নিকষকালো আঁধার-ঘেরা রাত্রি।
দুই দিকে দুইজন বন্দুকধারী সৈনিক এডমন্ডের হাত ধরে একখানা ঘোড়ার গাড়ির ভিতর টেনে তুললো। গাড়ি চলতে আরম্ভ করলো।
এডমন্ড গাড়ির জানালার দিকে তাকালো। প্রত্যেক জানালায় লোহার গরাদে। কয়েদীবাহী গাড়ি। এই গাড়িতে উঠেও কিন্তু এডমন্ডের মনে হলো যে মাসিয়ে ভিলেফোর্ট তাকে নিশ্চয়ই ছেড়ে দেবেন। মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট দয়ালু। তিনি তো স্পষ্টই বলেছেন, আমাকে কেবল কয়েকদিনের জন্য পুলিশের হেপাজতে থাকতে হবে।
সমুদ্রের ধারে এসে গাড়িখানা থামলো।
এডমন্ড উঁকি মেরে দেখলো, সামনেই রয়েছে একদল সৈনিক। একজন সৈনিক বন্দুক কাঁধে করে গাড়ির সামনে এগিয়ে এসে বন্দীকে নামিয়ে আনতে বললো।
গাড়ি থেকে নামতে নামতে এডমন্ড অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো–এত সৈন্য কেন এখানে?
সৈন্যেরা তাকে নিয়ে একটা জেটির ধারে গিয়ে পঁড়ালো। সেখানে একখানা নৌকো বাঁধা ছিল। সেই নৌকোয় তোলা হলো এডমন্ডকে। নৌকো ছেড়ে দিল। সমুদ্রের ঠাণ্ডা হাওয়ায় এডমন্ডের তপ্ত মাথা খানিকটা ঠাণ্ডা হলো। কৌতূহলী হয়ে একজন রক্ষীকে সে জিজ্ঞাসা করলো–আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?
–একটু পরেই দেখতে পাবে।
–তবু…
–উপরওয়ালার নিষেধ, তোমার সঙ্গে আমরা কথা কইতে পারবো না।
এরপর কিছুক্ষণ আর কারো মুখে কোন কথা নেই। নৌকো এগিয়ে চলেছে ধীর গতিতে। একটা বাতিঘর দেখা গেল। সেটাকে পিছনে রেখে নৌকো চলতে লাগলো।
আবার কৌতূহল জাগলো। এডমন্ড আবার জিজ্ঞাসা করলো –এখনি যা জানতে পারব তা একটু আগে আমাকে জানালে এমন কি ক্ষতি হবে? আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?
এডমন্ডের এই প্রশ্নের উত্তরে রক্ষীদের ভিতর থেকে একজন বলে উঠলো–শুনেছি তুমি নাবিক। মার্সেঈ-এ থাকো। এখনো কি তুমি বুঝতে পারছ না, কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তোমাকে?
–না।
–সে কি! তুমি কি অন্ধ নাকি? ভালো করে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখ দেখি।
মিটমিটে তারকাকিরণে রহস্যময় নিশ্চন্দ্র আকাশ! খুব কাছেই অন্ধকারের মধ্যে সাগর-দানবের মত মাথা উঁচু করে পঁড়িয়ে একটা পর্বত-দুর্গ। স্যাতো-দ্য-ইফ। দুৰ্গটাকে এখন কারাগারে পরিবর্তিত করা হয়েছে। এডমন্ড জানতো যে ঐ কারাগারে যাদের রাখা হয়, তারা আর জীবিত অবস্থায় ফিরে আসতে পারে না। বহু হতভাগ্যের বন্দী-জীবনের অবসান ঘটেছে ঐ কুখ্যাত কারাগারে।
মনে মনে শিউরে উঠে এডমন্ড বললো–স্যাতো-দ্য-ইফ! ওখানে আমায় নিয়ে যাচ্ছো কেন? আমি তো কোন অপরাধ করিনি।
রক্ষীরা মুখ টিপে হাসলো।
–এখানে কি আমার বিচার হবে? এখানে কি কোন বিচারক আছেন?
–না। এখানে আছে শুধু কারাধ্যক্ষ, প্রহরী ও তোমার মত কয়েদীর দল–আর আছে খুব চওড়া পাথরের প্রাচীর।
–আমাকে কি এখানে বন্দী করে রাখা হবে?
–তাই তো মনে হয়।
–সে কি কথা! আমাকে যে মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট আশা দিলেন…
–কে তোমাকে কি আশা দিয়েছে তা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাবার দরকার নেই। এখন নেমে পড় দেখি। নৌকো ঘাটে এসেছে!
অন্ধকারের ভিতর থেকে কয়েকটি ছায়ামূর্তি এগিয়ে এলো নৌকোর দিকে! তাদের মধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করলো– বন্দী কোথায়?
রক্ষীরা বললো–এই যে!
–ওকে নিয়ে এসো!
যন্ত্রচালিতের মত প্রহরীবেষ্টিত হয়ে এডমন্ড চলতে লাগলো কারাগারের দিকে। কিছুক্ষণ চলবার পর সেই লোকটা বললো–দাঁড়াও!
এডমন্ড সভয়ে লক্ষ্য করলো, তার সামনেই কারাগারের বিরাট লৌহকপাট।
সেই লোকটির আদেশে লৌহকপাট খুলে গেল। এডমন্ডকে ঠেলে ভিতর ঢুকিয়ে দিতেই আবার বন্ধ হয়ে গেল সেই বিরাট কপাট। যেন একটা ভয়ংকর দানব গিলে ফেললো একটা ছোট্ট মানুষকে।
এডমন্ডের মাথাটা ঘুরে উঠলো।
তার মনে পড়লো বৃদ্ধ পিতার কথা–মার্সেদেসের কথা– বাড়ির কথা–মুক্ত আলো-হাওয়ার কথা।
দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো তার দুই গাল বেয়ে।
হঠাৎ একজন কারারক্ষী কর্কশস্বরে বলে উঠলো–এই কয়েদী! এগিয়ে আয়!
কয়েদী!
বিচার না হতেই কয়েদী হয়ে গেল সে! হায় ভগবান!
সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।
বন্দী আদেশ পালন করছে না দেখে কারারক্ষী তাকে ধাক্কা দিতে দিতে নিয়ে চললো ভিতর দিকে। কিছুক্ষণ চলবার পর একটা ঘরের সামনে এনে পঁড় করানো হলো তাকে। কারারক্ষী তখন সেই ঘরের দরজা খুলে তাকে এক ধাক্কায় সেই ঘরের ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করতে করতে বললো–এই তোর ঘর। আজ চললাম। কাল আবার দেখা হবে। দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
.
পরদিন সকালে কারারক্ষী এসে দরজা খুলে দেখে, কাল। রাত্রে এডমন্ড যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, এখনও ঠিক সেইখানেই সে দাঁড়িয়ে আছে। এক রাত্রেই তার চেহারা হয়েছে পাগলের মত, চোখ দুটি হয়েছে লাল টকটকে জবাফুলের মত।
রক্ষী তার কাঁধের উপরে একখানা হাত রেখে সহানুভূতির স্বরে বললো–রাত্রে ঘুমোওনি নাকি?
–জানি না।
–তোমার ক্ষিদে পেয়েছে?
–জানি না।
–তুমি কি চাও?
–গভর্নরের সঙ্গে দেখা করতে।
–অসম্ভব।
–কেন?
–তা নিষিদ্ধ।
–তবে কি নিষিদ্ধ নয়?
–খেতে পারো, শুতে পারো, ঘুমুতে পারো।
–আমি খেতে, শুতে, ঘুমোতে চাই না। অনাহারে মারা যেতে চাই।
–অবুঝ হয়ো না। অপেক্ষা কর। হয়তো গভর্নরের সঙ্গে একদিন তোমার দেখা হয়ে যেতে পারে।
–কতদিন পরে?
–হয়তো এক মাস, হয়তো ছয় মাস, হয়তো বা এক বৎসর।
–অতকাল অপেক্ষা করতে পারব না। আমি তার সঙ্গে এখনই দেখা করতে চাই।
–বার বার এক কথা নিয়ে অত মাথা ঘামিও না। তাহলে হয়তো পাগল হয়ে যাবে।
–পাগল হয়ে যাবো?
–হ্যাঁ। এখানে ওরকম ব্যাপার এর আগেও হয়েছে। তুমি এখন যেখানে আছ, এই ঘরেই একটা লোক পাগল হয়ে গিয়েছিলো।
–পাগল হয়ে গিয়েছিলো! বলছো কি?
–ঠিকই বলছি। পাগল হবার পর লোকটার ধারণা হয়, সে নাকি অনেক টাকার মালিক। সে বলতো তাকে ছেড়ে দিলে গভর্নরকে সে লক্ষ টাকা পুরস্কার দেবে।
–কতদিন আগে সে এখানে ছিলো?
–তা প্রায় দু’বছর হবে।
–এখন সে কোথায়?
–মাটির নিচের অন্ধ-কোঠায়।
–কী ভয়ানক! মাটির নিচের ঘরে মানুষ থাকতে পারে?
–পারে কিনা নিজেই বুঝতে পারবে।
–তার মানে?
–মানে, তোমাকেও শীগগিরিই সেখানে চালান করা হবে। এডমন্ড শিউরে উঠলো এই কথা শুনে।
***
মাটির নিচের অন্ধ-কোঠা।
আলো নেই, হাওয়া নেই, কেবল আছে অন্ধকার। এই নিরন্ধ্র অন্ধকারে আর ভয়াবহ নির্জনতাকে সঙ্গী করে দিন কাটাচ্ছে এডমন্ড।
দিনে একবার আর রাতে একবার রক্ষী তার খাবার দিয়ে যায়। এডমন্ড চেয়ে চেয়ে দেখে তার আসা-যাওয়া। মুক্ত সে। ইচ্ছা করলে বাইরের মুক্ত বাতাসের স্পর্শ সে পেতে পারে– কিন্তু এডমন্ড বন্দী, অসহায়। পৃথিবীর আলো-বাতাস থেকে জোর করে বঞ্চিত করা হয়েছে–বিনা অপরাধে।
রক্ষীটির সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করে এডমন্ড। কিন্তু লোকটা যেন বোবা।
কোন কথাই বলে না,–উত্তর দেয় না তার কোন প্রশ্নেরই।
এইভাবে কত দিন, কত মাস, কত বৎসর যে কেটে গেছে সে জানে না। কালের মাপকাঠি সে হারিয়ে ফেলেছে।
সে যখন জেলখানায় ঢুকেছিল তখন তার মুখে সবে মাত্র। দাড়ি গজাতে আরম্ভ করেছে, আর এখন তার মুখে ছয় ইঞ্চি লম্বা দাড়ি। তার চুলও বেড়ে গিয়ে পিঠের নিচে পড়েছে।
প্রথম প্রথম সে বাইরে যাবার স্বপ্ন দেখতো, কিন্তু এখন আর তার মনে আশা নেই।
মানুষের সমাজ থেকে টেনে এনে অমানুষ করে রাখা হয়েছে তাকে।
.
৭.
চুপ করে শুয়েছিল এডমন্ড। ঘুম তার চোখে ছিল না। তবুও সে চেষ্টা করলো ঘুমোতে। জেগে থাকলেই রাজ্যের চিন্তা এসে তার মনটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ভূগর্ভের কত নিচে যে সে আছে তা সে জানে না। মাটির নিচের ভয়াবহ নীরবতা প্রথম প্রথম অসহনীয় মনে হলেও ক্রমে সহ্য হয়ে আসছে। বাইরের কোন শব্দই তার কানে আসে না। সেই অখণ্ড নির্জনতায় মাঝে মাঝে নিজের কণ্ঠস্বর শুনলেও সে চমকে ওঠে। ঘরের মধ্যে চলে বেড়াবার সময় নিজের পায়ের শব্দও স্পষ্টভাবে শুনতে পায় সে।
হঠাৎ তার তন্দ্রা টুটে গেল। তার মনে হলো কোথায় যেন ঠক ঠক আওয়াজ হচ্ছে। অতি ক্ষীণ আওয়াজ। ধড়মড় করে উঠে বসলো সে। দেয়ালে কান পেতে শুনতে চেষ্টা করলো শব্দটা।
ঠুকঠুকঠুক ঠুক! কে যেন দেয়ালের গায়ে কোন শক্ত জিনিস দিয়ে আঘাত করছে। কিসের এ শব্দ? কোথা থেকে আসছে এই অদ্ভুত আওয়াজ?
এডমন্ড বুঝতে চেষ্টা করে, কিন্তু ঐ শব্দ যে কি তা সে কিছুতেই আন্দাজ করতে পারে না। খানিকক্ষণ পরে শব্দটা আবার থেমে গেল।
পরদিন আবার সেই শব্দ।
তার পরদিন, আবার তার পরদিনও! এডমন্ড লক্ষ্য করলো, রক্ষী যখন বন্দীদের খাবার নিয়ে আসে শব্দটা থেমে যায় তার কিছুক্ষণ আগেই। তারপর আবার আরম্ভ হয় সে চলে যাবার কিছুক্ষণ পরেই। এর অর্থ কি? এডমন্ড আরও লক্ষ্য করে যে, শব্দটা যেন ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে আসছে দিনের পর দিন। আশ্চর্য হয়ে সে ভাবে–এটা তাহলে ভৌতিক ব্যাপার নাকি?
সেদিনও রোজকার মত শুয়ে ছিল এডমন্ড। মাথার ভিতর তখন তার অনেক চিন্তা।
মুক্তি কি পাব না কোনদিনই? বাবা এখন কি করছেন? তিনি কি বেঁচে আছেন এখনও? মার্সেদেস কি অন্য কাউকে বিয়ে… কিন্তু একি! দেয়ালের পাথরখানা সরে আসছে না! তাই তো!
ধড়মড় করে উঠে বসে এডমন্ড! সে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করে যে, দেয়াল থেকে একখানা বড় পাথরের স্ল্যাব আগা হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে।
এডমন্ডের মনে হয় ওদিক থেকে কে যেন পাথরখানাকে ঠেলে দিচ্ছে। সে তখন লাফ দিয়ে উঠে গিয়ে পাথরখানাকে ধরে টানতে লাগলো। কিছুক্ষণের চেষ্টায় পাথরখানা সম্পূর্ণভাবে ঘরের ভিতরে এসে পড়তেই এডমন্ড অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো যে সেই পাথরের পিছনে একটা সুড়ঙ্গ-পথের মুখে এক অদ্ভুত মূর্তি।
মুর্তিটি হামাগুড়ি দিয়ে ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়ালো। এডমন্ড দেখলে যে লোকটার দাড়ি কোমরের নিচে পর্যন্ত নেমেছে, মাথায় সাদা চুলে জট পাকিয়ে গেছে। পরনে কয়েদীর পোশাক। সেই লোকটাই কথা বললো প্রথমে। হতাশ স্বরে সে বললো–হ্যায় ভগবান! আমার এতদিনের সব চেষ্টা আজ বিফল হয়ে গেল।
এডমন্ড বললো–কে আপনি? কি বিফল হয়ে গেল?
লোকটা বললো–বিফল হলো আমার দীর্ঘ চার বছরের অমানুষিক চেষ্টা। আমি চেয়েছিলাম আমার ঘর থেকে সুড়ঙ্গ-পথ তৈরি করে সমুদ্রের ধারে গিয়ে বেরুবো। কিন্তু আজ দেখছি দিক ভুল করে উল্টো পথে সুড়ঙ্গ তৈরি করেছি। আমি।
–আপনি কে দয়া করে বলবেন কি?
লোকটা হেসে বললো–তা জেনে তোমার কি সুবিধা হবে? আমিও তোমারই মত একজন বন্দী। তবে এককালে লোকে আমাকে ফারিয়া বলে ডাকতো।
–ফারিয়া! আপনিই সেই মহাজ্ঞানী অধ্যাপক ও ধর্মযাজক ফারিয়া?
–হ্যাঁ বিগত জীবনে তাই ছিলাম বটে, তবে বর্তমানে আমি একটি নম্বরে পরিণত হয়েছি। আমার নাম এখন ‘তেইশ নম্বর’। অবশ্য আরও একটি নতুন উপাধি আমি পেয়েছি, সেটি হচ্ছে ‘পাগলা’। যাই হোক আমার কথা পরে শুনলেও চলবে। এবার তোমার পরিচয়টা বল দেখি! নাম কি তোমার?
–আমার নাম এডমন্ড দান্তে! আমি ফারাওঁ জাহাজের দ্বিতীয় কর্মচারী ছিলাম।
–তোমার বয়স কত?
–জানি না। কারাগারে বন্ধ থেকে আমি বৎসর আর কালের মাপ হারিয়ে ফেলেছি। কেবল এইটুকু মনে আছে, ১৮১৫ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি তারিখে আমাকে যখন গ্রেপ্তার করা হয়, তখন আমার বয়স ছিল উনিশ বৎসর।
ফারিয়া তখন মনে মনে কিছুক্ষণ হিসাব করে বললেন– তাহলে তোমার বয়স এখন ছাব্বিশ বৎসর।
–বলেন কি! সাত বছর আমি এখানে আছি!
–হ্যাঁ তাই। যাই হোক, কি অপরাধে তুমি বন্দী হয়েছ?
–বিনা অপরাধে। শুনবেন আমার জীবনের কাহিনী?
ফারিয়া বললেন–শুনবো বৈকি, এসো তোমার বিছানায় বসে তোমার সব কথা শুনি।
***
এডমন্ডের মুখে তার বিড়ম্বিত জীবনের সব কথা শুনে ফারিয়া বললেন তোমাদের কাপ্তেন যখন মৃত্যুশয্যায় শুয়ে এ দ্বীপে যাবার জন্য তোমাকে অনুরোধ করছিলেন, তখন সেখানে আর কোন লোক ছিল না?
–না, কামরার ভিতরে আমি আর কাপ্তেন ছাড়া আর কোন লোক ছিল না।
এই কথা বলে একটু চিন্তা করে এডমন্ড আবার বললো– তবে হ্যাঁ, ড্যাংলারকে কামরার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম যেন।
–তাহলে জেনে রাখো, ঐ ড্যাংলারের চক্রান্তেই আজ তুমি এই কারাগারে।
–অসম্ভব! ড্যাংলার আমার বন্ধু।
–দুষ্ট লোকে বন্ধুত্ব মানে না। তোমার পদোন্নতি তার সহ্য হয়নি। তা ছাড়া আমার বিশ্বাস তার দলে ফার্নান্দও ছিল।
–ফার্নান্দ! সে কেন শত্রুতা করবে আমার সঙ্গে? আমি তো তার কোন অপকারই করিনি!
এডমন্ডের এই কথায় ফারিয়া হেসে বললেন–তুমি দেখছি এখনও ছেলেমানুষ। এই সহজ কথাটা কেন বুঝতে পারছ না যে মার্সেদেসকে বিয়ে করতে চেয়েছিল সে।
–এই তুচ্ছ কারণে আমার সঙ্গে শত্রুতা করেছে তারা, এই কথা আপনি বলছেন?
–বলছি বৈকি! তা ছাড়া আরও একটা কথা জেনে রাখো যে মঁসিয়ে ভিলেফোর্টও তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
–না না, তিনি অতি সজ্জন ব্যক্তি। আমার বিরুদ্ধে প্রধান প্রমাণ সেই চিঠিখানা আমার সামনেই তিনি পুড়িয়ে ফেলেছিলেন।
ফারিয়া বললেন–হ্যাঁ, তা ফেলেছিল বটে, তবে সেটা (তামাকে বাঁচাবার জন্য নয়। নিজের বাবাকে রাজরোষ থেকে রক্ষা করবার উদ্দেশ্যেই সেই চিঠিখানা সে পুড়িয়ে ফেলেছিল। তুমি হয়তো শুনলে আশ্চর্য হয়ে যাবে যে মঁসিয়ে নয়ের্তিয়ার হচ্ছেন তোমার ঐ সজ্জন ভিলেফোর্টের বাবা।
–আঁ! কি বলছেন আপনি?
–ঠিকই বলছি। তাকে আমি খুব ভাল ভাবেই চিনি। তিনি যে সম্রাট নেপোলিয়ানের দলের লোক তাও আমি জানি। মার্শাল বাট্রান্ডের সেই চিঠিখানার কথা ফাঁস হয়ে গেলে কেবল যে নয়েতিয়ারেরই বিপদ হত, তাই নয়, ভিলেফোর্টকেও হারাতে হত সরকারি চাকরির উচ্চাসন। এডমন্ড স্তম্ভিত হয়ে গেল এই কথা শুনে।
ফারিয়া তখন সস্নেহে তার মাথার উপর একখানি হাত রেখে বললেন–মানুষের হৃদয়হীনতা দেখে বিচলিত হয়ো না। আমিও তোমারই মত বিনা অপরাধে এই নরকযন্ত্রণা ভোগ করছি। একসময় লোকে আমাকে ভক্তি করতে, পণ্ডিত বলে শ্রদ্ধা করতো, কিন্তু মানুষের অমানুষিকতা আজ আমাকে ঠেলে দিয়েছে কারাগারের অন্ধকারে। পৃথিবীর আলো-হাওয়া আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে কয়েকজন স্বার্থপর জীবের –যারা মানুষ বলে নিজেদের পরিচয় দেয়, তাদের ষড়যন্ত্রে। এই পর্যন্ত বলে একটু চুপ করে থেকে ফারিয়া আবার বলতে আরম্ভ করলেন–কিন্তু তবুও আমি দুঃখ করি না। অভিযোগ জানাই না কারো কাছে। হয়তো এই শাস্তি আমার পাওনা ছিল। হয়তো এই অন্ধকার কারাকক্ষেই আমার সমাধি রচিত হবে। এই বোধ হয় ভগবানের ইচ্ছা। ভগবানের ইচ্ছাই পূর্ণ হোক।
এই বলে একটু থেমে তিনি আবার বলতে লাগলেন–আমি চেয়েছিলাম এই কারাগার থেকে পালিয়ে যেতে। দীর্ঘকাল– দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর অমানুষিক পরিশ্রম করে আমি সুড়ঙ্গ তৈরি করে চলেছিলাম। আশা করেছিলাম, এই সুড়ঙ্গ-পথের শেষে দেখতে পাবো মুক্ত সমুদ্র। কিন্তু আমার সব আশা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। তোমার এই ঘরে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই আমি বুঝতে পেরেছি যে, আমি ভুল পথে এসেছি। যাই হোক, ওসব কথা ভেবে আর লাভ কি? আমি আজ শত দুঃখ আর হতাশার মধ্যেও খুশি হয়েছি তোমাকে পেয়ে। তুমি আমার ছেলের বয়সী। আজ থেকে নিজের ছেলের মতই আমি তোমাকে দেখবো। বিদ্বান বলে আমার কিঞ্চিৎ খ্যাতি ছিল। আমি গ্রীক, ইটালিয়ান, ফরাসী, জার্মান, ইংরেজি আর (স্পনীয় ভাষা জানি। সেই সব ভাষায় তোমাকে আমি শিক্ষিত করে তুলবো।
এডমন্ড বললো–কারাগারের অন্ধকারেই যার জীবন শেষ হবে, শিক্ষিত হয়ে তার লাভ?
–তুমি দেখছি একেবারেই হতাশ হয়ে পড়েছো! হাল ছাড়তে নেই। তুমি যুবক। এখনও তোমার সামনে পড়ে আছে সুদীর্ঘ জীবন। হয়তো তুমি আবার অর্জন করবে অবাধ স্বাধীনতা; আবার দেখতে পাবে মুক্ত আকাশের নীলিমা–অনুভব করবে অনাহত বাতাসের স্নিগ্ধ স্পর্শ।
এডমন্ড নতজানু হয়ে ফারিয়ার পায়ের কাছে বসে পড়ে বললো–আজ থেকে আমি আপনার আদেশমতই চলবো! তারপর থেকেই শুরু হলো দুই বন্দীর অধ্যয়ন আর অধ্যাপনা। দেখতে দেখতে নানা ভাষায়, নানা শাস্ত্রে পণ্ডিত হয়ে উঠলো এডমন্ড–মহাজ্ঞানী অধ্যাপক ফারিয়ার অধ্যাপনার কল্যাণে।
সকাল থেকে দুপুরের খাবার আসবার আগে পর্যন্ত আর দুপুরের পর থেকে রাত্রের খাবার আসবার আগে পর্যন্ত সময়টা এডমন্ড কাটাতো ফারিয়ার কক্ষে। রক্ষীরা ওদের তৈরি সেই সুড়ঙ্গ-পথের সন্ধান জানতো না। এমন সুকৌশলে সুড়ঙ্গের মুখে পাথর চাপা দিয়ে রাখতো ওরা, যার ফলে বাইরে থেকে কারো বুঝবার সাধ্য ছিল না যে, দেয়ালের গায়ে সুড়ঙ্গ কাটা হয়েছে।
.
৮.
হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন অধ্যাপক ফারিয়া। প্রতিদিনের মতো সেদিনও দুপুরের আহার শেষ করে এডমন্ড তাঁর ঘরে এসেছিল। এই সময়টা ফারিয়া তার চৌকির উপর বসে থাকতেন রোজই, কিন্তু সেদিন তাকে শুয়ে থাকতে দেখে এডমন্ড বিস্মিত হলো।
তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো–আপনার কি কোন অসুখ করেছে?
ফারিয়া কোন উত্তর দিলেন না এডমন্ডের প্রশ্নের। এডমন্ড বুঝতে পারলো যে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
সে তখন তার শিয়রের কাছে বসে গায়ে মাথায় ধীরে ধীরে হাত বুলাতে লাগলো। মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানালো সে–ভগবান, এই মহাপ্রাণ মানুষটিকে তুমি ভাল করে দাও।
কিছুক্ষণ পরে চোখ মেলে চাইলেন ফারিয়া। তিনি উঠে বসবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। ডান হাতখানা তুলতে চেষ্টা করলেন, তাও পারলেন না।
নিজের অবস্থা বুঝতে পেরে এডমন্ডের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণকণ্ঠে বললেন–আজ থেকে আর আমি উঠে দাঁড়াতে পারবো না। পক্ষাঘাতে শরীরের ডান দিকটা অসাড় হয়ে গেছে আমার।
এই নিদারুণ সংবাদ শুনে এডমন্ডের চোখ দুটি অশ্রুসজল হয়ে উঠলো।
ফারিয়া বললেন–মনে দুঃখ করো না এডমন্ড। আমার যে এরকম হবে তা আমি আগেই জানতাম। এর আগেও আর একবার এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলাম আমি। আমি এও জানি যে, এই রোগেই আমার মৃত্যু হবে। এ রোগের তৃতীয়বার আক্রমণেই আমি মারা যাবো।
এডমন্ড বললো–অমন কথা বলবেন না গুরুদেব! আপনাকে হারাতে হবে এ কথা ভাবতেও আমার কষ্ট হচ্ছে।
–কিন্তু সত্য যা তাকে তো অস্বীকার করা যায় না এডমন্ড! আমি বেশ বুঝতে পারছি, আমার দিন ঘনিয়ে এসেছে। তাই যাবার আগে তোমাকে আমি কিছু দিয়ে যেতে চাই।
–ওসব কথা এখন থাক গুরুদেব। আপনি এখন ভয়ানক দুর্বল। এ অবস্থায় বেশি কথা বলা ঠিক নয় আপনার।
–না না এডমন্ড, আমাকে তুমি বাধা দিও না। আজ না বললে হয়তো আর কোন দিন বলাই হবে না সে কথা। এতদিন যা আমি নিজের মনের মধ্যে গোপন করে রেখেছি, সে কথা আজ আমি বলবো।
–কি কথা গুরুদেব?
–তোমাকে আমি বিপুল গুপ্তধনের সন্ধান দেব।
–গুপ্তধন!
–হ্যাঁ, গুপ্তধন। যার পরিমাণ যে কোন রাজার ঐশ্বর্যের চাইতে বেশি। ঐ অতুল ঐশ্বর্যরাশির মালিক আমিই হতাম, কিন্তু তার আগেই আমার হলো যাবজ্জীবন কারাবাসের আদেশ।
এডমন্ডের মনে হলো, রোগের আক্রমণে হয়তো ওঁর মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
ফারিয়া তার মনের ভাব অনুমান করে ম্লান হাসি হেসে বললেন–আমার কথায় সন্দেহ করো না এডমন্ডা মাথা আমার ঠিকই আছে। এখন মন দিয়ে শোনো আমার কথাগুলো।
এডমন্ড বললো–বলুন!
ফারিয়া বলতে আরম্ভ করলেন–আমি যে কাউন্ট স্পাডার সেক্রেটারি ছিলাম সে কথা তোমাকে আগেই বলেছি। এই স্পাডা বংশ একসময় ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে ধনী বলে পরিচিত ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে রোমের কুখ্যাত পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্দার আর দুরাত্মা সিজার বোর্জিয়া, কার্ডিনাল স্পাডাকে হত্যা করে তাঁর অতুল ঐশ্বর্য হস্তগত করবার জন্য গোপনে এক ষড়যন্ত্র করে। তাদের যড়যন্দ্রের কথা জানতে পেরে কার্ডিনাল স্পাডা তার যাবতীয় ধনসম্পত্তি কোন এক গোপন জায়গায় লুকিয়ে রেখে আসেন। তার ইচ্ছা ছিল যে, ঐ গুপ্তধনের সন্ধান তিনি তাঁর উত্তরাধিকারীকে জানাবেন। কিন্তু সে সুযোগ আর তিনি পান না। দুরাত্মা সিজার বোর্জিয়া তাকে রাজপ্রাসাদে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে মদের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে খাইয়ে হত্যা করে। এডমন্ড বললো–তারপর?
–তারপর বোর্জিয়া পাড়া প্রাসাদ তন্ন তন্ন করে খোঁজ করে। কিন্তু প্রাসাদে সামান্য কয়েক লক্ষ টাকা আর কিছু আসবাবপত্র ছাড়া বিশেষ কিছু পায় না সে। তারপর থেকেই স্পাডা পরিবার ‘অতুল ধনশালী” এই প্রবাদ নিয়েই ক্রমে ক্রমে দরিদ্র হয়ে পড়ে। এই পরিবারের সর্বশেষ উত্তরাধিকারীই ছিলেন কাউন্ট পাড়া। কাউট স্পাডার সম্পত্তির মধ্যে ছিল তার পৈতৃক প্রাসাদটি, কয়েকখানা প্রাচীন বই, কয়েক বান্ডিল দলিলপত্র আর রোমান ক্যাথলিক চার্চ সংক্রান্ত একখানি অতি প্রাচীন পুঁথি। ঐ পুঁথিখানিকে ভাড়া পরিবার অতি পবিত্র বলে মনে করতেন। পূর্বপুরুষদের নির্দেশ ছিল যে ঐ পবিত্র পুঁথিখানি পরিবারের কর্তা তার মৃত্যুর পুর্বে তাঁর উত্তরাধিকারীর হাতে দিয়ে যাবেন।
–আমি যাঁর সেক্রেটারি ছিলাম, তিনিই ঐ গ্রন্থখানি পেয়েছিলেন উত্তরাধিকারসূত্রেই। স্পাডা পরিবারের ঐশ্বর্যের প্রবাদ তিনিও জানতেন, তাই আমাকে তিনি আদেশ করেছিলেন প্রাসাদের প্রত্যেকটি জায়গা খুঁজে দেখতে এবং প্রত্যেকখানা দলিল পড়ে দেখতে।
মাসের পর মাস আমি স্পাডা পরিবারের পুরনো দলিলগুলো পড়ে দেখতে থাকি। কিন্তু কোথাও ধনরত্ন সম্বন্ধে কোনরকম উল্লেখ পাই না। শুনেছিলাম যে, আমার আগে স্পাডা বংশের কুড়িজন পূর্বপুরুষ আর তাদের কুড়িজন সেক্রেটারি আমারই মত পণ্ডশ্রম করে গেছেন।
এডমন্ড বললো–তারপর?
–তারপর আমার পূর্ববর্তীদের মত হতাশ হয়ে আমিও পুরনো কাগজ ঘাঁটার পণ্ডশ্রম বন্ধ করলাম। এর কিছুদিন পরেই কাউন্ট স্পডা হঠাৎ মারা গেলেন। মৃত্যুকালে তিনি আমার হাতে স্পাডা পরিবারের শেষ সম্বল সেই জীর্ণ পুঁথিখানি আর সামান্য কিছু সম্পত্তি, যা তখনও অবশিষ্ট ছিল, তুলে দিয়ে বললেন–আমার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে মহিমান্বিত স্পাডা বংশ। তাই আমি আমাদের বংশের এই শেষ সম্পত্তি আপনার হাতেই তুলে দিয়ে গেলাম। আপনাকেই আমি করে গেলাম আমার উত্তরাধিকারী। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, কাউন্ট পাড়ার কোন উত্তরাধিকারী ছিল না।
এডমন্ড বললো–তারপর?
–কাউন্টের মৃত্যুর কয়েকদিন পরেই আমি খবর পাই যে, আমাকে নাকি রাজদ্রোহের অপরাধে গ্রেপ্তার করা হবে। খবরটা পেয়ে আমার মনের অবস্থা যে খুব ভাল থাকতে পারে না, তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারো। ঐ রকম মানসিক অবস্থায় এক রাত্রে কি মনে করে আমি স্পাডা পরিবারের সেই পবিত্র পুঁথিখানি পড়তে আরম্ভ করি। পড়তে পড়তে হঠাৎ একখানা ভাজকরা কাগজ আমি দেখতে পাই তার মধ্যে। কাগজখানার ভাজ খুলে লক্ষ্য করলাম যে, তাতে কিছুই লেখা নেই। বাজে কাগজ মনে করে আমি সেখানাকে মোমবাতির শিষের উপর ধরি পুড়িয়ে ফেলবার উদ্দেশ্যে। আগুনের তাপ লাগতেই কাগজখানার উপর কতকগুলো অক্ষর ফুটে উঠে। আমি তখন তাড়াতাড়ি আগুন নিবিয়ে সেই লেখাগুলো পড়তে আরম্ভ করি। কিছুটা পড়েই আমি আশ্চর্য হয়ে যাই। ঐ কাগজখানাতেই লেখা ছিল স্পাডা বংশের সেই গুপ্তধনের সন্ধান।
এতক্ষণ একনাগাড়ে কথা বলে হাঁফিয়ে উঠলেন ফারিয়া। এডমন্ডের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন–একটু জল! এডমন্ড তাড়াতাড়ি ঘরের কোণে রাখা জলের কলসী থেকে একটি গ্লাসে জল গড়িয়ে এনে ফারিয়ার মুখের কাছে ধরলো।
ফারিয়া এক নিঃশ্বাসে গ্লাসের সবটুকু জল পান করে ধীরে ধীরে বললেন–আমার বিছানার নিচে শিয়রের দিকে দুখানা ভাজকরা কাগজ আছে। কাগজ দুখানা বের করে আনো (তা!
এডমন্ড কাগজ দুখানা বের করে আনলে তিনি আবার বললেন–ওর মধ্যে সেই পোড়া কাগজখানা আর আমার হাতে লেখা একখানা নকল দেখতে পাবে তুমি। এইবার ঐ পোড়া কাগজখানা পড়ে, তাহলেই বুঝতে পারবে আমার কথা সত্যি কিনা।
এডমন্ড তখন সেই পোড়া কাগজখানার ভাজ খুলে ফেললো।
কাগজখানার কিছুটা অংশ মাত্র পুড়ে গিয়েছিল। যে অংশটুকু আস্ত ছিল, তাতে লেখা ছিল–
“পরস্বাপহারী ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা করবার উদ্দেশ্য আমাদের বংশের পুরুষানুক্রমে সঞ্চিত দুই কোটি রোমান ক্রাউনের* চাইতেও বেশি মূল্যের ধনসম্পত্তি মন্টিক্রিস্টো দ্বীপে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
এই ধনরত্ন যাতে স্পাডা বংশের বৈধ উত্তরাধিকারী ছাড়া অন্যের হাতে না পড়ে, এই উদ্দেশ্যে তার সন্ধান আমি এই পুঁথির মধ্যে রেখে যাচ্ছি।
পশ্চিম সমুদ্রতীর ঘেঁষে যে পাহাড়টা দায়ের মতো ভঙ্গিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, সেই পাহাড়ের নিচে দেখতে পাবে একটা ছোট পাহাড়ে নদী। ঐ নদীর উৎস-বরাবর এগিয়ে যেতে হবে পাহাড়ের ভিতরে। যাবার পথে পাহাড়ের চুড়াগুলো গুনতি করে যাবে। কুড়ি নম্বর চুড়ার সামনে এসে একটু দক্ষিণ দিকে গেলেই দেখতে পাওয়া যাবে একটি গুহা। গুহার মুখটি পাথর চাপা দিয়ে বন্ধ করে রেখেছি। ঐ পাথরখানা সরিয়ে ফেলে গুহার মধ্যে ঢুকলেই পাওয়া যাবে সেই ধনরত্নের সন্ধান।”
কাগজখানা পড়া হয়ে গেলে এডমন্ড বিস্মিত হয়ে ফারিয়ার দিকে তাকালো। ফারিয়া বললেন–আজ থেকে এই কাগজ তোমার। তোমাকেই আমি দান করলাম স্পাডা বংশের ঐ বিপুল ধনরাশি।
এডমন্ডের মাথা ঘুরতে লাগলো কাগজ দু’খানা হাতে পেয়ে।
——–
* দুই কোটি রোমান ক্রাউনের দাম স্টার্লিং-এর হিসাবে তের কোটি পাউন্ডের কাছাকাছি আর আমাদের দেশের টাকার হিসাবে একশ বিরাশি কোটি টাকার সমান।
.
৯.
এরপর থেকেই ফারিয়ার যাবতীয় ভার এসে পড়লো এডমন্ডের উপরে। বৃদ্ধের ডান হাত আর ডান পা অবশ হয়ে যাওয়ায় এডমন্ডই তাকে খাইয়ে দিতো রোজ এসে।
প্রহরী খাবার রেখে চলে যেতেই এডমন্ড সেই সুড়ঙ্গ-পথ দিয়ে ফারিয়ার ঘরে ঢুকতো। তারপর তাকে খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজের ঘরে ফিরতো খাবার জন্য।
কিছুদিন এইভাবে কাটবার পর আবার সেই মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেন ফারিয়া। এবারকার আক্রমণ থেকে তিনি আর আত্মরক্ষা করতে পারলেন না। এডমন্ডের কোলে মাথা রেখে কারাগারের অন্ধকার গর্ভে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন পৃথিবীর একজন মহাজ্ঞানী মানুষ।
.
বৃদ্ধের মৃত্যুতে এডমন্ড ছেলেমানুষের মতো কাঁদতে লাগলো। দু’চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ে বুক ভেসে যেতে লাগলো তার।
এদিকে তখন প্রহরীর খাবার নিয়ে আসবার সময় হয়ে গিয়েছিল। ওখানে বসে থাকলে ধরা পড়তে হবে, আর ধরা পড়লে সুড়ঙ্গের কথা প্রকাশ হয়ে পড়বে এই ভয়ে এডমন্ড তাড়াতাড়ি বৃদ্ধের মৃতদেহের উপরে কম্বল চাপা দিয়ে সুড়ঙ্গ পথে নিজের ঘরে চলে গেল।
.
কিছুক্ষণ পরে।
এডমন্ড নিজের বিছানায় আপাদমস্তক কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে বৃদ্ধের কথাই চিন্তা করছিল, এই সময় খাবার নিয়ে প্রহরী ঘরে ঢুকলো।
এডমন্ডকে কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে থাকতে দেখে সে বললো– কি হে! ঘুমিয়ে পড়েছো নাকি?
এডমন্ড বললো–না। শরীরটা একটু খারাপ লাগছে, তাই একটু শুয়ে আছি।
–শরীর খারাপ লাগছে! তাহলে তুমিও আবার ঐ পাগলা বুড়োটার মতো কেঁসে যাবে নাকি?
–কি বললে?
–ও, জানো না বুঝি? সেই যে পাগলা বুড়োটার কথা বলেছিলাম না! সেই বুড়োটা আজ মারা গেছে।
–কবর দেওয়া হয়েছে কি?
–কবর? হেসে উঠলো প্রহরী। বললো–এখানকার কোন কয়েদী মরলে আবার কবর দেওয়া হয় নাকি?
–কি করা হয় তাহলে?
–বস্তায় বন্ধ করে সমুদ্রের জলে ফেলে দেওয়া হয়। একেবারে যাকে বলে সলিল সমাধি–হেঁ-হেঁ-হেঁ।
–কখন ফেলা হবে?
–রাত্রে।
এডমন্ড আর কোন কথা বললো না।
প্রহরী তখন তার খাবার নামিয়ে রেখে দরজা বন্ধ করে চলে গেল।
সেদিন আর খেতে ইচ্ছা হলো না এডমন্ডের। ফারিয়ার কথা মনে করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল সে,–আহা, এমন একজন জ্ঞানী মানুষকে কবর পর্যন্ত দেওয়া হবে না। বস্তায় বন্ধ করে…
হঠাৎ তার মাথায় একটা মতলব এসে যায়।
–তাই তো! ওর বদলে আমি যদি বস্তার মধ্যে ঢুকে থাকি তাহলে কেমন হয়? ওরা আমাকে মরা মনে করে সমুদ্রে ফেলে দেবে; তারপর আমি বস্তা কেটে বেরিয়ে পড়বো! ঠিক হয়েছে! এই উপায়েই আমি পালাতে চেষ্টা করবো!
উত্তেজনায় তার বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করে ওঠে। বিছানার উপরে উঠে বসে সে।
সন্ধ্যার পরে।
ফারিয়ার সেই কাগজ-দুখানাকে পকেটে নিয়ে এডমন্ড সেই সুড়ঙ্গ-পথের দিকে এগিয়ে গেল। হঠাৎ কি মনে করে একবার থমকে দাঁড়ালো সে! তারপর ধীরে ধীরে সুড়ঙ্গের মুখের পাথরখানা সরিয়ে ফেলে সে ঢুকে পড়লো সেই সুড়ঙ্গের মধ্যে।
ফারিয়ার ঘরে গিয়ে সে দেখতে পেলো যে ঘরের মধ্যে একটা বস্তা পড়ে আছে। বস্তাটার দিকে তাকাতেই তার মনটা হু হু করে কেঁদে উঠলো। কিন্তু এখন মন খারাপ করে সময় নষ্ট করা চলে না। সে বস্তাটার কাছে এগিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখলো যে, ফারিয়ার মৃতদেহ তখন বস্তার মধ্যে ঢুকিয়ে বস্তার মুখটা সেলাই করে রাখা হয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে সেলাই করবার সুচ আর রশিও ছিল ওখানে। বোধ হয় প্রহরীরা ফেলে গেছে।
এডমন্ড তখন আর এক মুহর্ত সময় নষ্ট না করে বস্তার সেলাই খুলে মৃতদেহটা টেনে বের করে ফেললো। তারপর সেই মৃতদেহকে টেনে নিয়ে চললো সুড়ঙ্গ-পথ দিয়ে। সুড়ঙ্গের সরু পথে মৃতদেহ নিয়ে চলতে খুবই কষ্ট হলো তার, কিন্তু কষ্টকে সে কষ্ট বলে মনে না করে শেষ পর্যন্ত নিজের ঘরে নিয়ে এলো। তারপর সেই মৃতদেহকে নিজের বিছানার উপর তুলে ভাল করে কম্বল চাপা দিয়ে সে আবার ফিরে চললো ফারিয়ার ঘরে। বলা বাহুল্য, যাবার সময় সুড়ঙ্গ-মুখের পাথরখানা ভাল করে টেনে বন্ধ করে দিল সে।
সেই সুড়ঙ্গের মধ্যে কতকগুলি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যোগাড় করে রেখেছিলেন ফারিয়া। ঐ সব জিনিসপত্রের মধ্যে কয়েকখানা চিনেমাটির প্লেটের ভাঙা টুকরোও ছিল। এডমন্ড ওগুলোর ভিতর থেকে ধারালো দেখে একখানা টুকরো তুলে নিয়ে পকেটে রাখলো। তারপর ঢুকে পড়লো ফারিয়ার ঘরে।
সে তখন তাড়াতাড়ি সেই বস্তার মধ্যে ঢুকে গিয়ে ভিতর থেকেই অতি কষ্টে সেলাই করে ফেললো বস্তার মুখটা।
প্রায় দুই ঘণ্টা বস্তাবন্দী হয়ে থাকবার পর দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেলো এডমন্ড। সে তখন মড়ার মত নিঃশব্দে পড়ে রইলো সেই বস্তার মধ্যে। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ যাতে কেউ শুনতে না পায় সেজন্য সে সাবধান হলো। তার বুকের মধ্যে তখন যেন হাতুড়ির ঘা পড়ছে।
একটু পরেই এডমন্ড বুঝতে পারলো যে, প্রহরীরা দড়ি দিয়ে বস্তাটাকে বেঁধে ফেলছে। সে তখন মনে মনে ভগবানের নাম স্মরণ করতে লাগলো। তার মনে হলো যে ঐ বাঁধন কাটতে না পারলে তার জীবন্ত সমাধি হবে সমুদ্রের অতল তলে।
বাঁধাহাদা শেষ হয়ে গেলে তাকে ধরে তুললো তিন-চার জনে মিলে। একজন আবার রসিকতা করে বললো–বুড়োটা কি ভারী দেখছো?
কিছুক্ষণ পরেই শীতল বাতাসের স্পর্শে শরীর জুড়িয়ে গেল এডমন্ডের। বুঝতে দেরি হলো না যে তাকে বাইরে নিয়ে আসা হয়েছে। বাইরে এসে প্রহরীরা পাহাড়ের উপর উঠতে লাগলো তাকে কাঁধে নিয়ে। অনেকটা পথ চলবার পর হঠাৎ নামিয়ে রাখা হলো তাকে। এর কিছুক্ষণ পরেই এডমন্ডের মনে হলো তার পায়ের সঙ্গে কি যেন বাঁধা হচ্ছে। আসলে সেটা ছিল একগাছা সরু লম্বা দড়ি। সেই দড়ির আর এক প্রান্তে বাঁধা ছিল একখানা ভারী পাথর। মৃতদেহ যাতে ভেসে উঠতে না পারে সেই জন্যই এই ব্যবস্থা।
যে জায়গাটায় তাকে রাখা হয়েছিল সেটা ছিল একটা পাহাড়ের চূড়া। তার ঠিক নিচেই সমুদ্র। প্রহরীরা তখন তিন চার জন ধরে তার বস্তাবন্দী দেহটাকে তুলে নিয়ে বার কয়েক দোল দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল সমুদ্রের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে আর একজন সেই দড়িতে বাঁধা পাথরখানাও ঠেলে ফেলে দিল।
ঝপাং করে একটা শব্দ তুলে এডমন্ডের বস্তাবন্দী দেহটা তলিয়ে যেতে লাগলো। পায়ের সঙ্গে দড়িতে বাঁধা পাথরের টানে নিচে নেমে যেতে লাগলো সে। জলের চাপে তার দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। কিন্তু ঐ অবস্থাতেও মনের বল হারালো না এডমন্ড। সে তাড়াতাড়ি সেই ভাঙা প্লেটের টুকরোটা দিয়ে বস্তার সেলাইটা কেটে ফেললো। তারপর প্রাণপণ শক্তিতে সে কাটতে লাগলো পায়ে বাঁধা সেই দড়িগাছা।
মুহূর্তে মুহূর্তে নিচের দিকে নেমে চলেছে সে। দম আর থাকছে না। এখনই হয়তো দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে সে। সে তখন শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দড়িগাছা কাটতে চেষ্টা করতে লাগলো। হঠাৎ দড়িগাছা কেটে গেল এই সময়ে। দড়ি কেটে যেতেই সে ভেসে উঠতে লাগলো উপরের দিকে। সে তখন বহু কষ্টে বস্তার বাঁধনগুলো কেটে ফেলে বস্তা থেকে বেরিয়ে এলো। তারপর অল্পক্ষণের মধ্যেই সে ভেসে উঠলো জলের উপর।
মুক্তি! ওঃ! কত কাল পরে বাইরের মুক্ত হাওয়া গায়ে লাগলো এডমন্ডের।
উপরের দিকে তাকিয়ে এডমন্ড দেখতে পেলো যে প্রহরীরা তখনও যায়নি ওখান থেকে। তাদের লণ্ঠনের আলো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে পাহাড়ের চূড়ার উপর।
এডমন্ড সাঁতার কেটে এগিয়ে চললো।
কিছুক্ষণ সাঁতার কাটবার পর হঠাৎ বিকট ঢং ঢং আওয়াজ শুনে চমকে উঠলো সে। জেলখানায় ‘পাগলা ঘণ্টি’ বেজে উঠেছে।
.
১০.
মুক্তির আশায় প্রাণপণে সাঁতার দিয়ে এগোচ্ছিলো এডমন্ড, কিন্তু মানুষের শরীরে আর কত সহ্য হয়! তীরের দিকে যাবার উপায় নেই। তীরে উঠলেই আবার তাকে ধরা পড়তে হবে। তার তখন একমাত্র ভরসা, কোন জাহাজ যদি তাকে দেখতে পেয়ে তুলে নেয়। কিন্তু অন্ধকার সমুদ্রে কোন জাহাজের চিহ্নও সে দেখতে পেলো না। ক্রমে পুবের দিক ফর্সা হয়ে এলো। সারারাত সাঁতার কাটার ফলে হাত-পা অবশ হয়ে আসতে লাগলো এডমন্ডের। দুর্লঙঘ্য সাগরের বুকে খালি হাতে কতক্ষণ সাঁতার কাটতে পারে মানুষ! মাথা ঘুরে উঠলো এডমন্ডের।
তারপর আর সে কিছু মনে করতে পারলো না। অজ্ঞান হয়ে ভেসে চললো সে সাগরের বুকে।
***
ভূমধ্যসাগরে সেই সময় বহু বোম্বেটে-জাহাজ চলাফেরা করতো। এই জাহাজের নাবিকদের চেহারা ভদ্রলোকের মত হলেও আসলে তাদের পেশা ছিল ডাকাতি করা।
এডমন্ডের সংজ্ঞাহীন দেহটি যখন সমুদ্রের বুকে ভাসতে ভাসতে চলেছে, সেই সময় ঐ রকম একখানি জাহাজ চলেছিল তার পাশ দিয়ে। জাহাজের একজন নাবিক হঠাৎ দেখতে পায় যে জলের উপর একটি মানুষের দেহ ভেসে যাচ্ছে। সে তক্ষুণি খবরটা জানালো জাহাজের কাপ্তেনকে।
কাপ্তেন বললো–তুলে নাও ওকে।
জাহাজে তুলবার পর এডমন্ডের চেহারা দেখে ঘাবড়ে গেল সবাই। একি সাংঘাতিক চেহারা রে বাবা! দেড় হাত লম্বা দাড়ি, মাথার চুল আড়াই হাত লম্বা, হাতের নখগুলো তিন চার ইঞ্চি করে! মানুষের এ রকম চেহারা আগে দেখেনি তারা।
কাপ্তেন বললো–এটা কোন দেশের লোক বলতে পারো?
নাবিকেরা সমস্বরে বললো–না, এ রকম মানুষ জীবনে দেখিনি আমরা।
একজন বললো–এটা কোন জন্তু নয় তো?
আর একজন বললো–দূর! জন্তু হবে কেন? দেখলে না, ঠিক মানুষের মত চেহারা!
আর একজন এই সময়ে বলে উঠলো–আরে আরে! এর গায়ে যে কয়েদীর পোশাক দেখছি। বোধ হয় জেল থেকে পালিয়েছে লোকটা।
কাপ্তেন বললো–তাই হবে। আচ্ছা দেখ তো লোকটা বেঁচে আছে কি না?
কাপ্তেনের আদেশে একজন লোক এডমন্ডের বুকের উপরের দাড়ির গোছা সরিয়ে দিয়ে তার বুকের উপরে কান রাখলো। কিছুক্ষণ কান লাগিয়ে থেকে সে বলে উঠলো–না, মরেনি! বুক ধক ধক করছে এখনও।
কাপ্তেন বললো,–আচ্ছা, এবার তাহলে ওর পেট থেকে জলগুলো বের করবার ব্যবস্থা করো।
সঙ্গে সঙ্গে তিন-চার জন লোক মিলে এডমন্ডের দেহটিকে উপুড় করে শুইয়ে তার হাত আর পা ধরে নানা-রকম প্রক্রিয়া শুরু করলো। কিছুক্ষণ ঐ ভাবে প্রক্রিয়া করবার পর এডমন্ডের পেট থেকে জল বের হয়ে গেল। কাপ্তেন তখন তাকে শুকনো পোশাক পরিয়ে গরম কাপড় দিয়ে সেঁকতে আদেশ দিলো। কিছুক্ষণ সেঁকবার পর চোখ মেলে চাইলো এডমন্ড।
সে চোখ মেলে তাকাতেই খানিকটা ব্র্যান্ডি খাইয়ে দেওয়া হলো তাকে।
ব্র্যান্ডি পেটে পড়তেই তার শরীরটা চাঙা হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে বললো–আমি কোথায়?
কাপ্তেন বললো–আমার জাহাজে।
–কোন দেশের জাহাজ এটা?
–ভয় নেই, আমরা তোমাকে ধরিয়ে দেব না! কিন্তু তুমি জেল থেকে পালালে কি করে?
–সে অনেক কথা। এখন বলতে পারবো না। একটু সুস্থ হলে সব কথাই বলবো আপনাকে। কিন্তু দোহাই আপনার, আমাকে ওদের হাতে ধরিয়ে দেবেন না যেন।
কাপ্তেন মৃদু হেসে বললো–না, সে ভয় নেই তোমার। তাছাড়া আমরাও খুব সাধু-সজ্জন নই। বোম্বেটে-জাহাজের নাম শুনেছ তো? এখানাও একখানা বোম্বেটে-জাহাজ।
এডমন্ড খুশি হলো এই কথা শুনে। খুশি হলো এই কারণে যে, বোম্বেটেরা তাকে নিশ্চয়ই ধরিয়ে দেবে না।
সে তখন উঠে বসবার চেষ্টা করতেই কাপ্তেন বললো– এখনই উঠে বসবার চেষ্টা করো না। আগে কিছু খেয়ে নাও, তারপরে উঠো।
কাপ্তেনের নির্দেশে তখনই এক প্লেট ডিম আর আলুসিদ্ধ এনে দেওয়া হলো তাকে।
দীর্ঘ চৌদ্দ বৎসর পরে ডিমসিদ্ধ মুখে দিল সে। কি ভালই যে লাগলো তার ঐ ডিম আর আলুসিদ্ধগুলি!
তাকে গোগ্রাসে গিলতে দেখে কাপ্তেন বললো–আর দেব?
এডমন্ড বললো–দিন।
কাপ্তেনের আদেশে আর এক প্লেট ডিমসিদ্ধ এনে দেওয়া হলো তাকে।
খাওয়ার পরে এডমন্ড বললো–আপনাদের জাহাজে কোন নাপিত আছে কি?
কাপ্তেন হেসে বললো–তা তো আছে, কিন্তু আমি ভাবছি তোমার এই জাদরেল চেহারাখানার একটা ছবি যদি রাখা যেত তাহলে বড় চমৎকার হত। এ রকম দেড় হাত লম্বা দাড়িওয়ালা মানুষ তো বড় একটা দেখা যায় না কি না!
হব্ব-জব্ব দাড়ি-গোঁফের ফাঁক দিয়ে এডমন্ড হেসে ফেললো এই কথা শুনে। হাসি থামলে সে বললো–আমার এই চেহারাখানা নিজেরই একবার দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে যে!
কাপ্তেন বললো–বেশ তো। আমার ক্ষুর নিয়ে বাথরুমে ঢুকে যাও। ওখানে আয়না আছে। কামানোও হবে, চেহারাও দেখতে পাবে।
এই বলেই একজন লোককে সে আদেশ করলো–আমার ঘর থেকে কামাবার সরঞ্জামগুলো এনে দাও তো একে।
একটু বাদেই একখানা ক্ষুর আর একখানা কঁচি নিয়ে এসে লোকটা বললো–এসো আমার সঙ্গে, বাথরুম দেখিয়ে দিচ্ছি তোমাকে।
বাথরুমে ঢুকে আয়নায় নিজের চেহারাখানা দেখেই ঘাবড়ে গেল এডমন্ড। একি সাংঘাতিক চেহারা রে বাবা!
এর পর কিছুক্ষণ আয়নায় সেই অপরূপ চেহারার দিকে তাকিয়ে থেকে ক্ষুর দিয়ে দাড়ির গোছা চেঁছে ফেলে দিল সে। দাড়ি-গোঁফ কামানো হয়ে গেলে এডমন্ড আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলো যে, তখনও তার চেহারায় যৌবনের দীপ্তি আছে।
এডমন্ড হিসাব করে দেখলো, তার বয়স তখন তেত্রিশ বছর। দাড়ি-গোঁফ কামানো হয়ে গেলে সে কঁচি দিয়ে মাথার চুলগুলোও ঘাড় পর্যন্ত হেঁটে ফেললো। এইভাবে চুল-দাড়ি কামানো হয়ে গেলে সে স্নান করতে বসলো। অনেকক্ষণ ধরে স্নান করে গা থেকে ময়লাগুলো যতদূর সম্ভব ঘষে তুলে সে (পাশাক পরে নিলো। পোশাক পরে আবার সে দাঁড়ালো আয়নার সামনে। নাঃ! ভালই দেখাচ্ছে তাকে।
এই সময় হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল যে হাত-পায়ের নখগুলো কাটা হয়নি। সে তখন কঁচি দিয়ে হাত-পায়ের নখগুলো কেটে ফেললো।
এর পর সে যখন বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো তখন তাকে দেখে সবাই আশ্চর্য হয়ে গেল। জাহাজের কাপ্তেন তার দিকে এগিয়ে এসে করমর্দন করে বললো–বাঃ! তোমার চেহারাখানা তো বড় চমৎকার হে!
এই সময় হঠাৎ ফারিয়ার সেই কাগজ দুখানার কথা মনে পড়ে যায় এডমন্ডের। কাগজ দুখানা তার সেই কয়েদী জামার পকেটে ছিল।
ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো সে আমার জামা! আমার জামা কোথায় রেখেছেন?
নাবিকদের মধ্যে একজন হেসে বললো–তোমার সেই মহামূল্যবান জামাটার কথা বলছো তো? ভয় নেই, ও চীজ চুরি যাবে না। ঐ দেখ দড়িতে শুকোচ্ছে।
এডমন্ড ছুটে গেল সেই জামাটার কাছে! তারপর তার পকেটে হাত দিয়ে টেনে বের করলো সেই ভাঁজ-করা কাগজ দুখানা। বের করবার সময় সে নাবিকদের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়েছিল, উদ্দেশ্য–ওরা কেউ যাতে দেখতে না পায় জিনিসটা।
ভিজে একেবারে ন্যাতা হয়ে গিয়েছিল কাগজ দুখানা। এডমন্ড তাড়াতাড়ি কাগজ দুখানাকে পকেটে ফেলে জামাটাকে উল্টে দিতে লাগলো। এমন ভাব দেখালো যেন ঐ জামাটা শুকোতে দিতেই সে ওখানে গেছে।
সে ফিরে এলে কাপ্তেন বললো–ও জামাটির মায়া এবার (তামাকে ত্যাগ করতে হবে ভাই। ও চীজ তোমার কাছে দেখলেই পুলিশ তোমাকে ধরবে।
এডমন্ড বললো–ঠিকই বলেছেন। ওটাকে এখনই বিদেয়। করা উচিত। এই বলেই সে আবার এগিয়ে গেল সেই জামাটার কাছে। তারপর দড়ি থেকে জামাটা নামিয়ে নিয়ে ডেকের ধারে গিয়ে সমুদ্রের জলে ছুঁড়ে ফেলে দিল সেটাকে।