বঁধুর রূপ দেখিয়া হইয়াছি পাগল
ঔষধে আর মানে না
চল সজনি যাই লো যমুনায়।
এই বঁধুর কাঁটা বিষম কাঁটা
ঠেকলে কাঁটা খসান দায়
চল সজনি যাই লো যমুনায়।
গৌর অঙ্গ ভূজঙ্গ হইয়া বুঝি
দংশি যাচ্ছে আমার গায়
চল সজনি যাই লো যমুনায়।
প্রেমের বিষে যখন তখন
বঁধুর বিষে প্রাণ যায়
চল সজনি যাই লো যমুনায়।।
বঁধু, আমি ভুবন ভ্রমিয়া অবশেষে জানিয়াছি, জননী জন্মভূমি বাস্তবিকই স্বর্গাদপি গরীয়সী। যত মালিন্যই তাহার অঙ্গে থাকুক, এই মাটি আমার আপন মা, এর কোল, এই বাতাস আমার নিশ্বাস, আর ঘন বনরাজিনীমালার ঊর্ধ্বে এই আকাশ আমার ঐশলোক, যেখানে চন্দ্র-সূর্যে গ্রহ-নক্ষত্রে, নিঃসীম নীলে কিংবা নিত্যনবরূপা মেঘমণ্ডলে আমার সকল জনম ও চরম লীলাভূমি অনাদি-অনন্তকাল ব্যাপিয়া বিস্তৃত। একদিন আমি আপনাকে পৃথিবীর সন্তান ভাবিয়া সমস্ত সীমা-সীমানা অতিক্রম করিতে চাহিয়াছি; আমি ক্ষুদ্রকে সার করিয়া বৃহৎকে দৃষ্টিতে রাখিতে পারি নাই, আবার বিশাল বিপুল বৃহৎকে দেখিতে গিয়া সেই ক্ষুদ্রকেও অবহেলা করিয়াছি যাহার উপর নির্ভর ব্যতীত কোনো বৃহতের অস্তিত্ব নাই। আমি ঈশ্বরকে সর্বস্ব করিয়া মানুষকে দেখি নাই, আবার মানুষকে সর্বক্ষমরূপে পূজিয়া ঐশবিচ্যুত হইয়াছি। আমি ফকির হইয়াছি, বাউল হইয়াছি; জ্ঞানের উপক্রমণিকার কালেই অধীর হইয়া ভাবাবেগে সব ভাসাইয়া সংকীর্তনে মাতিয়াছি, জীবনের গূঢ় তত্ত্ব তাই আয়ত্তের বাহিরে, বোধেরও বাহিরে রহিয়া গিয়াছে।
অথচ এই ভুবনই আমাকে পথে নামাইয়াছে। কিন্তু আমার জন্মভূমির মতো ঠাই অন্য কোনোখানে দেখিলাম না। ভুবন আমাকে বাহিরে ডাকিয়া লইয়াছে, আবার বাহিরও আমাকে সেই অন্তঃপুরের আহ্বানের দিকে সজাগ করিয়া তুলিয়াছে। আমি কবি নই, বাউল নই, একজন অতি সাধারণ মানুষ। জানিয়াছি জীবন-জীবিকা কী নিদারুণ সংগ্রাম, প্রতিমুহূর্তের প্রাণস্পন্দন কত লক্ষ লক্ষ বিষয়ের সুসমঞ্জস গতিবিধির উপর নির্ভরশীল; আমাদের কথা সুর স্বর ভরা সংগীত হইয়া ওঠে না, গীত-কথার মতো মনোহরণকারীও হইতে পারে নাই; জীবনের-ভুবনের অফুরন্ত শোভা-সৌষ্ঠব-সৌন্দর্যের মধ্যে আমরা প্রাণপাত করিয়াও যেন একান্ত হইতে পারি না। তবু, বিশ্বাস করো, চেষ্টার অবধি নাই। আর, বারংবারই মনে হয় তোমার সখ্যতার জন্য আমারও কিছু বলিবার আছে। তুমি হয়তো জীবিকার কঠোর চক্রে পিষিয়া পিষিয়া মরিয়া সার হইতেছ, হয়তো তাহার রূপের দিকে চক্ষু তুলিয়া চাহিবারও অবসর পাও না। তুমি নিজে বাঁচিয়া থাকিবার তাগিদেই হৃদয়-ঘরের বহির্মুখী বাতায়নগুলি বন্ধ করিয়া হয়তো একান্তই আপনাকে লইয়া ব্যস্ত, কিংবা হয়তো দেখিতে গিয়াছ পর্বতমালা, দেখিতে গিয়াছ সিন্ধু, কিন্তু কবি-কথার মতো ঘর হইতে শুধু দুই পা ফেলিয়া ঘাসের উপরে শিশির বিন্দুটির মধ্যে বিশাল ভুবনের প্রতিবিম্বটি দেখ নাই। একবার চাহিয়া দেখ, মনের বাতায়ন পথেই দৃষ্টি মেলিয়া দাও মুহূর্তকালের জন্য-সেই একটি মুহূর্তকাল তোমার হৃদয়ে অনন্তকালের ব্যাপ্তি আনিয়া ভরিয়া দিবে, তুমি মুগ্ধ হইবে।
দেখিও, মনে পড়িবে সেই কোনকালের মহাকবি কালিদাসের কথা দূরাদয়াশ্চক্র তাল-তমালবনরাজি নীলা, আতিবেলা লবণাম্বুরাশি ধারানিবন্ধেব কলঙ্করেখা। উত্তর হইতে দক্ষিণে পূর্ব হইতে পশ্চিমে, অঞ্চলে অঞ্চলে ইহার রূপ-বৈচিত্র্যে জীবনের চির যৌবনভার। আবার নিত্য নবরূপ ঋতুতে ঋতুতে। কোথাও রূক্ষ পাহাড়ের গাম্ভীর্য, কোথাও ঘন অরণ্য, কোথাও বা বাবলাগাছ কাকরভরা প্রান্তরের বুকে ভরা দ্বিপ্রহরেও রুদ্র রৌদ্রের নৃত্য, কিন্তু সবই উপেক্ষা করিয়া সবুজে-শ্যামে-হরিতে আলোকে ভরা খেতে-মাঠে জনপদে অপরাজেয় অফুরন্ত জীবন গান। মহাসমুদ্রের ঢেউ কোথা হইতে ধাইয়া আসিয়া আছড়াইয়া পড়িতেছে সোনালি সৈকতে, ঘন নারিকেলবীথি তাহার আবেগের স্পর্শ পাইয়া পৌঁছাইয়া দিতেছে যেন কোনো মহামন্ত্র আরও অভ্যন্তরের দেশে, শস্যশ্যামল খেতে তাই কত ঢেউ, মানুষেরও দৈনন্দিন জীবন-কর্মে সেই একই ছন্দ শতরূপে দৃষ্টিতে ধরা পড়িবে। দেখিও, কী ললিত ছন্দে চাষি বোনে ধান, মাঝি টানে নাও, বউ-ঝি কাদাজলে গোবরে লেপে তাহাদের ক্ষুদ্র মাটির ঘরের ভিত, কেমন করিয়া ভানে তাহাদের ধান, লতাইয়া দেয় সেইসব গৃহস্থালির অঙ্গাভরণের মতো পুঁই কি ঝিঙা, কত সবজির লতাপাতা ডগা। আমি মুগ্ধ হইয়া দেখি, তাহাদের তিনপাড় দেওয়া নীল বসন দুরন্ত বাতাস বিস্রস্ত করিয়া দিতে চায়, কখনও ডালপালার কৌতুকে মাথার ঘন দীর্ঘ কেশজাল ভাঙিয়া পড়িয়া সব লজ্জা ঢাকিয়া দেয়। তাহাদের গলার হাঁসুলি, কাদামাখা পায়ে খাড়ু-মল, শীর্ণহাতে সেই বালা কাঁকন যাহার দ্যুতি অভিরাম, ঈষৎ আওয়াজে ও চতুর্দিকের সুর-শব্দের সঙ্গে যেন অনন্তকাল ধরিয়া একই লয়ে বাঁধা। তাহাদের বসনের তিনটি রূপালি রেখাও যেন দেশ-প্রকৃতি হইতে অবিচ্ছিন্ন। দেখ না, দেশের শ্যাম-নীল প্রকৃতি অঙ্গ ঘিরিয়া ঘিরিয়া নদীজলের রৌপ্যস্রোত কেমন লতাইয়া লইয়া জড়াইয়া রাখিয়াছে।
যদি আরও দেখিবে, তবে চল সেইখানে, সেইখানে কবি বলে ‘মৃত্তিকা উপরে জলের বসতি, জলের উপরে ঢেউ, ঢেউয়েরই সাথে পবনের পিরিতি, নগরে জানে না কেউরে সখি, নগরে জানে না কেউ, দেশ-প্রকৃতি সে এইখানে মাখনের মতো মাটির অঙ্গ সবুজ শস্যে-অরণ্যের আবরণে ঢাকিয়া, অসংখ্য খাল-বিল নদী-নালার সহস্র প্রকার সনাতনি হারের মালা পরিয়া বাস্তবিকই গৃহলক্ষ্মী রূপা বধূবেশে সজ্জিতা। অঙ্গে তাহার উদ্ভিন্ন দুরন্ত যৌবন-প্রাণ, লাবণি আবরণের বন্ধন মানে না, যৌবন-জ্বালায় তাহার আসন, তাহার চিত্ত কখনও বেপথু, কখনও অস্থির। ক্রমাগত তাহার প্রতীক্ষা প্রচণ্ড প্রকৃতি-পুরুষপীড়ন। ঘন নীল সমুদ্রপ্রান্তে তাহার গৌরপদের কাছে অজস্র বাসনা বারংবার মাথা কুটিয়া মরিতেছে। আকাশ হইতে ঝরিয়া পড়া সোনার রৌদ্রে তাহার অঙ্গ তাতিয়া তাতিয়া ওঠে, বাতাসের কৌতুকে অঙ্গবসন খসিয়া খসিয়া যাইতে চায়, খেতে-মাঠে-জলে-স্থলে সব রূপ স্বর ও স্বর অহরহ বাসনাকেই আরও উদ্দীপ্ত করিয়া তোলে। সে যেন স্বয়ম্বরাসজ্জিতা, অথচ সহস্র বৎসরের সাধনার ধনের মতোই রূপবৈভবা, ঐশ্বর্যভূষিতা, চিরদিনের চিরকালের দয়িতা কুমারী রমণী। কাশফুলের চামর দুলাইয়া সংখ্যাতীতা সখিজনও তাহার আশে-পাশে সর্বক্ষণ ঘিরিয়া রহিয়াছে।
তারপর একদিন ওই সমুদ্র হইতে উঠিয়া আসে এক রুদ্র পুরুষ, দস্যুর। মতো, কখনও ঝঞ্ঝার রুদ্র বেশে, বন্যার বেশে; বেপথুব্যাকুলা সেই বধূকে যৌবন মদমত্ত মহাপ্রেমের ক্রীড়া কৌতুকে তাহাকে ক্লান্ত শ্রান্ত বিশৃংখল করিয়া আবারও উধাও হইয়া যায়। সেই বাসনা-বন্যার তুফান অপসারিত হইয়া গেলে সর্বংসহা বধূর মতো এই দেশ সুখাবেশে প্রথম গর্ভিণীর স্নেহ ও গরবে হয় অপরূপা জননীর মতো শান্ত। আকাশে তখন অজস্র আদরের সাদা মেঘ ভাসিয়া ভাসিয়া যায়, নভোনীলিমার আলো মমতা হইয়া ঝরিয়া ঝরিয়া পড়ে, সেই বধূ সম্পদে-সৌষ্ঠবে সাজাইয়া তোলে তাহার সংসার; তাহার সকল জীবন কর্ম-ধর্ম অন্তর সংগীত হইয়া ছড়াইয়া পড়ে আকাশে-বাতাসে প্রতিটি দিবসে রজনীতে দুঃখকে সে জয় করে, অঙ্গের সম্পদ সে খুশির আনন্দে সোনালি শস্যের আকারে অকৃপণভাবে ছড়াইয়া দেয়। তাহার একক। প্রেম তখন মহাপ্রেমের রূপে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য ব্যাপক হইয়া যায়। কিন্তু ক্ষমা সেই রুদ্র প্রকৃতিকে সে সম্ভবত কখনও করে না! তাহার প্রেমের পৃথিবীর সহজ ও সরল, অথচ শৌর্য-বীর্য-মাধুর্যে ভরা। সেই জীবনাচারকে যাহারা ধ্বংস করিতে চায়, তাহাদের উদ্দেশে এখনও অজস্র কবি-কণ্ঠ নানা রূপে উচ্চারিত হয়।
কেন না তাহার প্রতীক্ষা সেই মানুষের জন্যে, প্রেম যাহার বীরব্রত, জীবন। এই দেশ, এই প্রকৃতির কোলে তাহার সন্তানেরা এই মৃত্তিকা রৌদ্রবাতাস-জল ছানিয়া কোলে মাখিয়া বাড়িয়া ওঠে, গড়িয়া ওঠে। তাহাদের কর্মে, তাহাদের কণ্ঠে সেই ভালোবাসারই সুর বাজে প্রতিনিয়ত। কখনও সে গভীর বিশ্বাসে উজ্জীবিত হইয়া বলে, হে ক্ষুদ্র মানুষ, তোমার ক্ষুদ্রতাকে বৃহতের মধ্যে লইয়া যাও, তাহাতে নিমজ্জিত হইয়া যাও। কখনও তাহাদের মা-এর বাণী কানে সুধার মতো লাগে বলিয়াই তাহার মানে নিজেদের ধন্য মানে। ভালোবাসা ব্যাপ্ত হয়, কখনও কোনো কন্যার জন্য, কখনও রূপাতীত আরও ব্যাপকতর কাহারও জন্য। তখন কেবল আর মন বাঁধা পড়িয়া থাকিতে চাহে না আত্মসুখে, আসে নিজেকে বিলাইয়া বিশ্বপ্রেমে পাগল হইবার উন্মাদনা। দেশ-প্রকৃতিই তাহাদের সেইদিকে নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছে।
এই দেশ, এই মানুষ, এই প্রকৃতি জীবনের এক তুলনাবিহীন রূপ; এই, প্রেম জীবনের প্রতি প্রেমেরই কঠোর কোমল অধ্যায়। যদি মন চায়, সময় করিতে পারো, একবার তাকাইয়া দেখ, আমি কেবল তোমাদের সাদর আহ্বান জানাইয়া রাখিলাম।
.
০২.
মনের মানুষ না হইলে
মনের কথা কইও না
কথা কইও না, প্রাণ সজনি।
মনের মানুষ না পাইলে
প্রাণের কথা কইও না।
আবার অসৎ এরই এমন ধারা
চোরের নাউ সাউধের নিশানা
মুখের কথায় সব সেরে যায়
কাজে কিছুই না
তুমি শিমুল ফুলের রং দেখিয়া
ঝম্প দিও না
মনের মানুষ না পাইলে
মনের মানুষ না হইলে
তোমার মনের কথা কইও না।
সবেমাত্র মৌসুমের শুরু। রাত্রি বহুক্ষণ যাবৎ দ্বিপ্রহর উত্তীর্ণ। সাধারণত এমন নিশুতিকালে গাঁও-গ্রামের নিস্তব্ধ আকাশে-বাতাসে কোনো দূর হইতে ভাসিয়া আসা বন্য শিয়াল কী কুকুরের ডাকাডাকি ছাড়া অন্যতর কোনো জীবনের সাড়া টের পাওয়া যায় না, আসমানের নক্ষত্র তারকাদল একটা অজ্ঞাত রহস্যলোকের মধ্যে টানিয়া লয় সর্বত্র আর সবকিছু। কিন্তু মৌসুমি বাতাস কেবলমাত্র উতলা হইয়া বহিতে শুরু করিয়াছে, নীচের সাগরের উপর হইতে টানিয়া আনিতেছে বিপুল জলকণাভরা মেঘমালা। প্রথম বর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে মোহানা বাহিয়া উপরের দিকে আকুল-ব্যাকুল হইয়া ছুটিয়া আসিতেছে মাছের ঝাঁক। এ সময় প্রায় সব গৃহস্থই ডিঙি ভাসাইয়া গাঙে নামিয়া আসিয়াছে। চর্তুদিকে অন্ধকার, মাথার উপর ঝিরঝির বৃষ্টি, সবখানে এত মানুষ যে ডিঙিতে ডিঙিতে প্রায় ঠোকাঠুকি লাগার মতো অবস্থা। বৃষ্টিজলের কণায় কণায় ইতস্তত হারিকেনের আলোগুলিও যেন ঘন কুয়াশার মধ্যে নিষ্প্রভ। বৃষ্টির ধীরগতি ঝিরঝির শব্দ ছাড়া কোথাও আর অন্য কোনো স্বর নাই, সাড়া নাই। ডিঙির মানুষগুলি হাতের খোঁটজালের ফাঁদ গাঙে নামাইয়া সন্তর্পণে বসিয়া থাকা ছাড়া কোনো অনর্থক বাক্যব্যয়ও করে না। শিকারের কালে সে নিয়ম নাই।
জীবনের দাক্ষিণ্য অপরিসীম। সমুদ্র হইতে ঝাঁকে ঝাঁকে ছড়াইয়া পড়া ইলিশের দল আটকাইয়া পড়িতেছিল প্রায় সকলেরই জালে। এমন ‘জোবা’ সচরাচর পায় না বলিয়া শিকারিদেরও লোভ বাড়িয়া উঠিয়াছিল। কাহাকেও বা ডিঙির উপর একটার পর একটা মাছ উঠাইতে নেশার মতো পাইয়া বসিয়াছে। গাঙে ঢেউ ছিল না। তাহার কালো জল হইতে নীল রূপালি মাছগুলি ডিঙিতে উঠাইয়া ভরিয়া ফেলিবার আনন্দটাই বহুজনের কাছে মুখ্য লক্ষ্য। ডিঙির উপর সেই মাছগুলি প্রথমে কিছু ছটফট করিয়া ক্রমান্বয়ে নিস্তেজ হইয়া যাইতেছিল।
এ সময় এ অঞ্চলের সর্বত্রই এই ইলিশ মাছ ধরার উৎসব লাগিয়া যায়। কোনো বাড়িতে এমন পুরুষ নাই যে গাঙের দিকে বাহির হইয়া পড়ে না। বউ-ঝিরা তাদের ফেরার পথ চাহিয়া থাকে, মশলা বাটিয়া রাখে, তারপর পুরুষেরা ফিরিয়া আসিলে সেই রূপার মতো মাছগুলি নানাভাবে রাধিয়া ভাজিয়া খায়, মোটা চাউলের ভাতের সঙ্গে। বয়সে যাহারা বড়ো তাহারা মাছের লালচে অংশটুকু শিশুদের দেখাইয়া বলে : এইটুকু কি জানো? গোটা মাছটার মধ্যে এই জাগাটুকের লাহান মজা অন্য কোনোখানে নাই। হরিণের গোস্ত তো খাও নাই, এই জাগাটুকু সেই হরিণের গোস্তর লাহান মজা। একদিন যামু এ সুন্দরবনের জঙ্গলে। হরিণও ধরিয়া আনমু। আসলে কী জানো? এই ইলিশে আর হরিণে আছিল যেমন দোস্তালি, তেমনি রেষারেষি। হরিণের এই জাগাটুকু নিজের গা থেকিয়া কাটিয়া দিছিল ইলিশের। কেন জানো? দোউড় হইয়াছিল দুইজনের মধ্যে। সাব্যস্ত হইছিল যে হারবে সে নিজের গা-এর একটু গোস্ত কাটিয়া অন্যরে দেবে। এমন যে হরিণ, সে-ও গেল ঠকিয়া। কী আর করে, চুক্তি যা হইছে তার তো আর খেলাপ করা চলে না। দিল কাটিয়া এই গোস্তটুকু ইলিশের। এই সব গাল-গল্প, কথা উপকথা সহজাত জীবনের সঙ্গে সঙ্গে নানাভাবে পল্লবিত। সুন্দর হরিণ ক্রমাগত মানুষ ও পশুর তাড়া খাইয়া খাইয়া জঙ্গলে আত্মগোপন করিয়াছে, এই মাছের ঝকও একপ্রকার দিকদিশা হারা হইয়া উপরে উঠিয়া আসে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে গর্ভের জ্বণদল রক্ষার তাগিদটাই প্রধান কিনা তাহা লইয়া কেউই বড়ো একটা মাথা ঘামায় না।
অথচ শিকদার তাহার ব্যতিক্রম। যাহা লইয়া কেউরই কোনো ভাবনার অবকাশ নাই, শিকদারকে সেই সবই একরকম ব্যাধির মতো পাইয়া বসিয়াছে, একা মানুষ, নিজের জগতে বিভোর হইয়া ছিল, একমাত্র বন্ধু হোসেনও একা। সে-ই অনেক সাধ্য সাধনা, তর্কবিতর্ক এবং জোর-জবরদস্তি করিয়া তাহাকে লইয়া গাঙের এই শিকার-উৎসবে নামিয়া আসিয়াছে।
: নিজের জীবন রাখার মতো বড়ো কাম আমি আর অন্য কিছু দেখি নাই শিকদার। একের প্রয়োজনে অন্য, এই সৃষ্টির নিয়মটাই এই। তোমার মতো চিন্তায় বসলে কিছুই হয় না। কেউ আসিয়া এক থালা রান্ধাভাত তোমার সামনে আনিয়া দেবে না। আর কিছু না হউক, কিছু হাটে বেচিয়া কিছুকাল চাল-ডাইলের কড়ি জোগানো যাইবে।
সেই শিকদারই এক সময় দূরের দক্ষিণ হইতে আগাইয়া আসা স্টিমারের সার্চ লাইটের আভা লক্ষ করিয়া বলিল: চলো, এইবার ফিরিয়া যাওন যাউক, অনেকই তো হইল।
হোসেনও আরও একবার জালটা গাঙে নামাইয়া দিতে দিতে বলিল : বেজোড়টা সমান করিয়া লই। ঠিকই কইছ, ওই অত্তো বড় জাহাজটার দৌরাত্মে বেশ কিছুক্ষণ আর কেউর ডিঙিতে একটাও উঠবে না।
গাঙের জলে ঝপঝপ চাকা খাবলাইয়া, ঘনঘন সিটি বাজাইয়া, সার্চলাইটের আলো ক্রমাগত এইদিক-সেদিক ঘুরাইয়া স্টিমারটা একদিক হইতে দেখা দিয়া অন্যদিকে অদৃশ্য হইয়া গেল। তাহার দু-তিনটা তলা, সব আলোয় উজ্জ্বল। সেই আলোর ঘটায় দিশা খুঁজিয়া মাছ শিকারি ডিঙিগুলি অতি দ্রুত দূরে দূরে সরিয়া গেল। স্টিমার যে-তাণ্ডব জলে তোলে তাহার উপযুক্ত মোকাবেলা করার সাধ্য তাহাদের নাই জানিয়াই শিকারিদের ভিড় অবিলম্বে প্রায় মিলাইয়া গেল। তবু গাঙ্গেয় ঢেউ যেন খাল অবধি ধাইয়া আসিল। হোসেনের ডিঙি-চালনার দক্ষতা অপরিসীম, গাঙের ফুলিয়া ফুলিয়া ওঠা ঢেউ গায়ে আসিয়া আছড়াইয়া পড়িবার আগেই সে বাড়ির পথের খালের মোহনায় ঢুকিয়া পড়িল।
: আন্ধারে দিশা পাইলা না হয়তো, এ ঢেউ পাশাপাশি আসিয়া লাগলে এই ডিঙি মোচার ভোলার মতো উলটাইয়া যাইত!
: আমি তো আগেই কইছিলাম—
কিন্তু শিকদারের কথা শেষ করিতে না দিয়া হোসেন নিজের ভাবনাটা ব্যক্ত করিতে চাহিল : এমন যে ইংরাজ তারাও ওই জাহাজগুলি এমন গরজ দেখাইয়া চালাইত না। ভার দিছে এখন দেশি সারেং-এর হাতে। ফলে দারোগার চাইয়া তার চোটপাটের দাপট হইছে বেশি।
: রাজ্য যাগো তারা তো গরম হইবেই। গাঙও দেখো না, এই সুযোগে ফুসিয়া উঠিয়া সকলরে কেমন ঠেলিয়া খেদাইয়া দিছে।
হোসেনের কানে সে-মন্তব্য পৌঁছাইল না, অথবা তাহার পছন্দ হইল না। অন্ধকারের মধ্যে হালের কাছে বৈঠা লইয়া সে নৌকার গতি নির্ণয়ে ব্যস্ত রহিল।
বৃষ্টি ইতিমধ্যে থামিয়া গিয়াছে, খালের দুইপাড়ের ঝোঁপঝাড়ও অন্ধকার, উপরের আসমান চোখে পড়িয়াও পড়ে না।
: হারিকলটা উসকাইয়া একটু সামনের দিকে বাঁধিয়া দেও শিকদার ভাই, তবু যদি কিছু চৌখে পড়ে।
শিকদার হাসিয়া বলিল : ওই জাহাজের লাইটে চৌখ ধাঁধিয়া গেছে। এই অন্ধকারই ভালো, বাতি উসকাইলে হয়তো আর কিছু চোখে পড়বে না।
হোসেন বুঝিতে পারিল কথাটা নেহাত বাজে বলে নাই শিকদার। অন্ধকারের মধ্যেও ঠাহর করা কষ্টকর হইলেও অসম্ভব নয়। পোকামাকড় কী ব্যাঙের ডাকাডাকি, কোনওখানে বা জোনাক পোকার জ্বলা নেভা, মাঝেমধ্যে পাড়ের দুই ধারে দৈত্যর মতো খাড়া কড়ই, পিঠাকড়া কিংবা আম-নারকেলের বাগান যেন দুই দিক হইতেই খালের উপর ঝুঁকিয়া আসিয়া পড়িয়াছে। তাহাদের ডালপালা পাতা বাহিয়া বৃষ্টিজল তখনও গায়ের উপর ঝরিয়া পড়িতেছিল।
: উস বেশ ঠাণ্ডা পড়ছে তো! শিকদার ভাই, কিছু মনে করিও না, একবার তুমি একটু নাওখানা ধরো। আমি দেখি, তাওয়াটা নিভিয়া গেছে না কী! একটু তামাক সাজাইয়া শরীলডা গরম করিয়া লই।
: মনে করা-করির কী আছে! তুমি থাকো ওইখানেই, আমি দেখতে আছি। হুঁকায় গোটাকয়েক টান দিয়া হোসেন বলিল : সত্যই! আচ্ছা, কও দেখি, কী পাগলামিতে পাইছেলে! এরে তারে বিলাইয়াও তো অনেকগুলান থাকিয়া যাইবে।
: এই না ঠিক ছিল হাটে বেচা?
: গাঙে কেমন ভিড় দেখলা না? দশ বিশটা না পাইছে এমন মানুষ নাই। মানুষের গরজ না থাকলে বেচা-কেনারও দর ওঠে না।
: সেইসব তো আগেই ভাবন উচিত আছিল। হুঁকায় আরও কয়েকটা টান দিয়া হোসেন আবারও বৈঠা হাতে তুলিয়া লইল; দেখন যাউক দেখন যাউক। হাটের ঘাটে জিয়ল মাছের তালাশে জালিয়ারাও আসে। খরিদ্দার তেমন না পাইলে তাগো নৌকাতেই তুলিয়া দেওন যাইবে। তাগো সব এই মুলুকে সেই মুল্লুকে চালান দেওয়ার লাইন আছে।
আঁকা-বাঁকা খালের মধ্যে আরও কিছুকাল অগ্রসর হইয়া হোসেন এক সময় ডিঙির গতি শ্লথ করিল : একটুকাল ইতস্তত করিয়া সে ডিঙিটাকে ভিড়াইল পাড়ের এক ধারে। বিস্মিত শিকদারকে কিছু বলিবার অবকাশমাত্র না দিয়া সে গোটা দুই মাছ হাতে ঝুলাইয়া পাড়ে উঠিয়া গেল।
: শিকদার ভাই, একটু সবুর আমি আসলাম বলিয়া।
: আরে, এমন আকা কোথায় চলল?
: এক বান্ধব বাড়ি, কেবল যামু-আসমু! শিকদার অবাক হইয়া গেল
: তিনকূলে যার কেউ নাই, তার আবার বান্ধব আসলো কোথা হইতে?
হোসেন তখন পাড়ের অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য হইয়া গিয়াছে, কিছু বলিল কি বলিল না তাহাও বোধগম্য হইল না।
কিছুক্ষণ এদিক সেদিক চাহিয়া শিকদার এলাইয়া পড়িল নৌকার গলুইয়ের উপর। খালের পাড়ের একটা কড়ই গাছের ডালপালাপাতা ভরা মাথাটা আকাশটাকেও তাহার চোখের আড়াল করিয়া রাখিল। কিন্তু বুঝিতে বেগ পাইতে হইল না রাত্রি প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে। ধীর গতি হালকা বাতাস বহুদূর হইতে ভোরের স্পর্শ লইয়া আগাইয়া আসিতে শুরু করিয়াছে। দুই ধারে তাল নারিকেল গাছগুলি পাগড়িপরা ভূতের মতো মাথা উঁচাইয়া খাড়া। কোথাও হইতে কিছু পাখি-পাখালির কাকলিও ভাসিয়া আসিল।
হোসেন বাস্তবিকই দেরি করিল না। ডিঙির পাড়া খুলিয়া সে আবারও খালের স্রোতে ভাসিয়া পড়িল।
: কী বিত্তান্ত, কোশ্নে গেছিলা?
হোসেন সংক্ষিপ্তভাবে জানাইল : কইলাম না, এক বান্ধব বাড়ি।
: কই কোনোদিন তো তেমন কিছু কও নাই।
হোসেন অন্যমনস্কভাবে বৈঠায় টান দিল : এমন কিছু সম্বন্ধ না, সে অনেকদিনের কথা। আগে আছিল আমাগোই গায়-গ্রামে। এখন এইখানে আসিয়া বসতি করছে। এত মাছ! দিয়া আসলাম তাগো কিছু। শিকদার ভাই, বৈঠাখান লইয়া তুমিও না হয় গোটা কয়েক ক্ষেপ দেও।
শিকদার বেশ কিছুক্ষণ বৈঠায় জল টানিয়া পিছনে ফিরিল : কেমন যেন ভাবনায় পড়লা হাওলাদার, বিষয়টা কী কও দেখি।
হোসেন হাসিয়া উঠিল : এই আন্ধারেও তোমার চোখ চলে! কী আবার বিত্তান্ত!
: নাহ, আছে একটা কিছু!
: হ,–হোসেন হাসিয়া উড়াইয়া দিতে চাহিল : থোও কথা! তুমি বৈঠায় গোটাকয়েক জোর টান দেও শিকদার ভাই। জালিয়া নৌকার দেখা না পাইলে এত মাছ ঘরে রাখনেরও জায়গা নাই।
পুবের দিকটা প্রায় ফরসা হইয়া আসিতে শুরু করিয়াছিল। হাটে পৌঁছিয়া বাস্তবিকই তেমন কোনো খরিদ্দারের দেখা পাওয়া গেল না। খুঁজিয়া খুঁজিয়া শেষ পর্যন্ত জেলে-ডিঙিতেই তুলিয়া দিল সব। নিজের জন্য রাখিল বটে, গোটা দুই, কিন্তু শিকদার নিজের জন্য একটা রাখিতেও অনিচ্ছা দেখাইল।
: না রে ভাই, এমন কাটা ধোওয়া রান্ধন আমার পোষাইবে না। কাটতে বসিয়া কেবলই ওর পেটের কাঁটায় হাত কাটিয়া ফেলি। আমার বাস্তবিকই তেমন কোনো আহইট নাই। বরং দুইটা পয়সা হইলে আমার চাউল ডাইলের খিচুড়িটা জোটবে।
: আহ, এই ইলিশের জন্য দুনিয়া পাগল।
শিকদার হাসিতে লাগিল : জানি জানি বইকী। কিন্তু সেই গীতের কথাই ভালো। শুনাইছিলাম তোমারে?
বাড়ির পথে ডিঙি খুলিয়া হোসেন বলিল : কত গীতগান, কোনটার কথা কইতে আছ ঠিক খেয়াল করিয়া উঠতে পারতে আছি না।
শিকদার গুন গুন করিয়া শোনাইল : সেই সে, মাছের মধ্যে মাছ সে না ইলিশা সে না মাছ, ও তোর রুই মাছ কে চাইছে, চাঁদা পুঁটি ধুরাই না মোদের সংসার রাখিয়াছে।
হোসেন হাসিয়া ফেলিল : হ, হ, এখন আমারও মনে আসছে। তবে ওই কথাগুলি না বাকিটুক। এরপর পরই সে গীতে আছে না, নারীর মধ্যে নারী সেই না গোরা সেই না নারী ও তোর পরী চাইছে কে, শুকনা কালা ভেড়ুয়া নারীই না মোদের সংসার রাখিয়াছে। তাই না?
শিকদার সায় দিল : হ, অনেকটা ওই রকমই। এক এক জনে এক এক বয়ান দিছে, কেবল আদত তত্ত্বটার দিকে কেউই আর তেমন খেয়াল নাই।
হোসেন সে মন্তব্য গ্রাহ্যে আনিল না : তত্ত্ব-ফত্ব থাউক। তুমি কও দেখি একটা বিয়া করলে কেমন হয়?
শিকদার অন্যমনস্কভাবে কহিল : করবে না।
: কী করবে না?
শিকদার তেমনই অন্যমনস্কভাবে বলিল : বিয়া। ক্ষেপছে! বিয়া করিয়া ঘরে আনিয়া সেই বউরে খাওয়াবা কী? ওই যে কথায় বলে নিজের শোওয়ার নাই জাগা হাউস হইছে কবিলারে সাধা। মোরগো মতো মানুষ হাওলাদার, যাগো চাল নাই, চুলা নাই, বোঝলা হাওলাদার, তাগো কেউ মাইয়া দেয় না। মাইয়ার বাপেও না মাইয়ারাও আংডি-চুংডি হেন তেন না পাইলে বিয়া বইবে না। হয় না, হয় না!
: সকল মাইয়ারাই কী তেমন?
শিকদার বেশ কিছুকাল ভাবিল; এক সময় যেন আপনমনেই বলিল : যারা সেসব চায় না, হেরা কী যে চায় তা বোঝানের মধ্যে দেবতা দরবেশেরও নাই। মনের মতো কেউরে পাওন যায় না। বোঝলা হাওলাদার-গুণগুণ করিয়া শিকদার হোসেনকে তাহার এক গীতের কয়েকটি কলি শুনাইয়া দিল : দুনিয়াবিতে সকল পাওন যায় কেবল মনের মতো মানুষ পাওন দায়। হোসেন মনে মনে হাসিয়া সে কথা উড়াইয়া দিল; মুখে আসিয়া গিয়াছিল বলে যে, যারা পায় না তারাই এমন আপছুছের গীত গান ধরে, কিন্তু সামলাইয়া গেল : দুর, একজনকে দিয়া সকল মাইয়া মানষের বিচার করণ ঠিক হয় না। কিন্তু ধরো যদি তেমন একজন পাওয়াই যায়?
শিকদার বৈঠা থামাইয়া এক মুহূর্ত কী ভাবিল, তারপর আবারও বৈঠা জলে নামাইয়া বলিল : মাইয়ার বাপ, না হয় ভাই বেরাদার সে মাইয়া দেবে না তোমারে।
: যদি দেয়? অবস্থা-বৈগুণ্যও তো আছে।
শিকদার অনেকক্ষণ পর্যন্ত অবাক হইয়া রহিল।
: এমন আচুক্কা এ সব কথা কও যে?
হোসেন কিছু বলিতে উপক্ৰম করিয়া আবার সামলাইয়া লইল : নাই, এমনি কইলাম।
শিকদার একটু আশ্বস্ত হইল : হ, কও। এমন কইয়াই যা সুখ!
খালে তখন খালের জোয়ার উঠিয়া পড়িয়াছে, তাহার টানে ডিঙি তরতর করিয়া অগ্রসর হইয়া চলিল। ইতিমধ্যে প্রভাতকালের আলোয় চতুর্দিক নিত্যদিনের পরিচিত রূপ লইতে শুরু করিয়াছে। সকাল বেলার হাওয়া চিরকালই মন্দমধুর শিকদারের কাছে, রাত্রি তাহার অসহ্য। অনেক প্রসন্ন হইয়া সে হোসেনকে ডাকিয়া কহিল : ছাড়ান দেও, হাওলাদার, ছাড়ান দেও। দুইমুঠ ভাত জোটানোর চেষ্টায় যাগো দিন কাটে তাগো ওইসব স্বপ্পন দেখিয়া লাভ নাই। রাত্তিরে যে চান্দ ওঠে তা কার না পরাণ উতলা করে কিন্তু দিনের খরা রোদে সেই চিত্ত আর থাকে না। দিনের ঠাটাপড়া রৌদে পিঠ পুড়িয়া যায় না, তাতে জ্বালা না সুখ? রাত্তিরের মিঠা চান্দের হলক তখন মনে হয় মিছা স্বপ্ন। ঠিক কী না? আমাগোও বিয়া করা বউর সাধ সেই রকমই একটা ঠুনকা স্বপ্ন। অভাব দুঃখের জ্বালা ধরানিয়া দিনগুলোই মোগো জন্য সত্য। আর বেবাকই মিছা, একেবারে ডাহা মিছা। ওইসব লইয়া মাথা ঘামানোর কোনোই ফল নাই।
খালে জোয়ারের বেগ তখন আরও বাড়িয়া উঠিয়াছে। হোসেন বৈঠার টানে। একটু ঢিলা দিল। সে শিকদারের কথা কিছু শুনিল, কিছু শুনিল না। বলিতে চাহিল ‘অভাব পীড়িত শ্রান্ত ক্লান্ত ঘর্ম-সিক্ত দিনগুলিই কী জীবনের একমাত্র সত্য? এমন অসহায় আর রুগ্ন দিনগুলি হইতে বাস্তবিকই কোনো পরিত্রাণ নাই? তা হইলে কোন আশায় তাহারা বাঁচিয়া রহিয়াছে? এই ডিঙি বাহিয়া চলিয়াছে? সত্য নয়, সত্য হইতে পারে না। তা হইলে দুনিয়া চলিত না। ঘোর দুঃখের মধ্যেও যে নিমগ্ন ভবিষ্যতের আশায়ই সে বাঁচিয়া থাকার প্রেরণা পায়, সংগ্রাম করে; কেউ হারে, কেউ জেতে। আমি অবশ্যম্ভাবীভাবে পরাজিত হইব, এই ভাবনা কোনোই ফল দেয় না। চাহিয়া দেখো পৃথিবীর দিকে, দিন কাহারও একই রকম কাটে না। শিকদারের সঙ্গে এইখানেই। তাহার ঘোর তফাত। ভবিষ্যতের উপর বিশ্বাস সে কোনো মতেই ত্যাগ করিতে পারে না। তাহার সারা সংসার, বাপ-মা-ভাই-বোন যখন দুরন্ত ব্যাধির দাপটে দুই-রাত্রির মধ্যেই শেষ হইয়া গেল, সে সম্পূর্ণ নিঃস্ব, কোথাও কোনো সহায় নাই, চারিদিক হইতে দুর্ভাগ্যের তমসা তাহাকে প্রায় গ্রাস করিয়া ফেলিতেছিল, তখন মনে হইয়াছিল বৈকী সেই অবস্থা হইতে আর পরিত্রাণ নাই; পিঠ এমনই ভাঙিয়া গিয়াছে যে আর কখনও সিধা হইয়া খাড়াইবারও উপায় নাই। সেই রাত্রিও তো কাটিয়া গিয়াছে। তখন দুই মুঠা ভাত প্রায় ভিক্ষা করিয়া জোটাইতে হইয়াছে। দিন যাপন নির্ভর ছিল অন্যের সাহায্য না হয় করুণার উপর। আজ সে ধীরে ধীরে সেইসব অতিক্রম করিয়া অন্তত নিজের পা-এর উপর দাঁড়াইতে পারিয়াছে। সেই ভাঙা বাড়িটাকেও ফের সাজাইয়াছে, জমিও আছে কয়েক বিঘা। বাড়ির সামনের দরজায় পুকুরটাকেও কাটাইয়াছে নতুন করিয়া, পাড়ে সাজাইয়াছে আম কাঁঠাল নারিকেল-সুপারির বাগান। খেত বাগানের কাম-কার্য যখন থাকে না, এই ডিঙিটাতেই ছই লাগাইয়া সে কেরায়া খাঁটিতে বাহির হইয়া পড়ে। গীত-গান সে-ও ভালোবাসে অবশ্য, সে উপলক্ষেই তো শিকদারের সঙ্গে এমন বন্ধুত্ব গড়িয়া উঠিয়াছে। কিন্তু সেই সব আনন্দ দেউক, একটা পথের না হয় উপায়ের সন্ধান দেউক, তাহার মধ্যে নিজেকে হারাইয়া ফেলিতে হইবে কেন। অবশ্য এত করিয়াও হোসেনের জীবনে এখনও স্বাচ্ছন্দ্য নাই, গৃহস্থালি সংসারের বহনেরও সামর্থ্য নাই। তবু আর যাহাই হউক, দুই-মুঠা ভাতও এখন জোগাইতে পারিতেছে। যে অভাবে উপবাসে থাকে নাই সে এই দুই মুঠা ভাতের মূল্য বুঝিবে না। সুতরাং ভবিষ্যতে বিশ্বাস রাখা দরকার। এই যে সেদিন তাহার পায়ের পাতার এইখানে মস্তবড় একটা ময়না কাটা ফুটিয়া পাকিয়া টাটাইয়া তাহাকে অস্থির করিয়া তুলিল–যন্ত্রণায় ঘুমাইতে পারে নাই, আহার্যও মনে হইয়াছে বিস্বাদ, ঘোর জ্বরেও পড়িয়া রহিল কয়েকটা দিন। এখনও দেখ, কাঁটাটা বাহির হইয়া গেলেও জখমটা এখনও রহিয়া গিয়াছে, কে জানে চাপাচাপি করিলে হয়তো এখনও পুঁজ বাহির হইয়া পড়িবে। এই কষ্টও তো দূর হইল। তখন মনে হইয়াছিল, দুনিয়া অন্ধকার, বাঁচিয়া থাকার আর কোনোই সম্ভাবনা নাই। কথা হইতেছে বিশ্বাসের, তাক এর বুকের হিম্মতের। চেষ্টায় মানুষ বড়ো হইয়াছে, আশা পূরণ করতে পারিয়াছে, এমন দৃষ্টান্ত বিরল নয় একেবারেই। চেষ্টার হাল ছাড়িয়া দিতে সে কিছুতেই রাজি নয়। এই যে জোয়ারের জল এমন তরতর করিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে কোনো বাধা সে মানিতে চায়? ভাটার কালে এইরকম দুইকূলভরা জোয়ার বিশ্বাসই হইতে চাহিবে না। জোয়ারের এই গতিতে স্রোতও হয় রূপী হয় আর দুইধারেরও রূপ বাড়ায়। তোমার আমার জীবনেও এই রকম সম্ভব হইতে পারে না? শিকদার এতক্ষণ হোসেনের কথাগুলি কিছু শুনিতেছিল, কিন্তু অনুমান করিতেছিল। মনের কথা গুছাইয়া বলিতে পারার সাধ্য তাহার নাই বলে, সব ভাবনা তেমন স্পষ্ট নয়।
কিন্তু শিকদার বন্ধুকে জানে বলিয়াই কখনও এইসব কথায় বিরক্তি বোধ করে না, অমনোযোগীও হয় না। একদিক হইতে দুইজনের মনোভাব উভয়ের কাজেই পরিপূরক বলিয়া তাহাদের বন্ধুত্ব কখনো ক্ষুণ্ণ হয় নাই। এক সময় সে হাসিয়া জানিতে চাহিল : খালের কথা থাউক। জীবনের মধ্যেও তুমি জোয়ারটা দেখলা কোনখানে? আচুক্কা এইসব কী কও? তেমন দেখতেই হয় যদি আমি তো চতুর্দিকে কেবলই দেখি ভাটার টান। দশটা বছর আগেও গাঁও গ্রামের যে অবস্থা আছিল এখনও তেমন আছে? সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য যা আছিল, সবই তো মিলাইয়া যাইতে আছে ধীরে ধীরে। এইটারে তুমি জোয়ারের সঙ্গে তুলনা দেও?
: না, না-সেই কথা না।-হোসেন একটু মাথা চুলকাইল, পাগড়ির মতো বাঁধা গামছার তলায় : না, আমি অন্য কথা কইতে আছিলাম!
: বেশ তো, বুঝাইয়া কও না?
হোসেন বেশ একটুকাল ইতস্তত করিল, এইদিক সেইদিক চাহিয়া খুঁজিয়া লইল কথা : আমি কইতে চাইছিলাম এই বয়সটার কথা। যত ডাঙার হইয়া উঠতে আছি, ততই এইসব মনে উদয় হইতে আছে। এত্তো বড়ো দুনিয়াবীর মধ্যে সাধ-আহ্লাদ মিটাইবার সুযোগ না হয় যদি সৃষ্টিকর্তা পয়দা করছে কী উদ্দেশ্যে? তুমিই কও না, নিশ্চয় এর একটা অর্থ আছে।
শিকদার হঠাৎ কোনো মন্তব্য করিল না, বিষণ্ণভাবে এক সময়ই হাসিয়া বলিল : দেখিও, তোমার মনও যেন কেউ আবার ফকিরালির দিকে টানিয়া লইয়া না যায়।
হোসেন হাসিয়া ফেলিল : নাহ, তুমি আর মানুষ পাইলা না! দেখি তো তোমারেও, মুর্শিদি মারফতি ধরিয়া তুমিই বা কতটুকু আউগাইতে আছ। নাহ, দুনিয়াদারির উপর কোনো বিতৃষ্ণা এখনও আমার হয় নাই।
শিকদার স্মিতমুখে জানিতে চাহিল : তোমার কি মনে কয় আমার মনও আর এই দুনিয়াদারির উপর নাই? দুনিয়াটারে ভালোবাসি বলিয়াই তো এখনও তক ফকির হইতে পারলাম না।
হোসেন জবাব দিল না। শিকদারকে একটু খোঁটা দিয়া সে মনে মনে লজ্জিত হইয়া পড়িয়াছিল।
শিকদারই ব্যাপারটা হালকা করিতে চাহিল : না মর্দ, তোমার লক্ষণ ভালো না।
: তুমি ভুল বোঝলা!
: মোটেই না। আমি পষ্ট দেখতে আছি তুমিও ভাবের কথা শুরু করছ যখন, তখন তোমার কপালও বুঝিবা ফকিরালির দিকে ঠেলতে আছে কেউ।
: কেমন, কেমন!–: হোসেন আগ্রহ দেখাইল : ভাঙিয়া কও।
: ওই যে কেচ্ছা আছে না একটা। বাপে মাইয়ার বিয়া দিবে, কিন্তু মাইয়া কিছুতেই সেই বিয়া বইবে না। বাপে কত চোখ রাঙায়, কোঁদে, কাঁদে তবু মাইয়া অটল। একদিন তার কবিলা ফিসফিসাইয়া কয় কোন জোয়ানের দিকে মাইয়ার মন। বাপ শুনিয়া হাঁ করিয়া চাহিয়া রয়, শেষে আপশোশ করিয়া কয়, হায়, হায়, আমার এমন মাইয়ার কপাল লেংড়া ময়জদ্দির দিকে ঠেলছে কেডায়? কেডায় আবার, কয় কবিলা, যার পয়দা তার হুকুমই ঠেলছে। বাপ আবার হাঁ করিয়া চাইয়া রয়, কয় পয়দা করলাম আমি, এখন হুকুম দিতে আইলো কেডায়? কবিলা শাসন করিয়া থামাইয়া দেয়, যার কপালে যেদিক টান পড়ছে, তার পিছে নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তার হুকুম আছে। বাপে কয়, আমি তাইলে কেবল চাইয়া চাইয়া দেখমু আমার মাইয়ার কপাল বাস্তবিকই ময়জদ্দির দিকে ঠেলছে? কিছুতেই তেমন হইবে না।
: হোসেন হাসিয়া উঠিল প্রায় ডিঙি কাঁপাইয়া : নিশ্চিন্ত থাকো শিকদার, নিশ্চিন্ত থাকো, আমার উপর সেইরকম কোনো হুকুমের আছর হয় নাই।
.
০৩.
বঁধু হৃদয় যে আর মানে না বারণ
অঙ্গের যৌবন-জ্বালা না মানে শাসন ॥
শয়নে কন্টক ফোটে, জাগিয়া ব্যাকুল,
তোমারই পিরিতে বঁধু হইলাম রে আকুল
শাওনের মেঘের মতো পরান উতলায়
আমি কেমনে শাসন করি তায় ॥
তোমার অঙ্গের পরশে অঙ্গে ধরল জ্বালা
তোমার নাম হইয়াছে যে আমার জপের মালা
আমি জল আনিতে যাই নদীর ঘাটে
তুমি পবন হইয়া ঢেউ দেও তাতে
কলসি দূরে ভাসিয়া যায়
এখন কূল-কন্যার লাজ রাখা যে দায় ॥
তুমি এমন করিয়া ঢেউ দিও না,
ঢেউ দিও না, ঢেউ দিও না গো
তোমায় করি যে বারণ ॥
ইতিমধ্যে তাহারা বাড়ির ঘাটে পৌঁছিয়াছিল। শিকদারকে নামাইয়া দিয়া হোসেন নিজ ঘাটে চলিয়া আসিল।
মৌসুমি বৃষ্টির কাল, এই বৃষ্টি, এই রৌদ্র, বৃষ্টির মেঘ কাটাইয়া তখন বেলার রৌদ্র ঝলমল করিয়া উঠিয়াছে চতুর্দিকে। হঠাৎ বড়ো চোখে পড়ে; কিন্তু একই সময় সজীব করিয়া তোলে মন-প্রাণ। উঠানের একধারে জালটা মেলিয়া দিয়া হোসেন দাওয়ার উপর বসিয়া রহিল একটু কাল। দৃষ্টি আটকাইয়া রহিল হালটের অপর পাড়ের শূন্য বাড়িয়ালটার দিকে। সেই বাড়ির সখিনা এখন যেন সেই রৌদ্রের মতোই ঝলমল করিয়া উঠিয়াছে।
শিকদারকে সে কথাটা খুলিয়া বলিতে সংকোচ বোধ করিয়াছে। সে-ও অবশ্য খেয়াল করিয়া থাকিবে জমিজমা সংক্রান্ত বিবাদের ফলেই ওই বাড়িয়ালটা এখন শূন্য। তাহার বাপ মুজফফরই এক রকম জোর করিয়া উঠাইয়া দিল ওই ভিটা হইতে সখিনার বাপ গঞ্জে আলীকে, দায়-দেনা শোধ করিতে না পারার জন্য। মুজফফরের উপর অন্য রকম চাপ পড়িয়াছিল। তবু সে যা-ই হউক গঞ্জে আলী কি সেই বিবাদ কোনোদিন ভুলিয়া যাইতে পারিবে!
মাত্র সাত আট বছর আগের বিষয়। যেখানে এখন হোসেনের ধুলট কৃষির খেত সেইখানেই ছিল তাহাদের ভিটা বাড়ি। হালটের উপর বাঁশের কেঁচকি দিয়া লম্বা সুপারি গাছের সাঁকো। তাহার উপর দিয়া নিত্য ছুটাছুটি, হালটের জলে ঝাঁপাঝাপি। কখনও বা পাড়ের সিঁদুরে আম গাছে না হয় জাম গাছে। উঠিয়া নীচে দাঁড়ানো সখিনার দিকে লক্ষ করিয়া তুলিয়া দিত ফলগুলি। সিঁদুরে আমগুলি হাত ফসকাইয়া হালটে পড়িয়া গেলে নামিয়া সেইগুলি আবারও তুলিয়া আনিত ডুব দিয়া দিয়া। কেবল চাহিয়া দেখিতে পারিত না তাহার চালিতা খাওয়া। চৈত্রমাসে যখন ধানের খেতও ফাটিয়া চৌচির, হালটের জলও কমিয়া কমিয়া একেবারে তলায় গিয়া জমিয়াছে, তাহার মধ্যে ছোট ছোট পুঁটি, ট্যাংরা আর চোলাগুলি মাথা তুলিয়া ছুটাছুটির আনন্দে মাতিয়া উঠে, সেইকাল-যখন চতুর্দিকে কেবল ঠাঠা রৌদ্রের খরা, বাতাসও বহে না, গাছের পাতাটি পর্যন্ত কাঁপে না, সেই সময় তাহার চালিতা খাওয়ার ধুম। সেই চালিতার কোনটা যে কাঁচা আর কোনটা পাকা তাহা বুঝিয়া উঠিতে হিমশিম খাইয়া যাইত হোসেন। সখিনা সেই চালিতা এতখানি মরিচ আর এতখানি লবণ মাখাইয়া কচকচ না হয় চাকুমচুকুম করিয়া খাইত মাথা দুলাইয়া দুলাইয়া। দেখিয়াও হোসেনের দাঁত শরীর শিরশির করিয়া উঠিত। কেবল কেবল সেই চালিতা পাড়িয়া কাটিয়া হেঁচিয়া ক্লান্ত হইয়া পড়িত সে, শেষ পর্যন্ত বোকার মত রাগিয়া যাইত, ছুড়িয়া ফেলিত হাতের চালিতা আর দা; আমি আর পারমুনা বলিয়া সাঁকো পার হইয়া বাড়ি চলিয়া আসিত। সখিনা অবাক হইয়া তাকাইয়া থাকিত। তখন কে জানিত, এখন এতগুলি বছর বাদে তাহাকে আবার দেখিয়া হোসেন এমন চঞ্চল হইয়া উঠিবে?
এখন আরও স্পষ্ট হইয়া ওঠে নানারকম অতীত কথা; মনে হয় যেন এমন করিয়া আর কখনও দেখা হয় নাই।
সেই শেষ ফাল্গুনের কথা। বাড়ির উঠানের একধারের মাদার পলাশের গাছগুলিতে যেন হঠাৎ আগুন জ্বলিয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু তাহার চাইতেও বেশি জ্বলিয়া উঠিল তাহাদের দুই পরিবারের মধ্যে বিবাদ, বিষয় সম্পত্তিগত নেহাত আদনা ব্যাপার লইয়া। ধূম কাজিয়ার সঙ্গে বাহিরের লোকজনও যোগ দিয়া ঘটনাটাকে আরও জটিল করিয়া তুলিল। দুই পরিবারের মুখ দেখাদেখিও বন্ধ। খালের ঘাটে সখিনার কাছাকাছি হইয়া আসিবার দেখা করিলেও সে মুখ ঘুরাইয়া উঠিয়া চলিয়া যাইত। কিছুকাল পরেই চেষ্টা গেল গোটা পরিবার কোথায় চলিয়া গিয়াছে আর হোসেন-এর বাপ মুজফফর চাল বেড়া ভাঙিয়া শূন্য ভিটামাটিকে চষিয়া খেত বানাইতে ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে। জিজ্ঞাসাবাদ করিবে কী, বাপের তাড়নায় তাহাকেও সেই কর্মে যোগ দিতে হইল।
তবু খোঁজ খবর রাখিয়াছিল বলিয়াই একটা অজুহাত লইয়া গঞ্জে আলীর বাড়ি উপস্থিত হইয়াছিল। কিছুটা আগে ভাগে ঠিক করিয়া, কিছুটা ঝোঁকের মাথায়। এমন বন্ধু শিকদারের কাছে কথাটা বলি বলি করিয়াও নানা সমস্যাঁতে বলা হয় নাই। বিষয়টা এমন নয় যে ওই সখিনার অভাবে তাহার জীবন খাক হইয়া যাইতেছে, কিন্তু অমন তাজা একটা বউ সংসারে আসিলে হোসেনের তাকত-হিম্মত যেন আরও বাড়িয়া যাইত। সে নিজের জীবনটাকেও ওই বন্ধু শিকদারের মতো কখনও শ্রীহীন করিয়া তুলিতে চায় না, চায় নাই।
সেই শিকদারের সঙ্গেই দেখা। অন্যমনস্কভাবে এই দিক সেই দিক ঘঘারাঘুরির কালে হয়তো একটু ফিটফাট হইয়া বাহিরে নামিয়াছিল বলিয়াই শিকদারের মুখে চোখে একটু রহস্যের হাসি খেলিয়া গেল। অথবা এমনও হইবে যে হোসেনই সেই রকম দেখিল; একবার যে আবারও গঞ্জে আলীর বাড়ির দিকে যাওয়ার কথা মনে হয় নাই তাহাও তো নয়, তবু সে শিকদারের কাছে ধরা পড়িতে চাহিল না।
: কোথায় আর যামু, তোমার ওই দিকেই রওনা হইয়াছিলাম।
: উঁহু!-শিকদার তামাশায় মাথা দোলাইল : না, না মর্দ, ফাটকি দিও না। এমন সাজন গোজন-এর নিশ্চয় একটা তত্ত্ব আছে, উদ্দেশ্য আছে।
হোসেন অপ্রস্তুতভাবে মুখ নামাইল। এই রকম সবকিছুর মধ্যেই তত্ত্বের উদ্দেশ সব সময়ই যে তাহারও প্রিয় প্রসঙ্গ হইবে এমন মনে করার কোনো হেতু নাই। উঠানের একধারে সামান্য শাক-সবজির খেত মাচানগুলিকে পরিচর্যা করিতে গিয়া যে বেশ একটু বৃষ্টি-বাদলায় ভিজিয়াছে, উদলা গায়ে কাদামাটি ছড় আঁচড়ের খেয়াল রাখে নাই, এক সময় একটু শীত শীত বোধ হওয়ায় নিজেকে একটু সাফসুফা করিয়া পিরহানটা গায়ে তুলিয়াছে মাত্র; কোনোখানে যাইবার তেমন কোনো উদ্বেগ নাই। শিকদার অবশ্য তাহার সেই সব ব্যাখ্যায় কান না দিয়া ‘সুজন বন্ধু যায় বাণিজ্যে যায়, ময়ূরপঙ্খী বাদাম খোলে, হংস যেমন পাখনা মেলে-’ অথবা ওই জাতীয় কিছু গুনগুনাইয়া উঠিলে সে বাস্তবিকই খুব প্রীত হইত না। যে-উদ্দেশ্যে শিকদারের বাড়ির দিকে পা বাড়াইয়াছিল, তাহাতে বহু রকম সংকোচের জড়তা আসিয়া গেল।
: চলো, সাঁঝ নামিয়া আসছে, ঘরের বারিন্দায় উঠিয়া বসন যাউক।
উঠানের একধারে আম-জাম-শিমুলের তলায় শিকদারের ছোটো ঘর; তাহার কোনো খানেই বিশেষ তেমন কোনো যত্ন নাই, মাটির হাতিনার উপর শনের মাদুরটারও টুটা-ফুটা দশা, কোন যুগের একটা কাঁঠাল তক্তার পিঁড়া সে মুখ থুবড়াইয়া পড়িয়াছিল, তাহা হোসেন খুঁজিয়া বাহির না করিলে হয়তো কখনওই চোখে পড়িত না।
তবু বেশ কিছুক্ষণ ইতস্তত করিয়া হোসেন তাহার ভাবনাগুলি শিকদারের সঙ্গে যাচাই করিতে চাহিল। ঘর-গৃহস্থালিই হউক কি একজন পুরুষ মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যই হউক একজন গৃহিণী না হইলে চলে না। শিকদারের তুলনায় হোসেন একজন হালকা মেজাজের কেউই হইবে বা, কিন্তু বেশ বুঝিয়া উঠিয়াছে, এইভাবে একা একা আর দিন কাটাইতে পারে না। এখনই সময়, বুঝিয়া-শুনিয়া একটা কিছু করিতে হয়। কোনোখানে তেমন কাহাকেও চোখে পড়ে না বলিয়াই সে গঞ্জে আলীর কন্যা সখিনার কথাটা মনে মনে বিবেচনা শুরু করিয়াছে, তেমন কোনো বান্ধব তো কেউ নাই, তাই শিকদারের পরামর্শ ছাড়া আর যেন অগ্রসর হইতে পারিতেছে না।
শিকদার সঙ্গে সঙ্গেই কোনো মন্তব্য করিল না, একবার বিষয়টা তরল করিবার জন্য কিছু বলিবার উপক্রম করিয়াও থামিয়া গেল, তারপর হাঁটুর উপর দুই হাত বাঁধিয়া উঠানের একধারে নির্নিমেষে তাকাইয়া রহিল।
: তুমি হয়তো মনে করবা আমি ডুবিয়া ডুবিয়া পানি খাই, না হয় ওই সব কিছু।–হোসেন আরও একটু ব্যাখ্যা দিল : সেই রকম কোনো ঘটনা নাই। আসল কথা, ঘরে একটা মাইয়া ছেইলা না থাকলে কোনো শ্রী ছাদই যেন আসে না। আগে এমন দরকার বোধ করি নাই, এখন দিনে দিনে কেমন যেন অস্থির হইয়া পড়ছি। হ, এইরকমই বলা ভালো, কেমন চঞ্চল হইয়া পড়তে আছি। কী জানি, হয়তো এরই নাম হইবে সেই যৈবন, তুমি যার কথায় কও পদ্মপাতার উপর পানির মতো টলমল, এই কালে থির থাকন তার স্বভাবে। নাই। আমি আসমান-জমিন, কোলা-খেত-মাঠ, খাল-বিল, ঘর-বাড়ি, মানুষ জন, গাছ-গাছালি, জন্তু-জানোয়ার, পশু-পাখালি যেইদিকেই দেখি, একটা বাসনাই যেন চৈত-বৈশাখের ভাপের নাহান পুড়িয়া পুড়িয়া দপ করিয়া জ্বলিয়া উঠতে চাইতে আছে। বিষয়টা সুখের না, একটা বিহিত করতেই হয়।
হোসেন জানে বইকী বিলক্ষণ, এইরকম একটা অভাববোধ হয়তো শিকদারেরও মনে আছে, কিন্তু জীবনে একটা ঘা খাইয়া সে আর কাহারও উপর বিশ্বাস আনিতে পারে নাই, পারিবে না। তবে সকল মেয়ে মানুষই যে একই রকম হইবে তাহার কথা কি পুথি-কেতাবে আছে? যদি তাহাই হইত, চলিতে পারিত দুনিয়াজোড়া এত এত মানুষের সংসারধর্ম? সুখ কি কাহারও নাই, কিছুই নাই?
শিকদার মুখ ফিরাইয়া হাসিতে চাহিল, আবারও তাহার মুখে কোনো তরল কথা জোগাইল না; উঠিয়া সে দোতারাটা লইয়া আসিল; টুং টাং আওয়াজ তুলিয়া সে ধীরে ধীরে একটা গীত ধরিল :
সুজন বঁধু, প্রেম করিওনা না করিয়া ওজন।
ইলিশ মাছ কি বিলে থাকে
কিলাইলে কি কাঁঠাল পাকে গো?
বল্লা কি যায় মধুর চাকে
ভেঙ্গুর কি যায় মধুবন,
প্রেম পিরিতির এমন ধারা।
যেন জাতিসাপের লেজে ধরা।
উলটিয়া ছোঁ মারিলে
সখা, বাঁচবে না তোর এ জীবন!
হোসেন একটু অসহিষ্ণু ভাব দেখাইল : দূর, ওই সব প্রেম-পিরিতির কথা না বয়াতি ভাই, প্রয়োজন, আমি গরজের কথা কইতে আছি। তোমার কাছে। শোনা গীতের কথা আমিও উল্টা করতে পারি :
ওরে রসগোল্লার স্বাদ পাবি কি তুই
চিটাগুড় খাইলে?
কিঞ্চিৎ মধু পাবার আশায়
ঝাঁপ দিলি তুই বল্লার বাসায়
তোরে বল্লায় কামড়াইলে!
বয়াতি ভাই, আমার চাইয়া এলেম-তালেম তোমার অনেক বেশি। ফস করিয়া কোনো কামকায্য তোমার স্বভাবে নাই। অনেক ইচ্ছা, অনেক কষ্ট তুমি মনে মনে সহ্য করার ক্ষমতা রাখো। আমার সেই শক্তি নাই, সত্য কি জানো, কোনটা মধুবন আর কোনটা বল্লা কি ভেঙ্গুর, সেইসব তবধও আমার মনে ভালো করিয়া পয়দা হয় নাই, বোধ করি হইবেও না। সেই জন্যই তো তোমার পরামর্শ চাই। এখন যে-বয়সের যা ধরম, তা মানিয়া না চললে আমারও আরও আউল-বাউল হইয়া যাওয়া ছাড়া গতি নাই! আমার মনে কয় না, দুনিয়ার সব মাইয়া মানুষের একই প্রকৃতি, একই স্বভাব। তারা সংসারের শোভা, তাগো ছাড়া এইরকম শূন্য শূন্য জীবন, এই রকম দিন গুজরানির কোনো অর্থ হয় না। তোমার মনে কোনো পুরানা কথা আমি খোঁচাইয়া তুলতে চাই না। তবু তোমার চুপ করিয়া থাকলে চলবে না। একটা পরামর্শ দিতে হয়।
শিকদার দোতারাটা কোলের উপর হইতে সরাইয়া রাখিল; বেশ কিছুক্ষণ পরে হোসেন-এর দিকে সম্মিতভাবে তাকাইয়া বলিল : কেবল একটা মাইয়া মানুষ দিয়াই সংসার হয় না, একজন পুরুষ মানুষের ইচ্ছা-আকাক্ষা হিম্মত তাকতও বোধ করি যথেষ্ট না। তবু দুঃখ থাকে। সেই সুখ কেমন করিয়া কাটান যায় তা নিয়া আমারও তো জিজ্ঞাসার শেষ নাই।
: তত্ত্ব-কথা থাকুক, একটা সমূহ পরামর্শ চাই।-হোসেন আবারও অধৈর্য দেখাইল। শিকদার তাহার স্বভাবসিদ্ধভাবে আরও কিছুক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করিয়া ধীরে ধীর বলিল
: তুমি যেন অন্ধের কাছে পথের ঠিকানা চাইতে আছ। তবু বলি, কথাটা যখন এমন করিয়াই তোমারে আশ্রয় করছে বেশ একটু বিবেচনা দরকার। ফট করিয়া কোনো কিছু করা কি ঠিক হইবে? দেখো, শোনো, বেশ একটু খোঁজখবর লও। তোমার ইচ্ছার কথা বোঝলাম, কিন্তু ওই তরফের মনোভাবটাও তো বুঝতে হইবে!
আপাতত সেই বিষয়টাই হোসেনকে বেশি অস্থির করিয়া তুলিয়াছিল। হঠাৎ করিয়া কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছিবার ইচ্ছা তাহারও ছিল না। প্রথাসম্মতভাবে, এইসব ক্ষেত্রে যেমন দস্তুর, সে ঘটকালির কথাও চিন্তা করিতে পারিত; কিন্তু তাহার অসীম সাহসের পিছনে যেন এক ভীরু শিশুচিত্তও লুকাইয়া ছিল। সখিনার বাপ-মা রাজি হউক বা না-হউক, সে যে অন্য কাহারও দয়িতা, সেই রকম একটা আঘাত যেন সে-ও এড়াইয়া চলিতে চাহিয়াছিল। সুতরাং নানারকম দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনার পর সে স্বয়ং তাহাদের খোঁজখবর লইতে যাওয়াই মনস্থ করিল।
এক শিকদার ছাড়া জানাইবার মতো কেউ ছিল না, কিন্তু তাহাকেও জানাইল না।
গঞ্জে আলীর বাড়ির ঘাটে নৌকা বাঁধিয়া উঠানের পাড়ে আসিতেই চোখ পড়িল, উঠানে ধান মেলিয়া দিতেছে সখিনা; কেবল পুষ্ট পুষ্ট ধানই নয়, সখিনাও যেন প্রখর রৌদ্রে তাহার চোখ ধাঁধাইয়া দিল। ঘন সুপারিবনের আড়ালে দাঁড়াইয়া, সখিনার সেই আধা-উবু হইয়া দুই হাতে ডাইনে বাঁয়ে ধান মেলিয়া দিবার ছন্দে সে এক রকম আত্মবিস্মৃত হইয়া পড়িল। সম্ভবত কোনো সময় কোনো শব্দ হইয়া থাকিবে, সখিনা তাহার উপস্থিতি টের পাইয়াই চমকিয়া গেল।
: আরে, তুমি ওইখানে? কী মনে করিয়া? কখন আইলা?
সখিনা কোনো উত্তরের অপেক্ষা করিল কি করিল না, গায়ের আঁচল মাথায় টানিয়া সে দ্রুতপদে ঘরের হাতিনার দিকে আগাইয়া গেল। তাহার হাতের চুড়ি বাজিল, পায়ের মল-এর ধ্বনি যেন আরও মুখর হইয়া উঠিল। আসো, আসো, বসো আসিয়া, মা-য়রে খবর দিই।
হোসেন ফস করিয়া বলিল ফেলিল : নাহ, বসার ইচ্ছা নাই।
: ক্যান?-সখিনা মুখ ফিরাইয়া উত্তর খুঁজিল।
তাহার সেই দৃষ্টি যেন বড়ো পুকুরের মতো টলটল, আরও গভীর, সেই দৃষ্টি পুকুরের মতোই বুকে কাঁপন ধরাইয়া বহিয়া গেল। হোসেন তবু বলিয়া গেল : ক্যান না! যা পর পর হইয়া গেছি; আমারে দেখিয়া অত্তো বড়ো ঘোমটা তো কক্ষনো টানিয়া দেও নাই!
: ও! সখিনা মৃদু হাসিয়া তাড়াতাড়ি ঘরে উঠিয়া গেল; কপাটের আড়াল হইতে উঁকি দিয়া আরও বলিল : বসো, বসো তুমি, মা-য়রে খবর দিই।
সেই রকম কোনো ইচ্ছা থাকুক বা না-থাকুক, অন্য কিছুই করিবার ছিল না। কিছুকাল পরেই হাতিনার উপরকার কপাটের আড়ালে সখিনার মা-এর সাড়া পাওয়া গেল; মনে হইল পা-এর বাতের ব্যথা লইয়া কোনো রকমের স্বচ্ছন্দে বসিতে উদ্যোগ করিয়াছে। সখিনাও ঘরের মধ্যে থাকিয়াই তাহার সম্মুখে পানদান আর কয়েকটা পান আনিয়া দিল।
সাধারণ কুশলবার্তাদি জিজ্ঞাসার পর সখিনার মা তাহার শারীরিক বৈকল্যের দীর্ঘ ইতিহাস বলিতে শুরু করিল; কোথায় কোন কোন কবিরাজ কী ডাক্তার দেখানো হইয়াছে, কত কত হাত দর্শনি হইয়াছে এইটা-সেইটা বেচিয়া, কে কোন ঔষধ বা বড়ি হয় পটপটি কোন কোন অনুপানের সঙ্গে খাইতে বলিয়াছে, সেই সব খুঁটিনাটিও তাহার বর্ণনা হইতে বাদ পড়িল না। সেইসব শিকড়-পাতা কি গাছ গাছালির বাকলের কোনো অভাব ছিল না পুরানো বাড়িতে, কিন্তু এই বাড়িতে কিছুই নাই; মানুষের আর এই জাতীয় ঔষধের উপর বিশ্বাসও বড়ো নাই।
হোসেন খুব মনোযোগ দিয়া সব শুনিবার ভান করিতেছিল বটে, কিন্তু কাছাকাছি আবডালে বসা সখিনার দিকেই দৃষ্টি যাইতেছিল ঘুরিয়া ঘুরিয়া; মনে হইল সে-ই একসময় মা-এর হাত ঠেলিয়া পানদানটা আগাইয়া দিল।
: তা এখন এমন ডাঙর জোয়ান, ঘর-সংসার নিশ্চয়ই করছ-জিজ্ঞাসা করিল সখিনার মা। সেইদিন যখন মাছ দিয়া গেলা তখন ভালোমতো সংবাদ লইবারও সুযোগ হয় নাই। তা কোথায়, ছেলেমাইয়া হইছে?
হোসেন একটু বিব্রত বোধ করিলেও দৃষ্টি ফিরাইয়া মাথা নাড়িল : বিয়াই করি নাই চাচি, এ সব ঘর-সংসারের ভাগ্যে সকলেরই হয় না।
: সেইটা কী কথা! একেবারে পথের ফকিরও তো কেউ তোমাদের কইবে না।
হোসেন একটা পানের খিলি আঙুলে ভঁজ করিয়া বলিল : যা দিনকাল পড়ছে চাচি, এখন দুইবেলার ভাত জোগানই দায়। খাওয়ামু কী বিয়া করিয়া?
সখিনার মা একটুকাল বিস্মিত হইয়া রহিল : শোনো, কী আজব কথা। কত ঘর-সংসার দেখি, দেখতে আছি চতুর্দিকে, তোমার লাহান জোয়ান মানুষ কে কোনখানে সংসার-ছাড়া পড়িয়া রইছে? হঠাৎ সখিনার দিক হইতেও একটা শ্লেষ ভরা প্রশ্ন আসিল : ক্যান, বউ বুঝি কেবল খাইতেই ঘরে আসে? হোসেন একটু সময় লইয়া ধীরে ধীরে বলিল : সেইখানেই তো কথা। ভালো অশন-বসন, আঙটি-চুঙটি, বাহারের পালঙ্ক, কত রকম চাহিদা, দেখি তো চতুর্দিকের অবস্থা।
সখিনার দিক হইতে তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ আসিল : জ্বী না, সব মাইয়া ছেইলাই তেমন আহট লইয়া সংসারের যায় না। যায়ও যদি তার জন্যও ডেনার জোর রাখতে হয়। এখন আর সেইদিন নাই, সক্কলরেই সংসার সাজাইয়া গুছাইয়া লইবার ভার নিতে হয়।
সখিনার মা বলিল : তা চিন্তা ভাবনা ভালোই। তবে এখনও বিবাগী হইয়া থাকন কোনো ভালো লক্ষণ না। এই-ই তো সময়, দেখিয়া-শুনিয়া একটা ভালো মাইয়া ঘরে আনিয়া সব কিছু গুছাইয়া লইতে মন দেও।
হোসেন মাথা নিচু করিয়া মেঝের উপর দৃষ্টি রাখিয়া বসিয়া রহিল; অনেক চিন্তা-ভাবনার পর একটু হাসিতে চাহিল : হে, চাচি, যেমন কপাল লইয়া জন্মাইছি, তাতে আমার মতো গবির-পুর্বারে কে-ই বা কার ভালো মাইয়া দিতে চাইবে?
সখিনার মা গালে হাত দিল : এইটা কোনো কথা হইল? তুমি বসো বাজান, খাওয়া-দাওয়া করিয়া যাবা, সখিনার বাপেরও কাম-কায্য থেকিয়া ফিরিয়া আসার সময় হইল। গরিবের ঘর, তবু দেখি কিছু ভালো-মন্দর কী জোগড় করন যায়।
হোসেন আপত্তি উঠাইল : না, না, চাচি, আমারে এমন আস্তিকের কোনোই প্রয়োজন নাই। ত্বরাত্বরি বাড়ি ফিরতে হইবে, অনেক কাম-কায্যের উদ্বেগ আছে।
কপাটের আড়ালে থাকিয়াই সখিনা একটু অভিমান দেখাইল : তবে আইলেনই বা ক্যান এমন ভোলা পাহায় দিয়া? মন বসে না, সেই আসল কথাটা কইলেই হয়!
হোসেন একটু চমকাইয়া গেল। সখিনা কি বাস্তবিকই সেই কথাগুলি বিবেচনা করিয়া বলিতেছে? মন চাহিল বলিয়াই তো সে আসিয়াছে, না কি অন্য কিছু? মন তো চায় সে সব কিছু ঢিলা দিয়া একদম অবশ হইয়া বসে মাথার পিছনে দুইহাত বাঁধিয়া এই হাতিনার উপরেই নেতাইয়া পড়ে, আর সখিনা সেই ছোটকালের মতো নানান কথা বলিয়া যাউক, রাত্রির অন্ধকার আরও তাড়াতাড়ি নামিয়া আসুক, মিটিমিটি করিয়া তারা নক্ষত্র জ্বলে উঠুক আকাশে, এইদিক সেইদিকের ঝোঁপ-ঝাড়ের মধ্যে জোনাকির দল আসুক ঘুরিয়া ঘুরিয়া, কিন্তু সেই শক্তি যেন আর জীবনে কোনোখানে নাই। মন বসিত, যদি সে পারিত আবার সেই শৈশব দিনের সব রকমের কল্পকথা অবাধে সখিনার সঙ্গে গল্প করার সুযোগ পাইত। সেই যে কত কত ছাড়া বাড়ির জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরিয়া ফলমূল তালাশ করা, এইখান-সেইখান হইতে সব ভয় বিপত্তি তুচ্ছ করিয়া জঙ্গলের হোনকাইচ খুঁটিয়া খুঁটিয়া মিছা মিছা রত্নের ভাণ্ডার সাজানো, খালের জলে ঝাঁপাঝাপি করিয়া মাছ ধরার উল্লাস, এই রকম দিনে খালের অথবা বিলের পাশে পাশে কাশফুলের গুচ্ছভরা ঝোপে ঝাড়ে ডাহুকের ডিম না হয় কেয়াফুলের সন্ধান, কেবলই খুঁজিয়া ফেরা কোনখানে আছে কোন পাখির বাসা, কোনখানে থাকে ব্রহ্মদৈত্য আর কোনখানেই বা প্রলয়ঙ্কর আজদহা অজগর–এইসব তো এখনও মনে হয় মাত্র অল্প কিছুদিনের ঘটনা। এখনও তো তাহার স্বপ্ন মনে পড়ে শীতদিনের ভোরবেলায় সখিনা জিহ্বা বাহির করিয়া খেজুর গাছতলায় দাঁড়াইয়া থাকিত; উপরের গাছের মাথা হইতে এক ফোঁটা রস পাইলেও সে মহা হৈ চৈ করিয়া অসাধারণ তৃপ্তির ভান দেখাইত; একবার সেই রসের ফোঁটার সঙ্গে একদল মিষ্টিলোভী পিঁপড়া তাহাকে কী না ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিয়াছিল। একবার কাউফলের স্বাদে সে যে কেমন মুখ বিকৃত করিয়াছিল তাহা এখনও হোসেন স্পষ্ট মনে করিতে পারে। হোসেনের মন বসিত যদি সে আবারও দেখিতে পারিত সখিনা সবুজে পালে হরিতে ভরা কলাবতীর ঝড়ের আড়ালে লুকোচুরি খেলিতে ব্যস্ত, যদি দেখিত সেই পুরানো বাড়িয়ালের পাশ হইতে নুইয়া পড়া আমগাছের ডালে চড়িয়া সে-ও বৈশাখী বাতাসের মতো উদ্দাম হইয়া আবোল-তাবোল গান জুড়িয়া দিয়াছে। তাহারে মন বসিত, বাস্তবিকই সেই সখিনার সঙ্গে এখনকার এই তরুণীর সকল সাদৃশ্য খুঁজিয়া পাইত। এখনও এইখানে ‘আহ্বান আছে, কিন্তু হোসেন নিজেও বুঝিয়া উঠিতে পারিল না কেন সে তাড়াহুড়া করিয়া বাড়ির পথ ধরিল।
পথে গঞ্জে আলীর সঙ্গে দেখা। হোসেন খেয়ালই করে নাই। গঞ্জে আলীই থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িয়াছিল। তাহার সঙ্গে গাঁ-গ্রামের বড়োমিঞা কিসিমের আর একজন গোলটুপি পড়া কেউ। নজর, ছুঁচালো করিয়া তাহার পরিচয় নিবার জন্য উৎসুক্য হইয়াছিল।
: বান্ধব, বান্ধব, সেই পুরানো বাড়ির লাগ বরাবর পড়শি।-গঞ্জে আলী সেই বড়োমিঞার উৎসুক্য এড়াইয়া হোসেন-এর খোঁজ খবর লইল।
হোসেন একটু বিস্মিত হইল তাহার আস্তিক-আহ্বান-এর পীড়াপীড়ি লক্ষ করিয়া : পাগল না কী, এই ভর দু-পহরে এত কড়া রৌদ্র মাথায় লইয়া না খাইয়া যাবা এইটা কোনো কামের কথা! আসো, আসো-গঞ্জে আলী তাহার হাতে ঝুলান খালুই উঁচাইয়া দেখাইল : খোড়ল হাতাইয়া কত্ত বড় বড় কই মাছ পাইছি দেখো, খাইয়া-দাইয়া ধীরে সুস্থে যাইও।
হোসেন একটু ইতস্তত করিল। গঞ্জে আলীর এইরকম সমাদর তাহার প্রত্যাশারও অতীত। সামান্য জমি-জমার বিষয় লইয়া কী বিবাদটাই না বাঁধিয়াছিল। খালপাড়ে তাহাদেরই বাড়ির একটা প্রান্ত মাত্র। গঞ্জে আলীরও কোনো ঠাই নাই দেখিয়া মুজফফরই তাহাকে সেইখানে থাকিতে দিয়াছিল। দুই জনেই কেরায়া নৌকার মাঝির কাজ করিয়াছে, কিন্তু মুজফফরের শরীরটা খারাপ হইয়া পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাহার মেজাজটা যেন আরও বিগড়াইয়া গেল। গঞ্জে আলী অনেক সহ্য করিয়াছে; তাছাড়া সম্ভবত অন্য কোনো কারণও ছিল যা হোসেন কখনও আন্দাজ করিতে পারে নাই।
সেই সময় বড়োমিঞা ধরনের লোকটি আগাইয়া আসিল : আরে মিঞা এই তো তোমার দোষ, তুমি মানুষের গরজ বোঝে না। যখন বাড়িতে কাম কায্য থাকে তখন কি আর আহার বিহারে মন দেওন যায়, আমারেও ত্বরাত্বরি ফিরতে হইবে। তোমারও মনে কয়-হোসেনের দিকে চাহিয়া সে একটা সিদ্ধান্তও দিয়া দিল; খেত-খামারের কাজে ঢিলা দেওয়া যাইবে না, কি কও মিঞা?
হোসেন-এর পক্ষে মাথা দোলাইয়া সায় দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর রহিল না।
গঞ্জে আলীও আর পীড়াপীড়ি করিল না : বেশ, বেশ, কাজে-কর্মে মন থাকা খুবই ভালো কথা।
: নিশ্চয়, নিশ্চয়। বলিল সেই বড়োমিঞা কিসিমের সেই লোকটি।
: তবে আসিও আর একদিন, খুব শিগগির শিগগিরই, কেমন?
: আচ্ছা।–হোসেন আবারও মাথা দোলাইয়া খালের পাড়ে বাঁধা নৌকার দিকে পা বাড়াইল।
.
০৪.
নর চায় নারীসঙ্গ
নারী চায় নর
একে দেখো করি আছে
অন্য জনে ভর।
এই ভাবে সাজিয়াছে
জগৎ-সংসার
কর্মশক্তি না থাকিলে
সকলই অসার।
প্রেম-প্রীতি হাসিয়া ওঠে
নিজ প্রয়োজনে
সকলই মিলাইয়া যায়, বঁধু,
অভাব-অনটনে
গৃহস্থের গৃহ চাই
ঘরনির সুখ
কর্মশক্তি না থাকিলে
জগৎও বিমুখ।
ভবি চায় এক ভাব
মন চায় আন
দুই ক্ষুধা মিলাইলে
গুণীর সন্ধান ॥
বাস্তবিক পক্ষে হোসেন বাড়িতে কোনো উদ্বেগ রাখিয়া আসে নাই। বরঞ্চ কোনো বিশেষ কিছু করার ছিল না বলিয়াই তাহার দুর্ভাবনা বাড়িয়া চলিয়াছে। একটা ঘর, আর তাহার আশে-পাশে সামান্য, অতি সামান্য কিছু ‘রাগ’ মাটি, যেখানে একসময় ছিল নেহাত ঝোঁপঝাড় অথবা ময়লা ফেলার ঠাই। বাপের অসুখে মায়ের মৃত্যুতে ছোট হালের জমিটি হাতছাড়া হইয়া যাইবার পর, কোনো উপায়ান্তর না দেখিয়া সেই চিলতা ঠাই-এর উপরেই সে কিছু শাক-সবজির খেত বানাইয়াছে। তবে তাহা দিয়া তো আর জীবন চলে না, কেরায়া নৌকা লইয়া গঞ্জে ঘাটে চড়নদার তালাশ করার কাজটাই এখন মুখ্য। চুরির ভয়ে সবজিখেত একেবারে ছাড়িয়া রাখিয়া যাওয়াও সম্ভব না। হোসেন যতই চিন্তা করিয়াছে কেবলই দেখিতে পাইতেছে গৃহস্থালির পেশাও সংসার পরিবার ছাড়া সম্ভব করার উপায় নাই। নিজের ঘর-বাড়ির দিকে চাহিয়া তাহার মনের অস্থিরতা আরও বাড়িয়া যায়। ঘরের চাল বদলানো দরকার, মুলিবাঁশের বেড়াগুলিও খসিয়া ধ্বসিয়া পড়িতেছে; ভালো কাদা জোগাড় করিয়া ভিটাটাকেও মজবুত না করিলে চলে না। তা না হইলে হয়তো আরও একটা বন্যার কালে একেবারে গলিয়াই মিলাইয়া যাইবে। কেরায়া নৌকাখানির ছইও আবার মজবুত করিয়া বাধিতে হইবে, খোলের বাইরে ‘গাব’-এর পালিশ দিয়া বেশ একটু সংস্কারও দরকার। সে কাজেও একটা সাহায্যের হাত চাই। অথচ শৈশবকালে দেখিয়াছে এইসব কাজে কখনওই তেমন কোনো বেগ পাইতে হয় নাই। একজনের কাজে আগ বাড়াইয়া দশজন আসিয়া যোগ দিয়াছে। যে কোন কাজ যেন এক একটা উৎসবের উপলক্ষ বলিয়া মনে হইয়াছে। ঘর ছাওয়া অথবা নতুন করিয়া বানানো, পুকুর পরিষ্কার, খেতে হাল দেওয়া কিংবা ধান কাটা-বাছাই, নৌকা ডিঙি তৈরি, এমনকী মাছ ধরতে গাঙে কি বিলে যাওয়া, চৈত্র-বৈশাখ খেতে মাঠে নোতুন ওঠা পানির মধ্যে মশাল জ্বালাইয়া মাছের শিকার–কোননা কাজই এককভাবে অথবা উৎসবহীনভাবে সম্পন্ন হয় নাই। যার পক্ষে সেইরকম উৎসব অথবা যথাযোগ্য আদর-আস্তিকের সুযোগ নাই, তাহার জন্য উদ্বেগ দেখাইবার মানুষেরও ঘাটতি পড়িয়াছে।
দুনিয়াভরা এত মানুষ থাকিতেও চতুর্দিকে চাহিয়া তখন কাহাকেও আর চোখে পড়ে না যাহার দিকে পা বাড়াইতে ইচ্ছা হয়। ঘুরিয়া-ফিরিয়া বারংবারই মনে হয় শিকদারের কথা; সে কখনও যে-কোনো প্রয়োজনে হোসেনকে বিমুখ করে না; কিন্তু তখনকার মতো তাহার বাড়ির দিকে যাইতেও মন চাহিতেছিল না; ভয় হইল, হয়তো নেহাত আদনা বিষয় লইয়া কথায় বসিলেও কোনো না কোনোভাবে সখিনা প্রসঙ্গ উঠিয়া পড়িবেই। বারংবারই মনে হইতে লাগিল, তাহার ঘর-দুয়ারের যে ছিরি, তা কোনো কন্যারই মন ভুলাইতে পারিবে না। তাহাকে বধূবেশে এই ভাঙাঘাটে নামাইয়া লওয়া, এমন অযত্নে পড়িয়া থাকা উঠানের উপর দিয়া বাজাইয়া সে ধীরে ধীরে তাহার ওই মনে গিয়া উঠিবে, এমন কল্পনার বাস্তবিকই কোনো অর্থ নাই। খেত নাই, খামার নাই, কোন বলে সে এই ভগ্নশ্রী সংসারকে নতুন করিয়া গড়িয়া তুলিতে পারিবে? একমাত্র একটা স্থির সংকল্প আর নিজ বাহুবলের প্রয়োগ ছাড়া অন্য কোনো পন্থা চোখে পড়িল না।
এই সময় হঠাৎ দেখিল তাহার অন্য এক বন্ধু আমজাদের কেরায়া নৌকাটি খালের অন্য একধারে বাঁধা; গাছপালা আর ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে সন্তর্পণে দোল খাইতেছে। যেন কোনো গৃহস্থ বউ নিজ অঙ্গ মাজিতেছে নিরালা ঘাটে; হোসেন যেন একটা কূল পাইয়া গেল।
আমজাদের বাড়িতে উঠান ভর্তি ছেলেমেয়ে, ঘর-গৃহস্থালির চেহারাও অন্যরকম; অনেক ডাকাডাকির পর সে বাহির হইয়া আসিল; গামছাটা কাঁধে বিন্যস্ত করিয়া রাখিতে রাখিতে একগাল হাসিয়া বলিল : শেষ রাত্তিরে আসছি, বড়ো জোর ঘুমে পাইছিল, তেমন কিছু কানে যায় নাই।
: আরে মর্দ, তুমি যে কখন আসে কখন যাও কিছুই টের পাওন যায়!-হোসেন তাহার সঙ্গে একটু আড়ালে সরিয়া গেল : আরও কয়েকদিন তালাশ করছি। তাজ্জব হইয়া কেবল ভাবি সব সময়ই তো বাহিরে বাইরে, ঘর-পরিবারের জন্য সময় মেলে কখন?
আমজাদ হাসিতে লাগিল : কী করা, সবই করতে হয়! স্বামীধর্মও। সবে এখন মৌসুম পড়ছে, তায় ডেনায় যতক্ষণ জোর আছে ততক্ষণ ফায়দা উঠাইয়া লইতে হয়। কেবল মাঝে মধ্যে এক আধটা রাত্তির বাড়ি আসা ছাড়া অন্য কোনো হাউস-বিলাস নাই।
হোসেন একটুকাল তাহাকে নিরীক্ষণ করিয়া প্রসঙ্গটা পরিবর্তন করতে চহিল : তা কেমন চলছে কাম-কারবার?
আমজাদ একটু মাথা চুলকাইল : ওইখানেই তো অসুবিধা। মানুষের আগের মতো আসা যাওয়া নাই। গাঁও-গ্রামের যে মানুষরা একবার গিয়া শহরে নামতে পারছে তারা কেউ আর তেমন নামিয়া আসে না। যে-ঘাটেই যাই, এক চড়নদারের জন্যে রাজ্যের মানুষের মধ্যে যেন কাড়াকাড়ি পড়িয়া যায়। ওরই মধ্যে বুদ্ধি খাটাইয়া চড়নদারের জোগাড়ে সময় লাগিয়া যায়, আর ন্যায্য রোজগারটাও তেমন হয় না। তবু আছি, টিকিয়া আছি এখনও। দেখি তো, কেবল রিজিক দেনেওয়ালার জন্য বসিয়া থাকিলে কাম আউগায় না। তুমি কী ঠিক করলা?
: নৌকাখানের একটু মেরামতের দরকার পড়ছে। তারপরই আসিয়া যামু।
হোসেনের একবার ইচ্ছা হইল নিজ নৌকাটা দেখাইয়া আমজাদের সহায়তা চায়, কিন্তু দমন করিয়া লইল : কোন ঘাটে কখন আছ জানতে আইলাম। এ কামে তোমার কাছে অনেক এলেম তালেম নেবার আছে।
আমজাদ ধীরে ধীরে বলিল : আসিয়া যাও, জানোই তো সব হালচাল। বাদবাকি সবও ঠেকিয়া ঠেকিয়া রপ্ত হইয়া যাইবে। আরও দুই দুইটা পূর্ণিমাতক নলছিটির ঘাটেই আছি। ছোটো ছোটো ক্ষেপ লইয়া এদিক সেদিক যাই, তবে একদিন দেখা পাই।
: তুমি কেবল একটু ঘাট-মাঝিরে বলিয়া রাখিও। তা না হইলে হয়তো নৌকা ধারে কাছে ভিড়াইতেও দিবে না। তার সঙ্গে বন্দোবস্তের সাহায্য চাই।
আমজাদ সংক্ষিপ্তভাবে মাথা নাড়িল। ইতিমধ্যে ছোটো একটি মেয়ে তাহার ভাইকে কোলে লইয়া তাহার হাত ধরিয়া টানিতেছিল।
আমজাদ শিশুপুত্রটিকে কোলে লইয়া বাড়ির দিকে একবার ইঙ্গিত করিয়া হাসিল : ধারে-কাছে পায় না খুব একটা, তাই ডাকাডাকি লাগাইছে। হোসেনও হাসিতে চাহিল : বেশ, বেশ, যাও, তোমারে আর আটকাইয়া রাখতে চাই না।
: তা তেমন কোনো আদর-আস্তিকও গ্রহণ করলা না!
: হইবে, হইবে, অন্য সময় হইবে।
আমজাদ পুত্রকন্যাদের ভিড় লইয়া অন্তঃপুরের দিকে অগ্রসর হইল। হোসেনও খালপাড় হইয়া শিকদারের বাড়ির কাছাকাছি আসিয়া কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়াইয়া রহিল। শিকদার এবং আমজাদ বাস্তবিক দুই প্রান্তের দুইজন। একজন নিজের ঘর-পরিবারের জন্য কোনো হুশ না রাখিয়া বাহিরের জীবন লইয়া ব্যাকুল, আর অন্যজন সেই বাহিরকে একেবারেই উপেক্ষা করিয়া তাহার অন্তঃপুর লইয়া আকুল। শিকদারের অফুরন্ত অবসর আছে। বলিয়াই সামাজিকতারও ফুরসৎ আছে।
সে তাহার বারান্দার একধারে একমনে কী সব লইয়া ব্যস্ত ছিল; সামনে কিছু কলাপাতা, হাতে খাগের কলম; হোসেনকে দেখিয়া সরাইয়া রাখিল।
সে খুশিমুখে হোসেনকে সমাদর করিয়া বসাইল : আমিও ভাবতে আছিলাম, একবার তোমার ওইদিকে যাই। কেন যেন মনে হইতে আছিল তুমি একটু উদ্বেগের মধ্যে আছ।
: হ। ঠিকই!-হোসেন মাথা নাড়িয়া আরও বলিল : আমজাদের সঙ্গে কথাবার্তা কইয়া আসলাম, আর অনর্থক দেরি না করিয়া কেরায়ার কামে রওনা দিতে চাই।
: ভালো, খুউব ভালো কথা। বোধ করি মনটা একটু শান্ত হইছে।-শিকদার একটু ইতস্তত করিয়া বলিল : তুমি যদি চাও গঞ্জে আলীর কাছে আমিই সম্বন্ধ লইয়া যাই। তোমায় সুখে-শান্তিতে দেখলে আমারও আনন্দ পাইবে। হু, বিষয়টা লইয়া আমিও চিন্তা করছি।
হোসেন প্রথমে বেশ একটুকাল অবাক হইয়া রহিল; অনেকক্ষণ অবধি বাহিরের দিকে তাকাইয়া শিকদারের কথাগুলি মনে মনে পর্যালোচনা করিতে লাগিল, তারপর ধীরে ধীরে বলিল : তা হইলে তো ভালোই হইত। এই সমস্তে তোমার তেমন আর বিশ্বাস নাই বলিয়াই কথাটা তুলি নাই। তবে প্রস্তাব না, তাগো ইচ্ছা-অনিচ্ছাটা কী জানিয়া আসতে পারলেই ভালো হয়। ইতিমধ্যে আমার তো মনে হইতে আছিল, তুমি ঠিকই কও, যারগো কোনো তেমন অবস্থা নাই, তেমন বিশেষ আশা-ভরসাও নাই। তারগো সব লোকাঁচার মানিয়া চলন সহজ বিষয় না। কার্যত কিছুই হয় না, কেবল স্বপ্ন দেখার সুখটুকুই কপালে লেখা আছে। হ, সেই তোমার কথনই কইলাম!
শিকদারের সম্মুখে আসিয়া হোসেন যথাসম্ভব সংযতভাবেই কথাবার্তা বলে; আর যাই হউক কিংবা যে যাই বলুক, তাহাকে উপেক্ষা করিয়া কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সঙ্গত মনে হয় না। কোনো পাঠশালায় বা বিদ্যালয়ে যাইবার সুযোগ তাহার হয় নাই, কিন্তু মনে হয় জীবনই তাহাকে অনেক কিছু শিখাইয়াছে; তাহার সম্পর্কে অন্যান্যদের কথাবার্তার সময়ও সে একটা সম্ভ্রম লক্ষ করিয়াছে, হয়তো অন্য সকলের জন্য নিজেকে বিলাইয়া দিবার আগ্রহটাই সকলের কাছে তাহাকে এমন আত্মীয় করিয়া তুলিয়াছে। শিকদার এই গ্রামে থাকিয়াও, তাহাদেরই মতো একজন হইয়াও এক স্বতন্ত্র মানুষ। এই স্বাতন্ত্র, এই জগৎ-জীবন সম্পর্কে তাহার ধ্যান-ধারণা অন্যরকম কেন হইল, সে প্রশ্নের কোনো মীমাংসা হোসেন কখনও পায় নাই। এইটুকু কেবল জানে যে শিকদারের বহু পুরুষের বাসিন্দা ছিল ওই শ্রীহীন ঘর-বাড়িয়াল। কত রাজা রাজ্য আসিল, গেল, তাহারা কেউই শিকদারের মতো সাধারণ মানুষের জীবনে কোনো পরিবর্তন আনিতে পারে নাই। সে বলে না বটে এই পৃথিবী মায়া, এই সংসার কুহক, কিন্তু যেন ইহার মধ্যে থাকিয়াও, নাই, কোনো এক বিশেষ কারণে সে তাহার জীবনও অস্তিত্বকে ক্রমাগতই গুটাইয়া লইয়া একরকম নিভৃতবাসী হইয়াছে। সেই কারণটা সকলের কাছে এক রসাত্মক গল্প; হোসেনও শুনিয়াছে বইকী, কিন্তু সেই কারণটা সকলের কাছে সরাসরি উত্থাপনের সাহস পায় নাই।
লোকে জানে এক শৈশব-প্রেমের ব্যর্থতা তাহার জীবনে এমন ঔদাস্যের মূল। কেউ বলে আরও কত কী। শিকদার যে জানে না তা নয়, কিন্তু কোন শক্তি বলে সে সমস্ত কিছু উপেক্ষা করিয়া এমন অটল রহিয়াছে ভাবিয়া হোসেনের বিস্ময়ের কূল নাই। অত্যন্ত নিকট হইতে জানিয়াই সে এই মানুষটিকে সম্ভ্রম করিতে শিখিয়াছে; তাহার সম্মুখে সে নিজেকে যথাসম্ভব শুদ্ধভাবে নিজেকে প্রকাশ করার চেষ্টা করিয়া আসিতেছে।
: যদি বলল, আমি এই বিহানেই যাই। এইসব বিষয় লইয়া কোনো বাধ্যবাধকতা মঙ্গলের বিষয় হয় না। তোমার ঘর-সংসার হইলে আমারও যখন-তখন নানান খিদা মিটাইয়া লইবার একটা সুযোগ হইবে। আমার নিজেরও এইরকম অকর্মণ্য জীবনটার উপর বড় অশ্রদ্ধা আসিয়া গেছে।-শিকদার যেন নিজেকে সংযত করিবার চেষ্টাতেই অন্যদিকে মনোযোগ দিতে চাহিল।
: বেশ, তাই হউক,-হোসেন উঠিয়া পড়িল : ইতিমধ্যে আমি নৌকাটার মেরামতে মন দিই।
: সে-ই ভালো, সে-ই ভালো।-শিকদার বাড়ি হইতে অনেকদূর অবধি হোসেনের সঙ্গে সঙ্গে আসিল : বিহানবেলাটা ওইদিকে যাইবে, কিন্তু বৈকালে হয়তো বা তোমার কাম-কায্যে কিছু জোগান দিতে পারমু; বেলা পড়িয়া না আসলে এখনই কামে লাগিয়া যাওন যাইত।
না, না, এমন কোনো ত্বরাতৃরি নাই।-হোসেন তাহাকে বাড়ি ফিরাইয়া দিল : শিকদার ভাই, ওই সখিনারে না পাইলে আমার জীবনও যে আন্ধার হইয়া যাইবে এমন কোনো দুশ্চিন্তাও আমি করি না। আমি লড়াকু-লাঠিয়ালদের পোলা, কোনোখানেই হার মানতে আমার মন চায় না। এই যে জীবন জীবন বলিয়া জতুর্দিকে এত সব কথাবার্তা শুনি, কিছু তার বুঝি বা বুঝি না, কিন্তু একটা লড়াইর জন্য বড় উচাটন হইয়া উঠতে আছে দিনকে দিন। কী লাভ হইবে সেই লড়াই করিয়া যার কোনো পষ্ট অর্থ বুঝি না, কোনো ঠিকঠাক করা উদ্দেশ্যও দেখি না, একবার মন চায় একটা মাইয়া-মানুষ, একবার মনে হয় বিষয়-সম্পত্তি, কখনও আবার মনে কয় সব কিছু ছাড়িয়া-ছুড়িয়া কোনো শহরে-বন্দরে গিয়া উঠি। নিজেরে লইয়া একটা মহা জ্বালায় পড়ছি!
শিকদার হাসিতে চাহিল : ভালো, ভালো। জীবনের একটা লক্ষ্যও দরকার, উদ্দেশ্যও চাই। আমার তো মন বলে থির বান্ধনের কাল এখনও যায় নাই।
কথা বলিতে বলিতে দুইজনে খালপাড়ের গাছতলায় আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল। সন্ধ্যায় সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে নামিয়া আসিয়াছে। হোসেন অনুরোধ করিল : একটু বসো শিকদার ভাই, বুঝি বা না বুঝি, তোমার সঙ্গে কথা বলিয়া সুখ পাই।
শিকদার ইতস্তত তাকাইয়া আবারও বলিল : দেখো না চাহিয়া চতুর্দিকে, দুনিয়ার কোনখানে আর অন্য কারো মধ্যে চাঞ্চল্য নাই, কীট-পতঙ্গ, পশু পাখি, তরুলতা, আসমান-জমিন, গাঙ কী সমুদুর কোনখানে কি-ই বা থির হইয়া আছে? দেখি, পোয়ামি মা-এর পেটের শিশুও চঞ্চল হইয়া ওঠে বাহিরে
আসার জন্যে, জন্মকাল হইতে তামাম জীবনভর একটা না একটা চাঞ্চল্য তার স্বভাবধর্ম হইয়া যায়।
: হ, হইবে বা!-হোসেন একটু অন্যমনস্কভাবে বলিল : তোমার সব কথা বুঝিয়া ওঠার ক্ষমতা নাই, কিন্তু তুমি বয়াতিভাই, তুমি! মাঝে-মাঝে মনে কয় তুমিই যেন স্রোত ভুলিয়া দুমুড়ি কালের লাহান তবধো হইয়া আছ। না হয়, এই যে জগৎ সংসার, কেবলই অবিচল তার পাড়ে খাড়াইয়া আছ। আমার বিলক্ষণ মনে আছে তোমার একটা গীত। কিন্তু ওই ভাব লইয়া কেবলই যেন থামিয়া যাইতে হয়।
: কোন গীত?
: সেই যে আমার রূপ দেখিয়া ভরিয়া গেছে দুই আঁখি—
শিকদার খুশি হইল; এক সময়ে সে নিজেই তাহার সুর ধরিল :
রূপ দেখিয়া ভরিয়া গেছে দুই আঁখি
আমি আর আমার কথা বলব কী!
বোবায় যেমন স্বপ্ন দেখে
মনের আগুন মনেই রাখে
অন্তরে তেমনই লাইগাছে আগুন
বাহিরে জল ঢালিলে আর হবে কী!
হোসেন তবু বলিল : বুঝি, তোমার কাছেই শুনছি ঢেউ-এর উপর ঢেউ থাকে, বাতাসের মধ্যে বাতাস, স্বর-এর মধ্যে সুর। তোমার মনে কোনো রকম আঘাত দেওন আমার উদ্দেশ্য না, কিন্তু তোমাদের সংসারী দেখলে আমিও বড়ো সুখী হইতাম বয়াতি ভাই!
শিকদার হাসিয়া উঠিয়া পড়িল : মনে হয় ওই আমজাদের বাড়ি ঘুরিয়া আসিয়া তোমার আর একলা একলা সংসার করণের সাহস হইতে আছে না! উঠি, সন্ধ্যা নামিয়া গেছে, জীবজগতের নিয়ম মানিয়া চলতে হয়।
কখনওই শিকদারকে নিজ প্রসঙ্গ লইয়া মুখর হইতে দেখে নাই কেউ, না শুনিয়াছে তাহার নিজ মুখে কোনো ইতিবৃত্ত। লোকমুখে যাহাই প্রচলিত থাকুক, বউঝিরা যা লইয়াই কৌতূহলী হউক, হোসেন কখনও সেই সব গাল গল্পে বিশ্বাস আনিতে পারে নাই, মনে হইয়াছে শিকদারের মধ্যে অসাধারণ কোনো শক্তি আছে, হয়তো তা এমন কোনো বিচক্ষণতা যা হোসেন উপলব্ধি করিতে সক্ষম হয় না।
লোকশ্রুতি এক সময় এই গ্রামের একটা কন্যা সমস্ত চিত্ত অধিকার করিয়াছিল শিকদারের; তাহারই প্রেরণা উদ্দীপনায় শিকদার কবিয়াল হইল বটে, কিন্তু সেই কন্যা তাহার ঘরে আসিল না। অর্থ-বিত্তকেই সর্বস্ব জ্ঞান করিয়া সে নিজেকে অন্যত্র বিকাইয়া দিল। সকলের ধারণা সেই ঘটনার পর হইতে শিকদার নিজকে সব ঠাই হইতে সরাইয়া লইয়াছে; কোনো মেয়ে মানুষের উপর তাহার আর কোনো বিশ্বাস নাই, ভরসাও নাই।
আবার অন্য কেউ সেই সব কথা একান্ত বেহুদা বলিয়া উড়াইয়া দেয়, বলে এই দেশের মাটিই বড়ো পিচ্ছিল, বহুজনই কোনো না কোনোভাবে একবার পড়িয়া গিয়া আর কখনও খাড়া হইয়া দাঁড়াইতে পারে না। কেউ বা বলে, শিকদারের মতো মানুষেরা এইসব মুলুকের জীবনের সঙ্গে লড়াইতে ব্যর্থ হইয়াই নানারকম ভাব-তত্ত্বের আড়ালে-আবরণে কেবলই নিজেদের লুকাইতে চাহিয়াছে। সেই সব আলোচনাও হোসেন খুব একটা বুঝিয়া উঠিতে পারে না; শিকদারকে সে খুব নিকট হইতে জানে; তাহার সম্পর্কে কোনো সাধারণ রসাত্মক আলোচনা তাহার কখনই সহ্য হয় না। এখন যে সে নিজেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া গঞ্জে আলীর বাড়ি যাইতে মনস্থ করিয়াছে তাহাতে হোসেন মনে মনে খুবই কৃতজ্ঞতাবোধ করিতে লাগিল।
তবু নানারকম অস্থিরতায় সেই রাত্রে ঘুম আসিতে চাহিল না চোখে; একসময় সে বসিল আসিয়া বাহিরের হাতিনায়; উঠানের উপরকার তারাভরা আকাশের দিকে চাহিয়া। চতুর্দিকে তখন নিঝুম, কেবল একটা উচ্চিংড়া ভিতরে কোন ফোকর হইতে ডাকাডাকি করিয়া সেই নিঃস্তব্ধতাকে খণ্ড-বিখণ্ড করার চেষ্টা চালাইতেছিল। আরও পোকামাকড় ডাকাডাকি করিতেছিল চতুর্দিকে, কিন্তু সেই উচ্চিংড়াটার ঔদ্ধত্য অসহ্য মনে হইল, সে একসময় পিড়ার কাছে তাহার অবস্থান অনুমান করিয়া লাঠি দিয়া খোঁচাইয়া স্তব্ধ করিয়া দিল। কিন্তু একটুকাল পরে মনে হইল সেইটা আরও কোনখান হইতে মুখ বাহির করিয়া আরও জোরে-শোরে ডাকাডাকি শুরু করিয়াছে। কেবল সেইটা একা কেন, চতুর্দিক তাহাদের সংখ্যা শুমারেরই বা সাধ্য আছে কার। সামান্য। এক পশলা বৃষ্টির পর পরিষ্কার আকাশ-বাতাস তবু অন্ধকারে স্পষ্ট কিছু দেখা না গেলেও মনে হয় অকস্মাৎ যেন সেই জীব জগতের কাহারও চোখে ঘুম। নাই; সবাই সকলকে ডাকাডাকি করিয়া একটা মহা হট্টগোল লাগাইয়া দিয়াছে। চৈত্র-বৈশাখের ঝিঁঝিও এমন তারস্বর বলিয়া মনে হয় না। মনে পড়িল একদিন শিকদারই বলিয়াছিল আদতে এত চেঁচামেচি নাকি তাহাদের জোড় বাঁধিবার জন্যই ডাকাডাকি। মানুষ তো না, সুতরাং লাজ-শরমের কোনো বালাই নাই!
আর শুধুই কী তাহারা? পুঞ্জ পুঞ্জ জোনাকির দলও বাহির হইয়া পড়িয়াছে। কোথাও হইতে; কয়েকটা ব্যাঙও ডাকিতেছে এই দিকে সেই দিকে। মনে হয়, কিছুক্ষণের মধ্যে তাহাদের ডাকাডাকিতেও রাত্রি ভরিয়া উঠিবে। কানে আসিল দূর হইতে পাতিশিয়াল আর কুকুরের আওয়াজও। উঠানের পাশে আমগাছের ডালপালার পাতাগুলিও হঠাৎ কী সব কথাবার্তা ফিসফাস করিয়া বাতাসে ছড়াইয়া দিতে শুরু করিয়াছিল।
হোসেন সমস্ত অলস ভাবনা মন হইতে তাড়াইয়া ঘুমাইবার চেষ্টা করিতে লাগিল। কিন্তু তবু চোখে পড়ে গরিবঘরের টুটাফাটা ফাঁক দিয়া বাহিরের আকাশ। তাহার কেবলই মনে হইতে লাগিল মনের সবরকম গোপন কামনা বাসনাগুলিকে দেখার জন্য সমস্ত দুনিয়া যেন কৌতূহলে অদম্য হইয়া উঠিয়াছে। রাত্রিটা কোনো রকমে কাটাইয়া সে ব্যস্ত হইয়া পড়িল নৌকা সাজাইবার কাজে। খোল-এর জমা জল সেঁচিয়া ফেলিতে না ফেলিতে ছোটো নৌকাখানি একটা বড়ো হাঁসের মতো গরবিণিভাবে দুলিতে লাগিল। কিছু মেরামত আর রং করার জন্য শুকনা পাড়ে টানিয়া তুলিতে বেশ বেগ পাইতে হইল। হাঁসগুলি যেমন ডানাঝাড়া দিয়া পুকুর হইতে নরম পাড়ের উপর হেলিয়া দুলিয়া উঠিয়া আসে সেই রকম দূরের কথা, বরং বারংবার অবাধ্য পশুর মতো এক এক ঠায় স্থির হইয়া আটকাইয়া যাইতে চাহিল। একসময় হাঁপাইতে হাঁপাইতে হোসেন বেশ একটু চোটপাটও দেখাইল : এই জন্যই তো গলুই-পাছায় কোনো সাজ জোটে নাই!
মুখচোখের ঘাম মুছিয়া সে আবারও যখন নানারকম দড়ি-দাঁড়ায় ঠেকাইয়া নৌকাটাকে মোটামুটি একটা সন্তোষজনক ঠাইতে তুলিয়াছে, এইসময় চোখে পড়িল শিকদার ফিরিয়া আসিতেছে। তাহার পদক্ষেপ ধীরগতি, মুখচোখও নিত্যদিনের মতো স্বভাব-বিষণ্ণ। এক দৃষ্টে বহুক্ষণ লক্ষ করিয়াও তেমন কোনো ফলাফল আন্দাজ করা গেল না, কেবল দেখিল মাথার উপর প্রথম রৌদ্র সত্ত্বেও শিকদার ছাতাটিকে বন্ধ অবস্থায় বগলে রাখিয়াই পথ চলিতেছে, কিছু বলিবার জন্য আগাইয়া গিয়াও হোসেন যেন কথা গুছাইয়া লইতে পারিল না।
সম্ভবত শিকদারও কী বলিয়া শুরু করিবে ভাবিয়া পাইতেছিল না, হোহাসেনের উপর হইতে দৃষ্টি সরাইয়া সে নৌকাটাকে দেখিতে লাগিল।
: খাওয়া-দাওয়া হইছে?-দৃষ্টি সরাইয়া জিজ্ঞাসা করিল হোসেন।
শিকদার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়িল : নাহ্, তবে তার সুযোগ আছিল অবশ্য। আমিই দেরি করিতে চাই নাই।
হোসেন হাসিতে চাহিল : আমার সেই বিহান থেকিয়া আর কিছু পেটে পড়ে নাই। তুমি হাতমুখ ধুইয়া জিরাও, আমিও একটু পয়-পরিষ্কার হইয়া লই একটা ডুব দিয়া। যা আছে কিছু এক সাথে মুখ দেওন যাইবে।
শিকদার আপত্তি করিল না : সে-ই ভালো।
হোসেন একসময় আবারও জিজ্ঞাসুমুখে সরাসরি তাহার দিকে তাকাইল।
: বলি, কাজে-কামে বাহির হইলে অনেক অভাব মিটানোর সুযোগ হইবে।
: বয়াতিভাই?-হোসেন অনন্তভাবে দাবি জানাইল : কোনো রকম সুখবরের প্রত্যাশা আমি করি নাই। আসলে বিষয়টা কী?
: কী আর!-শিকদার হাতের ছাতাটিকে একধারে রাখিয়া খালের জলের ধারে নামিবার উদ্যোগ করিল : কন্যার সম্বন্ধ অন্য জায়গায় ঠিক হইয়া গেছে, এখন কেবল বিয়া পড়াইয়া উঠাইয়া নেওন বাকি। গঞ্জে আলীর লাহান ভিত ভূঁইছাড়া মানুষের পক্ষে রাজি না হইয়া উপায়ই বা কি ছিল? যারা তারে ঠাই দিছে, কাজ দিছে রিজিকের তারাই স্বয়ং সম্বন্ধ দিছে। এই রকম প্রতিপক্ষের সঙ্গে বাদ-বিসম্বাদের সাধ্য কেউই হইবে না।
হোসেন আর কোনো প্রশ্ন করিল না।
: একটা ক্রোধ আমারও হয়, কিন্তু কী করা? কোনও উপায় দেখি না। শিকদার ধীরে ধীরে আরও বলিল : গাছের ফল, পুষ্করিণীর মাছ, খেত খামারের সেরা জিনিস, এমনকী ঘরের ঝি-বউরেও কর্তাব্যক্তিদের ভোগে নেওয়ার নিয়মটাই সত্য হইয়া আছে। কী সুন্দর এই ভুবন, কত সম্ভার তার চতুর্দিকে! পথে আসতে আসতে দেখলাম, কত মানুষ কত রকম কামেকায্যে ব্যস্ত, কত নিষ্ঠা। তবু সব ভালো ভালো জিনিসের উপর তারগো অধিকার যেন কক্ষনো হইবার না। কিন্তু কোনো প্রতিকার দেখি না, কোনো কিছু করণের দেখি না। তুমি কিছু প্রত্যাশা করো নাই, কিন্তু আমারও খুব ইচ্ছা হইছিল এই বিষয়টা আবারও পরখ করিয়া দেখি। নাহ, নতুন কিছু নাই। সব একই রকম রইছে, তোমার আমার মতো মানুষের উপর সব অবস্থা-ব্যবস্থা যেন কেবলই চোখ রাঙাইয়া আছে।
হোসেন অনেকক্ষণ অবধি মুখ নিচু করিয়া কী চিন্তা করিল বহুক্ষণ; তারপর এক সময় মুখ তুলিয়া হাসিতে চাহিল : জানোই তো, আমি একটু গোঁয়ার মানুষ। কেবল চৌখ রাঙানি দেখিয়া দেখিয়া জীবন-যাপনের ইচ্ছাও আমার নাই। বুঝছি, আমার রিজিক, আমার হক আমার নিজেরই জোগাড় করিয়া লইতে মন দেওয়াই সুকায্য হইবে।
গাঙরে, তোমার যে মতি বোঝন ভার
তুমি এই কূল ভাঙিয়া ওই কূল সাজাও
ক্ষণেক হাসাও, ক্ষণেক কান্দাও,
এমন করিয়া খুশি মেটাও কার? গাঙরে,
তোমার মতি বোঝন ভার ॥
মাবুদরে, তোমারে যে মতি বোঝন ভার
এই গাঙে যেমন লক্ষ সোতের ধারা
তেমনি মোরা এই ভবেতে হারা
চলতে আছি কোন ঠিকানার পার?
গাঙরে, তোমার মতি বোঝন ভার ॥
নিজ গাঁ-গ্রামের অভ্যস্ত পরিবেশের বাহিরের ভুবনকে যেন চোখ মেলিয়া দেখারও অবকাশ হয় না। খালের মুখ অন্য এক জগতের ফটক। মোহানায় পৌঁছিবার আগেই তাহার রূপরসবর্ণগন্ধ যেন চতুর্দিক হইতে ধাইয়া আসে; নদীস্রোতের প্রান্তকালের অসংখ্য সৈন্যবাহিনী ঢেউ-এর মাথায় সওয়ার হইয়া, গর্ভ হইতে ফুসিয়া জাগিয়া হোসেনের ছোটো নৌকাখানি টানিয়া লইয়াছে; দেহের সবটুকু শক্তি বৈঠায় রাখিয়া একাগ্রভাবে দিকদিশা ঠিক রাখিয়া ভাসিয়া পড়িতে বেশ একটু সময় লাগিয়াছে। ডাঙার উপরে হাতের ছড়ি নাচাইয়া কী লাঠি ঘুরাইয়া যে যতই প্রতাপ দেখাউক, গাঙ-এর দুর্ধর্ষ শক্তির কাছে তাহার মূল্য বড়োই সামান্য বলিয়া মনে হয়। এইখানে কেবলমাত্র বৈঠার জোরে আর কৌশল করিয়া সমস্ত প্রতিকূলতা কাটাইয়া ওঠার মধ্যে হোসেন একটা গভীর আত্মপ্রসাদ অনুভব করিয়াছে।
মৌসুমি মেঘে ছাইয়া পড়িতেছে বিপুল আকাশ, আর গাঙও উঠিয়াছে আরও ফুলিয়া ফাপিয়া; স্রোত বহিয়া চলিয়াছে প্রচণ্ড বেগে। প্রাথমিক বৈরিতার মনোযোগ ত্যাগ করিয়া সে হোসেনকে কেবল ভাসাইয়া লইয়া চলিয়াছে। রৌদ্রে ধাঁধাইয়া উঠিতেছে মাঝে মধ্যে ঢেউ-এর চূড়া, কখনও বা এইদিক সেইদিক ‘উলাস’ দিয়া উঠিতেছে, শুশুক, দুইধারের বন-বনানী যেন নিঃশব্দে গাঙ-এর গতিবিধি দেখিতেছে। এক পাড় দর্পভরে আগাইয়া আসিয়াছে তো অন্যপাড় আরও দূরে সরিয়া গিয়াছে। খোলামেলা গাঙে স্রোত আর বাতাস সবসময় একই মুখি হয় না। হঠাৎ ঢেউ জাগিলে নৌকার দিক ঠিক করিয়া কাটিয়া বাহির হইতে হয়। এই স্রোতে নামা, তাহার উপর সওয়ার থাকা, তারপর ইচ্ছামতো স্কুলের বন্দর গঞ্জের ধারে নোঙরের সাফল্যলাভ রীতিমতো কঠিন হইলেও হোসেন কিছুমাত্র দমে নাই। যেই ঘাটে আমজাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ আশা করিয়াছিল, সেইখানে নৌকা ‘পাড়া’ লাগাইবার ঠাঁই-এরও অভাব। গঞ্জটি ছোটো, কিন্তু সেখানে যত না চড়নদার তাহার তুলনায় অনেক বেশি ভিড় কেরায়া নৌকার। সারা গাঙ তোলপাড় করিয়া সেইখানে বিরাট একটা জাহাজ আসিয়া থামে দিনে দুইবার; অল্প কিছু যাত্রী ওঠা নামা করে; সপ্তাহের হাটেও বেশ একটু ভিড় জমিয়া ওঠে তবে ঘাটের সর্দারি করে যে মাঝি তাহার সঙ্গে বুঝ-বন্দোবস্তের লাইন না থাকিলে যাত্রী সংগ্রহ আদৌ সম্ভব হয় না! তাহাদের হুকুম হাকাম না মানিলে মন না জোগাইয়া চলিলে নৌকাও ভিড়ানো যায় না ঘাটে; একদল নির্ধমা লোক সবসময় চরের মতো সবদিকে চোখ রাখিতেছে। নৌকাটিকে একটু দূরে বাঁধিয়া হোসেন একবার সমস্ত ঘাটটা ঘুরিয়া আসিল।
নৌকার গলুইতে বসিয়া পায়ের কাদা ধুইবার কালে খেয়াল হইল পাশের নৌকাটির মাঝি আলাপে উৎসুক। সে পাটাতনের উপরে ছোটো একটি উনানে ভাতের হাঁড়ি চাপাইয়াছে; একটু লাকড়ি খুঁজিয়া সে হোসেনের দিকে ফিরিয়া বসিল।
হোসেনের তুলনায় তাহার বয়স অনেক, সারামুখে গোঁফ-দাড়ি। রুগণ। কী প্রশ্ন সে করিয়াছিল হোসেন ঠিক বুঝিতে পারে নাই। জিজ্ঞাসুমুখে তাকাইলেও মাঝি আর সে প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করিল না; কেবল উপরের ডাঙার দিকে একটা ইঙ্গিত করিয়া বলিল : চড়নদার না জোটলে হাট-বাজারের দিকে আউগানও যায় না।
মুড়ি-বাতাসার একটা ছোট পোঁটলা গামছায় বাঁধিয়া কোমরে জড়াইয়া লইয়াছিল হোসেন; পাটাতনের উপর পা মুড়িয়া বসিয়া সে তাহার এক মুঠা মুখে পুরিল।
: নতুন আইলা বুঝি?
হোসেন সংক্ষিপ্তভাবে মাথা দোলাইল : জ্বে!
: আমি সেই কবে থেকিয়া চড়নদারের আশায় আছি!-বৃদ্ধ মাঝি আরও একটু কাছে সরিয়া আসিল : কী আর করি! চড়নদারেরা বাছিয়া নৌকায় ওঠে। আমার নাহান বুড়ারে বড়ো একটা আমলে নেয় না। কী আর করি! বসিয়া বসিয়া বেশ কিছু মাছ উঠাইলাম বড়শিতে। সেইগুলান বেচিয়াই খাওনের জোগাড় করছি। খাবা একমুঠ আমার সঙ্গে?
হোসেন একটু অবাক হইয়া রহিল; তারপর মাথা দুলাইল : না, না!
মাঝি তবু বলিল : অনেক, অনেক মাছ জুটছিল, রাঁধছিও ভালো করিয়া, চড়নদার না পাইলে কী করা। মাঠের কাছে তো সক্কলে বড়শি নামাইয়া বসছে। তাই আমি আরও একটু নামায় গেছিলাম, ওই ঘোঁজাটার কাছে। জাল-টাল ফেলার সুবিধা তো নাই, ডাঙার উপরের সকলকেই চৌখ রাখে। সামান্য সূতির বড়শি নামাইয়া বসলাম। আর বসতে না বসতেই টপাটপ টপাটপ এক একটা উঠাইতে লাগলাম। পাঙাশ ট্যাংরা। মনে কয় ঝাঁক বাঁধিয়া আমার বড়শির চাইরধারে ঘিরিয়া আসছিল। তবে বেশিক্ষণ ওইদিকে নৌকা লইয়া থাকতে পারি নাই। কেউর চোখে লাগিয়া যাওনের ডর আছিল, তায় চড়নদারের জন্য উদ্বেগ। এখন বৈকালের স্টিমারের আশায় আছি। দেখতেই আছ তো আসমানের অবস্থা, ঝড় দেয়ইর কাল ধাইয়া আসতে আছে। মনে কয় এই শরীর লইয়া তার মধ্যে আর ক্ষেপ দেওয়ার কাম করণ যাইবে না। আর এই ঘাটেও তেমন সুবিধা নাই, নৌকা বান্ধার জন্য এখন চর দখলের লাহান কাজিয়া-বিবাদ লাগিয়া যায়।-ভাতের হাঁড়িটা একবার পরীক্ষা করিয়া মাঝি আরও বলিল : আমি যখন পয়লা এই ঘাটে, তখন এত নৌকা আদতেই আছিল না, আর চড়নদারও আছিল নানান গাঁও-গ্রামের বড়ো বড়ো মানুষ। তাগো কৃপায় কেবল কেরায়ার পয়সাটাই না, ভালো-মন্দ অনেক কিছু জুটিয়া যাইত। নৌকা ছাড়ার আগে বাজার করিয়া আনতেন তাঁরাই, কিছু রান্নাবান্না হইত, কিছু লইয়া যাইতেন ঘর পরিবারের জন্য। সেইসব ঘর বাড়িতেও হয় অনেক আদর-আস্তিক, না হয় উপরি কামকার্য জুটিয়া যাইত। এখন সেইসব মানুষেরা আর তেমন এইসব দিকে আসা যাওয়া করে না। যে কয়জনই বা আসে যায় তারো উপর যেন তামাম মুল্লুক কাউয়ার লাহান ঝাপাইয়া পড়ে। ফলে এখন ঘাট মাঝির সঙ্গে বুঝ বন্দোবস্তটাই বড়ো হইয়া ওঠছে। তারে আগাম কিছু না দিলে সে আমলেই নেয় না। তোমার ডেনার জোর আছে, নৌকাখানও ভালো, তবে আগে ওইদিকে লাইনটা লাগাইয়া রাখো। তা হইলে আর কোনো চিন্তার কারণ থাকবে না।
মাঝি একটা মাটির বাসনে ভাত-মাছ সাজাইয়া হোসেনের দিকে বাড়াইয়া দিল। হোসেন বেশ একটু সংকোচের সঙ্গে বাসনটা গ্রহণ করিল বটে, কিন্তু তাহার এমন আপ্যায়নের কারণটা বিশেষ অনুমান করিতে পারিল না।
: আরে, খাও খাও মিঞা। ত্বরাত্বরি মুখে দেও, বৈকালের স্টিমারের সময় হইয়া আসতে আছে।-মাঝি নিজের আহারে মন দিয়া আরও বলিল : এই আমাগো লাহান নামার মানুষেরা কখনও একলা খাইতে বসে না।
হোসেন একটু রসিকতার চেষ্টা করিল : এই কারণেই বোধ করি খাওয়াইয়ার সংখ্যা বাড়ছে।
মাঝি হাসিয়া ফেলিল : হ, হ, কথাটা মন্দ কও নাই। হোসেন ভাত-মাছ মাখিয়া আরও বলিল : আর ফাঁকি-ফিকির করিয়া উপায়-এর অবস্থা-ব্যবস্থা অন্যে লুটিয়া নিতে আছে। দুই মুঠ খাওন জোগানের জন্য কোনোদিকেই যেন আউগান যায় না।
: ঘাবড়াইও না মিঞা।-মাঝি অভয় দিতে চাহিল : গাঙে কুমির, ডাঙায় বাঘ কবেই বা না আছিল এই মুলুকে? আমি তো দেখতে আছি, যত দিন যায় ততই এই যুদ্ধটা আরও ঘোরতর হইয়া আসে। ওই যে কইলাম চর-দখলের কথাটা, এখন সব বিষয়ই ওইরকম হইয়া গেছে। কী আর করা! ঘর-সংসার আছে বলিয়াই এখনও একরকম লাঠি ঘুরাইতেই হয়।
অথচ হোসেন আবারও লক্ষ করিল মুখে যতই বলুক, মাঝির সেই বয়স সম্ভবত আর নাই; কিন্তু সবরকম বাধা-বিপত্তি অসুবিধা অনটন কাটাইয়া উঠিবার জন্য আগ্রহ অপরিসীম। বৈকালের স্টিমারের কোনো যাত্রী আদৌ তাহার ভাগ্যে জুটিবে কিনা সে বিষয়ে ঘোর সংশয় থাকিলেও সে কেবলই তা দূরে ঠেলিয়া রাখিতেছে। চতুর্দিকে ধাইয়া চলিতেছে সবকিছু, আকাশের মেঘ, গাঙের স্রোত, ডাঙার উপরে ঘাটে-গঞ্জে নানারকম ব্যস্ততা, এমনকী চরের উপরে পাখি-পাখালিও স্থির নাই; কাদাখোঁচা ছোটো পাখিটাও এত বড়ো গাঙের পাড়ে পাড়ে চলিতেও বিশেষ ভয় পাইতেছে না, গাঙের স্রোতের বা ঢেউগুলির রীতি-প্রকৃতি যেন তাহারও ভালোভাবেই জানা আছে।
মুখে একগ্লাস আহার তুলিয়া হোসেন বলিল : আহ, আপনার রান্নাটা বড়ো ভালো হইছে!
মাঝিও খুশি হইল : সবই কপালগুণ! ভাগ্য! এইটা জোটে তো সেটা জোটে না। এত তালাশ করলাম তবু কোনোখানেই কচুর লতি চোখে পড়ল না। পাশে সেইসব দিতে পারলে আরও মজা হইত। আমি কী রাঁধতে জানি। দায়ে ঠেকিয়া করতে শিখছি। আমাগো যা অবস্থা তাতে নুন আনতেই পান্তা ফুরাইয়া যায়!
হোসেন তাহার হাসিতে যোগ না দিয়া আবারও বলিল : নাহ, খুউব ভালো খাইলাম।
: সবই ভাগ্য! এখন একটা ভালো ক্ষেপ পাইলেই হয়। ওইটাও ভাগ্য, তবে তার জন্য কেবল অপেক্ষায় থাকাই যথেষ্ট না।-মাঝি গলা নামাইয়া বলিল : আমি কয়েকটা মাছ ঘাট সর্দারদেরও দিয়া আসছি। তবে তারে এমন খুব একটা খুশি মনে হইল না। তার এক চেলা গলা বাড়াইয়া দেখিয়া কয়, এইসব মাছের এইদিকে অভাব আছে নাকি, আরও কয় কেন জিয়ল মাছ লইয়া আসি নাই! এমনি খাই বাড়ছে উনাগো যে এইসব আর মুখে রোচে না। আমার কাছে তাজ্জবের বিষয় এইটা যে গাঁও-গ্রামে থাকতে এইসব মানুষের মুখে তিতপুঁটিটাও জুটত না। বুঝলা, আবার এই ঘাটে আসতে হইলে আমারে জিয়লমাছ লইয়া আসতে হইবে। ওই মাছ কয়টা না দেওনই ভালো আছিল!
হোসেন গাঙপাড়ের নৌকাগুলির উপর দৃষ্টি বুলাইয়া ধীরে ধীরে বলিল : কৌশল করিয়া বড়ো হইছে, ক্ষমতা লইছে।
: থাউক-মাঝি হাত উঠাইয়া মানা করিল : মানিয়া যাওয়াই ভালো। এই সব কথা কেউ একবার ওনাগো কানে উঠাইলে আর এই ঘাটে ঠাঁই হইবে না। এই তো দেখো, এত নৌকা, এত মাঝি কিন্তু সকলে একজনে আরেকজনের কাঁধে পাও দিয়া উপরে উঠতে চায়। তা না হইলে এই ঘাটের কামকাজে সকলেরই কিছু না কিছু উপায় থাকত।
হোসেনও অন্যমনস্কভাবে বলিয়া ফেলিল : হ, বোধ করি আপনারও উনারে মাছগুলান দেওন ঠিক হয় নাই।
বৃদ্ধ মাঝি একটু অপ্রতিভ বোধ করিল, কিছুক্ষণ উসখুস করিয়া বলিল : হ, একরকম ঝোঁকের মাথায়ই আউগাইয়া দিতে গেলাম। ওই যে কইলাম কিছু না দিয়া থুইয়া পারি না। কাছ দিয়া যাইতে আছিলাম মাছগুলান বেচনের আশায়, তার দলবদলের চোখ পড়ল, তাই আগ বাড়াইয়া দিতে গেলাম, আর অন্য বিবেচনা করি নাই।
হোসেন পাড়ে নামিবার উদ্যোগ দেখাইল : চলেন, দেখন যাউক ভাগ্যে কী আছে। ঠিকই কইছেন, আশায় আশায় কেবল নৌকায় বসিয়া থাকলেই কেউই আর ডাকিয়া জিজ্ঞাস করবে না। উপস্থিত না থাকলে চাল-চালিয়াতরা আরও সুবিধা পাইয়া যায়। আমি দেখি যার রিজিকের চিন্তা তারই করতে হয়!
ছবদার খুব একটা উৎসাহ দেখাইল না : কী-ই করার আছে এমন কুহকে। অদৃষ্ট বুঝি লেখা আছে সেই জনম হইতে। ভাটায়-জোয়ারে বর্ষায়-খরায় এতটুকু এই ডিঙি এত এত টাল খাইয়া যায়, ভাগ্যে যা আছে তারে কে কেমন খণ্ডায়।
হোসেন একটু অবাক হইয়া তাহার দিকে চাহিয়া রহিল : একটুকাল পরে জিজ্ঞাসা করিল : এইটা কোনো কথা হইল মাঝি! এর মাইনি এই যে যা হইবে, আমার কোনো চেষ্টার কোনো ফল নাই?
ছবদার মাঝি একটু ইতস্তত করিল : তারপর পাড়ে নামিতে বলিল : বুঝি না, কোনো দিন বোঝারও সাধ্য হয় নাই। বিদ্যাবুদ্ধি যারগো আছে, যারা লিখন পড়ন জানে, তারা কয় মনুষ্য বড়ো ক্ষুদ্র, উপরের হুকুম ছাড়া নাকি কিছুই হয় না, কোনো কিছু বদলাইবার কিছুমাত্র সাধ্য মানুষের নাই। পুথিয়াল বলে, সেই একই সূর্যচন্দ্র নক্ষত্র পৃথিবী, তার তলে ঢেউ নাচে জনম অবধি। আমরা ঢেউ হইয়া পাড়ে উঠতে চাই মাটি খামচাইয়া, তবু সোতে ভাসিয়া যাই।
হোসেন জোরের সঙ্গে মাথা দোলাইল : এই কথা পছন্দ হইল না মাঝি, আমি মানিয়া লইতেও পারি না। কেমন যেন আমার এক কবিয়াল বন্ধুর কথার মতো শোনাইল। আমি এই ডেনার, এই মাথার উপর আস্থা রাখি। এমন কবিয়াল-পুথিয়ালরা কেমন যেন আউলাইয়া দেয়। ভাবের কথায় ভবি ভোলে না, আছে সে থাউক মনের মধ্যে। এই দেহের আহার জোগাইতে হয় আগে, তারপরে সব কাব্য-কথা। আমি লড়াইতে নামছি, এখন আর পিছন ফিরতে চাই না।
ছবদার মাঝিও নামিয়া আসিল : বোধ করি বয়সই হইয়া গেছে! দুনিয়াটা ঠাহর করিয়া এখন কেমন যেন ভয় পাইয়া যাই। লড়াই করতে তো আমিও রাজি। কেবল পথের দিশা পাই না। দাস-এর ভাগ্য মানিয়া লইছি বলিয়াই তো এখনও তক প্রাণে বাঁচিয়া আছি।
পাড়ে থকথক কাদা, পায়ের গোড়ালি অবধি ডুবিয়া যায়। শুকনার কাল হইলে পাশে হাট বসিত, মনোহারী দ্রব্যের দোকান বসিত চতুর্দিকে, আর বিরাট বিরাট শামিয়ানা টাঙাইয়া জীবন-যৌবনের উদ্দেশ্য-আদর্শ সম্বন্ধে বক্তৃতা করিত বড়ো বড়ো মহাজন। এখন কেবল কাদাখোঁচা পাখিগুলি ভয়ে ভয়ে তাহাদের আহার খুঁজিয়া ফিরিতেছে পুচ্ছ নাচাইয়া, তবু সে-ও সাবধান।
এমন যে কাক, তাহারাও সম্ভবত গঞ্জের শোরগোলের আগে পাশে ভিড় করিয়াছিল; মনে হইতেছিল কোনো মহোৎসবে যেন সারা ভুবনকে সচকিত করিয়া রাখিতেছিল।
.
০৫.
বনের কোকিল আর ডাকিস না রে
ও সে কদম্বডালে
প্রাণ বঁধু নাই যে মোর ঘরে রে
এ বসন্ত কালে।
কতদিন হইয়াছে বঁধু গিয়াছে ছাড়িয়া
মনেরে বুঝাইয়া রাখি প্রাণেতে বাঁচিয়া
জানি কার সে গুণে গিয়াছে ভুলিয়া।
সে আসবে বলে আমি রইয়াছি সাজিয়া
নিশীথে জাগিয়া থাকি পন্থপানে
যৈবন কাটিছে অকালে।
আগে যদি জানতাম রে কোকিল
পিরিতের এত জ্বালা
নিতাম না আর গলেতে রে
প্রেম-কলঙ্কের মালা ॥
গীত-গান শিকদারের না পেশা না নেশা। কিন্তু তাহার ছেলেবেলা হইতেই সে সেইদিকে প্রবণতা দেখাইতে শুরু করিয়াছিল।
এই সময় বেশ জমজমাট ছিল তাহাদের ঘর-গৃহস্থালি। খন্দের সময় রবরবা হইয়া উঠিত সব। উঠানের একধারে অহোরাত্রি ধান মাড়াই-মলাই হইত একপাল গোরু জুড়িয়া, কামলা লাগানো হইত পায়ে দলিয়া ধান মাড়াইবার জন্য। অন্য একধারে বড়ো বড়ো টেকদানে সিদ্ধ হইত ধান। আর তাহারই ফাঁকে অবসরে পুঁথি-পড়া ছাড়া কি ধাঁধার আসর বসিত নিত্য নিত্য। এইসব বিষয়ে দাদা করমালীর উৎসাহ ছিল অপরিসীম। তাহারই কোলে বসিয়া কখনও মুখে মুখে ধাঁধার ছড়া বানাইয়া কখনও বা অন্য অন্য কামলা বা জন-মুনশীদের মুখে শোনা গীতের কয়েক চরণ অবিকল গাহিয়া সে সকলকে অবাক করিয়া দিত। একবার পৌষমাসে একদল কবিয়াল-বয়াতি আনা হইল অন্য কোনো মুলুক হইতে; খাতির করিয়া তাহারা কিশোর শিকদারকে দোহার করিয়া লইল। যতদিন তাহারা ছিল শিকদার আর তাদের সঙ্গ ছাড়িতে পারে নাই। তাহারা বিদায় হইয়া যাইবার পরও শিকদারের গায়ক খ্যাতি রহিয়া গেল। দাদা করমালী একটা দোতারা বানাইয়া ছিলেন শখ করিয়া যতদিন বাঁচিয়া ছিলেন সন্ধ্যাবেলা তন্ময় হইয়া একটার পর একটা গীত শুনিতে চাহিতেন। মাঝে মধ্যে গ্রামের আরও অনেকে সেইসব আসরের ধারে কাছে আসিয়া বসিত। সেই সব গীত-গানের বেশিরভাগই কবিয়াল বয়াতিদের মুখে শোনা, কিন্তু দাদা-দাদিরাও জানিত, কিছু সে নিজেও ইতস্তত ঘুরিয়া ফিরিয়া সংগ্রহ করিয়াছিল। কবিয়ালদের সংসর্গে তাহার একটা বড়ো লাভ হইয়াছিল লিখন-পঠনের তালিম; কিন্তু বেশিদূর অগ্রসর হইবার আগেই একটা দূরন্ত ধাক্কায় সবকিছু টালমাটাল হইয়া গেল। একদিকে প্রচণ্ড মহামারিতে উজাড় হইয়া গেল সমস্ত পরিবার, অন্যদিকে জমিজমাও হাতছাড়া হইয়া গেল রাজা-রাজ্য বদলাইবার গণ্ডগোলে; কিশোর শিকদার বড়ো একা পড়িয়া গিয়াছিল। আত্মীয়কূল যাহারা সেই মহামারিতে টিকিয়া গিয়াছিল, তাহারাও যতটা শিকদারের বিষয়-আশয় গ্রহণ করিল, সেই অনুপাতে তাহার দিকে বিশেষ একটা মনোযোগ দেখাইল না। একদিন সব ত্যাগ করিয়া শিকদার নিজের পুরাতন ঘর-বাড়িতেই ফিরিয়া আসিল। একে একে বেশ কয়েকটি বছর ঘুরিয়া গিয়াছে পরে, কিন্তু সেই ‘ছাড়া ঘর গৃহস্থালিকে আবারও গুছাইয়া সাজাইয়া লইবার সাধ্য সামর্থ্য তাহার হয় নাই। ভাঙা বাড়ি-ঘরের একধারে দাওয়ায় বসিয়া সে-ও মাঝে মধ্যে গীত গানের পত্র-পুথিগুলি নাড়াচাড়া করে, কিন্তু তাহার মধ্যে কোনো সমাধান খুঁজিয়া পায় না, দাদা করমালীর দেওয়া সেই শখের দোতারাটাও একধারে অনাদৃত হইয়া পড়িয়া থাকে; শিকদারও অন্যমনস্কভাবে বাহিরের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে চাহিয়া আরও উন্মনা হইয়া যায়।
ফলে এক এক সময় ঘর-গৃহস্থালির সাধারণ কাজকর্মেও অঘটন ঘটিয়া যায়। আহার্য প্রস্তুতের সময় একঠায় উনানের কাছে বসিয়া থাকিলেও হয় রান্না পুড়িয়া না হয় গলিয়া আহারের অযোগ্য হইয়া ওঠে, তবুও তাহার জন্যও শিকদারের কাছে জগৎ-সংসার অর্থহীন বলিয়া মনে হয় না। উনানের উপর হাঁড়ির মধ্যে কিছু চাউল, কিছু সবজি আর কয়েকটা লঙ্কা পেঁয়াজ ছাড়িয়া দিয়াই সে মহাকীর্তির আনন্দ অনুভব করে; তারপর এক সময় পোড়া বা গলা যাহাই পাতে নামাউক কোনো রকম আপোেশ সে কখনওই করে না; বাড়তি কিছু থাকিলে উঠানের পাখি-পাখালিগুলিকেও দিতে-থুইতে তাহার ভুল হয় না। কেবল কিছুই জোটে না যখন সেই সময় বিষয়-সম্পত্তির কথা মনে উঁকি দিয়া যায়, কিন্তু কিছুই করিয়া উঠিতে পারে না। একদিকে শৈশবকাল হইতে সে শুনিয়া আসিতেছে বিশ্ব-সংসার আপন নিয়মে চলিতেছে, মানুষের উদ্যোগ আয়োজন তাহার কোনো কিছু বদলাইতে পারে না; অন্যদিকে যেই সমস্ত জমি-জমা-সম্পত্তি বংশসূত্রে তাহার নিজস্ব হইবার কথা, তা এখনই আত্মীয়কুল অথবা অন্যান্যের ভোগ-দখলে, সে কখনও যা কোনোভাবেই মুক্ত করিয়া লইতে পারিবে না। জোর-জবরদস্তি অথবা দাঙ্গা হাঙ্গামার মধ্যে কখনও নিজেকে জড়াইতে উৎসাহবোধ করে নাই। সে ক্রমাগত গীত-গানের চর্চার মধ্যেই তখনও নিজেকে ব্যস্ত রাখিতে চাহিতেছিল। কিন্তু ইদানীং এ বিষয়েও তাহার মধ্যে একটা স্থবিরতাবোধ জমিয়া উঠিতে শুরু করিয়াছিল। বুকের মধ্য হইতে গলায় যত সুরই আসুক তাহার সঙ্গে উপযুক্ত কথা মিলাইতে গিয়াই গোল বাঁধিয়া যাইত; কোনো কথাই যেন আর মনঃপূত হইতে চাহিত না। কিছু অক্ষর পরিচয়ের সুযোগ পাইয়াছিল সে বয়াতির কাছে। একদিন মহা উৎসাহে লেখার জন্য তালপাতা আর কালিও প্রস্তুত করিয়াছিল নিজে, খাগের কলম বানাইয়া লইয়াছিল পরম যত্নে, কিন্তু অগ্রসর হইবার কালেই তাহার সমস্ত উৎসাহ নিভিয়া যাইতে শুরু করিল। একদিকে নিজের অতৃপ্তি, অন্যদিকে খেয়াল হইল বাস্তব জীবনে সেইসব গীত-গানের ভাবাবেগ অথবা কথার আদৌ কোন মূল্য নাই।
এইসব বোধ তাহাকে ক্রমাগত অসামাজিক করিয়া তুলিতেছিল। যাহার জীবনে আনন্দ নাই, উৎসাহ নাই, কোনো উদ্দেশ্য নাই; তাহার নিকটে আসিতে কেউই কোনো আগ্রহবোধ করে না। সে নিজেও বুঝিতে পারে দুনিয়ার মানুষের প্রতি বুকভরা ভালোবাসা লইয়া আপন করিতে গিয়া সে নিজেই এখন অপাংক্তেয় হইয়া রহিয়াছে। তুষের আগুনের মতো একটা কষ্ট তাহার বুকের মধ্যে ধিকিয়া ধিকিয়া জ্বলে, কিন্তু তাহার কবল হইতে মুক্তির কোনো উপায়ই সে পাইতেছিল না।
হোসেন বলিয়া গিয়াছিল তাহার ঘর-বাড়ির দিকে দৃষ্টি রাখিতে। শিকদার ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখে হোসেন চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখে নাই। তাহার ছোটো বাড়ি-ঘরের সব ঠাইতে কিছু না কিছু ফলাইবার আগ্রহ তাহার অপরিসীম। নিজের পৃথিবীর চতুর্দিক খুঁড়িয়া-ছুঁড়িয়া সে আপন অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বদ্ধপরিকর। শিকদারের মনে হয় সে যেন একই রকম যুদ্ধের মেজাজ লইয়া এখন বৈঠা হাতে গাঙে নামিয়াছে। উঠানের দুই ধারে সবজিখেত, ঘরের বারান্দার চালে কচি লাউলতার বিস্তার, নানারকম ফল-ফলারির গাছে বাড়িয়া ফুটিয়া উঠিবার আকুতি লক্ষ করিয়া শিকদারের বারংবারই মনে হইতে লাগিল হোসেনকে সাহায্য করা দরকার। তাহার নিজের জীবনে শ্রী-ছাদ না-ই থাকুক, কিন্তু হোসেনের উদ্যমে যথাযোগ্য সহায়তা করিতে পারিলে তাহারও আনন্দের পরিসীমা থাকিবে না। এক সময় নিজের সঙ্গেই অনেক যুক্তিতর্ক করিয়া সে আবারও গঞ্জে আলীর বাড়িতে উপস্থিত হইল।
সে কোথায় কী কাজে গিয়াছে; কিন্তু তাহার কবিলা প্রত্যাশার অতীত খাতির-যত্ন দেখাইল। ঘরের কপাটের আড়াল হইতে পান-সুপারি ঠেলিয়া দিয়া সে মৃদুস্বরে বলিল : গেদির বাপের মন-মেজাজ ভালো নাই আইজ কাইল, কেবলই কাজ-কামের ধাঁধায় কোথায় কোথায় ঘুরিয়া বেড়ায়। এই সংসার যেন তার পক্ষে বড়ো জ্বালা হইছে।
: কেন, নতুন করিয়া আবার কী হইল?-শিকদার পানের থালাটা গ্রহণ করিয়া উৎসুক্য দেখাইল বটে, কিন্তু কপাটের অন্যপ্রান্ত হইতে কোনো জবাব আসিল না; সাড়াশব্দে সে টের পাইল সম্ভবত সখিনাও তাহার মায়ের কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।
: নতুন কী আর হয় আমাগো নাহান গরিব-গুর্বার সংসারে! এক জট খুলতে যাইয়া আরেক জটে বাঁধিয়া পড়নই কপালে লেখা আছে।-কথার মাঝখানে স্বরপরিবর্তন করিয়া ধমক দিল কাহাকে : তুই যা এখান হইতে। কইলাম তো অন্য কোনো কামেকার্যে মন দিতে। আমারে দুইটা কথা কইতে দে। ওনার কি তামাকের অভ্যাস আছে?
: না, না।-শিকদার শশব্যস্তে বলিল : আপনে ব্যস্ত হইবেন না। হোসেন আপনাগো খুবই আত্মীয় জ্ঞান করে। আমিও সেই রাবিদে একটু খোঁজ খবরের জন্য আসলাম।
: কোথায় সে? এই কিছুদিন যাবৎ তারে একবার বোলাইয়া আনার মানুষও পাইলাম না। আমরা মাইয়া মানুষ, অন্তঃপুরের বাসিন্দা। ইচ্ছামতোন সবকিছু কি আর সাধ্যে কুলায়।
: কেন, কী বিষয়?-শিকদার আবারও ঔৎসুক্য দেখাইল : নাও লইয়া বাহির হইছে, তবে তেমন দরকার পড়িয়া থাকলে খবর দেওয়া অসম্ভব হইবে না।
: নাহ, এখন আর কোনো লাভ নাই। যা হবার হইয়া গেছে। ভাগ্যের বিষয় কেউ আর কখনও খণ্ডাইতে পারে না। আমার কেবল আপশোশের কথা এইটাই যে মাইয়া মানুষ করলাম এত ছিদ্দত করিয়া, তবু তার বিয়া-শাদীর বিষয়ে আমি যেন পর হইয়া রইলাম। কী হয় মানুষের ঘর-পরিবার মুল্লুক দিয়া যদি হাসিয়া খেলিয়া বাঁচিয়া থাকনের সুযোগ না পাওন যায়?-গঞ্জে আলীর কবিলা আরও বিস্তৃতভাবে বলিল : গেদির বাপে যুক্তি দেখাইল মানুষ কত আর মুলুক বদলাইতে পারে? একদিন না একদিন তারে এক রাজ্যে থির হইতে হয়, এক না এক রাজা মানিয়া লইতে হয়। আমিও বিশেষ কোনো ওজরআপত্তি তুলি নাই। তখন তো আর মাইয়ার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনোরকম দুশ্চিন্তার কারণ হয় নাই। এখনই না মাইয়ার কাছে শুনি কত বড়ো হাড়ে-হারামজাদার ঘরে মাইয়ারে তুলিয়া দিছি। মাইয়া সেই যে বাপের বাড়ি বেড়াইতে আসার নাম করিয়া চলিয়া আসিয়াছে, আর ওই বাড়ির দিকমুখি হইতে চায় না। এই সঙ্কটে সকলেই বড়ো অশান্তিতে আছি।
শিকদারের মুখে অনেকক্ষণ অবধি কোনো কথা জোগাইল না; মুখ নিচু করিয়া সমস্ত বিষয়টা বুঝিয়া উঠিতে চেষ্টা করিল।
: গোড়ার দিকে মাইয়ার অমতের ভাব আমরা খুব আমলে আনি নাই। একটা ঠাই ঠিকানার যুক্তিতে অন্য সব বিষয় গৌণ হইয়া গেল। এখন তো নানান বিপদ আরও বিষম হইয়া দেখা দিছে। এখন সেইসব ভাবনায় গেদির বাপ আরও আউল বাউল হইয়া এইদিক-সেইদিক ঘুরিয়া বেড়াইতে আছে।
শিকদার উঠানের দিক হইতে দৃষ্টি ঘুরাইয়া হঠাৎ জানিতে চাহিল : হোসেনকে তালাশের কারণটা কী আছিল?
গঞ্জে আলীর কবিলা বেশ একটু সময় লইল জবাব দিতে : এখন আর সেই সব বলার কি কোনও লাভ আছে। উঠাইয়া লইয়া যাওনের আগেই মাইয়ার কাছে যা টের পাইলাম, যেমন তার মনের কথা ঠহর পাইলাম, তখনই হোসেনের কথাটা মনে উদয় হইছিল কিন্তু কিছু করণ গেল না। এই জগৎ সংসারের রীতিনীতি বদলাইয়া ফেলনের জন্য অবলা মাইয়া জাতির এমন কী-ইবা শক্তি আছে!
অকস্মাৎ শিকদার নিজেকেও একটু অপরাধী বোধ করিতে লাগিল; ভাবিতে শুরু করিল যে নিজ অভিজ্ঞতা দিয়াই পৃথিবীর সমস্ত স্ত্রী-জাতের উপর কোনো চূড়ান্ত ধারণা সঙ্গত হইতে পারে না; ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। সখিনাকে সে চেনে না, জানে না, অথচ তাহার প্রতিও সে সহানুভূতি বোধ করিল।
: এইসব বিষয় আগেই বোঝন উচিত আছিল!-কথাটা মুখ দিয়া বাহির হইয়াছে কী হয় নাই, আর গঞ্জে আলী কবিলাই বা কোন বৃত্তান্ত দিতে শুরু করিল, সেইসব দিকেও আর খুব একটা মন দিতে পারিল না শিকদার; একটু ইতস্তত করিয়া কেবল বলিল : হাওলাদারের এখনও সাক্ষাৎ নাই। এইবার আমারেও উঠতে হয়।
: কপাল, সবই কপাল!-কেবলই আপশোশ করিতে শোনা গেল গঞ্জে আলীর কবিলাকে; শিকদারকে উঠানে নামিতে দেখিয়া সে-ও কপাটের আড়াল হইতে বাহির হইয়া আসিতেছিল; আর ঘরের বাহিরের বেড়ার কাছেও একটি কিশোরী মেয়েকে উঁকি দিতে দেখা গেল!
শিকদার দৃষ্টি ফিরাইয়া বাড়ির পথ ধরিল : দ্বিতীয়বার ফিরিয়া দেখিবার সাহস পাইল না; মনে হইতে লাগিল সে বুঝি বা আরও কোনো দুৰ্জ্জেয় সমস্যার মধ্যে জড়াইয়া পড়িবে। তবুও কয়েক পা অগ্রসর হইয়াও তাহার গতি শ্লথ হইয়া পড়িল। গঞ্জে আলীর কিশোরী কন্যা এবং তাহার এককালের সঙ্গিনী জোবেদার মধ্যে সামঞ্জস্যের বিষয়গুলি খেয়াল করিয়া সে বেশ কিছুক্ষণ বিহ্বলভাবে দাঁড়াইয়া রহিল।
মুখ তুলিলে সে যেন এখনও স্পষ্ট দেখিতে পাইবে বৈশাখের এক তপ্ত মধ্যাহ্নবেলা। গাছ-গাছালি ঘেরা বাড়িয়ালের একধারে ছুটিয়া গিয়াছে। শিকদার আর অন্যদিক হইতে আঁচল উড়াইয়া আসিয়াছে জোবেদা; কাছের পুকুরে আকাশ যেন আরশিতে মুখ দেখিতেছিল। এখনও যেন স্পষ্ট কানে ভাসিয়া আসে জোবেদার চাপা কণ্ঠস্বর : এই, গলা উঠাইও না কবিয়াল, মনে কয় চতুর্দিক নিঝুম হইয়া কান পাতিয়া রইছে।
বাড়িয়ালের পিছনে, আমবাগানের ধারে, আইলের উপর পা ঝুলাইয়া বসিয়াছিল দুইজনে; উপরে ডালপালার মধ্যে মাঝে-মধ্যে মর্মরস্বর, সামনের ধানখেত শুকনা ‘নাড়া’র গোড়াগুলি লইয়া ধূ ধূ করিতেছে, আরও দূরে কোথাও একটা চলতি নৌকায় লগি রৌদ্রে ঝকঝক করিয়া উঠিতেছে বারংবার; কেবলই মনে হইতেছিল কোন দূর দক্ষিণ হইতে উদ্দাম হাওয়া খুব শিগগিরই ধাইয়া আসিতেছে, মেঘের দল আগাইতেছে দল বাঁধিয়া, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমগাছের ডালে ডালে ভর-বাড়ন্ত কচি আমগুলির মধ্যে চাঞ্চল্যের আর সীমা রহিবে না। আইলের উপর হইতে পা ঝুলাইয়া বসিবার কালে সাবধান করিয়া দিয়াছিল শিকদার; একধারে পুরানো শামুকের আর কচ্ছপের ডিমের বাসাগুলির দিকে ইঙ্গিত করিয়া সাপের গর্তের কথা বলিয়াছিল; তৎক্ষণাৎ ভীতভাবে তাহাকে প্রায় জড়াইয়া ধরিয়াছিল জোবেদা; পরক্ষণেই লজ্জা পাইয়া উঠিয়া গিয়াছিল; বাড়িয়ালের আড়াল হইতে সে-ও যেন একইভাবে উঁকি দিয়া বাহিরের দিকে তাকাইয়াছিল। শিকদার হাসিতে চাহিল; কিন্তু পারিল না। কয়েক পা চলিবার পর আবারও যেন সেই দিনক্ষণ অন্যদিক হইতে চোখে পড়ে; মনে হয় সময় ও স্থানের সমস্ত প্রতিকূলতা এড়াইয়া সব কিছুই যেন অবিকল রহিয়া গিয়াছে।
আইলের অন্য আরেক ধারে বসিয়াছে দুইজন, খুবই কাছাকাছি। দুপুরের আহারের পর এক গাল পান খাইয়া মুখ লাল করিয়া তুলিয়াছে জোবেদা; ঠোঁট দুইটি পাকা মরিচের মতো উজ্জ্বল লাল। শিকদার বারংবার তৃষিতের মতো দেখিতেছিল, এটা-সেটা কত কথা, কিন্তু কোনোটাই যেন জমিয়া ওঠে না। দূর দিগন্তের দিকে অনেকক্ষণ অবধি চাহিয়া থাকিয়া একসময় জোবেদা বলিয়া উঠিয়াছিল : দূর ছাই, কিছুই আর ভালো লাগে না।
শিকদারও মাথা দোলাইয়াছিল : হ, আমারও তাই! শুনবা নোতুন বাঁধা গীতটা?
: নাহ, এখন না! জোবেদা উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল : চাপা গলায় গীত-গান ভালো লাগে না। তুমি যখন আসরে বসিয়া গলা ছাড়িয়া গীত ধরো তখনই না আমার ঠিক এইখানে-বুকের উপর হাত দিয়া জোবেদা বলিয়াছিল : কেমন একটা উথাল-পাতাল শুরু হইয়া যায়। অন্য মানুষজন ধারে-কাছে থাকে বলিয়াই সামলাইয়া উঠিতে পারি। হ, এমন নিরজনে বড়ো ভয় হয়!
এক পশলা হাসি ছড়াইয়া জোবেদা বাড়ির দিকে যাইতে যাইতে আবার ফিরিয়া দাঁড়াইয়াছিল; গলা নামাইয়া জানাইয়াছিল : বেলা পড়িয়া আসতে আছে এখনই চতুর্দিকে লোকজন বাহির হইয়া পড়বে। জানি তো, কোন বাড়িতে আইজ সন্ধ্যায় আসর বসবে, আমার শুনতে ভুল হইবে না! হ, দেখমু, আমারে আউলাইয়া দেওনের লাহান কেমন ক্ষমতা তোমার আছে!
অথচ তাহাকে কোনো রকম ‘আউলাইয়া দিবার কোনো ইচ্ছা শিকদারের ছিল না। সেই সন্ধ্যার আসরে আরও আবেগ প্রকাশ দূরে থাকুক, বরং সে খুবই সংযতভাবে তাহার সকল গানগুলি পরিবেশন করিয়াছিল। তবে গানের আসরে একটা বাতির সম্মুখে বসিয়া তাহার বারংবারই মনে হইতেছিল চতুর্দিকে কেউ কোথাও নাই, দেহমনের কোনো গভীর গুপ্তস্থান হইতে অন্য কেউ উঠিয়া আসিয়া তাহার সমস্ত চিত্ত-চৈতন্য আচ্ছন্ন করিয়া তুলিয়াছিল। কী বা কে যে সেই সব গীত-গানের উদ্দীষ্ট তাহা সে নিজেও পরিষ্কার বুঝে নাই, কার খুশিতে ঘোর আন্ধারের মধ্যেও তারার বাতি জ্বলে, কার দুঃখ লইয়া মোতির মেলা বসে বিহান-বেলায় দূর্বাঘাসে, কার জন্য ঝড়-তুফান দেয়ই-ঠাটা উপেক্ষা করিয়া ধাইয়া চলে যুবক-যুবতীর গোপন চৈতন্য-সেই সব সে নিজেও কখনও খুব একটা ‘তবধে’ আনিতে পারে নাই। অথচ নিজেকে সম্পূর্ণ বিলাইয়া নিঃস্ব করিয়া দিবার একটা আকাঙ্ক্ষাই যেন বড়ো হইয়া উঠিয়াছিল। আসরের শেষে, যখন দোতারাটি পিঠে ঝুলাইয়া নিজ বাড়ির পথে চলিয়াছে, সেই সময় অকস্মাৎ অন্ধকারের মধ্য হইতে জোবেদা আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল সম্মুখে : কোনো কথা নাই, সম্বোধনও নাই, সবেগে সে শিকদারকে নিজের দেহের সঙ্গে জড়াইয়া ধরিয়া আবারও অকস্মাৎ মিলাইয়া গেল। শিকদারের পক্ষে কোনো কিছু বলিবারও অবকাশ হয় নাই, সে দেয়ও নাই।
আউলাইয়া গেল শিকদারই স্বয়ং। বেশ কয়েকদিন আর দেখা পাইল না জোবেদার, কত ঘোরাঘুরি করিয়াছে তাহাদের বাড়িয়ালদের কাছাকাছি, পাছদুয়ারের আম-জাম গাছের বাগানে। তখন ‘খন্দের কাল। হাট-মাঠ-ঘাট ভরভরাট, কখনও কোথাও আর কোনো নির্জনতা নাই। শিকদার ভাবিয়াছিল, হয়তো ঘর-গৃহস্থীর কাজকর্মেই জোবেদা ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে। সেও নিজের সামান্য সংসারের দিকে মনোযোগের প্রবণতা অনুভব করিয়াছিল! এই সময় হঠাৎ একদিন কানে আসিল জোবেদার সম্বন্ধের কথা। প্রথমটা একটা বিমূঢ় বোধ করিলেও সে আর অন্য কোনো বিষয়ে মন বসাইতে পারিল না।
একদিন দেখা হইল পুকুরঘাটের কাছে। তখন ভর দু-প্রহর বেলা। পাছদুয়ারের পুষ্করিণীতে স্নান-সমাপন করিয়া জোবেদা ঘরে ফিরিতেছিল; কাঁখে কলসি; দূর উপরের আকাশে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল কতকগুলি অক্লান্ত চিল; প্রখর রৌদ্রের মধ্যে চতুর্দিকের প্রকৃতিকে বড়োই অসহায় দেখাইতেছিল। কেবল শিকদারের উপস্থিতিই নয়, সদ্য সিক্ত বসনও যেন জোবেদার গতিরোধ করিয়া দিল। ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া সে নিজের বসন সংবরণে ব্যস্ত হইয়াছিল।
: ছি! এরকম পাছদুয়ারে ঘোরাঘুরি করো ক্যান তুমি?
শিকদারের মুখে কথা জোগায় নাই, মুখ নামাইয়া একসময় বলিয়াছিল : অনেকদিন তোমার দেখা পাই না।
জোবেদা কাঁখ হইতে কলসিটা নামাইয়া রাখিয়াছিল; অন্য কোনো কথা না খুঁজিয়া সে আবারও সেটা তুলিয়া লইল : রোজ রোজ দেখা হওনেরই বা এমন কী কথা আছে? কোনো কড়ার নাই। আর আমিও তেমন আর বাহির হইতে পারি না। কিছুদিন ধরিয়া সকলেই যেন আমারে আউগলাইয়া রাখছে, মনে কয় যেন হাঁস-মুরগির ছানার লাহান। একটু চৌখের আড়াল করলেই ওই চিল-শকুনের লাহান কেউ ঝাঁপ দিয়া লইয়া যাইবে! এই রকম ডাঙর না হওনই বোধ করি ভালো আছিল!
শিকদারের মুখে কথা জোগায় নাই। গীতগানে কথা বা সুর সাজাইতে না পারার মতো একটা অখুশি মনে ক্রমাগত ব্যাপ্ত হইয়া পড়িতেছিল; কেবল এক সময় বলিতে বাধ্য হইল : একটা কথা শুনলাম বলিয়াই এমন করিয়া তোমার জন্য উদ্বেগ বোধ করছিলাম।
জোবেদা একবার তাহার উপর দৃষ্টি বুলাইয়া বলিয়াছিল : উদ্বেগের কী আছে। মাইয়াছেইলা হইয়া জন্মাইলে একদিন পরের বাড়ি যাইতেই হয়। তুমি পথ ছাড়ো, আমারে এখন ঘরে যাইতেই হয়। কেউ কোনোখান থেকিয়া দেখিয়া ফেলাইলে আমার বাপ-চাচা আমারে জ্যান্ত পুঁতিয়া ফেলাইবে।
শিকদার ধীরে ধীরে তাহার পথ হইতে সরিয়া দাঁড়াইয়াছিল; সুরে আর ছন্দে কথা সাজায় সে, কিন্তু সেইদিন অসংলগ্নভাবে কেবল বলিতে চাহিয়াছিল : এমন যে হইতে পারে, সেই কথা কক্ষনো আমি চিন্তাও করি নাই।
জোবেদা কয়েক পা অগ্রসর হইয়া মুখ ঘুরাইলও : সেইখানেই তো কথা। মনে কয় তোমার আর অন্য কোনো সাধ নাই, সাধ্যও নাই।
শিকদার তবুও তাহার কাছে আগাইয়া গেল : এইটা কী কইলা?
: ঠিকই কইছি! আঁচলটাকে আবারও মুখের কাছে টানিয়া লইয়া জোবেদা বলিল : সকলেই কয় ঘর সংসারের উপর মমতা নাই বলিয়াই তোমাগো বংশ এমন সহজে উজাড় হইয়া গেছে। তোমার কোনো উদ্বেগ বাস্তবিকই থাকলে তুমি সেই মতো উদ্যোগ আয়োজন করতা। কেবল গীত কথা দিয়া ভরণ-পোষণ হয় না। সকল বাপ-মা-ই চায় নিজ নিজ মাইয়া ভালো পাত্রে দিয়া অবস্থার উন্নতি। তোমর কথা কেউরই বিবেচনায় আসে নাই, আর আমিও কিছু করতে পারি না। তুমি যাও, যাও মিছামিছি আর অন্যের রোষের কারণ হইও না।
সেই তখনকার স্তব্ধতা যেন আর কখনও কাটাইয়া উঠিতে সক্ষম হয় নাই শিকদার; অনেক দিন রাত্রি এই বিষয় লইয়া বিচার-বিবেচনা করিয়াছে, কখনও কখনও দেহমনের সমস্ত আকুতি, ব্যথা এবং বেদনাকে গীত-গানে মিটাইয়া লইবার চেষ্টা করিয়াছে, তারপর জীবনের সমস্ত বহিরঙ্গের দিকে একটা অতি নিদারুণ ঔদাস্যবোধ তাহার সমস্ত চিত্ত চেতনাকে আশ্রয় করিয়া ফেলিয়াছিল।
দাদা করমালীর কথা মনে পড়িত। খুব ছোটো বয়সে তাহার সব কথাবার্তা চাল-চলন বুঝিতে পারি নাই; এখন বয়স হইবার সঙ্গে সঙ্গে জীবন ও জগতের নানা বিষয় লক্ষ করিয়া বারংবার তাহার কথা মনে হয়। উঠানের একধারে তিনি দোতারা কোলে লইয়া বসিতেন। বাড়িয়ালের মধ্যে ধানমলা, ধান বাছাই কিংবা সংসারের কোনো কাজ-কর্মই তাঁহাকে আকৃষ্ট করিয়া রাখিতে পারিত না। একমনে অজস্র গীত-কথার স্রোতের মধ্য হইতে জাগিয়া উঠিয়া তিনি গল্প শুরু করিয়া দিতেন।
: দেখিস একবার ভালো করিয়া চাইয়া ব্রহ্মপুত্রের দিকে, ওই গাঙে ভাসিয়া আসছি নীচে। গাঙের ঢেউ যেমন পাড় খাবলাইয়া উপরের পাড়ে উঠতে চায়, থির হইতে চায়, তেমনই আমরাও এমনই একটা জন্ম-মৃত্যুর চক্করে বাঁধা পড়িয়া গেছি যে উদ্ধারের উপায়ও জানি না।-পরক্ষণেই তিনি চক্ষু মুদিয়া গাহিয়া উঠিতেন :
এই লীলাখেলা সব সাঙ্গ হবে।
যেথাই হইতে আইসেছিলে সেথা যাবে
ধন দৌলত সব পইড়ে রবে
তোর কথা আর কেই বা কবে
কেবল অন্তর্যামী রাখবে তোরে অন্তরেতে।
শিকদার আজও পর্যন্ত তাহাকে বুঝিয়া উঠিতে পারে নাই। সংসারে স্বাচ্ছল্য ছিল, আর কোনো গুরুতর পরিশ্রমও করমালীকে কখনও করিতে হয় নাই; নানারকম ভাব এবং তত্ত্ব-কথা লইয়া দিনাতিক্রমণ তাহার পক্ষে অস্বাভাবিক হয় নাই; সংসারের ভাঙনও ছিল তাহার কাছে অবধারিত। কিশোর শিকদার বারংবারই বুঝিতে চাহিয়াছে কে সেই অন্তর্যামী, কে-ই বা সকল মানুষের ভাগ্য আগে হইতেই নির্দিষ্ট করিয়া দেয়, কিন্তু কখনও বুঝিয়া উঠিতে পারে নাই, নানারকম লোকবিশ্বাস অনুসরণ করিতে করিতে একটা ধাঁধা তাহার সমস্ত চিত্ত-চৈতন্যে আরও জটিল হইয়া উঠিয়াছে। মাঝে-মধ্যে তাহার গীতগানের প্রবৃত্তির মধ্যেও একটা সংশয় জাগিয়া ওঠে। দোতারাটাকে ঠেলিয়া রাখিয়া সে জগৎ সংসারের সব রূপ সব সত্যকে নতুন করিয়া দেখিতে বাহির হইয়া যায়। জোবেদার সঙ্গে সেই সাক্ষাতের দিন হইতে শিকদারের সমস্ত উদ্যম যেন নিশ্চল হইয়া পড়িয়াছিল। কী কারণে সে এমন বহির্ভূত হইয়া রহিয়াছে?
: আরে, কবিয়াল যে! এইদিকে কোথায়?
শিকদার ভাবনায় স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া ছিল; খেয়াল করিল, দুইজন দেহাতি মানুষ তাহাদের পথ চলিতে চলিতে থামিয়া পড়িয়াছে; একটা যথাযোগ্য উত্তরের চেষ্টা করিয়া সে পাশ কাটাইয়া যাইতে চাহিল।
: আরে; খাড়াও না কবিয়াল! তোমার সঙ্গে দেখা হইয়া যাওয়া তো একটা ঘটনা।–দেহাতীদের একজন সমাদর দেখাইল : আইজকাল তোমার যে আর সাড়াশব্দও পাওন যায় না। শুনি, কেউ ডাকলেও আর যাও না!
অন্য দেহাতীও জানিতে চাহিল উৎসুকভাবে : ক্যান, ক্যান বিষয়টা কী?
: কী আর!-তাহাদের সরাসরি দৃষ্টি এড়াইয়া যাইতে চাহিল শিকদার : অনেকদিন আর নতুন কোনো গীত বাঁধনের সুযোগ হয় নাই।
: ক্যান, ক্যান?
অন্যজন তাহাকে বিব্রত দেখিয়া হাসিতে চাহিল : এইটা কোনো কথা হইল কবিয়াল! তোমার আসরে হাজির থাকা আমি কক্ষনো কামাই দেই নাই। কেবলি তো শুনছি নিত্য নতুন গাহন শুনাইতা। এই রকম উঠতি কালেই ক্যান যে এমন করিয়া আউলাইয়া গেলা। শোনো, একটা তারিখ ফেলাইয়া দেই, তুমি আসো, একটু আমোদ-আহ্লাদও হইবে।
অন্য দেহাতি এইদিক-সেইদিক চাহিয়া সঙ্গীকে সাবধান করিয়া দিতে চাহিল : তুমি আর সময় পাই না। গান-বাজনার উপর গুনাহগিরির ধমকগুলানরে যে আর খেয়াল রাখতে আছ না। তেমন কিছু করতে গেলে আগে গাঁও-গ্রামের প্রধানগো লগে কথাবার্তার দরকার আছে।
শিকদার যথাসম্ভব সৌজন্য দেখাইয়া আপন পথ ধরিল : আমার যাইতে হয় এখন বড়ো উদ্বেগের মধ্যে আছি। আইজকাইল আর তেমন কোনো চর্চা নাই।
সেই দেহাতি মাথা নাড়িয়া আপশোশ করিল : এইটা ভালো কথা না কবিয়াল, এইটা ভালো কথা না। আমাগো লাহান গরিব-গুর্বা মানুষের হাউশ আহ্লাদ মিটানোর একটা অছিলাও তো চাই। তোমার মতো গুণী মানুষের এমন করিয়া নিভিয়া যাইতে দেখতে পারি না।
তাহার সঙ্গী তাহাকে ভৎর্সনা শুরু করিল : দূর মর্দ, তোমারই দেখতে আছি আর বুঝ-হিসাব নাই।
শিকদার আর কোনো রকম অধিক কথাবার্তায় জড়াইয়া পড়িতে চাহিল না। : তবু একদিন আসিও কবিয়াল, তোমার গীতগানে কাঁদিয়া-কাটিয়াও একটা সুখ হয়। পথ চলিতে চলিতে শিকদার আবারও উন্মনা হইয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। ইচ্ছা হইল ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া সে কিছু বলে, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হইল কোনো কথাই সে যেন গুছাইয়া বলিতে পারিবে না। বরং অনর্থক আরও জটিলতা বাড়িয়া উঠিবে, সকল কথার একটা সরলার্থই সম্ভবত সকলের কাছে সত্য হইয়া রহিয়াছে। কিন্তু আরও কিছু ব্যথা-বেদনাও যে তাহার অন্তর জুড়িয়া ছড়াইয়া পড়িতেছিল, সেই সব কথা হয়তো কেউ বুঝিয়াও উঠিতে পারিবে না। আর তা বলিয়াও কোনো লাভ নাই।