১৫. হিলডার সঙ্গে লাঞ্চ

১৫. হিলডার সঙ্গে লাঞ্চ

‘তুমি দেখছি নতুন একটা জুতো কিনেছ,’ পরদিন সোমবার বাসা থেকে বের হতে যাবো, এমন সময় বলল আমার স্ত্রী।

‘না, কিনিনি,’ বললাম আমি। তাকালাম জুতো জোড়ার দিকে। হোথর্ন আমাকে যে-জুতো জোড়া দিয়েছিল, সেগুলোই পরে আছি। এই জুতো দুটোর মালিক আসলে ড্যামিয়েন ক্যুপার।

জুতো জোড়া আসলে বেশ আরামদায়ক, ইটালিয়ান। কিছু না-ভেবেই এগুলো পরে ফেলেছি। ‘ওহ্, এগুলো!’ বিড়বিড় করে বললাম।

আমার স্ত্রী একজন টেলিভিশন প্রডিউসার। ওর খুঁটিনাটি দেখার ক্ষমতা সাংঘাতিক। ইচ্ছা করলেই একজন গোয়েন্দা অথবা গুপ্তচর হতে পারত। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি, জবুথবু হয়ে গেছি। হোথর্নের ব্যাপারে এখনও কিছু বলিনি আমার স্ত্রীকে।

বললাম, ‘এই তো… গত কয়েকদিন হলো পরছি এগুলো। তবে… সব সময় পরি না।

স্ত্রীর সঙ্গে কখনও মিথ্যা কথা বলি না আমি, সে-ও আমার সঙ্গে করে না ওই কাজ। এইমাত্র যা বললাম, সেটা, ব্যাপক অর্থে, সত্যি।

‘তুমি যাচ্ছ কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল সে।

‘হিলডার সঙ্গে লাঞ্চ খেতে।’

হিলডা স্টার্ক আমার সাহিত্য-সংক্রান্ত এজেন্ট। তাকেও হোথর্নের ব্যাপারে কিছু বলিনি।

আর দাঁড়িয়ে থাকলাম না আমার স্ত্রীর সামনে, যত জলদি সম্ভব কেটে পড়লাম।

একজন লেখক এবং তার এজেন্টের মাঝখানের সম্পর্কটা সব সময়ই অদ্ভুত লাগে আমার। এই সম্পর্ক ঠিক বুঝি কি না, সে-ব্যাপারে আমি নিজেও নিশ্চিত না। এজেন্টদেরকে দরকার লেখকদের। এজেন্টরা লেখকদের অনেক কাজ করে দেয়, বিনিময়ে লেখকরা যা আয় করে তার দশ শতাংশ গ্রহণ করে কমিশন হিসেবে। ব্যাপারটা খুবই যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয় আমার। কোনো লেখকের বই যদি খুব বেশি বিক্রি হতে শুরু করে, তা হলে অবশ্য কমিশনের ব্যাপারটা অন্যরকম।

যা-হোক, লাঞ্চের পর ওয়েইটার যখন প্লেট-ডিশ ইত্যাদি পরিষ্কার করছে, তখন হিলডা বলল, ‘আমার একজন ক্লায়েন্টকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, জানেন কি না জানি না।’

‘কে লোকটা?’

‘রেমন্ড ক্লুন্স।

‘মঞ্চনাটকের প্রযোজক?’

মাথা ঝাঁকাল হিলডা। ‘সঙ্গীতধর্মী একটা নাটকের জন্য গত বছর কিছু টাকা জোগাড় করেছিলেন তিনি। নাটকটার নাম ছিল ‘মরোক্কান নাইটস’। আশা করা হয়েছিল বেশ ভালো ব্যবসা করবে ওই নাটক, কিন্তু বাস্তবে ঘটেনি তেমনটা। যারা টাকা দিয়েছিল নাটকটার জন্য, তারা অভিযোগ করেছে, তাদেরকে নাকি ভুল পথে পরিচালিত করা হয়েছে। পুলিশ তাই জালিয়াতি তদন্তের কাজে নেমেছে মিস্টার ক্রুন্সের বিরুদ্ধে।’

তার মানে, মিসেস ক্যুপারের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের পর ব্রুনো ওয়াং যে-গল্প শুনিয়েছিল আমাদেরকে, সেটা সত্যি।

আশ্চর্য হলাম। হিলডা যে মঞ্চনাটকের-প্রযোজকদেরও কাজ করে, জানতাম না। সে-ও কি টাকা বিনিয়োগ করেছিল বিশেষ সেই নাটকের পেছনে? কে জানে! কথাটা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হলো, কিন্তু সাহসে কুলাল না। হিলডাকে যতটা পছন্দ করি, ঠিক ততটা ভয়ও পাই।

যা-হোক, কুন্সের প্রসঙ্গ যখন এসেই গেছে, তার মানে কথা বলার সুযোগ পেয়ে গেছি; এবং সে-সুযোগ কাজে লাগিয়ে বলে ফেললাম, কুন্সের সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার সম্প্রতি… ডায়ানা ক্যুপারের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে। চলে এল হোথর্নের প্রসঙ্গ, জানিয়ে দিলাম ওর হয়ে একটা বই লিখে দিতে রাজি হয়েছি।

ভেবেছিলাম রেগে যাবে হিলডা, কিন্তু সে-রকম কিছু ঘটল না। ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কখনোই রাগারাগি করে না সে। বলল, ‘আপনার কথাটা বুঝলাম না আসলে। বলেছিলেন বাচ্চাদের বই লেখার কাজ থেকে সরে আসবেন আস্তে আস্তে, এবং সে- ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কথাও হয়েছিল আমার। নিজেকে বড়দের বই লেখার কাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন…’

‘এ-বই বড়দের জন্যই! ‘

‘ট্রু ক্রাইম অথবা সত্যিকারের অপরাধ বলতে যা বোঝায়, এ-বই হচ্ছে সে- রকম। কিন্তু আপনি কোনো ট্রু ক্রাইম রাইটার না। তা ছাড়া সবচেয়ে বড় কথা, সত্যিকারের অপরাধের কাহিনি নিয়ে যেসব বই লেখা হয়, সেসবের কাটতি নেই বললেই চলে।’ হাত বাড়িয়ে নিজের ওয়াইনের গ্লাস তুলে নিল হিলডা। ‘আমার মনে হয় না আপনার আইডিয়াটা ভালো। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আপনার হাউস অভ সিল্ক বইটা প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। এবং আপনি জানেন ওই বই কতখানি ভালো লেগেছে আমার। বইটার সিকুয়েল লিখবেন আপনি… এ-রকম একটা ব্যাপারে একমতও হয়েছিলাম আমরা।’

‘লিখবো তো!’

সেক্ষেত্রে ওই সিকুয়েল নিয়েই কাজ করা উচিত ছিল আপনার। লোকে কিন্তু হাউস অভ সিল্কের পরবর্তী কাহিনিই পড়তে চাইবে আপনার লেখায়। কেউ কেন ওই লোকের… কী যেন নাম বললেন তাঁর?’

‘হোথর্ন। ড্যানিয়েল হোথর্ন। তবে নিজের নামের প্রথম অংশটা ব্যবহার করতে চায় না সে।

‘সে একজন গোয়েন্দা?’

‘এককালে তা-ই ছিল।’

‘তার মানে এখন বেকার। অদ্ভুত এক লোকের পেছনে ঘুরছেন… বেকার একজন গোয়েন্দা। ও-রকম কোনো নামই দিয়েছেন নাকি বইটার? …ওই বইয়ের কোনো নাম ঠিক করেছেন?’

‘না।’

চটে উঠল হিলডা, ওয়াইনের গ্লাসটা সশব্দে নামিয়ে রাখল টেবিলের উপর। কেন এই কাজে রাজি হলেন, বুঝতে পারছি না। ওই লোককে কি বিশেষ ভালো লেগে গেছে আপনার?’

‘না।’

‘তা হলে?’

‘লোকটা খুবই চালাক।’

‘তা-ই? এখনও কিন্তু রহস্যের সমাধান করতে পারেনি সে।’

আমাদের মেইন কোর্স নিয়ে ওয়েইটার হাজির হলো এমন সময়। গত কয়েকদিনে যেসব ইন্টারভিউ নিয়েছি আমি আর হোথর্ন, সেগুলোর কিছু কিছু বললাম হিলডাকে।

আমার কথা শেষ হলে সে বলল, ‘এই হোথর্ন লোকটা আসলে কে? ঠিক কোন্ কাজে মজা পায়? মল্টের হুইস্কি খায় নাকি? ক্লাসিক কোনো গাড়ি চালায়? জ্যায বা অপেরা পছন্দ করে? কোনো কুকুর আছে তার?’

‘হোথর্নের ব্যাপারে আসলে তেমন কিছু জানি না আমি। তবে এটা জানি, বিয়ে করেছিল এককালে, এবং এগারো বছর বয়সী একটা ছেলে আছে তার। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সিঁড়ি থেকে কাউকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল খুব সম্ভব। সমকামী পুরুষদের পছন্দ করে না মোটেও… কেন করে না, জানি না।’

‘নিজেও সমকামী নাকি?’

‘না। তবে সে নিজের ব্যাপারে কিছু বলতে ঘৃণা করে। আসলে আমাকে ওর কাছে ঘেঁষতে দিতে চায় না।’

‘তা হলে তার ব্যাপারে লিখবেন কীভাবে?’

‘যদি সে রহস্যটার সমাধান করতে পারে…’

‘কোনো কোনো কেস সমাধান করতে বছরের পর বছর লেগে যায়। আপনি কি আপনার জীবনের বাকিটা সময় ওই লোকের পেছন পেছন লন্ডনের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকবেন? যা-হোক, ওই বই যদি লেখেন শেষপর্যন্ত, পাত্র-পাত্রীদের নাম বদলে দিতে হবে। লোকজনের বাসায় হুটহাট করে ঢুকে পড়ে তাদেরকে নিয়ে বই লিখতে পারেন না আপনি!’ জ্বলন্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে হিলডা। ‘আর… আমাকে নিয়েও যদি কিছু লেখেন ওই বইয়ে, নামটা বদলে দেবেন আমার। আমি অবশ্য চাই না আমাকে নিয়ে কিছু লেখা হোক জঘন্য ওই বইয়ে।’

‘দেখুন, কেসটা কিন্তু ইন্টারেস্টিং,’ বললাম আমি, জোর খাটানোর চেষ্টা করছি আসলে। ‘এবং আমার মনে হয় হোথর্ন একজন ইন্টারেস্টিং মানুষ। দরকার হলে ওর ব্যাপারে আরও কিছু জানার চেষ্টা করবো আমি।’

‘কীভাবে?’

একজন ডিটেক্টিভের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে আমার। তাঁকে দিয়েই শুরু করবো।’ চার্লি মিডোসের কথা ভাবছি। তাকে যদি একটা ড্রিঙ্ক কিনে দিই, তা হলে হয়তো আমার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়ে যাবে।

‘টাকা-পয়সার ব্যাপারে মিস্টার হোথর্নের সঙ্গে কথা হয়েছে আপনার?’ জানতে চাইল হিলডা।

ঠিক এই প্রশ্নেরই ভয় পাচ্ছিলাম। ‘আধাআধির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে…’

‘কী?’ আরেকটু হলে হাত থেকে কাঁটাচামচ ফেলে দিয়েছিল হিলডা। ‘আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? চল্লিশটা উপন্যাস লিখেছেন আজপর্যন্ত। আপনি একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক। আর মিস্টার হোথর্ন একজন বেকার গোয়েন্দা। তাঁর উচিত আপনাকে পারিশ্রমিক হিসেবে টাকা দেয়া, অথচ…। আর বখরার কথা যদি বলেন, তাঁকে তো বিশ শতাংশের বেশি দেয়ার কোনো যুক্তিই দেখি না!’

‘কিন্তু গল্পটা তো ওর!

‘যারই হোক, সে-গল্প লিখছেন আপনি।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল হিলডা। ‘আপনি কি আসলেই এই কাজ চালিয়ে যেতে চান?’

‘পিছিয়ে আসার ব্যাপারে দেরি হয়ে গেছে। যা-হোক, সত্যি বলতে কী, আমি এখনও নিশ্চিত না, কাজটা আসলেই করতে চাই কি না। …ড্যামিয়েন ক্যুপারের ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখেছি নিজের চোখে।’ নিজের স্টেইকের দিকে তাকালাম, নামিয়ে রাখলাম কাঁটাচামচ। ‘আসল কথা হচ্ছে, মিসেস ক্যুপার আর তাঁর ছেলেকে খুন করেছে কে, সেটা জানতে চাই আমি।’

‘ঠিক আছে,’ এমন এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল হিলডা যে, দেখে মনে হলো, যা করতে চলেছি আমি তা কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না, কিন্তু ওই ব্যাপারে কোনো দোষ নেই তার। ‘মিস্টার হোথর্নের নম্বরটা দিন আমাকে। তার সঙ্গে কথা বলবো। একইসঙ্গে আপনাকে সাবধান করে দিয়ে বলতে চাই, আরও দুটো বই লেখার ব্যাপারে আপনি কিন্তু চুক্তিবদ্ধ। এবং সে-বই দুটোর কমপক্ষে একটা উনিশ শতকের উপর ভিত্তি করে লেখার কথা আছে। আর… মিস্টার হোথর্নকে নিয়ে যে-বই লিখতে চলেছেন, আপনার প্রকাশকরা সেটার ব্যাপারে আদৌ আগ্রহী হবেন কি না, আমি নিশ্চিত না।’

লাঞ্চের পর ভিক্টোরিয়ার উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। নিজেকে একজন স্কুলপালানো বালকের মতো মনে হচ্ছে। কেন হঠাৎ করেই সব কিছু গোপন করার চেষ্টা করছি সবার কাছ থেকে? হোথর্নের ব্যাপারে কিছুই বলিনি আমার স্ত্রীকে। আর এখন… চুপিসারে রওয়ানা হয়েছি হোথর্নের সঙ্গে আবারও দেখা করার উদ্দেশ্যে, অথচ হিলডাকেও কিছু বলিনি এই ব্যাপারে। কেঁচোর মতো গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে আমার জীবনে ঢুকে পড়ছে হোথর্ন, এবং এমন এক পদ্ধতিতে কাজটা করছে, যা অবশ্যই অমঙ্গলজনক। সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার, ওর সঙ্গে আবার দেখা করার জন্য মুখিয়ে আছি– এই কেসে কোথাকার জল গড়িয়ে কোনদিকে যাচ্ছে তা জানার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে আছি। কিছুক্ষণ আগে সত্যি কথাটাই বলেছি হিলডাকে… আমি আসলে ফেঁসে গেছি।

ভিক্টোরিয়া জায়গাটা মোটেও ভালো লাগে না আমার। সেখানে বলতে গেলে যাই না কখনও। কেনই বা যাবো? এই জায়গা লন্ডনের অদ্ভুত এক জায়গা… বাকিংহাম প্যালেসের এমন এক প্রান্তে অবস্থিত, যা আমার দৃষ্টিতে ভুল বলে মনে হয়। যতদূর জানি, ওখানে ভালো কোনো রেস্টুরেন্ট নেই, প্রয়োজনীয় কোনো কিছু বিক্রি করা হচ্ছে এমন কোনো দোকান নেই। সিনেমা হল নেই একটাও। তবে দুটো থিয়েটার আছে। ভিক্টোরিয়া স্টেশনটাও এত পুরনো আমলের যে, সেখানে যদি কখনও হাজির হয় বাষ্পচালিত কোনো ট্রেন, আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে বলে মনে হয় না। সে-স্টেশন ছাড়িয়ে যাওয়ামাত্র আমার মনে হয়, একইরকম দেখতে জীর্ণশীর্ণ কতগুলো রাস্তার একটা জংশনে উপস্থিত হয়েছি যেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কর্তৃপক্ষ কিছুসংখ্যক গাইড দাঁড় করিয়ে দিয়েছে স্টেশনের সামনে; তাদের মাথায় থাকে বোলার হ্যাট, ট্যুরিস্টদের বিভিন্ন রকমের উপদেশ দেয় তারা। ওই লোকগুলোর প্রতি কোনো উপদেশ যদি দিতে বলা হয় আমাকে, তা হলে আমি তাদেরকে অন্য কোথাও চলে যেতে বলবো।

অ্যালান গডউইন কাজ করেন এখানেই। একটা প্রতিষ্ঠান চালান তিনি। কনফারেন্সের আয়োজন করে তাঁর সে-প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ীদের জন্য সামাজিক কিছু অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করে। ১৯৬০ সালের একটা বিল্ডিঙের দ্বিতীয় তলায় তাঁর অফিস। ওই ভবনের বেহাল দশা হয়েছে আবহাওয়ার ছোবলে; ওটা দাঁড়িয়ে আছে সরু একটা রাস্তার শেষমাথায়। আকর্ষণহীন কিছু ক্যাফে দিয়ে গিজগিজ করছে রাস্তাটা। অনতিদূরে আছে একটা কোচ স্টেশন

আমি যখন হাজির হলাম সেখানে, তখন বৃষ্টি পড়ছে। আজ সকাল থেকেই মেঘলা ছিল আবহাওয়া। রাস্তার ধারের ফুটপাতগুলোয় জায়গায়-জায়গায় গর্ত আছে; বৃষ্টির পানি জমে গিয়ে সেগুলোতে তৈরি হয়েছে ছোটখাটো ডোবা। কোচ চলছে; রাস্তায় জমে থাকা পানি ছিটকে দিয়ে যাচ্ছে সেগুলো।

হাজির হলাম অ্যালান গডউইনের অফিসে। দরজায় ঝুলছে একটা সাইনবোর্ড: ডিয়ারবয় ইভেন্টস। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম লেখাটার দিকে… কোত্থেকে এল ওটা, ভাবছি। মনে পড়তে বেশি সময় লাগল না। হারল্ড ম্যাকমিলান নামের এক রক্ষণশীল ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ বলেছিলেন কথাটা একবার। তাঁকে তখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, রাজনীতিবিদেরা আসলে কী ভয় পান। জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘ইভেন্সট, ডিয়ার বয়, ইভেন্টস।’

ছোট এবং অসম আকৃতির একটা রিসিপশন রুমে নিয়ে যাওয়া হলো আমাকে।

অ্যালান গডউইনের ব্যবসা কেমন চলছে, তা বুঝতে গোয়েন্দা হতে লাগে না। এই অফিসের আসবাবগুলো দামি, কিন্তু কেমন একটা শীর্ণতার ছাপ সবগুলোতে। ব্যবসাসংক্রান্ত যেসব ম্যাগাজিন ছড়িয়েছিটিয়ে পড়ে আছে একধারের একটা টেবিলের উপর, অনেক আগেই পুরনো হয়ে গেছে সেগুলো। পাত্রে লাগানো গাছগুলো হারিয়েছে সতেজ ভাব। কেমন একটা উদসীনতার ছাপ রিসিপশনিস্টের চেহারায়, এবং সেটা গোপন করার কোনো চেষ্টাই করছে না সে। তার ডেস্কে রাখা টেলিফোনটা বাজছে না। একদিকের একটা ডিসপ্লে শেল্ফে রাখা আছে কিছু পুরস্কার। ওগুলো দেয়া হয়েছে এমন কিছু প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে, যাদের নামই শুনিনি কখনও।

হোথর্ন ইতোমধ্যেই হাজির হয়ে গেছে এখানে, হাবভাবে ধৈর্যহীনতার লক্ষণ নিয়ে বসে আছে একদিকের একটা সোফায়। ওকে দেখে মনে হচ্ছে, অপরাধের প্রতি নেশাগ্রস্ত সে, এবং জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করতে তর সইছে না।

আমাকে দেখামাত্র বলল, ‘দেরি করে ফেলেছেন।’

হাতঘড়ির দিকে তাকালাম। তিনটা বেজে পাঁচ মিনিট। ‘কেমন আছেন?’ জানতে চাইলাম। ‘আপনার উইকএন্ড কেমন কাটল?’

‘ভালো।’

‘কিছু করেছেন এই উইকএন্ডে? কোনো সিনেমা-টিনেমা দেখেছেন?

কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল সে। ‘আপনার কী হয়েছে, বলুন তো?’

‘কিছু না।’ বসে পড়লাম হোথর্নের মুখোমুখি। ‘রেমন্ড কুন্সকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে… জানেন নাকি?’

মাথা ঝাঁকাল হোথর্ন। ‘খবরের কাগজে দেখলাম। পঞ্চাশ হাজার খসিয়েছিলেন তিনি ডায়ানা ক্যুপারের কাছ থেকে; খবরটা জানামাত্র আমার মনে হয়েছিল, ধোঁকাবাজি করেছেন আসলে।’

‘হতে পারে, মিসেস ক্যুপার হয়তো কিছু-একটা জেনে ফেলেছিলেন কুন্সের ব্যাপারে। আর হয়তো সে-কারণেই কুন্স শেষ করে দিয়েছেন ওই মহিলাকে।’

আমার কথা শুনে এমন এক প্রতিক্রিয়া দেখা দিল হোথর্নের চেহারায় যে, মনে হলো, এই চিন্তা ইতোমধ্যেই বাতিল করে দিয়েছে সে। ‘আপনি কি তা-ই ভাবছেন?’

‘ব্যাপারটা সম্ভব।’

রিসিপশন এরিয়ায় হাজির হলো যুবতী এক মেয়ে। জানাল, মিস্টার গডউইন দেখা করতে চান আমাদের সঙ্গে। সংক্ষিপ্ত একটা করিডর ধরে পথ দেখিয়ে আমাদেরকে নিয়ে গেল সে গডউইনের কামরার সামনে। দরজা খুলে বলল, ‘আপনার ভিটিররা চলে এসেছেন, মিস্টার গডউইন।’

ভিতরে ঢুকে পড়লাম আমরা।

দেখামাত্র চিনতে পারলাম অ্যালান গডউইনকে। মিসেস ক্যুপারের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে দেখেছি তাঁকে। তিনিই সেই উসুখুসু চুলের লম্বা লোক, যার হাতে সাদা রঙের রুমাল ছিল। এখন তিনি বসে আছেন একটা ডেস্কের পেছনে, আর তাঁর পেছনে দেখা যাচ্ছে একটা জানালা। তাঁর কাঁধ ছাড়িয়ে দেখতে পাচ্ছি সেই কোচ স্টেশনটা। গোল গলার একটা জার্সির উপর একটা স্পোর্টস জ্যাকেট পরেছেন তিনি। তাকানোর ভঙ্গি দেখে অনুমান করে নিলাম, আমাদেরকে চিনে নিতেও কষ্ট করতে হয়নি তাঁকে। সঙ্গে সঙ্গে চেহারাটা ঝুলে গেল তাঁর।

ডেস্কের এপ্রান্তে দুটো চেয়ার আছে। বসে পড়লাম আমরা।

হোথর্নের দিকে নার্ভাস ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন গডউইন। ‘আপনি পুলিশের অফিসার?’

‘হ্যাঁ… পুলিশের হয়ে কাজ করছি।’

‘আমাকে কি কোনো পরিচয়পত্র দেখাতে পারবেন?’

‘ব্রম্পটন কবরস্থানে কী করছিলেন আপনি?’

জবাব দিলেন না গডউইন।

‘পুলিশ কিন্তু জানে না সেখানে গিয়েছিলেন আপনি,’ বলে চলল হোথৰ্ন, ‘কিন্তু আমি জানি। কথাটা যদি জানিয়ে দিই তাদেরকে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনার সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী হয়ে উঠবে তারা। কাজেই আমার ধারণা, পুলিশের সঙ্গে কথা বলার চেয়ে আমার সঙ্গে কথা বলাটা তুলনামূলকভাবে বেশি সহজ আপনার জন্য।’

দেখে মনে হলো, গডউইন নিজের চেয়ারের ভিতরে ঢুকে গেছেন খানিকটা। ভালোমতো তাকালাম তাঁর দিকে। ব্যর্থতার ভারে আক্রান্ত একজন মানুষ। এবং এই ব্যাপার খেয়াল করে তেমন একটা আশ্চর্য লাগল না আমার। একটা দুর্ঘটনায় দুই ছেলের এক ছেলেকে হারিয়েছেন তিনি। অন্য ছেলেটা মারাত্মক আহত হয়েছে। হয়তো ওই দুর্ঘটনাই তাঁর ব্যর্থতার সূচনা। কারণ ওই ঘটনার পর হারিয়েছেন তিনি নিজের বাড়ি, স্ত্রীর সঙ্গে বলতে গেলে বিচ্ছেদ ঘটে গেছে তাঁর, আর এখন ব্যবসাতেও ভাটা পড়েছে। আমি জানি… মানে, বুঝতে পারছি, হোথর্নের প্রশ্নের জবাব দেবেন তিনি। কারণ প্রতিরোধ বা লড়াইয়ের কোনো চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি না তাঁর ভিতরে।

‘ওই শেষকৃত্যানুষ্ঠানে গিয়ে নিশ্চয়ই কোনো অপরাধ করিনি আমি?’ বললেন তিনি।

‘কেউ একজন মিসেস ক্যুপারের কফিনের ঢাকনা খুলেছিল এবং সেটার ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে একটা মিউযিক বক্স। এই ব্যাপারে কিছু জানা আছে আপনার?’

‘না।’

‘কিন্তু মিউযিক বক্স যে ঢোকানো হয়েছিল, সেটা তো জানেন? বাজনাটা বাজতে শুনেছিলেন নিশ্চয়ই?’

‘হ্যাঁ, অবশ্যই।’

‘ওই বাজনার বিশেষ কোনো অর্থ আছে আপনার কাছে?’

জবাব দেয়ার আগে একটু সময় নিলেন গডউইন। দেখতে পেলাম, তাঁর দুই চোখ যেন পরিণত হয়েছে হতাশার গভীর দুটো গর্তে। ‘টিমোথিকে যখন কবর দেয়া হচ্ছিল, তখন ওই মিউযিক বাজিয়েছিলাম আমরা।’ কণ্ঠ কর্কশ হয়ে গেছে তাঁর। ‘ওটা টিমোথির সবচেয়ে প্রিয় গান ছিল।

দেখে মনে হলো, কথাটা শুনে এমনকী হোথর্নও মানসিকভাবে হোঁচট খেয়েছে। কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না সেটা। আবার শুরু হলো ওর আক্রমণ। ‘মিসেস ক্যুপারের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে কেন গিয়েছিলেন?’ এমনভাবে জানতে চাইল, যেন জবাবটা দাবি করছে। ‘এমন একজন মহিলার শেষকৃত্যে কেন যোগ দিলেন, যাঁকে ঘৃণা করার সবরকমের কারণ ছিল আপনার?

‘কারণ আমি তাকে আসলেই ঘৃণা করতাম!’ দুই গাল লাল হয়ে গেছে গডউইনের। তাঁর ভ্রূ জোড়া কালো আর ঘন, কুঁচকে গেছে ওগুলো, বোঝা যাচ্ছে রেগে গেছেন। ‘ওই মহিলার নির্বুদ্ধিতা আর বেপরোয়া আচরণের কারণেই মারা গেছে আমার আট বছর বয়সী ছেলেটা। আমার আরেক ছেলে… কতই না প্রাণোচ্ছ্বল ছিল সে, হাসাতে পারত সবাইকে… একই কারণে জীবনটা তছনছ হয়ে গেছে তার। চশমা না পরে আমার জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছে ওই মহিলা। তার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে গেছি, কারণ সে যে মারা গেছে, সেটা দেখে ভালো লাগছিল। তাকে যে আসলেই দাফন করা হচ্ছে, সেটা দেখতে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, ওই দৃশ্য দেখতে পেলে আমার দুঃখকষ্টের অবসান হবে।’

‘আপনার দুঃখকষ্টের অবসান হয়েছে?’

‘না।’

‘এবার বলুন ড্যামিয়েন ক্যুপারের মৃত্যুর ব্যাপারে কী জানেন?’

আমার মনে হচ্ছে, হোথর্ন ইচ্ছা করলে টেনিস খেলোয়াড় হতে পারত। যেন সপাটে র‍্যাকেট চালিয়েছে সে… বলটা পাঠিয়ে দিয়েছে নেটের ওপ্রান্তে। ওর উদ্যম আর একাগ্রতা একজন টেনিস খেলোয়াড়ের মতোই।

অবজ্ঞার ভঙ্গিতে হাসলেন গডউইন। ‘মিস্টার হোথর্ন, আপনার কি ধারণা, আমি খুন করেছি ওই লোককে? আর সেজন্যই কি জানতে চেয়েছেন, মিসেস ক্যুপারের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের পর কী করেছি? …ওই অনুষ্ঠানের পর সোজা হাঁটা ধরি আমি… অনেকক্ষণ হেঁটেছি রাস্তায় রাস্তায়… কিং’স রোড ধরে চলে গেছি একেবারে থেমস নদীর পাড়ে। তবে হ্যাঁ, কোনো সাক্ষী নেই… মানে, আমাকে অতটা পথ হাঁটতে দেখেনি কেউ। আমি কোথায় ছিলাম তখন, সেটা আপনাকে বলে দেয়ার মতোও কেউ নেই। কিন্তু… একটা কথা ভেবে দেখুন… আমি কেন কোনো ক্ষতি করতে চাইবো ওই লোকের? সেদিনের সেই দুর্ঘটনার সময় সে তো চালাচ্ছিল না গাড়িটা। সে তখন ছিল তাদের বাসায়।’

‘হয়তো তাকে রক্ষা করার জন্যই তার মা গাড়ি না-থামিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন সেদিন।’

‘যদি কাজটা করেও থাকে ওই মহিলা, নিজের সিদ্ধান্তে করেছে। কাপুরুষের মতো, স্বার্থপরের মতো একটা কাজ করেছে সে, কিন্তু ওই ব্যাপারে তো কিছু করার ছিল না তার ছেলের!

আমি যা ভাবছিলাম, সেটারই যেন বহিঃপ্রকাশ ঘটল গডউইনের কথায়। ডায়ানা ক্যুপারকে খুন করার সব রকমের কারণ থাকতে পারে অ্যালান গডউইনের, কিন্তু নিজের রাগটা ওই মহিলার ছেলের উপর ঝাড়তে যাবেন কেন তিনি?

চুপ করে আছেন গডউইন, চুপ করে আছে হোথর্ন। তাঁদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, এতক্ষণ যেন বক্সিং করছিলেন দু’জন, এবং এইমাত্র একটা রাউন্ড শেষ হয়েছে।

বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না নীরবতা। হোথর্ন বলল, ‘মিসেস ক্যুপারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন আপনি।’

কিছু বলার আগে দ্বিধা করলেন গডউইন। ‘না।’

‘আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলবেন না, মিস্টার গডউইন। আমি জানি আপনি গিয়েছিলেন সেখানে।’

‘কীভাবে জানতে পারলেন?’

‘মিসেস ক্যুপার তাঁর ছেলেকে বলেছিলেন আপনার কথা। আপনাকে দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন তিনি। এবং ড্যামিয়েন ক্যুপারের ভাষ্যমতে, ওই মহিলাকে হুমকি দিয়েছিলেন আপনি।’

‘সে-রকম কিছুই করিনি আমি।’ থামলেন গডউইন, দম নিলেন লম্বা করে। ‘ঠিক আছে, ওই মহিলার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। কথাটা অস্বীকার করার কিছু আছে বলে মনে হয় না। ঘটনাটা তিন কি চার সপ্তাহ আগের

‘তার মানে মিসেস ক্যুপার খুন হওয়ার দুই সপ্তাহ আগের।

‘আমাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছিল জুডিথ, তার সপ্তাহ দু’-এক পরে গিয়েছিলাম মিসেস ক্যুপারের কাছে। ততদিনে আমি আর জুডিথ বুঝে গেছি, আমাদের বৈবাহিক সম্পর্কটা আর টিকিয়ে রাখা যাবে না। আর তখনই গিয়েছিলাম জঘন্য ওই মহিলার কাছে। ভেবেছিলাম, হয়তো সাহায্য করতে পারবে সে। ভেবেছিলাম, হয়তো সাহায্য করতে চাইতেও পারে।’

‘সাহায্য করবেন… আপনাকে? কীভাবে?’

‘টাকা দিয়ে! কেন, আপনি কী ভেবেছিলেন?’ আবারও লম্বা করে দম নিলেন গডউইন। ‘আমার প্রতিষ্ঠানের অবস্থা ভালো না। ব্যবসা বাড়ানোর আর কোনো সুযোগ নেই এখন। সবারই এখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। ওদিকে আমি আর জুডিথ… আমরা দু’জনই শেষ। চব্বিশ বছরের বৈবাহিক জীবন ছিল আমাদের। একদিন হঠাৎ করেই বুঝতে শুরু করলাম আমরা, একই ছাদের নিচে একই ঘরে থাকা আর সম্ভব না আমাদের পক্ষে।’ আঙুলের ইশারায় দেখিয়ে দিলেন ঘরের ছাদটা। ‘উপরতলায় এক বেডরুমের একটা ফ্ল্যাট আছে। এখন সেখানেই থাকি। আমার বয়স পঞ্চান্ন। কখনও বাসায় রান্না করে খাই, কখনও বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসি। এখন এই পর্যায়ে এসে ঠেকেছে আমার জীবন। যা-হোক, ওই বজ্জাত মহিলার সঙ্গে কেন দেখা করতে গিয়েছিলাম, জানেন? এই অফিস… আর কিছু দিন পর এখান থেকে বের করে দেয়া হবে আমাদেরকে। হ্যাঁরো-অন-দ্য-হিলে যে-বাড়ি আছে আমাদের, সেটাও হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল। মর্টগেজের রিপেমেন্ট শোধ করে ওই বাড়ি নিজেদের দখলে রাখাটা আর সম্ভব হচ্ছিল না আমাদের পক্ষে। তারপরও এই ব্যাপারটা গায়ে মাখতাম না, যদি না ওই বাড়ি জেরেমির হতো। ওটা ওর বাসা। সেখানে নিরাপদ বোধ করে সে।’ ক্রোধ স্ফুলিঙ্গের মতো ছিটকে উঠল তাঁর দুই চোখে। ‘ওর কথা ভেবেই নিজের মান-মর্যাদা সব গিলে খেয়েছিলাম সেদিন, দেখা করতে গিয়েছিলাম মিসেস ক্যুপারের সঙ্গে। ভেবেছিলাম, হয়তো সাহায্য পাবো। তার ঠিকানা জানা ছিল আগে থেকেই। পত্রিকা পড়ে জানতে পেরেছিলাম, তার ছেলে একইসঙ্গে নাম আর টাকা কামাই করছে হলিউডে। ভেবেছিলাম, শিষ্টাচার বলে যদি কোনো কিছু থাকে ওই মহিলার ভিতরে, তা হলে যা করেছে তার প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে নিজেকে হয়তো শুধরে নেয়ার চেষ্টা করবে। হয়তো টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করবে আমার পরিবারকে।’

‘সেটা করেছিলেন তিনি?’

‘কী মনে হয় আপনার?’ অবজ্ঞাসূচক চাহনিটা ফিরে এসেছে গডউইনের চেহারায়। ‘বজ্জাত ওই মহিলা আমাকে দেখামাত্র তার বাসার দরজাটা আমার মুখের উপর লাগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। আমি যখন জোর করে ভিতরে ঢুকে পড়লাম, পুলিশে খবর দেয়ার হুমকি দিল।’

‘জোর করে ভিতরে ঢুকে পড়েছিলেন?’ বলল হোথর্ন। ‘মানে কী কথাটার?

‘মানে… তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম, আমার সঙ্গে যাতে কথা বলে সে। হুমকি-ধমকি দিইনি… ও-রকম কিছু করার কোনো ইচ্ছাও ছিল না আমার। হিংস্র কোনো আচরণ করিনি ওই মহিলার সঙ্গে… বিশ্বাস করা না-করা আপনাদের ইচ্ছা। বলতে গেলে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিলাম তার সামনে, আমার কথা শোনার জন্য দশটা মিনিট সময় চেয়েছিলাম তার কাছে।’ একটুখানি থামলেন গডউইন, তারপর আবার বলতে লাগলেন, ‘আমি শুধু কিছু টাকা ধার চেয়েছিলাম ওই মহিলার কাছে। আপনিই বলুন, খুব বেশি কিছু কি চেয়েছিলাম? কিন্তু বজ্জাত মহিলাটা আমার মুখের উপর বলে দিল, তার কাছে নাকি টাকাপয়সা নেই। একটা মানুষ এত নিরুত্তাপ আর নিস্পৃহ হয় কী করে, জানি না। বলল, তার বাড়ি ছেড়ে ওই মুহূর্তে বেরিয়ে যেতে। এবং ঠিক সে-কাজই করেছিলাম আমি। পরে ভীষণ অনুশোচনা হলো আমার… এত বেশি যে, অসুস্থ বোধ করছিলাম… কেন মরতে গিয়েছিলাম ওই বজ্জাত মহিলার কাছে? আসলে মরিয়া না-হলে জীবনেও যেতাম না আমি শয়তানটার বাড়িতে।’

‘আপনি যা-যা বললেন সেসব ঘটনা ওই বাড়ির কোন্ ঘরে ঘটেছিল, মিস্টার গডউইন?’

‘সামনের ঘরে। মানে… লিভিং রুমে। কেন?’

‘তখন ক’টা বাজে?’

‘লাঞ্চের আওয়ার ছিল তখন। তার মানে আনুমানিক বারোটা।

‘অর্থাৎ ঘরের পর্দাগুলো বেঁধে রাখা অবস্থায় ছিল?’

‘হ্যাঁ,’ গডউইনের চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে, হোথর্নের প্রশ্নে হতবুদ্ধি হয়ে গেছেন।

‘মিসেস ক্যুপার যে বাসায় ছিলেন, সেটা জানলেন কী করে?’

‘জানতাম না। স্রেফ গিয়ে হাজির হয়ে গিয়েছিলাম ওখানে। কপালগুণে ওই মহিলাকে পেয়ে গেছি

‘এবং পরে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন মিসেস ক্যুপারের কাছে?’

একটুখানি দ্বিধা করলেন গডউইন। ‘হ্যাঁ।’

পরনের জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল হোথর্ন, বের করে আনল একটা চিঠি… ওটা ওকে দিয়েছিল আন্দ্রিয়া কুভানেক।

গত কয়েক দিনে এত বেশি ঘটনা ঘটেছে যে, এটার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম আমি।

চিঠিটার ভাঁজ খুলল হোথর্ন। আপনার উপর নজর রেখেছি আমি, জানি কোন্ কোন্ জিনিস খুব প্রিয় আপনার কাছে।’

‘ পড়ল। ‘একটু আগে বললেন, আপনি নাকি হুমকি দেননি মিসেস ক্যুপারকে। কিন্তু চিঠির এই অংশটা সাংঘাতিক শাসানিমূলক বলে মনে হচ্ছে আমার।’

‘আসলে রেগে গিয়েছিলাম তখন। তবে… এই কথার মাধ্যমে তেমন কিছু বোঝাতে চাইনি।’

‘কখন পাঠিয়েছিলেন এই চিঠি?’

‘পাঠাইনি। হাতে হাতে দিয়ে এসেছিলাম।’

‘কখন?’

‘ওই মহিলার সঙ্গে দেখা করার সপ্তাহখানেক পরে। সেদিন ছিল শুক্রবার… মাসের ছয় বা সাত তারিখ।’

‘অর্থাৎ মিসেস ক্যুপার মারা যাওয়ার আগের উইকএন্ড!’

‘চিঠিটা দিতে ওই বাড়ির ভিতরে ঢুকিনি আমি। দরজার নিচ দিয়ে ঠেলে দিয়েছিলাম।’

‘মিসেস ক্যুপার কি এই চিঠির কোনো জবাব দিয়েছিলেন?’

‘না। তাঁর পক্ষ থেকে আর কোনো সাড়াশব্দ পাইনি

চিঠিটার দিকে আবার তাকাল হোথর্ন। ‘জানি কোন্ কোন্ জিনিস খুব প্রিয় আপনার কাছে… এই কথার মাধ্যমে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন?’

‘কিছুই বোঝাতে চাইনি!’ ডেস্কের উপর দুম করে একটা কিল বসিয়ে দিলেন গডউইন। ‘কিছু-একটা লেখার দরকার ছিল, তাই লিখেছি ওভাবে। আমার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে ভেবে দেখুন ব্যাপারটা। ওই মহিলার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়াটা ভুল হয়েছে আমার। তাকে চিঠি লেখাটাও ভুল হয়েছে। কিন্তু দেয়ালে যখন পিঠ ঠেকে যায় লোকের, তখন তারা বোকার মতো কিছু কাজ করতে বাধ্য হয়।’

‘একটা বিড়াল ছিল মিসেস ক্যুপারের,’ বলল হোথর্ন। ‘একটা পার্সিয়ান গ্রে। আমার মনে হয় না ওটা দেখেছেন আপনি।’

‘না। কোনো বেজন্মা বিড়াল দেখিনি আমি ওই বাসায়। এবং আপনাকে বলার মতো আর কিছু নেইও আমার। এখনপর্যন্ত নিজের আইডি কার্ডটা আমাকে দেখাননি আপনি। আমি আসলে জানিও না আপনি কে। কাজেই আমি চাই আপনি

এখন চলে যান।

পাশের অফিসে একটা টেলিফোন বেজে উঠল এমন সময়। আমরা এ-বিল্ডিঙে ঢোকার পর এই প্রথম কোনো যান্ত্রিক আওয়াজ শুনতে পেলাম।

‘কিছুক্ষণ আগে বললেন এখান থেকে নাকি বের করে দেয়া হবে আপনাদেরকে,’ বলল হোথর্ন। ‘আর কতদিন সময় আছে আপনার হাতে?’

‘মাস তিনেকের লিয বাজি আছে এখনও।’

উঠে দাঁড়াল হোথর্ন। ‘তা হলে পরে কোথায় পাওয়া যেতে পারে আপনাকে, সেটা জেনে নেবো আমরা।

প্রায় শূন্য অফিসের ভিতর দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে এলাম আমরা। বাইরে তখনও বৃষ্টি হচ্ছে।

রাস্তায় হাজির হওয়ামাত্র একটা সিগারেট ধরাল হোথর্ন। ‘আগামীকাল ক্যান্টেব্রিতে যাবো আমি।’ হঠাৎ করেই বলল সে। ‘আপনি যাবেন?’

‘ক্যান্টেব্রিতে কেন?’

‘নাইজেল ওয়েস্টনের খোঁজ বের করতে পেরেছি।’

সহসা মনে করতে পারলাম না নামটা।

‘নাইজেল ওয়েস্টন… কিউসি… সিনিয়র ব্যারিস্টার,’ আমাকে মনে করিয়ে দিল হোথর্ন। সেই বিচারক, যিনি বেকসুর খালাস দিয়েছিলেন ডায়ানা ক্যুপারকে। আর তারপর… ঠিক করেছি, ডিল-এ ঢুঁ মেরে আসবো একবার। আপনার হয়তো ভালো লাগবে, টনি। সাগরের বাতাস একটুখানি হলেও লাগাতে পারবেন গায়ে।’

‘ঠিক আছে,’ বললাম বটে, কিন্তু লন্ডন ছেড়ে কোথাও যেতে চাইছি না আসলে। প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন সব জায়গায় যেতে হচ্ছে আমাকে, এবং গাইড হিসেবে হোথর্ন যখন সঙ্গে থাকে তখন কেন যেন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারি না।

‘দেখা হবে তা হলে।

আমাদের দু’জনের পথ দু’দিকে… আমরা তাই আলাদা হয়ে গেলাম একজন আরেকজনের থেকে।

হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেছি রাস্তার শেষমাথায়, ঠিক তখনই প্রশ্নটা মনে পড়ে গেল আমার। এটা জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু খেয়াল ছুটে গেছে। অ্যালান গডউইন বলেছেন, মিসেস ক্যুপারের মৃত্যুতে খুশি হয়েছেন তিনি। অথচ শেষকৃত্যানুষ্ঠানের সময় তাঁকে কাঁদতে দেখেছি আমি। একটু পর পর রুমাল দিয়ে চোখ মুছছিলেন তিনি। কেন?

আরেকটা কথা।

গডউইন বলেছেন: চশমা না-পরে আমার জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছে ওই মহিলা।

কিছুক্ষণ আগে বলেছেন তিনি কথাটা। ওই সময়, খেয়াল করেছি, ক্রোধে অর্ধেক-বুজে এসেছিল তাঁর কণ্ঠ। অথচ আরেকজন সাক্ষী… রেমন্ড ক্লুন্স… বলেছেন সম্পূর্ণ আলাদা একটা কথা।

বাসায় ফেরামাত্র নিজের খাতাপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগলাম… বিশেষ কিছু নোট খুঁজছি। ওটা পেতে বেশি সময় লাগল না। এই ব্যাপারটা মিস করেছে হোথৰ্ন… এটা সব সময় আমাদের চোখের সামনেই ছিল, কিন্তু নজর এড়িয়ে গেছে আমাদের দু’জনেরই।

তাকিয়ে আছি বিশেষ সেই নোটের দিকে।

কেন খুন করা হয়েছে মিসেস ক্যুপার এবং তাঁর ছেলেকে, সেটা বোধহয় বুঝতে পেরেছি আমি।

এবং কে করেছে খুন দুটো, তা-ও সম্ভবত জানা হয়ে গেছে আমার। সত্যি বলতে কী, এই ব্যাপারে এখন আর কোনো সন্দেহ নেই আমার মনে।

টের পেলাম, ক্যান্টেব্রিতে যাওয়ার ব্যাপারে উদ্‌গ্রীব হয়ে উঠছি ভিতরে ভিতরে।

কেন যেন মনে হচ্ছে, অন্তত একবারের জন্য হলেও টেক্কা মারতে পারবো এবার হোথর্নের উপর।

১৬. ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর নিডোস

বইয়ের সমাপ্তি ঘনিয়ে এসেছে… অন্তত তা-ই দেখতে পাচ্ছি আমি; উপলব্ধি করতে পারছি, আরও কিছু ব্যাকগ্রাউন্ড দরকার আমার। কাজেই ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মিডোসের সঙ্গে দেখা করার জন্য এটাই উপযুক্ত সময়।

কাজটা শেষপর্যন্ত সহজই হলো আমার জন্য। ফোন করলাম মেট্রোপলিটান পুলিশে, নাম বললাম মিডোসের; সঙ্গে সঙ্গে, আমার ধারণা, তার মোবাইলে ট্রান্সফার করা হলো লাইনটা। যতক্ষণ কথা বলছিলাম তার সঙ্গে, বায়ুচালিত কোনো একজাতের ড্রিলিঙের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম ব্যাকগ্রাউন্ডে।

প্রথমেই নিজের পরিচয় দিলাম লোকটাকে। কেন দেখা করতে চাই, বললাম সেটা। সন্দীহান হয়ে উঠল সে। দেখা না-করার জন্য এটা-সেটা বাহানা দিতে শুরু করল। হয়তো কেটেই দিত লাইনটা, যদি না… সরাসরিই বলি… ঘুষ দিতাম। অর্থাৎ, প্রতি এক ঘণ্টা সময়ের জন্য ৫০ পাউন্ড করে অফার করলাম। আরও বললাম, এমন কোনো পাবে দেখা করতে চাই, যেখানে ড্রিঙ্ক কিনে খাওয়াতে পারবো তাকে! রাজি হয়ে গেল লোকটা, কিন্তু কণ্ঠে তেমন উৎসাহ নেই।

সেদিন বিকেলেই সোহো’র একটা ক্লাবে দেখা হলো আমাদের।

আসতে দশ মিনিট দেরি হয়ে গেল মিডোসের। আমি ততক্ষণে ওই ক্লাবের উপরতলায় নির্জন একটা কোনা বেছে নিয়েছি নিজেদের জন্য। ভদকা মার্টিনির অর্ডার করল সে… আশ্চর্য হলাম কিছুটা। তার বিশাল পাঞ্জায় ত্রিকোণাকৃতির পানপাত্রটা কেমন হাস্যকর দেখাচ্ছে। মাত্র তিন চুমুকে খালি করে ফেলল ওই পাত্র, তারপর অর্ডার করল আরেকটা ড্রিঙ্ক।

মিডোসের জন্য অনেক প্রশ্ন নিয়ে এসেছি আমি, কিন্তু প্রথমে আমার ব্যাপারে এটা-সেটা অনেক কিছু জানতে চাইল সে। হোথর্নের সঙ্গে কী করে পরিচয় হলো আমার? ওর জন্য বই কেন লিখছি আমি? আমাকে কত টাকা দিয়েছে সে?

জবাব দিলাম সবগুলো প্রশ্নের। কিছু বাড়তি কথার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিলাম, হোথর্নের ব্যাপারে সংশয় আছে আমার মনেও, এবং সে আমার বন্ধু না।

কথাটা শুনে হাসল মিডোস। ‘হোথর্নের মতো কোনো মানুষের কোনো বন্ধু থাকার কথা না। এমন অনেক চোর আর ধর্ষণকারীকে পাকড়াও করেছি আমি, যারা হোথর্নের চেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিল।’

‘খুনখারাপি নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছি আমি, কিন্তু হোথর্নের মতো কারও সঙ্গে পরিচয় হয়নি কখনও।’

আবারও হাসল মিডোস। ‘পরিচয় না-হওয়ারই কথা, কারণ হোথর্নের মতো লোক খুব বেশি নেই। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।’

‘আপনি ঠিক কেন অপছন্দ করেন ওকে, বলবেন?’

‘কী মনে হয় আপনার? আমি আসলে তেমন একটা পাত্তা দিই না তাকে। আমার মনে হয়, তার মতো কাউকে… মানে, যারা আসলে পুলিশের লোক না… পুলিশের কোনো কাজে নিয়োগ দেয়া উচিত না।’

‘ঠিক কী ঘটেছিল, জানতে চাই আমি। কেন চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল ওকে?’

‘আপনি যে দেখা করতে এসেছেন আমার সঙ্গে, সেটা কি জানিয়েছেন হোথর্নকে?’

‘না। তবে সে জানে, ওকে নিয়ে লিখছি আমি। কাজটা সে-ই করতে বলেছে আমাকে। এবং আমি ওকে বলেছি, ওর ব্যাপারে যা-যা জানা দরকার, সেগুলো জেনে নেবো যেভাবেই হোক।’

‘তার মানে আপনিও একটু-আধটু গোয়েন্দাগিরি করতে চান আর কী। …মার্ডার স্কোয়াডের ব্যাপারে আপনাকে কিছু বলেছে হোথর্ন?’

‘না, বলেনি। আমি আসলে ওর ব্যাপারে বলতে গেলে কিছুই জানি না। এমনকী সে কোথায় থাকে, তা-ও না।’

‘রিভার কোর্ট, ব্ল্যাকফ্রায়ার্স।’

অর্থাৎ ক্লার্কেনওয়েলে যে-ফ্ল্যাটে থাকি আমি, সেটা থেকে মাত্র এক মাইল দূরে।

‘তবে বাসাটা হোথর্নের নিজের না,’ বলে চলল মিডোস।

‘ঠিকানাটা জানেন?’ জিজ্ঞেস করলাম।

মাথা নাড়ল মিডোস। ‘না।’

‘হোথর্ন আমাকে বলেছিল, গ্র্যান্টস হিলে নাকি…’

‘স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর ওই জায়গা ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে তাকে।’

‘আমিও তা-ই ভেবেছিলাম। ওর স্ত্রীর সঙ্গে কি কখনও দেখা হয়েছে আপনার?’

‘একবার। আমাদের অফিসে এসেছিল। অনেক লম্বা… পাঁচ ফুট এগারোর মতো হবে। ককেশিয়ান।’ এমনভাবে বর্ণনাটা দিল মিডোস যে, শুনে আমার মনে হলো, কোনো একটা কেসের কোনো একজন সন্দেহভাজনের ব্যাপারে বলছে। ‘তবে মহিলা যথেষ্ট সুন্দরী, মাথার চুলগুলো সাদা। বয়সে হোথর্নের চেয়ে কয়েক বছরের ছোট। কিছুটা নার্ভাস প্রকৃতির। সেদিন অফিসে আমার কাছে এসে বলল দেখা করতে চায় হোথর্নের সঙ্গে। তখন তাকে হোথর্নের ডেস্কে নিয়ে গেলাম আমি।’

‘কী নিয়ে কথা হয়েছিল ওদের দু’জনের মধ্যে?’

‘কোনো ধারণা নেই আমার। …হোথর্নের সঙ্গে কেউ মিশত না। আমিও এড়িয়ে চলতাম।’

‘সহকর্মী হিসেবে সে কেমন ছিল?’

‘ভালো না। তার সঙ্গে কাজ করতে পারবেন না আপনি। ২০০৫ সালে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয় সে। অন্য একটা সাব-কমান্ডে ছিল… সাটন আর হেন্ডনে… সেখানে ওরা রাখতে চায়নি তাকে। কেন চায়নি, সেটা হোথর্ন আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়ার কয়েকদিন পরই বুঝতে পারি।’ থামল মিডোস।

অপেক্ষা করছি আমি।

‘কাজ শেষে একসঙ্গে ড্রিঙ্ক করা আমাদের অভ্যাস। আমরা একজন আরেকজনকে সাহায্য করি। কিন্তু হোথর্ন সে-রকম না। সে অন্য কারও সঙ্গে মেলামেশা করতে পছন্দ করে না। এবং সত্যি বলতে কী, এ-রকম কাউকে পছন্দ করে না কেউ। অথচ কাজেকর্মে সে কিন্তু সাংঘাতিক ভালো। যেসব কেস কখন ও সমাধান করা যাবে না বলে ধরেই নিয়েছিলাম আমরা, সেসব কেসে তাক-লাগানো সমাধান করে দেখিয়েছে সে। তার কাজ করার ধরণ সম্পূর্ণ আলাদা… সম্পূর্ণ নিজের মতো। কারও অনুমতির তোয়াক্কা না-করেই কখনও কখনও গায়েব হয়ে যেত অফিস থেকে… কারণ হুট করেই কিছু-একটা মনে পড়ে যেত তার, অথবা কিছু-একটা অনুমান করে ফেলত। কিন্তু যা-ই করত, প্রতিবারই দেখা যেত, ঠিক কাজটাই করেছে। হয়তো সে-কারণেই তার উপর আস্তে আস্তে বিরক্ত হয়ে উঠেছিলাম আমরা সবাই। তার মতো অ্যারেস্ট রেকর্ড নেই আমাদের ডিপার্টমেন্টের কারও।’

‘কিন্তু একটা লোক ভালো কাজ করছে বলেই কি তাকে অপছন্দ করতে হবে?’

‘হ্যাঁ। কারণ সে গোদের উপর বিষফোঁড়ায় পরিণত হয়েছিল আমাদের সবার জন্য। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করত। কাউকে পছন্দ করত না, কারও যুক্তি-পরামর্শ শুনত না। সবচেয়ে বড় কথা, মদ খেত না কখনও। ওই জিনিস না-খাওয়াটা খারাপ কোনো কাজ না, কিন্তু সে-অভ্যাস কোনো কাজেই লাগেনি তার। সন্ধ্যা সাতটা বাজলেই গায়েব হয়ে যেত অফিস থেকে। হয়তো বাসায়, নিজের স্ত্রীর কাছে চলে যেত। কিন্তু অফিসের অনেকেই তখন আড়ালে ফিসফিস করে বলত, অন্য কোথাও নিজের যৌনচাহিদা মেটাতে গেছে। তবে এসব আসলে কোনো ব্যাপার না।’

‘সিঁড়ির ব্যাপারে আমাকে সাবধান থাকতে বলেছিলেন আপনি।’

‘কথাটা আসলে বলা উচিত হয়নি আমার।’ তৃতীয় আরেক রাউন্ড ভদকা মার্টিনি নিল মিডোস। ‘লোকটার নাম ছিল ডেরেক অ্যাবোট। ৬২ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত একজন শিক্ষক, থাকত ব্রেন্টফোর্ডে। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধী বলতে যা বোঝায়, সে ছিল ঠিক সে-রকম। পঞ্চাশটা দেশে অপারেশন চালিয়ে পাকড়াও করা হয়েছিল তাকে। মেইল আর ইন্টারনেটের মাধ্যমে চাইল্ড পর্নোগ্রাফিই ছিল তার কাজ। এই ক্রাইম চেইনের শুরুটা হয় কানাডায়, তিন শ’রও বেশি লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তখন। সন্দেহ করা হয়, যুক্তরাজ্যে মেইন ডিস্ট্রিবিউটরের ভূমিকা পালন করছে অ্যাবোট। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে আসা হয় তাকে। হোথর্ন তখন পাটনিতে কী যেন করছিল। ওই ব্যাপারে আসলে নিশ্চিত না আমি, কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, সে-সময় সেখানে ছিল সে।’

‘তারপর?’

‘কাস্টোডি অফিসে ছিল অ্যাবোট… সেটা ছিল আমাদের অফিস বিল্ডিঙের দ্বিতীয় তলায়। সেখান থেকে বেইযমেন্টে… মানে, ইন্টারভিউ রুমে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তাকে। হোথর্ন তখন স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করতে চায়। সিদ্ধান্ত নেয়, হাতকড়া পরানো অবস্থায় থাকবে অ্যাবোট। অথচ ওই কাজের কোনো দরকার ছিল না। লোকটার বয়স ছিল ষাটের ঘরে। মারামারির কোনো রেকর্ড ছিল না তার যা-হোক, এরপর কী হয়েছিল, আপনি বোধহয় অনুমান করতে পারছেন। বিল্ডিঙের ওই অংশে সেদিন সিসিটিভিও কাজ করছিল না। পরে অ্যাবোট আমাদের কাছে কসম খেয়ে বলেছে, তাকে নাকি ল্যাং মেরেছিল হোথর্ন। অথচ হোথর্ন কথাটা বেমালুম অস্বীকার করে। মাথাটা নিচের দিকে দিয়ে সিঁড়ির চোদ্দটা ধাপ নিচে নেমে যায় অ্যাবোট। পতন ঠেকানোর কোনো উপায়ই ছিল না, কারণ তার দুই হাত পিছমোড়া করে আটকানো ছিল।’

‘ঠিক কী-রকম আহত হয়েছিল লোকটা?’

অনিশ্চিত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকালেন মিডোস। ‘ঘাড়ে ব্যথা পেয়েছিল সাংঘাতিক। শরীরের কয়েকটা হাড়ও ভেঙে গিয়েছিল। সে যদি মারা যেত, জেল খাটতে হতো হোথৰ্নকে।’

আশ্চর্য হলাম না ঘটনাটা শুনে। হোথর্নের ভিতরে প্রচণ্ড রাগ আর অবিচার দেখেছি আমি। যৌন-নিপীড়নকারী কাউকে লাথি মেরে সিঁড়ি থেকে ফেলা দেয়াটা খুবই সম্ভব ওর পক্ষে।

জানতে চাইলাম, ‘পরে কী হয়েছিল অ্যাবোটের?’

‘জানি না। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাকে। কিন্তু তারপর তাকে আর কখনও দেখিনি আমরা।’

প্রসঙ্গ বদল করলাম। ‘একজন ডিটেক্টিভ চিফ ইন্সপেক্টর সব সময় সাহায্য– সহযোগিতা করেন হোথৰ্নকে।’

‘রাদারফোর্ড। তাঁর মনে হোথর্নের জন্য নরম একটা জায়গা আছে। তিনিই এই প্যারালাল ইনভেস্টিগেশনের বুদ্ধিটা ঢুকিয়েছেন পুলিশের বড় কর্তাদের মাথায়। আর তাঁর সেই বুদ্ধির ফলেই হোথর্ন কখনও কখনও কাজ পেয়ে যায়। বিশেষ করে যেসব কেসের সমাধান করতে গিয়ে আমরা… মানে, রেগুলার পুলিশ অফিসাররা গলদঘর্ম হই, সেসব কেসে। … মিসেস ক্যুপারের বাসায় গিয়েছিলেন আপনি! দেখেছেন, কীভাবে সব কিছু রেখে দেয়া হয়েছিল হোথর্নের জন্য। সে সরাসরি রিপোর্ট করে রাদারফোর্ডের কাছে। আসলে এভাবে পুরো সিস্টেমটা পাশ কাটিয়ে… ‘ থেমে গেল মিডোস, বুঝতে পেরেছে যা বলা উচিত না তা বলে ফেলছে। হাতঘড়ি দেখল। ‘আর কিছু?’

‘জানি না। আমাকে বলার মতো আর কিছু কি আছে আপনার?’

‘না। তবে আপনি আমাকে এখন কিছু-একটা বলতে পারেন। হোথর্নের পেছন পেছন তো অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বলুন তো, অ্যালান গডউইন নামের কারও সঙ্গে কি দেখা করেছে সে?’

শীতল একটা অনুভূতি হলো আমার পেটের ভিতরে। কখনও কল্পনাও করিনি, এই কেসে হোথর্নের উপর টেক্কা মারার কাজে আমাকে ব্যবহার করবে মিডোস। মনে হলো, আমার সঙ্গে দেখা করতে যে রাজি হয়েছে লোকটা, এটাই হলো তার আসল কারণ। একইসঙ্গে বুঝতে পারলাম, তাকে কোনো কিছু বলতে পারবো না… বলাটা উচিত হবে না। মিডোস যদি খুনির পরিচয় ফাঁস করে দেয়, ভয়ানক একটা বিপর্যয় ঘটে যাবে। বিশেষ এই কাহিনি নিয়ে কোনো বই লেখা হবে না আমার!

আনুগত্য বা বিশ্বস্ততা যা-ই বলি না কেন, গত কয়েকদিনে হোথর্নের প্রতি সে- রকম কোনো এক আবেগ জন্মেছে আমার মনে। মাত্র দু’জন… তারপরও আমরা একটা দল। মিডোস অথবা অন্য কাউকে না, এই কেস সমাধান করতে হবে আমাকে আর হোথৰ্নকে।

দুর্বল গলায় বললাম, ‘অনেকের সঙ্গেই কথা বলছে হোথর্ন, তবে সবগুলো ইন্টারভিউ’র সময় হাজির থাকি না আমি।

‘কথাটা বিশ্বাস করতে পেরেছি বলে মনে হয় না।’

‘দেখুন… আমি আসলে দুঃখিত। হোথর্ন কী করছে না-করছে সে-ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারি না আমি। একটা চুক্তি হয়েছে আমাদের মধ্যে। ব্যাপারটা গোপনীয়।’

অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে মিডোস। তার সে-দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে, পেনশনভোগী কোনো বুড়ো লোককে যেন পিটিয়েছি আমি। অথবা খুন করেছি কোনো শিশুকে। এই নিয়ে মিডোসের সঙ্গে তিনবার দেখা হলো আমার। প্রতিবারই তাকে ধীরস্থির, লঘুচিত্ত এবং এমনকী আনাড়ি বলে মনে হয়েছে। প্রতিবারই তাকে জ্যাপ বা লেসট্রেড বলে ভেবেছি আমি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, আসলে অবমূল্যায়ন করেছি তাকে। কারণ মিডোসের মতো লোকেরা কখনও কখনও বিপজ্জনকও।

‘অ্যান্টনি, আপনাকে দেখলে কিন্তু মনে হয় না, অনেক কিছু জানেন আপনি। তবে… পুলিশি কর্মকাণ্ডে বাধা দেয়ার শাস্তি সম্পর্কে নিশ্চয়ই জানা আছে আপনার?’

‘হ্যাঁ, আছে।’

‘১৯৯১ সালের পুলিশ অ্যাক্ট অনুযায়ী, পুলিশের কাজে বাধা সৃষ্টি করলে আপনাকে এক হাজার পাউন্ড জরিমানা গুনতে হতে পারে। এমনকী জেলেও যেতে পারেন।’

‘পাগলামি করছেন আপনি।’

ঠিকই বলেছি আমি। কারণ এখন যেখানে আছি আমরা সেটা একটা পাব, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড না। এবং মিডোস আমাকে ধরে আনেনি, আমিই বরং আমন্ত্রণ জানিয়েছি তাকে।

‘আমি শুধু সহজ একটা প্রশ্নের জবাব জানতে চেয়েছি আপনার কাছে,’ কণ্ঠ কিছুটা কোমল হলো মিডোসের।

‘হোথর্নকে জিজ্ঞেস করুন।’

আমার দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা।

আমিও তাকিয়ে আছি তার দিকে। কী করবে সে, বুঝতে পারছি না। কিন্তু হঠাৎ করেই কেমন যেন শিথিল হয়ে গেল।

বলল, ‘একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। আমার ছেলে যখন শুনল আপনার সঙ্গে দেখা করবো আমি, খুবই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল।’

‘তা-ই?’ জিন অ্যান্ড টনিকের অর্ডার করেছিলাম, নিজের গ্লাসে চুমুক দিলাম একটুখানি।

‘হ্যাঁ। সে আবার অ্যালেক্স রাইডারের বড় একজন ভক্ত।’

‘শুনে ভালো লাগল।’

‘সত্যি বলতে কী…’ হঠাৎ করেই লাজুক হয়ে গেছে মিডোস। সঙ্গে করে চামড়ার একটা ব্রিফকেস নিয়ে এসেছে, হাত ঢুকিয়ে দিল সেটার ভিতরে।

কী ঘটতে চলেছে, বুঝে গেছি আমি। বছরের পর বছর ধরে এ-রকম ঘটনা এবং লোকজনের শারীরিক ভাষা দেখে যা বুঝবার বোঝা হয়ে গেছে আমার।

অ্যালেক্স রাইডার সিরিযের তৃতীয় বই ‘স্কেলিটন কী’ বের করল মিডোস। বইটা একেবারে নতুন। তার মানে এই পাবে আসার আগে কোনো একটা বইয়ের- দোকানে থেমেছিল সে।

বলল, ‘অটোগ্রাফ দিতে নিশ্চয়ই আপত্তি নেই আপনার?’

‘না, না, আপত্তি কীসের? বরং ভালোই লাগবে।’ কলম বের করলাম আমি। ‘ওর নাম কী?’

‘ব্রায়ান।’

বইটা খুললাম আমি। প্রথম পাতায় লিখলাম:

ব্রায়ানকে। তোমার বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। আরেকটু হলে আমাকে গ্রেপ্তার করে ফেলেছিলেন তিনি। অনেক শুভকামনা রইল।

স্বাক্ষর করে ফিরিয়ে দিলাম বইটা। ‘আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালো লাগল। সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ।

‘আমার মনে হয় আপনি বলেছিলেন, আপনাকে সময় দিলে কিছু টাকা দেবেন আমাকে।’

‘ওহ্, হ্যাঁ,’ ওয়ালেট বের করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম। ‘পঞ্চাশ পাউন্ড।’

হাতঘড়ি দেখল মিডোস। ‘আসলে… এক ঘণ্টা দশ মিনিট কথা বলেছি আমি আপনার সঙ্গে। আর এখানে আসতে সময় লেগেছে আরও আধ ঘণ্টা।’

এক শ’ পাউন্ড নিয়ে চলে গেল লোকটা।

ড্রিঙ্কের দামও চুকিয়ে দিলাম আমি। ভাবতে লাগলাম, এত কিছুর বিনিময়ে কী পেলাম?

আদৌ কিছু পেয়েছি কি না, তা নিয়ে সন্দেহ হতে লাগল।

১৭. ক্যান্টারি

পরদিন কিং’স ক্রস সেইন্ট প্যানক্র্যাসে যখন দেখা হলো হোথর্নের সঙ্গে, দেখতে পেলাম, খোশমেজাজে আছে সে। ইতোমধ্যেই টিকেট কিনে ফেলেছে। আমাকে শুধু আমার টিকেটের দাম দিতে বলল।

ট্রেনের কামরায় একটা টেবিলের দু’প্রান্তে মুখোমুখি বসে পড়লাম আমরা। আমি কিছু বলতে শুরু করার আগেই হুট করে একটা পেপারপ্যাড, একটা কলম আর একটা পেপারব্যাক বই বের করল হোথর্ন। ওই বইয়ের প্রচ্ছদের দিকে তাকালাম। দ্য আউটসাইডার, লিখেছেন আলবেয়ার কামু। ফরাসি ভাষা থেকে অনুবাদ করা হয়েছে ওটা। সেকেন্ড হ্যান্ড এডিশন, পেঙ্গুইন ক্লাসিক।

খুবই আশ্চর্য হলাম। ট্যাবলয়েড খবরের-কাগজ ছাড়া আর কিছু যে পড়ে হোথর্ন, কখনও মনেই হয়নি আমার। মনে হয়নি, কল্পকাহিনির প্রতি কোনো আগ্রহ থাকতে পারে ওর।

বিরক্ত করতে ইচ্ছা করছে না ওকে। কিন্তু ডায়না ক্যুপার আর তাঁর ছেলের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে যে-সমাধান বের করেছি, সেটা বলার জন্যও নিশপিশ করছে আমার ভিতরটা। মিনিট পনেরো চুপচাপ বসে থাকার পর আর সহ্য করতে পারলাম না। এই সময়ে তিন পৃষ্ঠা পড়ে ফেলেছে সে।

জিজ্ঞেস করলাম, ‘বইটা পড়তে কি ভালো লাগছে আপনার?’

‘কী?’

‘দ্য আউটসাইডার।

‘লাগছে মোটামুটি।

‘তার মানে আধুনিক সাহিত্য ভালো লাগে আপনার।’

হোথর্নের চেহারা দেখে বোঝা গেল, আমার কথায় বিরক্ত হচ্ছে। বলল, ‘এই বই আমি নিজে পছন্দ করিনি।’

‘মানে?’

‘মানে… একটা বইয়ের-গ্রুপের সঙ্গে জড়িত আছি।’

বইয়ের গ্রুপ! তা-ও আবার হোথর্ন!

বললাম, ‘আমার বয়স যখন আঠারো, তখন ওই বইটা পড়েছি। যা-হোক, আসল কথায় আসি। আমার ধারণা, কে খুন করেছে মিসেস ক্যুপার আর তাঁর ছেলেকে, সেটা বুঝে ফেলেছি আমি।’

চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল হোথর্ন। একরকমের চ্যালেঞ্জ খেলা করছে ওর দৃষ্টিতে। ‘কে?’

‘অ্যালান গডউইন।’

মাথা ঝাঁকাল হোথর্ন, তবে সেটা সম্মতি জানানোর কায়দায় না। ‘ডায়ানা ক্যুপারকে খুন করার যথোপযুক্ত কারণ আছে ওই লোকের, কিন্তু আমরা যখন শেষকৃত্যানুষ্ঠানে ছিলাম, তখন তিনিও ছিলেন সেখানে। লন্ডনের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্ত পাড়ি দিয়ে ড্যামিয়েনের ফ্ল্যাটে অত জলদি গেলেন কী করে তিনি?’

‘আমার ধারণা, বিশেষ সেই মিউযিক বাজতে শুরু করামাত্র কবরস্থান ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন তিনি। তা না-হলে আপনিই বলুন, আর কে ওই এমপি থ্রি প্লেয়ারটা রাখতে যাবে কফিনের ভিতরে? আমাদেরকে যা বলেছেন গডউইন, শুনেছেন আপনি। বলেছেন, গানটা নাকি তাঁর ছেলের প্রিয় গান ছিল।’ আমাকে হোথর্ন থামিয়ে দেয়ার আগেই বলে চললাম, ‘ডায়ানা ক্যুপারকে খুন করার কোনো কারণ নেই অন্য কারও। কেন, আপনি কি দোষ চাপাতে চান ওই ক্লিনার মেয়েটার উপর… কারণ সে টাকা চুরি করেছে মিসেস ক্যুপারের বাড়ি থেকে? নাকি দোষী সাব্যস্ত করতে চান রেমন্ড কুলকে… কারণ তিনি কিছু টাকা খসিয়ে নিয়েছিলেন মিসেস ক্যুপারের কাছ থেকে? কী হলো… চুপ করে আছেন কেন? এই ব্যাপারটা নিয়ে এখনও তর্কাতর্কি করছি আমরা… আশ্চর্য লাগছে আমার কাছে।’

‘আমি কোনো তর্ক করছি না,’ বলল হোথর্ন, শান্ত আছে এখনও। যা বলেছি আমি তা ভাবল কিছুক্ষণ, তারপর কেমন দুঃখিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। ‘দুর্ঘটনাটা যখন যখন ঘটল, মানে.. মিসেস ক্যুপারের গাড়ির নিচে যখন চাপা পড়ল মিস্টার গডউইনের ছেলে দুটো, ড্যামিয়েন তখন নিজেদের বাসায়। ওই দুর্ঘটনার ব্যাপারে কিছুই করার ছিল না তার। কাজেই তাকে কেন খুন করবে গডউইন?’

‘আমার মনে হয় এই প্রশ্নের জবাবও বের করে ফেলেছি আমি। মনে করুন গাড়িটা আসলে ডায়ানা ক্যুপার চালাচ্ছিলেন না। খেয়াল করে দেখুন, মেরি ও’ব্রায়ান কিন্তু ঠিকমতো দেখতে পায়নি মিসেস ক্যুপারের চেহারা। গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেখেই কিন্তু শেষপর্যন্ত ধরা গেছে ওই মহিলাকে।’

‘তিনি কিন্তু শেষপর্যন্ত গিয়ে হাজির হয়েছিলেন পুলিশ স্টেশনে। ধরা দিয়েছিলেন পুলিশের কাছে।’

‘কাজটা তিনি ড্যামিয়েনকে রক্ষা করার জন্যও করে থাকতে পারেন। … আমার কথা হচ্ছে, যদি বলি গাড়িটা আসলে ড্যামিয়েনই চালাচ্ছিল, তা হলে?’ কথাটা যত ভাবছি, সম্ভাবনাটা ততই প্রকট বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে। ‘ড্যামিয়েন, মিসেস ক্যুপারের ছেলে। যে-সময়ে ঘটেছে দুর্ঘটনাটা, সে-সময়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল সে। হতে পারে… মাত্রাতিরিক্ত মদ খেয়ে মাতাল অবস্থায় ছিল তখন। আবার এমনও হতে পারে, কোকেনের মাত্রাতিরিক্ত ডোজ নিয়ে ফেলেছিল। যে-কোনো কিছু হতে পারে আসলে। মিসেস ক্যুপার জানতেন, এসব কথা যদি জানাজানি হয়… যদি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয় ড্যামিয়েন, তার ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যাবে। আর তাই ওই দুর্ঘটনার দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তিনি। সেজন্যই ভুলে-চশমা- ফেলে-যাওয়ার বানোয়াট গল্পটা বানিয়েছিলেন। এই গল্প বানানোর বিশেষ একটা উদ্দেশ্যও ছিল তাঁর… নিজে যাতে না-ফেঁসে যান আইনের চোখে।’

‘এসব আপনার অনুমান… এসবের পক্ষে উপস্থাপন করার মতো কোনো প্রমাণ নেই আপনার হাতে।

‘সত্যি বলতে কী… আছে।’ এতক্ষণে আমার টেক্কাটা চালোম। ‘আপনি যখন রেমন্ড কুন্সের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তিনি তখন বলেছিলেন, যেদিন লাঞ্চ করেছিলেন মিসেস ক্যুপারের সঙ্গে… মানে যেদিন খুন হয়েছেন ওই মহিলা… সেদিন তিনি মিসেস ক্যুপারকে টিউব স্টেশন থেকে বের হয়ে আসতে দেখেছেন। আমাকে দেখে হাত নেড়েছিল সে… ঠিক এই কথাটাই বলেছিলেন মিস্টার কুন্স। এখন একটা কথা চিন্তা করে দেখুন। মিস্টার কুন্সকে রাস্তার ওপ্রান্তে দেখে যদি হাত নেড়ে থাকতে পারেন মিসেস ক্যুপার, তার মানে ওই মহিলার দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিল। যাঁর দৃষ্টিশক্তি আজ থেকে কিছু দিন আগে স্বাভাবিক থাকতে পারে, তাঁর সে-শক্তি বছর দশেক আগে কীভাবে খারাপ হবে? অর্থাৎ ওই দুর্ঘটনার পরে পুলিশের কাছে বানিয়ে কথা বলেছেন মিসেস ক্যুপার।’

বিরল একজাতের হাসি দেখা গেল হোথর্নের ঠোঁটের কোনায়। তবে পরমুহূর্তেই মিলিয়ে গেল সেটা। ‘হুঁ… দেখা যাচ্ছে এই কেসে বেশ মনোযোগ দিতে শুরু করেছেন আপনি।’

‘বুঝলাম, কিছু একটা বলতে চান আপনি,’ ক্লান্ত গলায় বললাম। ‘শুনছি।’

‘ওই টিউব স্টেশন থেকে যখন বের হয়ে এসেছিলেন মিসেস ক্যুপার, তখন যে চশমা ছিল না তাঁর চোখে, কে বলল আপনাকে? এ-রকম কি হতে পারে না, তখন চশমা পরে ছিলেন তিনি?’ হোথর্নকে দেখে মনে হচ্ছে আমার কথায় দুঃখ পেয়েছে যেন। আবার এমনও হতে পারে, আমার যুক্তি খণ্ডন করতে গিয়ে কষ্ট পাচ্ছে মনে। ‘মিসেস ক্যুপার চশমা পরে ছিলেন কি না, সে-ব্যাপারে কিন্তু কিছুই বলেননি মিস্টার ক্লন্স। আরেকটা কথা। আপনি বলেছেন, সেদিনের সেই দুর্ঘটনার সময় মিসেস ক্যুপার নাকি গাড়ি চালাচ্ছিলেন না। সেক্ষেত্রে ওই ঘটনার পর গাড়ি চালানো ছেড়ে দিলেন কেন তিনি? কেন বাড়ি বদল করে চলে এলেন অন্য এক জায়গায়? ওই ঘটনার ব্যাপারে যে-ক’জনের সঙ্গে কথা বলেছি, মোটামুটি সবাই বলেছে, ঘটনাটার পর আপসেট হয়ে পড়েছিলেন মিসেস ক্যুপার… যেন এমন কোনো অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন, যা আসলে করেননি তিনি।’

‘হ্যাঁ… ড্যামিয়েন যদি ঘটিয়ে থাকে দুর্ঘটনাটা, তা হলেও আপসেট হয়ে থাকতে পারেন মিসেস ক্যুপার। আমি বলবো, ওই মহিলা ছিলেন ওই ঘটনার… অন্যভাবে যদি বলি, ওই অপরাধের সহযোগী। …কীভাবে জানি না, কিন্তু যে- কোনোভাবেই হোক না কেন, অ্যালান গডউইন জেনে গিয়েছিল সত্যি কথাটা। আর সে-কারণেই তিনি সুযোগ পাওয়ামাত্র খুন করেছেন মিসেস ক্যুপার আর তাঁর ছেলেকে। কারণ ওই দুর্ঘটনার জন্য ওই দু’জনই দায়ী।’

আমরা যে-ট্রেনে সওয়ার হয়েছি, সেটার গতি বেড়েছে। পূর্ব লন্ডন ছাড়িয়ে এগিয়ে চলেছি, আস্তে আস্তে কমে আসছে দালানকোঠার সংখ্যা। শ্যামলিমার দেখা মিলছে এখন। সামনে দেখতে পাচ্ছি কিছু খোলা জায়গাও।

‘আপনার থিউরি মনঃপুত হলো না আমার,’ বলল হোথর্ন। ‘ওই দুর্ঘটনার পর মিসেস ক্যুপারের দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষা করার কথা পুলিশের। আরেকটা কথা।

‘কী?’

অনিশ্চিত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল হোথর্ন… ভাবখানা এমন, এই কথোপকথন আর চালিয়ে যেতে চাইছে না। কিন্তু তারপর, সম্ভবত, আমার উপর করুণা হলো ওর। ‘আন্ডারটেকার… মানে, মিস্টার কর্নওয়ালিসের কাছে যখন গিয়েছিলেন মিসেস ক্যুপার, তখন ঠিক কী খেলা করছিল তাঁর মনে? এবং ওই ফিউনারেল পার্লারে গিয়ে সবার প্রথমে ঠিক কোন্ জিনিসটা দেখেছিলেন তিনি?’

‘আপনিই বলুন।

‘আমার বলার দরকার নেই, মেইট। এই উপন্যাসের প্রথম চ্যাপ্টারটা যাচ্ছেতাইভাবে লিখে আমাকে দেখিয়েছিলেন আপনি একবার… মনে আছে? আমার প্রশ্নের জবাবটা সেখানে লিখে দিয়েছিলেন আপনি। যা-হোক, আমার মনে হয় যা দেখেছিলেন মিসেস ক্যুপার, সেটা এই কেসে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।’

ভাবতে লাগলাম আমি। ওই ফিউনারেল পার্লারে গিয়ে সবার প্রথমে ঠিক কোন্ জিনিসটা দেখেছিলেন মিসেস ক্যুপার?

ওই মহিলার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে চিন্তা করার চেষ্টা করলাম ব্যাপারটা।

বাস থেকে নামলেন তিনি। হাঁটতে লাগলেন ফুটপাত ধরে। হ্যাঁ… ফিউনারেল পার্লারের নামটাই সবার আগে দেখেছিলেন তিনি… কর্নওয়ালিস অ্যান্ড সন্স। অথবা… অফিসের ঘড়িটা দেখেছিলেন তিনি… তখন সে-ঘড়িতে দুপুর বারোটা বাজতে এক মিনিট বাকি আছে। কিন্তু… এই কেসের সঙ্গে ওই ফিউনারেল পার্লারের নাম অথবা ওই ঘড়ির সম্পর্ক কী? ও… ওই পার্লারের একটা জানালার গোবরাটে মার্বেল দিয়ে একটা বই বানানো ছিল… যে-কোনো আন্ডারটেকারের অফিসেই দেখা যায় ও-রকম কোনো-না-কোনো জিনিস… কিন্তু এসব দেখলে কি বিশেষ কোনো কিছু খেলা করার কথা মিসেস ক্যুপারের মনে? হোথর্ন আমাকে বলেছে, মিসেস ক্যুপার নাকি জানতেন, আজ বাদে কাল মারা যাচ্ছেন তিনি। কেউ একজন হুমকি দিয়েছিল তাঁকে কিন্তু তিনি পুলিশের কাছে যাননি। কেন?

হঠাৎ করেই টের পেলাম, রেগে যাচ্ছি আমি।

‘ঈশ্বরের দোহাই লাগে, হোথর্ন,’ বলে উঠলোম, ‘আমার নাকে দড়ি দিয়ে অর্ধেকটা ইংল্যান্ড ঘুরিয়েছেন আমাকে। কাজেই আমরা আসলে কী করছি, অন্তত সেটা তো বলতে পারেন… নাকি?’

‘সেটা ইতোমধ্যেই বলেছি আপনাকে। জাজ নাইজেল ওয়েস্টনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। তারপর যাবো যেখানে-দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল সেখানে।’

‘তার মানে আপনি ভাবছেন ওই দুর্ঘটনার সঙ্গে এই কেসের সম্পর্ক আছে।’

হাসল হোথর্ন। জানালার কাঁচে ওর চেহারার প্রতিবিম্ব দেখতে পেলাম। ‘দিনশেষে যখন আপনাকে আপনার কাজের জন্য টাকা দেয়া হবে, তখন সব কিছুর সঙ্গে সব কিছুরই কোনো-না-কোনো সম্পর্ক আছে।’

বইয়ে মনোযোগ দিল সে, আর কোনো কথা বলল না।

.

নাইজেল ওয়েস্টন, মানে যে-জাজ দ্য ক্রাউন বনাম ডায়ানা ক্যুপারের কেসটা পরিচালনা করেছিলেন এবং পক্ষপাত দেখিয়েছিলেন দ্বিতীয় পক্ষের প্রতি, থাকেন কেন্টাব্রি’র একেবারে কেন্দ্রস্থলে। তাঁর বাসস্থানের একপাশে আছে একটা গির্জা, আরেক পাশে আছে সেইন্ট অগাস্টিন’স কলেজ। সে-বাসস্থান দেখলে মনে হবে, সারাটা জীবন আইন নিয়ে কাজ করার পরও নিজেকে ঘিরে রাখার জন্য ইতিহাস আর ধর্ম বেছে নিয়েছেন তিনি। কারণ আমাদের চারপাশে এখন প্রাচীন সব দেয়াল আর চূড়া, সেইসঙ্গে পথেঘাটে বাইসাইকেলে সওয়ার হয়ে চলেছেন মিশনারিরা। তাঁর বাড়িটা কেমন চারকোনা, নিরেট, দেখলে মনে হয় সব কিছু বানানো হয়েছে সমান অনুপাতে। যতদূর চোখ যায়, শুধু সবুজ আর সবুজ। জায়গাটা আরামদায়ক, এই শহর আরামদায়ক, এবং চারদিক দেখলে মনে হয় নাইজেল ওয়েস্টন আরামদায়ক একটা জীবন যাপন করছেন।

তাঁর সঙ্গে এগারোটার সময় দেখা করার ব্যাপারটা চূড়ান্ত করেছে হোথৰ্ন। ট্যাক্সি থেকে নেমে ড্রাইভারকে টাকা দিচ্ছি, এমন সময় খেয়াল করলাম আমাদের জন্য সদর দরজায় অপেক্ষা করছেন ওয়েস্টন। তাঁকে দেখলে যতটা না একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যারিস্টার বলে মনে হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি মনে হয় একজন সুরকার… সুর-পরিচালকও বলা যেতে পারে সম্ভবত। হালকাঁপাতলা শরীর তাঁর, কেমন রোগাটে বলে মনে হয়। আঙুলগুলো লম্বা লম্বা, মাথায় রূপালি চুল। চোখে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি। বয়স সত্তরের ঘরে। দেখলে মনে হয়, বয়সের ভারে কুঁচকে যাচ্ছেন। ভারী একটা নিট-কার্ডিগান এবং মোটা সুতি কাপড়ের ফুল প্যান্ট পরে আছেন। মনে হচ্ছে ওগুলোর ভিতরে যেন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন। শু পরেননি, বরং স্লিপার পরেছেন। চোখ দুটো গর্তে বসে গেছে। গভীর মনোযোগে তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে। কণ্ঠার হাড় দুটো দেখলে কেমন অনমনীয় বলে মনে হয় তাঁকে।

‘আসুন, ভিতরে আসুন। আশা করি আপনাদের যাত্রা সুখকর হয়েছে। এত সদয় আর অমায়িক আচরণ করছেন কেন তিনি, ভাবলাম। আমার ধারণা, কেন এসেছি আমরা এখানে, সেটা তাঁকে জানায়নি হোথর্ন।

পুরু কার্পেট, অ্যান্টিক আসবাব আর দামি আর্টে ঠাসা একটা হলওয়ে ধরে তাঁর পিছন পিছন এগিয়ে চলেছি আমরা দু’জন। এরিজ জিল নামের একজন ডিযাইনারের একটা ড্রয়িং চিনতে পারলাম আমি। এরিক র‍্যাভিলিয়াস নামের এক চিত্রশিল্পীর একটা জলরঙও চোখে পড়ল। দুটোই আসল।

আমাদেরকে ছোট একটা লিভিংরুমে নিয়ে গেলেন নাইজেল ওয়েস্টন। এখান থেকে বাইরের শ্যামলিমা দেখা যায়। একধারের ফায়ারপ্লেসে জ্বলছে আগুন। একটা টেবিলের উপর আগে থেকেই আমাদের জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে কফি আর বিস্কিট।

বসে পড়লাম আমরা।

‘আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে খুব ভালো লাগল, মিস্টার হোথর্ন,’ বলতে শুরু করলেন নাইজেল ওয়েস্টন। ‘বেশ নামডাক আছে আপনার। রাশান রাষ্ট্রদূতের সেই কেসটা… দ্য বেযরুকভ কেস… চমৎকার কাজ দেখিয়েছেন আপনি।’

‘কিন্তু শেষপর্যন্ত অপরাধী হিসেবে প্রমাণ করা যায়নি তাঁকে,’ মনে করিয়ে দেয়ার কায়দায় বলল হোথর্ন।

‘নিজের জন্য খাসা একজন উকিল নিয়োগ দিয়েছিলেন তিনি। আর… আমার ধারণা জুরিকে ভুল পথে পরিচালিত করা হয়েছিল। …কফি খাবেন?’

হোথর্নকে যে আগে থেকেই চেনেন নাইজেল ওয়েস্টন, আশা করিনি ভাবলাম, হোথর্ন যতদিনে বেরিয়ে এসেছে পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে, সেই বেযরুকভ কেস কি সে-ঘটনার আগের নাকি পরের? কারণ ওই কেস হোথর্ন তদন্ত করবে… ব্যাপারটা কেমন যেন অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে।

আমাদের তিনজনের জন্যই কফি ঢালছেন নাইজেল ওয়েস্টন। এই সুযোগে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি আমি। ঘরের বড় একটা অংশ দখল করে রেখেছে ক্ষুদ্রকায় একটা গ্র্যান্ড পিয়ানো। ঢাকনাটা নামানো আছে, সেটার উপর দামি ফ্রেমে ঠাঁই পেয়েছে আধ ডজন ফটোগ্রাফ। চারটা ছবিতে অন্য কোনো লোকের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে ওয়েস্টনকে। একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে এক লোকের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, তাঁদের দু’জনেরই পরনে হাওয়াইয়ান শার্ট আর শর্টস। আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই, ইতোমধ্যে এই ছবিগুলো দেখা হয়ে গেছে হোথর্নের।

‘তো… ক্যান্টাব্রিতে আসা হলো কেন?’ জানতে চাইলেন ওয়েস্টন।

‘একটা জোড়া খুনের কেস তদন্ত করছি আমি,’ ব্যাখ্যা করল হোথর্ন। ‘ডায়ানা ক্যুপার এবং তাঁর ছেলে।’

‘হ্যাঁ, পড়েছি আমি ওই খুন দুটোর ব্যাপারে। ভয়ঙ্কর ব্যাপার। মেট্রোপলিটান পুলিশকে পরামর্শ দিচ্ছেন আপনি?’

‘হ্যাঁ, স্যর।’

‘ওরা আপনাকে একেবারেই ছেড়ে না-দিয়ে খুব ভালো কাজ করেছে। …কী ধারণা আপনার… ডিলে যে-দুর্ঘটনা ঘটেছিল এবং তার ফলে যে-ছেলেটা মারা গিয়েছিল, সে-ঘটনার সঙ্গে ওই খুন দুটোর কোনো সম্পর্ক আছে?’

‘আমি কোনো সম্ভাবনাই বাদ দিচ্ছি না, স্যর।’

‘এসব কেসে আবেগ প্রচণ্ড একটা ব্যাপার হতে পারে কখনও কখনও। খেয়াল করেছি, ওই দুর্ঘটনার দশ বছর হতে চলেছে। আর তাই দুর্ঘটনাটাকে হত্যাকাণ্ড- দুটোর সম্ভাব্য কারণ হিসেবে ভাবছি আমিও। …ওই সময়ে আদালতে যেসব রিপোর্ট দাখিল করা হয়েছিল, ইচ্ছা করলেই তো সেগুলো ঘাঁটতে পারেন আপনি; কাজেই আমি ঠিক কীভাবে সাহায্য করতে পারি আপনাকে, বুঝতে পারছি না।’

এখনও একজন বিচারকের মতো কথা বলেন নাইজেল ওয়েস্টন। চিন্তাভাবনা না-করে একটা শব্দও উচ্চারণ করেন না।

‘যে বা যাঁরা জড়িত ছিলেন ওই বিচারকাজের সঙ্গে, আমার মনে হয় তাঁদের সঙ্গে কথা বলাটাও দরকার।’

‘মানলাম। সাক্ষ্য আর লিখিত প্রমাণের মাঝখানে কিছু-না-কিছু পার্থক্য থাকে সব সময়ই। …গডউইন পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছেন?’

‘হ্যাঁ, স্যর।’

‘তাদের জন্য খুব খারাপ লাগে আমার। তাদের জন্য ওই সময়ও খারাপ লেগেছিল আমার এবং সেটা বলেছিও। তারা ভেবেছিল, আমি বোধহয় ন্যায়বিচার করিনি তখন। কিন্তু, মিস্টার হোথর্ন, আপনাকে বলার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না, তারপরও বলছি… এসব কেসে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির পরিবার কী ভাবল না-ভাবল তা আমলে নেয়ার কোনো সুযোগ থাকে না

‘বুঝতে পেরেছি।’

দরজাটা খুলে গেল এমন সময়, দ্বিতীয় আরেকজন লোককে দেখা গেল। এই লোককে পিয়ানো-উপর-রাখা ফটোগ্রাফে দেখেছি কিছুক্ষণ আগে। লোকটা বেঁটে, বেশ গাঁট্টাগোট্টা, বয়সে ওয়েস্টনের চেয়ে বছর দশেকের ছোট। হাতে একটা সুপারমার্কেটের-শপিংব্যাগ।

‘বাইরে যাচ্ছি আমি,’ বললেন লোকটা, ‘আপনার কিছু লাগবে?’

‘কিচেনে লিস্ট রেখে দিয়েছি।’

‘নিয়েছি ওটা। কোনো কিছু লিখতে ভুলে গেছেন কি না, সেটাই ভাবছিলাম।’

‘আরও কিছু ডিশওয়াশার ট্যাবলেট দরকার আমাদের।’

‘লিস্টে আছে ওটা।

‘তা হলে আর কিছু লাগবে বলে মনে হয় না।’

‘দেখা হবে,’ বলে গায়েব হয়ে গেলেন লোকটা।

‘কলিন,’ গাঁট্টাগোট্টার পরিচয় দিলেন ওয়েস্টন।

‘আপনি যে-রায় দিয়েছিলেন তখন, তাতে পত্রিকাওয়ালারাও খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারেনি,’ বলল হোথর্ন। খেয়াল করলাম, অদ্ভুত একজাতের বিদ্বেষ খেলা করছে ওর চোখে।।

একটুখানি হাসলেন ওয়েস্টন। ‘আমি যে-রায় দিয়েছি সেটা নিয়ে পত্রপত্রিকায় কী লেখালেখি হলো, সেসব দেখার স্বভাব কোনোকালেই ছিল না আমার। পত্রিকাওয়ালাদের খুশি হওয়া অথবা বেজার হওয়ার সঙ্গে আসল ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই।’

‘আসল ঘটনা মানে? আট বছর বয়সী একটা ছেলেকে পরপারে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মিসেস ক্যুপার। ওই ছেলের ভাইকে পঙ্গু বানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যাপারটা যখন আদালত পর্যন্ত গড়াল, তখন নামকাওয়াস্তের শাস্তি পাওয়া ছাড়া আর তেমন কিছু হলো না তাঁর।’

ওয়েস্টনের হাসিটা মলিন হলো। ‘রোড ট্রাফিক অ্যাক্ট ১৯৮৮-এর সেকশন টু- এ অনুযায়ী, প্রসিকিউশনের দায়িত্ব হচ্ছে, বিপজ্জনক ড্রাইভিঙের মাধ্যমে যদি কারও মৃত্যু হয়ে থাকে, সেটা প্রমাণ করা। কিন্তু তারা সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এবং তাদের সে-ব্যর্থতার কারণও আছে। মিসেস ক্যুপার আইন ভঙ্গ করেননি, আবার এমন কিছুও করেননি যার ফলে কেউ বলতে পারবে, ঝুঁকিপূর্ণ ড্রাইভিং করছিলেন তিনি তখন। গাড়ি চালানোর আগে তিনি ড্রাগ নেননি, মাত্রাতিরিক্ত মদও খাননি। আর কিছু কি বলার দরকার আছে আমার? আসলে আমি যা বলতে চাইছি তা হলো, কাউকে খুন করার কোনো ইচ্ছা ছিল না ওই মহিলার।

‘তিনি সে-সময় চশমা পরে ছিলেন না,’ বলল হোথর্ন, তাকাল আমার দিকে। আমি যাতে ব্যাঘাত সৃষ্টি না-করি, সে-ব্যাপারে ইশারায় নিষেধ করল আমাকে।

‘মানলাম। ঘটনাটা দুঃখজনক। কিন্তু, মিস্টার হোথর্ন, আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন, ঘটনাটা ২০০১ সালের। তারপর থেকে বিশেষ এই ব্যাপারে আইন অনেক কড়া হয়ে গেছে। এবং আমার মনে হয় সেটা ঠিকই হয়েছে। তারপরও, আমার মনে হয়, ও-রকম কোনো কেসে যদি আজ আমাকে বিচারকের ভূমিকা পালন করতে হতো, তা হলেও একই রায় দিতাম।’

‘কেন?’

সে-সময়ের আদালতের কার্যক্রমের লিখিত প্রতিলিপি যদি দেখে নেন, ভালো হয়। তারপরও বলি… ওই বাচ্চা দুটো… ওরাই কিন্তু দৌড়ে হাজির হয়ে গিয়েছিল রাস্তার মাঝখানে। রাস্তার ও-প্রান্তে আইসক্রিমের দোকানটা দেখতে পেয়েছিল তারা। তাদের দেখভালের দায়িত্ব ছিল যে-মেয়ের উপর, সে সামান্য কিছু সময়ের জন্য নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল ছেলে দুটোর উপর। ওই মেয়েকেও দোষ দেয়া যায় না আসলে। কিন্তু একটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখুন, মিসেস ক্যুপার যদি চশমা পরে থাকতেনও, হয়তো সময়মতো থামাতে পারতেন না গাড়িটা।’

‘সে-কারণেই কি তাঁকে বেকসুর খালাস দেয়ার কথা বলেছিলেন আপনি জুরিকে?’ দেখে মনে হলো, হোথর্নের কথা শুনে মনে চোট পেয়েছেন ওয়েস্টন। কিছু বলার আগে চুপ করে থাকলেন কয়েকটা মুহূর্ত। ‘সে-রকম কিছুই করিনি আমি। আর… সরাসরিই বলি… আপনার কথা কিছুটা আক্রমণাত্মক বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে। স্বীকার করে নিচ্ছি, আমি যে-রায় দিয়েছিলাম সেটা মিসেস ক্যুপারের পক্ষে গেছে, তারপরও পুরো ঘটনা ভেবে দেখার অনুরোধ জানাবো আপনাকে। ক্রিমিনাল রেকর্ড বলতে কিছুই ছিল না তাঁর, এবং তিনি ছিলেন সম্মানিত একজন মানুষ। ছেলে দুটোর পরিবারের জন্য ওই ঘটনা ছিল খুবই দুঃখজনক, কিন্তু সেটা বিবেচনা করে যদি কোনো রায় দিতাম, তা হলে সে-রায়ও যথোপযুক্ত হতো না।’

সামনের দিকে ঝুঁকল হোথর্ন। শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চলেছে এমন কোনো বুনো জন্তুর কথা মনে পড়ে গেল আমার আরও একবার। ‘ভদ্রমহিলাকে চিনতেন আপনি।’

তিনটা সাধারণ শব্দ উচ্চারণ করেছে হোথর্ন, অথচ তাতেই কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছেন ওয়েস্টন। আমার মনে হচ্ছে, যেন দড়াম করে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে কোনো শবকক্ষের দরজা। হঠাৎ করেই যেন বদলে গেছে আমার আশপাশের সব কিছু। নাইজেল ওয়েস্টন যেন হঠাৎই টের পাচ্ছেন, বিপদ হাজির হয়েছে এই ঘরে। আগুনে পুড়ছে কাঠ, সে-আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। সে-উত্তাপ টের পাচ্ছি নিজের চেহারায়।

‘সরি?’ বললেন ওয়েস্টন।

‘আমার মনে হয়, মিসেস ক্যুপারের সঙ্গে পূর্বপরিচয় ছিল আপনার। এবং আমার আরও মনে হয়, রায় দেয়ার সময় সে-পরিচয় কিছুটা হলেও ভূমিকা পালন করেছে।’

‘আপনার ভুল হয়েছে। মিসেস ক্যুপারকে চিনতাম না আমি।’

দেখে মনে হলো, থতমত খেয়ে গেছে হোথর্ন। ‘রেমন্ড ক্রুন্সের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল আপনার।

‘আমার মনে হয় না…’

‘রেমন্ড কুন্স… থিয়েটারের প্রযোজক। ওই লোকের নাম তো আপনার ভুলে যাওয়ার কথা না। তাকে কাজে লাগিয়ে অনেক টাকা কামিয়েছেন আপনি।’

আত্মসংবরণ করতে কষ্ট হচ্ছে ওয়েস্টনের। ‘রেমন্ড কুন্সকে ভালোমতোই চিনি আমি।’

‘একটা শো-তে টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন আপনি।’

‘একটা না, দুটো। লা কেইজ অঁ ফলে এবং দ্য ইম্পর্টেন্স অভ বিইং আর্নেস্ট।’

‘দ্বিতীয় নাটকটাতে অভিনয় করেছিল ড্যামিয়েন ক্যুপার। সে-নাটক উপলক্ষে যে-ফার্স্ট নাইট পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল, সেটাতে ড্যামিয়েন আর তার মায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল আপনার। ঠিক না?’

‘না।’

‘কিন্তু দুর্ঘটনার সেই কেস নিয়ে কুন্সের সঙ্গে কথা বলেছিলেন আপনি।’

‘কে বলেছে?’

‘কুন্স নিজেই।’

আর সহ্য করতে পারলেন না ওয়েস্টন। ‘আপনার সাহস তো কম না! আমার বাড়িতে বসে আমারই বিরুদ্ধে লাগাতার অভিযোগ করে চলেছেন!’ কণ্ঠ চড়াননি তিনি, কিন্তু ক্রোধোন্মত্ত হয়ে গেছেন। যে-আর্মচেয়ারে বসে আছেন সেটার হাতল আঁকড়ে ধরেছেন দুই হাতে। তাঁর চামড়ার নিচের রগগুলো পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। ‘ওই পার্টিতে গিয়েছিলাম আমি, কিন্তু ড্যামিয়েন ক্যুপার অথবা তার মা যদি সেখানে গিয়েও থাকে, আমার সঙ্গে দেখা হয়নি তাদের, কথাও হয়নি।’

‘মিসেস ক্যুপার কি ওই বিচারকাজ চলার সময় বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে রেমন্ড কুন্সকে পাঠিয়েছিলেন আপনার কাছে?’

‘কেন করতে যাবেন তিনি কাজটা?’

‘যাতে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করেন আপনি ঘটনাটা। যাতে রেমন্ড কুন্সের কথা শোনেন আপনি। কারণ আপনি এবং মিসেস ক্যুপার দু’জনই টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন কুন্সের নাটকে।’

‘যথেষ্ট হয়েছে,’ উঠে দাঁড়ালেন ওয়েস্টন। ‘আপনার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়েছিলাম, কারণ ভেবেছিলাম হয়তো সাহায্য করতে পারবো আপনাকে। তা ছাড়া আপনার নামও শুনেছিলাম অনেক। কিন্তু আপনি আজেবাজে কথা বলে মেজাজটাই খারাপ করে দিলেন আমার… আপনার সঙ্গে কথা বলার আর কোনো প্রয়োজন বোধ করছি না।’

কিন্তু কথা এখনও শেষ হয়নি হোথর্নের। ‘আপনি কি জানেন রেমন্ড কুন্স জেলে যাচ্ছেন?’

‘আপনাকে চলে যেতে বলেছি!’ চিৎকার করে উঠলেন ওয়েস্টন।

আর কিছু বলল না হোথর্ন, বেরিয়ে এল।

আমিও তা-ই করলাম।

স্টেশনের পথে যখন ফিরে চলেছি, তাকালাম ওর দিকে। ‘আপনি আসলে কেন এসেছিলেন নাইজেল ওয়েস্টনের কাছে, বলুন তো?’

একটা সিগারেট ধরাল হোথর্ন। ‘ওই দুর্ঘটনাটার ব্যাপারে আরও বেশি কিছু জানতে চাই। ডায়ানা ক্যুপার আর গডউইন পরিবারের মধ্যে কোনো যোগাযোগ ছিল কি না, জানতে চাই। আমার ধারণা, নাইজেল ওয়েস্টন ছিলেন সে- যোগাযোগের একটা অংশ। আর সেটাই বের করতে চাইছি আমি।’

‘তার মানে আপনি ভাবছেন খুন দুটোর ব্যাপারে কিছু-না-কিছু করার ছিল ওয়েস্টনের?’

‘যাদের সঙ্গেই দেখা করেছি আমরা, খুন দুটোর ব্যাপারে কিছু-না-কিছু করার ছিল তাদের প্রত্যেকেরই। হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারটাই ও-রকম। আপনি বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থায় মারা যেতে পারেন। ক্যান্সারে ভুগে মারা যেতে পারে। আবার বার্ধক্যজনিত জটিলতায় ভুগেও মারা যেতে পারেন। কিন্তু কেউ যখন আপনাকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে, অথবা আপনার শ্বাসরোধ করবে, তখন বুঝতে হবে কোথাও-না-কোথাও কোনো-না-কোনো ছক আছে… একটা নেটওয়ার্ক আছে… আর সেটাই খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি আমরা।’ মাথা নাড়ল হোথর্ন। ‘আমি আসলে জানি না! আপনি হয়তো এ-সবের জন্য উপযুক্ত না, টনি। অন্য লেখকদের কাছে যে যেতে পারিনি আমি, সেটা ভেবে এখন লজ্জাই লাগছে আমার।’

‘কী?’ ঘাবড়ে গেছি আমি। ‘কী বলছেন আপনি?’

‘যা বলেছি, শুনতে পেয়েছেন।’

‘অন্য লেখকদের সঙ্গে কথা বলেছেন আপনি?’

‘অবশ্যই, মেইট। তবে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন তাঁরা।’

১৮. ডিল

ট্রেনে সওয়ার হয়ে ডিলে যাওয়ার পথে হোথর্নের সঙ্গে একটা কথাও বললাম না। এবার একটু দূরে সরে বসেছি ওর থেকে। আগের সেই বইটা পড়ছে সে, থেকে থেকে পাতা উল্টাচ্ছে। আমি জানালা দিয়ে গোমড়া মুখে তাকিয়ে আছি বাইরে, হোথর্নের শেষ কথাটা ভাবছি। কিন্তু যখন হাজির হয়ে গেলাম ডিলে, ব্যাপারটা বেরিয়ে গেল আমার মাথা থেকে।

এর আগে কখনও ডিলে আসিনি আমি। তবে আসতে চেয়েছিলাম বহুবার। কারণ সমুদ্রতীরবর্তী কোনো শহরের প্রতি সব সময়ই একরকমের অনুরাগ ছিল আমার মনে… বিশেষ করে যখন পর্যটকদের মৌসুম চলে না, তখন। কারণ সে- সময় রাস্তাঘাট থাকে ফাঁকা। সে-সময় আকাশটা থাকে ধূসর, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিও হয় কখনও কখনও। আমার ভালো লাগে বালিয়াড়ি, স্লট মেশিন, পিয়ার্স, সিগাল, প্রিন্ট- করা নামের পিপারমিন্ট রক। ক্যাফে আর চায়ের দোকান, পট থেকে কাদাপানির– মতো-দেখতে চা ঢালতে থাকা বুড়ি মহিলাদের দল, মাছ ধরার জাল বিক্রি করে এমন দোকান, গাছের সারি এবং নভেলটি হ্যাঁটের প্রতি একরকমের লালসা আছে আমার মনে।

কিন্তু যখন স্টেশন থেকে বের হলাম, ডিল শহরটা তখন আশ্চর্য রকম আকর্ষণহীন বলে মনে হলো আমার। হাঁটতে লাগলাম প্রধান সড়কটা ধরে। আমাদের মাথার উপর চিৎকার করছে সিগালের দল… বিভিন্ন বাড়ির ছাদে বসে আছে ওগুলো। এখন মে মাস, পর্যটনের মৌসুম শুরু হতে বাকি আছে এখনও। আবহাওয়া নিতান্তই খারাপ। স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য এই শহর কেমন, সে-চিন্তা খেলে গেল আমার মনে।

হাজির হলাম সমুদ্রের ধারে। আবহাওয়া ঠাণ্ডা, চারপাশের কোনো কিছুর প্রতিই কোনো আকর্ষণ বোধ করছি না। একটামাত্র পিয়ার আছে বেলাভূমিতে; সেটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্বল পিয়ার বলে মনে হচ্ছে আমার। কোথাও কোনো পেনি আর্কেড নেই, ট্রাম্পোলিন নেই, ক্যারোযেল নেই। এ-রকম এক জায়গায় গডউইন দম্পতি তাদের দুই ছেলেকে পাঠাতে গেল কেন? এখানে অন্য কোথাও কি বিনোদনের ভালো কোনো ব্যবস্থা ছিল?

যেখানে ঘটেছিল দুর্ঘটনাটা, প্রথমেই সেখানে গেলাম না আমরা।

ডায়ানা ক্যুপার কোথায় থাকতেন, সেটা আগে দেখতে চায় হোথর্ন। আর তাই সাগরের ধারে পৌঁছে ডানদিকে মোড় নিলাম আমরা। এখান দিয়ে যাওয়া যায় কাছের একটা গ্রামে। গ্রামটার নাম ওয়ালমার। এখনও আমাদের দু’জনের মধ্যে কথা বলা বন্ধ আছে।

একটা অ্যান্টিক শপকে পাশ কাটাচ্ছি, এমন সময় থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল হোথর্ন, ওই দোকানের জানালা দিয়ে তাকাল ভিতরে। কিন্তু একটা জাহাজের- কম্পাস, একটা গ্লোব, একটা সেলাই মেশিন, নষ্ট হয়ে যাওয়া কিছু বই আর ছবি ছাড়া অন্যকিছু নজরে পড়ল না।

আরও মিনিট পনেরো হাঁটলাম আমরা। তারপর সহসাই হাজির হয়ে গেলাম ওয়ালমার গ্রামে। গিয়ে দাঁড়ালাম স্টোনার হাউসের সামনে। বিশেষ সেই দুর্ঘটনা ঘটার আগে এখানেই থাকতেন ডায়ানা ক্যুপার, পরে বাধ্য হয়ে এই জায়গা ছেড়ে চলে যান। দু’পাশে দুটো রাস্তা স্যান্ডউইচের মতো ঘিরে রেখেছে বাড়িটাকে। পেছনের রাস্তাটা লিভারপুল রোড, আর সামনেরটা দ্য বীচ। দুই রাস্তার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে ব্যক্তিগত একটা ড্রাইভ। সেটার দুই মাথায় আছে সুসজ্জিত দুটো ধাতব গেট।

ডায়ানা ক্যুপারকে যতটুকু চিনেছি, সে-অনুযায়ী আমি বলবো, এই বাড়িতে চমৎকার মানিয়ে গিয়েছিল তাঁকে। বাড়িটা ধূসর নীলাভ রঙের, দেখলে নিরেট বলে মনে হয়। রক্ষণাবেক্ষণের কাজ নিয়মিত করা হয় এখনও। বাড়িটা দুই তলা। চিমনির সংখ্যা একাধিক। একদিকে একটা গ্যারেজ আছে। সদর দরজার সামনে যেন পাহারায় নিয়োজিত আছে পাথরে-নির্মিত দুটো সিংহ। চারদিকে গাছের সারি, সুন্দর করে ছেঁটে রাখা হয়েছে সেগুলোর ডালপাতা; সরু কিছু ফ্লাওয়ারবেডে শোভা পাচ্ছে অর্ধগ্রীষ্মমণ্ডলীয় কতগুলো গাছ। নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর লাগানো হয়েছে ওগুলো। পুরো এলাকা যে ব্যক্তিগত সেটা বোঝানোর জন্য জায়গাটা ঘিরে দেয়া হয়েছে দেয়াল দিয়ে।

‘আমরা কি বেল বাজাবো?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি, দাঁড়িয়ে আছি লিভারপুল রোডের এককোনায়। যতদূর বুঝতে পারছি, ওই বাড়িতে কেউ নেই।

‘না। দরকার নেই।’ পকেট থেকে একটা চাবি বের করল হোথর্ন। দেখতে পেলাম, সেটার গায়ে একটা ট্যাগ লাগানো আছে, আর সেই ট্যাগে লেখা আছে বাড়িটার নাম।

থতমত খেয়ে গেলাম।

তবে ব্যাপারটা বুঝতে বেশি সময় লাগল না আমার। এই চাবি মনে হয় ডায়ানা ক্যুপারের কিচেন থেকে জোগাড় করে নিয়েছে হোথর্ন, কিন্তু কখন করেছে কাজটা সে-ব্যাপারে নিশ্চিত না আমি। পুলিশ যদি টের পেত মিসেস ক্যুপারের শেষ আবাসস্থল থেকে কোনো কিছু সরাচ্ছে হোথর্ন, তা হলে কাজটা কখনোই করতে দিত না তাকে। তার মানে, ধরে নেয়া যায়, এই চাবির অস্তিত্বে সম্পর্কে কিছু জানা ছিল না পুলিশের।

চাবিটা নিরেট আর মোটাসোটা। ইয়েল জাতীয় কোনো কিছু না। বুঝতে পারছি, এটা সদর-দরজার চাবি না আসলে। তার মানে এটা দিয়ে ওই ধাতব দরজা দুটোর কোনো একটা খোলা যাবে হয়তো। একটা দরজার দিকে এগিয়ে গেল হোথর্ন, ওই চাবি দিয়ে দু’বার চেষ্টা করল তালা খুলতে কিন্তু পারল না। মাথা নেড়ে বলল, ‘এটা এই দরজার চাবি না।’

দ্য বীচ লাগোয়া যে-রাস্তা আছে, সেখানে গেলাম আমরা; এখানকার দরজাটা খোলার চেষ্টা করল হোথর্ন সেই চাবি দিয়ে। কিন্তু এবারও পারল না। বিড়বিড় করে বলল, ‘দুঃখের বিষয়।’

‘এই বাড়ি ছেড়ে দেয়ার পরও এখানকার একটা চাবি নিজের কাছে রাখতে গেলেন কেন মিসেস ক্যুপার?’ জিজ্ঞেস করলাম।

‘আমিও জানতে চাই সেটা।’

এদিক-ওদিক তাকাল হোথর্ন। ভাবলাম, আমাদেরকে এবার হয়তো হেঁটে ফিরে যেতে হবে ডিলে। কিন্তু আরেকটা গেট দেখতে পেয়েছে সে… আমিও দেখেছি ওটা। স্টোনার হাউসে একটা আলাদা আর ব্যক্তিগত বাগান আছে… বেলাভূমির ঠিক পাশেই। আনমনে হাসল হোথর্ন, রাস্তা পার হয়ে এগিয়ে গেল ওই দরজার দিকে, তৃতীয়বারের চেষ্টায় কাজে লেগে গেল ওর সেই চাবি।

ছোট একটা চৌকোনা জায়গায় প্রবেশ করলাম আমরা। চারদিকে ছোটবড় ঝোঁপঝাড়। আসলে বাগান বলতে যা বোঝায়, এই জায়গা সে-রকম কিছু না, বরং এটাকে একটা চত্বর বলা যেতে পারে। ক্ষুদ্রাকৃতির কিছু ইউ গাছ আছে এদিকে- সেদিকে, আর আছে গোলাপ ফুলের কিছু বেড। এগুলো ঘিরে রেখেছে মার্বেল পাথরে-বানানো সুন্দর একটা ফোয়ারাকে। ঘিরে রেখেছে কাঠের দুটো বেঞ্চকেও… ওগুলো দাঁড়িয়ে আছে একটা আরেকটার মুখোমুখি। ইয়র্ক পাথরে মুড়ে দেয়া হয়েছে জমিন। এত কিছুর কারণে পুরো জায়গায় তৈরি হয়েছে মঞ্চনাটকের মতো একটা আবহ… মনে হচ্ছে, বাচ্চাদের কোনো নাটকের কোনো দৃশ্য দেখছি যেন।

এগিয়ে গেলাম ফোয়ারাটার দিকে। শুকিয়ে খটখট করছে ওটা, বোঝাই যায় অনেকদিন হয়ে গেল আর ব্যবহৃত হচ্ছে না। কেমন একটা দুঃখের অনুভূতি ভর করল আমার মনে। কী খুঁজে পেতে চলেছি আমরা, সে-ব্যাপারে একটা ধারণাও জন্মাল।

এবং সেটা চোখে পড়তে বেশি সময় লাগল না।

ফোয়ারাটার একদিকে, পাথরের গায়ে খোদাই করা আছে :

লরেন্স ক্যুপার
৩ এপ্রিল –২২ অক্টোবর ১৯৯৯
‘টু স্লিপ, পারচ্যান্স টু ড্রিম।

‘মিসেস ক্যুপারের স্বামী,’ বললাম আমি।

‘হ্যাঁ। ক্যান্সারে ভুগে মারা গিয়েছিলেন ভদ্রলোক। আর তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যেই এই জায়গা বানিয়েছিলেন মিসেস ক্যুপার। বেচারী এই বাড়িতে থাকতে পারেননি, কিন্তু জানতেন, এখানে ফিরে আসতে চাইবেন বার বার। আর তাই এই বাড়ির একটা চাবি রেখে দিয়েছিলেন নিজের কাছে।

‘মিসেস ক্যুপার তাঁর স্বামীকে খুবই ভালোবাসতেন,’ বললাম আমি।

মাথা ঝাঁকাল হোথর্ন।

একটাবারের জন্য মনে হলো আমার, আমরা দু’জনই ভুগছি অস্বস্তিতে।

‘চলুন বেরিয়ে যাই এখান থেকে,’ বলল হোথর্ন।

.

যে-দুর্ঘটনা বদলে দিয়েছিল ডায়ানা ক্যুপারের জীবন, সেটা ঘটেছিল ডিলের কেন্দ্রস্থলে… দ্য রয়্যাল নামের একটা হোটেলের কাছে। হোটেলটা সুন্দর, জর্জিয়ান আমলের। এখানেই উঠেছিল মেরি ও’ব্রায়ান, তার সঙ্গে ছিল জেরেমি আর টিমোথি গডউইন। বিকেলের নাস্তা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে আর যখন মাত্র কয়েক মিনিট বাকি ছিল তাদের তিনজনের, তখনই ঘটে দুর্ঘটনাটা।

মেরি কী বলেছিল, মনে পড়ে গেল আমার। সৈকত থেকে উঠে এসেছিল জেরেমি আর টিমোথি… এই মুহূর্তে আমাদের পেছনে আছে ওই বেলাভূমি। এখানকার রাস্তাটা ডিলের যে-কোনো জায়গার রাস্তার তুলনায় চওড়া, ফলে এই জায়গায় হাজির হলে গাড়ির চালকেরাও স্বাভাবিকভাবে গতি বাড়িয়ে দেয়। রাস্তার একধারে একটা দোকান দেখা যাচ্ছে, আরেক প্রান্তে আছে একটা এন্টারটেইনমেন্ট আর্কেড। আরও দেখতে পাচ্ছি একটা পাব এবং একটা ওষুধের দোকান। দোকানটার নাম পিয়ার ফার্মেসি। সবশেষে, ওষুধের ওই দোকানের পাশে, দেখা যাচ্ছে আইসক্রিম শপটা। দোকানটার সামনের দিকের পুরোটা বানানো হয়েছে প্লেট-গ্লাস উইন্ডো দিয়ে, সেটার উপর লাগিয়ে রাখা হয়েছে একটা উজ্জ্বল আর চিত্রবিচিত্র শামিয়ানা।

ওই দুর্ঘটনা কীভাবে ঘটেছিল সেটা অনুমান করে নেয়াটা মোটেও কঠিন কোনো কাজ না এখন আমার জন্য: রাস্তার একটা কোনা ঘুরে বেরিয়ে এসেছিল মিসেস ক্যুপারের গাড়ি, দ্রুত ড্রাইভ করছিলেন তিনি। ঠিক ওই সময়ে জেরেমি আর টিমোথি সিদ্ধান্ত নেয় পালাবে মেরি ও’ব্রায়ানের কাছ থেকে, ফুটপাত ধরে ছুট লাগায় তারা। তারপর হুট করেই নেমে পড়ে রাস্তায়, দৌড় দেয় ওই আইসক্রিম শপের উদ্দেশে।

তার মানে… নাইজেল ওয়েস্টন হয়তো ঠিকই বলেছিলেন। ডায়ানা ক্যুপার যদি তখন চশমা পরেও থাকতেন, সময়মতো ব্রেক কষতে পারতেন কি না সন্দেহ। দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল বছরের এই সময়েই… আজকের তারিখের কাছাকাছি কোনো তারিখে। এই প্রমেনাড এখন যে-রকম জনশূন্য, সে-সময়ও হয়তো সে-রকমই ছিল। হয়তো আজকের মতো সেদিনও কেবল ফিকে হতে শুরু করেছিল শেষ- বিকেলের আলো।

‘কোত্থেকে শুরু করবো আমরা?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।

মাথা ঝাঁকাল হোথর্ন। ‘আইসক্রিমের দোকান

দোকানটা, দেখতে পাচ্ছি, খোলা। রাস্তা পার হয়ে গিয়ে ঢুকলাম সেখানে।

দোকানটার নাম গেইল’স আইসক্রিম। ভিতরে সব জায়গায় কেমন একটা খুশি-খুশি ভাব। ফর্মিকা-বিছানো মেঝের উপর পেতে দেয়া হয়েছে প্লাস্টিকের চেয়ার। এখানে যে-আইসক্রিম বিক্রি করা হয় সেটা বাসায় বানানো। একটা ফ্রিয়ারের ভিতরে বারোটা আলাদা আলাদা টাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে ওগুলো। বেশ পুরনো হয়ে গেছে ফ্রিয়ারটা, বেহাল দশা ওটার। জানালার পাশে স্তূপ করে রাখা হয়েছে কোন-গুলো। দেখে মনে হচ্ছে, ওগুলো বেশ কিছু দিন ধরে আছে ওখানে। এই দোকানে আরও পাওয়া যায় ফিযি ড্রিঙ্ক, চকলেট, ক্রিস্পস আর রেডি-মিক্স সুইট ব্যাগ। একদিকের দেয়ালে ঝুলছে একটা মেন্যু। তাতে বলা হচ্ছে, ডিম, বেকন, সসেজ, মাশরুম আর চিপসও পাওয়া যায় এখানে।

দোকানের মাত্র দুটো টেবিলে খদ্দের দেখা যাচ্ছে। একটা টেবিলে বসে আছে বয়স্ক এক দম্পতি। আরেকটা টেবিলে বসেছে যুবতী দুই মা, তাদের সঙ্গে আছে দুটো পুশচেয়ার, সেগুলোর ভিতরে আছে দুটো বাচ্চা। কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেলাম আমরা। সেখানে দেখা যাচ্ছে বড়সড় হাস্যোজ্জ্বল এক মহিলাকে। তাঁর বয়স পঞ্চাশের ঘরে। কাপড়ের উপর একটা অ্যাপ্রন পরে আছেন। ওই অ্যাপ্রন, এই দোকানের প্রবেশপথের শামিয়ানাটার মতোই চিত্রবিচিত্র। খদ্দেরদের সেবা দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি।

জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী দেবো আপনাদের?’

‘সাহায্য,’ বলল হোথৰ্ন, ‘আমি পুলিশে আছি।’

‘ওহ্?’

‘আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে এখানে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল। ওটার ব্যাপারে খোঁজখবর করছি। একটা গাড়ির নিচে চাপা পড়েছিল ছোট দুটো ছেলে।’

‘কিন্তু… এই ঘটনা তো দশ বছর আগের!’

‘ডায়ানা ক্যুপার… মানে যে-মহিলা গাড়িটা চালাচ্ছিলেন তখন… মারা গেছেন। আপনি কি পড়েননি খবরটা?’

‘কিছু একটা পড়েছি। কিন্তু …’

‘আপনি যা বলবেন তার ফলে হয়তো নতুন কোনো প্রমাণ পাওয়া যাবে।’

‘ওহ্!’ নার্ভাস দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকালেন মহিলা। তাঁর সে-দৃষ্টি দেখে আমি ভাবলাম, বিশেষ কোনো কিছু গোপন করতে চাইবেন হয়তো। ‘কিছু মনে করবেন না… ওই ব্যাপারে আসলে বেশি কিছু বলার নেই আমার।

‘আপনি কি তখন ছিলেন এখানে?’

‘আমার নাম গেইল হারকোর্ট। এটা আমারই দোকান। এবং দুর্ঘটনাটা যেদিন ঘটেছিল, সেদিন আমি এখানেই ছিলাম। ওই দুটো বাচ্চার কথা যখনই মনে পড়ে, তখনই কেমন যেন অসুস্থ বোধ করি। ওরা শুধু আইসক্রিম খেতে চেয়েছিল, আর সে-কারণেই রাস্তা পার হতে ছুট লাগিয়েছিল। কিন্তু ওরা যদি আসত এখানে, কোনো লাভ হতো না… সেদিন এই দোকান বন্ধ ছিল।’

‘জুনের শুরুতে বন্ধ? কেন?’

ছাদের দিকে ইঙ্গিত করলেন মহিলা। ‘একটা পাইপ ফেটে গিয়েছিল। ফলে পানিতে ভেসে গিয়েছিল পুরো জায়গা। আমার মালসামান সব নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। নষ্ট হয়ে গিয়েছিল ইলেকট্রিক লাইনও। এই দোকানের কোনো কিছুরই বীমা করাইনি আমি। কারণ বীমার কিস্তি দেয়ার ক্ষমতা ছিল না আমার। কাজেই ওই পাইপ ফেটে যাওয়ার ঘটনায় বলতে গেলে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল আমার ব্যবসা।’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ‘দুর্ঘটনাটার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলাম। তবে দেখতে পাইনি ঘটনাটা। তৎক্ষণাৎ দৌড়ে বের হই রাস্তায়, দেখি ছেলে দুটো পড়ে আছে। একটা মেয়ে ছিল ওদের সঙ্গে… কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, প্রচণ্ড কোনো মানসিক ধাক্কা খেয়েছে। তার বয়স ছিল খুবই কম… বিশ্বের কোঠায়। যা-হোক, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাই আমি তখন, দেখতে পাই গাড়িটা। পিয়ারের আরেক প্রান্তে গিয়ে থেমে দাঁড়ায় ওটা। মিনিটখানেকের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর আবার চলতে শুরু করে এবং একসময় অদৃশ্য হয়ে যায়।’

‘ড্রাইভারকে কি দেখেছিলেন?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।

ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল হোথর্ন, কিন্তু পাত্তা দিলাম না।

‘দেখেছিলাম মানে… শুধু ওই মহিলার মাথার পেছনদিকটা দেখেছিলাম।’

‘তার মানে গাড়িটা কে চালাচ্ছিল তখন, সে-ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত না? অর্থাৎ, ড্রাইভার যে-কেউ হতে পারে?’

‘যে-কেউ মানে? ওটা তো ওই মহিলাই! তাকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল ওই দুর্ঘটনার কারণে।’ হোথর্নের দিকে তাকালেন গেইল হারকোর্ট। ‘একটা মানুষ কীভাবে ওই কাজ করতে পারে… মানে, কোনো দুর্ঘটনার জায়গা থেকে পালিয়ে যেতে পারে, জানি না আমি। দু’-দুটো বাচ্চা ছেলে পড়ে ছিল ওখানে! ওই মহিলা… আসলে একটা কুত্তী! আপনি জানেন কি না জানি না… তখন কিন্তু চশমা পরে ছিল না সে। চোখে দেখতে পায় না এমন কেউ কেন গাড়ি চালাবে, বুঝি না আমি। ওই মহিলাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া উচিত ছিল। আর ওই বিচারক… যে কিনা ওই মহিলাকে বেকসুর খালাস দিয়েছে… তার চাকরি চলে যাওয়া উচিত ছিল। বিরক্তিকর! ন্যায়বিচার বলে কোনো কিছু আর বাকি নেই আমাদের দেশে।’

গেইল হারকোর্টের প্রচণ্ডতা দেখে বিস্মিত হয়ে গেছি আমি। বিকট দেখাচ্ছে তাঁকে এই মুহূর্তে।

আরও দু’জন খদ্দের ঢুকল দোকানের ভিতরে, নিজেকে সামলে নিলেন গেইল হারকোর্ট, প্রস্তুত হলেন ব্যবসার জন্য। ‘পাশের বাসায় মিস্টার ট্র্যাভার্টন নামের এক ভদ্রলোক আছেন, আপনারা ইচ্ছা করলে কথা বলতে পারেন তাঁর সঙ্গে। তিনিও সেদিন ছিলেন এখানে। আমার চেয়ে বেশি দেখেছেন তিনি সেদিনের ঘটনাটা।’ কাউন্টারের কাছে চলে এসেছে মাত্র-দোকানে-ঢোকা খদ্দের, তার উদ্দেশে হাসলেন। ‘হ্যাঁ, কী নেবেন আপনি?’

.

‘এখনও যখন ভাবি ঘটনাটা, আমার মনে হয় মাত্র গতকাল ঘটেছে সেটা। তখন বিকেল সোয়া চারটা। দিনটা ছিল চমৎকার… আজকের মতো না। ঝকঝকে রোদ ছিল, সাগর-পানিতে গোসল করার জন্য যথেষ্ট গরম ছিল আবহাওয়া। আমি তখন কিছু-একটা বিক্রি করছিলাম একজন খদ্দেরের কাছে। ওই লোক ছিল একজন রহস্যমানব… পরে সবাই আগ্রহী হয়ে উঠেছিল তার উপর। দুর্ঘটনাটা যখন ঘটল, তার বড়জোর সেকেন্ড পাঁচেক আগে আমার দোকান ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে। আর সে-কারণেই বীভৎস শব্দটা স্পষ্ট শুনতে পেলাম আমি। শুনতে পেলাম, গাড়িটা ছুটে এসে ধাক্কা মারল ছেলে দুটোকে। আওয়াজটা যে কী বীভৎস… বলে বোঝাতে পারবো না। এবং খুব জোরে হয়েছিল ওই শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলাম, খারাপ কিছু-একটা হয়েছে। থাবা চালিয়ে তুলে নিলাম আমার মোবাইল ফোন, একদৌড়ে বের হলাম বাইরে। আমার দোকানে তখন মিস প্রিসলি ছাড়া আর কেউ ছিল না। বিয়ে হয়ে গেছে তার, এখন সে আর ডিলে থাকে বলে মনে হয় না। যা-হোক, বাইরে যাওয়ার আগে নিশ্চিত হয়ে নিলাম দোকানে আছে কি না মেয়েটা। আমাদের এই দোকানে অনেক ওষুধপত্র আছে, এবং কাউকে পাহারায় না রেখে এখান থেকে বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই। অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা যদি ঘটে… যেমন যে- ঘটনার কথা বলছি এখন… তবুও না।’

পিয়ার ফার্মেসি অদ্ভুত আর সেকেলে একটা দোকান। ঘরোয়া একটা আবহ আছে। অনেক কিছু বিক্রি করা হয় এখানে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে স্টাফ-করা খেলনা, জ্যাম, চকলেট বার, সিরিয়াল, টয়লেট পেপার, এমনকী কুকুরের-গলায়- বাঁধার ফিতা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি আমি। সাধারণ ওষুধপত্র তো আছেই। এককোনায় কিছু হার্বাল সামগ্রীও আছে। এখানকার স্টাফদের সবাই সাদা কোট পরে। তাদের হাতের নাগালে রয়েছে বিভিন্ন জাতের শত শত প্যাকেট, ফয়েল আর বোতল।

সে-রকম একজনের সঙ্গেই এখন কথা বলছি আমরা… গ্রাহাম ট্রেভার্টন। তিনি এই দোকানের মালিক এবং ম্যানেজার। বয়স পঞ্চাশের ঘরে। মাথায় টাক পড়ে গেছে। গাল দুটো লালচে। উপরের পার্টির সামনের দিকের দুটো দাঁতের মাঝখানে শূন্যস্থান আছে। আমাদের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে বেশ আগ্রহী তিনি। এবং যেসব ডিটেইল দিচ্ছেন আমাদেরকে, সেগুলো শুনে আমি অবাক। সেদিন যা ঘটেছিল, সে-ব্যাপারে দেখা যাচ্ছে সব কিছুই ঠিকমতো মনে আছে তাঁর। সে-বর্ণনা শুনে দু’-একবার ভাবতে বাধ্য হলাম, কোনো কিছু বানিয়ে বলছেন কি না তিনি। কিন্তু কথা হচ্ছে, আগেও ইন্টারভিউ নেয়া হয়েছিল তাঁর… একবার নিয়েছিল পুলিশ, আরেকবার সাংবাদিকরা। কাজেই একই গল্প বার বার বলার অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। তা ছাড়া আমার ধারণা, যখন ভয়ঙ্কর কোনো কিছু ঘটে, সে-ঘটনার সঙ্গে জড়িত অনেক কিছুই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মনে রাখতে পারে অনেকেই।

‘দরজা দিয়ে বের হলাম আমি,’ বলছেন ট্রেভার্টন। ‘আরেকটু হলে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলাম রহস্যময় ওই কাস্টোমারের উপর… ফুটপাতের উপর দাঁড়িয়ে ছিল লোকটা।

‘কী হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করলাম লোকটাকে। জবাব দিল না সে… কিছুই বলল না।

‘ততক্ষণে যা দেখার দেখা হয়ে গেছে আমার। ছেলে দুটো পড়ে ছিল রাস্তার উপর। দু’জনের পরনেই নীল শর্টস আর খাটো হাতার শার্ট। তাদের একজন এমনভাবে পড়ে ছিল যে, দেখামাত্র আমার মনে হলো, মারা গেছে বেচারা। চোখ দুটো বন্ধ ছিল, একটুও নড়ছিল না। অন্য ছেলেটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে ছিল তাদের আয়া মেরি ও’ব্রায়ান। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল মেয়েটা, ভূতের মতো দেখাচ্ছিল তাকে। ঘটনাস্থলে গিয়ে যখন দাঁড়ালাম, চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল মেয়েটা, অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল। ভাবখানা এমন, সাহায্যের জন্য আকুতি জানাচ্ছে আমার কাছে, কিন্তু… কী-বা করার ছিল আমার? পুলিশে খবর দিলাম। আমার মনে হয় আমার জায়গায় থাকলে অনেকেই সে-কাজ করত ওই সময়।

‘নীল রঙের একটা ভক্সওয়্যাগন তখন দুর্ঘটনার-জায়গাটা থেকে কিছুটা দূরে থেমে দাঁড়িয়ে ছিল। খেয়াল করলাম, কেউ একজন বসে আছে গাড়ির ভিতরে। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরই চলতে শুরু করল গাড়িটা, তারপর একসময় গতি বাড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। কসম খেয়ে বলতে পারি, ওই গাড়ির এক্সহস্ট থেকে তখন ধোঁয়া বের হচ্ছিল। রাস্তার উপর চাকার তীব্র ঘর্ষণের আওয়াজও শুনতে পেয়েছিলাম। তখন অবশ্য জানতাম না, যে-মহিলা দায়ী ছিল দুর্ঘটনাটার জন্য, গাড়িটা তারই। কিন্তু চট করে গাড়ির নম্বরটা লিখে নিলাম, এবং পরে সেটা রিপোর্ট করে দিলাম পুলিশের কাছে। যা-হোক, ওই রহস্যমানবের উপর নজর পড়ল আমার তখন আমি তাকে দেখছি টের পেয়ে চট করে ঘুরে গেল সে, হাঁটা ধরল। কিং স্ট্রীটের কোনা ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল একসময়।’

‘বিশেষ এই ঘটনা কি অদ্ভুত মনে হয়েছিল আপনার কাছে?’ জিজ্ঞেস করল হোথর্ন।

‘অবশ্যই। খুবই অস্বাভাবিক আচরণ করছিল লোকটা। মানে… আপনি যখন ও-রকম কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে দেখবেন তখন কী করবেন? কী করা উচিত সাধারণ একজন মানুষের? হয় একজায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকবেন কী ঘটে… বেশিরভাগ লোক তা-ই করে। নয়তো আপনার কিছুই করার নেই ধরে নিয়ে চলে যাবেন। কিন্তু ওই লোক কী করেছিল, জানেন? খুবই তাড়াহুড়ো করে চলে গিয়েছিল… ভাবখানা এমন, সে যেন চায়নি কেউ দেখে ফেলুক তাকে। আরও কথা আছে। দুর্ঘটনাটা নিজের চোখে দেখেছে সে। তার ঠিক সামনেই ঘটেছে ওই ঘটনা। অথচ পুলিশ যখন বিবৃতি চাইল প্রত্যক্ষদর্শীদের, দেখা দিল না সে… উপস্থিত হলো না পুলিশ স্টেশনে।’

‘ওই লোকের ব্যাপারে আর কী বলতে পারেন?’

‘বেশি কিছু না… কারণ লোকটা সানগ্লাস পরে ছিল। এখন আমার কথা হচ্ছে, ওই সময়ে সানগ্লাস পরার দরকারটা কী ছিল তার? তখন সাড়ে চারটার মতো বাজে, সূর্যও কিছুটা ঢলে পড়েছে আকাশে। এবং ততক্ষণে কিছুটা মেঘলা হতে শুরু করেছে আবহাওয়া। …আমার কী মনে হয়, জানেন? মনে হয়, আসলে সানগ্লাসের দরকারই ছিল না ওই লোকের… যদি না লোকটা বিখ্যাত কেউ হয়ে থাকে… মানে, সে হয়তো চায়নি, কেউ চিনে ফেলুক তাকে। আরেকটা কথা। মাথায় ক্যাপ পরে ছিল সে। কী কিনেছিল সেদিন, সেটাও মনে আছে আমার।’

‘কী?’

‘মধুর একটা বোতল আর এক প্যাকেট আদা চা। মধুটা স্থানীয়… আমিই ওটা কিনতে বলেছিলাম ওই লোককে।’

‘তারপর কী হলো?’

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ট্র্যাভের্টন। ‘আর তেমন কিছু বলার নেই। ওই আয়া মেয়েটা হাঁটু গেড়ে বসে ছিল দুর্ঘটনাস্থলে। দুটো বাচ্চার মধ্যে একটা বাচ্চা বেঁচে ছিল। ওকে চোখ খুলতে দেখলাম আমি। ‘বাবা’ বলে ডেকে উঠল সে। ব্যাপারটা খুবই করুণ… আসলেই! পুলিশ এল একসময়, হাজির হলো একটা অ্যাম্বুলেন্সও। আসতে বেশি সময় লাগেনি তাদের। আর কিছু করার নেই বুঝে দোকানে ফিরে এলাম তখন। উপরতলায় গিয়ে এক কাপ চা খেলাম। মোটেও ভালো লাগছিল না আমার। এবং এই যে এখন ঘটনাটা বলছি আপনাদেরকে… এখনও ভালো লাগছে না।

.

ফার্মেসি থেকে হেঁটে আমরা হাজির হলাম কিছুটা দূরের রয়্যাল হোটেলে। একেবারে চুপ করে আছে হোথর্ন। ওর নিজেরও এগারো বছর বয়সী একটা ছেলে আছে। এইমাত্র যে-কাহিনি শুনলাম আমরা, সেটা খুব সম্ভব প্রভাব বিস্তার করেছে ওর মনে। তবে একটা কথা বলতেই হয়… ওকে দেখে কিন্তু দুঃখিত বা বিষণ্ণ বলে মনে হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে, ফিরে যাওয়ার জন্য তাড়া অনুভব করছে যেন।

লাউঞ্জের মতো একটা জায়গায় ঢুকে পড়লাম। শুধু কোনো ইংলিশ সমুদ্রতীবরর্তী-হোটেলেই দেখা যায় এ-রকম জায়গা… নিচু ছাদ, কাঠের মেঝের জায়গায় জায়গায় ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে কিছু রাগ, আরও আছে আরামদায়ক কিছু লেদার ফার্নিচার। তবে এই জায়গা… দেখে আশ্চর্য লাগল আমার… লোকে ভর্তি। তাদের বেশিরভাগই বয়স্ক দম্পতি। খুব উৎসাহ নিয়ে স্যান্ডউইচ আর বিয়ার খাচ্ছে সবাই। ঘরের ভিতরে এত গরম যে, সহ্য করতে পারছি না। এককোনায় পুরোদমে চলছে একটা রেডিয়েটর, গ্যাসের আগুন জ্বালানো হয়েছে সেখানে।

নিজেদের জন্য পথ করে নিয়ে রিসিপশন এরিয়ার দিকে এগিয়ে গেলাম আমরা। স্থানীয় একটা মেয়ে কাজ করছে সেখানে, বন্ধুবৎসল ভাব আছে তার চেহারায়। হোথর্নের কথা শুনে বলল আমাদেরকে সাহায্য করতে পারবে না, তবে ফোন করল হোটেলের ম্যানেজারকে। নিচতলার বারে ছিলেন মহিলা, উঠে এলেন উপরে।

তাঁর নাম মিসেস রেন্ডেল। বারো বছর ধরে আছেন রয়্যাল হোটেলে, কিন্তু বিশেষ সেই দুর্ঘটনার দিন ছিলেন না এখানে। তবে মেরি ও’ব্রায়্যান আর জেরেমি- টিমোথির সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাঁর।

‘লক্ষ্মী বাচ্চা ছিল ওরা,’ বললেন তিনি। ‘ওদের ব্যবহার খুব ভালো ছিল। হোটেলের দ্বিতীয় তলায় একটা ফ্যামিলি রুমে উঠেছিল। একটা কিং সাইজের বেড আর বাঙ্ক ছিল ওখানে। রুমটা কি দেখতে চান আপনারা?’

‘না,’ বলল হোথর্ন।

‘ওহ্,’ দেখে মনে হলো, হোথর্নের কথায় মনে চোট পেয়েছেন মিসেস রেন্ডেল। তারপরও বলে চললেন, ‘আমার মনে আছে, যেদিন এই হোটেলে উঠেছিল ওরা, সেদিন ছিল বুধবার। আর দুর্ঘটনাটা ঘটল তার পরের দিন। সত্যি বলতে কী, ওই রুম নিয়ে খুশি ছিল না মিস ও’ব্রায়্যান। কারণ সেখান থেকে সমুদ্র দেখা যায় না। লাগোয়া দরজা আর ডাবল বেড আছে এ-রকম একটা টুইন রুমের জন্য অনুরোধ করেছিল মেয়েটা। কিন্তু আমাদের হোটেলে ও-রকম কোনো রুম নেই, তা ছাড়া বাচ্চা দুটো ছেলেকে কোনো ঘরে একা ঘুমাতে দেয়াটা সম্ভব ছিল না আমাদের পক্ষে। যা-হোক, মেয়েটাকে ঠিক পছন্দ হয়নি আমার। তাকে বিশ্বাস করতে পারিনি। বলতে খারাপই লাগছে, আবার না-বলেও পারছি না… আমার সেই অবিশ্বাস সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। বাচ্চা দুটোকে ধরে রাখা উচিত ছিল তার। কিন্তু সেটা না-করে ওদেরকে দৌড়ে রাস্তায় নেমে যেতে দিল সে, এবং তার ফলেই…। আর সে-কারণেই আমার মনে হয় না, ওই দুর্ঘটনার জন্য দোষ দেয়া যায় মিসেস ক্যুপারকে।’

‘তাঁকে চিনতেন আপনি?’

‘অবশ্যই। প্রায়ই লাঞ্চ বা ডিনার খেতে আমাদের এই হোটেলে আসতেন তিনি। বেশ কমনীয় ছিলেন, তার চেয়েও বড় কথা, বিখ্যাত একটা ছেলে ছিল তাঁর।’

হঠাৎ করেই টের পেলাম, এই হোটেলে আর থাকতে ইচ্ছা করছে না আমার। তাই হোথর্ন যখন মিসেস রেন্ডেলকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল আর-কিছু জিজ্ঞেস করার নেই ওর, খুশি হলাম তখন।

হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে এলাম আমরা দু’জন।

১৯. মিস্টার টিবস

পরদিন যে দেখা হয়ে যাবে হোথর্নের সঙ্গে, আশা করিনি। তাই যখন ফোন করল সে আমাকে, আশ্চর্য হলাম। ব্রেকফাস্টের কিছুক্ষণ পর এল ওর কলটা।

‘আজ সন্ধ্যায় কিছু করছেন?’

‘হ্যাঁ, কাজ আছে,’ বললাম আমি। ‘আমার একটু আসা দরকার।’

‘কোথায়? আমার এখানে?’

‘হ্যাঁ।’

‘কেন?’

হোথর্ন আগে কখনও আমার লন্ডনের-ফ্ল্যাটে আসেনি। এবং সে যে আসেনি, সেজন্য আমি খুশি। সুকৌশলে একটু একটু করে ঢুকতে চেয়েছি আমি ওর জীবনে, কখনও চাইনি উল্টোটা ঘটুক। এখনপর্যন্ত নিজের বাসার ঠিকানাটা পর্যন্ত বলেনি সে আমাকে। সত্যি বলতে কী, সে জেনেশুনে ভুল পথে পরিচালিত করেছে আমাকে। বলেছে, ওর বাসা নাকি গ্যান্টস হিলে। অথচ ব্ল্যাকফায়ার্সের রিভার কোর্টে একটা ফ্ল্যাট আছে ওর। আমি চাই না, সে ওর গোয়েন্দা-নজরটা ফেলুক আমার বাসার উপর। চাই না, পরে আমারই কোনো কিছু ব্যবহার করুক আমার বিরুদ্ধে।

আমি যে ইতস্তত করছি, সেটা বোধহয় লাইনের ওপ্রান্তে থেকেও টের পেয়ে গেল সে। ব্যাখ্যা করার কায়দায় বলল, ‘একটা মিটিঙের আয়োজন করতে চাই আসলে। এবং আমি চাই, সেটা নিরপেক্ষ কোনো জায়গায় হোক!

‘ওই মিটিং আপনার বাসায় হলে সমস্যা কী?

‘মিটিংটা আমার বাসায় করা ঠিক হবে না আসলে।’ একটুখানি থামল সে। ‘ডিলে আসলে কী ঘটেছিল, সে-ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্তে এসেছি আমি। এবং সেটার সঙ্গে যে আমাদের তদন্তের সম্পর্ক আছে, আমার মনে হয় সে-ব্যাপারে একমত হবেন আপনি।’

‘কার সঙ্গে মিটিং করতে চান?’

সেটা তাঁদের দু’জনকে দেখলেই জানতে পারবেন।’ শেষ আরেকবার অনুরোধ করল হোথর্ন। ‘ব্যাপারটা জরুরি।

ঘটনাক্রমে আজ সন্ধ্যায় আমি একাই আছি বাসায়। আমার মনে হলো, কোথায় থাকি সেটা যদি দেখতে দিই হোথর্নকে, তা হলে সে কোথায় থাকে, তা দেখতে দেয়ার ব্যাপারে বলেকয়ে রাজি করাতে পারবো ওকে। নদীর দিকে মুখ করে আছে এ-রকম কোনো ফ্ল্যাটে থাকার আর্থিক সামর্থ্য হয় কী করে ওর, জানার খুব ইচ্ছা আমার। অথচ মিডোস বলেছে, ওই ফ্ল্যাট নাকি হোথর্নের নিজের না।

‘কখন?’ জানতে চাইলাম।

‘বিকেল পাঁচটায়।’

‘ঠিক আছে। বললাম বটে, কিন্তু ইতোমধ্যেই ভুগতে শুরু করেছি অনুশোচনায়। ‘আগেই বলে রাখি… এক ঘণ্টার বেশি সময় দিতে পারবো না।’

‘ঠিক আছে,’ লাইন কেটে দিল হোথর্ন।

সকালের বাকি সময়টা আমাদের তদন্তের বিভিন্ন নোট টাইপ করার কাজে ব্যয় করলাম… ব্রিটানিয়া রোড, কর্নওয়ালিস অ্যান্ড সন্স, দ্য সাউথ অ্যাক্টন এস্টেট। কারও কারও কথা নিজের আইফোনে রেকর্ড করে নিয়েছিলাম; ওটা কানেক্ট করলাম আমার কম্পিউটারের সঙ্গে, হেডফোনের মাধ্যমে শুনতে লাগলাম হোথর্নের আকর্ষণহীন আর ছলনাপূর্ণ কণ্ঠ। ডজনখানেকের মতো ফটোও তুলেছি, দেখতে লাগলাম ওগুলো। যা যা দেখেছি এই কেসে, নিজেকেই যেন মনে করিয়ে দিচ্ছি সেগুলো। এই কেসে, বলা বাহুল্য, যা যা দরকার, তার চেয়ে অনেক বেশি মালমশলা ছিল আমার কাছে এবং আমি নিশ্চিত সেগুলোর নব্বই শতাংশই অপ্রাসঙ্গিক।

আসলে এ-রকম কোনো পদ্ধতিতে আগে কখনও কাজ করিনি আমি। সাধারণত যখন কোনো উপন্যাস বা টিভি স্ক্রিপ্টের পরিকল্পনা করি, কী-কী দরকার তা ভালোমতোই জানা থাকে আমার। অপ্রয়োজনীয় বর্ণনা দিতে গিয়ে সময় নষ্ট করি না তখন। কিন্তু হোথর্নের মাথায় কী চলছে তা যেহেতু জানা নেই আমার, সেহেতু কোটা প্রয়োজনীয় আর কোটা অপ্রয়োজনীয় বুঝবো কী করে? ফলে এই কেসের তদন্তের কাজে যেসব জায়গায় গেছি, সেসব জায়গায় যা-যা দেখেছি তার প্রায় সব কিছুই লিখতে হয়েছে আমাকে।

আমি এখনও নিশ্চিত, অ্যালান গডউইনই খুনি। ওই লোক যদি খুনি না-হবে, তা হলে আর কে খুন করে থাকতে পারে মিসেস ক্যুপার আর তাঁর ছেলেকে? নিজের ডেস্কের ধারে বসে থেকে কথাটা আপনমনেই জিজ্ঞেস করলাম নিজেকে।

জুডিথ গডউইন… উদাহরণ হিসেবে কি বলা যায় ওই মহিলার কথা? ডায়ানা ক্যুপার আর তাঁর ছেলেকে খুন করার পেছনে যে-মোটিভ আছে অ্যালান গডউইনের, প্রায় একই মোটিভ আছে জুডিথেরও।

খুনির ব্যাপারে কী বলেছিল হোথর্ন, ভাবতে লাগলাম। হাতড়াতে শুরু করলাম আমার কাগজগুলো, নির্দিষ্ট কাগজটা খুঁজে পেতে বেশি সময় লাগল না। আমি যা বলছি মেনে নিন– খুনি একজন পুরুষ। মেয়েরাও যে মেয়েদেরকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে, জানি আমি; তারপরও… মিসেস ক্যুপারের বেলায় ঘটনাটা অস্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে।

এখন কথা হচ্ছে, কোনো কিছু অস্বাভাবিক হলেই কি সেটা অসম্ভব হয়ে যায়?

সুতরাং জুডিথ গডউইন খুন করে থাকতে পারেন ডায়ানা ক্যুপার আর তাঁর ছেলেকে। আবার মেরি ও’ব্রায়ানও করে থাকতে পারে কাজটা। গত দশটা বছর ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে চলেছে সে গডউইন পরিবারে। বোঝাই যায়, প্রচণ্ড ভালোবাসে সে জেরেমিকে। ভালোবাসত টিমোথিকেও। অন্ধ সেই ভালোবাসাই কি কারও প্রাণহরণের কাজে উদ্বুদ্ধ করেছিল তাকে?

জেরেমি গডউইন কি করে থাকতে পারে খুন দুটো? হতে পারে, সবাই তাকে যে-রকম অসহায় ভাবে, আসলে ততটা অসহায় না সে। শারীরিকভাবে অক্ষম কত খুনিরই তো বর্ণনা পাওয়া যায় দেশ-বিদেশে।

গ্রেস লোভেলের কথাই বা বাদ দিই কী করে? মুখে যদিও বলেনি সে, কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে হয়েছে, শাশুড়ির সঙ্গে তেমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল না তার। ওদিকে ওই অভিনেত্রী মেয়েটার উপরও কোনো টান ছিল না মিসেস ক্যুপারের… নাতনি অ্যাশলিই ছিল তাঁর সব আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। বাচ্চা ওই মেয়ের কারণেই শেষ হয়ে গিয়েছিল গ্রেসের অভিনয়-ক্যারিয়ার। শুধু তা-ই না, পত্রপত্রিকায় যেসব খবর ছাপা হয়েছিল, সেগুলো যদি সত্যি হয়ে থাকে, তা হলে স্বীকার করে নিতেই হবে, আদর্শ পার্টনার বলতে যা বোঝায়, সেটার সঙ্গে যোজন যোজন দূরত্ব ছিল ড্যামিয়েনের। সোজা কথায় তার সঙ্গে গ্রেসের সম্পর্কটা ছিল কেবল শারীরিক, মানসিক দিক দিয়ে যথেষ্ট দূরত্ব ছিল তাদের দু’জনের মধ্যে। ড্রাগস, পার্টি, শোগার্ল… এসব নিয়ে আমেরিকায় ব্যস্ত ছিল ড্যামিয়েন, হয়তো ঠিকমতো সময় দিতে পারত না গ্রেসকে।

সুযোগ পাওয়ামাত্র সে-বঞ্চনারই কি শোধ তুলেছে মেয়েটা? ড্যামিয়েনকে খুন করার জন্য সেটাই কি মোটিভ তার? কিন্তু একইসঙ্গে এ-কথাও ভুললে চলবে না, ডায়ানা ক্যুপারকে যখন খুন করা হয়, তখন আমেরিকায় ছিল মেয়েটা।

আসলেই?

আরও একবার হাতড়াতে লাগলাম আমার নোটগুলো। যা খুঁজছিলাম, তা পেয়েও গেলাম একসময়।

একবার একটা কথা বলেছিল ড্যামিয়েন ক্যুপার। এবং যখন বলেছিল সে কথাটা, তখন ততটা গুরুত্ব পায়নি সেটা। কিন্তু এখন কেন যেন ওই কথা খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে আমার।

গ্রেস অভিযোগ জানিয়ে বলেছিল, লস অ্যাঞ্জেলসে ফিরে যেতে চায় না সে। তার বাবা-মায়ের সঙ্গে আরও বেশি করে সময় কাটাতে চায় সে। ড্যামিয়েন তখন বলেছিল, তাদের সঙ্গে ইতোমধ্যেই একটা সপ্তাহ কাটিয়ে ফেলেছ তুমি, বেইব।

সন্তুষ্টি অনুভব করছি আমি। কিছুই মিস করিনি! এমনও হতে পারে, এই কেস সমাধান করার ব্যাপারে হোথর্নকে ছাড়িয়ে গেছি। হতে পারে, ড্যামিয়েনের চেয়ে নয়-দশ দিন আগেই ইংল্যান্ডে চলে এসেছিল গ্রেস। তার মানে যেদিন খুন হয়েছেন ডায়ানা ক্যুপার, সেদিন এ-দেশেই ছিল মেয়েটা।

কিন্তু একটা ব্যাপার মিলছে না। মিসেস ক্যুপারের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের পরে মেয়েটাকে ফুলহ্যাম রোডের ওই পাবে রেখে ব্রিক লেনের উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছিলাম আমি আর হোথর্ন। আমার মনে আছে, কী সাংঘাতিক যানজট ছিল তখন। ড্যামিয়েনকে খুন করতে হলে আমাদের আগে ব্রিক লেনের ওই ফ্ল্যাটে হাজির হতে হবে গ্রেসকে। প্রশ্ন হচ্ছে, সেটা সে করল কী করে?

সেদিনের সেই শেষকৃত্যে আর কে কে ছিল?

রবার্ট কর্নওয়ালিস অথবা আইরিন লযের যে-কেউ ওই মিউযিক প্লেয়ারটা ঢুকিয়ে থাকতে পারেন কফিনের ভিতরে। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রশ্ন রয়ে যায়… কেন করতে যাবেন তাঁরা কাজটা? ডায়ানা ক্যুপার যেদিন খুন হয়েছেন, সেদিনই তাঁর সঙ্গে প্রথমবার দেখা হয়েছে ওই দু’জনের। তাদের কারও কোনো লাভ হয়নি ওই মহিলা কিংবা তাঁর ছেলের মৃত্যুতে।

সারাটা দিন মেতে থাকলাম আমার সেই নোটগুলো নিয়ে। ঘড়ির দিকে তাকানোর মতো সময়ই পেলাম না। পাঁচটা বাজতে যখন মিনিট পনেরো বাকি, তখন বেজে উঠল ডোরবেল।

যে-বিল্ডিঙে থাকি আমি, সেটার পঞ্চম তলায় কাজ করি… মানে লেখালেখি করি। একটা ইন্টারকম আছে আমার এখানে, সেটা সরাসরি যুক্ত হয়েছে রাস্তার সঙ্গে। আমাদের বাসায় যদি কেউ আসে, তার সঙ্গে ওই ইন্টারকমের মাধ্যমে কথা যায়।

মনে পড়ে গেল হোথর্নের কথা। বুঝলাম, হাজির হয়ে গেছে সে।

‘সুন্দর জায়গা,’ ভিতরে ঢুকে বলল সে। ‘তবে আমার মনে হয় না ড্রিঙ্কের কোনো দরকার আছে।’

অতিথি আসবে বাসায়; তাই মিনারেল ওয়াটার, কমলার জুস আর কয়েকটা গ্লাস রেখেছি আমি। হোথর্নের কথামতো ওগুলো নিয়ে গিয়ে ঢুকিয়ে রাখছি ফ্রিজে, এমন সময় খেয়াল করলাম, আমার লিভিংরুমটা ভালোমতো দেখছে সে।

একটা কফি টেবিল ঘিরে দুটো সোফা আছে, ওগুলোর একটাতে বসে পড়ল হোথর্ন। ওকে দেখে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত বলে মনে হচ্ছে।

‘ডিলে ঠিক কী ঘটেছিল, সেটা তা হলে জানা হয়ে গেছে আপনার,’ বললাম আমি। ‘তা হলে… ডায়ানা ক্যুপারকে কে খুন করেছে, সেটা কি জানতে পারি?’

মাথা নাড়ল হোথর্ন। ‘এখনই না। তবে কথাটা যখন বলবো আপনাকে, ইন্টারেস্টিং লাগবে আপনার কাছে। যা-হোক, ভালো একটা খবর আছে আমার কাছে।

‘কী?’

‘মিস্টার টিবসকে পাওয়া গেছে।

‘মিস্টার টিবস?’ নামটা কীসের, মনে করতে কয়েক সেকেন্ড লেগে গেল আমার। ‘মিসেস ক্যুপারের বিড়ালটার কথা বলছেন?’

‘হ্যাঁ। মিসেস ক্যুপারের সেই পার্শিয়ান গ্রে।’

‘কোথায় আছে ওটা?’

‘স্কাইলাইট দিয়ে ওই মহিলার এক প্রতিবেশীর বাসায় ঢুকে পড়েছিল। তারপর আর বের হতে পারেনি। ওই প্রতিবেশী ভদ্রলোক আবার বেড়াতে গিয়েছিলেন দক্ষিণ ফ্রান্সে, তিনি বাসায় ফিরে এসে খুঁজে পান বিড়ালটাকে। তারপর ফোন করেছেন আমাকে।

‘হ্যাঁ… খবরটা মনে হয় ভালোই।’ বললাম বটে, কিন্তু এই কেসের সঙ্গে ডায়ানা ক্যুপারের বিড়ালের কী সম্পর্ক, বুঝতে পারছি না। এমন সময় একটা চিন্তা খেলে গেল আমার মাথায়। ‘এক মিনিট। যতদূর মনে পড়ে, মিসেস ক্যুপারের এক প্রতিবেশী একজন উকিল… ‘

‘মিস্টার গ্রসম্যান।

‘তিনি কেন ফোন করলেন আপনাকে? আপনি কে, সেটাই বা জানলেন কী করে তিনি?’

‘তাঁর সদর-দরজার নিচ দিয়ে একটা নোট ঠেলে দিয়েছিলাম আমি ভিতরে। সত্যি বলতে কী, ব্রিটানিয়া রোডের সবগুলো বাসার সদর-দরজার নিচ দিয়েই একটা করে নোট ঠেলে দিয়েছিলাম। ওসব বাড়ির বাসিন্দাদের কেউ দেখতে পেয়েছিল কি না বিড়ালটাকে, সেটাই জানতে চেয়েছিলাম আসলে।’

‘কেন?’

‘মিস্টার টিবসের কারণেই সব কিছু ঘটেছে, টনি। মিস্টার টিবস যদি হারিয়ে না-যেত, তা হলে খুন হতেন না মিসেস ক্যুপার। খুন করা হতো না তাঁর ছেলেকেও।’

আমি নিশ্চিত, মশকরা করছে হোথর্ন। অথচ ওকে দেখে তা মনে হচ্ছে না। আমার সামনেই বসে আছে সে; আক্রোশ আর আত্মকেন্দ্রিকতার যে-অদ্ভুত শক্তিমত্তা দেখা যায় ওর ভিতরে, দেখতে পাচ্ছি সেটা… সে-শক্তির কারণে ওকে ঠিক বুঝে উঠতে পারি না বেশিরভাগ সময়। এইমাত্র যা বলেছে সে, সে-ব্যাপারে ওকে চ্যালেঞ্জ জানানোর আগেই দ্বিতীয়বারের মতো বেজে উঠল ডোরবেলটা।

‘দরজা খুলবো?’ জিজ্ঞেস করলাম।

হাত নাড়ল হোথর্ন। ‘এই বাসা আপনার।’

এগিয়ে গিয়ে তুলে নিলাম ইন্টারকম টেলিফোনটা। ‘হ্যাঁ, বলুন?’

‘আমি অ্যালান গডউইন।’

উত্তেজনার উত্তাল একটা তরঙ্গ যেন টের পেলাম নিজের ভিতরে। উপরে আসতে বললাম আমার প্রথম অতিথিকে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির হয়ে গেলেন গডউইন। কাপড়ের উপরে একটা রেইনকোট পরেছেন, সেটা তাঁর শরীরের তুলনায় বেশ বড় দেখাচ্ছে। মনে পড়ে গেল, এই কোট তিনি মিসেস ক্যুপারের শেষকৃত্যের দিনও পরেছিলেন। এমন এক ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকলেন, দেখে মনে হলো, ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কোনো আসামি।

আমি প্রায় নিশ্চিত, ক্যান্টেব্রিতে যাওয়ার পথে হোথর্ন আমাকে যা-ই বলে থাকুক না কেন, সে আজ এখানে গডউইনকে ডেকে এনেছে একটা মাত্র কারণে… সে-ও আমার মতোই ভাবছে, গডউইনই খুনি। এবং কথাটা আজ সরাসরি বলবে সে। আজ নিজের সব গোপন কথা প্রকাশ করবে আমার সামনে। মনে পড়ে গেল, আরও একজনের আসার কথা আছে। তার মানে… খুনের কাজে কি কোনো সহযোগী ছিল গডউইনের?

‘কী চান আপনি?’ জিজ্ঞেস করলেন গডউইন, সোজা এগিয়ে গেছেন হোথর্নের দিকে। ‘বলেছেন, আমাকে বলার মতো নাকি কিছু কথা আছে আপনার। সেসব কথা ফোনে কেন বলতে পারলেন না?’ এদিক-ওদিক তাকালেন তিনি, চারপাশটা দেখে নিলেন একনজর। ‘আপনি কি এখানেই থাকেন?’

‘না,’ ইঙ্গিতে আমাকে দেখিয়ে দিল হোথর্ন। ‘তিনি থাকেন।’

গডউইন বোধহয় বুঝতে পারলেন, আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পরও আমার ব্যাপারে কিছুই জানেন না তিনি। ‘আপনি কে?’ দাবি জানানোর ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন। ‘নিজের নামটা আমাকে বলেননি কখনও।’

সৌভাগ্যক্রমে ডোরবেলটা বেজে উঠল আবারও, জবাব দেয়ার জন্য দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলাম।

কিন্তু এবার ইন্টারকমের ও-প্রান্তে নীরবতা।

‘আপনি কি হোথর্নের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি। ‘হ্যাঁ,’ জবাব দিল একটা নারীকণ্ঠ।

‘একটা বাটন চেপে দরজা খুলে দিচ্ছি। সিঁড়ি বেয়ে চলে আসুন উপরতলায়।’

‘কে এসেছে?’ জিজ্ঞেস করলেন গডউইন, তাঁর কণ্ঠের ভীতি স্পষ্ট টের পেলাম। এবং এ-ও বুঝতে পারলাম, যে এসেছে তার পরিচয় জানা আছে তাঁর।

‘আপনি বসে পড়ছেন না কেন, মিস্টার গডউইন?’ বলল হোথর্ন। ‘আপনি যদিও আমাকে বিশ্বাস করবেন না, তারপরও বলি… আমি কিন্তু আসলে আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছি। কিছু লাগবে আপনার?’

‘জুস আছে আমার বাসায়,’ বললাম আমি।

‘পানি খাবো,’ টেবিলের আরেকপ্রান্তে বসে পড়লেন গডউইন। হোথর্নের মুখোমুখিই বসেছেন, কিন্তু ওর সঙ্গে যাতে চোখাচোখি না-হয় সে-ব্যাপারে সতর্ক আছেন।

পানি আর জুস দুটোই সরিয়ে রাখতে বলেছিল হোথর্ন; গিয়ে পানি নিয়ে এলাম গডউইনের জন্য। ঠিক তখনই পায়ের আওয়াজ শুনতে পেয়ে মুখ তুলে তাকালাম।

ঘরে ঢুকছে মেরি ও’ব্রায়ান।

কল্পনাও করিনি, ওই মেয়েকে এখন এই সময়ে দেখতে হবে আমার এখানে।

আমাদের দিকে দু’কদম এগিয়ে এল সে, তারপরই থেমে দাঁড়িয়ে পড়ল স্থাণুর মতো। একটা মুহূর্ত আগেও হয়তো নার্ভাস আর অনিশ্চিত ছিল সে, কিন্তু এখন তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার উপর বজ্রপাত হয়েছে যেন। অ্যালান গডউইনকে দেখতে পেয়েছে, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে। গডউইন নিজেও কোনো অংশে কম চমকাননি মেরির চেয়ে, তিনিও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মেয়েটার দিকে।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল হোথর্ন। শয়তানি কিছু-একটা দেখা যাচ্ছে ওর চেহারায়… এমন একজাতের উল্লাস দেখতে পাচ্ছি সেখানে, যা আগে কখনও দেখিনি। বলল, ‘আমার ধারণা আপনারা দু’জন চেনেন একজন আরেকজনকে।’

বজ্রাহত অবস্থা থেকে আগে সামলে নিলেন অ্যালান গডউইন। ‘অবশ্যই আমরা চিনি একজন আরেকজনকে। আপনি আসলে কী বোঝাতে চাইছেন, বলুন তো?’

‘আমার ধারণা কী ঘটছে এখানে, সেটাও জানেন আপনি, অ্যালান। মেরি, আপনি বসছেন না কেন? আপনাদের দু’জনকে যদি নাম ধরে ডাকি, অসুবিধা আছে? আসলে আমরা এখানে যারা আছি এখন, সবাই একজন আরেকজনের বন্ধু… ঠিক না?’

‘কিছুই বুঝতে পারছি না আমি!’ নিজেকে সামলে রাখার চেষ্টা করছে মেরি ও’ব্রায়ান, কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আর কিছুক্ষণের মধ্যে কান্নায় ভেঙে পড়বে। গডউইনের দিকে তাকাল। ‘আপনি কেন এসেছেন এখানে?’

ইঙ্গিতে হোথর্নকে দেখিয়ে দিলেন গডউইন। ‘তিনি আসতে বলেছেন।’

গডউইন আর মেরি… দু’জনকেই কেমন অপরাধীর মতো দেখাচ্ছে। একইসঙ্গে মনে হচ্ছে, তাঁরা রেগে গেছেন… ভয়ও পেয়েছেন।

উঠে দাঁড়ালেন গডউইন। ‘এখানে আর থাকছি না আমি। মিস্টার হোথর্ন, আপনি যে-খেলায় মেতেছেন, সেটা নিয়ে কোনো পরোয়া নেই আমার। ওই খেলায় অংশ নিতে আমি রাজি না।’

‘খুব ভালো কথা, অ্যালান। কিন্তু আপনি যদি এই ঘর থেকে বেরিয়ে যান, পুলিশ জেনে যাবে সব কথা। এবং তারপর আপনার স্ত্রীও জানতে পারবেন।’

বরফের মতো জমে গেলেন গডউইন। মেরিও নড়ছে না।

ঘরের ভিতরের পুরো পরিস্থিতি এখন হোথর্নের নিয়ন্ত্রণে।

‘বসে পড়ুন,’ বলল সে। ‘গত দশ বছর ধরে আপনারা দু’জন গোপনে আঁতাত করছেন, এবং মিথ্যা কথা বলছেন সবার কাছে। কিন্তু আজ সেই খেল খতম। আর সে-কারণেই আপনাদেরকে ডেকে আনা হয়েছে এখানে।’

আবারও বসে পড়লেন গডউইন। গিয়ে তাঁর পাশে বসে পড়ল মেরি, তবে দূরত্ব বজায় রেখেছে।

খেয়াল করলাম, মেয়েটা বসামাত্র, গডউইন নিঃশব্দে বলে উঠলেন, ‘আমি দুঃখিত।’ তাঁর ঠোঁট নাড়ানোর ভঙ্গি দেখে বুঝে ফেললাম কথাটা। এবং এ-ও বুঝতে পারলাম, গডউইন আর মেরি আসলে প্রেমিক-প্রেমিকা। আরও বুঝতে পারলাম, এই ব্যাপারটা সন্দেহ করেছিলেন জুডিথ গডউইন। আর সে-কারণেই মন কষাকষি হয়েছিল ওই দুই মেয়েমানুষের মধ্যে।

পিয়ানো স্টুলটার উপর বসে পড়লাম আমি। এখন ঘরের ভিতরে কেবল হোথৰ্নই দাঁড়িয়ে আছে!

‘ডিলে যা ঘটেছিল,’ শুরু করল সে, ‘তা খতিয়ে দেখা দরকার আমাদের। কারণ পুরো কাহিনি কম করে হলেও ছ’বার শুনেছি আমি। কিন্তু আপনারা দু’জন যা বলেছেন ওই ব্যাপারে, তা মিথ্যা ছাড়া আর কিছু না। যা-হোক, এখন আপনারা ফেঁসে গেছেন, এবং এই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই আপনাদের। আমার খারাপ লাগা উচিত ছিল আপনাদের জন্য, কিন্তু লাগছে না।

সিগারেটের প্যাকেট বের করল সে পকেট থেকে, একটা ধরাল। কিচেনে গিয়ে ঢুকলাম আমি, একটা অ্যাশট্রে নিয়ে এলাম। ওটা রাখলাম টেবিলের উপর যাতে ব্যবহার করতে পারে।

‘এই লীলাখেলা কবে থেকে শুরু করলেন আপনারা?’ জিজ্ঞেস করল হোথর্ন। নীরবতা।

কাঁদতে শুরু করেছে মেরি।

হাত বাড়িয়ে দিয়ে ওই মেয়ের একটা হাত ধরতে চাইলেন অ্যালান গডউইন, কিন্তু টান মেরে হাতটা সরিয়ে নিল সে।

গডউইন বুঝে গেছেন, আর ভান করে কোনো লাভ নেই। হোথর্নের প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘মেরি আমাদের ওখানে কাজ শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই। আসলে… আমিই শুরু করেছিলাম এসব। সম্পূর্ণ দায় নিজের উপর নিচ্ছি আমি।’

‘সব শেষ হয়ে গেছে এখন,’ নিচু গলায় বলল মেরি। ‘অনেকদিন হলো সব কিছু শেষ হয়ে গেছে আমাদের মধ্যে।

‘সত্যি বলতে কী,’ মুখ খুলল হোথর্ন, ‘আপনাদের মাঝখানের এই অনৈতিক সম্পর্কের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র পরোয়া নেই আমার। আমি শুধু সত্যি কথাটা জানতে চাই। …ডায়ানা ক্যুপার হয়তো ভুলে তাঁর চশমা ফেলে এসেছিলেন, কিন্তু বাচ্চা দুটো দৌড়ে রাস্তা পার হতে চেয়েছিল আপনাদের দু’জনের কারণেই। বলুন, ঠিক না?’

মাথা ঝাঁকাল মেরি। তার গাল বেয়ে অশ্রু নামছে।

আমার দিকে তাকাল হোথর্ন। ‘একটা সত্যি কথা বলি আপনাকে, টনি আপনাকে নিয়ে যখন ডিলে গেলাম, অনেক কিছুই আমার বোধগম্য হচ্ছিল না। যেমন, বাচ্চা দুটো ওই আইসক্রিমের দোকানে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রাস্তা পার হওয়ার জন্য ছুট লাগিয়েছিল। কিন্তু দোকানটা তখন ছিল বন্ধ। শুধু তা-ই না, পানিতে ভেসে গিয়েছিল সেটা, ইলেকট্রিক লাইনেও সমস্যা হয়েছিল। তার মানে দোকানের ভিতরে তখন ছিল অন্ধকার। আমি জানি বাচ্চা দুটোর বয়স তখন মাত্র আট বছর। তারপরও… কোনো দোকান বন্ধ নাকি খোলা, সেখানে গেলে আইসক্রিম পাওয়া যাবে কি যাবে না… এসব বুঝবার মতো বুদ্ধি নিশ্চয়ই ছিল তাদের? তারপরও তারা দৌড় দিল, এবং গিয়ে পড়ল মিসেস ক্যুপারের গাড়ির নিচে। একজন মারা গেল সেখানেই। আরেকজন পড়ে থাকল গুরুতর আহত অবস্থায়। এবার ওষুধের দোকানের মিস্টার ট্রাভের্টনের কথা অনুযায়ী, বেঁচে থাকা বাচ্চাটা ওর বাবাকে ডাকতে লাগল। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, ও-রকম অবস্থায় কোনো বাচ্চাই ওই কাজ করবে না। কোনো বাচ্চা যখন আহত হয়, সে তার মাকে চায়… সে তার মাকে ডাকে। কাজেই, ঠিক কী হচ্ছিল তখন সেখানে?’

একটুখানি থামল সে।

কেউ কিছু বলছে না।

আমার মনে হচ্ছে, পুরো পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়েছে হোথর্ন। মনে হচ্ছে, এই ফ্ল্যাট শুধু আমারই না, ওরও। অস্বীকার করার উপায় নেই, চুম্বকের মতো কোনো একজাতের ব্যক্তিত্ব আছে হোথর্নের। এবং এ-কথাও অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, চুম্বক শুধু আকর্ষণই করে না, বিকর্ষণও করে।

‘চলুন একেবারে শুরুতে ফিরে যাই,’ বলছে সে। ‘বাচ্চা দুটোকে ডিলে নিয়ে গেলেন মেরি। তাদের মায়ের একটা কনফারেন্স ছিল। আর বাবা একটা বিযনেস ট্রিপে গিয়েছিলেন ম্যানচেস্টারে। ছেলে দুটোকে নিয়ে রয়্যাল হোটেলে উঠলেন মেরি। একটা ফ্যামিলি রুম বরাদ্দ দেয়া হলো তাঁদেরকে, কিন্তু সেটা পছন্দ হলো না তাঁর। তিনি বাচ্চা দুটোর জন্য চেয়েছিলেন একটা টুইন রুম। আর নিজের জন্য চেয়েছিলেন একটা ডাবল রুম। এবার, টনি, আপনিই বলুন, ও-রকম কেন চাইলেন মেরি?’

‘হোটেল থেকে আমাদেরকে বলা হয়েছে, ওই ফ্যামিলি রুম থেকে নাকি সাগর দেখা যায় না।’

‘সাগর দেখা যাওয়া না-যাওয়ার সঙ্গে এসবের কোনো সম্পর্ক নেই আসলে। …মেরি, আসল ঘটনাটা আপনিই বলে দিচ্ছেন না কেন টনিকে?’

আমার দিকে তাকাল না মেরি। যখন কথা বলল, আমার মনে হলো কোনো মানুষ না, একটা রোবট কথা বলছে যেন। ‘ডিলে… দেখা করার কথা ছিল আমাদের দু’জনের। একসঙ্গে… থাকার কথা ছিল।

‘ঠিক,’ ব্যঙ্গ ঝরে পড়ল হোথর্নের কণ্ঠে। ‘পুরনো সেই প্রেমকাহিনি … আয়া এবং তার নিয়োগকর্তা। কিন্তু হ্যাঁরো-অন-দ্য-হিলে এসব করার উপায় ছিল না আপনাদের, তাই না? কাজেই আপনারা করলেন কী… চুরি করে একটা উইকএন্ড ম্যানেজ করলেন নিজেদের জন্য, তা-ও আবার সমুদ্রতীরবর্তী কোনো শহরে। ভালোমতোই জানা ছিল আপনাদের, বাচ্চা দুটো ছ’টার মধ্যে শুয়ে পড়ে বিছানায়। অর্থাৎ একসঙ্গে থাকার জন্য সারাটা রাত ছিল আপনাদের হাতে।’

‘আপনি আসলে বিরক্তিকর একটা মানুষ,’ বলে উঠলেন গডউইন। ‘নোংরা সব কথাবার্তা বলছেন।’

‘কেন, নোংরা কোনো কিছু কি করেননি আপনারা?’ ধোঁয়া ছাড়ল হোথর্ন। ‘সেদিন সেই ওষুধের দোকানে একজন রহস্যমানবের আবির্ভাব ঘটেছিল… আপনিই সে-লোক। কী করছিলেন আপনি সেখানে, বলুন তো? যদি বলি, ডায়ানা ক্যুপারের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের সময় যে-কারণে কাঁদছিলেন, ঠিক একই কারণে সেদিন গিয়েছিলেন ওই দোকানে, তা হলে কি ভুল হবে?’

খুব মনমরা দেখাচ্ছে গডউইনকে… কেন, ভাবলাম আমি।

‘আসলে আপনার হে ফিভার (hay fever) আছে। এটা একজাতের অ্যালার্জি… ফুলের রেণু বা ধূলিকণার কারণে হয়। এই অসুখ যাদের আছে, তাদের চোখ আর নাকের মিউকাস মেমব্রেন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়, ফলে চোখ আর নাক দিয়ে সমানে পানি পড়তে থাকে… দেখলে মনে হয় কাঁদছে তারা।’ আমার দিকে তাকাল হোথর্ন। ‘ব্রম্পটন সেমেট্রিতে যখন ছিলাম আমরা, প্লেন ট্রি-গুলো লক্ষ করেছিলেন?’

‘হ্যাঁ। এবং ওই ব্যাপারে নোটও নিয়েছি আমি। মিসেস ক্যুপারের কবরের ঠিক পাশেই ছিল ওই গাছগুলো।

‘আপনার যদি হে ফিভার থাকে, তা হলে প্লেন ট্রি আপনার জন্য সাংঘাতিক খারাপ। কারণ ওসব গাছের পরাগরেণু সরাসরি চলে আসতে পারে আপনার নাকে। …এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের দুটো বহুল-পরিচিত উপায় কি আপনাকে বলে দিতে হবে?’

‘মধু,’ বললাম আমি। ‘আর আদা চা।’

‘এবং ঠিক ওগুলোই ওই ফার্মেসি থেকে কিনেছিলেন অ্যালান সেদিন।’ গডউইনের দিকে তাকাল হোথর্ন। ‘তখন রোদ ঝলমল করছিল না, অথচ সানগ্লাস পরে ছিলেন আপনি। আসলে চাননি কেউ চিনে ফেলুক আপনাকে। আপনার বান্ধবীর সঙ্গে প্রেম করার জন্য ডিলে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। কিন্তু তখন, যে- কোনো কারণেই হোক, হে ফিভারে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। আর তাই সাহায্যের জন্য ওই ওষুধের-দোকানে যেতে হয় আপনাকে। কিছু হার্বাল সামগ্রী কেনার পর ওই দোকান থেকে বেরিয়ে আসেন, আর তখনই ঘটে দুর্ঘটনাটা।

‘আপনার কারণেই ঘটেছিল মর্মান্তিক ওই ঘটনা। আপনার দুই ছেলে তখন ছিল সৈকতসংলগ্ন প্রমেনেডে। কখনও যাতে দৌড়ে রাস্তা পার না-হয়, সেটা বলে দেয়া হয়েছিল ওদেরকে। ওরাও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল, আইসক্রিমের দোকানটা বন্ধ। কিন্তু হঠাৎ করেই ওদের চোখের সামনে হাজির হলো ওদের বাবা… হেঁটে বের হলো সেই ওষুধের দোকানটা থেকে। আপনি তখন ক্যাপ আর সানগ্লাস পরে ছিলেন, তারপরও আপনাকে চিনে নিতে কষ্ট হয়নি বাচ্চা দুটোর। খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল ওরা, ছুট লাগাল আপনার উদ্দেশে। আর ঠিক সে-মুহূর্তেই রাস্তার কোনা ঘুরে বেরিয়ে এল ডায়ানা ক্যুপারের গাড়িটা। এবং মর্মান্তিক সেই দুর্ঘটনাও ঘটল আপনার চোখের সামনেই। আপনার দুটো বাচ্চাই চাপা পড়ল গাড়ির নিচে।’

গুঙিয়ে উঠলেন গডউইন। দুই হাতে চেপে ধরলেন মাথা। নিঃশব্দে ফোঁপাচ্ছে মেরি।

‘টিমোথি মারা গেল,’ বলে চলল হোথর্ন, ‘ঘটনাস্থলে পড়ে ছিল জেরেমি, ‘বাবা, বাবা’ বলে ডাকতে লাগল সে, কারণ কিছুক্ষণ আগে আপনাকে দেখেছিল। অ্যালান, ওই মুহূর্তে আপনার মনের ভিতরে ঠিক কী চলছিল, কল্পনাও করতে পারি না আমি। কারণ আপনি তখন চোখের সামনে দেখেছেন, আপনার দুই ছেলেকে চাপা দিয়ে চলে গেছে একটা গাড়ি। অথচ বাচ্চা দুটোর কাছে যেতে পারছেন না, কারণ তা হলে ফাঁস হয়ে যাবে আপনি আসলে ম্যানচেস্টারে যাননি। বাচ্চা দুটোর কাছে যেতে পারেননি আপনি, কারণ যদি যেতেন তা হলে ডিলে কী করছিলেন সে- ব্যাপারে কী ব্যাখ্যা দিতেন আপনার স্ত্রীর কাছে?’

ওরা যে গুরুতরভাবে আহত হয়েছে, সেটা বুঝতে পারিনি আমি তখন,’ কর্কশ হয়ে গেছে গডউইনের কণ্ঠ। ‘ওদের জন্য আমার কিছু করারও ছিল না আসলে…

বিশ্রী একটা গালি দিল হোথর্ন। ‘কিছু করার ছিল না আপনার, না? দৌড়ে হাজির হতে পারতেন আপনি আপনার ছেলেদের কাছে। টিমোথির জন্য হয়তো কিছু করার ছিল না, কিন্তু জেরেমির জন্য তো কিছু করতে পারতেন? আসলে আপনার মাথায় তখন খেলা করছিল নিজেকে লুকিয়ে ফেলার ব্যাপারটা, আর তাই সুযোগ পাওয়ামাত্র সটকে পড়েছিলেন।’ অ্যাশট্রেতে পিষে নেভাল সিগারেটটা, গনগন করে উঠল ছাই। ‘আসলে ওই মুহূর্তে মেরির সঙ্গে একরকমের চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলেন আপনি। কোনো কথাই হয়নি আপনাদের মধ্যে, শুধু ইশারায় সম্পাদিত হয়েছিল ওই চুক্তি। কীভাবে বুঝলাম? ট্রাভের্টন বলেছেন, মেরি নাকি তাকিয়ে ছিলেন তাঁর দিকে। ভুল বলেছেন তিনি। মেরি আসলে তাকিয়ে ছিলেন আপনার দিকে। কারণ আপনি দাঁড়িয়ে ছিলেন ট্রাভের্টনের ঠিক পাশে।’ মেরির দিকে তাকাল হোথর্ন। ‘আপনি ইশারায় চলে যেতে বলেছিলেন অ্যালানকে, ঠিক না?’

‘করার মতো কিছু ছিল না ওর,’ একটু আগে যা বলেছেন গডউইন, সে-কথারই পুনরাবৃত্তি করল মেরি। মড়ার মতো চেহারা হয়েছে তার। দুই গালে এখনও লেগে আছে অশ্রুর দাগ।

হোথর্ন বলল, ‘এত বছর ধরে গডউইন পরিবারের সঙ্গে কেন আছেন, সেটা বোধহয় মোটামুটি বুঝতে পারছি আমি, মেরি। যা ঘটেছিল ডিলে, সে-দায় থেকে নিজেকে মুক্তি দিতে পারেননি আপনি আসলে। নাকি… অ্যালানের সঙ্গে এখনও অবাধ যৌনাচার চলছে আপনার?’

‘ঈশ্বরের দোহাই লাগে!’ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে গডউইনের চেহারা। ‘ওসব অনেক আগেই বন্ধ করে দিয়েছি আমরা। জেরেমির জন্য রয়ে গেছে মেরি। শুধু জেরেমির জন্য।’

‘হ্যাঁ। আর জেরেমিও আছে মেরির জন্য। ওদের একজনকে আসলে বানানো হয়েছে আরেকজনের জন্য।’

‘আমাদের কাছে কী চান আপনি?’ জিজ্ঞেস করলেন গডউইন। ‘আপনার কি মনে হয় না সেদিন যা ঘটেছে, তার জন্য ইতোমধ্যেই যথেষ্ট শাস্তি পেয়েছি আমরা?’ একটা মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করলেন তিনি। তারপর বলে চললেন, ‘পুরো ব্যাপারটা দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছু না। আমি যদি ওই মুহূর্তে বেরিয়ে না- আসতাম ওই দোকান থেকে, তখন যদি আমাকে না-দেখত বাচ্চা দুটো…। আপনি কি এখন সব কথা বলে দেবেন জুডিথকে?’

‘না, তাঁকে কিছুই বলবো না আমি। ব্যাপারটা আমার না।

‘তা হলে আমাদের দু’জনকে এখানে নিয়ে এলেন কেন?’

‘কারণ আপনাদের ব্যাপারে যা অনুমান করেছিলাম আমি, সেটা ঠিক কি না, জানার দরকার ছিল আমার।’

উঠে দাঁড়ালেন অ্যালান গডউইন। একই কাজ করল মেরি ও’ব্রায়ানও। দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন অ্যালান। তাঁর পিছু নিয়েছে মেয়েটা।

বেরিয়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে ঘুরলেন গডউইন। ‘আপনি একজন চালাক মানুষ, মিস্টার হোথর্ন। কিন্তু এতগুলো বছর আমাদের উপর দিয়ে কী গেছে, সে-ব্যাপারে কোনো ধারণাই নেই আপনার। কারণ আবেগ বলে কিছু নেই আপনার। ভয়ঙ্কর একটা ভুল করে ফেলেছিলাম আমরা, এবং সে-ভুলের দায় মাথায় নিয়ে প্রতিটা দিন অতিবাহিত করতে হচ্ছে আমাদেরকে। তারপরও বলবো, আমরা কিন্তু দানব না। আমরা অপরাধী না। আমরা একজন আরেকজনকে ভালোবেসেছিলাম।’

হোথর্নকে দেখে মনে হচ্ছে না, গডউইনের ওসব কথা বিন্দুমাত্র প্রভাব বিস্তার করেছে ওর মনে। আরও বেশি পাণ্ডুর দেখাচ্ছে ওকে। আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রতিশোধপরায়ণ দেখাচ্ছে ওর দুই চোখ।

বলল, ‘কীসের ভালোবাসা? আপনারা আসলে সেক্স করতে চেয়েছিলেন। এবং আপনি জেনেবুঝে ধোঁকা দিচ্ছিলেন আপনার স্ত্রীকে। আর সে-কারণেই মারা গেছে আপনার একটা ছেলে।’

তীব্র বিতৃষ্ণার দৃষ্টিতে হোথর্নের দিকে তাকিয়ে আছেন গডউইন। মেরি ইতোমধ্যেই বেরিয়ে গেছে দরজা দিয়ে। ঘুরলেন গডউইন, অনুসরণ করলেন মেয়েটাকে।

এখন ঘরের ভিতরে শুধু আমি আর হোথৰ্ন।

‘ওই দু’জনের সঙ্গে কি এতটা কঠোর হওয়ার দরকার ছিল?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।

অনিশ্চিত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল হোথর্ন। ‘কেন, ওদের জন্য কি খারাপ লাগছে আপনার?’

‘জানি না… সম্ভবত। অ্যালান গডউইন খুন করেননি ডায়ানা ক্যুপারকে।’

‘ঠিক। ওই দুর্ঘটনার জন্য তিনি দায়ী করেন না মিসেস ক্যুপারকে। বরং তিনি দায়ী করেন নিজেকেই। কাজেই মিসেস ক্যুপারকে খুন করার কোনো কারণই নেই তাঁর।’

‘কিন্তু গাড়িটা যে চালাচ্ছিল তখন…’

‘ড্যামিয়েন, তার মা, অথবা তাদের কোনো প্রতিবেশী… গাড়িটা কে চালাচ্ছিল ওই সময়ে, তাতে কিছু যায়-আসে না।

ঘরের বাতাসে যেন ঝুলে আছে সিগারেটের ধোঁয়া। এই ঘটনার ব্যাখ্যা পরে আমার স্ত্রীর কাছে দিতে হবে আমাকে। আমি এখনও বসে আছি পিয়ানো টুলটার উপর। হত্যাকাণ্ড দুটোর ব্যাপারে যে-এক নম্বর থিউরি দাঁড় করিয়েছিলাম, সেটা বিধ্বস্ত হয়েছে এইমাত্র।

বললাম, ‘অ্যালান গডউইন যদি খুনি না-হবে, তা হলে কে খুন করেছে মিসেস ক্যুপার আর তাঁর ছেলেকে?’

‘গ্রেস লোভেল,’ বলল হোথ

চমকে উঠলাম আমি।

কিন্তু হোথর্নের পরের কথায় কেটে গেল আমার সে-চমক।

‘আগামীকাল গ্রেস লোভেলের সঙ্গে দেখা করতে যাবো আমরা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *