১৫. মনোবিজ্ঞান এবং রাজনীতি

মনোবিজ্ঞান এবং রাজনীতি

রাজনীতিতে মনোবিজ্ঞান অনতিবিলম্বে যে সকল প্রতিক্রিয়ার কারণ হতে পারে, অথবা কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তাই আলোচনা করব। সম্ভাব্য ভালো এবং খারাপ দু’রকমের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আমি আলোচনা করতে চাই।

রাজনৈতিক মতবাদ যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। সোনার মান প্রত্যাহার করার মতো। যান্ত্রিক একটি বিষয়ও প্রধানতঃ ভাবাবেগ দ্বারা নির্ধারিত হয়েছিল। মনোঃসমীক্ষকদের মতে ভাবাবেগ হলো তেমন চিজ, যা সভ্যসমাজে কোন পাত্তা পায় না। এখন একজন যুবকের ভাবাবেগ বলতে শিক্ষার প্রতিভাসে সংমিশ্রিত প্রবৃত্তির সারাংশের . সুবৃহৎ পরিধিকেই বোঝায়। ভাবাবেগের এক অংশে শিক্ষাকল্পনার ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। প্রত্যেকে নিজেকে একজন সুন্দর মানুষ হিসেবে দেখতে চায় এবং যেটা তার কীর্তিস্থাপনের সম্ভাব্য সহজ পথ বলে মনে করে, সে পথেই তার কল্পনা এবং ধাবিত হয়। আমার মনে হয়, যদি কেউ যৌবনে মনোবিজ্ঞান পড়ে থাকে, তাহলে তিনি পরলোকগত লর্ড কার্জন অথবা লণ্ডনের প্রধান ধর্মাধ্যক্ষের মতো হতে পারবেন।

যে কোন বিজ্ঞানের দু’রকমের প্রতিক্রিয়া আছে। একদিকে বিশেষজ্ঞরা যা তৈরি এবং আবিষ্কার করেন যা শক্তির অধিকারী তারা তা ব্যবহার করেন। অন্যদিকে বিজ্ঞান আমাদের কল্পনায় প্রভাব বিস্তার করে আমাদের বোধবুদ্ধি এবং প্রত্যাশার পরিবর্তন সাধন করতে পারে। খুব কড়াকড়িভাবে বলতে গেলে তৃতীয় রকমের আরেকটি প্রতিক্রিয়া রয়েছে তা হলো যাবতীয় ফলাফলসমূহ জীবনের পদ্ধতিতে একটা বিরাট পরিবর্তন। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই তিন রকমের প্রতিক্রিয়াই এখন সুবিকশিত হয়ে ওঠেছে। প্রথম প্রতিক্রিয়াকে উড়োজাহাজের সাহায্যে দ্বিতীয়টাকে জীবনের প্রতি যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ এবং তৃতীয়টা হলো অধিকাংশ মানুষ শিল্প এবং শহরতলী অথবা গ্রামের মধ্যে পরবর্তী পছন্দের ওপর নির্ভর করে। মনোবিজ্ঞানে আমাদেরকে এখনো বিভিন্ন প্রকারের প্রতিক্রিয়ার প্রকৃতি বুঝতে হলে ভবিষ্যৎবাণীর ওপর নির্ভর করতে হয়। ভবিষ্যৎবাণী সকল সময়ে ভীড় করে থাকে। প্রথম ধরনের প্রতিক্রিয়া তৃতীয় ধরনের প্রতিক্রিয়া যা আমাদের কল্পনার দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভরশীল তার চেয়ে ভবিষ্যত্বাণীর ওপর অধিকতর নির্ভরশীল। সুতরাং আমি প্রথমে প্রথম কারণের প্রধান প্রতিক্রিয়াগুলোর ওপর আলোচনা করব।

ইতিহাসের অন্যান্য সময়ের সম্বন্ধে কিছু বললে আবহাওয়াটা বুঝবার পক্ষে কিছু সাহায্য হতে পারে। মধ্যযুগে প্রত্যেকটা রাজনৈতিক প্রশ্নকে ধর্মতাত্ত্বিক যুক্তির আলোকে বিচার করা হতো, যা সামঞ্জস্য বিধানের রূপ পরিগ্রহ করত। পোপ এবং সম্রাটের মধ্যে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। পোপ সূর্য এবং সম্রাট চন্দ্র বলে স্বীকৃত হলেন। শেষপর্যন্ত জয় হলো পোপের। পোপের সুশিক্ষিত সৈন্য ছিল বলে জয়লাভ করেছেন, একথা বললে ভুল করা হবে। তিনি তার সৈন্যদেরকে আকর্ষণীয় শক্তি সূর্য চন্দ্রের সামঞ্জস্যের তাৎপর্য বুঝিয়ে দিলেন। ফ্রান্সিসের মতাবলম্বীদেরকে তিনি সৈন্য হিসেবে সংগ্রহ করে মোতায়েন করলেন। এভাবেই জনতাকে মুগ্ধ করে সত্যিকারভাবে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করা হলো। আজকের যুগে কেউ কেউ সমাজকে যন্ত্র এবং কেউ কেউ গাছ বলে মনে করে। প্রথম দলের মধ্যে আছে ফ্যাসিবাদী সাম্রাজ্যবাদী, শিল্পবাদী এবং বলশেভিক মতানুসারীরা এবং শান্তিবাদী, নিয়মতান্ত্রিকতাবাদী আর কৃষিভিত্তিক সমাজবাদীরা হলেন পরবর্তী দলের অন্তর্ভুক্ত। আদতে সমাজ যন্ত্র কিংবা গাছ দু’টোর কোনটা নয় বলে এ যুক্তিকে উদ্ভট মনে হয়।

রেনেসাঁর সঙ্গে আমরা নতুন প্রভাবের সংস্পর্শে আসি, সে-হলো বিশেষভাবে সাহিত্যের প্রভাব। আমাদের যুগে পর্যন্ত সে প্রভাব ক্রিয়াশীল রয়েছে, বিশেষ করে যারা পাবলিক স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাভ্যাস করেন তাদের মধ্যে বেশি। অধ্যাপক গিলবার্ট মারেকে যখন কোন রাজনৈতিক বিষয়ে মনস্থির করতে হয়, লোকে বলে তিনি নিজেকেই প্রশ্ন করেন, প্রথমে এ সম্পর্কে ইউরিপিডস কী বলে গেছেন? কিন্তু এ দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমানে আর প্রভাবশীল নয়। রেনেসাঁর সময়ে অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে শুরু করে ফরাসি বিপ্লব পর্যন্ত সে ভাবাদর্শের জোড়ালো প্রভাব ছিল। বিপ্লবী বক্তারা সবসময়ে রোমান গুণাবলীর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তুলে ধরতেন। মন্তেস্কু এবং রুশোর মত লেখকদের এমন যুগান্তকারী প্রভাব রয়েছে কোনো সাম্প্রতিক লেখকের মধ্যে পাওয়া যায় না। যা হওয়া উচিত বলে মনে করেছেন তা আমেরিকান সংবিধানে বাস্তবায়িত হয়েছে, একথা যে কেউ বলতে পারে। রোমের শাসনব্যবস্থার কোন দিকটির প্রশংসা নেপোলিয়নের জীবনে ক্রিয়াশীল ছিল তার প্রভাব বিচার করার মতো সক্ষম বিচারক নই।

শিল্পবিপ্লরের সঙ্গে সঙ্গে আমরা একটি নবযুগে পদার্পন করি; তাহলো পদার্থবিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞানীরা বিশেষ করে গ্যালিলিও এবং নিউটন এ যুগের পথ প্রশস্ত করেছেন, কিন্তু সে যুগের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক পদ্ধতির প্রতীক হিসেবে রূপ পরিগ্রহ করল! যন্ত্র একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যবিশেষ এবং তা বৈজ্ঞানিক নিয়ম-কানুন মেনে চলে, (তা না হলে যন্ত্রের সৃষ্টি করা যেতনা) সে বিশেষ উদ্দেশ্যটি সবসময় বাইরের স্থাপিত মানুষের সঙ্গে, বিশেষ করে মানুষের জাগতিক জীবনের সঙ্গে সম্পর্কশীল। কেলভিনিয় ধর্মতত্ত্বে ভগবানের সঙ্গে পৃথিবীর যে সম্পর্ক বর্ণিত হয়েছে মানুষের সঙ্গে যন্ত্রের সম্পর্ক অবিকল তাই। সম্ভবতঃ সে জন্যই বোধ হয় প্রোটেষ্টান্টদের দ্বারা শিল্পের আবিষ্কার হয়েছিল এবং তাতে এ্যাঙ্গলিকান গির্জার অনুসারীদের তুলনায় ননকনফরমিষ্টরা অধিকতর উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় অংশগ্রহণ করেছিল। যান্ত্রিক সামঞ্জস্যবিধান চিন্তাধারার ওপর প্রগাঢ় প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং এখনো করছে। আমরা পৃথিবী সম্পর্কে যান্ত্রিক মতামত, যান্ত্রিক ব্যাখ্যা, যান্ত্রিক অর্থ সাধারণতঃ প্রাকৃতিক নিয়মকে যান্ত্রিকভাবে ব্যাখ্যা করে থাকি। সম্ভবতঃ অচেতনভাবে যন্ত্রের বাইরের একটি উদ্দেশ্য এবং পরিণতি যন্ত্রের মধ্যে প্রবর্তন করে থাকি। সুতরাং সমাজকে যদি যন্ত্র বলে ধরা হয়, তাহলে ধরে নিতে হয় সমাজবহির্ভূত একটি উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য সমাজের রয়েছে। ভগবানের গৌরবের জন্য যন্ত্রের প্রচলন হয়েছে একথা বলে আমরা আর সন্তুষ্ট হতে পারিনা, কিন্তু ভগবানের সমার্থক যেমন ব্যাঙ্ক অব ইংল্যাণ্ড বৃটিশ সাম্রাজ্য এবং কমিউনিস্ট পার্টি ইত্যাদি খুঁজে নিতে আমাদের কষ্ট হয়না। এই বিভিন্ন ধরনের সমার্থক লক্ষ্যের সংঘাতেই আমাদের মধ্যে যুদ্ধ লাগে। এটা মধ্যযুগীয় চন্দ্র সূর্যের ধারণার পূনরাবৃত্তি ছাড়া আর কিছু নয়।

পদার্থবিজ্ঞান সুনির্দিষ্ট বিজ্ঞান বলেই অধিকারী এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এই পরিবর্তন পরিবেশকেই পরিবর্ধিত করে চলেছে, মানুষকে নয়। পদার্থবিজ্ঞানের মতো সমান সুনির্দিষ্ট এবং মানবজীবনে প্রত্যক্ষ পরিবর্তন আনতে সক্ষম আরেকটি বিজ্ঞানের আবির্ভাব হলে পদার্থবিজ্ঞান অপ্রধান হয়ে পড়বে: মনোবিজ্ঞান সে স্থান দখল করতে পারে। সাম্প্রতিককালে ছাড়া অন্যসময়ে গুরুত্বহীন দার্শনিক বাগাড়ম্বর বলে মনে করা হতো। আমি যৌবনে যে মনোবিজ্ঞান পড়েছি সেগুলো আদৌ পাঠ করার উপযুক্ত নয়। কিন্তু বর্তমানে মনোবিজ্ঞানের দু’রকম আবেদন বা পদ্ধতি স্পষ্টতঃই গুরুত্বসম্পন্ন হয়ে উঠেছে। তাহলো মনোবিজ্ঞানী এবং মনঃসমীক্ষকদের পদ্ধতি। ফলাফলের দিক দিয়ে এ দু’পদ্ধতি অধিকতর নিশ্চিত এবং নির্দিষ্ট হয়ে উঠেছে যখন স্পষ্টতঃই মনোবিজ্ঞান বর্ধিতহারে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে নিয়ন্ত্রণ করে।

শিক্ষাকে আমরা আলোচ্য বিষয় হিসেবে নিতে পারি। প্রাচীনকালের প্রচলিত মতানুসারে আট বছর বয়স থেকে শিশুদের পড়তে দেয়া উচিত। কিন্তু ল্যাটিন শিক্ষার আগ্রহ হাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগের প্রয়োজনীয় মতবাদ গুরুত্বহীন হয়ে পড়ল! তাৎপর্যগত অর্থে এই মতবাদ এখনো শ্রমিকদের মধ্যে প্রবল : ক্ষমতায় থাকার সময়ে তারা নার্সারি স্কুলে শিশুশিক্ষা দেয়ার চেয়ে চৌদ্দ বছরের পরে শিক্ষা দেওয়ার জন্য অধিকতর যত্নবান হয়ে থাকেন। প্রাচীন ব্যবস্তার প্রতি মানুষের দৃষ্টি এখনো কেন্দ্রীভূত বলেই অনেকে শিক্ষা সম্বন্ধে হতাশা পোষণ করে। তারা মনে করে যে, শিক্ষা একজন মানুষকে ভরণপোষনের উপযোগী ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনা! কিন্তু দেখা যাবে যে শিক্ষার বৈজ্ঞানিক মনোভঙ্গী আগেকার তুলনায় অনেক বেশি শক্তি দিয়ে থাকে, অবশ্য শিক্ষা খুবই ছোটকাল থেকে শুরু করতে হবে। মনঃসমীক্ষকেরা জন্মের সঙ্গে সঙ্গে আর জীব বিজ্ঞানীরা তারও আগে থেকে শিক্ষা শুরু করতে চান। আপনি একটি মাছকে দু’দিকে চোখ থাকার বদলে মাঝখানে একটি চোখ বিশিষ্ট করে শিক্ষিত করে তুলতে পারেন (Jennius.Promethus. P 60) কিন্তু তা করতে হলে আপনাকে মাছ জন্মাবার আগে থেকে শিক্ষিত করে তোলার কাজ শুরু করতে হবে। কিন্তু এ পর্যন্ত দেখা গেছে যে স্তন্যপায়ী প্রাণীদেরকে জন্মের পূর্বে শিক্ষা দেওয়ার মধ্যে বিস্তর অসুবিধা আছে, কিন্তু সেগুলো কাটিয়ে ওঠা যায়।

তবে আপনারা বলবেন, আপনি শিক্ষাকে বেশ মজার অর্থেই ব্যবহার করছেন। একটা মাছকে বিকৃত করা একটা ছেলেকে ল্যাটিন ব্যাকরণ শেখানো এ দু’য়ের মধ্যে প্রভেদ কিসের? আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি আমার কাছে দু’টাই একরকম। উভয়টিই ছাত্রের আনন্দের পক্ষে ক্ষতিকারক। সে যাহোক, একে শিক্ষার সংজ্ঞা বলে মেনে নেয়া যায় না। শিক্ষার আসল অর্থ হলো, পরিচালকের নির্দেশক্রমে সংশোধিত একপ্রকারের (মৃত্যু ছাড়া) ইন্দ্রিয়বৃত্তিক পরিবর্তন। অবশ্য পরিচালক বলে থাকেন যে শিক্ষার্থীর মঙ্গলই হচ্ছে তার আকাঙ্খা। নিরপেক্ষভাবে যাচাই করে দেখলে তার মন্তব্যের যে কোন সত্যতা আছে তা ধরা পড়েনা।

এখন ইন্দ্রিয়বৃত্তিক পরিবর্তন করার জন্য অনেকগুলো পদ্ধতি আবিস্কৃত হয়েছে। আপনি ইচ্ছা করলে মাছের অস্তিত্বে পরিবর্তন করতে পারেন, যাতে করে একটা চোখ হারিয়েও বেঁচে থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ একজন মানুষের শরীরের অভ্যন্তরে ঔষধ প্রয়োগ করে রাসায়নিক উপাদানের পরিবর্তন সাধন করতে পারেন। মামুলি পদ্ধতি শেষ ধরনের পরিবর্তনের বিশেষ দিক। বর্তমানে শিক্ষার সবকিছু উপদেশ বা অনুজ্ঞা ব্যতিরেকে যন্ত্রটি যখন খুবই তরুন তখনই ছাপ ফেলতে সক্ষম বলে প্রমান করা হয়। এ-ধারনা অনুসারে মানুষের শিক্ষা শুরু হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো চার বছরের পর। কিন্তু আমি যেমন আগে বলেছি এখনো বলছি জন্মের পূর্বে শিক্ষা এখনো সম্ভব হয়নি,যদিও তা এশতাব্দীর শেষদিকে সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।

বাল্যকালে শিক্ষা দেবার দুটো পদ্ধতি রয়েছে। একটা রাসায়নিক এবং অন্যটা সাঙ্কেতিক পদ্ধতি। যখন আমি রাসায়নিক কথাটা বলি তখন সম্ভবতঃ আমাকে জবরদস্ত বস্তুবাদী বলে ভাবা হবে। যদি আমি বলতাম প্রত্যেক সতর্ক মা শিশুকে যে সকল স্বাস্থ্যকর পথ্য পাওয়া যায় তাই খেতে দেবে, তাহলে আমাকে বস্তুবাদী ভাবা হতো না। রাসায়নিক কথাটাকে ঘুরিয়ে বললে তাই দাঁড়ায় বৈকি, যে সকল সম্ভাবনা কম বেশি ইন্দ্রিয়বোধ সম্বন্ধীয় সেগুলোর সঙ্গে আমার কারবার। পথ্যের সঙ্গে উপযুক্ত ঔষধ অথবা ইনজেকশনের সাহায্যে রক্তের মধ্যে সারবান উপাদান প্রবিষ্ট করিয়ে দিলে বুদ্ধিবৃত্তির বৃদ্ধি অথবা আবেগের প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটানো যায়। সকলেই জানে যে মুখতার সঙ্গে আয়োডিনের অভাবের সম্পর্ক রয়েছে। সম্ভবতঃ আমরা দেখতে পাবো যে তারাই হচ্ছে বুদ্ধিমান মানুষ যারা বাল্যকালে পথ্যের সঙ্গে অল্প পরিমাণে দুপ্রাপ্য উপাদান কড়াই, বাসন অপরিষ্কার থাকার ফলে খেতে পেয়েছে। অথবা গর্ভাবস্থায় মায়ের পথ্যের থেকে সে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের সঞ্চার হয়েছে, এ বিষয়ে আমার পরিপূর্ণ জ্ঞান নেই, শুধু আমি লক্ষ্য করেছি যে মানুষকে শিক্ষা দেওয়ার চাইতে সরীসৃপকে শিক্ষা দেওয়া অনেক বেশি সহজ। তার প্রধান কারণ সরীসৃপের আত্না আছে তা আমরা কল্পনা করিনে!

বাল্যকালে শিক্ষার মনস্তাত্ত্বিক শিক্ষা জন্মের আগে কখনো শুরু হতে পারে না। কারণ, শিক্ষার প্রধান কাজ হলো স্বভাব গঠন। জন্মের আগে আয়ত্ব করা স্বভাবের কোন প্রভাব বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জন্মের পরে থাকতে পারে না। কিন্তু শৈশবের চরিত্র সংগঠনের বেলায় তার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে, সে সম্বন্ধে আমার সন্দেহ নেই। যারা দেহের ক্রিয়া-প্রক্রিয়া দিয়ে মনকে বিচার করে এবং যারা মনকে প্রত্যক্ষভাবে দেখে তাদের মধ্যে যে বিরোধ আছে, আমার মনে হয় তার কোন প্রয়োজন নেই। প্রাচীনপন্থী ডাক্তার খ্রিষ্টান হলেও আমাদের শারীরিক অবস্থাই দায়ী এবং সে অবস্থাকে দূরীভূত করলে রোগী আরোগ্য হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে মনঃসমীক্ষকেরা সবসময় মনস্তাত্ত্বিক কারণই অনুসন্ধান করেন এবং সেগুলোকে বিন্যস্ত করতে চেষ্টা করেন। এ সমস্ত বিষয়টা মন এবং বস্তুর দ্বৈত-সত্তার মধ্যে দোলায়মান, আমার মতে তা ভ্রান্তি ছাড়া আর কিছু নয়। কোন কোন সময়ে সেগুলোকে মানসিক কারণ বলে থাকি তা উদ্ভাবন করা সহজসাধ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু আমাদের মনে করা উচিত যে দু’ধরণের প্রতিক্রিয়াই সবসময়ে বর্তমান। কোন বিশেষ ক্ষেত্রে যখন কোন লক্ষণ আবিষ্কার হয় তার সাহায্যে অনুসন্ধান করাটাই যুক্তিসঙ্গত বলে আমার ধারণা। এ ক্ষেত্রে আয়োডিনের সাহায্যে মুগ্ধতা নিরসন এবং অন্যক্ষেত্রে ফোবিয়ার রোগীকে আরোগ্য করা মধ্যে কোন অসঙ্গতি নেই।

যখন আমরা রাজনীতি সম্বন্ধে একটা মনস্তাত্ত্বিক ধারণা নিতে চাই তখন সাধারণ মানুষের মৌলিক আবেগ প্রবৃত্তি এবং পরিবেশের সাহায্যে কি করে সেগুলোর উৎকর্ষ বিধান করা যায় তা দিয়ে শুরু করাই স্বাভাবিক বলে মনে করি। একশ বছর আগে গোঁড়া অর্থনীতিবিদদের ধারণা ছিল ক্ষমতাপ্রীতিই রাজনৈতিক ব্যক্তিদের একমাত্র উদ্দেশ্য। কার্ল মার্কসও এই মতামতকে গ্রহণ করেছেন এবং তার ওপর ভিত্তি করে ইতিহাসের অর্থনৈতিক ভাষ্য রচনা করেছেন। পদার্থবিজ্ঞান এবং শিল্পবাদের থেকে স্বাভাবিকভাবেই এ মতবাদের উদ্ভব হয়েছে। আমাদের যুগে পদার্থবিজ্ঞানকে কাল্পনিক প্রাধান্য দান করার ফলে কমিউনিস্ট এবং সকল শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিবৃন্দ এ মতামতের দ্বারা আচ্ছন্ন! তরুণী রমণীরা জন সাহায্যে প্রতিপালিত মানুষকে বিয়ে করার জন্য আয়ের মায়া ত্যাগ করাতে, বিচারক এবং টাইম পত্রিকা যেমন তাদের আশ্চর্য হওয়ার কথা প্রকাশ করেছিলেন, এ-ও অনেকটা সে রকম। সুখের সম্বন্ধে প্রচলিত মতবাদ, সুখ হলো আয়ের অনুপাতের উপর নির্ভরশীল। তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে একজন ধনী অবিবাহিতা বৃদ্ধা একজন বিবাহিতা রমণীর চেয়ে সুখী-এ কথা বলতে হবে। আমাদের প্রথম বক্তব্যকে সত্য প্রতিপন্ন করার জন্য আমরা সাধ্যমত পরবর্তী মহিলার ওপর বেদনা এবং যাতনা আরোপ করি।

গোঁড়া এবং মার্কসবাদীদের বিরুদ্ধে মনঃসমীক্ষকেরা বলে যে যৌনবোধ হচ্ছে মানুষের একটি মৌলিক প্রবৃত্তি। তারা আরো বলে যে ক্ষমতাপ্রীতি হলো পীড়িত যৌন-কামনাবোধের এক ধরনের বিকৃত বিকাশ! যে মানুষ এতে বিশ্বাস করে সে লোক অর্থনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী যে মানুষ, তার চাইতে আলাদা কাজ যে করবে একথা তো দিবালোকের এত স্পষ্ট। বিশেষ বিশেষ রোগে আক্রান্ত হলে, প্রত্যেকেই জীবনে সুখী হতে চায়। কিন্তু অধিকাংশ সুখ কিসের মধ্যে তার কতকগুলি প্রচলিত থিয়োরিকে সারসত্য বলে গ্রহণ করে থাকে। যদি মানুষ চিন্তা করে সম্পদের মধ্যে সুখ রয়েছে, তারা যখন যৌনক্রিয়াকে অপরিহার্য মনে করবে সে অনুসারে কাজ করবেনা। উভয় মতামতের কোনটাকেই আমি সত্য বলে মনে করিনা, কিন্তু নিশ্চিতভাবে মনে করি যে পরবর্তী মতামত অধিকতর কম ক্ষতিকর, কি করলে সুখ পাওয়া যায় তার প্রকৃত থিয়োরির কিসের প্রয়োজন। কোন মানুষ যদি তার জীবনের বৃত্তিকে নির্বাচন করার জন্য তা ব্যবহার করে তাহরে বলতে হবে তিনি থিয়োরি দ্বারা অধিকতর প্রভাবিত হয়েছেন। যদি কোনো ভুল থিয়োরি বর্তমান থাকে, তাহলে সার্থক মানুষেরা অসুখী হবেন; তা তারা নিজেরাও জানবেননা। যে সকল মানুষকে তারা অবচেতনে হিংসা করে তাদেরকে হত্যা করার ইচ্ছায় তাদের হৃদয় ক্রোধে আন্দোলিত হয়ে ওঠে। অত্যাধুনিক রাজনীতি, সাধারণতঃ অর্থনীতির ওপর যা নির্ভরশীল, প্রবৃত্তির সন্তুষ্টির অভাব জনপ্রিয় মনস্তত্ত্বের প্রমাদের কারণেই হয়ে থাকে।

যৌন-প্রবৃত্তি যে সবকিছু তা আমি মনে করতে পারিনা। রাজনীতিতে যৌনপ্রবৃত্তিকে যখন থেতলিয়ে দেয়া হয় তখনই বিশেষভাবে প্রয়োজন হয়ে পড়ে। যুদ্ধে অবিবাহিত বয়স্কদের মধ্যে একধরণের হিংস্রতা এসে থাকে এবং তা অংশতঃ একারণে যে যুবকেরা তাদেরকে অবজ্ঞা করে, তারা অস্বাভাবিকভাবে ঝগড়াটে হয়ে থাকে। আমার মনে পড়ে আর্মিষ্টিসের পরে ট্রেনে সালটাশ সেতু অতিক্রম করার সময় নিচে আমি অনেকগুলো নোঙ্গর করা যুদ্ধজাহাজ দেখেছিলাম। দু’জন অবিবাহিতা বয়স্থা কুমারি পরস্পরকে বলতে শুনেছিলাম, তাদের সকলকে অলসভাবে শুয়ে থাকতে দেখলে দুঃখ হয়না, যৌনপ্রবৃত্তি পরিতৃপ্তি হলে রাজনীতিতে বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। আমার বলা উচিত যে রাজনীতিতে ক্ষুধা তৃষ্ণাকে সর্বাগ্রে স্থান দেয়া হয়। পিতৃত্বের প্রয়োজন অপরিসীম, কেননা পরিবারের প্রয়োজন রয়েছে। এমনকি রিভার্স বলেছেন যে পরিবারই ব্যক্তিগত সম্পত্তির উৎস। কিন্তু পিতৃত্বকে অবশ্যই কোনমতে যৌনকামনার সঙ্গে এক করে মিলিয়ে ফেলা যাবেনা।

প্রবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে জীবনের সংরক্ষণ ও প্রসারের জন্য অনেক কিছু থাকতে পারে, যেগুলো আমরা গৌরব বলে আখ্যায়িত করতে পারি। সেগুলো হলো ক্ষমতাপ্রীতি, গরিমা, প্রতিদ্বন্দিতা ইত্যাদি। স্পষ্টতঃ রাজনীতি সহনশীল জীবনযাপনের অবস্থা সৃষ্টি করতে চায়; তাহলে এ গৌরবের প্রবৃত্তি সমূহকে পোষ মানিয়ে রাখা একান্তই প্রয়োজন এবং এমন শিক্ষিত করে নেয়া উচিত যাতে করে নির্দিষ্ট গণ্ডীর বাইরে আসতে না পারে।

আমাদের মৌলিক প্রবৃত্তিসমূহ ভালো অথবা মন্দ দু’টার কোনটাই নয়, সেগুলো নীতিগতভাবেই নিরপেক্ষ। শিক্ষার এমন লক্ষ্য হওয়া উচিত, যাতে সেগুলো ভালো দিকে মোড় নেয়। খ্রিষ্টানেরা এখনো পুরনো পদ্ধতি, এগুলোকে ধ্বংস করে ফেলা হয় তাতে বিশ্বাস করে। নতুন প্রক্রিয়ানুসারে সেগুলোকে শিক্ষিত করে তোলা হয়। ক্ষমতাপ্রীতির কথা ধরা যাক, সেখানে খ্রিষ্টানদের অবদমিত নীতির কথা প্রচার করে লাভ নেই। তাতে প্রবৃত্তিসমূহ স্পষ্ট রূপ ধারণ করবে। যা আপনি করবেন সে উদ্দেশ্যে সুবিধাজনক একটি রাস্তা আপনাকে করতেই হবে। প্রকৃত অন্তর্নিহিত প্রবৃত্তির হাজারোভাবে যথা নির্যাতন, ব্যবসা, রাজনীতি, বিজ্ঞান, শিল্পচর্চা ইত্যাদি যখন সাফল্যজনকভাবে করা হয়, তাহলে অতি সুচারু পরিতৃপ্তি বিধান করা যায়। একজন মানুষ যার ক্ষমতাপ্রীতি রয়েছে তার বাস্তব রূপ দেবার জন্যে যৌবনে যে সকল বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেছে তার মধ্যে একটি পছন্দ করে সে পেশা হিসেবে গ্রহণ করবে। আমাদের পাবলিক স্কুল সমূহের উদ্দেশ্যে অত্যাচার করা ছাড়া আর কিছু নয়। ফলতঃ সে স্কুলসমূহ সাদা মানুষের বোঝা বইবার মত মানুষের সৃষ্টি করে। যদি এসকল মানুষকে বিজ্ঞানের প্রতি অনুরাগসম্পন্ন করে তোলা হয়, সম্ভবতঃ কঠিনতর কাজটা করতে ভালোবাসে। যেমন সতরঞ্চ খেলোয়ার মমুলি খেলা পছন্দ করবেনা। এভাবে দক্ষতা এবং কলাকৌশলের সাহায্যে প্রবৃত্তিকে শাসনে রাখা যায়।

অন্য একটি দৃষ্টান্ত নিতে পারি, যেমন ভীতিনির্ভর বিপদের চার রকমের প্রতিক্রিয়ার কথা বর্ণনা করেছেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নটা প্রযোজ্য।

(১) ভয় পাওয়া এবং পলায়ন করা।

(২) রাগ হওয়া এবং সংগ্রাম করা।

(৩) কৌশলের আশ্রয় নেওয়া।

(৪) নিঃসাড় হয়ে যাওয়া।

এটা স্পষ্ট যে মধ্যে তৃতীয়টাই হলো সবচেয়ে উত্তম, কিন্তু তার জন্য খাপ খায়, এমন বিশেষ ধরনের কৌশলের প্রয়োজন। দ্বিতীয়টাকে সাহস নাম দিয়ে জঙ্গীবাদী ব্যক্তি, স্কুল শিক্ষক এবং ধর্মাধ্যক্ষেরা প্রশংসা করে থাকেন। প্রত্যেক রকমের শাসকশ্রেণীর নিজস্ব শ্রেণীকে সাহসী করে গড়ে তোলার লক্ষ্য থাকে, যাতে করে তারা অধীনস্থদের ভীতু এবং পালনীয় মনোবৃত্তিসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে পারে। আমাদের সময়ের আগে নারীজাতিকে শঙ্কাকুলা করে গড়ে তোলা হতো। অপকৃষ্ট বৃত্তি যে সামাজিক ভাবে নমনীয় এবং হামবড়ামীর রুপ পরিগ্রহ করেছে এখনো তা শ্রমিকদের মধ্যে দেখা যাবে।

সবচেয়ে বেশি ভয়ের কারণ হলো, মনোবিজ্ঞান ক্ষমতাসীনদের হাতে নতুন ধরনের অস্ত্র তুলে দেবে। তারা ভীরুতা এবং বশ্যতা শিক্ষা দিতে সক্ষম হবে এবং ধীরে ধীরে পোষমানা জম্ভর মত করে ফেলবে। আমি ক্ষমতাসীনদের নামে শুধু পুজিপতিদের কথা বলছিনা, সমস্ত সরকারি কর্মচারী, এমনকি ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রমিকদল সকলেরই কথা বলছি, প্রত্যেক অফিসার এবং প্রত্যেক ক্ষমতাসীন ব্যক্তি চান যে অনুসারীরা তার কাছে অনুগত থাকুক। তারা যদি তাদের সুখের ধারনা অনুসারে নিজস্ব ভাবধারার প্রসার করতে চায়, তাহলে তিনি রুষ্ট হন। অতীতের উত্তরাধিকারনীতি নিশ্চয়তা প্রদান করেছিল যে শাসক শ্রেণী অলস এবং অযোগ্য হবে, যার ফলে অন্যেরা সুযোগ পেয়ে যাবে। প্রত্যেক সময়ের শাসক শ্রেণী যুগের অত্যুৎসাহী এবং কর্মী ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে যদি নির্বাচন করা হয় তাহলে তারা নিজের চেষ্টায় মাথা তুলবে। এ ব্যপারে সাধারন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বড়ো বেশী ঝাপসা। পৃথিবীতে কেউ অলসের পক্ষে সমর্থন করে কোন কিছুর ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে এমন দৃষ্টান্ত বিরল। যারা অপরের ব্যাপারে নাক গলায় না অলস বলতে আমি তাদের কথাই বলছি। পৃথিবীর সমস্ত শক্তি যেখানে প্রতিদ্বন্দিতার পুরস্কার সেখানে যদি শান্তিকামী মানুষেরা পাত্তা অর্জন করতে চায়, তাহলে তাদেরকে যৌবনের নির্ভীকতা এবং উদ্যমশীলতা শিক্ষা করতে হবে। সম্ভবতঃ গণতন্ত্রের যুগ এখন অতিক্রান্ত। তাই যদি হয় মনোবিজ্ঞান দাসদের আবদ্ধ করে রাখার শৃঙ্খলের আঙটা হিসেবে কাজ করবে। অত্যাচার করবার কৌশলে পুরোপুরি দক্ষতা অর্জন করার আগে গণতন্ত্রকে নিরাপদ করবার প্রয়োজন সে জন্য।

শুরুতে আমি বিজ্ঞানের তিন রকমের প্রতিক্রিয়ার কথা বলেছি। তাতে পুনরায় প্রবর্তন করলে এটা স্পষ্ট হয়ে পড়ে যে মনোবিজ্ঞান শক্তির অধিকারী কোন কাজে আসবে তা আমরা কল্পনা করতে পারিনে, যতক্ষণ পর্যন্ত না কী ধরণের সরকার আমাদের গঠন করতে হবে সে সম্বন্ধে ওয়াকেবহাল না হই। প্রত্যেক রকমের বিজ্ঞানের মত মনোবিজ্ঞানও শাসকদের হাতে নতুন রকম অস্ত্র প্রদান করবে। তার মধ্যে প্রধানতঃ উল্লেখযোগ্য হবে শিক্ষা এবং প্রোপাগাণ্ডার অস্ত্র, উভয়টাকে পরিপূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতিতে এমনভাবে গড়ে তোলা যায়, যাতে দু’টোই বাস্তবিকভাবে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। যদি ক্ষমতাসীনেরা শান্তিকামনা করে, তাহলে তারা শান্তি কামী জনতার সৃষ্টি করতে পারবে। আর যদি যুদ্ধ চায়, তাহলে পোষমানা জনসাধারণের সৃষ্টি করবে। যদি তারা বৃদ্ধিবৃত্তির প্রসার করতে চায় করতে পারবে, যদি বোকামো এবং মূর্খতা প্রচার করতে চায় তাও পারবে। সুতরাং এক্ষেত্রে ভবিষ্যৎবাণী করা রীতিমতো অসম্ভব।

কল্পনায় মনোবিজ্ঞান সম্ভবতঃ দু’টো পরস্পরবিরোধী প্রতিক্রিয়া করবে। একদিকে ব্যাপকভাবে ডিটারমিনিজম বা নিয়ন্ত্রনবাদকে গ্রহণ করা হবে। অধিকাংশ মানুষ এখন বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করতে আরাম বোধ করে না, তার কারণ হলো আবহাওয়াবিজ্ঞান। কিন্তু তারা যখন ভালো হৃদয়ের জন্য প্রার্থনা করে তখন তত খারাপ লাগেনা। বৃষ্টির যা কারণ ভালো হৃদয়েরও তাই যদি কারণ হয়ে থাকে তাহলে প্রভেদ থাকবেনা। যে লোক ডাক্তার ডেকে খারাপ আকাথা থেকে মুক্ত না হয়ে ভালো হৃদয়বিশিষ্ট হওয়ার জন্য প্রার্থনা করে তাকে কপট বলে মার্কা মেরে দেয়া যেতে পারে। যদি যে কেউ হার্লি খ্রিষ্টের সাধুর কাছ থেকে কয়েক গিনি দিয়ে প্রার্থনা করে ভালো হয়ে যেতে পারে, তাহলে তাকে কপট ছাড়া আর কি বলা যায়। নিয়ন্ত্রণবাদের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে সম্ভবতঃ কর্মপ্রেরণা কমে যাবে এবং সাধারণের মধ্যে নৈতিক অলসতা আসবে, কিন্তু এরকমের ফলাফল যুক্তিসঙ্গত নয়। এ আমাদের পক্ষে লাভজনক হবে কি ক্ষতিকারক হবে তা আমরা বলতে পারি না, যেহেতু প্রমাদপূর্ণ মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে সমন্বিত নৈতিক প্রচেষ্টার কি ভালো ফল হবে না খারাপ ফল হবে তা আমি বলতে পারিনে। অন্য দিকটি বস্তুর সঙ্গে নৈতিক এবং দার্শনিক কোন বাঁধন থাকবেনা। আবেগসমূহ যখন সর্বজনস্বীকৃত সক্রিয় বিজ্ঞানের বিষয় হিসেবে রূপান্তরিত হবে তখন আবেগ রাশিকেই অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করা হবে। আমার মতে এর ফল মোটামুটি ভালোই হবে, যেহেতু তা সুখের প্রচলিত প্রমাদপূর্ণ ধারণার নিরসন করতে পারবে।

আমাদের জীবনের ধারায় আবিষ্কার এবং উদ্ভাবনের মাধ্যমে যে সম্ভাব্য পরিবর্তন আনতে পারে তার সম্বন্ধে অগ্রিম কিছু বলার মত দুঃসাহস আমার নেই। একধরণের প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশা করার কোন সঙ্গত কারণ আমি দেখিনা। উদাহরণস্বরূপ নিগ্রোদের কাছে অন্যান্য উৎকর্ষ না আয়ত্ব করে সাদা মানুষের মতো যুদ্ধ করতে শিক্ষা করাই হবে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়া অথবা বিপরীতভাবে মনোবিজ্ঞান নিগ্রোদেরকে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অবলম্বন করতে অনুপ্রাণিত করবে। এই দুই সম্ভাবনা ভিন্ন ভিন্ন পৃথিবীর জন্ম দিতে পারে : একটা বাস্তবায়ন হবে, না কোনটাই হবে না, সে বিষয়ে অনুমান করার কোন উপায় নেই।

উপসংহারে মনোবিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ বাস্তব গুরুত্ব হবে তা সাধারণত মানুষ মানুষীকে সত্যিকারের সুখ কিসে তার একটি ধারণা প্রদান করবে। প্রধান প্রধান ব্যাপারে মানুষ যদি সুখী থাকে তাহলে তারা অসন্তোষ, দ্বেষ এবং ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের শিকারে পরিনত হবে না। জীবনের প্রয়োজনীয় চাহিদা ছাড়াও কমপক্ষে মধ্যবিত্ত এবং মজুরদের যৌন এবং পিতৃত্বের স্বাধীনতা থাকা চাই। আমাদের প্রবৃত্তির জ্ঞানকে সার্বজনীন করে তোলার কাজ বর্তমান জ্ঞানের সাহায্যে কঠিন হবে না, যদি না আমরা, যারা সুখ পায়নি এবং অন্যকেও পেতে দেয়নি তাদের হিংসুটে আবেগের দ্বারা প্রবৃত্তিগুলোকে ধ্বংস না করি এবং সুখ যখন সার্বজনীন হয়ে পড়বে তখন নিজেই নিজের অস্তিত্ব ঘৃণা এবং ভীতির বিরুদ্ধে আবেদনের মাধ্যমে রক্ষা করতে সম্ভবপর হবে বর্তমান রাজনীতি আঁশে শাঁসে যে হিংসা বিদ্বেষ তাও নিরালম্ব হয়ে পড়বে। কিন্তু মনোবিজ্ঞান যদি অভিজাততন্ত্রের দ্বারা পরিচালিত হয় তাহলে পুরনো দোষত্রুটিাকে আবার জাগিয়ে তুলবে এবং তাও নিরালম্ব হয়ে পড়বে এবং তা দীর্ঘস্থায়ী হবে। পৃথিবীতে সুখ সন্তুষ্টি বিধান করার এমন পর্যাপ্ত জ্ঞান রয়েছে, যে মানুষের উৎপত্তির সময় থেকে তাবৎ ইতিহাসে তার জুড়ি মেলেনা; কিন্তু প্রাচীন অসঙ্গতি লোভ, দ্বেষ এবং ধর্মীয় নিষ্ঠুরতা সে সুখের প্রতিবন্ধক হয়ে রয়েছে, এর ফলাফল কি হবে আমি জানিনা, কিন্তু মনে করি খারাপ হোক, ভালো হোক তা এমন হবে যা মানুষের অনুমান কল্পনার বাইরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *