দেখতে দেখতে প্রায় সপ্তাহখানেক কেটে গেল। মনে হচ্ছে, মন বসে গেছে এই হৃষীকেশে।
এক বিকেলে, চা খাওয়ার পরে, চারণ তার তিনতলার ঘরের লাগোয়া বারান্দাতে দাঁড়িয়েছিল।
নীচের পথ দিয়ে সাংঘাতিক আওয়াজ করে বাস, ট্রাক, গাড়ি, অটো ছুটে চলেছে। অধিকাংশ যাবে দেবপ্রয়াগ, রুদ্রপ্রয়াগ, কর্ণপ্রয়াগ, কেদারনাথ, নয় বদ্রীনাথ, যমুনোত্ৰী, নয় গঙ্গোত্রী। কত জায়গায়ই না মানুষ যাচ্ছে। আর কিছু যাবে দেরাদুনের দিকেও। এখানে বিভিন্ন যানবাহনের এই আগ্রাসী আওয়াজটাই বড় বিরক্ত করছে। একবার ভাবল, বিকেলের দিকে ম্যানেজারকে বলে ঘর বদলে পিছন দিকের ঘরে চলে যাবে। আবার ভাবল, তা হলে তো ঘরে বসে এবং নিজস্ব বারান্দাতে বসে গঙ্গা দেখতে পাবে না। ওপারের গহন অরণ্যানী, হিমালয়ের পাদদেশে খাঁজে খাঁজে জমাট বাঁধা রুখু উত্তুঙ্গ শিবালিক পর্বতমালা।
তারপর ভাবল, ভেবে দেখবে বিকেলে, কী করবে! তাড়া নেই কোনও সিদ্ধান্ত নেবার।
চারণ ভাবছিল, এই যে এত মানুষে ছুটছেন, কেউ পুণ্য করতে, কেউ বেড়াতে। তাদের মধ্যে সকলেই কি তাদের এই মত্ততার মানে খুঁজেছেন? বা, খুঁজলেও পেয়েছেন খুঁজে? তাঁদের সমস্ত আনন্দ কি ধেয়ে গিয়ে বুড়ি ছোঁয়ারই মধ্যে? বুদ্ধু সিং যেমন বলছিল?
তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই কি শুধুমাত্র দেশ বেড়ানোর বা তীর্থস্থানে যাবার শ্লাঘার জন্যই যাচ্ছেন? ঘামণ্ড এরই জন্যে? গতিমাত্রই, গন্তব্যমাত্রই, সে বন-পাহাড়ের গন্তব্যই হোক কী মন-পাহাড়ের; পৌনঃপুনিক যতি বিনা যে নিতান্তই অর্থহীন হয়ে যায়, তা কি তাঁরা জানেন? কে জানে! হয়তো এই অগণ্য ধাবমান নারী-পুরুষের মধ্যে কেউ কেউ জানেন। অবশ্যই জানেন। তবে অধিকাংশই হয়তো জানেন না।
চমৎকার ঘুম হল দুপুরে। দুপুরে ঘুম! অভাবনীয়। প্রায় তিনটে অবধি ঘুমোল চারণ। তারপরে উঠে, হোটেলেরই প্যাডে সেদিনের ঘটনাবলী সংক্ষেপে লিখে রাখল। সেদিনের নয়, এখানে আসা অবধি যা কিছু ওর মনে দাগ কেটেছে সেই সব। সফল কবি বা সাহিত্যিক হওয়া হয়নি কিন্তু জাগতিকার্থে সফল মানুষ হয়ে, সেই আনন্দে ডগমগ হয়ে, কলকাতার বিভিন্ন ক্লাব, লায়ন্স ক্লাব এবং রোটারিতে এলিট সমাজে দশজনের ঈষার কারণ হয়ে জ্বলজ্বলে তারার মতো সে বিরাজ করেছে।
এইটাই হাইট অফ অ্যাচিভমেন্ট। এবং এইটা ট্রাজেডিও বটে।
তবে সুখের কথা এইটুকুই যে, চারণ অবশ্যই বোঝে যে তার এই চোখ-ঝলসানো সাফল্য ট্রাজেডি ছাড়া আর কিছুই নয়। এই সহজ সস্তা সাফল্য যে ওর প্রার্থিত নয়, ও এই সরল সত্যটা যে বুঝেছে সে কারণেও কৃতজ্ঞ থাকে। তবে এ কৃতজ্ঞতা যে কার কাছে সেটা স্পষ্ট বোঝে না।
হোটেল থেকে যখন বেরুল তখন রোদের তেজ কমে এসেছে। কিছুটা এগোতেই দেখল পথের বাঁদিকের একটি আশ্রম থেকে অতি অল্পবয়সী এক সাধু বেরুল, বন-থেকে-টিয়ে বেরুনোর মতন। তার বয়স বেশি নয়। হয়তো বাইশ-তেইশ হবে। পরনে ইস্ত্রি করা রক্তচন্দন-রঙা টেরিকটের ধুতি, লুঙির মতন করে পরা এবং তার উপরে পাঞ্জাবি। টেরিকাটা চুল। ঘাড়ের পেছনটাতে কোনও দক্ষ হাজাম-এর সযতনে ডিজাইন করা ছাঁট। ইনি টালিগঞ্জের অধম-কুমার না সন্ন্যাসী বোঝা দুষ্কর। লম্বা জুলফি। বাঁ হাতে একটি টাইটান ইন্ডিগ্লো ঘড়ি। পাছে ঘড়িটা দেখা না যায়, তাই বাঁ হাতের পাঞ্জাবির হাতাটি একটু গোটানো।
সন্ন্যাসীসুলভ পোশাক-আশাক না থাকলেও হৃষীকেশের যাত্রী মাত্রই যে সন্নিণী অথবা পুণ্যার্থী এমন ভেবে নিয়ে তিনি চারণের কাছে পেছন থেকে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলেন। এসে বললেন, কবে এলেন?
সন্ন্যাসী দেখেছিল যে, চারণ মন্দাকিনী হোটেল থেকে বেরিয়েছে। একসপেনসিভ হোটেল।
ভাবল, ভীমগিরিও সন্ন্যাসী, এ মক্কেলও সন্ন্যাসী।
কোনও উত্তর দিল না।
উত্তর না-দেওয়াতে সন্ন্যাসী চটে গেল। চারণ জানে যে, কোনও মানুষকে উপেক্ষা করলে সে যতখানি অপমানিত হয়, তেমন আর কিছুতেই হয় না। অবশ্য যদি তার অপমানবোধ আদৌ থাকে।
চলতে চলতে সন্ন্যাসী বলল, উত্তর দিচ্ছেন না যে।
এমন সময়ে পথের উলটোদিকের, মানে, ডানদিকের একটা বড় অডিও ক্যাসেটের দোকান থেকে ভীমসেন যোশীজির বিখ্যাত এবং গায়ে কাঁটা দেওয়া, ভৈরবীতে বাঁধা ভজন ভেসে এল। যো ভজে হরিকো সদা,…পরমপাদ…মিলেগা বাজছিল।
সেই সন্ন্যাসীর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্যেই পথ পার হয়ে চারণ সেই ক্যাসেটের দোকানে গিয়ে ঢুকল। পেছনে পেছনে বর্মী-জোঁকের মতন সেই সন্ন্যাসীও এসে ঢুকল।
ক্যাসেট তো চারণ কিনতে ঢোকেনি। একটু পরেই বেরিয়ে এসে ত্রিবেণী ঘাটের দিকে এগোেল। সেই সন্ন্যাসী কিছুটা রাগে, কিছুটা ঔৎসুক্যে কিছু দুর অবধি চারণের পেছন পেছন এসে তারপর অন্য কোথাও চলে গেল। চারণ কেন যে অমন করল তা ও জানে না। ওর মধ্যে যে অনেকগুলো মানুষ বাস করে। তাদের একজনের চরিত্রও সে তখনও বুঝে উঠতে পারেনি। ওর সবচেয়ে বড় বিপদ নিজেকে নিয়েই। ওর নিজের ভেতরটা এমনই অগোছালো যে একদিক গোছাতে গেলে অন্যদিকে ধুলো জমে। এ জীবনে নিজেকে নিয়েই সবচেয়ে বেশি হিমসিম খায় চারণ।
নিজেই নিজেকে বোঝে না, তার অন্যদের বোঝাবে বা বুঝবে কী করে?
চারণ যখন জনস্রোতে মিশে গেল তখন হঠাৎই ওর খুব হালকা লাগতে লাগল। এই ভারশূন্যতার রকমটি ও ঠিক ব্যাখ্যা করে বলতে পারবে না। কারণ, তার স্বরূপ সে নিজেও জানে না। শিকড় উপড়ে গেলে যেমন মনে হয়, তেমন এক বোধ। রিচার্ড বাক-এর লেখা জোনাথন লিভিংস্টোন সীগাল বইটি পড়ে যেমন বেশ কিছু দিন শিকড় আলগা করে নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল, সেইরকম স্বপ্ন সে আবারও দেখতে আরম্ভ করেছে এখানে এসে।
শিকড়বাকড় মানুষের সব কি ঘরের মধ্যেই থাকে? চার দেওয়ালেরই মধ্যে? শৈশব থেকে বার্ধক্য এই সব পর্বেই কি শিকড়বাকড়ের দড়াদড়ি দিয়ে বাঁধা থাকে মানুষ মাত্রই? ওই সমস্ত প্রশ্নর একটিরও উত্তর ওর কাছে নেই। দেখবে, উত্তর যদি খুঁজে পায় হৃষীকেশের বাসিন্দা অগণ্য সব ঘরছাড়াদের কারও কাছে।
ভাবছিল চারণ, কিসের নেশাতেই বা মানুষ ঘরে থাকে? আর কিসের নেশাতেই বা ঘর ছাড়ে? ঘরছাড়ারা যদি ঘরের বাইরের টানের মধ্যে এক ধরনের তীব্র আসক্তিই বোধ করে, তবে গৃহস্থরা দোষ করল কি? এটা নইলে চলবে না, ওটা নইলে চলবে না, এই তো আসক্তির মূলে। আর যদি তাই হয়, তরে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে, নিজের অন্তরের মধ্যের বন্দী আমিত্বকে অন্তরতমর কোরক থেকে বিচ্ছিন্ন করে উৎপাটিত রক্তাক্ত হৃৎকমলের মতন তাকে যদি নিজের করপুটে রেখে তীব্র কিন্তু নিরাসক্ত আগ্রহের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা যেত তা হলে কি উত্তর পেতে পারত ওর এই প্রশ্নর?
এত সব গভীর তত্ত্বের বোধের চৌকাঠে পৌঁছেই ও হোঁচট খেল এই সরল সত্যটি উপলব্ধি করে যে, ভীমগিরি তাকে ত্রিবেণী ঘাটের দিকে টানছেন। কোনও টানেই যদি ধরা দেবে, সে টান যে টানই হোক না কেন, পুরনো গোপন রোগের মতন নিজের মনের মধ্যে গভীরে প্রোথিত অগণ্য বিরক্তি এবং আসক্তি থেকে মুক্ত হবার চেষ্টাতে এসেও আর এমন গা-ভাসানো কেন? ভীমগিরি নামক এক বিড়ি-ফোঁকা গঞ্জিকাসেবী, অশিক্ষিত সন্নিসীর টানেই যদি স্রোতের মুখে কুটোর মতন ভেসে যাবে চারণ চাটুজ্জে, তবে কক্ষচ্যুত সে আবার তার নিজকক্ষে ফিরে গিয়ে জয়িতাকেই বরং জয়ী করুক। স্মিত, স্নিগ্ধ, পূর্ণ চন্দ্ৰই গ্রাস করুক তীব্র দৃপ্ত মার্কশুকে। সেই সপিণীর ছোবলেই প্রাণ এবং মান হারাক ও।
জাহান্নামে যাক চারণ চাটুজ্জে। রিয়্যাল জাহান্নামে।
ভারী রাগ হল চারণের নিজেরই উপরে। আইন বোঝে, অর্থনীতি বোঝে, লাভ-লোকসান বোঝে, কমপুটার বোঝে, জীবনের মীন-মিডিয়ান-মোড বোঝে, এতরকমের কোশিয়েন্ট বোঝে, বাণিজ্য জগতের ঝাঁ-চকচক নিত্যনতুন টার্মস আর ভ্যারিয়েবলস যার নখদর্পণে, যার অঙ্গুলি হেলনে বিনুর স্বপ্নের রেলগাড়ির মতন দুলে উঠে চলতে আরম্ভ করে আধুনিক পৃথিবী, সেই মানুষ কেন, কী করে ভীমগিরি নামক একজন চাতালবাসী হা-ভাতে সন্নিসীর প্রতি এমন করে আকৃষ্ট হয়?
যে নিজে এত বড় আইনজ্ঞ সে এ কোন বে-আইনে বাঁধা পড়তে চলেছে?
আশ্চর্য।
না। ও ঠিক করল, যেখানেই যাক, আজ সন্ধেতে ত্রিবেণী ঘাটে মোটেই যাবে না। এই মোহ ওকে ত্যাগ করতেই হবে। সে ব্যাটা সন্ন্যাসী নিশ্চয়ই তাকে কোনও তুকতাক করেছে। গুরুকে দিয়ে হয়তো বাণ মারিয়েছে। তার মতন বিজ্ঞানমনস্ক বামপন্থী ইনটেলেকচুয়াল, তার মতন সফল ভারতবিখ্যাত আইনজ্ঞর পক্ষে অমন এক গঞ্জিকাসেবীর খপ্পরে পড়ার চেয়ে বড় লজ্জা আর কি হতে পারে। Emancipation-এর এই সব মুখরা বোঝেটা কি? রামমন্দিরের চাতালে বসে ভজন গাওয়াই যার সিদ্ধিলাভের একমাত্র প্রক্রিয়া তার কাছে বা তাদের কাছে আর যারই কিছু শেখার থাকুক চারণের শেখার কিছুমাত্রই নেই।
আর একটু এগোতেই দেখল পথের বাঁ পাশে প্রাচীন একটি হর্স-চেস্টনাট গাছের নীচে ঝুপড়ি বানিয়ে আছে এক পরিবার। তারা বড়ই গরীব। এক বৃদ্ধ এক হাতে দু-আড়াই বছরের নাতনিকে জড়িয়ে ধরে কোলে বসিয়ে মেরুদণ্ড টান টান করে একটি ছোট চৌপাইতে বসে অন্য হাতে কো ধরে, গালের সঙ্গে লাগিয়ে হুড়ক-ভুড়ক শব্দ করে হুঁকো খাচ্ছে। তার জওয়ান ছেলে আগুনের মধ্যে লোহা গরম করে সেই গনগনে লাল লোহা চিমটে দিয়ে তুলে একটি মোটা লোহার থামের মতন জিনিসের উপরে ধরে আছে আর তার যুবতী, সুগঠিতা বউ একটি বড় হাতুড়ি দিয়ে সেই লাল লৌহখণ্ডকে পিটছে। ছেলেটির হাতের কাছেও একটি ছোট হাতুড়ি রয়েছে। তা দিয়ে সে নরম লোহাকে পিটে-পাটে চূড়ান্ত রূপ দিচ্ছে, লোহার একপ্রান্তকে ছুঁচোলো করছে। সম্ভবত ত্রিশূল বানাবে।
মেয়েটি একটি বহুবর্ণ ঘাঘরা পরে আছে আর বহুবর্ণ ছিটের আঁটসাঁট ব্লাউজ। ঘাঘরার ঘের বেশি নয়। আর তার ঝুল থেমে গেছে তামাটে গোড়ালির অনেকখানি উপরে এসে। তার সুগঠিত পা, সুন্দর সুডৌল, ঘর্মাক্ত, পুরনো-সোনার রঙের স্তনযুগল ছেড়ে ঘরছাড়া চারণ চাটুজ্জ্যের চোখ কোথাওই আর যেতে চাইছিল না। দুটি স্নিগ্ধ এবং কোমল পাখি যেন জোড়ে উড়ে এসেছে স্বর্গ থেকে। এই মর্ত্যভূমিতে আদৌ এদের স্থায়ী বাস যে হতে পারে, তা বিশ্বাসই হয় না।
জয়িতা কত ইটালিয়ান অলিভ অয়েল, কত বিদেশি ময়েশ্চারাইজার, কত ম্যাসুরের সাহায্য নিয়েও এই মেয়েটির স্তনের মতন সুন্দর করতে পারেনি নিজের স্তনকে। এ যে পথপাশের পারিজাত! কখন যে ফোটে শুধু তাই জানা নেই চারণের। শুনেছে, পারিজাত রাতে ফোটে।
পরমুহূর্তেই ভাবল ও, স্তনী তো প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্কা নারীই। কিন্তু জয়িতার স্তনের সঙ্গে কি তুলনা হতে পারে অন্য কারও স্তনের? সে যে জয়িতারই স্তন।
চারণের জিগরি দোস্ত লক্ষৌ-এর বাসিন্দা হাফিজ একটি শায়ের বলত প্রায়ই, যখন লানডান স্কুল অফ ইকনমিকস-এ পড়াশুনো করত ওরা একসঙ্গে। বলত : নীগাহ যায়ে কঁহা সীনেসে উঠকর? হুয়াতো হুসনকি দওলত গড়ী হ্যায়। অর্থাৎ, সুন্দরীর সব সৌন্দর্য, তার সব দৌলত তো ঈশ্বর যুগলবুকেই গড়ে রেখেছেন। বুক ছেড়ে চোখ আর কোন চুলোতে যাবে?
মানল নয় তা। কিন্তু এই সৎ, পরিশ্রমী, স্বনির্ভর ক্ষুধাকাতর ভারতীয় পরিবারের পরিশ্রমমুখিনতাতে বা তাদের কষ্টে বা সততাতে চারণ একটুও চমৎকৃত না হয়ে চমৎকৃত হল। অজ্ঞাতকুলশীলা যুবতীর স্তনযুগলে! ছিঃ ছিঃ।
মনে মনে বলল, শান্তি? নির্বাণ? বোধি? চারণ চাটুজ্যের জন্যে? দূর অস্ত। দূর অস্ত।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ওদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল চারণ।
বুড়ো বলল, জাতে ওরা পান্ধী। যাযাবর। এমনই ঝুপড়ি বানিয়ে আবার ভেঙে ফেলে পথ থেকে পথে, জেলা থেকে জেলাতে চলে যাবে। কোনও পিছুটান নেই। ওদের শুধুই সামনে চাওয়া।
ভারী ভাল লাগল চারণের। ভাবল, কত বড় দেশ এই ভারতবর্ষ। কত বিচিত্র পেশার, বিচিত্র নেশার মানুষের সমাহার এখানে। দেশকে ভাল করে না দেখলে, দেশের মানুষকে ভাল করে না জানলে, তাদের জন্যে সমব্যথী না হলে মানুষ হয়ে জন্মানোই বোধহয় বৃথা। এরাও তো এক ধরনের সন্ন্যাসীই!
ভাবল ও।
মেয়েটি অত বড় ও ভারী হাতুড়ি বারংবার ওঠাতে নামাতে, হাঁপ উঠছিল তার। কথা বলার মতন অবস্থা তার ছিল না। অপরিচিতর সঙ্গে কথা সে বলতও না হয়তো।
মাঝে মাঝেই সে কোমর টানটান করে দাঁড়িয়ে পড়ে চোলি দিয়ে মুখ, গলা এবং ঘাড়ের ঘাম মুছছিল। সে যখনই নিচু হচ্ছিল তখনই তার স্তনযুগল ম্যাগনোলিয়া গ্র্যান্ডিফ্লোরা ফুলের মতনই বিভাসিত হচ্ছিল।
সেই দৃশ্যে বিমোহিত হয়ে ছাত্রাবস্থায় পঠিত কবি ও সাহিত্যিক মণীশ ঘটকের (যুবনাশ) কবিতার দুটি পঙক্তি মনে পড়ে গেল হঠাৎই চারণের : বলমুক্ত তুঙ্গ স্তনদ্বয়, সহসা উদ্বেল হল শুভ্র বক্ষময়। বল্কলমুক্তর আগে একটা শব্দ ছিল। একটি দারুণ শব্দ। কিছুতেই মনে করতে পারল না।
কবিতাটির আশ্লেষ সেই একটি হারিয়ে যাওয়া শব্দে যেমন ক্ষুণ্ণ হল, তেমন আবার ভাস্বরও হল।
মেয়েটিকে দেখে, তার সন্ন্যাসী হওয়া যে এ জীবনে অথবা এ যাত্রাতে হবে না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হল চারণ। এবং নিশ্চিত হয়ে বিলক্ষণ দুঃখিত হল। তরুণ, শক্তিশালী কোনও গদ্যকারের লেখা গদ্যর মতন গদ্যে এই মেয়েটি সম্বন্ধে কিছু লিখতে ইচ্ছে করল চারণের।
মাত্র একটি প্যারাগ্রাফ। জীবনে একটিমাত্র প্যারাগ্রাফের মতন প্যারাগ্রাফও যদি লেখা যেতে পারত, সারা জীবনের চেষ্টা দিয়ে নিজেকে নিয়ত ভাঙচুর করে, মাত্র একটিমাত্র তেমন প্যারাগ্রাফ বা মণীশ ঘটকের ওই কবিতাটির মতন মাত্র দুটি ছত্র, তা হলেই যথেষ্ট ছিল।
স্বপ্নময়ের গদ্যর স্বপ্নহীনতা চারণকে এই যুবতীর স্তনযুগলেরই মতন আবিষ্ট করে, ডিফারেনসিয়াল ক্যালকুলাসের অশ্রুত ছন্দ তাকে মুগ্ধ করে, হুসেনের তেল রঙের মারদাঙ্গা অথচ নয়নশোভন ঔজ্জ্বল্য, জয়নুল আবেদিনের হালকা জল রঙের গাঢ় আভিজাত্য, জয় গোস্বামী অথবা অনিল ঘড়াই-এর অথবা শিবতোষ ঘোষের, তাদের পদ্য ও গদ্যর মধ্যে দিয়ে জীবনকে দেখার ভঙ্গি, জিন-কণ্ঠী ইফফাত আররা খান-এর অননুকরণীয় গভীর যৌনগন্ধী স্বরের নাব্যতা, অথবা শ্রুতি সাডোলিকারের গলার প্রভাতী বিভাস এ সব কিছুর কথাই একই সঙ্গে মনে পড়ে গেল চারণের সেই হাতুড়ি-পেটা ঘর্মাক্ত পান্ধী মেয়েটির কবুর ব্লাউজের মধ্যে অস্ফুটে ফুটে-থাকা স্তনযুগলে চোখ পড়েই।
হঠাৎই যেন কানের মধ্যে কে বলে উঠল, বেটা। তোর আধার ভাল।
চারণ হতভম্ব হয়ে গেল। পরক্ষণেই কান্না পেয়ে গেল তার। মনে মনে বলল, হবে না, হবে না। যে জীবনকে এতখানি ভালবাসে, জীবন যাকে এমন অঙ্গাঙ্গীভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে, তার কখনওই পালানো হবে না ভোগের জীবন থেকে। বন্ধনই তার কপাল-লিখন। চিরবন্ধন। জীবনকে যে ভালবেসেছে, যে ঘৃণা করেছে, যে প্রেমিকার মতন জড়িয়ে ধরেছে, যে ফুটবলের মতন লাথি মেরেছে চারণের মতন, শুধু সেই জানে যে জীবন অক্টোপাস। সহস্র হাতের সুদৃঢ় অদৃশ্য বন্ধনে জীবন মানুষ-মানুষীকে বেঁধে রাখে। অভ্যেসের মধ্যে। প্রতিদিনের কাজের মধ্যে, সুগীত গান, সুলিখিত কবিতা, সুললিত কথোপকথন, সুন্দর দৃশ্য, গন্ধ, স্পর্শ এবং শব্দর মায়ার ঘেরে।
সংসারের থেকে, জীবনের বজ্রমুষ্ঠি থেকে, হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে যাওয়া খুবই সহজ। কিন্তু সুকোনো যাবে না কোথাওই। দৌড়নো হয়তো যাবে, দূর হতে বহু দূরে, হয়তো দিগন্ত অবধিও কিন্তু লুকোনো হবে না। জীবন ঠিক পিছনে পিছনে এসে তার বজ্রমুষ্টিতে কব্জি আঁকড়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে চারণকে তার ঘেরাটোপের মধ্যে। চারণ অলীক মানুষ নয়, অলীক স্বপ্নও দেখে না!
চারণ জানে যে, একদিন হৃষীকেশের এই কটি দিনকে স্বপ্নের মতন মনে হবে। সত্য, কঠিন এবং বাস্তব জীবনের ফ্রেমের মধ্যে এই দিনটি, এই পান্ধী যুবতীর কবুর ব্লাউজের মধ্যে দিয়ে উঁকি মারা ভীরু কবোষ্ণ পাখির মতন স্তনযুগলের মতন, পৃথিবীর সব সৌন্দর্য ও স্নিগ্ধতার সংজ্ঞার মতনই বাঁধানো থাকবে মনে।
না কি, মোড় নেবে তারও জীবন?
বাঁকে বাঁকে কি বয়ে যাবে নতুন খাতে? হয় হৃষীকেশ, নয় আরও উপরের দেবপ্রয়াগ, রুদ্রপ্রয়াগ, কর্ণপ্রয়াগ, কোথায়? তা কে বলতে পারে!
মুক্তি নেই ভীমগিরি মহারাজ। মুক্তি নেই।
যদি আত্মহত্যা করে ও?
জীবন্মৃত জীবনের চেয়ে মৃত্যুই কি শ্রেয় নয়?
পাঠক! আপনি ভাবছেন চারণ চাটুজ্জ্যেকে রাঁচির কাঁকে রোডে পাঠানো দরকার। যার প্রকৃত বেদনা নেই, আর্থিক কষ্ট নেই, যার কষ্ট বেদনা-বিলাস মাত্র, তার দুঃখটা কিসের?
পাঠক! আপনি যদি মানুষ হন অথবা মানুষী, তবে অবশ্যই জানবেন যে, মানুষের প্রকৃত কষ্টটা কোনও দিনই ভাত কাপড়ের ছিল না। এ সব কথা নানা মতের, নানা দেশের রাজনীতিকদের বানানো কথা। ভোট বাগানোর কল। ভাত কাপড়ের কষ্টই যদি মানুষকে কোনও দিনও তেমন করে ক্লিষ্ট করত তবে ভীমগিরির মতন কেউই হাসিমুখে বলতে পারতেন না ভুখখা মরো।
মানুষের মতন মানুষ যে, সে চিরদিনই দুঃখী। বড়লোকই হোন, কী গরীব, রাজাই হোন কী প্রজা। এই দুঃখবোধেরই আর এক নাম বোধহয় মনুষ্যত্ব।
ভেবেছিল যে, অন্য কোথাও যাবে। ত্রিবেণী ঘাটের দিকে যাবে না। কিন্তু সেই ডানদিকেই ঘুরল। তবে প্রথম মোড়ে নয়, এগিয়ে গিয়ে, দ্বিতীয় মোড়ে। ঘাটে যাওয়ার সেই দ্বিতীয় পথটি ভাল করে দেখা হয়নি ওর এখনও।
একটু এগোতেই দেখল, বাঁদিকে একটি ইডলি-দোসার দোকান। বিকেলে চায়ের সঙ্গে কিছু খায়নি। একটু খিদে-খিদে বোধ করছিল। দুদিনেই তো আর ভুখা মরা বাণীতে উদ্বুদ্ধ হতে পারবে না। সময়কে সময় দিতে হবে বৈকি, যতখানি সময়, সময় চায়। ঢুকে পড়ল, দোকানটিতে। দেখল, দেওয়ালময় রবীন্দ্রনাথ, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ এবং শরৎচন্দ্রর ছবি তো বটেই দার্জিলিং-এর সুযযাদয়, দীঘার শীতকালের তটের ফোটো, এই সব টাঙানো। একটি প্লেইন দোসা আর কফির অর্ডার দিয়ে ও ছবিগুলো দেখতে দেখতে ভাবল দোকানি নিশ্চয়ই বাঙালি। ক্যাশ কাউন্টারে যে ছেলেটি বসে ছিল, তাকে জিগ্যেস করল উঠে গিয়ে, মালিক বাঙালি কি না! সে দুদিকে মাথা নেড়ে মিলিয়ান অ্যাকসেন্টের আড়ষ্ট হিন্দিতে বলল, আম হাজহি আয়া, আমারা ইন্দি নেই আ আয়।
এক ভদ্রলোক বসে ডিশের উপরে কফি ঢেলে সুরুৎ সুরুৎ করে মেপে মেপে চুমুক দিয়ে কফি খাচ্ছিলেন। চারণের ঔৎসুক্য দেখে আপনা থেকেই তিনি হিন্দিতে বললেন, মালিক মাড্রাজি হ্যায়।
দক্ষিণ ভারত যে একটি মস্ত বড় জায়গা, সেখানে যে অনেকগুলি রাজ্য আছে এসব খবর পূর্ব, উত্তর এবং পশ্চিম ভারতেরও সাধারণ মানুষে রাখেন না। অনেক শিক্ষিত মানুষও রাখেন না। তামিল, তেলেগু, মালয়ালি, কনাটকি, কুর্গি, সকলেই মাদ্রাজি বলেই বর্ণিত হয়। আশ্চর্য সরলীকরণ!
দেওয়ালের ছবিগুলো দেখিয়ে চারণ বলল, তব?
তব ক্যা?
ইয়ে সব বাঙালি ঔর বাঙালকি তসবির?
সে বলল, হাঃ। ইয়ে সব বাঙালি কাস্টোমার পাকাড়নেকে লিয়ে।
হাসি পেল চারণের।
সত্যি। বাঙালি এক আশ্চর্য জাত। তাদের নিজ শহরে অমিতাভ বচ্চন আর মাধুরী দীক্ষিতে মজে থাকে তারা, কিন্তু প্রবাসে রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দর ফোটো দেখেই কাত। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ অথবা শরৎচন্দ্রর একটি বইয়ের এক লাইনও পড়া থাক আর নাই থাক, তাতে যায় আসে না কিছুমাত্রই। প্রবাসে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, রামকৃষ্ণদেব বা বিবেকানন্দর চার ফেললে বাঙালিরা যে মাছেরই মতন বুড়বুড়িতুলে হুড়মুড়িয়ে আসে এই তথ্য দোকান-মালিকের ভাল করেই জানা ছিল। তাই সেই দোকানের বিক্রি ঠেকায় কেডা? চাকরি করা আর বসে-খেতে ভালবাসা বাঙালি অন্য সব রাজ্যের সব স্তরের ব্যবসায়ীকে যেমন নির্বিকারে বড়লোক করে তেমন আর কোনও রাজ্যের মানুষই করে বলে চারণের জানা নেই।
দোসাটা যখন তৈরি হচ্ছে তখনই হঠাৎ সেই নবীন সন্ন্যাসী পথ দিয়ে দুধারে উঁকিঝুঁকি মারতে মারতে যেতে যেতে চারণকে দেখতে পেয়েই দোকানে ঢুকে পড়লে।
সন্ন্যাসীরাও কি দোসা খান?
ভাবল চারণ।
তারপরই ভাবল, না খাওয়ার কি আছে? তা ছাড়া ইনি তো সন্ন্যাসী ননও। ভেকই ধরেছেন শুধু।
চারণের উলটোদিকের চেয়ার টেনে বসে পড়ে সন্ন্যাসী বলল, পালাতে চাইলেই কি পালাতে পারা যায়?
চারণ উত্তর দিল না।
সন্ন্যাসী মিটিমিটি হাসতে লাগল।
চারণের রাগ, বিরক্তি, কৌতূহল সব মেলানো এক অনুভূতি জাগল মনে। কিন্তু ঠিক করল যে, কথা বলবে না।
রক্তচন্দন-রঙা টেরিকট পরা সন্ন্যাসী বলল, আমি অনেক ঘাটের জল খেয়ে এখানে এসেছি।
চারণ বোবার মতন চেয়ে রইল।
উত্তর না পেয়ে সন্ন্যাসী আরও চটে গেল।
বলল, সন্ন্যাসী কত রকমের হয় জানেন?
চারণ এবারে তার তর্জনী আর মধ্যমা দেখাল তাকে?
মানে?
চারণ মুখে বলল, দুরকমের।
ঘন্টা জানেন।
সন্ন্যাসী বলল।
বলেই বলল, কোন কোন রকম?
সাচ্চা আর ঝুঠা।
আপনি একটা ইডিয়ট।
মুখের উপরে প্রকৃত ইডিয়ট যে, তাকেও ইডিয়ট বললে সে চটে উঠত কিন্তু স্থান মাহায্যে এবং ওই ল্যাকব্যাকে ভীমগিরির সামান্য প্রভাবেই বোধহয় চারণের আমি কিছুটা ঢিলে হয়ে গিয়ে থাকবে ইতিমধ্যেই। সে না রেগে, ঠাণ্ডা গলাতে বলল, লজ্জা, মান, ভয়, তিন থাকতে নয়।
এই বাক্যটি দিদিমার উত্তরপাড়ার পুজোর ঘরের দেওয়ালে কাঁচ ঢাকা ফ্রেমের মধ্যে বাঁধানো ছিল।
তারপরই সন্ন্যাসী যা বলল, তা শোনার জন্য চারণ তৈরি ছিল না। সে বলল, আপনাকে আমি চিনি। আমার বাবার সঙ্গে আপনার অফিসে আমি বহুবার গেছি।
আপনার বাবার নাম কি?
অবাক হয়ে চারণ জিগ্যেস করল।
সেই তরুণ সন্ন্যাসী যে নামটি বলল তা শুনে চারণ চমকে উঠল। তার নির্মোহ নির্মোক আর বজায় রাখা সম্ভব হল না।
চারণ বলল, দোসা খাবে?
নাঃ।
এবার তার পালা চারণকে উপেক্ষা করার।
চারণ বলল, তুমি ঘর ছাড়লে কবে? আর ছাড়লেই কেন?
সে সব অনেক কথা। পূর্বাশ্রমের কথা আমি আলোচনা করতে চাই না। আপনার Arogance ভাঙবার জন্যই পিতৃপরিচয় দিতে হল। তবে সে লোকটাকে আমি বাবা বলতে যা বোঝায়, মানে যে সম্মান সম্ভ্রম প্রাপ্য থাকে সব বাবারই তার ছেলের কাছ থেকে, তার কণামাত্র দিতে পারিনি, দেব না। কারও গর্ভে কাম-উৎসারিত এক ফোঁটা ঔরস নিক্ষেপ করলেই কেউ কারও বাবা হয়ে ওঠে না। সব বাবার বেলাতেই পিতা ধর্ম, পিতা স্বর্গ, পিতাহি পরমতপ বলা চলে না। সন্তানের জন্মদাতা পাবেন কোটি কোটি কিন্তু বাবা কজন তাঁদের মধ্যে?
নিজের বাবাকে এত ঘৃণা কি করা ভাল? এত ঘৃণা নিয়ে কি তুমি সন্ন্যাসী হতে পারবে? তোমার নামটা যেন কি? তোমার নাম অবশ্য আমি জানতামও না কোনও দিন?
সন্ন্যাসীর পূর্বাশ্রমের নাম জেনে লাভই বা কি? আমার এখনকার নাম পাটন। গুরুজি বলেন পাটনানন্দ।
পাটন! অদ্ভুত নাম তো। পাটন! মানে কি?
বাঙালির ছেলে হয়ে পাটন মানে জানেন না? পাটনি শব্দের মানে জানেন তো?
পাটনি? ও হ্যাঁ।
তবে পাটনের স্ত্রী লিঙ্গই তো পাটনি। আমি খেয়াঘাটের মাঝি। আপনার মতো শর্ট টেম্পারড অ্যারোগ্যান্ট মানুষদের নদী পার করাই আমি, আমার নির্বাণের খেয়া নৌকোতে।
বাব্বা! তুমি বয়সে ছোট হলে কি হয়, কথা তো বেশ বড় বড় বলতে শিখেছ।
এখনও কিছুই শিখিনি। শুধু কথাই না, কাজও শিখব। কথা বলা তো অতি সহজ। এই সব কথাকে জীবনে ট্রানস্লেট করে দেখাতে হবে।
বাবা। বাংলাও তো খুব ভাল বলো দেখছি তুমি!
সবই গুরুর কৃপা। তার পায়ের কাছে বসে থাকি। যা উপচে পড়ে এসে জোটে তাই তো যথেষ্ট।
দীক্ষা-টিক্ষা নিয়েছ নাকি? হাসালে তুমি। তুমিও!
এমন করে কথাটা বলল চারণ যে, You too Brutas! এর মতনই শোনাল।
সে বলল, আপনি মস্ত বড় ইমপর্ট্যান্ট লোক হতে পারেন, সমাজের দণ্ডমুণ্ডের একজন মালিক, কিন্তু আপনি জানেন না কিছুই।
তুমিও কিছুমাত্রই জানো না আমার সম্পর্কে। অবান্তর কথা বোলো না। চৌধুরী সাহেবের একমাত্র ছেলে ঘর ছেড়ে গেরুয়া পরে হৃষীকেশের এই ইডলি-দোসার দোকানে বসে আমার সঙ্গে বে-এক্তিয়ারে বিতণ্ডা করবে এ আমার পক্ষে অভাবনীয় ব্যাপার। আমি তো বলব তুমি উন্নতি করোনি, অধঃপাতে গেছ। তোমার বাবা কখনওই আমার সঙ্গে এইভাবে কথা বলতেন না।
কি করে বলবেন? তাঁর টিকি যে বাঁধা আছে আপনাদের মতন Professionalsদের কাছে। আমার বাবা তার কর্মচারীদের সঙ্গে কী ভাষাতে কথা বলে তা কি আপনি কখনও শুনেছেন?
না শুনিনি।
ওঁর যত বিনয় সব আপনাদেরই কাছে।
তোমার বয়স কত পাটন?
বয়স কি বয়সে হয় স্যার?
বয়স তবে কিসে হয়?
বয়স হয় অভিজ্ঞতায়। বয়স, কোনওদিনই বয়সে হয় না, হয়নি। জীবনের মূল্যও কোনও দিনও আয়ু দিয়ে মাপা হয় না। এ সব জানেন না বলেই তো খেয়াঘাটের মাঝির দরকার আপনার। আমার বয়স পঁচিশ। কিন্তু হিসেব করলে দেখা যাবে আমি হয়তো আপনার চেয়ে পঞ্চাশ বছরের বড়।
পঞ্চাশ বছরের?
ইয়েস স্যার।
দোসাটা এসে গেল। এক কাপ কফিও দিতে বলল চারণ। তারপর বলল, কফিও খাবে না এক কাপ? অথবা চা?
নাঃ। থ্যাঙ্ক উ্য।
তুমি না গোয়ালিয়রের পাবলিক স্কুলে পড়তে? তারপরে কোথায় ছিলে? সত্যি। ভাবা যায়। সেই তুমিই এখন…।
স্কুলিং শেষ করে স্টেটসে গেছিলাম।
কেন?
বাবা বলেছিল এ দেশে পড়াশুনো হয় না। আমাকে মানুষ করতে পাঠিয়েছিল। ম্যাসাচুসেটসও গেছিলাম। সেখান থেকে এম বি এ করে ফেরার কথা ছিল।
তা চলে এলে কেন?
ওসব না করেই লেজ গজিয়ে গেল। স্টেটস-এ তো লোকে লেজ গজাতেই যায়। তা ছাড়া গুরুও ডাকলেন।
গুরুও কি লেজ গজাবার জন্য স্টেটস-এ গেছিলেন না, তোমাকে ডাকতে?
সে সব কথা অবান্তর। আপনি জেনে কি করবেন? তবে লিটারালি ডাকেননি। আমার অন্তরে সেই নিরুচ্চারিত ডাক পৌঁছেছিল। দুত্তোর বলে সব ছেড়ে ছুঁড়ে চলে এলাম তাঁরই সঙ্গে।
তোমার গুরু কে?
গাড্ডুবাবা। কেউ কেউ বলে ভোঁদাই মহারাজ।
সেকি! এমন বিচ্ছিরি নাম কেন?
তা জানি না। আমি তো দিইনি নাম। তবে মনে হয় ওই নামটা আসল মানুষটাকে প্রচ্ছন্ন রাখে। যদি কোনও গুরুর নাম হয় ইন্টেলিজেন্ট মহারাজ তবে জানতে হবে তাঁর মতন বড় বুদ্ধু আর দ্বিতীয় নেই।
চারণের বুদ্ধু সিং-এর কথা মনে পড়ে গেল। কফি আর দোসার দাম দিয়ে দোকান থেকে বেরোল চারণ, পাটনের সঙ্গে।
কোন দিকে যাবেন আপনি চ্যাটার্জি সাহেব?
পাটন বলল।
আমাকে তুমি চারণদা বলেই ডেকো।
বলব। কিন্তু আপনিও আমাকে পাটন বলেই ডাকবেন।
তারপর বলল, ক্যাসেটের দোকানে কি আমাকে ফলো করেই ঢুকেছিলে না কোনও ভজনের ক্যাসেট কিনতে?
ফলো করে তো নিশ্চয়ই! তবে ভজনের ক্যাসেটের জন্য নয়, মাইকেল জ্যাকসনের কোনও ক্যাসেট পাওয়া যায় কি না খোঁজ করতে গেছিলাম।
মাইকেল জ্যাকসন। মাই গুডনেস। মাইকেল জ্যাকসন এবং পাটন মহারাজ। ভাবা যায় না।
কেন? Incompatibility-টা দেখলেন কোথায়?
Incompatibility নেই?
নাঃ। কোনও Incompatibility-ই নেই।
তুমি তো চিন্তায় ফেললে আমাকে।
চিন্তাই তো মানসিক উৎকর্ষতার একমাত্র পথ। তবে চিন্তার রকমভেদ আছে। সৎ চিন্তা করতে হবে। আমার বাবাও তো সব সময়েই চিন্তা করে। তবে শুধুই টাকার চিন্তা, টাকার, আরও টাকার। অথচ টাকার ব্যবহার জানে না। এ ছাড়াও প্যাঁচ মারার চিন্তা, অন্যকে টাইট দেওয়ার চিন্তা। পরের অপকার করার চিন্তা।
তোমার বাবার জন্যই তুমি তা হলে এই অন্য জীবনে প্রবেশ করতে পারলে বল! এ জন্যও তো তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত তোমার!
তা বলতে পারেন। তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, কিন্তু আপনি এখানে কেন?
এমনি।
না। এমনি নয়। এমনি যারা আসেন তাঁদের দেখেই বোঝা যায়।
তাই নাকি? তা হলে মনে করো এমনি নয়। আচ্ছা ভীমগিরিকে চেনো? ভীমগিরি মহারাজ?
এখানে কত মহারাজ, কত বাবা আছেন। আমি চিনি না। তা ছাড়া আমি তো থাকিও না এখানে।
এখানে থাকো না? তবে কোথায় থাকো?
উপরে। ভিয়াসির আগে। এখান থেকে মাইল কুড়ি দূরে দেবপ্রয়াগের পথ থেকে বাঁদিকে পোয়া কিমি মতো উঠে এক মস্ত গুহা আছে। সেখানেই গাড্ডু মহারাজ থাকেন। আমিও সেখানেই থাকি।
তাই? নিয়ে যাবে আমাকে? কেন? গাড্ডু মহারাজকে দেখতে?
না, না থাকতে। তোমরা বাইরের লোকদের থাকতে দাও?
কে যে বাইরের আর কে যে অন্তরের তা তো অন্তর্যামীই জানেন। গুরুকে জিগ্যেস করতে হবে। কিন্তু কেন? ভাল লাগছে না এখানে?
মন্দাকিনী হোটেলে থেকে সাধু-সন্ত-মহারাজদের নাগাল পেতে বড়ই অসুবিধা হচ্ছে। তাদের কাছে পৌঁছতে পারছি না, পারব না যে, তাও বুঝতে পারছি।
নাগাল পাওয়ার জন্য এমন কাঙালপনাই বা কেন? আপনি Instant Coffeeর মতো Instant বৈরাগ্য প্রার্থী?
না তা না।
ঠিক বলতে পারব না। বলব, যাকে সাধু বাংলাতে বলে মন উচাটন হওয়া, তাই হয়েছে। সে জনাই…
বাঃ।
আমার গুরু বলেন, এই হল প্রকৃত সাধকের লক্ষণ। মানে, সাধক হওয়ার প্রস্তুতির লক্ষণ। দামি বলে যা-কিছুকেই জানতেন তার সব কিছুই হঠাৎ মূল্যহীন, অসার বলে ঠেকেছে তো? হুমম। কিন্তু আমি যদিও ওঁকে গুরু বলি, উনি আমাকে কেন, কারওকেই শিষ্য বলে মানেন না।
বলেই বলল, আপনি জিড্ডু কৃষ্ণমূর্তির লেখা পড়েছেন?
হ্যাঁ।
চারণ বলল, আচ্ছা আরও একটা কথা বলো তো? তুমি তোমার পাঞ্জাবির বাঁ হাতের হাতাটা গুটিয়ে ঘড়িটা বের করে রেখেছ কেন? দেখাবার জন্যই তো? এটা কোন সাধনার লক্ষণ? এটা কি এগজিবিশানিজম নয়?
চারণের কথাতে খুব জোরে হেসে উঠল পাটন।
হাসছ কেন?
হাসি পেল বলে।
তারপর বলল, এর পরে আপনি নিশ্চয়ই জিগ্যেস করবেন যে আমি রক্তচন্দনৰঙা টেরিটের এবং ইস্ত্রি করা লুঙি-পাঞ্জাবি কেন পরেছি? তাই না?
চারণ লজ্জিত হল।
তারপর বলল, তোমার কথাটা ঠিকই।
তা হলে শুনুন। ঘড়িটা বাঁ হাতের কব্জিতে বের করে রেখেছি কারওকে দেখবার জন্য নয়। এই দেখুন। ডান হাতের পাঞ্জাবির হাতা ডান হাতের আঙুল দিয়ে উঠিয়ে ঘড়ি দেখার উপায় নেই। ডান হাতটা সব সময়েই আটকে থাকে। এই দেখুন।
বলেই, ডান হাত বের করে দেখাল পকেট থেকে। চারণ দেখল, সত্যিই তার হাতে জপমালা।
তুমি জপমালা পকেটে নিয়ে ঘোয়রা? চৌধুরীসাহেবের ছেলে। যিনি পশ্চিমবঙ্গের পয়লা নম্বরী ঢালাইওয়ালা, মাধুরী স্যানিটারি ন্যাপকিন-এর মালিক…। তুমি গোয়ালিয়রের পাবলিক স্কুলের ছাত্র।
হ্যাঁ। ঘুরি। তারা টাকার জন্য মালা জপে আর আমি জপি মোক্ষর জন্য।
মোক্ষ! হাসালে তুমি পাটন।
বলল, চারণ।
তারপর বলল, এই বয়সে মোক্ষর তুমি বোঝোটা কি?
আবারও বয়স বয়স করছেন! স্বামী বিবেকানন্দ মারা গেছিলেন কত বয়সে?
চারণ চুপ করে গেল।
তুমি যাই বল, ব্যাপারটা অভাবনীয় আমার কাছে। প্রিন্স-অফ-ওয়েলস মালা জপছে রক্তচন্দন বসন পরে।
কেন? এতে অবাক বা স্তম্ভিত হবার কি আছে? অভাবনীয়ই বা কেন? মুসলমানেরা তো দিনে পাঁচবার নামাজ পড়ে। কি? পড়ে না? খ্রিস্টানেরা প্রতি রবিবারে চার্চে যায় না? বৌদ্ধরা, সেই ডাব্বার মতন জিনিসটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে, নাম মনে পড়ছে না, বলে না, ও মণিপদ্মে ইম। ও মণিপদ্মে ম। ওঁ মণিপদ্মে ম? তা হলে লজ্জা কি শুধু পুজোআচ্চা করাতেই? মালা জপাতেই? স্তম্ভিত বার কথা তো ছিল আমারই! আপনার অজ্ঞতাতে অথবা ঔদাসীন্যে। অথবা হিন্দু হয়েও আপনার হিন্দুত্ব অস্বীকার করার এই হাস্যকর চেষ্টাতে। অবশ্য এ কথাও ঠিক যে ভারতবর্ষে বিশেষ করে, পশ্চিমবঙ্গে এখন নিজেকে হিন্দু বলে পরিচয় দেওয়াটা আউট অফ ফ্যাশান।
আমি হিন্দু নই।
চারণ বলল।
আপনি তবে কি?
আমি জন্মসূত্রে অবশ্যই হিন্দু, কারণ আমার মা বাবা হিন্দুই ছিলেন। কিন্তু তোমার জানবার কথা নয়, তাই তোমাকে জানাবার জন্যই বলছি যে আমার প্রথম (এবং শেষও বটে) চাকরির দরখাস্তে Religion-এর যে Column ছিল সেখানে লিখেছিলাম Hindu by birth but do not conform to any known form of Religion.
পাটন বলল, কোনও Known form of Religion-এ আপনার ভক্তি না থাকতে পারে কিন্তু আপনি কি ধর্মই মানেন না?
ধর্ম মানে ইডিয়টসরা, হাফ-উইটসরা, জড়বুদ্ধিরা।
চারণ বলল।
পাটন দুঃখিত অথবা ক্রুদ্ধ অথবা অপমানিত কোনও কিছুই না হয়ে, হাসল।
ছেলেটা বয়স অনুপাতে সত্যিই বড় বেশি পেকে গেছে। সবজান্তা হয়ে গেছে। ভাবল চারণ। পাটনের হাসিতে একটু শ্লেষও ছিল।
পাটন বলল, আপনি তা হলে যথার্থই এক জন নিটোল বাঙালি ইনটেলেকচুয়াল। কোনও ভেজাল নেই আপনার ইনটেলেক্ট-এ। ধর্ম-মানা মানুষ মাত্রই আপনার কাছে ইডিয়টস, হাফ-উইটস, জড়বুদ্ধি। Very well said indeed!
তারপর দাঁড়িয়ে পড়ে, একটু চুপ করে থেকে বলল, আমি এবারে ফিরে যাব। আপনার পেছন পেছন অন্য পথে অনেকই দূর চলে এসেছি।
সকলেই তো অন্যের পেছন পেছনই ভুল পথে চলে যায়। অনেক দূর। তারপর পস্তায়। তোমার এখনও সময় আছে। বয়স বেশি নয়। এখনও অন্যের পেছন ছাড়তে পার।
থ্যাঙ্ক ঊ্য ফর দ্য অ্যাডভাইস স্যার।
ভেকধারী চৌধুরী, অধুনা পাটন মহারাজ বলল।
তারপর বলল, চলে যাবার আগে আমার এই ইস্ত্রি করা রক্তচন্দনসঙা টেরিকটের বসনের রহস্যটাও জানিয়ে যাই। এ নিয়ে প্রথম দর্শন থেকেই আপনার মনে জিজ্ঞাসা জেগেছে যে তা বুঝতে পেরেছি।
কি করে?
বুঝেছি। কি করে, তা নাই বা জানলেন। তা হলে শুনুন, এই পোশাকও আমার নয়। আমার বলতে আমার গায়ের চামড়াটুকুই। তবে সুখের বিষয় এই যে চামড়াটা মানুষের, চোখের চামড়াসুন্ধু, গণ্ডার অথবা শিম্পাঞ্জির নয়। পোশাকটি পথপাশের যে আশ্রম থেকে আমাকে বেরোতে দেখলেন, যেখানে গত রাতটি কাটিয়েছিলাম, সেই আশ্রমের এক সৌখিন সন্ন্যাসীর। আমার জিনের ট্রাউজার আর শার্ট ছিঁড়ে গেছে। একজোড়ার দুটিই। তাই সেলাই ও রিপু করতে দিয়েছি। আজ মানে, এখনই দিয়ে দেবে। যাঁর পোশাক তাঁকে ফেরত দিয়ে পুনর্মুষিকঃ হব।
চারণ অবাক হয়ে বলল, জিনস পরা সন্ন্যাসী?
পাটন বলল, পোশাকে কি আসে যায় বলুন? আমার গুরুও তো গেরুয়া পরেন না। মুসলমান কসাইরা যেমন চেক-চেক রঙিন লুঙি পরে, গাজ্জুবাবাও তাই পরেন। উপরে সাদা পাঞ্জাবি। টুইলের। তাঁর এক শিষ্য আছেন মুসলমান। তাঁর নাম ইমতিয়াজ। লানডান স্কুল অফ ইকনমিকস-এর ছাত্র ছিলেন।
ইমতিয়াজ?
চমকে উঠল চারণ।
কেমন দেখতে?
কে?
ইমতিয়াজ?
নবাবের মতন চেহারা। লক্ষৌ-এর মানুষ। কথায় কথায় শায়েরের ছেছাড় করেন, যেন মিজা ঘালিব। লম্বা। আগুনের মতন গায়ের রং। ছিপছিপে। আগে মোটা-সোটা ছিলেন কি না বলতে পারব না।
প্রত্যেক সেন্টেন্স-এ একবার করে ইনসাল্লা বলে কি?
ঠিক ঠিক। আপনি চেনেন নাকি তাঁকে?
চিনি। আমার সহপাঠী ছিল লানডান-এ।
তাই?
হ্যাঁ। কিন্তু সে কি হিন্দু হয়ে গেছে? কাফির বনেছে।
না। তা কেন বনবেন? তা ছাড়া আমার গুরুর মধ্যে তো কোনও রকম গোঁড়ামি নেই। থাকলে, মুসলমান শিষ্য কি থাকত? তবে ইমতিয়াজ মহম্মদ সাহেব এখানে থাকেন না বরাবর। বছরে দু-তিনবার ঘুরে যান। আমার গুরুর কাছে এসে নানা জিজ্ঞাসার নিরসন করেন, আলোচনা করেন তারপর ফিরে যান। কোরান, হাদিস-এর উপরে যেমন, কনফুসিয়াস, স্পিনোজার উপরেও তেমন দখল। পোলিটিকাল এবং ইকনমিক থিওরিতে যেমন, দর্শনেও তেমন দখল।
চারণ স্বগতোক্তির মতন বলল, জানি। তারপর বলল, ইমতিয়াজ মহম্মদ থাকে কোথায় এখন?
তাঁর বাড়ি তো লক্ষ্ণৌতে। কিন্তু আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে না দিল্লির কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান যেন। দিল্লিতেই থাকেন। অত জানি না।
তাই?
হ্যাঁ। এবারে আমি চলি।
কবে ফিরে যাবে?
আজই যাব।
কখন?
আমার জামাকাপড় পেলেই। তা ছাড়া, একটু রাবড়ি নিয়ে যাব গুরুর জন্য। রাবড়ি খেতে খুব ভালবাসেন গুরু।
বাঃ। বেশ ভোগী গুরু তত তোমার।
শুধু ভোগী নন, ত্যাগীও। তিনি গুরুবাদে বিশ্বাসী নন। আমরাই তাঁকে গুরু মানি। উনি কারওকেই দীক্ষা দেন না, কারও উপরেই নিজের কোনও মত বা ইচ্ছা বা দর্শন আরোপ করেন না। গাড্ডুবাবা এই ভাগীরথীরই মতন। তিনি নিজের খেয়ালেই বয়ে যান। কেউ সে নদীতে চান করে যায়, কেউ তা থেকে খাবার জল নিয়ে যায়, কেউ বা নোংরা কাপড় কাঁচে, কেউ বা হাতমাটিও করে। যার যেমন আত্মা, যার যেমন আধার।
বলেই বলল, আর দেরি করতে পারব না। অন্ধকারে পাহাড়ে চড়তে অসুবিধে হবে। ভুলে টর্চটাও ফেলে এসেছি।
তারপর দুপা গিয়েই দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, আপনি এখানে কি করতে এসেছেন চ্যাটার্জি সাহেব?
বললামই তো। ঘুরতে। জাস্ট ঘুরতেই।
বাঃ। ভাল। মন উচাটন রোগ যদি পুরোপুরি না সারে, তবে চলে আসবেন আমাদের গুহাতে।
চিনব কি করে?
আপনিই পথ চিনে নেবেন। আপনি রবীন্দ্রনাথের মুক্তধারা পড়েছেন?
না। তবে একবার নাটকটি দেখেছিলাম।
তাই? তাতে ধনঞ্জয় বৈরাগীর সেই গানটি ছিল না?
কোন গান? পথ আমাকে সেই দেখাবে যে আমারে চায়।
মনে নেই।
মনে পড়ে যাবে। চলি আমি, চ্যাটার্জি সাহেব।
চারণ তখনও অবিশ্বাসীর চোখে কলকাতার কোটিপতি বুজু চৌধুরীর একমাত্র ছেলের দিকে চেয়েছিল। ধীরে ধীরে পরম-বিস্ময় পাটন, নির্বাণের নৌকো বাওয়া, খেয়াঘাটের-মাঝি, জনারণ্যে মিলিয়ে গেল।
পাটন চলে গেলে, চারণ বলতে গেলে, অনবধানেই ত্রিবেণী ঘাটের দিকে পা বাড়াল।
নানারকম দোকান সেই পথে। দর্জির, মনোহারির, হিন্দি বইয়ের, নানারকম ধর্মপুস্তকের। সরল গ্রামীণ তীর্থযাত্রীদের লুব্ধ করার জন্যে চোখ-ঝলসানো কাঁচের চুড়ির দোকান। কোথাও কোথাও নানা-রঙা প্লাস্টিকের খেলনা। কোথাও বা গরম জিলাপি আর সিঙ্গাড়া ভাজা হচ্ছে। কোথাও পুরী আর আলুর তরকারি, লেবু ও লংকার আচার সহযোগে পরিবেশিত হচ্ছে। সস্তা ঘি আর আচারের গন্ধ উড়ছে হাওয়াতে। এখানকার দুধ খুবই ভাল। তাই, দুধের নানারকম মিষ্টিও অঢেল। রাবড়ি, মালাই।
চারণ ভাবল, এখানে সিদ্ধির সরবতও নিশ্চয়ই পাওয়া যায়। কিন্তু কোথায় পাওয়া যায়, তার খোঁজ জানে না। ভীমগিরি জানবেন হয়তো।
শ্লথ পায়ে, উদ্দেশ্যহীন এই চলা ওর। বেশ লাগছে চারণের।
যে কোনও আধুনিক শহরেই অধিকাংশ মানুষেই হাঁটে না, দৌড়োয়ই। দুলকি চালে চলে। TROT-এ। আর পশ্চিমে তো Literally দৌড়ায়। কলকাতার কথা আলাদা। কলকাতা তো তিলোত্তমা। কলকাতার তুলনা একমাত্র কলকাতাই। সেখানে সকলেই হয়তো অজানিতেই তাঁদের আলসেমি ও অনিয়মানুবর্তিতাতে এক একজন দার্শনিক বনে গেছেন। তাঁদের হাঁটা দেখলে মনে হয় যে, তাঁদের কোনও গন্তব্য তো নেইই, থাকলেও সেখানে পৌঁছবার জন্যে আদৌ কোনও তাড়া নেই।
এই যে।
কে যেন পথ চলতে চলতে নানা চিন্তাতে বুঁদ হয়ে যাওয়া চারণের ঘোর ভাঙালে।
এই যে! চারণবাবু।
চারণ চেয়ে দেখল, ভীমগিরি। বিড়ি কিনছেন বিড়ির দোকানে দাঁড়িয়ে। মাথায় একটা সস্তা বাঁদুরে টুপি।
চারণ হাসল। বলল, বিড়ি-সিগারেট খাওয়া ভাল নয়।
তারপরেই নিজের পকেট খুঁজে বিড়ির সেই বাণ্ডিলগুলো বের করল। করে, ভীমগিরিকে দিল।
কেন? ভাল নয় কেন?
ভীমগিরি শুধোলেন।
ফুসফুসে ক্যানসার হয়, হার্ট অ্যাটাক হয়।
হলে?
মানুষ মরে যায়।
কোনও মানুষই কি আর চিরদিনের জন্যে ইজারা নিয়েছে জীবন, চারণবাবু? জন্ম-মুহূর্তেই যে সত্য সবচেয়ে বড় হয়ে ওঠে, তা হল মৃত্যু।
ভীমগিরি বিড়িগুলো নিয়ে হেসে বললেন, সুক্রিয়া।
তারপর বললেন, মৃত্যু নিয়ে এত উদ্বেগ শুধুমাত্র ভোগী মানুষদেরই থাকে। আমার মতন একজন নগণ্য উদাসী যত তাড়াতাড়ি এই গরীব দেশের অন্নধ্বংস করা বন্ধ করি ততই তো মঙ্গল। এই ভাগীরথী, শিবালিক পর্বতমালার পাদদেশ দিয়ে, এই ত্রিবেণী ঘাটের সামনে দিয়ে ঠিকই বয়ে যাবে। বসন্তর পরে গ্রীষ্ম আসবে, প্রতিবছরই, গ্রীষ্মর পরে বর্ষা, তারপরে শীত। ত্রিবেণী ঘাটও আজ সন্ধেরই মতন গমগম করবে রোজই, আমার মতন উদাসী, সাধু, সন্ন্যাসী ও পুণ্যার্থীদের ভিড়ে। দিনের বেলা দক্ষিণ বাহিনী আর রাতের বেলা উত্তর বাহিনী হাওয়া ঠিক এমন করেই বয়ে যাবে, যেমন করে বইছে যুগযুগান্ত ধরে। কড়োয়া চওথ-এ এমনি করেই প্রদীপ ভাসাবে সালঙ্কারা বিবাহিতা মেয়েরা। কোনও কিছুরই কিছুমাত্রই পরিবর্তন হবে না। শুধু আমিই থাকব না। এই ঘাটতিটুকুও কারও চোখেই হয়তো পড়বে না।
তারপর একটু থেমে বললেন, চারণবাবু, জীবন নিরবধি চলছে, চলবে। মানুষের জীবন বড়ই ছোট। এখানে জলের উপরে নাম লিখতে এসেছি আমি। অগণ্য সাধারণ মানুষেরই মতন। আমার মৃত্যুতে মহাদেবের ওই পাথরের চতুষ্পদ নন্দীও এক ফোঁটা চোখের জল ফেলবে না। তাই বলছিলাম, বিড়ি খাওয়ার সামান্য সুখটুকু থেকে নিজেকে বঞ্চিত করব কেন?
তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন, তাছাড়া, আমরা প্রত্যেকেই তো প্রাপ্তবয়স্ক। কেউই শিশু নই। তাই এটা কোরো না, ওটা কোরো না কারওকে না বলাই ভাল। কথা তো কেউই শুনবে না অন্যের। মধ্যে দিয়ে আপনিই মিছিমিছি নিজের মান হারাবেন।
চারণের দুকান লাল হয়ে গেল। চুপ করে রইল ও।
ভীমগিরি বললেন, চলুন। আজ আমার গুরুর কাছে দুজন বিদেশি শিষ্য এসেছেন। তাঁরাই গুরুসেবা করছেন। তাই আমি আজ একটু ঘুরে-ঘারে গিয়ে ভজনে বসব।
বিদেশি শিষ্য মানে? কোন দিশি?
অস্ট্রিয়া।
তারপরই তিনি জিগ্যেস করলেন চারণকে, আপনি কি গেছেন সে দেশে? দেশটা কোনদিকে?
গেছি। দেশটা পশ্চিমে। ইউরোপেরই দেশ একটি আর কী! টীরল বলে একটি প্রভিন্স আছে অস্ট্রিয়াতে। দারুণ। জেনারাল রোমেল-এর নাম শুনেছেন আপনি? তিনি সেখানেই জন্মেছিলেন।
কে জেনারাল রোমেল?
জামান জেনারাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন মরুভূমির যুদ্ধে যিনি বাঘা বাঘা ইংরেজ জেনারালদের, মন্টোগোমারি সুদ্ধ, একেবারে ঘোল খাইয়ে ছিলেন। জেনারাল রোমেলকে বলা হত ডেজার্ট-ফক্স। মানে মরুভূমির শেয়াল। নাম শোনেননি? তাঁর নাম শুনলেই শত্রুপক্ষের সৈন্যদের বুকের রক্ত হিম হয়ে যেত।
তাই? নাঃ। শুনিনি।
হেসে বললেন, ভীমগিরি।
তারপরই বললেন, আমি শুধু একজন জেনারালেরই নাম শুনেছি। এ পৃথিবীর সব দেশে কত শয়ে শয়ে জেনারাল আছেন। সকলকে জানার সময় কোথায়? প্রয়োজনই বা কি? এই ঘোট জীবনে একজনকে জানাই যথেষ্ট। তাঁর নামেই এ ভবতরী পার হয়ে যাব। তারপরে একটু থেমে বললেন, আপনাদের গোলমালটা কোথায় জানেন?
কোথায়?
আপনারা বড় বেশি জানেন। অত কিছু জানার প্রয়োজন নেই কোনও।
তাই?
তা নয়তো কি? জ্ঞান হলেই তো হল না, জ্ঞান তো হজমও করা চাই। গরু-ছাগলেও জাবর কাটতে জানে, শুধু জানল না মানুষে। ভাবলেও বড় অবাক লাগে।
কে তিনি? মানে আপনার সেই একজন?
ধিয়ানগিরি মহারাজ। আর কে আমার জেনারাল? আমার গুরু।
বলেই, আবার হাসলেন।
এখানে সিদ্ধি পাওয়া যায়?
প্রসঙ্গ বদলে, চারণ বলল।
সিদ্ধিলাভের জন্যেই তো এত মানুষের এখানে আনাগোনা। কেউ কেউ অবশ্যই পায়।
আহা! সে সিদ্ধি না। মানে, খাওয়ার সিদ্ধি।
ও বুঝেছি। ভাঙ্গ এর কথা বলছেন? অবশ্যই পাওয়া যায়। তা আপনি গুলি খাবেন, না সরবত?
গুলি কখনও খাইনি। দশেরার দিনে সরবত খেয়েছি কয়েকবার।
সরবতই যখন খাবেন তত আমি নিজে হাতে বানিয়ে দেব। দোকানের সরবত ভাল নয়।
কোথায় বানাবেন?
আমার ডেরাতে নিয়ে যাব।
আপনি তো ওই চাতালেই থাকেন। ডেরা আবার কোথায় আপনারা?
এতদিন তাই ছিলাম। কাল রাত থেকেই উঠে গেছি ডেরাতে। পরশু থেকেই শীতটা বড় জাঁকিয়ে পড়েছে। বিস্ত ডাগদার বলেছেন আমার ব্লাড প্রেসার নাকি লো, তাই ঠাণ্ডা বেশি লাগে। তাছাড়া, সাইনাসাইটিস না কি রোগ, তাও আছে আমার। ঠাণ্ডা সয় না বেশি।
তাই?
হ্যাঁ।
আর আপনার গুরু?
গুরু আমার সিদ্ধপুরুষ। তিনবছর এই নদীতেই গলা অবধি ডুবিয়ে নাঙ্গা হয়ে বসেছিলেন।
বলেন কি? কবে? শীতেও?
চমকে উঠে বলল, চারণ।
হ্যাঁ।
সে বহুদিনের কথা। সব ঋতুতেই। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা। লাগাতার তিন বছর।
কেন?
নিজেকে কষ্ট দেওয়ার জন্যে। শরীরটা যে কিছু নয়, মনটাই আসল, এই জানাকে ধ্রুব করার জন্যে।
চারণ অবাক হয়ে গেল। ভাবল, এমনিতেই বেঁচে থাকতে কতরকম কষ্ট। তাতেও কুলোল না! নিজেকে আরও কষ্ট দেওয়া! এখনও পুরো শীত আসেনি তবুও নিজে ও এই বরফ-গলা নদীতে পনেরো মিনিটও থাকতে পারবে না। আর তিন বছর?
তারপরই মনে মনে ভাবল, এসব গাঁজাগুল। সত্যি হতেই পারে না। এ সব করা হিউম্যানলি ইম্পসিবল। এ কথা সত্যি হওয়ার পেছনে কোনওই যুক্তি নেই। এঁরা নিজেরা গাঁজা খান বলে তো আর চারণ গাঁজা খায় না যে যা-ই শুনবে অশিক্ষিত তীর্থযাত্রীদের মতন তা-ই বিশ্বাস করবে?
ভীমগিরি বললেন, যা ভাবছেন, তা নয়।
চমকে উঠে চারণ বলল, কি ভাবছি?
যা ভাবছেন।
তারপরই বললেন, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদুর।
বলেই, একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
এই বাক্যটি এর আগে বহু মানুষকে বহুবারই বলতে শুনেছে চারণ। ও নিজেও হয়তো বলেছে কখনও সখনও সম্পূর্ণ অন্য প্রেক্ষিতে। কিন্তু আজ এই সন্ধেবেলাতে ত্রিবেণী ঘাটের পাশের গলিতে দাঁড়িয়ে ভীমগিরির মুখ থেকে শুনে বুঝতে পারল যে, ওই বাক্যটি জানত ঠিকই কিন্তু তার যাথার্থ সম্বন্ধে কোনও জ্ঞানই ছিল না। বিশ্বাস এবং অবিশ্বাস কলকাতাতে নিছকই দুটি শব্দ মাত্র। কিন্তু হৃষীকেশের এই ত্রিবেণী ঘাটের সামনে দাঁড়িয়ে শব্দ দুটির যে কী তাৎপর্য তা যেন বুঝতে পারছে একটু একটু।
চলুন এগোই। আজ আবার মাদ্ৰীও এসে বসে থাকবে।
মাদ্রী! মাদ্রী কে?
চেনেন না? সেই যে গুরুবহিন আমাব। আমার কাছে এসে কথা বলল না সেই রাতে? দেখেছেন নিশ্চয়ই, মনে নেই আপনার?
হবে।
স্বগতোক্তি করল চারণ। আসলে মনে ঠিকই ছিল। সেটা দেখাতে চাইল না।
চলতে চলতে ভীমগিরি বললেন, আমাদের এই সব হঠযোগ নিয়ে পশ্চিমী দেশে অনেক হাসি-তামাশা করা হয় বলে শুনেছি। কলকাতা বম্বে দিল্লির মতন বড় বড় শহরেও আপনাদের মতন ইংরেজি-নবীশেরাও করে থাকেন যে, তাও জানি। তাতে আমার গুরুর মতন যোগীর কিছুমাত্রই এসে যায় না অবশ্য। শুধু অঙ্গারই জানে, আগুনের মাহাত্ম্য। যারা আগুন পোহায়, আগুনে শুধু উষ্ণতাই খোঁজে, তারা আগুনের স্বরূপ সম্বন্ধে কতটুকুই বা জানে। সকলকেই সব কিছু জানার জন্যে মাথার দিব্যিই বা কে দিয়েছে কাকে!
বলেই, একটি বিড়ি বের করে বলল, নিন, বিড়ি খান একটি। তারপরই বলল, এইরকম তিনবছর জলে ডুবে ছিলেন দুধাহারী বাবাও। হরিদ্বারে।
কি নাম?
দুধাহারী বাবা। শুধু দুধ খেয়ে থাকতেন তাই নয়, তাঁর আশ্রমে আজও যেই যায় তাকে হয় দুধ, নয় লস্যি বিতরণ করা হয় বিনামূল্যে।
তিনি কি বেঁচে আছেন?
না, গত হয়েছেন বহুদিন হল।
আমি যে এনেছিলাম, সেই বাণ্ডিলগুলো থেকে খেলেন না বিড়ি?
চারণ বলল।
আপনি এনে দিয়েছেন তো বটেই। সবসময়েই আমি আমি করবেন না। আমিত্বকে পুরোপুরি মাটি চাপা দিতে হবে। এই প্রথম পাঠ। আমার এই বিড়ি সে বিড়ি নয়। এতে গাঁজা আছে। খেয়ে দেখুন।
গাঁজা খেলে কি হবে?
চিন্তিত গলাতে বলল চারণ।
তাজা হবেন আর কী! খেলে, মনের গ্রহণ ও প্রেরণ শক্তি বেড়ে যাবে, বৃষ্টির পরে প্রকৃতির যেমন হয়। আপনাদের বিলিতি মদের চেয়ে অনেকই ভাল। পশ্চিমী দেশের নেশা মাত্রই উত্তেজনা বাড়ায়। আর আমাদের নেশাকে, ঠিক নিস্তেজক বলব না, বলব এ নেশা নির্লিপ্ত আনে। গাঁজা বা ভাঈ খেয়ে কেউ কারোকে ধর্ষণ করেছে এমন কি শুনেছেন কখনও? খুনোখুনি করেছে? কিন্তু মদ খেয়ে অনেকেই করে। করে কি না বলুন?
হ্যাঁ। কাগজে তো প্রায়ই দেখি তেমন খবর।
গাঁজা খেলে না কি বিশেষ কোনও কোনও ক্ষমতা বাড়ে।
বাড়ে কি না বলতে পারে তেমনই মানুষ, যার দুরকমের অভিজ্ঞতাই আছে। অর্থাৎ, খেয়ে এবং না খেয়েও যে…। বলব বলব, সে সব কথা হবে এখন। এবারে একটু পা চালিয়ে চলুন দেখি চারণবাবু।
.
দূর থেকে আলো-ঝলমল ত্রিবেণী ঘাট দেখা যাচ্ছিল। মাইকে ভজনের আওয়াজ ভেসে আসছিল। এত স্ত্রী পুরুষ, দেশ-বিদেশের কত বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা, কেউ ঘাটের দিকে যাচ্ছেন, কেউ ফিরে আসছেন। কেউ হাসিখুশি, কেউ বিমর্ষ। দ্রুতধাবমান দীপমালা বুকেকরা গঙ্গা অন্ধকারে কতজনের সুখ দুঃখ বয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে হর-কি-পউরির দিকে।
ঘাটের কাছে এলেই মনটা কেমন যেন অন্যরকম হয়ে যায়। কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেও দেখেছে যে এমনটি হয়। ভক্তি বা বৈরাগ্য বা ভীমগিরি সমিসীর ভাষায়, উদাসীনতা (নিজেকে উনি উদাসী বললেন আজ।) সম্ভবত কোনও বিশেষ স্থানের দান নয়। তা থাকে এক-একজনের অন্তরেরই মধ্যে। কোনও বিশেষ স্থান সেই ভাবকে উদ্দীপ্ত করে মাত্র।
দেখল, চাতালের সেই কোণে দুজন লম্বা শ্বেতাঙ্গ পুরুষ সাদা ধবধবে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে ধিয়ানগিরি মহারাজের সামনে বসে আছেন জোড়াসনে। একজনের হাতে ফাইফ-ফাইফ-ফাইভ সিগারেটের খোলা-প্যাকেট, দুহাতে ধরে বাবাকে নিবেদন করছেন। অন্য জন, গাঁজার কলকে সেজে বাবার জন্যে ধরে আছেন। নিবেদন করবেন বলে স্থির। ধিয়ানগিরি মহারাজ যেন ধন্দে পড়েছেন আগে কোনটির সেবা করবেন তা নিয়ে। পাশেই, ভীমগিরির সেই গুরুবহিন মাত্ৰী দাঁড়িয়ে আছে। আজ একটা লাল শাড়ি পরেছে মাত্ৰী, সাদা ব্লাউজ। দেখে মনে হচ্ছে যেন তামাকের টিকেতে আগুন লেগেছে। কিন্তু মাত্রীর গায়ের কালোরঙের কথা কারোরই মনে থাকবে না, তার সাদা দাঁতের হাসি একবার দেখতে পেলে। ওই হাসি দেখলেই বোঝা যায় যে ও সাধারণ নয়, হয় উদাসী নয় সন্ন্যাসিনী। গৃহী মানুষী অমন হাসি হাসতে পারে না। চারণ লক্ষ করল যে, আজও মাত্রীর মাথাতে ফুল। আজকে বেণী বাঁধেনি, খোঁপা করেছে। মুখে বিন্দুমাত্র প্রসাধন নেই তার, সারল্য আর বুদ্ধির প্রসাধন ছাড়া।
ভীমগিরিকে তার ভালই লেগেছিল। কিন্তু এখনও তাঁর গুরু ধিয়ানগিরি সম্বন্ধে কিছুমাত্রই ব্যক্তিগতভাবে না জেনে তাঁকে ভাল বা মন্দ কিছুই এখনও লাগেনি। পরের মুখে ঝাল খাওয়া স্বভাব নয় চারণের। মানুষটি তার দিকে তাকিয়েছেন, ভীমগিরির পাশে বসে সেই রাতে অনেকক্ষণ যে চারণ গল্প করেছে তাও লক্ষ করেছেন। কিন্তু তাতেই ধন্য হয়ে যাবার মতন কিছু ঘটেনি চারণের। এখনও অন্ধভক্তি বা মূর্তি বা ব্যক্তি-পুজোর মতন বোকামি তাকে পেয়ে বসেনি। তবে এ কথা ঠিক, যতই দিন যাচ্ছে, চারণ এই অনুষঙ্গে, এই প্রেক্ষিতে বেশ এক মজা তো বটেই একধরনের সম্ভ্রমও যেন বোধ করতে শুরু করেছে। ধিয়ানগিরি তাকে পাত্তা দেননি। তারই বা কি দরকার পড়েছে তাঁকে পাত্তা দেওয়ার। ওর কোনও পাটন-পাটনির দরকার নেই।
হঠাৎ পাশ থেকে ভীমগিরি বললেন, জগৎ আমি-ময়, তাই না চারণবাবু?
ভীষণ চমকে উঠল চারণ।
তারপরই একটু ভয়ও পেয়ে গেল। এই উদাসী ভীমগিরি তো উদাসী মাত্র নন। যাই চারণ ভাবুক না কেন সঙ্গে সঙ্গেই তা জানতে পেরে যাচ্ছেন এই সন্নিসী। যেন, কোনও মন্ত্রবলে।
চারণ মাথা নেড়ে জানাল, যে, তাই। জগৎ আমি-ময়।
ভীমগিরি বললেন, জানেন, এক ব্যাধ গেছিল এক অদৃষ্টপূর্ব সাংঘাতিক হিংস্র জানোয়ারকে মারতে, গ্রামবাসীদের অনুরোধে। সেই জানোয়ারকে গ্রামবাসীরাও দেখেনি কেউই। কিন্তু তাদের গ্রামের লাগোয়া-জঙ্গলে সেই প্রাণীর ভয়ংকর উপস্থিতি টের পেয়েছে তারা নানাভাবেই। ব্যাধ যখন খুঁজতে খুঁজতে বনের মধ্যে এক তালাও-এর পাশের নিবিড় বনের মধ্যে আলোড়নের শব্দ শুনল হঠাৎ, তখন সে বিষাক্ত তীর, ধনুকের ছিলাতে চড়িয়ে অতি সাবধানে এগোল সেদিকে। এগোতে এগোতে যখন সেই ভয়ংকরের খুবই কাছে পৌঁছে গেল তখন হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল সেই জানোয়ার। ব্যাধ চমকে উঠল নিজে, নিজেরই গলার স্বর শুনে। তারপরই দেখতেও পেল। তার নিজেরই চেহারা, তাকেই। তবে ভয়াবহ, রোমশ, পৃথুল, বিকটদন্তী, কোনও প্রাগৈতিহাসিক আরণ্যক জন্তুরই মতন।
জন্তু বলল, মারবি কাকে? আমি বাইরের কেউ নই, আমি তোরই অন্তরবাসী। আমিই তুই। তোকে কাছে আনবার জন্যেই আমি গ্রামবাসীদের ভয় দেখিয়ে ছিলাম। তীর খুলে নে ছিলা থেকে। নিজেকে শাসন কর, শোধন কর, তোর অন্তরের জানোয়ারকে, শৃঙ্খলাবদ্ধ কর, তাহলেই আমার মৃত্যু হবে। তোর মধ্যে যে-আমি আছি, সেই-আমিকে গলা টিপে মেরে ফেল। যদি মানুষের মতন মানুষ হয়ে বাঁচতে চাস।
চারণ বলল, এ গল্প আপনি কোথায় পড়েছেন?
কোথাওই পড়িনি। গুরুর মুখে শোনা। গুরু কোথায় পড়েছেন তা গুরুই বলতে পারবেন। পড়াশুনা আমি আর কতটুকু জানি। আমার যতটুকু শেখা, সবই গুরুমুখী।
ভীমগিরি মাদ্রীর কাছে চলে গেলেন।
চারণ কিছুক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে কী এক অপ্রতিরোধ্য টানে ধিয়ানগিরির কাছে পৌঁছেও তাঁর একেবারে সামনে গেল না। বুঝল, তার ভিতরের জন্তুটা তখনও একটুও দুর্বল হয়নি। সে ওই অস্ট্রিয়ান ছেলে দুটির পেছনে চাতালে বসে ঘাটের দিকে চেয়ে রইল যেন ও ধিয়ানগিরির প্রতি আদৌ মনোযোগী নয়। তবে কান দুটি খাড়া করে রাখল, আধো-শোয়া আধোবসা উবু হয়ে থাকা অতি সাধারণ চেহারার সেই সন্নিসীর মুখনিঃসৃত কথা শোনার জন্যে।
এই অস্ট্রিয়ান যুবক দুটিও কি হিন্দি জানে! তাদের বয়স চারণের চেয়ে পাঁচ-ছ বছর কম হবে হয়তো আরও কম হতে পারে। পশ্চিমদেশের আর পর্বতবাসীদের বয়স চট করে বোঝা যায় না।
গাঁজা-দেওয়া বিড়িটা খেয়ে বিশেষ কিছু যে মনে হল এমন নয়, তবে এক অভূতপূর্ব বোধ জাগতে লাগল ধীরে ধীরে। ভীমগিরি যেন বুঝতে পেরেই হঠাৎই উদয় হয়ে আর একটি বিড়ি দিয়ে গেলেন চারণকে। ছোট হয়ে-আসা প্রথম বিড়িটি থেকে চারণ দ্বিতীয় বিড়িটি ধরিয়ে নিল।
ছেলে দুটির মধ্যে একজন, যে, চাতালের উপরে কিন্তু ঘাটের দিকে বসেছিল, ইংরেজিতে বলল, গুরুজি, আপনি বললেন, Religion মানে A force which binds together. কিন্তু হিন্দুধর্মর বাঁধন এমন আলগা হয়ে গেছে কেন? এইরকম ধর্মস্থান ছাড়া হিন্দুধর্ম যে বেঁচে আছে তাই তো বোঝা যায় না। আমাদের মতে, মানে আমরা দেখি এদেশে এসে, ইসলামের বাঁধন, ধর্ম হিসেবে, অনেকই দৃঢ়, অনেকই সহজ গোর। প্রতি শহরে এবং গ্রামেও আমাদের ঘুম ভেঙে যায় আজানের শব্দে। অধিকাংশ মুসলমানই দিনে পাঁচবার না হলেও দুবার অন্তত নামাজ পড়েন। ধর্মাচরণ করাটা (Rituals) শিক্ষিত অশিক্ষিত সকলেরই কমবেশি কর্তব্য বলে মনে করেন দেখি অথচ শিক্ষিত হিন্দুরা ধর্মাচরণকে ছোট চোখে দেখেন। আপনি কি বলেন? এটা কি হিন্দুধর্মের দৌর্বল্য বা হীনতা?
কথাবার্তা সবই হচ্ছিল ইংরেজিতেই। চারণের নেহাত বিদেশিদের সঙ্গে নিত্য ওঠাবসা ছিল, নিজেও একসময়ে পড়াশোনাও করেছিল ইংল্যান্ডে। তাই অস্ট্রিয়ান ছেলেটির ইংরেজি উচ্চারণ বুঝতে তার কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না। কিন্তু ও অবাক হয়ে যাচ্ছিল ভিখিরির চেয়েও গরিব, প্লাস্টিকের নোংরা চাঁদরের চাঁদোয়ার নীচে কুঁজো হয়ে বসে, অ্যালুমিনিয়ামের খালি-দুধের বাসনের গায়ে তাল দিয়ে গুনগুনিয়ে গান-গাওয়া এই ধিয়ানগিরি সন্নিসী কী করে এইরকম অ্যাকসেন্টের ইংরেজি অতি সহজে বুঝছেন!
বুঝছেন যে, তা বুঝল তাঁর উত্তর শুনেই।
ধিয়ানগিরি যখন মুখ খুললেন, মিটিমিটি হাসতে হাসতে, তখন চমক লাগল চারণের তার ইংরেজি উচ্চারণ শুনেও। শুদ্ধ অলক্সানিয়ান উচ্চারণে কথা বলছেন ধিয়ানগিরি মহারাজ। যে উচ্চারণের কথা আজকের তেল-সাবান টিভি ভিসিআর বিক্রি করা ভারতীয় ইংরেজি বলা, অধিকাংশ অ্যাড-এজেন্সির সর্বজ্ঞরা অথবা তাঁদের মক্কেলেদের এক-লাখি দুলাখি চাকরেরা কল্পনাতেও আনতে পারেন না।
খুবই লজ্জা পেল চারণ, নিজেরই কারণে। ভাবল, সাহেবরা পাত্তা দিচ্ছে, এ দেখে বা ধিয়ানগিরি দারুণ সাহেবি ইংরেজি বলছেন বলেই কি তার মনে সম এল সন্নিসী সম্বন্ধে? ছিঃ ছিঃ ছিঃ।
হতেও পারে। ইংরেজরা এদেশে থাকাকালীন ওদের উপরে যতখানি প্রভুত্ব করতে পেরেছিলেন, তাঁরা চলে যাবার পঞ্চাশ বছর পরে সেই প্রভুত্ব আরও অনেকই বেশি দৃঢ় হয়েছে। তবে তার প্রকৃতি পালটে গেছে। উইনস্টন চার্চিল কবরের মধ্যে শুয়ে তাঁর বিদ্রুপাত্মক হাসিটি হয়তো সমানে হেসে চলেছেন। উনি বলেছিলেন যে, এই অসভ্য বর্বর মানুষেরা (ভারতীয়রা) নিজেদের স্বাধীনতার মোগ্য করে তোলেনি এখনও।
কে জানে। হয়তো তিনি ঠিকই বলেছিলেন। স্বাধীনতার মোগ্যতা যদি চারণদের সত্যিই থাকত তাহলে পঞ্চাশ বছরে দেশের অবস্থা এইরকম করে তুলত না। হয়তো নিজেদের স্বরাজ এমন নৈরাজ্যে এসে পৌঁছত না।
পরক্ষণেই অস্ট্রিয়ান শিষ্যর কঠিন প্রশ্নর উত্তরে ধিয়ানগিরি কি বলেন তা শোনার জন্যে উৎকর্ণ হয়ে রইল চারণ সমস্ত মনোযোগ সেদিকে দিয়ে।
ধিয়ানগিরি হেসে বললেন, সব ধর্মেরই বাহ্যিক রূপটি একরকম নয়।
তারপর একটু চুপ করে থেকে কী যেন ভেবে বললেন, তুমি কি আমাদের ফঙ্গু নদী দেখেছ? গৌতম বুদ্ধ যেখানে বোধিলাভ করেছিলেন সেই বোধগয়ারই পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ফ। অন্তঃসলিলা।
সাহেবরা সমস্বরে বলে উঠল ইয়েস ইয়েস, নিয়ার গায়া।
ধিয়ানগিরি হাসলেন। উনি জানতেন যে গয়াকে ওরা গায়া উচ্চারণ করবে।
তারপর বললেন, সে নদীর দুটি শাখা নদীও আছে। নাম, জাঁম আর ইলাজান।
দ্বিতীয় শিষ্য বলল, জাম। অদ্ভুত নাম তো।
অদ্ভুত নয় বেটা। আমাদের দেশ মস্ত দেশ। বহু ভাষাতে কথা বলে এখানে মানুষ। অধিকাংশ মুসলমানের ভাষাই হল উর্দু। জাঁম শব্দটা একটি উর্দু শব্দ।
জাঁম মানে কি?
এক শিষ্য প্রশ্ন করল।
ধিয়ানগিরি হাসলেন।
কাছ থেকে তাঁর হাসি দেখে চারণ এই প্রথমবার বুঝল যে, এই ব্যক্তিটির সঙ্গে তার অনেকই অমিল। এমন সরল পবিত্র হাসি বহুকাল দেখেনি কারওকেই হাসতে।
উনি হেসে বললেন, জাঁম মানে, পানপাত্র। বিখ্যাত এক মুসলমান কবির কবিতা আছে : অ্যায়সা ডুবাহুঁ তেরী আখো কি গেহরাইমে,
হাত মে জাঁম হ্যায়, মগর পীনেকি হোঁস নেহি।
চারণ মুগ্ধ হয়ে গেল এবারে ধিয়ানগিরির উর্দু উচ্চারণ শুনেও। যদিও মানেটা সাহেবের ঠিক বোধগম্য হল না।
তারপরই বললেন, Hinduism, as a religion is like that river. River Falgu. It is not apparent. The water flows Beneath the sands Unseen.
তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন, You have to scratcha Hindu to find Hinduism in Him
অর্থাৎ হিন্দুধর্ম ফল্লু নদীরই মতন অন্তঃসলিলা। বাইরে থেকে বোঝাই যায় না যে, আছে।
তারপর ধিয়ানগিরি গাঁজার কল্কেতে একটান দিয়ে কিছুক্ষণ দম আটকে রেখে তারপর ধুয়ে ছেড়ে বললেন, এই ধর্মের আচার-আচরণ, রেজিমেন্টেশান, অন্য ধর্মের চেয়েও অনেক কম দৃশ্যমান কিন্তু ফন্ধুর বালি খুঁড়লেই তবেই যেমন জল বেরোয় তেমনই কোনও শিক্ষিত ইংরেজিনবীশ, ধর্মে আপাত-অবিশ্বাসী উচ্চমণ্য হিন্দুকে খোঁচাখুঁচি করলে হিন্দুত্ব যে নিহিত আছে তার চামড়ার নীচে, তখনই তা বোঝা যাবে।
এ কথা কেন বলছেন? একটু বুঝিয়ে বলুন।
প্রথম শিষ্য নিজের কন্ধেতে টান দিয়ে বললেন।
বলছি, এ জন্যে যে, এটাই সত্যি। আজকের অর্ধশিক্ষিত, দাম্ভিক, স্বাভাবিক বুদ্ধিরহিত অগণ্য ধর্মবিশ্বাসহীন আধুনিক হিন্দুদেরও কানে যখন মন্দিরের কাঁসর-ঘণ্টা, ফুলের আর ধূপধুনোর গন্ধ, তাদের সদ্য-স্নাতা মা-ঠাকুমার লালপেড়ে গরদের বা তাঁতের বা মিলের শাড়ির গন্ধ স্মৃতি থেকে উঠে আসে নাকে, সেই সব পবিত্র, পাখিডাকা সকাল-সন্ধে, পুজোর ঢাকের বাদ্যির সঙ্গে যখন ফিরে আসে তাদের মস্তিষ্কে, তাদের স্মৃতিতে, পরিযায়ী পাখিদেরই মতন বহুদূরের বিস্মৃতি ও পণ্ডিতম্মন্যতার কুয়াশা-ভেজা জলাভূমি থেকে, তখন তারা বুঝতে পারে এবং বোঝেও যে, ঈশ্বরবাদ যদি প্রমাণ-সাপেক্ষ হয় (তারা প্রমাণ বলতে যা বোঝায়) তবে নিরীশ্বরবাদও সমানভাবেই প্রমাণ সাপেক্ষ। ধর্ম মানা বা ধার্মিক হওয়ার মধ্যে কোনওই লজ্জা নেই। সে ধর্ম, যে ধর্মই হোক না কেন। সে হিন্দু বলে তার লজ্জিত হওয়ারও বিন্দুমাত্র নেই, যদি না সে সবার্থে অজ্ঞ এবং কাপুরুষ হয়।
ধিয়ানগিরি অবশ্যই হুবহু এই ভাষাতে বলছিলেন না। তবে চারণ, অন্য কিছু না জানলেও ইংরেজিটা হয়তো ধিয়ানগিরির চেয়ে একটু ভালই জানে, তাই ধিয়ানগিরির বক্তব্য তার নিজের ভাষাতে ব্যক্ত করতে গিয়ে হয়তো একটু অন্যরকম করে ফেলল।
একটু চুপ করে থেকে আবার ধিয়ানগিরি বললেন, ইসলাম কি শেখায় জান? শেখায়, আল্লা ছাড়া দ্বিতীয় কারও কাছেই মাথা নোয়বে না। আমাদের হিন্দুধর্মও তাইই শেখায় : ঈশ্বর ছাড়া আর কারওকেই ভয় করবে না।
তবে, মাঝে মাঝেই যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয় এই দুই ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে আপনাদের ভারতে?
বাঁদিকে বিদেশি শিষ্য জিগ্যেস করলেন।
সব ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই গুণ্ডা বদমাইস থাকে। মানুষ হিসেবে যারা বাজে। তাদের চেয়েও বড় বদমাইস সব ধর্মের রাজনীতিকেরা। শালারা সবাই গিধ্বড়। ধর্মাবলম্বীদের এক শ্রেণীর মধ্যে বিরোধ সব কালেই সব দেশেই ছিল, ক্রিশ্চান-ইহুদি, ইহুদি-মুসলিম, মুসলিম-হিন্দু কিন্তু কোনও ধর্মের সঙ্গেই অন্য ধর্মের বিরোধ নেই। কখনওই ছিল না। All Roads lead to Rome।
বলেই, হেসে, এমন এক টান লাগালেন তাঁর গাঁজার কল্কেতে যে, কল্কে প্রায় ফাটে ফাটে আর কী! তারপর আবারও দম বন্ধ করে রইলেন, গাল ফুলিয়ে বেশ অনেকক্ষণ। চোখ দুটি লাল হয়ে বড় হয়ে গেল। চোখের মধ্যেও যে শিরা আছে, থাকে, তা দৃশ্যমান হল।
দুই বিদেশি শিষ্য মন্ত্রমুগ্ধের মতন বসে রইলেন গুরুর পায়ের কাছে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে। তাঁদের মুগ্ধতার অনেকখানিই গুরুর বহুমুখী পাণ্ডিত্যর কারণে। আর কিছুটা এল গঞ্জিকা সেবনেরও ফলে। চারণ এখানে এসে পৌঁছবার ঠিক কতক্ষণ আগে থেকে তারা গুরু এবং গঞ্জিকার সেবা করছিল তা অবশ্য জানা ছিল না চারণের। তবে, খুব বেশিক্ষণ হবে না। সন্ধে তো হয়েছে মাত্র ঘণ্টাখানেক ঘণ্টা-দেড়েক হবে।
চারণ উঠে পড়ল।
ভাবল, জ্ঞান আহরণ ভাল কিন্তু একসঙ্গে ভোজ বেশি হয়ে গেলে দলমা থেকে আসা পুরুলিয়ার বা মেদিনীপুরের Over-Tranqulaised বুনো-হাতিরই মতন বেঘোরে অক্কা পাবে। সবে গাঁজার নেশা জমেছে চারণের, গুরুর নেশাও। এখুনি সে মরতে চায় না আদৌ।
সে একটু তফাতে গিয়ে বসল চাতালে। গুরু আজও তাকে পাত্তা দিলেন না। সেও বিশেষ পাত্তা দিল না। পাত্তা দেবার মতন কিছু হয়নি। গুরু যত বড় মানুষই হন না কেন চারণকে তিনি ইস্পট্যান্ট মনে করলে তবেই চারণ তাঁকে ইস্পট্যান্ট মনে করবে।
আপাতত, তাঁর ভীমগিরিই ভাল।
মাদ্রী মেয়েটির মুখে সবসময়েই হাসি ঝুলে থাকে এবং একটি আলগা শ্রীর সঙ্গে আলগা দীপ্তি, তার চুলের ফুলেরই মতন। এই দীপ্তিময়ী শ্ৰী, তার গায়ের রঙের কালিমাকে ধুয়ে-মুছে দিয়ে তাকে এক আশ্চর্য স্বাতন্ত্র দিয়েছে। প্রথম দর্শনেই মনে হয়েছিল চারণের যে, মাদ্রী যেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যকের ভানুমতী। রাজা দোবরুপান্নার কন্যা, পথ ভুলে, লবটুলিয়া বইহার বা নাড়া বইহারের তৃণভূমি পেরিয়ে, মহালিখাপুরের পাহাড়ের মায়া কাটিয়ে, এই শিবালিক পর্বতমালার পাদদেশে প্রবাহিত পুণ্যতোয়া জাহ্নবীর পাশে এসে থিতু হয়েছে। এখনও সে অবিবাহিতা। অতি বড় বরণী না পায় বর, অতি বড় ঘরণী না পায় ঘর। চারণের মা এই বাক্যটি বলতেন ওদের ছেলেবেলায়। মানেটা তখন ঠিক বোঝেনি, আজও বোঝে না। তবে আন্দাজ করতে পারে। অবশ্যই।
মাদ্রী, ভীমগিরিকে ছেড়ে, সেদিন যেমন ঘাটের দিকে গেছিল, তা না গিয়ে বাজারের অলিগলির মধ্যে ঢুকে আলো-ঝলমল বহুবর্ণ কাঁচের দোকানের সারির মধ্যে তার লালশাড়ি পরে হারিয়ে গেল।
ভীমগিরি, চারণকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে বলল, এবারে একটু ভজন করা যাক।
চারণ বলল, করুন। ভজন শুনব বলেই তো বসে আছি। আপনার গলাতে সপ্তসুর জীবন্ত হয়ে ওঠে।
ভীমগিরি লজ্জা পেয়ে বললেন, ছিঃ ছিঃ। আমি গান গাইতেই জানি না, সপ্তসুরই সুপ্ত এখনও। গান করেন আমার গুরু। যেদিন শুনবেন, সেদিন বুঝবেন।
ঠিক সেই সময়ে একজন সন্নিসী যেন শূন্য থেকেই উদিত হয়ে ভীমগিরির সামনে এসে দাঁড়ালেন। তার পথজুড়ে। তার পিঠের উপরে গোল করে পাকানো একটি চিতল হরিণের চামড়া। বেঁটে-খাটো, গাঁট্টাগোট্টা চেহারা। গায়ের রঙ কালো না হলে হুবহু ডিয়েগো মারাদোনা বলে চালিয়ে দেওয়া যেত অনায়াসে। তবে বয়স হয়েছে পঞ্চাশ-মতন। ভীমগিরি তাঁকে দেখেই ভজনের তোড়-জোড় ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তাঁকে স্বাগত জানালেন।
আগন্তুক বললেন, মেধানন্দ মহারাজ নেই?
মেধানন্দ?
প্রথমে অবাক হলেন, তারপরে একটু ভাবলেন ভীমগিরি।
তারপর বললেন, আমার গুরু হয়তো তাঁকে জানাতে পারেন। আমি তো তাঁকে জানি না। কোথায় থাকতেন তিনি?
এই ত্রিবেণী ঘাটেই।
কোন সময়ে?
তা বছর কুড়ি আগে হবে।
ভীমগিরি আগন্তুককে ধিয়ানগিরি মহারাজের কাছে নিয়ে গেলেন। দূর থেকে, ধিয়ানগিরি মহারাজ এবং আগন্তুক সন্নিসীর মধ্যে কি কথা হল শুনতে পেল না চারণ ঘাটের গোলযোগের মধ্যে তবে দেখল যে, আগন্তুক ধিয়ানগিরির কাকের বাসার মতন বাসাটিরই অনতিদূরে খোলা আকাশের নীচে পিঠের মৃগচর্মটি বালির উপরে সমান করে পেতে নদীতে গেলেন আচমন করতে। একটু পরেই ফিরে এসে, ওই চিত্রল হরিণের চামড়ার আসনের উপরে পদ্মাসনে পশ্চিমে চেয়ে ধ্যানে বসলেন।
ভীমগিরি তাঁকে বসিয়ে দিয়ে, আবার চারণের কাছে ফিরে এলেন।
বললেন, বহু দূর থেকে আসছেন। সারাদিন অভুক্ত আছেন।
উনি কে? এলেন কোথা থেকে?
ওঁর নাম স্বামী পদ্মানন্দ, মেধানন্দ মহারাজের শিষ্য। মেধানন্দ মহারাজ নাকি সিদ্ধ-যোগী ছিলেন। আমার গুরু তাঁকে জানতেন। তবে তিনি এই ঘাটেই দেহ রেখেছেন আজ প্রায় দশ বছর হল। এখানের অনেক আগন্তুক সাধু-সন্তই তাঁর কথা জানেন না। পদ্মানন্দ এখন এসেছেন পউরি থেকে। কিন্তু থাকেন কুমায়ু হিমালয়ের বিনসার-এ।
পউরি জায়গাটা কোথায়?
গাড়োয়াল হিমালয়েই। তবে বেড়াবার জায়গা হিসেবেই বেশি পরিচিত।
ভীমগিরি বললেন, তেহরি-গাভোয়ালে গেছিলেন কাজে। ফিরেও যাবেন আবার পউরি হয়েই, পাহাড়ে পাহাড়ে। সারাদিন খাওয়া দাওয়া করেননি। এদিকে সন্ধেও হয়ে গেছে। আজ আর কিছু খাবেন না। ধিয়ান সেরেই শুয়ে পড়বেন ভজন করে।
এসেছিলেন কেন?
গুরু সন্দর্শনে।
ও।
বলল, চারণ। তা
উনি থাকবেন কোথায়?
এই চাতালেও থাকতে পারেন। যদি অসুবিধে হয় তো নিয়ে যাব ওঁকে কালিকমলি বাবার আশ্রমে। গুরু আমাকে বলেই দিয়েছেন। আমি যখন ভজন করব তখন ওঁর উপরে একটু নজর রাখবেন তো। ধ্যান শেষ হলেই আমাকে তাঁর সেবা করতে হবে। গুরুর আদেশ।
সেবা? এঁকে তো আপনি চেনেনই না। অচেনা মানুষকে, যাঁর প্রতি আপনার কোনও ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা-ভক্তি নেই, তাঁকে সেবা করবেন? মনের সায় পাবেন সেবা করার?
নিশ্চয়ই।
কী আনন্দ পান এমন অপরিচিত আনজান মানুষের সেবা করে? কি সেবা করবেন?
আগে পদসেবা করব। কতদুর থেকে হেঁটে এসেছেন।
পুরোটা হেঁটে এসেছেন?
না পুরোটা নয়। নরেন্দ্রনগর থেকে।
কেন?
বাসভাড়া ছিল না, তাই।
সত্যি?
হ্যাঁ।
পদসেবা করবেন?
হ্যাঁ।
বদলে কি পাবেন?
ভীমগিরি হেসে ফেললেন।
তারপরে বললেন, আমার গুরু একটা কথা বলেন। বলেন, এখন না হয় টাকাপয়সার চল হয়েছে। মুদ্রা, কাগজের টাকা, কিন্তু মানুষের সভ্যতার গোড়ার দিকে যদি পেছনে হেঁটে যান তবেই মনে পড়বে যে তখন কারেন্সি ছিল না, Legal Tender বলতে আজকে আমরা যা বুঝি তা ছিল না।
আপনি Legal Tender শব্দের মানে জানেন?
অবাক হয়ে বলল চারণ।
ভীমগিরি হাসলেন। বললেন একটু একটু জানি বই কী! সব কিছুই কি আর বই পড়ে শিখেছি? জীবনের পথে চলতে চলতে আপনাদের মতন অনেক মানুষের সঙ্গে মিশেছি, যেখানেই গেছি, ভাল ভাল গুরু পেয়েছি। আমি খুবই ভাগ্যবান বলতে হবে। আমার এক গুরু ছিলেন সাবরিমালাতে, তিনি ফিজিসিস্ট। অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনে ছিলেন। সন্নিসী হয়ে গেছেন।
সাবারিমালাটা আবার কোথায়? এ জায়গার তো নাম শুনিনি।
দক্ষিণ ভারতের কেরালাতে। খুব উঁচু পাহাড়ের উপরে সে তীর্থ। এখানকার কেদার বীরই মতন বছরের এক বিশেষ সময়ে সেই তীর্থ করতে হয়। কালো পোশাক পরে পদব্রজে যেতে হয় সেখানে।
কালো পোশাক?
হ্যাঁ। সকলেই কালো পোশাক পরে যেতে হয়। পুরো দক্ষিণাঞ্চল থেকে তামিল, তেলেগু, কন্নড়, সকলেই যান সেই তীর্থে। তবে মেয়েদের
মেয়েদের যাওয়া বারণ?
সব মেয়েদের নয়। যাঁরা রজস্বলা তাদের যাওয়া বারণ। ঋতুমতী হবার আগে অথবা ঋতুবন্ধ হওয়ার পরে যেতে কোনও বাধা নেই।
কদিন লাগে সেই তীর্থে, মানে তীর্থ শেষ করতে?
নির্ভর করে। অনেকে পুরো পথটিই হেঁটে যান, পায়ে হেঁটে পাহাড়ে চড়েন, যেমন এখনও অনেকে যান কেদার-বদ্রীতে পায়ে হেঁটেই, অমরনাথে, কৈলাসে, মানস সরোবরে। পায়ে না হাঁটলে কি পৃথিবীকে জানা যায়? নিজের মনের চালই খোলে না। মন গাঁটে-গাঁটে আটকে থাকে যে! না হাঁটলে পায়ের বাতেরই মতন মনের বাতও ছাড়ে না। একা পদব্রজে কোথাওই যাওয়াটা, উদাসী হতে হলে, খুবই দরকার।
আর সন্ন্যাসী হতে হলে?
ভীমগিরি আবারও হাসলেন, একেবারে disaming হাসি।
বললেন, বলেইছি তো! সন্নিসী বা সাধু সন্ত কি সকলের হওয়া হয়ে ওঠে চারণবাবু? সারা জীবন সাধুসঙ্গে থেকেও অনেকেরই হওয়া হয়ে ওঠে না আবার অনেকে ঘনঘোরা ভয়াল সংসারের মধ্যে থেকে তার সব দাবি অবহেলে মিটিয়েও পংকের মধ্যে ডুবে থেকেও সন্ত হতে পারেন। পাঁকের মধ্যে বাস করেও পাঁক লাগে না তাঁদের গায়ে, পেঁকো গন্ধ থাকে না, তাঁরা পদ্মর মতন ফুটে থাকেন পাঁকেরই মধ্যে। আসল হল আধার চারণবাবু। আধারটাই আসল। আমার গুরু বলেছেন না, আপনার আধার ভাল।
চারণ লজ্জিত হল নতুন করে। একটু ভীতও হল। মাত্র কদিনের মধ্যেই সে কলকাতা থেকে এসে ক্রমশ এ কোন এক অন্য জগতে ঢুকে পড়ছে অনবধানে? একের পর এক ঘটনা, একের পর এক অভিঘাত তাকে এ কোন অন্য নিয়তির দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে যে, ও ঠিক বুঝতে পারছে না। এই অনুষঙ্গ, এই পরিবেশ, এই হৃষীকেশ, ত্রিবেণী ঘাট এসবই কি টানছে শুধু? না, তাও বোধহয় নয়। ওর মনের ভিতরে বহুদিন ধরে যে শূন্যতা, যে অসারতা যে উদ্দেশ্যহীনতা বাসা বেঁধেছিল তাই ত্বরান্বিত করছে তার এই তাড়াতাড়ি বদলে যাওয়াটাকে।
যা বলছিলাম, ভীমগিরি বললেন। বলছিলাম, গুরু বলেছিলেন, আগে মানুষে Barter System এ জিনিস দেওয়া-নেওয়া করত। Currency বা সোনা রুপো বা তামার মুদ্রাও ছিল না তখন। তাই তো। ছিল কি?
না। কিন্তু কি বলতে চাইছেন আপনি?
চারণ বলল, একটু অধৈর্য হয়ে। হয়তো একটু বিরক্তিরও সঙ্গে।
বুঝলেন না, কি বলতে চাইছি?
না।
সভ্যতার গোড়াতেও মানুষের দেনা-পাওনার জ্ঞানটা আজকের মতনই টনটনে ছিল। লেন-দেন এর। তুমি নুন দাও তো আমি বদলে চাল দেব। আমি হাঁসের ডিম দিচ্ছি তুমি খাম আলু দাও বদলে। তার মানে কি? মানে, কোনও কিছুই আমরা দেওয়া-নেওয়া করতে শিখিনি নিজেদের স্বার্থ ছাড়া। আর Barter ই বলুন, Shopping ই বলুন এই দেওয়া-নেওয়ার তাগিদই তো আমাদের চালিত করে! আজকের পৃথিবীর যা-কিছু ক্রিয়াকাণ্ড দৌড়ো-দৌড়ি দেখেন এর সবই তো এই দেওয়া-নেওয়া লেন-দেনে নিজে কতটা বেশি লাভবান হওয়া যায় এই জন্যেই। আমার কত বাড়ল Profit? এই তো এখন একমাত্র সাধনা। না কি?
একটু চুপ করে থেকে বললেন, আমার গুরু প্রথম দিনে, যেদিন আমাকে চেলা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, আমাকে বলেছিলেন, তুই যে আমার সেবা করতে এসেছিস? কি জন্যে? কিসের লোভে? কী পাবি তুই?
আত্মার শান্তির জন্যে, উন্নতির জন্যে।
আমি বলেছিলাম।
তোর মাথা।
গুরু বলেছিলেন।
তারপর বলেছিলেন, এ সংসারে কেউ কারওকে কিছুই শেখাতে পারে না। যারা বলে যে পারে, তাদের ঘামণ্ড যায়নি এখনও। আর যারা বলে যে, তারা অন্যের কাছ থেকে শিখতে পারে, তাদেরও ঘামণ্ড সবে তৈরি হচ্ছে। কান খুলে শুনে রাখ যে, আমি তোকে কিছুই শেখাব না, কোনও জ্ঞানই দেব না। কারওকে বিলি করার মতন জ্ঞান নেই আমার। অন্য দশজন মানুষেরই মতন তোর ভিতরে যে এঞ্জিনটা আছে, যা নিরন্তর জ্ঞান তৈরি করে জনমাবধি নিজের ভেতরে, সে যদি তা তৈরি করে নিতে পারল তো পারল, নইলে অন্যে কেউই তোকে কিছুই দিতে পারবে না। তুই শুধু দিয়েই যাবি, পদসেবা করবি, গাঁজা সেজে দিবি, অসুস্থ হলে আমার শুশ্রূষা করবি। হাঁসের ডিম দিবি, খাম আলু দিবি, নুন দিবি, চাল দিবি কিন্তু বদলে চাইবি না কিছুমাত্রই। চাইলেও, পাবি না আদৌ। কিছু দিয়ে, বদলে যদি কিছুমাত্রও চাস তাহলে তোর দেওয়াটা দান আর রইবে না, বিনিময় হয়ে যাবে। Barter, Exchange, বাণিজ্য। হৃদয়ের গোড়া থেকে এই লেনদেন এর ব্যাপারটা, সংজ্ঞাটাকেই তোর একেবারে নির্মূল করে মুছে ফেলতে হবে। বদলে কিছুমাত্রই না চেয়ে।
এতকথা যে ভীমগিরি একনাগাড়ে বলে গেলেন ঠিক তা না। ধীরে ধীরে, ধুনির আগুনের কাঠের অস্ফুট দীর্ঘশ্বাস, কাঠের জ্বলে-ওঠার অস্ফুট শব্দ, আগুনের ফুলকির উর্ধপানে উঠে নিঃশব্দে মিলিয়ে যাওয়ারই মতন করে বললেন, আলতো করে। আমাকে শোনাবার জন্যেও নয়, যেন স্বগোতোক্তিই করছেন, এমনইভাবে।
ভারী ভাল লাগল চারণের। Shopping এর জীবন যে জীবন নয়, Barter এর জীবনও যে জীবন নয়, জীবনের এই এক সম্পূর্ণ অভাবনীয়, অবিশ্বাস্য নতুন ব্যাখ্যা ওকে বুঝতে শেখাল, ঠিক বুঝতে নয়, অনুভব করতে শেখাল, কেন এত আধন্যাংটো মানুষ, তার চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞানী ও শিক্ষিত, ভারতের বিভিন্ন জায়গার সব মানুষ, সারা দেশের এই ত্রিবেণী ঘাটেরই মতন অগণ্য ঘাটে, দুর্গম অরণ্যে, পর্বতে, কন্দরে, গিরি গাত্রে, মরুভূমিতে, নির্জন নদীর মধ্যের নির্জনতম দ্বীপে, বছরের পর বছর এমন কি সারা জীবনও অবহেলে কাটিয়ে দেন, কারও কাছে কিছুই বিন্দুমাত্র না চেয়েও।
এমন সময়ে হঠাৎই দূরের এক শেঠের বাড়ির কোনও আলোকোজ্জ্বল উৎসবের প্রাঙ্গন থেকে অ্যামপ্লিফায়ারে জোরে ভেসে এল মাধুরী দীক্ষিতের লিপ-দেওয়া সেই গান : টুক টুক টুক টুক টুক টুক, চোলি কা পিছে ক্যা হ্যায়? মেরী চুনরী কি পিছে কেয়া হ্যায়?
দ্য সঙ অফ দ্য টাইম।
এক দুর্জ্ঞেয় হাসি ফুটে উঠল চারণ চাটুজ্যের মুখে।
চোলিকে পিছে ক্যা হ্যায় তা যেন এই প্রথমবার বুঝতে পারল ও। সামুচ। শুধু পৃথিবী-বিখ্যাত আর্টিস্ট এম এফ হুসেইন এর বন্দিত সুন্দরী নায়িকার চোলিকা পিছেই নয় শুধু এই পৃথিবীর আপামর নারী এবং নারীর হৃদয় আর মস্তিষ্ককে আড়াল করে যা-কিছুই আছে, তার সব কিছুরই অপার অসারতা তাকে আবিষ্ট করে ফেলল যেন।
সে রাতে মন্দাকিনী হোটেলের দিকে ঠাণ্ডার মধ্যে হেঁটে হেঁটে ফিরে আসতে আসতে ভাবছিল যে, ভীমগিরিও নিশ্চয়ই উচ্চশিক্ষিত। পূর্বাশ্রমের কাহিনী তিনি মিথ্যে করে বলেছিলেন সম্ভবত চারণকে। মহারাষ্ট্রের এক গ্রামের স্কুলের ছাত্রর পক্ষে Barter, Currency এবং অর্থনীতির গোড়ার এসব কথা, ডিম্যান্ড-সাপ্লাই এবং লেনদেনের ব্যাপার-স্যাপার এমন প্রাঞ্জলভাবে শুধু নিজেই বোঝা নয়, অন্যকেও বোঝানো বড় সহজ কথা নয়।
অনেকের উপরেই অনেক রাগ এবং অভিমান নিয়ে চারণ পথে বেরিয়েছিল। এখন দেখছে, সে ঠিক করেনি। না, পথে বেরোনোটা ঠিকই হয়েছিল কিন্তু দশজনের উপরে রাগ এবং অভিমান করাটা আদৌ ঠিক হয়নি। ও যেন হঠাই ক্ষমা করতে শিখছে এবং যেন পারছেও একটু একটু।
এই কথা ভেবেই ওর ভারী আনন্দ হল।
জয়িতাকে ও যতটুকু দিয়েছিল তার চেয়ে সম্ভবত অনেকই বেশি চেয়েছিল, আশা করেছিল, তার কাছ থেকে। Barter-এ সেই জিততে চেয়েছিল। পচা ডিম দিয়ে রক্ত গোলাপের গুচ্ছ পেতে চেয়েছিল। হয়তো।
তখন রাত নটা বেজে গেছে। দেখল, পান্ধীদের সেই পরিবার তখন ঘন হয়ে বসে, সামনে ধুনী নয়, কাঠকয়লার উনুন জ্বেলে রুটি বানাচ্ছে। এবং উনুনেরই তিন পাশে গোল হয়ে পরিবারের পাঁচজনই বসে আগুন পোয়াচ্ছে। খুবই গরিব ওরা, বড় হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয় ওদের। কিন্তু মুখে হাসির অভাব নেই। দুটি ছিন্ন ও মলিন রাজস্থানি রাজাই চৌপায়ার উপরে বিছানো আছে। শীতের মোকাবিলা আসলে ওরা করবে একে অন্যের শরীরের উত্তাপ দিয়েই। এই রাজাই দুটি শীতের সঙ্গে লড়াইএর অস্ত্র নয়, অজুহাত মাত্র।
.
তখন হঠাৎই জয়িতার কথা মনে হয়েছিল চারণের। জয়িতাকে এমনি বুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে, কবোষ্ণ কল্পনাতে কত শীতের রাতই না কাটিয়েছে! শুধুই কল্পনাতে। একা একা। আজ রাতে এই পান্ধী বিবাহিত যুবতীর মধ্যে ও যেন হঠাৎই জয়িতাকেই আবিষ্কার করল। ওর সুখই যেন জয়িতার সুখ।
ও দাঁড়িয়ে পড়ে পান্ধী পরিবারকে উদ্দেশ্য করে বলল, দিনের কাজ শেষ হল?
বুড়ো বলল, হুঁ।
যুবকটি আর যুবতীটি খুবই ক্লান্ত ছিল সম্ভবত। কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না ওদের, তবুও ওরা হাসল।
বুড়ি, শিশু নাতিকে বলল, এই তো দাদু রুটি পাকাচ্ছি। হয়ে গেলেই খাবে আর শোবে।
চারণ লক্ষ করল, নদীর খাত বেয়ে কনকনে হাওয়া বয়ে যাচ্ছে শরীরের হাড় হিম করে।
কত কামালে আজ সারাদিনে?
চারণ শুধোল।
পন্দরো রুপাইয়া।
বুড়ো বলল।
বাসস?
ঔর ক্যা বাবু?
এতে তোমাদের এতজনের ডাল-রুটি হবে?
খুবই।
বলে, হুঁকোতে ভুড়ক ভুড়ক টান তুলে এই মস্ত ভারতবর্ষের, চারণের সুন্দর দেশের, চারণের ভাইবোন ভারতবাসীর প্রতিভু সেই বুড়ো বলল, কত পরিবার আছে, দিনে মাত্র পাঁচ টাকা কামায়। আমরা তো বড়লোক।
বলেই হাসল। দুঃখের হাসি নয়, সুখের হাসি।
স্তম্ভিত হয়ে গেল চারণ।
বলল, মিথ্যে কথা বলছ তোমরা। তোমাদের কষ্ট নেই?
কষ্ট কি নেই বাবু? কিন্তু ওপরের দিকে চাইবার কি শেষ আছে? আমরা নীচের দিকে তাকাই। নিজেদের কষ্টকে কষ্ট বলে মনেই হয় না। সত্যিই কষ্ট নেই বাবু। কোমর-ভাঙা মেহনত করে যা কামাই তাতে রোটি-ডাল তো হয়ে যায়। হারামের পয়সাতে খাই না বাবু, চুরির পয়সা বা ঘুষের পয়সা বা অত্যাচারের পয়সাতেও খাই না। বড়ই আনন্দ আমাদের। উপরওয়ালা যা দেন, দিয়েছেন, তাই যথেষ্ট। তুমি দেখো আমার এই নাতি একজন ইমানদার দেশোয়ালি হবে। ভারতের মুখোজ্জ্বল করবে এ একদিন।
নিশ্চয়ই করবে।
চারণ বলল।
উপরওয়ালা যা দেন তাই যথেষ্ট। কোনও খেদ নেই।
বুড়ো বলল।
চারণ তার হিপ-পকেট থেকে একটি একশ টাকার নোট বের করে ওদের দিল।
যুবতী বৌটির মুখে একটু চকিত ভয় দেখতে পেল যেন। নৃত্যরতা আগুনের শিখাতে সারসার সোনার গরাদ নেচে গেল তার মুখে। যুবকটির মুখে রাগ ফুটল, যদিও ক্ষণিক। বুড়ো কিন্তু চারণের মুখের দিকে একমুহূর্ত চেয়েই, টাকাটা দুহাতের পাতা মেলে পরম সম্মান দিয়ে নিল।
বুড়ি বলল, তুমি বিকেলে যাওয়ার সময়েও দাঁড়িয়েছিলে এখানে। আমার বহু…। আমরা ভেবেছিলাম তুমি মানুষটা খারাপ।
ভুল ভাবনি একটুও।
চারণ বলল।
যুবকটির মুখের মাংস আবার শক্ত হয়ে এল। চিবুক, রাগের বাহক হয়ে আকাশ পানে উঠল উদ্ধত হয়ে।
বুড়ো বলল, তাহলে?
তাহলে কিছু নয়। যে-মানুষটা তখন এ পথ দিয়ে গেছিল সে হয়তো খারাপ মানুষই ছিল। পুরোপুরি খারাপ না হলেও পুরোপুরি ভালও নয়। কিন্তু যে-মানুষটা এখন তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে ভাল মানুষ। বলতে পার, পুরোপুরিই ভাল। আপাতত।
তুমি কোথায় থাক?
ছেলেটি জেরা করার গলাতে বলল।
চারণ বলল, আমি পরদেশী।
তুমি কে?
এবার যুবতী বধূটি বলল।
চারণ হেসে বলল, আমি উপরওয়ালার দূত। কিছু কি বুঝলে বহিন?
মেয়েটি অবিশ্বাসী গলাতে হেসে বলল, ততক্ষণে তার ভয় কেটে গেছে, উপরওয়ালার দূত কখনও এমন পোশাক পরে?
চারণ বলল, তোমাদের উপরওয়ালা কি কারওকে দেখা দিয়েছেন? আমি ঈশ্বরের অগণ্য দূতের মধ্যে একজন। টাকাটা তোমরা হাসিমুখে নিলে আমার খুব আনন্দ হবে, রাতে ঘুম হবে। উপরওয়ালাও খুবই খুশি হবেন। নেবে তো?
ওদের সকলের মুখে অবিশ্বাস-মাখা আনন্দের হাসি ফুটে উঠল।
চারণও হাসল।
ওরা বলল, ভগবান আপ কি ভালা করে গা।
চারণ চমকে উঠল। ভাবল, এও তো Barter-ই।
তাড়াতাড়ি বলল, না, না, আমি তোমাদের ভগবানের কাছে কিছুমাত্রই চাই না। তোমরা খুশি হলেই আমি সুখি। বিশ্বাস করো।
ওরা বিশ্বাস করল কি করল না তাতে চারণের বিন্দুমাত্র যাবে আসবে না। তার মুখনিঃসৃত কথা কটিতে চারণ নিজে যে একশভাগ বিশ্বাস করল এইটেই সবচেয়ে বড় কথা।
বরফ গলতে শুরু করেছে হিমবাহর। এখন সে কোনও শীতার্ত বা উষ্ণ বা নাতিশীতোষ্ণ সাগরে ভেসে যাবে। পরিযায়ী দুধলি রাজহাঁসের মতন মসৃণ গতিতে ভেসে যাবে কি না তা ঈশ্বর নামক অস্তিত্বহীন এই পান্ধীদের উপরওয়ালাই জানেন অথবা ভীমগিরি বা ধিয়ানগিরি মহারাজদের ঈশ্বর। ঈশ্বর বলে কোনও ব্যাটা আদৌ আছে কি নেই তা জানতেই ওর কলকাতা ছেড়ে-ছুঁড়ে হঠাৎ আসা এই অশিক্ষিত সাধু সন্ন্যাসীদের denএ। ব্যাপারটার শেষ দেখতে চায় ও।
মানে, এই নিরবধি কালের বুজরুকির।
.
বেশ ঠাণ্ডা আছে। মাঝরাতে ঠাণ্ডাতে ঘুম ভেঙে গেল একবার ওর। বারান্দার পুরোটাই কাঁচের স্লাইডিং-ডোর। দুটো কম্বলেও শীত করছে। কম্বল দুটি দিয়ে ভাল করে গলা ও ঘাড় আর কাঁধ ঢেকে পাশ ফিরে শুতে শুতে ভারী এক আনন্দে চারণের মন ভরে উঠল। পান্ধী পরিবারটির কথা মনে পড়ল। এমন সংরক্ষিত ঘরে যদি ওর এত শীত করে তবে ঐ অরক্ষিত পথে ওদের কত না শীত করছে, কে জানে। ভাবল, প্রয়োজন, আরাম, বিলাস এসব বাড়ালেই বাড়ে।
আজ হোটেলে ফেরার পথে, জীবনে এই প্রথমবার, বদলে কিছুমাত্রই প্রত্যাশা না করে, কারও জন্যে সামান্য কিছু করল ও। এমন নিঃস্বার্থভাবে কারও জন্যে একতরফা কিছু করার মধ্যে যে এত আনন্দ, দেওয়া-নেওয়ার নয়, শুধুই দেওয়ার আনন্দ, আগে সত্যিই জানত না।
শেষ রাতে একবার টয়লেটে গেছিল। বেরিয়ে, উষ্ণ বিছানাতে জোড়া কম্বলের নীচে যাওয়ার আগে কী মনে হওয়াতে একবার বারান্দাতে এসে দাঁড়াল চারণ।
ঝরনার মতন শব্দ করে শেষ রাতের হাওয়া বইছে তীব্রগতি অথচ আপাত-স্থির নদীর উপর দিয়ে। জল এদিকে গভীর। রাতের হাওয়া ওখানে উত্তরবাহিনী।
গতবছরের বইমেলাতে, শিশু সাহিত্য সংসদ প্রকাশিত শ্রী দিলীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভারতের অনেকই নদনদী সম্বন্ধে ছোটদের জন্যে লেখা সুন্দর একটি বই কিনেছিল ও। বই যদি ভাল হয় ও তাতে জানার মতন কিছু থাকে তাহলে ছোটদের বই বড়রা এবং বড়দের বইও ছোটরা অনায়াসেই পড়তে পারেন। যত্ন করে পড়েছিল বইটি চারণ। না পড়লে, হয়তো গঙ্গা সম্বন্ধেও এত কিছু জানতে পারত না।
যে কোনও নদীই চারণকে অভিভূত করে। কোথায় যে চর ফেলে নদী, আর কোথায় যে পাড় ভাঙে, তা সেই জানে। কত জনপদ গড়ে ওঠে একটা নদীর দুদিকে এই নদীমাতৃক দেশে। মানুষ মরে যায়, গাছ পড়ে যায়, ঐরাবতের মতন অতিকায় প্রস্তরখণ্ড তার ঘর্ষণে-চুর্ণনে নুড়িতে পরিণত হয় কালের প্রবাহে। পরিবর্তিত, নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তার খাতের দুপাশের সব কিছু। কিন্তু নদী চলে নদীরই মনে। অবিরত, বাধাহীন।
.
উত্তরকাশী জেলায় গঙ্গোত্রী থেকেও প্রায় কুড়ি কিমি দূরের এক বরফের গুহা গোমুখ থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এসেছে গঙ্গা তারপর গঙ্গোত্রী হয়ে নেমে এসেছে হিমালয়ের গা বেয়ে। গোমুখের উচ্চতা সাত হাজার মিটার মতন। উত্তরকাশী শহর গঙ্গোত্রীর উজানে। অত্যন্ত প্রাচীন শহর।
হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ স্কন্দপুরাণে এর নাম বর্ণিত আছে বারণাবর্ত। চীনদেশী পর্যটক হিউয়েন সাঙ এই শহরের নাম অবশ্য ব্ৰজপুর বলে উল্লেখ করেছিলেন।
অনেকে এও বলেছেন যে, মহাভারতে বর্ণিত জতুগৃহ নাকি এখানেই নির্মিত হয়েছিল।
.
সবচেয়ে মজার কথা এই যে, অন্য অধিকাংশ নদ নদীরই মতন গঙ্গার নাম কিন্তু উৎসমুখেও তো বটেই, তার অনেক নীচে পর্যন্তও গঙ্গা নয়। দেবপ্রয়াগে অলকানন্দার সঙ্গে ভাগীরথীর সঙ্গমের পর থেকেই এর নাম গঙ্গা হয়েছে।
অলকানন্দার জন্ম গাড়োয়াল হিমালয় ও তিব্বতের সীমানাতে দুর্গম পার্বত্য এলাকাতে। সতোপন্থ হ্রদ আর ভগীরথ হিমবাহ থেকে জন্মেছে অলকানন্দা প্রায় আটহাজার মিটার মতন উচ্চতাতে। বেশ কিছুটা নেমে এসে সে মিলেছে মন্দাকিনীর সঙ্গে, রুদ্রপ্রয়াগে।
রুদ্রপ্রয়াগ অবশ্য চারণের কাছে বেশি জানা জিম করবেট এর বই-এর মাধ্যমেই। দ্য ম্যান-ইটিং লেপার্ড অফ রুদ্রপ্রয়াগ।
রুদ্রপ্রয়াগেই ওই দুই নদীর সঙ্গমের নীচে পথ-পাশের একটা আমগাছের ডালে বসে মেরেছিলেন ওই চিতাটিকে জিম করবেট সাহেব এক রাতে।
জয়িতার আর্ম-চেয়ার ওয়াইল্ডলাইফ এজিয়াস্ট দাদার কাছে শুনেছিল চারণ যে, রুদ্রপ্রয়াগে যে জায়গাতে চিতাটাকে মারা হয়েছিল সেখানে একটি বোর্ড লাগানো আছে নাকি।
যদি কখনও রুদ্রপ্রয়াগে যায়, তবে সে ওই তীর্থ-দর্শনেই যাবে। মন্দির-মসজিদে তার কোনও মন নেই।
বদ্রীনাথ বা বদ্রীবিশাল অলকানন্দারই ঐ পারে। রুদ্রপ্রয়াগের ব্রিজ পেরিয়ে অলকানন্দা যে পারে, সেই পারের পাহাড় বেয়েই বদ্রীনাথের পথ চলে গেছে। আর নদী না পেরিয়ে সোজা চলে গেলে কেদারনাথের পথ।
রুদ্রপ্রয়াগ থেকে হৃষীকেশ অনেকখানি পথ। এখানে এসেই গঙ্গা সমতলভূমি পেয়ে বিস্তৃতিলাভ করেছে। তারপর হরিদ্বার হয়ে কানপুর। তারপর ইলাহাবাদ। যেখানে যমুনা ও প্রাচীনকালে সরস্বতীর মিলন ক্ষেত্র। সঙ্গম। এই শহরের নাম আর্যদের সময়ে ছিল প্রয়াগ। কিন্তু মুঘল বাদশা আকবর যমুনার তীরে একটা দুর্গ তৈরি করেন এবং শহরের নাম বদলে করেন ইলাহাবাদ। ইলাহাবাদ থেকে এলাহাবাদ। এলাহাবাদের থেকে প্রায় দেড়শ কিমি দূরে কাশী বা বারানসী। এখানেই উত্তরবাহিনী গঙ্গার পশ্চিম পারে বরুণা ও অসি নদীর সঙ্গমে বেড়ে উঠেছিল প্রাচীন জনপদ, হিন্দুদের পবিত্র তীর্থ বারানসী।
এই কাশী শহর পৃথিবীর প্রাচীনতম শহরগুলির মধ্যে একটি। হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ উপনিষদ ও পুরাণেও কাশীর নাম রয়েছে। এখানে বিশ্বনাথের মন্দিরের এবং বিগ্রহের বর্ণনা চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণীতেও আছে। এর দশাশ্বমেধ ঘাটের কথাও সর্বজনবিদিত। আরও অনেক ঘাট আছে বারানসীতে।
কিংবদন্তী আছে যে, ব্রহ্মার আদেশে কাশীর রাজা দিব্যদাস নাকি দশটি অশ্ব দিয়ে অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন রুদ্র সরোবরের তীরে। সেই থেকেই নাম : দশাশ্বমেধ।
আরও অনেকই কথা জানা গেছিল এই নদী সম্বন্ধে দিলীপবাবুর বইটি পড়ে। সে-নদী যেখানে এসে সমতলবাসী হয়েছে সেখানে, সেই হৃষীকেশে দাঁড়িয়েই এই সব মনে পড়ছে চারণের।
গঙ্গা, পাটনা বা পাটলিপুত্রকে পাশে রেখে, পৌঁছেছে শরৎচন্দ্রের ভাগলপুরে। সে সবও পেছনে রেখে রাজমহলের কাছে এসে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছে। আরও শ-খানেক কিমি নেমে এসে ভাগ হয়ে গেছে গঙ্গা দুভাগে। একটির নাম হয়েছে পদ্ম। সেটি চলে গেছে মুর্শিদাবাদ জেলা হয়ে বাংলাদেশে আর অন্যটির নাম হয়েছে ভাগীরথী। তারপর আরও দক্ষিণে পৌঁছে ভাগীরথীর নাম হয়ে গেছে হুগলি।
চারণের ভাবনারই মতন সব মানুষেরই ভাবনা এইরকমই, নদীরই চালের মতন। কোথায় যে তার উৎপত্তি, কোথায়, কোন নদীর সঙ্গে যে তার সঙ্গম আর কোথায় যে সে লীন হয়েছে মহত্তম সঙ্গমে সমুদ্রের সঙ্গে, তা তার উৎসে দাঁড়িয়ে বোঝা পর্যন্ত যায় না।
.
০৪.
শেষ পর্যন্ত আসা হল কুঞ্জাপুরীতে।
প্রভাকর মার্কেটের কুমার ট্রাভেলস এর থেকে একটি অ্যাম্বাসাডার ভাড়া নিয়েছিল চারণ।
ওর সঙ্গে আলাপ হওয়ার দিনেই ভীমগিরি কুঞ্জাপুরীর কথা বলেছিলেন।
সত্যি সত্যি কোথাওই পৌঁছানো বড় সোজা কথা নয়। সে মনেই হোক, কী পাহাড় বনে। হৃষীকেশে আসা অবধিই ভাবছিল যে আসবে, এই মন্দিরের কথা শোনার পর থেকেই, কিন্তু আসতে আসতে এতদিন লেগে গেল।
মন্দিরের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে, মন্দিরের চাতালে দাঁড়িয়ে পেছনে এবং ডানে হৃষীকেশ শহরটা চোখে পড়ে। ছড়ানো-ছিটোনো। খাত-এর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গার পুরোটাই যে এখান থেকে দেখা যায়, তা নয়। কিন্তু নদীর এ পারের তপোবন, মুণিকা-রেতি এবং ওপারের স্বর্গাশ্রম ইত্যাদির আভাস পাওয়া যায়।
চারণ বসেছিল, মন্দিরের পেছনে, চাতালের প্রাচীরের ওপর। রোদ পড়েছিল পিঠে। ভারী আরাম লাগছিল। চোখ বুঁজে আসছিল আরামে।
কুঞ্জাপুরী মন্দিরের পুরোহিত পণ্ডিত কুঁবারসিংজী তার পাশে দাঁড়িয়ে বহু দুরের বরফাবৃত শৃঙ্গগুলি চেনাচ্ছিলেন।
একদিকে উত্তুঙ্গ গিরিগাত্র এবং অন্যদিকে গভীর এবং প্রায় খাড়া নেমে-যাওয়া খাদ রেখে নাতিদূরের আঁকা বাঁকা এবং সর্পিল পথ দিয়ে বাস চলে যাচ্ছিল তেহরি-গাড়োয়ালের দিকে। কোনও বাস আসছে হৃষীকেশ হয়ে, কোনও বাস দেরাদুন থেকে। এই পথই চলে গেছে চাম্মাতে। কলুষহীন উঁচু শিবালিক পর্বতমালার গিরিগাত্র এবং খাদে রোদ ও ছায়ার মায়া রচিত হয়েছে। টেরাসিং-কালটিভেশান করা ক্ষেত-খামার, SURE-FOOTED গাই বলদ, খচ্চর, ছাগল-ভেড়া, পাহাড়ী কুকুর, গৃহকর্মে ব্যস্ত নারীর চিকন স্বরে ডাকাডাকি, ছাগলের দূরাগত ব্যাঁ ব্যাঁ রব, একঝাঁক Rock Pegion-এর ওড়াউড়ি শীতের ওম-ধরা রোদমাখা সুনীল আকাশে, সমস্ত কিছুর দিকেই চেয়ে থাকতে থাকতে চারণের ঘোর লেগে যাচ্ছিল। ওর কলেজের সহপাঠী অমলেশের কথা বারেবারে মনে পড়ে যাচ্ছিল ওর। অমলেশের পাহাড়ে ট্রেকিং করার নেশা ছিল।
চারণ ওকে বলত, কী যে দৌড়োস ছুটি পেলেই পাহাড়ে বার বার! পাহাড় ছাড়া পৃথিবীতে দ্রষ্টব্য কি আর কিছুই নেই?
অমলেশ হাসত। ঝকঝক করত ওর উজ্জ্বল কালো চোখের মণি দুটো। ও বলত, একবার চল আমার সঙ্গে, তখন বুঝবি, কেন যাই? একবার গেলেই ঘোর লেগে যাবে। বারেবারে আসতেই হবে।
একবার এসেই বুঝতে পারছে চারণ যে, তাকেও আসতে হবে বারে বারেই। কিছু আছে এইসব পর্বতরাজিতে, গাড়োয়াল এবং কুমায়ু হিমালয়ে। হয়তো আছে এর চেয়ে কম উঁচু বিন্ধ্য ও মাইকাল পর্বতমালাতেও। কে জানে! পশ্চিমঘাটের পর্বতমালাতেও হয়তো আছে। পূর্ব আফ্রিকার কিলিমানজারো বা পশ্চিম আফ্রিকার রুয়েনজোরি রেঞ্জ বা পশ্চিমী দুনিয়ার ইউরোপের আল্পস, পিরিনিজ, ইত্যাদির সঙ্গে আমাদের এই সব নগাধিরাজদের কোনও তুলনাই চলে না। আমেরিকার রকি মাউনটেইনস রুক্ষ, দুর্দম যদিও কিন্তু এই দেবদুর্লভ মাহাত্ম্য তাদের একটুও নেই। নিজ চোখে না দেখলে কুমায়ু আর গাড়োয়াল হিমালয়কে, এসব কথা বোঝা যায় না আদৌ। এসব দেখে নিজের দেশ সম্বন্ধে গর্ব জাগে। কলকাতা দিল্লী, মুম্বাই, চেন্নাই ভারতবর্ষ নয়। সে সব নগরের কোনও বিশেষ ভারতীয়ত্ব নেই। পশ্চিমী দুনিয়ার সস্তা, দৃষ্টিকটু নকল বলে মনে হয় সে সব শহর দেখলে। ভারতবর্ষকে জানতে হলে এই রকম সব জায়গাতেই আসতে হয়। নয়তো বনে-জঙ্গলে।
ভাবছিল, নিজের এই আশ্চর্য সুন্দর দেশের কতটুকুই বা দেখেছে! কী বিচিত্র দেশ তাদের। কত বিভিন্ন তার রূপ, কত বিচিত্র তার দেশবাসীর ভাষা, বেশবাস, আচার ব্যবহার। কিন্তু এই বৈচিত্র্যরই মাঝে মূল সুরটি একই। ভারতের শাশ্বত সম্ৰান্ততাকে দারিদ্র কোনওদিনও মলিন করতে পারেনি, পারবে না। এই মূল সুর কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বয়ে চলেছে একটি অবিরত প্রবহমাণ স্রোতেরই মতন, তাতে দুপাশে অববাহিকা থেকে অগণ্য উপস্রোত এসে মিশেছে একে একে। তাতে মূল স্রোতে বাধা পড়েনি। বরং তার জোর বেড়েছে, ভার বেড়েছে, সে বিস্তৃত হয়েছে আরও।
ভারী গর্ব হচ্ছিল চারণের এই প্রাচীন দেশে জমেছে বলে। এই ঐতিহ্যের দেশে, রামায়ণ, মহাভারতের দেশে। নিজের দেশকেই যে-মানুষ ভাল করে দেখেনি, জানেনি, তার পক্ষেই বিদেশের প্রশস্তিতে মুখর মতন পঞ্চমুখ হওয়া সম্ভব। নিজেকে যে জানে, শুধু সেই না পরের সঙ্গে তুলনা করতে পারে নিজের!
কুঞ্জাপুরীর পুরোহিত প্রথমে চারণের ওপরে বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন। তার কারণও ছিল। চারণ গাড়ি করে উঁচু শৃঙ্গর ওপরে ওঠার পরও আরও তিনশ ষাটটি সিঁড়ি ভেঙে যখন এই ছোট্ট মন্দিরের চাতালে এসে পৌঁছেছিল তখন পুরোহিত সিঁড়িতে চারণের পদশব্দ পেয়ে নিজেই এসে দাঁড়িয়েছিলেন চাতালের মুখে। চারণ তাকে নমস্কার করার আগেই তিনি তাকে নমস্কার করেছিলেন।
চারণ বলেছিল, আমি কিন্তু এখানে পুজো দিতে আসিনি।
তবে?
বলেছিলেন কুঁবারসিংজি, বংশানুক্রমে যিনি এই মন্দিরের পুরোহিত। গাড়োয়লের রাজা যাঁর পূর্বপুরুষকে উত্তরপ্রদেশের সমতলভূমি থেকে এনে এই উতুঙ্গ শৈলশিখরের উচ্চতম চুড়োতে অধিষ্ঠিত শিব-কর্তৃক ছেদিত মহামায়ার পীঠের পূজারী করেছিলেন। জনশ্রুতি আছে, এখানে নাকি মহামায়ার স্তন পড়েছিল। জানে না চারণ। কুঁবারসিংজি যা কিছুই বলবেন তার সবকিছুই বিশ্বাস করতে হবে এমন কোনও কথা নেই। তবে নারী শরীরের সবচেয়ে সুন্দর অংশ, চারণের মতে, তার স্তন এবং তলপেট। দেবীর শরীরেরও তাই হবে হয়তো।
ভাবল, নাস্তিক চারণ।
ভেবেই ভাবল, এই কুভাবনার কথা আর এস এসরা বা শিবসেনারা জানতে পারলে হয়তো তার শিরচ্ছেদ করবে।
কুঁবারসিংজির তবের উত্তরে একটি লালরঙা পঞ্চাশ টাকার নোট তাঁকে দিয়ে চারণ বলেছিল, পুজো আপনি দিন কিন্তু আমি মন্দিরের ভিতরে ঢুকব না।
সে কি?
না। আমি কোনও মন্দিরের ভিতরে ঢুকিনি। কখনওই ঢুকবও না।
অজীব আদমী আপনি। তবে এলেন কেন কষ্ট করে এতদূরে? তারওপর ওই তিনশ ষাটটি সিঁড়ি চড়ে?
এলাম, মন্দির দেখতে। আপনাকে দেখতে। যে-কোনও মন্দিরের চাতালে এলেই আমার মনে এক ধরনের শান্তি আসে। ভাল লাগে।
শান্তি থাকে আপনার বুকেরই মধ্যে, কোনও মন্দির মসজিদ বা গিজাতে নয় বাবুজি। তবে সেই শান্তি হয়তো ভ্রমরের মতন কৌটো বন্ধ থাকে। এমন এমন জায়গাতে এলে সেই কৌটোর ঢাকনি হয়তো খুলে যায়।
ভাল লাগল খুব চারণের, কুঁবারসিংজির এই কথাটি। ভাবল, আমাদের প্রত্যেকেরই বুকের মধ্যে অনেক কথাই থাকে, শান্তির ঐ ভ্রমরেরই মতন, যা আছে বলে আমরা জানি অথচ কী করে তাকে বাইরে আনা যায় সুন্দরভাবে, পুরোহিত কুরসিংজি এই মাত্র যেমনভাবে আনলেন, তা আমাদের জানা নেই।
ভাবছিল চারণ যে, লেখাপড়া শিখলেই যে, সকলেই শিক্ষিত হন এমন নয়, লেখালেখি করলেই যে সকলেই তাঁরা লেখক হয়ে ওঠেনই এমনও নয়, নিজের অথবা পাঠকের মনের ভিতরের গোপন কথাটিকে, ওই ভ্রমরেরই মতন, কৌটোর ঢাকনি খুলে বাইরে যিনি আনতে পারেন অবহেলে, তিনিই প্রকৃত শিক্ষিত, প্রকৃত লেখক!
ওই দেখুন! ডানদিকে, মানে, সবচেয়ে ডানদিকে যে তুষারাবৃত পর্বতটি দেখা যাচ্ছে, তা হল নন্দাদেবী। তার পাশে, বাঁ পাশে ঘণ্টাকর্ণ। দেখতে পাচ্ছেন?
হ্যাঁ। চারণ বলল।
আরও একমাস পরে যদি এখানে আসতে পারেন একটি দূরবীণ সঙ্গে নিয়ে তবে এই কুঞ্জাপুরীর চাতালে বসেই বদ্রীবিশালের মন্দির দেখতে পাবেন। কুঞ্জাপুরী, হৃষীকেশের চারদিকে শিবালিক পর্বতমালাতে যতগুলি শৃঙ্গ আছে তার মধ্যে সবচেয়ে উঁচু। অথচ লক্ষ লক্ষ ভ্রমণার্থী প্রতি বছরে বাবা কেদারনাথ এবং বদ্রীবিশাল দর্শনে, হৃষীকেশের উপর দিয়েই যান অথচ তাঁদের মধ্যে প্রায় কেউই কুঞ্জাপুরীতে আসেন না। খোঁজই রাখেন না অধিকাংশই এই পাহাড়চুডোর মন্দিরের। নামও জানেন না। জিগ্যেস করে দেখবেন আপনি।
চারণ বলল, ভাগ্যিস!
কেন? একথা বলছেন কেন?
মন্দির মসজিদের বা অন্য সব ধর্মস্থানের মাধুর্য, মাহাত্ম্যর কথা আমি বলতে পারব না, তবে আমার কাছে সব ধর্মস্থানের মাহাত্ম্যই কিন্তু তার নির্জনতাতে, শান্তিতেই। যে মন্দিরে অতি কম মানুষ আসেন, যে মসজিদে বা গিজাতে অতি কম মানুষে নামাজ পড়েন বা প্রার্থনা করেন, সেখানেই মনে হয় মানুষ মন্দিরে মসজিদে যা খুঁজতে আসে, তাই বেশি করে পেতে পারে। আমি যদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতাম তবে কোনও মন্দিরেই বা মন্দিরের কাছাকাছিও কোনও যানবাহনকে আসতেই দিতাম না।
তারপর থেমে বলল, আমি এখানে এসেছি অল্প কদিন। কিন্তু এখানের সাধুসন্তদের সঙ্গে মিশে এ কদিনে যতটুকু বুঝেছি তাতে মনে হয়, ঈশ্বর কখনওই মন্দিরের বিগ্রহ নন। ঈশ্বর থাকেন মন্দিরের পথের ধুলোতে, পথপাশের ফুলে-পাতায়, পথকষ্টে, সহযাত্রীর প্রতি সহমর্মিতা এবং দয়ামায়ারই মধ্যে। যদি তাঁর কোনও অবয়ব থাকেও তবুও তিনি পাথর বা রুপোর বা সোনার মূর্তিতে আদৌ বদ্ধ থাকবেন, তা কিন্তু আমার মনে হয় না।
কুঁবারসিংজি বললেন, এমন সব কথা বলবেন না বাবুজি। অবিশ্বাসীরা মন্দিরের চাতালে তবে আসেনই বা কেন? আপনিই বা এলেন কেন? মা জানতে পারলে মুখে রক্ত উঠে মারা যাবেন আপনি।
চারণ হাসল, কুঁবারসিংজির কথাতে।
তাতে, মনে হল, পূজারী আরও চটলেন।
চারণ বলল, কুঁবারসিংজি আপনি আমার কথা বুঝতে পারেননি। ঈশ্বর-বিশ্বাস আর মূর্তি-পুজো, আমার মনে হয় সমার্থক নয়। কেন নয়, তা আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না। বরং একথা বলতে পারেন যে, এইসব কথা বোঝার জন্যেই হৃষীকেশে এসে মৌরসী-পাট্টা গেড়ে বসেছি। দেখি, কিছু বুঝতে পারি কি পারি না।
কুঁবারসিংজি তখনও রেগেই ছিলেন।
পূজারী বললেন, আপনি কি জানেন যে, হিন্দুর দেবদেবীকে যে মানুষ নিজে হিন্দু হয়েও অপমান করেন, আপনারই মতন, তিনি মুখে রক্ত উঠে বা দুর্ঘটনাতে মারা যান। অন্য কারওকেই নিধন করতে হয় না তাকে। খুনোখুনি করার শিক্ষা হিন্দুধর্ম দেয় না। আমার ধর্মের সঙ্গে অন্য সব ধর্মেরই অনেক তফাৎ আছে।
চারণ, ঠাণ্ডা, নিস্পৃহ গলাতে বলল, এ প্রসঙ্গ বরং থাক এখন।
থাক তবে।
এখন বলুন, মানে, ওই বরফাবৃত চুড়োগুলো চিনিয়ে দিন আমাকে দয়া করে।
ঘণ্টাকর্ণ দেখেছেন ত, নন্দাদেবীর বাঁ পাশে?
হ্যাঁ। ওই ঘণ্টাকর্ণর পায়ের কাছেই আছে চন্দ্রবদনী।
চন্দ্রবদনী? কী চমকার নাম। কিন্তু কই? দেখা যাচ্ছে না তো!
না। দেখা যায় না এখান থেকে। মধ্যে একটি অন্য পর্বত পড়ে গেছে। দেখছেন? কালো, মানে, বরফ-ঢাকা নয়। ওই কালো পর্বতটি অনেকই কাছে এখান থেকে। তাই দূরের চন্দ্রবদনী তার পেছনে পড়ে যাওয়াতে আড়ালে পড়ে গেছে।
তাই?
হ্যাঁ।
তেমনই বোধহয় ঘটে সবসময়ই। জড় তো বটেই, জীবন্তর বেলাতেও।
কি? কুঁবারসিংজি বললেন।
যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন শুধুমাত্র কাছে আছে বলেই আমরা কেবল তাদেরই দেখতে পাই। তাদের প্রকৃত আকারের চেয়ে অনেক বড় দেখি তাদের আর তাদের আড়ালে যে কত সুন্দর এবং বড় কত কিছুই ঢাকা পড়ে গিয়ে আমাদের চোখের আড়ালেই থেকে যায় চিরদিন, তা আমরা জানতে পর্যন্ত পাই না।
কুঁবারসিংহজি কী যেন বললেন, অস্ফুটে। ঠিক বুঝতে পারল না চারণ। তবে বুঝল যে, অকবি চারণের মুখ নিঃসৃত এই আকস্মিক কাব্যিক মন্তব্যে পুরোহিত কিঞ্চিৎ প্রীত হয়েছেন।
আবার চারণ বলল, চন্দ্রবদনী? বাঃ!
হুঁ।
কুঁবারসিংজি বললেন।
ভাবল চারণ যে, এ জীবনে এই নামের কোনও নারীর সঙ্গে যদি কখনওই দেখা হয় তবে শুধু নামমাহাত্ম্যরই কারণেই তাকে মন-প্রাণ সব দিয়ে দেবে। মানুষে যদি রূপ দেখেই মনপ্রাণ সঁপতে পারে, যদি পারে গুণ দেখে, তবে শুধু নাম শুনে তা পারতেই বা দোষ কোথায়?
কুঁবারসিংজি বলে চললেন, তারপর দেখুন ঘণ্টাকর্ণর বাঁপাশে, মানে আমাদের বাঁপাশে চৌখাম্বা। দেখেছেন? কেমন চৌকো মতো, বিরাট।
চৌখাম্বা দেখে চারণের মনে পড়ে গেল তার মেজমামার ছেলে পটু কথায় কথায় আখাম্বা বলে ওঠার কথা। ওই একটি শব্দ যে সে দিনের মধ্যে কতবার, কত অর্থে ব্যবহার করত। পন্টু সঙ্গে থাকলে চৌখাম্বা দেখেও নিশ্চয়ই সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠত আখাম্বা।
পন্টু অবশ্য আর চারণের সঙ্গে কোথাওই যাবে না। কারণ, সে পৃথিবী থেকেই চলে গেছে মাত্র সাতাশ বছর বয়সেই। কোথায় গেছে, কে জানে।
মানুষ মরে কি কোথাওই যায়?
হৃষীকেশে যে অগণ্য প্রশ্ন বুকের মধ্যে জড়ো করে নিয়ে চারণ এসেছিল তার একটিরও উত্তর এখন পর্যন্ত পায়নি। জানে না, পাবে কি না আদৌ। তবে এটা অবশ্যই বুঝতে পারছে যে এক অভিনব বাতাবরণের মধ্যে সে ঢুকে পড়েছে, যা বাতানুকুল। যার মধ্যে বিশ্বাসের শিখা জ্বলে স্থির হয় সতত। নিবাত, নিষ্কম্প।
কুঁবারসিংজি বললেন, চৌখাম্বা থেকেই বেরিয়েছে অলকানন্দা আর মন্দাকিনী। চৌখাম্বার পায়ের কাছে এদিকে কেদারনাথের মন্দির আর উলটোদিকে বদ্রীবিশাল। অলকানন্দা বেরিয়ে উত্তরে গেছে, কেদারনাথের দিকে, তারপর সেখান থেকে নেমে এসেছে রুদ্রপ্রয়াগে আর মন্দাকিনী দক্ষিণে বদ্রীবিশালের দিকে গিয়ে নেমে এসেছে রুদ্রপ্রয়াগের দিকে এবং সেখানেই মিলন হয়েছে এই দুই নদীর।
তার পরের শৃঙ্গটির নাম কি? চৌখাম্বার বাঁ পাশের?
চারণ জিগ্যেস করল।
হ্যাঁ। ওটির নাম বান্দরপুঞ্ছ।
বান্দরপুঞ্ছ? নাম? পর্বত শৃঙ্গর?
আজ্ঞে হ্যাঁ। তার একটা ইতিহাস আছে।
কি ইতিহাস?
মহাপ্রস্থানের পথে বেরিয়ে যখন পাণ্ডবেরা ওই সব অঞ্চলে পৌঁছেন তখন সহোদর ভীমকে, যুধিষ্ঠির তাঁরই কোনও কাজে পাঠান। ভীম সে কার্যে যেতে গিয়ে দেখেন পথ জুড়ে আছে এক বিশাল বাঁদরের লেজ। পথ অবরুদ্ধ। তখন তিনি অনুরোধ করেন সেই বাঁদরকে তার লেজটি পথ থেকে সরাতে। তখন বাঁদর বলেন, আমি বুড়ো হয়েছি, গায়ে একটুও জোর নেই। আপনিই লেজটা সরিয়ে নিন বরং। রেখে দিন পথের একপাশে। আপনি তো মহাবলী ভীম।
ভীম হেঁইও-হাঁইও করেও যখন লেজটা সরাতে পারলেন না পথ থেকে একচুলও তখনই তাঁর সন্দেহ হল। পরক্ষণেই তিনি বুঝলেন যে, এই বাঁদর অন্য কেউই নন, সাক্ষাৎ পবননন্দন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি নত হয়ে প্রণাম করে হনুমানের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বললেন, হনুমানজি যেন তাঁকে মাফ করে দেন?
তাই এই শৃঙ্গের নাম বান্দরপুঞ্ছ।
চারণ বলল, তাই?
তারপর জিগ্যেস করল, বান্দরপুঞ্জের বাঁ পাশের ওই শৃঙ্গগুলির নাম কি? মানে, যেগুলি দেখা যাচ্ছে এখান থেকে।
গোমুখ, গঙ্গোত্রী, যমুনোত্ৰী, তারপরে সারকুণ্ডা, একেবারে শেষে। ওই বান্দরপুঞ্চ থেকে নীলকণ্ঠ অবধি পর্বতগাত্রে স্ফটিক পাওয়া যায়। স্ফটিক ছাড়া অন্য সব গ্রহরত্নরাজি তো পাওয়া যায়ই।
নীলকণ্ঠ কোথায়? দেখালেন না তো? সেই শৃঙ্গও কি বরফাবৃত?
না, না। নীলকণ্ঠ অত উঁচু নয়। নীলকণ্ঠ হৃষীকেশের উলটোদিকে। স্বগাশ্রমের পারে। পায়ে হেঁটে যাবার পথ আছে। খুব চড়াই। ঘণ্টা তিনেক লাগে। আজকাল গাড়িতেও যাওয়া যায়। গঙ্গাজির উপরের বারাজ পেরিয়ে রাজাজি ন্যাশনাল পার্ক হয়েও যাওয়া যায়। নীলকন্ঠের পাশে পাশে বয়ে গেছে সুন্দরী ইউওল নদী।
ইউওল? বাঃ। সুন্দর নাম তো! কোথায় গিয়ে পড়েছে সে নদী?
ইউওল গিয়ে মিশেছে গঙ্গাজির সঙ্গে, ফুলচট্টির কাছে।
ফুলচট্টি কোথায়? কুঁবারসিংজি হাসলেন। বললেন, আগে তো কেদারবদ্রী যেতে হত লছমনঝুলার পায়ে হাঁটা ব্রিজ পেরিয়ে গঙ্গাজির ওপারে ওপারেই। পায়ে হেঁটে। পুণ্যার্থীদের প্রথম হলটই ছিল ফুলচটি। নানা চট্টিতে থামতে থামতে রাত কাটাতে কাটাতে অনেকদিন হাঁটার পরই তখন পৌঁছনো যেত কেদারনাথ আর বদ্রীবিশালে। আজকাল তো গাড়িতে আর বাসে হুস-হাস করে বুড়ি ছুঁয়েই সকলে চলে আসে। এখন কি আর সেই তীর্থযাত্রা আছে?
তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন, আমরা তো সব নিষ্কর্মা ছিলাম। এখনকার মানুষদের যে সময়ের দাম হয়ে গেছে ভারী। সময় নষ্ট করে মানুষ, এমন সময় এখন কোথায়? কিন্তু যে-সময়টা তারা বাঁচাচ্ছে তা দিয়ে কী করে তা জানতে বড় ইচ্ছে করে। আরও টাকা রোজগার করে কি? তাই মনে হয়। কথাটা কি জানেন বাবু, অনেক টাকা করার পরেই শুধু মানুষে বোঝে যে টাকা কাগজই মাত্র। তার নিজের নিজস্ব কোনও দাম নেই। কে কেমন ভাবে টাকাকে কাজে লাগায় তার উপরেই নির্ভর করে সব।
নীলকণ্ঠতে লোকে যায় কেন?
চারণ জিগ্যেস করল।
নীলকণ্ঠর মন্দির আছে যে সেখানে। ওইখানে বসেই নাকি মহাদেব বিষপান করে নীলকণ্ঠ হন। এইরকমই জনশ্রুতি আছে।
তাই?
এমন সময়ে মন্দিরের ঘণ্টা বেজে উঠল। মন্দিরের পেছন দিকে বসে থাকায় সিঁড়ি বেয়ে কেউ উঠলে তা এখান থেকে দেখতে পাওয়া যায় না। এই ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে কলকাতার বা বাংলার মানুষেরা কাঁসর-ঘণ্টা বলতে যা বোঝেন তার কোনও মিল নেই। চারণ লক্ষ করেছিল যে, এদিকের প্রত্যেক মন্দিরের চারদিকেই প্যারাপেট থেকে অসংখ্য ঘণ্টা ঝোলানো থাকে। পুণ্যার্থীরা মন্দির প্রদক্ষিণ করার সময়ে এবং মন্দিরে ঢোকা এবং বেরুবার সময়ে ওই ঘণ্টাগুলিকে নাড়িয়ে দিয়ে, বাজিয়ে দেন। তাতে দারুণ এক সুন্দর শব্দমালা তৈরি হয়। হাওয়ার বিভিন্ন স্তরে, বিভিন্ন তরঙ্গ তুলে, বিভিন্ন স্বরগ্রামে সেই শব্দলহরী ফুলমঞ্জরীর মতন নিস্তব্ধ পাহাড়-উপত্যকাতে গড়িয়ে গিয়ে, ছড়িয়ে যায়। এই শব্দমালাকে যদি ছবিতে অনুবাদ করা যায়, তাহলে কবুর জলরঙে-আঁকা ACUQAর কোনও নিপুণ কাজ বলে মনে হবে।
কুঁবারসিংজি চলে গেলে চারণ একা হয়ে যেতেই ওই নিস্তব্ধ রৌদ্রস্নাত পর্বত ও উপত্যকারাজির সৌন্দর্য যেন হঠাৎই বাঙময় হয়ে, আচ্ছন্ন করে ফেলল তাকে।
কী একটা পাখি ডাকছে। কী পাখি, জানে না চারণ। পাখি চেনে না, ফুল চেনে না, ঘাস চেনে না। জীবনের প্রায় অর্ধেকটাই আনকুথ সব মানুষ চিনে, অকাজে অন্যের আরও আরও আরও অথোপার্জনে সাহায্য করেই কাটিয়ে দিল। মিছিমিছি। এই সত্য উপলব্ধি করেই মন খারাপ হয়ে গেল ওর। এবারে বাকি সময়টুকু কাজের কাজ করতে হয়। কাজের কাজ। ওরও যে মন বলে একটা পদার্থ ছিল, সেটার খোঁজ যে এতদিন করেনি কেন, তা ভেবেই বড় অবাক হয়। মনের দেরাজের গভীরে বহুবছর ধরে রেখে-দেওয়া অব্যবহৃত, স্বার্থগন্ধহীন, নিরাসক্ত মনটি হঠাৎ এই এক আকাশ রোদের মধ্যে, উত্তুরে হাওয়ার মধ্যে, যখন আচমকা বেরিয়েই পড়ল তখন খুবই অস্বস্তিতে পড়ল চারণ তাকে নিয়ে। কোথায় রাখবে, কী দিয়ে ঢাকবে, তা ভেবে পেল না।
নিজের ভাবনাতে নিজে কুঁদ হয়ে বসেছিল, কতক্ষণ যে, তার হুঁস নেই। একেকবার প্রশ্বাস নিচ্ছে আর মনে হচ্ছে যেন নতুন জীবন পাচ্ছে। নূতন প্রাণ দাও, প্রাণ সখা গানটির কথা মনে পড়ে যেতে লাগল। প্রতি প্রশ্বাসেই নতুন প্রাণ।
ঠাণ্ডাতে নাকের পাটাটা ব্যথা ব্যথা করছে। কিন্তু ভাল লাগছে খুবই।
হঠাৎই পেছনে খটাখট শব্দ শুনে ওর ঘোর ভেঙে গেল। চমকে চেয়ে দেখে পাকদণ্ডী পথ বেয়ে একটা গাড়োয়ালি ছেলে উঠে আসছে প্রায় নব্বই ডিগ্রি খাড়া পথ বেয়ে। তার হাতে এক গাছা দড়ি। দড়ির অপর প্রান্ত রয়েছে একটা খচ্চরের গলাতে বাঁধা। খচ্চরের পিঠে পাথরের চাঙর। এমনি পাথরের নয়। সবুজ রঙা গ্রানাইটের।
আশ্চর্য হয়ে গেল, এমন খাড়া পথে মানুষ অথবা জানোয়ার ভার বহন করে কি ভাবে উঠে আসে উপরে এই কথা ভেবে। তারপরই ভাবল, এখানে এই মন্দির এবং চাতাল যখন তৈরি হয়েছিল একদিন, তখনও গাড়োয়াল-রাজ এমনই প্রক্রিয়াতেই তো মানুষ, জানোয়ার, মালমশলা সব এই পর্বত চুড়োয় তুলেছিলেন!
নিজের নিবুর্দ্ধিতাতে নিজেই লজ্জিত হল।
খচ্চরটি ওই খাড়া পথ বেয়ে এসে যখন চাতালের বেঁটে পাঁচিলের ধার ঘেঁষে দাঁড়াল তখন যেন বাঁচল। তার বড় বড় কান সমেত খয়েরিরঙা মুখটা চারণের মুখের থেকে মাত্র দুহাত মতন দূরে ছিল। এপর্যন্ত শান্তিনিকেতনি, কেষ্টলগর-সিটি, নানা বরেন্দ্রভূমি, বদ্যিবাটী ইত্যাদির জায়গার কিছু খসসর সে কলকাতাতে দেখেছে ওর কর্মজীবনে। এবং তার অফিসের টেবিলের উলটোদিকে তারা যখন বসেছে, তখন তাদের মুখগুলিও ওই দুহাত মতনই দূরে ছিল। কিন্তু এত বড় বড় কানওয়ালা রিয়্যাল খচ্চর, মানে, পেডিগ্রি-খচ্চর, এত কাছ থেকে আগে আর দেখেনি। হাত বাড়িয়ে, পরম শ্রদ্ধাতে, তার কান মুলে দিতে ইচ্ছা করল চারণের।
চারণ, লোকটির মুখের দিকে, খচ্চরটির মুখেরই দিকের মতন মনোযোগ সহকারে ভাল করে চেয়ে দেখে বুঝল যে, লোক নয়, ছেলে। মানে, সদ্য যুবক। সবে দাড়ি-গোঁফের রেখা উঠেছে।
আসছ কোথা থেকে?
চারণ শুধোল।
বিরেডা।
গ্রাম?
হ্যাঁ। সে
টা কোথায়?
ওই নীচের নদী পারে।
কোন নদী?
নদী নয়, ঝোরা।
নাম কি ঝোরার?
গ্রামের নামে নাম, বিরেডা।
এই খচ্চর কি তোমার?
প্রশ্নটা মুখ ফসকে বেরিয়ে যেতেই নিজের ভুল বুঝতে পারল চারণ।
কোনও খসসর বা খচ্চরই কি কোনও কালেই কারও হয়? সে বা তারা, না হয় মালিকের, না হয় স্ত্রীর, না হয় প্রেমিকার, না হয় জনগণের। এমন কি, না হয় নেতারও। খচ্চরদের সব খচরামিই। এখানে। খচ্চর অথবা খসসর সর্বকালেই তার নিজেরই। অর্থাৎ, খচ্চর, খচ্চরেরই।
তোমাদের জমি-জমা নেই?
আছে। অল্প।
ছেলেটা কতখানি চড়াই বেয়ে আসছে, তা কে জানে। পাহাড়িরা হাঁফায়-টাফায় না। অত সহজে হাঁফ-টাফ ওঠে না। তবে সামান্য পরিশ্রান্ত হয়েছে যে, তা মুখ দেখে বোঝা গেল। তার মাথার গোল টুপি খুলে তার ভেতর থেকে বিড়ির বাণ্ডিল বের করে পকেট থেকে কেরোসিনের সস্তা লাইটার বের করে কুটুক আওয়াজ করে আগুন জ্বেলে একটা বিড়ি ধরাল। তারপর তাতে একটা টান লাগিয়ে বেশ কিছুক্ষণ গাল ফুলিয়ে থেকে পরম আরামে ধোঁয়া ছাড়ল।
কি চাষ কর সেখানে?
কী আর করব, মক্কী, গেঁহু, মসুর এইসব।
এই গ্রানাইট পাথর এখানে বয়ে আনছ কেন?
মন্দিরের মাথাতে চড়বে।
কেন? কালো পাথরের মন্দির তো চমৎকার মজবুতই আছে।
কে জানে, কেন? পুরোহিতজি জাদা যাত্রী লানেকো ফেরমে যায় শায়েদ। মন্দির চকমকানেসে জাদা যাত্রী উপ্পর আয়েগা। দোনো সাইডসে ঔর দোনো মন্দিরভি বনে গা রামজি ঔর সীতাজিকি।
উসসে কুরসিংজি কি ক্যা ফ্যায়দা?
কামাই জাদা হোগা, ঔর ক্যা?
তারপরে একটু থেমে বলল, আসতে তো অনেকই ঝকমারি এখানে, কী তেহরি থেকে বা দেরাদুন থেকে। হৃষীকেশ থেকেও তেহরি রোড ধরে গাড়োয়ালের পুরনো রাজধানী নরেন্দ্রনগর ছাড়িয়ে এসে বাস থেকে নেমে বহৎ চড়াই উঠে, তারপর আবার তিনশ ষাট সিঁড়ি। গাড়িতে আর কজন আসতে পারে। তবে অবশ্য উপরে একবার উঠে আসতে পারলে ভারী আরাম।
বলেই বলল, এখানের জল খেয়েছেন?
জল? এখানে?
হ্যাঁ। কল আছে তো সিঁড়ি দিয়ে উঠেই বাঁদিকে। বৃষ্টির জল ট্যাক্কিতে জমা হয়। তারপর পাম্প করে তা উঠিয়ে ফিল্টার করিয়ে তারপর দেওয়া হয়। জল খেলে দিল খুশ হয়ে যাবে। ৬৪
আবার একটু থেমে বলল, ফেরার পথে তেহরির দিকে একটু গেলেই যা রাবড়ি পাওয়া যায়, তা বলার নয়। পুরো গাড়োয়ালে এর জবাব নেই।
তাই?
তারপর চারণ বলল, উনি ঈশ্বরের সেবক, কামাইএর ধান্দা কেন?
হাঃ। ঈশ্বরের সেবা আজকাল আর কজন করেন বাবু?
তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, সবাই নিজের নিজের পেটেরই সেবা করে। ডাক্তারও কী রোগীর সেবা করে আজকাল? না, উকিল মোক্তারের? জমানাই বদল গ্যায়া।
তাই?
এই সত্য কথনে আহত হল চারণ।
ওঁর ছেলে মেয়ে নেই? সংসার?
আছে না! উনি তপোবনে থাকেন। ওঁর ছেলে ভারী চাকরি করে। এক ছেলে ব্যবসা। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে ভারী-ভারী সব অফসারদের সঙ্গে।
ছেলেরা কেউ পুজো করে না? মানে, পুরোহিত হয়নি?
নাঃ! এখন প্রত্যেকেরই অনেক টাকার দরকার। এই টঙে সারাদিনে কজন যাত্রীই বা আসে।
ধূপ-ধুনো, ফুল, মন্দিরের গা-থেকে ঝোলানো ঘণ্টার মস্বর এই কলুষহীন উত্তরে বাতাস, পাখির ডাকে নিজের মনটাতে বেশ একটু নিরাসক্তি এসেছিল, ধার্মিক-ধার্মিক ভাব। আর ঠিক সেই সময়েই এই খচ্চরওয়ালা উলটো বকে এই শান্তির বাতাবরণ ছিঁড়ে-খুঁড়ে দিল। চটকে দিল শ্রদ্ধা।
খচ্চরের মালিকও কি খসসর হয়? কে জানে!
এসব কথা তো সে জানেই। রোজই শুনে শুনে ক্লান্ত। আর ক্লান্ত বলেই তো এতদুরে এসেছে অন্য কিছু শুনবে বলে। তবে কি এসব চারণের উইশফুল থিংকিং? সকলেরই কি ভেক আছে? সব সাধুর? সব পুরোহিতের?
না, না, তা হতেই পারে না। এই পুরোহিতের ত এই পেশা। ওঁর সঙ্গে ত্রিবেণী ঘাটের ভীমগিরির ধিয়ানগিরিদের কোনওই মিল নেই। ওঁরা প্রকৃতই সাধু। সন্ত আদমি। মাধুকরী করে খাওয়া সহজ মানুষ সব।
আবারও মন্দিরের ঘণ্টা বেজে উঠল। চারণ বুঝল যে, আবারও যাত্রী এল তিনশ ষাটটি সিঁড়ি ভেঙে, পাহাড়ের চুড়োতে ওঠার পর। আরও কামাই হবে কুঁবারসিংজির।
মনটা খারাপ হয়ে গেল চারণের। ও তো কোনও মন্দিরে ঢোকেই না। মন্দিরের বাইরেটাই ওর কাছে সব। এই পাহাড়-চুড়োর কালো পাথরের চাতালটির প্রেমে পড়ে গেছিল ও। মন্দিরটিও ছোট চাতালের একেবারে মধ্যিখানে বানানো আর পর্বত-শীর্ষের পুরোটা নিয়ে পাঁচিল-ঘেরা চাতাল। পোঁছে, ভারী শান্তি পেয়েছিল।
তারপর ভাবল, এঁদেরই বা দোষ কি? সারা দেশই যখন লুঠমার এ মেতেছে, সব পেশারই মানুষ, রাজনীতিক, চাকুরিজীবীরা, পঞ্চায়েতের মাথা থেকে মুখ্যমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী প্রত্যেকেরই যখন আরও টাকার, অনেক টাকার দরকার, গণ্ডা-গণ্ডা অপোগণ্ড ছেলেদের হিল্লে করা দরকার, তখন কুঁবারুসিংজি বেচারি, দেবতার সেবা করেন বলেই কি আর দেশের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবেন?
থাকবেন, কি করে?
ভাবছিল চারণ যে, হৃষীকেশের দুপাশে স্বগাশ্রম এবং তপোবনেও টিভির ডিশ-অ্যান্টেনাতে ভরে গেছে। এই আপদের হাত থেকে, সর্বগ্রাসী লোভের হাত থেকে বাঁচতে হলে, হয় ত্রিবেণী ঘাটের মতন কোনও উদোম ঘাটে নয়তো কোনও গুহাতে করে না গেলে উপায় নেই। একদিন বিদ্যুৎ স্বাগতম ছিল। কারণ, অন্ধকারকে তা আলোকিত করত। আজকে, চারণের মনে হয় যে বিদ্যৎ চরম অন্ধকারের বাহন হয়ে এসেছে। তার নানা-রঙা আলোর ঝলকানির আড়ালে অন্ধকারের সর্বনাশা বীজকে সাধারণে দেখতে পায় না, পাবে না আরও কিছুদিন।
কিন্তু…।
কে জানে! হয়তো কেদারনাথ ও বদ্রীবিশালেও ভিশ-অ্যান্টেনা পৌঁছে গেছে।
হৃষীকেশ শহরে ঢোকার মুখেই রুদ্রপ্রয়াগের একটি হোটেলের বিজ্ঞাপন দেখেছিল। হোটেল পুষ্পদীপ। অল কমফর্টস! টোয়েন্টি ফোর আওয়ার্স রানিং হট অ্যান্ড কোন্ড ওয়াটার। কেবল টিভি ইত্যাদি।
ভাবতেও খারাপ লাগছিল ওর। আজ থেকে বছর ষাটেক আগে, যখন অলকানন্দার পারে একটি আমগাছের উপরে বসে মহান ভারতপ্রেমী জিম করবেট রুদ্রপ্রয়াগের মানুষ খেকো চিতাবাঘটিকে মেরে হাজার হাজার তীর্থযাত্রীর এবং এইসব অঞ্চলের বাসিন্দাদের অলিখিত, অঘোষিত কিন্তু DEFACTO কাফু থেকে মুক্ত করেছিলেন, যখন টর্চের ড্রাইসেলের ব্যাটারি পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি, তাই অন্ধকারেই নিশানা নিয়ে গুলি করতে হয়েছিল তাঁকে। তখন উনি কি ভেবেছিলেন যে, সেই গাছটির অনতিদূরের একটি হোটেলে এবং রুদ্রপ্রয়াগের অন্য জায়গাতেও কেবল টিভি এসে যাবে।
কী উদ্ভাবন বিজ্ঞানের! অভাবনীয়। ড্রাইসেলের টর্চ ছিল না মাত্র ষাট বছর আগে আর এখন বিদ্যুতে আর কৃত্রিম উপগ্রহে কি না করছে? নিজে আর দাঁত মাজছে না মানুষ, কোমর টিপছে না, দাড়ি কামাচ্ছে না, ফলের রস করছে না, গাড়ি চালাবার সময়ে অ্যাকসিলেটরে পা দিয়ে চাপ দিতে হচ্ছে না, গিয়ার দিতে হচ্ছে না, শত্রুপক্ষের ঘাঁটিতে বোমা ফেলতে হলে বহুবার প্লেনে পাইলট লাগছে না। যে-মরুভূমিতে, ইংরেজ জেনারাল মন্টাগোমারি আর জার্মান জেনারাল রোমেল ঢোলা খাকি হাফ-প্যান্ট আর বুশ শার্ট পরে ট্যাঙ্কের যুদ্ধ করেছেন সেই মরুভূমিতেই সেদিন যুদ্ধ করল অ্যামেরিকান সৈন্যরা এয়াকন্ডিশনড ফাইটিং-স্যুট পরে। মেয়ে সৈন্যরা গর্ভবতী হয়ে পড়ল সারেসার, রাতারাতি, যুদ্ধ করতে হবে না বলে। মিসিল ছুটল, মৃত্যুর দৃত। কোনওরকম তর্জনগর্জন ছাড়াই। নিছক তর্জনী হেলনে। বোতাম টিপে। মানুষের শৌর্য, বীর্য, মহত্ব, ত্যাগ, দয়া, মায়া, সংযম, মনুষ্যত্ব এ সব কিছুরই আর কোনও দাম রইল না।
পৃথিবী দুর্বার গতিতে এগিয়ে গেছে গত ষাটবছরে। অভাবনীয় ভাবে। জয়! বিজ্ঞানের জয়! আরাম-আয়েসের জয়! ভোগের জয়! মৃত্যুর জয়।
চারণ ভাবছিল, এই যে সব হাজার হাজার বৈজ্ঞানিকদের উদ্ভাবন করা যন্ত্র মানুষের সময় বাঁচিয়ে দিল, দিনের কয়েকঘণ্টা, ভিডিও, ক্যাসেট রেকডার, কেবল টিভির মাধ্যমে জ্ঞানী করে তুলল মানুষকে, পেজার এবং মোবাইল ফোন দিয়ে সব মানুষকেই গম্য এবং লভ্য করে তুলল, তার পরিণাম কি?
কি হবে?
এই বেঁচে-যাওয়া সময় নিয়ে মানুষ কি করল? মানুষ? বিধাতার সৃষ্ট সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী?
বান্দরপুঞ্ছর দূরের আকাশ-জোড়া বরফাবৃত পর্বতশৃঙ্গরাজির দিকে চেয়ে চারণ ভাবছিল, মানুষ যাকে অগ্রগতি ভাবছে, যাকে ভাবছে উদ্ভাবন, যাকে ভাবছে বিজ্ঞানের জয়জয়কার, তা কি মানুষকে আবার বাঁদরত্বেই ফিরিয়ে আনছে? আমাদের সকলেরই কি বান্দরপুঞ্চ রই মতন লেজ গজাবে আবারও? বিজ্ঞান কি সত্যি সত্যিই কিছুমাত্রই উদ্ভাবন করেছে? এ সব কি নিছকই আবিষ্কার নয়?
অনেকক্ষণ বান্দরপুঞ্ছ-র দিকে চেয়ে চারণ বসে রইল চুপ করে। ভাবছিল, ওর লেখাপড়া শেখা কি বিফলেই গেল? এই প্রচণ্ড বিজ্ঞানমনস্কতার দিনে মানুষের মগজ কম্পুটারকে দাদন দিয়ে, মানুষে যখন পরমানন্দে ওয়েফার-চিপস আর আইসক্রিম খেতে খেতে সোপ-অপেরা দেখছে এই বাঁচানো-সময়ের সদ্ব্যবহার করে, নয়তো সকালে উঠে রেসের ঘোড়ার বা কেনেল ক্লাবের প্রতিযোগিতাতে সামিল হওয়া কুকুরেরই মতন ফিজিক্যাল ফিটনেসের ক্রেজে সামিল হয়েছে, তখন চারণ একা এত বিজ্ঞান-বিরোধী কেন?
প্রকৃতই অশিক্ষিত বলে কি?
মুঝে মাফ কর দিজিয়ে। ম্যায় জারা বীজী হো গ্যায়া থা।
কুঁবারসিংজি এসে বললেন।
চারণ উঠে পড়ল।
মনে মনে বলল, মাফ করা গেল না এই সুন্দর চাতাল আর মন্দিরকে কদর্য করে তোলার পরিকল্পনার জন্যে।
মুখে বলল, আজকে যাচ্ছি। আসব আবার কখনও।
নিশ্চয়ই আসবেন।
পকেট থেকে বের করে আরও একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দিল ওকে চারণ। দেখেও না দেখে, উনি সেটা নিলেন।
চারণ ভাবল, অনেক সময় তো নষ্ট করেছে ও কুরসিংজির। প্রত্যেক মানুষেরই সময়ের দাম থাকে। কিন্তু কে কার সময়কে কী ভাবে ব্যয় করল তার ওপরেই একজন মানুষের সঙ্গে অন্যের পার্থক্য।
কুঞ্জাপুরীর মন্দিরের তিনশ ষাটটি সিঁড়ি বেয়ে চারণ যখন নেমে আসছে নীচে, তখন দেখল একটি সাদা মারুতি এস্টিম গাড়ি উপরে উঠে আসছে নীচ থেকে।
তবে যে খচ্চরওয়ালা বলল, পুণ্যার্থীরা আসেন না এখানে!
ও যখন উপরে উঠছিল মন্দিরের পথের চড়াই খাড়া ফার্স্ট গিয়ারে ঠেঙিয়ে, তখন অত্যন্তই বিপজ্জনকভাবে দুটি গাড়িকে উপর থেকে নামতে দেখেছিল। নেশাগ্রস্তর মতন এদিক-ওদিক করতে করতে আসছিল গাড়িগুলো খাড়া উতরাইয়ে। কিসের নেশা করেছিল ড্রাইভারেরা কে জানে!
সত্যি! নিরামিষপুরী হৃষীকেশে না এলে নিজের দেশের নিরামিষ-নেশার জগতের অলিগলিও অজানাই থেকে যেত হয়তো। কতরকম বৈচিত্র্য! আহা রে। এ সবের সামনে হুইস্কি রাম-জিন-ভডকা এসব কোনও নেশাই নয়। অথচ ওই সবই এখানে Tabool। যদিও এসবের প্রত্যেকটিই মাছ-মাংস নয়, ফল-ফুল ধান্য-শস্য থেকেই তৈরি হয়। তারাও নিরামিষই। অথচ এখানে সম্পূর্ণই বর্জ্য। ও সব নাকি বিজাতীয়, উত্তেজক নেশা। একশো ভাগ দিশি হলেও কারণ বারিরও চল নেই এখানে। মনে হয়, রাগটা, জলীয় পদার্থের উপরেই। কারণটা অবশ্য অজানাই। এখানের নেশা হল সিদ্ধির নেশা, গাঁজার নেশা, চতুচরসের নেশা, আসলি কেন্দুপাতাতে মোড়া আসলি তামাকের এক আঙুল লম্বা বিড়ির নেশা, রুখা-শুখা, রুখা-প্রকৃতির নেশা, শুখা-ভৈরবীর নেশা, এত সব নেশার কথাও তো আগে জানত না চারণ! আস্তে আস্তে জানছে। খচ্চরের নেশার কথাও।
খচ্চরের নেশাটা অবশ্য ঠিক কী বস্তু তা ও নিজেই ভাল করে জানে না। তবে, নাকে এখনও খচ্চরের গন্ধটা, তীব্র এবং টাটকা আছে। নাকে নিয়েই চারণ বুঝতে পেরেছে এই গন্ধ যে, খচ্চরেরও মানুষকে ইনটক্সিকেট করার ক্ষমতা আছে।
গরুর গায়ের গন্ধ, কুকুরের গায়ের গন্ধ, ঘোড়র গায়ের গন্ধ সম্বন্ধে ও অভিজ্ঞ ছিলই। কিন্তু তাদের গায়ের গন্ধে এমন kick নেই, যে kick, সব নেশারই মূলে। তার সঙ্গে আজ যোগ হল গাড়োয়াল রেঞ্জের বিরেড়া গ্রামের থায়রা-ব্রেড খচ্চরের গায়ের গন্ধ।
বৃষ্টিতে ভিজলে মোটা-মোটা নোমওয়ালা চতুষ্পদ জন্তুদের গায়ের গন্ধ ভুরভুরায়। তা তারা বন্যই হোক কী গৃহপালিত।
চারণ জানে।
চারণের মা বলতেন, ও যখন ছোট ছিল তখন ওর মাথাতে উড়ন-চাঁটি মেরে বলতেন, তুই একটা গন্ধগোকুল, বলতেন, ছুছুন্দরকী শর পর চামেলিকি তেল।
কেন বলতেন, তা জানে না। খচ্চরের গায়ের গন্ধটা কিন্তু তীব্র হলেও বেশ বন্ধুভাবাপন্ন। চারপেয়ে প্রাণী বলেই এই প্রজাতিকে গন্ধ দিয়েই দুর থেকে চেনা যায়। এদের চেনা, দুপেয়ে খসসরদের মতন কঠিন নয়। খসসরদের গায়ে নিজস্ব কোনও গন্ধ নেই। যে-ধান্দা নিয়ে তারা যখন ঘোরে তাদের গা থেকে তখন সেই ধান্দার গন্ধ ছাড়া অন্য সব ধান্দার গন্ধই ওড়ে।
এও খসসরদের এক ধরনের খসরামি।
চারণও নীচে পৌঁছেছে আর সাদা মারুতি এস্টিমটাও এসে পৌঁছল।
চারণ, কুমার ট্রাভেলস-এর ভাড়া গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল এমন সময়ে এক বামাক ওই গাড়ির দরজা খুলে নেমেই ইংরেজিতে বলল, হোয়াট আ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ। ইন দিস আউট অফ দ্য ওয়ার্লড প্লেস! চারণদা-দা+আ+আ+আ।
চারণ, বিষম খাওয়ার মতন চমকে উঠে দেখল, মিলি।
তুমি!
দক্ষিণ কলকাতার সোসাইটি-গার্ল, ক্লাব-পার্টি করা, রেসের মাঠে যাওয়া সুন্দরী মিলিকে এখানে দেখে অবাক হল চারণ।
মিলি একটা কমলা রঙা সিল্কের শাড়ি পরেছে। সাদা সিল্কের ব্লাউজ। কপালে কমলারঙা বিন্দি, পায়ে চামড়ার কমলা রঙা চটি। হাতে, এক্সপোর্ট-লেদারের নরম কমলা রঙা ব্যাগ, কোমরে রুপোর পৈছা আর এক বিঘৎ অনাবৃত ফরসা মসৃণ পেট-দেখানো কোমর থেকে গোঁজা কমলারঙা রুমাল। পেটটা এমন করে দেখায় ও, যেন পেট দেখলেই পেটের নীচে কি আছে তা দেখতে ইচ্ছে যায় দেখভাল করণেওয়ালা পুরুষদের।
চারণদা! আপনি এখানে? অফ অল প্লেসেস, এই গড-ফরসেকেন কুজাপুরীতে?
হু সেইড সো? দিস প্লেস, আই অ্যাম টোন্ড, ইজ ভেরি মাচ অ্যান অ্যাবোড অফ গড। আই মীন, গডেস।
তা বলতে পারেন। আপনি যেখান থেকে নেমে এলেন সেখানে আর কোনও ভগবান থাকেন তা আমি জানি না, কিন্তু আমার ভগবান অবশ্যই থাকেন।
ভয়ে চারণের পেট গুড়গুড়িয়ে উঠল।
মিলিটা তো ফাস্ট-রেট-ফ্লার্ট হয়ে উঠেছে। ভাবল, চারণ।
তারপর তুলে বলল ই-ই-ইয়ার্কি কোরো না। তুমিই বা কোত্থেকে? পথ ভুলে?
ওপাশের দরজা খুলে কালা মাছের মতন লাল-চোখো এবং বোয়াল মাছের মতন মুখশ্রীর বেঁটে-বাঁটকুল ফেডেড-জিনস আর ওয়্যারহাউসের ক্যাজুয়াল-ওয়্যার একটা খাকি জামা পরে নামলেন একজন। তিনি ডান হাতের আড়াইখানা আঙুল তুলে শিঙ্গিমাছের লেজেরই মতন দ্রুত নাড়িয়ে বললেন, হাই!
চারণও যন্ত্রচালিতের মতন বলল, হাই!
এ. কে. ফর্টিসেভেনের গুলির মতন এফর্টলেসলি বেরিয়ে গেল শব্দটা।
তারপরে চারণ বলল, ইনি?
ও, আই অ্যাম সরি। ইনি গবেশ গুহ।
চারণ ভাবল, শটি কর্তন করে ট বসিয়ে দেওয়া উচিত অবিলম্বে।
আর এই যে!
যে ডিমিন্যুটিভ ভদ্রমহিলা গাড়ির পেছনের সিট থেকে নামলেন, শুশুকের মতন, কিন্তু সাদ শুশুক, তাঁর দিকে তর্জনী নির্দেশ করে বলল মিলি, এই যে, আমাদের চামচুমা বৌদি।
নমস্কার!
বলল, চারণ।
মিলি বলল, হরিদ্বারে ফ্ল্যাট কিনেছেন গবেশদা। ওঁরা বিষনই ভালবাসেন হারডয়ার।
চারণের ইচ্ছে হল বলে, যে কোনও HARDWAREই ওঁদের অবশ্যই ভালবাসেন। ভালবাসাবাসিতে মিউচুয়ালিটিই হল প্রধান শর্ত।
কেমন দেখলেন মন্দিরের বিগ্রহ? দেবা, না দেবী?
আমি মন্দিরের ভিতরে ঢুকিনি।
মাই গুডনেস। হোয়াই?
আমি ঢুকি না কোনও মন্দিরেই।
সিলি! হাইট অফ স্টুপিডিটি চারণদা-আ+আ।
ফোর-প্লে করার পরেও প্রবেশ না করে চলে যাওয়া। হাউ মরবিড!
বলেই, গবেশ হাসল।
খিঃ খিঃ। করে, হাসল মিলি।
চারণ অফেডেড হল। মিলির বাবা পর্যন্ত তাকে সম্মানের চোখে দেখতেন আর মেয়েটার কোনও পাত্র-জ্ঞান নেই।
.
বিরেডা গ্রামের নাম না জানা ছেলেটার ইনোসেন্ট খচ্চরটার গন্ধ ফিরে এল ওর নাকে। তার পরেই এই দুপেয়ে মেয়ে খসসর-এর। এটা নতুন খসসর। এখনও গন্ধ ক্যামোফ্ল্যাজ করা শেখেনি।
ভাবল, চারণ।
চামচুম বৌদির মাথার উপর দিয়ে মিলির স্কুল রসিকতা এবং ইংরেজি ভাষা, বাউলার এর মতন বেরিয়ে গেল। চার হাত পা এবং তাঁর তাবৎ বুদ্ধির বেঁটে ব্যাট ঘুরিয়েও তিনি খেলতে পারলেন না মিলিকে।
পরক্ষণেই চারণের মনে হল, গবেশ কোনও অশিক্ষিত বড়লোকের মেয়েকে ফাঁসিয়েছে অথবা তার বাবাই গবেশকে ফাঁসিয়েছে। বড়লোকদের মধ্যে অধিকাংশই অবশ্য অশিক্ষিত। কিছু ক্ষমতান্ধ শিক্ষিতর মধ্যে শিক্ষার গুমোর অবশ্য থাকে। প্রকৃত শিক্ষিত নন বলেই থাকে।
মোটা চামচুম বৌদি ফুলে ফুলে হাসলেন। হুঃ হুঃ হাঃ হাঃ।
অবভিয়াসলি-মোটা, রসিকতার বিন্দুমাত্রই না বুঝে।
চারণের ভাল লাগল চামচুম বৌদিকে। কোনও প্রিটেনশানস নেই। অ্যাজ পিওর অ্যাজ ছ-মাসের গালাগোব্দা ছাগলছানা। মানে, মানসিকভাবে, যদিও শরীরে তিনি জলে-ঢেউতোলা শুশুক।
আপনি কোতায় উটেচেন?
মন্দাকিনী হোটেলে।
ও+ও+ও ম+অ+আ+আ। আমরাও তো সেকানেই চেক-ইন করে সোজা একানে আসচি। কাল সকালে পাহাড় চড়ব। মানে, গাড়িতে। আপনার ঘরের নাম্বার কত?
আমি আজ বিকেলেই চেক-আউট করে চলে যাব।
চারণ মিথ্যে বলল।
যাবেন কোতায়?
চারণের ইচ্ছে হল যে বলে, জাহান্নামে। কিন্তু বলল, কিছু না ভেবেই, চাম্মাতে।
সেটা কোথায়? বাট হোয়াই? নো-ও-ও। ঊ্য কান্ট। রাতে আমরা ডিনার খাব একসঙ্গে।
চারণ বলল, মিলির মানসিকতার স্তরে নিজেকে অদৃশ্য প্যারাসুট দিয়ে নামিয়ে এনে, মাই ফুট! ডিনার! রুটি-তড়কা না রুটি পালক-পনির? ডিনার? আর তার পর? নাচবে কোথায়? তোমার তো শুনেছি ডিনারের পর না নাচলে ডিনার হজম হয় না। তা, এ কি তাজবেঙ্গল পেয়েছ? ইনকগনিটো আছে এখানে ভেবেছ বুঝি?
গবেশ মধ্যে পড়ে এবারে খাটাশের মতন হাসল, খোঃ। খোঃ।
মিলি বলল, আপনিই তো আচেন। আপনিই আমার তাজ বেঙ্গলের ইনকগনিটো, এবং ওবেরয় গ্রান্ডের পিংক-এলিফেন্ট।
চামচুম চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তাকে দেখলে মনে হচ্ছে, দাঁড়াতেও ভারী কষ্ট তার। তাকে শুইয়ে দিলেই আরামে থাকে। এতই মোটা সে মহিলা!
চারণ মনে মনে বলল, মিলিকে, পেঁচি, ক্ষ্যামা দে।
চুপ করে আচেন কেন চারণদাদা?
মিলি অধৈর্য গলাতে বলল।
চারণভূমিতে যেতে হবে আমার।
সেটা কি জিনিস আবার।
সংসদের অভিধান দেখে নিও।
সেটাই বা কি? কী যে কুইজ করো না তুমি।
গবেশ শব্দের মানে কি স্যার?
গবেশের দিকে ফিরে হঠাত্র জিজ্ঞেস করল চারণ। কথা ঘুরিয়ে।
ফ্রাঙ্কলি স্পিকিং, গলাটা একটু খাঁকরে নিয়ে গবেশ বলল, আমি জানি না স্যার।
সে কি! নিজের নামের মানে জানেন না?
না চারণদা।
চারণ মনে মনে গায়ে-পড়া, বোয়াল-মুখো, কাৎলা-চোখো লোকটার উপরে চটলো।
চেনা নেই শোনা নেই, দাদা! বঙ্গভূমের এই এক কাদা।
নাম দিয়েছিলেন কে?
বাবা-মায়ের দেওয়া নাম তত ছিল প্রাণধন। তা চামচুম আমার সঙ্গে বিয়ের পরে বলল, তুমি প্রাণ তো নয়ই, ধনও নয়!
চামচুম ডলফিনের মতন শব্দ করে হাসল।
ধনও নয় কেন? বাংলার সব ছেলেই ধন। ধন ধন ধন, আমার সোনার খো-ওকন।
শোনেননি?
চারণ বলল।
না, তা নয়, চারণদা। আমি আমার স্ত্রীকে খুব বালবাসি। তাই, অ্যাফিডেভিট করে নামটা বদলে নিলাম।
গবেশ নামটা ঠিক করেছিলেন কে? এরই বা মানে কি?
নাম ঠিক করে দিয়েছিল চামচুমই। তবে মানে, ওও জানে না।
সে কী।
আজ্ঞে।
এ নামটা বুদ্ধদেব গুহর কোনও উপন্যাসের নায়কের নাম। এমন সব উদ্ভট উদ্ভট নাম দেন না। ভদ্রলোক!
আপনার স্ত্রী বুঝি বুদ্ধদেব গুহর ভক্ত?
না, না, আমার স্ত্রী নন। আমার মেয়েকে যিনি বাংলা পড়ান, সেই দিদিমণি।
মিলি ফুট কাটল, হ্যাঁ। সে বিষনই বক্ত।
বাংলা তো আমার মেয়ে পড়তেই চায় না অনেক আধুনিক শিক্ষিত বাঙালির মতন।
গর্বিত গলাতে বললেন গবেশ অথবা গবেট,
তা, উনি নামের মানেটা বলেননি? মানে, মেয়ের বাংলা দিদিমণি? নামটা তো ওঁরই দেওয়া?
না, না। নাম আমিই দিয়েছি।
এবারে চামচুম বললেন।
তারপর বললেন, রিনা বলল, একটা উদ্ভট নাম দিয়ে দাও। বুদ্ধদেব গুহ ঠিক একটা মানে বের করে দেবেন।
চারণ হেসে বলল, তাই? বাঃ দ্য জোক অফ দ্য ইয়ার। গ্রেট লেখক তো।
ভাবল, এদের জন্যেই বাংলা সাহিত্যের এই অবস্থা। ঘিলু বলতে কিছু নেই, বাবরির বাহার। মিলি বলল, কতবার বললুম। তোমার নাম রাখো গলিয়াথ, গবেশ বদলে, তা শোনে কই? গলিয়াথ?
স্তম্ভিত হয়ে বলল, চারণ।
হ্যাঁ গলিয়াথ! হোয়াই নট?
মিলি যেন চারণের মনের কথাই আঁচ করে বলল, আমি কিন্তু ওইসব ট্র্যাশ পড়ি না। আমি কোনও বাংলা বই-ই পড়ি না।
পড়বেই বা কেন? তুমি তো মেমসাহেব।
ওয়েল, উ্য নন্যা চারণদা, আই অ্যাম!
বলেই বলল, তুমি কি নীচে নামছ?
চারণ হেসে বলল, নীচেই তো নামছি সারাটা জীবন। নীচে নামা তো চিরকালই সহজ মিলি। তুমি তারাশংকরের দুই পুরুষের সুশোভনের ডায়ালগটি জানো না বুঝি? নাটকের রেকর্ডও ছিল। জহর গাঙ্গুলি অভিনয় করতেন ওই চরিত্রে, আর ছবি বিশ্বাস, নুটুবিহারী। পড়েছ কি দুই পুরুষ?
না। পড়িনি। বললামই তো যে, বাংলা পড়িনি। বলল না, কী ডায়ালগ?
নুটুবিহারী মোক্তার, মাতাল সুশোভনকে বললেন, তোমার এত বড় অধঃপতন হয়েছে সুশোভন?
জবাবে সুশোভন বললে, জড়ানো গলাতে, পতন তো চিরকাল অধঃলোকেই হয় নুটুদা! কে আর কবে ঊর্ধ্বলোকে পড়েছে বল?
খোঃ খোঃ করে গবেশ হেসে উঠল।
মিলি বলল, ওয়ান্ডারফুল।
তারপর বলল জানো, মাঝে মাঝে মনটা খারাপ লাগে, নিজে বাঙালি হয়েও বাংলা সাহিত্য পড়িনি, পড়িনা বলে। কিন্তু এত প্যানপ্যানে, ম্যাদামারা না, যে পড়তে ইচ্ছেই করে না। তবে বাঙালি লেখকদের জন্যে আমার ফিলিং আছে। মাই! মাই! হাউ পুওর দে আর! দে লিভ লাইক দ্যা ব্ল্যাকস লিভিং ইন দ্য ইয়র্ক ঘেট্টো। বিক্রম শেঠ, দুধের শিশু, একখানা দ্য টেবল বয় লিখেও মাল্টিমিলিয়েনিয়র হয়ে গেল। আর বাংলাতে যাঁরা লেখে? খেতে পায় না চারণদাদা, খেতেই পায় না। ওয়াট আ পিটি!
সে কথা অবশ্য বেঠিক নয়।
মিলি বলল, তবে খবর-কাগজের সঙ্গে যাঁরা আছেন, মানে চাকরি করে, বা না করেও চাকর এবং সেখানে নিয়মিত লেখেন তাঁবা সকলেই ওয়েল-অফফ বলে শুনেছি। ফ্ল্যাট আছে, গাড়ি আছে।
তেমনই শুনেছি অবশ্য। চারণ বলল।
দ্যাটস রাইট। অনেকই করেছে খবর কাগজেরা, হা-ভাতে লেখকদের জন্যে, কবিদের জন্যে।
গবেশ বলল। মানে, তাঁদের ভাত কাপড়ের জন্যে।
আপনি এত জানলেন কি করে?
চারণ শুধোল।
আমার আপন মাসতুতো ভাইয়ের আপন সেজ ভায়রাভাই-এর মেজ ভগ্নীপতি যে জার্নালিস্ট।
ও। তবে তো জানতেই পারেন। অবশ্যই পারেন!
চারণ বলল।
তারপর বলল, বাংলা সাহিত্য পড়েন না অথচ বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের প্রতি যে আপনার এতখানি কনসার্ন তা তাঁরা জানতে পেলে প্রীত হতেন। খবর কাগজেরাও হয়তো খুশি হতেন তাদের পুণ্যকর্মর অ্যাপ্রিসিয়েশনের জন্যে।
মিলি হঠাই বলল, বাঈ। পুণ্য করতে যাই।
চারণ, যেন শুনল, উঠল বাই তো কটক যাই।
মিলি বলল, আমরা কিন্তু দেবভূমিতে এক-ক্রেট হুইস্কি স্মাগল করে নিয়ে এসেছি। রাতে জমে যাবে। হিঃ হিঃ।
শুকনো থাকতে পারি না মা শ্যামা, আমার কারণ বারি চাই।
কালা-চোখো বোয়াল-মুখো গবেশ বলল।
তারপর হাসল, খিঃ খিঃ।
চামচুম আশ্রম-মৃগীর মতন ড্যাবা-ড্যাবা চোখে চেয়ে রইল তার স্বামীর দিকে। মৃগীরা ছাগীদের কাজিনস।
মনে পড়ল চারণের।
চারণের চিন্তা হল চামচুমের জন্যে। যে নিজের পায়ে দাঁড়াতেই পারছে না, সে ওই তিনশ ষাটটি সিঁড়ি উঠবে কি করে!
মিলি এগিয়ে যেতে যেতে বলল, বাঈ। আজ রাতে যাবেন না প্লিজ। এই মরুভূমিতে আপনিই ওয়েসিস।
চারণ দাঁড়িয়ে দেখছিল। ওরা উঠতে লাগল উপরে।
গবেশ রেলিং ধরে কচ্ছপের মতন উঠছিল আর চামচুম নীলগিরি হিলস-এর স্লো-লরিস বদরির মতন, ভূকম্পন তুলে, ছেড়ে ছেদড়ে। আর মিলি উঠছিল ক্যাট-ওয়াকিং করে। যেন কুঞ্জাপুরীতে আজ দুপুরে কোনও অ্যাড-এজেন্সি আয়োজিত ফ্যাশান-প্যারেড আছে।
গাড়িতে বসে, ড্রাইভারকে গাড়ি স্টার্ট করতে বলে, ও ভাবছিল, ওর মুক্তি নেই, মুক্তি হবে না। যে-অনুষঙ্গ ওকে ঘিরে ছিল, যে কালিমা, যে কলুষ, যে সস্তা বিত্তববষ্টিত সাধারণ্য ওর পা দুটিকে, বাদার দলদলিরই মতন জড়িয়ে ছিল, তা থেকে নিজেকে বিযুক্ত করা হয়তো এ জয়ে আর হবে না।
মিলির মতন, গবেশের মতন, চামচুমের মতন অগভীর মানুষেরা কুঞ্জাপুরীর মন্দিরে এত কষ্ট করে উঠে কী খুঁজবে কে জানে! হয়তো কলকাতাতে ফিরে ঝলমলে ড্রয়িংরুমে বা ক্যালকাটা ক্লাবের লেডিজ কফি-মিট এ কুঞ্জাপুরী দেখার রোমহর্ষক গল্প করবে, যেমন ভাবে রাজস্থানের রানথামবোর স্যাংচুয়ারিতে বাঘ দেখার গল্প করে।
কিছু মানুষ সংসারে চিরদিনই ছিল, আছে এবং থাকবে, যারা চিরটা জীবন অন্যকে ইমপ্রেস করার জন্যেই বেঁচে থাকে। মৃত্যুর ক্ষণ অবধি। যখন যম ডাকে, শুধু তখনই বুঝতে পারে, এ জম্মটা বৃথাই গেল। নিজের জন্যে কিছুমাত্রই করা হল না। মিলিরও এই জম্মটাও হয়তো তেমনভাবেই যাবে। তবে গবেশ আর চামচুমের কথা বলতে পারে না চারণ। অত অল্প সময়ে দেখে কোনও মানুষকেই বিচার কথা উচিত নয়। বাইরে থেকে, কচ্ছপদের, খোলার জন্যে সঠিক দেখা যায় না। তাদের চিৎ করিয়ে ফেলতে হয়। তাতে, সময় লাগে। এমনও হতে পারে যে, গবেশের মধ্যে হয়তো খুবই গভীরতা আছে। সেও মিলিকে ইমপ্রেস করারই জন্যে এই মূর্খর মুখোশ পরে আছে। এমন অনেক মানুষ ও মোসাহেব দেখেছে তার পেশার জীবনে। কারোকেই বহিরঙ্গ রূপ দেখে বিচার করতে নেই তড়িঘড়ি। ঠকতে হয় তাতে।
ভাবছিল চারণ, তার পেশাতে সে সমাজের এমনই Cross-section নিজ চোখে দেখেছে, দূরে এসে সেই অভিজ্ঞতার গভীরতা এখন বুঝতে পারে। এবং পেরে, চমকৃত হয়।
পেশা থেকে অর্থ যা পেয়েছে! মান যা পেয়েছে তা তো পেয়েছেই। মনুষ্যচরিত্র সম্বন্ধে যে জ্ঞান জন্মেছে, সেও তো ফ্যালনা নয়!
মিলিও তার এক মক্কেলেরই কন্যা। যেমন ছিলেন পাটনের বাবাও। দুজনের বাবারই একটাই অসুখ। সে অসুখের নাম টাকা। লক্ষ্মীদেবীর মতন ছিন্নমতি দেবী বোধহয় বেশি নেই। দশটির মধ্যে নটি ক্ষেত্রেই তিনি গিয়ে ভুল বাড়িতে ঢোকেন কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে। মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তরা প্রতি বৃহস্পতিবারে তাঁকে পুজো করে, লক্ষ্মীপূর্ণিমার দিনে যারা দরজার বাইরে থেকে সিন্দুক বা আলমারি পর্যন্ত লক্ষ্মীর পা আলপনায় আঁকে, পরম যত্নে চালের গুঁড়ো আর ময়দার পিটুলি দিয়ে, তাদের বাড়িতে না গিয়ে, যাদের বাড়িতে তাঁর আরাধনা আদৌ হয় না, তাঁদের বাড়িতেই গিয়ে ওঠেন তিনি।
অর্থর মতন অনর্থ যে আর দ্বিতীয় নেই, গোবরের মধ্যে, পুরীষের মধ্যে, পচা-কাঠের মধ্যে, ঝুরো-মাটির নীচের অর্থবানদের, পোকামাকড়েরই মতন তার নৈর্ব্যক্তিক পেশাদারি দৃষ্টি, এবং পর্যবেক্ষণের কাঠি দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে এই সিদ্ধান্তেই এসেছে চারণ।
এই প্রেক্ষিতে চারণ অবশ্যই বলবে যে, পাটন ছেলেটা তাকে একেবারেই বুদ্ধু বানিয়ে দিয়েছে। বুদ্ধু সিংকে সঙ্গে নিয়ে, একদিন ভিয়াসির কাছে পাটনের ভোঁদাইবাবার আশ্রমে তাকে যেতেই হবে। পাটনের বাবার মতন এমন একজন ছোট মনের, নিষ্ঠুর, স্বার্থমগ্ন ধনকুবের বেশি দেখেনি চারণ। তাঁদের ছেলেমেয়েরা সাধারণত মিলির মতনই হয়। পাটনের মতন নয়।
মিলি বিবাহিত। তার স্বামী ঘরজামাই। হাবা-গোবা, একজন অতি সাধারণ ঘরের, বি এ পাশ, উচ্চাকাঙ্ক্ষাহীন ছেলের সঙ্গে মিলির বিয়ে দিয়েছিলেন মিলির বাবা, নাতি-নাতনি নিয়ে খেলা করবেন বলে, যেমন করে তিনি তার জার্মান স্পিৎজদের নিয়ে খেলেন। কিন্তু বিধি বাম। চারণ জানে না, মিলি আদৌ তার স্বামীর সঙ্গে সহবাস করেছে কি না! বিয়ে অবশ্য হয়েছে মাত্র তিন বছর। তবে সহবাস করার মানুষের অবশ্য মিলির অভাব নেই। এখনও মনে সন্তানের ইচ্ছা জাগেনি হয়তো, তাই সন্তান আসেনি। তবে যখনই আসুক, মিলির সন্তান সম্ভবত কানীনই হবে। জীবনকে তার মতন করে উপভোগ করার সাধ আছে মিলির। সাধ্যও আছে। কিন্তু সাহস নেই। ও যদি কোনও মনোমতো পুরুষ সঙ্গীকে একা নিয়ে আসত এখানে, তাও বুঝত চারণ। কিন্তু এই গবেশ আর চামচুমের গুণগত মান সম্বন্ধে আদৌ সন্তুষ্ট হতে পারেনি ও। অবশ্য ওর সন্তুষ্টি নিয়ে মাথাই বা কে ঘামাচ্ছে! এইসব অশিক্ষিত অর্থবানদের প্রত্যেকেরই মধ্যে একটা জিনিস দেখেছে ও, যা কমোন। তা হচ্ছে, এঁরা কেউই কোনও স্বার্থ যেখানে নেই, সেখানে মানুষের সঙ্গে মিশতে পারেন না। মোসাহেব ও চাকরবাকর ছাড়া, এঁরা কারও সঙ্গেই মিশতে পারেন না।
মিলির বাবা হরিচরণবাবু হাওড়াতে থাকতেন এখনও। মিলিই একমাত্র সন্তান। হরিচরণবাবুর স্ত্রী মিলির বিয়ের আগেই গত হয়েছিলেন। হরিচরণবাবুও গত হয়েছেন বছর দুয়েক হল। তারপরই মিলি এই মিলি হয়েছে। বাড়িতে তার স্বামী জনার্দন কুকুরদের দেখাশোনা করে, খরচের হিসাব রাখে, তিনখানা গাড়ি সার্ভিস করায়, মেরামত করায়, ফার্নিচার ঝাড়পোঁছ করায়, ঝাড়গ্রামের বাগানবাড়ির দেখাশোনা করে। জনার্দন ছেলেটা খুব শান্ত। এবং ইতিহাসে অনার্স নিয়ে বি এ পাশ করেছিল। ভাল ছেলে। বেচারি। ও যদি জানত যে, ওর জীবদ্দশাতেই ও নিজেই ইতিহাস হয়ে যাবে তবে কী করত কে জানে! সবচেয়ে বড় কথা, নিম্নবিত্ত গরিব মা নিজের এবং ওর সুরাহার জন্যে কোটিপতির একমাত্র সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে সম্বন্ধ আসাতে গদগদ হয়ে রাজি হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন যে, ওঁর হাওড়ার কদমতলা লেন থেকে বেরোনো সরু গলির মধ্যে তাঁর ভাড়া বাড়িতে এসে মিলি ঘর আলো করবে। ওঁর সব স্বপ্নই বিফল হয়ে ছিল। একাই থাকেন সেখানে। একটা মেয়ে রেখে দিয়েছে জনার্দন তার হাতখরচের টাকা থেকে।
এই জনার্দন ছেলেটা চারণের কাছে এক বিস্ময়। কোনওরকম জাগতিক চাহিদা শুন্য ছেলেটা। ইতিহাসে বি এ-র চাকরি হয় না সহজে। হলেও, মাকে ছেড়ে সে যেতে পারত না, যেও না। তাই ভাগ্যের হাতে সে নিজেকে সমর্পণ করেছে। আজকের দিনেও লক্ষ লক্ষ বাঙালি ছেলে যা করে।
চারণ এতদিন জানত পুত্রার্থে ভায্যা। কিন্তু জনার্দন পুত্রার্থে স্বামী। অথচ সেই কাজটাও মিলি ওকে দিয়ে করাল না। কিন্তু আশ্চর্য! হরিচরণবাবু বা মিলির এত বৈভবের মধ্যে বাস করেও বড়লোকদের কোনওরকম দোষ ছুঁতে পারেনি জনার্দনকে। ও জানে, ও সব ওর নয়, ও সবে ওর অধিকারও নেই। প্রয়োজনও নেই। সংসারে থেকেও যে সন্ন্যাসী হওয়া যায়, তা কুরসিংজিরাও শিখতে পারতেন জনার্দন দলুই এর কাছ থেকে।
জনার্দনের সব দুঃখের কথা চারণ জানে, কিন্তু তা শোধন করার কোনও ক্ষমতাই ওর নেই।
হরিচরণবাবু জনার্দনকে কিছুমাত্রই দিয়ে যাননি তাঁর উইলে। বাড়ির ভিতরের একজোড়া স্পিৎজ কুকুর, বাইরে জোড়া অ্যালসেশিয়ান এবং একটি গ্রেটডেন এবং বাগানের আধডজন ম্যাকাও যেমন খেতে পায় দুবেলা, দানা এবং পানি, জনার্দনের অধিকার তাদের চেয়ে একটুও বেশি নয় এ সংসারে।
জনার্দন দুপুরে একবার মায়ের কাছে যায়। সেই তার জীবনের একমাত্র সুখ।
কত মানুষের কত রকম দুঃখ থাকে এ সংসারে তার কতটুকুই বা অন্যে লাঘব করতে পারে! অন্যের কষ্ট চারণকে চিরদিনই মথিত করেছে। আজও করে। চারণ যে হরিচরণবাবুর মতন মানুষদের, পাটন-এর বাবার মতন মানুষদের সেবা করেই জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ কাটিয়ে দিয়েছে, এটা ভেবে, নিজের প্রতি অনুকম্পা হয়। আবার কখনও ভাবে, যা কিছুই ঘটে, তার পেছনে হয়তো কোনও গুঢ় কারণও থাকে, যা আদৌ আপাতদৃষ্টিগোচর নয়।
আপশোষ হচ্ছিল, মিলিকে জনার্দনের কথা জিজ্ঞেস করা হল না বলে।
মিলি লা-মাৰ্টস-এ পড়েছিল নাই ক্লাস অবধি। তাই যথেষ্ট। ফটফট করে ইংরেজি বলতে পারা আর কী করে, কোথায়, মুঠো মুঠো পরার্জিত টাকা অবহেলে খরচ করা যায়, তা জানলেই ঐ সমাজে সহজেই শিক্ষিত এবং সপ্রতিভ বলে মান্য হওয়া যায়। শিক্ষা আর ঔদ্ধত্য ঐ সমাজে সমার্থক। ঔদ্ধত্য বা দম্ভর আবার রকমভেদ আছে। হরিচরণবাবুদের মধ্যে কেউ কেউ রক্তকরবীর রাজার মতনই লোকচক্ষুর আড়ালে থাকেন। তাঁদের বড় একটা দেখা যায় না। শোনা যায় শুধু। তাও, তাঁদের নিজের কণ্ঠস্বরেও নয়। তাঁদের চাকরবাকরেরই কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে। তাঁরা কারওকে তোলেন, কারওকে ফেলেন। অবলীলায়, অবহেলে।
লক্ষ্ণৌ-এর নবাবেরা যেমন বটেরের বা উটের দৌড় দেখতেন খেলা হিসেবে, তেমনই এই তোলা-ফেলার খেলাটাই তাঁদের একমাত্র খেলা। সাধারণত এই শ্রেণীর অর্থবানেরা কান-পাতলা হন। ফলে, অন্যদের উপরে নির্ভর করতে করতে একটা সময় আসেই, যখন একটা চক্রর শিকার হতে হয় তাঁদের প্রত্যেককেই। হিতার্থীর মুখোশ-পরা একদল চাকরই যে তাঁদের অজ্ঞাতে কখন তাঁদের মালিক হয়ে ওঠেন, তাদের পূর্ণ অনবধানে এবং মৌন সম্মতিতে, তা বুঝতে পর্যন্ত পারেন না তাঁরা। এই দল, খসসর বড়লোকদের মধ্যে হিমবাহ। তাঁদের ক্রিয়াকাণ্ডর সামান্যই দেখা যায়। যতখানি না বড়লোক তাঁরা, দেখান তার চেয়ে বেশি। দুহাতে টাকা খরচ করেন।
আবার আরেকদল বড়লোক আছেন, যাঁরা চেঁচান, মাথা গরম করেন, টাকার গরম দেখান। আসল ক্লাস ওয়ান গ্রেড ওয়ান বড়লোকেরা কিন্তু নিজে হাতে টাকা ধরেন না, নিজে হাতে টাকা খরচও করেন না। আয়ের টাকাও নিজে হাতে ছোঁন না, নিঃশব্দে আয় হয়, ব্যয়ও হয়, নিঃশব্দেই। তার জন্যেও মাইনে করা লোক আছে। তাঁরা কখনওই রাগ দেখান না। নিজে হাতে রেগে গিয়ে চড়চাপড়ও মারেন না, নিজ-মুখে বকেন না। তাঁরা খুন করিয়ে দেন অন্যদের দিয়ে অপছন্দর মানুষকে। আয় করার, ব্যয় করার জন্যে তাঁদের যেমন চাকর থাকে, খুন করার জন্যে, চরিত্র হননের জন্যেও বিভিন্নরকমের চাকরের চাষ করেন তাঁরা।
কুঞ্জাপুরীর মন্দিরের খাড়া উতরাই নেমে এসে গাড়িটা এবারে তেহরি-গাড়োয়ালের পথে নেমে বাঁদিকে মোড় নিল। পাহাড় নামার টেনশন থেকে মুক্ত হল চারণ। ড্রাইভারকে বলল, ফেরার সময়ে নরেন্দ্রনগরের ভিতরটা একটু ঘুরিয়ে দেখাতে হবে ভাই। গাড়োয়লের রাজারা আগে থাকতেন তো এখানে!
ড্রাইভারও গাভোয়ালি। নাম কেশর সিং। তার বাড়ি দেবপ্রয়াগে। সে বলল, দেখাবে।
এতদিন চারণ তার পরতের পর পরত অতীতকে, তার নানা অনুষঙ্গকে ঝামা দিয়ে ঘষে ঘষে ভোলার মতন যে তুলছিল, সেই process-টা পুরোপুরি Retarded হয়ে গেল মিলির সঙ্গে দেখা হয়ে। যে-অতীতকে সে ছোট-হয়ে-যাওয়া জামার মতন ছুঁড়ে ফেলতে চায়, ছেড়ে ফেলতে চায়, সেই অতীতই, গন্ধ-শোঁকা গন্ধগোকুল কুকুরের মতো মিলির মাধ্যমে তার খোঁজ পেয়ে গেল। হয়তো তার পিছু ছাড়বে না।
চারণকে পালাতে হবে আজই। পালাতেই হবে। ভাবল, মিথ্যাচার যদি ভাল কাজের জন্যে করতে হয়, তবে সেটা দোষের মধ্যে গণ্য নয়। ঠিক করল, আজই হোটেলে ফিরে ম্যানেজারকে বলে, সে চলে যাবে কেশর সিংকে নিয়ে ভিয়াসি। বুদ্ধু সিংকে পথ থেকে তুলতে পারলে তুলবে, নইলে একাই কেশর সিংকে নিয়ে চলে যাবে ভোঁদাইবাবার আশ্রমের সন্ধানে।
মিলিকে দেখার পর থেকে পাটনের কথা খুবই মনে পড়ছিল চারণের। ভাবছিল, এই মেকীর দুনিয়াতে পাটন একটি অরিজিনাল ছেলে। হাইলি ইন্টারেস্টিং। ওর কোনও প্রোটোটাইপ নেই।
রাবড়ি খাওয়া আর হল না। কেশর সিং বাঁয়ে মোড় নিয়ে নিয়েছিল। রাবড়ি খেতে হলে, তেহরির দিকে আরও একটু যেতে হত ডাইনে।
যাকগে।
ভাবল, চারণ। একা একা কোনও বিলাসই করতে ইচ্ছে হয় না। সেই জন্যেই হয়তো সন্ন্যাসের গোড়ার কথা ভেড়চাল-এর ভিড় এড়িয়ে একা হয়ে যাওয়া।
কিছুক্ষণের মধ্যেই নরেন্দ্রনগরে পৌঁছনো গেল। হৃষীকেশ-এর পথ ছেড়ে শহরের ভেতরে ঢুকল কেশর সিং। বাজারটা প্রধান পথের উপরেই পড়ে। অনেকটা মোগলদের হাভেলি এবং হারেমের মধ্যে যে বাজার থাকত তেমন। দুপাশে সার সার দোকান, মধ্যে দিয়ে পথ। এখনও দিল্লির লালকেল্লাতে যেমন আছে। যাওয়ার সময়ে দ্রুত চলে গেছিল, ভাল করে দেখেনি।
একটু পরেই নির্জনে পৌঁছে রাজার প্রাসাদ দেখা গেল। এখন হৃত-গৌরব, ভাগ্য-হত, অস্তমিত-সূর্য কিন্তু এক সময়ের প্রবল-প্রতাপান্বিত রাজা, মহারাজা, শিল্পপতি, রাজনীতিক এবং মিডিয়া-মালিকদের নরেন্দ্রপুরে একবার আসা দরকার। আসা দরকার এই সরল সত্যটি হৃদয়ঙ্গম করতে এই প্রাসাদ দেখে যে, কোনও রাজত্বই চিরকালীন নয়, কোনওরকম অন্যায়কারীর রাজত্ব তো নয়ই! যতদিন অর্থ, বাহুবল এবং নানাবিধ ক্ষমতা থাকে, ততদিন তাতে অন্ধ না-হয়ে ঐ সবের অনিত্যতার কথা মনে রেখে মানুষের সঙ্গে মানুষের মতন ব্যবহার করা যে উচিত ছিল, এই কথা, এই সব করুণ ছবি, হয়তো তাঁদের মনে করিয়ে দিতেও পারে। অবশ্য যদি মনুষ্যত্ব তাঁদের মধ্যে তখনও বিন্দুমাত্র বেঁচে থাকে।
গাড়োয়াল রাজের রাজধানীর মূল রাজবাড়িতে এখন কেউই থাকেন না। তা, ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার। রাখার মতন রেস্তও আজকের রাজার নেই বলে মনে হল। নইলে, বহুবর্ণ লম্বকর্ণদের মিটিং বসত না সুউচ্চ, চওড়া, অগণ্য ধাপ-সম্বলিত সিঁড়িতে।
রাজা কোথায় থাকেন?
জিগ্যেস করাতে, কেশর সিং চারণকে বলল, পেছনের দিকের একটা অংশে। রাজবাড়ির পেছন দিকের গেট দিয়ে ঢুকতে হয়। তবে গেট-এ তালা দেওয়া থাকে। একজন মাত্র দারোয়ান আছে। ভারী পদা ঝোলে একতলার স্বল্পকটি ঘরের বড় বড় জানালা থেকে দিনের বেলাতেও। এই জন্যে যে, যদি কেউ ভেতরে ঢুকেও আসে, তবেও যেন কিছুই দেখতে না পায়। রাজা নাকি দিনরাত মদ খান।
কেশর সিং তারপরে বলল, ভিতরে কি যাবেন পেছন দিক দিয়ে?
চারণ বলল, না, না। ঠিক আছে।
তারপর চারণ নিজেকে বলল, সব জিনিসই নিজে চোখে দেখার উদগ্র বাসনার মধ্যে একধরনের অশিক্ষা আছে। অবশ্যই আছে। চানঘরে না বলে ঢুকে পড়ে কোনও স্নানরতাকে দেখতে, আর হৃতরাজ্য, হৃত-দৌলত কোনও রাজার অ-সুরক্ষিত বাসস্থানে অমন ঢুকে পড়তে, তার রুচিতে বাধে। তাছাড়া, অনেক কিছুই না-দেখেই দেখা যায়। কল্পনা দিয়ে। মানুষ হয়ে জন্মানো বড় সৌভাগ্যের কথা। এই কল্পনার দান কি বিধাতা অন্য প্রাণীকে দিয়েছেন?
জানা নেই।
থাকুন রাজা, আহত-বাঘের মতো তাঁর নিভৃতির আড়ালে, ক্ষতস্থানের রক্ত জিভ দিয়ে, আক্ষেপ আর ক্ষোভের লালার সঙ্গে চাটুন তিনি সকল দুঃখহারী মদের সঙ্গে। তাঁর নিভৃতি তাঁরই থাকুক। ভাগ্যহতকে যদি গলা-খাঁকারি দিয়ে জানান দেওয়া যায় যে, তিনি ভাগ্যহত, তাতে আর যাই হোক, যিনি জানান দেন, তাঁর মানও যেমন বাড়ে না, তেমনই ভাগ্যহতর দুঃখও কমে না। প্রত্যেক শিক্ষিত মানুষেরই সম্ভবত উচিত, এই শিক্ষাতে শিক্ষিত হওয়া। কতটুকু চোখে দেখবেন আর কতটুকুকে দূর থেকে কল্পনা দিয়েই ভরিয়ে নেবেন, অন্যকে কোনওরকম অস্বস্তিতে না ফেলে, সেই discretion-এর ব্যবহার জানাটা শিক্ষার অঙ্গ অবশ্যই!
গাড়ি ঘুরিয়ে নিতে বলল চারণ, কেশর সিংকে।
তেহরি-গাভোয়ালের পথ ছেড়ে দেরাদুন রোডে পড়ে যখন হৃষীকেশের দিকে বাঁয়ে ঘুরল গাড়িটা তখন চারণ কেশর সিংকে বলল, ওর কোম্পানিতেই যেতে। মানে, কুমার ট্র্যাভেলস-এ। হৃষীকেশ-দেবপ্রয়াগ রোডের উপরে।
সেখানে যখন পৌঁছল তখন প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। ওখান থেকেই মন্দাকিনী হোটেলে ফোন করে বলল যে, যদি কেউই ওর খোঁজ করে, তাহলে বলতে যে ও চাম্মাতে চলে গেছে।
সেখান থেকে হয়তো মুসৌরি হয়ে, দিল্লি হয়ে কলকাতাতে ফিরে যাবে। এবং এও বলতে বলল যে, হোটেল থেকে চেক-আউট করে চলে গেছে চারণ।
ম্যানেজার উত্তরপ্রদেশের মানুষ। জিন্দা-দিল। বললেন, কিউ সাহাব, মাডার-উডার তো কিয়া নেই না? ম্যায় কোই লারামে তো নেহি ফাঁসে গা?
নেহি নেহি জি! ম্যায় মাডার নেহি কিয়া মগর খুদকো মাডার হোনেকা ডর হ্যায়। উসী কারণমেই ঝুট বোলনে পড়েগি আপকি।
ম্যানেজার রসিক লোক। বললেন, ঠিক যায়। হররোজ সুরে সে সামতক তো আপনা আপনা রোটি-ডালকে ফিরমে বহতই ঝুট সবহিকা বোলনাহি পড়তা, কিসিকো জান বাঁচানে কে লিয়ে এক ঔরভি ঝুট বোল দেগা। আপ বেফিকর রহিয়ে।
তারপর বলল, রাতমে খনাত লিজিয়েগা না?
চারণ বলল, কুছ কহ নেহি শকতা। ভিয়াসিকি তরফ যানো বিচার হ্যায়। খয়ের, হুঁয়া রোক গিয়া তো রাতমে লওটনে নেহিভি শকতা।
ভিয়াসিমে?
বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, ম্যানেজার।
তারপর বললেন, অজীব বাত। ঘঁয়া আভূভি হ্যায় কেয়া? হামারা কোঈ ভি যাত্রী তো হুঁয়া যাতে নেহি। মগর হাঁ। পাস কর যাতা হ্যায় জরুর। দেওপ্রয়াগ যানেকি রাস্তেমেহিতো পড়তা না ভিয়াসি!
হ্যাঁ। মায় জানতা হুঁ।
তব ঠিক হ্যায় সাহাব। রুম বেয়ারাকো বোল দুংগা ম্যায়, কামরা ঠিক-ঠাক করকে রাখে গা।
সুক্রিয়া।
বলল, চারণ।
চারণ, গাড়ি ওখানেই ছেড়ে দিল। তবে কুমার ট্র্যাভেলস-এর মালিককে বলল যে, তিনটে-চারটের সময় ফিরে ও বেরোতে পারে। ঠিক নেই। কেশর সিং তখন থাকলে ভাল হয়।
মালিক বললেন, গাড়ি দেব ঠিকই সাব কিন্তু কোন ড্রাইভার আর কোন গাড়ি তা আগে থাকতে বলা শক্ত। আপনি যদি সকাল থেকে পুরোদিনের জন্যে নিতেন তো কথা অন্য ছিল।
ও বলল, ঠিক আছে।
তারপর ত্রিবেণী ঘাটের দিকে এগোল। ঠিক করল আজ ওই ঘাটেরই কাছাকাছি কোনও দোকানে কিছু খেয়ে নেবে।
হাঁটতে হাঁটতে ত্রিবেণী ঘাটের দিকে যেতে যেতে ভাবছিল ও, কে জানে! এখন ভীমগিরিকে পাবে কি না ঘাটে।
না পেলে?
এই কদিনে ও যে এতখানি ভীমগিরি-নির্ভর হয়ে উঠেছে এই সত্যটা বাবে বারে উপলব্ধি করে ভীষণই বিরক্ত হল। একা থাকতে পারে, একা ভাবতে পারে, এই গুণ ওর আছে বলেই একধরনের শ্লাঘা জন্মে গেছিল মনে কিন্তু এই হৃষীকেশের ভীমগিরি সন্নিসী তাকে পুরোপুরি পর-নির্ভর করে দিচ্ছে আস্তে আস্তে ক্রমশই। এমন মুক্তি তো ওর আদৌ প্রত্যাশিত ছিল না।
ঘাটে যখন পৌঁছল তখন ভিড় পাতলা হয়ে গেছে। নিত্যই যাঁদের যাতায়াত, তারা ঘরে গেছেন খাওয়া-দাওয়া করতে কিন্তু ভ্রমণার্থী যাঁরা, বহু দূর দূর দেশ থেকে যাঁরা আসছেন, কেউ বা কেদারবদ্রী যাবার পথে ছুঁ মেরে যাচ্ছেন, তাঁদের ভিড় সবসময়ই লেগে থাকে ত্রিবেণী ঘাটে। এবং আছে।
ভীমগিরিকে দেখা গেল না। কিন্তু তাঁর গুরু ধিয়ানগিরি যথারীতি লুঙির মতন করে ধুতি আর গায়ে একটা হাতওয়ালা সাদা গেঞ্জি পরে সামনে ঝুঁকে তাঁর কোণটিতে বসে আছেন। গায়ের উপরে আড়াআড়ি করে একটা নস্যিরঙা বহু-ব্যবহৃত গরম চাদর ফেলা। উনি মনোযোগ দিয়ে এবং তাঁর চারপাশের প্রতিবেশ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ আত্মবিস্মৃত হয়ে কী একটা তারের বাজনা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন।
দেখল বটে চারণ, কিন্তু কাছে গেল না। ভাবল, কী দরকার।
ওর কারওকেই দরকার নেই। ও নিজেতে নিজেই সম্পূর্ণ। ভীমগিরিকেও দরকার নেই চারণের, তার গুরুকেও নয়। ধিয়ানগিরি হঠাৎ মুখ তুললেন। এবং চারণকে দেখতে পেয়ে হাসলেন। আশ্চর্য এক হাসি। চারণ অভিভূত হয়ে গেল সেই হাসি দেখে। সেই হাসির মধ্যে কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। না, নিজেকে কৃতার্থ করা সেই হাসি, না, পরকে। সেই হাসি যেন কোনও বনফুলের হাসির মতন, বুদ্ধু সিং এর বাড়ি থেকে উতরাইতে-নামা পথের দুপাশে ফুটে-থাকা লালটায়েন ফুলেরই মতন, পার্বত্য ঝরনারই মতন। হাসলেন, কোনওরকম আদেশ-নির্দেশ-প্রত্যাশা না রেখে। যেন না হেসে পারেন না, তাই হাসলেন। কিন্তু হাসলেনই শুধু।
কাছে আসতে বললেন না তাকে। দুরে যেতেও নয়।
সেই হাসি দেখে চারণের মনে এক আশ্চর্য ভাবের সৃষ্টি হল। ও চাতালের এক প্রান্তে গাছতলিতে বসে পড়ল ওই নদীতীরের মধ্যাহ্ন-প্রকৃতিরই অঙ্গ হয়ে গিয়ে। ত্রিবেণী ঘাটের পটভূমির এক আঙ্গিকই হয়ে গেল যেন। ঠাণ্ডা হাওয়ার মধ্যে নদীতীরের সিমেন্ট বাঁধানো ঠাণ্ডা চাতালে আসন পিঁড়ি হয়ে বসে, ধিয়ানগিরির দিকে চেয়ে চারণের মিলন কুন্দেরার THE UNBEARABLE LIGHTNESS OF BEING বইটির কথা মনে পড়ে গেল। বইটি এমন কিছুই নয়। ইংরেজি বই হলেই বা পুরস্কৃত বই হলেই যে সুপাঠ্য অথবা ভাল বই হবে তার কোনও মানে নেই। মিলন কুন্দেরা শোভা দে-র চেয়ে একটু অন্যরকম হলেও, ওই একই পদের। প্রায় শ-খানেক অধমনস্ক রতিক্রিয়ার অনুপুঙ্খ বর্ণনাই যদি সাহিত্য-পদবাচ্য করে তুলতে পারে কোনও লেখাকে তবে তো কথাই ছিল না। কুন্দেরা, নিজস্ব কারণেই কমুনিস্ট-বিরোধী। কিন্তু শুধু সেই জন্যেই যদি আমেরিকান-লবি তাকে মহৎ-সাহিত্যিক বলে ঠাউরে বসেন তাহলে বলার কিছুই নেই। তাছাড়া, মিলন কুন্দেরার লেখাতে মহৎ কোনও ব্যাপার নেই, যেমন বরিস পাস্টারনাকের লেখাতে আছে। তবে একথা ঠিক যে, কুন্দেরার বইয়ে মাঝে মাঝে কিছু কিছু পংক্তি আছে, কিছু কিছু বক্তব্য আছে, যা মহৎ সাহিত্যের চৌকাঠে পৌঁছেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, চৌকাঠে এসেই ফিরে গেছে। মহত্ত্বর নির্জন ঘরে প্রবেশ করতে পারেনি।
মিলন কুন্দেরার ঐ বইটির এক জায়গায় উনি লিখেছেন যে, কেউ আমাদের দিকে চেয়ে দেখুক অথবা মনোযোগী হোক, এটা আমরা সব মানুষই আশা করি, প্রত্যেকেই চাই। অন্যভাবে বললে বলতে হয়, আমরা প্রত্যেকেই ইম্পট্যান্ট হতে চাই, অন্যের দ্রষ্টব্য, মনোযোগের পাত্র হতে চাই। এই ইস্পট্যা-প্রত্যাশী আমাদের মধ্যে, কুন্দেরার মতে, আবার নানা ভাগ আছে। একদল চাই অগণ্য অচেনা অজানা মানুষ আমাদের দেখুন। অর্থাৎ, সেই দল, জনগণের মনোযোগ এবং চোখ চান, জনগণের দেওয়া অসাধারণত্বে সম্পৃক্ত, সিঞ্চিত হতে চান।
আরেকদল আছেন আমাদের মধ্যে, যাঁদের পক্ষে নিছক বেঁচে থাকার জন্যেই অগণ্য পরিচিত মানুষদের মনোযোগের তীব্র চাহিদা থাকে। তাঁদের পরিচিতির গণ্ডীর মধ্যে তাঁরা প্রত্যেকের চোখে ইম্পট্যান্ট হয়ে উঠতে চান এবং থাকতে চান। এই সব মানুষেরাই প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ককটেল-পার্টি আর ডিনারে নেমতন্ন করেন পরিচিতদের এবং অপরিচিত, অর্ধ-পরিচিতদেরও। যাতে পরিচিতির বৃত্তর মধ্যে তাঁদের এনে ফেলা যায়। সেই চেষ্টাতেই প্রতিমুহূর্তে সচেষ্ট থাকেন।
আর তৃতীয় দল হচ্ছেন তাঁরা, যাঁরা অনুক্ষণ তাঁদের এক বা একাধিক ভালবাসার জনের চোখের মণি হয়ে বেঁচে থাকতে চান।
শুধু এই তিন শ্রেণীই নয়, তিনভাগ জল এবং একভাগ স্থলের মতন একটি চতুর্থ শ্রেণীও আছে। চলিতাৰ্থে নয় যদিও। সেই শ্রেণীর মানুষেরা খুবই বিরল। তাঁদের কোনও মানুষকেই শারীরিকভাবে প্রয়োজন হয় না। মানে, কারওই শারীরিক নৈকট্যর প্রয়োজন হয় না। হয় না, কারও চোখের চাওয়ারও। তাঁরা তাঁদের কল্পনায় অগণ্য অনুপস্থিত এমন কি অস্তিত্বহীন মানুষেরও চোখের সামনে থাকেন অথবা তাঁদের চোখের সামনে রাখেন। এরা হলেন স্বপ্ন-দেখা মানুষ। DREAMERS।
কে জানে! ভাবছিল চারণ, মহারাজ ধিয়ানগিরিও হয়তো এই চতুর্থ শ্রেণীতেই পড়েন। পড়েন, অনেক সাধু-সন্নিসী, লেখক, গায়ক, চিত্রকর, যাঁরা সাধরণের শ্রেণীভুক্ত নন বলেই তাঁদের চাওয়া-পাওয়ার রকমসকমও পুরোপুরি আলাদা হয়। এবং হয় বলেই হয়তো ধিয়ানগিরিও চারণকে দেখেও দেখলেন না, হেসেও হাসলেন না।
চারণ ভাবছিল যে, অগণ্য নারী-পুরুষের পরিবেষ্টনে, প্রতিবেষ্টনে, প্রতিবেশে বাস করেও ওই মানুষেরা একেবারেই একা। তীব্র কল্পনা এবং ইচ্ছা শক্তি দিয়েই শুধুমাত্র তাঁরা নিজেদের নিজস্ব জগত গড়ে নিতে জানেন। গড়ে নেন ইমারত, খাট-পালঙ্ক, মালঞ্চ, তড়াগ। কোনও নারী শরীরের কাছে না গিয়েও অনায়াসে সম্ভোগ করেন তাকে কল্পনাতে। কোনও পুরুষের কাছেও না এসে তাকে, তাদের স্তুতি ও শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেন চুম্বকের মতন।
মিলন কুন্দেরা হয়তো জানেনও না যে, এই শ্রেণীর মানুষকেই, ভারতীয়রা সাধক বলে থাকেন। সব জাগতিক সাধ-আহ্লাদকেই যাঁরা অবহেলে পায়ে মাড়িয়ে যান অন্য কিছুর, অনেক বড় কিছু পাওয়ার প্রত্যাশায়, সে সব প্রাপ্তি সম্বন্ধে পশ্চিমী ভোগবাদের দুনিয়ার কোনও ধারণাই নেই। তাদের জগতের, তাদের মানসিকতার, তাদের ভাবনা-চিন্তার স্তরের ভাষাভাষী কোনও মানুষের পক্ষে এই ভীমগিরি-ধিয়ানগিরিদের সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা করাও হয়তো সম্ভব নয়।
চারণের চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল ভীমগিরির গলার স্বরে।
নমস্কার চারণবাবু।
চমকে উঠে বলল চারণ, নমস্কার।
এই অসময়ে?
সকালে কুঞ্জাপুরীতে গেছিলাম যে!
তাই? তা লাগল কেমন?
ভাল। তবে পরে গেলে হয়তো আর ভাল লাগবে না। শুনলাম, চাতালের উপরে দুটি ছোট মন্দির বানাচ্ছেন কুঁবারসিংজি।
তাই? সত্যিই তো খারাপ খবর তাহলে।
তারপরে বললেন, ভগবানেরা তো আর শরিকদের সঙ্গে ঝগড়া করেন না, মানুষদের মতন যে, এজমালি বাড়িতে তাদের ঠাঁই-এর অকুলান হবে। চাতালটিই তো কুঞ্জাপুরীর সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য ছিল। আশ্চর্য!
আমারও তাই মনে হয়। চারণ বলল। মন্দিরে-মসজিদে মানুষ তো যায়ই সেই জন্যে। পরিবেশে যদি শান্তিই না থাকল, না থাকল space, আক্ষরিকার্থে এবং মানসিকার্থে, তাহলে মন্দিরের অন্ধকারের মধ্যে বসিয়ে-রাখা বিগ্রহ কি শান্তি দিতে পারে কারওকে।
সাহী বাত।
বললেন, ভীমগিরি মহারাজ।
চারণ বলল, আজ এখানেই কোথাও খেয়ে নেব।
কেন?
কারণ আছে।
ও। তাছাড়া খিদেও পেয়েছে নিশ্চয়ই। কুঞ্জাপুরীর তিনশো ষাটটি সিঁড়ি চড়া তো সোজা কথা নয়।
চারণ হেসে বলল, তা একটু পেয়েছে।
বলেই বলল, আপনি খাবেন না? আপনার খাওয়া কি হয়ে গেছে?
ভীমগিরি বললেন, গতকাল থেকে উপোস আছি। পরশু আবার খাব।
সে কি? কষ্ট হচ্ছে না?
ভীমগিরি হাসলেন।
বললেন, দেখে কি তাই মনে হচ্ছে?
না, তা মনে হচ্ছে না। হাসছেন তো কথায় কথায়ই।
হাঃ। হাসির সঙ্গে খাওয়ার কি? খেতে সময় তো নষ্ট হয়ই, খেলে নানারকম ঝামেলাও হয়।
খেলে ঝামেলা? কী রকম?
খেলেই তা হজম করানোর ঝামেলা তো আছেই। তার উপরে আবার খাওয়ার ইচ্ছেও জাগে। সবচেয়ে বড় ঝামেলা সেটা। তবে শরীর বহতই বেশরম জানোয়ার হলেও তার একটা মস্ত গুণ হল এই যে, সে নিজেকে খেয়েও বেঁচে থাকতে পারে অনেকদিন। যে গুণ, মনের নেই। মন কেবলি অন্য মনের ফসল খেতে চায়।
ভীমগিরি উঠে দাঁড়ালেন।
বললেন, চলুন দেখিয়ে দিই আপনাকে। এই দোকানের বয়স সত্তর বছরের উপরে। এখন নাতি মালিক। ইমানদার ইনসান সে। এত সস্তাতে এত আড়ম্বরহীন ভেজালহীন খাবার এখানে আর কোথাও পাবেন না।
ভীমগিরি মহারাজ, নদীর সমান্তরালে যে পথটি গেছে দুধারের নানান দোকানের মধ্যে দিয়ে, সেই পথে কিছুটা হেঁটে গিয়ে ডানদিকে একটি ছোট্ট দোকানের সামনে দাঁড়ালেন।
দোকানের সামনেটা হবে বারো থেকে পনেরো ফিট। ভেতরে গভীর। তবে সেই গভীরতা যে কতটা তা পথে দাঁড়িয়ে বোঝা গেল না। ডানদিকে ছোট ছোট গোটা চারেক পেরেক-ওঠা কিন্তু ব্যবহারে ব্যবহারে মসৃণ হয়ে যাওয়া কাঠের সরু বেঞ্চ ও টেবিল। একটি উনিশ কুড়ি বছরের ফর্সা ছোটখাটো হাসিখুশি ছেলে বাঁদিকের খাদ্য-সম্ভারের মধ্যে বসে আছে।
ভীমগিরিকে দেখেই ছেলেটি বলল, জয় রামজি কি!
জয় রামজি কি।
ভীমগিরি বললেন।
যে বামের নাম ইংরেজি শিক্ষিত চারণের এবং চারণের মতন কলকাতার সর্বজ্ঞ মানুষদের কাছে বিন্দুমাত্র তাৎপর্যহীন, এমনকি তাচ্ছিল্য এবং উপহাসের বিষয়, সেই নামটিই যে কত শ্রদ্ধার সঙ্গে এখানে আপামর জনসাধারণ উচ্চারণ করেন, তা দেখে আশ্চর্য হল চারণ।
তাবপর ভাবল, উচ্চারিত হলে আশ্চর্য হওয়ার বা উপহাস করারই বা কি আছে? জ্ঞানের সীমা তো চিরদিনই ছিল, অজ্ঞতারই সীমা ছিল না কোনওদিন। মুসলমানেরা যদি কথায় কথায়, আল্লা বসুলের নাম বলতে পারেন শ্রদ্ধার সঙ্গে, যদি বলতে পারেন ইনসা আল্লা, বলতে পারেন খুদাহ হাফিজ, যদি খ্রিস্টানেরা বলতে পারেন, ওহ লর্ড, গুড গ্রেশাস, বলতে পারেন খ্রিস্টর প্রতি গভীর স্তুতিতে মে গড গিভ উ্য পিস ইত্যাদি তাহলে ভীমগিরি আর এই হালুইকরের নাতি জয় রামজি কি বললে দোষের বা উপহাসের কিছু আছে এমন তত মনে হল না চারণের। ও বুঝতে পারল যে, ও নিজে ধর্ম মানুক আর নাই মানুক ওর দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ ধর্ম মানে। সে ধর্ম হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্ট, শিখ, জৈন, যাই হোক না কেন। নিজ নিজ ধর্ম মেনে তারা যদি খুশি হয়, আনন্দে থাকে, তাহলে সে তার কলকাত্তাইয়া-বুদ্ধিজীবীর মানদণ্ড দিয়ে এঁদের বিচার করার কে? সে এখানে; না এলে হয়তো বুঝতেই পারত না যে, এই কোটি-কোটি মানুষের মান্য ধর্মকে চারপাতা ইংরেজি পড়ে সর্বজ্ঞ হয়ে বাতিল করার আগে তার এই সর্বজনমান্যতার প্রকৃতিকে একজন যুক্তিবাদী হিসেবে যাচাই করা অবশ্যই প্রয়োজন।
ভোজন কিজিয়েগা মহারাজ?ছে
লেটি বলল।
নেহি যুগলপ্রসাদ। ইনকো আচ্ছাসে ভোজন করাও।
বলে, চারণকে ভিতরে এগিয়ে দিয়ে নিজে পেছন পেছন গিয়ে একটি বেঞ্চে তাকে বসিয়ে নিজে উলটোদিকে বসলেন।
যুগলপ্রসাদ নামক ছেলেটি বলল, বলিয়ে বাবু, কেয়া দুই? চাওল ইয়া রোটি?
চারণ বলল, চাওল।
ভীমগিরি বললেন, তুমহারা যো যো চিজ আজ বন চুকে হ্যায়, ঔর আচ্ছা যায়, উও সব দো বাবুকো। ম্যায় চল রহা হ্যায়।
আপনি খাবেন না কিছু? এক গ্লাস দুধ অন্তত খান।
ছেলেটি বলল।
নেহি বেটা। কুছ নেহি। ভগওয়ান তেরা ভালা করে গা।
কোথায় যাবেন এখন?
চারণ শুধোল।
শ্মশানে।
কেন?
সেই সন্নিসীকে মনে আছে আপনার? কাঁধের ওপরে হরিণের ছাল জড়ানো কম্বল নিয়ে এক সন্ধের মুখে এসে পৌঁছেছিলেন গুরুজির আখড়াতে? আমি কালিকমলি বাবার আশ্রমে পৌঁছে দিয়ে এলাম যাঁকে? পদসেবা করলাম…
হ্যাঁ হ্যাঁ। মনে আছে বইকী!
উনকি দেহান্ত হো গ্যয়া।
ইসস।
দুঃখের সঙ্গে বলল, চারণ।
মৃত্যুর মধ্যে দুঃখের কি আছে বাবুজি? আর সেই সন্ত তো তাঁর গুরুর সাধন-ক্ষেত্রে দেহ রাখবার জন্যেই হৃষীকেশে এসেছিলেন। এবং আসার পর অতি স্বল্পদিনের মধ্যেই দেহ রেখেছেন। এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে।
যুগলপ্রসাদ একতলার গভীরের অন্ধকারে চলে গেল চারণের খাবারের তদ্বির করতে। মনে হল ছেলেটির বাসস্থান এটি। একতলাতে খাওয়া-দাওয়া, দোতলাতে থাকা-শোওয়া। তারপরই বুঝল যে ওর বাবা এবং ঠাকুর্দা চটিওয়ালা ছিলেন। যখন পূণ্যার্থীরা পদব্রজে যেতেন সব ধর্মস্থানে, পুণ্য যখন ক্যাপসুলের মধ্যে, প্যাকেজ ট্যুরের মাধ্যমে পণ্যর মতন বিক্রি হত না, তীর্থযাত্রীর সব পুণ্য ছিল তার যাত্রাপথেরই মধ্যে, সাধুসন্ত এবং ভাল-মন্দ মেশানো গৃহী মানুষের সঙ্গে মেলামেশার অভিজ্ঞতারই মধ্যে, তখন এই সব চটিওয়ালারই তাঁদের খাদ্য-পানীয় এবং রাতের আশ্রয় দিতেন।
আমি যাই।
বললেন, ভীমগিরি।
ভীমগিরি বললেন, আমরা আজ সকলে আনন্দ করব। পউরি থেকে নেমে-আসা সেই সন্ত তাঁর প্রয়াত গুরুজির পদপ্রান্তে গিয়ে মিলিত হয়েছেন বলে। মৃত্যু, গৃহীদের দুঃখ দেয়। অজ্ঞদের। জ্ঞানীর কাছে মৃত্যু বলে কিছু নেই। আমাদের গীতাতে আছে আত্মা অবিনশ্বর। আগুন তাকে পোড়াতে পারে না, হাওয়া তাকে শুকোতে পারে না, জল তাকে ভেজাতে পারে না। আত্মার বিনাশ নেই। তার আধারেরই পরিবর্তন হয় শুধু।
চারণের খাবার এসে গেল। কানা-ভোলা একটা পেতলের থালাতে। গরম ধুয়ে-ওঠা ভাত। অড়হরের ডাল। রাইতা। আলুর চোকা। তার মধ্যে আবার দই দেওয়া। মুলো, ফিনফিনে করে কেটে তার স্যালাড। খিচুড়ির সঙ্গে যেমন কড়কড়ে আলুভাজা খায়, তেমন আলুভাজা। পেঠার মিষ্টি তরকারি। চমৎকার। সঙ্গে কটি গরম গরম আটার ফুলকা। দেশি ঘি-এ ভাজা।
কেমন? ভাল?
চমৎকার। চারণ বলল।
মনে মনে বলল, এখানেই এসে খাবে দুবেলা।
ভীমগিরি বললেন, আমি এবারে চললাম।
আপনি নিজে কাল থেকে খাননি আর আমি খাচ্ছি দেখেও খিদে পাচ্ছে না আপনার?
শব্দ করে হাসলেন ভীমগিরি।
বললেন, পাচ্ছে আবার না? খুবই পাচ্ছে।
চারণ বোকার মতন বলল, তাহলে?
তাহলে কি? ওইটাই তো পরীক্ষা।
কিসের পরীক্ষা?
নিজেকে বঞ্চিত করতে পারার পরীক্ষা। এই বঞ্চনার আনন্দ বড় গভীর চারণবাবু। এই আনন্দর কাছে পৃথিবীর তাবৎ সুস্বাদু খাবার খাওয়ার আনন্দও কিছুই নয়।
এই পরীক্ষার পরীক্ষক কে?
আবার হাসলেন, ভীমগিরি। বললেন, আমিই পরীক্ষক, আমিই পরীক্ষার্থী।
তারপরই, উঠে চলে গেলেন।
.
পেট ভরে তৃপ্তি করে খেয়ে উঠল চারণ। আট টাকায় মধ্যাহ্নভোজ!
যুগলপ্রসাদ হেসে বলল, আবার আসবেন বাবু। এই দোকানের বয়স সত্তর বছর। আমার বাবা বলতেন, মুসাফিরদের যত্ন করে খাওয়াবি তাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় পুজো। তোর মন্দিরে যেতে হবে না বেটা। তোর আত্মা এমনিতেই মুক্ত হয়ে যাবে।
বলে, যুগলপ্রসাদ চারণের হাতে এবার মৌরি দিল।
আসব যুগলপ্রসাদ।
বলে, পথে নামল ও।
তারপরই ফিরে, জিগ্যেস করল, শ্মশানটা কোন দিকে?
চন্দ্রভাগাতে। শুখা নদী আছে না?
যে নদী এসে পড়েছে গঙ্গানদীতে?
হ্যাঁ। সেখানে। সোজা চলে যান ভিয়াসির পথে। একটা অটো নিয়ে নেবেন। পথটা যেখানে চন্দ্রভাগার উপরের ব্রিজটা পেরিয়েছে সেখানে অটো ছেড়ে নদীতে নেমে গেলেই হবে। না বুঝতে পারলে, সেখানে কারওকে জিগ্যেস করবেন।
সুক্রিয়া, ভাই।
ভাই শব্দটা বলতে পেরে বড় খুশি হল চারণ। স্বামী বিবেকানন্দের কথা মনে পড়ে গেল। এই ভ্রাতৃত্ব বড় উদ্দীপক ভ্রাতৃত্ব। মুসলমানেরা একেই বলে বিরাদরী। মস্ত বড় গুণ এ তাদের।
বড় রাস্তার দিকে হেঁটে যেতে যেতে চারণ ভাবছিল, ভীমগিরি এবং এখানের আরও কত অগণ্য মানুষ, শিক্ষিত, উচ্চ-শিক্ষিত, এবং অশিক্ষিতও কত সহজ দ্বিধাহীনভাবে বিশ্বাস করে যে, আত্মা অবিনশ্বর। মৃত্যু শুধু পরিবর্তনের। তার আধার পরিবর্তনেরই দ্যোতক।
ভাবছিল যে, বা যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁরা বোধহয় এমনই অনড় পাথরের মতন বিশ্বাসকে বহন করেন। এইসব ব্যাপার তর্কের নয়। এই জন্যেই বোধহয় কথাতে বলে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহু দূর। কিন্তু সত্যিই কি পরজন্ম আছে? পূর্বজন্ম?
চারণের মনে পড়ে গেল যে, জামানেরা একটা বাক্য বলেন প্রায়ই। সেটা একটি জার্মান ADAGE। ওঁরা বলেন WHAT HAPPENS BUT ONCE, MIGHT AS WELL NOT HAVE HAPPENNED AT ALL.
LIVING ONLY ONE LIFE. WE CAN NEITHER COMPARE IT WITH OUR PRIOR LIVES NOR PERFECT IT IN OUR FUTURE LIVES.
সত্যিই কি আমাদের একটামাত্রই জীবন? নাকি পরজন্ম আছে? আমাদের গীতা যা শেখায়, উপনিষদ, বেদ, বেদান্ত, কোরান, হাদিস, এসবই কি মিথ্যে? যে কোটি-কোটি মানুষে মন্দিরে-মসজিদে-গুরদোয়ারাতে মন-প্রাণ নিবেদন করে পুজো করেন, তাঁরা কি সকলেই নির্বুদ্ধি? অজ্ঞ? তাঁদের মধ্যে তো চারণের চেয়ে সবদিক দিয়েই বড় এমন অগণ্য মানুষও আছেন।
তবে?
ঈশ্বরবাবু বলে কি আদৌ কেউ আছেন? নাকি কলকাতার সর্বজ্ঞ আঁতেল চুড়ামণিরাই ঠিক। ওই জার্মান ADAGE টিই ঠিক? EINMAL IST KEINMAL?
মোড় থেকে একটা অটো নিয়ে চারণ যখন ব্রিজের কাছে অটো ছেড়ে দিয়ে নেমে পড়ল তখন দুপুরের আর খুব বেশি বাকি নেই।
ব্রিজ বানানো হচ্ছে নতুন এবং চওড়া। বর্তমানে যে ব্রিজটা আছে তা বহু পুরনো ও সরু। তাছাড়া, বদ্রীনাথ-কেদারনাথের পঞ্চাশ মাইল ওপাশেও ভারতীয় সেনাবাহিনীর পার্বত্য রেজিমেন্ট ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে নেহরু সাহেবের আমলের হিন্দি-চীনি-ভাই-ভাই-এর পিণ্ডি-চটকানো তেলাপোকা-খাওয়া চিনেদের হামলার প্রতিষেধক হিসেবে। আধুনিক সেনাবাহিনীর ভারী ও বড় মেকানাইজড যানবাহন চলাচলের পক্ষে এই রকম ব্রিজ তাই একেবারেই অচল। ভাগীরথীর উপরে দেবপ্রয়াগে বা অলকানন্দার উপরে রুদ্রপ্রয়াগে এবং অন্যত্রও যে সব নতুন সেতু হয়েছে এইসব অঞ্চলে, যার জন্যে এখন গঙ্গার বাঁ পাড়ের চওড়া পিচ রাস্তা বেয়ে কেদারনাথ ও বদ্রীবিশালের পুণ্যার্থীরা বাসে বা গাড়িতে সহজেই প্যাকেজ-ট্যুরে তীর্থ করতে যেতে পারছেন, সেই সব পথও সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়াররাই বানিয়েছেন।
ব্রিজ বানানো একজন মিস্ত্রিকেই শুধোলো চারণ, শ্মশানটা কোথায়? জানেন?
লোকটি স্থানীয় নয় বোধহয়। হাতের কাজ থামিয়ে কিছুক্ষণ চারণের মুখের দিকে চেয়ে থেকেই হঠাৎ বলল, সে তত আপনার বুকের মধ্যেই আছে।
চমকে উঠল চারণ।
এই দেবভূমিতে এসে পৌঁছলে কি সকলেই দার্শনিক অথবা খসসর হয়ে যায়?
ভাবল ও।
লোকটি তারপর ডানহাত প্রসারিত করে দূরে দেখাল।
তার হাতের প্রসার ও হাতটিকে চকিতে ওঠানো দেখে মনে হল যে, সেও হয়তো সেনাবাহিনীরই লোক।
হয়তো।
চারণ শুকনো, দুর্গন্ধ চন্দ্রভাগাতে নামল। পুণ্যতোয়া গঙ্গা, যে-গঙ্গাতে এত সহস্র পুণ্যার্থী, সাধুসন্ত দুবেলা ভক্তিভরে চান করেন, আচমন করেন, সেই গঙ্গারই সঙ্গে মিলিত-হওয়া এই শুকনো চন্দ্রভাগা বহু স্থানীয় মানুষের উন্মুক্ত শৌচাগার যে, একথা ভেবেই বড় খারাপ লাগল চারণের। হিন্দুদের অধিকাংশ ধর্মস্থানই বড় নোংরা। কেন? কে জানে! বালি আর নুড়ির উপর দিয়ে বেশ কিছুটা হেঁটে যাওয়ার পরে হঠাৎ এক দৃশ্যে চোখ পড়াতে ও থেমে গেল। গঙ্গার একাংশের তীর ধরে বহমান এক শোভাযাত্রা চোখে পড়ল। সেই শোভাযাত্রা তখন অনেকই দূরে ছিল। এই শব যাত্রীরা কোথা থেকে আসছেন কে জানে! হয়তো কালিকমলি বাবার আশ্রম থেকেই। একটি রক্তবর্ণ, নতুন কম্বলে জড়ানো শবকে স্কন্ধারূঢ় করে হেঁটে আসছেন শবযাত্রীরা সেনাবাহিনীর SINGLE FORMATION। দীর্ঘ শোভাযাত্রা।
পউরি থেকে, তাঁর গুরুদর্শনে নেমে-আসা শক্তসমর্থ সেই পরবাসী আগন্তক সন্নিসীর হৃষীকেশে যে এত আপনজন ছিল, তা সেই সন্ধেতে তাঁকে কিছুক্ষণের জন্যে দেখে অনুমানও করতে পারেনি চারণ। তাছাড়া, তাঁর গুরুরও তো দেহান্ত হয়ে গেছে বহুদিনই হল। তবুও!
ওর মনে হল, সংসারে যাঁর আপনজন বলতে কেউই নেই, যাঁর পূর্বাশ্রমের পরিচয় যিনি নিজে হাতেই মুছে ফেলেন, রক্তের আত্মীয়দের পরিচয় যাঁর কাছে পুরোপুরি অবলুপ্ত নিজেরই ইচ্ছাতে, সেই নিরুদ্দিষ্টই বোধহয় সবচেয়ে বেশি পরিবৃত থাকেন আত্মার-আত্মীয়দের দ্বারা। অবাক হল নিজ চোখে দেখে, শবকে ওঁরা কোনও চারপাইতে বহন করছেন না। বহন করছেন, কোন শিশুর শবের মতন নিজেদের কোলে কাঁখে। আর সেই কম্বলের ঘোর লাল রং, শিবালিক পর্বতমালার পাদদেশের ঘন অরণ্যানীর গাঢ় সবুজ, গঙ্গার সাদা এবং শুকনো চন্দ্রভাগার ছাইরং-এর পটভূমিতে যেন সেই চলমান শবযাত্রার সঙ্গে আন্দোলিত, বিচ্ছুরিত হচ্ছে। মাথার উপরে পাহাড়ি শঙ্খচিলেরা উড়ছে ঘুরে ঘুরে যেন শব-হয়ে-যাওয়া সম্নিসীর চলমান মাথার উপরে চামর বুলোচ্ছে তারা নরম, আশটে গন্ধ পালকের।
চারণ কিছুটা এগিয়ে গেল ওই শববাহী শোভাযাত্রার দিকে। আশ্চর্য! এত আপনজন মানুষটার কোথায় ছিল! যারা পরকে আপন করে, আপনারে পর তাদের পরম্পরা সম্বন্ধে এক গভীর ঔৎসুক্য জাগছিল ওর মনে। বিলক্ষণ বুঝতে পারছিল যে, গোলমেলে সুকঠিন মামলার নথিপত্র ও যত সহজে বুঝতে পারার বিদ্যা করায়ত্ত করেছিল, এই আপাত-সাধারণ, জীর্ণ-শীর্ণ ভীমগিরি-ধিয়ানগিরিদের অত সহজে আয়ত্ত করার নয়। তাঁরা প্রত্যেকেই এক একটি কুইজ। তাঁদের চাউনি আর হাসির সারাৎসার বুঝতেই তার এক জীবন কেটে যাবে। এই অতি সাধারণ, মাধুকরী করে দিন-গুজরানো, আপাত-ফোর-টোয়েন্টি, আপাত-ভগবান, বৃক্ষছায়ার চাতাল-নিবাসী অথবা নানা নদীর ঘাটবাসী বা গুহা করবাসী, নানা আশ্রমবাসী অগণ্য সাধু-সন্তদের সঠিকভাবে বোঝা সহজকর্ম নয়। অর্থকরী বিদ্যা শিখে, অথোপার্জনের অন্ধ আঁধিতে এতদিন ঘূর্ণিত-চূর্ণিত হয়ে ওর দৃষ্টিই পুরোপুরি আবিল হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের লেখাতে পড়েছিল সহজ হবি, সহজ হবি। আসলে, সহজ হবার মতন কঠিন কাজ সম্ভবত আর দ্বিতীয় নেই।
ভাবছিল, চারণ।
শবযাত্রা আরও এগিয়ে এসেছে। এই ঊষর জনহীন চন্দ্রভাগা নদীর কোন জায়গাতে যে শ্মশানটা অবস্থিত তা সঠিক বুঝতে পারছিল না চারণ। সম্ভবত মোহনার কাছেই হবে। এখন দূরাগত শবযাত্রীদের মুখ-নিঃসৃত মন্ত্রোচ্চারণেরই মতন ওর কানে আসছে রাম নাম সত হ্যায়, রাম নাম সত হ্যায়, রাম নাম সত হ্যায় ধ্বনি, যে ধ্বনি, ভারতের অধিকাংশ স্থানেই শবযাত্রীরা মন্ত্রোচ্চারণেরই মতন উচ্চারণ করে। চারণেরা নিজেরা বাংলাতে বলে বল হরি হরি বল, বল হরি হরি বল।
হরি আর রাম তাহলে কি এক? এই রামায়ণের রাম মানুষটি কি একটি Myth? চারণের কলকাতার আঁতেল-চূড়ামণিরা যেমন বলেন? অথবা, বিভিন্ন দলের মুসলমান-তোষণকারী রাজনীতিকরা?
কারওকেই তোষণ করার বরাবরই বিদ্বেষী চারণ। তিনি যেই হন না কেন। তাঁদের আসল প্রেম তো ভোটের প্রতি। মুসলমানদের জন্যে তাঁরা করেছেনটা কি এতবছর? এখন আর মুসলমানেরা ভারতীয় কোনও দলের অনুগ্রহের প্রত্যাশাতে বসেও নেই।
রাম যে যোধ্যাতে জন্মেছিলেন এমন কোনও প্রমাণ কারও কাছেই নাকি নেই। যিশুখ্রিস্ট যে জন্মেছিলেন জেরুজালেমে সেই প্রমাণ আছে কি কারও কাছে? মহম্মদের জন্মের এবং জন্মস্থানের প্রমাণ? তাই যদি হয়, তবে নিজেরা ভারতবাসী হয়েও, ভারতের সন্তান হয়েও, শুধুমাত্র রামকেই উড়িয়ে দেবার এমন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে কেন ভারতে? আসল কথাটা হচ্ছে এই যে, খুব কম ভারতীয়ই, প্রকৃত ভারতবর্ষকে জানেন, তার অন্তপ্রকৃতিকে উপলব্ধি করেন। শহরবাসী ইংরেজিনবীশরা তো ননই। তাই অনেক সহজ ব্যাপারই তাঁদের কাছে দুর্বোধ্য ঠেকে।
এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার সময় বোধহয় হয়েছে।
সেদিন হরিণের চামড়া গোল করে পাকিয়ে ঘাড়ের উপর নিয়ে, দেবপ্রয়াগ থেকে যে সন্ন্যাসী পদব্রজে নেমে এলেন হৃষীকেশে বাসভাড়া না থাকাতে, তাঁর সঙ্গে এই লালকম্বলে মোড়া শবের কি সম্পর্ক? সেই মানুষটি কতখানি ছিলেন তাঁর জীবন্ত সত্তায় আর কতখানি আছেন তাঁর মৃত সত্তার মধ্যে?
কে চারণকে বলে দেবে এই তত্ত্ব। তবে এটুকু বুঝেছে চারণ যে, বোঝা অত সোজা নয়। সেইসব মানুষদের আপাত-সপ্রতিভ এবং অগভীর ইংরেজিনবিশীই শেষ কথা নয়। অনাদিকাল ধরে যা-কিছু ভারতীয় পরম্পরাতে মানুষে বিশ্বাস করে এসেছে তার সবটাই কিসসুই নয় বলে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার পেছনে অশিক্ষাজনিত হামবড়াই যতটুকু আছে, জিগীষা তার তুলনাতে ছিটেফোঁটাও নেই। কিছু সবজান্তা ভুইফোড়, গুঢ় নিজ-স্বার্থপরায়ণ মানুষে সাম্প্রতিক অতীত থেকে উঠে পড়ে লেগেছেন ঈশ্বর নেই তার প্রমাণ দেবার জন্যে। চারণ, সেইসব প্রগাঢ় পণ্ডিত, খল, ইতর, প্রাইজ ও যশ এবং অর্থ-প্রত্যাশী উদ্বায়ু সমাজতাত্ত্বিক এবং সাহিত্যিকদের মধ্যে কারও কারওকে ব্যক্তিগতভাবেও চেনে। তাঁরা যে প্রণিধানযোগ্য, তা আদৌ নন। কিন্তু ওইসব জীবনের রঙ্গমঞ্চের বালখিল্য অভিনেতারাই চারণকে এমন করে ঘর থেকে বাইরে এনেছে, যেমন এনেছে, তার অর্থপাগল মক্কেলরা। তারা সকলেই তাদের যুথবদ্ধতায়, একদেশদর্শিতাতেই চারণের মধ্যে নিজের চোখ, নিজের বিদ্যা, বুদ্ধি এবং বিচারশক্তি দিয়ে সত্যকে আবিষ্কার করার এক তাগিদ সঞ্চারিত করেছে। কী জানবে, তা ও আদৌ জানে না। তবে অন্ধ ঈশ্বর-বিশ্বাসীদের প্রতি ওর যেমন অনুকম্পা আছে অন্ধ ঈশ্বর-অবিশ্বাসীদের প্রতিও তার চেয়ে কিছু কম অনুকম্পা নেই। দুদলকেই সে অনুকম্পারই সঙ্গে বাতিল করে মুক্ত মনে, মুক্ত চোখে এই দেশের কোটি কোটি মানুষের মনের মর্মস্থলে পৌঁছে গন্ধমাদন পর্বত উথাল-পাথাল করে বিশল্যকরণী খুঁজতে এসেছে।
চারণ, মহাবীরের চেয়ে সামান্য বেশি বুদ্ধি ধরে। গন্ধমাদন পর্বত উপড়ে নিয়ে যাওয়ার মতন মোটাবুদ্ধি তার নয়। সে বিশল্যকরণীই খুঁজে বের করবে এবং যে সব মূর্খর মুখামির এবং ঔদ্ধত্যর কোনও সীমা-পরিসীমা নেই, তাদের মুখামির নাকে সেই বিশল্যকরণী ঘষে দেবে। জ্ঞানের সীমা চিরদিনই ছিল কিন্তু অজ্ঞতার সীমা কোনওদিনই ছিল না। এবং ছিল না বলেই, অজ্ঞ এবং গর্দভ প্রবরেরা অনুক্ষণ এত লম্ফ-ঝম্ম করে।
আবারও মূল ভাবনাতে ফিরে এল চারণ। ওই লালকম্বল মোড়া সন্ন্যাসীর শবের মধ্যে ওই ঘরছাড়া মানুষটি কতটুকু আছেন আর যে জীবন্ত মানুষকে সে সেদিন অর্যমা-লগ্নে ত্রিবেণীঘাটে দেখেছিল তাঁর মধ্যে তিনি কতটুকু ছিলেন, তা জানার এক তীব্র আগ্রহ ওর মধ্যে জাগরূক হয়েছে।
এবারে দাঁড়িয়ে পড়ল চারণ। ভাবল, ও তো সন্ন্যাসী নয়। ও তো ঘোর গৃহী। জয়িতার ভাবনা সে এখনও ভাবে। এতদূরে এসেও মিলি আর তার বাবা হরিচরণবাবুর ছায়া তার এই পরিযানকে গ্রাস করতে সতঃই উদ্যত। তার মুক্তি তত দূরস্থান, মুক্তি-প্রত্যাশাও দূর অস্ত। তার কোনও অধিকারই নেই একজন সন্ন্যাসীর শবযাত্রাতে যোগ দেওয়ার। সেই শবযাত্রাকে সে যে চাক্ষুষ করেছে, এই যথেষ্ট।
মৃতর আত্মার প্রতি তার শ্রদ্ধা জানাল চারণ বহু দুর থেকে নমস্কার করে। এই অভ্যেসটি তার বহুদিনের। কোনও মৃতদেহ দেখলেই সে নমস্কার করে, খ্রিস্টানেরা যেমন আঙুল দিয়ে ক্রশ চিহ্ন দেন নিজের বুকে শব বা কফিন চাক্ষুষ করলেই, মুসলমানেরা যেমন মাথা নোয়ান।
চারণ ফিরে চলল। একটি শেয়ার-অটোতে চড়ে বসল ও। তারপর দেরাদুন রোডের মোড় আর তার পরের মোড়েও না নেমে আরও একটু এগিয়ে কুমার ট্রাভেলস-এর দপ্তরের সামনে নেমে পড়ল।
দোকানে ঢুকতেই মালিক বললেন, লিজিয়ে। কেশার সিংভি মজুদ। যাইয়ে আপ, যাঁহা যানা হ্যায় আপকি।
কেশর সিং বেঞ্চে বসেছিল। সিগারেট খাচ্ছিল। মধ্যমা আর বুড়ো আঙুলের মধ্যে ধরে। সেটা হাতে নিয়েই উঠে দাঁড়াল, বলল, চালিয়ে সাহাব।
চারণ বাইরে এসে সামনের সিটে কেশর সিং-এর পাশে বসল।
যানা কাঁহা হ্যায় সাব?
ভিয়াসি।
সাত বাজে গেট বন্ধ হো যায়েগা পাহাড়পর। ভিয়াসিকি উসপার তো নেহি না যানা?
কাহে?
চারণ শুধালো।
কিউ ক্যা, লওটনা পড়েগী সাত বাজেকি পহিলেই ভিয়াসি।
চারণ বলল, ভিয়াসি পর্যন্ত যাব না। তার আগেই ভোঁদাইবাবা বা গাড্ডুবাবার আশ্রম। সেই অবধি গিয়ে বাবার সঙ্গে দেখা করেই ফিরে আসবে।
তারপর জিগগেস করল, গয়া কভভি?
নেহি সাব। ভোঁদাইবাবা ইয়া গাড্ডুবাবাকি নামভি নেহি শুনা। ঔর ভিয়াসিকি পহিলে কৌ আশ্রমভিত নজারমে আয়া নেহি আজতক। হোনেসে, ট্যুরিস্ট লোগোঁনে কভভি কভি তো জরুর যাতে থে।
চারণ বলল, কুঞ্জাপুরীর কথাই বা কজন ট্যুরিস্ট জানে বাবা?
তারপরে না বলে বলল, সবাই তো প্রাণপণে দৌড়ে গিয়ে কেদারবীর বুড়ি ছুঁয়েই ফিরে যায়। তীর্থ করতে তারা আসে যে কেন! তীর্থ করা কাকে বলে, তা জানার মতো মানসিকতাই তাদের নেই। সর্বক্ষণ কলকল-খলখল করে। বাসের বা গাড়ির জানালার পাশে বসে দুধারে তাকিয়ে, অহো! কী অপূর্ব। কী অপূর্ব! করে। যাদের পূর্বাপর জ্ঞানই নেই তাদের আবার অপূর্ব! হাঃ।
পূর্বাপরের সঙ্গে অপূর্ব শব্দটাকে মনের মধ্যে একই শিলে বাটনা-বেঁটে ভারী মজা পেল চারণ। এই শব্দজব্দর মতো একা একা খেলার মতো বেশি খেলা নেই।
বুদ্ধু সিংকে ডাকতে পাঠাল কেশর সিংকে চারণ, খাড়া চড়াই উঠতে বলে। সেই কালো বড় পাথটার উপরে দাঁড়িয়ে কয়েকবার হাঁকাহাঁকি করার পরেও বুদ্ধু সিং-এর সাড়া পেল না।
কেশর সিং মানুষটির বয়স হবে মধ্য তিরিশ। খুব ছটফটে। হাসিখুশি। পরনে একটি নোংরা পাজামা আর ফুল হাতা শার্ট। সেটাও নোংরা। পকেটে চারমিনারের প্যাকেট আর দেশলাই। খুবই ঘন ঘন সিগারেট খায়। ওর সঙ্গে কথা বলে জেনেছিল চারণ যে, ওর বাবা নেই। মারা গেছেন লাঙ্গ ক্যানসারে। প্রচুর বিড়ি খেতেন নাকি তিনিও।
তারপরও? তুমি?
হাঃ।
হেসে বলেছিল, কেশর সিং।
তারপর বলেছিল, ইয়ে জিন্দেগী ক্যা হামারা বাপকি জমিনদারী হ্যায় সাব? মওত যব আয়েগা তব যানাতে পড়েহি পড়েগা। কাহে আয়েগা? কব আয়েগা? ইয়ে সব ফজুল বাঁতে যো শোচতা হ্যায়, উ বিলকুলই বুদ্ধু হ্যায়। সামুচ বুদ্ধ। যো দিল চাহে করো, ঔর ভগয়ানকো ইয়াদ রাখখো। কোঈভি দুখ নেহি পৌঁছেগা। প্যায়দা যব হুয়া, মরণা ত পড়েহি পড়েগা। মওত কিসিকো ছেড়েগি থোড়ি! উস বারেমে ইতনা শোচনেকি হ্যায় ক্যা?
বুদ্ধু সিংকে যখন ডাকবার জন্যে খাড়া পাহাড়ের চড়াই এর পাকদণ্ডী বেয়ে গান গাইতে গাইতে উঠে গেল কেশর সিং তখন চারণ গাড়ি থেকে নেমে নদীর দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল হু হু হাওয়ার মধ্যে।
ছেলেবেলাতে পড়া প্রাচীন আমেরিকান কবি ওয়াল্ট হুইটম্যানের Leaves of Grass-এর কয়েকটি পংক্তি মনে পড়ে গেল চারণের, পউরি থেকে আসা সন্ন্যাসীর মৃত্যুর প্রেক্ষিতে হঠাৎই।
Great is life…and real and mystical…
Wherever and whenever, great is death…
Sure as life holds all parts together death holds
All parts together;
Sure as the stars return again after they
Merge in the light, death is
great as life.
ভাবছিল চারণ, কী আশ্চর্য! এই গাড়োয়ালী মানুষটি, পেশাতে গাড়িচালক কেশর সিংও হুইটম্যানের মতনই জ্ঞানী। ইংরেজি না জেনে, না পড়েও জ্ঞানী। আসলে জ্ঞান, সম্ভবত মানুষের একধরনের সহজাত সম্পত্তি। একধরনের তরবারির মতন বোধ। এই বৃত্তি বা সম্পত্তিকে যে নিয়ত শাণিত করে, শুধুমাত্র তারই হেপাজতে তা ক্ষুরধার থাকে। এই সহজাত সম্পত্তি অনেকেরই থেকেও না-থাকারই সমান।
কেশর সিং ফিরে এল। বলল, বুদ্ধু সিং বাড়িতে নেই। তার বাবা আছেন। বুদ্ধু সিং চাম্মাতে গেছে তার এক নানার কাছে। আগামীকাল ফিরবে।
চারণ বলল, চল, তাহলে আমরা যাই।
কেশর সিং হাতের সিগারেটটা ফেলে দিয়ে বলল, আশ্রমটা ভিয়াসির কতখানি আগে, জানেন কি?
না। শুনেছি অল্প একটু আগে।
ঠিক আছে। আমি তো কখনওই দেখিনি বা শুনিনি। চলুন।
পাটন কি তার সঙ্গে রসিকতা করল?
ভাবছিল চারণ।
হতেও পারে। হি পুলড আ ফাস্ট ওয়ান অন হিম।
কেশর সিং কথা বলছিল না। পুরোটাই চড়াই। ফার্স্ট গিয়ারে বেশি না দিতে হলেও অধিকাংশ সময়ই গাড়িকে সেকেণ্ড-থার্ডেই চলতে হচ্ছে। গাড়ি ক্রমশ গরমও হচ্ছে। সামনের সিটে বসে আছে বলেই বুঝতে পারছে সে কথা। উপর থেকে আর্মির ট্রাক, জিপ, বাস, প্রাইভেট ট্রাক নামছিল ঘন ঘন। রাত নামলেই যানবাহনের যাতায়াত কমে যাবে। সাধারণ মানুষে রাতের বেলা এই সব দেবভূমিকে, এই ভূমে যাঁদের আবাস তাঁদেরই হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয় হয়তো।
চারণ চুপ করেই ছিল। মনের মধ্যে নানা কথা মাথা তুলছিল। তুলেই, ডুবে যাচ্ছিল। দিশি, বারোমেসে জংলি-হাঁস ড্যাবচিকদেরই মতন। যাদের আরেক নাম, ডুবডুবা।
হঠাৎই কেশর সিং বলল, ভিয়াসি ঔর দো মিল হ্যায় হিয়াসে।
একটু দাঁড় করাও তো গাড়িটা।
গাড়ি দাঁড় করাল সে।
চারণ নেমে দেখল যতদূর চোখ যায় কোথাওই কিছু নেই। জনমানবও নেই।
কেশর সিং বলল, চালিয়ে ভিয়াসি তক চলকে হুয়াই পুছপাছ কিয়া যায়গা।
চারণ বলল, তাই ভাল।
আবার গাড়িতে উঠে বসল দুজনে।
ভিয়াসিতে পৌঁছে দেখল ছোট্ট একটু জায়গা। দুএকটি দোকান-টোকান। কেশর সিং সব দোকানে গিয়েই ভোঁদাই বাবা বা গাড্ডুবাবার আশ্রমের খোঁজ করল। চারণও করল। ইতিমধ্যে দেবপ্রয়াগ থেকে একটি বাস এসে দাঁড়াল ভিয়াসিতে। সেই বাসের ড্রাইভারকন্ডাক্টরের কাছেও খোঁজ করল কেশর সিং। সকলেই একমত হলেন যে, ভিয়াসি আর লছমনঝোলার মধ্যে পথের উপরে ভিয়াসির আগে, ওই নামের কোনও সাধু থাকেন না যে শুধু তাই নয়, গত দশবছরের মধ্যেও কেউই অমন সাধুর নামও শোনেনি এ অঞ্চলে।
বাস ড্রাইভার, মুখে ঠেসে খৈনি মেরে বলল, কোই সাধু-সন্তকি নাম ক্যা ভোঁদাই ইয়া গাড়ু হোনে শকতা? কোঈ জরুর মজাক কিয়া হোগা।
চারণ যেন তার দুকানের পাশে পাটনের অট্টহাস্য শুনতে পেল। কল্পনাতে দেখতে পেল যে, জিনস-পরা পাটন কোমরে হাত দিয়ে ফুলে ফুলে হাসছে দুলে দুলে আর বলছে, কেমন দিলাম স্যার! কেমন দিলাম আপনাকে? দ্য গ্রেট মিস্টার, চারণ চ্যাটার্জিকে?
আভতি করনা ক্যা সাহাব?
কেশর সিং জানতে চাইল।
চারণ বলল, চায়ে পিনা। ঔর ক্যা?
বহত আচ্ছা। সাহী বাত।
বলেই, পায়জামার দুটি পাই, রোগা কিন্তু রোমশ হাঁটুর উপরে তুলে চায়ের দোকানের সামনের চেয়ারে বসে পড়ল ও।
চারণও তার পাশে বসে চা আর পকৌড়ার অর্ডার দিয়ে পাটনের কথাই ভাবছিল। মজাক-ই করেছে যে পাটন তার সঙ্গে, তাতে কোনওই সন্দেহ নেই। পাটন যে হৃষীকেশের কাছাকাছিই কোথাও রয়েছে অথবা হয়তো হৃষীকেশেই, সে সম্বন্ধেও এখন আর ওর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। সে আছেও, মনে হয়, কোনও আশ্রম-টাশ্রমেই। তাকে বুদ্ধ বানাবার জন্যেই হয়তো অমন মিথ্যাচার সে করেছিল। অথবা এও হতে পারে যে, তার গুরুদেবের নাম গোপন রাখবার জন্যেই সে মিথ্যাচার করেছিল। প্রকৃতই যে কেন করেছিল তা শুধু সে নিজেই জানে। তবে চারণকে বুদ্ধু বানালেও চারণ পাটনকে অ্যাপ্রিসিয়েট করল।
দোকানি রেকাবিতে করে পকৌড়া দিল।
চারণ বলল, এক চায়েমে শক্কর ঔর মালাই কমতি দেনা।
জি হাঁ। বলল, দোকানি।
বেলা পড়ে গেছে। একটু পরেই সূর্য হারিয়ে যাবে পশ্চিমের শিবালিক পর্বতমালার আড়ালে। তবে মেঘহীন কলুষহীন আকাশে আলো থাকবে অনেকক্ষণ।
পাটনকে খুঁজে বের করা যায় কি ভাবে, মনে মনে যখন তাই ভাবছিল চারণ, তখনই কেশর সিং বলল, উও ভোঁদাই বাবাকি ইসপিশালিটি ক্যা হ্যায়?
ম্যায় কৈইসি জানু? ম্যায় দিশা থোড়ি।
বিরক্ত ও বিব্রত চারণ বলল।
খ্যয়ের, শুনাতো হোগা জরুর, নেহিত উনকি তালাসমে ইতনা দূর আয়া হি আপনে কাহে?
বাবাকে জানি না। তবে তাঁর এক চেলার কাছেই শুনেছিলাম তাঁর কথা। চেলাকে খুঁজতেই আসা।
কেশব সিং দার্শনিকের মতো বলল, কিতনা কিসিমকি চেলা হোতা হ্যায় ইস দুনিয়ামে। কহতা তো হ্যায় গুরু মিলে লাখ লাখ চেলা মিলে এক মগর ম্যায় বহত চেলাভি দেখা যো চিনি বন গ্যয়ে।
মানে কি হল? চিনি?
অবাক হয়ে বলল, চারণ।
কেশর সিং পকৌড়া মুখে গবগব করে বলে উঠল, অজীব বাত সাব। গুরু গুড়, চেলা চিনি আপ কভভি শুনাহি নেহি?
নেহি তো।
কেশর সিং বলল, গুরু গুড় চেলা চিনি মানে গুরু গুড়ই রয়ে গেলেন আর চেলা চিনি হয়ে বেরিয়ে গেল। মানে, গুরুর চেয়েও সরেস হল আর কী!
চারণ হেসে উঠল, তাকে পাটন বুদ্ধ বানানো সত্ত্বেও।
কেশর সিং বলল, দেবপ্রয়াগে গেছেন আপনি সাহাব?
না। এখনও যাইনি।
বদ্রীনাথের বিগ্রহের যাঁরা বংশানুক্রমে পুরোহিত, সেই রাওয়ালেরা তো ওই দেবপ্রয়াগেই থাকেন শীতের সময়ে, মন্দির বন্ধ হয়ে গেলে। দেবপ্রয়াগেই তাঁদের মূল বাস।
তাই?
হ্যাঁ।
সেখানে এক বাবা আছেন, নাম অনন্তানন্দ বাবা। ঠিক দেবপ্রয়াগ বাজারে থাকেন না তিনি। যেখানে অলকানন্দা আর ভাগীবথীর সঙ্গম তারই উপরে পাহাড়ের এক গুহাতে থাকেন। তাঁর দর্শন পাওয়া সোজা ব্যাপার নয়। যাকে তাকে তিনি দর্শন দেনও না। দূর থেকেই তিনি মানুষ চেনেন। মুখও দেখতে হয় না। গন্ধ পান বাতাসে। তেমন উচ্চকোটির কোনও আগন্তুক এলে তবেই দেখা দেন। নইলে দেখা আদৌ দেন না। তিনশ পয়ষট্টি দিনের মধ্যে তিনশ দিনই মৌনী থাকেন। কত মানুষই যে তাঁর দর্শনলাভের জন্যে যান সেখানে। কিন্তু উনি দু একজনকেই দেখা দেন শুধু। তাও রাতের বেলা।
বলেই বলল, যাবেন আপনি সাহাব?
চারণ বলল, নাঃ।
না শব্দটির মধ্যে একটু বিরক্তিও জড়িয়ে ছিল সম্ভবত। সেটা লক্ষ করেই কেশর সিং বলল, না কেন?
আমি তো মানুষও খুন করিনি, চুরিও করিনি। কোনও বাবা দর্শন করেই বা গো-ব্রাহ্মণ পুজো করেই মুক্তি পাওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই।
ভাল মানুষ যাঁরা, তাঁরা তো আরও ভালও হতে পারেন সজ্জনের কাছে এলে।
হয়তো। ওসব নিয়ে ভাবিনি। তুমি বরং ভোঁদাইবাবা বা গাড্ডুবাবার একটু খোঁজখবর কোরো। হয়তো এখানেই থাকতেন, চলে গেছেন হয়তো এক দুদিন হল এমনও তো হতে পারে।
কেশর সিং হাসল। বলল, শুনলেন তো যে, দশ বছরের মধ্যে ভিয়াসির এদিকে কেউ কোনও বাবার কথা শোনেইনি।
তা ঠিক।
.
পকৌড়া আর চা খেয়ে ওরা যখন গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে হৃষীকেশের দিকে ফিরে চলল তখন সূর্য পশ্চিমের পাহাড়শ্রেণীর ঠিক উপরে দাঁড়িয়ে আছে। দেখল। পাহাড়ের পেছনে ডুবে যাবে আর দুএক মিনিটের মধ্যে।
উতরাইয়ে পথে নামছে গাড়ি এবারে দ্রুত। গাড়ি অবশ্য কেশর সিং গিয়ারেই রেখেছে। দ্রুত আলো কমে আসছে। রাইট-হ্যান্ড-ড্রাইভ গাড়ি। সামনের বাঁদিকের সিটে বসেছিল চারণ। সেদিকেই গভীর গিরিখাতের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা, হৃষীকেশের সমতলের দিকে। ঝরঝর করে হাওয়া আর জলের শব্দ আসছে নীচ থেকে। চলন্ত যানে বসে কখনওই প্রকৃতিকে উপলব্ধি করা যায় না, পাওয়া যায় না তার শব্দ ও গন্ধ, দেখা যায় না তাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে।
চারণ বলল, গাড়ি জারা রোক্কো তো কেশর সিং।
পোরসাব কিজিয়েগা ক্যা?
নেহি নেহি। এ্যাইসেহি রোক্কো।
কেশর সিং এর অত্যাধিক ঔৎসুক্যে বিরক্ত হয়ে বলল চারণ। ভাবল, দোষটা তারই। সকলকেই মাথায় চড়ায় ও। অনেকেই চড়ে পড়ার পর আর নামতে চায় না।
রাস্তা যেখানে যথেষ্ট চওড়া তেমন জায়গা দেখে গাড়িটা বাঁয়ে দাঁড় করাল একটু পরেই কেশর সিং।
দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে লম্বা শ্বাস নিয়ে স্বগতোক্তি করল সে, বাঃ।
কেশর সিং বলল, কুছ বোলে আপ?
নেহি।
আরও বিরক্ত হয়ে বলল, চারণ।
ভাবল, এসব জায়গাতে নিজেই গাড়ি চালিয়ে আসতে হয়। এত কথা বলা, অকারণ কথা অসহ্য। ওর ঘাসফড়িং মনের প্রকৃতি বুঝে চলার মতো মানসিকতাসম্পন্ন সঙ্গী আর কোথায় পাবে। এখন সব মানুষেরই যেন শুধু একটাই ধান্দা। কী করে দুটো পয়সা বেশি পাওয়া যায়। পকেট মারবার জন্যে শিক্ষিত-অশিক্ষিত গরিব বড়লোক সকলেই যেন ধার-দেওয়া ব্লেড পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই যে প্রকৃতির মধ্যে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়া, এটা যেন চুক্তির মধ্যে ছিল না কুমার ট্রাভেলস-এর সঙ্গে, তাই তাদের প্রতিভূ কেশর সিং এত বিরক্ত চারণের এই হঠাৎ-থামাতে।
বিরক্ত তো বিরক্ত! ভাবল, চারণ।
সূর্যটা ডুবছে শিবালিক পর্বতমালার আড়ালে কিন্তু পর্বতমালার ঢেউয়ের পরে ঢেউয়ে লালিমা তখনও লেগে রয়েছে আর সেই লালিমার ছোঁয়া লেগেছে নীচের নদীর জলেও। ভারী শান্তি এখানে। নীচে হাওয়া আর দ্রুতধাবমানা জল যেন ঝরঝরানির শব্দের প্রতিযোগিতাতে নেমেছে একে অন্যের সঙ্গে। যদিও সেই জায়গাতে পর্বতমালা প্রায় উষর, কিন্তু বড় গাছপালা আছে ওপারে। তাড় গাছ দেখা যাচ্ছে কয়েকটি মাথা উঁচোননা। এপারে শুধুই ঝোঁপঝাড়ের সবুজের প্রলেপ। তারা হাওয়ায় হেলছে দুলছে। দুলছে ঘাস, ঘাসফুল, লালটায়েন। নীচের খাড়া নেমে যাওয়া গিরিখন্দ থেকে দিনকে বিদায় জানানোর জন্যে পুরবীতে গলা বেঁধেছে রেড-ওয়াটেন্ড ল্যাপউইগ আর তিতিরেরা, চকোর, বটের আর ব্রেইনফিভার।
নীচের গভীর গিরিখাত দিয়ে বয়েযাওয়া গঙ্গার দিকে চেয়ে, নামতে নামতে হঠাৎই খেয়াল হল যে, জলে যে লালিমার আভা ছিল তা পুরোপুরি মুছে গেছে। কালিমাতে ঢেকে গেছে তখন পর্বতরাজি, নদী। এখন চোখ চলে না আর কোথাওই। এখন শুধু কানে শোনার বেলা। আজ কৃষ্ণা দ্বাদশী। অমাবস্যা সামনেই। দিওয়ালি। তবে শুনেছে, এই দিওয়ালি সিনিবালি। অর্থাৎ, কৃষ্ণা চতুর্দশীর দিনেই পড়েছে দিওয়ালি। চাঁদ যে উঠবে না আজ তা নয়, তবে উঠবে শেষ রাতে। ফালি চাঁদ।
কত বিচিত্র ফুল আর পাতার গন্ধ বয়ে নিয়ে বেগে বইছে গাঢ় অন্ধকারে, ঝরনার মতো অবুঝ হাওয়া। গাছে ঘাসে ফুলে কানাকানি উঠছে সেই হাওয়াতে। তার খসস-খসস ফিস ফিসস শব্দ আসছে কানে। অন্ধকারের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রূপ যেন আরও বেশি করে প্রতিভাত হচ্ছে সেই দ্রুতগতি পার্বত্য হাওয়ার অদৃশ্যমান ব্যক্তিত্বর বিচিত্র গা-শিউরানো শব্দে।
চারণ ভাবছিল, যাঁরা ঈশ্বর দেখতে মন্দিরের অন্দরে, পাহাড়ে কন্দরে যান, তাঁরা তা যান। চারণের ঈশ্বর এমন এমন জায়গাতে এমন এমন মুহূর্তেই দেখা না দিয়েও দেখা দেন চারণকে। অবয়বহীন, প্রত্যক্ষভাবে অনুপস্থিত, কিন্তু অন্তরের অন্তরতমে অন্তরময় অন্তর্যামীর প্রাণস্বরূপ হয়ে।
কেশর সিং হঠাৎই বলে উঠল, কভভি কভি ভাল আ যাতা হ্যায় হিয়া উপ্পরসে উত্বারকে। জানোয়ারসে এলাওয়া ঔর বহত কিসিমকি ডরভি হোতে হ্যায় ইয়ে সব জাগেমে সাহাব, সুরজ অস্ত হো যানে কি বাদহিমে। আইয়ে সাহাব, অব চলা যায়।
ঘোর ভেঙে গেল চারণের। চমকে উঠে অন্ধকারে মুখ ঘোরাতেই দেখল কেশর সিং-এর অনিবাণ সিগারেটের আগুন সেই নিঃসীম অন্ধকারে বাঘের চোখের মতনই জ্বলছে। সাদা অ্যাম্বাসারডাটাও যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে। এমনই নিকষ কালো অন্ধকার। তবে আর একটু পরেই যখন তারারা আকাশময় এক এক করে ফুটে উঠবে, হাস্যময়ী সদ্য-যুবতীর মুখের মতন টলটলে, নীলাভ সবুজাভ কমলাভ দুতিসমৃদ্ধ হয়ে, তখন এই অন্ধকারও আর অন্ধকার থাকবে না হয়তো।
এখন উঠেছে শুধুমাত্র সন্ধ্যাতারা।
কেশর সিং-এর কথায় সায় দিল না ও, কোনও প্রতিবাদও করল না। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে গাড়ির সামনের বাঁদিকের দরজাটা খুলল। খুলতেই, গাড়ির ভিতরের জ্বলে ওঠা আলো সেই অন্ধকারের নিভৃতি আর আশ্লেষকে ছিন্নভিন্ন করে দিল।
আশ্চর্য! গাড়ির ব্যাটারির ওই অতটুকু সামান্য আলোই ছিন্নভিন্ন করল এই আদিগন্ত অসামান্য অন্ধকারকে! মানুষ বড় ছিন্নমতি প্রাণ। বড়ই ছিন্নমতি। ভাবল, চারণ।