১৩. সুবিনয় অফিসে গেল

১৩.

সুবিনয় অফিসে গেল। ক্ষণা গেল মার্কেটিং-এ। সুবিনয়ের মা কুসুমকে নিয়ে কালীঘাটে।

আমি বাথরুমে বসে নিবিষ্ট মনে গেঞ্জি কাচছিলাম। আজকাল ক্ষণা কাচাকাচি করতে দেখলে রাগ করে বলে, তুমি কাচবে কেন? কুসুম দেবে’খন। না হয় তো আমি দেব। পুরুষ মানুষের কাজ নাকি এ সব!

গেঞ্জি কাচা আমার খুব পছন্দের কাজ নয়। কিন্তু ভাবি, সারা জীবন আমাকেই তো কাচতে হবে। আমার তো কোনও দিন বউ হবে না। মধু গুপ্ত লেনের রুস্তমদের টাকা আমি মিটিয়ে দেব। কেতকীর বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেছে। সেই ইঞ্জিনিয়ার। তাই ভাবি, এত কাল পর কেন এই আদরটুকু নিই? আমার এমনিই যাবে।

বাথরুমের দরজায় কে এসে দাঁড়াল। প্রথমে তাকাইনি। কিন্তু নিথর এক মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে টের পেয়ে চোখ তুলেই চমকে উঠি।

প্রীতি — আমার গলার স্বর কেঁপে যায়।

সাদা খোলের চওড়া জরিপেড়ে একটা ভীষণ দামি শাড়ি পরনে। ওর মুখও সাদা। ঠোঁট ফ্যাকাসে। খুব বিষন্ন দেখাচ্ছিল।

ও চৌকাঠের কাছে এগিয়ে এসে বলল, আমি আপনার কাছেই এসেছি।

আমার কাছে?

উপলবাবু, ক্ষণাদিকে নষ্ট করলেন?

আমি মাথা নিচু করে বলি, না তো। আমি ওকে ভালবাসি।

প্রীতি জলময় নোংরা চৌকাঠের ওপর সাদা শাড়ির কথা ভুলে গিয়ে বসে পড়ল ঝুপ করে। ঠিক আমার চোখে চোখ রেখে চেয়ে রইল।

কী হল?–আমি অবাক হয়ে বলি।

আমি সব জানি উপলবাবু।

আমি মাথা নিচু করে বললাম, মাইরি।

বেচারা! প্রীতি হেসে বলে, না, ক্ষণাদিকে নয়, আপনি বড় বেশি টাকা ভালবাসেন।

আমি মাথা নেড়ে বলি, না। আমি টাকা ভালবাসি না। আমি শুধু চেয়েছিলাম টাকা সহজলভ্য হোক! বৃষ্টির মতো, জলপ্রপাতের মতো টাকা ঝরে পড়ুক। হ্যান্ডবিলের মতো টাকা বিলি হোক রাস্তায় রাস্তায়।

তাই টাকার জন্য আমার দিদিকে নষ্ট করলেন?

নষ্ট?

বলে আমি অবাক হয়ে তাকাই। তারপর প্রীতির কাছে হামাগুড়ি দিয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে বলি, দেখুন। আমার মুখের মধ্যে দেখুন।

এই বলে হাঁ করে থাকি।

 প্রীতি আমাকে পাগল ভেবে উঠে দাঁড়ায়। বলে, কী দেখব?

দেখলেন না আমার মুখের মধ্যে?

কী?

বিশ্বরূপ। শ্রীকৃষ্ণ দেখিয়েছিলেন অর্জুনকে। আপনিও ভাল করে দেখলে দেখতে পেতেন, আমি কাউকে নষ্ট করিনি। যে যার কর্মফলে নষ্ট হয়ে আছে। আমি নিমিত্ত মাত্র।

লোকে যেমন রাস্তার পাশে পচা ইঁদুর দেখে তেমনি একরকম ঘেন্নার চোখে আমাকে দেখছিল প্রীতি। অনেকক্ষণ দেখে বলল, আপনি অন্য কোথাও যেতে চান না উপলবাবু?

গেঞ্জিটা ধুয়ে নিংড়ে আমি উঠে আসি। হেসে বলি, যাব। আমাকে তো যেতেই হবে। প্রীতি, জীবনে এই প্রথম একটা কাজ আমি সম্পূর্ণ করেছি। এই আনন্দটা আমাকে কিছুক্ষণ উপভোগ করতে দিন।

কী কাজ?

ক্ষণাকে পথ থেকে সরিয়ে দিয়েছি। এবার আপনারা আমেরিকা চলে যেতে পারবেন।

বেচারা!– প্রীতির দীর্ঘশ্বাস ফাঁকা বাড়িতে বড় করে শোনাল। বলল, আপনি কি ভাবেন, যে লোকটা তার বউকে স্ক্যান্ডালে জড়ানোর জন্য এত কাণ্ড করছে তাকে আমি বিশ্বাস করব? ক্ষণাদিকে আমরা ছেলেবেলা থেকে জানি। চিরকাল ওর ঘর-সংসারের দিকে ঝোঁক। এমন গুছিয়ে পুতুল খেলত যে সবাই বলত, ও খুব সংসার-গোছানি মেয়ে হবে। তাই হয়েছিল ক্ষণাদি। স্বামী, শাশুড়ি, বাচ্চা সংসার নিয়ে কেমন জড়িয়ে গিয়েছিল। অমন ভাল বউকে কেউ এত নীচে টেনে নামায়?

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাই।

প্রীতি আমার একটা হাতে হাত রেখে বলল, কেন করলেন এমন? কী দিয়ে ভোলালেন ক্ষণাদিকে?

উদাস স্বরে বলি, আমি নিমিত্ত মাত্র। যা হওয়ার তা হয়েই ছিল।

প্রীতি আরও এক পা কাছে সরে এসে বলল, কিছু হয়নি উপলবাবু। জামাইবাবুকে আমি নিইনি মনের মধ্যে। কখনও হয়তো কোনও দুর্বলতা এসেছিল, এখন নেই। আপনি দিদিকে ছেড়ে দিন। আমি আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।

কোথায় প্রীতি?

আপনাকে আমার ভীষণ দরকার।

 কেন প্রীতি?

বলব। আপনি আপনার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিন।

 গোছানোর মতো কিছু নেই।

তা হলে চলুন।

আমি পোশাক পরে নিই। টাকার মস্ত বান্ডিলটা পকেটে পুরি।

প্রীতি আড়চোখে দেখে বলল, কত টাকা!

 অনেক।

 প্রীতি চেয়ে রইল আমার দিকে। করুণাঘন চোখ।

ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছিল প্রীতি। উঠতে গিয়েই চমকে উঠে দেখি, রুমা বসে আছে। পিছনের সিটে হেলে বসে নিজের বাঁ হাতের নখগুলো দেখছিল। আমার দিকে খরচোখে একবার তাকাল। প্রীতিকে বলল, ওঁকে সব বলেছ প্রীতি?

না। তুমি বলো।

বলছি।

বলে রুমা সিটের মাঝখানে সরে এসে বসল। এক ধারে প্রীতি, অন্য ধারে আমি।

ট্যাক্সি ছেড়ে দিল। পাঞ্জাবি ট্যাক্সিওয়ালা ধীরগতিতে গাড়ি চালায়। হয়তো তাকে ও রকমই নির্দেশ দেওয়া আছে।

রুমা পাশে বসতেই আমার শরীরে একটা কাঠের মতো শক্ত ভাব দেখা দিল। বুকে ভয়। নার্ভাস লাগছে।

রুমা আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, শুনুন রোমিও, প্রীতি অবশেষে আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে।

আমি অনেকখানি বাতাস গিলে ফেলি।

 আমাকে?

 আপনাকে। কেন, আপনি রাজি নন?

উদভ্রান্তের মতো বলি, কী বলছেন? আমি কি ঠিক শুনছি?

 ঠিকই শুনছেন। প্রীতি আপনাকে বিয়ে করতে চাইছে। আজই এক্ষুনি। অনেক স্যুটারের ভিতর থেকে প্রীতি আপনাকেই বেছে নিয়েছে। আপনি ভাগ্যবান।

মাথাটা ঘুলিয়ে ওঠে। কিছু বুঝতে পারি না। পাঞ্জাবি ট্যাক্সি ড্রাইভারের সবুজ পাগড়ির দিকে চেয়ে থাকি। আমার শরীরের কোথায় যেন একটা বৈদ্যুতিক তার ছুঁয়ে আছে। মৃদু শিহরনে শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে। নতুন এক চোখে প্রীতির দিকে পাশ ফিরে চাইলাম।

প্রীতি আমার দিকে চেয়ে ছিল, চোখ চোখ পড়তেই মুখখানা ঘুরিয়ে নিল বাইরের দিকে।

গোলপার্কে ওদের ফ্ল্যাটে এসে রুমা বলল, আমি পাশের ঘরে আছি প্রীতি। তোমরা কথা বলে নাও।

রুমা তার ঘরে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে ছিটকানি দিয়ে দিল। তারপর ও ঘর থেকে সেই ট্যাংগো নাচের বাজনা আসতে লাগল।

তার সেই ঘোরানো চেয়ারে প্রীতি মাথা নত করে বসে আছে। কার্ল করা খাটো চুলের রাশি থোপা থোপা কালো আঙুরের মতো ঘিরে আছে মুখখানা।

গদি-আঁটা টুলের ওপর হতভম্ব মাথা নিয়ে বসে আছি। কথা আসছে না।

অনেকক্ষণ বাদে প্রতি তার সুন্দর কিন্তু ফ্যাকাসে মুখখানা তুলে আমার দিকে ফেরাল। নরম আদরের গলায় ডাকল, উপল!

উ।

আমাকে বিয়ে করবে না উপল?

মাথা নেড়ে বললাম, আমি কি স্বপ্ন দেখছি প্রীতি?

না।–প্রীতি মাথা নেড়ে বলল, শোনো উপল, তোমাকে ছাড়া আমার উপায় নেই।

 চোখের জল মুছে নিয়ে বললাম, আমাকে কেউ ভালবাসে না প্রীতি।

প্রীতি আবার কালো আঙুরের থোপায় মুখ ঢেকে মাথা নত করে মৃদু স্বরে বলল, আমি বাসি।

কবে থেকে প্রীতি?

যেদিন তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম। জামাইবাবুর পাগলামির চিঠি নিয়ে এসেছিলে। আমি তোমার ওপর বিরক্ত হয়েছিলাম উপল। কিন্তু তখন থেকেই তোমাকে ভুলতে পারি না। কেন ভুলতে পারি না তা অনেক বার ভেবে দেখেছি, বিরক্ত হয়েছি নিজের ওপর। পরে বুঝতে পেরেছি, তোমাকে আমি কবে থেকে যেন ভালবেসে ফেলেছি! বুঝে নিজের ওপর রেগে গেছি। কিন্তু ভালবাসার ওপর কি কারও হাত থাকে, বলো!

প্রীতি, আমি সামান্য মানুষ।

কে বলল উপল? তুমি সামান্য নও। তোমার ভিতরে কী আছে তা তুমি কোনও দিন বুঝতে পারোনি।

কী আছে প্রীতি?

 নতমুখী প্রীতি বলে, তুমি বড় ভাল লোক। তুমি খুব ভাল।

আমি মাথা নেড়ে বলি, না প্রীতি। আমি ভাল নই। আমার যখন খিদে পায় তখন আমার মাথার ঠিক থাকে না। তখন মানুষ আমাকে যা করতে বলে তাই করি। বরাবর মানুষ আমাকে নিমিত্তের ভাগী করেছে প্রীতি। কিন্তু যদি খিদে না পেত–

সজল, বিশাল দুখানা চোখে প্রীতি আমার দিকে তাকায়। তার ঠোঁট কেঁপে ওঠে। কথা ফোটে না প্রথমে। তারপর খুব অন্য রকম এক গলায় আস্তে করে বলে, আমি তোমাকে খাওয়াব উপল। আমি তোমাকে আমেরিকায় নিয়ে যাব। দুজনে মিলে খাটব, খাব। খিদের কথা বোলো না। আমার বড় কষ্ট হয়।

অবাক হয়ে বলি, আমেরিকায় নিয়ে যাবে?

ও মাথা নেড়ে বলল, নিয়ে যাব। আমি সামনের রবিবারে চলে যাচ্ছি। গিয়েই তোমার যাওয়ার সব ব্যবস্থা করব। ভেবো না, সে দেশে কখনও খাবারের অভাব হয় না।

নিয়ে যাবে! আমার রক্তে রক্তে ট্যাংগো নাচের বাজনা ঢুকে যায়। আমার ভিতরে যেন এক নাচঘর তৈরি হয়ে গেল। সেই ঘরে জোড়া জোড়া পা ফেলে সাহেব-মেম নেচে বেড়াচ্ছে।

প্রীতি!

 প্রীতি উৎকর্ণ হয়ে কী যেন শুনবার চেষ্টা করছিল। জবাব দিল, উ!

কবে আমাদের বিয়ে হবে?

আজ। বেলা তিনটের সময় ম্যারেজ রেজিস্ট্রার আসবেন, সাক্ষীরা আসবেন।

আমি হাসলাম। বহুকাল এমন গাড়লের মতো হাসিনি।

 প্রীতি, শোনো। বিয়ের পর আমরা জোড়ে মাসির কাছে যাব।

 প্রীতি অবাক হয়ে বলে, মাসি কে?

আমার এক মাসি আছে। মাসি ছাড়া দুনিয়ায় আর কেউ নেই। বড় খুশি হবে মাসি। কত আদর করবে তোমাকে, দেখো। যাবে তো!

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই যাব উপল।

তুমি মাসিকে প্রণাম করবে তো প্রীতি?

করব, নিশ্চয়ই করব।

কটা বাজে প্রীতি?

প্রীতি মৃদু হেসে বলে, তিনটে বাজতে পাঁচ মিনিট। তুমি ঘাবড়ে যাওনি তো উপল?

অবাক হয়ে বলি, না তো! ঘাবড়াব কেন? আমার অসম্ভব, অসহ্য এক আনন্দ হচ্ছে। প্রীতি, তুমি বিয়ের পর সিঁদুর পরবে তো?

প্রীতি করুণ মুখখানা তুলে বলে, পরতে তো হবেই।

 শাঁখা?

তাও।-বলে প্রীতি হাসল। বড় সুন্দর হাসি।

তুমি কি রাঁধতে পারো প্রীতিসোনা?

প্রীতি ঘাড় হেলিয়ে বলল, হ্যাঁ। আমি অনেক রকম রান্না জানি। দেশি, বিলিতি। আমেরিকায় তো আমাকেই রাঁধতে হবে তোমার জন্য।

কেন প্রীতি? আমরা রান্নার লোক রাখব।

ওদের দেশে ভীষণ টাকা লাগে লোক রাখতে।

লাগুক। তোমাকে আমি তা বলে রাঁধতে দেব না।

 আচ্ছা। বলে প্রীতি চোখে চোখে একটু হাসে।

 সিঁড়ি দিয়ে পায়ের শব্দ উঠে আসছে। উত্তেজনায় কেঁপে আমি দাঁড়িয়ে পড়ি।

প্রীতিও উঠে দাঁড়ায়। ম্লান মুখ করে বলে, ওরা আসছে।

আমি আজ দাড়ি কামাইনি প্রীতি।–গালে হাত বুলিয়ে বলি।

তাতে কিছু হবে না উপল। সারা জীবন তো কামাবেই।

সাজিনি।

তোমাকে অনেক পোশাক করে দেব।

তিনজন লোক ঘরে এসে দাঁড়ায়। একজনের হাতে খাতাপত্র। প্রথমে উত্তেজনার বশে আমি তাদের মুখ ভাল করে দেখতে পাই না। তারপর হঠাৎ খেয়াল হয়, তিনজনের মধ্যে একজন প্রীতির সেই প্রেমিক।

প্রীতি আমার কাছে ঘেঁষে এসেছিল। ওর একটা হাত কখন আমার হাতের মুঠোয় এসে গেছে। আমি ফিস ফিস করে বলি, ও কে প্রীতি? ও কেন এখানে?

প্রীতি মৃদু স্বরে বলে, ও আমার কেউ না উপল। ও শুধু সাক্ষী দিতে এসেছে।

পাশের ঘরে ট্যাংগো থামল, দরজা খুলে বেরিয়ে এল রুমা। খাতা হাতে লোকটা চেয়ার টেবিলে গিয়ে বসল। প্রীতির প্রাক্তন প্রেমিক আর একজন অচেনা লোক গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকল।

থমথম করছে ঘর। কেউ কোনও আনন্দ করছে না। এই শোকের ছায়ার মধ্যে কী করে বিয়ে হবে?

প্রীতি আমার হাত চেপে ধরে বলল, এসো উপল।

আমি বললাম, কেউ উলু দিল না প্রীতি, শাঁখ বাজল না।

প্রীতি আমাকে টেবিলের সামনে নিয়ে গেল। ম্যারেজ রেজিস্টার আঙুল দিয়ে ফর্মে একটা জায়গা দেখিয়ে দিয়ে বললেন, এইখানে সই করুন।

একদম সময় লাগল না। আমি আর প্রীতি সই করার পর রুমা, প্রীতির ভূতপূর্ব প্রেমিক আর অচেনা লোকটা সই করল। ম্যারেজ রেজিস্ট্রার তার খাতাপত্র গুছিয়ে নিয়ে উঠল। চলে গেল।

প্রীতি তার ঘোরানো চেয়ারে বসে আছে। নতমুখ। কালো আঙুরের থোপায় ঘিরে আছে মুখখানা। হঠাৎ ও একটু কেঁপে উঠল। চাপা কান্নার একটা অস্ফুট শব্দ কানে এল। ঘরের মাঝখান থেকে আমি ছুটে ওর কাছে যাওয়ার জন্য এগোতেই মাঝখানে রুমা এসে দাঁড়াল।

উপলবাবু! ওকে এখন আর ডিস্টার্ব করবেন না।

 ডিস্টার্ব!–আমি ভীষণ অবাক হয়ে বলি, ডিস্টার্ব মানে? ও আমার বউ। আমার বউ কাঁদছে কেন সেটা আমার জানা দরকার।

রুমার দু’পাশে প্রীতির প্রাক্তন প্রেমিক আর অচেনা লোকটাও এসে দাঁড়াল। করুণ চোখে আমার দিকে চেয়ে প্রেমিকটি বলল, সে তো ঠিকই উপলবাবু। ও তো চিরকালের মতোই আপনার হয়ে গেল। এখন ওকে একটু রেস্ট নিতে দিন।

তীব্র আকুলতায় আমি বললাম, আমাকে ওর কাছে যেতে দিন। আমার বউ কাঁদছে।

রুমা অত্যন্ত উদাস গলায় বলল, উপলবাবু, এখনও ও কেবলমাত্র কাগজের বউ। সেটাই আপনার পক্ষে যথেষ্ট হওয়া উচিত।

ভীষণ অবাক হয়ে বলি, কাগজের বউ! তার মানে?

 কাগজে সই করা বউ। রুমা নিষ্ঠুর গলায় বলে, তার বেশি নয়।

আমি গাড়লের মতো তাকিয়ে থাকি। তিনজন মানুষ আমার সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ওপাশে প্রীতি তার টেবিলে মাথা রেখে কাঁদে অঝোরে।

প্রীতি!– আমি প্রাণপণে ডাকি।

প্রীতি উত্তর দেয় না। কাঁদতে থাকে।

প্রেমিক আমার হাত ধরে বলে, ইমোশনাল হবেন না উপলবাবু। এখন আপনার অনেক দায়িত্ব।

আমি মাথা নেড়ে বলি, ঠিকই তো। আমি বিয়ে করেছি, দায়িত্ব হওয়ারই কথা।

প্রাক্তন প্রেমিক মাথা নেড়ে বলে, সেইজন্যই তো বলছি। দেয়ার আর মাচ টু বি ডান। এখন আপনার প্রথম কাজ সুবিনয়বাবুকে খবরটা পৌছে দেওয়া। ওকে জানিয়ে দেবেন, প্রীতির সঙ্গে আপনার বিয়ে হয়ে গেছে। এ কাজটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট উপলবাবু।

আমি বুঝতে পারি না। সব ধোঁয়াটে লাগে। তবু মাথা ঝাঁকাই। চিরকাল লোকে আমাকে এটা-সেটা ভালমন্দ কাজ করতে বলেছে। আমি করে গেছি।

প্রাক্তন প্রেমিক বলল, কেন ইম্পর্ট্যান্ট জানেন? সুবিনয়বাবুর পাগলামি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে উঠে গেছে। উনি সব সময়ে প্রীতিকে গার্ড দিচ্ছেন। অথচ পরশুদিন প্রীতিকে ফ্লাই করতেই হবে।

পরশুদিন!–আমি চমকে উঠে বলি।

পরশুদিন রবিবার। প্রীতির প্যাসেজ বুকড হয়ে আছে।

আমি অবাক হয়ে বলি, আজ কী বার?

শুক্রবার – উপলবাবু, শুনুন, সুবিনয়বাবুকে বলবেন, প্রীতির সঙ্গে কোনও রকম ঝামেলা করলে আমরা পুলিশের প্রোটেকশন নেব। প্রীতি এখন একজনের লিগাল ওয়াইফ।

একজনের নয়। আমি মাথা নাড়ি। একজন কথাটা আমার পছন্দ হয় না। আমি দৃঢ় কণ্ঠে বলি, প্রীতি আমার বউ।

পেপার ওয়াইফ।–রুমা তীব্র গলায় বলল।

না না।–প্রেমিক বলে ওঠে, উপলবাবু ঠিকই বলছেন। প্রীতি এখন উপলবাবুরই স্ত্রী।

 প্রীতি টেবিলে মাথা রেখে কাঁদছে। অঝোর কান্না। আমার বুকের মধ্যে ঢেউ দুলে ওঠে। আমার সামনে তিনজন মানুষ দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে।

আমি বলি, একবার আপনারা আমাকে ওর কাছে যেতে দিন। ও আমার বউ। আমার বউ কাঁদছে।

প্রাক্তন প্রেমিক বলে, ওকে কাঁদতে দিন। ও আনন্দে কাঁদছে। এবার কাজের কথা শুনুন উপলবাবু, সুবিনয়কে আপনি এই ম্যারেজ সার্টিফিকেটখানা দেখাবেন। ফেস হিম লাইক এ হিরো। মনে রাখবেন, আপনি আপনার স্ত্রীর নিরাপত্তার জন্য লড়ছেন।

আমি বুঝদারের মতো মাথা নেড়ে বলি, বুঝেছি। সুবিনয় কিছু করবে না। ও আমাকে ভয় পায়।

বলে আমি হাসতে থাকি।

প্রাক্তন প্রেমিক বলে, সেটা আমরা জানি উপলবাবু। সুবিনয় আপনাকে ভয় পায়। কারণ, আপনি ওর অনেক গোপন কথা জানেন। আর ঠিক সেই কারণেই আপনাকে এ কাজের জন্য চুজ করা হয়েছে।

চুজ করা হয়েছে। আমি বাতাস গিলে বলি, তার মানে?

স্লিপ অফ টাং মাই ডিয়ার। প্রাক্তন প্রেমিক একটু হেসে বলল, ডোন্ট মাইন্ড। কাজের কথাটা শুনে নিন। আপনি সুবিনয়কে আরও বলবেন যে, প্রীতি পরশু দিন আমেরিকা যাচ্ছে না। তার বদলে আপনি কাল প্রীতিকে নিয়ে হানিমুনে যাচ্ছেন। কুলু ভ্যালিতে।

কুলু ভ্যালি?

কুলু ভ্যালি। সুবিনয়কে মিসলিড করবেন। ও আপনাকে ফলো করার চেষ্টা করবে। যদি করে তো আপনি কলকাতা থেকে দূরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। প্রীতির রওনা হওয়ার আগে পর্যন্ত সুবিনয়ের কলকাতায় থাকাটা নিরাপদ নয়। হি ইজ ডেঞ্জারাস।

আমি মাথা নাড়লাম। প্রাক্তন প্রেমিক এক বান্ডিল নোট বের করে আমার পকেটে গুঁজে দিয়ে বলল, ফর দি এক্সপেনসেস, ফাইভ থাউজেন্ড।

অবাক হয়ে বলি, টাকা! টাকা কেন? আমি আমার স্ত্রীর নিরাপত্তার জন্য কাজ করব, আপনি টাকা দেবেন কেন?

কাগজের বউ। রুমা বলল।

না না। প্রেমিক বাধা দিয়ে বলে, আপনার বউ তো ঠিকই। কিন্তু টাকার তো দরকার হতে পারে। কিপ ইট অ্যাজ এ গিফট।

ইতস্তত করি। টাকা! কত টাকা! টাকা কি দুনিয়ায় সত্যিই সস্তা হয়ে গেল? আজকাল আমি পাশ ফিরলেও টাকা আসে। গোছ গোছা হ্যান্ডবিলের মতো টাকা।

প্রাক্তন প্রেমিক আমার পিঠে হাত রেখে দরজার দিকে নিয়ে যেতে থাকে। আমি জেদির মতো দাঁড়াই।

প্রীতি মুখ তুলছে। চোখ মুছল। তারপর তাকাল আমার দিকে। দুই চোখ লাল। মুখখানা রুদ্ধ আবেগে ফেটে পড়ছে। ওর ঠোঁট নড়ল। কিছু বলল কি? কিছু শোনা গেল না। কিন্তু বুঝতে পারি, ও বলল, বেচারা!

প্রাক্তন প্রেমিকের হাত ছাড়িয়ে আমি প্রীতির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললাম, প্রীতিসোনা, আমি তোমার জন্য সব করব। ভেবো না।

আমি প্রীতির দিকে এগিয়ে যাই। প্রীতি বিহ্বল চোখে তাকিয়ে থাকে। আমি বলি, প্রীতি, বউ আমার!

চকিত পায়ে রুমা রাস্তা আটকে দাঁড়ায়। কঠিন গলায় বলে, উপলবাবু, প্রীতিকে একা থাকতে দিন।

অসম্ভব রাগে আমার শরীর স্টার্ট নেওয়া মোটরগাড়ির মতো গর্জন করতে থাকে। আমি বলি, সরে যান!

রুমা তার স্ম্যাশ করার প্রিয় ভঙ্গিতে হাতখানা ওপরে তোলে। বলে, নট এ স্টেপ ফারদার।

অভিজ্ঞতা বলে আমি কুঁকড়ে যাই। ডালমিয়া পার্কের সেই স্মৃতি দগদগ করে ওঠে পুরনো ব্যথার মতো। প্রাক্তন প্রেমিক এসে আমার হাত ধরে সান্ত্বনার গলায় বলে, আগে কাজ তারপর সব কিছু। প্রীতি আপনারই রইল। এখন ওকে বিপদ থেকে বাঁচানোটা আগে দরকার।

আমি মাথা নাড়ি। তারপর প্রাক্তন প্রেমিকের কানে কানে বলি, এর আগে আমার কখনও বিয়ে হয়নি, জানেন! আমার অদ্ভুত ভাল লাগছে।

প্রাক্তন প্রেমিক আমাকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে। বলে, জানি। আপনি বড় ভাল লোক। পৃথিবীর শেষ কয়েকটা ভাল লোকের মধ্যে আপনি একজন।