১৫-১৬. তরুণ সন্ন্যাসীরা

তরুণ সন্ন্যাসীরা, এবং তুরতিও আজ ঘুমিয়ে পড়েছে প্রস্তরাশ্রয়ের মধ্যে, কম্বল গায়ে, গুঁড়িসুড়ি মেরে। যদিও রাত বেশি হয়নি। তবে রাত যত বাড়ছে, ঠাণ্ডাও ততই বাড়ছে। বাইরে ধুনিটা জ্বলছে।

গাঁজা খেয়েছে চারণও।

যার নাম চারণ, তার উচিত নয় ভাল মন্দ বা উদাসীন কোনও অভিজ্ঞতা থেকেই নিজেকে বঞ্চিত করা। তাই, জীবনের চলার পথে যে অভিজ্ঞতারই সম্মুখীন সে হয়েছে তাকেই আলিঙ্গন করেছে এ যাবৎ। সেই আবাহন তুলির মতন কোনও নারীর উৎসুক মৃণালভুজই হোক, জয়িতার মতন খেলো আধুনিকতার বঞ্চনার আর স্বার্থপরতার বাঘবন্দি খেলার পাঞ্জাই হোক অথবা চন্দ্রবদনীর মতন আত্মসংযমী সম্ভ্রান্ত নারীর দেওয়া সংযম-বিধুর মধুর সঙ্গই হোক, সবকিছুকেই গ্রহণ করেছে। সমান প্রসন্নতাতে। দীর্ঘ জীবনের যে পথটুকু বাকি আছে, সে পথে কোন অভিজ্ঞতা কখন যে কাজে লাগবে তা আগে থাকতে কে বলতে পারে! সবই গ্রহণ করেছে বিশেষ কোনও আগ্রহ অথবা অসূয়া ছাড়াই। তাই নিমোহভাবে তুরতির প্রসারিত হাতের গাঁজার কলকেও গ্রহণ করেছিল চারণ।

যতখানি, মানে যত ছিলিম গাঁজা খেয়েছিল, তাতে তার নেশা হয়েছে কি না তা সে বলতে পারে। গাঁজার নেশার প্রকৃতি কেমন? তা এক রাতের অভিজ্ঞতাতেই, বিস্তারিতভাবে অন্যকে তো বটেই, হয়তো নিজেকেও বোঝাতে পারবে না। তবে এটুকু বলতে পারে যে, শরীর মনের আদ্রতা যেন অনেকখানি খসে গেছে। বেশ একটা রুখু, চনমনে ভাব। মনোসংযোগ করার ক্ষমতাও যেন বেশ বেড়ে গেছে। কিন্তু মনোসংযোগের কোনও বিশেষ বিষয় না থাকলে মনোসংযোগের ক্ষমতার আধিক্য মনের অধিকারীর পক্ষে আদৌ স্বাস্থ্যকর কি না, তা মনের কারবারীরাই বলতে পারেন শুধু। তবে জিষ্ণু মহারাজের চেহারাটা স্পষ্ট হয়েছে খুব। মুখের হ্রদ এবং পাহাড়-পর্বত। দূরবীণ চোখে লাগিয়ে কিছু দেখলে যেমন দেখায় তেমনই আর কী! সাদা দাড়ি-গোঁফওয়ালা এই শীর্ণ গৌরবর্ণ সন্ন্যাসীর মুখমণ্ডলে তাঁর চোখ দুটি বাঘের চোখেরই মতো জ্বলজ্বল করছে।

চারণের মনে হল একবার, প্রথম রাতে যে বাঘের গর্জন শুনেছিল গভীর জঙ্গলাকীর্ণ উপত্যকার মধ্যে, সেই বাঘ এই সন্ন্যাসীরই অন্য সত্তা নয়তো? দেবী দুর্গারই উপাসক যিনি তাঁর দেবীর বাহন হতেই বা অসুবিধে কিসের?

বাইরে থমথম করছে নিস্তব্ধতা। ছমছম করছে শিশির ভেজা জ্যোৎস্না। শিশির-ধোওয়া চাঁদের আলো টুইয়ে পড়ছে চন্দ্রবদনীর মন্দিরে, মন্দির চত্বরে, জিষ্ণু মহারাজের প্রস্তরাশ্রয়ের সামনে এবং তাঁর মাথার উপরেও। রাত-পাখিরা স্বগতোক্তি করছে মাঝে মাঝে। যামিনীর এই বিশেষ যাম যেন বিশেষ কোনও ঘটনার সাক্ষী হবে বলে উন্মুখ হয়ে আছে। যে কোনও মুহূর্তেই সেই ঘটনা ঘটতে পারে।

জিষ্ণু মহারাজ আজও আবার চারণের পাণি প্রার্থনা করলেন। চারণ তাঁর কাছেই, সামনে বসে ডানহাতটা এগিয়ে দিতেই মহারাজ হাতটা টেনে নিয়ে তাঁর দুহাতের গাঁজার কলকেরা রুক্ষ বুড়ো আঙুলে নানাভাবে টেপাটেপি করতে লাগলেন চারণের দুহাতের পাতা। আর কিছুক্ষণ বাদে বাদে শুঁকতে লাগলেন।

সেই আশ্চর্য প্রক্রিয়া শেষ হলে বললেন, তুমহারা ওয়াক্ত আয়া যায়।

কিসের ওয়াক্ত?

 যাত্রা শেষের।

কোন যাত্রার? আমি তো বিশেষ কোনও গন্তব্য নিয়ে যাত্রা করিনি যে, যাত্রা শেষ হবে গন্তব্যে। এসে!

তা নয়। এবারে তোমার মন শান্ত হয়ে যাবে। থিতু হয়ে বসবে তুমি। তুম চাপরাশি বনোগে বেটা।

চাপরাশি হতে যাব কোন দুঃখে। আমি কখনওই কারও চাপরাশি হব না।

হব না বললে তো আর হল না। আমরা প্রত্যেক মানুষই তো চাপরাশিই। কারও না কারও চাপরাশ বহন করতেই আমরা আসি এই পৃথিবীতে।

তাই?

অবশ্যই!

আমরা না হয় গৃহী মানুষ। কারও না কারও আদেশ বা উদ্দেশ্য আমাদের সিদ্ধ করতে হয়ই। কিন্তু আপনিও কারও চাপরাশি হতে যাবেন কোন দুঃখে?

চারণ বলল।

জিষ্ণু মহারাজ হাসলেন। দুয়ে এক হাসি। সেই রহস্যময় গভীর রাতের অমথিত নিস্তব্ধতাতে সেই হাসি পঞ্চমীর চাঁদেরই মতন ঝুলে রইল যেন রহস্যময়তর হয়ে।

মহাবাজ বললেন, আমি দেবীর চাপরাশি। চন্দ্রবদনীর চাপরাশি। তুমিও এক মানবীর চাপরাশি হবে।

কোন দুঃখে?

 চাপরাশি হওয়ার মধ্যে তো হীনতা নেই। লজ্জাও নেই কোনও। চাপরাশ শব্দটির মানে যে তুমি জানো না শিক্ষিত হয়েও একথা জেনে খারাপ লাগল আমার বেটা। মীরাবাঈ যখন গেয়ে ওঠেন ম্যায়নে চাকর রাখো, চাকর রাখো, চাকর রাখো জী। তখন কি আক্ষরিক অর্থে চাকর রাখার কথা বলেন? চাকরেরও তো কত রকম হয়। আর চাপরাশ-এর তো হয়ই।

চারণ চুপ করে রইল অনেকক্ষণ।

ভাবছিল ও যে, শিশুকাল থেকে চাপরাশি শব্দটি শুনে আসছে। তকমা আর লাল ফেট্টি বুকে কাঁধে ঝোলানো চাপরাশিও দেখেছে অনেক। তাদের বাড়ির উলটোদিকেই মিত্তির সাহেব থাকতেন, হাইকোর্টের জজ। তাঁর বাড়ির ভিতর বাহির চাপরাশিতে ছয়লাপ ছিল। নিজেও তো নানা ট্রাইবুনালে এবং বিভিন্ন হাইকোর্টে সুপ্রিমকোর্টে চাপরাশি কম দেখেনি এত বছর। অথচ শব্দটির মানে যে কি? সে সম্বন্ধে তার কোনওই ঔৎসুক্য ছিল না। চাপরাশ শব্দটাই তার কাছে অপরিচিত ছিল। চাপরাশ বহন করে বলেই যে তারা চাপরাশি এই সরল সত্যটি কখনও মনে উদয় হয়নি। আশ্চর্য। আর সেই শব্দের মানে জানতে হল এই সুদুর চন্দ্রবদনীর মন্দিরের সন্ন্যাসীর কাছে।

জিষ্ণু মহারাজ প্রকৃতই জিষ্ণু।

ভাবল, চারণ।

হঠাৎই মহারাজ বললেন, তুমি যখন গান গাও…

চারণ বলল, আমি তো গান জানি না। চানঘরে গান গাই শুধু।

যেমনই গাও, গাও তত বেটা! এখন যা বলি, মনোযোগ দিয়ে শোনো। তুমি যখন গান গাও, তখন সেই সুরের অনুরণন তোমার মধ্যে কি কোনও ভাবের সঞ্চার করে?

চারণ একটু চুপ করে থেকে বলল, করে।

কেমন সেই ভাব?

 মনে হয়, কেউ যেন আমার দুকাঁধে হাত দুইয়ে রেখেছেন। কেউ যেন আমার গলায় এসে বাসা বেঁধেছেন। আমি যেন কোনও মানুষকে শোনাবার জন্যে গাইছি না, অথচ অদৃশ্য অনেকেই যেন আমার চারধারে বসে সেই গান শুনছেন।

জানতাম।

তারপর জিষ্ণু মহারাজ বললেন, তুমি কোথায় গান শিখেছ? তোমার গুরু কে? কী গান শিখেছ?

তেমন করে শিখিনি কোথাওই। নাড়া বেঁধেও শিখিনি। কোনও বিশেষ ধরনের গানে বিশারদও হইনি। তবে এর তার কাছে শিখেছি ভাললাগার গান। গানের ব্যাকরণ বলতে যা বোঝায় আমি তার কিছুই জানি না। কিন্তু কখনও ব্যাকরণ জানার ইচ্ছাই হয়নি। গান শুনতে আর গান গাইতে ভাল লেগেছে, লাগে। ব্যাকরণ জানতে নয়।

ভাষার ব্যাকরণে পণ্ডিত হলে স্কুলের বা টোলের মাস্টারি পেতে। আর গানের ব্যাকরণে প্রগাঢ় পণ্ডিত কিন্তু গিধ্বরের মতন গলার গায়কও বহত দেখেছি। ব্যাকরণ না জেনেও তো মৈজুদ্দিন হয়। তোমার উপরে গন্ধর্বলোকের অনেক সুরঋদ্ধ ঐশী শক্তির আশীর্বাদ আছে বেটা। তুমি সব ছেড়ে দিয়ে শুধুই গান গাও।

চারণ হেসে বলল, আমার গান কে শুনবে? আপনি পাগল হতে পারেন, আমি তো নই। অন্যেরাও নয়।

তুমিও পাগল। তুমি গান গাইলে সারা জগৎ তোমার গান শুনবে। তোমার জন্যে…

তারপরই বললেন, সংগীত-গবাক্ষ কাকে বলে জানো?

না তো। সেটা কি? এর কথা শুনিনি তো কখনও কারও কাছে এর আগে।

 তুমি স্বর্গে গেলে তিনরকম সুর শুনতে পাবে। সংগীত-গবাক্ষর তিনটি গবাক্ষই খুলে যাবে তোমার জন্যে। তিনরকমের পরকলা দিয়ে সুরলহরী এসে পৌঁছবে তোমার কানে।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন, তাল যে ব্ৰহ্ম, এ কথা কি জানো তুমি? গ্রহ-নক্ষত্র এবং আমাদের পৃথিবীও যে অভাবনীয় গতিতে ছুটে চলেছে, একে-অন্যেকে নিয়মবদ্ধ হয়ে প্রদক্ষিণ করছে যুগযুগান্ত ধরে, তাও যে সংগীতের মূর্ঘনার সঙ্গে, তালবদ্ধ হয়েই, তা কি তুমি জানো? কত স্বর্গীয় জ্যোতি আর দ্যুতির বিচ্ছুরণ হয়ে চলেছে সেই সংগীতের মূর্ঘনার সঙ্গে সঙ্গে, তাও কি তুমি জানো?

না।

চারণ বলল।

 তারপর বলল, হৃষীকেশ এর এক সন্ন্যাসীর মুখে শুনেছিলাম যে স্বর ঈশ্বর আর তাল ব্ৰহ্ম।

কী নাম তাঁর?

 ধিয়ানগিরি মহারাজ।

ও হ্যাঁ। গান জানতেন বটে ধিয়ানগিরি। কিন্তু তিনি আজই বিকেলে স্বলোকে চলে গেলেন। এখন তিনি তিন-তিনটি সংগীত-গবাক্ষ খুলে বসে গান শুনছেন। গানের মতন জিনিস আর আছে কি বাবা?

স্বর্গলোকে গেছেন মানে?

হাঁ বেটা। আজই বিকেলে তাঁর দেহান্ত হয়ে গেল।

কে বলল আপনাকে?

 বলবে আবার কে? আমি দেখতে পেলাম যে!  

আপনি সবই দেখতে পান?

সব নয়। সব নয়। যতটুকু মা চন্দ্রবদনী দেখান ততটুকুই পাই। আমি কে? ফুঃ।

তারপর বললেন, সংগীতের ব্যাকরণ তোমার না জানলেও চলবে, রিওয়াজ না করলেও চলবে। তোমার হয়ে অনেক বড় বড় ওস্তাদ বহু বহু বছর ধরে রিওয়াজ করে গেছেন এইখানেই। তাঁদের আশীবাদ পড়েছে তোমার ওপরে। তুমি বড় ভাগ্যবান। তুম কোঈ মামুলি ইনসান নেহি যায় বেটা। তুমকো ম্যায় অ্যাইসেহি নেহি বুলায়া থা কাল, তুমকো চবুতরামে চড়কে আতে হুয়েহি দিখকর ম্যায় জানতাথা তুম কওন হো।

কওন হ্যায়? ম্যায়?

মতলব, কোঈ খাস আদমী ঔর দেবদেবীকি বারে ম্যায় নেহি কহ রহা। তুম মামুলি ইনসান নেহি হ্যায় ই ম্যায় সমঝ পায়া থা। মগর যব লওটেঙ্গে কলকাত্তা, সব কামধান্দা ছোড়কর স্রিফ গানাহি গাও।

খাব কি?

এক আদমী কি খানেমে ক্যা লাগতা হ্যায়? ম্যায় কা ভুখা? থোড়িসি খানাসে মজেমে দিন গুজার যাতি হ্যায়। লালচিকি ভুখ কভভি না মিটতা। কত অল্পেই আমরা সুখি হতে পারি, থাকতে পারি। আশার কি শেষ আছে। এই যে আমাদের তুরতি! ও একটা গান প্রায়ই গায়। ওঃ সে গান তো তোমাকে সন্ধেরাতে শুনিয়েই দিয়েছে। এই গাঁজায় দম দিলেই আমার বুদ্ধি ঘুলিয়ে যায়।

তারপর বললেন, আরও একটা গান গায় তুরতি সুখ এর বিষয়ে। কার কাছে শিখেছিল জানি। তবে যেসব মানুষেরা সর্বক্ষণ সুখ সুখ করে, সুখের পিছনে দৌড়ে বেড়ায় তাদের এই গানটা শোনা উচিত।

কোন গান?

গান তো আমি গাইতে পারি না। কাল সকালে তুরতির কাছে শুনতে চেও, শোনাবে। গানের বাণীটাই তোমাকে বলতে পারি শুধু।

কী বাণী?

সুখের কথা বোলো না আর, বুঝেছি সুখ কেবল ফাঁকি
দুঃখে আছি ভাল আছি, দুখেই আমি ভাল থাকি।
দুঃখ আমার প্রাণের সখা, সুখ দিয়ে যান চোখের দেখা
দুদণ্ডের হাসি হেসে মৌখিক ভদ্রতা রাখি।
 দয়া করে মোর ঘরে সুখ, পায়ের ধুলা ঝাড়েন যবে
চোখের বারি লুকিয়ে রেখে, মুখের হাসি হাসতে হবে।
দেখলে পরে চোখের বারি, সুখ চলে যান বিরাগ ভরে
দুঃখ তখন কোলে করে, আদর করে মুছায় আঁখি।
সুখের কথা বোলো না আর বুঝেছি সুখ কেবল ফাঁকি।

বাঃ।

চারণ স্বগতোক্তি করল।

তারপরে বলল, কার লেখা গান এটা?

তা জানি না। তুরতিকে জিগ্যেস কোরও।

জিষ্ণু মহারাজ বললেন, তুরতি এসে জুটেছে আমার কাছে বছর তিনেক হল। ও একটা মস্ত রিলিফ এই বৈরাগ্যর ভেকধারী জগতে।

ভেকধারী বলছেন কেন? আপনার তো কোনও ভেক নেই।

সব শালারই ভেক থাকে। যেদিন ভেকহীন হতে পারব, গুমোরহীন হতে পারব, সেদিন তো তরেই যাব।

তারপর বললেন, থাক এসব কথা। এবার আসল কথাতে আসি। বলো তো? তুমি কি খুজতে এসেছ এই দেবভূমিতে? দেখি! আমি তোমাকে তোমার এই খোঁজে কিছু সাহায্য করতে পারি কি না!

কিছু খুঁজব বলে মন করে তত আসিনি মহারাজ। মনটা বড়ই উচাটন হয়েছিল। এতগুলো বছর কী করলাম, করে কী হল, মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় প্রার্থনা কি? সুখ কাকে বলে? সুখ আর শান্তি, সুখ আর প্রেম কি এক? সুখ আর অর্থও কি এক? সুখ আর আরাম? এই সব নানা প্রশ্নে জরজর হয়েই বেরিয়ে পড়েছিলাম একদিন।

জিষ্ণু মহারাজ হেসে বললেন, সুখের সঙ্গে, প্রেমের বা আরামের সহাবস্থান যে সবসময়ে হবেই। এমন বলা যায় না। সেই আমাদের গিরীশ ঘোষের গান ছিল না একটা? গিরীশ ঘোষের লেখা প্রথম গান।

কোন গান?

সুখ কি সতত হয় প্রণয় হলে?
সুখ অনুগামী দুখ, গোলাপেও কণ্টক মেলে।

পরের পংক্তিগুলি মনে আছে কি?

 নাঃ। তুরতির মনে থাকলেও থাকতে পারে। কাল ওকে জিগ্যেস করে দেখো।

এবারে আপনি যা বলার বলুন আমাকে মহারাজ। কলকাতা ছেড়ে আসবার সময়ে যেমন উচাটন হয়েছিল মন এখন যেন কলকাতাতে ফেরার জন্যেই মন তেমনই উচাটন হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। যদিও আমার কোনও প্রশ্নরই উত্তর পাইনি এখনও।

জিষ্ণু মহারাজ হাসলেন। বললেন, যখন উত্তর পাবে বেটা, সব প্রশ্নেরই উত্তর একই সঙ্গে পাবে। ধৈর্য রাখতে হবে। সংসারে অথবা সন্ন্যাসে সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে ধৈর্য। তবে ইনস্ট্যান্ট উত্তর পাও আর না পাও, তুমি যে কদিন এই দেবভূমিতে কাটিয়ে গেলে তা তোমার আত্মাকে, মনকে অবশ্যই পরিশোধন করবে। ফিরে গিয়ে, জীবনের এক নতুন মানে খুঁজে পাবে। নতুন জীবন পাবে। তুমি দ্বিজ হবে। জীবনে যারা অভ্যেসের কাদাতে আর চোরাবালিতে একবার মোষের মতন গেঁথে যায় তাদের আর বাঁচার কোনও উপায়ই নেই। মোষ তবু একসময় কাদা ছেড়ে স্বেচ্ছাতে উঠতে পারে কিন্তু গৃহী মানুষে পারে না। মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে জন্মালেই তো আর কেউ Ipso facto মানুষ হয়ে যায় না।

মনটা ভারী খারাপ হয়ে গেল চারণের। ভেবেছিল ধিয়ানগিরি মহারাজের সঙ্গে আবারও অবশ্যই দেখা হবে। আর কোনওদিনও দেখা হবে না জানলে আরও কটা দিন কাটিয়ে আসত হৃষীকেশ-এ। ভীমগিরি মহারাজই বা কেমন আছেন কে জানে! সন্ত তুকারামের জীবনীর পুরোটা যে শোনা হয়নি। তা কি আর শোনা হবে? চারণ ভাবছিল, যখন পরিবেশ প্রতিবেশ সব স্থির থাকে তখন বিশ্বাসই হয় না যে, একদিন তা অস্থির হয়ে উঠতে পারে। যখন অস্থির হয়ে যায় তখন সবই এলোমেলো হয়ে যায়। স্থিরতার স্থিরচিত্রটি আর কল্পনাতেও ফিরিয়ে আনা যায় না। স্থির জলের উপরের প্রতিবিম্ব, জল নড়ে গেলে যেমন লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়, ঠিক তেমনই। শত চেষ্টাতেও জোড়া লাগানো যায় না।

চারণ বলল, মহারাজ! আমাকে কি ফিরে যেতেই হবে? আমিও যদি আপনার চেলা বা চামুণ্ডা হয়ে থেকে যাই এখানে বাকি জীবন?

খুব জোরে হেসে উঠলেন জিষ্ণু মহারাজ।

হাসি থামলে বললেন, কোন দুঃখে? তুমি তো আর তুরতি নও যে, ক্ষেমি বাঈজির মেয়েকে ব্যয়লা বাজিয়ে ফেরার হতে হবে তোমাকে! তোমার কতকিছু করার আছে এখনও। বনে পাহাড়ে আমাদের মতন যারা সংসার ত্যাগ করে এসে সন্ন্যাসীর ভেক ধরে পড়ে আছে তাদের অধিকাংশরই সংসারকে দেবার মতন তেমন কিছু ছিল না হয়তো। সংসারও কেউ যদি কিছু দিতে চায়, তা সকলের কাছ থেকে নেয় না। তারও কিছু বিশেষ পছন্দ-অপছন্দ আছে। এসব অনেক গভীর তত্ত্বের কথা, অভিজ্ঞতার কথা। এক কথায় বুঝিয়ে বলা যাবে না।

তারপরে বললেন, তোমাকে বোঝানোর দরকারও হয়তো নেই।

চারণ চুপ করে রইল।

জিষ্ণু মহারাজ আবারও গাঁজা সাজলেন। সেজে, নিজে কষে এক টান লাগিয়ে চারণকে এগিয়ে দিলেন কলকেটা। এক টান মারতেই চারণের মধ্যের আগে–সেবিত সুপ্ত সিদ্ধি যেন কেরে? কেরে? বলে উঠল। ও, না, সিদ্ধিতে সিদ্ধ ছিল, না, গঞ্জিকাতে সঞ্জীবিত। ও তো এই সব বিদ্যাতেই এতাবৎ আনপড়ই ছিল। ওর দুচোখ স্থির হয়ে গেল যেন এক মুহূর্তের জন্যে। তারপর সেই অস্থায়ী স্থিরতা থেকে স্থায়ী অস্থিরতাতে ফিরে এসে চারণ বলল, বলুন মহারাজ, যা বলছিলেন।

আমি কী বলব? তুমি আরও কি জানতে চাও বল? সেই মেয়েটির কথা জানতে চাও কি আরও? দেবীজির নামেই যে কন্যার নাম সেওত দেবীরই মতন। খুব ধার্মিক এক প্রকৃত উচ্চশিক্ষিত পরিবারের মেয়ে সে। সে তোমার যোগ্য সহধর্মিণী হবে।

সহধর্মিণী? চমকে উঠে বলল, চারণ।

কথাটা যে আদৌ ভাবেনি তা নয়। ভেবেছে, শয়নে, স্বপনে, জাগরণে কিন্তু নিজ মুখে কথাটা উচ্চারণ করার সাহস হয়নি।

অবশ্যই! এবং শুধুমাত্র জীবন-সঙ্গিনীই নয়, যথার্থ সহধর্মিণী, ধর্মপত্নী। রাজযোটক মিল হবে তোমাদের।

জিষ্ণু মহারাজ বললেন।

আপনি কি করে জানলেন?

 খুব খুশি হয়েও উদাসীনতার ভান করে বলল, চারণ।

 আমি যে জানি, এইটুকুই জেনে বাখো এখনকার মতন। এর চেয়ে বেশি জেনে কি হবে?

তারপর হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, সেই কন্যার বাড়ি কি বদ্রীবিশালজির মন্দিরে যাবার পথের উপরেই কোনও জায়গাতে?

হ্যাঁ। চারণ বলল।

কিন্তু আপনি এসব জানলেন কি করে? আপনি কি ওঁদের চেনেন?

আমি যে দেখতে পাচ্ছি সব। দেখতে পাই। যে দেখতে চায় তেমন করে, তাকে দৌড়ে বেড়াতে হয় না পৃথিবীময় রণপায়ে চড়ে। সমস্ত পৃথিবী, সমস্ত বোধ, সমস্ত জ্ঞান তার ঘরে আসে। পর্বত যেমন মহম্মদেব কাছে গেছিল। চাইতে জানা চাই। তেমন করে চাইলে সবই পাওয়া যায়। এই চাওয়া তোমার নিজের জন্যে চাওয়া হতো নয়। এ বোধরই জন্যে চাওয়া। শাক্যসিংহ যেমন করে চেয়েছিলেন। তেমন করে চেয়েছিলেন বলেই না বুদ্ধ হতে পেরেছিলেন। স্থিতপ্রজ্ঞ।

তারপরই বললেন, চন্দ্রবদনীদের পরিবারে একজন আছেন যিনি বৌদ্ধ। তাই না?

হ্যাঁ। ওর দাদু, মানে ঠাকুর্দা। ভারী ভাল মানুষ। জ্ঞানী মানুষও। উনি তিব্বতী বৌদ্ধ।

ভাল মানুষ ওঁরা সকলেই। তবে ভেব না যে, শুধুমাত্র দেবভূমিতে বাস করার কারণেই তাঁরা ভাল। এইসব অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দাদের মধ্যে অধিকাংশই অবশ্য ভাল মানুষ কিন্তু আমাদের মতন আগন্তুকদের মধ্যে অধিকাংশই ফেরেববাজ। আরে, যত অন্ধকার সব তো প্রদীপেরই নীচে। তাই না?

তারপরে বললেন, দাঁড়াও।

 বলেই, চোখ বন্ধ করলেন।

নাঃ যা দেখছি তাতে মনে হয় ওঁরা প্রত্যেকেই ভাল। ভাল মানে এমন ভাল যে, যার চেয়ে ভাল আর হয় না।

আপনি দেখতেই যদি পাচ্ছেন তো বলুন তো চন্দ্রবদনী এখন কি করছে এই গভীর রাতে?

সে পড়ছে। তার ভাইয়ের ঘরে, ভাইয়ের খাটে শুয়ে। তার মুখটা শুধু দেখতে পাচ্ছি। চেকচেক বাসন্তী আর কচিকলাপাতা-সবুজ একটা কম্বলে তার শরীর ঢাকা।

সে কি কাঁদছে?

কেঁদেছিল। একসময়ে খুবই কেঁদেছে। মনে হচ্ছে। তবে এখন আর কাঁদছে না।

বইটার নাম কি? মানে, যে বইটা পড়ছে ও?

 তাও বলতে হবে? দাঁড়াও। চোখ বন্ধ করে একটুক্ষণ চুপ করে থেকে জিষ্ণু মহারাজ বললেন, বইটার নাম The Perils of Terrorism.

কার লেখা?

চারণ জিষ্ণু মহারাজের পরীক্ষক হয়েই যেন প্রশ্ন করছিল। এদের বুজরুকিটা ও ধরে ফেলতে চায়। ও না শিক্ষিত মানুষ! কলকাতা শহরের বাসিন্দা। যা বলবে ও সব সাধু-ফাধু, তার সবই বিনা প্রতিবাদে বিশ্বাস করতে হবে? ইয়ার্কি না কি?

দাঁড়াও। তুমি বড় নাছোড়বান্দা হে। বলে আবারও চোখ বন্ধ করলেন জিষ্ণু মহারাজ।

তারপর বললেন, Kirsten Anderson.

তিনি কে?

আঃ জ্বালালে দেখছি। দাঁড়াও। বলেই আবারও চোখ বুজলেন।

একটু পরে বললেন, একটি স্যুয়েড মেয়ে, মানে সুইডেনের।

 তাই?

হুঁ। আবারও চোখ বন্ধ করে বললেন, আমাদের পোশাকের রঙেরই মতন লাল রঙা জোব্বা পরে আছেন বৃদ্ধ। মানে দাদু।

ওর বাবা কি আছেন সেখানে?

দেখতে তো পাচ্ছি না।

সে কি? তাঁর ছেলে মারা গেল গুলি খেয়ে আর তিনি এলেন না।

হাঃ।

হাসলেন জিষ্ণু মহারাজ।

বললেন, গুলিখোরদের মধ্যেই তো বাস তাঁর। মৃত্যু তো মৃত্যুই। গুলি খেয়ে মরাও মরা, আবার তুরতি যে গুলি খায় তা বেশি খেয়ে মরাও মরা। যিনি সেনাপতি তাঁর কাছে গুলি খেয়ে মৃত্যুটাই ন্যাচারাল ডেথ। বোঝ না।

চন্দ্রবদনীর মা নেই?

 চারণ যেন জিষ্ণু মহারাজকে পরীক্ষা করার জন্যেই জিগ্যেস করল।

 হাঃ। আছেন। তবে তিনি অন্য পুরুষের কণ্ঠলগ্ন। ভারতে নেই এখন।

চারণ স্তব্ধ হয়ে রইল বহুক্ষণ। একবার মনে হল মানুষটা, মানে, জিষ্ণু মহারাজ একটি গ্রেট বুজরুক। তারপর মনে সন্দেহ হল চন্দ্রবদনীদের পুরো পরিবারকেই উনি চেনেন। তা নইলে এ কি সম্ভব?

হয়। হয়। সবই সম্ভব হয়। হিন্দুধর্ম, দর্শন, হিন্দু ঐতিহ্য, হিন্দু সংস্কৃতি, এই সব কোনও কিছুই মিথ্যে নয়, ছোট নয়। তাচ্ছিল্যের নয়। তাই অনেক কিছুই অভাবনীয় ঘটে ভারতবর্ষে। শুধুমাত্র আমরা আর বৌদ্ধরাই আমাদের ধর্ম কারও ওপরে জোর করে চাপাইনি কোনওদিনও। অন্য সমস্ত ধর্মাবলম্বীরাই কমবেশি তাই করেছে। তবে প্রত্যক্ষভাবে জোর মুসলমানেরা ছাড়া অন্যেরা তেমন কখনওই করেননি। ইতিহাস তাই বলে। যারা ইতিহাস পড়েছে, তারা তাই বলে। অথচ আমাদের ঔদার্য, আমাদের মহত্বর জন্যে আমাদের যুগে যুগে অন্য ধর্মাবলম্বীদের কাছে যা মূল্য দিতে হয়েছে তা অভাবনীয়।

আপনি যাকে ঔদার্য বলছেন তাকেই অন্য অনেকে ভীরুতা বলেন।

চারণ বলল।

ঔদার্য আর কাপুরুষতা এবং ভীরুতা যে সমার্থক নয়, যত জোরেই অন্যায়কে অ্যামপ্লিফায়ারের মাধ্যমে প্রচার করা হোক না কেন, অন্যায় যে কখনওই ন্যায়ের সমার্থক হতে পারে না, এই কথা জার-জবরদস্তিকারীরা কোনওদিনই বোঝেনি। তাই অন্যান্য অনেক ধমাবলখী ধরেই নিয়েছেন যে, মামাদের বুকে অন্যায়ের প্রতিকার করার মতন সাহস নেই। SPADE-কে SPADE বলাটা মামাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। কিন্তু হিন্দুধর্ম বৈষ্ণবধর্ম নয়। মেরেছ কলসীর কানা তাই বলে ক প্রেম দেব না এই শিক্ষা হিন্দুধর্মের শিক্ষা নয়। হিন্দুধর্ম কোনওদিনও ক্লীবত্বকে সমর্থন করেনি।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন, কথাটা কি জান? মানুষে বড়ই কম পড়াশুনো করে। পড়াশুনো ছাড়াও, জ্ঞানী আরও অনেক প্রক্রিয়াতে হওয়া যায়, কিন্তু সেই প্রক্রিয়াতেও আগ্রহ নেই বলেই আমাদের মধ্যে অধিকাংশরাই কিছু জানি না। জানে না।

তারপর হেসে বললেন, জ্ঞানের সীমা চিরদিনই ছিল কিন্তু অজ্ঞতার সীমা কোনওদিনও ছিল না।

অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন জিষ্ণু মহারাজ। তাঁকে কি একটু উত্তেজিত দেখাচ্ছিল? না। উত্তেজনাও তো ভীরুতারাই লক্ষণ। মহারাজ আর যাই হন, ভীরু আদৌ নন।

মহারাজ বললেন, তোমার আর কীই বা বয়স। তোমার এসব জানবার কথা নয়। কিন্তু আশ্চর্যের কথা এই যে যারা জানেও, তারাও মুখে কুলুপ এঁটে থাকে। সত্যি কথা বলাটা, বিশেষ করে ধর্ম ও ধর্মাবলম্বী সম্বন্ধে, অত্যন্ত, কুরুচিকর বলে গণ্য হয় এখন সমতল ভারতবর্ষের সব জায়গাতেই। বলবে কি করে? প্রত্যেক রাজনৈতিক দল, প্রত্যেক নেতারই যে অনেকই কিছু চাইবার আছে। থাকে। Everyone has an axe to Grind আর the worst of all axes কি বলত?

কি?

কি আবার? ভোট। পাছে ভোট না পায়, পাছে পরের টার্ম-এ নিজের পোঁদের গরমে গরম হয়ে-থাকা গদিটিতে আবারও ভোট পেয়ে এসে না বসতে পারে, ওই ভয়েই তো শালাদের রাতে ঘুম থাকে না তো। সে শালারা দেশ আর দশের সেবা করবে কি? কেমন সেবা করেছে এরা গত পঞ্চাশ বছরে তা প্রতি সকালে খবরের কাগজ খুললেই তো দেখতে পাও। কি? পাওনা?

একটু চুপ করে থেকে বললেন, অবশ্য চাইবার কথাতে মনে পড়ে গেল যে, খবরের কাগজওয়ালাদেরও চাওয়ার শেষ নেই। যারা গণতন্ত্রের প্রকৃত প্রহরী হতে পারত তারাও ভেলিগুড়ের ব্যবসাদার হয়ে গেছে। মিডিয়ারও বিবেক-ফিবেক কিছু নেই। তারাও নিছক টাকা কামাবার কল। জাস্ট টাকা কামাবার কল আর ক্ষমতা কুক্ষিগত করবার। নেতারা, কাগজওয়ালারা, সব শালারাই ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে গেছে। কী ভেক! কী ভেক। ভাবলেও বমি পায়। অথচ ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটার মানে পর্যন্ত বোঝে না তারা। আর বুঝলেও, তা স্বীকার করাটা ভোটের স্বার্থবিরোধী বলে, স্বীকার করার ধারে কাছেও যায় না।

আপনি এই নির্জন টঙে বসে খবরের কাগজে কি লেখা হয় জানেন কি করে?

হাঃ। যে করে, কন্যা চন্দ্রবদনীর হাঁড়ির খবর জানলাম, তোমার হাঁড়ির খবর জানলাম, তাই করে।

এও কি সম্ভব?

সবই সম্ভব। বিশ্বাস চাই। আর সাধনমার্গের এক বিশেষ জায়গাতে পৌঁছনো চাই শুধু।

আপনি কি বলতে চান সকলের ধর্মনিরপেক্ষতাই মিথ্যে বুলি?

ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটার মানে কজন ভারতীয় বোঝে? যারা বোঝে, তারা সকলেই ভয়েই চুপ করে থাকে। তারা ইচ্ছে করে ভুল ব্যাখ্যা করে। সংখ্যালঘুদের ভোট চাই যে। বোঝ না? আরে শালারা এইটাই বোঝে না যে, দেশটাই যদি বেহাত হয়ে যায়, মেয়ে-বৌ যদি ধর্ষিত হয়, বাড়ি-ঘর জ্বলে যায়, এক কাপড়ে নিজের দেশেই সাতপুরুষের ভিটে ছেড়ে আবারও উদ্বাস্তু হয়ে যেতে হয়, তখন কপচানোবুলি দিয়ে আর কী হবে! হিন্দুদের মতন নিপীড়িত জাতি এবং অবশ্যই ইহুদিদেরও মতনও, পৃথিবীতে আর বেশি কি আছে? তবে নিপীড়নের এখনই কি হয়েছে? ভবিষ্যতে যদি বেঁচে থাকো বেশিদিন, তো দেখবে। তখন পালাবে কোথায় আঁতেল ভারতীয়রা? ভারত মহাসাগর আর বঙ্গোপসাগরে কি ঝাঁপিয়ে পড়বে? তাছাড়া তো পালাবার আর কোনও জায়গা নেই হিন্দুদের।

কেন? নেপাল আছে।

হাঃ। নেপালে তো একটি রাজ্যের মানুষই ধরবে না। তাছাড়া, নেপাল কি গোপাল করে রাখবে তোমাদের ভেবেছ?

এ আপনার ভুল কথা মহারাজ।

 ভুল কথা? কেন?

শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে…

সারা পৃথিবীতে দিনে দিনে ইসলামি মৌলবাদ কি কমছে না বাড়ছে? তুমি কি অন্ধ বেটা? শিক্ষা বলতে তুমি যা বোঝাতে চাইছ সেই শিক্ষার সঙ্গে কি অবাঙালি মুসলিম মৌলবাদীদের কোনও সম্পর্ক আছে? তবে? এসব আলোচনার মানে কি?

তারপর বললেন, আমি অনেকই জানি। সব জানি বলার মতন মুখ যেন কখনও না হই। আমার মস্তিষ্ক, মনে করো, একটি স্যাটেলাইট। আমার ধর্মের মাহাত্ম্য, আমার ঐতিহ্য, আমার সাধনাই হয়তো আমাকে এই দান দিয়েছে। সারা পৃথিবীতে বটেই দ্যুলোক ভূলোক স্বর্গলোকে কি ঘটছে কখন তাও আমি বুঝতে দেখতে পাই।

তা বলে, বাবরি মসজিদ ভাঙাটা আপনি সমর্থন করেন কি?

 চারণ বেশ উম্মার সঙ্গেই বলল।

 একেবারেই করি না। নিশ্চয়ই করি না।

তারপরে একটু চুপ করে থেকে বললেন, কিন্তু তুমি কি আমাকে বলতে পারো হিন্দু আর বৌদ্ধরা, এমনকি ক্রিশ্চানেরাও অন্যদের ধর্মস্থান কতবার ভেঙেছে? পৃথিবীর ইতিহাস কি বলে? অতীতে যাবার দরকার নেই। বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রতিক্রিয়া হিসেবে শুধুমাত্র বাংলাদেশেই তো মসজিদ ভাঙার অব্যবহিত পরেই পাঁচশ মন্দির ভাঙা হয়েছে। তসলিমা নাসরিন এই তথ্য তাঁর লজ্জা উপন্যাসে লিখেছিলেন বলেই তাঁর স্বদেশে তাকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। তাকে মৌলবাদীরা খুন করার হুমকিও দিয়ে রেখেছে। সেটার না হয় তবু একটা ব্যাখ্যা করা যায়। মৌলবাদীরা, কাফিরদের পক্ষ নেওয়ায় তাঁকে দেশদ্রোহী আখ্যাও দিতে পারে। বাংলাদেশের রাজনীতিকদেরও ভোট-এর। কথা চিন্তা করতে হয়। তাঁরাও এই উপমহাদেশেরই মানুষ। কিন্তু তার চেয়েও অনেক বড় লজ্জার কথা এই যে, আমাদের মহান ধর্মনিরপেক্ষ ভারত সরকার পাছে মুসলমান ভোট কংগ্রেসের বিরুদ্ধে চলে যায় এই ভয়ে তসলিমাকে ভারতে ঢোকার ভিসা পর্যন্ত দেননি। মেয়েটি তাঁর স্বদেশ এবং ভারত, এই দুই দেশেই সমান অবাঞ্ছিত, সমান অপমানিত, অবহেলিত। বাংলাদেশের যুক্তি যদিও বা। মানতে পারি কিন্তু তসলিমার প্রতি ভারতের এই ব্যবহার নপুংসকতারই নামান্তর। শালার রাজনীতিকরনেওয়ালারা! ভোটে তোদের এতই আঠা! বাঘ-সিংহ চোরেরা সব।

দেবেগৌড়া সরকারও তো দেননি। ভিসা।

না। দেননি।

তারপর বললেন, কলকাতার যে-সব বাঙালি কবি-সাহিত্যিক পাদপ্রদীপের আলোতে আসবার জন্যে তসলিমার চারপাশে মাছির মতো ভন ভন করেছেন একসময়ে, তাঁকে এক মুহূর্তও চোখের আড়াল করেননি, বাংলাদেশে গিয়েও তাঁর ছায়া হয়েছেন, তিনি যখনই এখানে এসেছেন তখনই যাঁরা তাঁর লোকাল গার্জেন বনে গেছেন, তাঁদের মধ্যে একটা কথাও তো বলেননি একজনও? তসলিমার প্রতি এই অন্যায়ের প্রতিবাদে? বলেছেন কি সেই বুদ্ধিজীবীরা? থুঃ! থুঃ! থুঃ! এ শালারা আবার ইনটেলেকচুয়াল। হাসি পায়।

এটা বলা আপনার অন্যায়।

চারণ বলল।

কেন? অন্যায় কেন? কী কারণে অন্যায়?

কবি-সাহিত্যিকদের তো আর ভোটের দরকার নেই। ওঁদের ভয় কিসের?

হাঃ তুমি একখানা ছাগল! ভোটের দরকার নেই কিন্তু বাড়ি-গাড়ির দরকার তো আছে। গ-গ্রিন-এ ফ্ল্যাট, সল্ট লেক-এ জমি, সরকারি দাক্ষিণ্য, পুরস্কার, এ সবেরও দরকার আছে। তাছাড়া বাংলাদেশই এখন বাংলা বইয়ের সবচেয়ে বড় বাজার। এইসব বিস্ফোরক কথা যদি কোনও কবি-সাহিত্যিক বলেন, তাহলে বাংলাদেশ সরকার কখনও যদি মৌলবাদী হয়ে যান তখন তো সেখানে তাঁদের লেখা বই ঢুকতে নাও দিতে পারেন। সেই সব কবি ও লেখক তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার স্বচ্ছ বর্ষাতি গায়ে চাপিয়ে তখন ঝড়-ঝঞ্জা পেরবেন কি করে? খাবেন কি? তাহলে তো বড়ই সর্বনাশ হবে। সত্যি! এই সহজ কথাটুকুও তোমার মগজে ঢোকে না। তোমার মতন এমন মূর্খ ভারতবর্ষে তো বটেই বঙ্গভূমেই বা আর কে আছেন?

তারপর একটু চুপ করে থেকে জিষ্ণু মহারাজ বললেন, বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মতন অসৎ, কুপমণ্ডুক এবং নীচ বুদ্ধিজীবী সম্ভবত পৃথিবীতে আর নেই।

সকলেই? না। একথা মানতে পারলাম না।

চারণ বলল।

হয়তো সকলেই নন। তবে অধিকাংশই।

তবে তাঁরা, মানে সেই সব অসৎ বুদ্ধিজীবীরা জানেন না যে, একদিন জনগণ, প্রকৃত জনগণ, তাঁদের ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দিয়ে তাঁদের যা ন্যায্য প্রাপ্য তাই দেবেন। প্রকৃত দেশদ্রোহী যে সেই বুদ্ধিজীবীরাই এই সরল সত্য প্রকৃত জনগণেরা তখন বুঝতে পারবেন।

চারণ বলল, মহারাজ। আপনারা তো অনেক জানেন। আমার ভুল হলে ক্ষমা করবেন। আমার মনে হয়, আমাদের হিন্দুধর্মে ক্লীবত্বর জয়গান গাওয়া হয়ে থাকে। তাই হয়তো যুগে যুগে কালে কালে আমরা অন্যদের অত্যাচার অবিচার এবং পেশী শক্তির আস্ফালন দেখতে দেখতে নিথর হয়ে গেছি। আমাদের ধর্মে কি অন্যায়কারীদের হত্যা করায় কোনও বাধা আছে? যেসব অন্যায়ের প্রতিকার, শুধুমাত্র অন্যায় দিয়েই করা সম্ভব, সেখানেও কি হিন্দুধর্মে শারীরিক বল প্রয়োগের বিরুদ্ধে কোনও অনুশাসন আছে?

একেবারেই নেই। অন্যায়কারীকে দমন করায় কোনওই বাধা নেই। অন্যায়ের প্রতিকার করার বিরুদ্ধে কোনও অনুশাসন নেই। তোমাকে তো বললামই যে, অজ্ঞতার চেয়ে বড় শত্রু মানুষের আর কিছুই নেই।

মহারাজ বললেন।

 তারপর বললেন, তোমাকে উদাহরণ স্বরূপ বলতে পারি যে, দেশভাগের কিছু আগে নোয়াখালিতে এবং ত্রিপুরাতে দলবদ্ধ এক বিশেষ সম্প্রদায়ভুক্ত গুণ্ডাদের নানাবিধ দানবীয় অত্যাচারের হৃদয়বিদারক দুঃখকাহিনী নানা খবরের কাগজে পড়ে রামকৃষ্ণ মিশনের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক স্বামী মাধবানন্দ ৭ই কার্তিক ১৩৫৩ সনে একটি আবেদন প্রচার করেছিলেন, মুখ্যত পূর্ব-পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত রাজকর্মচারীদের প্রতি, যাতে এই অন্যায়ে তাঁরা প্রকৃত রক্ষাকতার ভূমিকা নেন, দর্শকের নয়।

আপনি জানলেন কি করে?

আমি যে তখন নোয়াখালিতেই। আমার মামাবাড়িতে। এই আবেদন আমি যখন পড়ি তখন আমি সাত বছরের ছেলে। মামাবাড়িতে দুধ-ভাত খেতে গেছিলাম। তার তিনদিন পরে আমার মামা ও মামী দুজনকেই গলা কেটে খুন করে যায় সেই গুণ্ডারা। তার আগে মামীকে ধর্ষণও করে দলবেঁধে আমারই সামনে। সেই প্রথম নগ্নরূপ দেখি কোনও মহিলার। সেই গুণ্ডাদেরও। কিন্তু যা হতে পারত সৌন্দর্যর প্রতীক তাই বীভৎসতার প্রতীক হয়ে রইল আমার চোখে আজীবন। সেই কারণেই আজ অবধি আমি কোনও রমণী শরীরে যেতে পারিনি বেটা। আমার মেজ মামীর কথা মনে পড়ে যায় কেবলই।

তারপর?

রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী মাধবানন্দ সেই অপমানে অপমানিত, অত্যাচারিত, পতিত, ধর্ষিত, বলপর্বত বিবাহের শিকার হিন্দুদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছিলেন যে,

আমরা আশা করি যে, তাঁহারা সর্বশক্তি দিয়া নিজেদের ঘরবাড়ি, বিশেষত কুলনারীগণের মর্যাদা রক্ষা করিতে চেষ্টা করিবেন। ইহাই তাহাদের শাস্ত্রের আদেশ। সাধারণ লোকের কর্তব্য মহাপুরুষের কর্তব্য হইতে সম্পূর্ণ পৃথক। নিশ্চেষ্টতাকে যেন সমদর্শিতা বলিয়া ভুল বুঝা না হয়। প্রাচীন ভারতের মহামহিম স্মৃতিকার মনু..

তারপরই হঠাৎ থেমে বললেন, আমাকেও কেটে ফেলত। একটি দাড়িওয়ালা বুড়োর কী দয়া হয়েছিল। অন্যদের হাত থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়েছিল। কিন্তু মামীকে ওরা তারপরও প্রাণে না মারলেও পারত।

বেঁচে যেতেন?

 হাঃ। যে প্রাণ থাকত সে কি প্রাণ।

 এই অবধি বলেই, মহারাজ জিগ্যেস করলেন মনুর নাম শুনেছ? শোনোনি তো?

তা কেন শুনবে! তোমরা কার্ল মার্ক্স এর নাম শুনেছ। নীটশে, শোপেনহাওয়ার, মাও জেডং-এর। মনুর বা বেদ বা উপনিষদের নামই যদি জানতে তবে কি আর আজ হিন্দুধর্মের এমন অবস্থা হয়! তোমরা জানো না। কিন্তু জামানরা জানে। জিগ্যেস করে দেখো, কোনও শিক্ষিত জামানকে। তোমরা তো বাবা, শিক্ষা যাকে বলে, তা আদৌ পেলে না। ইংরেজদের ছেড়েওয়া পেদো-প্যান্টুলনের মতনই ছেড়ে যাওয়া জুডিসিয়াল-সিসটেমের মোক্তার-উকিল-জজ হয়েছ, নয়তো তেল-সাবানের ফিরিওয়ালা হয়েছ। এই তো হল বাঙালি শিক্ষিতদের শিক্ষার পরাকাষ্ঠা। হাঃ।

তারপর বললেন, মনুর মনুসংহিতার ইংরেজি অনুবাদও পাওয়া যায়। পারলে, পড়ে ফেলল কলকাতাতে ফিরে।

বলুন, যা বলছিলেন।

হ্যাঁ। মনু, আত্মরক্ষার জন্যে আততায়ীকে বধ পর্যন্ত করবার বিধান দিয়েছেন।

বাবাঃ। এতে তো নিজেরও প্রাণহানির আশঙ্কা।

চারণ বলল, স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

বলেইঅবশ্য লজ্জিতও হল।

 জিষ্ণু মহারাজ হেসে উঠলেন, জোরে।

বললেন, মরবে তত বেটা মাত্র একবারই। মরতে যারা ভয় পায় তারাই ক্লীব। মরতে যারা ভয় পায় তারা হয় মুখ নয়তো বেপথে বহুত পয়সা কামিয়েছে। পয়সা যার যত বেশি মৃত্যু ভয়ও তার তত বেশি।

তারপর বললেন, তোমরা যে স্বামী বিবেকানন্দের লেখাও পড়নি। অথচ দক্ষিণ ভারতে যাও, দেখবে তার কদর। বাঙালির মতন আত্মবিস্মৃত জাত সত্যিই আর নেই। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর মহানিবাণতন্ত্রে গৃহী ব্যক্তি শত্রুর সম্মুখে শুরভাব অবলম্বন করিবে এই উক্তির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছিলেন :

শত্রুগণকে বীর্য প্রকাশ করিয়া শাসন করিতে হইবে। গৃহস্থের পক্ষে ঘরের এক কোণে বসিয়া কাঁদিলে আর অহিংসা পরমধর্ম বলিয়া বাজে বকিলে চলিবে না। যদি তিনি শত্রুগণের নিকট শৌর্যপ্রদর্শন না করেন তাহা হইলে তাঁহার কর্তব্যের অবহেলা হইবে।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন, রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী মাধবানন্দ সেই আবেদনে আরও একবার বলেছিলেন,

আমরা নিপীড়িতগণকে জোরের সঙ্গে বলিতেছি যে, মানবজাতির কল্যাণ ভগবানেরই হস্তে, স্বার্থান্ধ ব্যক্তিগণের হস্তে নহে, তাহারা আপাতত যতই শক্তিশালী বলিয়া প্রতীয়মান হউক না কেন। বিগত মহাযুদ্ধে ইহাই প্রতিপন্ন হইয়াছে। জীবনের এক অমোঘ আধ্যাত্মিক নিয়ম এই যে, পাপ এমতাবস্থায় যতই প্রভাব বিস্তার করুক না কেন, পরিণামে তাহাকে নির্মূল হইতেই হইবে। শ্রী ভগবান নিপীড়িতগণকে সাহস ও বল এবং অত্যাচারীগণকে বিচারবুদ্ধি ও মৈত্রীভাব প্রদান করুন।

চারণ বলল, এ তো হাইট অফ উইশফুল থিংকিং। অত্যাচারীগণের বিচারবুদ্ধির জন্যে প্রার্থনা তো এমনই ভণ্ডামি যে, কমুনিস্টরাও লজ্জা পাবে।

তারপর বলল, পঞ্চাশ বছর আগের রামকৃষ্ণ মিশন আর আজকের মিশনে অনেক তফাত হয়ে গেছে, না? আপনি কি বলেন?

হয়তো। এখন রামকৃষ্ণ মিশনের টাকা-পয়সা প্রতিপত্তির অভাব নেই। এখন আন্তজাতিক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে তো মিশন! মিশনও এখন আর হিন্দু নেই, প্রাকৃত নেই, তাও হয়তো দেশের আঁতেলদের মতই হয়ে গেছে। মিশন এখন আন্তর্জাতিক সংস্থা। সামান্য হিন্দুধর্ম প্রচার করাটাই মিশনের অভিষ্ট নেই হয়তো আর।

গরীব হতে পারে কিন্তু ভারত সেবাশ্রম কিন্তু পুরোপুরি দিশিই আছে। তাই না?

চারণ বলল।

তাই। বন্যা বা ভূমিকম্প বা দাঙ্গার পর সবচেয়ে আগে ভারত সেবাশ্রমের সম্যাসীদেরই অবশ্য দৌড়ে যেতে দেখি। গয়াতে পিণ্ডি দিতে গেলেও তারা ছাড়া গতি নেই। ভারত সেবাশ্রম আজও গ্রাম্য, দিশি এবং মূলত হিন্দুই রয়ে গেছে। হয়তো সেই জন্যেই অধুনা ভারতবর্ষে তাই জাতে উঠতে পারেনি। তাই আন্তজাতিক হয়ে ওঠার সাধনাও তাদের নয়। পয়সাই তো এখন জাত-বেজাত পৃথকীকরণের একমাত্র উপায়। তবে, সারা পৃথিবীতে হিন্দু ও ভারতীয় সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারে রামকৃষ্ণ মিশনের অবদান অনস্বীকার্য। এ মিশনে কত প্রগাঢ় পণ্ডিত মহারাজ ছিলেন এবং আজও আছেন। কলকাতাতে গেলে গোলপার্কের আন্তজাতিক ইনস্টিটিউট-এ লোকেশ্বরানন্দ মহারাজের সঙ্গে আলাপ করে এসো। অনেক কিছু শিখতে পারবে। ওঁর একটি বই আছে ইংরেজিতে, স্পিরিচুয়্যালিজম এব উপরে লেখা। স্বামীজীর বক্তব্যই অতি প্রাঞ্জলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন উনি তাতে। বইটির নাম এখন ঠিক মনে করতে পারছি না। আমাকে তোমারই মতো চন্দ্রবদনীজি দেখতে-আসা এক বাঙালি টুরিস্ট দিয়ে গেছিলেন।

এ বইটি অনেকের কাছে রেকমেন্ডও করেছি। কেনার কথাও বলেছি। রামকৃষ্ণ মিশন থেকেই প্রকাশিত।

কী আছে বইটিতে?

যেসব পণ্ডিতম্মন্য মহামূর্খ পৌত্তলিকতা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে, তাদের বাকোধ হয়ে যাবে লোকেশ্বরানন্দজির ঐ বই পড়লে। হয়তো পড়েছেন অনেকে। কারণ, ইংরেজিতে লেখা যে। হায়রে ভারতবর্ষ! কবে যে এদেশ সত্যি স্বাধীন হবে! যথার্থই ভারতীয়দের হবে! স্বামীজির পাণ্ডিত্য ও যুক্তি যে কী প্রকার ছিল তার আভাস পাবে লোকেশ্বরানন্দজির বইটিতে। চটি একটি বই।

চারণ একটা বড় হাই তুলল।

 মহারাজ বললেন, কী হল, এবারে কি শয়নে পদ্মনাভ?

আপনি যা আজ্ঞা করবেন।

 আমি কি তোমাকে এ পর্যন্ত একটিও আজ্ঞা করেছি বেটা?

 না, তা করেননি।

তবে?

 তারপর বললেন, তোমার যখন খুশি তখনই শোবে। চব্বিশ ঘণ্টাতে ঘণ্টা চারেক ঘুমের প্রয়োজন আমাদের। দিনে ঘুমিয়ে নিয়ে সারাটা রাত জেগে থাকাই শ্রেয়। তখন মন মনের ঘরেই থাকে। বিক্ষিপ্ত কম হয়। মানুষের সঙ্গে জানোয়ারের তফাৎ কি জানো? মানুষ ভাবে আর জানোয়ার ভাবে না। ভাবনা চিন্তার ক্ষমতা একমাত্র মানুষেরই আছে।

খুবই ঘুম পাচ্ছিল চারণের। সিদ্ধি ও গাঁজা খাওয়ার জন্যেই। জিষ্ণু মহারাজের কথাতে নয়। তাঁর কথা শুনতে খুবই ভাল লাগছিল। সত্যিই জ্ঞানী মানুষ।

তার হাতঘড়িকে চারণ হৃষীকেশেই নির্বাসন দিয়েছিল। ব্যাটারি যতদিন না শেষ হয় ততদিন চলতেই থাকবে সে কুঅভ্যেসে। চলার আদৌ কোনও প্রয়োজন থাকুক আর নাই থাকুক, শহর-নগরের অগণ্য অভ্যাস-তাড়িত মানুষেরই মতন।

জানোয়ারের ভাববার ক্ষমতাই নেই। তোমাকে ধিয়ানগিরি মহারাজ কি সেই শ্লোকটা বলেছিলেন? উপনিষদের শ্লোক? তাঁর খুবই প্রিয় শ্লোক ওটি।

জিষ্ণু মহারাজ বললেন।

কোনও শ্লোক? আমার সঙ্গে ওঁর আলাপ ভাল করে হতে না হতেই তো চলে এলাম দেবপ্রয়াগে। তারপরে তো উনি সব আলাপই শেষ করে দিলেন।

তাই তো হয়। আলাপ এ সংসারে কার সঙ্গে আর কার হয়? সংসারে, জীবনে, গানের মতন বিস্তারের সুযোগ তো কমই আসে! আলাপেই গান শেষ। একদিক দিয়ে ভালই। বিস্তারে একঘেয়েমিরও জন্ম হয় অনেক সময়ে।

শ্লোকটা কি?

 হ্যাঁ। বলছি।

আহার নিদ্রা ভয় মৈথুনম
 সামান্য মেতাৎ পশুভিরণরানাং।
 ধর্মহি তেষাম অধিকো বিশেষেঃ
ধর্মেনাহীনা পশুভিঃ সমানাঃ।

মানে কি হল?

মানে হল, আহার, নিদ্রা, ভয় এবং মৈথুন এসব পশুরও আছে, মানুষেরও আছে। কিন্তু শুধুমাত্র মানুষরেই ধর্ম আছে। ধর্মহি তেষাম অধিকো বিশেষোঃ

এই ধর্ম মানে কি? চারণ জিগ্যেস করল।

এই ধর্ম মানে, সুযোগসন্ধানী বা অনেক রাজনীতিক ধর্ম বলতে যা বোঝন, তা নয়। এই ধর্ম হিন্দুত্ব, ইসলাম, খ্রিশ্চান বা জৈনও নয়। হিন্দুধর্মর প্রকৃত ধারণা এবং প্রকৃতি অনেকই বড়। গভীরতার সংজ্ঞা সে। তাকে ছোট করেছে কতগুলো অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত পূরুত আর বামুন। ব্রাহ্মণত্ব কাকে বলে তা না জেনেই জানোয়ারের মতন ব্যবহার করে এসেছে অব্রাহ্মণদের সঙ্গে। তাদেরই লাগাতার অত্যাচার এবং স্বার্থান্ধতাতে জর্জরিত হয়ে হিন্দুরা নিজেরাও অনেকই সমযে ধর্মান্তরিত করেছে নিজেদের। হিন্দুধর্মর নিজস্ব দোষও কিছু কম নয়।

আপনার মতে কোনও ধর্ম সবচেয়ে ভাল?

সবচেয়ে ভাল কি না জানি না তবে ইসলাম ধর্ম হচ্ছে সবচেয়ে সোস্যালিস্ট ধর্ম। অমন বিরাদরী, অমন সমতা খুব কম ধর্মের মধ্যেই আছে। সে কারণেই কোটি কোটি নিপীড়িত মানুষ সহজে তার ছত্রছায়ায় গিয়ে জড়ো হয়েছে। যারা আজ দলিত তারা আমাদেরই দ্বারা দলিত। আয়নার সামনে দাঁড়ালে এবং এখনও যদি কিছুমাত্র লজ্জাবোধ আমাদের থেকে থাকে, তবে লজ্জিত হয়ে আমাদের যুগযুগান্ত ধরে সঞ্চিত পাপের কিছুটা লাঘব করা উচিত। কত কোটি দলিত যে এই অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য মুসলমান বা ক্রিশ্চান হয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। যে ধর্মে পৈতে জড়ালেই অন্য মানুষের চেয়ে বড় হয়ে যায় একদল মানুষ, বিন্দুমাত্র গুণ ব্যতিরেকেই, সেই ধর্মেব মারণবীজ হয়ে এসেছে সেইসব উচ্চবংশীয়রাই।

তারপর একটু থেমে বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন না?

মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে
ভাগ করে খেতে হবে তাহাদের সাথে অন্নপান
হতে হবে সবার সমান।

একটু চুপ করে থেকে স্বগতোক্তিরই মতন বললেন জিষ্ণু মহারাজ, এই ভাঙচুর, আসলে শুরু হয়েছে অনেকদিনই হল। দোষটা কোনওদিনও ধর্মের মধ্যে ছিল না। যাহা ধারণ করে তাহাই ধর্ম এই সংজ্ঞাতে বিচার করলে হিন্দুধর্ম নিশ্চয়ই এক মহান ধর্ম। এই ধৰ্মর পরম দুভাগ্য যে অগণ্য। শূন্যকুম্ভ স্বার্থন্বেষী বুজরুকেরা এই ধর্মকে কামধেনুর মতন দোহন করেছে, সাধারণ, ধর্মবিশ্বাসী সরল দেশবাসীদেরও যেমন দোহন করেছে। এই অপরাধে অনেক ভণ্ড গেরুয়াধারীরা যেমন অপরাধী তেমনই অপরাধী ধর্ম যারা মানে তারা পাগল একথা যারা বলে, সেই–মান-যশসম্পন্ন ধান্দাবাজ অপার অশিক্ষিতরাও।

চারণ উঠে দাঁড়াল।

বলল, আমি এবার গিয়ে শুই।

যাও বেটা। ভিতরের দিকে চলে যাও। ঠাণ্ডা কম লাগবে। শেষ রাতে নারীর শরীর যদিও সবচেয়ে গরম হয়ে ওঠে, ধরিত্রীর শরীর সবচেয়ে ঠাণ্ডা হয়। যাও, রাতের পথ ফুরিয়ে এল। একটু পরেই আকাশে অন্ধকার ফিকে হতে শুরু করবে। যাও। তুমি যাও।

কিন্তু যাও বললেই তো যাওয়া যায় না। এতক্ষণে পায়ের নীচে আঠার এক পুরু আস্তরণ জমেছে তা তো বুঝতে পারেনি। এই আঠার রকম অন্য। ও দাঁড়িয়ে উঠতেই ব্রহ্মাণ্ড টলতে লাগল। সিদ্ধি এবং গাঁজার যুগপৎ প্রভাবে তার মধ্যে এমন এক অদ্ভুত ক্রিয়া-বিক্রিয়া চলতে লাগল যে, সে অনুভূতি ও ব্যাখ্যা করতে পারবে না। আশ্চর্য এক ভারশূন্যতার পর মুহূর্তেই অসীম ভার। তারপর মুহূর্তেই আবারও ভারশূন্যতা। একবার শরীর ও মস্তিষ্ককে পাখির মতন হালকা মনে হচ্ছে আবার পরমুহূর্তেই পাথরের মতন ভারী।

কোনওরকমে এক কোণে গিয়ে তার ঝোলাটি যেখানে রাখা ছিল, সেখান থেকে বাঁদুরে টুপি এবং কম্বলটিকে বের করে নিয়ে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল চারণ।

.

১৬.

কোথায় যেন ভোর হচ্ছিল।

পাখি ডাকছে নানারকম।

 চারণ তার মা আর দাদুর সঙ্গে হাজারিবাগে গেছে। গয়া রোডের সেই সুন্দর ছবির মতন বাড়িটি। সামনে মোরব্বা ক্ষেত, গড়িয়ে গেছে হাজারিবাগ লেক অবধি। রিফরমেটরির লাল ধুলোর রাস্তা চলে গেছে। দূরে উলটোদিকে খোয়াই-এর পর খোয়াই পেরিয়ে পাহাড় দেখা যাচ্ছে। সেদিকে ক্যানারি হিল রোডের দুপাশের বড়লোকের বাড়ির কম্পাউন্ডে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ইউক্যাপিলটাসের সারি। ছবির মতন।

চারণের মা ইউক্যালিপটাস গাছ দেখলেই বলতেন, আড়ি। আড়ি। আড়ি।

কেন যে ঝগড়া ছিল মায়ের ইউক্যাপিটাস গাছেদের সঙ্গে চারণ জানে না। একদিন জিগ্যেস করেছিল। মা বলেছিলেন, এসব বড়দের কথা। তুমি বড় হলে বলব কখনও।

কবে যে বড় হবে। ভাবত চারণ। ও বড় হওয়ার আগেই ইউক্যালিপটাস গাছেদের সঙ্গে ঝগড়া এবং চাপা অভিমান নিয়ে মা চলে গেছিলেন যেখানে সকলকেই যেতে হয় একদিন।

মা ডাকলেন, খোকা! খোকা! ওঠ। আর ঘুমোয় না। আমরা মর্নিং-ওয়াক-এ যাব। কোররার মোড়ে গিয়ে গরম গরম জিলিপি আর সিঙ্গাড়া খাব। ওঠ।

কোররার মোড়ের দিকে লাল ধুলো গায়ে-মাখা পথটি চলে গেছে সার্কিট হাউসের উলটোদিকে তারপর পুলিশ সাহেবের বাংলোর কাছে গিয়ে বাঁয়ে মোড় নিয়েছে। তারও পরে কালো পাথরে তৈরি THE GIBRALTER নামের একটি অতিকায় বিশাল ভুতুড়ে দুর্গের মতন বাড়ির পাশ দিয়ে গিয়ে পৌঁছেছে পথ ক্যানারি পাহাড়ের গায়ের কাছে। পোঁছে, ডানদিকে বাঁক নিয়ে কচি কলাপাতা সবুজ শালবনের মধ্যে দিয়ে আবীর-লাল সেই পথ পোঁছে গেছে কোররা। কচি কলাপাতারঙা, টিয়াপাখির ঝাঁক পাইলটকারের মতন যে পথে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় পথিককে।

মায়ের সঙ্গে হাঁটছে চারণ। চৈত্রর শেষ। পেছনে পেছনে হাজারিবাগের সেই বাড়ির বহু পুরনো বিশ্বস্ত দারোয়ান, চমনলাল। যার বাঁ কানটা ডান কান থেকে ছোট এবং যে তার ইচ্ছে হলে শোনে এবং ইচ্ছে না হলে শোনে না।

বসন্তর ভোরে এখানে এখনও শীত-শীত করে। মায়ের গায়ে সেই হালকা মেরুন রঙা হালকা পশমিনা শালটি। সাদা-সিল্কের শাড়ি। মেরুন রঙা ব্লাউজ সিঙ্কের। চারণের গায়ে পোলো-নেক সোয়েটার। ঘন সবুজ রঙা। মেজমামীমা বুনে দিয়েছিলেন আগের বছরের শীতে।

পুলিশ সাহেবের বাংলো ছাড়িয়ে ওরা ক্যানারি রোডে পড়ে, ক্যানারি পাহাড়ের দিকে চলেছে।

 মা বললেন, বড় হয়ে তুই কি হবি রে খোকা?

কী হব?

 তোর কি হতে ইচ্ছে করে?

অনেক কিছু। অনেক কিছু মা।

যথা?

এয়ারফোর্সের ফাইটার পাইলট।

 যাঃ। আর?

আর্মির জেনারাল।

আর?

এঞ্জিনিয়ার।

আর?

ডাক্তার।

আর কিছু?

পিটু মামার মতো চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট।

আরও কিছু?

আর আর আর…মদন মেসোমশাই-এর মতো প্রফেসর।

অন্য আর কিছু?

 তাহলে আমাদের পাড়ার সান্যাল সাহেবের মতন ব্যারিস্টার?

ব্যারিস্টার ছাড়া?

তাহলে জীবনানন্দ দাসের মতন কবি। তুমি সেদিন রূপসী বাংলা পড়ে শোনাচ্ছিলে আমাকে। আঃ মা। কী সুন্দর।

হুঁ।

মা বললে।

ছোট্ট চারণ বলল, আমি কী হলে তুমি খুশি হও মা? তবে কি কবি হব?

সবচেয়ে বেশি খুশি? হ্যাঁরে খোকা?

মা বলেছিলেন।

হ্যাঁ।

খোকা, বাবা, তুই এসবের একটিও নাহলেও আমার একটুও দুঃখ হবে না। কিন্তু আমি সবচেয়ে খুশি হব যদি তুই মানুষ হোস।

মানুষ!

চারণ অবাক হয়ে তার মায়ের হাত জড়িয়ে ধরে বলেছিল, আমি তো মানুষই। আমি কি খরগোস, না বাঁদর?

তোর চেহারাটাই মানুষের মতন। নাক, চোখ, চিবুক, নানান অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। কিন্তু তুই যে মানুষই একথা এখনই বলা যাচ্ছে না। চেহারাতেই মানুষের মতন হোস না কেবল, তুই মানুষের মতন মানুষ হোসরে খোকা। তুই যে প্রকৃত মানুষ এই সত্য তোকে প্রমাণ করতে হবে বড় হয়ে।

মানুষের মতন মানুষ হওয়া কাকে বলে তা চারণ জীবনের পথে এতদূর হেঁটে এসে একটু একটু বুঝতে পারে কিন্তু পুরো যে বুঝেছে সে কথা বলতে পারে না।

মানুষের মতন মানুষ হয়ে ওঠা অত সহজ নয়।

ঘুম ভেঙে গেল নদীস্রোতের শব্দের মতন দুরের সুতরার কোলাহলে। আজ অনেক যাত্রী এসেছেন মনে হয় চন্দ্রবদনীর মন্দিরে। আজ কি ছুটির দিন? তীর্থক্ষেত্রে অবশ্য ছুটির দিন বলে কিছু নেই। তবে এখন শীত পড়ে গেছে তাই বদ্রীবিশাল আর কেদারনাথে বহিরাগত প্যাকেজ-পুণ্যার্থীদের ভিড় কম। তখনও অবশ্য হৃষীকেশের কাছের কুঞ্জাপুরী বা দেবপ্রয়াগের কাছের এই চন্দ্রবদনীতে তাঁরা কেউই যান না। তাঁরা রণপাতে চড়ে মূল গন্তব্যে চলে যান। এবং ঝড়ের বেগে ফিরেও যান। সময় কোথায় সময় নষ্ট করবার।

এখন সেই প্রস্তারাশ্রয়ে কেউই নেই। ধুনিটা তবু জ্বলছে ধিকিধিকি, পুরনো প্রেমের মতন। চিতাশান্তি করার মতন করে কমণ্ডলু থেকে জল ছিটিয়ে তাকে নিভিয়ে দিল চারণ। তারপর সেই কমণ্ডলু নিয়েই মুখ-চোখ ধোবার জন্যে পেছনের অরণ্যাবৃত পাহাড়ে গেল। কার কমল কে জানে! এখানে হিজ হিজ হুজ হুজ সংস্কৃতি এখনও পুরোপুরি শিকড় গাড়েনি।

সকালে পরপর দুকাপ গরম চা না খেয়ে বিছানা ছাড়তে পারত না চারণ কলকাতাতে। এখন সেসব অভ্যেস চলে গেছে। সারা দিনেও এক কাপ চা না খেলেও চলে যায়। পেলে ভাল, না পেলেও হয়। তার বদলে গাঁজা, গুলি খায় বটে, কিন্তু সৌভাগ্যবশত সেসবেও এখনও পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়নি। সবরকম অভ্যাসই দাসত্ব যে, একথাও এইসব সাধুসন্তদের সঙ্গে মিশেই জেনেছে। জেনেছে তো অনেকই কিছু কিন্তু তার কতটুকুই বা গ্রহণ করতে পেরেছে!

কে জানে! আজ শেষ রাতে বহুবছর আগের হাজারিবাগের সকালের সেই স্মৃতি স্বপ্ন হয়ে কেন ফিরে এল। এই স্বপ্নের কি মানে আছে কোনও? ও যে মানুষ হতে পারেনি এখনও তাই কি ওরে চলে-যাওয়া মা স্বপ্নে দেখা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন?

হাত-মুখ ধুয়ে ফিরে আসতেই দেখল, তুরতি একটা বড় গ্লাসে করে চা নিয়ে তা থেকে ছোট মাটির ভাঁড়ে একটু একটু করে ঢেলে ঢেলে খাচ্ছেন। তা, কেন করছেন তা বোধগম্য হল না। চারণ কাছে আসতেই বললেন, নিন দাদা খান। এই যে কুলহার।

.

বলেই, পাশে রাখা আরেকটা ছোট মাটির ভাঁড় বের করে তাতে ঢেলে চারণকে এগিয়ে দিলেন। এখানে ভাঁড়কে কুলহার বলে।

জিষ্ণু মহারাজ কোথায়? চারণ শুধোল।

উনি তো সারা রাত ধ্যানে থাকেন। এখন ঘুমোচ্ছেন। উঠে আসবেন অবশ্য এখুনি। ঘণ্টা চারেক ঘুমোন।

কোথায় ঘুমোন?

একটি পাথরের চাতাল আছে। খাদের পাশে। শীত, গ্রীষ্ম ওইখানেই কাটে সকালবেলায়। বষাতে অবশ্য এই ডেরারই এক কোণে শুয়ে পড়েন। তবে ঘুমটি ওঁর, আমার আপনার মতন নিত্যদিনের অভ্যাস নয়। কখনও সপ্তাহ বা মাসও ঘুমোন না। একই আসনে বসে থাকেন চোখ কুঁজে। চারপাশে আমরা খাই, ঘুমাই, হাসি। সূর্য ওঠে সূর্য ডোবে। চাঁদ ফোটে চাঁদ ববাজে। তাঁর চারধারে এই পৃথিবী ও পৃথিবীর সবকিছুই আবর্তিত হয় কিন্তু তিনিই স্থবির থাকেন। গোলমালে ওঁর ধ্যানের কোনও বিঘ্ন ঘটে না।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বলেন, আপনি-আমি এঁদের কাছে থাকতে পারি মাসবছর কিন্তু এঁদের মতন হতে দু-এক জনম পার করে দিতে হবে। কে জানে! এঁরা হয়তো অনেক জন্ম ধরেই এইরকম জীবনযাপন করছেন, তাই আজ এই সিদ্ধি।

তারপরে নিজেই বলল, মারুন গুলি। ওঁদের সিদ্ধি ওঁদেরই থাক। আর আমাদের সিদ্ধি থাক আমাদের।

একটু চুপ করে থেকে তুরতি বলল, শান্তিনিকেতনী কায়দাতে যেমন করে বলে, কাল লাগল কেমন? এবং উত্তর হয় ভাল-ও-ও-ও।

তারপর বললেন, আজ আরেকটা গুলি বেশি দেব।

তারপর আবার একটু চুপ করে থেকে বললেন, বুঝলেন দাদা, সব নেশাই করে দেখলাম। সোনাগাছিতে থাকাকালীন নানারকম বাবু দেখেছি তো! স্কচ-খানেওয়ালা যেমন দেখেছি আবার চুল্লু-পিনেওয়ালাও দেখেছি। সব বাবুর সঙ্গেই সঙ্গ করেছি। কালো-ফর্সা রোগা-মোটা বাঙালি-মাড়োয়ারি-বিহারি-ইউপিওয়ালি-নেপালি ইত্যাদি সবরকম মেয়েছেলের সঙ্গেও ও কম্মা করেছি। ফুর্তি যতরকম হতে পারে, করে নিয়েছি। কিন্তু সিদ্ধির মতন নেশা নেই। বুয়েচেন দাদা। সাধে কি মহাদেব ওই নেশা করেন! ভাল করে সিদ্ধি খান, দেখবেন, আপনার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আর আপনার নেই। হাপিস হয়ে গেছে। আপনি পায়ের বুড়ো আঙুল দেখতে পাচ্ছেন। অথচ সে বলছে সে আপনার নয়। ইয়েস স্যার। সে আপনার নয়!

ফ্যাক্ট! এমনকি, কী আর বলব, আপনার সাধের ধনও আপনার নয়।

এমন কথা শুনেছেন কখনও?

 কিন্তু কথাটা সত্যি। ভাল করে খেয়ে দেখবেন আপনি, পেরকিতই অধন হয়ে যাবেন।

তারপরই, কী যেন মনে পড়ে যাওয়াতে বললেন, সেই রবিঠাকুরের একটা গানের লাইন ছেল? অধনেরও হও ধন?

 হ্যাঁ। চারণ বলল।

তুরতি বললেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথ সিদ্ধির নেশা কীরকম ডেঞ্জারাস হতে পারে তা বিলক্ষণ জানতেন। ছেলেবেলাতে কুস্তি-মুস্তি লড়তেন তো! হয়তো তখন চাকরবাকরে খাইয়ে দিয়ে থাকবে কখনও তেনাকে! আর হয়তো জানতেন বলেই ওই কলিটি লিখেছিলেন। আপনার কি মনে হয়? মানে, কী বলেন?

আমি আর কী বলব?

চারণ স্তম্ভিত হয়ে বলল। একবার ভাবল, তর্ক করে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ইয়ার্কি অসহ্য লাগে। তারপরই ভাবল, কি লাভ? তুরতি হচ্ছে প্রকৃত সিদ্ধপুরুষ, সর্বার্থেই সিদ্ধ বাবা। তাকে জ্ঞান দেয় অমন জ্ঞান চারণের কোথায়?

একটু চুপ করে থেকে তুরতি বললেন, তবে একটা কথা বলব, নিজের সম্বন্ধে প্রশংসার কথা, তাই বলতে একটু লজ্জা করছে, কিন্তু কথাটা সত্যি।

কি কথা?

এই যে সব পুণ্যার্থীরা আসে, এত পুজোপাঠ করে, তাদের তো বটেই, অনেক সাধু-সন্ন্যাসীর জ্ঞানও আমার চেয়ে অনেক কম।

কি ব্যাপার? মানে, কোনও বিষয়ে?

কোনও বিষয়ে নয়! তাই বলুন? ধরুন এই যে দুব্বো ঘাস দিয়ে দুটি ঘাসের মধ্যে ছোট ঘাসটি ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে সকলেই পুজো করে, তা কেন করে বলতে পারেন?

চারণ অবাক হল। বলল, তাই করে বুঝি?

করে না? পুজো মণ্ডপে দেখেননি যে, মা লক্ষ্মীরা সব চান করে উঠে নতুন শাড়ি পরে এসে সাতসকালে ফল কাটে আর দুর্বো ছেঁড়ে বসে বসে, পুজোর আয়োজন সম্পন্ন করতে?

ও হ্যাঁ হ্যাঁ। দেখেছি তো!

চারণ বলল।

তা দেখেছেনই যদি, কখনও কি মনে এ প্রশ্ন আপনার জেগেছে যে, কেন দুব্বোর মধ্যিখানটার ছোট ঘাসটি ছিঁড়ে ফেলে দিতে হয় দেব-দেবীর পুজোর যোগ্য করে তুলতে?

না, তা জাগেনি।

জানার ইচ্ছার, অর্থাৎ জিগীষার আরেক নামই তো শিক্ষা! বুয়েচেন স্যার? যার জিগীষা মরে গেছে, সে মালকে আমি অন্তত শিক্ষিত বলে মানি না।

মানা উচিতও নয়। তাহলে আপনিই বলুন, কেন দুব্বোর মধ্যিখানের ছোট ঘাসটি ছিঁড়ে তারপর পুজোতে দেওয়া হয়?

চারণ বলল।

শুনুন স্যার। এবারে আমি যে গুপ্ত কথাটি বলচি আপনাকে, সেটি যেন আবার কারওকে বলে দেবেন না। আর যদি কখনও বলে দেনও এই তুরতি বাবার নাম না করে বলবেন না যেন। কোনওদিন দেখব এই ফোরটোয়েন্টি দুনিয়াতে আমারই জ্ঞান অন্যের জ্ঞান হয়ে আমার কাছে বেয়ারিং চিঠির মতন ফিরে এল।

না, বলব না। মানে, বললেও আপনার নামোল্লেখ করেই বলব।

কথা দিচ্ছেন তো?

দিচ্ছি।

তারপরই বললেন, খিদে পেয়েছে নাকি?

তা একটু পেয়েছে বৈ কি। কাল রাতেও সিদ্ধি আর গাঁজা ছাড়া কিছু খাওয়া হয়নি।

তবে চলুন গরম গরম পুরী-কচৌরি খেয়ে আসি। জিলিপিও খাবেন। তবে আমাদের হাতিবাগানের বেকা খচ্চরের দোকানের মতন জিলিপি ভূ-ভারতে আর কোথাও খেলাম না। দাদ চুলকে ঘেমো গামছা চিপে যে কী কায়দাতে বানাত তা সেই জানত! তার জুড়ি নেই।

তাই?

নয়তো কি?

এবারে বলুন।

আমাদের তো আর সিদ্ধি হয়নি যে খিদের সময়ে না খেয়ে থাকলে চলবে? কী বলব দাদা! কাম বলে একটা সুন্দর, মনোরম ধনারাম ব্যাপার ছেল, সে তো ভুলেই গেছি! তাবলে ক্ষুধা-তৃষ্ণাও ভুলতে যাব কোনও দুকে? গুরু কি আমাকে তরিয়ে দেবেন? নিজে তরে যাবেন তো ঠিকই। সঙ্গে থোড়িই নেবেন! তবে আর অত ইয়ে কিসের!

মন্দির থেকে যে সিঁড়িগুলো নীচের দিকে নেবে গেছে সেই সিঁড়িরই পাশে ছোট্ট দোকান হালুইকরের। এখানে কোথা থেকে দুধ আসে, কে ঘি ময়দা চিনি বয়ে নিয়ে আসে, কে জানে। কিন্তু আসে। সবই আসে। এই পৃথিবীতে কে যে কী, কেমন করে কোথায় জোগায় তা ভাবলেও আশ্চর্য হতে হয়। তবে এ দোকানে বেশি খদ্দের হয় না। খাওয়া-দাওয়া যাদের করবার আছে তারা নীচ থেকেই করে আসে। চন্দ্রবদনীজির কাছে কজন সাধু আর থাকেন। লোকে বলে, রাতে এখানে থাকলে মানুষ মরে যায়। প্রকৃত সাধু আর আমার মতো প্রকৃত অসাধু ছাড়া এখানে তিষ্টায় এমন সাধ্য কার?

চারণ হাসল, তুরতির কথা শুনে। ও ভাবছিল, তুরতি সত্যিই ক্ষেমিবাঈজির মেয়েকে নিয়ে ব্যয়লা বাজিয়েছিল কি না জানে না তবে মানুষটি খুবই ইন্টারেস্টিং। চারণের সন্দেহ হয় যে, তুরতির অজ্ঞতা অশিক্ষা এসবই হয়তো একটা ভেক। সংসারে অধিকাংশ মানুষই পাণ্ডিত্যের ভেক ধরে বিজ্ঞর ভেক ধরে। কিন্তু অবহেলে যারা অশিক্ষিত ও মূর্খর ভেক ধরতে পারে তাদের শিক্ষা এবং জ্ঞানের হয়তো সীমা নেই।

সিঁড়ি নামতে নামতে ভাবছিল চারণ যে, সংসারে কোথায় যে কার জন্য কে লুকিয়ে থাকে, গর্তের মধ্যের সাপের মতন, পোকার মতন, দুই পাথরের মধ্যের ছত্রাকের মতন, পাহাড়তলির উপত্যকার ফিকে বেগনি ফুলের মতন, ফরগেট মি নট এর মতন, তা আগে থাকতে কে বলতে পারে। ভাগ্যিস বেরিয়ে পড়েছিল ঘর ছেড়ে। তা নইলে কি ভীমগিরি, ধিয়ানগিরি, নবীকৃত শুদ্ধ পাটন, দেবপ্রয়াগের উচ্চকোটির সব সাধু-সন্তেরা, চন্দ্রবদনী, তার পরিবারের সকলে, রওনাক সিং, চুকার, এই চন্দ্রবদনীজির মন্দির সংলগ্ন জিষ্ণু মহারাজ আর তাঁর এই ওরিজিনাল চেলা তুরতির সঙ্গে দেখা হত। বেরিয়ে পড়াটাই হচ্ছে আসল। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লে আর চোখ কান খোলা রাখতে পারলে বোধহয় পৃথিবীর সমস্ত অধীত জ্ঞানবিদ্যাই অপ্রত্যক্ষভাবে আয়ত্তে আসে।

বসুন।

তুরতি আজ্ঞা করলেন।

তারপর নিজের খুশি মতন খাবার অর্ডার করে বললেন, গুরুর জন্য এক কেজি রাবড়ি নিয়ে যাব। রাবড়ি নিয়ে গেলে আনন্দ করে খান। তবে লোভ নেই কোনও জিনিসেরই উপরে।

বলেই বললেন, আমার সঙ্গে পয়সা-টয়সা নেই কিন্তু। ওসব আমি রাখি না। টাকা-মাটি মাটি-টাকা। রামকৃষ্ণদেব পড়েছেন? হাতের কাছে মেড-ইজি থাকতে কী করতে যে আপনারা এতদূর ঠেঙ্গিয়ে আসেন, কে জানে তা! উনি বেঁচে থাকলে তো আমি ওখানেই ফিট হয়ে যেতাম। এতদূরে থোড়াই আসি!

একটু চুপ করে থেকে তুরতি বললেন, অন্য কথাতে যাবার আগে খোলসা করে বলে দিই দাদা যে, দামটা কিন্তু আপনিই দেবেন। নগদ না থাকলে দোকানি ধারেও দেবে। আমার অ্যাকাউন্ট আছে এ দোকানে।

আপনার সঙ্গে টাকা পয়সাই নেই তাহলে অ্যাকাউন্ট কিসের?

বাঃ। অ্যাকাউন্ট না থাকলে হিসেব থাকবে কি করে? যখন বেশি টাকা হয়ে যায় তখন আপনার মতন মালদার কারওকে ঠাকুর পাঠিয়ে দেন। তিনিই অ্যাকাউন্টটা ক্লিয়ার করে দেন। তারপর দিন থেকে আমার জমা শুরু হয়।

ঠাকুর মানে?

ঠাকুর মানে ঠাকুর রামকৃষ্ণ নন। ক্ষেমি বাঈজির বাড়িতে যে রান্না করত সেই শক্রয় ঠাকুর। ওড়িশার ঢেনকানলে বাড়ি।

সে পাঠিয়ে দেয় মানে?

আরে তার মতো মহাত্মা আমি আর দুটি দেখিনি। মহাত্মা হতে হলেই কি আর গঙ্গার পাড়ে বা হিমালয়ে এসে থাকতে হয় সংসার ছেড়ে? অমন ঠাকুর আর দেখিনি। আহা। আমার প্রাণের ঠাকুর। জিষ্ণু মহারাজ-ফহারাজের কোনও তুলনাই হয় না তাঁর সঙ্গে। তাঁকে নিয়ে আমি একটি বই। লিখে তাঁকেও ওয়ার্ল্ড-ফেমাস করে দেব।

তাঁর কথা বলুন না, শুনি।

দু-এক কথাতে তাঁর কথা বলা তো যাবে না স্যার। মাসবছর লেগে যাবে। সত্যিই বলছি, অমন মহাত্মা বড় একটা দেখা যায় না। উনিই তো আমাকে মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে পালিয়ে যেতে বললেন, নইলে, সেইদিন সকালেই কাল্লু মিঞাকে দিয়ে ক্ষেমি আমাকে কোতল করাত।

পুরী কচৌরি খেতে খেতে চারণ বলল, সেই দুব্বো ঘাসের রহস্যটার কি হল?

বলব, বলব। খেয়ে নিই আগে। গত দুদিন শুধু গুরুর বাক্যি শুনেছি আর খালি-পেটে সিদ্ধি খেয়েছি। পেটে আগুন জ্বলছে। অম্বলের ঢেকুরে জেরবার হয়ে গেলাম। এইসব দেবস্থানে কোনও অ্যান্টাসিডের এজেন্সি নিলে লালে লাল হয়ে যাওয়া যেত। আমার নেহাৎ পয়সার দরকার নেই বলেই নিই না।

কেন?

পয়সার দরকার নেই কেন?

কী দরকার?

আপনারাই তো আমরা পয়সা! কোনও মুখ নিজে হাতে টাকা ধরে হাত নোংরা করে? কত রোগের বীজাণু আছে এক একটি নোট-এ তা কে জানে!

চারণ চুপ করে ছিল।

ওর মধ্যে কলকাতায় ফেরার ইচ্ছাটা কেবলই তীব্র হচ্ছিল। কিছুদিন থেকেই ইচ্ছাটা জাগরুক হয়েছে। ক্রমশই তা গতিজাড্য পাচ্ছে। ওর এই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল ও এই গাড়োয়াল হিমালয়ের এই চন্দ্রবদনীর মন্দিরের পদতলের হালুইকরের দোকানে তুরতি নামক এক ঘোর সন্দেহজনক চরিত্রের মানুষের সঙ্গে বসে আছে কিসের জন্যে?

কী হল? চুপ করে গেলেন যে!

তুরতি বলল।

নাঃ। এমনি। আচ্ছা আপনি এইখানে এসে জুটলেন কেন বলতে পারেন? নিজের কাছ থেকে পালাবার জন্যে কি কলকাতা ছেড়ে এই এত দূরের চন্দ্রবদনীতে আসা খুবই জরুরি ছিল?

দূরত্বটা তো মনের! পথের দূরত্বটা কোনও ব্যাপারই নয়। শেওড়াফুলিতে থেকেও এর চেয়ে দূরে যাওয়া যেত।

চারণ একটু বিরক্তির সঙ্গেই বলল।

আপনিই বা এলেন কেন?

এই বুড়োকে দুরস্ত করতেই এসেছিলাম।

কোনও বুড়ো?

এই মিস্টার জিষ্ণুকে।

সে কী! দুরস্ত করতে মানে?

 হ্যাঁ। মানে যা, তাই।

উনি আমাকে চিনতে পারেননি। কিন্তু উনি আমার চেয়েও আরও বড় পাপী। তবে সাধু-সাধু খেলা করতে করতে সে সত্যিই সন্ত বনে গেছে। কী কেলো। কে কেলো। সেই ব্যাধের গল্পের মতন। অনেক সন্ত-এর চেয়ে বড় সন্ত। সে কারণেই ওঁকে দুরস্ত করতে এসে আমিও ওঁর চেলা বনে গেছি। নইলে আমি কম্যুনিস্ট, আমি এখানে থাকতে যাব কেন মৌরসী পাট্টা গেড়ে?

তারপর বলল, জানেন কি? আপনাদের এই জিষ্ণু মহারাজও একসময়ে কট্টর কমুনিস্ট ছিলেন। আর আজ কমুনিস্টদের নাম সহ্য করতে পারেন না। আমার সঙ্গে জিষ্ণু মহারাজের লড়াইটা ওই সমতলের। আমি জানতে চাই, জানাতেও চাই। আমাকে বোঝাতে না পারলে, আমি ফিরতে রাজি নই।

চারণ অবাক যত না হল তার চেয়ে বেশি বিরক্ত হল। ভাবল, সকলেই মনে করে যে সে ক্যুনিস্ট, কারণ সেটা ফ্যাশনেবল তাই। কম্যুনিজম-এর মানে বোঝে কজন? তাছাড়া ক্যুনিস্ট হওয়াতে দোষের কি আছে? গণতন্ত্রে প্রত্যেক মানুষেরই পূর্ণ অধিকার আছে তার নিজ মত ও পথে চলার, তার পছন্দমতো দলকে সমর্থন করার। এতে দোষের বা গুণের তো কিছু নেই!

তুরতি হঠাৎ বললেন আপনি মার্কস পড়েছেন?

 কার্ল মার্কস?

অবাক হয়ে বলল, চারণ।

হ্যাঁ হ্যাঁ। আবার কটা মার্কস আছে রে বাবা!

পড়েছিলাম, ছাত্রাবস্থাতে। আপনি পড়েছেন? মার্কস কি বলেছিলেন, জানেন?

 চারণ, একটু বিদ্রুপের গলাতেই বলল।

 এত লোকে জানে আর আমি জানব না?

তুরতি বলল, কচৌরি চিবোত চিবোতে।

তারপরই কাঁচা-পাকা খোঁচা-খোঁচা দাড়িওয়ালা মুখে, জটাধারী, গেরুয়া-পরা জিষ্ণু মহারাজকে গাঁজা সেজে-দেওয়া তুরতি হঠাৎই চারণের দিকে ফিরে বলল, Communism is the positive abolition of private property, of human self-alienation and thus the real appropriation of human nature, through and for man. It is therefore, the return of man himself as a social, that is real human being, a complete and conscious return which asimilate all the wealth of previous development.

কার্ল মার্কস আঠারশ চুয়াল্লিশে লিখেছিলেন।

বলল, তুরতি।

চারণ একটু উত্তেজিত হয়ে বলল, আপনি নিজের পরিচয় ভাঁড়ান কেন? আপনার ইংরেজি উচ্চারণ তো চমৎকার।

বাঃ। শুধু আপনারটাই চমৎকার হবে?

উলটে বলল তুরতি।

তারপরই বলল, আরে আমি কি একা নাকি? ভাঁড়ামিতে? এই সাধু-সন্ন্যাসীদের সকলেই তো পরিচয় ভাঁড়িয়েছেন। সকলেই চক্ষু নিমীলিত করে মুখে বলেন, পূর্বাশ্রমের কথা জিগ্যেস করবেন না।  আমি অসাধু বলেই বা আমার পূর্বাশ্রমের কথা বলতেই হবে কেন আমার? যাক গে। এসব কথা।

হ্যাঁ।

যাক গে এবার শুনুন দুব্বো ঘাসের রহস্য।

বলুন শুনি।

সমুদ্রমন্থন হচ্ছে, বুঝলেন। হিন্দু দেবতারা চিরদিনের খচ্চর। তারা মৈনাক পর্বত বেষ্টন করা নাগ বাসুকির ন্যাজ এর দিকে ধরেছে আর দানোদের দিয়েছে বাসুকির মুখের দিকে। মন্থন যতই এগোয় ততই বাসুকির মুখ থেকে বিষ, অর্থাৎ হলাহল বেরোতে লাগল। তাই দেখে তো দেবতাদের অবস্থা কাহিল। মন্থন বন্ধ হয়ে যায় আর কী। একজন তখন বললে, আরে, বাঁচতে চাস তো ডাক ডাক মহাদেবকে ডাক। সে ছাড়া আর কেউ বাঁচাতে পারবে না। মোটাসোটা মহাদেব লুঙি ঢিলে দিয়ে বসে গাঁজাতে দম দিচ্ছিলেন এমন সময়ে দেবতাদের ভগ্নদৃত গিয়ে বলল, স্যার বাঁচান। আপনি ছাড়া উপায় নেই।

মহাদেব তখন লুঙির কষি টাইট করে নেমে এসে চোঁ-চোঁ করে হলাহল পান করে নীলকণ্ঠ হলেন। তারপর আবার চলে গেলেন কৈলাসে।

কিছুক্ষণ পরে মহাদেবের এক চামচে, নন্দী-ভৃঙ্গীদের মধ্যেই কেউ হবে, হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল, গুরু! বিষ খাবার সময়ে তুমি আর ভাল ভাল যা মাল বেরোল সে সব অন্য দেবতারা সব ঝেপে দিলে! তুমি চলল। এতক্ষণে মণি-মাণিক্য ধনরত্ন এমনকি অমৃত পর্যন্ত নিশ্চয়ই সবই শেষ হয়ে গেছে। এটা কি পৃথিবী হয়ে গেল।

তারপর?

 চারণ বলল, তুরতির গল্প বলার আকর্ষণীয় ঢঙে মুগ্ধ হয়ে।

তারপর আর কি? সমুদ্রতটে মহাদেব পৌঁছে দেখলেন সত্যিই তো তাই! সী বীচ একেবারে সুনশান। শুধু দূরে একটি সুন্দরী মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

চামচে বলল, গুরু, আর যখন কিছুই নেই তখন ওই সাঁটুলিকেই ধরো।

ঠিক বলিচিস, ঠিক বলিচিস। বলে, মহাদেব তো তাকে ধরার জন্য দৌড়তে লাগলেন। কিন্তু মোটা-সোটা হাবলু-গুবলু দেবতা তন্বী-তরুণীর সঙ্গে দৌড়ে পারবেন কেন? এদিকে লুঙিও খুলে যায় আর কী। দেবতারা তো আর ব্রিফ পরেন না। হাইলি কেলো ঘটঘট, এমন সময়ে মহাদেব দাঁড়িয়ে পড়ে, দাঁড়িয়ে পড়ে, দাঁড়িয়ে পড়ে…

কি হল?

 নাঃ আর বলা যাবে না।

কেন?

নাঃ। অশ্লীলতার দায়ে পড়তে হবে। এর পরে অনেকখানি আছে গল্পের। কিন্তু বলা যাবে না।

এ আবার কি কথা?

না সত্যি বলছি। বলা যাবে না।

 কোথায় দুব্বো ঘাসের রহস্য আর কোথায় সমুদ্রতটে দাঁড়িয়ে থাকা মহাদেব আর তন্বী তরুণী…

আরে দাদা! সে কি অর্ডিনারী তরুণী নাকি? নারায়ণ তখনও মোহিনী বেশ ছাড়েননি যে। আসলে তরুণীরূপী নারায়ণ। তারও হাতে তো সুদর্শন চক্র। মহাদেবের যে কোনও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খচাখচ করে তিনিও কেটে দিতে পারেন যে!

তা তো বুঝলাম। কিন্তু দুব্বো ঘাসের সঙ্গে এসবের কি সম্পর্ক?

বললাম না। আর বলা যাবে না। ইমপসিবল। আপনার সঙ্গে আলাপ যদি আরও অনেক ঘনিষ্ঠ হয় তখনই শুধু বলা যেতে পারে। এখন থাক।

বলুনই না। প্লিজ বলুন। সত্যিই তো ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি দুব্বো ঘাস ছিঁড়ে পুজো করতে। কিন্তু কেন? তা তো সত্যিই কখনই মনে হয়নি।

শুনবেন? কলজের জোর আছে? আছে। আছে।

 ঠিক আছে। কিন্তু আরও সরে আসুন কাছে। অন্য কেউই যেন না শুনে ফেলে।

এই এলাম। এবারে বলুন।

 তুরতি বললেন, না। বললাম না আর এগোনো যাবে না। সত্যিই।

 চারণ ভাবছিল, হিন্দুধর্মের এই মুক্তির দিকটা নিয়ে কখনওই ভাবেনি আগে। আমেরিকান ডেমোেক্রসির মতন। ফ্রিডম অফ স্পিচ নিয়ে কোনওই সন্দেহ নেই। অন্য খুব কম ধর্মাবলম্বীরাই হয়তো এমন স্বাধীনতার দাবি করতে পারেন। তাঁদের উপাস্যদের তারা সম্মানিত করতেই শিখেছেন, আপন করে উঠতে পারেননি। হয়তো কখনও পারবেনও না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *