১. সিল্কের ঝলমলে লুঙ্গি

রাবণের দেশে আমি এবং আমরা ভ্রমণকাহিনী — হুমায়ূন আহমেদ

ভূমিকা

এই বইটিকে ভ্রমণকাহিনী বলা যাবে না। ভ্রমণকাহিনী আমি আসলে লিখতে পারি না। বিদেশে ট্রাভেলগ নামে কিছু বই আছে। ভ্রমণের সঙ্গে গল্প মেশান। এই বইটিকে ট্রাভেলগও বলা যাবে না। ভিন দেশে আমাদের আনন্দ-বেদনার কাব্য বলা যেতে পারে। চেষ্টা করেছি তথ্য দিয়ে বইটিকে ভারী না করতে, বাধ্য হয়ে কিছু তথ্য দিতে হয়েছে। তথ্যে ভুল থাকার কথা না, তারপরেও কোনো ভুল কারও চোখে পড়লে আমাকে জানাবেন। পরের সংস্করণে ঠিক করে দেওয়া হবে।

শ্রীলংকা দেখার আমার শখ ছিল। কারণটা বিচিত্র। মহান বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর লেখক আর্থার সি ক্লার্ক নিজ দেশ ফেলে সারা জীবন এই দেশে কাটিয়েছেন। একজন লেখকের কাছে নিজ দেশের চেয়ে অন্যদেশ কেন মনে ধরল তা জানার ইচ্ছা ছিল।

হুমায়ূন আহমেদ
নুহাশপল্লী

.

০১.

সিল্কের ঝলমলে লুঙ্গি পরা একজন হাস্যমুখী মানুষ। দেখতে আমাদের বাঙালিদের মতো। যখনই হাসছেন তখনই ধবধবে সাদা দাঁত ঝকমকিয়ে উঠছে। ভদ্রলোকের হাতে গোলাপি রঙের ক্যামেরা। তিনি বিপুল উৎসাহে ক্যামেরায় একের পর এক ছবি তুলে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে নিজেও ছবির জন্যে পোজ দিচ্ছেন। তাঁর ক্যামেরায় অন্যরা ছবি তুলে যাচ্ছে।

ঘটনাটা ঘটছে ঢাকা এয়ারপোর্টের (এই এয়ারপোর্টের নাম ঘনঘন বদলাচ্ছে বলে ঢাকা এয়ারপোর্ট বলছি) যাত্রীদের ওয়েটিং লাউঞ্জে, যেখানে শ্রীলংকাগামী যাত্রীরা প্লেনে ওঠার অপেক্ষায় বসে আছেন। যাত্রীদের মধ্যে আছি আমি, দুই পুত্র এবং তাদের মা শাওন। লুঙ্গি পরা মানুষটির কর্মকাণ্ড আগ্রহ নিয়ে দেখছি। আগ্রহে বাধা পড়ল, কারণ হঠাৎ করেই পারিবারিক বিপ্লবের সূচনা হলো। তিন মাস বয়েসী কনিষ্ঠপুত্র নিনিত গলায় মাইক ফিট করে কান্না শুরু করেছে। সে দুধ খাবে। কৌটার দুধ আছে, কিন্তু তার মা দুধ গোলানোর পানি আনতে ভুলে গেছে। বেচারিকে বিব্রত দেখাচ্ছে।

নিনিতের বড় ভাই নিষাদের বয়স সাড়ে তিন বছর। সে তার ছোট ভাইকে কাঁদতে দেখলেই নিজে কাঁদার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে। নিষাদ বলল, আমার ক্ষিধে পেয়েছে। আমি এখন কী খাব? বলেই ভাইয়ের সঙ্গে গলা মিলিয়ে কান্না।

আমার সফরসঙ্গী স্কুলজীবনের বন্ধু সেহেরি এবং তার স্ত্রী নাজমা। তাদের মধ্যে কিছু নিয়ে ঝামেলা বেঁধেছে। নাজমা ভাবি শান্তমুখে স্বামীকে কঠিন কঠিন কথা বলছেন। সেহেরি গৌতম বুদ্ধের মতো মৌনভাব ধারণ করেছে। পারতপক্ষে সে স্ত্রীর সঙ্গে ঝামেলায় যায় না। বাইপাস অপারেশনের পর তার মধ্যে ভেজিটেবলভাব প্রবল হয়েছে। উচ্চশ্রেণীর কোনো ভেজিটেবলও না, নিম্নশ্রেণীর। যেমন ধুন্দুল।

আমাদের এই হৈচৈ ঝামেলার মধ্যে লুঙ্গি পরা মানুষটি ক্যামেরা হাতে এগিয়ে এলেন। হাসিমুখে বললেন, আমি আপনাদের ছবি তুলি?

আমি যথেষ্টই বিরক্ত হয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। তখন একজন বললেন, উনি বাংলাদেশে শ্রীলংকার হাইকমিশনার। যারা শ্রীলংকায় যাচ্ছেন তাদের হ্যালো বলতে এসেছেন।

আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। এক জীবনে নানান দেশে গিয়েছি। কোনো দেশের হাইকমিশনার বা অ্যামবেসেডারই এয়ারপোর্টে হ্যালো বলতে আসেন নি। ঘটনাটা কী?

সেহেরি বলল, বাংলাদেশ-শ্রীলংকা সরাসরি বিমান চলাচল আজই প্রথম শুরু তো, এই কারণেই হাইকমিশনার এসেছেন।

নাজমা ভাবি যে-কোনো ঘটনা নেগেটিভ ভাবে দেখার অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছেন। তিনি মহা বিরক্ত হয়ে বললেন, প্রথম বিমান চলাচল শুরু হয়েছে তার জন্যে হাইকমিশনার আসার দরকার কী? এইগুলা আবার কী ঢং! ছবি তোলাতুলিতে সময় নষ্ট। তার কারণেই তো বিমান ছাড়তে দেরি করছে।

বাংলাদেশ-শ্রীলংকা সরাসরি বিমান যাত্রার প্রথম ফ্লাইটের যাত্রী আমরা–এই তথ্য আমার জানা ছিল না। শ্রীলংকা ভ্রমণের আইডিয়া শাওনের। সব ব্যবস্থা সে করেছে। আমাকে কিছু জানায় নি, আমি জানতেও চাই নি। আমার কাছে এই মুহূর্তে শ্রীলংকা ভ্রমণ বিভীষিকার মতো। পুত্র নিনিতের বয়স তিন মাস। আমি অতীত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, বিদেশের মাটিতে পা দেওয়া মাত্র এই ছেলে তার মাকে চিনবে না। সে সারাক্ষণ বানরের বাচ্চার মতো আমার ঘাড়ে ঝুলে থাকবে। ফিডারে করে তাকে দুধ খাওয়ানো থেকে শুরু করে ডায়াপার বদলানোর সর্ব দায়িত্ব আমার। একই ব্যাপার নিষাদের বেলায়ও ঘটেছে। সারাক্ষণ বাবা! বাবা! বাবা ডাক অবশ্যই মধুর, কিন্তু বিদেশের মাটিতে না।

আমরা মিহিন লংকা বিমানে উঠেছি। সেহেরি এবং তার স্ত্রী বসেছেন আমাদের পেছনেই। নাজমা ভাবি ‘মেদভুঁড়ি কী করি’ গ্রুপের সদস্য। সিটে অনেক কষ্টে শরীর আঁটিয়েছেন। এখন বেল্ট বাঁধতে পারছেন না। তার বিরক্তি হঠাৎ তুঙ্গে উঠেছে। তিনি তার স্বামীকে ধমকাচ্ছেন–সিটে বাঁকা হয়ে বসেছ কেন? সোজা হয়ে বসো। পা নাচাচ্ছ কেন? তুমি কি পুলাপান? ওই দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছ কেন? সাদা চামড়ার মেয়ে আগে দেখো নাই? জীবনে প্রথম দেখছ?

তিন ঘণ্টার বিমান ভ্রমণে উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটল না। শুধু একজন বিমানবালা নাজমা ভাবির কাছে ধমক খেয়ে হকচকিয়ে গেল। বেচারি এসেছিল সেহেরিকে জিজ্ঞেস করতে, লাঞ্চে দুটা চয়েস আছে। নাসি গোড়াং এবং জিরা রাইস। সে কোনটা নিবে?

নাজমা ভাবি শ্রীলংকান বিমানবালাকে খাস বাংলায় বললেন, তারে জিজ্ঞেস করেন কেন? সে কি কিছু জানে? তারে যা দিবেন গবগবায়া খাবে। তার যে ডায়াবেটিস–এটা খাওয়ার সময় মনে থাকে না।

শ্রীলংকার এই বিমানবালার খাঁটি বাংলা বোঝার কোনোই কারণ নেই। ইউনিভার্সল বডি ল্যাংগুয়েজের কারণেই মনে হয় সে বুঝল। দু’ধরনের খাবার এনে নাজমা ভাবির সামনে ধরল। ভাবি ভুরু কুঁচকে বলল, এইগুলা কী? আমাদের দেশের কোনো ফকিরের পোলাও তো এইগুলা খাবে না।

.

বন্দর নায়েকে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে নেমে দেখি, আমাকে রিসিভ করার জন্যে শ্রীলংকায় বাংলাদেশ মিশনের কনসুলার অফিসার মীর আকরাম এসেছেন। তার হাতে সুন্দর গিফট র‍্যাপে মোড়া উপহার। আমার লজ্জার সীমা রইল না। অ্যাম্বেসির লোকজনের গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত থাকা উচিত। একজন লেখককে রিসিভ করতে এয়ারপোর্ট এসে সময় নষ্ট করা উচিত না।

আমি হাসিমুখে (নকল হাসি। এভারেস্টবিজয়ী মুসা ইব্রাহিম যে হাসি হেসে ছবি তোলেন।) আকরাম সাহেবের হাত থেকে উপহার নিলাম। ছবি উঠল। আমি এবং শাওন আবার হাসিমুখে একই গিফট নিলাম। আবারও ছবি উঠল। পুত্র নিষাদকে মাঝখানে রেখে তৃতীয়বারের মতো গিফট নেওয়া হলো। নকল হাসির বাজার বসে গেল।

গিফট হাতে নিয়ে আমি হতভম্ব। সেখানে লেখা–হুমায়ুন স্যার এবং শাওন ভাবির বিবাহবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা। পৃথিবীর বেশির ভাগ স্বামীর মতো আজকের দিনটি আমার মনে নেই। এতক্ষণে দুয়ে দুয়ে চার হলো। শাওন কেন এই দিনেই শ্রীলংকা যাওয়ার ব্যবস্থা করল, কেন আমাকে ভ্রমণসংক্রান্ত কিছুই জানায় নি, কেন আমার কাছ থেকে কোনো টাকাপয়সা নেয় নি–সব পরিষ্কার। শ্রীলংকায় প্রমোদ ভ্রমণ বিবাহবার্ষিকীতে আমাকে দেওয়া শাওনের উপহার। এখন আমার উচিত তার দিকে প্রেমপূর্ণ নয়নে তাকানো, তা পারছি না। কারণ কনিষ্ঠ পুত্র শ্রীলংকার বাদরের মতোই আমার গলায় ঝুলে তারস্বরে চিৎকার শুরু করেছে। তার ডায়াপারের ফাঁক দিয়ে হলুদ রঙের সিরাপের মতো কী যেন নামছে। তার বড় ভাই কিছুক্ষণ পরপর আমার শার্টে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলছে, বাবা! আমি এখন কী খাব?

 [পাঠক-পাঠিকারা নিশ্চই কৌতূহল বোধ করছেন, গিফট র‍্যাপে মোড়া উপহারটা কী জানার জন্যে। তাদের কৌতূহল মেটাচ্ছি। উপহার হলো একটা ফটোফ্রেম। ফটোফ্রেমের বিশেষত্ব হচ্ছে ফ্রেম বানানো এলাচির খোসা দিয়ে। গরম মসলার দেশে সব কিছুতে গরম মসলা থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক।]

আকরাম সাহেব আমাদের জন্যে গাড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছেন। (সাড়ে চার শ’ ডলারে চুক্তি। সাত দিন গাড়ি থাকবে আমাদের সঙ্গে।) নয় সিটের বিশাল গাড়ি। গাড়ির চালক সুদর্শন যুবা পুরুষ, নাম ‘দিগায়ু’। আমি চালককে বললাম, তোমার নামের অর্থ কি দীর্ঘ জীবন?

চালক অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ। তুমি কীভাবে জানলে?

দীর্ঘায়ু থেকে দিগায়ু– এটি আর ব্যাখ্যা করলাম না। আমার নজর সেহেরির দিকে। সে চোখের ইশারায় আমাকে কী যেন বলতে চাচ্ছে। মেয়েদের চোখের ভাষা সহজেই পড়া যায়, পুরুষদেরটা পড়া যায় না। এক পর্যায়ে সেহেরির চোখের ভাষা বুঝতে পারলাম। সে তার স্ত্রীর পাশে বসতে চাচ্ছে না। আলাদা বসতে চাচ্ছে। আমি বললাম, সেহেরি! তুমি ড্রাইভারের পাশে বসো।

 নাজমা ভাবি বললেন, এটা কেমন কথা! স্বামী-স্ত্রী বসবে পাশাপাশি, এটাই নিয়ম।

আমি বললাম, প্রবাসে নিয়ম নাস্তি। এর অর্থ বিদেশে কোনো নিয়ম নেই।

নাজমা ভাবি বললেন, আপনারা তো স্বামী-স্ত্রী ঠিকই পাশাপাশি বসেছেন।

আমি বললাম, আমাদের দুজনের মাঝখানে ডাবল হাইফেনের মতো দুই পুত্র।

নাজমা ভাবি মুখ ভোঁতা করে পরিস্থিতি মেনে নিলেন। আমাদের টিম লিডার শাওনের নির্দেশে গাড়ি চলতে শুরু করল। আমরা যাচ্ছি ‘ডাম্বুলা’। সেখানে কোন হোটেলে উঠব, দর্শনীয় কী দেখব, কিছুই জানি না। টিম লিডার জানেন এটাই যথেষ্ট।

শাওন বলল, ডাম্বুলা যেতে আমাদের লাগবে মাত্র আড়াই ঘণ্টা। আমরা উঠব পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হোটেলগুলির একটিতে। হোটেলটা ডিজাইন করেছেন পৃথিবীর সেরা আর্কিটেক্টদের একজন, তাঁর নাম জেফরি বাওয়া। হোটেলের নাম হেরিটেন্স কাভালামা। প্রায় বছরই এটি পৃথিবীর সেরা পরিবেশবান্ধব হোটেল হিসেবে ইউনেস্কো পুরস্কার পায়।

কী মনে করে আমি দিগায়ুকে জিজ্ঞেস করলাম, ডাম্বুলা যেতে আমাদের কতক্ষণ লাগবে।

সে বলল, সাত থেকে আট ঘণ্টা।

আমি টিম লিডারের দিকে তাকালাম। টিম লিডার বললেন, আমি সব তথ্য পেয়েছি ইন্টারনেটে। এক্ষুণি তোমাকে দেখাচ্ছি।

সে তার আইফোন নিয়ে টেপাটিপি করতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে তার মুখ পাংশুবর্ণ হয়ে গেল। সে জানাল তার আইফোন কাজ করছে না।

আমি দিগায়ুকে বললাম, আমরা দীর্ঘ ভ্রমণে রওনা হয়েছি, ধরো কোনো কারণে গাড়ি নষ্ট হয়ে গেল, তখন আমরা কী করব?

দিগায়ু বলল, আমি কোম্পানিকে টেলিফোন করে দিলেই অন্য গাড়ি চলে আসবে। তবে ছোট্ট সমস্যা হয়েছে।

কী সমস্যা?

 হাত থেকে পড়ে আমার মোবাইল ফোন নষ্ট হয়ে গেছে।

আমি বললাম, চমৎকার। ধরা যাক কয়েকটা ইঁদুর এবার।

 দিগায়ু বলল, কী বললে বুঝলাম না।

আমি বললাম, বাংলা ভাষায় আনন্দ প্রকাশ করলাম।

ততক্ষণে আনন্দের বদলে আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবার ক্ষুধা পাবে। সঙ্গে শ্রীলংকার কোনো টাকা নেই। এয়ারপোর্টে ডলার ভাঙানো হয় নি, কারণ টিম লিডারের নির্দেশ পাওয়া যায় নি।

আমি দিগায়ুকে বললাম, পথে আমাদের কিছু খেতে হবে। এমন কোনো রেস্টুরেন্ট কি পাওয়া যাবে যেখানে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা যায়? আমার সঙ্গে ক্রেডিট কার্ড আছে। ডলার আছে।

দিগায়ু বলল, সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে চেষ্টা করে দেখব।

প্রতি আধঘণ্টা পরপর দিগায়ু একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামাচ্ছে। খোঁজ নেওয়ার জন্যে ছুটে যাচ্ছে এবং মুখ শুকনো করে ফিরে আসছে। আমি প্রমাদ গুনলাম।

অন্ধকার রাস্তা। স্ট্রিট লাইটের ব্যবস্থা নেই। রাস্তাও ভালো না। বাংলাদেশের মফস্বল শহরের রাস্তার মতো খানাখন্দে ভরা। আমরা ঝাঁকুনি খেতে খেতে এগুচ্ছি। ঝাঁকুনির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ভালো। নিনিত ঘুমাচ্ছে। শিশুরা বিচিত্র কারণে ঝাঁকুনি পছন্দ করে।

সেহেরি বলল, আমার ডায়াবেটিস! কিছু না খেলে তো মারা যাব।

আমি বললাম, নিনিতের দুধ আছে। ফিডারে করে বানিয়ে দেই খাও।

সেহেরি হতাশ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে মৌনভাব ধরল। নাজমা ভাবি বললেন, হুমায়ূন ভাই তো ভুল কিছু বলেন নাই। তুমি রোগী মানুষ। তোমার খাওয়া দরকার। দুধ তোমার জন্যে উপকারী। বাচ্চাদের দুধে ফ্যাটও থাকে কম।

সেহেরি ক্ষিপ্ত গলায় বলল, আমি ফিডারে করে দুধ খাব?

নাজমা ভাবি বললেন, তোমার জন্যে এখন গ্লাস পাব কই? হুমায়ূন ভাই জ্ঞানী মানুষ। তিনি না ভেবে-চিন্তে কিছু বলেন না।

সেহেরি বলল, চুপ করো তো!

নাজমা ভাবি বললেন, চুপ করব কেন? চুপ করার কী আছে? আগে তো জীবন রক্ষা করবে, তারপর অন্য কিছু। তোমাকে ফিডারে দুধ খেতে হবে। আমরা আমরাই তো। কেউ তো আর ঘটনা দেখছে না।

প্রিয় পাঠক, সেহেরি ফিডারে দুধ খেয়েছে কি খায় নি তা পরিষ্কার করছি না। সব তথ্য প্রকাশ করতে নেই। তবে আমাদের রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন, গোপন কথাটি রবে না গোপনে।

গভীর রাতে আমরা জেফরি বাওয়ার ডিজাইন করা হোটেলে ঢুকতে শুরু করলাম। মনে হলো সুরঙ্গের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। একসময় গাড়ি থামল। পাথরের প্রকাণ্ড পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে হোটেল। কেমন যেন ভৌতিক দেখাচ্ছে।

ফাইভস্টার হোটেলের লবি হয় আলোঝলমল। দেখামাত্র চোখ ধাঁধিয়ে যায়। এখানে লবি বলে কিছু নেই। টেবিলের কোণে দু’টি লুঙ্গি পরা মেয়ে বসে আছে। তাদের সামনে টিমটিম করে আলো জ্বলছে। আধো আলো এবং অন্ধকার। সব মিলিয়ে অতি রহস্যময় পরিবেশ।

নাজমা ভাবি কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, হুমায়ূন ভাই! এই কোন জঙ্গলে এনে আপনি তুললেন? তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই ফল পড়ার মতো গাছ থেকে দুটা বাঁদর পড়ল। নাজমা ভাবি চেঁচিয়ে উঠলেন, এইগুলা কী! এইগুলা কী!

পুত্র নিষাদ বলল, এগুলির নাম মাংকি!

মাংকি দু’টা নিষাদের সামনে এসে দাঁড়াল। মুহূর্তের মধ্যেই নিষাদের হাতের চকলেটের প্যাকেট কেড়ে নিয়ে গাছে উঠে পড়ল।

ভয়ে হোক কিংবা প্রেমবশতই হোক নাজমা ভাবি সেহেরিকে জড়িয়ে ধরে আছেন। দৃশ্যটা দেখতে ভালো লাগছে।

.

অতি দ্রুত আমরা রুমের চাবি পেয়ে গেলাম। রিসিপশনিস্ট মেয়েটি বলল, তোমাদের রুমের একদিকটা পুরোটাই কাচের। স্লাইডিং ডোর। রাতে ঘুমুবার আগে অবশ্যই স্লাইডিং ডোর লক করবে। নয়তো বাঁদর ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র নিয়ে যাবে।

নাজমা ভাবি হেঁচকি তোলার মতো শব্দ করে বললেন, হুমায়ূন ভাই, আপনি কোথায় এনে তুলেছেন! রাতে বান্দর ঢুকে তো আমাকে খেয়ে ফেলবে।

সেহেরির ঠোঁটের ফাঁকে ক্ষীণ হাসি। বাঁদর তার স্ত্রীকে খেয়ে ফেলছে–এই দৃশ্য কল্পনায় দেখে তার হয়তো ভালো লাগছে।

ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত বিধ্বস্ত অবস্থায় রুমে ঢুকলাম। শাওন বলল, হোটেল পছন্দ হয়েছে?

আমি বললাম, ভোর হোক, তারপর বলব।

রুমের সামনের বিশাল বারান্দায় সাত-আটটা বাঁদর এসে বসে আছে। গভীর আগ্রহে তারা নতুন অতিথিদের দেখছে। একটিকে দেখলাম দু’পায়ে ভর দিয়ে মানুষের মতো দাঁড়িয়ে আছে। নিষাদ তার দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলল, Don’t touch me, সে কিছুদিন হলো স্কুলে যাচ্ছে। তার ইংরেজি স্কুল থেকে শেখা।

পাশের রুমে সেহেরি এবং নাজমা ভাবি। নাজমা ভাবির কঠিন গলা শোনা যাচ্ছে। সেহেরির গলা পাওয়া যাচ্ছে না। ঝগড়া হচ্ছে একতরফা।

আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকীর রাত। রাতটাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে কিছু একটা করা দরকার। আমি শাওনের দিকে তাকিয়ে বললাম, একটা গান করো তো।

শাওন বলল, এই অবস্থায়?

আমি বললাম, হ্যাঁ।

 নিষাদ বলল, মা গান করবে না। আমি করব। বলেই সে গান ধরল–

আজকের আকাশে অনেক তারা
 দিন ছিল সূর্যে ভরা
আজকের জোছনাটা আরও সুন্দর
সন্ধ্যাটা আগুনলাগা।

শাফিন আহমেদের গাওয়া এই গানটা নিষাদ পুরোটা গাইতে পারে। নিষাদ গান করছে, তার মা’র চোখ ছলছল করছে। আহারে, কী সুন্দর দৃশ্য!

.

ভোর হয়েছে।

আমি চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় বসে আছি। আমার সামনে বিশাল কান্ডালামা লেক। আকাশ ঘন নীল। সেই নীল গায়ে মেখে কান্ডালামা হ্রদ হয়েছে নীল। কী আনন্দময় অপূর্ব দৃশ্য! আমি মনে মনে বললাম, ‘আজ আমি কোথাও যাব না।’

মধ্যবিত্তের বিদেশ ভ্রমণ হলো চড়কিবাজি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘোরাঘুরি। দর্শনীয় যা আছে সব দেখে ফেলতে হবে। কোনোকিছু যেন বাদ না পড়ে। এত টাকাপয়সা খরচ করে এসে বিশ্রামে সময় নষ্ট করা কেন?

ইউরোপ-আমেরিকার ট্যুরিস্টদের দেখি ভ্রমণের সঙ্গে তারা যুক্ত করে বিশ্রাম। রোদে শুয়ে থেকে বই পড়ে। বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ঘুম। ঠান্ডা বিয়ারের গ্লাসে চুমুক।

.

আমি সারা দিন আমার ঘরের বারান্দায় বসে কাটাব–এই দুঃসংবাদ শুনে নাজমা ভাবির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তিনি হতাশ গলায় বললেন, আপনি তো সারা দিন নুহাশপল্লীর বাংলোর বারান্দাতে বসে সময় কাটাতে পারেন। এত টাকাপয়সা খরচ করে এখানে তাহলে এসেছেন কেন?

অকাট্য যুক্তি। কিন্তু লেখকশ্রেণী যুক্তির বাইরে থাকতে পছন্দ করেন। আমি হ্রদের দিকে তাকিয়ে বারান্দায় বসে রইলাম। আমার সামনে কাগজ-কলম। দেশের বাইরে আমি কখনো লেখালেখি করি না। এই তথ্য জানার পরেও আমি যেখানে গিয়েছি শাওন কাগজ-কলম নিয়ে গেছে। আমার সামনে রেখেছে। শাওনকে খুশি করার জনেই কবিতার কয়েকটি চরণ লেখার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম।

আজ দুপুরে হ্রদের নিমন্ত্রণ।
অতিথি আমরা ক’জন।
 পুত্র নিষাদ এবং শাওন
শাওনের লেখক স্বামী…

এরপর আর মিলাতে পারছি না। গদ্যলেখক হওয়ার অনেক সুবিধা। মিলানোর চিন্তা নেই। কবিতাটা হয়তো আরও কয়েক লাইন লিখতে পারতাম, তার আগেই দুর্ঘটনা ঘটল। বাঁদর এসে টেবিল থেকে চশমা নিয়ে পালিয়ে গেল। চশমা ছাড়া আমি কাছের জিনিস দেখতে পাই। দূরের কিছুই দেখি না। এখন উপায় কী হবে! আমার হাহাকার ধ্বনি শুনে শাওন বারান্দায় এসে আমাকে আশ্বস্ত করল। সে আমার আরও দুটি চশমা নিয়ে এসেছে।

এখন অতি বিস্ময়কর একটি ঘটনা বলি। রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে বারান্দায় গিয়েছি শেষ সিগারেট খেতে। অবাক হয়ে দেখি টেবিলে আমার চশমা। যে বাঁদর চশমা নিয়ে গিয়েছিল সে ফেরত দিয়ে গিয়েছে।

.

পুনশ্চ

কান্ডালাম হোটেলে এক ভোরবেলায় নাশতা খাচ্ছি, বেয়ারা যখন শুনল আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি তখন আনন্দে তার বত্রিশ দাঁত বের হয়ে গেল। তার আনন্দের কারণ বুঝতে না পেরে আমি জানতে চাইলাম, বাংলাদেশী শুনে এত খুশি কেন?

সে বলল, তোমরা খুব ভালো মারামারি করতে পারো।

আমি আকাশ থেকে পড়লাম। তার কাছে শুনলাম, এই হোটেলে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম এবং ইন্ডিয়ান ক্রিকেট টিম ছিল। তাদের মধ্যে মারামারি লেগে গেল। বাংলাদেশ জিতল। দু’দলের মারামারি থামিয়েছিলেন ক্রিকেটার জাভেদ ওমর।

যেভাবেই হোক দেশ পরিচিতি পাচ্ছে, এটা খারাপ কী!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *