১৬. নীতিযুদ্ধের বিপত্তি

নীতিযুদ্ধের বিপত্তি

মানবজাতির ইতিহাসে বিভিন্নভাবে সামরিক আলোড়ন ঘটে গেছে। উৎসাহী ব্যক্তিরা তার যে কোন একটি ইতিহাসের চাবিকাঠি বলে ধরে নিতে পারেন। আমি যে আলোড়নটির ওপর আলোচনা করতে চাই সম্ভবতঃ তা কম গুরুত্বসম্পন্ন নয়। আলোড়নের ফলে ইতিহাসের সমন্বয় এবং অসহনশীলতা থেকে বিশ্লেষণ এবং সহনশীলতায় উত্তরণ, তারপর আবার পূর্বাবস্থায় প্রত্যাগমন আমার প্রস্তাবিত বিষয়।

অসভ্য গোত্রগুলো প্রায়ই অসহিষ্ণু এবং সন্দেহপ্রবণ হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে সামাজিক আচার বিচারের খুবই প্রধান্য এবং আগন্তুকদের সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হয়। ইতিহাসের প্রাকহেলেনিক যুগের সবটাতেই এ বৈশিষ্ট্য পুরোমাত্রায় বিরাজমান ছিল। বিশেষ করে মিশরে শক্তিশালী পুরোহিততন্ত্রই ছিল জাতীয় ঐতিহ্যের সংরক্ষক। আখনাতোন বিদেশী সিরীয় সভ্যতার কাছ থেকে যে সাবলীল সংশয়বাদ আয়ত্ব করেছিলেন তা দমন করতে সম্পূর্ণ পারঙ্গম ছিলেন। মিনোয়ানের সময়ের অবস্থা যাই থাকনা কেনো গ্রিসেই সর্বপ্রথম বিশ্লেষণাত্মক সহনশীলতার পরিপূর্ণ বিকাশ হয়। এর পেছনের অনেকগুলো ধারাবাহিক কারণের একটি দৃষ্টান্ত হলো বাণিজ্য, বিদেশীদের সঙ্গে সম্বন্ধ রাখার অভিজ্ঞতা থাকার ফলে এবং বিদেশীদের সঙ্গে সম্বন্দ রাখার তাগিদে তাদের মধ্যে সহনশীলতার প্রয়োজন ছিল। সাম্প্রতিককালের পূর্বপর্যন্ত বাণিজ্য ছিল ব্যক্তিমালিকানাধীন, কুসংস্কার ছিল তখন লাভের প্রতিবন্ধক এবং সকলের সঙ্গে প্রীতির সম্বন্ধ রক্ষা করাই হলো ব্যবসায়ে সাফল্যের নীতি। কিন্তু পরবর্তী গ্রিসের বাণিজ্যম্পৃহার থেকেই, শিল্প এবং দর্শনের উদ্ভব হয়, কিন্তু সামরিক সাফল্যের জন্যে যে পরিমাণ সামাজিক সঙ্গতির প্রয়োজন ছিল তা সৃষ্টি করতে পারেনি। সুতরাং গ্রিকেরা প্রথমে মেসিডোনিয়া এবং পরে রোমানদের কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল।

আধুনিক দৃষ্টিতে দেখতে গেলে রোমান পদ্ধতি ছিল নিঃসন্দেহে সমন্বয়ধর্মী এবং অসহনশীল। এখানে আধুনিক অর্থের মানে আমি বোঝাতে চাচ্ছি যে তারা ধর্মতাত্ত্বিক দিক দিয়ে নয়, সাম্রাজ্যবাদী এবং অর্থনৈতিক দৃষ্টিতেই ছিল সমন্বয়বাদী। সে যাহোক, রোমানদের সমন্বয়বাদ ধীরে ধীরে সংশয়বাদের মধ্যে ডুবে গেলো এবং যা খ্রীষ্টিয় এবং মুসলমান সমন্বয়বাদে রূপ পরিগ্রহ করেছিল। এ সমন্বয়বাদ রেনেসাঁর পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত প্রবল ছিল। পশ্চিম ইউরোপের বুদ্ধিবৃত্তি এবং শিল্পোতকর্ষময় একটি সংক্ষিপ্ত যুগের জন্ম রেনেসা দিয়েছিল; যখন রাজনীতিতে অব্যবস্থা এবং সাদাসিধা মানুষদেরকে বোকা বানিয়ে ধর্মযুদ্ধে পরস্পর পরস্পরকে নির্মমভাবে হত্যা করানো হচ্ছে। ইংল্যাণ্ড, ইংল্যাণ্ডের মতো ব্যবসায়ী জাতিসমূহ সর্বপ্রথমেই সংস্কার এবং প্রতিসংস্কার আন্দোলন থেকে বেরিয়ে আসে এবং আলাদা হবার জন্য অন্যান্যদের সঙ্গে সংগঠিত হয়ে রোমের বিপক্ষে যুদ্ধ করার ব্যাপারে সহনশীলতার পরিচয় দান করল। প্রাচীন গ্রিসের মতো ইংল্যাণ্ডও প্রতিবেশী দেশসমূহে একটা সফল প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল এবং যা গণতন্ত্র ও পার্লামেন্টারি শাসনব্যবস্থার জন্য যে পরিমাণ সংশয়বাদের প্রয়োজন তা সৃষ্টি করেছিল। আজকের অসহিষ্ণু যুগে তা সম্ভব নয় বলে মানুষ ফ্যাসিবাদ এবং বলশেভিক মতবাদকে তার স্থলাভিষিক্ত করতে চায়।

উনবিংশ শতাব্দীর পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের যে সাধারণ ধারণা তারও চেয়ে অধিক ১৬৮৮ সালের বিদ্রোহের দর্শন জন লকের লেখায় যা প্রকাশ পেয়েছে, তার মধ্যে হৃদয়ঙ্গম করতে পারি। এই দর্শন ১৭৭৬ সালে আমেরিকা এবং ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসিদেশে প্রভুত্ব বিস্তার করে এবং তার পরে পাশ্চাত্যের প্রায় দেশেই ছড়িয়ে পড়ল। শিল্পবিপ্লব এবং নেপোলিয়নকে পরাজিত করে ইংল্যাণ্ড যে সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হয়েছিল তাই ছিল এ দর্শনের ব্যাপক প্রসারের কারণ।

মানুষ ধীরে ধীরে এ ক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য অসঙ্গতির বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠেছে। লক এবং উনবিংশ শতাব্দীর উদারনৈতিক মতবাদ ছিল শিল্পনির্ভর নয়, বাণিজ্যনির্ভর। নিখুঁতভাবে যে দর্শন শিল্পনির্ভর তা সমুদ্রবিহারী অভিযাত্রী বণিকের দর্শনের চাইতে সম্পূর্ণ আলাদা। শিল্পবাদ সংযোজনধর্মী বৃহৎ অর্থনৈতিক এককের সৃষ্টি করে সমাজকে অধিকতর যান্ত্রিকতায় রূপান্তরিত করে এবং ব্যক্তির আশা আকাঙ্খর অবদমনের দাবি করে। তদুপরি, শিল্পবাদের অর্থনৈতিক সংগঠন কাঠামোর দিক দিয়ে এ পর্যন্ত কতিপয় ব্যক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং আপাত-বিজয়ের মুহূর্তটিকে রাজনৈতিক গণতন্ত্রের নিরপেক্ষ রূপ দান করেছে। এ সকল কারণে মনে হয় যে আমরা সমন্বয়শীল অসহিষ্ণু নতুন একটি যুগের মধ্যে প্রবেশ করছি। যার ফল অন্যান্য যুগের দর্শনের সংঘাতের মত এযুগে যে যুদ্ধ হবে, তা বলাবাহুল্য মাত্র। আমি এই সম্ভাবনাকেই তুলে ধরে দেখাতে চাই।

আজকের পৃথিবীতে দুটো শক্তিশালী রাষ্ট্র রয়েছে, একটি সোভিয়েট রাশিয়া এবং অন্যটি আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র। তাদের লোকসংখ্যা সমান এবং যে সকল দেশকে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের লোকসংখ্যাও প্রায় তাদের সমান। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপসহ বাকি আমেরিকা মহাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং রাশিয়া তুরস্ক,ইরান এবং চীনের অধিকাংশকেই নিয়ন্ত্রণ করে। এই বিভেদ মধ্যযুগের খ্রিষ্টান এবং মুসলমানদের বিভেদের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। সে আগের এত নীতির দ্বন্দ্ব, নির্জলা হিংসা এবং বিস্তৃত এলাকা সবকিছু এখনও বর্তমান। মধ্যযুগে খ্রিষ্টান শক্তির সঙ্গে মুসলমান শক্তির যেমন যুদ্ধ হয়েছিল তেমনি এ দুটো শক্তিমান শিবিরের মধ্যেও যুদ্ধ হবে। কিন্তু আমরা প্রত্যাশা করতে পারি যে শীগগীর অথবা বিলম্বে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে তার নিরসন করা হবে এবং পরস্পরের মধ্যে ক্লান্তিজনিত সংঘর্ষ ছাড়া আর কিছুই হবে না। এ সংঘর্ষের ফলে দু’দলের একদল বিজয়ী এবং বিজয়ের ফলে যে সুবিধা আদায় করতে পারবে তা আমি মনে করি না। একদল অন্যদলকে ঘৃণা করবে এবং মন্দভাবে বলেই দু’দলের মধ্যে হিংসাত্মক মনোভাব অটুট থাকবে বলে আমি মনে করি এবং তাই হলো নীতিযুদ্ধের একটি বৈশিষ্ট্য।

আমি অবশ্য এ ধরনের কোন পরিণতি যে অবশ্যম্ভাবী সে সম্বন্ধে কোন নিশ্চয়তা দিচ্ছি না। এখন পর্যন্ত বিজ্ঞান যে যে পর্যায়ে তার চেয়ে অনেক দূর না এগিয়ে গেলে মানুষকে তার ভবিষ্যতের ব্যাপারে সবসময় অনিশ্চিতের উপর নির্ভর করতে হবে। আমার কথা হলো নির্দেশিত দিকে টেনে নেয়ার মত কিছু শক্তিশালী উপাদান রয়েছে যেহেতু এ শক্তিগুলো মনস্তাত্ত্বিক সেহেতু এগুলো মানুষের নিয়ন্ত্রণসাধ্য। যদি ক্ষমতার অধিকারী ভবিষ্যতে নীতিযুদ্ধের পুনঃ প্রবর্তন না করতে চায় তাহলে তারা অতি সহজে যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে পারবে। ভবিষ্যত সম্পর্কে কোন অপ্রিয় মন্তব্য করে এবং মন্তব্যটাও যদি স্বাভাবিক যুক্তিসিদ্ধ না হয়, তাহলে জনগণকে তার ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে চেষ্টা করার জন্য অনুপ্রাণিত করা তার আংশিক কর্তব্য বিশেষ হয়ে দাঁড়ায়। যারা অশুভ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত করেন, তারা যদি বিশ্বপ্রেমিক হন প্রথমে নিজেদেরকে ঘৃণিত করে তোলা উচিত, যাতে করে তাদের ভবিষ্যদ্বাণী সফল না হলে তারা অত্যন্ত অসুখী হতে পারেন। এই প্রাথমিক বোধটুকু নিয়ে আমি সম্ভাব্য নীতিযুদ্ধের ভিত্তিভূমি নির্ণয় করতে চাই এবং পরে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে কি পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে, তাতে হাত দেব।

অষ্টাদশ শতাব্দীর চাইতে অদূর ভবিষ্যতে সক্রিয় অসহিষ্ণুতার ক্ষেত্রজ কারণ হলো বৃহৎ সাম্যবাদী ইস্তাহারের চেয়েও পুরনো যুগের আসনে এখনো আসীন। বর্তমান ক্ষেত্রে এর যে প্রতিক্রিয়া আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিতে শুরু হয়েছে, তাই আমাদের বিবেচনার বিষয়। কয়েকজনের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলে মতামতের উৎসকে বন্ধ করে দেয়ার জন্য বর্ধিত মনোভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ কারণে সংখ্যালঘু মতামত কখনো পরিপূর্ণ বক্তব্যের আঙ্গিকে প্রকাশ করার সুযোগ পায় না। সোভিয়েট রাশিয়াতে ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থে রাজনৈতিকভাবে মতামতকে অবদমন করা হয়। প্রথমে মতামত অবদমদের পদ্ধতিটি সাফল্যজনক প্রমাণ হবে কিনা সে সম্পর্কে প্রচুর সন্দেহের অবকাশ ছিল, কিন্তু যতই বছরের পর বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে ততই সে সন্দেহের নিরসন হচ্ছে। বাস্তব অর্থনীতিতে সুবিধা দেয়া হয়েছে, কিন্তু রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক থিয়োরি এমনকি দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যেও কোন বিশেষ সুবিধা দেয়া হয় না। কমিউনিজম ধীরে ধীরে ভবিষ্যৎ স্বর্গের অনুসন্ধানী এবং পার্থিব সম্পর্কবিমূর্খ একটি বিশ্বাসে পরিণত হচ্ছে। বেড়ে ওঠা নতুন যুগের মানুষ এই বিশ্বাসকে চরম সত্য বলে মেনে নিয়েছে, কারণ এর নির্মিতির যুগে সে সম্বন্ধে কেউ কোন প্রশ্ন ওঠায়নি। বর্তমানে সাহিত্যের ওপর, সংবাদপত্রের ওপর, বেতারের ওপর রাষ্ট্রের যে কর্তৃত্ব, আগামী বিশ বছর যদি তা বলবৎ থাকে তাহলে অধিকাংশ মানুষ কমিউনিস্ট দর্শনকে গ্রহণ করবে, তাতে সন্দেহ করার কোন সঙ্গত কারণ নেই। কিছু সংখ্যক বয়স্ক লোক যারা পূর্ব যুগের দর্শনের রিক্তাবশেষ এবং যারা স্বাধীন চিন্তা করেন তেমনি কতিপয় মানুষ কমিউনিজমের বিরোধিতা করবেন, দীর্ঘদিনের ব্যবধানেও যারা বিশেষ কোন প্রভাব সৃষ্টি করতে পারবেন না বলে মনে হয়। পৃথিবীতে সবসময় স্বাধীন চিন্তাবিদ ছিলেন। ইতালির অভিজাততন্ত্র সবসময় একদেশদর্শী ছিল, কিন্তু কোন আকস্মিক কারণে, আজকের মেক্সিকোর মতো তাদের মতামত রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কার্যকরী হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠিত গির্জার সামান্য একটু শুভেচ্ছা থাকলে তা এড়ানো যায় এবং ধরে নেয়া যায়। রাশিয়ার প্রতিষ্ঠিত গির্জা এ ব্যাপারে যথকিঞ্চিত সদিচ্ছা দেখাতে পেরেছে। শিক্ষাবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে তরুণ কৃষকদের মাঠে এনে কৃষিকার্যের পদ্ধতির ক্ষেত্রে তার ব্যক্তিত্ব স্বীকার করে নিয়ে তাকে নীতিতে বিশ্বাস করিয়ে নেয়া হচ্ছে। কমিউনিজম যেখানে গাঢ় নয় সেখানে তা শুধু অর্থনৈতিক রাজত্বমাত্র এবং যেখানে কমিউনিজম প্রগাঢ় সেখানে তা সাধারণত স্বীকৃত একটি বিশ্বাসের স্তরে উন্নীত হয়।

শুধুমাত্র এশিয়া অথবা রাশিয়ার অঞ্চলসমূহের মধ্যে এই পদ্ধতি অনুসৃত হচ্ছে। না। চীনদেশেও এ পদ্ধতি শুরু হতে যাচ্ছে, সম্ভবত তা অধিকতর শক্তিও সংগ্রহ করবে। চীনদেশের সবচেয়ে যা শক্তিশালী, বিশেষ করে বলতে গেলে জাতীয়তাবাদী সরকারের ওপর রাশিয়ানদের প্রভাব অপ্রতিহত। রাশিয়ানদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত প্রচার প্রোপাগাণ্ডার কারণে দক্ষিণ বাহিনী সামরিক সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্ম এবং তাও মতবাদ প্রভৃতি প্রাচীন ধর্মে যে সকল চীনা রাজনৈতিক বিশ্বাসী তারা প্রতিক্রিয়াশীল। বিদেশীদের কাছে জাতীয়তাবাদীদের তুলনায় খ্রিষ্টানেরা অধিকতর বন্ধুভাবাপন্ন। এর কারণ হলো প্রধানতঃ জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে প্রাচীন ধর্মসমূহের কোনও বিরোধ নেই। দেশী হোক, বিদেশী হোক তাদের প্রসঙ্গে একই কথা খাটে। আনকোরা নতুন মতবাদ, প্রগতির শেষ অর্থ এবং তার সঙ্গে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ শক্তি বলতে গেলে একমাত্র রাজনৈতিক বন্ধুত্বপূর্ণ শক্তির সংযোগ থাকার ফলে রাশিয়ার নতুন ধর্ম দেশপ্রেমিক জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছে। চীনদেশে কমিউনিজমকে গ্রহণ করেছে এটা কল্পনা করা অসম্ভব হলেও সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

বৃটিশদের সবচেয়ে বিরাট ভুল হলো অনুন্নত জাতির সম্বন্ধে বিবেচনা করার সময় তার ঐতিহ্যের শক্তিতে অতিমাত্রায় বিশ্বাস স্থাপন করে। চীনদেশে এমন প্রচুর ইংরেজ আছেন, যারা চীনের প্রাচীন সাহিত্য সম্বন্ধে জ্ঞান রাখেন, জনসাধারণের কুসংস্কারের সঙ্গে সুপরিচিত; এমনকি রক্ষণশীল সাহিত্যিকদের মধ্যে তাদের বন্ধু বান্ধবও আছেন, কিন্তু নব্যচীন সম্পর্কে অবজ্ঞেয় নিস্পৃহতা পোষণ করা ছাড়া সত্যিকারভাবে বোঝে এমন একজনও ইংরেজ সেখানে নেই। জাপানিদের বিতাড়নের মুখে চীনের অতীতকে দিয়ে ভবিষ্যৎ বিচার করে এবং বলে যে শিগগির কোন পরিবর্তনের আশঙ্কা নেই। জাপানে, যেমন চীনদেশকেও পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তি নতুন মর্যাদায় মণ্ডিত করেছে এবং ঘৃণার আসনেও বসিয়েছে। কিন্তু রাশিয়ানদের বেলায় ঘৃণার প্রকাশ ঘটবে না; কেননা রাশিয়ানেরা পাশ্চাত্যের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাবার জন্য চীনাদের সাহায্য করবে, দ্রুত পরিবর্তনের সাহায্যেই অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে সহজেই প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার করানো যায়। কারণ শিক্ষাব্যবস্থার পেছনে সরকারি সাহায্যের গৌরব রয়েছে বলে তরুণেরা বয়স্ক শিক্ষিতদেরকে সহজেই ঘৃণা করতে শেখে।

সুতরাং আগামী বিশ বছরের মধ্যে সমগ্র চীনদেশে কোনও উপায়েই বলশেভিক মতবাদকে প্রতিরোধ করা যাবে না এবং চীনারা রাশিয়ানদের সঙ্গে একটি ঘনিষ্ট রাজনৈতিক চুক্তিতে আবদ্ধ হবে। ধীরে ধীরে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে পৃথিবীর অর্ধেক জনসংখ্যার মনে এ মতবাদটিকে প্রবিষ্ট করিয়ে দেয়া হবে। তারপরে আর অর্ধেক জনসাধারণের কি অবস্থা হবে।

প্রতীচ্য জগতের যেখানে সরকারের গোঁড়ামির এবং পূর্বাবস্থার কোনও পরিবর্তন নেই, বরঞ্চ সূক্ষ এবং সুপ্রচুর পদ্ধতিতে সেগুলোকে ধরে রাখা হয়েছে, আসলে প্রচলিত পদ্ধতির একটাও কোন প্রতিষ্ঠিত উদ্দেশ্য ছাড়া বেড়ে উঠতে পারেনি। আধুনিক বিশ্বাসকে খাঁটিভাবে ইউরোপে দেখা যায় না, মধ্য যুগের নানা বিশ্বাসের অপভ্রংশ ও আধুনিক বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে দেয়া যায়। একমাত্র আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রেই ধনতান্ত্রিক শিল্পবাদ সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে বিকশিত হয়েছে এবং সেখানে এর লক্ষণগুলো অত্যন্ত সুস্পষ্ট। পশ্চিম ইউরোপকে অবশ্যই পদে পদে আমেরিকান চরিত্রটি গ্রহণ করতে হবে, একারণে যে আমেরিকা এখন পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র। একথার মানে আমি এ বলছিনা যে আমাদেরকে মৌলিকভাবে সে নীতি গ্রহেণ করতে হবে যা ছিল ধার্মিক কৃষকদের মধ্যে বপনকৃত ইউরোপিয়ানদের বিলম্বিত বিশ্বাস। আমেরিকার কৃষিপ্রধান অংশ, আন্তর্জাতিক দিক দিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং মহৎ বিশ্বাস। কিন্তু এই বিশ্বাসটি আমেরিকাতে একরকম রাশিয়াতে আরেক রকম। এই দুই প্রতিষ্ঠানের বৈপরিত্যই পৃথিবীর সুখ শান্তির সঙ্গে জড়িত।

রাশিয়ার মত আমেরিকারও একটি আদর্শ আছে, তার বাস্তব রূপায়ণ এখনো হয়নি। শুধু থিয়োরিগতভাবে সে আদর্শের সঙ্গে মূল্যবোধের সংযোজন করা হয়েছে। কমিউনিজম হলো রাশিয়ার আদর্শ আর আমেরিকার আদর্শ হলো স্বাধীন প্রতিযোগিতা। যে অর্থনৈতিক পদ্ধতি রাশিয়ান আদর্শের চূড়ান্ত প্রতিবন্ধক সে পদ্ধতিই হচ্ছে আমেরিকান আদর্শের পরম সহায়। কমিউনিস্টরা যেখানে সংগঠনের ভিত্তিতে চিন্তা করে, সেখানে আমেরিকানরা ব্যক্তির পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করে। রাজনীতিতে যারা তরুণ তাদের সামনে লগ কেবিন থেকে হোয়াইট হাউজ’ নীতিকে তুলে ধরা হয়, ব্যবসার ক্ষেত্রে উন্নতি করার জন্য অনুরূপ একটি অর্থনৈতিক পদ্ধতিরও জোড়ালো বিজ্ঞাপন দান করা হয়। এটা সত্য কথা যে, সকলের পক্ষে হোয়াইট হাউজে প্রবেশ করা অথবা কোন কর্পোরেশনের প্রেসিডেন্ট হওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু তা পদ্ধতির দোষ নয়। প্রত্যেক যুবকের কাছে আবেদন করে সঙ্গীদের চেয়ে অধিকতর পরিশ্রমী এবং বুদ্ধিমান করে তোলবার জন্য তা করা হয়। আমেরিকাতে তখন এত সুযোগ ছিল যে অধিকাংশ লোকের পক্ষে অন্যের ঘাড়ের ওপর পা না রেখে কিছু পরিমাণ সাফল্য অর্জন করতে পারা যেত। এখনও মানুষ সেখানে শুধু জাগতিক উন্নতির প্রত্যাশা করে এবং শক্তির পরোয়া করে না। আমেরিকার একজন মজুর মহাদেশের অন্যান্য মানুষের চাইতে বেশি আয়ও করতে পারে।। কিন্তু ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে আসছে। যারা সুযোগ সুবিধা থেকে বাদ পড়েছে: দাবি দাওয়া নিয়ে আসবে অন্তত তাদের কাছ থেকে একটা বিপত্তি প্রত্যাশা করা যেতে পারে। নেপোলিয়নের প্রতিভাবানেরা অনেক কিছু করতে পারে এ বাণীতে বিশ্বাস স্থাপন করে বাদবাকি কাজ সমষ্টিগত প্রচেষ্টা ব্যতিরেকে ব্যক্তিক চেষ্টায় সাফল্যমণ্ডিত করতে পারে বলে মনে করে। কমিউনিজম দর্শনে গ্রুপ অথবা দলই হলো সাফল্যের মূল কারণ, কিন্তু আমেরিকান দর্শন অনুসারে ব্যক্তি প্রাধান্য লাভ করে। ফলতঃ যে লোক কোন কাজে সফলতা অর্জন করতে অকৃতকার্য হয়, সমাজকে দোষী করা অথবা সমাজের ওপর রাগ পোষণ করার চাইতে নিজের অক্ষমতার জন্য লজ্জিত হয়। একজন ব্যক্তি যদি ব্যক্তিকেন্দ্রিক দর্শনে অভ্যস্ত হয়ে থাকে তাহলে সমন্বিত প্রচেষ্টায় কিছুই অর্জন করা যায় না বলে মনে করে। ক্ষমতার অধিকারী যারা তারা যখন সামাজিক পদ্ধতির সুযোগ গ্রহণ করে অর্থ সম্পদের মালিক হয় এবং বিশ্বজোড়া প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়, তাদের বিরুদ্ধে কোন সার্থক বিরোধিতা সম্ভব হয়ে ওঠেনা।

এমন কোন সময় ছিলনা যখন মানুষের আকাঙ্খিত বস্তু মানুষের মধ্যে ন্যায্যতঃ বন্টন করে দেয়া হয়েছে। একটি স্থায়ী সমাজব্যবস্থার মধ্যে অবশ্যই এমন কতকগুলো পদ্ধতি থাকে, সে অনুসারে কম সৌভাগ্যবান মানুষেরা তাদের মন্দ ভাগ্যের জন্য অপরকে দোষারোপ করে এবং স্বভাবতঃই তা একধরনের বিশ্বাস বা সংস্কারবিশেষ। কিন্তু ব্যাপক স্বীকৃতি আদায় করতে হলে একটা বিশ্বাসকে সমগ্র সমাজ যে সকল অবিচারের নিন্দা করে তার ক্ষতি পূরণের ব্যবস্থা করে থাকে। আমেরিকাতে তা যান্ত্রিক উন্নতি এবং জাগতিক আরামের ব্যবস্থা করেছে। হয়ত তা অনির্দিষ্টভাবে পরবর্তী স্তরের প্রয়োজনের সুব্যবস্থা করতে পারবেনা এবং নির্দিষ্ট সময় না আসা পর্যন্ত তা আগের এমতো চলতেই থাকবে। রাশিয়াতে শুধু ধনিকের স্বার্থে নয়, সর্বসাধারণের কল্যাণের জন্য শিল্পোৎপাদন ব্যবস্থা পরিচালনা করা হয়। রাশিয়ান মজুরেরা যে আমেরিকান মজুরদের চেয়ে দরিদ্র তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, কিন্তু এটা জেনে সে সান্তনা পায় যে (অন্ততঃ বিশ্বাস করে যে সে তার ন্যায্য অংশ পাচ্ছে এবং অন্য কাউকে অপ্রয়োজনে বড়ো এবং শক্তিমান করার জন্যে সে কাজ করছে না। অধিকন্তু যে নিজেকেও দৃঢ়সংবদ্ধ সামাজিক সংস্থার একটি একক বলে মনে করে, আলাদা আলাদা একক হিসেবে একে অন্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে বলে মনে করে না :

আমার মনে হয়, আমরা এখন রাশিয়ান এবং আমেরিকান বিশ্বাসের বিরুদ্ধবাদী আওতার মধ্যে এসে পড়েছি। আমেরিকানদের দৃষ্টিভঙ্গি শতাব্দীব্যাপী অপ্রতিহত প্রোটেষ্টান্ট মতবাদে কর্ষিত হয়ে গড়ে উঠেছে এবং ব্যক্তিগত সংগ্রামে কারো কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণ না করেও দারিদ্র থেকে সমৃদ্ধির স্তরে উন্নীত হতে পারে। কল্পনায়, তাকে জংলি মানুষের মতো একজন ভাবা যেতে পারে, কিন্তু যদি বাস্তবে প্রতিযোগী মানুষের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করে তাহলে নির্ভর করার এত স্থায়ী কোন বিষয় নয়। মানসিক সংহতির বিনিময়ে বস্তু সম্পদ আহরণ করে মতামত প্রকাশের ব্যাপারে সারাজীবন দাস যে সংস্থা করে রাখে তাও ভালো নয়। যে সমস্ত মতামত সে অবশ্যই প্রকাশ করবেনা নিশ্চিতভাবেই সেগুলো আবাঞ্ছিত মতামত, বাধ্য হয়ে জিহ্বাকে শাসন করতে হয়। মাঝারি বয়সে পৌঁছুলে এ দৃষ্টিভঙ্গী সারাজীবন ধরে অবদমিত মতামতসম্পন্ন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে দাঁড়ায়।

পক্ষান্তরে রাশিয়া, বাইজান্টাইন গির্জা, তাতার এবং জারতন্ত্রে মানব মনের ওপর ধারাবাহিক চাপ প্রয়োগ করে ব্যক্তিজীবনের অনিত্যতাকে উদঘাটিত করেছে। আগে একজন ব্যক্তি যা ভগবানের উদ্দেশ্যে, গির্জার উদ্দেশ্যে এবং জারের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করত তা সমাজের জন্য কম কষ্ট সহকারে উৎসর্গ করা হয়। রাশিয়ান কমিউনিষ্টেরা তাদের পশ্চিমা হামদরদিদের সঙ্গে ব্যক্তির সম্মানের প্রশ্নে সম্পূর্ণভাবে ভিন্নরকম। এক্ষেত্রে তারা পূর্বসূরী বাইজান্টাইনদের তুলনায় অনেক বেশি খোলামেলা এবং তৎপর। তারা ওদের মত আত্মার অস্তিত্ব এবং অবিনশ্বরতায় বিশ্বাস করে না। আত্মাকে অস্বীকার করে সোভিয়েট রাশিয়ার শাসকেরা হবস এর লেভিয়াথিনের সহধর্মী কোন মতকে একজন খ্রিস্টানের চেয়ে নিঃসন্দিগ্ধ চিত্তে গ্রহণ করতে পারে। তাদের মেনেনিয়াম এ্যাগরিপার উপকথায় বর্ণিত মানুষের বিক্ষিপ্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে একত্রে যদি যোগ করা যায়, তাদের কাছেও প্রতীচ্যের ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ তেমনি মানব শরীরের বিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মত। শিল্পকলা, ধর্ম, নৈতিকতা পরিবার সবকিছু সম্বন্ধে তাদের যে দৃষ্টিভঙ্গি মৌলিকভাবে এই ধারণা থেকে উদ্ভূত।

পশ্চিমের সমাজতন্ত্রীরা মাঝে মাঝে বলে থাকে যে তারাও একইভাবে সমাজের সর্বোচ্চ গুরুত্বে বিশ্বাস করে, কিন্তু বাস্তবে তা কদাচিৎ পরিদৃষ্ট হয়। উদাহরণস্বরূপ একজন মানুষ দূরদেশে চলে যাওয়ার সময় স্ত্রী পুত্রকে নিয়ে যেতে চাইবে এটা তাদের পক্ষে খুব স্বাভাবিক। কিন্তু প্রাচ্যের একজন গোঁড়া কমিউনিষ্টের কাছে তা নিছক ভাববাদিতা ছাড়া আর কিছু নয়। তারা বলবে যে ছেলেপুলেদের রক্ষণাবেক্ষণ করবে রাষ্ট্র এবং যেখানে যাচ্ছে সেখান থেকে পুরনো স্ত্রীর মত ভালো একটি স্ত্রী সহজে যোগাড় করা যায়। স্নেহ-মমতার স্বাভাবিক দাবিকে বিদঘুঁটে ব্যাপার বলে মনে করে। এটাও সত্য যে ধনতান্ত্রিক সমাজেও বাস্তবে এরকম ব্যাপার সহ্য করতে হয়, কিন্তু থিয়োরিগতভাবে তা অতোটা নয়। লেনিনের মতামত আমি যা বলেছি সম্পূর্ণভাবে তার বিপরীত। আমি মনে করি তাকে অসংগতি বলেই স্বীকার করে নিতে হবে, কারণ থিয়োরির আবরণ ছিন্ন করে একটা রক্তমাংসের মানুষের উদ্ভব হিসেবে লেনিন বেরিয়ে এসেছিলেন। একজন সত্যিকারের কমিউনিষ্ট লেনিনকে একজন ব্যক্তি না বলে একটি মুক্তির প্রতীক বলে অভিহিত করবেন বলে আমার ধারণা। ঈশ্বরবাক্যের মত কালক্রমে তিনি হয়ত বিমূর্ত রূপ ধারণ করবেন।

কিছু সংখ্যক মানুষ মনে করে যে রাশিয়ানরা হঠাৎ অথবা ধীরে ধীরে প্রতীচ্যকে জয় করে ফেলবে। এ মনোভাবের সপক্ষে এমন কতেক যুক্তি রয়েছে আপাতঃদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে সেগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিল্পবাদের জন্য কমিউনিষ্ট দর্শন ধনতান্ত্রিক দর্শনের চেয়ে অধিকতর উপযোগী তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কারণ শিল্পবাদ অনিবার্যভাবে ব্যক্তির প্রতিকূলে বর্ধিতহারে সংগঠনের গুরুত্বকে বাড়িয়ে দেয়। জমি এবং প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানা একজন ব্যক্তির চাইতে একটি শিল্পপদ্ধতির হাতে থাকাটা অধিকতর স্বাভাবিক এবং যুক্তিসঙ্গত। জমির ব্যক্তিগত মালিকানার দুটি উৎস। একটি হলো অভিজাততন্ত্রভিত্তিক, তলোয়ারের সাহায্যে মালিকানা অর্জন করা হয় যাতে, অন্যটি হলো গণতান্ত্রিক। সে মালিকানার ভিত্তি হলো কৃষক নিজের হাতে যে জমি চাষ করে তার মালিক সে নিজেই। একটি শিল্পভিত্তিক সমাজে এ দুটো পদ্ধতিই উদ্ভট এবং অকেজো বলে প্রমাণিত হয়েছে। খনির মাশুল এবং সামন্ত জমিদারী অভিজাততান্ত্রিক জমি মালিকানা উদ্ভটভাবেই স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেয়, যেহেতু জমিদার যে রাজস্ব পেয়ে থাকে তার কোন সামাজিক উপকারিতা নেই বলে দেখাবার ভান করে। আবার কৃষকের জমি চাষ করার যে অধিকার একইভাবে তাও জঘণ্য প্রমাণ করা যায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ দক্ষিণ আফ্রিকার একজন কৃষক জমি চাষ করার সময় সোনা পেলে এত সম্পদ অর্জন করতে সমর্থ হবে যে তাকে কোনক্রমেই সামাজিক কোন কর্মের ফলশ্রুতি বলা যাবে না। কোন মানুষের একটি ক্ষেত যদি শহরের উপকণ্ঠে পড়ে যায় তার সম্বন্ধেও একই কথা প্রযোজ্য। শুধুমাত্র ব্যক্তি মালিকানা নয়, জাতীয় মালিকানার মধ্যেও একই রকমের বিপত্তি দেখা দিতে পারে। মিশর এবং পানামা প্রজাতন্ত্র তাদের অঞ্চলের খালপথ নিয়ন্ত্রণ করায় তা এখন হাস্যাস্পদ হয়ে দাঁড়াবে এবং একই ভাবে অনুন্নত দেশসমূহে তাদের দেশের মাটিতে প্রাপ্ত তৈল ইত্যাদির নিয়ন্ত্রণভার হাতে নিয়ে নিলে একই বিপদের উদ্ভব হতে পারে। আন্তর্জাতিকভাবে কাঁচামাল নিয়ন্ত্রণ করার যুক্তি থিয়োরিগতভাবে অপ্রতিরোধ্য এবং শুধুমাত্র কৃষি ঐতিহ্য আমাদেরকে এ সত্য স্বীকার করতে বাধ্য করায় যে ধনী প্রভাবশালী ব্যক্তিরা খনিজ দ্রব্য ব্যবহারের জন্য পৃথিবীতে ব্যাপকভাবে অত্যাচার করে থাকে।

কৃষিভিত্তিক সমাজের চাইতে শিল্পভিত্তিক সমাজ অধিকতর দঢ়ভাবে সংগ্রন্থিত। কৃষিভিত্তিক সমাজে আইনতঃ ব্যক্তিকে যে শক্তি কোন প্রকারের বিপদের আশঙ্কা না করে অর্জন করা যায়। শিল্পভিত্তিক সমাজে ব্যক্তির হাতে অতটুকু ক্ষমতা প্রদান করা হলে মারাত্মক বিপদের কারণ হয়ে ওঠে। অধিকন্তু তাতে হিংসা দ্বেষের অর্গল (অন্য অর্থে যাকে বিচারবোধ বলা যায়) খুলে যায়, যা সমাজতন্ত্রীদের অনুপ্রাণিত করে বিশেষভাবে। এসকল যুক্তি থাকা সত্ত্বেও আগামী শতাব্দীতে আমেরিকাতে যে সমাজতন্ত্র আসবে আমি তার কোন লক্ষণ দেখছি না। আবার আমেরিকা যদি মতামতের দিক দিয়ে সমাজতন্ত্রী না হয়, কোন জাতি তার অর্থনৈতিক পদ্ধতিতে সামান্য পরিমাণ সমাজতন্ত্রেরও প্রবর্তন করতে পারবে না। উদাহরণস্বরূপ জার্মানিতে ডাওয়েস পরিকল্পনা অনুসারে রেলওয়েকে রাষ্ট্রীয়করণের কথা বলা যেতে পারে।

আমার এ মনোভাব পোষণ করার পেছনে যুক্তি হলো, আমেরিকানরা বিশ্বাস করে তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি ম্লান হবেনা এবং সে কারণে আমেরিকাও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে না। যতদিন পর্যন্ত আমেরিকান শ্রমিকেরা সমাজতান্ত্রিক দেশের শ্রমিকদের থেকে ধনী থাকবে, ততদিন ধনতান্ত্রিক প্রচার অর্থনৈতিক ধ্বস ঠেকিয়ে রাখতে পারবে। এজন্য আমার পূর্বোক্ত বৃহৎ পণ্যোৎপাদনে অর্থনীতির প্রয়োজন সর্বাপেক্ষা অধিক। গোষ্ঠীর সংবাদপত্র, কোটিপতিদের দ্বারা পরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থা, গির্জাশাসিত প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা, সুসংগঠিত পুস্তকব্যবসা যাতে পুঁজিপতিদের থেকে দান দিয়ে সস্তায় উৎপন্ন করে সীমিত গণ্ডীর বাইরে সস্তায় লক্ষাধিক বিলি করা যায়, রেডিয়ো এবং সর্বোপরি ছায়াছবি অতিরিক্ত করে সর্বত্র পয়সা রোজগার করতে পারে এত নির্মাণ করে পশ্চিমা জগতের সর্বত্র প্রদর্শন করা হয়। দুর্ভাগ্যবশতঃ এর সবকিছুতে নিয়ন্ত্রিত সংবাদ প্রচার এবং শক্তির অধিকারীদের মনোনীত দর্শন এবং বিশ্বাসকেই ব্যক্ত করা হয়।

এ জাতীয় প্রচারপ্রোপাগান্ডা যে সম্পূর্ণভাবে অপ্রতিরোধ্য তা আমি মনে করি না। সাধারণ মানুষকে যতদিন সাফল্যের কথা শুনাতে পারবে ততদিনই তা টিকে থাকতে পারবে। যুদ্ধে পরাজয় হলো ব্যর্থতার নিদর্শন তা সকলেরই জানা কথা। তার ফলে যে কোন শাসনব্যবস্থা উল্টে যেতে পারে। তবে আমেরিকার যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার আশঙ্কা খুবই স্বল্প। সুতরাং উনবিংশ শতাব্দীর ইংল্যাণ্ডে পার্লামেন্টারি শাসনব্যবস্থায় সাফল্যজনক ছিল বলে জনগণ যে আগ্রহসহকারে পার্লামেন্টারি সরকারের দাবি করেছিল তেমনিভাবে আমেরিকার জন্য আমেরিকান পদ্ধতির প্রচার করতে পারে।

অবশ্য প্রাচী এবং প্রতীচ্যের অর্থনৈতিক নীতি ধর্মীয় কারণে বিভিন্নতার জন্যে প্রাচীন পদ্ধতিগত অর্থে জোরালোভাবে অবস্থান করবে। আমেরিকা খ্রিষ্টান এবং প্রাচ্যদেশ খ্রিষ্টানবিরোধী থাকবে তা সকলেই আশা করে। আরো আশা করতে পারে যে আমেরিকা খ্রিষ্টিয় নীতি অনুসারে বিয়ে এবং পরিবারের সপক্ষে শুধু মৌখিক সমর্থন দিতে থাকবে যখন প্রাচ্যের মানুষ সেগুলোকে বাসী কুসংস্কার মনে করবে। আশা করা যায় যে দু’পক্ষের মধ্যেই ব্যাপক নির্মমতা দেখা দেবে, এবং একের প্রোপাগাণ্ডা প্রচারের মধ্যে অন্যের নির্মমতা নির্দয়তাকে তুলে ধরা হবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ খুব কম সংখ্যক আমেরিকান সাক্কো এবং ভেনজেট্টির সত্য কাহিনীটি জানে। অন্য মানুষ স্বীকারোক্তি করেছে এমন একটি খুনের জন্যে একটি মানুষকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো। যে সংবাদের ওপর নির্ভর করে দণ্ড দেয়া হলো, কর্মরত পুলিশেরা ফ্রেমআপ যন্ত্রের সাহায্যে তা সংগ্রহ করেছিল। পরে যে লোকটি স্বীকার করেছিল যে সে খুন করেছে তার জন্য নতুন বিচারের ব্যবস্থা করতে অস্বীকার করা হলো, একারণে যে সে ছিল একজন বদ চরিত্রের লোক; সুতরাং এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে আমেরিকান বিচারকের মতামতে একমাত্র ভালো লোকরাই খুন করে। সাক্কো এবং ভেনজট্টির ওপর আসল অভিযোগ তারা ছিল নৈরাজ্যবাদী। ধনতান্ত্রিক বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে ঘৃণাবোধ জাগাবার জন্য সেসকল সংবাদ রাশিয়াতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। একইভাবে রাশিয়ান সমাজতান্ত্রিক কর্তৃক বিপ্লবী পিতৃতান্ত্রিকদের বিচারের কথা আমেরিকাতে জানা যায়। এভাবে অন্যকে জঘণ্যভাবে চিত্রিত করার জন্য প্রচুর প্রমাণের প্রয়োজন হয়ে পড়ে কিন্তু আপন আপন ত্রুটির প্রতি কোনোও ভ্রূক্ষেপ করে না।

সম্প্রতি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন অধ্যাপকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, তিনি মুনির নাম শোনেননি। মুনি ক্যালিফোর্নিয়া জেলে, নিজে করেননি এমন একটা খুনের অপরাধে অন্তরীণ ছিলেন। তা সত্ত্বেও রাশিয়ার কেরেনস্কির সময়ে প্রেসিডেন্ট উইলসন তদন্ত করবার জন্য একটা কমিটি নিয়োগ করলেন, তাদের মতে তাকে অপরাধী মনে করবার কোন সঙ্গত প্রমাণ নেই, কিন্তু সে একজন কমিউনিষ্ট।

মতামতের অত্যাচার সকল দেশেই এভাবে সহ্য করতে হয়। সুইজারল্যণ্ডে একজন কমিউনিষ্টকে হত্যা করা শুধু আইনসিদ্ধ নয়, যে লোক প্রথমে হত্যা করেছে, তাকে পরবর্তী হত্যার কাজে অভিজ্ঞ হত্যাকারী বলে নিয়োগ করা হয়। এ ব্যাপারে গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে জাপানের দৃষ্টান্ত সকলের উর্ধ্বে। একজন পুলিশ দু’জন নৈরাজ্যবাদী এবং তাদের ছোট ভাইপোকে পবিত্রজ্ঞানে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করেছিল একটি থানায়। বিচারে তাকে নিদিষ্ট সময়ের জন্য কারাদণ্ড দান করা হয়েছিল। তারপরেও সে একজন বীর বলে চিহ্নিত হলো রাতারাতি এবং স্কুলের ছাত্রদেরকে তার প্রশংসায় রচনা লিখতে আহবান করা হয়েছিল।

এ সকল কারণে যে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে প্রচলিত শাসনব্যবস্থা খুবই সাফল্যজনক বলে বিবেচিত হয় অথবা যে দেশে আমেরিকান অর্থনীতির প্রভাব সর্বাধিক, ভবিষ্যতের যে কোন সময়ে কমিউনিষ্ট নীতি গ্রহণ করতে পারে তা আমি মনে করি না। পক্ষান্তরে শাসক সম্প্রদায় পূর্বাবস্থা কায়েম রাখার জন্য বর্ধিত হারে গোড়া হয়ে যাবে এবং সমাজের গোঁড়ামি কুসংস্কারকেই সমর্থন করবে। অবশ্য তাদের মধ্যে ধর্ম হলো সবচেয়ে প্রবল! জার্মানির নির্বাচনে গির্জা নিসংশয়ে ঘোষণা করল যে রাজকীয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করলে অখ্রিষ্টানসুলভ কাজ করা হবে। এসকল মতামত পুরস্কৃত হওয়ার দাবি রাখে এবং নিঃসন্দেহে পুরস্কৃতও হয়।

সুসংগঠিত ধর্ম, বিশেষ করে ক্যাথলিক ধর্ম ধনতান্ত্রিক দেশে বর্ধিতহারে শক্তিশালী হয়ে উঠবে। ধনীর স্বার্থে শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করাই তার কারণ বলে আমি মনে করি : রাশিয়া এবং পাশ্চাত্যের মধ্যে যে বিভেদ, প্রধানতঃ অথনৈতিক পদ্ধতি সম্বন্ধীয় হলেও, বিশ্বাসের সকল স্তরে পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়বে এ আশঙ্কা করা যায়। বিশ্বাস বলতে আমি বস্তু সম্পর্কে সে সকল কুসংস্কারাচ্ছন্ন গোঁড়ামির কথাই বলছি, যার সাহায্যে সত্যকে জানা যায় না। বিজ্ঞানের প্রতি অনুসন্ধিৎসা বোধ জাগিয়ে দিতে পারলে সমস্ত বিপত্তিকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভবপর হয়ে উঠবে। বিশ্বাসের ওপর নয়, প্রমাণের ওপর নির্ভর করে স্বভাব গঠন করাকেই আমি বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা বলতে চাই। যদিও শিল্পের জন্য বৈজ্ঞানিক কলাকৌশলের প্রয়োজন, তবু বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা সত্যিকারভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং কোন শাসকের প্রভাবমুক্ত বলে অধিকতর বাণিজ্যভিত্তিক। সুতরাং আমাদেরকে তা হল্যাণ্ড, ডেনমার্ক স্ক্যাণ্ডিনেভিয়া ইত্যাদি যে সকল দেশ আধুনিক জীবনপ্রবাহের বাইরে রয়েছে তাদের কাছ থেকে শিক্ষা করতে হবে।

আবার এটাও অসম্ভাব্য নয় যে এক শতাব্দী সময় বা তারও বেশি কিছু কাল সংগ্রামের ফলে তিরিশ বর্ষব্যাপী যুদ্ধের পরে যেমনটি হয়েছিল, তেমনিভাবেই দু’পক্ষই ক্লান্ত হয়ে পড়বে। যখন সে সময় আসবে তখনই উদার মতাবলম্বীরা তাদের মতামত প্রচারের সুযোগ পাবে।

আসন্ন বিরোধ বিসংবাদে কোন পক্ষে মনের একাগ্র আকাঙ্খায় যোগ দিতে অক্ষম বিধায় ইরাসমাস যেমন করেছিলেন, আমিও ঠিক তেমনি করব! আমি আমেরিকান ক্রোড়পতিদের তুলনায় বলশেভিকদের সঙ্গে অধিকতর একমত হতে পারব সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। শুধু তাদের দর্শন সত্য অথবা সুখময় একটি পৃথিবীর সৃষ্টি করতে সক্ষম একথা আমি বিশ্বাস করতে পারি না। আমি স্বীকার করি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ রেনেসার সময়ে জন্ম লাভ করে ক্রমান্বয়ে বাড়তে বাড়তে ভয়ঙ্কর উ/রূপ পরিগ্রহ করেছে যদি শিল্পবাদী সমাজকে টিকে থাকতে হয় এবং যদি গড়পড়তা নরনারীর জীবনের সুখ-সন্তুষ্টি বিধান করতে হয় তাহলে অধিকতর সমবেত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। কিন্তু বলশেভিক মতবাদের প্রধান অসুবিধা হলো! সেখানে অমেরিকানদের মতো অর্থনীতি হলো সংস্থার চালিকা শক্তি। কিন্তু মানুষের প্রবৃত্তির পানে তাকিয়ে দল করা হলে তাতে সঙ্গতি আসে। পরিবার এবং রাষ্ট্রের সম্বন্ধ হলো জীববিজ্ঞানের আর ট্রাষ্ট এবং ট্রেড ইউনিয়নের সম্পর্ক হলো অর্থনীতির। জীববিজ্ঞানভিত্তিক দল গঠনের যে ক্ষতি, তা আজ আর কেউ অস্বীকার করেনা, কিন্তু যে প্রবৃত্তির ফলে এ দলগঠন হয় তা বিবেচনা না করে সমস্যার সমাধান করা যাবে বলে আমি মনে করি না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, আমি তখন এই মেনে নেবো যখন সমস্ত শিশু পিতামতার হস্তক্ষেপ ছাড়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে শিক্ষিত হবে, অধিকাংশ মানুষ শ্রমসাধ্য কাজ করার উন্মাদনা হারিয়ে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে পড়লে বোধ হয়, জাতীয়তাবাদেরও নিজস্ স্থান রয়েছে, যদিও সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনী স্পষ্টত তার প্রকাশ, কিন্তু তার উপযুক্ত ভূমিকা রাজনৈতিক যতটুকু নয়, তার চেয়ে সাংস্কৃতিক মানবশিশুকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এবং শিক্ষাপদ্ধতির মাধ্যমে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করা যায়, যদি পরিবর্তনগুলো মৌলিক প্রবৃত্তিকে ধ্বংস করে ফেলে, তাহলে ফল দাঁড়াবে, মানুষ উদ্যম হারিয়ে ফেলবে। বলশেভিকরা অর্থনৈতিক পদ্ধতিকে একমাত্র মনস্তাত্ত্বিক গুরুত্বসম্পন্ন আখ্যা দিয়ে বিরাট ভুল করেছে। পাশ্চাত্যের প্রতিযোগী সমাজব্যবস্থার সঙ্গে অংশ গ্রহণ করে তারাও ভুল করছে, যদিও পাশ্চাত্যে এ ব্যাপারে কম সোচ্চার।

জীবনের অর্থনৈতিক দিকটির ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করাই হচ্ছে আমার মতে এ যুগের আসল ভ্রান্তি। শারীরিক প্রয়োজন তার জন্য প্রাচীন উদারনৈতিকদের সঙ্কেতবাক্য ছাড়া আর কিছু আমার জানা নেই, এবং আমি অনুভব করি যে তাও খুব বেশি কাজে আসবে না। মতামতের স্বাধীনতা এবং তার প্রসারই হলো এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়। কিন্তু মতামতের প্রসার করাটা ভয়ঙ্কর প্রতিবন্ধকতা পরিপূর্ণ। কোন মতামতকে ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হলে যে বিরাট প্রচারযন্ত্রের প্রয়োজন তার নিশ্চিতভাবে রাষ্ট্র অথবা বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন। গণতন্ত্রের এবং শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তনের পূর্বে মতামতের ছিল সত্যনিষ্ঠা, সক্রিয় মতামত শুধুমাত্র স্বল্প সংখ্যক মানুষের জন্য সীমিত ছিল। আধুনিক ব্যয়বহুল প্রচার প্রোপাগাণ্ডা ছাড়া তাদের কাছে মতামত পৌঁছে দেয়া যেত। রাষ্ট্র এবং ধনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ যে সকল বিষয় ক্ষতিকর এবং নৈতিকতার শত্রু মনে করে সে সকল বিষয়ের ব্যাপারে উদ্যম গ্রহণ করবে এবং টাকা খরচ করবে তা আশা করা যায় না কোন মতে। ধনতান্ত্রিক সংগঠনের মতো রাষ্ট্রও বাস্তবে হতাশা আমুদে বোকা বুড়ো মানুষের মত: কুসংস্কারের মধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, যুগের যা ভালো তার কিছু গ্রহণ করতে পারে না; কতকগুলো অক্ষম অকর্মণ্য ব্যক্তির অনুসন্ধান ব্যতিরেকে সক্রিয়ভাবে কোন মহত্বকে তুলে ধরা যায় না, যা অলিতে-গলিতে প্রচার করা যায় কিন্তু তার পাঠকও অলি-গলির মানুষ।

আধুনিক বাণিজ্যপদ্ধতি যতই ব্যাপক এবং কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে বিপদও ততই বাড়ছে। জনপ্রিয় নয় এমন একটি মতামতকে যদি ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হয় তাহলে মহিলা ভোটাধিকার আন্দোলনকারীদের পন্থাই হবে একমাত্র পন্থা এবং তাতে যেখানে সরল আবেগবহুল সে অংশ প্রয়োগ করা উপযোগী জটিল এবং যুক্তিবহুল অংশ নয় সরকারি এবং বেসরকারি তদন্তের একমাত্র প্রতিক্রিয়া হলো যুক্তিযুক্ত কিছুর চাইতে আবেগবহুল কিছুর বিরোধিতা করা এবং শান্ত মস্তিষ্কে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এর সপক্ষে বিপক্ষের বিচার করে জনসাধারণের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া করবে স্পষ্টভাবে তা নির্ধারণ করা।

দৃষ্টান্তস্বরূপ একটি সরকারি ডাক্তারি প্রকাশনার কথা ধরা যাক, যার কাজ হচ্ছে খারাপ প্যাটেন্ট ঔষুধের দোষগুণ তুলে ধরা, কিন্তু তা সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রচারিত হবে না বলে কেউ জানবে না। অন্যদিকে খ্রিষ্টান বিজ্ঞানীরা মনে করে যে সব ঔষধই সমানভাবে বাজে এবং সে মত প্রচার করার ক্ষমতা তাদের আছে। একই ব্যাপার রাজনীতির ক্ষেত্রে সমানভাবে ঘটছে উভয়পক্ষই চূড়ান্ত মতামত প্রচার করতে পারে। অন্যদিকে সহনশীল এবং যুক্তিনিষ্ট মতামতসমূহ যেগুলো কর্তাব্যক্তিদের বিরোধিতা করে তাকে সেগুলো শোনার অনুপযুক্ত নীরস কচকচি বলে ধরে নেয়া হয়। অন্যান্য দেশের তুলনায় ইংল্যাণ্ডে যে বিপদ কম। কেননা ইংল্যাণ্ড প্রধানত বাণিজ্যভিত্তিক দেশ এবং বাণিজ্যের সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতাপ্রীতিকেও রক্ষা করেছে।

অবশ্য, কেউ যদি মনে করে যে যাদের হাতে ক্ষমতা আছে তারা এর প্রয়োজনীয়তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারলে এর প্রতিবিধান উদ্ভাবন করা যায়। প্রমাণের গুরুত্ব যাচাই করে দেশপ্রেম এবং দেশপ্রেমের প্রতি পক্ষপাত শূন্য যুক্তি প্রয়োগ করতে পারে এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করা হলে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে তা রোধ করা যাবে। সম্ভবতঃ এমন সময়ও আসতে পারে, যখন মানুষ বৃদ্ধিবৃত্তিকে মানবসমাজের উজ্জ্বল রত্ন বলে অনুভব করবে, কিন্তু আমি কোন আন্দোলনের মধ্যে সে অভিমুখে তেমন কোন লক্ষণ দেখছি এমন কথা বলতে পারবো না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *