ। মুগের ডাল ভেজানো, ফল আর আখের বা খেজুরের গুড়। দোকানের পাক দেওয়া সন্দেশ রসগোল্লা চলে না।
: পুজোর বা ভোগরাগ নিবেদনের কোনও নিয়ম বা মন্ত্র আছে?
: ভোগরাগ এই বেলতলায় রেখে দুটো ফুল ফেলে তাঁর নাম করতে হয়। তিনি সেবা করেন। আর যখন চালজল সেবা দিই তখন বলতে হয়—
হক্ হাড়িরামচন্দ্র তোমাকে চালজল দিলাম
সেবা করুন আপনি।
জাতিতত্ত্ব ভাৰসত্য তোমা হতেই শুনি।
তোমায় ভাবি ধ্যানে জ্ঞানে আমার আর কোনও বাঞ্ছা নাই।
পলকে পলকে হাড়িরামচন্দ্র যেন তোমার দেখা পাই।
: হাড়িরামের মহোৎসব কোনখানে হয়?
: এখানেই। এই বেলতলাতেই সব। চত্তির মাসের একাদশী, জষ্টি মাসের সংক্রান্তি আর কাত্তিক মাসের একাদশী—এই তিনবার মচ্ছব। তা ছাড়া সঙ্কল্প, মানসিক সব এখানে। এখানেই তিনি থাকেন। কিন্তু এখন জষ্টিমাসের এই কাঠবেলায় বাছা তুমি অত বক বক কোরো না দিকিনি। তুমি ওই টিউকলের জলে মুখখান ধুয়ে বসুন। একটু তেনার পেসাদ সেবা হোক। কাঁচাভোগ।
ভক্তি ভরে রাধারাণী আমার হাতে তুলে দেয় এক খামচা টাটকা আখের গুড় আর পেতলের ঘটিতে ঠাণ্ডা জল। গরিব মানুষের দীন আয়োজনেও পূর্ণতার স্বাদ মেলে। পথক্লান্ত শরীর নিমেষে ঠাণ্ডা হয়ে মনে নেমে আসে স্নিগ্ধ প্রসন্নতা। বুঝি যে, বলরামীদের বিশ্বাসের ভিত্তিতে রয়েছে সারল্য আন্তরিকতা আর আয়োজনহীন উপচার। যে সব বড় বড় উপাস্যকে পূজার ছলে আড়ম্বরে আমরা ভুলেই থাকি হাড়িরাম তেমন আরাধ্য নন। তিনি নিত্যজীবিত রয়ে গেছেন শ্রান্ত শ্রমজীবী মানুষের প্রতিটি ক্ষণে আর প্রাত্যহিক স্মরণে।
কথাটা আরও স্পষ্ট হল যখন বেলতলা থেকে পৌছলাম বিপ্রদাস হালদারের মেটে দাওয়ায়। ষাট ছুঁই-ছুঁই পেটা চেহারা বিপ্রর। মৎস্যজীবী। ইয়া দুখানা গোঁফ। আমাকে দেখেই হইহই করে হেঁকে উঠল, ‘আরে, আসুন আসুন। আপনি আসবেন সে কথা বি. ডি. ও সায়েব বলে পেটিয়েচে। তবে টাইম তো দ্যায় নি! তাই বেলান্ত পথ চেয়ে বসে আছি। বেলতলায় গিয়েলেন বুঝি। জয় হাড়িরামচন্দ্র। সবই তাঁর হেকমতের খেল। তা আমাদের ঘরে সেবা নেবেন তো দুপুর বেলা?’
সম্মতি জানাতেই আরেকবার হুংকার দিল: জয় হাড়িরামচন্দ্র। তিনি ব্রাহ্মণকেও সদবুদ্ধি দ্যান। ওরে কাঞ্চন বিটি, এ বাবুকে গামছা ঘটি দে। গরিবের ঘরের মুড়ি চা একটু খাওয়া। ভাত চড়া। আমি ততক্ষণে খ্যাপলা জালটা নিয়ে এই নদী পানে। যদি একটা মাছ মেলে।
আমি বললাম: এত বেলায় কি মাছ মিলবে?
‘সবই কারিকরের ইচ্ছে, তিনি যখন তোমাকে পেটিয়েছেন তখন মাছও পাটাবেন বৈকী’, বলে জাল হাতে এগোল বিপ্রদাস। বাড়ির একটু দূরেই খরস্রোতা নদীর রুপোলি ফালি দেখা যাচ্ছে দাওয়া থেকে। আমি বেশ দেখতে পেলাম বিপ্র নামল নদীর হাঁটুজল ছাড়িয়ে, ছুঁড়ে দিল খ্যাপলা জাল। তারপর জাল টেনে নিরীক্ষণ করে হাত তুলে দিল ওপরে। তার মানে এক খেপেই কেল্লা ফতে। প্রায় ছুটতে ছুটতেই উঠে এল। ধড়ফড় করছে হাতে একখানা পাঁচ-ছশো গ্রাম ওজনের মৃগেল।
আমি দাওয়ায় উঠে দাঁড়িয়ে তাকে অভ্যর্থনা করে বললাম: তুমি তো খুব ওস্তাদ মেছো দেখছি।
বিপ্র তার দাওয়ায় মাছটা রাখল। তারপরে পাকানো গোঁফে চাড়া দিয়ে একগাল হেসে বলল: এতে আমার আর কেরদানি কী আছে? সবই তাঁর হেকমৎ আর আপনার ভাগ্য। আপনি বসুন। আমি সক্কলকে খবর দিই।’ বিপ্র গুনগুন করতে লাগল:
আরে বল হাওয়াতে কইছে কথা
মন আলেকলতা।
দেখতে দেখতে বিপ্রদাসের দাওয়া ভরে উঠল বলরামীদের ভিড়ে। দাওয়ায় জায়গা তার আঁটে না। মুড়ি চা খেতে খেতে আলাপ চলল। সবচেয়ে বয়স্ক ভক্ত পূর্ণ হালদার এসে দণ্ডবৎ করে বসল। খবর পেয়ে গ্রামের ব্রাহ্মণ এক মাস্টারমশাই এসে তাঁর পরিচয় দিয়ে আমন্ত্রণ করলেন তাঁর বাড়ি মধ্যাহ্নভোজের। বাধা দিয়ে বিপ্র বলল, ‘বলেন কী? উনি মেহেরপুর ফেরত লোক, একেবারে খোদ হাড়িরামের অতিথা কারিকর ওঁর জন্যে ইয়া বড় একখানা মাছ পেটিয়েছেন। তা ছাড়া ওঁর আপ্তজ্ঞান হয়েছে। জাত বিচার করেন না।’ বলেই হাত বিপ্র গাইল।
আমার হাড়িরামের চরণ কৃপায় মিলে সব জাতে।
ও তার শুদ্ধ আচার সত্যবিচার দেখলাম সাধুসঙ্গেতে ॥
তব জলে পাক অন্ন ভেদ নাই ছত্তিশ বন্ন
এ সংসারে আর কে পারে হাড়িরাম ভিন্ন?
দারুণ সুরেলা গলা। তালমানের জ্ঞানটুকুও পাকা। অবাক হয়ে বলতেই হল: কথায় কথায় তোমার এখন গান এল কেমন করে? গলাখানাও তো চমৎকার বানিয়েছ!
বিপ্রদাস জিভ কেটে সংশোধন করল, ‘আবার ভুল করলেন বাবুমশাই, সবই কারিকরের খেল। আর গানের কথা বলছেন? সেটা বলার মতো। কী বলো হে তোমরা। আমার বাড়িতে ধানের গোলা নেই বটে, নেতান্ত গরিবগুরবো জেলে, তবে এ আমার গানের গোলাবাড়ি’, একটা বিকট হেসে বিপ্র বলল, ‘চোপর রাত ধরে আমি হাড়িরামের গান গাইব। ও আপনার টেপ রেকর্ডার যন্তরের ফিতে শেষ হয়ে যাবে তবু আমার গান শেষ হবে না। না কি বলল তোমরা!’
সকলে সানন্দে সায় দিল। পূর্ণ হালদার বলল; আর তোর স্মরণশক্তির কথাটা বল।
খুব সায় দিয়ে গোঁফ মুচড়ে বিপ্রদাস বলল: সেটাও কারিকরের অদ্ভুত কৃপা আমার পর। কোনও জিনিস আমার বিস্মরণে নাই। লেখাপড়া বেশি জানি না, এই ফোর পাশ, কিন্তু হাড়িরামের সব তত্ত্ব আর দীন গোষ্ঠ সদানন্দর সব গান আমার অন্তরে লেগে আছে। তবে কতদিন থাকবে জানিনে আর আমি চলে গেলে যে এ সব গান কে গাইবে কে জানে! এ ছোঁড়াগুলোর আসনাই বেশি, নিষ্ঠা কম। দেখি, কারিকর কাকে শেখাতে আদেশ করে। আপাতক তো আপনার যন্তরে বন্দি করা থাক। একটা হদিশ থাকবে। বিকেলে আরশিগঞ্জ থেকে আমাদের আরেক গাহকের আসার কথা। দেখি। যদি আসে। সে ব্যাটা বোধিতনে পড়ে আছে তো? কথা রাখতে পারে না।
: বোধিতন কী? আমি জিজ্ঞেস না করে পারলাম না।
বিপ্র তুড়ি মেরে বলল: জানবেন জানবেন। সবই জানবেন। সে সব হল নিগুঢ় তত্ত্ব— বেদবেদান্ত ছাড়া। কারিকর যখন তোমাকে পেটিয়েছে আর মেহেরপুর যখন ঘুরে এসেছ তখন আপনার অজানিত কিছুই থাকবে না। এখন বসুন দু দণ্ড। স্নান সেবা হোক। ততক্ষণে আমি একটা ডুব দিয়ে বেলতলায় কাঁচাভোগ সেবা দিয়ে আসি।
বাইরে জ্যৈষ্ঠের অসহ্য দাবদাহ, দাওয়ায় বিশ্বাসী ভক্তদের স্নিগ্ধ সমাবেশ। আমার মনের পর্দায় ফিল্মের মতো ঘুরে যাচ্ছে মেহেরপুরের ভৈরব নদীর ধারে বলরামের মন্দিরের রহস্যময় উদ্ভাস—বৃন্দাবনের সরল মুখ আর বিশ্বাসভরা দুখানা আকুল চোখ। ভাবতে আশ্চর্য লাগছিল, দেড়শো বছরেরও আগেকার একজন ক্ষুব্ধ বিদ্রোহী এদের পরিত্রাণের মন্ত্র এনে দিয়েছে। রক্তে দিয়েছে প্রত্যয়। পায়ের তলায় শক্ত মাটি। বেদ বেদান্ত ব্রাহ্মণ শাস্ত্র সব কিছু দলিত মথিত করে গ্রামে গ্রামে এ কোন গুপ্ত প্লাবন? অথচ এরা দীন দরিদ্র দুঃখভারনত। এদের রক্তে সত্যিই ডাকাতির নেশা আছে? এদের পূর্বপুরুষরা কি বেছে বেছে ব্রাহ্মণ আর উচ্চবর্ণের বাড়িতে ডাকাতি করত? সে কি তবে প্রতিশোধ? সবকিছু কেমন অলীক মনে হতে লাগল।
গেজেটিয়ারে দেখেছিলাম নিশ্চিন্তপুর গ্রামের বয়স দেড়শো বছরের বেশি। আগে ও জায়গায় ছিল জঙ্গল। উচ্চবর্ণের অত্যাচারে কিছু শূদ্র এখানে পালিয়ে এসে জঙ্গল কেটে বসত করেছিল। তারপর একদিন সেই অবমানিত মানুষদের মধ্যে বলরাম তুলে ধরেছিলেন বিশ্বাসের ছবি, বাঁচার প্রত্যয়। সে সময়ে দীক্ষাপ্রাপ্ত তনু মহীন্দর রামচন্দ্র জলধর সদানন্দ শ্ৰীমন্ত রাজুরা আজ কোথায়? এদের মধ্যে কি তাদেরই সন্তান সন্ততি? সকলের বংশ কি এখানেই? নাকি তারা দেশান্তরে।
নব্বই বছরের পূর্ণ হালদার নম্রকণ্ঠে বললে: সকলের খবর তো জানা যায় না। তবে তনুর তে বংশ নেই, বিবাহই করেনি। দিনু বাংলাদেশের আমঝুপিতে ছিল। এখনও বংশ আছে। কুঞ্জর নাতি জয়দেব কাছেই ভবানীপুরে থাকে। ধনঞ্জয়ের বংশ আছে পঞ্চকোটিতে। রাজু ফকিরের আশ্রম আছে পলাশীপাড়া ঘাটে। সদানন্দর বংশ আছে পঞ্চকোটিতে। মহীন্দর শ্ৰীমন্ত দক্ষ আর জগো তো হাড়িরামের সঙ্গে মেহেরপুরে চলে গিয়েছিলেন। কী জানি কী হল। তাঁরা তো সব সিদ্ধ মানুষ। কারিকরের সঙ্গে আছেন।
: আচ্ছা, হাড়িরামের শিষ্যদের সম্পর্কে কোনও কিংবদন্তি বা অদ্ভুত গল্প নেই?
: তাঁরা তো সকলেই ছিলেন অদ্ভুত মানুষ। অলৌকিক। কেবল আমাদের শেখাবার জন্যে কারিকরের সঙ্গে মনুষ্যদেহ নিয়েছিলেন। তবে শুনেছি আমাদের নিশ্চিনপুরের শ্ৰীমন্ত হাড়িরামের সেবা করতে করতে একটি অঙ্গ পেয়েছিল। তাঁর জন্মেছিল এক রত্তি লেজ।
: তবে কি সে ছিল হনুমানের অবতার? তোমরা তাই মানো?
: কী করে বলি সে সব নিগূঢ় তত্ত্ব। তবে তিনি ছিলেন আমাদের প্রথম সরকার। তেনা থেকেই আমাদের শাস্তরের উৎপত্তি। তাঁর থেকেই সব শিক্ষা।
: তাঁর পরে কে সরকার হয়েছিলেন? সরকার কীভাবে ঠিক হয়?
: পুরনো সরকার দেহ রাখলে নতুন সরকার ঠিক হয়। শ্রীমন্তের পর কে হন আমরা জানি না। তবে আমার জ্ঞান হবার পর থেকে সাহেবনগরের গোষ্ঠকে সরকার দেখেছি। তাঁর দেহ চলে গেলে আমাদের সরকার এখন ধা’পাড়ার চারু মণ্ডল।
: সরকারের ছেলে বুঝি সরকার হয় না?
: হতে বাধা তো কিছু নেই। সে রকম গুণগরিমা জ্ঞান থাকলে হয়, হতে পারে। বাচক হতে হয়। হাড়িরামতত্ত্ব সকলকে বোঝাবার ক্ষ্যাম্তা চাই। সকলের মান্যমান হওয়া চাই। আর হতে হয় নিত্যনের সাধক। যেমন ধরুন, আমাদের আগেকার সরকার গোষ্ঠর ছেলে ফণী। খুব গুণগরিমাঅলা মানুষ। জ্ঞানবুদ্ধিও পাকা। কিন্তু গোষ্ঠের দেহ রাখার পর তাকে ‘সরকার’ করা গেল না।
: কেন?
: অনেকগুলো সন্তান তার। কোথায় এয়োতন থেকে নিত্যনের সাধনা করবে, তা নয় পড়ে গেল বোধিতনের ফাঁদে।।
: এ সব কথা তো কিছুই বুঝছি না। এয়োতন, নিত্যন বোধিতন…
পূর্ণ গম্ভীর হয়ে বলল, ‘ও সব বুঝবেন বিপ্রদাসের কাছে। এখন একটা গান শোনেন। যদি মর্ম কিছু বোঝেন। কাঁপা গলায় গান ধরল পূর্ণ—
এবার ভক্তিভাবে ভাবো তারে
নইলে উপায় নাইকো আর।
হাড়িরামের চরণ করে সার।
মন আমার বোধিতনে থাকলে পড়ে
পড়বি সব যুগের ফেরে দ্যাখ বিচারে।
বোধিতনে বদ্ধ হয়ে থেকোনাকো মন আমার
হাড়িরামের চরণ বিনে গতি নাহি আর॥
পূর্ণ বলল, ‘কারিকরের কী খেলা! এ গান গোষ্ঠদাসের রচনা অথচ তার নিজের সন্তান ফণী পড়ে গেছে এই বোধিতনের পাকে।’
এমন সময় হইহই শব্দে এসে পড়ল বিপ্রদাস। পূর্ণ তাকে কাছে ডেকে কানে কানে কী যেন সব বলল। বিপ্র এক লাফ মেরে বললে: হবে হবে সব হবে। সব শুনবেন। সে সব অনেক রাতের ব্যাপার। বেলতলায় শুনতে হয় সে সব তত্ত্ব। আমি বেলতলার কারিকরের কাছে হুকুম নিয়ে এসেছি। গানও শোনাব অনেক। কিন্তু জানেন তো আগে ভোজন পরে ভজন।
আমি বললাম: এও কি কারিকরের কথা নাকি?
বিপ্র গোঁফে তা দিয়ে বললে: না। এ কথাটা কারিকরের নয়। এটা তাঁর অধম পেটেল বিপ্রদাসের। এই তোরা সব বাড়ি যা এখন। স্নানসেবা সারগে যা। বাবু তো আর পালাচ্চে না। একবার এয়েচেন যখন তেরাত্তির বাস নিয়ম।
সারাদিনের দিগ্দাহ যখন জুড়িয়ে এল তখন নামল সন্ধ্যা মায়াময় রূপে। হু হু বাতাস। আকাশে একখানা মানানসই চাঁদ। বিপ্রদাস আর আরশিগঞ্জের সেই গায়ক একটানা গান গাইতে লাগল নদীর পাড়ে বসে। সঙ্গে একতারা আর আনন্দলহরীর সঙ্গত। কখন গান থেমে গেছে, কখন সবাই চলে গেছে, কিছুই জানি না। ঘুমের জড়িমা আমাকে একেবারে কাতর করে দিয়েছিল। ক্লান্ত শরীর আর শ্রান্তিহারী হাওয়া। আমার দোষ কী?
বিপ্রদাস যখন ডাকল তখন বেশ রাত। দুজনে চললাম বেলতলার দিকে। সারা গাঁ নিশুতি। গা ছম ছম নীরবতা। বেলতলায় একা রাধারাণী শুধু প্রদীপ জ্বালিয়ে ধ্যানস্থা। দুজনে তার কাছাকাছি বসতেই বিপ্র হুংকার দিল—
বীজে কলে একস্থানে উৎপত্তি আমার।
হাড়ি রামচন্দ্র সেই বল্ শক্তি
ইহার তত্ত্ব জানেন যেই ব্যক্তি
তাহার চরণে আমার কোটি কোটি দণ্ডবৎ।
তিনি যাহা বলেন হাড়িরামের বলের বলে॥
এরপরে বিপ্র আর রাধারাণী বেলতলার খড়মে ফুলজল দিয়ে দ্বৈত কণ্ঠে বলল—
হাড়িরামচন্দ্রের শ্রীচরণে ফুলজল দিলাম। ধরাতলে ধন্য হলাম।
রূপযৌবন নয়নমন অৰ্পণ করিলাম।
আমি দুর্বল। দুর্বলেরি বল তুমি। সকল জানে অন্তর্যামী।
কেবল তোমারই গুণ গাই। শুন অন্য কাহারে না জানি ॥
খানিকক্ষণ সব চুপচাপ। এলোমেলো হাওয়া। বিপ্রদাসের চোখ দুটো জ্বলছে। রাধারাণী ধ্যানস্থা। হঠাৎ বিপ্র গালবাদ্য বাজিয়ে বলল: জয় হক্ হাকিম হাড়িরামচন্দ্রের জয়। শুরু হোক সৃষ্টিতত্ত্ব।
রাধারাণী চোখ বন্ধ রেখেই বলতে লাগল—প্রথমে হক্ হাড়িরাম। তাঁর থেকে হৈমবতী আর নারদের জন্ম।
বিপ্র বলল: আর এই হৈমবতী হতেই জন্ম নিলেন ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব। ব্রহ্মার সন্তান দুটো—ঘামকাঞ্চনী আর ভগবতী। ভগবতী হতে অঘাসুর বকাসুর কংসাসুর আর লোহাসুরের জন্ম।
রাধারাণী বলল: আর ঘামকাঞ্চনীর সন্তান তিনজন—কালু মুরারি বাসুদেব। এই কালুর সন্তান হল—খাগর, নাগর, নীলাম্বর আর মন্মথ। মুরারির সন্তান—লোকনাথ, জীবন, আজির মেথর আর ভুষি ঘোষ। বাসুদেবের সন্তান—শানমৃগ, গজকন্যা আর মুনিবালক।
বিপ্রদাস আরেকবার গালবাদ্য বাজিয়ে বলল; এইখানে সাঙ্গ হল ব্রহ্মার বংশ। এবারে বিষ্ণু বংশ শোনেন রাধারাণীর মুখে।
‘বিষ্ণুর বংশ মস্ত বড়’, নিমীল চোখে বলে চলে রাধারাণী, ‘তাঁর তিন সন্তান— ঝো-কালি, মুছুন্দরী কালি আর মুসুক কালি। ঝো-কালির সন্তান নেই। মুছুন্দরী কালির সন্তান হাওয়া আর আদম। এই আদমের সন্তান হাবেল আর কাবেল। কাবেল হতে নিকাড়ি, জোলা আর রাজপুত জাতের জনম। ইদিকে হাবেল হতে সেখ, সৈয়দ, মোগল, পাঠানের জনম।’
বিপ্র বলল: এবারে শুনুন আমার ঠাঁই। সেখ থেকে জন্মাল চারটে জাত—জিন সেখ, পরী সেখ, হাইদুলি সেখ আর দুলদুলি সেখ। সৈয়দ থেকেও চারটে জাত—হুমানী সৈয়দ, আলী সৈয়দ, দুমরা সৈয়দ আর হুরানা সৈয়দ। মোগল হতে চার জাত—লাল মোগল, নীল মোগল, সুন্নি মোগল আর শিয়া মোগল। পাঠান হতেও চার জাত—ছুর, ছুরানি, লুধি, লোহানি। ব্যাস। এবারে বাকি আছে মুসুক কালির বংশ বেত্তান্ত। শোনেন তা রাধারাণীর ঠেঁয়ে।
: মুসুক কালির তিন সন্তান—পরাশর মুনি, নমস মুনি আর ঋষভ মুনি। এই পরাশর মুনির এগারো সন্তান—যথা, ছাগ বাঘ নাগ শকুন মুসক মশক হাজত ঘোড়া বিড়াল উট আর হনুমান। ইদিকে নমস মুনির সন্তান একুনে বারোজন, যথা—জরলাল ফরলাল গ্রহক নৈনি শিউলে নুলো আলতাপেটে মুগলবেড়ে মালদহী ঝাপানি পুরকাটা আর চং।
বিপ্র বলল: ঋষভ মুনির চার ছেলে—দরশন নরশন পরশন আর পদ্ম। এখন নরশন থেকে হল নাপিত। পরশন থেকে ধাই আর পদ্ম থেকে হল মুচিরাম দাসের জন্ম। দরশনের সন্তান তো অজস্র। গুণে নেন বাবু। দোবে চোবে তেবে পাঠক পাঁড়ে উবিদ্ধি তেওয়ারি মিশির মেতেল দেবেল ঠাকুর বিষণ আর শুকুর। তেরোজন হল? এবারে সৃষ্টিতত্ত্ব সাঙ্গ করো।
রাধারাণী বলল: রইল বাকি শিবের অংশ। শিবের সন্তান কার্তিক গণেশ আর সরস্বতী। কার্তিকের সন্তান অর্জুন, গণেশের সন্তান ভুঁইমাসুর। আর সরস্বতী চিরকুমারী ব্রহ্মচারী।
বিপ্র সেই নিশীথ রাত্রিকে কাঁপিয়ে বলল: ইতি নমো সৃষ্টিতত্ত্ব। হক হাকিম হাড়িরামের নামে বলিহারি দাও।
বিপ্র আর রাধারাণী গদগদ চিত্তে এবং আমি খানিকটা হতভম্ব হয়ে একসঙ্গে তিনবার বলে উঠলাম—বলিহারি বলিহারি বলিহারি।
রাতের কত প্রহর তার নিশানা নেই। সবদিক শান্ত স্তব্ধ। শুধু অদ্ভুত তিনটে মানুষ যেন জেগে আছে এত বড় বিশ্বে। এই সৃষ্টিতত্ত্ব শুনব বলে আমরা তিনজনই একাহারী আছি। তাই নিয়ম। যে বলে আর যে শোনে দুজনকেই আহার নিদ্রা থেকে বিরত থাকতে হয় রাত দু প্রহর থেকে। কেমন যেন অবাক লাগছে সব কিছু। এতক্ষণ এ সব কী কথা শুনলাম?
কিন্তু বেশিক্ষণ সে বিস্ময় পোহানো গেল না। বিপ্রদাস বললে: এবার রাধারাণী একা যাপন করবে বাকি রাতটুকুন। আসুন আমরা একটু ওধারে গিয়ে কথা বলি। আমাদের তনের সাধনা আপনাকে বলব। সেটাই হাড়িরামের নিগূঢ় তত্ত্ব।
বেলতলার বিপরীত দিকে একটা ঘাসের জমিতে জমিয়ে বসতেই বিপ্র বলতে লাগল: আমাদের মতে গুরু নেই, সাধনসঙ্গিনী নেই। হাড়িরাম বলে গেছেন সবচেয়ে দামি সাধনা সেইটা যাতে ‘সখার সখী নেই, সখীর সখা নেই।’ একেই বলে খাসতনের সাধনা। আমাদের হাড়িরাম ছিলেন একমাত্র খাসতনের সাধক। কিন্তুক খাসতন বুঝতে হলে আগে আপনাকে বুঝতে হবে আর সব তনের থাক বা ঘর।
আমার আর কোনও প্রশ্ন নেই কারণ বিপই বলে যাচ্ছে অনর্গল।
: হাড়িরামের ধর্ম বৈরাগ্যের নয়। এ হল গিয়ে গৃহীর সাধনা। তাই আমাদের সাধনার আদি থাক হল এয়োতন। তার মানে হাড়িরামের মনের মানুষ জন্মদ্বারে যাবে অর্থাৎ স্ত্রী সঙ্গম করবে শুধু সৃষ্টির জন্যে। তাই বৃথা সঙ্গম নয় আর রোজ সঙ্গম নয়। আমাদের মতে বৃথা বীর্যক্ষয় নরহত্যার সমান পাপ। তাই স্ত্রীলোকের রক্তস্রাবের সাড়ে তিনদিন পরে অর্থাৎ চতুর্থদিনে সহবাস করতে হবে সুসন্তান কামনা করে। এই সহবাসই এয়োতনের ধর্ম। ওই সাড়ে তিন দিনের সময় রক্তের রং হয় পীতবর্ণ। এই সাড়ে তিন আমাদের আপ্ততত্ত্ব। বলেই গান ধরল বিপ্রদাস—
আরে ওই বৃন্দাবন হ’তে এলো সাড়ে তিন রতি
ওই পথেতেই এয়োতনের যেন থাকে মতি ॥
আমি বললাম: এই তা হলে এয়োতনের সার কথা?
: আজ্ঞে হ্যাঁ। তবে আরও কথা আছে। হাড়িরাম বলে গেছেন সন্ধে-রাতে স্ত্রী সহবাস করলে যে সন্তান জন্মায় সে হয় চোর। আবার সন্ধ্যার পর কিন্তু রাত বারোটার মধ্যে সঙ্গম থেকে যে সন্তান হয় সে হবে ডাকাত। তা হলে বুঝলেন তো রাত বারোটার পরই সহবাস ভাল। তাতে সুসন্তান হয়। আর ভোরবেলার সহবাসে জন্মায় দেবগুণান্বিত সন্তান!
বিপ্রদাস ব্যাপারটাকে গুছিয়ে বলল: এয়োতনের ধর্ম তা হলে কী দাঁড়াল? শুধু সন্তানের জন্য জন্মদ্বারে যাওয়া, সেও ওই সাড়ে তিন রাত্তিরে। অন্যদিন সহবাস নিষিদ্ধ। স্ত্রী ঋতুমতী না হলে বৃথা সঙ্গম অর্থাৎ কাম এয়োতনের ধর্ম নয়।
প্রজনন তত্ত্বের এহেন ব্যাখ্যা আমি কখনও শুনি নি, তাই কৌতুহল জাগল। বিপ্রদাস ক্রমে বুঝিয়ে দিল ‘নিত্যন’ হল এয়োতনের পরের ধাপ। গৃহস্থ ধর্মে এয়োতন মেনে একটা-দুটো সন্তান জন্মালে নিতে হবে নিত্যনের পথ। তখন মনের মধ্যে আনতে হবে সংসারে অনাসক্তি আর জন্মদ্বারে ঘৃণা। জন্মদ্বারকে পচা গর্তরূপে ভেবে তাকে চিরতরে ত্যাগ করতে হবে। সংসার আর জগতের আইন কানুনের বাইরে গিয়ে নিত্যপুরুষ হাড়িরামের ধ্যান করতে হবে। নির্জন মাঠে, নদীর ধারে বা বেলতলায়। মেহেরপুরের বৃন্দাবন আর নিশ্চিনপুরের রাধারাণী নিত্যনের পথে আছে।
কিন্তু সবচেয়ে কঠিন সাধনা বোধ হয় খাসতনের। একা হাড়িরাম শুধু এ সাধনা করতে পেরেছিলেন। আর কেউ পারবে না। খাসতন হল চরম মুক্তির সাধনা। পৃথিবীর আলো হাওয়া আকাশ গাছপালা নদী পাহাড় বন মাঠ এরা খাসতালুকের প্রজা। স্বাধীন। এরা কাউকে খাজনা দেয় না। এদের বেঁচে থাকতে গেলে কোনও মূল্য দিতে হয় না। মানুষকে বেঁচে থাকার মূল্য দিতে হয় বীর্যক্ষয় আর বীর্যগ্রহণের মধ্যে দিয়ে। যে মানুষ কোনওদিন তার বীর্যক্ষয় করে নি সে খাসতনের সাধক। একমাত্র হাড়িরাম তা পেরেছিলেন, তাই তিনি জগৎস্রষ্টা কারিকর।
এই অবধি বোঝার পর আমি বললাম: এবারে আমি বোধিতন বুঝেছি। বোধিতন মানে কামের দ্বারে একেবারে বন্দিত্ব আর তার জন্যে অনুতাপ। তাই না?
: ঠিক তাই। বোধিতন হল জ্ঞানপাপীর দশা। আমরা সবাই তাই। হাড়িরাম বলে গেছেন, যে প্রতিদিন সঙ্গম করে আর অকারণ বীর্যক্ষয় করে সে পড়ে বোধিতনের ফাঁদে। হাড়িরামের সব শিষ্য এই বোধিতন থেকে মুক্তি খোঁজে, কাঁদে। নিত্যনের জন্যে চোখের জল ফেলে। এই আমার কথাই ধরুন। প্রত্যেকদিন দু’বেলা বেলতলায় মাথা কুটি আর কারিকরকে বলি, খাসতন তো পাব না এ জন্মে, অন্তত নিত্যনের পথে একটু এগিয়ে দাও। গোষ্ঠদাসের গান শুনুন—
বোধিতনে বদ্ধ হয়ে থেকোনা রে মন আমার
হাড়িরামের চরণ বিনে গতি নাহি আর।
আর অন্য উপায় দেখিনে থাক একিনে
আবার মানব হবি যদি হাড়িরামের চরণ করো সার ॥
গানের করুণ সুর সমস্ত পরিবেশকে গাঢ় করে দিল। যেন আমার চেতনা থেকে অস্পষ্টতা কেটে গিয়ে উদ্যত সত্যের মতো আকাশে জেগে রইল শেষ রাতের দীপ্ত চাঁদ। গানের ভাবে আর সুরে সমস্ত পৃথিবীর কামমোহিত সকল মানুষের অসহায় মাথা-কোটা যেন আমি শুনতে পেলাম। মনে হল এ কোনও লৌকিক ধর্মের বানানো তত্ত্ব নয়। এর মধ্যে চিরকালের লৌকিক মানুষের অসহায় অনুতাপ আর কান্না।
গানের সুর শেষ হলেও কান্না থামেনি বিপ্রদাসের। আমি তার পাশে গিয়ে আস্তে আস্তে মমতার সঙ্গে কাঁধে হাত রাখলাম। অমন শালপ্রাংশু মানুষটা আত্মধিক্কারে একেবারে কুঁকড়ে গেছে। আমি তার হাত ধরে বেলতলার দিকে নিয়ে যেতে যেতে বললাম শান্ত হও। হাড়িরামকে ডাকো। তোমার তো অনেক বয়স হয়েছে। আর ভয় কী?
বিপ্রদাস করুণ কণ্ঠে বলল: বাবু, আমার ভিতরের পশুটা যে আজও মরে নি।
শেষ চাঁদের ঝিলিক মারা আলোয় পা ফেলে বেলতলায় গিয়ে দাঁড়াই দু’জন। গাছতলায় হাড়িরামের খড়মের কাছে জ্বেলে দেওয়া প্রদীপ এত হাওয়াতেও নেভেনি। ধ্যানতন্ময় রাধারাণীর মুখে পড়েছে সেই আলো। সেইদিকে চেয়ে ভাবলাম কোথায় গেল মেহেরপুরের সেই মেধাবী সিদ্ধ সাধক? কোথায় তার তনু সদানন্দ শ্ৰীমন্ত নুটু জগো দক্ষ? নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে, অবনত অবমানিত মানুষদের বাঁচাতে তৈরি হয়েছিল যে শাস্ত্র তাতে তো কই একফোঁটাও কলঙ্ক লাগেনি।
***
* এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্যের জন্য দ্র. ‘বাঙলায় বাউলবিরোধী আন্দোলন: প্রেক্ষিত লালন শাহ’ আবুল আহসান আহসান চৌধুৰী। চৌধুরী। লালন স্মারক গ্রন্থ। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, বাংলাদেশ ১৯৭৪.