১.০২ কলিকাতার বারোইয়ারি-পূজা

কলিকাতার বারোইয়ারি-পূজা  

And these what name or title e’er they bear,
—I speak of all–”
Beggars Bush.

সৌখীন চড়ক-পার্ব্বণ শেষ হলো বলেই যে দুঃখে সজনেখাঁড়া কেটে গেলেন। রাস্তার ধূলো ও কাঁকরেরা অস্থির হয়ে বেড়াতে লাগলো। ঢাকীরা ঢাক ফেলে জুতো গড়তে আরম্ভ কল্লে। বাজারে দুধ সস্তা (এতদিন গয়লাদের জল মেশবার অবকাশ ছিল না), গন্ধবেণে ভালুকের রোঁ বেচতে বসে গেলেন। ছুতরেরা গুলদার ঢাকাই-উড়ুনিতে কাঠের কুঁচো বাঁধতে আরম্ভ কল্লে। জন্ম-ফলারে যজমেনে বামুনেরা আদ্যশ্রাদ্ধ, বাৎসরিক সপিণ্ডীকরণ টাকতে লাগলেন—তাই দেখে গরমি আর থাকতে পাল্লেন না; “ঘরে আগুন”, “জল ডোবা” ও “ওলাউঠো” প্রভৃতি নানারকম বেশ ধরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লেন।

রাস্তার ধারের ফোড়ের দোকান, পচা নিচু ও আঁবে ভরে গেল। কোথাও একটা কাঁটালের ভুতুড়ির উপর মাছি ভ্যান ভ্যান কচ্চে, কোথাও কতকগুলো আঁবের আটি ছড়ান রয়েছে, ছেলেরা আঁটি ঘষে ভেপু করে বাজাচ্চে। মধ্যে একপলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় চিৎপুরের বড় রাস্তা চুলারের পাতের  মত দেখাচ্ছে—কুঠিওয়ালারা জুতা হাতে করে, বেশ্যালয়ের বারাণ্ডার নীচে আর রাস্তার ধারের বেণের দোকানে দাঁড়িয়ে আছে—আজ ছক্কড়মহলে পোহাবারো।

কলকেতার কেরাঞ্চি গাড়ী বেতো রোগীর পক্ষে বড় উপকারক, গ্যালবানিক শকের কাজ করে। সেকেলে আশমানী দোলদার ছক্কড় যেন হিন্দুধৰ্ম্মের সঙ্গে সঙ্গেই কলকেতা থেকে গা-ঢাকা হয়েছে— কেবল দুই একখান আজও খিদিরপুর, ভবানীপুর, কালীঘাট অর বারাসতের মায়া ত্যাগ কত্তে পারেনি বলেই আমরা কখন কখন দেখতে পাই।

“চার অনা!” “চার অনা!” “লালদীঘি!” “তেরজরী!” “এস গো বাবু ছোট আদালত!” ব’লে গাড়োয়ানেরা সৌখীন সুরে চীৎকার কচ্চে; নববধ্বাগমনের বউয়ের মত দুই এক কুঠিওয়ালা গাড়ীর ভিতর বসে আছে।—সঙ্গী জুটচে না। দুই-একজন গবর্ণমেন্ট অফিসের কেরাণী গাড়োয়ানদের সঙ্গে দরের কষাকড়ি কচ্চেন। অনেকে চ’টে হেঁটেই চলেছেন—গাড়োয়ানের হাসি টিটকিরির সঙ্গে “তবে ঝাঁকামুটেয় যাও, তোমাদের গাড়ী চড়া কৰ্ম্ম নয়।” কমপ্লিমেন্ট দিচ্চে।

দশটা বেজে গেছে। ছেলেরা বই হাতে ক’রে রাস্তায় হো হো কত্তে কত্তে স্কুলে চলেছে। মৌভাতি বুড়োরা তেল মেখে গাছ কাঁধে করে অফিমের দোকান ও গুলীর আড্ডায় জলে। হেটো ব্যাপারীরা বাজারে বেচা-কেনা শেষ করে খালি বাজরা নিয়ে ফিরে যাচ্চে। কলকেতা সহর বড়ই গুলজার—গাড়ীর হরুবা, সহিসের পয়িস পরিস শব্দ, কেঁদো কেঁদো ওয়েলার ও নরম্যাণ্ডির টাপেতে রাস্তা কেঁপে উঠচে—বিনা বাঘাতে রাস্তায় চলা বড় সোজা কৰ্ম্ম নয়।

বীরকৃষ্ণ দার ম্যানেজার কানাইধর দত্ত এক নিমখাসা রকমের ছক্কর ভাড়া করে বারোইয়ারি পূজার বার্ষিক সাধতে বেরিয়েছেন।

বীরকৃষ্ণ দাঁ কেবলচাদ দার পুষ্যিপুত্তর, হাটখোলায় গদী, দশ-বাবোটা খন্দ মালের আড়ত, বেলেঘাটায় কাঠের ও চুণের পাঁচখানা গোলা, নগদ দশ বারো লাখ টাকা দাদন ও চোটায় খাটে। কোম্পানীর কাগজের মধ্যে মধ্যে লেন-দেন হয়ে থাকে; বারো মাস প্রায় সহরেই বাস, কেবল পুজোর সময় দশ-বারো দিনের জন্য বাড়ী যেতে হয়। একখানি বগী, একটি লাল ওয়েলার, একটি রাঁড়, দুটি তেলী মোসাহেব, গড়পারে বাগান ও ছ-ডেড়ে একু ভাউলে ব্যাভার, আয়েস ও উপাসনার জন্যে নিয়ত হাজির।

বীরকৃষ্ণ দাঁ শ্যামবর্ণ, বেটেখেঁটে রকমের মানুষ, নেয়াপাতি রকমের ভুঁড়ি, হাতে সোনার তাগা, কোমরে মোটা সোনার গোট, গলায় একছড়া সোনার দু-নরী হার, আহ্নিকের সময়, খেলবার তাসের মত চ্যাটালো সোনার ইষ্টিকবচ পরে থাকেন, গঙ্গাস্নানটি প্রত্যহ হয়ে থাকে, কপালে কণ্ঠায় ও কানে ফোঁটাও ফাঁক যায় না। দাঁ মহাশয় বাঙ্গালা ও ইংরাজী নামসই কত্তে পারেন ও ইংরেজ খদ্দের আসা যাওয়ায় দু-চারটে ইংরাজী কোম্পানীর কনট্যাক্টে ‘কম’ আইস, ‘গো’ যাও প্রভূতি দুই-একটা ইংরজী কথাও আসে; কিন্তু দাঁ মহাশয়কে বড় কাজকর্ম্ম দেখতে হয় না, কানাইধন দত্তই তার সব কাজকর্ম্ম দেখেন, দাঁ মশায় টানা-পাখায় বাতাস খেয়ে, বগী চড়ে, আর এসরাজ বাজিয়েই কাল কাটান।

বারো জনে একত্র হয়ে কালী বা অন্য দেবতার পূজা করার প্রথা মড়ক হতেই সৃষ্টি হয়—ক্রমে সেই অবধি “মা” ভক্তি ও শ্রদ্ধার অনুরোধে ইয়ারদলে গিয়ে পড়েন। মহাজন, গোলদার, দোকানদার ও হেটোরাই বারোইয়ারি-পূজোর প্রধান উদযোগী। সংবৎসর যার যত মাল বিক্রী ও চালান হয়, মণ পিছু এক কড়া দু কড়া বা পাঁচ কড়ার হিসাবে বারোইয়ারি খাতে জমা হয়ে থাকে, ক্রমে দু-এক বৎসরের দস্তুরি বারোইয়ারি খাতে জমলে মহাজনদের মধ্যে বর্ধিষ্ণু ও ইয়ারগোচের সৌখীন লোকের কাছেই ঐ টাকা জমা হয়। তিনি বারোইয়ারি-পূজের অধ্যক্ষ হন—অন্য চাঁদা আদায় করা, চাঁদার জন্য ঘোরা ও বারোইয়ারি সং ও রং-তামাসার বন্দোবস্ত করা তাঁরই ভার হয়।

এবার ঢাকার বীরকৃষ্ণ দাঁ-ই বারোইয়ারির অধ্যক্ষ হয়েছিলেন, সুতরাং দাঁ মহাশয়ের আমমোক্তার কানাইবন দত্তই বারোইয়ারির বার্ষিক সাবা ও আর আর কাজের ভার পেয়েছিলেন।

দত্তবাবুর গাড়ী রুনু রুনু রুনু ছুনু ছুনু করে নুড়িঘাটা লেনের এক কায়স্থ বড়মানুষের বাড়ীর দরজায় লাগলো। দত্তবাবু তড়াক ক’রে গাড়ী থেকে লাফিয়ে পড়ে দারোয়ানদের কাছে উপস্থিত হলেন। সহরের বড়মানুষের বাড়ীর দরোয়ানের খোদ হুজুর ভিন্ন নদের রাজা এলেও খবর নদারক! “হোরির বক্সিস”, “দুর্গোৎসবের পার্ব্বণী”, “রাখী পূর্ণিমার প্রণামী” দিয়েও মন পাওয়া ভার। দত্তবাবু অনেক ক্লেশের পর চার অন কবলে একজন দারোয়ানকে বাবুকে এংলা দিতে সম্মত কললেন। সহরের অনেক বড়মানুষের কাছে “কর্জ্জ দেওয়া টাকার সুদ” বা তাঁর “পৈতৃক জমিদারী” কিনতে গেলেও বাবুর কাছে এংলা হ’লে হজুরের হুকুম হ’লে, লোক যেতে পায়; কেবল দুই-এক জায়গায় অবারিতদ্বার! এতে বড়মানুষদেরো বড় দোষ নাই, ‘ব্রাহ্মণপণ্ডিত’, উমেদার’, ‘কন্যাদায়’, ‘আইবুড়ো’ ও ‘বিদেশী ব্রাহ্মণ’ ভিক্ষুকদের জ্বালায় সহরে বড়মানুষদের স্থির হওয়া ভার। এদের মধ্যে কে মৌতাতের টানাটানির জ্বালায় বিব্রত, কে যথার্থ দায়গ্রস্ত, এপিডেপিট করলেও তার সিদ্ধান্ত হয় না! দত্তবাবু আর ঘণ্টা দরজায় দাঁড়িয়ে বইলেন; এর মধ্যে দশ-বারোজনকে পরিচয় দিতে হলো, তিনি কিসের জন্য হজুরে এসেছেন। তিনি দুই একটা বেনাড়া রকমের দরোয়ানি ঠাট্টা খেয়ে গরম হচ্ছিলেন, এমন সময় তাঁর চার অলি দাদুনে দরোয়ান ঢিকুতে ঢিকুতে এসে তাঁরে সঙ্গে করে নিয়ে হজুরে পেশ কললে।

পাঠক। বড়মানুষের বাড়ীর দরোয়ানের কথায়, এইখানে আমাদের একটি গল্প মনে পড়ে গেল; সেটি না বলেও থাকা যায় না।

বছর দশ-বারো হলো, এই সংবের বাগবাজার অঞ্চলের একজন ভদ্রলোক তার জন্মতিথি উপলক্ষে গুটিকত ফ্রেণ্ডকে মধ্যাহ্নভোজনের নিমন্তন্ন করেন। জন্মতিথিতে আমোদ করা হিন্দুদের পক্ষে ইংরেজদের কাপি করা প্রথা নয়; আমরা পুরুষপরম্পরা জন্মতিথিতে গুড়-দুধ খেয়ে তিল বুলে, মাছ ছেড়ে, (যার যেমন প্রথা) নতুন কাপড় পরে, প্রদীপ জ্বেলে, শাক্ বাজিয়ে, আইবুড়ো ভাত খাবার মত–কুটুম্ব-বন্ধু বান্ধবকে সঙ্গে নিয়ে ভোজন করে থাকি। তবে আজকাল সহরের কেউ কেউ জন্মতিথিতে বেতর গোচের অমোদ করে থাকেন। কেউ যেটের কোলে ষাট বৎসরে পদার্পণ করে আপনার জন্মতিথির দিন গ্যাসের আলোর গেট, নাচ ও ইংরেজদের খানা দিয়ে চোহেলের খানা দিয়ে চোহেলের একশেষ করেন; অভিপ্রায়, আপনারা আশীৰ্বাদ করুন, আর ষাট বছর এমনি করে আমোদ কত্তে থাকুন, চুলে ও গোঁফে কলপ দিয়ে জরির জামা ও হীরের কণ্ঠী পরে নাচ দেখতে বসুন—প্রতিমা বির্জন–স্নানযাত্রা ও রথে বাহার দিন। অনেকের জন্মতিথিতে বাগান টের পান যে, আজ বাবুর জন্মতিথি, নেমন্তন্নেদের গা সারতে আফিসে একহপ্তা ছুটি নিতে হয়। আমাদের বাগবাজারের বাবু সে রকমের কোন দিকেই যান নি, কেবল গুটিকতক ফ্রেণ্ডকে ভাল করে খাওয়াবেন, এই তাঁর মতলব ছিল। এদিকে ভোজের দিন নেমন্তন্নেরে এসে একে একে জুটলেন, খাবার-দাবার সকলি প্রস্তুত হয়েছিল, কিন্তু সেদিন সকালে বাদলা হওয়ায় মাছ পাওয়া যায় নি। বাঙ্গালীদের মাছটা প্রধান খাদ্য, সুতরাং কর্ম্মকর্ত্তা মাছের জন্য উড়ই উদ্বিগ্ন হতে লাগলেন; নানা স্থানে মাছের সন্ধানে লোক পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু কোন রকমেই মাছ পাওয়া গেল না।–শেষ একজন জেলে একটা সে দশ-বারো ওজনের রুইমাছ নিয়ে উপস্থিত হলো। মাছ দেখে কৰ্ম্মকর্ত্তার আর খুসীর সীমা রইলো না। জেলে যে দাম বলবে, তাই নিয়ে মাছটি নেওয়া যাবে মনে করে জেলেকে জিজ্ঞাসা কল্লো, “বাপ, এটির দাম কি নেবে? ঠিক বল, তাই দেওয়া যাবে।” জেলে বল্লে, “মশাই! এর দাম বিশ ঘা জুতো।” কৰ্মকর্ত্তা বিশ ঘা জুতো শুনে অবাক হয়ে রইলেন। মনে কল্লেন, জেলে বাদলা পেয়ে মদ খেয়ে মাতাল হয়েছে, নয়ত পাগল। কিন্তু জেলে কোন ক্রমেই বিশ ঘা জুতো ভিন্ন মাছটি দিবে না, এই তার পণ হলো। নিমন্তুন্নে, বাড়ীর কর্তা ও চাকর-বাকরেরা জেলের এ আশ্চর্য্য দাম শুনে তারে কেউ পাগল, কেউ মাতাল বলে ঠাট্টা-মস্করা কত্তে লাগলো; কিন্তু কোন রকমেই জেলের গো ঘুচলো না। শেষে কর্ম্মকর্ত্তা কি করেন, মাছটি নিতেই হবে, আস্তে আস্তে জেলেকে বিশ ঘা জুতো মাত্তে রাজী হলেন, জেলেও অম্লানবদনে পিঠ পেতে দিলে। দশ ঘা জুতো জেলের পিঠে পড়বা মাত্র জেলে “মশাই! একটু থামুন, আমার একজন অংশীদার আছে, বাকী দশ ঘ সেই খাবে, আপনার দরোয়ান–দরজার বসে আছে, তারে ডেকে পাঠান। আমি যখন বাড়ীর ভিতরে মাছ নিয়ে আসছিলেম, তখন মাছের অর্ধেক দাম না দিলে আমারে ঢুকতে দিবে না বলেছিল, সুতরাং আমিও অর্ধেক বখরা দিতে রাজী হয়েছিলেম।” কর্ম্মকর্ত্তা তখন বুঝতে পাললেন, জেলে কিজন্য মাছের দাম বিশ ঘা জুতো চেয়েছিল। দরোয়াজীকে দরজায় বসে আর অধিকক্ষণ জেলের দামের বখরার জন্য প্রতীক্ষা করে থাকতে হলো না; কর্ম্মকর্ত্তা তখনি দরোয়ানজীকে জলের বিশ ঘার অংশ দিলেন। পাঠক বড়মানুষেরা! এই উপন্যাসটি মনে রাখবেন।

হুজুর দেড়হাত উঁচু গদীর উপরে তাকিয়ে ঠেস দিয়ে বসে আছে, গা আদুর! পাশে মুন্সীমশায় চসমা চোখে দিয়ে পেস্কারের সঙ্গে পরামর্শ কচ্চে—সামনে কতকগুলো খোলা থাতা ও একঝুড়ি চোতা কাগজ, আর একদিকে পাঁচজন ব্রাহ্মণপণ্ডিত বাবুকে “ক্ষণজন্ম”, “যোগভ্রষ্ট” বলে তুষ্ট করবার অবসর খুঁজচেন। গদীর বিশ হাত অন্তরে দুজন বেকার ‘উমেদার’ ও একজন বৃদ্ধ কন্যাদায় কাঁদো কাঁদো মুখ করে ঠিক ‘বেকার’ ও ‘কন্যাদায়’ হালতের পরিচয় দিচ্চেন। মোসাহেবের খালি গায়ে ঘুর-ঘুর কচ্ছে, কেউ হুজুরের কাণে কাণে দু-চার কথা কচ্চেন—হুজুর ময়ূরহীন কার্ত্তিকের মত আড়ষ্ট হয়ে বসে রয়েছেন। দত্তবাবু গিয়ে নমস্কার কললেন।

হুজুর বারোইয়ারি-পূজার বড় ভক্ত,পূজার কদিন দিবারাত্রি বারোইয়ারিতলাতেই কাটান। ভাগ্নে, মোসাহেব, জামাই ও ভগিনীপতি বারোইয়ারির জন্য দিনরাত শশব্যস্ত থাকেন।

দত্তবাবু বারোইয়ারি-বিষয়ক নানা কথা কয়ে হজুরি সবষ্ক্রিপসন হাজার টাকা বিদেয় নিলেন! পেমেন্টের সময় দাওয়ানজী শতকরা দু টাকার হিসাবে দস্তুরী কেটে ন্যান, দত্তজা ঘরপোড়া কাঠের হিসাবে ও দাওয়ানজীকে খুশী রাখবার জন্য তাতে আর কথা কইলেন না। এদিকে বাবু বারোইয়ারি পূজার ক-রাত্রি কোন্‌ কোন্ রকম পোষাক পরবেন, তার বিবেচনায় বিব্রত হলেন।

কানাইবাবু বারোইয়ারি-বই নিয়ে না খেয়ে বেলা দুটো অবধি নানা স্থানে ঘুরলেন, কোথাও কিছু পেলেন, কোথাও মস্ত টাকা সই মাত্র হলো; (আদায় হবে না, তার ভয় নাই), কোথাও গলা ধাক্কা, তামাসা ও ঠোনাটা-ঠানাটাও সইতে হলো।

বিশ বচ্ছর পূর্ব্বে কলকেতার বারোইয়ারির চাঁদা-সাধারা প্রায় দ্বিতীয় অষ্টমের পেয়াদা ছিলেন–ব্রহ্মোত্তর জমির খাজানা সাধরি মত লোকের উনোনে পা দিয়ে টাকা আদায় কত্তেন, অনেক চোটের কথা কয়ে, বড়মানুষেদের তুষ্ট করে টাকা আদায় কত্তেন।

একবার এক বারোইয়ারি-পাণ্ডারা এক চক্ষু কাণা এক সোণার বেণের কাছে চাঁদা আদায় কত্তে যান। বেণেবাবু বড়ই কৃপণ ছিলেন, “বাবার পরিবারকে” (অর্থাৎ মাকে) ভাত দিতেও কষ্ট বোধ কত্তেন, তামাক খাবার পাতের শুকনো নলগুলি জমিয়ে রাখতেল; একবৎসরের হলে ধোপাকে বিক্রী কত্তেন, তাতেই পরিবারের কাপড় কাচার দাম উসুল হতো। বারোইয়ারি-অধ্যক্ষেরা বেণেবাবুর কাছে চাঁদার বই ধল্লে, তিনি বড়ই রেগে উঠলেন ও কোন মতে এক পয়সাও বারোইয়ারিতে বাজে খরচ কত্তে রাজি হলেন না। বারোইয়ারির অধ্যক্ষের ঠাউরে ঠাউরে দেখলেন, কিন্তু বাবুর বাজে খরচের কিছুই নিদর্শন পেলেন না; তামাক গুলি পাকিয়ে কোম্পানীর কাগজের সঙ্গে বাক্সমধ্যে রাখা হয়—বালিসের ওয়াড়, ছেলেদের পোষাক বেণেবাবু অবকাশমত স্বহস্তেই সেলাই করেন—চাকরদের কাছে (একজন বুড়ো উড়ে মাত্ৰ) তামাকের গুল, মুড়ো খেংরার দিনে দুবার নিকেশ নেওয়া হয়—ধুতি পুরণো হলে বদল দিয়ে বাসন কিনে থাকেন। বেণেবাবুর ত্রিশ লক্ষ টাকার কোম্পানীর কাজ ছিল; এ সওয়ায় সুদ ও চোটায় বিলক্ষণ দশ টাকা আসতো; কিন্তু তার এক পয়সা খরচ কত্তেন না; (পৈতৃক পেসা)। খাঁটি টাকায় মাকু চালিয়ে যা রোজগার কত্তেণ, তাতেই সংসারনির্ব্বাহ হতো; কেবল বাজে খরচের মধ্যে, একটা চক্ষু, কিন্তু চসমায় দুখানি পরকলা বসানো। তাই দেখে, বারোইয়ারির অধ্যক্ষেরা ধরে বলেন, “মশাই! আপনায় বাজে খরচ ধরা পড়েছে, হয় চসমাখানির একখানি পরকলা খুলে ফেলুন, নয় আমাদের কিছু দিন।” বেণেবাবু এ কথায় খুসী হলেন; অনেক কষ্টে দুটি সিকি পর্যন্ত দিতে সম্মত হয়েছিলেন।

আর একবার বারোইয়ারি-পূজোর এক দল অধ্যক্ষ সহরের সিঙ্গিবাবুদের বাড়ী গিয়ে উপস্থিত; সিঙ্গিবাবু সে সময় অফিসে বেরুচ্ছিলেন, অধ্যক্ষেরা চার-পাঁচ জনে তাহাকে ঘিরে ধরে ‘ধরেছি, ধরেছি’ বলে চেঁচাতে লাগলেন। রাস্তায় লোক জমে গেল, সিঙ্গিবাবু অবাক্–ব্যাপারখানা কি? তখন একজন অধ্যক্ষ বল্লেন, “মশায়! আমাদের অমুক জায়গায় বারোইয়ারিপূজোয় মা ভগবতী সিঙ্গির উপর চড়ে কৈলাস থেকে আসছিলেন, পথে সিঙ্গির পা ভেঙ্গে গেছে; সুতরাং তিনি আর আসতে পাচ্ছেন না, সেইখানেই রয়েছেন; আমাদের স্বপ্ন দিয়েছেন যে, যদি আর কোন সিঙ্গির যোগাড় কত্তে পার, তা হলেই আমি যেতে পারি। কিন্তু মহাশয়! আমরা আজ একমাস নানা স্থানে ঘুরে বেড়াচ্চি, কোথাও আর সিঙ্গির দেখা পেলেন না। আজ আপনার দেখা পেয়েচি, কোন মতে ছেড়ে দেবো না–চলুন, যাতে মার আসা হয়, তাই তদ্বির করবেন। সিঙ্গিবাবু অধ্যক্ষদের কথা শুনে সন্তুষ্ট হয়ে, বারোইয়ারির চাঁদায় বিলক্ষণ দশ টাকা সাহায্য কল্লেন।

এ ভিন্ন বারোইয়ারির চাঁদা-সাধা বিষয়ে নানা উদ্ভট কথা আছে। কিন্তু এখানে সে সকলের উত্থাপন নিষ্প্রয়োজন। পূৰ্ব্বে চুঁচড়োর মত বারোইয়ারি-পূজা আর কোথাও হতো না, “আচাভো’, ‘বোম্বোচাক’ প্রভৃতি সং প্রস্তুত হতে; সহরের ও নানাস্থলের বাবুরা বোট, বজরা, পিনেস ও ভাউলে ভাড়া করে সং দেখতে যেতেন। লোকের এত জনতা হতো যে, কলপাত এক টাকায় একখানি বিক্রী হতো, চোরেরা আণ্ডীল হয়ে যেতো; কিন্তু গরীব, দুঃখী গেরস্তোর হাঁড়ি চড়তো না। গুপ্তিপাড়া, কাঁচড়াপাড়া, শান্তিপুর, উলো প্রভৃতি কলকেতার নিকটবর্তী পল্লীগ্রামে ক’বার বড় ধুম করে বারোইয়ারি-পূজো হয়েছিল। এতে টক্করাটক্করিও বিলক্ষণ চলেছিল। একবার শান্তিপুরওয়ালারা পাঁচ লক্ষ টাকা খরচ করে এক বারোইয়ারি-পূজো করেন; সাত বৎসর ধরে তার উজ্জুগ হয়, প্রতিমাখানি ষাট হাত উঁচু হয়েছিল। শেষে বিসর্জ্জনের দিনে প্রত্যেক পুতুল কেটে কেটে বিসর্জ্জন কত্তে হয়েছিল, তাতেই গুপ্তিপাড়াওয়ালার ‘মার’ অপঘাতমৃত্যু উপলক্ষে গণেশের গলায় কাচা বেঁধে এক বারোইয়ারি পূজো করেন, তাতেও বিস্তর টাকা ব্যয় হয়!

এখন আর সে কাল নাই; বাঙ্গালী বউমানুষদের মধ্যে অনেক সভ্য হয়েচেন। গোলাপজল দিয়ে জলশৌচ, ঢাকাই কাপড়ের পাড় ছিঁড়ে পরা, মুক্তাভস্মের চূণ দিয়ে পান খাওয়া, এখন আর শোনা যায় না। কুকুরের বিয়েয় লাখ টাকা খরচ, যাত্রায় নোট প্যালা, তেল মেখে চার ঘোড়ার গাড়ী চড়ে ভেপু বাজিয়ে স্নান কত্তে যাওয়া, সহরে অতি কম হয়ে পড়েছে। আজ্ঞা হুজুর, উঁচু গদী, কার্ত্তিকের মত বাউরি-কাঁটা চুল, একপাল বরাখুরে মোসাহেব, রক্ষিত বেশ্যা আর পাকান কাছা–জলস্তম্ভ আর ভূমিকম্পের মত—’কখনোর’ পাল্লায় পড়েছে!

কায়স্থ, ব্রাহ্মণ বড়মানুষ (পাড়াগেঁয়ে ভুতেরা ছাড়া প্রায় মাইনে-করা মোসাহেব রাখেন না; কেবল সহরে দু’চার বেণে বড়মানুষই মোসাহেবদের ভাগ্যে সুপ্রসন্ন। বুক-ফোলান, বাঁকা সীঁথি, পইতের গোছা গলায়, কুঁচের মত চক্ষু লাল, কাণে তুলোয় করা আতর (লেখাপড়া সকল রকমই জানেন, কেবল বিস্মৃতিক্রমে বর্ণপরিচয়টি হয় নাই) আমরা খালি বেণে বড় মানুষ বাবুদের মজলিশে দেখতে পাই।

মোসাহেবী পেশা উঠে গেলেই, ‘বারোইয়ারি’, ‘খেমটা’, ‘চেহেল’ ও ‘ফররার’ লাঘব হবে সন্দেহ নাই।

সন্ধ্যা হয় হয় হয়েচে–গয়লারা দুধের হাঁড়া কাঁধে করে দোকামে যাচ্ছে। মেছুনীরা আপনাদের পাটা, বঁটি ও চুবড়ি ধুয়ে প্রদীপ সাজাচ্ছে! গ্যাসের আলো-জ্বালা মুটেরা মৈ কাঁধে করে দৌডুচ্চে, থানার সামনে পাহারাওয়ালাদের প্যারেড (এঁরা লড়াই করবেন, কিন্তু মাতাল দেখে ভয় পান) হয়ে গিয়েছে। ব্যাঙ্কের ভেটো কেরাণীরে ছুটি পেয়েছেন। আজ এ সময়ে বীরকৃষ্ণ দাঁর গদীতে বড় ধূম—বাবোইয়ারির অধ্যক্ষেরা একত্র হয়ে কোন কোন রকম সং হবে, কুমোরকে তারি নমুনা দেখাবেন, কুমোর নমুনো-মত সং তৈয়ের করবে, দাঁ মহাশর ও ম্যানেজার কানাইধন দত্তজা সমুনোর মুখপাত!

ফৌজদুরী বালাখানা থেকে ভাড়া করে এনে, কুড়িটি বেল লণ্ঠন (রং-বেরং—সাদা, গ্রিন, লাল) টাঙ্গান হয়েছে। উঠোনে প্রথমে খড়, তার উপর দরমা, তার উপর মাদরাজি খেরোর জাজিম হাসচে। দাঁড়িপাল্লা, চ্যাটা, কুলো ও চালুনীরে, গণিগব্যাগ ও ছেঁড়া চটের আশপাশ থেকে উঁকি-ঝুঁকি মাচ্চে—আর তারা ঘরজামাই ও অন্নদাস-ভাগ্নের দলে গণ্য।

বীরকৃষ্ণবাবু ধূপছায়া চেলীর জোড় এবং কলার-কপ ও প্লেটওয়ালা (ঝাড়ের গেলাশের মত) কামিজ ও ঢাকাই ট্যার্চ্চা কাজের চাদরে শোভা পাচ্ছে, রুমালখানি কোমরে বাঁধা আছে—সোনা চাবি-শিক্লী, কোঁচা ও কামিজের উপর ঘড়ির চেনের অফিসেয়েটিং হয়েছে।

পাঠক! নবাবী আমল শীতকালের সূর্যের মত অস্ত গেল। মেঘন্তের রৌদ্রের মত ইংরেজদের প্রতাপ বেড়ে উঠলো। বড় বড় বাঁশঝাড় সমূলে উচ্ছন্ন হলো। কঞ্চিতে বংশলোচন জন্মাতে লাগলো। গবো মুন্সী, ছিরে বেণে ও পুঁটে তেলী রাজা হলো। সেপাই পাহারা, আনা-সোটা ও রাজা খেতাপ, ইণ্ডিয়া রবরের জুতো ও শান্তিপুরের ডুরে উড়ুনির মত রাস্তায় পাঁদাড়ে গড়াগড়ি যেতে লাগলো। কৃষ্ণচন্দ্র, রাজবল্পভ, মানসিংহ, নন্দকুমার, জগৎ শেঠ প্রভৃতি বড় বড় ঘর উৎসন্ন যেতে লাগলো, তাই দেখে হিন্দুধৰ্ম্ম, কবির মান, বিদ্যার উৎসাহ, পরোপকার নাটকের অভিনয় দেশ থেকে ছুটে পালালো। হাফ-আখড়াই, ফুল-আখড়াই পাঁচালী ও যাত্রার দলেরা জন্মগ্রহণ কলে, সহরের যুবকদল গোধুরী, ঝকমারী ও পক্ষীর দলে বিভক্ত হলেন। টাকা বংশগৌরবকে ছাপিয়ে উঠলেন। রামা মুদ্দফরাস, কেষ্টা বাগদী, পেঁচো মল্লিক ও ছুঁচো শীল ককেতার কায়েত-বামুনের মুরুব্বী ও সহরের প্রধান হয়ে উঠলো। এ সময়ে হাফ আখড়াই ও ফুল-অখিড়াইয়ের সৃষ্টি ও এই অবধি সহরের বড়মানুষেরা হাফ-আখাড়াইয়ে আমোদ কত্তে লাগলেন। শামবাজার, রামবাজার চক ও সাঁকোর বড় বড় নিষ্কর্মা বাবুর৷ এক এক হাফ-আখড়াই দলের মুরুব্বী হলেন। মোসাহেব, উমেদার, পাড়াস্থ ও দলস্থ গেরস্তগোছ হাড়হাভাতেরা সৌধীন দোহারের দলে মিশলেন। অনেকের হাফ-আখড়াইয়ের পুণ্যে চাকরী জুটে গেল। অনেকে পূজুরী দাদাঠাকুরের অবস্থা হতে একেবারে আমীর হয়ে পড়লেন—কিছুদিনের মধ্যে তকমা বাগান, জুড়ী ও বালাখানা বনে গেল!

আমরা পূর্ব্বে পাঠকদের যে বারোইয়ারি-পূজোর কথা বলে এসেচি, বীরকৃষ্ণ দাঁর উজ্জুগে প্রথম রাত্রি সেই বারোইয়ারিতলায় হাফ-আখড়াই হবে, তার উজ্জুগ হচ্ছে।

ধোপাপুকুর লেনের দুইয়ের নম্বর বাড়ীটিতে হাফ-আখড়াইয়ের দল বসেচে-বীরষ্ণেবাবু বগী চ’ড়ে প্রত্যহ আড্ডায় এসে থাকেন। দোহারেরা কুঠি থেকে এসে হাত-মুখ ধুয়ে জলযোগ করে রাত্রি দশটার পর একত্রে জমায়েৎ হন–ঢাকাই কামার, চাষাধোপা, পুঁটেতেলী ও ফলারে বামুনই অধিক। মুখুয্যেদের ছোটবাবু অধ্যক্ষ। ছোটবাবু ইয়ারের টেক্কা, বেশ্যার কাছে চিড়িয়ার গোলাম ও নেশায় শিবের বাবা! শরীর ডিগ্‌ডিগে, পুইতে গোচ্ছা ক’রে গলায়, দাঁতে মিশি, প্রায় আধহাত চেটালো কালা ও লালপেড়ে চক্ৰবেড়ের ধুতি পরে থাকেন। দেড়ভরি আফিম, দেড়শ ছিলিম গাঁজা ও একজালা তাড়ী রোজকী মৌতাতের উঠনো বন্দোবস্ত। পাল-পার্ব্বণে ও শনিবারে বেশী মাত্রা চড়ান!

অমাবস্যার রাত্রি–অন্ধকারে ঘুরঘুট্টি–গুড় গুড় করে নড়ছে না, মাটি থেকে যেন আগুনের তাপ বেরুচ্চে, পথিকেরা এক একবার আকাশ-পানে চাচ্ছেন, আর হন্ হন্ করে চলেচেন-কুকুরগুলো খেউ ঘেউ কচ্চে, দোকানীরে ঝাঁপড়া বন্ধ করে ঘরে যাবার উজ্জুগ কচ্চে,–গুডুম করে “নটার” তোপ পড়ে গেল। পোপাপুকুর লেনের দুইয়ের নম্বরের বাড়ী আজ বড়ই ধূম। ঢাকার বীরকৃষ্ণবাবু, চকবাজারের প্যালানাথবাবু, দলপতি বাবুয়ো ও দু-চার গাইয়ে ওস্তাদও আসবেন। গাওনার সুর বড় চমৎকার হয়েছে–দোহারেরাও মিলে ও তালে দোরস্ত।

সময় কারুরই হাত-ধর নয়–নদীর স্রোত্রে মত, বেশ্যার যৌবনের মত ও জীবের পরমায়ুর মত, কারুরই অপেক্ষা করে না! গির্জ্জের ঘড়িতে ঢং ঢং ঢং করে দশটা বেজে গেল, সোঁ সোঁ করে একটা বড় ঝড় উঠলো, রাস্তার ধূলো উড়ে যেন অন্ধকার অরো বাড়িয়ে দিলে–মেঘের কড়মড় কড়মড় ডাক ও বিদ্যুতের চমকানিতে ক্ষুদে ক্ষুদে ছেলেরা মার কোলে কুণ্ডুলী পাকাতে আরম্ভ কল্লে–মুষলের ধারে ভারী একপসলা বৃষ্টি এলো।

এদিকে দুয়ের নম্বরের বাড়ীতে অনেকে এসে জমতে লাগলেন। অনেকে সকলের অনুরোধে ভিজে ঢ্যাপঢ্যাপে হয়ে এলেন। চারডেলে দেয়ালগিরিতে বাতি জ্বলচে—মজলিস জক জক কচ্চে–পান, কলাপাতের এঁটো নল ও থেলো হুঁকোর কুরুক্ষেত্তর! মুখুয্যেদের ছোটবাবু লোকের খাতির কচ্চেন––‘ওরে’ ‘ওরে’ ক’রে তার গলা চিরে গ্যাচে। তেলী, ঢাকাই কামার ও চাষাধোপা দোহারেরা একপেট ফির্নি মেটো, ঘণ্টো ও আটা-নেবড়ান-লুসে, ফরসা ধুতি-চাদরে ফিট হয়ে বসে আছেন, অনেকের চক্ষু বুজে এসেচে–বাতির আলো জোনাকী-পোকার মত দেখছেন ও এক একবার ঝিমকিনি ভাঙলে মনে কচ্চেন, যেন উড়চি। ঘরটি লোকারণ্য—সকলেই খাতায় খাতায় ঘিরে বসে আছেন—থেকে থেকে ফুক্কুড়ি টপ্পাটা চলচে,—অনেক সেয়ানা ফরমেসে জুতো-জোড়াটি হয় পকেটে, নয় পার নীচে রেখে চেপে বসেচেন;–জুতো এমনি জিনিস যে, দোহারদলের পরস্পরেও বিশ্বাস নাই! চকবাজারের প্যালানাথবাবুর অপেক্ষাতেই গাওনা বন্ধ রয়েছে, তিনি এলেই গাওনা আরম্ভ হবে। দু-একজন ধরতা দোহার প্যালানাথবাবুর আসবার অপেক্ষায় থাকতে বেজার হচ্চেন–দু-একজন “তাই ত” বলে দাদার বোলে বোল দিচ্চে; কিন্তু প্যালানাথবাবু বারোইয়ারির একজন প্রধান ম্যানেজার, সৌখীন ও খোসপোষাকীর হদ্দ ও ইয়ারের প্রাণ! সুতরাং তার অপেক্ষা না কল্লে তাঁর অপমান করা হয়, ঝড়ই হোক, বজ্রাঘাতই হোক আর পৃথিবী কেন রসাতলে যাক না, তাঁর এসব বিষয়ে এমন সখ যে, তিনি অবশ্যই আসবেন।

ধতা দোহার গোবিন্দবাবু বিরক্ত হয়ে নাকিসুরে ‘মনালে বঁদিয়া’ জিক্কুর টপ্পা ধরেছেন;–গাঁজার হুঁকো একবার এ থাকের পাশ মেরে ও থাকে গেল। ঘরের এককোণে হুঁকো থেকে আগুন পড়ে যাওয়ায়, সে দিকের থাকেরা রল্লা করে উঠে দাঁড়িয়ে কোঁচা ও কাপড় ঝাড়চেন ও কেমন করে আগুন পড়লো, প্রত্যেকে তারই পঞ্চাশ রকম ডিপোজিশন দিচ্চেন;—এমন সময় একখান গাড়ী গড় গড় করে এসে দরজায় লাগলো। মুখুয্যেদের ছোটবাবু মজলিস থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে, বারাণ্ডায় গিয়ে “প্যালানাথবাবু! প্যালানাথবাবু এলেন” বলে চেঁচিয়ে উঠলেন;–দোহারদলে হুররে ও রৈ-রৈ পড়ে গেল,–ঢোলে রং বেজে উঠলো। প্যালানাথবাবু উপরে এলেন–শেকহ্যাণ্ড, গুড ইভনীং ও নমস্কারের ভিড় ঢুকতে আধঘণ্টা লাগলো।

চকবাজারের বাবু প্যালানাথ একহারা বেঁটেখেঁটে মানুষ, গত বৎসর পঞ্চাশ পেরিয়েচেন; বাবু বড় হিন্দু–একাদশী-হরিবাসর ও রাধাষ্টমীতে উপোস, উত্থানও নির্জলা করে থাকেন; বাবুর মেজাজ গরিব। সৌখীনের রাজা! ১২১৯ সালে সারবর্‌ন সাহেবের নিকট তিনমাস মাত্র ইংরেজী লেখাপড়া শিখে ছিলেন, সেই সম্বলেই এতদিন চলচে–সর্ব্বদা পোষাক ও টুপী পরে থাকেন; (টুপীটি এমনি হেলিয়ে হেলিয়ে পরা হয়ে থাকে যে, বাবুর ডান কাণ আছে কি না হঠাৎ সন্দেহ উপস্থিত হয়); লক্ষ্ণৌ ফ্যাশানে (বাইজীর ভেডুয়ার মত) চুড়িদার পায়জামা, রামজামা, কোমরে দোপাটা ও মাথায় বাঁকা টুপী, তাঁর মনোমত পোষাক। বাঈ ও খেমটা মহলে প্যালানাথবাবুর বড় মান! তাদের কোন দায়-দখল পড়লে বাবু আড় হয়ে পড়ে আফোতে তামায করেন, বাঈয়ের অনুরোধে হিন্দুয়ানী মাথায় রেখে কাছা খুলে ফয়তা দেন ও বাবোইয়ারির নামে তযবি পড়েন। মোসলমান-মহলেও বাবুর বিলক্ষণ প্রতিপত্তি! অনেক লক্ষ্ণৌয়ে পাতি ও ইরাণী চাপদাড়ি বাবুর বুজরুকি ও কেরামতের অনিয়ম এনসাফ করে থাকেন! ইংরেজী কেতা বাবুর ভাল লাগে না; মনে করেন, ইংরেজী লেখাপড়া শেখা শুদ্ধ কাজ চালাবার জন্য। মোসলমান-সহবাসে প্রায় দিবারাত্রি থেকে থেকে ঐ কেতাই এঁর বড় পছন্দ! সর্ব্বদাই নবাবী আমলের জাঁকজমক, নবাবী আমীরী ও নবাবী মেজাজের কথা নিয়ে নাড়াচাড়া হয়।

এদিকে দোহারের নতুন সুরের গান ধল্লেন। ধোপাপুকুর রন্‌ রন্‌ কত্তে লাগলো; ঘুমন্ত ছেলেরা মার কোলে চমকে উঠলো কুকুরগুলো খেউ খেউ করে উঠলো;–বোধ হতে লাগলো যেন, হাড়ীরে গোটাকতক শূয়ার ঠেঙ্গিয়ে মাচ্চে! গাওনার নতুন সুর শুনে সকলেই বড় খুসী হয়ে ‘সাবাস! বাহবা!’ ও শোভান্তরীর বৃষ্টি কত্তে লাগলেন–দোহারের উৎসাহ পেয়ে দ্বিগুণ চেঁচাতে লাগলো,– সমস্ত দিন পরিশ্রম করে ধোপারা অঘোরে ঘুমুচ্ছিলো, গাওনার বেতরো আওয়াজে চমকে উঠে খোটা ও দড়ি নিয়ে দৌডুলো! রাত্রি দুটো পর্যন্ত গাওনা হয়ে, শেষে সে রাত্রের মত বেদব্যাস বিশ্রাম পেলেন–দোহার, সৌখীন বাবু অধ্যক্ষের অন্ধকারে অতিকষ্টে বাড়ী গিয়ে বিছানার আড় হলেন!

এদিকে বারোইয়ারিতলায় সং গড়া শেষ হয়েচে। একমাস মহাভারতের কথা হচ্ছিলো, কাল তাও শেষ হবে; কথক বেদীর উপর ব’সে বৃষোৎসর্গের ষাঁড়ের মত ও বলিদানের মহিষের মত মাথায় ফুলের মালা জড়িয়ে রসিকতার একশেষ কচ্চেন, মূল পুঁথির পানে চাওয়া মাত্র হচ্চে, বস্তুতঃ যা বলছেন, সকলি কাশীরাম খুড়োর উচ্ছিষ্ট ও কোনটা বা স্বপাক। কথকতা পেশাটা ভাল–দিব্য জলখাবার, দিব্য হাতপাখার বাতাস; কেবল মধ্যে মধ্যে কোন কোন স্থলে আহার বিহারের আনুষঙ্গিক প্রহারটা সইতে হয়, সেইটেই মহান কষ্ট। পূৰ্ব্বে গদাধর শিরোমণি, রামধন তর্কবাগীশ, হলধর, পঞ্চানন প্রভৃতি প্রধান প্রধান কথক ছিলেন; শ্রীধর অল্পবয়সে বিলক্ষণ খ্যাত হন। বর্তমান দলে শাস্ত্রজ্ঞানের অপেক্ষা করেন না, গলাটা সাধা; চাণক্যশ্লোকের দু-আখর পাঠ ও কীর্তন-অঙ্গের দু’টো পদাবলী মুখস্থ করেই, মজুর কত্তে বেরোল ও বেদীতে বসে ব্যাস বধ করেন! কথা শোবার ও সং দেখবার জন্যে লোকের অম্ভব ভিড় হয়েছে–কুমোর, ভাওয়াল ও অধ্যক্ষেরা থেলো হুঁকোয় তামাক খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্চেন ও মিছে মিছে চেঁচিয়ে গলা ভাঙচেন! বাজে লোকের মধ্যে দু-একজন, আপনার আপনার কর্তৃত্ব দেখাবার জন্য, “তফাৎ তফাৎ কচ্চে, অনেকে গোছালো-গোছের মেয়েমানুষ দেখে, সঙের তরজমা করে বোঝাচ্চেন! সংগুলি বর্ধমানের রাজার বাঙ্গালা; মহাভারতের মত; বুঝিয়ে না দিলে মৰ্ম্ম গ্রহণ করা ভার!

কোথাও ভীষ্ম শরশয্যায় পড়েচেল—অর্জ্জুন পাতালে বাণ মেরে ‘ভোগবতী’র জল তুলে খাওয়াচ্চেন। জ্ঞাতির পরাক্রম দেখে, দুর্য্যোধন ফ্যাল্ ফ্যাল্‌ করে চেয়ে রয়েচেন। সঙদের মুখে ছাঁচ ও পোষাক সকলেরই এরকম, কেবল ভীষ্ম দুধের মত সাদা, অর্জ্জুন ডেমাটিনের মত কালো ও দুৰ্য্যোধন গ্রীণ।

কোথাও নবরত্নের সভা–বিক্রমাদিত্য বত্রিশ পুতুলের সিংহাসনের উপর আফিমের দালালের মত পোষাক পরে বসে আছেন। কালিদাস, ঘটকর্পর, ঝরাহমিহির প্রভৃতি নবরত্নেরা চারিদিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন—রত্নদের সকলেরই একরকম ধুতি, চাদর ও টিকি; হঠাৎ দেখলে বোধ হয়, যেন একদল অগ্রদানী ক্রিয়াবাড়ী চোকবার জন্য দরোওয়ানের উপাসনা কচ্চে।

কোথাও শ্ৰীমন্ত দক্ষিণ মশানে চৌত্রিশ অক্ষরে ভগবতার স্তব কচ্চেন, কোথাও কোটালেরা ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েচে–শ্ৰীমন্তের শাখার শালের শামলা, হাক ইংরাজী গোছের চাপকান ও পায়জামা পরা; ঠিক যেন একজন হাইকোর্টের প্লীডার প্লীড কচ্চেন! এক জায়গায় রাজসূয় যজ্ঞ হচ্ছে—দেশ দেশান্তরের রাজারা চারিদিকে ঘিরে বসেচেন—মধ্যে ট্যানা-পরা হোতা পোতা বামুনরা অগ্নিকুণ্ডের চারিদিকে বসে হোম কচ্চেন। রাজাদের পোষাক ও চেহারা দেখলে হঠাং বোধ হয়, যেন একদল দরোওয়ান স্যাকরার দোকানে পাহারা দিচ্চে।

কোনখানে রাম রাজা হয়েচেন;–বিভীষণ, জাম্বুবান, হনুমান ও সুগ্রীব প্রভৃতি বানরেরা, সহুরে মুচ্ছুদ্দি বাবুদের মত পোষাক পরে চারিদিকে দাঁড়িয়ে আছেন। লক্ষ্মণ ছাতা ধরেছেন—শত্রুঘ্ন ও ভরত চামর ব্যাঞ্জন কচ্চেন, রামের বাঁদিকে সীতা দেবী; সীতের ট্যার্চ্চা শাড়ী, ঝাঁপটা ও ফিরিঙ্গি খোঁপায় বেহদ্দ বাহার বেরিয়েছে।

“বাইরে কোঁচার পত্তন ভিতরে ছুঁচোর কেত্তন” সং বড় চমৎকার—বাবুর ট্যাসেল দেওয়া টুপী, পাইনাপোলের চাপকান, পেটি ও সিল্কের রুমাল, গলায় চুলের গার্ডচেন; অথচ থাকবার ঘর নাই, মাসীর বাড়ী অন্ন লুটেন, ঠাকু্রবাড়ী শোন, আর সেনেদের বাড়ী বসবার আড্ডা। পেট ভরে জলখাবার পয়সা নাই, অথচ দেশের রিফরমেশনের জন্য রাত্রে ঘুম হয় না (মশারির অভাবও ঘুম না হবার একটি প্রধান কারণ)। পুলিস, বড় আদালত, টালার নীলেম, ছোট আদালতে দিনের ব্যালা ঘুরে বেড়ান; সন্ধ্যে-ব্যালা ব্রাহ্মসভায়, মিটিং ও ক্লাবে হাঁপ ছাড়েন, গোয়েন্দাগিরি, দালালী, খোসামুদী ও ঠিকে-রাইটরী করে যা পান, ট্যাসল-ওয়ালা টুপী ও পাইনাপোলের চাপকান রিপু কত্তে ও জুতো বুরুসে সব ফুরিয়ে যায়! সুতরাং মিনি মাইনের স্কুলমাষ্টারীও কখন কখন স্বীকার কত্তে হয়।

কোথাও “অসৈরণ সৈতে নারি শিকেয় বসে কুলে মরি” সং;—“অসৈরণ সইতে নারি” মহাশয়, ইয়ং বাঙ্গালীদের টেবিলে খাওয়া, পেণ্টুলেন ও (ভয়ানক গরমিতেও) বনাতের বিলিতী কোট-চাপকনি পরা, (বিলক্ষণ দেখতে পান অথচ) নাকে চসমা, রাত্তিরে থানায় পড়ে ছুঁচো ধরে থান, দিনের বেলা রিফরমেশনের স্পিচ করেন দেখে–শিকেয় ঝুলচেন।

এ সওয়ায় বারোইয়ারিতলায় “ভাল কত্তে পারবো না মন্দ করবো, কি দিবি তা দে,” “বুক ফেটে দরজা,” “ঘুটে পোড়ে গোবর হাসে,” “কাণা পুতের নাম পদ্মলোচন,” “মদ খাওয়া বড় দায় জাত থাকার কি উপায়,” “হাড়-হাবাতে মিছরির ছুরি” প্রভৃতি নানাবিধ সং হয়েছে; সে সব আর এখানে উত্থাপন করার অবশ্যক নাই। কিন্তু প্রতিমের দু-পাশে “বকা ধার্ম্মিক” ও “ক্ষুদে নবাবের” সং বড় চমৎকার হয়েছে; বকা ধার্ম্মিকের শরীরটি মুচির কুকুরের মত নুদুর নাদুর–ভুঁড়িটি বিলাতী কুমড়োর মত–মাথা কামান চৈতন ফক্কা ঝুঁটি করে বাঁধা। গলায় মালা ও ঢাকের মত গুটিকতক সোণার মাদুলী—হাতে ইষ্টিকবচ–চুলে ও গোঁফে কলপ দেওয়া–কালাপেড়ে ধুতি, রামজামা ও জরির বাঁকাতাজ; গত বৎসর আশী পেরিয়েছেন–অঙ্গ ত্রিভঙ্গ! কিন্তু প্রাণ হামাগুড়ি দিচ্চে। গেরস্ত-গোচের ভদ্রলোকের মেয়েছেলের পানে আড়চক্ষে চাচ্ছেন—হরিনামের মালার ঝুলিটি ঘুরচ্চেন! ঝুলির ভিতর থেকে গুটিকতক টাকা বেমালূম আওয়াজে লোভ দেখাচ্চে!

ক্ষুদ্র নবাব,–ক্ষুদ্র নবাব দিব্যি দেখতে—দুধে আলতার মত রং–আলবার্ট ফেশানে চুল ফেরানো–চীনের শূয়ারের মত শরীরটি ঘাড়ে-গর্দ্দানে হাতে, লাল রুমাল ও পিচের ইষ্টিক–সিমলের ফিনফিনে ধুতি মালকোঁচা করে পরা–হঠাৎ দেখলে বোধ হয়, রাজরাজড়ার পৌত্তর; কিছু পরিচয়ে বেরোবে “হৃদে জোলার নাতি!”

বারেইয়ারি প্রতিমাখানি প্রায় বিশ হাত উঁচু–ঘোড়ায় চড়া হাইল্যাণ্ডের গোরা, বিবি, পরী ও নানাবিধ চিড়িয়া, শোলার ফুল ও পদ্ম দিয়ে সাজানো; মধ্যে মা ভগবতী জগদ্ধাত্রী-মুৰ্ত্তি–সিঙ্গি গায় রূপুলি গিলটি ও হাতী সবুজ মকমল দিয়ে মোড়া। ঠাকুরুণের বিবিয়ানা মুখ, রং ও গড়ন আসল ইহুদী ও আরমানী কেতা, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ও ইন্দ্র দাঁড়িয়ে যোড়হাত করে স্তব কচ্চেন। প্রতিমের উপরে ছোট ছোট বিলাতী পরীরা ভেপু বাজাচ্চে হাতে বাদশাই নিশেন ও মাঝে খোড়াসিঙ্গিওয়ালা কুইনের ইউনিফরম ও ফ্রেষ্ট!

আজ বাবোইয়ারির প্রথম পূজো, শনিবার—বীরকৃষ্ণ দাঁ, কানাই দত্ত প্যালানাথবাবু ও বীরকৃষ্ণবাবুর ফ্রেণ্ড আহিরীটোলার রাধামাধববাবুরো বেলা তিনটে পর্যন্ত বাবোইয়ারিতলায় হামরাও হয়েছিলেন;–তিনটে বড় বড় অর্ণা মোষ, একশ ভেড়া ও তিন-শ পাটা বলিদান করা হয়েছে; মুল নৈবিদ্যির আগা তোলা মোণ্ডাটি ওজনে দেড়মণ। সহরের রাজা, সিঙ্গি, ঘোষ, দে, মিত্র ও দত্ত প্রভৃতি বড় বড় দলস্থ ফোঁটা-চেলির জোড়, টিকি ও তিলকধারী উর্দ্দীপরা ও তকমাওয়ালা যত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের বিদেয় হয়েছে;–‘সুপারীস’, ‘আনাহূতো’, ‘বেদলে’ ও ‘ফলারেরা’ নিমতলার শকুনির মত টেঁকে বসে আছেন। কাঙ্গালী, রেয়ো, অগ্রদানী, ভাট ও ফকির বিস্তর জমেছিল; পাহারওয়ালারাই তাদের বিদেয় দেন, অনেক গরীব গ্রেপ্তার হয়।

ক্রমে সন্ধ্যা হয়ে এলো–বারোইয়ারিলা লোকারণ্য; সহরের অনেক বাবু গাড়ী চড়ে সং দেখতে এসেছেন—স’ এলে অনেকে তাঁদের দেখচে। ক্রমে মজলিসে দু-একটা ঝাড় জ্বেলে দেওয়া হলো। সঙদের মাথার উপর বেললণ্ঠন বাহার দিতে লাগলো। অধ্যক্ষবাবুরা একে একে জমায়েৎ হতে লাগলেন। নল-করা থেলো হুঁকো হাতে করে ও পান চিবুতে চিবুতে অনেকে চীৎকার ও ‘এটা কর ওটা কর’ ক’রে হুকুম দিচ্চেন। আজ ধোপাপাড়ার ও চকের দলের লড়াই হবে। দেড় মণ গাঁজা, দুই মণ চরস, বড় বড় সাত গামলা দুধ ও বারোখানি বেণের দোকান ঝেঁটিয়ে ছোট বড় মাঝারি এলাচ, কর্পূর দারুচিনি সংগ্রহ করা হয়েছে; মিঠেকড়া ভ্যালসা অম্বুরি ও ইরানি তামাকের গোবর্দ্ধন হয়েচে। এ সওয়ায় বিস্তর অন্তঃশিলে সরঞ্জামও প্রস্তুত আছে;আবশ্যক হলে দেখা দেবে।

সহরে ঢি ঢি হয়ে গেছে, আজ রাত্রে অমুক জায়গায় বারোইয়ারি পূজোর হাফ-আখড়াই হবে। কি ইয়ারগোচের স্কুল বয়, কি বাহাত্তুরে ‘ইনভেলিড’ সকলেই হাফ-আখড়াই শুনতে পাগল। বাজার গরম হয়ে উঠলো। ধোপারা বিলক্ষণ রোজগার কত্তে লাগলো। কোচান-ধুতি, ধোপদস্ত কামিজ ও ডুরে শান্তিপুরে উড়ুনীর এক রাত্রের ভাড়া আট আনা চড়ে উঠলো। চার পুরুষে পাঁচ পুরুষে ক্রেপ ও নেটের চাদরেরা, অকর্ম্মণ্য হয়ে নবাবী আমলে সিন্দুক আশ্রয় করেছিলেন, আজ ভলন্টিয়র হয়ে মাথায় উঠলেন। কালো ফিতের ঘুন্সি ও চাবির শিকলি, হঠাৎ বাবুর মত স্বস্থান পরিত্যাগ করে ঘড়ির চেনের অফিসিয়েটিং হলো–জুতোরা বেশ্যার মত নানা লোকের সেবা কত্তে লাগলো।

বারোইয়ারিতলায় লোকারণ্য হয়ে উঠলো, একদিকে কাঠগড়া ঘেরা মাটির সং–অন্যদিকে নানা রকম পোষাক-পরা কাঠগড়ার ধারে ও মধ্যে জ্যান্ত সং। বড়মানুষের ট্যাসলওয়ালা টুপী চাপকান, পেটি ও ইষ্টিকে চালচিত্রের অসুর হতেও বেয়াড়া দেখাচ্ছেন। প্রধান অধ্যক্ষ বীরকৃষ্ণবাবু লক্কাই লাট্টুর লাটিম মত ঘুরে বেড়াচ্চেন, দু’কস দিয়ে পাজির ছবির রক্তদন্তী রাক্ষসীর মত পানের পিক গড়িয়ে পড়ছে। চাকর, হরকরা, সরকার, কেরাণী ও ম্যানেজারদের নিশ্বেস এ্যালবার অবকাশ নাই।

ঢং ঢং ক’রে গির্জ্জের ঘড়ীতে রাত্রি দুটো বেজে গেল। ধোপাপাড়ার দল ভরপুর নেশায় ভোঁ হয়ে টলতে টলতে আসরে নাবলেন। অন্সেকে আখড়াঘরে (সাজঘরে শুয়ে পড়লেন। বাঙ্গালীর স্বভাবই এই, পরের জিনিস পাতে পড়লে শীগগির হাত বন্ধ হয় না; (পেট সেটি বোঝে না, বড় দুখের বিষয়!) দেড়ঘণ্টা ঢোল, বেহালা, ফুলোট, মোচাং ও সেতারের রং ও সাজ বাজলো, গোড়ার দু’শ বাহবা ও দু-হাজার বেশ দিলেন, শেষে একটি ঠাকরুণ বিষয় গেয়ে, (আমরা গানটি বুঝতে অনেক চেষ্টা কল্লেম, কিন্তু কোনমতে কৃতকার্য্য হতে পাল্লেম না) ধোপাপাড়ার দল উঠে গেল, চকের দল আসরে নাবলেন।

চকের দলেরাও ঐ রকম করে গেয়ে শোভান্তরী, সাবাস ও বাহবা নিয়ে উঠে গেলেন—একঘণ্টার জন্য মজলিস খালি রইলো; চায়নাকোট, ক্রেপের, নেটের ও ডুরে ফুলদার ট্যারচা চাদরো  পিঁপড়ের ভাঙ্গা সারের মত ছড়িয়ে পড়লেন। পানের দোকান শূন্য হয়ে গেল। চুরোট তামাক ও চরসের ধুয়ায় এমনি অন্ধকার হয়ে উঠলো যে, সেবাবে “প্রোক্লেমেশনের” উপলক্ষে বাজিতে বা কি ধোঁ হয়েছিল। বড় বড় রিভিউয়ের তোপে তত ধোঁ জন্মে না। আধঘণ্টা প্রতিমেখানি দেখা যায় নি ও পরস্পর চিনে নিতেও কষ্ট বোধ হয়েছিল।

ক্রমে হঠাৎ-বাবুর টাকার মত, বসন্তের কুয়াসার মত ও শরতেব মেঘের মত, ধোঁ দেখতে দেখতে পরিষ্কার হয়ে গেল। দর্শকেরা স্থির হয়ে দাঁড়ালেন, ধোপাপুকুরের দল আসোর নিয়ে বিরহ ধোল্লেন। আধঘণ্টা বিরহ গেয়ে আসোর হতে দলবল সমেত আবার উঠে গেলেন। চকবাজারেরা নাবলেন ও ধোপাপুকুরের দলের বিরহের উতোর দিলেন। গোঁড়ারা রিভিউয়ের সোজারদের মত দুল বেঁধে দু’ থাক হলো। মধ্যস্থেরা গানের চোতা হাতে করে বিবেচনা কত্তে আরম্ভ করেন–একদলে মিত্তির খুঁড়ো, আর একদলে দাদাঠাকুর বাঁধন্দার।।

বিরহের পর চাপা কাঁচা খেউড়; তাতেই হার-জিতের বন্দোবস্ত, বিচারও শেষ; (মধুরেণ সমাপয়েৎ) মারামারিও বাকি থাকবে না।

ভোরের তোপ পড়ে গিয়েছে, পূর্ব্বদিক্‌ ফরসা হয়েচে, ফুরফুরে হাওয়া উঠেচে-ধোপাপুকুরের দলেরা আসোর নিয়ে খেউড় ধলেন, “সাবাস! ‘বাহবা!’ ‘শোভান্তরী।’ ‘জিতা রও!’ দিতে দিতে গোড়াদের গলা চিরে গেল; এই তামাসা দেখতে যেন সূর্য্যদেব তাড়াতাড়ি উদয় হলেন। বাঙ্গালীরা আজো এমন কুৎসিত আমোদে মত্ত হন ব’লেই যেন—চাঁদ ভদ্রসমাজে মুখ দেখাতে লজ্জিত হলেন। কুমুদিনী মাথা হেঁট কল্লেন! পাখীরা ছি ছি ক’রে চেঁচিয়ে উঠলো! পদ্মিনী পাঁকের মধ্যে থেকে হাসতে লাগলো! ধোপাপুকুরের দল আসের নিয়ে খেউড় গাইলেন; সুতরাং চকের দলকে তার উতোর দিতে হবে। ধোপাপুকুরওয়ালার দেড়ঘণ্টা প্রাণপণে চেঁচিয়ে খেউড়টি গেয়ে থামলে, চকের দলেরা নাবলেন; সাজ বাজতে লাগলো। ওদিকে আখড়াঘরে খেউডের উতোর প্রস্তুত হতে লাগলো;–চকের দলেরা তেজের সহিত উতোর গাইলেন। গোঁড়ারা গবুম হয়ে “আমাদের জিত, আমাদের জিত।” করে চেঁচাচেঁচি কত্তে লাগলেন; (হাতাহাতি ও বাকি রইলো না) এদিকে মধ্যস্থেরাও চকের দলের জিত সাব্যস্ত কল্লেন। দুও! হো! হো! হুর্‌রে ও হাততালিতে ধোপাপুকুরের দলেরা মাটির চেয়ে অধম হয়ে গেলেন—নেশার খোয়ারি-রাত জাগবার ক্লেশ ও হারের লজ্জায় মুখুয্যেদের ছোটবাবু ও দু-চার ধরুতা দোহার একেবারে এলিয়ে পড়লেন।

চকের দলের ঢোল বেঁধে নিশেন তুলে, গাইতে গাইতে ঘরে চল্লেন-কারু কারু শুধু পা মোজা পায়; জুতো কোথায়, তার খোজ নাই। ওগোড়রা আমোদ কত্তে কত্তে পেছু পেছু চল্লেন-বেলা দশটা বেজে গেল; দর্শকরা হাফ-আখড়াইয়ের মজা ত্বপূর লুটে বাড়ীতে এসে সুত, ঠাণ্ডাই, জোলাপ ও ডাক্তারের যোগাড় দেখতে লাগলেন। ভাড়া করা ও চেয়ে নেওয়া চায়নাকোট, ধুতি, চাদর, জামা ও জুতোর কাজ সেরে, আপনার আপনার মনিববাড়ী ফিরে গেল।

আজ রবিবার। বারোইয়াবিতলায় পাঁচালী ও যাত্রা। রাত্রি দশটার পর অধ্যক্ষেরা এসে জমলেন; এখনো অনেকের ‘চোঁয়া ঢেকুর’ ‘মাথা-ধরা’, ‘গা মাটি মাটি’ সারে নি। পাঁচালী আরম্ভ হয়েচে-প্রথম দল গঙ্গাভক্তিতরঙ্গিণী, দ্বিতীয় দল মহীরাবণের পালা ধরেচেন, পাঁচালী ছোট কেতার হাফ-আখড়াই, কেবল ছড়া কাটানো বেশীর ভাগ; সুতরাং রাত্রি একটার মধ্যে পাঁচালী শেষ হয়ে গেল।

যাত্রা। যাত্রার অধিকারীর বয়স ৭৬ বৎসর, বাবরিকাটা চুল, কপালে উল্কী, কাণে মাকড়ি! অধিকারী দূতী সেজে, গুটিবারো বুড়ো বুড়ো ছেলেকে সখী সাজিয়ে আসোরে নাবলেন। প্রথমে কৃষ্ণ খোলের সঙ্গে নাচলেন, তারপর বাসুদেব ও মণিগোঁসাই গান করে গেলেন। সকেষ্ট সখী ও দূতী প্রাণপণে ভোর পর্যন্ত ‘কালো জল খাবো না!’ ‘কালো মেঘ দেখবো না!’ (জামিয়ানা খাটিয়ে দিমু) কালো কাপড় পরবো না!’ ইত্যাদি কথাবার্ত্তায় ও নবীন বিদেশিনীর। গানে লোকেন্দ্র মনোরঞ্জন কল্লেন! থাল, গাড়ু, বড়, ছেঁড়া কাপড়, পুরাণ ___ ও পচা শালের গাদী হয়ে গেল। টাকা, আধুলী, সিকি ও পয়সা পর্যন্ত প্যালা পেলেন! মধ্যে মধ্যে ‘বাবা দে আমার বিয়ে’ ও ‘আমার নাম সুন্দরে জেলে, ধরি মাছ, বাউতি জালে,’ প্রভৃতি রকমওয়ারি সঙের রকমওয়ারি গানেরও অভাব ছিল না। বেলা আটটার সময় যাত্রা ভাঙলো, একজন বাবু, মাতাল, পাত্র টেনে বিলক্ষণ পেকে যাত্রা শুনছিলেন, যাত্রা ভেঙে যাওয়াতে গলায় কাপড় দিয়ে প্রতিমে প্রণাম কত্তে গেলেন, (প্রতিমে হিন্দুশাস্ত্রসম্মত জগদ্ধাত্রী-মূর্ত্তি)। কিন্তু প্রতিমার সিঙ্গি হাতীকে কামড়াচ্ছে দেখে, বাবু মহাত্মার বড় রাগ হলো, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বাবু করুণার সুরে–

তারিণী গো মা কেন হাতীর উপর এত আড়ি।
মানুষ মেলে টেটা পেতে তোমায় বেতে হতো হরিণবাড়ী।।
সুর্কি কুটে সারা হতো, তোমার মুকুট যেত গড়াগড়ি।।
পুলিসের বিচারে শেষে সঁপতো তোমায় গ্ৰানযুড়ি।
সিঙ্গি মামা টেরটা পেতেন ছুটতে হতে উকীলবাড়ী।।

গান গেয়ে, প্রণাম করে চলে গেলেন।

সহরের ইতর মাতালদের (মাতালদের বড় ইতর-বিশেষ নাই, মাতাল হলে কি রাজা বাহাদুর, কি পালার বাপ, কি গোবরা প্রায় এক মূর্ত্তিই ধরে থাকেন। ঘরে ধরে রাখার লোক নাই বলেই আমরা নর্দমায়, রাস্তায়, খানায়, গারদে ও মদের দোকানে মাতলামি কত্তে দেখতে পাই। সহরে বড়মানুষ মাতালও কম নাই, শুদ্ধ ঘরে ধরে পুরে রাখবার লোক আছে বলেই তারা বেরিয়ে এখন মাতলামি কত্তে পান না। এদের মধ্যে অনেকে এমন মাতলামি করে থাকেন যে, অন্তরীক্ষ থেকে দেখলে পেটের ভিতর হাত-পা সেঁধিয়ে যায় ও বাঙ্গালী বড়মানুষদের উপর বিজাতীয় ঘৃণা উপস্থিত হয়। ছোটলোক মাতালের ভাগ্যে–চারি আনা জরিমানা–এক রাত্রি গারদে থাকা বা পাহারাওয়ালাদের ঝোলায় শোয়ার হয়ে যাওয়া ও জমাদারের দুই-এক কোঁৎকামাত্র। কিন্তু বাঙ্গালী বড়মানুষ মাতালদের সকল বিষয়ে শ্রেষ্ঠতা। পাখী হয়ে উড়তে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে মরা–বাবার প্রতিষ্ঠিত পুকুরে ডোবা, প্রতিমের নকল সিঙ্গি ভেঙ্গে ফেলে আসল সিঙ্গি হয়ে বসা, ঢাকীকে মার সঙ্গে বিসর্জ্জন দেওয়া, ক্যাণ্টনমেণ্ট, ফোর্ট, রেলওয়ে ষ্টেসন ও অবশেষে মদ খেয়ে মাতলামি করে চালান হওয়া, এ সব ত আছে। এ সওয়ায়, করুণা গান, বকসিস ও বক্তৃতার বেহদ্দ ব্যাপার।

একবার সহরের শ্যামবাজার অঞ্চলের এক বনেদী বড়মানুষের বাড়ীতে বিদ্যসুন্দর যাত্রা হচ্চে। বাড়ীর মেজোবাবু পাঁচো ইয়ার নিয়ে শুনতে বসেচেন; সামনে মালিনী ও বিদ্যে “মদন আগুন জ্বলছে দ্বিগুণ, কল্লে কি গুণ ঐ বিদেশী” গান করে মুঠো মুঠো প্যালা পাচ্ছে-বছর ষোল বয়সের দু’টো (ষ্টেডব্রেড) ছোকরা সখী সেজে ঘুরে ঘুরে খেমটা নাচ্চে। মজলিলে রূপের গেলাসে ব্রাণ্ডি চলচে-বাড়ীর টিকটিকি ও শালগ্রাম ঠাকুর পর্যন্ত নেশীয় চুরচুরে ও ভোঁ! যাত্রায় কমে মিলনের মন্ত্রণা, বিদ্যার গর্ভ, রাণীর তিরস্কার, চোর ধরা ও মালিনী যন্ত্রণার পালা এসে পড়লে; কোটাল মালিনীকে বেঁধে মাতে আরম্ভ কল্লে। মালিনী বাবুদের দোহাই দিয়ে কেঁদে বাড়ী সরগরম করে তুল্লে। বাবুর চমক ভেঙ্গে গেল; দেখলেন, কোটাল মালিনীকে মাচ্চে, মালিনী বাবুর দোহাই দিচ্চে; অথচ পার পাচ্ছে না। এতে বাবু বড় রাগত হলেন, “কোন্ বেটার সাধ্যি মালিনীকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যায়,” এই বলে সামনের রূপের গেলাসটি কোটালের রগ তেগে ছুড়ে মাল্লেল; গেলাসটি কোটালের রগে লাগবামাত্র কোটাল ‘বাপ!’ বলে, অমনি ঘুরে পড়লো চারিদিক থেকে লোকেরা হাঁ হাঁ করে এসে কোটালকে ধরাধরি করে নিয়ে গেল। মুখে জলের ছিটে মারা হলো ও অন্য অন্য নানা তদ্বির হলো : কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না—কোটালের-পো এক ঘাতেই পঞ্চত্ব পেলেন।

আর একবার ঠনঠনের ‘র’ ঘোষজাবাবুর বাড়ীতে বিদ্যাসুন্দর যাত্রা হচ্ছিল, বাবু মদ খেয়ে পেকে মজলিসে আড় হয়ে শুয়ে নাক ডাকিয়ে যাত্রা শুনছিলেন। সমস্ত বাত বেহু সেই কেটে গেল, শেষে ভোর ভোর সময়ে দক্ষিণ-মশানে কোটালের হাঙ্গামাতে বাবুর নিদ্রাভঙ্গ হলো; কিন্তু আসোরে কেষ্টোকে না দেখে বাবু বিরক্ত হয়ে “কেষ্ট ল্যাও, কেষ্ট ল্যাও’ বলে ক্ষেপে উঠলেন। অন্য অন্য লোকে অনেক বুঝালেন যে, “ধৰ্ম্ম অবতার। বিদ্যাসুন্দর যাত্রায় কেষ্ট নাই;” কিন্তু বাবু কিছুতেই বুঝলেন না; (কৃষ্ণ তাঁরে–নিতান্ত নির্দয় হয়ে দেখা দিলেন না বিবেচনায়) শেষে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগলেন।

আর একবার এক গোস্বামী এক মাতাল বাবুর কাছে বড় নাকাল হয়েছিলেন; সেকথাও না বলে থাকা গেল না। পূর্ব্বে এই সহরে বেনেটোলায় দীপচাঁদ গোস্বামীর অনেকগুলি বড়মানুষ শিষ্য ছিল। বারসিমলের বোসবাবুর প্রভুর প্রধান শিষ্য ছিলেন। একদিন আমতার রামহরিবাবু বোসজাবাবুরে এক পত্র লিখলেন যে, “ভেক নিতে আমার বড় ইচ্ছ, কিন্তু গুটিকতক প্রশ্ন আছে; সেগুলির যতদিন পূরণ না হচ্ছে ততদিন শাক্তই থাকবো।” বোসজী মহাশয় পরম বৈষ্ণব; রামহরিবাবুর পত্র পেয়ে বড় খুসী হলেন ও বৈষ্ণব-ধর্মের উপদেশ ও প্রশ্ন পূরণ করবার জন্যে প্রভু নদেরচাঁদ গোস্বামী মহাশয়কে তার কাছে পাঠিয়ে দিলেন।

রামহরিবাবুর সোণাগাছিতে বাস। দু-চার ইয়ার ও গাইয়ে বাজিয়ে কাছে থাকে; সন্ধ্যার পর বেড়াতে বেরোন—সকালে বাড়ী আসেন, মদও বিলক্ষণ চলে; দু-চারটা নিমখাসাগোচের দাঙ্গার দরুশ, পূলিসেও দুএক মোচলেকা হয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যার পর সোণাগাছির বড় জাঁক; প্রতি ঘরে ধূনোয় ধোঁ, শাঁকের শব্দ ও গঙ্গাজলের ছড়ার দরুণ হিন্দুধৰ্ম্ম মর্ত্তিমন্ত হয়ে সোণাগাছি পবিত্র করেন। নদেরচাঁদ গোস্বামী, বোসবাবুর পত্র নিয়ে সন্ধ্যার পর সোণাগাছি ঢুকলেন। গোস্বামীর শরীরটি প্রকাণ্ড, মাথা নেড়া, মধ্যে তরমুজের বোঁটার মত চৈতনফক্কা সর্বাঙ্গে হরিনামের ছাপা, নাকে তিলক ও অদৃষ্টে (কপালে) একধাবড়া চন্দন। হঠাৎ বোধ হয় যেন কাগে হেগে দিয়েছে। গোস্বামীর কলকেতায় জন্ম, কিন্তু কখন সোণাগাছিতে ঢোকেন নাই (শহরের অনেক বেশ্যা সিমলের মা-গোঁসাইয়ের জুরিসডিক্সনের ভেতর)। গোস্বামী অনেক কষ্টে রামহরিবাবুর বাসায় উপস্থিত হলেন।

রামহরিবাবু কুঠী থেকে এসে পাত্র টেনে গোলাপী রকম নেশায় তর হয়ে বসেছিলেন। এক মোসাহেব বায়ার সঙ্গতে ‘অব হজরত যাতে লণ্ডনকো’ গাচ্ছেন, আর একজন মাথায় চাদর দিয়ে বাঈয়ানা নাচের উজ্জ্বগ কচ্ছেন; এমন সময় বোসবাবুর পত্র নিয়ে গোস্বামী মশাই উপস্থিত হলেন। অমন আমদের সময়ে একটা ব্রকোদ (বৃকোদর) গোঁসাইকে দেখলে, কার না রাগ হয়? মজলিসের সকলেই মনে মনে বড় ব্যাজার হয়ে উঠলেন; বোসজার অনুরোধেই কেবল গোস্বামী সে যাত্রা প্রহার হতে পরিত্রাণ পান।

রামহরিবাবু বোসজার পত্র পড়ে গোস্বামী মহাশয়কে আদর করে বসালেন। রামা, বামুনের হুঁকোটি জল ফিরিয়ে তামাক দিলে। (হুঁকোটি বাস্তবিক খাঁ সাহেবের) মোসাহেবদের সঙ্গে তার চোখ টেপাটিপি হয়ে গেল। একজন মোসাহের দৌড়ে কাছে দরজীর দোকান থেকে হয়ে এলেন। এদিকে গাওনা ও ইয়ারকি কিছু সময়ের জন্য পোষ্টপন হলো—শাস্ত্রীয় তর্ক হবার উজ্জুগ হতে লাগলো। গোস্বামী মহাশয় তামাক খেয়ে হুঁকো রেখে নানাপ্রকার শিষ্টাচার কল্লেন; রামহরিবাবুও তাতে বিলক্ষণ ভদ্রতা কল্লেন।

রামহরিবাবু গোস্বামীকে বলেন, “প্রভু! বষ্টমতন্ত্রের কটি বিষয়ে আমার বড় সন্দেহ আছে। আপনাকে মীমাংসা করে দিতে হবে। প্রথম কেষ্টর সঙ্গে রাধিকার মামী সম্পর্ক, তবে কেমন করে কেষ্ট বাধাকে গ্রহণ কল্লেন?”

দ্বিতীয়, “একজন মানুষ (ভাল দেবতাই হলো) যে, ষোলশত স্ত্রীর মনোরথ পূর্ণ করেন, এ কি কথা?”

তৃতীয়, “শুনেছি, কেষ্ট দোলের সময়ে মেড়া পুড়িয়ে খেয়েছিলেন। তবে আমাদের মটনচপ খেতে দোষ কি? আর বষ্টমদের মদ খেতেও বিধি আছে, দেখুন, বলরাম দিনরাত মদ খেতেন, কেষ্টও বিলক্ষণ মাতাল ছিলেন।” প্রশ্ন শুনেই গোস্বামীর পিলে চমকে গেল, তিনি পালাবার পথ দেখতে লাগলেন। এদিকে বাবুর দলের মুচকি হাসি; ইসরা ও রূপোর গেলাসে দাওয়াই চলতে লাগল। গোস্বামী মনের মত উত্তর দিতে পারলেন না বলে, একজন মোসাহেব বলে উঠলো, “হুজুর! কালীই বড়; দেখুন–কালীতে ও কেষ্টতে ‘ক’ পুরুষের অন্তর, কালীর ছেলে যে কার্ত্তিক, তার বাহন ময়ূরের যে ল্যাজ কেষ্টোর মাথার উপর; সুতরাং কালাই বড়।” এ কথায় হাসির তুফান উঠলো, গোস্বামী নিজ স্বভাবগুণে গোঁয়ারতিমোয় গরম হয়ে, পিট্টানের পথ দেখবেন কি, এমন সময় একজন মোসাহেব গোস্বামীর গায়ে টলে পড়ে, তার তিলক ও টিপ জিভ দিয়ে চেটে ফেলে; আর একজন ‘কি কর। কি কর।’ ব’লে টিকিটি কেটে নিলেন। গোস্বামী ক্রমে শ্রাদ্ধ গড়ায় দেখে জুতো ও হরিনামের থলি ফেলে, চোচাদৌড়ে রাস্তায় এসে হাঁপ ছাড়লেন! রামহরিবাবু ও মোসাহেবদের খুসীর সীমা রইলো না। অনেক বড়মানুষ এই রকম আমোদ বড় ভালবাসেন ও অনেক স্থানে প্রায়ই এইরূপ ঘটনা হয়।

কলকেতা সহরে প্রতিদিন নতুন নতুন মাতলামি দেখা যায়; সকলগুলি সৃষ্টিছাড়া ও অদ্ভুত! ঠকবাগানে ধনুকর্ণ মিত্তিরবাবুর বাপ, ন্যাট ড্রাইব মনকিসন কোম্পানীর বাড়ীর মুছুদ্দি ছিলেন, এ সওয়ায় চোটা ও কোম্পানীর কাগজেরও ব্যবসা কত্তেন। ধনুবাবু কালেজে পড়ে, একজামিন পাস করেছেন, লেকচার শোনেন ও মধ্যে মধ্যে ইংরজি কাগজে আর্টিকেল লেখেন। সহরে বাঙ্গালী বড়মানুষের ছেলেদের মধ্যে প্রায় অনেকে বিবেচনায গাধার বেহদ্দ; বুদ্ধিটা এমন সূক্ষ্ম যে, নেই বল্লেও বলা যায়; লেখাপড়া শিখতে আদবে ইচ্ছা নাই, প্রাণ কেবল ইয়ারকির দিকে দৌড়ায়, স্কুল যাওয়া কেবল বাপ-মার ভয়ে অষুদগেলা গোছ! সুতরাং একজামিন্ পাস করবার পূর্ব্বে ধনুকর্ণবাবু চার ছেলের বাপ হয়েছিলেন ও তাঁর প্রথম মেয়েটির বিবাহ পর্যন্ত হয়েছিলো। ধনুকর্ণবাবুর দু-চার স্কুলফ্রেণ্ডও সৰ্ব্বদা আসতেন যেতেন; কখন কখন লুকিয়ে-চুরিয়ে–চরসটা, মজমের বরফ খান, সিদ্ধিটে আসটাও চলতো; ইচ্ছেখানা, এক আদ্দিন শেরিটে, শ্যামপিটারও আস্বাদ নেওয়া হয়। কিন্তু কৰ্ত্তা স্বকলমে রোজগার করে বড়মানুষ হয়েছেন, সুতরাং সকল দিকে চোখ রাখেন ও ছেলেদের উপরেও সৰ্ব্বদা তাই করে থাকেন; সেই দব দবাতেই ইচ্ছেখানায় ব্যাঘাত পড়েছিল।

সমরভেকেশনে কলেজ বন্ধ হয়েছে, স্কুল-মাষ্টারেরা লোকের বাগানে বাগানে মাছ ধরে বেড়াচ্ছেন। পণ্ডিতেরা দেশে গিয়ে লাঙ্গল ধরে চাষবাস আরম্ভ করেচেন; (ইংরেজী ইস্কুলের পণ্ডিত প্রায় ঐ গেছেরি দেখা যায়) ধনুবাবু সন্ধ্যার পর দুই-চার স্কুল-ফ্লেণ্ড নিয়ে পড়বার ঘরে বসে আছেন। এমন সময়ে কলেজের প্যারীবাবু চাদরের ভিতর এক বোতল ব্রাণ্ডি ও একটা শেরি নিয়ে, অতি সন্তর্পণ ঘরের ভিতর ঢুকলেন। প্যারীবাবু ঘরে ঢোকবামাত্রই চারদিকের দোর-জানলা বন্ধ হয়ে গেল; প্রথমে বোতলটি অতি সাবধানে খুলে (বেড়ালে চুরি করে দুধ খাবার মত করে) অত্যন্ত সাবধানে চলতে লাগলো ক্রমে ব্রাণ্ডি অন্তর্ধান হলেন। এদিকে বাবুদের মেজাজও গরম হয়ে উঠলো; দেরি-জানালা খুলে দেওয়া হলো, চেঁচিয়ে হাসি ও গররা চলতে লাগলো। শেষে শেরীও সমীপস্থ হলেন, সুতরাং ইংরেজী ইস্পিচ ও টেবিল চাপড়ানো চল্লো; ভয় লজ্জা পেয়ে পালিয়ে গেল। এ দিকে ধনুবাবুর বাপ চণ্ডীমণ্ডপে বসে মালা ফিরুচ্ছিলেন; ছেলেদের ঘরের দিকে হঠাৎ চীৎকার ও রৈ রৈ শব্দ শুনে গিয়ে দেখলেন, বাবু্রা মদ খেয়ে মত্ত হয়ে চীৎকার ও হৈ-হৈ কচ্চেন, সুতরাং বড়ই ব্যাজার হয়ে উঠলেন ও ধনুবাবুকে যাচ্চেতাই বলে গালমন্দ দিতে লাগলেন। কর্ত্তার গালাগালে একজন ফ্রেণ্ড বড়ই চটে উঠলেন ও ধনুও তার সঙ্গে তেড়ে গিয়ে একটা ঘুষো মাল্লেন! কৰ্ত্তার বয়স অধিক হয়েছিল, বিশেষতঃ ঘুষোটি ইয়ং বেঙ্গালি (বাঁদরের বাড়া); ঘুষি খেয়ে কর্ত্তা একেবারে ঘুরে পড়লেন, বাড়ীর অন্য অন্ত পরিবারের হাঁ হাঁ! করে এসে পড়লো। গিন্নী বাড়ীর ভেতর থেকে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এলেন ও বাবুকে যথোচিত তিরস্কার কত্তে লাগলেন। তিরস্কার, কান্না ও গোলযোগের অবকাশে ফ্রেণ্ডরা পুলিশের ভয়ে সকলেই চম্পট দিলেন। এদিকে বাবুর করুণা উপস্থিত হলে মার কাছে গিয়ে বলেন, “মা, বিদ্দেসাগর বেঁচে থাক, তোমার ভয় কি? ও ওল্ডফুল মরে যাক না কেন, ওকে আমরা চাই নে; এবারে মা এমন বাবা এনে দেবো যে, তুমি, নূতন বাবা ও আমি একত্রে তিনজনে বসে হেলথ ড্রিঙ্ক করবো, ওল্ডফুল মরে যাক, আমি কোয়াইট রিফরমড বাবা চাই।”

রামকালী মুখোপাধ্যায় বাবু সুপ্রিমকোর্টের মিসুয়ার্স, থিক রোগ এণ্ড পিকপকেট উকিল সাহেবদের আফিসে খাতাঞ্জী। অফিসের ফেরত রাধাবাজার হয়ে অসচেন ও দু’ধারি দোকান ফাঁক যাচ্ছে না। পাগড়ীটে এলিয়ে পড়েছে, ধুতি খুলে হুতুলি পুতুলি পাকিয়ে গেছে, পাও বিলক্ষণ টলচে, ক্রমে ঘোড়াসাঁকোর হাড়িহাটায় এসে একেবারে এড়িয়ে পড়লেন, পা যেন খোটা হয়ে গেড়ে গেল, শেষে বিলক্ষণ হবুচবু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ঠাকুরবাবুদের বাড়ীর একজন চাকর সেই সময়ে মদ খেয়ে টলতে টলতে যাচ্ছিল। রামবাবু তাকে দেখে “আরে ব্যাটা মাতাল” বলে টলে সরে দাঁড়ালেন। চাকর মাতাল থেমে জিজ্ঞাসা কলে, “তুই শালা কে, আমায় মাতাল বল্লি?” রামবাবু বল্লেন, “আমি রাম।” চাকর বল্লে, “আমি তবে রাবণ।“ রামবাবু “তবে যুদ্ধং দেহি” বলে যেমন তারে মাত্তে যাবেন, অমনি নেশার ঝোঁকে ধুপুস করে ধরে গেলেন। চাকর মাতাল তার বুকের উপর চড়ে বসলো। থানার সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট সাহেব সেই সময় থানায় ফিরে যাচ্ছিলেন, চাকর মাতাল কিছু টিকে ছিল, পুলিসের সার্জ্জন দেখে রামবাবুকে ছেড়ে দিয়ে পালাবার উদ্যোগ কল্লে। রামবাবুও সুপারিণ্টেণ্ডেণ্টকে দেখেছিলেন, এখন বাবণকে পালাতে দেখে, ঘৃণা প্রকাশ করে বল্লেন, “ছি বাবা! এখন রামের হনুমানকে দেখে ভয়ে পালালে? ছি!”

রবিবারটা দেখতে দেখতে গেল, আজ সোমবার। শেষ পূজোর আমোদ, চোহেল ও ফররর শেষ, আজ বাঈ, খেমটা, কবি ও কেত্তন।।

বাঈনাচের মজলিস চূড়ান্ত সাজানো হয়েছে, গোপাল মল্লিকের ছেলের ও রাজা বেজেন্দরের কুকুরের বিয়ের মজলিস এর কাছে কোথায় লাগে! চকবাজারের প্যালানাথবাবু বাঈ-মহলের ডাইরেক্টর, সুতরাং বাঈ ও খেমটা নাচের সমুদায় ভার তাঁকেই দেওয়া হয়েছিল। সহরের নন্নী, নুন্না, মুন্নী, খন্নী ও টন্নী প্রভৃতি ডিগ্রী মেডেল ও সার্টিফিকেটওয়ালা বড় বড় বাজার ও গোপাল, শাম, বিধু, থুতু, মণি ও চুণি প্রভৃতি খেমটাওয়ালীরা, নিজ নিজ তোবড়া-তুবড়ি সঙ্গে করে আসতে লাগলেন। প্যালানাথবাবু সকলকে মা-গোঁসাইয়ের মত সমাদরে রিসিভ কচ্চেন, তাঁদেরও গরবে মাটিতে পা পড়ছে না।

প্যালানাথবাবুর হীরের ওয়াচগাৰ্ডে ঝোলানো আধুলির মত মেকাবী হন্টিঙের কাঁটা ন’টা পেরিয়েছে। মজলিসে বাতির আলো শরতের জ্যোৎস্নাকেও ঠাট্টা কোচ্চে, সারঙ্গের কোঁয়া কোঁয়া ও তবলার মন্দিরের রুণু ঝুনু তালে, “আরে সাঁইয়া মোরারে তেরি মেরা জানিরে” গানের সঙ্গে এক তরফা মজলিস রেখেছে। ছোট ছোট ট্যসল হামামা ও তাজিরা এ কোণ থেকে ও কোণ, ও চৌকি থেকে ও চৌকি করে বেড়াচ্চেন, (অধ্যক্ষদের ক্ষুদে ক্ষুদে ছেলে ও মেয়েরা) এমন সময়ে একখানা চেটে গুড় গুড় করে বারোইয়ারিতলায় ‘গড সেভ দি কুইন’ লেখা গেটের কাছে থামলো। প্যালানাথবাবু দৌড়ে গেলেন; গাড়ী থেকে জরি ও কিংখাপে মোড়া জড়ির জুতো শুদ্ধ একটা দশমুণী তেলের কূপো এ এক কুটে মোসাহেব নাবলেন; কুপোর গলায় শিকলের মত মোটা চেন, অঙ্গুলে আঠারটা করে ছত্রিশটা  আংটী।

প্যালানাথবাবুর একজন মোসাহেব বড়বাজারের পচ্চুবাবু তূলোর ও পিসগুডসের দালাল, বিস্তর টাকা! “বেশ লোক” বলে চেঁচিয়ে উঠলেন; পচ্চুবাবু মজলিসে ঢুকে মজলিসের বড় প্রশংসা কলে, প্যালানাথবাবুকে ধন্যবাদ দিলেন, উভয়ে কোলা কলি হলো; শেষ পচ্চুবাবু প্রতিমা ও মাথালো মাথালো সঙেদের (যথা—কেষ্ট, বলরাম, হনুমান্ প্রভৃতি) ভক্তিভরে প্রণাম কল্লেন; আর বাঈজীকে সেলাম করে দু’খানি আমেরিকান চৌকি জুড়ে বসলেন। দু’টি হাত, এককুড়ি পানের দোনা, চাবির থোলো ও রুমালের জন্য আপাততঃ কিছুক্ষণের জন্য আর দুখানি চৌকি ইজারা নেওয়া হলো : কুটে মোসাহেব পচ্চুবাবুর পেছন দিকে বলেন, সুতরাং তারে আর কে দেখতে পায়? বড়মানুষের কাছে থাকলে লোকে যে ‘পর্বতের আড়ালে আছ’ বলে থাকে, তাঁর ভাগ্যে ভাই ঠিক ঘটলো।

পচ্চুবাবুর চেহারা দেখে বাঈ অড়ে আড়ে হাসচে, প্যালানাথবাবু আতোর, পান, গোলাব ও তোররা দিয়ে খাতির কচ্চেন, এমন সময় গেটের দিকে গোল উঠলো—প্যালানাথবাবুর মোসাহেব হীরেলাল রাজা অঞ্জনারঞ্জন দেববাহাদুরকে নিয়ে মজলিসে এলেন।

রাজা বাহাদুরের গিল্টিকরা পালা ভরা আশা সকলের নজর পড়ে এমন জায়গায় দাঁড়ালো! অঞ্জনারঞ্জন দেববাহাদুর গৌরবর্ণ, দোহারা–মাথায় খিড়কীদার পাগড়ী—জোড়া পরা–পায়ে জরির লপেটা জুতো, বদমাইসের বাদসা ও ন্যাকার সদ্দার। বাঈ রাজা দেখে কাচবাগে সরে এসে নাচতে লাগলো, “পুজোর সময় পরবস্তি হই যেন” বই তবজী ও শারাঙ্গের। বড় রকমের সেলাম বলে, বাজে লোকেরা সং ও বাঈ ফেলে কোন অপরূপ জানোয়ারদের মত রাজা বাহাদুরকে এক বৃষ্টি দেখতে লাগলেন।

ক্রমে রাত্তিরের সঙ্গে লোকের ভিড় বাড়তে লাগলো, সহরের অনেক বড়মানুষ রকম রকম পোষাক পরে একত্র হলেন, নাচের মজলিস রন্ রন্ কত্তে লাগলো; বীরকৃষ্ণ দাঁর আনন্দের সীমা নাই, নাচের মজলিসের কেতা ও শোভা দেখে আপনা আপনি কৃতার্থ হলেন, তাঁর বাপের শ্রাদ্ধতে বামুন খাইয়েও এমন সন্তুষ্ট হতে পারেন না।

ক্রমে আকাশের তারার মত মাথালো মাথালো বড়মানুষ মজলিস থেকে খসলেন, বুড়োরা সরে গ্যালেন, ইয়ার-গোচের ফচকে বাবুরা ভাল হয়ে বসলেন, বাঈরা বিদেয় হলো—খ্যামটা আসরে নাবলেন।

খ্যামটা বড় চমৎকার নাচ! সহরের বড়মানুষ বাবুরা প্রায় ফি রবিবারে বাগানে দেখে থাকেন। অনেকে ছেলেপুলে, ভাগ্নে ও জামাই নিয়ে একত্রে বসে— খ্যামটার অনুপম রসাস্বাদনে রত হন। কোন কোন বাবুরা স্ত্রীলোকদের উলঙ্গ করে খ্যামটা নাচান—কোনখানে কিস না দিলে প্যালা পায় না–কোথাও বলবার যো নয়!

বারোইয়ারিতলায় খ্যামটা আরম্ভ হলো, যাত্রার যশোদার মত চেহারা দু’জন খ্যামটাওয়ালি ঘুরে কোমর নেড়ে নাচতে লাগলো, খ্যামটাওয়ালারা পেছন থেকে “ফণির মাথার মণি চুরি কল্লি, বুঝি বিদেশে বিঘোরে পরাণ হারালি” গাচ্চে; খ্যামটাওয়ালির ক্রমে নিমন্তুন্নেদের সকলের মুখের কাছে এগিয়ে অগ্‌গরদানি ভিকিরির মত প্যালা আদায় করে তবে ছাড়লেন! রাত্তির দু’টোর মধ্যেই খ্যামটা বন্ধ হলো—খ্যামটাওয়ালির অধ্যক্ষ হলে যাওয়া-আসা কত্তে লাগলেন, বারোইয়ারিতলা পবিত্র হয়ে গ্যালো।

কবি। রাজা নবকৃষ্ণ কবির বড় পেট্রন ছিলেন। ইংলণ্ডের কুইন এলিজেবেথের আমলে যেমন বড় বড় কবি ও গ্রন্থকর্ত্তা জন্মান, তেমনি তার আমলেও সেই রকম রাম বসু, হরু, নিলু, রামপ্রসাদ ঠাকুর ও জগা প্রভৃতি বড় বড় কবিওয়ালা জন্মায়। তিনি কবি গাওনার মান বাড়ান, তার অনুরোধে ও দেখাদেখি অনেক বড় মানুষ কবিতে মাতলেন! বাগবাজারের পক্ষীর দল এই সময় জন্ম গ্রহণ করে। শিবচন্দ্র ঠাকুর (পক্ষীর দলের সৃষ্টিকর্ত্তা) নবকৃষ্ণর একজন ইয়ার ছিলেন। শিবচন্দ্র মুখোপাধ্যায় বাগবাজারের রিফরমেশনে রামমোহন রায়ের সমতুল্য লোক—তিনি বাগবাজারেদের উড়তে শেখান। সুতরাং কিছুদিন বাগবাজারেরা সহরের টেক্কা হয়ে পড়েন। তাদের একখানি পবলিক আটচালা ছিলো, সেইখানে এসে পাকি হতেন, বুলি ঝাড়তেন ও উড়তেন—এ সওয়ার বোসপাড়ার ভেতরেও দু’চার গাঁজার আড্ডা ছিল। এখন আর পক্ষীর দল নাই, গুখুরি ও ঝক্‌মারির দলও অন্তর্ধান হয়ে গেছে, পাকিরা বুড়ো হয়ে মরে গেছেন, দু-একটা অধমরা বুড়ো গোচের পক্ষী এখনও দেখা যায়, দল ভাঙ্গা ও টাকার খাক্তিতে মনমরা হয়ে পড়েছে, সুতরাং সন্ধ্যার পর ঝুমুর শুনে থাকেন। আড্ডাটি মিউনিসিপ্যাল কমিশনেররা উঠিয়ে দেছেন, অ্যাখান কেবল তার রুইনমাত্র পড়ে আছে। পূর্ব্বের বড় মানুষেরা এখনকার বড় মানুষের মত ব্রিটিশ ইণ্ডিান এসোসিয়েসন, এড্রুস, মিটিং ও ছাপাখানিক বিব্রত ছিলেন না, প্রায় সকলেরই একটি একটি রাড় ছিল, (এখনও অনেকের আছে) বেলা দুপুরের পর উঠতে, আহ্নিকের আড়ম্বরটাও বড় ছিলো—দুতিন ঘণ্টার কম আহ্নিক শেষ হতো না, তেল মাখতেও ঝাড়া চারঘণ্টা লাগতো —চাকরের তেল মাখানীর শব্দে ভূমিকম্প হতো—বাবু, উলঙ্গ হয়ে তেল মাখতে বসতেন, সেই সময় বিষয়-কৰ্ম্ম দেখা, কাগজ-পত্রে সই ও মোহর চলতো, আঁচাবার সঙ্গে সঙ্গে সূৰ্য্যদেব অস্ত যেতেন। এঁদের মধ্যে জমিদাররা রাত্তির দুটো পর্যন্ত কাছারি কত্তেন; কেউ অমনি গান বাজনা জুড়ে দিতেন। দলাদলির তর্ক কত্তেন ও মোসাহেবদের খোসামুদিতে ফুলে উঠতেন—গাইয়ে বাজিয়ে হলেই বাবুর বড় প্রিয় হতো, বাপান্ত কল্লেও বক্‌সিস পেতো, কিন্তু ভদ্দরলোক বাড়ী ঢুকতে পেতো না; তার বেলা লাঙ্গী তরওয়ালের পাহারা, আদব কায়দা! কোন কোন বাবু, সমস্ত দিন ঘুমুতেন-সন্ধ্যার পর উঠে কাজকৰ্ম্ম কত্তেন দিন রাত ছিল ও রাত দিন হতো! রামমোহন রায়, গুপিমোহন দেব, গুপিমোহন ঠাকুর, দ্বারিকানাথ ঠাকুর ও জয়কৃষ্ণ সিংহের আমোল অবধি এই সকল প্রথা ক্ৰমে ক্ৰমে অন্তর্ধান হতে আরম্ভ হলো, (বাঙ্গালীর প্রথম খবরের কাগজ) সমাচারচন্দ্রিকা প্রকাশ হতে আরম্ভ হলো। ব্রাহ্মসমাজ স্থাপিত হলো! তার বিপক্ষে ধর্ম্মসভা বসলো, রাজা রাজনারায়ণ কায়স্থের পইতে দিতে উদ্যোগ কল্লেন, সতীদাহ উঠে গেল। হিন্দুকলেজ প্রতিষ্ঠিত হলো। হেয়ার সাহেব প্রকাশ হলেন–ক্রমে সংকৰ্ম্মে বাঙ্গালীর চোখ ফুটে উঠলো।

এদিকে বারোইয়ারিতলায় জামদার কবি আরম্ভ হলো; ভাল্কোর জগা ও নিম্‌তের রামা ঢোলে ‘মহিম্নস্তব’, ‘গঙ্গাবন্দনা’ ও ‘ভেটকিমাছের তিনখানা কাঁটা’, ‘অগ্‌গরদ্বীপের গোপীনাথ’, ‘যাবি তো যা যা ছুটে ছুটে যা’ প্রভৃতি বেল বাজাতে লাগলো; কবিওয়ালারা বিষমের ঘরে (পঞ্চমের চার গুণ উঁচু) গান ধল্লেন–

চিতেন।
“বড় বারে বারে এসো ঘরে মকদ্দমা করে ফাঁক!
এইবারে গেরে, তোমার কল্লে সূর্পণখার নাক!”
আস্তাই।
ক্যামন সুখ পেলে কম্বলে শুলে,
ব্ৰহ্মওর দেবত্তর বড় নিতে জোর করে
এখন জারী গ্যাল, ভূর ভাংলো,
তোমার আত্তো জুলুম চলবে না!
পেনেলকোডের আইন গুণে মুখুয্যের পোর ভাংলো জাঁক।
বে-আইনীর দফারফা বদমাইসি হলো খাক্॥
মোহাড়া।
কুইনের খাসে, দেশে, প্রজার দুঃখ রবে না।
মহামহোপাধ্যায় মথুরানাথ মুসড়ে গিয়েচেন।
কংস-ধ্বংসকারী লেটোর, জেলায় এসেছেন।
এখন গুমী গ্রেপ্তারী লাঠি দাঙ্গা ফোর্জ চলবে না।

জমিদারী-কবি শুনে সহুরেরা খুশী হলেন, দু-চার পাড়াগেঁয়ে রায়চৌধুরী, মুন্সী ও রায়বাবুরা মাথা হেঁট কল্লেন, হুজুরী আমমোক্তারেরা চৌক রাঙ্গিয়ে উঠলো, কবিওয়ালার ঢোলের তালে নাচতে লাগলো।

স্ক্যাভেঞ্জরের গাড়ী সার বেঁধে বেরিয়েচে। ম্যাথরের ময়লার গাড়ী ঠেলে সেনের ঘাটে চলেছে। বাউলের ললিত রাগে খরতাল ও খঞ্জনীর সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের সহস্র নাম ও
“ঝুলিতে মালা রেখে, জপলে আর হবে কি।”
কেবল কাঠের মালার ঠকঠকী, সব ফাঁকি!”

লোকের দোয়ারে দোয়ারে গান করে বেড়াচ্চে। কলুভায়া ঘানি জুড়ে দিয়েছেন। ধোপারা কাপড় নিয়ে চলেচে। বোঝাই-করা গরুর গাড়ী কোঁ-কোঁ শব্দে রাস্তা জুড়ে যাচ্ছে। ক্রমে ফরসা হয়ে এলো। বারোইয়াভিলায় কবি বন্ধ হয়ে গেল; ইয়ারগোচের অধ্যক্ষ ও দর্শকেরা বিদেয় হলেন, বুড়ো ও আধবুড়োরা কেত্তনের নামে এলিয়ে পড়লেন; দেশের গোঁসাই, গোঁড়া, বৈরাগী ও বষ্টব একত্র হলো;– সিমলের শাম ও বাগবাজারের নিস্তারিণীর কেত্তন।

সিলের শাম উত্তম কিত্তনী—বয়স অল্প, দেখতে মন্দ নয়—গলাখানি যেন কাঁসি খনখন কচ্চে। কেত্তন আরম্ভ হলো–কিত্তনী “তাথইরা তাথইয়া নাচত ফিরত গোপাল ননী চুরি করি খাঞীছে আরে আরে ননী চুরি করি খাঞীছে তাথইয়া” গান আরম্ভ কল্লে; সকলে মোহিত হয়ে পড়লেন! চারিদিক থেকে হরিবোল ধ্বনি হতে লাগলো, খুলীরে হাঁটু গেড়ে বসে সজোরে খোল বাজাতে লাগলো। কিত্তনী কখন হাঁটু গেছে কখনো দাঁড়িয়ে, মধু-বৃষ্টি কত্তে লাগলেন—হরি-প্রেমে একজন গোঁসাইয়ের দশা লাগলো। গোঁড়ারা তাকে কোলে করে নাচতে লাগলো। আর যেখানে তিনি পড়েছিলেন, জিভ দিয়ে সেইখানেই ধূলো চাটতে লাগলো!

হিন্দুধৰ্ম্মের বাপের পুণ্যে ফাঁকি দেখাবার মত ফিকির আছে, গোঁসাইগিরি সকলের টেক্কা। আমরা জন্মাবচ্ছিন্নে কখন একটি রোগা দুৰ্বল গোঁসাই দেখতে পাই নে! গোঁসাই বল্লেই একটা বিকটাকার, ধুম্বলোচন হবে, ছেলেবেলা অবধি সকলেরই এই চিরপরিচিত সংস্কার। গোঁসাইদের যেরূপ বিয়ারিং পোষ্টে আয়েস ও আহারাদি চলে, বড় বড় বাবুদের পয়সা খরচ করেও সেরূপ জুটে ওঠবার যো নাই। গোঁসাইরা স্বয়ং কেষ্ট ভগবান বলেই, অনেক দুর্লভ বস্তুও অক্লেশে ঘরে বসে পান ও কালীয়দমন, পূতনাবধ, গোবর্ধনধারণ প্রভৃতি কটা বাজে কাজ ছাড়া, বস্ত্রহরণ, মানভঞ্জন, ব্ৰজবিহার প্রভৃতি শ্রীকৃষ্ণের গোছালো গোছালো লীলাগুলি করে থাকেন! পেটভরে মাল্লো ও ক্ষীর লেসেন ও রকমারি শিষ্য দেখে চৈতন্যচরিতামৃতের মতে—
“যিনি গুরু তিনি কৃষ্ণ না ভাবিও আন।
গুরু তুষ্টে কৃষ্ণ তুষ্ট জানিবা প্রমাণ॥”
“প্রেমারাধ্যা রাধাসমা তুমি লো যুবতী।
রাখ লো গুরুর মান যা হয় যুকতি।”
—প্রভৃতি উপদেশ দিয়ে থাকেন। এ সওয়ায় গোঁসাইরা অণ্ডরটেকরের (মুদ্দফরাস) কাজও করে থাকেন–পাঁচসিকে পেলে মন্ত্রও দেন, মড়াও ফেলেন ও বেওয়ারিস বেওয়া ম’লে এরা তার উত্তরাধিকারী হয়ে বসেন। একবার মেদিনীপুরে এক ব্রকোদ গোঁসাই খড় জব্দ হয়েছিলেন। এখানে সে উপকথাটিও বলা আবশ্যক।

পূর্ব্বে মেদিনীপুর অঞ্চলে বৈষ্ণবতন্ত্রে গুরু-প্রসাদি প্রথা প্রচলিত ছিল—নতুন বিবাহ হলে গুরুসেবা না করে স্বামি-সহবাস করবার অনুমতি ছিল না। বেতালপুরের রামেশ্বর চক্রবর্ত্তী পাড়াগাঁ অঞ্চলে একজন বিশিষ্ট লোক! সুবর্ণরেখা নদীর ধারে পাঁচবিঘা আওলাৎ ঘেরা ভদ্রাসন বাড়ী, সকল ঘরগুলি পাকা, কেবল চণ্ডীমণ্ডপ ও দেউড়ির সামনের বৈঠকখানা উলু দিয়ে ছাওয়া। বাড়ীর সামনে দু’টি শিবের মন্দির, একটি শাণ-বাঁধানে পুষ্করিণী, তাতে মাছও বিলক্ষণ ছিল। ক্রিয়েকৰ্ম্মে চক্রবর্ত্তীকে মাছের জন্যে ভাবতে হতো না। এ সওয়ায় ২০০ বিঘা ব্রহ্মোত্তর জমি, চাষের জন্য পাঁচখানা লাঙ্গল, পাঁচজন রাখাল চাকর, পাঁচজোড়া বলদ নিযুক্ত ছিল। চক্রবর্ত্তীর উঠোনে দুটি বড় বড় ধানের মরাই ছিল, গ্রামস্থ ভদ্রলোকমাত্ৰেই চক্রবর্ত্তীকে বিলক্ষণ মান্য কত্তেন ও তার চণ্ডীমণ্ডপে এসে পাশা খেলতেন। চক্রবর্ত্তীর ছেলেপুলে কিছুই ছিল না, কেবল এক কন্যামাত্র; সহরের ব্ৰকভানু চাটুষ্যের ছেলে হরহরি চাটুয্যের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের সময় বর-কনের বয়স ১০/১৫ বছরের বেশী ছিল না, সুতরাং জামাই নিয়ে যাওয়া, কি মেয়ে আনা কিছুদিনের জন্য বন্ধ ছিল। কেবল পাল-পার্ব্বণে পিঠে-সংক্রান্তি ও ষষ্ঠবাটায় তত্ত্ব তাবাস চলতো।

ক্রমে হরহরিবাবু কালেজ ছাড়লেন, এদিকে বয়সও কুড়ি-একুশ হলো, সুতরাং চক্রবর্ত্তী জামাই নেযাবার জন্য স্বয়ং শহরে এসে ব্রকভানুবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ কল্লেন। ব্রকভানুবাবু চক্রবর্ত্তীকে কয়দিন বিলক্ষণ আদরে বাড়ীতে রাখলেন, শেষে উত্তম দিন দেখে হরহরিরে সঙ্গে দিয়ে পাঠালেন। একজন দারোয়ান, একজন সরকার ও একজন চাকর হরহরিবাবুর সঙ্গে গেল।

জামাইবাবু তিন-চার দিনে তোলপুরে পৌঁছিলেন। গাঁয়ে সোর পড়ে গেল, চক্রবর্ত্তীর সহুরে জামাই এসেছে; গাঁয়ের মেয়েরা কাজকর্ম্ম ফেলে ছুটোছুটি জামাই দেখতে এলো! ছোঁড়ারা সহুরে লোক প্রায় দেখে নি, সুতরাং পালে পালে এসে হরহরিবাবুরে ঘিরে বোসলো। …চক্রবর্ত্তীর চণ্ডীমণ্ডপ লোকে রৈ-রৈ করে লাগলো; একদিকে আশপাশ থেকে মেয়েরা উঁকি মাচ্চে; একপাশে কতকগুলো গোডিমওয়ালা ছেলে ন্যাংটা দাঁড়িয়ে রয়েছে; উঠানে বাজে লোক ধরে না। শেষে আমাইবাবুকে জলযোগ করবার জন্য বাড়ীর ভিতরে নিয়ে যাওয়া হলো। পূর্ব্বে জলযোগের যোগাড় করা হয়েছে শিড়ে নীচে চারিদিপে চারটি সুপারি দেওয়া হয়েছিল; জামাইবাবু যেমন পিঁড়েয় পা দিয়ে বসতে যাবেন, অমনি পিঁড়ে গড়িয়ে গেল। জামাইবাবু ধুপ করে পড়ে গেলেন শালী-শালাজ-মহলে হাসির গর্‌রা পড়লো! জলযোগের সকল জিনিসগুলিই ঠাট্টাপোরা। মাটির কালো জাম, ময়দা ও চেলের গুঁড়ির সন্দেশ, কাঠের আক ও বিচালির জলের চিনির পানা, জলের গেলাসে ঢাকুনি দেওয়া আরসুলো ও মাকোড়সা, পানের বাটায় ছুঁচো ও ইঁদুর পোরা। জামাইবাবু অতিকষ্টে ঠাট্টার যন্ত্রণা সহ্য করে বাইরে এলেন। সমবয়সী দু’চার শালা সম্পর্কের জুটে গেল; সহরের গল্প, তামাসা ও রঙ্গেই দিনটি কেটে গেল।

রজনী উপস্থিত—সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে–রাখালেরা বাঁশী বাজাতে বাজাতে গরুর পাল নিয়ে ঘরে ফিরে যাচ্ছে। এক-একটি পরমা সুন্দরী স্ত্রীলোক কলসী কাঁকে করে নদীতে জল নিতে আসচে–লম্পটশিরোমণি কুমুদরঞ্জন যেন তাদের দেখবার জন্যই বাঁশঝাড়ে ও তালগাছের পাশ থেকে উঁকি মাচ্ছেন। ঝিঁঝিপোকা ও ঈইচিংড়িরা প্রাণপণে ডাকচে। ভাম, খটাখ ও ভোঁদড়েরা ভাঙ্গা শিবের মন্দির ও পড়ো বাড়ীতে ঘুরে বেড়াচ্চে। চামচিকে ও বাদুড়েরা খাবার চেষ্টায় বেরিয়েছে; এমন সময় একদল শিয়াল ডেকে উঠলো–এক প্রহর রাত্রি হয়ে গেল। ছেলেরা জামাইবাবুর বাড়ীর ভিতর নিয়ে গেল, পুনরায় নানারকম ঠাট্টা ও আসল খেয়ে–জামাইবাবু নির্দ্দিষ্ট ঘরে শুতে গেলেন।

বিবাহের পর পুনর্ব্বিবাহের সময়েও জামাইবাবু শ্বশুরালয়ে যান নাই। সুতরাং পাঁচ বৎসরের সময় বিবাহকালে বা স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল তখন দুইজনেই বালক-বালিকা ছিলেন। সুতরাং হরহরিবাবুর নিদ্ৰা হবার বিষয় কি? আজ স্ত্রীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হবে, স্ত্রী মান করে থাকলে তিনি কলেজী এডুকেশন ও ব্রহ্মজ্ঞান মাথায় তুলে পায়ে ধরে মান ভাঙবেন এবং এরপর যাতে স্ত্রী লেখাপড়া শিখেন ও চিরহৃদয়তোষিকা হন, তার বিশেষ তদ্বির কত্তে থাকবেন। বাঙ্গালীর স্ত্রীরা কি দ্বিতীয়া “মিস ষ্টো, মিস টমসন ও মিসেস বরকরলি ও লেডী বুলুয়ার লিটন” হতে পারে না? বিলিতী স্ত্রী হতে বরং এরা অনেক অংশে বুদ্ধিমতী ও ধর্ম্মশীলা—তবে কেন বডি দিয়ে, পুতুল খেলে ঝকড়া ও হিংসায় কাল কাটায়? সীতা, সাবিত্রী, সতী, সত্যভামা, শকুন্তলা, কৃষ্ণাও তো এক খনির মণি? তবে  এঁরা যে কয়লা হয়ে চিরকাল “ফরনেসে” বন্ধ হয়ে পোড়েন ও পোড়ন, সে কেবল বাপ-মা ও ভাতারবর্গের চেষ্টা ও তদ্বিরের ত্রুটিমাত্র। বাঙ্গালীসমাজের এমনি এক চমৎকার রহস্য যে, প্রায় কোন বংশেই স্ত্রী-পুরুষ উভয়ে কৃতবিদ্য দেখা যায় না! বিদ্যাসাগরের স্ত্রীর হয়তো বর্ণ পরিচয় হয় নাই; গঙ্গাজলের ছড়া–সাফরিদের মাদুলী ও বালসির চন্নমেত্তো নিয়েই ব্যতিব্যস্ত! এ ভিন্ন জামাইবাবুর মনে নানা রকম খেয়াল উঠলো, ক্রমে সেইসব ভাবতে ভাবতে ও পথের ক্লেশে অঘোর হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। শেষে বেলা এক প্রহরের সময়ে মেয়েদের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল—দেখেন যে, বেলা হয়ে গিয়েছে— তিনি একলা বিছানায় শুয়ে আছেন।

এদিকে চক্রবর্ত্তীর বাড়ীর গিন্নীরা বলাবলি কন্তে লাগলেন যে, “তাই তো গা! জামাই এসেচেন, মেয়েও ষেটের কোলে বছর পোনের হলো, এখন প্রভুকে খবর দেওয়া আবশ্যক।” সুতরাং চক্রবর্ত্তী পাঁজি দেখে উত্তম দিন স্থির করে, প্রভুর বাড়ী খবর দিলে–প্রভু তূরী, খুন্তি ও খোল নিয়ে উপস্থিত হলেন। গুরুপ্রসাদির আয়োজন হতে লাগলো।

হরহরিবাবু প্রকৃত রহস্য কিছুমাত্র জানতো না, গোঁসাই দলবল নিয়ে উপস্থিত, বাড়ীর সকলে শশব্যস্ত! স্ত্রী নূতন কাপড় ও সর্ব্বালঙ্কারে ভূষিত হয়ে বেড়াচ্চে! সুতরাং তিনি এতে নিতান্ত সন্দিগ্ধ হয়ে একজন ছেলেকে জিজ্ঞাসা কল্লেন, “ওহে, আজ বাড়ীতে কিসের ধূম?” ছোকরা বল্লে, “জামাইবাবু, তা জান না, আজ আমাদের গুরুপ্রসাদি হবে।”

“আমাদের গুরুপ্রসাদি হবে” শুনে হরহরিবাবু একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে গেলেন ও কি প্রকারে কুৎসিত গুরুপ্রসাদি হতে স্ত্রী পরিত্রাণ পান, তারি তদ্বিরে ব্যস্ত রইলেন।

কর্ত্তব্যকৰ্ম্মের অনুষ্ঠান কত্তে সাধুরা কোন বাধাই মানেন না বলেই যেন দিনমণি কমলিনীর মনোব্যথায় উপেক্ষা করে অস্ত গেলেন। সন্ধ্যাবধূ শাঁক ঘণ্টা ও ঝিঁঝিঁ পোকার মঙ্গলশব্দের সঙ্গে স্বামীর অপেক্ষা কত্তে লাগলেন। প্রিয়সখী প্রদোষ দূতীপদে প্রতিষ্ঠিত হয়ে, নিশানাথকে সংবাদ দিতে গেলেন। নববধুর বাসরে অমোদ করবার জন্য তারাদল একে একে উদয় হলেন, কুমুদিনী স্বচ্ছ সরোবরে ফুটলেন—হৃদয়রঞ্জনকে পরকীয় রসাস্বাদনে গমনোদ্যত দেখেও, তাঁর মনে কিছুমাত্র বিরাগ হয় নাই। কারণ, চন্দ্রের সহস্র কুমুদিনী আছে, কিন্তু কুমুদিনীর তিনিই একমাত্র অনন্যগতি! এদিকে নিশানাথ উনয় হলেন—শেয়ালেরা যেন স্তব পাঠ কত্তে লাগলো—ফুলগাছেরা ফুলদল উপহার দিতে লাগলো দেখে আাদে প্রকৃতি সত্য হাসতে লাগলেন।

চক্রবর্ত্তীর বাড়ীর ভিতর বড় ধূম। গোস্বামী বরের মত সজ্জা করে জামাইবাবুর শোবার ঘরে গিয়ে শুলেন। হরহরিবাবুর স্ত্রী নানালঙ্কার পরে ঘরে ঢুকলেন; মেয়েরা ঘরের কপাট ঠেলে দিয়ে ফাঁক থেকে আড়ি পেতে উঁকি মাত্তে লাগলো।

হরহরিবাবু ছোঁড়ার কানে শুনে একগাছি রুল নিয়ে গোস্বামীর ঘরে শোবার পূর্ব্বেই খাটের নীচে লুকিয়ে ছিলেন; এক্ষণে দেখলেন যে, স্ত্রী ঘরে ঢুকে গোস্বামীকে একটি প্রণাম করে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলো; প্রভু খাটে থেকে উঠে স্ত্রীর হাত ধরে অনেক বুঝিয়ে শেষে বিছানায় নিয়ে গেলেন; কন্যাটি কি করে! বংশপরম্পরাগত “ধৰ্ম্মের অন্যথা কল্লে মহাপাপ” এটি চিত্তগত আছে, সুতরাং আর কোন আপত্তি কল্লে না—শুড় শুড় করে প্রভুর বিছানায় গিয়ে শুলো। প্রভু কন্যার গায়ে হাত দিয়ে বল্লেন, বল “অমি রাধা তুমি শ্যাম”; কন্যাটিও অনুমতিমত “আমি রাধা তুমি শ্যাম” তিনবার বলেচে, এমন সময় হরহরিবাবু আর থাকতে পালেন না, খাটের নীচে থেকে বেরিয়ে এসে “এই কাঁদে বাড়ি বলরাম” বলে রুলসই কত্তে লাগলেন। ঘরের বাইরে ন্যাড়া বষ্টমেরা খোলকত্তাল নিয়ে ছিল— গোস্বামীর রুলসইয়ের চীৎকারে তারা হরিবোল ভেবে দেদার খোল বাজাতে লাগলো। মেয়েরা উলু দিতে লাগলো; কাঁসোর ঘণ্টা শাঁকের শব্দে হুলস্থুল পড়ে গেল। হরহরিবাবু হঠাৎ দরজা খুলে ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়ে, একেবারে থানার দারোগার কাছে গিয়ে সমস্ত কথা ভেঙ্গে বল্লেন। দারোগা ভদ্রলোক ছিলেন, (অতি কম পাওয়া যায়); তারে অভয় দিয়ে সেদিন যথা সমাদরে বাসায় রেখে, তার পরদিন বরকন্দাছ মোতায়েন দিয়ে বাড়ী পাঠিয়ে দিলেন। এদিকে সকলের তাক লেগে গেল, ইনি কেমন করে ঘরে গিয়েছিলেন। শেষে সকলে ঘরে গিয়ে দেখে যে, গোস্বামীর দাঁতকপাটি লেগে গেচে, অজ্ঞান অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে, বিছানায় রক্তের নদী বচ্চে। সেই অবধি গুরুপ্রসাদি উঠে গেল, লোকের চৈতন্য হলো। প্রভুরাও ভয় পেলেন।

আর একবার এক সহুরে গোঁসাই এক বেনের বাড়ী কেষ্টলীলা করে জব্দ হয়েছিলেন, সেটিও এই বেলা বলে নিই।

রামনাথ সেন ও শ্যামনাথ সেন দুই ভাই, সহরে চার পাঁচটা হৌসের মুচ্ছুদ্দি। দিনকতক বাবুদের বড় জ্বলজ্বলা হয়ে উঠেছিল–চৌঘুড়ী, ভেঁপু, মোসাহেব ও অবিদ্যার ছড়াছড়ি। উমেদার, বেকার রেকমেণ্ড চিঠিওয়ালা লোকে বৈঠকখানা থৈ থৈ কত্তো, বাবুরা নিয়ত বাগান, চোহেল ও আমোদেই মত্ত থাকত্তেন, আত্মীয়-কুটুম্ব ও বন্ধুবান্ধবেই বাবুদের কাজকর্ম্ম দেখতেন। একদিন রবিবার বাবুরা বাগানে গিয়েছেন, এই অবকাশে বাড়ীর প্রভু,–খুন্তি, খোল ও ভেঁপু নিয়ে উপস্থিত, বাড়ীর ভিতর খবর গ্যালো। প্রভুকে সমাদরে বাড়ীর ভিতর নিয়ে যাওয়া হলো। প্রভু চৈতন্যচরিতামৃত ও ভাগবতের মতে লীলা দেখালেন। শেষে গোস্বামী বাড়ী ফিরে যান–এমন সময় ছোটবাবু এসে পড়লেন। ছোটবাবুর কিছু সাহেবী মেজাজ, প্রভুকে দেখেই তেলেবেগুনে জ্বলে গেলেন ও অনেক কষ্টে আন্তরিক ভাব গোপন করে জিজ্ঞেসা কল্লেন, “কেমন প্রভু! ভগবানের মতে লীলা দেখান হলো?” প্রভু ভয়ে আমতা আমতা গোছের “আজ্ঞে হাঁ’ করে সেরে দিলেন। ছোটবাবুর একজন মুখোড়া গোছের কায়স্থ মোসাহেব ছিল, সে বল্লে, “হুজুর। গোঁসাই সকল রকম লীলে করে চল্লেন, কিন্তু গোবর্ধনধারণা হয়নি, অনুমতি করেন তো প্রভুকে গোবর্ধন ধারণটাও করিয়ে দেওয়া যায়, সেটাও বাকী থাকে কেন?” ছোটবাবু এতে সম্মত হলেন, শেষে দরওয়ানদের হুকুম দেওয়া হলো–দরজার পাশে একখান দশ-বারো মণ পাথর পড়ে ছিল, জন কতকে ধরে এনে গোস্বামীর ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে, পাথরের চাপানে গোস্বামীর কোমর ভেঙ্গে গেল। এদিকে বারোইয়ারিতলায় কেত্তন বন্ধ হয়ে গেল, কেত্তনের শেষে একজন বাউল সুর করে এই গানটি পাইলে–

বাউলের সুর

আজব সহর কলকেতা।
রাড়ী বাড়ী জুড়ীগাড়ী মিছে কথার কি কেতা।
হেতা ঘুঁতে পোড়ে গোবর হাসে বলিহারি ঐকতা;
যত বক বিড়ালে ব্রহ্মজ্ঞানী, বদমাইসির ফাঁদ পাতা।
পুঁটে তেলির আশা ছড়ি শুঁড়ী সোনার বেণের কড়ি,
খ্যামটা খানকির খাসা বাড়ী, ভদ্রভাগ্যে গোলপাতা।
হদ্দ হেরি হিন্দুয়ানী,  ভিতর ভাঙ্গা ভড়ংখানি,
পথে হেগে চোরাঙ্গানি, লুকোচুরির ফেরগাঁতা।
গিন্টি কাজে পালিশ করা, রাঙ্গা টাকায় তামা ভরা,
হুতোম দাসেস্বরূপ-ভাষে, তফাৎ থাকাই সার কথা।

গানটি শুনে সকলেই খুসী হলেন। বাউলে চার আনার পয়সা বক্সিস পেলে; অনেকে আদর করে গানটি শিখে ও লিখে নিলেন।

বারোইয়ারি পুজো শেষ হলো, প্রতিমখানি আট দিন রাখা হলো, তারপর বিসর্জ্জন করবার আয়োজন হতে লাগলো। আমমোক্তার কানাইধনবাবু পুলিশ হতে পাশ করে আনলেন। চার দল ইংরাজী বাজনা, সাজা তুরুকসোয়ার নিশেন ধরা ফিরিঙ্গি, আশা শোটা ঘড়ী ও পঞ্চাশটা ঢাক একত্র হলো! বাহাদুরী কাঠতোলা চাক একত্র করে, গাড়ীর মত করে, তাতেই প্রতিমে তোলা হলো; অধ্যক্ষের প্রতিমের সঙ্গে সঙ্গে চল্লেন, দু পাশে সংয়ের সার বেঁধে চল্লো। চিৎপুরের বড় রাস্তা লোকারণ্য হয়ে উঠলো; রাঁড়েরা ছাদের ও বারাণ্ডার উপর থেকে রূপোবাঁধানো হুঁকোয় তামাক খেতে খেতে তামাসা দেখতে লাগলো, রাস্তার লোকেরা হাঁ করে চলতী ও দাঁড়ানো প্রতিমে দেখতে লাগলো। হাটখোলা থেকে জোড়াসাঁকো ও মেছোবাজার পর্যন্ত ঘোরা হলো, শেষে গঙ্গাতীরে নিয়ে বিসর্জ্জন করা হয়। অনেক পরিশ্রমে যে বিশ পঁচিশ হাজার টাকা সংগ্রহ করা হয়েছিলো, আজ তারি শ্ৰাদ্ধ ফুরুলো। বীরকৃষ্ণ দাঁ আর আর অধ্যক্ষের অত্যন্ত বিষণ্ণদনে বাড়ী ফিরে গেলেন। বাবুদের ভিজে কাপড় থাকূলে অনেকেই বিবেচনা কতো যে, বাবুরা মড়া পুড়িয়ে এলেন।

বারোইয়ারি পূজোর সম্বৎসরের মধ্যেই বীরকৃষ্ণ দাঁর বাজার-দেনা চেগে উঠলো, গদী ও আড়ত উঠ গ্যাল, শেষে ইন্সল্‌ভেট গিয়ে ফরেশডাঙ্গায় গিয়ে বাস করেন; কিছুদিন বাদে হঠাৎ ঘর চাপা পড়ে মরে গেলেন! আমমোক্তার কানাইবন দত্তজা সুপ্রিমকোর্টে জাল সাক্ষ্য দেওয়া অপরাধে, সার রবার্ট পিল সাহেবের বিচারে চৌদ্দ বছরের জন্য ট্রান্সপোর্ট হলেন, তার পরিবারের কিছুকাল অত্যন্ত দুঃখে কাল কাটিয়ে শেষে মুড়িমুড়কির দোকান করে দিনপাত কত্তে লাগলেন; মুড়িঘাটা লেনের হুজুর কোন বিশেষ কারণে বারোইয়ারিপুজোর মধ্যে কাশী গ্যালেন। প্যালানাথবাবু একদিন কতকগুলি বাঈ ও মেয়েমানুষ নিয়ে বোটে করে কোম্পানীর বাগানে বেড়াতে যাচ্ছিলেন; পথে আচমকা একটা ঝড় উঠলো, মাঝিরে অনেক চেষ্টা কল্লে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না, শেষে বোটখানি একেবারে একটা চড়ার উপর উল্টে পড়ে চুরমার হয়ে ডুবে গেল। বাবু বড়মানুষের ছেলে, কখন সাঁতার দেন নাই। সুতরাং জলের টানে কোথায় যে গিয়ে পড়লে তার অদ্যাপি নির্ণয় হয় নাই। মুখুয্যেদের ছোটবাবু ক্রমে ভারি গাঁজাখোর হয়ে পড়লেন, অনবরত গাঁজা টেনে তার যক্ষ্মাকাস জন্মালো, আরাম হবার জন্যে তারকেশ্বরের দাড়ি রাখলেন বাল্‌সীর চরণামৃত খেলেন, সাফরিদের মাদুলী ধারণ কল্লেন; কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না, শেষে বিবাগী হয়ে কোথায় যে বেরিয়ে গেছেন, আজও তার ঠিকানা হয় নাই। প্রধান দোয়ার গবারাম গাওনা ছেড়ে পৈতৃক পেশা গিল্টি অবলম্বন করে কিছুকাল সংসার চালাচ্ছিলেন, গত পুজোর সময় পক্ষাঘাত রোগে মরেচেন। পচ্চুবাবু, অঞ্জনারঞ্জন দেব বাহাদুর ও আর আর অধ্যক্ষ দোয়ারেরা এখনও বেঁচে আছেন। তাদের যা হবে, তা এর পরে বক্তব্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *