১. ছোঁচা শব্দটা

০১.

ছোঁচা শব্দটা কোথেকে এল মশাই? ছুঁচো থেকে নাকি? হাতটান শব্দটারই বা ইতিহাস কী? কিংবা দু’ কান-কাটা কথাটাই বা অমন অপমানজক কেন?

অবশ্য অপমান কথাটারও কোনও মানে হয় না। অপমান মনে করলেই অপমান। আমার যা অবস্থা তাতে অপমান গায়ে মাখতে যাওয়াটাও এক লাটসাহেবি শৌখিনতা।

সুবিনয়দের পিছনের বারান্দায় আমি শুই। বারান্দাটা খারাপ নয়। বুক-সমান দেয়ালের গাঁথুনি, তার ওপরটা গ্রিল দেওয়া। বারান্দার অর্ধেকটা প্লাইউড দিয়ে ঘিরে খাওয়ার ঘর হয়েছে, বাকি অর্ধেকটায় এঁটো বাসনপত্র ডাই করা থাকে, মুখ ধোওয়ার বেসিন রয়েছে, কয়েকটা প্যাকিং বাক্স পড়ে আছে খালি। এইসব বাক্সে বিদেশ থেকে কেমিকালস আসে। বিদেশের জিনিস বলে বাক্সগুলো বেশ মজবুত। দিনের বেলা প্যাকিং বাক্সগুলো, মোট তিনটে, একটার ওপর আর-একটা দাড় করানো থাকে। রাত্রিবেলা ওগুলো নামিয়ে আমি পাশাপাশি সাজিয়ে নিই। বাক্সগুলো সমান নয়, যার ফলে একটু উঁচু-নিচু হয়। তা হোক, তা হোক। আমার কিছু অসুবিধা হয় না। একেবারে মেঝেয় শোওয়ার চেয়ে এটুকু উচ্চতা মন্দ কী?

বারান্দার লাগোয়া পাশাপাশি দুটো ঘর। একটা ঘরে সুবিনয়ের বিধবা মা শোন খাটে, মেঝেয় শোয় ষোলোসতেরো বছর বয়সের ঝি কুসুম। অন্য ঘরে সুবিনয় এক খাটে শোয়, অন্য খাটে দুই বাচ্চা নিয়ে সুবিনয়ের বউ ক্ষণা। সামনের দিকে আরও দুটো ঘর আছে। তার একটা সুবিনয়ের ল্যাবরেটরি, অন্যটা বসবার ঘর। কিন্তু সেইসব ঘরে আমাকে থাকতে দেওয়ার কথা ওদের মনে হয়নি। সুবিনয়ের এক বোন ছিল এই সেদিন পর্যন্ত বিয়ে হচ্ছিল না কিছুতেই। যতই তার বিয়ের দেরি হচ্ছিল ততই সে দিনরাত মুখ আর হাত-পায়ের পরিচর্যা নিয়ে অসম্ভব ব্যস্ত হয়ে পড়ছিল। ছেলে-ছোকরা দেখলে কেমন হন্যের মতো হয়ে যেত, এবং শেষমেষ আমার মতো অপদার্থের দিকেও তার কিছুটা ঝুঁকে পড়ার লক্ষণ দেখে আমি বেশ শঙ্কিত হয়ে পড়ি। একদিন তো সে পরিষ্কার তার বউদিকে বলে দিল, এই শীতে উপলদা একদম খোলা বারান্দায় শোয়, তার চেয়ে খাওয়ার ঘরটায় শুতে দাও না কেন? এ কথা যখন হচ্ছিল তখন আমি চার-পাঁচ হাত দূরে বসে সুবিনয়ের মুখোমুখি খাওয়ার টেবিলে চা খাচ্ছি। চোর-চোখে তাকিয়ে দেখি, রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়ানো সুবিনয়ের বোন অচলার দিকে চেয়ে রান্নাঘরের ভিতরে টুলে-বসা ক্ষণা একটু চোখের ইঙ্গিত করে চাপা স্বরে বলল, উঃ হু!

আমিও ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। ঠিকই তো! খাওয়ার ঘরে দেয়ালের র‍্যাকে দামি স্টিলের বাসনপত্র, চামচ থেকে শুরু করে কত কী থাকে সরানোর মতো। এখানে আমাকে শোওয়ানো বোকামি। তা সে যাক গে। অচলার যখন ওইরকম হন্যে দশা, তখন আমার এ বাড়িতে বাস সে এক রাতে প্রায় উঠিয়ে দিয়েছিল আর কী। কোথাও কিছু না, মাঝরাতে একদিন দুম করে চলে এসেছিল বারান্দায়। বাথরুমে যাওয়ার প্যাসেজের ধারেই আমি শুই, মাঝরাতে বারান্দা দিয়ে বাথরুমে আনাগোনা করতে কোনও বাধা নেই। কিন্তু অচলা বাথরুমে যায়নি, সটান এসে আমার প্যাকিং বাক্সের বিছানার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে বোধহয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছিল। সেটা নিতান্ত মানবিক করুণাবশতও হতে পারে। কিন্তু তাইতেই আমার পাতলা ঘুম ভেঙে যেতে আমি ‘বাবা গো’ বলে চেচিয়ে উঠেছিলাম ভূত ভেবে। অচলা সময় মতো পালিয়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে বিকট শব্দ করেছিল। গোলমাল শুনে তার মা উঠে এসে বারান্দায় তদন্ত করেন, আমি তাকে বলি যে আমি দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছি। তিনি তা বিশ্বাস করেননি এবং আমার উদ্দেশেই বোধহয় বলেন, এ সব একদম ভাল কথা নয়। কালই সুবিনয়কে বলছি।

সুবিনয়কে তিনি কী বলেছিলেন কে জানে, কিন্তু সুবিনয় ব্যাপারটা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামায়নি। ঘামালে বিপদ ছিল। কারণ, সুবিনয়ের চেহারা দানবের মতো বিশাল এবং রাগলে তার কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। কোনও ব্যাপার নিয়েই সে বড় একটা মাথা ঘামায় না। সর্বদাই সে এক ভাবনার ঘোরে বাস করে। জাগতিক ব্যাপারস্যাপার নিয়ে তাকে কেউ কোনও কথা বললে সে ভারী বিরক্ত হয়। এই যে আমি তার বাড়িতে আছি, খাচ্ছি-দাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি, এটাও যে খুব বাঞ্ছিত ব্যাপার নয় কোনও গৃহস্থের কাছে তাও সে বোঝে না। সে সর্বদাই তার কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়ে আছে। মস্ত এক কোম্পানির চিফ কেমিস্ট, কিছু পেপার লিখে বৈজ্ঞানিক জগতেও নাম-টাম করেছে। প্রায়ই বিদেশে যায়। সুবিনয় বাংলাদেশের সেই লুপ্তপ্রায় স্বামীদের একজন যাদের বউ খানিকটা সমীহ করে চলে। স্ত্রী স্বামীকে সমীহ করে, এ ব্যাপারটা আমি আর কোথাও দেখিনি এ জীবনে। সুবিনয়ের এই কর্তৃত্বময় অস্তিত্বের দরুনই আমি এ বাড়িতে বেশ কিছুকাল টিকে আছি। সুবিনয় যে আমাকে তাড়ায় না তার একটা গূঢ় কারণও আছে।

তা বলে যেন কেউ মনে না করেন যে, আমার প্রতি সুবিনয় স্নেহশীল। সত্য বটে, স্কুলজীবনে আমরা সহপাঠী ছিলাম মিত্র ইনস্টিটিউশনে। গলায় গলায় ভাব ছিল তখন। কলেজে ও সায়েন্স নিল, আমি কমার্স। কোনওক্রমে বি কম পাশ করে আমি লেখাপড়া ছাড়ি, সুবিনয় সোনার মেডেল পেয়ে এগিয়ে গেল। আমরা ভিন্ন হয়ে গেলাম। দুই বন্ধুর একজন খুব কৃতী হয়ে উঠলে আর বন্ধুত্ব থাকে না, কমপ্লেকস এসে যায়।

এখন আমাকে সবাই অপদার্থ বলে জানে। কেবল দীর্ঘকাল আমি নিজেই সেটা বুঝতে পারিনি। আমার ধারণা ছিল, আমার প্রতিভা একদিন বিকশিত হবেই। আমি মোটামুটি ভাল গান গাইতে পারতাম, চমৎকার থিয়েটার করতাম, নাটক-ফাটকও লিখেছি এককালে উদ্বাস্তুদের দুঃখ নিয়ে, অল্পস্বল্প ছবি আঁকতে পারতাম, সবচেয়ে ভাল পারতাম কাদামাটি দিয়ে নানা রকম মূর্তি তৈরি করতে। এত বহুমুখী প্রতিভা নিজের ভিতরে দেখে আমার ধারণা ছিল, একটা না একটা লাইন ধরে আমি ঠিক উন্নতি করব, আর সবক’টা লাইনেই যদি উন্নতি করি তা হলে তো কথাই নেই। আরও অনেকেরই এককালে ধারণা ছিল। আমার বিচক্ষণ বাবা কিন্তু বরাবর বলে এসেছেন, এ ছেলের কিছু হবে না। এত দিকে মাথা দিলে কি কারও কিছু হয়?

আমার পারিবারিক ইতিহাসটি খুবই সংক্ষিপ্ত। আমি মা বাবার একমাত্র সন্তান। আমার পাঁচ বছর বয়সে মা মারা গেলে বাবা আমার এক মাসিকে বিয়ে করেন। মায়ের পিসতুতো বোন। মাসির এক চোখ কানা আর দাত উঁচু বলে তাঁর বিয়ে হচ্ছিল না। আমি সেই মাসির কাছে মানুষ। বি কম পরীক্ষার কিছু আগে বাবা অপ্রকট হলেন। দুনিয়ায় তখন আমার মাসি, আর মাসির আমি ছাড়া কেউ নেই। কিন্তু কেউ কারও ভরসা নই। মাসি বলত, তুই যদি চুরি ছ্যাঁচড়ামি গুন্ডামি বা ডাকাতি করেও দুটো পয়সা আনতে পারতিস!

বাস্তবিক বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের যে-সব উন্নতি হয় বলে শুনেছি তার কিছুই আমার হল না। হ্যাঁ, গান আমি এখনও আগের মতোই গাই, সুযোগ পেলে অভিনয়ও খারাপ করব না, আগের মতো নাটকও লিখতে পারি। ছবি কিংবা মাটির পুতুলও আঁকতে বা বানাতে পারি। কিন্তু সে সবও যেন কোথায় আটকে আছে, উন্নতি হয়নি। সিনেমায় নামতে গিয়েছিলাম। দু-চারটে সিনেমায় চান্স পেলাম বটে ছোট ছোট ভূমিকায় কিন্তু তাকে সিনেমায় নামা বলে না ঠিক। দুটো-একটা চাকরিও পেয়েছিলাম, একটার কোম্পানি ক্লোজার হল, অন্যটায় অস্থায়ি চাকরি টিকল না। মাসির লেখাপড়া ছিল না তেমন। বাবা লোকান্তরিত হওয়ার পর মাসি বিস্তর সেলাই-ফোড়াই করে সংসার চালাতে গিয়ে একটা ভাল চোখকেও প্রায় খারাপ করে ফেলল। মাসি যখন কাঁদত তখন কিন্তু তার অন্ধ চোখেও জল পড়ত।

বিনা কাজে সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়াতাম। বেশ লাগত। কাজকর্ম না করতে করতে এক ধরনের কাজের আলসেমি পেয়ে বসেছিল। আড্ডার অভাব ছিল না। সংসারের ভাবনা একা মাসিকে ভাবতে দিয়ে আমি চৌপর দিন বাইরে কাটাতাম। নিছক সঙ্গী না জুটলে ময়দানের ম্যাজিক, খোলামাঠের ফুটবল বা ক্রিকেট, ইউসিস লাইব্রেরিতে ঢুকে ছবির ম্যাগাজিন দেখে সময় কাটাতাম। বাবা বাড়ি করে যাননি, ভাড়া বাকি পড়ায় একবার বাড়িওলা হুড়ো দিয়ে তুলে দিল। বুড়ো বাড়িওলা মারা গেছে, ছেলেরা লায়েক হয়েছে। তাদের অত মায়া-দয়া নেই। মহা আতান্তরে পড়ে মাসি তার লতায়-পাতায় সম্পর্কের এক বড়লোক ভাইয়ের বাড়ি গিয়ে উঠল। ভাই মাসিকে তাড়াল না, গরিব আত্মীয়দের আশ্রয় দিলে বিস্তর কাজ আদায় করা যায়। কিন্তু সেখানে আমার ঠাঁই হল না। তারা পরিষ্কারই বলে দিলেন, তোমার বোনপোকে রাখতে পারব না বাপু, বড়সড় ছেলে, নিজের রাস্তা নিজেই দেখে নেবে। এ কথা শুনে মাসি বলে, ওমা, বোনপো কী? ও আমার ছেলে, নিজের হাতে মানুষ করেছি যে! কিন্তু তারা কিছুতেই মত দিল না যখন মাসির তখন হাউহাউ করে কান্না। আমি মাসিকে অনেক স্তোকবাক্য দিয়ে তখনকার মতো ঠান্ডা করে কেটে পড়লাম। আমার যা হোক, কানা মাসিটা আমার তো না খেয়ে মরবে না। তবে সে বাড়িতে আমার যাতায়াত আছে, কয়েক বার নেমন্তন্নও খেয়েছি।

তখন হাওড়া-কদমতলা রুটের একটা প্রাইভেট বাসে কন্ডাক্টরি করি। সারাদিন পয়সার ঝনঝন, লোকের ঘেমো গা, গাড়ির চলা, তার মধ্যে কখনও ঘুণাক্ষরেও মনে পড়ত না যে, আমি বি কম পাশ বা এ কাজের চেয়ে একটা কেরানিগিরি পেলে অনেক ভাল হত। সে যা হোক, কন্ডাক্টরি কিছু খারাপ লাগত না। তবে প্যাসেঞ্জারদের সঙ্গে ঝগড়া কাজিয়ার সময়ে আমি বেশি সুবিধা করতে পারতাম না। আর একটা লাভও হত বেশ, প্যাসেঞ্জারদের মুখে নানা খবর শুনে শুনে দুনিয়া সম্পর্কে বিনা মাগনা অনেক জ্ঞানলাভও হয়ে যেত। কয়েক দিনের মধ্যেই এলাকার হেক্কোড়দের চিনে ফেললাম, তাদের কাছে টিকিট বেচার প্রশ্ন উঠত না, উলটে খাতির দিতে হত। মনাই ঘোষ ছিলেন এলাকার মাথা। মনে আছে একবার তিনি পঞ্চাননতলার মোড়ে বাস থামিয়ে নেমে গিয়ে লন্ড্রির জামা কাপড় আনলেন, বাস ততক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। চোর, ছিনতাইবাজ, পকেটমার বিস্তর চেনা-জানা হয়ে। গেল, আজও ও-সব জায়গায় গেলে দু’-চার কাপ চা বিনা পয়সায় লোকে ডেকে খাওয়ায়। আনাড়ি ছিলাম বলে প্রথম দিকে আমার ব্যাগ থেকে বার দুই খুচরো হাপিশ হয়েছে। পরের দিকে কাকের মতো চালাক হয়ে উঠি। বাস চালাত ধন সিং নামে একটা রাজপুত। জলের ট্যাঙ্কের কাছে একবার সে একটা ছোকরাকে চাপা দিলে রাস্তার লোক রে রে করে তাড়া করল। ভয়ে ধন সিংয়ের আর হিতাহিত জ্ঞান রইল না। পঞ্চাননতলার সরু রাস্তায় যে আপ-ডাউন বাস কী করে চলে সেইটাই লোকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না, আর সেই মারাত্মক ভিড়ের সরু রাস্তায় ধন সিং বাসের গতি বোধকরি ত্রিশ-চল্লিশ মাইল তুলে দিল। কোনও স্টপে গাড়ি দাঁড়াচ্ছে না। প্যাসেঞ্জাররা প্রাণভয়ে চেঁচাচ্ছে, বাঁচাও। এই স্টুপিড! এই উল্লুকের বাচ্চা! এই শুয়োরের বাচ্চা! কে শোনে কার কথা! আমরা দুই কন্ডাক্টর, আমি আর গোবিন্দ, দুই দরজায় সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, বিপদ দেখলেই লাফাব। ধন সিং কদমতলা পর্যন্ত উড়িয়ে নিল বাস। তারপর যেই থামল, অমনি কোত্থেকে যে শয়ে শয়ে লোক জুটে গেল চারধারে কে জানে! পালানোর পথ ছিল না। ধন সিং প্রচণ্ড মার খেয়ে আধমরা হয়ে হাসপাতালে গেল, আমি আর গোবিন্দ ঠ্যাঙানি খেয়ে কিছুক্ষণ ঝুম হয়ে পড়ে রইলাম রাস্তায়। মুখ-টুখ ফুলে, গায়ে গতরে একশো ফোড়ার ব্যথা হয়ে বিচ্ছিরি অবস্থা।

অনেক পরে চেনা একটা হোটেলের বাচ্চা বয়গুলো এসে আমাদের জলটল দিয়ে তুলে নিয়ে যায়। দু’জনে কষ্টেসৃষ্টে চেনা দোকানে গিয়ে কোকাতে কোকাতে বসলাম। ব্যাগ দু’জনেরই হাপিশ হয়ে গেছে, জামা-টামা ছিড়ে একাকার, গোবিন্দর চটিজোড়াও হাওয়া। পাবলিক প্যাদালে তো কিছু করার নেই। রাগও করা যায় না, কার মুখ মনে করে রাগ করব? গোটা জীবন আর তাবৎ দুনিয়ার ওপর রাগে চোখে জল আসে শুধু। গোবিন্দ আর আমি একটা করে কোয়ার্টার রুটি আর ছোট সানকির মতো কলাই করা প্লেটে হাফ প্লেট করে মাংস নিয়ে বসলাম। মাংস মুখে দিয়েই গোবিন্দ উহু উহু করে যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, জিভটা কেটে এই ফুলেছে মাইরি, নুন ঝাল পড়তেই যা চিড়িক দিয়েছে না! খাই কী করে বল তো!

এ সব কথা যখন হচ্ছে তখনই ছোকরা বয়টা এসে বলল, গোবিন্দদা, আপনার দেশ থেকে আপনার খোঁজে একটা লোক অনেক বার এসে ঘুরে গেছে। ওই আবার এসেছে, দেখুন।

গোবিন্দ মুখ তুলল, আমিও দেখলাম, বুড়ো মতো একটা লোক খুব বিষন্ন মুখের ভাব করে এসে বেঞ্চে বসে মুখের ঘাম মুছল সাদা একটা ন্যাকড়া পকেট থেকে বের করে।

গোবিন্দ বলল, তারক জ্যাঠা, খবরটবর কী? খারাপ নাকি?

 হ্যাঁ বাবা। তোমার পিতৃদেব—

গোবিন্দ আঁতকে উঠে বলল, আর বলবেন না, আর বলবেন না।

লোকটা ভড়কে থেমে গেল। আর দেখলাম, গোবিন্দ গোগ্রাসে মাংস-রুটি খাচ্ছে জিভের মায়া ত্যাগ করে। খেতে খেতেই বলল, ও শুনলেই খাওয়া নষ্ট। এখন পেটে দশটা বাঘের খিদে। একটু বসুন, ও খবর পাঁচ মিনিট পরে শুনলেও চলবে। শত হোক, হিন্দুর ছেলে তো! ও খবর শুনলে খাই কী করে!

খাওয়ার শেষে গোবিন্দ উঠে দাম-টাম দিয়ে এল, বলল, চলুন, দেশে যেতে হবে তো?

তারক জ্যাঠা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, তা তো হবেই। পরশুদিনের ঘটনা বাবা, মাঠ থেকে ফিরে তোমার বাবামশাই হঠাৎ উঠোনে টান টান হয়ে শুয়ে পড়লেন। কত জল, পাখা, ওঝা, বদ্যি, হাঃ—

 গোবিন্দ আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, উপল, খবরটা ভাল। তারপর গোবিন্দ গম্ভীর হয়ে বলল, হক্কের মরা মরেছে, জ্যাঠা। আর বেঁচে থেকে হতটা কী? দুনিয়া তো ছিবড়ে হয়ে গিয়েছিল। এই বলে সে আমার দিকে চেয়ে বলল, উপল, তুইও চল। গায়ের ব্যথাটা ঝেড়ে আসবি। দেশে আমাদের ধানজমি আছে। বাবা তাড়িয়ে দিয়েছিল বদমাইশির জন্য, তাই ফিরতে পারছিলাম না। নইলে কোন শালা মরতে কন্ডাক্টরি করে।

বিনা নোটিশে চাকরি ছেড়ে দু’জনে সেই রাতে কেটে পড়লাম হাওড়া জেলার শিবগঞ্জে।

আমার স্বভাব বসতে পেলেই ঠেলেঠুলে শুয়ে পড়া। গোবিন্দর দেশটা বেশ ভালই। বাগনান থেকে বাসে ঘণ্টা কয়েকের রাস্তা। পৌঁছে গেলে মনে হয়, ঠিক এ রকমধারা জায়গাই তো এতকাল খুঁজছিলাম। গোবিন্দদের ধানজমি বেশি না হোক, ওদের দু’বেলা ভাতের অভাব নেই। বিরাট একটা নারকোল বাগান আছে। মেটে দোতলা বাড়িতে বেশ মাঝারি বড় সংসার।

দু’বেলা খাওয়ার-শোওয়ার ভাবনা নেই, আমি তাই নিশ্চিন্তে সেখানে শেকড় চালিয়ে দিলাম। ভরসা হল, বাকি জীবনটা এখানেই কেটে যাবে বুঝি! গোবিন্দ তখন প্রায়ই বলত, দাঁড়া তোকে এ দিকেই সেট করিয়ে দেব। কিন্তু মাস তিনেক যেতে না যেতেই গোবিন্দ বিয়ে করে বসল, আর তার দুমাস বাদেই গোবিন্দর মুখ হাঁড়ি। আমার সঙ্গে ভাল করে কথা কয় না। বুঝলাম, ওর বউ বুদ্ধি দিয়েছে। তবু গায়ে না-মেখে আমি আরও এক মাস কাটিয়ে দিলাম। মোট ছ’ মাস পর। গোবিন্দর বড় ভাই একদিন খাড়ুবেড়েতে যাত্রা দেখে ফেরার পথে গহিন রাতে রাস্তায় টর্চ ফেলে ফেলে আগে আগে হাঁটতে হাঁটতে নরমে গরমে বলেই ফেলল, এ বয়সটা তো বসে খাওয়ার বয়স নয় গো বাপু। গাঁ-ঘরে কাজকর্মই বা কোথায় পাবে। বরং কলকাতার বাজারটাই ঘুরে দেখোগে।

গোবিন্দর বড় ভাই নন্দদুলালের খুব ইচ্ছে ছিল তার মেয়ে কমলিনীকে আমি বিয়ে করি। কিন্তু কমলিনীর বয়স মোটে বারো, সুশ্রীও নয়, তা ছাড়া আমারও বিয়ের ব্যাপারটা বড় ঝামেলা বলে মনে হয়, তাই রাজি হইনি, ঘরজামাই রাখলেও না হয় ভেবে দেখতাম। তা সে প্রস্তাবও নয়, বরং কমলিনীর মা আমাকে প্রায়ই কাজ খোঁজার জন্য হুড়ো দিত, চাষবাস দেখতে পাঠাত। বেলপুকুর বাজারে গিয়ে শুকনো নারকোল বেচে এসেছি কতবার। আখের চাষ হবে বলে গোটা একটা খেত নাড়া জ্বেলে আগুনে পোড়াতে হয়েছিল। এত সব কাজকর্ম আমার ভাল লাগে না। বউ হলে সে আরও তাড়া দেবে সারা জন্ম।

এক বর্ষার রাতে গোবিন্দদের গোলাঘরে চোরে সিঁধ দিল। বিস্তর ধান লোপাট। সকালবেলা খুব চেঁচামেচি হল, তারপর থিতু হয়ে সবাই বসে এক মাথা হয়ে ঠিক করল যে, এবার থেকে আমাকে সারা রাত বাড়ি চৌকি দিতে হবে। একটা নিষ্কর্মা লোক সারা দিন বসে খাবে, কোনও কাজে লাগবে না, এ কি হয়?

দিন পনেরো পাহারা দিতেও হল। এক রাতে ফের চোর এল। আমার চোখের সামনে পরিষ্কার পাঁচ-ছ’জন কালো কালোলোক। তাদের দু’-একজন আমার মুখ চেনা। দক্ষিণের ঘরের দাওয়ায় বসে লণ্ঠন পাশে নিয়ে একটা লম্বা লাঠি উঠোনে মাঝে মাঝে ঠুকছিলাম, দুটো দিশি কুকুর সামনে ঝিমোচ্ছে। এ সময়ে এই কাণ্ড। চোর দেখে ভিরমি খাই আর কী। লাঠি যে মানুষের কোন কাজে লাগে তা তখনও মাথায় সেঁধোচ্ছে না। চোর ক’জন এসে সোজা আমার চারধারে দাঁড়িয়ে গেল, একজন বলল, উপল শালা, মেরে মাঠে পুঁতে দিয়ে আসব, মনে থাকে যেন। কুকুর দুটো দু’বার ভুক ভুক করে হঠাৎ ল্যাজ নাড়তে লাগল চোরদের খাতির দেখানোর জন্য। দিশি কুকুরদের বীরত্ব জানা আছে। আমিও তাদের দেখে কায়দাটা শিখে গেলাম, এক গাল হেসে বললাম, আরে তোমরা ভাবো কী বলো তো, অ্যাঁ? পাহারা কি আসলে দিই? গুঁতোর চোটে পাহারা দেওয়ায়। যা করার চটপট সেরে নাও ভাই সকল, আমি চার দিকে চোখ রাখছি।

চোরেরা যখন মহা ব্যস্ত ঠিক তখনই আখের বুঝে আমি লাঠি আর লণ্ঠন নিয়ে লম্বা দিলাম। নইলে পরদিন আমার ওপর দিয়ে বিস্তর ঝামেলা যেত।

তা সেই লাঠি আর লণ্ঠন ছাড়া তখন আর আমার কোনও মূলধন ছিল না। আফসোস হল, চোরদের সঙ্গে হাত লাগিয়ে যদি কিছু নগদ বা ঘটিবাটি গোবিন্দদের বাড়ি থেকে হাতিয়ে আনতে পারতাম তো বেশ হত।

আমার বাবা সারা জীবনটাই ছিলেন ডাকঘরের পিয়োন, শেষ জীবনে সর্টার, আর এক থাক উচুতে উঠতে পারলে তাকে ভদ্রলোক বলা চলত, তা তিনি উঠতে পারেননি। বিস্তর ধারকর্জ করে খাওয়া-দাওয়া ভাল করতেন। ওই এক শখ ছিল। প্রভিডেন্ট ফাণ্ড-এর অর্ধেকই প্রায় ফৌত হয়ে গিয়েছিল ওই কর্মে। সারাটা জীবন তাকে কেবল টাকা খুঁজতে দেখেছি। অন্য সব টাকার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে তিনি বাড়ির আনাচে কানাচে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পুলিশের মতো সার্চ চালাতেন। বিছানার তোশক উলটে, জাজিম উঁচু করে চাটাইয়ের তলা পর্যন্ত, ওদিকে কাঠের আলমারির মাথা থেকে শুরু করে রান্নাঘরের কৌটো বাউটো, পুরনো চিঠিপত্রের বান্ডিলের মধ্যে পরম উৎসাহে তিনি টাকা বা পয়সা খুঁজতেন। কদাচিং এক আধটা দশ বা পাঁচ পয়সা পেয়ে আনন্দে ‘অ্যাই যে, অ্যাই যে, বলেছিলুম না!’ বলে চেঁচিয়ে উঠতেন। ঘরের গোছগাছ হাঁটকানোর জন্য মাসি খুব রাগ করতেন বাবার ওপর। বাবা সে-সব গায়ে মাখতেন না, বরং সুর করে মাসিকে খ্যাপাতেন, কানামাছি ভোঁ ভোঁ..। কানা মাসির নামই হয়ে গিয়েছিল কানামাছি।

বাবার কাছ থেকে ওই একটা স্বভাব আমি পেয়েছি। আমারও স্বভাব যখন তখন যেখানে সেখানে অবসর পেলেই পয়সা খোঁজা, হাটে-বাজারে, রাস্তায়-ঘাটে ঘর-দোরে প্রায় সময়েই আমি হাট পাট করে পয়সা খুঁজি। সিকিটা আধুলিটা পেয়েও গেছি কখনও সখনও। না পেলেও ক্ষতি নেই, খোঁজাটার মধ্যেই একটা আনন্দ আছে, যেমন লোকে খামোকা ঘুড়ি উড়িয়ে বা মাছ ধরতে বসে আনন্দ পায় এ অনেকটা সে রকমই আনন্দ।

একবার হরতালের আগের দিন বিকেলে বাবা পবদিনের বাজার করতে গেছেন। তখনও বুড়ো বাড়িওলা বেঁচে। বাজারে বাবার সঙ্গে দেখা হতেই বুড়ো বাড়িওলা আঁতকে উঠে বললেন, এ কী বাপ, তোমাকে না আজ সকালেই বাজার করে ফিরতে দেখলুম! আবার এ বেলা বাজারে কেন বাবা? বাবা মাথা চুলকে বললেন, কাল হরতাল কিনা, তাই কালকের বাজারটা সেরে রাখছি। শুনে বুড়ো রেগেমেগে খেকিয়ে উঠলেন, হরতাল ছিল তো হরতালই হত, শাকভাত নুনভাত কি মুড়ি-টুড়ি চিবিয়ে কাটিয়ে দিতে পারতে না। অ্যা? এ কী ধরনের অমিতব্যয় তোমাদের, দিনে দু-দুবার বাজার। এ বয়সেই যদি দুটো পয়সা রাখতে না পারো তো কি গুচ্ছের ছেলেপুলে হয়ে গেলে তখন পারবে? দুটো পয়সার মর্ম যে কবে বুঝবে তোমরা! বয়স হয়ে গেলে কপাল চাপড়াবে।

সেই থেকে বাবা একটা ঠাট্টার কথা পেয়ে গিয়েছিলেন। প্রায় সময়েই খুক খুক করে হাসতে হাসতে বললেন, দুটো পয়সা রাখতে না পারলে…!

কিন্তু ঠাট্টার কথা হলেও, ওই দুটো পয়সা রাখতে না পারায় কানা মাসিকে ভাইয়ের বাড়িতে ঝিগিরি করতে হচ্ছে। আর আমার হাতে হারিকেন।

বাস্তবিকই হারিকেন আর লাঠি সম্বল করে গোবিন্দর বাড়ি থেকে যেদিন পালাই সেই দিন রাতে ভারী একটা দুঃখ হচ্ছিল আমার। বলতে কী গোবিন্দর বাড়িতে থাকতে আমি দুটো পয়সা করেছিলাম। প্রায় দিনই এটা-সেটা নিয়ে গোপনে বেচে দিতাম, ঘরের মেঝেয় একটা সোনার মাকড়ি কুড়িয়ে পেয়ে রেখে দিয়েছিলাম, দু-চারটে পয়সা কুড়িয়ে-টুড়িয়ে একটা বাঁশের চোঙায় জমিয়ে রেখেছিলাম। সেই গুপ্ত সম্পদ গোবিন্দদের পশ্চিমের বাতায় গোঁজা আছে। আনতে পারিনি।