ভালো হতে চাই – উপন্যাস – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
ট্যাক্সি ধরার জন্য অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল অভিজিৎ। সন্ধ্যের মুখটায় ধর্মতলায় ট্যাক্সি পাওয়া খুবই শক্ত। কিন্তু অভিজিতের বাড়ি ফেরার তাড়া আছে। ট্যাক্সির বদলে প্রথম থেকেই যদি সে বাসে ওঠার চেষ্টা করত, তাহলে এতক্ষণ বোধহয় বাড়ি পৌঁছে যেত! এখন আর উপায় নেই। এখন ট্যাক্সির আশা ছেড়ে বাস ধরতে গেলে তার সত্যিই অনেক দেরি হয়ে যাবে। সাড়ে সাতটার সময় সুমিত্রাকে কল্যাণদের বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়ার কথা। সাড়ে সাতটা বাজতে আর মাত্র দশ মিনিট বাকি।
তা ছাড়া, অভিজিতের নিয়তিই বোধ হয় তাকে ওইসময় ট্যাক্সির জন্যে দাঁড় করিয়ে রেখে দিল ধর্মতলায়। একটা ট্যাক্সি খুব কাছাকাছি এসে থামল। ভেতরের লোক নামছে। অভিজিৎ দৌড়ে গেল সেদিকে।
ট্যাক্সিতে তিন জন লোক বসে ছিল, তার মধ্যে থেকে নামল মাত্র এক জন। অর্থাৎ, ট্যাক্সিটা খালি হবে না। ভেতর থেকে একজন চেঁচিয়ে বলল, আরে অভিজিৎ না? কোথায় যাবি?
বাদল আর নিখিল। অভিজিতের পুরোনো বন্ধু। এর মধ্যে নিখিল থাকে বোম্বেতে, তিন চার বছর দেখা নেই।
অভিজিৎ জিজ্ঞেস করল, তোরা কোন দিকে যাচ্ছিস?
উঠে পড়, উঠে পড়।
কোন দিকে যাচ্ছিস, বল না?
উঠে পড় না।
আমার একটা জরুরি কাজ আছে।
উঠে পড় না, পৌঁছে দেবো আমরা।
একেবারে মোড়ের মাথায় ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রাখার নিয়ম নেই। চালক ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। অভিজিৎকে ট্যাক্সিতে উঠে পড়তেই হল।
তুই কবে এসেছিস নিখিল?
কাল রাত্তিরে। তোর খোঁজ করছিলাম। তুই বাড়ি বদলেছিস শুনলাম?
হ্যাঁ।
বিয়েও তো করেছিস?
অভিজিৎ ঠিক মনে করতে পারল না, নিখিলকে সে তার বিয়ের চিঠি পাঠিয়েছিল কিনা। বাদলকে অবশ্য নেমন্তন্ন করেছিল, কিন্তু সে কী জন্য যেন আসতে পারেনি।
ট্যাক্সি যাচ্ছে পার্ক স্ট্রিটের দিকে। অভিজিৎ বলল, তুই দু-একদিন থাকছিস তো নিখিল? পরে দেখা করব, আমাকে এখানে নামিয়ে দে, আমি আর একটা ট্যাক্সি ধরে নিই।
বেশ, তুই কোথায় যাবি?
আমাকে একবার মানিকতলায় যেতে হবে।
মানিকতলায় কেন?
সুমিত্রা মানে আমার স্ত্রী মানিকতলায় গেছে, কল্যাণদের বাড়িতে। ওখান থেকে ওকে সাড়ে সাতটার সময় আমার তুলে আনার কথা।
কল্যাণ কে?
কল্যাণ আমার এক পুরোনো বন্ধু, সম্পর্কে আবার সুমিত্রার একরকম ভাইও হয়। ওদের বাড়িতে আজ মেয়ে দেখার ব্যাপার আছে, সুমিত্রা সেইজন্য গেছে।
তোর স্ত্রী একা বাড়ি ফিরতে পারবেন না?
রাস্তাঘাট ঠিক ভালোমতন চেনে না।
তুই না গেলেও, কেউ-না-কেউ পৌঁছে দেবে নিশ্চয়ই।
না, না, আমি কথা দিয়েছি।
নিখিল হা-হা করে হেসে উঠল। তারপর বলল, আমরা তো ভাই বিয়ে করিনি, আমরা এ-রকম কথা দেওয়ার মানে বুঝি না। এত বড় একটা শহরে মেয়েরা নিজে যাতায়াত করতে পারে না মুম্বাইতে তো দেখেছি সকলে নিজেরাই ঘোরাফেরা করে।
অভিজিৎ একটু অস্বস্তি বোধ করল। কোনো উত্তর দিতে পারল না।
বাদল বলল, অভিকে তো আজকাল দেখাই যায় না। কোনো আড্ডাতেই দেখি না।
অফিসের বড্ড কাজ পড়ে গেছে। তারপর ক্লান্ত হয়ে পড়ি, বাড়ি চলে যাই।
নিখিল বলল, শোন, আমি পরশুই শিলং চলে যাচ্ছি। কাল সারাদিন স্টুডিয়োতে ব্যস্ত থাকব, তাহলে তোর সঙ্গে আর দেখাই হবে না অভিজিৎ।
বাদল বলল, এক কাজ কর না। আমরা রোলাণ্ড রোডের একটা ফ্ল্যাটে যাচ্ছি, সেখানে ফোন আছে। সেখান থেকে তোর স্ত্রীকে ফোন করে দে যে তোর যেতে একটু দেরি হবে।
অভিজিৎ বলল, না রে, আজ আমি চলেই যাই। কাল-পরশু ঠিক দেখা করে নেব তোদের সঙ্গে।
নিখিল বলল, কিন্তু তোর সঙ্গে যে আমার জরুরি দরকার আছে। ফোন করে দিবি তোর বউকে, তাতে অসুবিধে কী?
অভিজিৎ ক্ষীণ গলায় বলল, ঠিক আছে, চল।
বাদল বলল, ওখানে স্কচ আছে।
আমি মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।
নিখিল খানিকটা ঠাট্টার সুরে বলল, সে কী গুরু! এসব কী কথা শুনছি?
বাদল বলল, এই নিয়ে ক-বার ছাড়লি রে?
না, এবার সত্যি ছেড়ে দিয়েছি। বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছিল, প্রত্যেকদিনই একটা-না-একটা ঝামেলা!
অত বেশি না খেলেই হয়। আমিও ঝামেলা একদম পছন্দ করি না।
তোরা কার ফ্ল্যাটে যাচ্ছিস? সেখানে আর কে কে থাকবে?
চল না। তোর কোনো অসুবিধে হবে না।
ট্যাক্সি এসে থামল পুরোনো আমলের সাহেবি কায়দার একটি বাড়ির সামনে। এখানে এলে হঠাৎ বিশ্বাসই হয় না যে, কলকাতাটা এত ভিড়ের শহর। এখানকার রাস্তাঘাট নিরালা, বাড়িগুলো ফাঁকা ফাঁকা, প্রায় প্রত্যেকটি বাড়ির সামনে বাগান।
লোহার গেট ও বাগান পেরিয়ে একটি চওড়া গাড়িবারান্দা। সিঁড়িতে কার্পেট। তবু ঘরের দরজায় পেতলের নেমপ্লেট দেখে বোঝা যায় এটা ফ্ল্যাটবাড়ি। তিন তলার সিঁড়ির সামনে দরজায় লেখা–আর এল চাড্ডা। নিখিল সেই দরজারই বেল বাজাল।
দরজা খুলে দিল একজন প্রৌঢ় লোক, পাজামা ও সিল্কের পাঞ্জাবিপরা। পাঞ্জাবির বোতামগুলো লাগানো নেই, তাই ফাঁক দিয়ে দেখা যায় বুকে একরাশ চুল। লোকটার শরীরটা চ্যাপটা ধরনের। দেখলেই বোঝা যায়, গায়ে জোর আছে। লোকটি পরিষ্কার বাংলায় বলল, আপনারা অনেক দেরি করেছেন।
ঘরে ঢুকে কুশল বিনিময় ও আলাপ-পরিচয় হল। ওই লোকটিরই নাম রতনলাল চাড্ডা। উনি কাঠের ব্যবসা করেন। প্রধানত থাকেন জলপাইগুড়িতে, কলকাতায় ওঁর আলাদা নিজস্ব বাড়ি আছে। এখানে এই ফ্ল্যাটটি রেখেছেন শুধু বাইরের লোকজনের সঙ্গে দেখা করার জন্য কিংবা সন্ধ্যে বেলা আমোদপ্রমোদের জন্য। লোকটির সঙ্গে বাদল আর নিখিলের যে ঠিক কী সম্পর্ক তা অভিজিৎ ঠিক বুঝতে পারল না।
দরজা দিয়ে ঢুকেই একটা মস্তবড়ো বসবার ঘর। আগাগোড়া কার্পেটে মোড়া। দামি চামড়ায় মোড়া মোটা গদিওয়ালা সোফা ঘরের দু-জায়গায় সাজানো। রতনলাল চা খুব খাতির করে বলল, বসুন বসুন। আরাম করে বসুন। বেয়ারা–
বসবার ঘর থেকেই দেখা যায় একপাশে ছোটো একটা রান্নাঘর। সেখান থেকে একজন উর্দিপরা বেয়ারা বেরিয়ে এল।
গ্লাস আর সোডা লাও। আউর কুছ খানা
টেবিলের তলা থেকে স্কচের বোতল বার করল রতনলাল। তারপর নিখিলকে জিজ্ঞেস করল, বলুন, বাবুভায়ের খবর বলুন।
নিখিল পরে আছে একটা গাঢ় নীল রঙের স্যুট। সে বরাবরই ফিটফাট সেজে থাকতে ভালোবাসে। এখন বোম্বাইতে থাকার ফলে তার সাজপোশাকের চাকচিক্য আরও বেড়েছে। এক সময় অভিজিতের সঙ্গে কলেজে পড়ত নিখিল। ছাত্র হিসেবে খুব ভালো ছিল, এখন বোম্বাইতে একটা টুথপেস্ট কোম্পানিতে বড়ো কাজ করে। বাদল কাজকর্ম বিশেষ কিছু করে না। তবু অবস্থা বেশ সচ্ছল। ওদের কী যেন একটা পারিবারিক ব্যবসা আছে। তা নিয়ে বাদলকে কখনো মাথা ঘামাতে দেখা যায় না, কিন্তু ওর পকেটে বেশ টাকা থাকে।
নিখিল কোটের ভেতরের পকেট থেকে সাবধানে একটা খাম বার করে বলল, বাবুভাই আপনাকে কিছু কাগজপত্র পাঠিয়েছে।
রতনলাল খামটা পকেটে ভরে বলল, ঠিক আছে, এনিয়ে আপনার সঙ্গে পরে কথা বলব। বাবুভাই কি এখন মুম্বাইতেই থাকছেন না কোচিন চলে যাবেন?
নিখিল বলল, বাবুভাই এখন কিছুদিন একটা নার্সিংহোমে থাকবেন।
তারপর কিছুক্ষণ ধরে নিখিল আর রতনলালের মধ্যে বাবুভাই নামে কোনো একটা রহস্যময় লোক সম্পর্কে আলোচনা চলল।
অভিজিৎ উশখুশ করতে লাগল। সুমিত্রাকে টেলিফোন করা হচ্ছে না। ওরা ভুলে গেছে। এসব ঘরে কোনো টেলিফোন দেখা যাচ্ছে না।
সে বাদলকে ইঙ্গিত করল।
বাদল বলল, ও হ্যাঁ, এই যে রতনলালজি, আমার বন্ধু একটু আপনার টেলিফোনটা ব্যবহার করবেন।
রতনলাল বলল, চলে যান না, ওই ঘরের মধ্যে চলে যান
পর্দা সরিয়ে অভিজিৎ পাশের একটা ঘরে ঢুকল। ঘরটায় একটা খাট পাতা–তার ওপরে অনেকগুলো জামাকাপড়ের বাক্স। নতুন সুতো দিয়ে বাঁধা। হঠাৎ এতগুলো জামাকাপড় কেন এখানে কিনে রাখা হয়েছে কে জানে। হয়তো রতনলালের বাড়িতে কোনো বিয়ে আছে।
ঘরের কোণে ছোট্ট একটা শ্বেতপাথরের ওপর টেলিফোন। কল্যাণদের বাড়ির নম্বরটা অভিজিতের মুখস্থই আছে। কিন্তু লাইন পেল না। এনগেজড। একটুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।
অভিজিৎ দাঁড়িয়ে রইল। ঘরটা বেশ ঠাণ্ডা। দুটো স্টিলের আলমারি তালাবন্ধ। দেয়ালে একটা অসমিয়া ভাষার ক্যালেণ্ডার। চাড্ডারা কোথাকার লোক? নাম শুনে তো মনে হয় মাড়োয়ারি।
লোকটা বেশিরভাগ সময়ই থাকে জলপাইগুড়ি। কলকাতায় এলে মাঝে মাঝে সন্ধ্যে বেলা কয়েক ঘণ্টার জন্যে এখানে আসে। তারজন্যেই এত বড়ো একটা ফ্ল্যাট রাখা আছে। আবার একজন আর্দালি। অথচ কলকাতার কত লোক থাকার জায়গা পায় না। এ-রকম একটা ফ্ল্যাট যদি অভিজিৎ পেত!-না, পোষাতে পারত না, নিশ্চয়ই প্রচুর ভাড়া!
অভিজিৎ আবার টেলিফোনে চেষ্টা করল। আবার লাইন এনগেজড। পর পর চার বার চেষ্টা করেও কল্যাণদের বাড়ির লাইন পাওয়া গেল না। ধুৎ! কতক্ষণ আর এ-রকম ফাঁকা ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা যায়। তার থেকে বরং এবার চলে যাওয়াই ভালো। আটটা বেজে গেছে। টেলিফোনের ওপর নির্ভর করাটাই তার ভুল হয়েছে।
বাইরে বেরিয়ে আসতেই নিখিল বলল, কী রে, এতক্ষণ ধরে বউয়ের সঙ্গে গল্প করছিলি?
লাইনই পাইনি!
এতক্ষণ ধরে লাইন এনগেজড!
রতনলাল ইতিমধ্যে চারটে গেলাসে হুইস্কি ঢেলেছে। একটা গেলাস অভিজিতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নিন, আপনার জন্যে শুরু করতে পারছি না।
অভিজিৎ সংকুচিতভাবে বলল, না, না, আপনারা শুরু করুন, আমার লাগবে না।
আপনি খাবেন না?
আমি মদ খাই না।
রতনলাল বিস্মিতভাবে নিখিলের দিকে তাকাল। তার ভাবখানা এই, যে মদ খায় না, তাকে এখানে আনার কী মানে হয়? এটা কি নিরামিষ জায়গা?
নিখিল অভিজিৎকে এক ধমক দিয়ে বলল, নে, কী ইয়ার্কি করছিস? জানেন রতনলালজি, আমার এই বন্ধু, এই অভিজিৎই আমাকে মদ খাওয়া শিখিয়েছে। তাও কোথায়! গ্র্যাণ্ড হোটেলে! আমি প্রথম মদ খাই গ্র্যাণ্ড হোটেলে।
তা আপনার বন্ধু আপনাকে শিখিয়ে এখন নিজেই সরে পড়ছেন।
ওসব ওর বাজেকথা। নিশ্চয়ই কাল বেশি খেয়েছে–তাই আজ একটু বৈরাগ্য এসেছে! নে অভিজিৎ!
না রে! তা ছাড়া আমাকে এখন যেতে হবে। টেলিফোনও করতে পারলাম না।
একটু বাদে আবার চেষ্টা করবি।
না। চলেই যাই।
অনেকেই বিয়ে করে–কিন্তু তোর মতন এমন বউ-বাতিকগ্রস্ত তো আর কারুকে দেখিনি! বউকে ভয় পাস বুঝি?
বাদল বলল, অভিজিৎ, তোর বউ বুঝি মদ খাওয়া একদম পছন্দ করে না? তুই বিয়ের আগে বলে নিসনি?
রতনলাল বেশ শব্দ করে হেসে উঠল।
বউয়ের প্রসঙ্গ তুলে খোঁচা মারলে পুরুষমানুষের আত্মাভিমানে লাগে। তা ছাড়া একটু যেন বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। মাত্র কিছুদিন আগেও অন্য কেউ এ-রকম আড্ডা ছেড়ে উঠে চলে যেতে চাইলে অভিজিৎই তাকে ঠাট্টা করত।
সে বসে পড়ে গেলাসটা তুলে নিয়ে এক চুমুক দিল।
সঙ্গে সঙ্গে যেন তার বুকটা জুড়িয়ে গেল। বুকটা যেন শুকিয়ে কাঠ হয়েছিল একেবারে। আট দিন হল, অভিজিৎ এক ফোঁটাও খায়নি। প্রতিজ্ঞা করে ছেড়ে দিয়েছিল।
অভিজিতের একটু একটু ভয় করতে লাগল। প্রতিজ্ঞা রাখতে পারল না। সুমিত্রাকে কী বলে বোঝাবে! যাক, খুব কম করে খেলেই হবে। এই এক গেলাস, ব্যস!
অভিজিৎ বাদলের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। সে সিগারেটও ছেড়ে দিয়েছিল।
নিখিল বলল, তুই এখনও মুখ গোমড়া করে আছিস কেন?
বাদল বলল, অন্তত তিন পেগ না খেলে অভিজিতের মেজাজই খোলে না। বার বার দেখেছি।
অভিজিৎ তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বলল, না না—
তুই টেলিফোনটা করতে পারিসনি বলে মনটা খচখচ করছে তো? দে নম্বরটা আমাকে দে! আমি লাইন ধরে দিচ্ছি, কিংবা আমিই বলে দিচ্ছি তোর বউকে–এই সুযোগে আলাপও হয়ে যাবে। তোর বউকে আমার নাম-টাম বলেছিস তো? আমাকে চিনতে পারবে তো?
অভিজিৎ হেসে বলল, তা পারবে।
নম্বরটা জেনে নিয়ে নিখিল চলে গেল পাশের ঘরে।
রতনলাল বলল, নিখিলজির মুখে শুনলাম, আপনি পাবলিসিটি ফার্মে আছেন?
হ্যাঁ।
কোন ফার্ম? কী নাম?
বেঙ্গল ন্যাশনাল।
ফার্ম আপনার নিজের?
না। আমি চাকরি করি, ম্যানেজার!
আপনাকে আমাদের কাজে লাগবে। আমরা শিগগিরই একটা বিয়ার ফ্যাক্টরি খুলছি শিলং এ। পাবলিসিটি ক্যাম্পেন হবে। আপনি যদি এর ভার নিতে পারেন
অভিজিৎ সচকিত হয়ে উঠল। এ তো দারুণ প্রস্তাব। নতুন বিয়ার ফ্যাক্টরির পাবলিসিটি তো বেশ বড়ো কাজ। এ কাজ জোগাড় করতে পারলে তার কোম্পানির মালিক খুব খুশি হবে। সে নিজেও কমিশনের একটা পার্সেন্টেজ পাবে। অনেক টাকার ব্যাপার।
রতনলাল বলল, ফাইনান্স কিছু আসবে মুম্বাই থেকে। মেঘালয়ে প্রোজেক্ট স্যাংশান হয়ে গেছে। খুব শিগগিরই কাজ শুরু হবে—
অভিজিৎ উৎসাহের সঙ্গে বলল, এ ব্যাপারে আমাদের খানিকটা অভিজ্ঞতা আছে। আমরা শ-ওয়ালেসের কিছু কাজ করেছি।
গেলাসের পানীয় ফুরিয়ে গিয়েছিল, রতনলাল আবার ঢেলে দিল। অভিজিৎ বাধা দিল না।
নিখিল ফিরল বেশ দেরি করে। ফিরে এসে সে রতনলালকে বলল, মি. রাওকে খবর দিয়ে দিয়েছি। আর শিলং-এ ট্র্যাঙ্কও বুক করে ফেলেছি, আধ ঘণ্টার মধ্যে পাওয়া যাবে।
অভিজিৎ ভাবল, নিখিল কি তার টেলিফোনটার কথা ভুলে গেছে নাকি? আচ্ছা দায়িত্বজ্ঞানহীন তো!
নিখিল তার দিকে ফিরে বলল, অভিজিৎ, তোর লাইন কিছুতেই পাওয়া গেল না। অপারেটার বলল, ও লাইন আউট অব অর্ডার।
তার মানে সুমিত্রাকে খবর দেওয়ার কোনো উপায় নেই। তাহলে আর দেরি করা যায় না, এক্ষুনি উঠতে হয়। কিন্তু রতনলাল এত বড়ো একটা কনট্রাক্টের কথা বলল, এটা সম্পর্কে কিছু পাকাপাকি না করে চলে যাওয়া যায়? সুমিত্রা না হয় খানিকটা অপেক্ষা করবে। যদি সে নিজেই বুদ্ধি করে একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসে–রাস্তা চেনার দরকার কী? ট্যাক্সিওয়ালাকে বাড়ির ঠিকানা বলে দিলেই তো হয়।
পুরুষমানুষের বাইরে অনেকরকম কাজকর্ম থাকে। মেয়েদের এটা বোঝা উচিত। এত বড়ো একটা কাজের তুলনায় বউকে ঠিক সময়ে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা মোটেই বড়ো কথা নয়। আর এইসব কাজের জন্য অনেক বড়ো বড়ো মহলে ঘুরতে হয়। সেখানে একটু-আধটু মদ না খেয়ে উপায় নেই। সুমিত্রা এইটুকু বুঝবে না।
এত বড়ো কাজের ব্যাপার, দু-চার কথায় শেষ হয় না। মধ্যে মধ্যে আবার নিখিল অন্য কথা পেড়ে বসছে। নিখিলের কথা শুনে মনে হয় সে এখন খুব বড়ো বড়ো মহলে ঘুরছে। অনেক টাকার কোনো কারবারে জড়িত।
অভিজিতের যখন তিন পেগ শেষ হয়েছে, সেই সময় একটি মেয়ে এসে হাজির হল।
অভিজিৎ খুব একটা অবাক হল না। এরকম সুসজ্জিত ফাঁকা ফ্ল্যাট যখন, তখন এর সঙ্গে কোনো-না-কোনো মেয়ে জড়িত থাকবেই। কলকাতায় মেয়ে পাওয়া অনেক সোজা, এ-রকম জায়গা পাওয়াই শক্ত।
মেয়েটি একটি কমলা রঙের শাড়ি পরেছে। মাথার চুল ছোটো করে ছাঁটা, ঠোঁটে অনেকখানি রং। বয়েস মনে হয় বাইশ-তেইশের বেশি নয়। ঠিক সুন্দরী বলা যায় না, তবে রূপের একটা চটক আছে। রতনলাল উঠে দাঁড়িয়ে তাকে খাতির করে এনে বসাল। আলাপ করিয়ে দিল সকলের সঙ্গে। মেয়েটির নাম শেলি দত্ত। শুনলেই বোঝা যায়, ওটা ওর আসল নাম নয়। মেয়েদের নাম কেন শেলি রাখা হয়? একজন বড়ো কবির অপমান।
প্রসঙ্গটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে আনার অনেক চেষ্টা করল অভিজিৎ। কিন্তু রতনলাল আর মন দিতে চাইছে না। মেয়েটির দিকেই তার বেশি মনোযোগ। মাঝে মাঝে রতনলাল মেয়েটির ঊরুর ওপর হাত রাখছে, যেন কিছুই ব্যাপার নয়। কেউ তাকাচ্ছে না সে-দিকে। বাদল আর নিখিল এতক্ষণ রতনলালের সঙ্গে খুব খাতির করে কথা বলছিল। এখন মেয়েটিকেও খাতির করতে লাগল। মেয়েটিও হুইস্কি খাচ্ছে। এক বোতল শেষ হয়েছে, আর-এক বোতল বেরিয়েছে! অভিজিতের পাঁচ পেগ হয়ে গেছে, এখন রাত দশটা!
অভিজিৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি চলি।
মেয়েটি বলল, এ কী, আমি এলাম আর অমনি আপনি চলে যাচ্ছেন?
অভিজিৎ কটমট করে মেয়েটির দিকে তাকাল। এসব মেয়েদের সে দু-চক্ষে দেখতে পারে। না। যে মেয়ের ঊরুতে অন্য লোকেরা হাত দেয়।
নিখিল বলল, দাঁড়া, আমরা একটু পরেই যাব।
না, আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে।
রতনলাল বলল, ঠিক আছে, আপনার সঙ্গে পরে আবার কথা হবে।
কবে আপনার সঙ্গে আমি যোগাযোগ করব বলুন। কাল?
না, কাল হবে না। আমি ব্যস্ত থাকব। ঠিক আছে, নিখিলবাবু আগে শিলং থেকে ঘুরে আসুক, তারপর বাকি কথা হবে।
অভিজিৎ নমস্কার জানিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
শরীরে বেশ একটা চনমনে ভাব। সিঁড়ি দিয়ে নামল জুতোর টকটক শব্দ করে। রাস্তায় বেরিয়ে আপনমনে শিস দিতে লাগল আস্তে আস্তে। একটা বড়ো কাজের সন্ধান পাওয়া গেছে, অফিসে সবাই খুশি হবে। ইদানীং অফিসের অবস্থা বিশেষ ভালো যাচ্ছিল না। হাঁটতে বেশ ভালো লাগছে অভিজিতের। হালকা লাগছে মাথাটা।
বড়ো রাস্তাতেও দু-একবার চেষ্টা করে ট্যাক্সি ধরা গেল না। কত রাত বেড়ে যাচ্ছে, সুমিত্রা এতক্ষণ কী করছে কে জানে?
কোনো একটা হোটেলের বা বারের সামনে নিশ্চয়ই ট্যাক্সি পাওয়া যাবে। এই ভেবে অভিজিৎ সেই দিকে এগোল। সত্যিই তাই, একটি বারের সামনে অনেকগুলো ট্যাক্সি দাঁড়ানো।
কিন্তু কোনো একটাতে উঠতে গিয়েও তার একটা সমস্যা দেখা দিল। এখন সে কোথায় যাবে? সুমিত্রা কি দশটা পর্যন্ত সেই মানিকতলাতেই বসে আছে? যদি না থাকে? এমনও হতে পারে, সুমিত্রা অন্য কারুর সঙ্গে বাড়ি চলে এসেছে। কিংবা নিজেই ট্যাক্সি নিয়ে। তাহলে অভিজিতের এখন বাড়িতেই ফেরা উচিত।
আবার যদি বাড়িতে গিয়ে দেখে সুমিত্রা ফেরেনি? সে যদি বোকার মতন অভিজিতের কথার ওপর ভরসা করে সেই মানিকতলাতেই বসে থাকে তাহলে অভিজিৎকে বাড়ি থেকে আবার মানিকতলায় ছুটতে হবে। সম্পূর্ণ উলটো রাস্তা। তার বাড়ি হাজরার কাছে। ট্যাক্সিতে উলটে অতখানি যেতে গেলে ভাড়াও তো কম লাগবে না।
কোথায় আগে যাবে অভিজিৎ কিছুতেই ঠিক করতে পারল না। সেইজন্যেই সে সামনের বারটায় ঢুকে পড়ল। গলাটা আবার শুকিয়ে এসেছে। আর একবার ভিজিয়ে নেওয়া দরকার। ভেতরে গিয়ে সে আর বসবে না। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে এক পেগ খেয়েই চলে যাবে।
পেগের অর্ডার দিতেই দূরের টেবিল থেকে কে যেন চেঁচিয়ে ডাকল–অভিজিৎ।
অভিজিৎ না-শোনার ভান করল। তার আড্ডায় জমে গেলে চলবে না। এক পেগ খেয়েই চলে যেতে হবে। সুমিত্রা কি মানিকতলায় এখনও বসে আছে? যদি নিজেই বুদ্ধি করে বাড়ি চলে আসে
পেছন থেকে একজন এসে অভিজিতের কাঁধে চাপড়া মারল। তারপর বলল, কী রে শালা, ডাকছি, শুনতে পাচ্ছিস না?
অভিজিৎ মুখ ফেরাল। প্রিয়ব্রত। একমুখ ভরতি দাড়ি, বিশাল চেহারা। এরমধ্যেই নেশায় চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে।
প্রিয়ব্রত একজন শিল্পী। কিছুদিন আগে পর্যন্ত অভিজিৎদের অফিসেই চাকরি করত। কিছুদিন আগে ঝগড়া করে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। প্রিয়ব্রতর মনটা শিশুর মতন, কিন্তু বড় বদমেজাজি।
এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস? আয়, আমার টেবিলে আয়।
অভিজিৎ অনুনয় করে বলল, না রে, আজ আর বসব না। এক্ষুনি চলে যেতে হবে।
এরমধ্যেই!
হ্যাঁ রে, জরুরি কাজ আছে।
রাত দশটায় জরুরি কাজ? আঃ হ্যা হ্যা হ্যা হ্যা–প্রিয়ব্রত প্রচন্ড জোরে হাসে। একবার শুরু করলে সহজে থামতে চায় না। এখন মাতালের হাসি। আরও জোরালো। অন্য টেবিল থেকে সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের দেখতে লাগল।
প্রিয়ব্রত জোর করে অভিজিতের হাত ধরে টেনে বলল, আয়, তোর সঙ্গে অনেক কথা আছে।
না রে, আজ না, আর-একদিন।
হঠাৎ অভিজিতের হাত ছেড়ে দিয়ে প্রিয়ব্রত নরম গলায় বলল, আসবি না? তুই আমাকে এড়িয়ে যেতে চাইছিস?
প্রিয়ব্রতর অভিমান হয়েছে। ওর স্বভাবই এইরকম। কখন যে রাগ হয়, কখন অভিমান, তা বোঝাই যায় না।
অভিজিৎ মুশকিলে পড়ল। প্রিয়ব্রতকে এখন কিছুতেই বোঝানো যাবে না। ও ভাবছে, ও অফিসে ঝগড়া করে কাজ ছেড়ে দিয়েছে বলেই অভিজিৎ ওকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। তা কখনো হয়? ঝগড়া তো হয়েছে মালিকের সঙ্গে। অভিজিৎ তো আর মালিক নয়, সে একটু বেশি উঁচু চাকরি করে–এইমাত্র। প্রিয়ব্রতর সঙ্গে ওর অনেক দিনের পরিচয়, তার সঙ্গে অফিসের কী সম্পর্ক আছে? কিন্তু আজ যে অভিজিতের সত্যিই আর দেরি করা উচিত নয়, সেটা কী করে বোঝাবে? এখানে হঠাৎ ঢুকে পড়াটাই ভুল হয়েছে। যদি এখুনি ট্যাক্সি নিয়ে
অভিজিৎকে প্রিয়ব্রতের টেবিলে এসে বসতেই হল। সেখানে আরও দু-জন রয়েছে, অভিজিতের সামান্য মুখ-চেনা।
প্রিয়ব্রত হাঁক পাড়ল, বেয়ারা, পেগ আনো।
তারপর সে অভিজিতের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, আমি নিজেই একটা ফার্ম খুলেছি, নিজে ব্যবসা করব। কোনো শালার চাকরি করব না আর এ জীবনে। তাতে মরি আর বাঁচি।
অভিজিৎ বলল, সে তো খুব ভালো কথা।
তুই আসবি আমার সঙ্গে? তোর অভিজ্ঞতাটা যদি কাজে লাগানো যায়–
অভিজিৎ চট করে কোনো উত্তর দিতে পারল না। সব জায়গাতেই আজকাল দারুণ প্রতিযোগিতা। নতুন কোনো কোম্পানির পক্ষে টিকে থাকা খুব শক্ত। অভিজিৎ ভালো কোম্পানিতে কাজ করে, যথেষ্ট মাইনে পায়। সে চাকরি ছেড়ে প্রিয়ব্রতর সঙ্গে ভিড়ে যাওয়া কি চট করে সম্ভব?
প্রিয়ব্রত বলল, তুই আমার সঙ্গে যদি আসিস, ফিফটি ফিফটি পার্টনারশিপ, দু-জনে লড়ে যাব, মরি বাঁচি যা হয়। তবু একটা সান্ত্বনা থাকবে, নিজের ইচ্ছেতেই যা কিছু করেছি। চাকরির থেকে অনেক ভালো।
অভিজিৎ সতর্কভাবে বলল, নতুন কোম্পানি খোলা কী সহজ কথা! অফিসঘর লাগবে, প্রথমে অনেক টাকা ঢালতে হবে।
সেসব ব্যবস্থা আমি করব, আর কিছু না, গোড়ার দিকেই যদি এই দেড় দু-লাখ টাকার কাজ ধরতে পারা যায়, তাহলেই কোম্পানি দাঁড়িয়ে যাবে।
অভিজিতের মনে পড়ল, একটু আগেই সে এ-রকম একটা বড় কাজের সন্ধান পেয়েছে। রতনলাল চাড্ডার কাজটা দেড়-দু লাখের বেশিই হবে হয়তো। সেই কাজটা প্রিয়ব্রতকে যদি পাইয়ে দেওয়া যায় তাহলেই ওর সমস্যা মিটে যাবে। কিন্তু অভিজিৎ মুখে কিছু বলল না। অত বড়ো একটা কাজ নিয়ে ছেলেমানুষি করা উচিত নয়। কাজটা তার নিজের অফিসকে পাইয়ে দিলে সেখানে তার অনেক সুনাম হবে, নিজে অনেক টাকার কমিশন পাবে। প্রিয়ব্রতর ওপর ভরসা কী!
একটু বাদে তার খেয়াল হল, এই টেবিলে এসে তার আরও দু-পেগ খাওয়া হয়ে গেছে। প্রিয়ব্রত তাকে খাওয়াচ্ছে। প্রিয়ব্রত কেন তাকে খাওয়াচ্ছে? প্রিয়ব্রত এখন বেকার, সে এত পয়সা খরচ করছে কেন? সারাসন্ধ্যে অভিজিতের নিজের প্রায় কিছুই খরচ হয়নি। সবাই কি তাকে কৃপণ ভাবছে? অ্যাঁ, অভিজিৎ সেনগুপ্ত কৃপণ? পয়সা তার কাছে খোলামকুচি!
অভিজিৎ চিৎকার করে বলল, বেয়ারা, পেগ লাও! টেবিলের সব্বাইকে।
তারপর সে টেবিলে এক ঘুসি মেরে প্রিয়ব্রতকে বলল, তুই কি ভাবছিস, আমি চাকরির পরোয়া করি? আমি তোর সঙ্গে আছি প্রিয়ব্রত। তুই যা-করবি, আমি তোকে সাহায্য করব।
তুই আসবি আমার সঙ্গে?
আলবাত।
দু-জনে মিলে যদি খাটি, কেউ আমাদের আটকাতে পারবে না। পাবিলিসিটি লাইনে তোর অনেক অভিজ্ঞতা, আমারও খানিকটা নাম-টাম আছে।
দেখ-না, বেশি খাটতেও হবে না। আমি এত বড়ো একটা কাজ জোগাড় করে আনব প্রথমেই।
এক চুমুকে পেগটা শেষ করে অভিজিৎ তীব্রভাবে তাকিয়ে রইল। মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠেছে। আবার সে হাঁক দিল, বেয়ারা। আর-এক রাউন্ড!
প্রিয়ব্রত বলল, আর খাসনি। চল এবার
অভিজিৎ তাকে এক ধমক দিয়ে বলল, বোস। আলবাত আরও খাব! কত খেতে চাস! আমার কাছে অনেক টাকা আছে…