দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইলো না-
সেই-যে আমার নানা রঙের দিন গুলি।
কান্নাহাসির বাঁধন তারা সইল না-
সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।।
জগতের নিয়মই এটা। রঙিন দিনগুলি আর থাকে না। স্মৃতিটুকু থাকে, তবে সেটাও ক্রমশই ধূসর বর্ণ ধারণ করে। সবার জীবনে এটা সত্য। এটা শাশ্বত। মানুষ জন্মাবে, জগতের আলো বাতাসে হাসবে, খেলবে, কাজ করবে, তারপর একদিন বিদায় নেবে। বিদায় সবসময় বেদনাবিধুর হয়ে থাকে। তবু বিদায় নিতে হয়। এটাই নিয়ম।
বিদায় নেয়ার ঘণ্টাটা কখন বেজে ওঠে মনের ভেতরে, তা কি কেউ দিনক্ষণ ধরে, ঘণ্টা-মিনিট ধরে বলতে পারবে? না, মনে হয় না। অদৃশ্য এক শক্তি এসে ঠাঁই নেয় মনে সে সময়। সেই বলে-সময় হয়েছে তো কী হয়েছে? বাকী জীবনের প্রতিটি ক্ষণকে উপভোগ কর, আনন্দে মেতে ওঠো।
কিন্তু কীভাবে আনন্দ করা যায় এ বয়সে এসে? তার সমাধান একটিই, কাজ। কাজ করে যেতে হবে শেষ অবধি। তবেই ধূসর দিনগুলিও সপ্তবর্ণা হয়ে উঠবে। এ দর্শনটা আমায় দিয়েছেন প্রখ্যাত লেখক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। তাঁর লেখা বিখ্যাত উপন্যাস লোটাকম্বল ঢাকার একটি বেসরকারি চ্যানেলে প্রচার উপলক্ষ্যে এসেছিলেন এখানে, তখনই দেখা, আলাপ, দারুণ একটি ব্যক্তিত্ব। আমি তো মুগ্ধ ঘণ্টা চারেকের আলাপচারিতায়। হাত দেখতে পারেন চমৎকার। কথায় কথায় বলেছিলেন—বয়েস হয়েছে তো কী হয়েছে—‘Tomorrow is the first day of rest of your life’ সেটাকে সেভাবে ভেবেই অনুপ্রাণিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে কাজে। কাজ করে আনন্দ উপভোগ করেই দিন কাটবে চমৎকার।
আমিও এই দর্শনটাই মেনে চলতাম। সঞ্জীবদার সাথে পরিচয় হওয়ার আগে থেকেই আমার আদর্শ ওটাই। বুড়ো হয়েছি— কথাটা ভুলেও মনে আনা যাবে না কখনো। আমিও আনি না। সকাল দশটা থেকে রাত দশটা অবধি সপ্তাহে প্রায় সাতদিনই কাজ করে চলেছি। এই কাজটিকে আমি ভালোবাসি তাই হয়তো ক্লান্তি আমাকে পেয়ে বসে না কখনো।
আব্বার কথা মনে পড়ে— যেদিন অবসর নিলেন, তাঁকে বেশ ঘটা করে বিদায় সংবর্ধনা জানানো হয়েছিল অফিস থেকে।
সন্ধেয় বাড়ি ফিরলেন— অনেক উপহার নিয়ে। সাথে একটি ফুলের মালা। উপহারের তালিকাটা আমি এখনও মুখস্ত বলে দিতে পারি। ১. জায়নামাজ, ২. কোরআন শরীফ, ৩, টুপি, ৪. লাঠি, ৫. তসবীহ। আব্বার মুখের মলিন হাসিটিও মনে গাঁথা রয়েছে আমার। এভাবে একটা মানুষকে আমরা বলে দিই— তুমি শেষ, যাও, মৃত্যুর দিন গুনো। অথচ আব্বার বয়স তখন কত? বড় জোর ছাপ্পান্নো। পরদিন থেকে সত্যিই তাঁর শারিরীক ভাষাও লক্ষ্যণীয়ভাবে বদলে গিয়েছিল।
উন্নত দেশগুলোর সাথে এখানেই আমাদের পার্থক্য। রাস্তাঘাটে দেখলেই বোঝা যায় আশি-নব্বই বছরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা একা একা পথ চলছেন, করছেন বাজার-ঘাট। সাহায্য করতে গেলে তেড়ে আসেন— ‘কী মনে করো, আমি বুড়ো?’
তবে সব কথার এক কথা, প্রাকৃতিক নিয়মে বুড়ো আপনি হবেনই, মানেন আর নাই মানেন। একটা রস ম্যাগাজিনে পড়েছিলাম— কতটা বুড়ো হয়েছেন সেটা যদি জানতে চান তো এই নিয়মটা খেয়াল করতে পারেন।
বার্ধক্যের চারটি স্তর আছে। প্রথম স্তরের বৃদ্ধ হলে আপনি চেনা মানুষের নাম ভুলে যাবেন। দ্বিতীয় স্তরে পৌঁছে আপনি ভুলে যাবেন চেনা মানুষের চেহারাও। এর পরবর্তী স্তরে পৌঁছুলে আপনি ভুলে যাবেন প্যান্টের চেইন লাগাতে। আর শেষ স্তরে পৌঁছালে তো প্যান্টের চেন খুলতেই ভুলে যাবেন।
হাসির কথা, কিন্তু বড়ই করুণ দশা।
চতুর্থ দশার এক বৃদ্ধ একবার ডাক্তারকে গিয়ে বললেন— তিনি ঈশ্বরের আলো দেখেছেন। কীভাবে?
‘কাল রাতে যখন ছোট কাজে বাথরুমে গেলাম, দরজাটা খুলতেই আলো জ্বলে গেল। তারপর কাজ সেরে দরজাটা বন্ধ করতেই আলো বন্ধ হয়ে গেল। এ নিশ্চয়ই ঈশ্বরের আলো।’ অবাক ডাক্তার এই কথাটি বৃদ্ধের স্ত্রীকে জানাতেই মহিলা তেলে বেগুনে জ্বলে বললেন-‘দেখেছেন, হারামজাদা বুড়ো আজও ফ্রিজের মধ্যে পেশাব করেছে।’
এ চুটকিটা বলতে গিয়ে আমার প্রখ্যাত কৌতুক অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়ে গেল। সেই চুয়াত্তরে একবার ঢাকায় এসেছিলেন। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এক পুরস্কার (সম্ভবত বাচসাস ও সিকোয়েন্স এ্যাওয়ার্ড) বিতরণী অনুষ্ঠানে চুটকি শোনাচ্ছিলেন। আমিও সেদিন ওই অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম পুরস্কার গ্রহণ করতে। ভানু বাবু বললেন-হাস্যরসের সৃষ্টি হয় করুণ-রস থেকে। যেমন ধরেন একটি লোক রাস্তা দিয়ে যেতে গিয়ে কলার খোসায় পা-পিছলে পড়ে গেল, অমনি আপনি হাসতে শুরু করলেন, কিন্তু উনি যদি আপনার বাবা হন, তাহলেই বিষয়টি উল্টে যাবে। আপনি হাসবেন তো না-ই বরং কান্নাকাটি শুরু করবেন বাবার শারীরিক সমস্যা হলো কিনা সেই দুর্ভাবনায়।
বুড়োদের নিয়ে তৈরি হয় প্রচুর চুটকি। এটা অনেকে পছন্দ করেন, অনেকে করেন না। অনেকে বলেন অমানবিক-বুড়োদের শারীরিক অক্ষমতাকে কটাক্ষ করাটা অন্যায়। এটা ঈশ্বরের বিধান। পরোক্ষে ঈশ্বরকে কটাক্ষ করা হয়।
তারপরও বৃদ্ধরা করুণার পাত্র প্রায়ই হচ্ছেন। সন্তান আজকাল অচল বাবা-মাকে বুড়োদের হোমে পাঠাচ্ছেন। আমরা সেই ঘটনা নিয়ে নাটক-সিনেমা করছি। আহা, উহু, করেই শেষ। সমস্যার সমাধান করতে এগিয়ে আসছেন না কেউ-ই। এ এক অদ্ভুত জগৎ। স্বীকার করি আর না করি, আমি বুড়ো। কাগজে কলমে বুড়ো। রাষ্ট্র আমাকে বলছে আমি ‘প্রবীণ নাগরিক’। ভুলতে পারছি কই যে বুড়ো। সবাই মনে করিয়ে দিচ্ছে, প্রতি পদে। শুটিং-এ দুপুরে খাবার পর সবাই আমাকে বিশ্রাম নেবার জন্যে বিছানা দেখিয়ে দেয়, যেটা সবচেয়ে বিরক্তিকর মনে হয় আমার।
আজকাল আবার নতুন প্রজন্মের অনেকে রাস্তাঘাটে দেখা হলে কাছে এসে বলে-
‘চাচা, কবে চলে যাবেন ঠিক নাই। একটা ছবি তুলে রাখি আপনার সাথে।’
হাসিমুখেই ছবি তুলি, কিন্তু এটা কী বৃদ্ধদের প্রতি সম্মান না অবমাননা? ব্যাঙ্গ? কোনো কিছুতে ভুল হলেই সবাই ইঙ্গিত করে বয়েসের দিকে। এটাও অনুচিত বলেই আমি মনে করি। এগুলোই বার্ধক্যকে করুণা করার ইঙ্গিত ছাড়া আর কি?
মানুষ বৃদ্ধ হবে এটা যেমন শাশ্বত, তেমনি এটাও প্রকৃতির নিয়ম— সে বার্ধক্যে চোখে কম দেখবে, কানে কম শুনবে, নিজের ওপর কমবে নিয়ন্ত্রণ। চুল পাকবে, দাঁত পড়বে ইত্যাদি।
হ্যাঁ, আমি স্মরণশক্তির ব্যাপারটাই এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করছি। এটাও ভীষণ বেদনার কথা— আপনি দুপুরে ভাত খেয়েছেন কিনা সেটা যখন মনে করতে পারবেন না, তখন সবাই করুণা করবেই। হাসাহাসিও করবে।
মানুষের মাথায় কোটি কোটি নিউরণ কাজ করে-যারা হার্ডডিস্কের মত ঘটনাবলী (স্মৃতি) রেকর্ড করে রাখে। বৃদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এদের নাকি ঘটে চারিত্রিক পরিবর্তন। সেদিন কোনো একটা উপলক্ষ্যে আমরা বেশ কিছু প্রবীণ প্রকৌশলী উপস্থিত হয়েছিলাম। সেখানেই বার্ধক্য নিয়ে প্রসঙ্গ ওঠাতেই প্রকৌশলী ড. বাসুনিয়া চমৎকার একটা বাণী শোনালেন— কোনো এক বিজ্ঞানীর বাণী। “মানুষ চব্বিশ ঘণ্টার এক তৃতীয়াংশ কাটায় ঘুমে, আর ঘুমের সময় মানুষের বয়স থমকে থাকে, বাড়েও না কমেও না। সুতরাং আপনার বয়স যদি হয় ৯০ বছর, আপনি ঘুমিয়েছেন ৩০ বছর। তাহলে আপনি বুড়ো বুড়ো করে মরেন কেন! You are only 60 now! কথাটা আমার খুব মনে ধরেছে, আপনারাও যারা নিজেকে বুড়ো ভাবেন, তাদের জন্য একটা টোটকা রইল এখন।
তবে এটা তো ঠিক যে সে বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে নিকট অতীতকে ধরে রাখতে পারে না। যেমন ভাত খেয়েছেন কি খান নি? পকেটে টাকা রাখলেন নাকি? চশমাটা পরেছেন কিনা ইত্যাদি। কিন্তু দূরবর্তী অতীতের স্মৃতিগুলোকে সে নতুন করে সামনে নিয়ে আসে।
তখন বুড়োরা রোমন্থন শুরু করে পুরোনো ঘটনার। পুরোনো কথার, নস্টালজিক হয়। বলতেই থাকে কথা, আর বলতেই থাকে বিরতিহীনভাবে।
আমার আজ এই দশা। অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে। মন খুলে সবার সাথে কথা বলতে চাইছি। তাই স্মৃতির পাতা খুলে বসলাম সবার সামনে।
হয়তো বিরক্ত বোধ করবেন। হয়তো বা ভালো লাগতে ও পারে, তবুও থাক না-আমার ভবিষ্যত প্রজন্মর জন্য একটা রেফারেন্স দেয়ার মত কিছু। কিছু পেলেও পেতে পারে তারা এর পাতা ঘেঁটে। শুরু করি তাহলে পুরোন পথে যাত্রা। যে পথের নাম দিলাম রবিপথ। হ্যাঁ, রবিপথ। হ্যাঁ, রবি হলো এই কলমধারীর নাম সেটা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন।