১.১ বাঙ্গালা সাহিত্যের আদি যুগ

বাঙ্গালা সাহিত্যের কথা
সুকুমার সেন
প্রথম পরিচ্ছেদ – দশম হইতে ত্রয়োদশ শতাব্দী 

বাঙ্গালা সাহিত্যের আদি যুগ : বাঙ্গালাদেশে রচিত সংস্কৃত কাব্য—জয়দেবের গীতগোবিন্দ—বাঙ্গালা ভাষার উৎপত্তি—বৌদ্ধসিদ্ধাচার্য্যদের রচিত বাঙ্গালা গান

 বাঙ্গালা দেশে আর্য্যদিগের আগমনের পূর্ব্বে যাহারা বাস করিত তাহাদের সভ্যতা আদৌ উচ্চাঙ্গের ছিল না, এবং সাহিত্য বলিতে যাহা বুঝায় এমন কিছুও তাহাদের ছিল না। খ্রীষ্টপূর্ব্ব তৃতীয় শতাব্দীতে মৌর্য্য সম্রাটদিগের সময় হইতেই এদেশে আর্য্যদিগের বসতি আরম্ভ শুরু হয়, এবং খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যেই বাঙ্গালাদেশের প্রায় সর্ব্বত্র ইঁহাদের দ্বারা অধ্যুষিত হয়। আর্য্যেরা উত্তর-পশ্চিম হইতে আসিয়া ছিলেন। ইঁহাদের পোষাকী অর্থাৎ শিক্ষা, বিদ্যাচর্চ্চা ও সামাজিক ব্যাপারের ভাষা ছিল সংস্কৃত; আর আটপহরিয়া অর্থাৎ ঘরোয়া ভাষা ছিল সংস্কৃত হইতে উদ্ভুত প্রাকৃত ভাষা।

এদেশে সাহিত্যের চর্চার পত্তন হয় এই সব উপনিবিষ্ট আর্য্যদিগের দ্বারা। প্রথম কয় শত বৎসর তাঁহারা যাহা কিছু লিখিতেন সবই সংস্কৃতে, দৈবাৎ প্রাকৃতে। এই সব লেখার নমুনা পাই তাম্রপট্টে লিখিত অনুশাসনে বা ভূমিদারপত্রে এবং দুই একটি মহাকাব্যে আর কতকগুলি সংস্কৃত শ্লোকে। বাঙ্গালা দেশে রচিত সর্ব্বাপেক্ষা পুরাতন কাব্য হইতেছে রামচরিত। এটি রামায়ণ-কাহিনী অবলম্বনে লেখা। কাব্যটির রচিয়তার নাম অভিনন্দ। অনুমান হয় যে, ইনি সম্রাট দেবপাল দেবের অনুচর ছিলেন। তাহা হইলে ইনি খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর শেষ ভাবে বর্ত্তমান ছিলেন, ধরিতে হইবে। পাল সম্রাটদিগের রাজত্বকালে আরও একটি কাব্য রচিত হইয়াছিল দশম শতাব্দীর শেষ ভাগে। এই কাব্যটিরও নাম রামচরিত। ইহাতে রামায়ণ-কাহিনী এবং রামপাল দেবের জীবনী একই সঙ্গে দ্ব্যর্থের সাহায্যে বর্ণিত হইয়াছে। কবি সন্ধ্যাকর নন্দী রামপাল দেবের পুত্র মদনপাল দেবের অনুচর ছিলেন।

পাল রাজারা বিদ্যোৎসাহী ছিলেন। তাহার পর বর্ম্ম ও সেন বংশের রাজত্ব। ইহারা আরও বিদ্যোৎসাহী এবং সাহিত্যামোদী ছিলেন। সেকালের প্রায় সকল বড় পণ্ডিত ও কবি সেনরাজদিগের সভা অলঙ্কৃত করিয়া গিয়াছেন। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে লক্ষণসেন দেবের সভায় উমাপতি ধর, শরণ, খোয়ী এবং জয়দেব এই চারি জন বিখ্যাত কবির সম্মেলন হইয়াছিল।

সে যুগের শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন জয়দেব। ইঁহার গীতগোবিন্দকাব্য শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলা বিষয়ে রচিত। গীতগোবিন্দে চব্বিশটি গান বা পদ আছে। এগুলি সংস্কৃতে রচিত হইলেও ইহাদের শ্রুতিমধুরতা শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সকলেরই মনোহরণ করে। প্রকৃতপক্ষে, এই পদগিলি লইয়াই বাঙ্গালা সাহিত্যের সূত্রপাত। পরবর্ত্তী কালের বৈষ্ণব কবিরা প্রায় সকলেই কিছু না কিছু পরিমাণে জয়দেবের নিকট ঋণী। জয়দেবের নিবাস ছিল অজয় নদের ধারে কেন্দুবিল্ব গ্রামে। এই গ্রাম এখন কেঁদুলী বা জয়দেব-কেঁদুলী নামে বিখ্যাত। জয়দেবের স্মৃতি-পূজা উপলক্ষে এই স্থানে আবহমান কাল ধরিয়া প্রতি বৎসর পৌষ সংক্রান্তির সময়ে বিরাট মেলা বসিয়া থাকে। বাঙ্গালা দেশের দূরতম অঞ্চল হইতেও সাধু-বৈষ্ণব আসিয়া এই মেলায় যোগ দিয়া থাকেন। জয়দেব ও তাঁহার পত্নী পদ্মাবতীর সম্বন্ধে নানা গল্প-কাহিনী প্রচলিত আছে। তবে তিনি যে কিছুকাল পুরীতে জগন্নাথদেবের সেবক বা ভক্তরূপে অবস্থান করিয়াছিলেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। জয়দেবের সময় হইতে জগন্নাথদেবের নিকট প্রত্যহ গীতগোবিন্দের পদ গীত হইয়া আসিতেছে।

সংস্কৃত ভাষা লোকের মুখে মুখে কালক্রমে রূপান্তরিত হইয়া প্রাকৃত ভাষায় পরিণত হয়। এই প্রাকৃত ভাষা ভাঙ্গিয়া আবার বিভিন্ন আধুনিক ভাষা—যেমন বাঙ্গালা, আসামী, উড়িয়া, মৈথিল, হিন্দি, উর্দ্দূ, গুজরাটী, মারাঠী ইত্যাদি—উৎপন্ন হইয়াছে। আধুনিক ভাষায় পরিণত হইবার ঠিক পূর্ব্বে প্রাকৃতের যে রূপ ছল, তাহাকে বলা হয় অপভ্রংশ। সেন রাজাদের সময়ে অপভ্রংশ ভাষারও কিছু চর্চ্চা হইত, তাহা অবশ্য রাজসভায় বা বিদ্বদ্‌-গোষ্ঠীতে নহে, সাধারণ লোকের মধ্যে, বিশেষ করিয়া বৌদ্ধধর্ম্মাবলম্বী সিদ্ধাচার্য্য এবং সাধকদিগের মধ্যে। এই বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য্যেরা বাঙ্গালাতেও পদ লিখিতেন। যতদূর জানা গিয়াছেন ইঁহাদের পূর্ব্বে বাঙ্গালা ভাষায় আর কেহ কিছু রচনা করেন নাই। তাহা করিবারও কথা নয়। কেননা, এই সময়েই—অর্থাৎ খ্রীষ্টীয় দশম-একাদশ শতাব্দীতেই—বাঙ্গালা ভাষা অপভ্রংশ হইতে পৃথক হইয়া স্বতন্ত্র ভাষারূপে মূর্ত্তি লাভ করে।

বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য্যদিগের লেখা একটি গানের বইয়ের পুঁথি মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় নেপাল দরবারের পুস্তকালয় ঘাঁটিয়া আবিষ্কার করেন এবং ১৩২৩ সালে, আরও কয়েকটি পুঁথির সঙ্গে “হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা” নামে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সাহায্যে প্রকাশিত করেন। মূল বইটিতে একান্নটি পদ ছিল, তাহার মধ্যে একটি পদ পুঁথি-লেখক বাদ দিয়াছেন, এবং পুঁথির কয়েকটি পাতা হারাইয়া গিয়াছে। ইহার ফলে মোটমাট সাড়ে ছেচল্লিশটি পদ আমাদের হস্তগত হইয়াছে। পদগুলিতে যে যে সুরে গাহিতে হইবে তাহারও নির্দ্দেশ দেওয়া আছে। পুঁথিটিতে অধিকন্তু আছে গানগুলির একটি বিস্তৃত সংস্কৃত টীকা।

গানগুলিতে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য্যদিগের সাধনার সঙ্কেত নিহিত আছে। সে সঙ্কেত আমাদের কাছে এখন প্রায় অবোধ্য। তবে গানগুলির বাহ্যিক যে অর্থ আছে, তাহা জানা বিশেষ দুরূহ নয়। ভাষা কিছু কঠিন বটে, কারণ বাঙ্গালা ভাষা তখন সবেমাত্র প্রাকৃতের খোলস ছাড়িয়া বাহির হইয়াছে।

জয়দেবের কাব্যে এবং বৌদ্ধ গানগুলিতে যে গীতকবিতা বা পদাবলীর ধারা সুরু হইল এই ধারা পরবর্ত্তী কালে বৈষ্ণব কবিদের কাব্যে অশেষ রস ও শক্তি সঞ্চয় করিয়া বাঙ্গালা সাহিত্যের প্রধান ধারারূপে পরিণত হইয়াছিল। আধুনিক সাহিত্যের মধ্যেও গীতি-কাব্যরূপে এই ধারাই নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহে অক্ষুণ্ণ গতিতে চলিয়াছে। বাঙ্গালা ভাষার জন্ম-মুহূর্ত্তেই যে তাহার সাহিত্য নিজের মূল ধারা, মূল সুর, অর্থাৎ গীতি-কাব্য, খুঁজিয়া পাইয়াছিল, ইহা পরম সৌভাগ্যের বিষয়, তাহা না হইলে বোধ হয় আজ বাঙ্গালা সাহিত্য জগতের প্রথম শ্রেণীর সাহিত্যের মধ্যে স্থান করিতে পারিত কিনা সন্দেহ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *