১৬-২০. তুমি তো সুন্দর কন্যা

তুমি তো সুন্দর কন্যা
মোরে দিছো মন
বাঁশির সুরে মনের কথা
কহিব এখন।

ছাড়িয়া দে কলসি আমার
যায় বেলা হে নাগর
ছাড়িয়া দে কলসি আমার
যায় যে বেলা।

কেমন তোমার মাতা-পিতা
কেমন তাদের হিয়া
তোমার মতো যুবা নারীর
কেন না দেয় বিয়া?

ভালো আমার মাতা-পিতা
ভালো তাদের হিয়া
তোমার মতো নাগর পাইলে
মোরে দিত বিয়া
এখন ছাড়িয়া দে কলসি আমার
যায় যে বেলা।

মেহেরজানের প্রতি সেই আসক্তি প্রকাশের পর বাকি দিনটা হোসেন কেবলই ছটফট করিতে লাগিল। একটা আত্মগ্লানি তাহাকে যেন আর কোনো স্বস্তি দিতেছিল না। সমস্ত বিকালটাই সে বাহিরের বাগানের এইদিকে সেইদিকে ঘুরিয়া কাটাইয়া দিয়াছে। সন্ধ্যায় ছবদারের স্ত্রী আহারে ডাকিয়া পাঠাইল, কিন্তু কিছুই যেন আর মুখে রুচিতেছিল না। নতমুখে সামান্য কিছু নাড়াচাড়া করিয়া সে উঠিয়া পড়িল। ছবদারের স্ত্রী অবাক হইয়া অনেক কিছুই অনুমানের চেষ্টা করিল, কিন্তু হোসেন এড়াইয়া গেল।

একসময় বাড়ির হাতিনায় তাহার নির্দিষ্ট ঠাঁইটিতে গিয়া শুইয়া পড়িয়াছে, সেই সময় জাফর আসিয়া বায়না ধরিল : কই, কোথায় আপনে ভাইজান? এমন অন্ধকার নামিয়া আসছে যে কোন্‌খানে যে কী আর কেডা টেরও পাওন যায় না। আপনার এইখানে নামিয়া আসতে আসতে বুজানের সঙ্গেও একটা ঠোক্কর খাইয়া আসলাম। বোধকরি একটা চড়-চাপড়ও দিয়া থাকবে, কিন্তু ভাগ্যিস, গায়ে পড়ে নাই। সেই কথা থাউক, আপনে এখন একটা নতুন কেচ্ছা শুরু করেন ভাইজান। খুব বড়ো একটা পরান কথা, এ?

হোসেনের আদপেই তেমন কোনো উৎসাহ ছিল না। এই কয়েক সন্ধ্যা আগেও এমনই এক সন্ধ্যায় তাহাকে ‘রুপভান কন্যা’র কাহিনি শুনাইয়াছে, ঘরের কেওয়ারের ওই ধারে বসিয়া চাচি এবং মেহেরজানও শুনিয়াছে। নিজেও কি সে সব জানিত। অন্য অন্য মাঝিদের মুখে মুখে শুনিয়া সে মনের মতো করিয়া সাজাইয়াছে, ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলি সংশোধন করিয়া দিয়াছে শিকদার, সে যতই রূপকথার কিংবা পরান-কথার চরিত্র বা ঘটনাগুলিকে অলীক অথবা অসম্ভব রকম মনোহরণ করিতে চাহিয়াছে, শিকদার ততই তাহাদের নামাইয়া আনিতে চাহিয়াছে সাধারণ মানুষের মধ্যে, দৈনন্দিন জীবন-যাপনের ঘটনার মধ্যে। তাহা ছাড়া, শিকদার কে জানে কোন্ কারণে সেইসব কলা-কথায় সাধারণত খুব একটা উৎসাহ প্রকাশ করিত না। কেমন করিয়া বারো দিনের রহিম বাদশাহর সঙ্গে বারো বছরের অপরূপা সুন্দরী রূপভান কন্যার বিবাহ হইল। অতিথি-অভ্যাগতরা অনেক কিছু ভালো-মন্দের সঙ্গে চা-টাও খাইলে সেই সব বর্ণনায় হোসেন মজা পায়, এমনকী জাফরেরও যেন বারংবার শুনিয়াও তৃপ্তি হয় না, কিন্তু শিকদার সেই সমস্ত কাহিনি-কথকতা অন্য একপ্রকার দৃষ্টি লইয়া যেন দূর হইতে দেখিতে চাহিত। বাস্তবিক বলিতে কী শিকদারের মনোভাবটা হোসেন কখনওই তেমন বুঝিয়া উঠিতে পারে নাই। এখনও হয়তো নিজের ধ্যান-ধারণা মতো কোনো একটা কাহিনি সে শুরু করিয়া দিত, কিন্তু উৎসাহ পাইল না। মনে হইতে লাগিল কোনো কলা-কথার সঙ্গে আসল জীবনের কোনো মিল নাই। মানুষ হয়তো চায় তেমন হউক কিন্তু হয় না।

জাফর তবুও কিছুক্ষণ সাধাসাধি করিয়া অবশেষে হাই তুলিয়া ক্ষুণ্ণমনে ঘুমাইতে চলিয়া গেল। সমস্তক্ষণ মেহেরজানকেও আর কোথাও দেখা যায় নাই, অন্তত সম্মুখে আসে নাই। হোসেন তাহার উপস্থিতিও অনুভব করিতে শিখিয়াছিল। এমনকী নিত্যকালের মতো পানটাও বাড়াইয়া দেয় নাই কপাটের আড়াল হইতে; মনে হইতে লাগিল সেও কোনো রকম নিস্তব্ধ হইয়া রহিয়াছে। চাচির ডাকাডাকির সাড়া পাইয়া বুঝিতে পারিল সেও কোনো আহার স্পর্শ না করিয়া শুইয়া পড়িয়াছে। বাড়ির সমস্ত স্বচ্ছন্দ আবহাওয়া পরিবেশ যেন হোসেনই নষ্ট করিয়া দিয়াছে।

এলোমেলো পায়ে বাড়ির দিকে ছুটিয়া যাইতে যাইতে কী বলিয়াছিল মেহেরজান তা বহুরকম চেষ্টা করিয়াও সে আর আন্দাজও করিয়া উঠিতে পারিতেছিল না। সেই রাত্রির অন্ধকার অগ্রাহ্য করিয়াও সে আবারও গেল দুপুর বেলার সেই পুকুরধারে। হঠাৎ কী যে কী হইয়া গেল। সে পুনর্বার সমস্ত ঘটনাটা পর্যালোচনা করিতে বসিল। অকস্মাৎ সমস্ত দেহমন যেন ধাইয়া গিয়াছিল মেহেরজানের দিকে, মনে হইয়াছিল তাহাকে আলিঙ্গন করিয়া নিজের সঙ্গে মিশাইতে পারিলে যেন বিশ্ব-ভুবনের সমস্ত আনন্দ-শান্তি তাহার জীবনে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিবে, তাহার সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর হইবে, সে গৃহী হইবে, স্বাভাবিক মানুষ হইবে। অথচ খেয়াল রাখিল না মেহেরজান কুমারী কন্যা নহে, অন্যের বধূ। হইয়াছে না হয় অতি শৈশবকালে বিবাহ, স্বামীর ঘরও সে করে নাই বড় হইয়া, কিন্তু সেই স্বামী এখনও বাঁচিয়া আছে, বিধিমতো সেই বিবাহ ভাঙা সম্ভব হয় নাই অর্থাভাবে। হোসেনের এমনকী সাধ্য আছে এই অবস্থা হইতে তাহাকে উদ্ধার করে? তাহার মা, সবার উপর সেও কি তাহার মতো বিদেশির সঙ্গে কোনো সম্পর্কের বিষয়ে সম্মত হইবে? মেহেরজানের যদি কিছুমাত্রও আগ্রহ থাকিত তাহা হইলে অমন আকুলি ব্যাকুলি করিয়া ভৎর্সনা করিয়া ছুটিয়া যাইত না। চিরকালই তো সে জানিয়া আসিয়াছে যে ভালোবাসার জনকে কেউ এমন করিয়া দূরে ঠেলিয়া দেয় না, বরং আরও ঘনিষ্ঠে আহ্বান করিয়া নেয়। সে যে আর কাছেও দেখা দিল না, আহারান্তে পানমশলাও বাড়াইয়া দিল না, তাহার মধ্যে একটা বিরাগই প্রকাশ করিয়াছে। অতিথি হইয়া উপকার করিতে আসিয়া হোসেন না চাহিলেও একটা নিদারুণ হঠকারিতা, একটা অসৎকর্ম করিয়া ফেলিয়াছে।

বাহির হইতে ঘর, ঘর হইতে বাহির, হোসেন কোথাও যেন আর সুস্থির থাকিতে পারিতেছিল না, উঠানের উপর পায়চারি করিতে করিতে সে নিজের সমূহ কর্তব্য স্থির করিয়া লইতে চাহিল। একটা হন্যে কুকুর অযাচিতভাবে সেই বাড়িতে আশ্রয় লইয়াছিল; সে কয়েকবারই হোসেনের কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করিয়া আবারও নিজের বাছিয়া লওয়া কোনো ঠাঁই-এর কাছে ফিরিয়া গেল। ঘরের দিকে অন্ধকার রাত্রি নিশুতি, কেবল মাঝে মধ্যে কোথাও হইতে একটা মৌসুমি হাওয়া হঠাৎ জাগিয়া আবার কোনো দিকে মিলাইয়া যাইতেছিল। হোসেন একসময় টের পাইল তাহার সঙ্গে সবেমাত্র নতুন ফোঁটা কদমফুলের গন্ধও ভাসিয়া আসিতেছিল। অথচ ঝি ঝি কি উচ্চিংড়া পোকাগুলি আর কোথাও ডাকাডাকি করিতেছে না; ইতস্তত হইতে ব্যাঙের ডাকাডাকিও তখন নীরব হইয়া গিয়াছে। ঘরের চাল বাহিয়া টুপটাপ করিয়া পড়িতেছে বাতাসে জমিয়া থাকা সারা রাত্রির শিশির, কখনও ঠাণ্ডা হাওয়ায় পুকুর পাড়ের আম-জামের গাছগুলিতে ধীর-লয়ের মর্মর ধ্বনিও যেন আর শোন যায় কী না যায়।

এক সময় ঘরের দিকে পা বাড়াইতেও তাহার মনে হইল কে যেন ছিল কেঁওয়ারের কাছে, তাহার সাড়া পাইয়াই ঝট করিয়া সরিয়া গেল।

হোসেন কয়েক মুহূর্ত নিশ্চলভাবে দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর হাতিনায় উঠিয়া যাত্রার আয়োজনে ব্যস্ত হইল। কিন্তু কেঁওয়ারের দিক হইতে চুড়ির আওয়াজ পাইয়া আবার সে থামিয়া গেল।

: চাচি

কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। ভিতরে শ্লেম্মাজড়িত কণ্ঠে নাক ডাকাইয়া সে হয়তো অঘোরে ঘুমাইতেছে। সকাল হইয়া আসিতেছে, সেই সময় জাফর কিংবা মেহেরজান কাহারোই আর জাগিয়া থাকিবার কথা নয়। অথচ সেই সকালের স্রোতেই ভাসিয়া পড়িবার জন্য হোসেন মনস্থির করিয়াছে।

: চাচি, আমি বিদায় লইতে চাই, রওয়ানা হইতে চাই, এই শেষ রাত্তিরের জোয়ারে। না হইলে মনে কয় কেবল মুসিবতের উপর মুসিবতই নামিয়া আসবে।

তখনও কোনো সাড়াশব্দ শোনা গেল না কাহারও। হোসেন অগত্যা বাহিরের দিকে পা বাড়াইবে এমন সময় কোথা হইতে শোঁ শোঁ আওয়াজ তুলিয়া নামিয়া আসিল মুষলধারায় বৃষ্টি। সেই সময় চুলাশালের দিক হইতে হাঁস-মুরগিগুলিও অকস্মাৎ কলরব তুলিয়া জাগিয়া উঠিল। মনে হইল, ঘরের মধ্যেও যেন কেউ দিয়াবাতিতে কুপি জ্বালাইয়া তাহাদের তদারকিতে উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিয়াছে।

: চাচি?

প্রথমে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না; কিন্তু হোসেন টের পাইল কেউ কেঁওয়ারের ধারে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।

: কী, হইল কী আপনার? ঘুমায়েন চুপ করিয়া।

ঘরের ভিতর হইতে মেহেরজানের চাপা ধমক শুনিয়াও হোসেন যেন শান্ত হইতে পারিল না। কুপির আলোটা নিভিয়া যাইতে দেখিয়া সে আবারও বলিয়া উঠিল : নাহ, এই জোয়ারেই আমারে রওয়ানা হইতে হয়। আমি চলোম।

সেই সময় খুলিয়া গেল সেই ঘরের কেঁওয়ার, অন্ধকারের মধ্য হইতে নামিয়া আসিল মেহেরজান এত কাছে যে যেন তাহার নিঃশ্বাসের শব্দও শোনা যাইতেছিল; আর তাহার দেহগন্ধ নোতুন ফোঁটা কদম ফুলের গন্ধও বিবশ করিয়া সেই দ্বিপ্রহর কালের বর্ণগন্ধ সৌরভকে মনে করাইয়া দিল।

: আপনি কী পাগল হইয়া গেলেন? কোথায় যাইবেন এই দেয়ইর মধ্যে? পাগলামি করবেন না আর, চুপচাপ বিছানায় গিয়া শুইয়া পড়েন। আপনার যাওয়া হইবে না।

হোসেন নিথর হইয়া পড়িল; তবু এক সময় জেদ দেখাইল : কিছুমাত্র পাগলামির কথা না। আমার বাড়ি আমার তো যাইতেই হইবে।

অন্ধকারের মধ্য হইতে একটি হাত হোসেনকে স্পর্শ করিল : না, এমন দেয়ইতেই যে বাহির হইতে হইবে এমন কোনো কড়ার নাই। তামাম রাত্রির এমন জাগিয়া থাকলে এমনিতেও শরীল কড়া হয়। একটা ঘুম দিয়া দেখেন, অনেক কিছুই পয়-পরিষ্কার হইয়া যাইবে।

হোসেন টের পাইল, তাহার পুঁটলিটা কোথাও সরাইয়া রাখিয়া মেহেরজান ঘরে উঠিয়া কেওয়ার ভেজাইয়া দিল।

হয়তো সেই সময় তাহার মা-ও জাগিয়া উঠিয়াছিল। প্রবল ইচ্ছাসত্ত্বেও হোসেন অন্য কোনো উদ্যোগের শক্তি পাইল না। মনে হইল মেহেরজান যেন তাহার ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা ভরসা হাতের মুঠায় লইয়া এমন কোনো অন্তঃপুরে চলিয়া গিয়াছে সেইখানে হোসেনের আর কোনো শক্তিই খাঁটিবে না। সে নিজ শয্যার উপর বসিয়া পড়িল বটে, কিন্তু আর ঘুমাইতে পারিল না। কেবলই মনে হইতে লাগিল মেহেরজানকে দলিত মথিত মর্দিত করিয়া তাহার কাছে নতজানু করাইতে পারিলেই সে হয়তো শান্তি পাইত, তারপর যদি মেহেরজান ডাগরচক্ষু মেলিয়া কাঁদিয়া কাকুতি-মিনতি করিয়া তাহার যাত্রা বন্ধ রাখিতে অনুরোধ জানাইত, হোসেন ভাবিয়া দেখিতে পারিত। হোসেনের জন্য তাহার কিছুমাত্র অনুরাগ থাকিলে সে উঠিয়া আসিতে পারে না?

অনর্থক প্রতীক্ষার মধ্যে দিয়া বাকি রাত্রিটুকু শেষ হইয়া গেল। ভোরের দিকে হয়তো বা একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হইয়া পড়িতেছিল, কিন্তু জাফরের ডাকা ডাকিতে উঠিয়া পড়িল।

: আরে, আরে। ওঠেন ভাইজান, আপনে আর বুজান ছাড়া এখনতক আর কেউই কোথায়ও বিছানায় পড়িয়া নাই। কোন বিহানে উঠছি আমি, যেন কাক-পঙ্খিরও ডাকের আগে। সারা রাত্তিরের বিষ্টির পর তামাম দুনিয়া পানিতে থৈ থৈ। সমস্ত মুলুকে মাছ ধরার ধুম পড়িয়া গেছে। পুকুরের জানে যে চাই পাতছিলাম তাতে না জানি কত মাছ আটকাইছে!

হোসেন অকস্মাৎ একটু অনুতপ্ত বোধ করিল। শিকদার যাহাই বলুক প্রকৃতি কখনও যাচিয়া ধরা দেয় না, পৌরুষ রুদ্রবেশে আসিয়া লুটিয়া না লইলে তাহার জীবন-যৌবনও যেন সার্থক হয় না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠিয়া যাইতে যাইতে কেবলই তাহার মনে হইতে লাগিল ঘরের সমস্ত কপাট ভাঙিয়া সেও মেহেরজানের কাছে উপস্থিত হইতে পারিত। কেবলই মনে হইতে লাগিল তাহারও সমস্ত কৌমার্য যেন সারা নিশিভর ছড়াইয়াছে কেয়া-কেতকীর মতো। নিশীথের অন্ধকার আর কান পাতিয়া দিগ-দিগন্তের শাসনবারণ প্রত্যুষের আশীর্বাদ হইয়া দেখা দিল। জাফরের কচি হাত, কিন্তু তাহারই মধ্যে ছবদারের সমস্ত পরিবারের জীবন-স্পন্দন অনুভব করিতে সে অন্য এক পৌরুষের সম্ভষ্টি বোধ করিতে লাগিল।

: চলো যাই, আইজ কেবল মাছ না, ভোঁদড়েরও নিস্তার নাই।

: না, না-হাত তুলিয়া সাবধান করিতে চাহিল জাফর : ভোঁদড়গুলান বড়ো চালাক, হলক হইতে না হইতে কোন কোন মুলুকে চলিয়া যায়, কেউ আর তারগো উদ্দেশ পায় না। বুজানরে জিগাইয়া দেখেন, সেও জানে, সে-ই কইছে।

হোসেন ঘরের কপাটের দিকে চাহিল বটে, কিন্তু সেই দিকে কেউ ছিল না।

.

১৭.

তার বাঁশির সুরে এমন মন হরে
যে কুলবধূ যায় কুল ছেড়ে রে
সখি, দেখা হলে বলিস তারে।
ধারে কাছে প্রতিবেশী, গুরুজন কাছে বসি
সে নাম ধরিয়া বাজায় বাঁশি
আমি লাজে যে যাই মরে রে।

মনে কয় জলের ঘাটে যাই
জলের ছায়ায় তারে দেখিয়া পরান জুড়াই
আবার ঘরের দাওয়ায় এসে এসে
জল ফেলিয়া জল ভরতে যাইরে
সখি, দেখা হলে বলিস তারে
সে যেন নাম ধরিয়া আর
বাঁশি বাজায় নারে
আমি কেমনে আর যাইব রে ঘাটে
কুল মান সংসারে সন্তরে–

পুকুরের একধারে ছোটো একটা নালা কাটিয়া খালের সঙ্গে যুক্ত; স্রোত এবং জল চলাচলের জন্য তাহার প্রয়োজন। সেইখানে বেত-বাঁশের খাঁচা পাতিয়া মাছ ধরার কৌশলটাও সাধারণ, কিন্তু সব বিষয়েই জাফরের যেন উত্তেজনা-উৎসাহের অবধি নাই।

: তবে ভাইজান আমি আপনার উপর বড়ো গোস্বা করিয়া আছি।

হোসেন কৌতুক অনুভব করিল : কেন, কী করলাম?

: আমারে কেচ্ছা শুনায়েন নাই।

: ও, আচ্ছা, আচ্ছা। আইজ শোনামু।

: সত্য?

: হুঁ, হুঁ!-হোসেন চিন্তামগ্নভাবে মাথা দোলাইল।

: অনেক বড়ো, অনেক লম্বা। সেই যেইটা শোনতে শোনতে এই দিকের আসমানের তারাগুলান এক্কেবারে এদিকে ঢলিয়া পড়তে থাকবে। একেবারে মন যেমন চায় সেইরকম পরান কথা। জানেন তা হইলে চুপচাপ বুজানও শুনবে, হ।

জাফর মহা উৎসাহে লম্বা লম্বা পা ফেলিয়া যাইতে লাগিল : বাপুরে বাপু, এত কেচ্ছা আপনে কেমনে পারেন ভাইজান?

: শুনি, মানষের মুখে, পুথিতে আছে।

জাফরের চক্ষু বড়ো বড়ো হইয়া উঠিল : আরে, পুঁথিও পড়তে পারেন আপনে? হোসেন মুখ তুলিয়া তাহার দিকে তাকাইল বটে, কিন্তু এখনকার মতো বিষয়টার ইতি টানিতে চাহিল : হ, হ, হইবে, হইবে।

হোসেন সরাসরি উত্তর এড়াইয়া গেল : তুমি পারো?

: হ, তা হইলে আর আপনারে এত সাধাসাধি করি। তায় আমাগো পুথিও নাই। ওই যে বাড়ি দেখেন-জাফর আঙুল উঁচাইয়া প্রতিবেশী গ্রামের দিকে দেখাইল : ওই তাগো বাড়িতে বেশ কয়েকখান পুথি আছে। অনেক সময়, সাঁঝের পর সুর করিয়া পড়তে বসে, কত মানুষ শোনতে আসে চতুর্দিক হইতে। রাত্তির কালে কান পাতিয়া রাখিয়েন, আপনেও শোনতে পারবেন।

: দেখিও, দেখিও, সব কাদায় পিছল হইয়া আছে। পা ফসকাইয়া পড়িয়া যাইও না।

জাফরকে সাবধান করিতে গিয়া হোসেনই পা ফসকাইয়া যাইতেছিল। জাফর খিলখিল করি হাসিয়া উঠিল। সেই সঙ্গে যেন আরও কাহার হাসি শোনা গেল ঘাটের দিক হইতে। হোসেন নিজেকে সামলাইয়া লইয়া দেখিল মেহেরজানও ঘাটে আসিয়াছে মুখ ধুইতে। সে গায়ের কাপড় টানিয়া মুখ ঘুরাইয়া লইল।

: হুঁ!-হোসেন একটু উষ্ম দেখাইল : পড়িয়া যাওন এমনই সোজা। আসলে, বোঝলা জাফর, একটা পেতনির ইচ্ছা হইছিল পড়িয়া যাই। সে কয় দেখো না মর্দ আমিও মুখ ধুইতে যাইতে আছি ঘাটে, তুমি যে বড়ো আগে আগে চলতে চাও? এই কইয়া দিতে চাইল আমারে এক ধাক্কা। তা আমি তো সেই সব আমলে আনি না। কই, পড়িয়া গেলাম?

: না তো!

: দেখো তা হইলে, কেমন আমার ক্ষ্যামতা! ও কী তবু যে হাসো।-বলিতে বলিতে হোসেন আড়চোখে চাহিয়া দেখিল মেহেরজান কুলি ছিটাইয়া ধীরপদে ঘরের দিকে চলিয়াছে।

: তা পেতনি কী করলে?–জাফর মজা পাইয়া আরও জানিতে চাহিল। হোসেন অনাবশ্যকভাবে একটু গলা চড়াইয়া কহিল : কী আর করবে? মুখ না ধুইয়াই সে তার শ্যাওড়াগাছের বাসায় ফিরিয়া গেল।

মেহেরজান ঘরের দিকে যাইতে যাইতে একবার কৃত্রিম রাগে ভ্রুকুটি করিয়া ফিরিয়া চাহিল। : দূর, দূর ভাইজান, এই মুলুকে শ্যাওড়াগাছও নাই, আর সেইসব ভূতপেতনিও নাই। ওই সব কেচ্ছা না, আপনে ফাটকি দিয়া আসল গল্প ভুলাইয়া দিতে চায়েন। না বাপু, তাহ হইবে না।

: হইছে, হইছে। চলো এখন, চাঁই উঠানো যাউক।

রাত্রির বৃষ্টিতে খাল-পুকুর, চতুর্দিকের খেত মাঠও ফাপিয়া উঠিয়াছিল। অনেকরকম মাছই ছুটাছুটি করিয়া চাই-এর মধ্যে আটকাইয়া পড়িয়াছিল। তাহাদের মধ্যে দুইটা বড়ো বড়ো শলা চিংড়ি পাইয়া জাফর মহা হৈ চৈ লাগাইয়া দিল। অন্য একটা চাই দেখা গেল ভাঙা, ভিতরে তিত পুঁটিটা পর্যন্ত নাই।

: এইটার মধ্যে ভোঁদড় ঢুকছিল আমাগো জন্য আর কিছু বাকি রাখে নাই। একটা আরও মজবুত চাই বানানোর কাম দিয়া গেছে।

জাফর শামুক-গুগলিও যত্ন করিয়া উঠাইয়া লইল : বুজানেও খুশি হইবে, হাঁস-মুরগিগুলানেরও মহোৎসব লাগিয়া যাইবে। আচ্ছা ভাইজান, কেমন ওই ভোঁদড়টা, কোথায় হইতে আসে, কখনও তো চৌখে দেখি নাই।

: থাকে কোথায় বন-বাদাড়ের মধ্যে, ওই মাঠ-ঘাটের কোনো দিকে কোনো গর্ত-টর্ত আছে। মানুষের ধারে কাছে বড়ো একটা আসে না, দেখলেও পালাইয়া যায়।

জাফর আশ্বস্ত হইতে চাহিল : পুকুরের মধ্যে আসে না, আর তেমন ডরেরও কিছু নাই, এ?

: দূর, এই চাই ভাঙা, আর মাছের জাল ভেঁড়া ব্যতীত অন্য কোনো ক্ষতি তারা করে না।

আবারও তাহার বাড়ির উঠান পর্যন্ত পৌঁছিয়া দেখে, গত রাত্রির বৃষ্টির জোড়ে একধারের সবজির মাচান প্রায় ভাঙিয়া পড়িয়াছে, মেহেরজান আর তাহার মা পুঁই, শশা, ঝিঙা, লতাগুলিকে সামাল দিবার জন্য জলে-কাদায় মাখামাখি করিয়া ফেলিয়াছে।

: দেখিস মেহের, দেখিস সাবধানে লতাইয়া দে, গাছে যেন ব্যথা না পায়। হোসেন ভাঙা চাইটা একধারে রাখিয়া আগাইয়া গেল : সরেন আপনারা, আমি আপন বাড়িতেও এইসব ফলাই।

জাফর মেহেরজানকে ডাক দিল : হাঁস-মোরগেরও আর খাওনের অভাব হইবে না। এত শামুক-গুগলি কেউ কক্ষনো চৌখেও দেখো নাই।-মাছের খালুইগুলি মা এবং ভগিনীর দিকে ঠেলিয়া দিয়া সেও মহা বিক্রমে হোসেনের কাছে আগাইয়া গেল : কই ভাইজান, কী করতে হইবে, কয়েন। কিন্তু কোনো নির্দেশের অপেক্ষা না করিয়া সে নিজেই মাচানের একটা কঞ্চি নাড়িয়া ঠিক করিবার জন্য টান দিতেই ঝপ করিয়া তাহার একপ্রান্ত থুবড়াইয়া পড়িয়া গেল।

ছবদারের স্ত্রী যেন সর্বাঙ্গে আঘাত পাইল। মেহেরজান সরিয়া যাইতেছিল, ফিরিয়া দেখিয়া হাসিয়া ফেলিল : মহা বাহাদুর সব! হইল তো?

জাফর একটু অপ্রস্তুত হইয়া পড়িল বটে, কিন্তু হোসেন তাহাকে টানিয়া উঠাইল : কিছু হয় নাই, ওঠো, সব ঠিক করিয়া দিতে আছি।

: তুই বরং সরিয়া আয় জাফর। শামুক গুলানরে বাছিয়া দে গিয়া তোর বুজানরে। সে হাঁসগুলানরে খাইতে দেউক। চৌখও রাখন লাগে। উপরের আসমানে সেই সকাল থেকিয়াই চিল-শকুন ঘোরাঘুরি করতে আছে।

জাফরকে তাড়া দিয়া তাহার মা কাদামাখা সবজিগুলি তুলিয়া ঘরের দিকে পা বাড়াইতেছিল। হোসেন মৃদুস্বরে তাহাকে ডাকিয়া ফিরাইল : চাচি, একটা বিষয়ে জিজ্ঞাস করতে চাই আপনারে।

জাফরের মা ফিরিয়া আসিল; কিছুক্ষণ হোসেনের দিকে চাহিয়া রহিল।

: আমি এই ডেনার জোরে উপার্জন করিয়া খাই, এখনই আমার কাম কায্যের মৌসুম। এখন আবার বাস্তবিকই যাওন লাগে। আমারও এইরকম একখান খেত আছে। একজনের উপর ভরসা করিয়া ছাড়িয়া আসছি। না, না, সে আপন মানুষ, যত্ন নিশ্চয়ই করবে। তবু আমিও তো আর এখন এইখানে থাকতে পারি না। আমারে যাইতেই হয়।

জাফরের মা নতমুখে কোঁচড়ে সবজিগুলি নাড়াচাড়া করিতে লাগিল : বুঝি বাজান, ধরিয়া রাখনের শক্তি আমাগোই বা কী আছে।

হোসেন একটু ইতস্তত করিয়া জিজ্ঞাসা করিল : আপনাগোই বা কী ব্যবস্থা হইবে? এইভাবে তো আর দিন চলতে পারে না।

: এই ছিদ্দত দূর করার জন্যই তো জাফরের বাপ ওই শরীর লইয়া গাঙে নামছেল ।–জাফরের মা-র গলা ধরিয়া আসিল : তুমি তো সবই দেখলা, সবই বোঝো, কেবল চিল-শকুন খেদাইয়া আর কতকাল বাঁচিয়া থাকন যায়? পাছ-দুয়ারে শিয়াল ঘোরে, নানান উৎপাতের শেষ নাই। মাঝে মাঝে দুই চৌখের পাতা এক করতে পারি না, দা, হাতে লইয়া বসিয়া থাকি। কিন্তু কোনো উপায়ও দেখি না।

: চেষ্টা তো করণ লাগে। আমি তো দেখি মেহেরের ওই বিবাদটা মিটাইয়া ফেলন দরকার।

জাফরের মা হঠাৎ কোনো উত্তর করিল না, কেবল নৈরাশ্যের ভঙ্গি করিয়া বলিল : এ, তো আর হয় না, বড়ো তেজি মাইয়া, সেই হাড়ে হারামজাদার ঘর করতে যাইবে না। চাপ দিলে হয়তো বা গলায় দড়ি দিয়া ঝুলিয়া পড়বে। এখন কেবল জাফরের ডাঙর হইয়া ওঠনের অপেক্ষা, সে যদি কোনো উপায় করিয়া সম্বন্ধটা ছাড়াইয়া লইতে পারে। সেই শয়তানটার স্বভাবই ওই, একটা করিয়া বিয়া করে, তারপর একদিন টাকা-পয়সার দাবি উঠায়। সেই আমার এগারো বছরের মাইয়াটারে লইয়া গেল, আর কয়েকমাস যাইতে আরও একজনরে ঘরে আনিয়া উঠাইল কোথায় হইতে। মেহের কোনো বাক বিতণ্ডার মধ্যেও যায় নাই। যেখানেই থাউক, মাইয়া ছেইলারা কক্ষনো বাপের বাড়ির পথ ভোলে না। সেই যে চলিয়া আইল, আর ফিরান গেল না। অবস্থাটা এমন হইয়া রইছে যে সেই ধুরন্ধর নগদ টাকা হাতে না পাইলে অন্য রকম সর্বনাশের পথ ধরবে। কখন যে কোনদিক দিয়া কী হয়, সেই ভয়ে তো কলিজা শুখাইয়া আছে।

: কত টাকার বিষয়?

: অনেক-অনেক টাকার বিষয় বাজান, পাঁচ-সাত কুড়িতেও হয়তো কুলাইবে না।

: টাকার ব্যবস্থা হইলে তারে ছাড়াইয়া লইতে পারবেন?

জাফরের মা-র চক্ষু জ্বলিয়া উঠিল : আমি তার ঘাড় ধরিয়া তালাকনামা লেখাইয়া লইতাম। আরও দশজনেরে লইয়া তার কাছে হাজির হইতাম।

হোসেন সেইসব কথায় আমল না দিয়া বলিল : আহা, আমি সেইসব হৈ হট্টগোলের কথা উঠাইতে আছি না। টাকার ব্যবস্থা হইলে তারে ছাড়াইয়া লইতে পারবেন কিনা সেই বিষয়টা বুঝ করতে চাইলাম। আমার জানা শোনা অনেক পোলা আছে, একটা ভালো সম্বন্ধের প্রস্তাব উঠাইতে পারতাম। জাফরের মা-এর মুখের ঔজ্বল্যটা যেন একটু নিভিয়া গেল; পিছনের দিকে কাহারও সাড়া পাইয়া ধীরে ধীরে বলিল : তোমারে আল্লায় জুটাইয়া দিছে। দেখো, তুমি যা ভালো বোঝে।

হোসেন মাচানের কাজে মন দিয়া বলিল : আমি তা হইলে এই শেষ রাত্তিরের জোয়ারেই রওয়ানা দিতে চাই।

জাফরের মা অন্যমনস্কভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া কী ভাবিল, তারপর উঠানের দিকে আগাইয়া গেল। উঠানের একধারে খরার দিনে ব্যবহারের চুলাশাল। মেহেরজান সেইখানে শামুক কাটিয়া হাঁসগুলিকে খাওয়াইতে ছিল।

: আয়, আয়, চৈ, চৈ, চৈ–

জাফরের মা কাছে গিয়া বসিয়া রহিল কিছুকাল, মেহেরজান বেশ কয়েকবার তাহার মুখ চোখ লক্ষ করিয়া কিছু আন্দাজ করিবার চেষ্টা করিল।

: আমারে জিগাইল তুই আর ওই বাড়িতে যাইতে ইচ্ছা করস না কেন? মেহেরজান শামুক কাটা থামাইয়া আরও কিছু শুনিবার অপেক্ষা করিতে লাগিল।

: কইলাম, মাইয়া আমার সে বাড়ির নামও আর মুখে লইতে দেয় না। তখন জিগগাস করে কত টাকা লাগবে ওই সম্বন্ধ ছাড়াইয়া লইতে। তার জানাশোনা ভালো পাত্রও নাকি আছে।

মেহেরজান হঠাৎ আর্তনাদ করিয়া উঠিল।

জাফরের মা-র ভাবনা ভাঙিয়া গেল, লক্ষ করিল বটির মাথায় একটা আঙুল কাটিয়া ফেলিয়াছে মেহেরজান, তাজা রক্তে সমস্ত হাত ভরিয়া উঠিয়াছে। মনে হইল নখের প্রান্তে এক টুকরা মাংসও যেন ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছে। মেহেরজান রক্ত থামাইতে ব্যস্ত হইয়া, যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া ককাইয়া উঠিল।

: কী কাণ্ড, কোনোদিকে কিছু শান্তি নাই, পোড়া কপাল, যেন চতুর্দিক দিয়া সমস্ত বিপদ-আপদ যড় করিয়া নামছে। ওরে জাফর, তোর ভাইজানরেও একবার ডাক দে দেখি।

হাতের যন্ত্রণা সত্ত্বেও মা-এর উপর বেশ একটু বিরক্ত হইয়া উঠিল মেহেরজান : এই দেখো, তারে আবার কেন? সব বিষয়ের মধ্যেই তাকে ডাক দেওনের কী এমন দরকার পড়ছে। তুমি কিছু কচুর ডাটা আর একটু ত্যানার জোগাড় করো।

কিন্তু ততক্ষণে হোসেন উপস্থিত, হাত বাড়াইয়া সে আঙুলটা দেখিল। যদিও মেহেরজানের সেই নিটোল হাত স্পর্শ করিতেও সে নিজেই থামিয়া উঠিল, তবু জাফরকে ইঙ্গিতে কাছে ডাকিয়া বলিল : একটু কেরাসিন তেল লইয়া আসো।

তারপর চুমুক দিয়া কিছুটা রক্ত টানিয়া লইয়া সে আঙুলটাকে শক্ত হাতে চাপিয়া ধরিয়া রাখিল। মেহেরজান আকুল ব্যাকুল হইয়া উঠিল।

: খুব কষ্ট হইতে আছে?

মেহেরজান জবাব দিল না, মুখ ঘুরাইয়া লইল।

: সামান্য একটু কাটছে, ডরের কারণ নাই।

মেহেরজান ঠোঁট ফুলাইয়া : হ, সামান্য। কেডা আপনারে ডাকছে? আইলেন কেমন করিয়া এত সব মাথা ব্যথা ফেলাইয়া?

হোসেন একটু অবাক হইয়া গেল।

: কেডা আপনারে কইছে আমার সম্বন্ধের উদ্দেশ করতে? যায়েন আপনে, আমার নিজের বিষয় আমি নিজেই দেখতে পারমু।-মেহেরজান নিজের হাত ছাড়াইয়া লইতে চাহিল।

হোসেন একটু হতভম্ব হইয়া পড়িলেও, তাহার হাত ছাড়িল না। ইতিমধ্যে জাফর কেরোসিন তেলের বোতল আর নেকড়া লইয়া আসিয়াছে, তাহার মা ও লইয়া আসিয়াছে তাজা কচুর ডাটা, পুষ্ট পুষ্ট পানের পাতা। হোসেন মেহেরজানকে অভয় দিয়া ক্ষতস্থানটি ধুইয়া দিল কেরোসিন তেলে; মুখে পান চিবাইয়া বাঁধিয়া দিল কচুর ঊটার বাকল দিয়া। মেহেরজানের চোখে জল আসিলেও, যন্ত্রণায় সমস্ত হাত বিবশ হইয়া যাইতে থাকিলেও উঠিয়া যাইতে পারিল না। তাহার হাতের আঙুলগুলি নাড়াচাড়া করিতে করিতে এক সময় সে দেখির মেহেরজান হাঁটুর উপর মুখ চাপিয়া যেন অগত্যাই হোসেনের কাছে আপন হাতখানি এবং সেইসঙ্গে আরও কিছু ইচ্ছা-অনিচ্ছাকেও ছাড়িয়া দিয়াছে।

: খুব টাটাইতে আছে?

কেবল সেই সময় মেহেরজান তাহার হাত টানিয়া লইতে চাহিল : তাতে আপনার কী? আমার জন্য সম্বন্ধের জোগাড়ে আপনার ঘুম হইতে আছে না।

জাফরের মা এবং জাফর তখন কাছাকাছি ছিল না। হোসেনের বুকের মধ্যে আবারও একটা ইচ্ছা যেন দুর্দম হইয়া উঠিল। মেহেরজান সম্ভবত তাহারাই আভাস পাইয়া দ্রুতপদে পাকঘরের দিকে উঠিয়া গেল।

হোসেনের মনে হইতে লাগিল নিজের একটা আঙুল কাটিয়া ফেলিলেও সে হয়তো এমন আউল-বাউল বোধ করিত না। একটা মেয়েমানুষ যে সমস্ত পুরুষ পৌরুষকে এমনভাবে চঞ্চল করিয়া তুলিতে পারে, সে খেয়াল তাহার যেন আর কখনও হয় নাই। বাতাসে কদমফুল না কোনো বুনোফুলের গন্ধ, নাকি মেহেরজানেরই শরীরের ঘ্রাণ তাহাও যেন সে আর আলাদা করিয়া অনুভবের সুযোগ পাইল না।

তবু সে একগুচ্ছ কদমের ফুল সংগ্রহ করিয়া জাফরকে দিল : নেও, বাড়ি লইয়া যাও, মিঠা-কড়া তামাকের লাহানই, এর সুবাস বাতাস ভরিয়া ফেলাইতে আছে। এই ফুল এত দেখছি, তবু এমন খেয়াল যেন কখনও করি নাই।

.

১৮.

সুখ দুঃখ নৃত্য করে ভুবন জুড়িয়া
ঋতু দেয় ফুল-ফল বৎসর ধরিয়া
ভটায় উজানে গড়ায় বহতা নদী
তারই মধ্যে, ভিত বাঁধি জনম অবধি
ফুলের কেশর হইয়া সাধ উড়িয়া বেড়ায়
অন্তরও আকাশ হইয়া কেবলই উথলায়।

কীট পতঙ্গ বৃক্ষ রাজি ফুল লতাপাতা
ভুবন জুড়িয়া গায় নিত্য গীতকথা
কী শক্তি লইয়া আমি তার কথা গাই
পুরাণে পরানের সাধ মিটাইতে চাই।

আর কেবল দুশ্চিন্তা লইয়া সময় কাটাইয়া দেওয়া নয়, শিকদারও নিজের জীবন বদলাইবার জন্য দৃঢ়-সংকল্প হইয়া উঠিয়াছিল। অথচ অতৃপ্তি এবং চাঞ্চল্যেও সে অধীর হইয়া উঠিল। ইতিমধ্যে সে কেবল নতুন গীত-গান বাঁধার চেষ্টাই করে নাই, হোসেনের ঘর-বাড়ি সবজি খেতেরও তদারক করিয়াছে, সখিনাদের বাড়ির দিকে বেশ কয়েকবার পা বাড়াইয়াও ফিরিয়া আসিয়াছে। কেবলই মনে হইয়াছে সেই ঘটনাটা বড়ো জটিল; গঞ্জে আলীর প্রভুপক্ষকে অসন্তুষ্ট করার মতো কোনো কাজ হোসেনের পক্ষেও মঙ্গলজনক। হইবে না।

কেবল একটা ইচ্ছা লইয়া তা করিতে পারে না। পুঞ্জ পুঞ্জ গায়ে-গ্রামে মানুষের গোষ্ঠী যেইভাবে জড় হইয়াছে, আশ্রয় লইয়াছে, তাহার মধ্যে নিজের প্রতি কর্তব্য ছাড়াও আরও কতকগুলি বাধ্যবাধকতা আছে। গঞ্জে আলীর মতো ভিটা-মাটিহীন মানুষের পক্ষে অন্যতর কোনো পথ খোলা ছিল না, সখিনারও তখন আর কোনো উপায় নাই। এই রকম অসংখ্য দুঃখ পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের মতো ছড়াইয়া রহিয়াছে বিশ্ব-ভুবনে। হয় মানুষ উদাস হইয়াছে না হয় আধ্যাত্মিকতার মধ্যে ডুবিয়া যাইতে চাহিয়াছে। এতকাল পর্যন্ত শিকদার যে গীত-কথার জগতে বিচরণ করিয়াছে, তাহার মধ্যে কেবল এই সব দুঃখের ক্রন্দনটাই মুখ্য, কোনো দুঃখ হরণ দুঃখ মোচন মন্ত্র নাই; নানারকম বাদ বিবাদকে আশ্রয় করিয়া জগৎ জীবনের আসল সমস্যাগুলির সমাধানও আড়ালে পড়িয়া রহিয়াছে। অথচ সেইসব কথা, সেইসব সুর শিকদার যেন পাইয়াও পাইয়া ওঠে না। মনের কোণে এক একবার দূর দিগন্তের ঠাটা ঝিলিকের মতো দেখা দিয়া আবারও তা বিশাল ভুবনে মিলাইয়া যাইতেছিল। দিন কয়েক অনর্থক নানা চেষ্টা করিয়া সে সমস্ত পুথিপত্র, সব বাদ্যযন্ত্র আবারও সরাইয়া রাখিল। তাহার ক্রমাগতই মনে হইতে লাগিল ক্ষুদ্রের মধ্যেও যে আনন্দ, সামান্যের মধ্যেও যে সন্তুষ্টি তাহার মধ্যেও তো কত জীবন-কথা। সেই কবির দলে তালিম দিবারও সময় এক অতি বড়ো কবি, শিক্ষিত ভদ্রজনের মুখে একটি গান শুনিয়াছিল, তাহার প্রতিটি পদ এখনও সে অবিকল মনে করিতে পারে, স্বয়ং কবি আবদুল করীমের সংগ্রহের গান, তাহারই গলার অপরূপ সুর করিয়া গাওয়ার ধরনটাও তাহার এক সময় খুবই ভালো লাগিয়াছিল। সেইরকম সাধারণ, অতিসাধারণ বিষয় লইয়াও কেন সে গীত বাঁধিতে পারে না?

নিজের হাতে বোনা একছড়া ঝাঁকিজাল কাঁধে লইয়া খালের দিকে চলিয়া গেল শিকদার। এমন বড়ো বিশাল ভুবনে কেবল কি দুঃখটাই সত্য হইয়া আছে? জীব-জীবনে, সময় সময় দৃশ্যেরও সঙ্গোপনে কত লীলা, কত আনন্দের অবকাশ, সেই মুহূর্তগুলিও কী সে দেখিয়াও দেখে নাই? মনে পড়িল একবার ঘঘারতর বন্যার সময় সেই শহর প্রান্তে এক অখ্যাত বয়াতিকে গাহিয়া উঠিতে শুনিয়াছিল :

এইবার জুত্তা জোড়া ছুটি পাইছে–
পারে না কেউ পরিতে
দাওয়াত দেও নাই তবু দেখো
পানি উঠছে অসিয়া বাড়িতে।

শিকদার বড়ো মজা পাইয়াছিল, মুগ্ধ হইয়াছিল। একই সঙ্গে রসিকতা এবং মানুষের বিপদ মোকাবেলার একটা সবল মনোভাবই যেন তাহার সেই গানে ফুটিয়া উঠিয়াছিল। শিকদার অন্যত্র যাইতেছিল, তাহার সঙ্গে পরিচয় অথবা সেই গীতের সমস্তটুকুও শোনা সম্ভব হয় নাই। সেই গায়ক থৈ থৈ করা বন্যার মধ্যে একটা উঁচা গাছের তলায় বসিয়া যেন আপন মনেই সেই পদগুলি মুখে মুখে বানাইয়া লইতেছিল, মাঝে মধ্যে কোলের দোতারায় অকস্মাৎ কিছু ঝঙ্কার তুলিয়া। শিকদারের কেবলই মনে হইতে লাগিল, গীত-গান, কাব্য কর্ম এমনকী সমস্ত আনন্দ ধর্মও যেন কোনো একক বস্তু নয়, একক সৃষ্টি নয়, অনেক মানুষ একসাথে হইয়া হয়তো সব দুঃখকেও অতিক্রম করিতে পারে।

সে কয়েকবার জাল ফেলিয়া কিছুদূর আগাইয়া গিয়াছে, এমন সময় পিছনে মনসব সর্দারের হাক শোনা গেল : এই কবিয়াল, হায়-হায়, খালে বুঝি আর একটা মাছও রইল না।

তাহার ঠা ঠা হাসির জোড়ে শিকদার সংকুচিতভাবে দাঁড়াইয়া পড়িল। মনসব সর্দার হাতের খালুইটা নাড়াচাড়া করিয়া বলিল : ভালোই হইল, এই রকম গুড়া মাছ আমার ঘরেও খুব পছন্দ।-বলিতে বলিতে ফট করিয়া একটা বুনা কচুগাছের পাতা ছিঁড়িয়া প্রায় সবগুলিই তাহার উপর ঢালিয়া লইল।

: যাইতে আছিলাম এইদিক দিয়া এস্টাটের নানা রকম কামকার্যের জন্য কিছু লোকজনের দরকার। মনে ইচ্ছা হইল, এই ফাঁকে তোমারও খবর লইয়া যাই। কী রকম আউগাইতে আছে?

শিকদার কী উত্তর দিবে ভাবিয়া পাইল না। এক সময় কেবল বলিতে চাহিল; চেষ্টায় আছি। দুঃখের কথা ছাড়া কোনো আমোদ-উৎসবের লজ যেন আর মুখেও আসতে চায় না।

মনসব সর্দার একটুকাল তাহার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া অন্তরঙ্গ হইতে চাহিল : কবি, ওইখানেই তো তোমার সমস্যা। একটা মাইয়া-মানুষের জন্য তুমি তোমার এমন গুণ, এমন জীবনটারে এক্কেবারে নষ্ট করিয়া দিতে আছ দেখিয়া দুঃখ হয়, রাগও হয়। কিছুতেই মনরে বুঝাইতে পারি না, দশজনে যা কয় সেই কথাটাই সত্য। তাও যদি হয়, তুমি কও আমারে, আমি সেই মাইয়াটারেই আনিয়া দি। আমার তো মনে কয় সেই মাইয়াটাও খুব সুখে নাই।

শিকদার একটু উৎসুক্য দেখাইল বটে, কিন্তু কোনো প্রশ্ন করিল না।

মনসব সর্দার চক্ষু নাচাইয়া ইঙ্গিত করিল গঞ্জের দিকে: এত বড়ো এস্টাট চালাইতে হয় আমারে, অনেক মানুষের সঙ্গে কারবার-সারবার। ওই নলসিঁড়ির ঘাটেই একদিন কিছু কথাবার্তা শোনলাম। সে যার ঘর করে সে গঞ্জে কী এক দোকান না আড়ত দিছে, আর সেইখানেই একটা বাজারের মাইয়া-মানুষ লইয়া থাকে। এই-ই হইছে এখনকার এক রীতি। যে-ই দুইটা পয়সার মুখ দেখে, তখনই পঙ্খির লাহান উড়াল দিয়া যায়, মৌমাছির লাহান মধু খুঁজিয়া বেড়ায়। দেখি তো, কোন ঘরে একটা মাইয়া-ছেইল্যা বাস্তবিকই সুখে শান্তিতে আছে?

শিকদার একটু অন্যমনস্ক হইয়া পড়িল। আবারও মনে হইল সেইদিন গঞ্জের ঘাটে নৌকার পর্দার আড়ালে হইতে জোবেদা কী কথা বলি বলি করিতেছিল। কিন্তু সে জোড় করিয়া সে-চিন্তা মন হইতে দূর করিয়া দিতে চাহিল, সে জীবন বদলাইবার সিদ্ধান্ত করিয়াছে, সেই বিষয়েই তাহাকে কৃতসংকল্প হইতে হইবে। তাহার সমস্ত চিন্তা-চারিত্রের একটি মাত্র সরলার্থই সকলে করিয়া রাখিয়াছে, সে শত চেষ্টা করিলেও কাহারোই ধ্যান ধারণা ভাঙিতে পারিবে না। একমাত্র উপায় নতুন ধরনের গীত-কথায় তাহাকে সাফল্যলাভ করিতে হইবে। আর তাহাও হয়তো কর্মের মধ্য দিয়া, সংগ্রামের মধ্যে থাকিয়াই তাহাকে আয়ত্ত করিতে হইবে। মুখ তুলিয়া হঠাৎ সে জিজ্ঞাসা করিল : সর্দার, একটা কাম আমারে জোটাইয়া দেওন যায় না?

মনসব সর্দার একটু অপ্রতিভ বোধ করিল : তোমার লাহান মানুষরে খাঁটিয়া খাওনের কাম কেমন করিয়া পোষাইবে। আমি তালাশে বাহির হইছি ভাটির দেশে হাল-হালুটিয়া কাম-কায্যের মানুষের জন্য। সেই যাগো ভিটা নাই, মাটি নাই, গায় গতরে খাঁটিয়া দুইমুঠ ভাত জোটানোর জন্য যাগো আর অন্য সাধ্য নাই, চারা নাই-সেই কাম তোমারে দিয়া হইবে না।

শিকদার মনসব সর্দারের হাসি আমলে না দিয়া বলিল : কেমন হইবে না সর্দার? আমার মনে কইতে আছে আমারও মনটা কেবল পুরাণ কথা আর পরান-কথার মধ্যে মজিয়া রইছে, আরও সত্য সঁচা কিছু দেখতে চাই, জানতে চাই, তা না হইলে এই জীবনের আর কোনো অর্থই খুঁজিয়া পাইতে আছি না। তুমি কও গীত বাঁধতে, কথা সাজাইতে, আমি এত চেষ্টা করি, তবু কোনো ভাব কোনো মিল যেন চতুর্দিকে আর খুঁজিয়া পাইতে আছি না। মনসব সর্দার একটুকাল তাহাকে নিরীক্ষণ করিয়া স্বভাবসিদ্ধ ঠা ঠা শব্দে হাসিয়া উঠিল : কীসের কোন মিলের জন্য যে তোমার এমন দুর্ভাবনা তা আমি বুঝিয়া উঠিতে পারি না। আমার ওই কথা এক কথা, কবি, এক তরতাজা মাইয়া-মানুষ কোলে লইয়া দেখো সব মিল কেমন সহজ সরল হইয়া যায়। মনে গোস্বা লইও না কবি। আমার পিরকিতি তো জন্যেই। কোনো মাইয়া-মানুষ মনে ধরলে আমি মর্দ কোনো হায়-হুঁতাশের মধ্যে নাই। একদিন তারে মুরগির লাহান বগলদাবা করিয়া বাড়ি আনিয়া উঠাই। পেরথমে হেইগুলায় খুউব চিল্লায় চেঁচায়, কান্দে-কাটে, অমত করে খুউব, শেষমেষ কয়েকদিন যাইতে না যাইতেই গলার উপর থেকিয়া তাগো হাতের বেড় সরাইয়া ছাড়াইয়া কাম-কায্যে যাওনও শক্ত হইয়া ওঠে। ওই একটা মিল হইলে সকল মিলই সহজ হইয়া যায়।–মনসব সর্দার শরীর দুলাইয়া হাসিতে লাগিল।

শিকদারের পিতামহ করমালীর সম্মুখে পড়িলে তাহাদের মধ্যে হয়তো একটা যুদ্ধই বাঁধিয়া যাইত। করমালী কেবলই এই দেহ ধারণ, এই জগৎ সংসারের উপরেই সমস্ত দুঃখের কারণ আরোপ করিত। একমাত্র পিতামহী আর তাহার পিতা করমালীর সেই সব বাড়াবাড়ি পছন্দ করিত না।

পিতামহী সেই শৈশবকালেই বলিয়াছিল : যে বয়সের যা ধারণ। দেহের জোর-এর ঘাটতি পড়লেই নানারকম ফিকির-জিকির দেখা দেয়! কানু, তোর গলাটা সুরাল, কিন্তু এই এমন কাঁচা বয়সেই আউগাইয়া আউগাইয়া বুড়া হইয়া যাইস না।

কিন্তু যে জিনিসটা শিকদারকে সেই গান-গীতের ভুবনের মধ্যে টানিয়া লইয়া গেল তা কেবল করমালীর আগ্রহই নয়, শিকদারও যেন নিত্যদিনের দুঃখ কষ্ট, জ্বালা-যন্ত্রণার নাগাল হইতে মুক্তি লাভ করিয়া সকলের সঙ্গে সমবেতভাবে অন্য কোনো ভুবনে চলিয়া যাইত। কেমন সেই ভুবন, তা কখনও জানে নাই, দেখেও নাই, কিন্তু রোমাঞ্চিত হইত। আসরের পর আসরে চতুর্দিকে সকলের উপস্থিতি, কলকণ্ঠ অথবা বিমুন্ধিতে যেন তাহারও মনে করমালীর মতোই ভাবাবেশ আসিয়া পড়িত। শিকদার সেইসব ভাবনা মন হইতে দূর করিয়া দিতে চাহিল, মনসব সর্দারের দিকে ফিরিয়া বলিল : নাহ্ সর্দার, কথাটা একেবারে উড়াইয়া দিয়েন না। আমি বাস্তবিকই এই জীবন বদলাইতে চাই।

মনসব সর্দারের হাসি থামিয়া গেল; সে নিজের পথে পা বাড়াইবার উপক্রম করিয়া বলিল : সে তো খুবই উত্তম কথা। তুমি, যেমন কইছি, এখন বড়োমিঞারে তুষ্ট করার উপায় দেখো, এই মুলুকে তোমার ভাতের অভাব হইবে না। আমি এখন ওই ভাটিতে এক চালান রওয়ানা করিয়া দেওনের কায্যে ব্যস্ত আছি। যাইতে চাও যাও, একবার ঘুরিয়া দেখিয়া আসবা। সেই মুল্লুক সহজ না, সেইখানে জীবনের জন্য সর্বক্ষণ যুদ্ধ করতে হয়, একহাতে ঠেকাইতে হয় রুষিয়া-ফুসিয়া ওঠা সমুদুরকে, আর অন্য হাতে দৈত্য-দানবের গুষ্টির লাহান ঝড় তুফানরে। একটু বিশ্রাম লইবারও যেন ফুরসত হয় না।

শিকদার আর পীড়াপিড়ি করিল না। অথচ মনে মনে তখনই স্থির করিয়াছিল সে আর মানুষের মন যোগাইবার জন্য ভাব-তত্ত্বের গান গাহিয়া বেড়াইবে না। যে-জীবন, কে ঐশ্বর্যকে জানে নাই, তাহার মধ্যেই একবার ঝাঁপাইয়া পড়িয়া দেখিবে। সেখানেও তো মানুষ আছে, জনতা আছে, কেবল নতুন গীত-কথা নয়, হয়তো তাহার এবং হোসেনেরও ভবিষ্যৎ গঠনের একটা সুযোগ মিলিয়া যাইবে।

মনসব সর্দার চলিয়া যাওয়ার পরেও সেই ভাটির মুলুকের কথা বারংবার ঘুরিয়া ফিরিয়া মনে আসিতে লাগিল। যায় নাই সে কখনও সেইদিকে, সেইখানকার কথাকাহিনি বর্ণনা কেবল লোকমুখেই শোনা। সেই শৈশবকাল হইতে গাঙপাড়ে দাঁড়াইয়া দেখিয়াছে প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড নৌকাগুলি নানারঙের পাল উড়াইয়া ভাসিয়া চলিয়াছে। এক একটা নৌকার পিছনে শক্ত হাল ধরিয়া মাঝি সম্মুখে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া খাড়া, ছইয়ের উপর অবলীলায় হাঁটা চলা করিতেছে মাঝি-মাল্লা, গলুইর পাটাতনে অন্যান্যদের কাজকর্ম, শীতের সময় নামিয়া গিয়াছে দক্ষিণে, আবার গ্রীষ্মের শেষে যেন প্রায় ডুবুডুব অবস্থায় হামাগুড়ি দিয়া উঠিয়া আসিয়াছে উপরে : মাস্তুলে মোটা দড়ির গুন বাঁধিয়া পাড়ের কাদা, ঝোঁপ-জঙ্গল পার হইয়া চলা মাল্লাদের সে সম্ভমে পথ ছাড়িয়া দিয়াছে। সেই সব মানুষের ঘন কালো দেহগুলি প্রখর রৌদ্রে যেন পাথরের মতো ঝলকাইয়াছে। মানুষের জীবন বদলাইবার জন্য ওই দিকমুখি হওয়া। ছাড়া যেন আর কোনো গত্যন্তর নাই। আর, শিকদার অকস্মাৎ বেশ একটু বিস্ময়ের সঙ্গে খেয়াল করিল অন্যতর জীবনের আগ্রহ রহিয়াছে বলিয়াই জগৎ-সংসার চলিতেছে।

এক সময় ঘাট-মাস্টারের কথাও মনে পড়িল। তাহার এবং হোসেনের সঙ্গে কিছু কিছু কথাবার্তা বলিতে পারিলে শিকদার যেন অনেক শান্তি অনুভব করিত, একটা পথ পাইত, একটা অতি প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত লওয়া সহজ হইয়া উঠিত।

বাড়ির পথে ফিরিতে ফিরিতে দেখিল একটা কড়ইগাছে অজস্র বাবুই পাখি বৈরি হাওয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া করিয়া তাহাদের বাসাগুলির পরিচর‍্যা করিতেছে, এক বাড়ির গৃহিণী যত্ন করিয়া লইয়া দিতেছে সবজির লতা ঘরের জীর্ণ চালের উপর, কোথাও হইতে কানে ভাসিয়া আসিল ঘেঁকির শব্দ, কেউ কাক-চিল তাড়াইতেছে তাহাদের অঙ্গন হইতে। যেই দিকেই তাকাইল, জীবন কোনখানে স্তব্ধ হইয়া নাই; কোথায়ও কোনো কিছুই অসার কি অনিত্য বলিয়া মনে হইল না।

.

১৯.

আমি তো অবলা নারী হইলাম অন্তঃপুরা
কূল ভাঙিলে নদীর জলে মধ্যে পড়ে
চড়া।
বসিয়া কাঁদে ফুলের ভ্রমর উড়িয়া কাঁদে
কাগা
শিশুকালের পিরিত হইল যৈবন কালে
দাগা ॥
সুজন চিনিয়া পিরিত করা বড়ো বিষম
ল্যাঠা
ভালো ফুল তুলিতে গেলে অঙ্গে লাগে
কাটা ॥
ঘরের বাহির হইতে নারি, কুলমানের
ভয়
পিঞ্জরা ছাড়িয়া মন যে বাতাসে উড়ায় ॥
কত করিয়া বুঝাই পঙ্খি না মানে সে
মানা
ভরা কলসি হইলরে বঁধু দিনে দিনে
উনা ॥

জোবেদা বাস্তবিকই আদৌ কোনো সুখের মুখ দেখে নাই। দেশের আরও অসংখ্য ঝি-এর মতো তাহারও যখন বিবাহ হইয়া গেল, কিশোরী তরুণীর নানা স্বপ্ন-কল্পনা লইয়া নিজ স্বামী সংসারের যে-আকাক্ষা করিয়াছিল, বাস্তবে তাহার কোনোই মিল পায় নাই। অথচ কোনো উপায় অথবা নিজ দুর্দশা হইতে মুক্তিরও সে কোনো পথ পাইতেছিল না।

শিকদারকে যখন মুহূর্তকালের জন্য গঞ্জের ঘাটে দেখিল, ইচ্ছা হইয়াছিল বটে অনেক কিছু, অজস্র কিছু তাহাকে বলে, কিন্তু পিছনে ছিল শাশুড়ি, তার স্বামী আসগরউল্লাও যে-কোনো মুহূর্তে আসিয়া উপস্থিত হইতে পারে, সেই ভয়ে সে পর্দার উপর হইতে হাতখানি সরাইয়া লইয়াছিল। শিকদারকে আর দেখা গেল না বটে, কিন্তু সেও নতমুখ হইয়া রহিল।

শাশুড়ি-স্বামীর ইচ্ছা মতো ফকির-দরবেশ-ওঝাদের ঘাটে ঘাটে ঘুরিয়া অজস্র রকম লাঞ্ছনা-গঞ্জনা-অপমান সহ্য করিয়া সে কেবলই একটা চরম মীমাংসার জন্য প্রস্তুত হইতেছিল। বিশেষ করিয়া যখন খেয়াল করিল যাহাদের নানারকম তুকতাকের উপর শাশুড়ি ও স্বামীর অগাধ বিশ্বাস, তাহাদের কাছেও সে যেন একটা মজার পুতুলে পরিণত হইয়াছে। তাহাদের রীতি-নীতির বিষয়ে শাশুড়ির কাছে মুখ ফুটিয়া কিছু বলিবার আগেই সে জ্বলিয়া উঠিল : অলক্ষণীয়া বেলেহাজ মাগি এইসব রীতি-প্রকৃতির তুই কী বোঝস? একটা লবজ উচ্চারণ করলেও পাপে তাপে তোর জিহ্বা খসিয়া পড়বে। সন্তান চাই, বংশ জিয়াইয়া রাখতে হইবে। আমি অন্য কিছু বুঝি না। এইবারটা দেখিয়া লই, এবারও কিছু না হইলে মনের মতো বউ আনিয়া ঘরে উঠামু। তোরে লইয়া আমি একটা দিনেরও সুখ পাই নাই। পোলাটারেও আর ঘরমুখি রাখতে পারস নাই। চুপ চুপ। সবই তোর মানিয়া চলতে হইবে।

স্বামী আসগরউল্লার কাছেও কোনো কথা উঠাইবার সুযোগ হইল না। একান্ত নিজস্ব প্রয়োজন ছাড়া সে কখনও তাহার কাছে আসে না, কখনো . কোনো কিছু বলেও না। মাঝে মধ্যে মনে হইয়াছে কখনও কোনো শব্দ তুলিতেও সে ভয় পায়; এই বিবাহটা যেন সে কেবল মা-কে খুশি রাখিবার জন্যই করিয়াছে, তাহাকে দেখাইবার জন্যই তাহার স্বামী-কর্তব্য করিবার চেষ্টা করিতেছে। জোবেদা তাহাকে কিছু বুঝাইতে গিয়াও ব্যর্থ হইয়াছে, বরং আসগরউল্লাও অহেতুকভাবে তাহার উপর শাসন ও কর্তৃত্বের মাত্রা বাড়াইয়া দিয়াছে।

পিতৃকুলের মধ্যেও তখন আর এমন কেউ ছিল না, যাহার কাছে আশ্রয় লইতে পারে। যাহারা ছিল, তাহাদের কাছে কিছু বলিলেও কেবলই শুনিতে হইয়াছে, পরের বাড়িতে মেয়েদের অমন একটু-আধটু অসুবিধা হয়ই; আরও বলে ‘পর’-এর বাড়িকে আপন করিয়া লওয়ার মধ্যেই তো কৃতিত্ব, নারীজন্মের সাফল্য। বেশি খামখেয়ালি কি তেজ দেখাইয়া কোনো কন্যাই কখনও কোনো সংসার সুখের করিতে পারে নাই।

বিবাহিত জীবনের কয়েকটি বছরের মধ্যে সে চক্ষু তুলিয়া চারিদিকে চাহিয়াও দেখে কেবলমাত্র একটা উদ্দেশ্যে তাহাদের ব্যবহার ব্যতীত অন্য কোনো মূল্য নাই। আকাশে-বাতাসে কী যে আছে, পুঁই উঁটার মতো তরতরাইয়া বাড়িয়া উঠিবার আগেই সব নিয়ম সব আচার সব ব্যবস্থা যেন মট মট করিয়া ভাঙিয়া ফেলিতে উদগ্রীব সকলে। পিতৃকুল নানারকম বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়িয়া যায়, ঘরের কন্যাকে অধিককাল অবিবাহিতা রাখাও কাহারও পক্ষে সম্ভব হইয়া ওঠে না। জোবেদা তেজ দেখায় নাই, কোনো অনর্থ-অসন্তোষ সৃষ্টি করিতে চায় নাই। কতকগুলি সহজাত বাস্তববুদ্ধি দিয়া সে শিকদারের প্রতিও উপেক্ষা দেখাইয়াছে। অথচ একমাত্র সেই শিকদারই জগৎ জীবন প্রকৃতি এবং নারী সম্বন্ধে কত বিমুগ্ধের মতো গীত কথা শুনাইয়াছে। এক এক সময় নিরালা আমবাগান অথবা বাঁশঝাড়ের ধারে বসিয়া তাহার কথা শুনিতে শুনিতে কী এক আনন্দে, কী এক গর্বে ভরিয়া উঠিয়াছে বুক। সব কথা সে বুঝিত না, কিন্তু মনে হইত একটি কন্যার কামনা ব্যতীত তাহার মনে আর কোনো ধ্যান নাই, বাসনা নাই। আবার সেই কারণেই তাহার প্রতি একটা অবজ্ঞা আর উপেক্ষার ভাব ক্রমাগতই তাহার মনে সঞ্চিত হইয়া উঠিতেছিল। সনাতন সংজ্ঞা যে পুরুষ ও পৌরুষের, তাহার সহিত কোনো মিল খুঁজিয়া পাইত না সেই শীর্ণদেহী স্বল্পভাষী লোকটির মধ্যে। জীবনের সঙ্গে সকলেই যখন যুদ্ধে যুদ্ধে পরিশ্রান্ত, ক্রমাগত সংগ্রাম ছাড়া যাহাদের মুখে আর কোনো বাণী নাই, কোনো আচরণের মধ্যে যাহারা কখনও পরাজয় অথবা হার মানিয়া যাওয়ার মনোভাব দেখায় না, সেইসব পুরুষের তুলনায় সে তাহাকে কখনও বড়ো করিয়া দেখিতে পারিত না; গুরুজনদের নানা বাক্য এবং পরামর্শ সে উপেক্ষাও করিতে সক্ষম হয়। নাই। বিবাহ যখন স্থির হইয়া গেল, তখনও তাহার মনে আশা ছিল, শিকদার আসিয়া সব উলটাইয়া-পালটাইয়া দিবে। নানারকম রূপ-রস-কথায় তাহার পরিপূর্ণ দেহমন অন্য কোনো অবধারিত সত্য উপলব্ধি করিতে পারে নাই।

এখনও পারে না। তবু ইচ্ছা হইয়াছিল, শিকদার আগাইয়া আসুক, বলুক তাহাকে কোনো কথা, কিংবা কোনো কথাও নয়, কেবল হাত বাড়াইয়া আহ্বান করুক তাহাকে, জোবেদা সব অগ্রাহ্য করিয়া তাহার সেই হাত আকর্ষণ করিয়া উঠিয়া যাইত। স্বাধীন স্বকীয় জীবন-যাপনের নামে সেই বন্দিনীদশা সে আর সহ্য করিতে পারিতেছিল না। মৃত্যু, একমাত্র মৃত্যু ব্যতীত তাহার কাছে অন্য কোনো উদাহরণ পথ বর্তমান বলিয়া মনে করিতেছিল না।

কেমন সেই পুরুষ যে ভুবনকেও দেখে কোনো রজস্বলা রমণীর মতো, শীতে-গ্রীষ্মে, শরতে-হেমন্তে কেবলই তাহার কোনো বন্ধুর বেশ, যাহার সারা দিনমান কামকলা ব্যতীত আর কোনো কর্ম নাই, অভীষ্ট নাই, সেই পুরুষকে জীবন যৌবন সমর্পণ করিতে কোন কন্যাই বা চাহিবে। জোবেদা কন্যা-স্বরূপ সচেতনতার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝিয়া উঠিতেছিল যে সংসার বড়ো কঠিন ঠাই, সেইখানে ক্রমাগত পৌনঃপুণিক নিয়মের মধ্যেই হৃদয়াবেগকে শাসন করিয়া, সংযত করিয়া লইতে হইবে।

অথচ, আর পারতেছিল না।

শাশুড়ি বুঝাইতে চাহিল : আমি এই গৃহের কী। যুগ-যুগান্তর ধরিয়া আমার কর্তব্য আর শিক্ষার মধ্যে একটা সত্যই বড়ো। বউকে ফলবতী হইতে হইবে, পুত্রবতী হইতে হইবে। গৃহস্থের মঙ্গল, গৃহস্থের সুখ, তাহার সমৃদ্ধি কেবল সেই একটি উপায়েই চতুর্দিকে মেলিয়া ধরন যায়।

জোবেদা চেষ্টার ত্রুটি করে নাই, অযাচিতা হইয়াও স্বামী সংসর্গ যাঞ্চা করিয়াছে, আসগরউল্লাহকে আর ঘন ঘন বাড়িতে আসিবার কলা কৌশল প্রয়োগ করিয়াছে, কিন্তু জীবন বদলায় নাই।

এক সময় মনে হইয়াছে তাহার সমস্ত শৃঙ্গার সমস্ত আগ্রহ আসগরউল্লাহর কাছেও কোনো করুণার বিষয় হইয়া পড়িয়াছে।

অগত্যা, জোবেদা নিরাশ হইয়া পড়িয়াছিল, ক্রমাগত নিঝুম নির্বাক হইয়া উঠিতেছিল; সেই সময় সমস্ত ফেরেববাজ ওঝা-ফকিরের উপরেও সে আরও কঠিন কঠোর হইয়া উঠিল। তাহারা কখনও আভাসে-ইঙ্গিতে, কখনও জটিল দুর্বোধ্য ভাষায় আসগরউল্লা এবং তাহার মা-কে জানাইয়া দিতে চাহিল : কেবল সংসারে নয়, জীবনে দুর্ভিক্ষের জন্যই তাহার মতো রমণীর আবির্ভাব ঘটিয়াছে, তাহাকে উপযুক্ত রকম হেদায়েতের জন্য গোরুর দারোগাকে আরও দুইটি গোরু, ছাগলের দারোগাকে আরও পাঁচটি ছাগল, ধান-চাউলের দারোগাকে আরও দশ মন ধান, এবং ফি পুন্নিমায় তাহাদের মহফিলে হাজির থাকিয়া সমস্ত গুনাহগারির জন্য ক্রিয়া-কর্ম করিতে হইবে। শাশুড়ি এবং স্বামী দুইজনেই মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িয়াছিল; অবস্থা যতই ভালো হউক, সেই সাধ্য তাহাদের ছিল না; স্বয়ং জোবেদাও সমস্ত কিছুর উপর বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছিল।

কেন এই জীবন রাখা, কী ইহার অর্থ? কী জিনিস সুখ-শান্তি? কীসের মূল্য এই জীবন যৌবনের যদি সমস্ত রকম কর্মকাণ্ডের প্রতি বাস্তবিক বোধোদয় না হইল? জোবেদা শিকদারকে কখনও বুঝিয়া উঠিতে পারে নাই, সাধ্যও ছিল না; সে কেবলই গুমরাইয়া মরিতেছিল। সেই প্রথম কৈশোরকালে একবার গুরুজনদের তিরস্কার শুনিয়া সে কেবলই একটা সমাধান খুঁজিয়া চাহিয়াছিল, কেন বিধাতা নর এবং নারীকে এমন পৃথক করিয়া সৃষ্টি করিলেন? তাবৎ জগৎ-সংসার যে কেবল পরস্পরের সৃষ্টির আগ্রহবশতই সর্বত্র ঘুরিয়া চলিতেছে, সেই বিশ্বাসকেও সে একমাত্র সত্য বলিয়া মানিয়া লইতে পারিতেছিল না।

শাশুড়ি সেই একটা বিষয় ছাড়া অন্য কিছু বুঝিত না, শুনিতেও চাহিত না। তাহার মতে বিশ্ব-ভুবনের সর্বত্র ওই একটি লীলাখেলাই সত্য তাহারই জন্য আজন্ম প্রস্তুতি, আমরণ কর্তব্য, বাহিরের যা-কিছু অসার, অনিত্য এবং মিথ্যা। জোবেদার মনের অবস্থা এমন হইয়া উঠিয়াছিল সে মাঝে-মধ্যে পুকুর-ঘাটে সে নিজের নগ্ন অবয়বের প্রতিবিম্বের দিকে চাহিয়া নিজেকেই প্রশ্ন করিতে শুরু করিয়াছিল, কোনটা? বেশি সত্য, কোনটা? বাস্তবিকই তাহার রূপ-যৌবন, শ্রী অথবা হৃদয়, না তাহার শ্রীঅঙ্গ? জগৎ-সংসারে কোন মূল্যে কোন অস্তিতে সে সুখ শান্তি স্বস্তি বোধ করিবে।

কখনও চক্ষে পড়িত সম্মুখে ধু ধু করিয়া জ্বলিতেছে খেত-মাঠ, একটা কঠিন কঠোর আড়াল তুলিয়া আকাশও যেন রৌদ্রকে আরও রুদ্র করিয়া তুলিয়াছে, কোথাও হইতে ক্লান্ত ঘুঘুর ডাক যেন কেবলই তাহাকে স্মরণ করাইয়া দিতে চাহিতেছে যে যদি মিথ্যা বলিয়া কিছু থাকে তাহা হইলে প্রকারান্তরে সত্যকেই স্বীকৃতি দিতে হইবে। জীবনের ইচ্ছা আছে, আকাঙ্ক্ষা আছে, অতএব তাহার উদ্দীষ্ট এবং লভ্যও বর্তমান রহিয়াছে।

সেই রকম মনের অবস্থায় তাহার বারংবারই শিকদারের কথা মনে হয়। সেও যেন সারা জীবন ধরিয়া কী খুঁজিয়া চলিয়াছে, বলিতে চাহিয়াছে, অথচ তাহাদের দুর্লভ এবং ঘনিষ্ঠ ক্ষণগুলি কেবলই সাধারণ, অতি সাধারণ আলাপচারীর মধ্যে নিঃশেষ হইয়া গিয়াছে। সে যেমন বলিতে পারে নাই, তরুণী কুমারী জোবেদার পক্ষেও উপলব্ধির সাধ্য হয় নাই।

এমন পুরুষ-পৌরুষ কি বাস্তবিকই আছে এই জগৎ সংসারে যে কোনো ললিত গলিত কাব্য কথার ধার ধারে না, হঠাৎ-জাগা বৈশাখের রুদ্র ঝঞ্ঝার মতো সে সমস্ত কিছুই লণ্ডভণ্ড করিয়া দিতে উন্মত্ত? আছে কি বাস্তবিকই তেমন কোনো রমণী যে পৃথিবীর মতোই সর্বংসহা, পৃথিবীর মতোই আকুলি ব্যাকুলি অথবা ধৈর্যশীলা? মনে হয় শিকদার কেবলই জীবন আর পৃথিবীকে লইয়া কল্পনায় রূপারোপ করিয়াছে, যেমন চাহিয়াছে ঠিক তেমনটিই স্বপ্ন দেখিয়াছে, কখনও সাদামাটা বাস্তবকে সে গ্রাহ্য করে নাই, আরও সম্ভবত ক্রমাগতই তাহার ধারণাও অতীতে রহিয়া গিয়াছে।

শাশুড়ি কখনও তাহাকে একান্তে অথবা ভাবনায় মগ্ন থাকিতে দেখিতে পারে না; সমস্ত দিক-দিগন্ত ঝমঝম করিয়া সে ধমকাইয়া ওঠে : মাইয়া মানষের কোনো ধ্যানে বসনের নিয়ম নাই। সাধে কি আর চতুর্দিকে অমঙ্গল নামিয়া আসতে আছে? জন্ম দেওনের আগে বাপ-মা কি কোনো আদবলেহাজও শিখায় নাই?

অবশ্য সময় সময় তাহার বাক্য-বচন সমস্ত শালীনতার মাত্রা অতিক্রম করিয়া যাইত, অবলীলায় ক্রমাগত তাহার মুখে উচ্চারিত হইত সেইসব কথা যাহার মধ্যে বারংবার একটা সত্যই যেন স্পষ্ট হইয়া উঠিত যে সে স্বয়ং কোনো সুখ জীবনে পায় নাই। বড়ো মায়া লাগিত তাহার জন্য মাঝে-মধ্যে। অজস্র গালিবৃষ্টি উপেক্ষা করিয়া সে খুশি করিবার জন্য ব্যস্ত হইত। আসগরউল্লার জন্যও সে আকুলি-ব্যাকুলি হইয়া অনেক কিছু করতে গিয়াছে। কিন্তু ফল হইয়াছে বিপরীত; সে তাহাকে আরও বিধ্বস্ত করিবার জন্য উন্মত্ততা দেখাইয়াছে।

শাশুড়ি কেবলই নালিশ জানাইত কখনও পরোক্ষে, কখনও প্রত্যক্ষে : এই মাইয়া-মানুষ সহবত শেখে নাই, গুরু বুজর্গদের মান্য করিতে জানে না। নিয়ম করিয়া হেদায়েত করতে করতে হয়তো একদিন এর শুভবুদ্ধির উদয় হইবে। এর মধ্যে গোরুর দারোগাকে

জোবেদাও দৃঢ় সংকল্প হইয়া উঠিতেছিল, কঠোরভাবে তাহাকে একদিন সেইসব দিনযাপনের ইতি টানিতে হইবে। একদিন সে নিশুতি রাত্রে নৌকা হইতে পাড়ের উপর উঠিয়া গেল।

তখন চতুর্দিকে ঘন অন্ধকার। উপরের আকাশে কতকগুলি তারা-নক্ষত্র যেন শৈশব-কৈশোরের বর্ণমালা দিয়া তাহাকে পথ দেখাইয়া দিতে লাগিল। আকাশ সেই একই রকম, বাতাসেও যেন ভাসিয়া আসিল কোন অভয়। জোবেদা, কোনো দিক নির্দিষ্ট না করিয়াই জীবনের মধ্যে ঝাঁপাইয়া পড়িল।

.

২০.

আবার কি আসিবারে মাঝি
এই ঘাটে নাও লইয়া
দিবস রাতি রইমু আমি
তোমার পন্থ চাইয়া।
আমি পল গুনিমু, পহর গুনিমু
গুনিমু দিনের পর দিন
আমি আর কেশ না বান্ধিমু
নিন্দও না যাইমু
হইমুনা বসনে রঙিন
আমি কেমনে কাটাইব কাল
কইয়া যাও মোরে
তুষের অনলের লাহান পরান
ঘুষিয়া ঘুষিয়া পোড়ে।

আরও একটা দিন হোসেন থাকিয়া গেল বটে, কিন্তু মেহেরজানের তেমন আর কোনো উত্তর পাইল না; সে যেন আরও দূরে দূরে কোথাও নিজেকে গুটাইয়া রাখিয়াছে, সারা দিনমানে তাহার আর দেখা না পাইয়া অন্তত সান্ধ্যাহারের সময়ও কোথাও না কোথাও তাহার উপস্থিতি টের পাইবে আশা করিয়াছিল; একটু ইতস্তত করিয়া হোসেন মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিতে গিয়াও থামিয়া গেল।

তাহার মা কেবলই বলিতেছিল : এত ছিদ্দত করিয়া আপন চোখেই তো দেখিয়া গেলা সব। আছি তো এই জঙ্গলের মধ্যে, আসমানে শকুন, বাইরে শিয়াল, এমনই ঘটনা দাঁড়াইয়াছে যে সর্বক্ষণ সন্ত্রস্ত থাকতে হয়। নানা কুলোকের চৌখ সবসময় চতুর্দিক হইতে ঘিরিয়া রাখছে। কতজনে কত প্রস্তাব দেয়, আভাসে ইঙ্গিতে কী না বুঝাইতে চায়, আমরা ডরে মরি। এ কয়দিন তুমি আছিলা, কেউ তেমন সাহস করিয়া আউগায় নাই। এখন ভরসা কেবল আল্লার উপর। এই সব দেশে সেই বিশ্বাসটাকেই বড়ো করিয়া দেখন ছাড়া আমাগো আর গতিক নাই।

হোসেন সাধারণত আহারপ্রিয়; সাধ্যে যা কুলাইয়াছে তেমন কোনো ব্যঞ্জনের ত্রুটি ছিল না, কিন্তু সে তেমন কোনো আগ্রহ বোধ করিল না। নৌকা ঠিকঠাক করিয়া আসছি। শেষ রাত্তিরের জোয়ার লাগলেই ভাসিয়া পড়মু, কয়েকদিন আপনাগো উপর বড়া উৎপাত করিয়া গেলাম।

ছবদারের স্ত্রী সেই কথা উড়াইয়া দিতে চাহিল : ছি, সেই কী কথা বাজান, কইছিলাম না তোমারে আল্লাহ জুটাইয়া দিছে। আমাগো বড়ো উপকার করিয়া গেলা। জাফর মন খারাপ করিয়া শুইয়া পড়ছে, ঘুমাইয়া পড়ছে না খাইয়াই। তোমারে কেন যাইতে বারণ করতে পারে নাই, সেই কথা লইয়া কী বচসা হইছে দুইজনে। বোধ করি মেহেরজানও তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমাইয়া পড়ছে। এত দূরের পথে যাবা বাজান, এখন তুমিও সকাল-সকাল একটু শুইয়া ঘুমাইয়া লও। আমার চোখে তো তেমন ঘুম আসে না, পুবের আসমানে হলক লাগতে না লাগতেই তোমারে উঠাইয়া দিমু।

: না চাচি, সেই সবের আর দরকার নাই। মাঝির কাম করি তো, এই যাত্রা করবার বিষয়টা কক্ষনোও তেমন কোনো আনন্দের বিষয় বলিয়া মনে হয় না। তায় জাফর উঠিয়া পড়লে আমারও যেন বৈঠায় হাত উঠবে না। আমি যাই চাচি, এখনই বিদায় লইয়া যাই।

জাফরের মা একটুকাল নীরব থাকিয়া বলিল : ছি বাজান, যাই কইতে নাই, বলল আসি। চিনিয়া জানিয়াই তো গেলা সব কিছু। ওই আশপাশের বাড়ির দুষ্টুলোকেরা চড়াও হইয়া পড়ার আগেই যেন আবার তোমার দেখা পাই, যদি নিজে আসতে নাই পারো, সংবাদ পাঠাতে ভুল করিও না।

জাফরের মা-ও এক সময় সরিয়া গেল বটে, কিছুক্ষণ পরে ঘরের মধ্যে তাহারও আর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না; মনে হইল মেহেরজানকে দুই একটা কী কথা জিজ্ঞাসা করিয়া সেও শয্যায় গড়াইয়া পড়িয়াছে।

রাত্রি বাড়িয়া চলিল প্রহর হইতে প্রহরে, কোথাও হইতে বুনা ফুলের উষ্ণতা, গন্ধ, অন্ধকারের সঙ্গে মিশিয়া ছড়াইয়া পড়িতে লাগিল আরও ঘন হইয়া, মনে হইতে লাগিল বারংবারই যে তাহার সঙ্গে যেন মেহেরজানেরও দেহ সৌরভ ভাসিয়া রহিয়াছে, তা সে যতই দূরে দূরে থাকুক। নানারকম পুরাণ কথা শোনা মন, পরান কথার প্রত্যাশা করে। বীতন্দ্রি শয্যায় সে কেবলই সতর্ক রহিল, এই বুঝি মেহেরজান কোনো সুযোগ পাইয়া কেঁওয়ারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। হয়তো তাহার বিপুল শরমজড়িত তবে হাতিনার পৈঠার উপরেও বাড়াইয়াছে। যদিও তেমন কিছুই ঘটিল, কিন্তু হোসেন কেবলই ভাবিয়া চলিল যে তেমন হইলে হোসেনও এই যাত্রার জন্য আর কোনো ক্লেশ বোধ করিত না। মেহেরজানের সৌগন্ধভরা দেহটি হোসেন সর্বাঙ্গ দিয়া আপন করিয়া লইবে, তাহারও সব ভাবনা দূর করিয়া দিতে চাহিবে, আর মনে হইতে লাগিল যে জীবন-যুদ্ধের জন্য একটা শুভ উদ্দেশ্য চাই, প্রিয়জন পরিবৃত গৃহ সংসার না থাকিলে সেই যুদ্ধও ক্লান্তিকর হইয়া পড়ে, আর তাহাতে পরাজয়ের সম্ভাবনা যেন আরও অধিক হইয়া ওঠে। সে বাস্তবিকই অত্যন্ত আকুলভাবে মেহেরজানের সঙ্গে কিছু অন্তরঙ্গ সমঝোতার প্রত্যাশা করিতেছিল।

এক সময় পাখপাখালির কিচির-মিচির শোনা গেল উঠানের পাশের আম জামের ডালপালার মধ্য হইতে। হোসেন পুবের দিকে মুখ বাড়াইয়া দেখিল উষার হলক’ দেখা দিতেছে। ঘরের ভেজানেনা কেঁওয়ারের দিকে এক নজর তাকাইয়া হোসেন উঠানে নামিয়া যাইতে গিয়াও দাঁড়াইয়া পড়িল। হাতে একটা ছোটো পুঁটলি লইয়া ধীরপদে মেহেরজান নামিয়া আসিতেছিল। কয়েক পা কাছে আগাইয়া মুখের আঁচলের আড়াল হইতে মৃদুস্বরে কেবল বলিল : মা-য় সঙ্গে দেওনের জন্য তৈয়ার রাখছিল। কিন্তুক এখন যেমন ক্লান্তি লইয়া শুইয়া পড়ছে তাতে উঠাইতে মায়া হইল।

: তুমি, তুমি জাগিয়া ছিলা!

মেহেরজান সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না, হাতিনার খুঁটির কাছে আসিয়া পায়ের কাপড় আরও সংবৃত করিয়া লইল; তারপর মুখ নত করিয়া রহিল।

: আর তোমার দেখা পাইলাম না। একবার ভাবছিলাম ওই কাটা আঙুলটার বিষে কোনো জ্বর-জারিও হইল বুঝি। এখন কেমন বোধ করতে আছ? কই, দেখি, দেখি।

মেহেরজান ব্যাকুলভাবে এইদিকে চাহিল : ছি, ছাড়েন আমার হাত, তেমন কিছু হয় নাই, কোনো উদ্বেগ নাই।-মৃগশিশু যেমন কোনো উদ্যত পশুর কবল হইতে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে, প্রায় সেই একইভাবে সে প্রায় কাঁদ কাঁদ হইয়া অনুনয় জানাইল : আপনে এমন অবুঝ হইয়েন না। এমনিতেই আমাগো তেলেসমাতির শেষ নাই। আপনে যে কী চায়েন তা আমি বুঝি। কিন্তু আমার হাত-পা বাঁধা, আমার কোনো উপায় নাই। যায়েন আপনে, সুমায় মতো নিজের কামে রওয়ানা হইয়ে যায়েন। যদি পারেন আবার আসিয়েন, পথ তো চিনিয়া গেলেন, আমার ঠিকানা বদল হইবে না।

তাহার শেষ কথাগুলির মধ্যে যেন একটা প্রত্যয় অথবা আশ্বাসের সুর বাজিয়া উঠিল হোসেনের কানে। সে কিছুক্ষণ মেহেরজানকে বিহ্বলভাবে নিরক্ষীণ করিল।

: তুমি চাও আমি ফিরিয়া আসি?

মেহেরজান কোনো উত্তর দিল না ঘাড় ফিরাইয়া ঘরের কেওয়ারের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করিয়া মৃদুস্বরে তাড়াতাড়ি বলিল : পোলাপানের লাহান কথা জিগাস করিয়েন না। আর আমার উপর রাগও রাখিয়েন না। আরও বলি, এখন বড়ো বায়-বাতাস আর দেয়ই-বাদলের কাল। নৌকা লইয়া সাবধানে যাইবেন। বাজানের কাছে শুনছি, ওই দিকের গাঙে বড়ো বড়ো ‘ঘোলা’ আছে, হুঁশিয়ার থাকিয়া চলবেন।

হোসেন দৃষ্টি নামাইয়া কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল; এত কথা ছিল বুকে, কিন্তু অকস্মাৎ মুখে যেন কিছুই আসিল না পা-ও উঠিল না।

মেহেরজান একটু ইতস্তত করিয়া বলিল : নিয়ত করিয়া নামছেন, এখন আর পিছন ফিরতে নাই। হলক উঠিয়া আসছে, সকলে জাগিয়াও পড়বে, আপনের রওয়ানা হইতে আরও দেরি হইয়া যাইবে। চলেন, আপনেরে আমিই ঘাট পর্যন্ত আউগাইয়া দিয়া আসি। আশা করি, এর মধ্যে কোনো বাঘ আমারে ধরিয়া খাইবে না।

হোসেন শশব্যস্তভাবে মানা করিল : না, না, ঘাট অবধি তোমারে যাইতে হইবে না। তুমি যাও, ঘরে ঘুমাও গিয়া, মনে কয় তুমিও বোধ করি সারা রাত্তির একেবারেই ঘুমাও নাই। সকলের কাছে তুমিই আমার হইয়া বিদায় চাইও।

তবু কথা থাকিয়া যায়, কত বিষয় এমনকী আদনা কত কি জিনিসও একই সঙ্গে মনের মধ্যে গুমরাইয়া দুমড়াইয়া ওঠে, যে হন্যে কুকুরটা সেই বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে আশ্রয় লইয়াছে, যে কবুতরগুলি ঘরের চালের কোণায় কোণায় বকবকম করে যখন-তখন, যে ফড়িংগুলি কলমিফুলে লেজ দুলাইয়া দুলাইয়া প্রতি সকালের রীত-কৃত্য করে, যে গাছগুলি উঠানের ধারে মর্মর করিয়া ওঠে মধ্যাহ্নের বাতাসে, সমস্ত কিছুর সঙ্গেই এমন আত্মীয়তা হোসেন জীবনে আর কখনও বোধ করে নাই।

: মেহের।-প্রায় ধরা গলায় হোসেন আবারও কিছু বলিতে চাহিল : আমার এক বন্ধু আছে, কানু শিকদার তার নাম, কবিয়াল নামেই প্রায় ভুবনজোড়া তার খ্যাতি। সে কেবলই কয়, জীবন বড়ো সুন্দর, আর কেবলই মায়ায় ভালোবাসায় বাঁধা। আমি তার মতো করিয়া বলতে পারমু না অবশ্য, তবু বলি, সেই বন্ধনে যেমন সুখ আছে আবার কষ্টও আছে। তার সঙ্গে একটা পরামর্শ আমার জরুরি কর্তব্য হইয়া পড়ছে। কয়েকটা ক্ষেপ দিয়া কিছু রোজগার করতে হইবে সমূহ। তারপর, দেখবা এমন হইতে পারে তারে সাথে করিয়াই আবার তোমাগো এই মুলুকে আসিয়া হাজির হইছি। তুমি আর আসিও না। এইখান হইতেই হাসিমুখে বিদায় দেও।

মেহেরজান কাছাকাছি একটা বড়ো গাছের গুঁড়ির আড়ালে দাঁড়াইয়া দেখিল হোসেন আর কাল বিলম্ব না করিয়া নৌকার বৈঠা হাতে তুলিয়া লইয়াছে। দাঁতে আঁচল চাপিয়া সে যতক্ষণ তাহাকে এবং তাহার নৌকাটিকে দেখা যায় নিথরভাবে দাঁড়াইয়া দেখিল। হোসেন এবং তাহার সেই ক্ষুদ্র নৌকাখানি দৃষ্টির অন্তর্হিত হইয়া যাইবার পরও সেই গাছটির গুঁড়ির উপর ভর করিয়া বেশ কিছুক্ষণ নতমুখে দাঁড়াইয়া রহিল।

এমন সময় নিকট হইতে কাহারো গলা-খাকারির আওয়াজ পাওয়া গেল। মেহেরজান চমকিয়া দেখিল একটা ঝাড়-ঝোঁপের আড়াল হইতে প্রতিবেশী বসতির কালু গাজি বাহির হইয়া আসিতেছে। সে তাড়াতাড়ি মাথায় কাপড় তুলিয়া দিয়া বাড়ির দিকে পা বাড়াইতে ব্যস্ত হইল।

: শোনো মাইয়া।-কালু গাজি একরকম তাহার পথের উপরই নামিয়া আসিল : সব জিনিসই যার যার, খেয়াল-খুশি কিংবা ইচ্ছার উপর চলে না। কতকগুলি বিধি-বিধান মানিয়া চলতে হয় দশজনের মধ্যে থাকতে গেলে। এই যে ওই বেগানা লোকটা এতদিন তোমাগো বাড়িতে থাকিয়া গেল, তুমিও যে এখন তার জন্য এমন হাপুস-উপাস হইয়া পড়তে শুরু করেছ, এইটা দশজন জানলে যে কেলেঙ্কারির সীমা থাকবে না।

মেহেরজান কিছু বলিতে চাহিল। কিন্তু কালু গাজির দৃষ্টি লক্ষ করিয়া আবারও কাঁপিয়া উঠিল, তবু কথা গুছাইবার চেষ্টা করিল : ছি চাচা, অন্যায় তো কিছু করি নাই, কেবল পথের খাওয়নের পোঁটলাটা হাতে তুলিয়া দিতে নামিয়া আসছিলাম।

কালু গাজি সেইসব কথার প্রতি কোনো আগ্রহই দেখাইল না; মুখে একটা সহানুভূতিসূচক চুকচুক শব্দ তুলিয়া ধীরস্বরে বলিল : তোমরা যেন ইচ্ছা করিয়াই নিজেগো উপর একটার পর একটা মুসিবত ডাকিয়া লইতে আছ। ছবদারও আমার কোনো পরামর্শ কানে তোলে নাই। আমরা এমন ধারে থাকতে কোন দূর-মুলুকে উঠাইয়া দিলো তোমারে। আইজও তক সেই বুড়ার হাত ছাড়িয়া নিষ্কৃতি পাও নাই। এখন এইসব জানাজানি হইলে যে তার খাই আরও বাড়িয়া যাইতে পারে সেই খেয়াল আছে? এখন যদি ঝোঁপ বুঝিয়া কোপ দিতে চায়, তালাকের দুই তিন কী চার গুণ বাড়াইয়া দেয় তা হইলে উপায়টা কী হইবে, এ?

মেহেরজান ঘরে উঠিয়া যাইবার পথ খুঁজিল; আবারও মৃদুকণ্ঠে জানাইল : কোনো অন্যায় করি নাই, কেউ কিছু দেখে নাই!

কালু গাজি চক্ষু ছোটো করিয়া হাসিতে চাহিল : কেন, আমিও কী এমন মিথ্যা হইয়া গেলাম? আমি চোখ রাখতে আছিলাম, সবই দেখছি-বুঝছি, এখন যেমন করিয়া সব সামাল দেওন যাইবে সেই বিবেচনা তোমার বুদ্ধির উপরই ছাড়িয়া দিলাম। তোমার কেবল নিজের কথা ভাবলেই তো চলবে না। মা আছে, কাঁচা একটা ভাই আছে।

মেহেরজান একটু শক্ত হইয়া কালু গাজির দিকে একবার দৃষ্টি লইয়া বুলাইল; দেখিল সে যেন সাহস পাইয়া কোনো অনেকদিনের আশা লইয়া তাহার আরও ঘনিষ্ঠ চলিয়া আসিতেছে।

: ছি চাচা, এইসব কথা উঠাইয়া আপনার কী লাভ আছে? আপনার বাড় বাড়ন্ত ঘর-পরিবার আছে। ছোটোকাল হইতে আপনেরে তমিজ করিয়া চলতে তো আমি কোনো ভুল করি নাই।

কালু গাজি হাতের দা-এর ডগা দিয়া কিছুক্ষণ মাথার পিছন দিকটা চুলকাইল; তারপর তেরছা দৃষ্টিতে মেহেরজানের দিকে তাকাইয়া চাহিল : হ, দেখছি তো আমিও তোমারে সেই ল্যাংটাকাল হইতে, তবে এখন যে এমন ঐশ্বর্যে ভরিয়া উঠবা তা কখনও ভাবি নাই। দেখলা তো একজন দুইজন জগঞ্জন। আমার সঙ্গেও একটা সমঝোতা করিয়া লইলে এমন কী আর ক্ষতিটা হইবে, এ তবধ করো, তবধ করিয়া দেখিও।

সম্ভবত উঠানের দিকে তাহার মা-এর সাড়া পাইয়াই কালু গাজি তখনকার মতো সরিয়া গেল। মেহেরজানের ইচ্ছা হইল তাহার হাতের দা-খানি ছিনাইয়া লইয়া সে তাহার উপর ঝাঁপাইয়া পড়ে; কিন্তু হাতে কোনো শক্তি অনুভব করিল না আর, মুখেও কোনো কথা জোগাইল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *