তুর্কী অভিযানের পরে
তুর্কী অভিযানের পরে : তুর্কী আক্রমণের ফল—স্বাধীন সুলতান রাজ্যের প্রতিষ্ঠা—সুলতান ও উচ্চ রাজ কর্ম্মচারিকর্ত্তৃক বাঙ্গালাদেশে বিদ্যা ও সাহিত্য চর্চ্চার পোষকতা—বিবিধ বাঙ্গালা কাব্যধারার উৎপত্তি—পাঁচালী কাব্য—পঞ্চদশ শতাব্দীতে বাঙ্গালা সাহিত্যের অবস্থা।
দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে বাঙ্গালা দেশে তুর্কী আক্রমণ সুরু হয়। বাঙ্গালা দেশ চিরদিনই আর্য্যবর্ত্তের রাষ্ট্রীয় সংঘাতের বাহিরে থাকিয়া নিজের স্বতন্ত্র পথে চলিয়া আসিতেছিল। সেই কারণে, আর্য্যাবর্ত্তে যখন শক হূণ প্রভৃতি বিদেশী আক্রমণকারিগণ প্রচণ্ড বিক্ষোভ তুলিয়াছিল, তখন তাহার ঢেউ বাঙ্গালা দেশের সীমানায় পৌঁছিয়া বাঙ্গালীর পল্লীজীবনের সুখশান্তির বিন্দুমাত্রও ব্যাঘাত ঘটাইতে পারে নাই। অনেক কাল পরে যখন তুর্কী ও পাঠান সৈন্য পশ্চিম ও উত্তর ভারতে একে একে দেশের পর দেশ গ্রাস করিয়া পূর্ব্বদিকে অগ্রসর হইতেছিল, তখনও এই ব্যাপারের গুরুত্ব বাঙ্গালীর বোধগম্য হয় নাই। অতএব যখন মুহম্মদ-বিন-বখতিয়ার মগধদেশ জয় ও লুণ্ঠন করিয়া অকস্মাৎ পূর্ব্বদিকে প্রধাবিত হইল, তখন বাঙ্গালা দেশের রাজশক্তি অথবা প্রজাবর্গ কেহই এই বিদেশী আক্রমণকারীদিগকে উপযুক্ত বাধা দিবার জন্যে একটুকুমাত্র প্রস্তুত ছিল না। সুতরাং মুষ্টিমেয় তুর্কী-পাঠান সৈন্যকে বাঙ্গালা দেশে বিশেষ কোন যুদ্ধ অথবা অন্য প্রকার বাধার সম্মুখীন হইতে হয় নাই।
তুর্কী আক্রমণের ফলে বাঙ্গালীর বিদ্যা ও সাহিত্যচর্চ্চার মূলে কুঠারাঘাত পড়িল। প্রায় আড়াই শত বৎসরের মত দেশ সকল দিকেই পিছাইয়া পড়িল। দেশে শান্তি নাই, সুতরাং সাহিত্যচর্চ্চা ত হইতেই পারে না। প্রধানতঃ এই কারণেই ত্রয়োদশ ও চতুর্দ্দশ এই দুই শতাব্দীতে কোন সাহিত্যিক রচনা পাওয়া যায় নাই।
চতুর্দ্দশ শতাব্দীর মধ্যভাবে শম্সু-দ্-দীন ইলিয়াস শাহ দিল্লীর সম্রাটের অধীনতা-পাশ ছেদ করিয়া বাঙ্গালায় স্বাধীন সুলতান রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিলেন। তখন হইতেই দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হইবার মত অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি হইল। দেশে পুনরায় জ্ঞানচর্চ্চা সুরু হইল, এবং সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য-সৃষ্টির প্রচেষ্টাও দেখা দিল। পাল এবং সেন বংশীয় নরপতিদিগের মত এবারেও মুখ্যভাবে রাজশক্তিই জ্ঞান ও সাহিত্যচর্চ্চার পৃষ্ঠপোষকতা করিতে লাগিল।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে অন্ততঃ তিন জন সুলতান এবং ষোড়শ শতাব্দীতে অন্ততঃ এক জন সুলতান এবং দুই জন উচ্চপদস্থ মুসলমান রাজকর্ম্মচারী যে নিজেদের সভাকবিদিগের দ্বারা অনেকগুলি উৎকৃষ্ট কাব্য রচনা করাইয়া ছিলেন, তাহার প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। এ বিষয়ে পরে আলোচনা করা যাইতেছে। তুর্কী অভিযানের পর, পঞ্চদশ শতাব্দী হইতে ইংরাজ অধিকারের পূর্ব্বকাল অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্য্যন্ত, বাঙ্গালা সাহিত্য প্রধাণতঃ গীতিমূলক ছিল। অর্থাৎ বাঙ্গালা কাব্য সাধারণতঃ পড়া বা আবৃত্তি করা হইত না,–মন্দিরা, মৃদঙ্গ ও চামর সংযোগে একাকী বা দলবদ্ধ ভাবে গীত হইত। অতি পূর্ব্বাকালে বোধ হয় পঞ্চালিকা বা পুতুল-নাচের সঙ্গে এই ধরনের কাব্য গীত হইত বলিয়া পরে বাঙ্গালা কাব্যের সাধারণ নাম হইয়াছিল “পাঁচালী”। আর, কাব্যগুলিতে কোন না কোন দেবতার অথবা দেবকল্প মানুষের মহিমা কীর্ত্তিত হইত। এই জন্য কাব্যের নামে প্রায় “মঙ্গল” বা “বিজয়” শব্দ যুক্ত থাকিত।
অনেকে ধারণা করিয়া থাকেন যে, প্রাচীন বাঙ্গালা সাহিত্যে “মঙ্গল” ও “বিজয়” কাব্য বলিয়া দুই স্বতন্ত্র প্রকারের কাব্যধারা বর্ত্তমান ছিল। এই ধারণা নিতান্তই ভুল। একই কাব্যের বিভিন্ন পুঁথিতে কখনও “মঙ্গল” কখনও বা “বিজয়” নাম পাইতেছি। যেমন, মালাধর বসুর কাব্য শ্রীকৃষ্ণবিজয়, শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল এবং গোবিন্দমঙ্গল এই তিন নামেই সমান ভাবে সুপরিচিত ছিল।
পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে পশ্চিমবঙ্গে জনসাধারণের সাহিত্যিক রুচির চমৎকার ছবি পাওয়া যায় বৃন্দাবন-দাসের চৈতন্যভাগবত গ্রন্থে। বৃন্দাবন-দাস লিখিয়াছিলেন যে, তখন গায়কেরা শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা ও শিবের গৃহস্থালীর গান গাহিয়া ভিক্ষা করিত, পূজা উপলক্ষে সাধারণ লোকে আগ্রহ করিয়া মঙ্গলচণ্ডীর ও বিষহরি অর্থাৎ মনসার পাঁচালী শুনিত, এবং রামায়ণ-গানে আর ঐতিহাসিক-গাঁথায় সাধারণ লোকের, এমন কি বিদেশী মুসলমানদের চিত্ত বিগলিত হইত। পঞ্চদশ শতাব্দীতে রচিত এই সব কাব্যের দুই একখানি মাত্র পাওয়া গিয়াছে। কিন্তু ঐতিহাসিক-গাঁথাগুলি—বৃন্দাবন-দাসের কথায় “যোগীপাল ভোগীপাল মহীপালের গীত”—একেবারেই লুপ্ত হইয়া গিয়াছে বলিয়া বোধ হয়।