মার্সেঈ শহরের মেয়রের আফিস।
বড় একখানা টেবিলের পিছনে বসে মেয়র আফিসের কাগজপত্র সই করছেন, এই সময় আদালী একখানা কার্ড এনে তার হাতে দিলো।
কার্ডখানার উপরে একবার চোখ বুলিয়ে মেয়র বললেন– সাবকো সেলাম দো।
একটু পরেই একজন সুবেশ ইংরেজ যুবক সেই কক্ষে প্রবেশ করে মেয়রকে অভিবাদন করলো।
মেয়র বললেন–বসুন। আপনিই এসেছেন ‘টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ’ কোম্পানি থেকে?
–হ্যাঁ।
–কি দরকার বলুন?
–আমি এসেছি এখানকার ‘মোরেল অ্যান্ড সন’ নামক জাহাজী কোম্পানি সম্বন্ধে খবরাখবর নিতে। ঐ কোম্পানির দেনা-সংক্রান্ত সব দলিলপত্র আমরা কিনে নিতে চাই।
–মোরেল কোম্পানির মত দেউলে প্রতিষ্ঠানের দেনা কিনে কোন সুবিধে হবে আপনাদের?
–তা বলতে পারি না। আমার মনে হয় ব্যবসার ক্ষেত্র থেকে প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করাবার উদ্দেশ্যেই এটা করা হচ্ছে। যাই হোক, আমরা খবর পেয়েছি যে, আপনার কাছে মঁসিয়ে মোরেল কিছু ধারেন। যদি ইচ্ছা করেন ঐ দেনার দলিলপত্র আমাদের কাছে বিক্রি করতে পারেন আপনি। মেয়র খুশি হয়ে উঠলেন যুবকের কথা শুনে।
তিনি বললেন–কি দাম দিতে চান!
–দেনার পুরো টাকা, আর তার উপরে শতকরা ছ’ টাকা হারে সুদ।
–বেশ, আমি রাজী আছি। কবে দিতে পারেন টাকা?
–আজই। প্রয়োজন হলে এখুনি।
যুবকের এই কথায় মেয়র বললেন–বেশ, কিন্তু দলিলপত্রগুলো তো এখানে নেই। আপনি যদি দয়া করে বিকালের দিকে আমার বাড়িতে যান, তাহলে বড় ভাল হয়। যুবকটি তখন মেয়রের বাড়ির ঠিকানা লিখে নিয়ে আর একবার অভিবাদন জানিয়ে চলে গেল।
.
ঐ দিনই বিকালে।
মেয়রের বাড়িতে বসে কথা হচ্ছিল, সেই যুবক আর মেয়রের মধ্যে। মেয়র তার দলিলখানা তখন ‘টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ’ কোম্পানির নামে হস্তান্তরিত করে দিয়েছিলেন।
কথায় কথায় মেয়র বললেন–আপনারা আরও দলিলপত্র কিনতে চান কি?
যুবকটি আগ্রহের সঙ্গে বললো–নিশ্চয়ই। আমার উপর সেই রকম নির্দেশই দেওয়া আছে কোম্পানির।
–বেশ! আমি তাহলে আর একজন ভদ্রলোকের কাছে পাঠাচ্ছি আপনাকে। মোরেল কোম্পানির কাছে মোটা টাকা পান তিনি।
–কি নাম ভদ্রলোকের?
–মঁসিয়ে-দ্য-বোভাইল। ইনি এখানকার কারাগারসমূহের ইনসপেক্টর-জেনারেল। যদি বলেন তো আমি একখানা চিঠিও লিখে দিতে পারি তার কাছে।
যুবকটি খুশি হয়ে বললো–তাহলে তো খুবই ভাল হয়।
মেয়র তখন ব্যক্তিগত ভাবে মঁসিয়ে-দ্য-বোভাইলকে একখানা চিঠি লিখে যুবকটির হাতে দিয়ে বললেন–এই চিঠিখানা তাঁকে দিলেই কাজ হবে।
যুবকটি মেয়রকে অশেষ ধন্যবাদ দিয়ে চিঠিখানা নিয়ে চলে গেল।
পরদিন দুপুরের একটু আগেই যুবকটি মঁসিয়ে-দ্য-বোভাইলের সঙ্গে দেখা করলো। বলা বাহুল্য, তাঁর আফিসেই সে গিয়েছিল।
মেয়রের চিঠি পড়ে আর যুবকটির মুখে মোরেল কোম্পানির দেনা কিনে নেবার প্রস্তাব শুনে মঁসিয়ে বোভাইল যেন হাতে স্বর্গ পেয়ে গেলেন। তিনি তখনই বাড়িতে লোক পাঠিয়ে দিলেন দলিলগুলো নিয়ে আসতে। মোরেল কোম্পানির কাছ থেকে টাকা আদায়ের আশা তিনি একরকম ছেড়েই দিয়েছিলেন। টাকা বড় কম নয়, দু’ লাখ ফ্ৰাঁ। দু’ লাখ ফ্রাঁ ডুবে যাবার কথা চিন্তা করে তার মনে শান্তি ছিল না। তা ছাড়া তার মেয়ের বিয়েও ঠেকে যাচ্ছিলো টাকার অভাবে। এই সব কারণে যুবকটিকে তিনি ছাড়তে চাইলেন না। তার ইচ্ছা, ঐ দিনই দলিলগুলো হস্তান্তরিত করবেন, কারণ যুবকটি বলেছিল যে সুদ-সহ পুরো টাকা দিয়ে দলিলখানা কিনবার মত নগদ টাকা তার সঙ্গেই আছে।
দলিল আসতে দেরি হচ্ছে দেখে যুবকটি তাঁর সঙ্গে গল্প গুজব আরম্ভ করলো। কথায় কথায় সে বললো–আচ্ছা, স্যা-দ্য-ইফ কারাগারের রেকর্ড আপনার এখানে আছে কি?
–নিশ্চয়ই আছে, কেন বলুন তো?
–না, মানে ফারিয়া নামে এক ধমর্যাজকের রেকর্ডটা দেখবার আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছে।
–বেশ তো! দেখুন না। আমি এক্ষুণি আনিয়ে দিচ্ছি, স্যাটু দ্য-ইফ কারাগারের রেকর্ড-বই।
এই বলেই একজন আর্দালী ডেকে স্যাটু-দ্য-ইফ কারাগারের রেকর্ড-বইখানা নিয়ে আসতে হুকুম দিলেন তিনি।
আৰ্দালী বইখানা নিয়ে এলে সিয়ে-দ্য-বোভাইল বললেন– এই নিন স্যাটু-দ্য-ইফ কারাগারের রেকর্ড-বই। আপনি ইচ্ছামত দেখুন।
যুবকটি তখন সেই রেকর্ড-বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে একটা জায়গায় এসে হঠাৎ থেমে গেল। সেই পৃষ্ঠার মাথায় লেখা ছিল–
“এডমন্ড দান্তে, অপরাধ রাজদ্রোহ ও ষড়যন্ত্র!
নেপোলিয়ানের সঙ্গে গুপ্ত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। ভূগর্ভস্থ নির্জন কারাকক্ষে রাখতে হবে একে।”
যুবকটি তাড়াতাড়ি পড়ে যেতে লাগলো সেই পৃষ্ঠার যাবতীয় লেখাগুলি। ঐ পৃষ্ঠার সঙ্গে পিন দিয়ে লাগানো কয়েকখানা আলগা কাগজও ছিল। সেই কাগজগুলি পড়ে যুবকটি জানতে পারলো যে, মঁসিয়ে মোরেল বহুবার ঐ বন্দীর মুক্তির জন্য চেষ্টা করেছেন। নেপোলিয়ন যখন প্যারিসে ফিরে এসেছিলেন, সেই সময় তার কাছে একখানা আবেদনপত্রও পাঠিয়েছিলেন মঁসিয়ে মোরেল, কিন্তু সেখানা কোন অজ্ঞাত কারণে সম্রাটের কাছে পাঠানো হয়নি। সেখানার উপর মঁসিয়ে ভিলেফোর্টের “কিছুই করণীয় নেই” মন্তব্য সহ জেলখানার ইন্সপেক্টর-জেনারেলের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
সেই আবেদনপত্র পড়ে যুবকটির চোখ দুটি হঠাৎ যেন জ্বলে উঠলো।
এই সময় দলিল নিয়ে মঁসিয়ে-দ্য-বোভাইলের বাড়ি থেকে লোক এসে পড়ায় যুবকটির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন– দেখা হলো আপনার?
যুবকটি তাড়াতাড়ি বইখানা বন্ধ করে বললো-হা, হয়েছে। দলিলখানা এসেছে কি?
এ মঁসিয়ে বোভাইল বললেন–হ্যাঁ, এই যে!
যুবকটি তখন দলিলখানা হাতে নিয়ে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখে বললো–বেশ আপনি লিখে দিন যে, সুদসহ পুরো টাকার বিনিময়ে এই দলিল আপনি রোমের “টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ” কোম্পানিকে হস্তান্তরিত করলেন।
লেখা শেষ হলে যুবকটি তার ব্যাগ খুলে নগদ দুই লাখ ছয় হাজার ফ্রাঁর নোট মঁসিয়ে-দ্য-বোভাইলকে গুনে দলিলখানা নিয়ে বিদায় হলো।
.
১৭.
সুপ্রসিদ্ধ জাহাজী প্রতিষ্ঠান ‘মোরেল অ্যান্ড সন’-এর আফিস।
বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়, এখনও বেশ ভাল ভাবেই চলছে এঁদের ব্যবসা, কিন্তু আসলে ঠিক তার উল্টোটি। কোম্পানির পাঁচখানা জাহাজের মধ্যে একমাত্র ফারাওঁ জাহাজখানা ছাড়া বাকি চারখানাই ডুবে গেছে। চারখানা জাহাজ পর পর নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মোরেল কোম্পানির যে বিরাট ক্ষতি হয়, সেই ক্ষতিপূরণ করতে তাদের যাবতীয় রিজার্ভ ফান্ড নিঃশেষিত হয়ে যায়।
কিন্তু তাতেও দেনা শোধ হয় না। এখনও কমপক্ষে পাঁচ লাখ ফ্র দেনা এই কোম্পানির। এই রকম যখন কোম্পানির অবস্থা ঠিক সেই সময় আর এক অভাবনীয় বিপদ এসে উপস্থিত হলো। কয়েক দিন আগে রোমের ‘মেসার্স টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ’ কোম্পানি মঁসিয়ে মোরেলকে এখানা চিঠি দিয়ে জানিয়েছে যে, তারা মোরেল কোম্পানির যাবতীয় দেনা কিনে নিয়েছে। চিঠিতে এ-কথাও তারা লিখেছে যে, কোম্পানির পক্ষ থেকে ৬ই মে তারিখে একজন প্রতিনিধি যাবে তার কাছে–দেনার টাকা সম্বন্ধে কথাবার্তা বলতে।
আজ সেই ৬ই মে।
মঁসিয়ে মোরেল চিন্তিতমুখে আফিসে বসে আছেন। বেলা তখন প্রায় এগারোটা। এই সময় ‘টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ’ কোম্পানির প্রতিনিধির কার্ড পেলেন তিনি।
কার্ডখানা হাতে পেয়েই তিনি নিয়ে আসতে বললেন। আগন্তুককে। একটু পরেই যে ইংরেজ যুবকটি সেই ঘরে এসে ঢুকলো, তাকে আপনারা এর আগে দু’বার দেখেছেন। একবার মেয়রের ঘরে, আর একবার মঁসিয়ে-দ্য-বোভাইলের আফিসে।
যুবকটি এসেই সসম্ভ্রমে অভিবাদন জানালো মাসিয়ে মোরেলকে।
মঁসিয়ে মোরেল বললেন–বসুন।
যুবকটি বসলে মঁসিয়ে মোরেল আবার বললেন–আপনিই এসেছেন ‘টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ কোম্পানির তরফ থেকে?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
–আমাদের যাবতীয় দেনার দলিল আপনারা কিনে নিয়েছেন?
–সেই রকমই আমি শুনেছি।
যুবকের এই কথায় মঁসিয়ে মোরেল ম্লান হেসে বললেন– কিন্তু আমাদের কোম্পানির দেনাগুলো কিনে নেবার কারণটা দয়া করে জানাবেন কি?
–তা আমি ঠিক বলতে পারি না। একথা একমাত্র কর্তৃপক্ষই বলতে পারেন। আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আপনার সঙ্গে দেখা করে কবে টাকাগুলো দিতে পারবেন, সেই তারিখটা জেনে নিতে। টাকাগুলো কি আজই দিতে পারবেন? দলিলপত্র আমার সঙ্গেই আছে।
মঁসিয়ে মোরেল ম্লান হেসে বললেন–ধন্যবাদ! কিন্তু আজ আমি টাকা দিতে পারবো না।
যুবকটি আশ্চর্য হয়ে বললো–বলেন কি মঁসিয়ে মোরেল! মোরেল কোম্পানির মত নামকরা প্রতিষ্ঠান দেনার টাকা দিতে দেরি করবে–এ যে বিশ্বাসেরও অযোগ্য!
যুবকের এই কথায় মঁসিয়ে মোরেল হাসবার চেষ্টা করে বললেন–বিশ্বাসের অযোগ্য হলেও এ কথা সত্যি। দেনার টাকা শোধ করবার ক্ষমতা আমার নেই। আমার এখন একমাত্র ভরসা–ফারাওঁ জাহাজ। আগস্টের শেষের দিকে জাহাজখানা ফিরে আসবার কথা আছে। জাহাজখানা যদি নির্বিঘ্নে ফিরে আসতে পারে, তাহলেই আমি দেনা শোধ করতে পারবো, নইলে ‘মোরেল অ্যান্ড সনে’র নাম জাহাজী প্রতিষ্ঠানসমূহের রেকর্ড থেকে চিরদিনের মত লুপ্ত হয়ে যাবে। যুবকটি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললো–বেশ, আমি আপনাকে তিন মাসের সময় দিচ্ছি। আগামী সেপ্টেম্বর মাসের ৫ই তারিখে বেলা ঠিক এগারোটার সময় আমি আসবো আবার। ঐ দিন যেন আমাকে ফিরে যেতে না হয়, দয়া করে সেদিকে একটু দৃষ্টি রাখবেন।
পাওনাদারের কাছ থেকে তিন মাসের সময় পেয়ে বিস্মিত হয়ে গেলেন মঁসিয়ে মোরেল।
তিনি বললেন–কিন্তু এই সময় দেওয়াতে আপনাকে কৈফিয়ত দিতে হবে নিশ্চয়ই?
যুবকটি হেসে বললো–তা একটু হবে বৈ কি! কিন্তু আপনার মত একজন সম্ভান্ত ও সৎ ব্যবসায়ীকে বিব্রত করতে আমি চাই না। আপনার সম্বন্ধে আমি যথেষ্ট খবরাখবর নিয়েছি। আপনি বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, কিন্তু জেনে রাখুন যে আপনার পাওনাদাররা পর্যন্ত আপনার জন্য দুঃখিত। আচ্ছা, আজ আমি উঠি। সেপ্টেম্বর মাসের ৫ই তারিখে ঠিক এই সময় আমি আবার আসবো।
যুবকটি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই মঁসিয়ে মোরেল অনুচ্চকণ্ঠে বললেন–নিশ্চয়ই ব্যবস্থা করবো মহান যুবক। যদি না পারি তাহলে আমাকে আর জীবিত দেখবেন না আপনি।
.
মঁসিয়ে মোরেলের ঘর থেকে বের হতেই যুবকটি দেখতে পেলো যে একটি তরুণী চুপ করে সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
যুবকটি তার পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই সে বলে উঠলো-বাবার সঙ্গে আপনার কথাগুলো আমি সব শুনেছি। আপনি আমার এবং আমার মায়ের তরফ থেকে ধন্যবাদ গ্রহণ করুন।
যুবকটি থমকে দাঁড়িয়ে গেল মেয়েটির সামনে। তার মুখ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে গেল–জুলি! পরক্ষণেই তাড়াতাড়ি আত্মসংবরণ করে নিয়ে সে আবার বললো–আপনিই কি মাদমোয়াসেল জুলি?
–হ্যাঁ, আমারই নাম জুলি। আপনি আমার নাম জানেন দেখছি!
মেয়েটির কথার সোজা উত্তর না দিয়ে যুবকটি বললো– একদিন ‘সিন্দবাদ নাবিক’ এই নাম সই-করা একখানা চিঠি আপনি পাবেন। ঐ চিঠির নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন আপনি। মনে রাখবেন, আপনার বাবার তাতে উপকার হবে। বলুন করবেন?
–করবো।
–প্রতিজ্ঞা করছেন?
–করছি।
–বেশ, আমি তাহলে যাচ্ছি। কথাটা দয়া করে গোপন রাখবেন আশা করি।
এই বলেই যুবকটি সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।
.
১৮.
৫ই সেপ্টেম্বর।
সেই যুবকটি বিদায় নিয়ে যাবার পর ঠিক তিন মাস অতীত হয়েছে আজ। এগারোটার সময় আসবার কথা আছে তার।
মঁসিয়ে মোরেলের মনের অবস্থা আজ খুবই খারাপ। সকালে। ঘুম থেকে উঠে যথারীতি সবার সঙ্গে বসে প্রাতরাশ শেষ করেছেন তিনি। তারপর ধীরে ধীরে উঠে গেছেন শোবার ঘরের দিকে। শোবার ঘরে গিয়ে একটা আলমারি খুলতে গিয়ে দেখতে পেলেন আলমারিটা চাবি বন্ধ। তিনি জুলিকে ডাকেন।
জুলি এলে গম্ভীরভাবে তিনি বললেন–আলমারির চাবিটা দাও তো মা!
–কেন বাবা?
–দরকার আছে।
–কি দরকার আমাকে বলো না!
–তর্ক করো না জুলি। যা বলছি তাই কর।
বাবার কাছ থেকে এরকম ব্যবহার এর আগে কখন পায়নি জুলি। তার চোখ অশ্রুপূর্ণ হয়ে এলো। চাবিটা বাবার হাতে দিল সে।
চাবিটা হাতে পেয়ে মঁসিয়ে মোরেল বললেন–তুমি এখন তোমার মায়ের কাছে যাও। আমি না ডাকলে এ ঘরে যেন কেউ না আসে।
–আমি তোমার কাছে থাকতে চাই বাবা। আজ আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না! না–না–কিছুতেই যাব না। মঁসিয়ে মোরেল স্নেহপূর্ণ স্বরে বললেন–ছেলেমানুষী করো না মা, যাও। তুমি তো আমার কথার অবাধ্য হওনি কোনদিন!
–আগে হইনি, কিন্তু আজ হবো। আমি বুঝতে পারছি, তুমি আজ একটা সাংঘাতিক কিছু করবার মতলব করছো! এমন সময় সৈনিকের বেশধারী একটি যুবক এসে ঢুকে পড়লো সেই ঘরে। মঁসিয়ে মোরেল তাকে দেখেই আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন
–ম্যাক্সিমিলান!
জুলি বললো–দাদা! দাদা এসে গেছে! তাহলে আর আমার কোন ভয় নেই। তুমি বাবার কাছে বসো দাদা। এখান থেকে এক মিনিটের জন্যও বাইরে যেয়ো না, বুঝলে!
–কি হয়েছে জুলি? ম্যাক্সিমিলান জিজ্ঞাসা করলো।
–তা ঠিক জানি না দাদা, কিন্তু আজ বাবাকে একলা ছেড়ে যেতে আমার ভয় করছে।
এই বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।
জুলি চলে যেতেই ম্যাক্সিমিলান জিজ্ঞাসা করলো–কি হয়েছে বাবা?
মঁসিয়ে মোরেল তার প্রশ্নের সোজা উত্তর না দিয়ে বললেন– হঠাৎ চলে এলে যে? ছুটি পেয়েছে নাকি?
–না, ছুটি নিয়ে এসেছি।
–ছুটি নিয়ে এসেছে! কেন বলো তো?
–তা ঠিক বলতে পারি না। মায়ের কাছ থেকে টেলিগ্রাম পেয়ে এসেছি আমি।
কি হয়েছে বাবা?
মঁসিয়ে মোরেল গম্ভীর স্বরে বললেন–বসো, বলছি।
ম্যাক্সিমিলান বসলে মঁসিয়ে মোরেল বললেন–ফারাওঁ ডুবে গেছে শুনেছো?
–ফারাওঁ ডুবে গেছে!
–হ্যাঁ বাবা, আজ আমরা সর্বস্বান্ত! মোরেল অ্যান্ড সন আজ তাদের দেনার টাকা দিতে অক্ষম।
এই কথা বলবার সময় মঁসিয়ে মোরেলের চোখ দুটি জলে ভরে এলো।
ম্যাক্সিমিলান বললো–আমাদের কত টাকা দেনা বাবা?
–পাঁচ লাখ ফ্রাঁ।
–কত আছে আমাদের?
–সতের হাজারের বেশি নয়।
–মাত্র?
–হ্যাঁ বাবা, মাত্র সতের হাজার।
–আর কোথাও কিছু পাওনা নেই?
–না। আর থাকলেও তা পাওয়া যাবে না।
–আমাদের তো বহুদিনের ব্যবসা। এমন কোন শুভানুধ্যায়ীও কি নেই আমাদের, যাঁর কাছ থেকে ধার পাওয়া যায়?
ম্যাক্সিমিলানের এই কথায় ম্লান হেসে মঁসিয়ে মোরেল বললেন–ব্যবসার জগতে শুভানুধ্যায়ী বলে কোন কথা নেই। এখানে সবাই চায় লাভ–মুনাফা।
এই সময় আফিসের তরুণ ম্যানেজার এমানুয়েল ছুটতে ছুটতে সেই ঘরে এসে বললো–চৰ্বিশ হাজার ফ্রাঁর একখানা ড্রাফট এসেছে এইমাত্র।
মঁসিয়ে মোরেল আশ্চর্য হয়ে বললেন কি বললে! চব্বিশ হাজার ফাঁর ড্রাফট! আচ্ছা, তুমি যাও।
এমানুয়েল চলে যেতেই ম্যাক্সিমিলান জিজ্ঞাসা করলো– এমানুয়েলের সঙ্গে জুলির বিয়ের কি হলো বাবা?
–হবে না।
–হবে না!
–না। একজন দেউলের মেয়েকে কে বিয়ে করবে?
–দেউলের মেয়ে?
–হ্যাঁ ম্যাক্সিমিলান, দেউলের মেয়ে। তোমার বাবা আজ দেউল, ফাঁকিবাজ, পাওনাদারদের দেনা মেটাতে অক্ষম। এই পর্যন্ত বলে একটু চুপ করে থেকে তিনি আবার বললেন
–এ অবস্থায় আমার কি কর্তব্য বলতে পারো?
ম্যাক্সিমিলানের দুই চোখ অশ্রুপূর্ণ হয়ে এলো। কোন কথাই তার মুখ দিয়ে বেরুলো না।
এই সময় ঘড়িতে দশটা বাজার শব্দ হলো।
মঁসিয়ে মোরেল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন–আর এক ঘণ্টা পরে টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ কোম্পানির প্রতিনিধি আসবে আমার কাছে! ওরা আমার কাছে পাঁচ লাখ ফ্রাঁ পায়। যে প্রতিনিধি আসবে, তার মত ভদ্র যুবক আমি খুব কমই দেখেছি। আজ থেকে ঠিক তিন মাস আগে সে আমার কাছে এসেছিল। আমি তখন বলেছিলাম যে ফারাওঁ’ ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি টাকা দিতে অক্ষম। এই কথা শুনে যুবক নিজের দায়িত্বে আমাকে তিন মাসের সময় দিয়ে গিয়েছিল। আজ বেলা এগারোটায় সেই তিন মাস উত্তীর্ণ হয়ে যাবে। ঠিক এগারোটায় সে আসবে টাকা নিতে।
–তাকে কি বলা হবে বাবা?
–কিছুই বলা হবে না। রক্ত দিয়ে অক্ষমতার অসম্মানকে ধুয়ে দেব। আমি আত্মহত্যা করবো।
–আত্মহত্যা করবে?
–হ্যাঁ ম্যাক্সিমিলান। আত্মহত্যা ছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই। জোচ্চোর নাম নিয়ে বেঁচে থাকতে আমি চাই না। তুমি সৈনিক, আশা করি আমার মনের অবস্থা তুমি বুঝতে পারছে।
মঁসিয়ে মোরেলের এই কথায় ম্যাক্সিমিলান একেবারে যেন পাথর হয়ে গেল। তার মুখ থেকে কোন কথাই বের হলো না। মঁসিয়ে মোরেল হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে চললেন আলমারির দিকে।
আলমারি খুলে একটা পিস্তল বের করে সেটাকে খুলে পরীক্ষা করলেন। হয়তো পিস্তলে গুলি ভরা আছে কিনা দেখে নিলেন। তারপর আবার সেটাকে বন্ধ করে পকেটে ফেলে যেমন ধীরে ধীরে গিয়েছিলেন ঠিক সেই রকম ধীরে ধীরেই ফিরে এসে চেয়ারে বসলেন।
তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন–এইবার আমাকে আফিস ঘরে যেতে হবে। অনেক কাজ শেষ করে যেতে হবে মরবার আগে।
–আমি কি তোমার সঙ্গে আসতে পারি বাবা?
–ইচ্ছা করলে আসতে পার। আমি জানি তুমি আমাকে বাধা দেবে না।
এই বলেই মঁসিয়ে মোরেল দরজার দিকে চলতে লাগলেন। ম্যাক্সিমিলানও চলতে লাগলো তার সঙ্গে সঙ্গে।
***
ম্যাক্সিমিলানকে বাবার কাছে রেখে জুলি সেই ঘর থেকে বের হয়ে সিঁড়ির সামনে আসতেই বাড়ির একটা চাকর একখানা খামে ভর্তি চিঠি তার হাতে দিয়ে বললো–আপনার চিঠি।
–আমার চিঠি! কে দিয়েছে?
–তা জানি না, একজন লোক এইমাত্র চিঠিখানা আমার হাতে দিয়ে বললো–এক্ষুণি চিঠিখানা মাদমোয়াসেল জুলির হাতে দিয়ে এসো।
জুলি খামখানা ছিঁড়ে চিঠি বের করে পড়তে লাগলো। চিঠিতে লেখা ছিল—
“এই চিঠি পাবার সঙ্গে সঙ্গে আপনি এলিজ-দ্য-মিলানে চলে যান। ওখানে ১৫নং বাড়ির চারতলার দক্ষিণ দিকের ফ্ল্যাটে যাবেন আপনি। দরজার সামনে একজন দরোয়ানকে দেখতে পাবেন। তার কাছ থেকে চাবি নিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকবেন। ঘরের এক কোণে একখানি রুমালে বাঁধা কিছু জিনিস দেখতে পাবেন। রুমালখানা নিয়ে এসে আপনার বাবার হাতে দেবেন। আপনি একা যাবেন। আপনার সঙ্গে অন্য কোন লোক থাকলে দারোয়ান আপনাকে চাবি দেবে । স্মরণ রাখবেন, রুমালখানা বেলা এগারোটার আগেই আপনার বাবার হাতে আসা দরকার। আপনি আমার কথা রাখবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। প্রতিজ্ঞাটা আর একবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। ইতি–
সিন্দবাদ নাবিক।”
চিঠিখানা পড়ে জুলি কি করবে ঠিক করে উঠতে পারলো না প্রথমটায়। একবার তার মনে হলো–হয়তো কোন দুষ্ট লোক তাকে বিপদে ফেলবার জন্য এই রকম ফাঁদ পেতেছে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো সেদিনের কথা। সেই যুবকটির কাছে সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, ‘সিন্দবাদ নাবিক’ সই করা চিঠির নির্দেশমত কাজ করবে সে।
এই সব কথা যখন সে চিন্তা করছে এই সময় এমানুয়েলকে দেখতে পেলো সে। এমানুয়েল তার বাবার ঘরের দিকে ছুটছিল। তাকে সিঁড়ির কোণে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এমানুয়েল বললো–তুমি একটু উঁড়াও লক্ষ্মীটি, আমি এক্ষুণি আসছি। এই বলে সে মঁসিয়ে মোরেলের ঘরের দিকে চলে গেল।
.
কিছুক্ষণ পরেই মঁসিয়ে মোরেলের ঘর থেকে ফিরে এলো এমানুয়েল। জুলির হাতের চিঠিখানা দেখে সে বললো–কার চিঠি ওখানা?
জুলি চিঠিখানা এমানুয়েলের হাতে দিয়ে বললো–পড়ে দেখ।
চিঠিখানা পড়ে এমানুয়েল বললো–বেশ তো! চলো না, আমিও তোমার সঙ্গে যাই।
জুলি বললো–কিন্তু তুমি সঙ্গে থাকলে দরোয়ান চাবি দেবে না, সে কথা পড়েছো তো?
–তাতে কি হয়েছে? তুমি একাই যেও। আমি তোমার জন্যে রাস্তায় অপেক্ষা করবো। যদি তোমার দেরি দেখি তখন আমি যাব।
ব্যবস্থাটা জুলির ভালই মনে হলো। ওরা তখন আর দেরি না করে ছুটলো এলিজ-দ্য-মিলানের দিকে।
***
এগারোটা বাজতে পাঁচ। মঁসিয়ে মোরেল আর ম্যাক্সিমিলান মুখোমুখি অবস্থায় টেবিলের দুই দিকে বসে।
একজন আরদালী এসে খবর দিল–টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ কোম্পানি থেকে একজন লোক এসেছে হুজুর।
মঁসিয়ে মোরেল বললেন–আচ্ছা তুমি যাও | দশ মিনিট পরে পাঠিয়ে দিও তাঁকে।
আবদালী চলে যেতেই পকেট থেকে পিস্তলটা বের করলেন মাসিয়ে মোরেল।
ম্যাক্সিমিলানের দিকে তাকিয়ে বললেন–তোমার মা আর জুলিকে তুমি…
…বাবা! বাবা!! বাবা!!!
হঠাৎ ঝড়ের বেগে ছুটতে ছুটতে জুলি এসে ঢুকলো সেই ঘরে।
মঁসিয়ে মোরেলের হাতে তখন গুলি-ভরা পিস্তল।
জুলি চিৎকার করে বলে উঠলো-বাবা! আমরা রক্ষা পেয়ে গেছি! আমাদের কোম্পানির আর কোন দেনা নেই।
–আমরা রক্ষা পেয়ে গেছি! কোম্পানি রক্ষা পেয়ে গেছে! কি বলছো জুলি!
–ঠিকই বলছি বাবা। এই দ্যাখো!
এই বলে সে রুমালে বাঁধা একটা ছোট পোঁটলা মঁসিয়ে মোরেলের হাতে দিল।
মঁসিয়ে মোরেল রুমালখানা খুলতেই দেখলেন যে, তার মধ্যে একখানা ভাজ-করা কাগজ।
কাগজখানার ভাজ খুলতেই আশ্চর্য হয়ে গেলেন তিনি। টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ কোম্পানি তাদের সম্পূর্ণ টাকা বুঝে পেয়ে রসিদ লিখে দিয়েছে। কাগজখানা সেই রসিদ।
রুমালের আর এক কোণে কি একটা জিনিস বাঁধা ছিল। উঁসিয়ে মোরেল কম্পিতহস্তে সে দিকটা খুলতেই দেখতে পেলেন, তার মধ্যে রয়েছে একখানা মহামূল্য হীরে আর একখানা ছোট কাগজ। কাগজখানায় লেখা—
“জুলির বিয়েতে যৌতুক।”
কোথা দিয়ে কি হয়ে গেল, কিছুই বুঝতে পারলেন না মঁসিয়ে মোরেল। কেবল রুমালখানা দেখে তার যেন মনে পড়তে লাগল যে, ওখানা একদিন তাঁরই ছিল।
কিছুই বুঝতে না পেরে জুলির দিকে তাকিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন–একি ব্যাপার জুলি? এ তুমি কোথায় পেলে?
জুলি তখন সিন্দবাদ নাবিকের লেখা সেই চিঠিখানা বাবার হাতে দিয়ে বললো–এই চিঠির নির্দিষ্ট স্থানে।
চিঠিখানা পড়ে মঁসিয়ে মোরেল বললেন–তুমি কি একা গিয়েছিলে সেখানে?
–না। এমানুয়েল আমার সঙ্গে ছিল। সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল।
ঠিক সেই সময় আফিসের হেড-ক্লার্ক হঠাৎ ছুটতে ছুটতে এসে ঢুকে পড়লো সেই ঘরে।
সে এসেই বললো–ফারাওঁ! ফারাওঁ ফিরে আসছে মঁসিয়ে!
–কি বললে! তুমি কি ক্ষেপে গেলে নাকি?
–না মঁসিয়ে। পোর্ট অফিস থেকে খবর পেলাম, ফারাওঁ ফিরে আসছে। এই দেখুন পোর্ট অফিসের চিঠি।
“একি আশ্চর্য কাণ্ড! যে জাহাজ ডুবে গেছে, যার নাবিকদের উদ্ধার করে এনেছে অন্য এক জাহাজ, সেখানা কি করে ফিরে আসছে আবার!”
মঁসিয়ে মোরেলের বিশ্বাস হয় না এই অসম্ভব কথা। কিন্তু বিশ্বাস না হলেও তিনি চললেন বন্দরের দিকে। তার সঙ্গে চললো ম্যাক্সিমিলান, জুলি, মাদাম মোরেল আর এমানুয়েল। মোরেল কোম্পানির আফিসের কর্মচারীরাও চললেন এই অভাবনীয় খবর শুনে।
বন্দরে ঢুকতেই ওঁরা দেখলেন যে ইতিমধ্যেই বন্দর লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে। ডুবে-যাওয়া জাহাজ আবার ফিরে আসছে–এই অসম্ভব কথা শুনে মার্সেঈ-এর আবালবৃদ্ধবনিতা ভেঙে পড়েছে বন্দরে।
মঁসিয়ে মোরেল সপরিবারে বন্দরের ধারে এসে দাঁড়াতেই দেখা গেল একখানা জাহাজ বন্দরে ঢুকছে। জাহাজের মাথায় বড় বড় অক্ষরে লেখা–”ফা রা ওঁ”!
সবাই উল্লাসে চিৎকার করে উঠলো–ফারাওঁ! ফারাও! ফারাওঁ ফিরে আসছে!
মঁসিয়ে মোরেল যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারলেন না। এ কি অসম্ভব কাণ্ড!
জাহাজখানি ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো জেটির দিকে।
কাপ্তেন দাঁড়িয়ে আছে ডেকের উপরে।
হঠাৎ ভিড়ের ভিতর থেকে কে যেন চিৎকার করে উঠলো–”জ্যাকোপো! জ্যাকোপো! আমার আন্তরিক ধন্যবাদ নাও বন্ধু।”
কাপ্তেন হাসিমুখে হাত উঠিয়ে অভিনন্দন জানালো সেই অদৃশ্য বক্তার উদ্দেশে। কিন্তু কে সেই বক্তা তা কেউ জানতে পারলো না।
বক্তা তখন লোকজনের ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিল মঁসিয়ে মোরেলের মুখের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে ধীরে ধীরে বললো–বিদায় মঁসিয়ে মোরেল! ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, আপনি সুখী হোন। এই বলে একটু থেমে সে মনে মনে আবার বললো–সজ্জনদের প্রতি আমার কর্তব্য এখানেই শেষ! এর পর থেকেই আরম্ভ হবে দুর্জনের বিরুদ্ধে আমার অভিযান। ফার্নান্দ! ড্যাংলার! ভিলেফোর্ট! তোমাদের দর্প চূর্ণ করতে আমি আমার সর্বশক্তি নিয়োগ করবো। তোমাদের ধ্বংসই আজ থেকে আমার সংকল্প।
.
১৯.
মার্সেঈ-এর সেই ঘটনার কয়েক বছর পরের কথা। প্যারিস শহরে তখন কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টো নামে একজন লোক রীতিমত আঁকিয়ে বসেছেন। তার চাল-চলন আর রাজা বাদশার মত খরচের বহর দেখে সারা প্যারিস বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেছে।
প্যারিসের অভিজাত সমাজের প্রত্যেকের মুখেই তখন কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টোর নাম। অভিজাত মহলের প্রত্যেকটি প্রীতিভোজেই হয় কাউন্টের নিমন্ত্রণ।
সেদিন মারকাফ প্রাসাদে এমনি এক প্রীতিভোজের ব্যবস্থা করেছিলেন ভাইকাউন্ট আলবার্ট-দ্য-মারকার্ফ। বলা বাহুল্য কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টোও নিমজ্জিত হয়েছিলেন সেই প্রীতিভোজে।
কাউন্ট আসতেই আলবার্ট তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে তাকে স্বাগত জানালেন।
কাউন্ট বললেন–দেরি করে আসার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন ভাইকাউন্ট। পনের শ’মাইল দূর থেকে আসতে হয়েছে বলেই ঠিক সময়ে পৌঁছোতে পারিনি আমি।
আলবার্ট আশ্চর্য হয়ে বললেন–দেরি! কৈ, দেরি তো হয়নি! সাড়ে দশটায় আসবার কথা ছিল আপনার, এখন তো দশটা একত্রিশও হয়নি।
কাউন্ট হেসে বললেন–কয়েক সেকেন্ড দেরিকেও আমি দেরি বলেই মনে করি।
আলবার্ট তখন কাউন্টকে তার বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে পরিচিত করে দিয়ে বললেন–তাহলে আর বিলম্ব করে লাভ কি? আসুন, খেতে বসা যাক।
ভোজ টেবিল।
নানারকম রসনা-তৃপ্তিকর খাদ্য আর ফরাসী দেশের বিখ্যাত মদ পরিবেশন করা হয়েছিল নিমন্ত্রিতদের।
খেতে খেতে গল্প চলতে লাগলো। কথায় কথায় কাউন্ট বললেন–আপনার বিয়ের নিমন্ত্রণে কবে আসছি বলুন! আলবার্ট হেসে বললেন–আরও কিছুদিন দেরি আছে ও ব্যাপারে, তবে আমার ভাবী বধু ইউজিনি আর তার পিতা ব্যারন ড্যাংলার-এর সঙ্গে আজই আপনার পরিচয় করিয়ে দিতে পারবো আশা করছি। তাদের আজ আসবার কথা আছে আমাদের বাড়িতে।
–ব্যারন ড্যাংলার! ব্যাঙ্কার কি তিনি?
–হ্যাঁ, তিনি এখন প্যারিসের সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যাঙ্কিং প্রতিষ্ঠানের মালিক। আপনি চেনেন নাকি তাকে?
–না, ঠিক চাক্ষুষ পরিচয় নেই, তবে তার ব্যাঙ্কের উপরেই লেটার-অব গ্যারান্টি দিয়েছে আমার রোমের ব্যাঙ্কার মেসার্স টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চা কিন্তু মঁসিয়ে ড্যাংলার ব্যারন হয়েছেন, তা আমি জানতাম না।
–না জানবারই কথা, কারণ ইনি খুব অল্পদিন হলো ব্যারন। উপাধি পেয়েছেন।
–দেশ সেবার পুরস্কার বুঝি?
–অনেকটা তাই! আমাদের সরকার যখন টাকার অভাবে দেউলে হবার মত হয়েছিল সেই সময় মঁসিয়ে ড্যাংলার ষাট লাখ ফ্ৰাঁ ধার দেন সরকারকে।
এই সময় কাউন্ট হঠাৎ অন্য কথার অবতারণা করে ব্যারন ড্যাংলারের প্রসঙ্গ চাপা দেন।
এরপর আরও নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলতে। লাগলো সেই ভোজসভায়। নিমন্ত্রিত ভদ্রমহোদয়রা সকলেই আশ্চর্য হয়ে গেলেন কাউন্টের জ্ঞানের গভীরতা দেখে। তিনি যেন জীবন্ত একখানি বিশ্বকোষ। এমন কোন বিষয় নেই যা নিয়ে তিনি আলোচনা করতে পারেন না।
গল্প-গুজবের মধ্যে ভোজপর্ব শেষ হলো। এর পর এলো বিদায় নেবার পালা। কাউন্টকে বিদায় সংবর্ধনা জানাবার জন্যে আলবার্ট যখন বাইরে বেরিয়ে এলেন, ঠিক সেই সময় একখানি সুদৃশ্য ল্যান্ডো এসে থামলো সেই বাড়ির ফটকে। কাউন্ট লক্ষ্য করলেন যে, ঐ গাড়ির ঘোড়ার মত সুন্দর ও আশ্চর্য রঙের ঘোড়া সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় না। ঘোড়াটির গায়ে জেব্রার মত ডোরা কাটা।
কাউন্ট বললেন–বাঃ! চমৎকার ঘোড়াটা তো!
আলবার্ট হেসে উত্তর দিলেন–ব্যারন ড্যাংলারের ঘোড়া। এই বলেই তিনি এগিয়ে গেলেন গাড়ির দিকে। গাড়ি থেকে নেমে এলেন ব্যারন ও ব্যারনেস ড্যাংলার, আর তাদের পিছনে মাদমোয়াসেল ইউজিনি।
আলবার্ট তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে কাউন্টের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
কাউন্ট সসম্মানে ব্যারনেস ড্যাংলারের সামনে মাথা নত করে অভিবাদন জানিয়ে বললেন–আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি ব্যারনেস!
ব্যারনেস তখন স্মিত হাস্যে করমর্দন করলেন তাঁর সঙ্গে।
এর পর ইউজিনির সঙ্গে করমর্দন করে কাউন্ট এগিয়ে গেলেন ব্যারন ড্যাংলারের কাছে। সাগ্রহে তার সঙ্গে করমর্দন করে কাউন্ট বললেন–আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুবই খুশি হলাম ব্যারন। আশা করি আমাদের এই পরিচয় শীঘ্রই আরও ঘনিষ্ঠ হবে।
ব্যারন ড্যাংলার বললেন–আপনার নাম আমি আগেই শুনেছি কাউন্ট। আজ ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পেয়ে ধন্য হলাম।
কাউন্ট বললেন–আমিও খুশি হয়েছি আপনার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হয়ে। আমার খুশি হবার আরও কারণ এই যে, আপনার ব্যাঙ্কের উপরই ‘লেটার অব গ্যারান্টি’ পাঠিয়েছেন আমার রোমের ব্যাঙ্কার মেসার্স টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ।
এরপর আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা হলো। তারপর কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টো বিদায় নিলেন।
***
পরদিন সকালে একজন সুবেশ ভদ্রলোক এসে দেখা করলেন ব্যারন ড্যাংলারের সঙ্গে। কিছুক্ষণ আলাপ-পরিচয়ের পর সেই ভদ্রলোক একেবারে কাজের কথা পেড়ে বসলেন।
তিনি বললেন–আপনার ঘোড়াটা যদি বিক্রি করেন, তাহলে আমি খুব ভাল দামে বিক্রি করিয়ে দিতে পারি।
ব্যারন মহা বিরক্ত হয়ে বললেন–আমি ঘোড়া বিক্রি করবো, একথা কে বলেছে আপনাকে?
–না, কেউ বলেনি, তবে আমি যাঁর কাছ থেকে এসেছি তিনি চান আপনার ঐ ঘোড়ার মত একটা ঘোড়া। তাতে যত দামই লাগে।
ব্যারন তখন কৌতুক করবার জন্য বললেন–ধরুন যদি পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁ দাম চাই আমি!
–আমি এখনই দিতে প্রস্তুত আছি ব্যারন। টাকা আমার সঙ্গেই আছে।
ব্যারন আশ্চর্য হয়ে গেলেন আগন্তুকের কথা শুনে। ভাবলেন–বলে কি লোকটা! পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁ দিয়ে একটা ঘোড়া কিনতে চায়! পাগল নাকি?
ব্যারনকে চুপ করে থাকতে দেখে আগন্তুক ভদ্রলোক বললেন –অত ভাবছেন কি ব্যারন? আপনি রাজী থাকলে আমি এখনই পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁ দিতে পারি আপনাকে।
এই বলে সত্যি সত্যিই ভদ্রলোক পকেট থেকে একগাদা ব্যাঙ্ক নোট বের করে টেবিলের উপর রাখলেন!
নোটগুলো দেখে লোভে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো ব্যারনের চোখ। তিনি বললেন–বেশ! আমি রাজী আছি। আপনি কি আজই নিয়ে যেতে চান ঘোড়াটাকে?
ভদ্রলোক বললেন–আজই নয়, এখনই।
ব্যারন ড্যাংলার তখন পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁর নোট গুনে নিয়ে রসিদ লিখে দিলেন ভদ্রলোককে।
একটু পরেই ব্যারনের ঘোড়াটা নিয়ে চলে গেলেন তিনি।
***
এই ঘটনার ঠিক তিন দিন পরে কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টোর গাড়িখানা এসে ব্যারন ড্যাংলারের বাড়ির দরজায় থামলো। ব্যারন আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলেন যে, কাউন্টের গাড়ি টানছে তার সেই ঘোড়া!
কাউন্ট গাড়ি থেকে নেমে সোজা ব্যারনের বসবার ঘরে এসে তার সঙ্গে দেখা করলেন। ব্যারন বললেন–আসুন কাউন্ট! আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি আমি।
কাউন্ট হেসে বললেন–হ্যাঁ, বৈষয়িক ব্যাপারগুলো সেরে ফেলবার জন্য আজ আসবো বলে খবর পাঠিয়েছিলাম। তা, কাগজ-পত্রগুলো কি এখানেই দেখাবো, আপনার ব্যাঙ্কে নিয়ে যাবো?
–ওগুলো কি আপনার সঙ্গে আছে?
–হ্যাঁ, সঙ্গে নিয়েই এসেছি আমি।
–বেশ, দিন তাহলে, এখানেই দেখে নিই।
কাউন্ট তখন ‘টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ’ কোম্পানির দেওয়া ‘লেটার অব গ্যারান্টি’খানা বের করে ব্যারন ড্যাংলারের হাতে দিলেন।
কাগজখানা পড়ে ব্যারনের ভ্রূ কুঁচকে উঠলো।
তিনি বললেন–এতে বোধ হয় একটু ভুল আছে। টাকার অঙ্ক লেখা নেই দেখছি।
কাউন্ট বললেন–ভুল আছে! কৈ দেখি!
এই বলে কাগজখানা ব্যারনের হাত থেকে নিয়ে তার উপর একবার চোখ বুলিয়ে দেখে বললেন–না, ভুল তত নেই।
–সে কি! এতে তো দেখছি লেখা আছে অপরিমিত টাকার ক্রেডিট আপনাকে দিতে। এরকম “লেটার অব গ্যারান্টি” তো এর আগে আর কখনও দেখিনি।
কাউন্ট হাসতে হাসতে বললেন–তাহলে আমি কি মনে করবো যে ‘টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ কোম্পানির এই গ্যারান্টিপত্র আপনি বিশ্বাস করছেন না, অথবা আমার প্রয়োজনীয় টাকা দেবার ক্ষমতা আপনার নেই?
কাউন্টের এই কথায় ব্যারন ড্যাংলারের মুখ লাল হয়ে উঠলো। তিনি বললেন–আমার আর্থিক ক্ষমতার কথাই যখন তুললেন, তখন আমি নিশ্চয়ই আপনার হিসাব আমার ব্যাঙ্কে খুলবো। বলুন, কত টাকা দরকার হবে আপনার? দশ লাখ ফ্রাঁ!
–দশ লাখ ফ্রাঁ। কাউন্ট হেসে বললেন–দশ লাখ ফ্রাঁ তো আমার পকেটেই থাকে সব সময়। ঐ সামান্য টাকার জন্য আপনার ব্যাঙ্কে হিসাব খুলবার দরকারই হতো না।
এই বলেই কাউন্ট পকেট থেকে একটা মরক্কো চামড়ার সুদৃশ্য নোটকেস বের করে তা থেকে প্রায় পনের লাখ ফাঁর নোট ব্যারন ড্যাংলারের টেবিলের উপরে রাখলেন।
ব্যাপার দেখে ঘাবড়ে গিয়ে ব্যারন ড্যাংলার আমতা আমতা করে বললেন–বেশ। তাহলে কত টাকা আপনার দরকার বলুন?
কাউন্ট মনে মনে হিসেব করে বললেন–তা ধরুন ষাট লাখ ফ্রাঁ তো বটেই।
ব্যারন বললেন–বেশ। ষাট লাখ ফ্রাঁই আপনি পাবেন। ব্যাঙ্কে গিয়ে লেখাপড়াটা সেরে আসবেন সময়মত।
ব্যারন ড্যাংলারের মুখের কথা শেষ হবার আগেই ব্যারনেস ড্যাংলার ঝড়ের মত বেগে সেই ঘরে ঢুকে পড়লেন।
কৈফিয়ৎ চাইবার সুরে ব্যারনের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন –আমার ঘোড়া অন্যের গাড়িতে দেখছি কেন? তুমি কি ওটা বিক্রি করেছে নাকি?
এই সময় কাউন্ট দাঁড়িয়ে উঠে ব্যারনের দিকে তাকিয়ে বললেন–আমি তাহলে আসি ব্যারন। সময়মত ব্যাঙ্কে গিয়ে দেখা করবো আপনার সঙ্গে।
এই কথা বলেই কাউন্ট বেরিয়ে গেলেন সেই ঘর থেকে।
***
ঘণ্টা দুই পরের কথা।
একজন পত্রবাহক ব্যারনেস ড্যাংলারের নামে চিঠি নিয়ে এলো। চিঠিখানি খুলে ব্যারনেস পড়লেন
মাননীয়াসু—
আপনার ঘোড়াটি আমি অজ্ঞাতসারে কিনে ফেলেছিলাম বলে দুঃখিত। পত্রবাহকের সঙ্গে ঘোড়াটি ফেরত পাঠালাম। এর দাম আপনাকে দিতে হবে না। এটা আমার উপহার বলে মনে করলে খুশি হবো। ইতি
কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টো।
চিঠিখানি পড়ে অবাক হয়ে গেলেন ব্যারনেস। পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁর দাবি এক কথায় যে লোক ছেড়ে দিতে পারে, তার টাকার পরিমাণ কত?
.
২০.
কাউন্ট অব মন্টিক্রিস্টোর কার্যধারার কিছুটা বিশ্লেষণ করা দরকার হয়ে পড়েছে। আগের পরিচ্ছেদে আপনারা জানতে পেরেছেন যে, কাউন্ট প্যারীতে এসে ভাইকাউন্ট আলবার্টের প্রীতিভোজে যোগদান করেছেন এবং ব্যারন ড্যাংলারের ব্যাঙ্কে হিসাবে খুলবার উদ্দেশ্যে অপরিমিত টাকার ‘লেটার অব গ্যারান্টি’ দাখিল করেছেন। তাছাড়া ব্যারনেস ড্যাংলারের ঘোড়াটা বহু টাকায় কিনে আবার তাঁকেই উপহার দিয়েছেন।
এ সবের উদ্দেশ্য কী?
এ উদ্দেশ্য একটা অবশ্যই আছে, আর সেটি হচ্ছে প্রতিহিংসা। কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টো ওরফে এডমন্ড দান্তে ভাল করেই তার শত্রুদের সম্বন্ধে খবরাখবর নিয়েছেন। ড্যাংলার, ফার্নান্দ ও ভিলেফোর্ট সম্বন্ধে খবরাখবর নিয়ে তিনি জানতে পেরেছেন যে, ওরা তিনজনেই এখন প্যারীর অভিজাত সমাজে বিখ্যাত তোক বলে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। জেলের ছেলে ফার্নান্দ এখন কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ আর জাহাজের কেরানী ড্যাংলার হয়েছে ব্যারন ড্যাংলার।
ফার্নান্দের সম্বন্ধে আরও যে সব খবর তিনি জানতে পেরেছেন, সেগুলি অত্যন্ত মারাত্মক! তিনি খবর পেয়েছেন যে, প্যারীতে আসবার আগে সে জেনিনায় আলী পাশার সৈন্যাধ্যক্ষ ছিল। তিনি আরও খবর পান যে, আলী পাশার মৃত্যুটাকে জেনিনার লোকেরা গুপ্তহত্যা বলে মনে করে।
আলী পাশার দুর্গ রক্ষার ভার ছিল ফার্নান্দের উপরে। পাশার স্ত্রী ও একমাত্র কন্যাও ঐ দুর্গেই ছিলেন তখন। কিন্তু আলী পাশার মৃত্যুর পর রহস্যজনকভাবে ঐ দুর্গটি শত্রুদের করায়ত্ত হয় এবং তার স্ত্রী কন্যার কোন খোঁজ পাওয়া যায় না।
এই সব খবর যোগাড় করবার পরই কাউন্ট অব্ মন্টিক্রিষ্টো প্যারিতে চলে আসেন। তাঁর মনের মধ্যে তখন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে প্রতিহিংসার আগুন। কিন্তু সে আগুন তিনি হাবভাবে বা চালচলনে একেবারেই প্রকাশ পেতে না দিয়ে স্থির মস্তিষ্কে বৈরনির্যাতনের কাজে লেগে যান। তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, মার্সেদেস তখন ঐ ফার্নান্দ ওরফে কাউন্ট-দ্য মারকার্ফ-এর স্ত্রী, আর ভাইকাউন্ট আলবার্ট তার ছেলে আলবার্টের সঙ্গে ড্যাংলারের মেয়ে ইউজিনির বিয়ের সম্বন্ধের কথাও জানতে পান তিনি। এখানে আরও একটা কথা বলে রাখা দরকার যে, কাউন্ট আলী পাশার স্ত্রী-কন্যার খোঁজে জেনিনাতেও গিয়েছিলেন। সেখান থেকে কতকগুলো গোপন খবর যোগাড় করে তিনি দস্যু-দলপতি লুইগি ভাম্পার সঙ্গে দেখা করেন। তারপর তাকে সঙ্গে করে পৃথিবীর বহু দেশ ঘুরে এসেছেন। লুইগি ভাম্পার সঙ্গে তার পরিচয় হয় ‘এমেলিয়া’ জাহাজের কাপ্তেনের মধ্যস্থতায়। লুইগি ভাম্পার সঙ্গে তিনি কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন বা কি কাজ করেছিলেন, সে সব কথা প্যারীর লোকেরা কিছুই জানতো না। তারা শুধু জানতো যে প্যারী শহরে কাউন্ট অব্ মন্টিক্রিষ্টো নামে একজন অসাধারণ লোকের আবির্ভাব হয়েছে–যে লোক ইচ্ছা করলে গোটা ফরাসী দেশটাই কিনে নিতে পারে।
প্যারীতে যে বাড়িখানা তিনি কিনেছিলেন, সেখানাকে লোকে আগে ভূতের বাড়ি বলতো। কিন্তু ঐ ভূতের বাড়িকেই তিনি যেন আলাদীনের দৈত্যের সাহায্যে রাজপ্রাসাদে পরিণত করে। ফেলেছেন।
আমরা যেদিনের কথা বলছি, ঐ বাড়িতে এক ইটালিয়ান মেজরের শুভাগমন হয়েছিল। মেজর মহাশয়ের নাম বার্তোলোমিও ক্যাভালকান্টি। ভদ্রলোক ফাদার বুসেনি নামে এক ধর্মযাজকের কাছ থেকে একখানা পরিচয়পত্র নিয়ে কাউন্টের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।
কাউন্টের সঙ্গে দেখা হতেই তিনি সাদর অভ্যর্থনা জানালেন মেজর সাহেবকে। তিনি বললেন–স্বাগতম মেজর ক্যাভালকান্টি, আমি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
–সে কি! আমি যে আজ আসবো সে খবর আপনাকে আগে জানাইনি!
–আপনি না জানালেও আমি তা জানতে পেরেছি। ফাদার বুসেনি আমাকে আপনার সম্বন্ধে সব কথাই বলেছেন। আপনি তো অস্ট্রিয়ান সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর?
–মেজর! তা হবে।
–তা ছাড়া আপনিই তো ফ্লোরেন্সের বিখ্যাত ক্যাভালকান্টি বংশের বর্তমান উত্তরাধিকারী..অর্থাৎ ক্যাভালকান্টি পরিবারের অতুল ঐশ্বর্যের মালিক, কেমন সত্যি কি না?
–এসব কথাও বুঝি ফাদার বুসেনি বলেছেন?
–তা ছাড়া আর কে বলবে? যাই হোক, আপনার কোন চিন্তা নেই। আপনার নিরুদ্দিষ্ট পুত্রের সন্ধান আমার কাছ থেকেই পাবেন, তা ছাড়া ফাদার বুসেনির নির্দেশমত পাঁচ হাজার ফ্ৰাঁও আমি আজই দিয়ে দেব আপনাকে। সে যাই হোক, আপনার হাতে ফাদার বুসেনি কোন চিঠিপত্র দিয়েছেন কি?
মেজর ক্যাভালকান্টি বললেন–হ্যাঁ, দিয়েছেন।
এই বলে পকেট থেকে একখানা খামে বন্ধ চিঠি বের করে কাউন্টের হাতে দিয়ে বললেন–এই যে!
চিঠিখানা গভীর মনোযোগ সহকারে পড়ে কাউন্ট বললেন– ফাদার বুসেনি টাকার বিষয়ে কিছু বলেছেন কি আপনাকে? কাউন্টের এই কথায় মেজর মহোদয় যেন বেশ একটু বিব্রত হয়ে পড়লেন।
তিনি বললেন–হ্যাঁ, মানে ফাদার আমাকে বলেছিলেন যে তিনি নাকি আপনার কাছে…
–কি বলেছিলেন বলুন!
–বলেছিলেন যে তিনি নাকি আপনার কাছে চল্লিশ হাজার ফ্ৰাঁ পান।
–হ্যাঁ, ঐ টাকা তিনি আপনাকে দিতে বলেছেন। আপনি একটু অপেক্ষা করুন; আমি চেক দিয়ে দিচ্ছি। আর ইতিমধ্যে আপনি ইচ্ছা করলে আপনার ছেলের সঙ্গেও দেখা করতে পারেন। সে পাশের ঘরেই অপেক্ষা করছে।
–আমার ছেলে! মানে…
–হ্যাঁ, আপনার নিরুদ্দিষ্ট ছেলে এন্ট্রি ক্যাভালকান্টি। আমি সব খবরই শুনেছি ফাদার বুসেনির কাছে। আপনি যে গোপনে অলিভা কার্সিনারী নামে এক মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন, সেই সার্টিফিকেট আর সারাজেভের মিউনিসিপ্যাল অফিসে আপনার ছেলে এন্ট্রির জন্ম রেজিস্ট্রির সার্টিফিকেটও আমার কাছে আছে, এই নিন।
এই বলে কাউন্ট পকেট থেকে একখানা লম্বা খাম বের করে মেজর ক্যাভালকান্টির হাতে দিলেন।
মেজর ক্যাভালকান্টি তখন খামখানা খুলে তার ভিতর থেকে সেই সার্টিফিকেট দু’খানা বের করে পড়ে দেখতে লাগলেন।
কাউন্ট বললেন–কেমন, ঠিক আছে তো?
-–ঠিক আছে বলেই তো মনে হচ্ছে, কিন্তু…
–আর কোন কিন্তু নয় মেজর! আপনি আপনার হারানো ছেলে আর সঙ্গে চল্লিশ হাজার ফ্রঁ আজই পাবেন। এরপর আপনি প্যারীতে আপনার সামাজিক পদগৌরব নিয়ে বাস করবেন। আপনাদের যাতে কোন রকম অসুবিধা না হয়, তার জন্য একখানা বাড়ি ভাড়া করে রেখেছি আপনার জন্য। এইবার যান, আপনার ছেলের সঙ্গে দেখা করুন গিয়ে।
–তা যাচ্ছি, কিন্তু…
–কিন্তু কি আবার?
–মানে–ঐ টাকাটা…
–ও, আচ্ছা দাঁড়ান, টাকাটা এখনই দিয়ে দিচ্ছি আপনাকে। এই বলে পকেট থেকে চেক বই বের করে ড্যাংলার কোম্পানির ব্যাঙ্কের উপরে চল্লিশ হাজার ফ্রাঁর একখানা চেক কেটে মেজর ক্যাভালকান্টির হাতে দিলেন কাউন্ট।
চেকখানা হাতে পেয়ে মেজর বললেন–আমি তাহলে…
–হ্যাঁ। ছেলের সঙ্গে দেখা করতে পারেন এবার।
মেজর ক্যাভালকান্টি পাশের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই কাউন্ট আবার তাকে ডাকলেন–হ্যাঁ শুনুন।
তাড়াতাড়ি ফিরে দাঁড়িয়ে মেজর বললেন–কি বলছেন। কাউন্ট?
–আপনি আপনার ব্যাঙ্কের হিসাব ড্যাংলার কোম্পানির ব্যাঙ্কেই খুলবেন।
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে মেজর ক্যাভালকান্টি পাশের ঘরের দিকে চলে গেলেন।
তিনি চলে যেতেই কাউন্টের ঠোঁটের কোণে যেন একটু দুষ্ট হাসি খেলে গেল বলে মনে হলো।
***
মেজর ক্যাভালকান্টি পাশের ঘরে ঢুকতেই একটি বিশ-একুশ বছরের ছেলে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠলো। মেজর ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে চললেন।
ছেলেটি বললো–আপনি?
–আমার নাম মেজর ক্যাভালকান্টি। বার্তোলোমিও ক্যাভালকান্টি।
–বাবা!
ছেলেটির মুখে ‘বাবা’ ডাক শুনবার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধ মেজর দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন–এন্ড্রি, বাপ আমার! এতদিন পরে তোমাকে তাহলে সত্যিই ফিরে পেলাম আমি!
এন্ড্রি এগিয়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো–বাবা, আজ যে আমার কী সুখের দিন, তা ভাষায় বলা সম্ভব নয়। এই পর্যন্ত বলেই বাবার কানের কাছে মুখ নিয়ে সে আবার বললো–কিন্তু কেবলকান্ত মহাশয়! আমার বাবা সাজবার জন্য তুমি কত পেয়েছো বলো দিকিনি?
পুত্রের কথায় মেজর ক্যাভালকান্টি হঠাৎ তড়িতাহতের মতো চমকে উঠে বললেন–এ তুমি কি বলছ এন্ট্রি?
–ঠিকই বলছি বাবা মশাই। আমিও তোমারই মতো এখানে আমদানি হয়েছি। মোটা টাকা পেয়েছি তোমার ছেলে সাজবার জন্য।
এই সময় কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টোকে ঘরে ঢুকতে দেখে মেজর সাহেব ফিসফিস করে বললেন–চুপ! কাউন্ট আসছে।
পিতা-পুত্রের এই মিলন দৃশ্য দেখে খুশি হয়ে কাউন্ট বললেন–তাহলে এন্ট্রি! পিতাকে ফিরে পেয়ে খুশি হয়েছে নিশ্চয়ই? এন্ড্রি বললো খুশি বলে খুশি, এরকম ব্যাপার যে ঘটতে পারে তা তো আমি ভাবতেই পারিনি!
কাউন্ট মৃদু হেসে বললেন–হয় বাপু হয়, দুনিয়ায় অনেক কিছুই হয়, যা তুমি বা আমি বুঝতেই পারি না। যাই হোক, তুমি এবার তোমার বাবাকে নিয়ে তোমাদের বাড়িতে চলে যাও। ওখানে সব ব্যবস্থাই করা আছে। তাছাড়া তোমরা যাতে ভালভাবে থাকতে পারো, তার জন্য বছরে বার লক্ষ ফ্রাঁর ব্যবস্থা করে রেখেছি আমি! ড্যাংলার কোম্পানির ব্যাঙ্কের চেক কাটলেই টাকা পাবে তোমরা।
বৃদ্ধ মেজর কিন্তু একেবারেই অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন কাউন্টের কাণ্ডকারখানা দেখে। তার মুখ দিয়ে একটি কথাও বের হলো না।
কাউন্ট তখন বৃদ্ধের পিঠে মৃদু করাঘাত করে বললেন– আমি বুঝতে পারছি মেজর, বহুদিন পরে ছেলের দেখা পেয়ে আপনি খুবই বেসামাল হয়ে পড়েছেন। তা এ রকম হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়। যাই হোক, এখন আপনারা আসুন, আমি একটু কাজে বের হব।
পিতা-পুত্র ততক্ষণ আলিঙ্গনমুক্ত হয়েছেন। ওঁরা এখন ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য পা বাড়াতেই কাউন্ট আবার বললেন–হ্যাঁ, এখনকার মত যান, তবে আমি শীগগির আপনাদের সংবর্ধনার জন্য একটা প্রীতিভোজের ব্যবস্থা করবো। প্যারীর অভিজাত সমাজের সঙ্গে আপনাদের পরিচয়ও হবে ঐ ভোজসভাতেই।
এই বলে কাউন্ট ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
কাউন্ট চলে গেলে সপুত্র ক্যাভালকান্টিও ধীরে ধীরে বিদায় হলেন।
***
কয়েক দিন পরের কথা। কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টো তার পল্লীভবনে এক বিরাট প্রীতিভোজের আয়োজন করেছেন। এই পল্লীভবনটি বহুদিন খালি অবস্থায় পড়ে ছিল, কিন্তু কাউন্ট এটাকে কিনে নিয়ে একেবারে রাজপ্রাসাদে পরিণত করে ফেলেছেন।
কাউন্টের নিমন্ত্রণে প্যারীর অভিজাত মহলের প্রায় সবাই উপস্থিত হয়েছিলেন। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে ব্যারন ও ব্যারনেস ড্যাংলার, মঁসিয়ে ও মাদাম ভিলেফোর্ট, কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ, মেজর ক্যাভালকান্টি ও এন্ট্রি ক্যাভালকান্টিও ছিলেন।
যথাসময়ে খানা-পিনা শেষ হয়ে যাবার পর ব্যারনেস ড্যাংলারের দিকে তাকিয়ে কাউন্ট বললেন–এই বাড়ির দোতলায় একখানা রহস্যময় ঘর আছে, দেখবেন?
কাউন্টের এই কথায় মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট হঠাৎ বাধা দিয়ে বলে উঠলেন–তার চেয়ে চলুন, বসে বসে গল্প করা যাক।
কাউন্ট বললেন–কিন্তু ঐ ঘরে আপনারা এমন কিছু দেখতে পাবেন যা এর আগে কখনও দেখেননি। আমি এই বাড়িখানা কিনবার পর যেদিন প্রথম ঐ ঘরে যাই, সেই দিনই কেন যেন আমার মনে হয়েছিল যে, ঐ ঘরে একটা সাংঘাতিক ব্যাপার, অর্থাৎ একটা অমানুষিক পাপকার্যের অনুষ্ঠান হয়েছিল। ঘরটাতে ঢুকলে এখনও যেন মনে হয় যে, ওখানে কোন হতভাগ্যের আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে। যাই হোক, মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট যখন যেতে চাইছেন না, তাহলে বরং…
কাউন্টের কথায় বাধা দিয়ে মাদাম ভিলেফোর্ট বললেন– আমরা দেখতে চাই সে ঘর। চলুন।
ঘরখানি ছিল দোতলায় দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। নিমন্ত্রিতদের সঙ্গে নিয়ে কাউন্ট সেই ঘরের সামনে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে দরজাটি খুলে ফেললেন। দরজা খুলবার সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনতে পাওয়া গেল। যেন একটি সদ্যোজাত শিশু কেঁদে উঠলো কোথাও।
ভিতরে ঢুকে সবাই আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলেন যে, ঘরখানা অনেকটা সুতিকাঘরের মতো সাজানো। ঘরে কোন আলো নেই, জানালা-দরজায় লাল পর্দা ঝুলছে। মেঝের উপরে একখানি ছোট খাট, খাটের পাশে একখানা ছোট টেবিল ও তোয়ালে রাখবার স্ট্যান্ড স্ট্যান্ডের উপর একখানা তোয়ালে। মাদাম ভিলেফোর্ট বললেন–কি বিশ্রী!
তার কথার জের টেনে কাউন্ট বললেন–শুধু বিশ্রী নয় মাদাম, ভয়াবহ! এই ঘরে, হ্যাঁ, ঠিক এই ঘরে আজ থেকে বিশ বৎসর আগে একটা সাংঘাতিক অপরাধ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
মাদাম ভিলেফোর্ট হেসে বললেন–সাবধান কাউন্ট, ‘প্রকিওরার দ্য রোয়া’, (রাজকীয় অভিযোক্তা) এখানে উপস্থিত আছেন, সে কথাটি ভুলে যাবেন না যেন!
কাউন্ট হেসে বললেন–না মাদাম, সে কথা আমি ভুলে যাইনি। তাছাড়া আমার মনে হয় মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট উপস্থিত থাকায় ভালই হয়েছে।
মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট বললেন–কি বলতে চাইছেন আপনি? কাউন্ট বললেন–আমি বলতে চাইছি যে, আজ থেকে বিশ বছর আগে এই ঘরে কোন মহিলা একটি সন্তান প্রসব করেন।
–আপনি কি আমাদের কোন রূপকথার গল্প শোনাতে চান নাকি কাউন্ট! বললেন মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট।
–মোটেই না। আমি বলতে চাই যে, এই ঘরে সেদিন যে ছেলেটি ভূমিষ্ঠ হয়েছিল, তার পিতা…তার দুরাচার লম্পট জন্মদাতা, নিজ হাতে সেই শিশুটিকে মায়ের কোল থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে…
এই সময় হঠাৎ ব্যারনেস ড্যাংলার অস্ফুট আর্তনাদ করে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। কাউন্ট তাড়াতাড়ি একটি স্মেলিং সল্টের শিশি এনে ব্যারনেসের নাকের কাছে ধরে মাথায় হাওয়া দিতেই তার জ্ঞান ফিরে এলো।
জ্ঞান ফিরে আসতেই তিনি বললেন–আমি আর এখানে থাকতে পারছি না। আমি বাইরে যেতে চাই।
কাউন্ট বললেন–তাহলে চলুন, এই ঘরের পেছনে যে গোপন সিঁড়ি আছে, সেই সিঁড়ি দিয়েই বাগানে যাওয়া যাবে।
এই বলেই কাউন্ট ঘরের অন্যদিকে গিয়ে একটা গুপ্ত দরজা খুলে ফেললেন।
নিমন্ত্রিতেরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলেন যে, দরজার সামনেই একটা সরু সিঁড়ি, যার অস্তিত্ব বাইরে থেকে, এমনকি ঘরের ভিতর থেকেও বুঝতে পারা যায় না।
সিঁড়িটা দেখে মেজর ক্যাভালকান্টি বললেন–এটা যেন। গোপন সিঁড়ি বলে মনে হচ্ছে!
কাউন্ট বললেন–ঠিকই বলেছেন মেজর। এ সিঁড়ির অস্তিত্ব বাইরের কোন লোক জানতো না। এর অস্তিত্ব জানতো শুধু সেই লোক যে এটাকে তৈরি করিয়েছিল।
–তার মানে? এবারের প্রশ্ন এলো মাদাম ভিলেফোর্ট-এর মুখ থেকে।
–মানে, যে ভদ্রলোক এই সিঁড়িটা তৈরি করিয়েছিলেন তিনিই ছিলেন সেই হতভাগ্য শিশুর অবৈধ পিতা। এই ঘরে থাকতেন সেই মহিলা, যিনি অবিবাহিতা অবস্থায় অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন, আর তারই চিকিৎসা ও প্রসবের জন্য ডাক্তার আর নার্স এই গোপন সিঁড়ি দিয়ে আনাগোনা করতো।
এই পর্যন্ত কথা হতেই নিচের বাগানে এসে পড়লেন সবাই।
কাউন্ট কিন্তু তখনও বলে চলেছেন। তিনি বললেন–আর এই সিঁড়ি দিয়েই সেই হতভাগ্য শিশুটিকে নিয়ে আসে তার পিতা…এই কাউন্টের কথায় বাধা দিয়ে মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট বললেন–কি সব যা তা বলছেন কাউন্ট! আপনি কি জানেন না যে, আপনার এই অভিযোগ কি রকম সাংঘাতিক!
–জানি বৈ কি মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট, কিন্তু আমি যা বলছি তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে আমার হাতে।
–প্রমাণ!
–হ্যাঁ, প্রমাণ। আমি জানি যে সেই দুরাচর লম্পট সেদিন সেই সদ্যোজাত শিশুটিকে এই সিঁড়ি দিয়ে নিয়ে এসে ঐ জায়গায় (এই বলে আঙুল দিয়ে একটা কলাগাছের ঝাড়ের দিকে দেখিয়ে)–হ্যাঁ, ঠিক ঐ জায়গায় তাকে জীবন্ত অবস্থায় কবর দিয়েছিল।
মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন মিথ্যা কথা! আপনি কি করে জানলেন এত কথা?
—উত্তেজিত হবে না মাঁসিয়ে প্রকিওরার, শুনে যান। আমার চাকররা ঐ জায়গায় গাছ লাগাবার উদ্দেশ্যে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে হঠাৎ একটি শিশুর অবিকৃত কঙ্কাল আবিষ্কার করে।
—কিন্তু তাতেই কি প্রমাণ হয় নাকি যে, শিশুটিকে জীবন্ত অবস্থায় কবর দেওয়া হয়েছিল?
কাউন্ট মৃদু হেসে বললেন—আপনি বােধ হয় উচ্চাসনে বসে প্যারিসের সামাজিক নিয়মকানুনগুলো ভুলে গেছেন। আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, এই বাগানটি গােরস্থান নয়। তা ছাড়া সদ্যোজাত মৃত শিশুকে কবর দেবার আগে তার মাথাটা কেটে ফেলবার নিয়ম আছে, কিন্তু এখানে যে কঙ্কাল পাওয়া যায়, সেটির মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।
এই কথা শুনে ব্যারনেস ড্যাংলার আর একবার আর্তনাদ করে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন।
ব্যারনেস ড্যাংলারকে এইভাবে দু-দুবার অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখে উপস্থিত সবাই এ-ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন।
কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টো যেন খুবই দুঃখিত হয়েছেন, এই রকম ভাব দেখিয়ে তাড়াতাড়ি ছুটে গেলেন ব্যারনেসের দিকে। তারপর স্মেলিং সল্ট এনে তাঁর নাকের কাছে ধরতেই তিনি ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে পেলেন।
ব্যারনেস ড্যাংলারের জ্ঞান ফিরে আসতেই কাউন্ট অত্যন্ত আহতস্বরে বললেন—আমি খুবই দুঃখিত মাদাম। এ গল্প আপনার সামনে বলা আমার মোটেই উচিত হয়নি।
এই বলেই তিনি অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে মসিয়ে ভিলেফোর্টের দিকে তাকালেন। মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট তখন কাউকে কিছু না বলে ব্যারনেস ড্যাংলারকে ধরে নিয়ে তার গাড়ির দিকে চলতে লাগলেন।
***
এই ঘটনার কয়েক দিন পরে আর্লিন্স-এর এক ছোট্ট টেলিগ্রাফ অফিসের সামনে একটি বিদেশী লোককে দেখা গেল। টেলিগ্রাফ অফিসটা ছিল একটা পাহাড়ের চূড়ার উপরে। যখনকার কথা হচ্ছে সেই সময় বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়নি। তখন সংবাদের আদান-প্রদান চলতো পতাকা ও আলোর সাহায্যে। দিনের বেলায় পতাকা আন্দোলিত করে ও রাত্রিকালে আলোকসংকেত করে টেলিগ্রাফ করা হত তখন।
যে টেলিগ্রাফ অফিসটার কথা বলা হচ্ছে, সেখানে ছিল একজন মাত্র কেরানী। কেরানীটির বাসাও ছিল ঐ আফিসের সঙ্গেই লাগানো।
বিদেশী লোকটি মিনিট খানেক দাঁড়িয়ে কি যেন চিন্তা করে নিয়ে সোজা ঢুকে পড়লেন আফিসের মধ্যে!
তাকে দেখে কেরানী জিজ্ঞাসা করলো–কি চান আপনি?
লোকটি মৃদু হেসে বললেন–চাই না বিশেষ কিছু, শুধু একটু আলাপ করতে এলাম।
–আলাপ করতে এলেন! কী ব্যাপার বলুন তো?
–বললাম তো, ব্যাপার বিশেষ কিছু নয়। আমি এসেছি আপনাকে কিছু টাকা দিতে, এই ধরুন, পাঁচ লাখ ফ্রাঁ।
–পাঁচ লাখ ফ্রাঁ। বলেন কি?
–ঠিকই বলছি। ইচ্ছা করলে এখনই নিতে পারেন ঐ টাকা। এই কথা বলেই তিনি তার হাতের অ্যাটাচি কেসটা খুলে কেরানীর সামনের টেবিলের উপর রাখলেন।
কেরানী সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলে যে অ্যাটাচি কেসটা গাদা গাদা ব্যাঙ্ক নোটে ভর্তি।
লোভে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার চোখ দুটি। সে বললো– কিন্তু আমাকে এত টাকা কেন দেবেন আপনি!
আগন্তুক হেসে বললেন–হ্যাঁ, এটা একটা প্রশ্নের মত প্রশ্ন বটে! কথাটা কি জানেন, আপনাকে একটা টেলিগ্রাম করতে হবে। সামান্য কাজ। আর এই সামান্য কাজটা করবার সঙ্গে সঙ্গেই পাঁচ লাখ ফ্রাঁ পেয়ে যাবেন আপনি।
–কি টেলিগ্রাম দেখি!
বিদেশী লোকটি তখন তার পকেট থেকে একখানা কাগজ বের করে কেরানীর হাতে দিলেন।
কাগজখানায় লেখা ছিল…
“স্পেনের নির্বাসিত রাজা ডন কালো বোর্জেস থেকে পালিয়েছেন। সংবাদ পাওয়া গেছে যে, তিনি ক্যাটালোনিয়া পার হয়ে স্পেনে ঢুকে পড়েছেন। আরও জানা গেল যে রাজা (স্পনের মাটিতে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে ওখানকার অধিবাসীরা তার পক্ষে যুদ্ধযাত্রা করেছে।”
কাগজখানা পড়ে দেখে কেরানী বললো–কী সর্বনাশ! এই টেলিগ্রাম পাঠালে যে আমার চাকরি যাবে!
–তাতে কি হয়েছে? সারা জীবন চাকরি করেও আপনি পাঁচ লাখ ফ্রাঁ রোজগার করতে পারবেন না। তাছাড়া চাকরিই বা যাবে কেন? আজ বেশ কুয়াশা আছে। আপনি বলবেন যে কুয়াশায় টেলিগ্রামের সংকেত ঠিকমত বুঝতে না পেরেই এই রকম ভুল সংবাদ পাঠানো হয়েছে।
কেরানী আমতা আমতা করে বললো–তাহলেও চাকরি থাকবে না।
–তা না থাকলেই বা! আপনি এই পাঁচ লাখ ফ্রাঁ নিয়ে আপনার বাকি জীবনটা বেশ সুখে-স্বচ্ছন্দেই কাটিয়ে দিতে পারবেন।
***
সেই দিনই সন্ধ্যায় সারা প্যারিসে রটে গেল খবরটা। প্রত্যেক লোকের মুখে শুধু ঐ কথা। খবরের কাগজের সান্ধ্য সংস্করণ বেরিয়ে গেল স্পেনের নির্বাসিত রাজা ডন কালোর প্রত্যাবর্তনের খবর বড় বড় হরফে ছেপে।
এই খবর বের হবার সঙ্গে সঙ্গেই স্পেনিস হুণ্ডীর দাম পড়ে যেতে লাগলো।
শহরময় হুড়োহুড়ি লেগে গেল ওগুলো বিক্রি করবার জন্য। সবাই বিক্রি করতে চায়, কেনবার লোক কেউ নেই।
ড্যাংলার কোম্পানির আফিসে খবরের পর খবর আসতে লাগলো। যার যত স্পেনিস হুণ্ডী ছিল, সেগুলোকে যে কোন দরে বিক্রি করে দিতে নির্দেশ আসতে লাগলো আমানতকারীদের পক্ষ থেকে।
ড্যাংলার একেবারে মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। মাত্র কয়েকদিন আগে কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টোর দেখাদেখি তিনি তার আজীবনের সঞ্চয়ও, এমনকি, ব্যাঙ্কের গচ্ছিত টাকা থেকেও বহু লক্ষ ফ্রাঁ নিয়ে প্রায় সত্তর লক্ষ স্ট্রার (স্পনিস তৃণ্ডী কিনেছিলেন। তিনি তখন বাধ্য হয়ে কম দরে ঐ তৃণ্ডীগুলো বিক্রি করে
আমানতকারীদের টাকা জমা করে দিলেন। ফলে নিজস্ব নগদ টাকা বলতে আর কিছু অবশিষ্ট রইলো না তার।
এ এদিকে যুদ্ধের খবরটা প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টো দালাল লাগিয়ে বাজার থেকে সবগুলো (স্পনিস হুণ্ডী বেনামীতে কিনে ফেললেন।
***
এর পরদিনই এক সরকারি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলো আগের দিনের খবরটাকে মিথ্যা ও ভুয়া খবর বলে ঘোষণা করে। সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হলো—”গতকল্য প্যারিসের সংবাদপত্রসমূহে স্পেনের নির্বাসিত রাজার সম্বন্ধে যে সংবাদটি প্রকাশিত হইয়াছিল, উহা একেবারেই ভিত্তিহীন। কুয়াশার জন্য কোন টেলিগ্রাফ অফিসের কেরানী একটা সাংকেতিক সংবাদ বুঝিতে ভুল করিবার জন্যই এইরূপ ভিত্তিহীন সংবাদ প্রচারিত হইয়াছিল।”
এই সরকারি প্রতিবাদ প্রকাশিত হবার ফলে (স্পনিস হুণ্ডীর দাম আবার বেড়ে যেতে লাগলো। অবস্থা এমন হয়ে উঠলো যে, আগে যে দাম ছিল তা থেকেও কিছু বেড়ে গেল স্পেনিস হুণ্ডীর দাম।
কিন্তু এই ব্যাপারে প্যারীর বিখ্যাত ব্যাঙ্কার ব্যারন ড্যাংলার একেবারেই সর্বস্বান্ত হয়ে গেলেন।