০১. শেষকৃত্যের পরিকল্পনা

দ্য ওয়ার্ড ইয মার্ডার – অ্যান্টনি হরোউইটয
রূপান্তর : সায়েম সোলায়মান
প্ৰথম প্ৰকাশ আগস্ট ২০২০

১. শেষকৃত্যের পরিকল্পনা

বসন্তের উজ্জ্বল এক সকাল। ঘড়িতে মাত্র এগারোটা বেজেছে। প্রায় সাদা সূর্যের- আলো যেন প্রতিজ্ঞা করেছে, আজ এমন এক উষ্ণতা বিলিয়ে দেবে, যা সচরাচর দেয় না। ফুলহ্যাম রোড পার হলেন ডায়ানা ক্যুপার, গিয়ে ঢুকলেন ফিউনারেল পার্লারে।

বেঁটেখাটোই বলা চলে তাঁকে। কাজের মানুষ বলতে যা বোঝায় ঠিক যেন সে- রকম। স্থির সংকল্পের ছাপ আছে দুই চোখে, রূঢ়ভাবে কাটানো চুলে, এমনকী হাঁটাচলার ভঙ্গিতেও। কেউ যদি তাঁকে হেঁটে আসতে দেখে, তা হলে পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াবে… চলে যেতে দেবে। তারপরও তাঁকে দেখলে দয়া-মায়াহীন বলে মনে হয় না। তাঁর বয়স ষাটের ঘরে। চেহারা মনোরম, গোলাকার। পরনের কাপড় দামি। ফেকাসে রেইনকোটের ভিতরে দেখা যাচ্ছে গোলাপি জার্সি আর ধূসর স্কার্ট। পুঁতি আর পাথর দিয়ে বানানো ভারী একটা নেকলেস গলায়। ওটা দামি হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে। কিন্তু হীরার যে-ক’টা আংটি পরে আছেন তিনি, সেগুলো নিঃসন্দেহে মূল্যবান

ফিউনারেল পার্লারটার নাম কর্নওয়ালিস অ্যান্ড সন্স। একটা টেরেসের শেষপ্রান্তে অবস্থিত ওটা। বিল্ডিঙের সামনের দিকে এবং পাশে ক্ল্যাসিকাল ফন্টে পেইন্ট-করে লেখা আছে নামটা; ফলে কোনো পথচারী যে-কোনো দিক দিয়েই আসুক না কেন, দেখতে পাবে ওই নাম। ‘কর্নওয়ালিস’ আর ‘সন্স’ শব্দ দুটো যাতে একত্রিত হতে না-পারে সেজন্য ও-দুটোর মাঝখানে, সদর-দরজার উপরে বসিয়ে দেয়া হয়েছে ভিক্টোরিয়ান একটা ঘড়ি। চলছে না ঘড়িটা… মাঝরাতের ঠিক এক মিনিট আগে, মানে ১১:৫৯ বেজে থেমে আছে।

নামটার ঠিক নিচে লেখা আছে:

Independent Funeral Directors:
A Family Business since 1820.

বাড়ির তিনটা জানালা মুখ করে আছে রাস্তার দিকে। দুটোতে পর্দা ঝুলছে। তৃতীয়টায় পর্দা নেই, তবে সেটার পাশের দেয়ালে বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে কারও উদ্ধৃতি: মানুষের জীবনে দুঃখ যখন আসে, একাকী কোনো গুপ্তচরের মতো আসে না, বরং বিশাল এক বাহিনীর মতো আসে। বাড়ির সব কাঠ… জানালার ফ্রেম, সামনের দিক, সদর-দরজা… গাঢ় নীল আর হালকা কালো রঙে রঞ্জিত।

সদর দরজাটা খুললেন মিসেস ক্যুপার। দরজার পুরনো ধাঁচের স্প্রিং মেকানিযমের সঙ্গে যুক্ত একটা ঘণ্টা বেজে উঠল জোরে, একবার। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখতে পেলেন, ছোট একটা রিসিপশন এরিয়ায় হাজির হয়েছেন। একধারে দেখা যাচ্ছে দুটো সোফা, নিচু একটা টেবিল, আর বইয়ে-ঠাসা কয়েকটা শেল্ফ। যেসব বই শুধু সাজিয়ে রাখা হয় কিন্তু পড়া হয় না, সেগুলোয় একজাতের দুঃখী-দুঃখী ভাব থাকে; ওই বইগুলোতেও সে-রকম একটা ভাব আছে। আরেকদিকে দেখা যাচ্ছে সিঁড়ি– উপরতলায় গেছে। অনতিদূরে যেন বিছিয়ে আছে সরু একটা করিডর।

মিসেস ক্যুপারের উপস্থিতি টের পাওয়ামাত্র হাজির হলো এক মহিলা। স্থূল শরীর তার, পা দুটো মোটা আর ভারী, পরনে কালো চামড়ার জুতো… সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে। স্নিগ্ধ আর বিনয়ী হাসি দেখা যাচ্ছে চেহারায়। সেই হাসি যেন নিঃশব্দে বলে দিচ্ছে, পলকা আর কষ্টকর একটা ব্যবসা পরিচালনা করা হয় কর্নওয়ালিস অ্যান্ড সন্স-এ, তবে সুস্থিরভাবে এবং দক্ষতার সঙ্গে করা হয় কাজটা। মহিলার নাম আইরিন লয। রবার্ট কর্নওয়ালিসের পার্সোনাল অ্যাসিস্টেন্ট। একইসঙ্গে কাজ করছে রিসিপশনিস্ট হিসেবে।

‘গুড মর্নিং,’ বলল সে। ‘আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’

‘হ্যাঁ,’ বললেন মিসেস ক্যুপার। ‘আমি একটা শেষকৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করতে চাই।’

‘সম্প্রতি মারা গেছেন, এমন কারও পক্ষে কি এখানে এসেছেন আপনি?’

‘না। আমি আসলে আমার জন্যই এসেছি।’

‘ও আচ্ছা।’ চোখ পিটপিট করেনি আইরিন লয… করবেই বা কেন? নিজের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করতে চাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না… অনেকেই চায়। ‘আপনার কি অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?’

‘না। অ্যাপয়েন্টমেন্ট যে করতে হবে, জানা ছিল না।’

‘আমি তা হলে দেখে আসি মিস্টার কর্নওয়ালিস ফ্রি আছেন কি না। প্লিয… বসুন। চা বা কফি কিছু খাবেন?’

‘না, ধন্যবাদ।’

বসলেন ডায়ানা ক্যুপার। করিডর ধরে অদৃশ্য হয়ে গেল আইরিন লয। ফিরে এল কয়েক মিনিট পর। তার পেছনে দেখা যাচ্ছে একজন লোককে। ফিউনারেল ডিরেক্টরদের মতো কালো স্যুট আর কালো টাই পরে আছে ওই লোক। কিন্তু এমন একটা ভাব খেলা করছে তার চেহারায় যে, দেখলে মনে হয়, এখানে থাকার কারণে নিঃশব্দে ক্ষমাপ্রার্থনা করছে যেন। গভীর অনুশোচনার ভঙ্গিতে একহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরেছে আরেক হাত। কিছুটা কুঁচকে আছে চেহারাটা, বিষাদের ছাপ পড়েছে সেখানে। পাতলা হয়ে-আসা চুল যদি আরও ঝরে যায় তা হলে টেকো হয়ে যাবে সে। দাড়ি আছে, তবে দেখলে মনে হয় পরীক্ষামূলকভাবে রেখেছে সেটা এবং সে- পরীক্ষা ব্যর্থ হয়েছে। রঙিন কাঁচের চশমা যেন চেপে বসেছে নাকের উপর, চোখ দুটো আড়াল করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে সেটা। লোকটার বয়স চল্লিশের মতো। আইরিনের মতো সে-ও হাসছে।

‘গুড মর্নিং,’ মিসেস ক্যুপারকে বলল লোকটা। ‘আমার নাম রবার্ট কর্নওয়ালিস। শুনলাম একটা শেষকৃত্যের পরিকল্পনা নিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চান।’

‘হ্যাঁ।’

‘আপনাকে কি চা বা কফি খেতে বলা হয়েছে? প্লিয… এদিকে আসুন।’

করিডর ধরে সেটার শেষপ্রান্তের একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো মিসেস ক্যুপারকে। এটাও একটা রিসিপশন এরিয়া, তবে আগেরটার সঙ্গে পার্থক্য আছে। এখানে বইয়ের বদলে সাজিয়ে রাখা হয়েছে সারি সারি ফোল্ডার আর ব্রশিউর। সেগুলো যদি খোলা হয় তা হলে দেখা যাবে বিভিন্ন রকমের কফিন ও শবযানের (গতানুগতিক অথবা ঘোড়ায়-টানা) ছবি এবং সেসবের মূল্যতালিকা। শবদাহের ব্যবস্থাও আছে, আর সে-উদ্দেশ্যে দুটো শেল্ফে সাজিয়ে রাখা হয়েছে কয়েকটা শবাধার। ঘরের একদিকে মুখোমুখি বসিয়ে রাখা হয়েছে দুটো আর্মচেয়ার। একটা চেয়ারের পাশে দেখা যাচ্ছে ছোট একটা ডেস্ক। ওই ডেস্কের পেছনে গিয়ে বসল কর্নওয়ালিস। রূপালি একটা মন্ট ব্ল্যাঙ্ক কলম বের করল। একটা নোটপ্যাডের উপর রাখল সেটা।

‘শেষকৃত্যানুষ্ঠানটা আপনার নিজের,’ শুরু করল সে।

‘হ্যাঁ,’ হঠাৎ করেই প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছেন মিসেস ক্যুপার, কাজের কথায় চলে যেতে চাইছেন সরাসরি। ‘আমার মনে হয় ওই ব্যাপারে কোনো সমস্যা নেই আপনাদের এখানে।’

‘সমস্যা তো নেই-ই, বরং কারও ব্যক্তিগত কোনো চাহিদা থাকলে সেটা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখি আমরা। আজকাল পূর্বপরিকল্পিত অথবা ফরমায়েশি শেষকৃত্য প্রধান অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের ব্যবসার। ক্লায়েন্ট যা চায়, তা তাদেরকে দেয়াটা আমাদের কর্তব্য। এখন আমাদের মধ্যে যে-আলোচনা হবে, সেটা শেষ হওয়ার পর আমাদের সব শর্ত যদি মেনে নেন আপনি, তা হলে সে-অনুযায়ী একটা ইনভয়েস দেয়া হবে আপনাকে। সেক্ষেত্রে, বন্ধু বা আত্মীয় বলতে যাঁরা আছেন আপনার, ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না তাঁদের। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বিশেষ সেই অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার পর তাঁরা সবাই বলবেন, যা-কিছু হয়েছে, আপনার ইচ্ছা-অনুযায়ীই হয়েছে।’

মাথা ঝাঁকালেন মিসেস ক্যুপার। ‘চমৎকার। তা হলে কাজ শুরু করে দেয়া যাক, কী বলেন? …আমি চাই, কার্ডবোর্ডের কফিনে দাফন করা হবে আমাকে।

নোট নেয়া শুরু করতে যাচ্ছিল কর্নওয়ালিস, কিন্তু থমকে গেল। তার কলমের নিব যেন কাগজের উপর ভেসে-আছে বাতাসে। ‘কিছু মনে করবেন না, ম্যাডাম, আপনি কি পরিবেশ-বান্ধব কোনো শেষকৃত্যানুষ্ঠানের কথা ভাবছেন? সেক্ষেত্রে আমি পরামর্শ দেবো, রিসাইকেল-করা কাঠের কফিন ব্যবহার করতে পারেন। অথবা কার্ডবোর্ডের বদলে উইলো গাছের বাঁকানো কাঠও ব্যবহার করতে পারেন।’

‘কেন?’

‘কারণ কখনও কখনও দেখা গেছে, কার্ডবোর্ডের কফিন খুব একটা ভালো ফল দেয় না। তা ছাড়া… কিছু মনে করবেন না…উইলো কাঠ কিন্তু কার্ডবোর্ডের চেয়ে খুব বেশি দামি না। আর…ওটা দেখতেও অনেক আকর্ষণীয়।’

‘ঠিক আছে। এবার আসুন, কোন্ জায়গায় দাফন হতে চাই আমি, সে-ব্যাপারে কিছু কথা বলা যাক।

‘জী, ম্যাডাম, বলুন। ‘

‘ব্রম্পটন সেমেট্রি-তে, ঠিক আমার স্বামীর কবরের পাশে।’

‘তিনি কি কিছু দিন আগে মারা গেছেন?’

‘না, বারো বছর আগে।’ হ্যান্ডব্যাগ খুললেন মিসেস ক্যুপার, এক তা কাগজ বের করে নামিয়ে রাখলেন ডেস্কের উপর।

কাগজটার দিকে তাকাল কর্নওয়ালিস। ‘দেখা যাচ্ছে আপনি আগেই অনেক কিছু ভেবে রেখেছেন এই ব্যাপারে। যা লেখা আছে এই কাগজে, সেটার কিছুটা অংশ ধর্মীয়, বাকি অংশ… কী বলবো… মানবতাবাদী। ‘

একচিলতে হাসি দেখা দিল মিসেস ক্যুপারের ঠোঁটের কোনায় ‘একটা ধর্মসঙ্গীত, আর বিটসের একটা গানের কয়েকটা লাইন। একটা কবিতা, একটা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, আর কিছু প্রশংসাবাক্য। তবে খেয়াল রাখবেন, ওগুলো যেন বেশি বড় হয়ে না-যায়।’

‘ঠিক আছে…

.

নিজের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের পরিকল্পনা করেছিলেন ডায়ানা ক্যুপার, এবং সেটা দরকার ছিল তাঁর জন্য। কারণ ওই পরিকল্পনা করার ঘণ্টা ছয়েক পর, সেদিনই, খুন করা হয় তাঁকে।

তিনি যখন মারা যান, তখনও তাঁর ব্যাপারে কিছুই জানি না আমি। কীভাবে মারা গেছেন তিনি, সে-ব্যাপারেও কিছু শুনিনি। সম্ভবত পত্রিকার হেডলাইনটা নজর কেড়ে নিয়েছিল আমার… খুন হয়েছেন অভিনেতার মা… কিন্তু যে-ছবি আর যে-গল্প ছাপা হয়েছিল, সেগুলোতে ওই মহিলার ব্যাপারে যতটা না আলোচনা করা হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল তাঁর সেই জনপ্রিয় অভিনেতা-ছেলেকে। যে-সময়ের কথা বলছি, তখন নতুন একটা আমেরিকান টিভি সিরিযের মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছে সে। একটু আগে যে- কথোপকথন উল্লেখ করেছি, সেটা প্রকৃতপক্ষে কাল্পনিক, কিন্তু পুরোপুরি বানোয়াট না। কারণ কর্নওয়ালিস অ্যান্ড সন্স-এ শেষপর্যন্ত যেতে হয়েছিল আমাকে, কথা বলতে হয়েছিল রবার্ট কর্নওয়ালিস এবং আইরিন লযের সঙ্গে। (আইরিন, কর্নওয়ালিসের চাচাতো বোন।)

ফুলহ্যাম রোড ধরে সোজা হেঁটে গেলে ওই ফিউনারেল পার্লার খুঁজে বের করতে মোটেও কষ্ট হয় না। ঘরগুলো, যেমনটা বর্ণনা করেছি ওই কাল্পনিক কথোপকথনে, ঠিক সে-রকম। অন্য বর্ণনাগুলো আমি লিখেছি প্রত্যক্ষদর্শীদের- বিবৃতি আর পুলিশ-রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে।

ঠিক কখন সেই ফিউনারেল পার্লারে ঢুকেছিলেন মিসেস ক্যুপার, সেটা জানা গেছে; কারণ দুটো সিসিটিভি’র রেকর্ডে দেখা গেছে তাঁকে… একটা রাস্তার, অন্যটা যে-বাসে সওয়ার হয়ে সেদিন সকালে বাসা থেকে ফুলহ্যাম রোডে গিয়েছিলেন তিনি, সে-বাসের। অদ্ভুত একটা খেয়াল ছিল তাঁর… সব সময় গণপরিবহন ব্যবহার করতেন। অথচ শোফার-সহ একটা গাড়ির ব্যবস্থা করাটা কোনো ব্যাপারই ছিল না তাঁর জন্য।

বারোটা বাজার মিনিট পনেরো আগে ফিউনারেল পার্লার থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। হাঁটতে হাঁটতে এগোন সাউথ কেনসিংটন টিউব স্টেশনের দিকে। সেখানে গিয়ে সওয়ার হন পিকাডিলি লাইনে, পৌঁছে যান গ্রীন পার্কে। সেইন্ট জেমস’স স্ট্রীটের ‘ক্যাফে-মুরানো’ নামের একটা দামি রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সেরে নেন এক বন্ধুর সঙ্গে। ওই রেস্তোরাঁ, ফোর্টনাম অ্যান্ড মেসন-এর কাছে অবস্থিত। যা-হোক, খাওয়ার পর রাস্তায় বেরিয়ে আসেন, একটা ট্যাক্সি ডেকে উঠে পড়েন সেটাতে, সোজা গিয়ে হাজির হন গ্লোব থিয়েটারে। তবে কোনো মঞ্চনাটক দেখার জন্য যাননি সেখানে। তিনি ছিলেন ওই থিয়েটারের পরিচালনা পরিষদের একজন সদস্য, সেদিন অংশ নিয়েছিলেন বিল্ডিঙের একতলায় অনুষ্ঠিত একটা মিটিঙে, দুপুর দুটোর সময় শুরু হয়ে বিকেল পাঁচটা বাজার কিছুক্ষণ আগপর্যন্ত চলেছিল সে-মিটিং। ছ’টা বাজার পাঁচ মিনিট পর বাসায় পৌঁছান। ততক্ষণে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে, তবে তাঁর সঙ্গে একটা ছাতা ছিল, বাসায় ঢোকার আগে সদর-দরজার কাছে একটা ভিক্টোরিয়ান স্ট্যান্ডের ভিতরে রাখেন ওটা।

ত্রিশ মিনিট পর কেউ একজন তাঁর গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করে তাঁকে।

চেলসি’র ঠিক পরই, ব্রিটানিয়া রোডের টেরেসওয়ালা সুন্দর-একটা-বাড়িতে থাকতেন তিনি। রাস্তায় কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না, কাজেই খুনটা যখন হয়েছে তখন কে ওই বাড়িতে ঢুকেছে অথবা বেরিয়ে গেছে, সেটা জানারও কোনো উপায় ছিল না। আশপাশের বাড়িগুলোও ছিল জনশূন্য। প্রতিবেশী ওই বাড়িগুলোর একটার মালিক দুবাইভিত্তিক একটা কনসোর্টিয়াম। সে-বাড়িতে থাকার প্রশ্নই আসে না মালিকপক্ষের, তাই সেটা ভাড়া দেয়া হয়েছিল। তবে মিসেস ক্যুপারকে যখন খুন করা হয়, তখন কোনো ভাড়াটে ছিল না ওই বাড়িতে। প্রতিবেশী অন্য একটা বাড়ির মালিক অবসরপ্রাপ্ত এক উকিল এবং তাঁর স্ত্রী। খুনটা যখন হয়েছে তখন তাঁরা দক্ষিণ ফ্রান্সে অবকাশ যাপন করছেন।

সুতরাং মিসেস ক্যুপারের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে রহস্যজনক কোনো কিছু শুনতে পায়নি কেউ।

টানা দু’দিন লাপাত্তা ছিলেন তিনি… মানে, ওই দু’দিন কেউ দেখেনি তাঁকে, তাঁকে নিয়ে কিছু শোনেওনি। তাঁর বাড়িতে কাজ করত আন্দ্রিয়া ক্লুভানেক নামের এক স্লোভাকিয়ান ক্লিনার, সপ্তাহে দু’দিন যেত সেখানে, এক বুধবার সকালে খুঁজে পায় সে লাশটা।

লিভিংরুমের মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে ছিলেন ডায়ানা ক্যুপার। পর্দা বাঁধার কাজে যে-রকম দড়ি ব্যবহৃত হয়, সে-রকম একটা লাল রঙের দড়ি পেঁচানো অবস্থায় ছিল তাঁর গলায়। ফরেনযিক রিপোর্ট বলছে, খুনি এত জোরে টান দিয়েছিল ওই দড়িতে যে, মিসেস ক্যুপারের গলার হায়োয়িড বোন ভেঙে গিয়েছিল, সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল দুই চোখের কনজাঙ্কটাইভা।

দৃশ্যটা আন্দ্রিয়ার জন্য মোটেও সুখকর ছিল না। বছর দু’-এক ধরে ওই বাড়িতে কাজ করছিল সে, বেশ পছন্দ করত মিসেস ক্যুপারকে। কারণ তার সঙ্গে শুধু ভালো ব্যবহারই করতেন না তিনি, বরং কখনও কখনও তাকে কাজ শেষে ডেকে নিয়ে দু’জনে একসঙ্গে কফিও খেতেন। যা-হোক, আন্দ্রিয়ার বর্ণনা অনুযায়ী, ফিকে লাল রঙ ধারণ করেছিল মিসেস ক্যুপারের চেহারা। বিস্ফারিত দুই চোখে তাকিয়ে ছিলেন তিনি নিষ্পলক-নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে। মুখের বাইরে বীভৎস ভঙ্গিতে বেরিয়ে পড়েছে জিভটা… দৈর্ঘ্যে স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ। যেন কিছু-একটা আঁকড়ে ধরার ভঙ্গিতে সামনের দিকে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল একটা হাত, অভিযোগ করার ভঙ্গিতে উঁচু হয়ে আছে সে-হাতের একটা আঙুল। হীরার একটা আংটি ওই আঙুলে। বাসার ভিতরে তখন সেন্ট্রাল হিটিং চলছে, পচতে শুরু করেছে লাশ, দুর্গন্ধ বের হচ্ছে।

পুলিশের কাছে যে-বিবৃতি দিয়েছে আন্দ্রিয়া, সে-অনুযায়ী, তখন চিৎকার করেনি সে। অসুস্থও হয়ে পড়েনি। ধীরে ধীরে পিছিয়ে এসে বেরিয়ে পড়ে বাড়ি থেকে, তারপর নিজের মোবাইল ফোন থেকে কল দেয় পুলিশের নম্বরে। পুলিশ না- পৌঁছানো পর্যন্ত আর ঢোকেনি ওই বাড়ির ভিতরে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার পর পুলিশ অনুমান করে নেয়, চৌর্যবৃত্তির শিকার হয়েছেন ডায়ানা ক্যুপার। তাঁর কিছু গহনা আর একটা ল্যাপটপ কম্পিউটার খোয়া গেছে। কিছু-একটা তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছে সারা বাড়ির বেশিরভাগ ঘরে, এবং যেসব ঘরে খোঁজ চালানো হয়েছে সেগুলো তছনছ করে ফেলা হয়েছে। তবে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, যার ফলে ধারণা করে নেয়া যেতে পারে, কেউ একজন জোরপূর্বক ঢুকেছে ওই বাড়িতে। যে-লোক হামলা চালিয়েছে মিসেস ক্যুপারের উপর, স্পষ্ট বোঝা গেছে স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে সে-লোকের জন্য দরজা খুলে দিয়েছেন তিনি। তবে লোকটাকে তিনি চিনতেন কি না, বোঝা যায়নি। তবে এটা বোঝা গেছে, ওই দড়ি ব্যবহার করে হঠাৎ করেই পেছন থেকে ফাঁস লাগানো হয়েছিল তাঁর গলায়, এবং ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে গিয়েছিলেন তিনি। বলতে গেলে কোনো বাধাই দিতে পারেননি হামলাকারীকে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায়নি ঘটনাস্থলে, ডিএনএ অথবা অন্য কোনো জাতের ক্লু-ও পাওয়া যায়নি। তার মানে অনুমান করে নেয়া যেতে পারে, ভালোমতো ছক কষেই হাজির হয়েছিল খুনি। কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিয়েছিল সে মিসেস ক্যুপারকে। বাড়ির লিভিংরুমে ভেলভেটের পর্দা আছে, আর সেগুলোর পাশে আছে হুক; ওই হুক থেকেই খুলে নিয়েছিল সে লাল-রঙের দড়িটা। তারপর চুপিসারে হাজির হয়ে যায় মিসেস ক্যুপারের পেছনে, হঠাৎ করেই ফাঁস লাগিয়ে দেয় তাঁর গলায়, এরপর সজোরে টেনে ধরে দড়ির দুই প্রান্ত। মারা পড়তে মিনিটখানেকের বেশি লাগেনি মিসেস ক্যুপারের।

খোঁজখবর করতে শুরু করে পুলিশ। এবং মিসেস ক্যুপার যে সেদিনই কর্নওয়ালিস অ্যান্ড সন্স-এ গিয়েছিলেন, সেটা জানতে পেরে আশ্চর্য হয়ে যায়। বুঝতে পারে, জটিল একটা ধাঁধার সম্মুখীন হয়েছে তারা।

ব্যাপারটা ভাববার মতো। নিজের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করে সেদিনই হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার ঘটনা বিরল… ও-রকম কোনো নজির নেই বললেই চলে। কাজেই পুলিশ অনুমান করে নেয়, পুরো ব্যাপারটা কাকতালীয় না। মিসেস ক্যুপারের সেই-ফিউনারেল-পার্লারে যাওয়া এবং ঘণ্টা ছয়েক পর হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার মধ্যে কোনো-না-কোনো যোগসূত্র আছে। তাঁকে যে খুন করা হবে, সেটা কি কোনোভাবে জানতে পেরেছিলেন তিনি? কেউ কি তাঁকে সেই ফিউনারেল পার্লারে ঢুকতে এবং সেখান থেকে বের হতে দেখেছে? তারপর সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাঁর উপর? তিনি যে ওই পার্লারে গিয়েছিলেন, কে কে জানত সেটা?

ব্যাপারটা আসলেই রহস্যজনক। এবং সে-রহস্য ভেদ করার জন্য একজন স্পেশালিস্ট প্রয়োজন। তবে যে-সময়ের কথা বলছি তখন ওই ব্যাপারে তেমন কিছু করার ছিল না আমার।

কিন্তু ঘটনা বদলে যেতে বেশি সময় লাগল না।

২. হোথর্ন

যেদিন সন্ধ্যায় খুন হলেন ডায়ানা ক্যুপার, সেদিনের কথা মনে করতে কোনো কষ্ট হয় না আমার। আমি তখন এক্সমাউথ মার্কেটে ‘মোরো’ নামের একটা রেস্টুরেন্টে আমার স্ত্রীর সঙ্গে ডিনার করছি। সেদিন বিকেলেই আমার প্রকাশকের কাছে ই- মেইলে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম নতুন উপন্যাসটা। ওটা লিখতে টানা আট মাস খাটুনি করতে হয়েছিল আমাকে।

উপন্যাসটার নাম দ্য হাউস অভ সিল্ক। এ-উপন্যাসে নতুনভাবে ফিরিয়ে আনা হয়েছে শার্লক হোমসকে। আমি কখনও ভাবিনি, কিংবদন্তির গোয়েন্দা চরিত্রকে নিয়ে কিছু লিখবো। আমার কাছে একদিন হঠাৎ করেই হাজির হলেন কোনান ডয়েল এস্টেটের কয়েকজন কর্মকর্তা। হোমসের নতুন কোনো উপন্যাস লেখার দায়িত্ব দিতে চাইছিলেন তাঁরা কাউকে। সুযোগ পাওয়ামাত্র যেন ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমি। আমার বয়স যখন সতেরো, হোমসের কাহিনিগুলো পড়েছিলাম তখন। তারপর থেকে, সারাটা জীবন ধরে, ওই গল্পগুলো রয়ে গেছে আমার সঙ্গে। আমি মনে করি, হোমস, সমস্ত আধুনিক গোয়েন্দা চরিত্রের বাবা। কিন্তু শুধু সে-কারণেই ওকে ভালোবাসিনি আমি। ওর প্রতিটা কাহিনিই দুর্দান্ত ছিল… কিন্তু সেটাও ওই চরিত্রকে ভালোবাসার একমাত্র কারণ না। আসলে হোমস আর ওয়াটসনের সেই জগত্‍টা… সে-সময়ের থেমস নদীর ধারের লন্ডনটা– খোয়াবিছানো পথের উপর দিয়ে ঘর্ঘর শব্দে ছুটে-চলা চারচাকার সেই হ্যাঁনসাম ক্যাব, সেই গ্যাসল্যাম্প, আর পাক খেয়ে- খেয়ে ভাসতে-থাকা সেই কুয়াশা… সব কিছু যেন অমোঘ একটা আকর্ষণ জাগিয়ে তুলেছিল আমার মনে। ওসব যেন আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল আমাকে… ২২১বি বেকার স্ট্রীটে হাজির হয়ে সাহিত্য-ইতিহাসের সবচেয়ে-বড়-বন্ধুত্বটা প্রত্যক্ষ করার। সে- নিমন্ত্রণ কী করে প্রত্যাখ্যান করি?

আমার দায়িত্ব ছিল, উপন্যাসের শুরুতেই নিজেকে লুকিয়ে ফেলা– কোনান ডয়েলের ছায়ায় অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। তাঁর যেসব সাহিত্যিক-ঢং ছিল, সোজা কথায়, সেগুলো অনুকরণ করা। এবং অনুপ্রবেশকারীদের মতো নিজস্ব কোনো কায়দায় কোনো বর্ণনা জুড়ে না-দেয়া। ওই উপন্যাসের প্রতিটা লাইন লেখার সময় ভেবেছি, কোনান ডয়েল নিজে যদি লিখতেন সেটা, তা হলে কীভাবে লিখতেন? মোদ্দা কথা, স্থান-কাল-পাত্র এবং ঘটনার বর্ণনা এমনভাবে দেয়ার চেষ্টা করেছি, যাতে আমার কোনো ছাপই যাতে না-থাকে ওই উপন্যাসে।

যে-সময়ের কথা বলছি, তখন আমি একজন কিশোর-সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত। এবং, সত্যি বলতে কী, মনে মনে আশা করছিলাম, দ্য হাউস অভ সিল্কউপন্যাসটা আমার সে-পরিচয় পাল্টে দেবে। কেন একজন কিশোর-সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত ছিলাম, তা-ও একটু বলি। অ্যালেক্স রাইডার নামের টিনএজার এক গুপ্তচরকে নিয়ে ২০০০ সালে একটা সিরিয লিখতে শুরু করি আমি। ওই সিরিযের জনপ্রিয়তাও বাড়তে শুরু করে একসময়, সারা বিশ্বব্যাপী বিক্রি হতে শুরু করে বইগুলো। শিশু-কিশোরদের জন্য বই লিখছিলাম ঠিকই, কিন্তু একইসঙ্গে এটাও টের পাচ্ছিলাম, আসলে যা লিখতে চাই আমি, সেটা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি আস্তে আস্তে। ওদিকে বয়সও থেমে নেই… পঞ্চান্নতে পা দিয়ে ফেলেছি। কাজেই অন্য কোনো দিকে সরে যাওয়ার একটা তাগাদা অনুভব করছিলাম আসলে। মনে আছে, তখন একটা সাহিত্য-উৎসবে অ্যালেক্স রাইডার সিরিযের দশম বই স্করপিয়া রাইযিং নিয়ে আলোচনা করার কথা ছিল আমার।

আরও একটা কাজ ছিল আমার হাতে তখন। ‘টিনটিন টু’ নামের একটা চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য সম্পাদনা করার জন্য ভাড়া করা হয়েছিল আমাকে। এবং কাজটা করেছিলেন প্রবাদপ্রতিম চিত্রপরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ স্বয়ং। সিনেমাটা পরিচালনা করার কথা ছিল পিটার জ্যাকসনের। তখন আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না, চিত্রজগতের সবচেয়ে বড় দু’জন পরিচালকের সঙ্গে কাজ করছি। কীভাবে ঘটে গেল ঘটনাটা, সে-ব্যাপারে আজও আমি নিশ্চিত না।

অস্বীকার করে লাভ নেই, বেশ নার্ভাস ছিলাম তখন। ওই চিত্রনাট্য কম-করে- হলেও বারোবার পড়ে ফেলেছি, নিজের সেরাটা ঢেলে দেয়ার চেষ্টা করছি ওই কাজে। বার বার ভাবছি, চরিত্রগুলো কি ঠিকমতো বর্ণনা করা হয়েছে? ঘটনার ধারাবাহিকতা কি ঠিকমতো সাজানো হয়েছে? যে-সময়ের কথা বলছি, তখন সপ্তাহখানেকের মধ্যে লন্ডনে একসঙ্গে হাজির হওয়ার কথা জ্যাকসন আর স্পিলবার্গের। তাঁদের সঙ্গে দেখা করার কথা আমার, তাঁদের শলাপরামর্শ নেয়ার কথা।

একদিন হুট করে বেজে উঠল আমার মোবাইল।

স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দেখি, নম্বরটা অপরিচিত। ভাবলাম, জ্যাকসন বা স্পিলবার্গ কেউ ফোন করেছেন নাকি? সঙ্গে সঙ্গে বাতিল করে দিলাম চিন্তাটা। তাঁদের কেউ সরাসরি ফোন করবেন না আমাকে। তাঁদের কোনো অ্যাসিস্টেন্ট হয়তো করতে পারে… লাইনে আমি আছি কি না সে-ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর ফোন দিতে পারে তাঁদের কাউকে। ঘড়ির দিকে তাকালাম। সকাল দশটা। নিজের ফ্ল্যাটের টপ ফ্লোরে, অফিসরুমে বসে আছি; রেবেকা ওয়েস্টের লেখা দ্য মিনিং অভ ট্রিযন বইটা পড়ছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ব্রিটেনের উপর লেখা ওই উপন্যাস একটা ক্লাসিক। বইটা বন্ধ করে তুলে নিলাম মোবাইল ফোন।

‘টনি?’ একটা কণ্ঠ জানতে চাইল।

নিশ্চিত হয়ে গেলাম, স্পিলবার্গ অথবা তাঁর কোনো সহকারী ফোন করেনি। কারণ খুব কম লোকই আমাকে টনি নামে ডাকে। সত্যি বলতে কী, নামটা পছন্দ করি না আমি। আমার আসল নাম অ্যান্টনি। বন্ধুরা কেউ কেউ বলে, অ্যান্ট।

‘হ্যাঁ, বলছি,’ বললাম আমি।

কেমন আছেন, মেইট? আমি হোথর্ন।’

সে ওর নামটা বলার আগেই ওকে চিনতে পেরেছি। স্বরবর্ণের নীরস উচ্চারণ, কথার সেই অদ্ভুত টান– কিছুটা লন্ডনবাসীদের মতো, আবার কিছুটা উত্তরাঞ্চলের মানুষদের মতো… এবং সবচেয়ে বড় কথা সেই ‘মেইট’ শব্দটা। হোথর্ন ছাড়া আর কারও ট্রেডমার্ক না এসব।

‘মিস্টার হোথর্ন,’ বললাম আমি, ‘আপনার ফোন পেয়ে ভালো লাগছে।’

আমাদের যখন পরিচয় হয়েছিল, তখন জানতে পেরেছিলাম, ওর নামের প্রথম অংশটা ড্যানিয়েল। কিন্তু ওই নাম ব্যবহার করতে কেমন যেন অস্বস্তি লাগে আমার। সে নিজেও তেমন একটা ব্যবহার করে না নামটা। অন্য কাউকেও ওটা ব্যবহার করতে শুনিনি কখনও।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, হোথর্নের কণ্ঠ অধৈর্য। ‘সময় আছে আপনার হাতে?’

‘কেন, কী হয়েছে?’

‘আপনার সঙ্গে দেখা করা যায় কি না ভাবছিলাম। আজ বিকেলে কী করছেন?’ এ-রকম কথাবার্তাও হোথর্নের ট্রেডমার্ক। আগামীকাল অথবা আগামী সপ্তাহে দেখা করতে পারবো কি না ওর সঙ্গে, সেটা জিজ্ঞেস করছে না সে; বরং যেইমাত্র আমাকে প্রয়োজন হয়েছে ওর, সঙ্গে সঙ্গে সে-প্রয়োজন মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। অর্থাৎ ওর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হলে এখনই করতে হবে আমাকে, এবং সেটা ওর প্রয়োজন অনুযায়ীই।

একটু আগেই বলেছি, সেদিন তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ ছিল না আমার হাতে, কিন্তু সেটা হোথর্নকে বলতে যাবো কেন? তাই বললাম, ‘আসলে… আমি ঠিক নিশ্চিত না…

‘যে-ক্যাফেতে দেখাসাক্ষাৎ করতাম আমরা একসময়, আজ বিকেল তিনটার সময় সেখানে আসতে পারবেন?’

‘জে অ্যান্ড এ?’

‘হ্যাঁ। আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করার আছে আমার। যদি সময় দিতে পারেন, খুব ভালো হয়… কৃতজ্ঞ থাকবো আপনার প্রতি।

জে অ্যান্ড এ ক্যাফেটা ক্লার্কেনওয়েলে… আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে হেঁটে যেতে দশ মিনিটের মতো লাগে। অনুরোধটা এড়িয়ে যাওয়ার মতো যুৎসই কোনো অজুহাতও মনে পড়ল না চট করে। তা ছাড়া… সত্যি বলতে কী… প্ৰচ্ছন্ন একটা আগ্রহ বোধ করতে শুরু করেছি হঠাৎ করেই।

‘ঠিক আছে,’ বললাম আমি, ‘তিনটার সময় দেখা হবে।’

‘খুব ভালো, মেইট। দেখা হবে।’

লাইন কেটে দিল হোৰ্থন।

আমার সামনে কম্পিউটারের স্ক্রীনে টিনটিনের চিত্রনাট্য। ওটা বন্ধ করে দিলাম আমি। হোথর্নকে নিয়ে ভাবছি।

ইনজাস্টিস নামের একটা পাঁচ-পর্বের টেলিভিশন সিরিযের জন্য একবার কাজ করছিলাম আমি, সে ঘটনার আগের বছর হোথর্নের সঙ্গে পরিচয় হয় আমার। ওই সিরিযে একটা গোয়েন্দা চরিত্র ছিল, তাকে হোথর্নের আদলে তৈরি করি আমি– ভয়ঙ্কর, বর্ণবাদী, রগচটা এবং আক্রমণাত্মক। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, হোথর্ন মোটেও সে-রকম কেউ না। অন্ততপক্ষে বর্ণবাদী তো না-ই। তবে আমার কাছে সব সময়ই বিরক্তিকর মনে হয়েছে ওকে। মনে হয়েছে, আমি যে-রকম, সে ঠিক তার উল্টো।

ওই সিরিযে প্রোডাকশন সুপারভাইযারের দায়িত্বে যিনি ছিলেন, তিনিই হোথর্নের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন আমাকে। তখন জানতে পারি, হোর্থন হচ্ছে লন্ডনের মেট্রোপলিটান পুলিশ সার্ভিসের একজন ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর, পাটনি’র সাব কমান্ডের বাইরে আছে আপাতত। হোমিসাইড স্পেশালিস্ট বলতে যা বোঝায়, সে ঠিক তা-ই। দশ বছর ধরে কাজ করছিল পুলিশফোর্সে। চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে ওকে… কারণটা ঠিক জানা নেই আমার।

যা-হোক, অপরাধ জগৎ নিয়ে লেখালেখি করতে হলে অথবা সিনেমা-নাটক বানাতে গেলে পুলিশের-এককালের-অফিসারদের সঙ্গে কমবেশি খাতির রাখতে হয়। কারণ তাঁরা এমন সব তথ্য দিতে পারেন, যেগুলো গল্প-উপন্যাসে অথবা নাটক-সিনেমায় যোগ করা হলে কাহিনিটা সত্যি বলে মনে হয়। আর হোথর্ন ছিল ওই কাজে ঝানু। আমি কী চাই, তা চট করে বুঝে ফেলার সহজাত একটা প্রবৃত্তি ছিল ওর ভিতরে। একটা উদাহরণ দিই। একবার এক কাহিনিতে আমার কল্পনার গোয়েন্দাচরিত্র এক সপ্তাহের পুরনো একটা লাশ দেখতে যায়। তাকে তখন নাকের নিচে মাখার জন্য ভিক্স-ভ্যাপোরাব দেয় ক্রাইম সিন একযামিনার। এক সপ্তাহ ধরে পচেছে লাশ, কাজেই বিকট গন্ধ বের হতে থাকবে ওটা থেকে, সুতরাং নাকের নিচে যদি ওই মেনথোলেটাম লাগিয়ে নেয় আমার গোয়েন্দা, তা হলে সেটা ভালো হবে ওর জন্য– মলমের গন্ধের নিচে চাপা পড়ে যাবে পচা-লাশের দুর্গন্ধ। বলা বাহুল্য, বুদ্ধিটা আমার না, হোথর্নের।

ইলেভেন্থ আওয়ার ফিল্মসের প্রোডাকশন অফিসে প্রথম দেয়া হয় ওর সঙ্গে। আমি যে-সিরিযের কথা বলেছি একটু আগে, সেটা বানাচ্ছিল ওই প্রতিষ্ঠান। প্রথম পরিচয়ের পরই যখন-তখন যোগাযোগ করতে লাগলাম হোথর্নের সঙ্গে, এটা-সেটা জিজ্ঞেস করতে লাগলাম। ওসব কাজ টেলিফোনেই সেরে নেয়া যেত।

মনে আছে, প্রথমবার যখন দেখি হোথর্নকে, তখন ওই প্রোডাকশন অফিসের রিসিপশন এরিয়ায় পায়ের উপর পা তুলে বসে ছিল সে, রেইনকোটটা খুলে ভাঁজ করে রেখেছিল কোলের উপর। ওকে দেখামাত্র বুঝতে পারি, ওর সঙ্গেই দেখা করার কথা আমার।

সে বিশালদেহী কেউ না। এবং প্রথম দেখায় মোটেও ভয়ঙ্কর বলে মনে হয় না ওকে। কিন্তু আমাকে দেখামাত্র যেভাবে দাঁড়িয়ে গেল, সে-ভঙ্গি দেখে কোনো প্যান্থার বা চিতাবাঘের কথা মনে পড়ে গেল আমার। অত মসৃণ আর ক্ষিপ্র গতিতে কোনো মানুষকে কখনও উঠে দাঁড়াতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বিদ্বেষ বা অপচিকীর্ষায় যেন জ্বলজ্বল করছে ওর হালকা বাদামি দুই চোখ। মনে হলো, আমাকে যেন চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে সে, যেন হুমকি দিচ্ছে নিঃশব্দে। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। খুবই ছোট করে কাটিয়ে-রাখা চুলের রঙ ঠাহর করা যায় না চট করে। ওগুলো ওর দুই-কানের কাছে ধূসর হতে শুরু করেছে। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। গায়ের রঙ পাণ্ডুর। কল্পনা করে নিলাম, যখন ছোট ছিল সে, তখন সুন্দর ছিল; কিন্তু তারপর ওর জীবনে এমন কিছু-একটা ঘটেছে, যার ফলে কুৎসিত-না- হওয়ার পরও আকর্ষণীয়-বলতে-যা-কিছু ছিল ওর চেহারায় সব বিদায় নিয়েছে। ব্যাপারটা যেন এ-রকম: সে নিজেই পরিণত হয়েছে নিজের বাজে একটা ফটোগ্রাফে।

স্যুট, সাদা শার্ট আর টাই পরেছে সে; স্মার্ট দেখাচ্ছে ওকে। উঠে দাঁড়ানোয় রেইনকোটটা এখন ভাঁজ করা অবস্থায় আছে এক হাতের উপর। তাকিয়ে আছে আমার দিকে, আরও বেশি জ্বলজ্বল করতে শুরু করেছে চোখ দুটো… যেন কৌতূহল অতি-মাত্রায় পেয়ে বসেছে ওকে… আমি যেন চমকে দিয়েছি ওকে।

‘হ্যালো, অ্যান্টনি,’ বলল সে, ‘আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালো লাগল।’

আমি কে, সেটা সে জানল কী করে? অফিসে অনেকেই আসছে এবং যাচ্ছে, কেউই আমার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেনি, আমার নাম উচ্চারণ করেনি। আমিও ওকে কিছু বলিনি।

তা হলে?

‘আমি আপনার লেখালেখির একজন ভক্ত বলতে পারেন,’ বলছে হোথর্ন, কিন্তু ওর বলার ভঙ্গি দেখেই বুঝলাম, আমার একটা লেখাও পড়েনি কখনও।

‘ধন্যবাদ, ভদ্রতা করলাম আমি। ‘আমিও আপনার সঙ্গে কাজ করার জন্য মুখিয়ে আছি।’

‘মজা হবে তা হলে।’

কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, হোথর্নের সঙ্গে কাজ করে একটুও মজা পাইনি আমি।

আগেও বলেছি, টেলিফোনে ওর সঙ্গে প্রায়ই কথা হতো আমার। ছয়-সাতবার দেখাও করেছি বিভিন্ন জায়গায়। কখনও কখনও ওই প্রোডাকশন কোম্পানির অফিসে, কখনও আবার জে অ্যান্ড এ’র বাইরে। (ধূমপানের বদভ্যাস আছে হোথর্নের, চেইনস্মোকার বলা যায় ওকে… ল্যাম্বার্ট অ্যান্ড বাটলার অথবা রিচমন্ডের মতো সস্তা সিগারেট খায় বেশিরভাগ সময়। )

জানতে পারলাম, এসেক্সে থাকে সে, কিন্তু সেটা ঠিক কোন্ জায়গায়, সে- ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো ধারণা পেলাম না। নিজের ব্যাপারে কখনোই কিছু বলত না সে। পুলিশফোর্সে থাকতে কী করত না-করত, সে-ব্যাপারেও কিছু বলত না কখনও। কেন হঠাৎ বরখাস্ত করা হয়েছে ওকে, তা নিয়ে ভুলেও কোনো শব্দ উচ্চারণ করেনি কোনোদিন।

কিন্তু আমার কৌতূহল কি আর থেমে থাকে? তাই একদিন গিয়ে ধরলাম সেই প্রোডাকশন সুপারভাইযারকে।

জানা গেল, বেশ কয়েকটা হাই-প্রোফাইল মার্ডার ইনভেস্টিগেশনে কাজ করেছে হোথর্ন। এবং বেশ নামডাকও আছে ওর। গুগলে সার্চ দিলাম ওর নামটা, কিন্তু কিছু পাওয়া গেল না।

অসাধারণ একটা মন… বলা ভালো, কল্পনাশক্তির অধিকারী সে। লেখালেখির কোনো অভ্যাস নেই, কোনো পরিকল্পনাও নেই ওই ব্যাপারে। আমার সেই সিরিয নিয়েও বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই ওর। তারপরও, যখনই ওই সিরিযের চিত্রনাট্যের কোনো একটা ঘটনা নিয়ে আলোচনা করতাম ওর সঙ্গে, ঘটনার শেষটা বলে দিত সে, এবং আশ্চর্য হয়ে টের পেতাম, ঠিক সে-রকম কিছু-একটাই ভেবে রেখেছিলাম আমি। আবারও একটা উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হয়ে যাবে ব্যাপারটা। ওই চিত্রনাট্যের একজায়গায় ছিল, আমার সেই গোয়েন্দাচরিত্র, কৃষ্ণাঙ্গ একটা ছেলেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে পুলিশের হাত থেকে। পুলিশ ওই ছেলের বিরুদ্ধে একটা মেডেল চুরির অভিযোগ এনেছে। বলা হচ্ছে, মেডেলটা নাকি পাওয়া গেছে ওই ছেলের জ্যাকেটের পকেটে। কিন্তু সে-মেডেল হাতে নিয়ে দেখা গেল, সম্প্রতি পরিষ্কার করা হয়েছে সেটা। তারপর পরীক্ষা করা হলো ওই ছেলের জ্যাকেটের পকেট, কিন্তু সালফেইমিক অ্যাসিড অথবা অ্যামোনিয়ার কোনো নমুনা পাওয়া গেল না– ওগুলোই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় রূপার জিনিসপত্র পরিষ্কার করার কাজে। তার মানে প্রমাণিত হয়ে গেল, ছেলেটার জ্যাকেটের পকেটে ওই মেডেল থাকতে পারে না। অর্থাৎ, ওটা চুরি করেনি সে।

বলা বাহুল্য, এই আইডিয়াও ছিল হোথর্নের

আমাকে যে পদে-পদে সাহায্য করেছে সে, সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই আমার। তারপরও ওর সঙ্গে যতবার যোগাযোগ করেছি, যতবার দেখা করেছি, অদ্ভুত এক শঙ্কা ততবার কাজ করেছে আমার মনে। অকাজের কথা একটাও বলতে রাজি না সে… যতবার কথা হয়েছে ওর সঙ্গে প্রায় ততবারই সরাসরি চলে গেছে মূল প্রসঙ্গে। ভাবখানা এমন, দুনিয়ার কোনো কিছু নিয়েই কোনো আগ্রহ নেই ওর। লোকে এটা-সেটা নিয়ে কত কথা বলে… আবহাওয়া অথবা সরকার থেকে শুরু করে ফুকুশিমার সাম্প্রতিক ভূমিকম্প অথবা প্রিন্স উইলিয়ামের বিয়ে; কিন্তু হাতে যে-কাজ আছে সেটা ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে কখনও একটা কথাও বলতে শুনিনি হোথৰ্নকে।

ওর আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করেছি। যতবার আমার সঙ্গে সময় কাটিয়েছে, কফি (কালো, চিনিসহ) খেয়েছে, সিগারেট টেনেছে, কিন্তু কোনো খাবার খায়নি। এমনকী বিস্কিটও না। এবং সব সময় একই কাপড় পরে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। সুতরাং, ওই যে বলেছিলাম, সে নিজেই যেন পরিণত হয়েছে নিজের বাজে একটা ফটোগ্রাফে– সেই একই ফটো বার বার দেখতে হয়েছে আমাকে। সেই ফটোর যেমন কোনো পরিবর্তন নেই, ওরও তেমন কোনো পরিবর্তন নেই।

মজার কথা হলো, আমার ব্যাপারে অগাধ জ্ঞান হোথর্নের। আমার প্রায় সব কিছুই জানে সে। ওর সঙ্গে যেদিন প্রথমবার দেখা হলো, তার আগের রাতে গলা ভেজানোর জন্য বাসার বাইরে গিয়েছিলাম। আমার সহকারী অসুস্থ ছিল, সপ্তাহান্তের দুটো দিন বুঁদ হয়ে ছিলাম আমি লেখালেখির কাজে। আশ্চর্য, কথাগুলো আমাকে গড়গড় করে বলে দিল হোথর্ন! অফিসের কারও সঙ্গে আমার ব্যাপারে কথা বলছিল কি না সে, ভাবলাম। কিন্তু বললেই বা কী… যে-কথা বলে আমাকে তাজ্জব বানিয়ে দিয়েছে সে, সেটা তো জানার কথা না অফিসের কারও!

যা-হোক, আমার সেই চিত্রনাট্যের দ্বিতীয় খসড়াটা যখন দেখালাম ওকে, ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কের অবনতিটা ঘটল তখনই। ঘটনাটা বলার আগে আরেকটা কথা বলে রাখি। সে-সময় কোনো একটা পর্বের শুটিং শুরু হওয়ার আগে ওই পর্বের চিত্রনাট্য লেখা এবং সম্পাদনার কাজটা কমপক্ষে বারোবার করতে হতো আমাকে কারণ কখনও এটা-সেটা বিভিন্ন বিষয় পরিবর্তন করতে বলতেন প্রযোজক নিজেই, কখনও আবার সেটা করতে বলত আমাদের ব্রডকাস্টার। কখনও বলত আমার এজেন্ট, আবার কখনও পরিচালক বা কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রী। আসল কথা হচ্ছে, সবাই চাইত, কোনো খুঁত বা সমস্যা যাতে না-থাকে সেই চিত্রনাট্যে।

কিন্তু হোথর্ন ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। এই ব্যাপারে ওর আচরণ ছিল ইট- দিয়ে-বানানো নিরেট কোনো দেয়ালের মতো। এই ব্যাপারে একবার যদি সে মনে করত কোথাও কোনো ভুল হয়েছে, তা হলে ওকে বোঝানোটা ছিল এককথায় অসম্ভব।

আরও একটা উদাহরণ দেয়া যাক। চিত্রনাট্যের একজায়গায় আমার গোয়েন্দা দেখা করতে গেছে ওর সিনিয়র অফিসার… অর্থাৎ পুলিশের একজন চীফ সুপারিনটেন্ডেন্টের সঙ্গে। কোথায় দেখা করতে গেছে তা-ও বলি… প্রত্যন্ত এক ফার্মহাউসের ভিতরে আবিষ্কৃত হয়েছে এক প্রাণীঅধিকার-কর্মীর লাশ, সেখানে। ওকে বসতে বলেছেন চীফ সুপারিনটেন্ডেন্ট, কিন্তু জবাবে সে বলছে, ‘আপনি যদি কিছু মনে না-করেন, তা হলে দাঁড়িয়েই থাকি আমি, স্যর।’

আসলে আমি বোঝাতে চেয়েছিলাম, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কিছুটা হলেও ঝামেলা আছে আমার গোয়েন্দা চরিত্রের। কিন্তু হোথর্ন সেটা মানতে নারাজ।

ও-রকম কখনও হয় না,’ সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিল সে।

কোনো একটা রেস্টুরেন্টের বাইরে বসে ছিলাম আমরা সেদিন… ঠিক কোথায় বসে ছিলাম তা এখন আর মনে নেই; আমাদের দু’জনের মাঝখানে একটা টেবিলের উপর রাখা ছিল চিত্রনাট্যের পাণ্ডুলিপিটা। বরাবরের মতো হোথর্নের পরনে স্যুট আর টাই। প্যাকেটের শেষ সিগারেটটা খাচ্ছে সে, খালি প্যাকেটটা ব্যবহার করছে অ্যাশট্রে হিসেবে।

‘কেন হয় না?’ জানতে চাইলাম আমি।

‘কারণ আপনার সিনিয়র কোনো কর্মকর্তা যদি বসতে বলেন আপনাকে, তা হলে আপনাকে বসতেই হবে।’

‘আমার গোয়েন্দা-চরিত্র যে বসেনি, সেটা তো কোথাও বলিনি আমি।’

‘না, তা বলেননি, তবে সে ব্যাপারটা নিয়ে তর্ক করেছে। (ছাপার অযোগ্য একটা গালি দিয়ে বসল হোথর্ন) আপনার গোয়েন্দাচরিত্র এ-রকম বোকাটে কেন, বুঝলাম না।’

কথায় কথায় গালি দেয়ার বদভ্যাসও আছে ওর।

‘আসলে ঘটনার সঙ্গে… বলা ভালো দৃশ্যটার সঙ্গে দর্শককে পরিচয় করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছি আমি ওই সংলাপের মাধ্যমে,’ বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম। ‘তার চেয়েও বড় কথা, দু’জন পুলিশ অফিসারের পারস্পরিক সম্পর্কটা ফুটে উঠেছে ওই সংলাপের মধ্য দিয়ে।’

‘কিন্তু ভুল করেছেন আপনি, টনি, মিথ্যা একটা দৃশ্যের অবতারণা করেছেন। আনাড়ির মতো হয়ে গেছে কাজটা।’

‘মিথ্যা দৃশ্য? বাস্তব জীবনে যেমনটা ঘটে, টেলিভিশনের কোনো সিরিযে কি ঠিক তা-ই দেখানো হয়? টিভিতে পুলিশ, ডাক্তার, নার্স বা অপরাধীদের দেখে যা শিখি আমরা, তাদেরকে নিয়ে যখন কিছু লিখি, সেই শিক্ষাটাই কিন্তু তখন ঘুরপাক খেতে থাকে আমাদের মস্তিষ্কে… আমরা সে-শিক্ষা দ্বারা অনুপ্রাণিত হই। বাস্তবের পুলিশ, ডাক্তার, নার্স বা অপরাধী কেমন হয়, সেটা কিন্তু ভাবি না আমরা বেশিরভাগ সময়ই।’

কিন্তু ব্যাপারটা হোথর্নকে বোঝানো গেল না কিছুতেই। আমার সঙ্গে রীতিমতো তর্ক জুড়ে দিল সে… বিশেষ করে যেসব দৃশ্যে পুলিশি কর্মকাণ্ড আছে, সেসব নিয়ে। কিছুতেই বোঝাতে পারলাম না ওকে, আমি যা লিখেছি তা একটা কল্পকাহিনি মাত্র, কোনো ডকুমেন্টারি ফিল্ম না।

কাজেই পাঁচ পর্বের ওই ধারাবাহিকের সবগুলো চিত্রনাট্য যখন লেখা হলো শেষপর্যন্ত, যখন সেগুলো তুলে দিতে পারলাম যথাযথ কর্তৃপক্ষের হাতে, এবং যখন আর যোগাযোগ করার দরকার থাকল না হোথর্নের সঙ্গে, তখন আমি যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। এটা-সেটা জানার যদি দরকার হতো কখনও, প্রোডাকশন অফিসকে বলে দিতাম, ওরাই তখন ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করত হোথর্নের সঙ্গে।

সাফোক আর লন্ডনে চিত্রায়িত হলো ওই সিরিয। চার্লি ক্রিড-মাইল্স্ নামের দুর্দান্ত এক অভিনেতা অভিনয় করলেন আমার সেই গোয়েন্দা-চরিত্রে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তাঁর সঙ্গে হোথর্নের শারীরিক গঠনের খুব মিল। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, হোথর্ন ততদিনে ঢুকে পড়েছে আমার অবচেতন মনে… আমার চরম বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে; কাজেই ওর চরিত্রের খারাপ দিকগুলো হয়তো অবচেতনভাবেই আমি ঢুকিয়ে দিতে শুরু করেছি আমার গোয়েন্দা-চরিত্রের ভিতরে। তার নামও আমি রেখেছিলাম হোথর্নের নামের সঙ্গে মিলিয়ে- ড্যানিয়েলের সঙ্গে মিল রেখে মার্ক, আর হোথর্নের সঙ্গে মিল রেখে ওয়েনবর্ন। চার নম্বর পর্বের শেষে যখন মার্ক ওয়েনবর্নকে মেরে ফেললাম আমি, স্বীকার করছি, তখন একটুখানি হলেও হাসি ফুটে উঠেছিল আমার ঠোঁটের কোনায়।

ফিরে আসি বর্তমানে। হোথর্ন কেন হঠাৎ দেখা করতে চাইছে আমার সঙ্গে, ভাবছি। আমার যে-জগৎ, তাতে ওর কোনো ভূমিকা নেই। এবং ওকে এই মুহূর্তে কোনো কাজে দরকারও নেই আমার। আবার এই কথাও সত্যি, এখনও লাঞ্চ সারিনি, আর ওদিকে লন্ডনের সেরা যত কেক আছে সব পাওয়া যায় জে অ্যান্ড এ-তে।

শেষপর্যন্ত ঠিক সময়েই গেলাম জায়গামতো।

রেস্টুরেন্টের বাইরে আমার জন্য অপেক্ষা করছে হোথর্ন, একটা টেবিলের ধারে কফি আর সিগারেট নিয়ে বসেছে। শেষবার যখন দেখেছিলাম ওকে, তখন ওর পরনে যা ছিল, এখনও তা-ই আছে: সেই একই স্যুট, একই টাই, একই রেইনকোট। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে মুখ তুলে তাকাল, মাথা ঝাঁকাল।

‘শুটিং কেমন হলো আপনাদের?’ জানতে চাইল।

‘কাস্ট এবং ক্রু-স্ক্রীনিঙের সময় আসা উচিত ছিল আপনার,’ বললাম আমি। ‘লন্ডনের একটা হোটেল ভাড়া নিয়ে সেখানে প্রথম দুটো পৰ্ব দেখিয়েছিলাম আমরা। আপনাকে নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ওই অনুষ্ঠানে।’

‘ব্যস্ত ছিলাম আমি তখন,’ বলল সে।

একজন ওয়েইট্রেস এগিয়ে এল আমাদের দিকে। চা আর একটুকরো ভিক্টোরিয়া স্পঞ্জের অর্ডার দিলাম আমি। তারপর তাকালাম হোথর্নের দিকে। ‘কেমন আছেন?’

অনিশ্চিত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল সে। ‘আছি একরকম… কোনো অভিযোগ নেই আর কী। গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন মনে হয়?’

ঘটনাক্রমে সেদিন সকালেই ফিরেছি আমি সাফোক থেকে। আমার স্ত্রীকে নিয়ে দুটো দিন কাটিয়েছি সেখানে।

‘হ্যাঁ,’ ক্লান্ত গলায় বললাম।

‘নতুন একটা কুকুরছানাও পেয়ে গেছেন বোধহয়!’

কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকালাম হোথর্নের দিকে। এটা ওর আরেকটা ট্রেডমার্ক। নিজে থেকে যদি কিছু না-ও বলি আমি ওকে, এটা-সেটা বিভিন্ন কথা বলে দেয় সে আমার ব্যাপারে। কী করে করতে পারে কাজটা, সে-ই ভালো জানে। লন্ডনের বাইরে গিয়েছিলাম আমি, সেটা এখন-পর্যন্ত জানাইনি কাউকে। এমনকী টুইটারেও কিছু লিখিনি ওই ব্যাপারে। আর ওই কুকুরছানার কথা যদি বলি… ওটা আমাদের এক প্রতিবেশীর। তাঁরা একটা কাজে বাড়ির বাইরে ছিলেন কিছু দিন, তখন ওটার দেখভাল করতে হয়েছে আমাদেরকে।

জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি জানলেন কীভাবে?’

‘অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান,’ আমার প্রশ্নটা পাশ কাটিয়ে গেল হোথর্ন। ‘যা-হোক, কাজের কথায় আসি। একটা ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করতে পারবেন?

‘যেমন?’

‘আমাকে নিয়ে কিছু লিখতে পারবেন?’

যতবার দেখা হয়েছে হোথর্নের সঙ্গে, কিছু-না-কিছু বলে আমাকে চমকে দিয়েছে সে… আজ আরও একবার চমকে উঠলাম।

‘মানে?’

‘আমি চাই আমাকে নিয়ে একটা বই লিখুন আপনি।’

‘সেটা কেন করতে যাবো আমি?’

‘টাকার জন্য।’

‘কে দেবে আমাকে সে-টাকা? আপনি?’

‘না। বইটা লিখে যা কামাই হবে, সেটা আধাআধি ভাগ করে নেবো আমরা দু’জন।’

দু’জন লোক এগিয়ে এল আমাদের দিকে, পাশের টেবিলটাতে বসে পড়ল। নার্ভাস লাগছে আমার– মুখের উপর মানা করে দিতে ইচ্ছা করছে হোথর্নকে, কিন্তু করতে পারছি না কাজটা।

‘বুঝলাম না আসলে,’ বললাম আমি। ‘ঠিক কী ধরনের বইয়ের কথা বলছেন আপনি?’

ঘোলাটে দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে হোথর্ন। ‘বুঝিয়ে বলি তা হলে। আপনি জানেন, টেলিভিশনের জন্য এখানে-সেখানে টুকটাক কাজ করি আমি। হয়তো এই কথাও শুনেছেন, পুলিশফোর্স থেকে লাথি মেরে বের করে দেয়া হয়েছে আমাকে। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, এখন টুকটাক কনসালটেন্সিও করি… এবং সেটা পুলিশের জন্য। তবে ব্যাপারটা আনঅফিশিয়াল। অস্বাভাবিক কোনো কিছু যখন ঘটে, তখন ডাক পড়ে আমার, কাজে লাগানো হয় আমাকে… ওরা আসলে কাজে লাগায় আমার কর্মঅভিজ্ঞতাকে। কখনও কখনও কোনো কোনো কেস একেবারে পানির-মতো সহজ হয় মেট্রোপলিটন পুলিশের জন্য, কখনও আবার তা হয় না। যখনই কঠিন কোনো সমস্যায় পড়ে যায় তারা, দ্বারস্থ হয় আমার।’

‘আসলেই?’ কথাটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে আমার।

‘হ্যাঁ। আধুনিক পুলিশ এভাবেই কাজ করে আজকাল। আসলে বিভিন্ন কারণে অভিজ্ঞ এত লোককে বাদ দেয়া হয়েছে ফোর্স থেকে যে, জটিল কোনো সমস্যার সমাধান করার জন্য এখন আর কেউই নেই বলা যায়। গ্রুপ ফোর অথবা সার্কোর নাম শুনেছেন? দুটোই বেসরকারি তদন্ত সংস্থা… সাহায্য করে পুলিশকে। এমন সব উপায়ে এমন সব তথ্য জোগাড় করে তারা, যা পুলিশের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। শুধু তা-ই না। ল্যাম্বেথে বড় একটা ল্যাবরেটরি আছে আমাদের, প্রয়োজন হলে সেটাও ব্যবহার করি। কখনও কখনও রক্তের-নমুনা পরীক্ষা করিয়ে নেয়া হয় সেখান থেকে, অন্য বিভিন্ন ফরেনযিক সাপোর্টও পাই। কাজেই এখন আমাকে একটা এক্সটার্নাল রিসোর্স বলা যায়।’

থামল হোথর্ন… যেন নিশ্চিত হতে চাইছে, ওর কথা আসলেই শুনছি কি না আমি।

মাথা ঝাঁকালাম।

পকেট থেকে সিগারেটের আরেকটা প্যাকেট বের করল সে, আরেকটা সিগারেট ধরাল।

বলতে লাগল, ‘ওই কনসালটেন্সি করে নিজের খরচটা ভালোই চালিয়ে নিতে পারছি। দিন-প্রতি একটা ভাতা তো পাই-ই, খরচাপাতি যা-যা লাগে তা-ও দেয়া হয় আমাকে। কিন্তু ইদানীং একটু টানাটানির মধ্যে পড়ে গেছি। কারণ আজকাল আর খুন-টুন তেমন একটা হচ্ছে না। যা-হোক, সেই টিভি শো-তে পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করতে গিয়ে যখন পরিচয় হলো আপনার সঙ্গে, তখন জানতে পারলাম, আপনি নাকি বইও লেখেন। তখনই একটা চিন্তা খেলে গিয়েছিল আমার মাথায়– আমরা একজন আরেকজনকে সাহায্য করতে পারি। বখরা আধাআধি। ইন্টারেস্টিং অনেক কাহিনি জানা আছে আমার। সেসব নিয়ে… মানে, আমাকে নিয়ে লিখতে পারেন আপনি।’

‘কিন্তু… আমি তো বলতে গেলে চিনিই না আপনাকে।’

‘আমাকে চিনতে বেশি সময় লাগবে না আপনার। …এখন একটা কেস আছে আমার হাতে! বেশিদিন হয়নি ওই কেস নিয়ে কাজ করছি, তবে… আমার মনে হয় আপনি যে-ঘরানার লেখক, কেসটা মনঃপুত হবে আপনার।’

আমার কেক আর চা নিয়ে হাজির হলো ওয়েইট্রেস। মনে মনে আফসোস করলাম– কেন যে অর্ডার দিতে গিয়েছিলাম এসব! এগুলো যদি না-দেয়া হতো এখন আমার সামনে, তা হলে যেভাবেই হোক হোথর্নকে পাশ কাটিয়ে বাসার পথ ধরতে পারতাম।

বললাম, ‘একটা কথা বলুন তো। বিখ্যাত শত শত লোক আছে দেশে- বিদেশে। তাঁদের কথা বাদ দিয়ে আপনার কথা কেন পড়তে যাবে লোকে?’

‘কারণ আমি একজন গোয়েন্দা। লোকে গোয়েন্দাকাহিনি পড়তে পছন্দ করে।’

‘কিন্তু গোয়েন্দা বলতে যা বোঝায়, আপনি তো সে-রকম কেউ না আসলে। চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে আপনাকে। …আচ্ছা, ভালো কথা, আপনাকে বরখাস্ত করা হলো কেন, বলুন তো?’

‘ওই ব্যাপারে কথা বলতে চাই না আমি।’

‘দেখুন, আপনি কিন্তু আবারও একগুঁয়েমি শুরু করেছেন। যদি চান আপনাকে নিয়ে কিছু লিখি আমি, তা হলে সব কথা সোজাসুজি বলতে হবে আমাকে। আপনার ব্যাপারে সব কথা জানা দরকার আমার।’

‘যেমন?’

‘কোথায় থাকেন আপনি। বিয়ে করেছেন কি না। ব্রেকফাস্টে কী খেয়েছেন আজ। যখন হাতে কোনো কাজ থাকে না তখন কী করেন… মোদ্দা কথা, আপনার ব্যাপারে সব জানতে হবে আমাকে। …গোয়েন্দাকেই যদি ঠিকমতো জানতে না- পারে লোকে, তা হলে খুনের গল্প পড়বে কেন?’

‘আপনার কি তা-ই মনে হয়?’

‘হ্যাঁ।’

মাথা নাড়ল হোথর্ন। ‘একমত হতে পারলাম না আপনার সঙ্গে। দ্য ওয়ার্ড ইয মার্ডার… মানে, আসল কথা হলো খুন। লোকে পড়বে একটা খুনের গল্প… গোয়েন্দা কীভাবে সমাধান করে হত্যারহস্যটার। গোয়েন্দাকে চিনে কী করবে তারা?’

সেক্ষেত্রে বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আপনার আইডিয়াটা ভালো ছিল, সন্দেহ নেই যে-কেস নিয়ে কথা বলতে চাইছিলেন সেটা ও দারুণ কিছু-একটা ছিল। কিন্তু আমি আসলেই খুব ব্যস্ত। তা ছাড়া আপনি যে-প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন আমার কাছে, সে-রকম কোনো কাজ করি না আমি। নিজের গোয়েন্দাকে নিজের কল্পনামতো সাজিয়ে নিই, বাস্তবের কারও সঙ্গে মেশাই না। ছোট্ট একটা উদাহরণ দিই, তা হলেই বুঝতে পারবেন। শার্লক হোমসের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন। এই কিছু দিন আগে ওকে নিয়ে একটা কাহিনি লিখে শেষ করলাম। পোয়ারোকে নিয়েও টুকটাক লিখেছি, টিভিতে একটা রহস্যকাহিনি-নির্ভর সিরিযও লিখেছি… নাম মিডসামার মার্ডার্স। মোদ্দাকথা, আমি কল্পকাহিনির লেখক। বাস্তব জীবনের ঘটনা নিয়ে যাঁরা লেখালেখি করেন, তাঁদের কাউকে খুঁজে বের করা উচিত আপনার।’

‘কথা তো একই, তা-ই না? আপনিও লেখক, যাঁদেরকে খুঁজে বের করতে বলছেন তাঁরাও লেখক।

‘না, কথা এক না। আমার প্রতিটা কাহিনির উপর আমার পূর্ণ দখল আছে। যা লিখি আমি, তার আদ্যোপান্ত আমার মাথায় থাকে সব সময়। নিজের মতো করে একটা অপরাধ তৈরি করি আমি, কিছু ক্লু জুড়ে দিই ওই ঘটনার সঙ্গে, তারপর ঘটনাপ্রবাহ সাজাই নিজের মতো করে। গোয়েন্দাকাহিনিকে যদি এভাবে উপস্থাপন করা হয় পাঠকের কাছে, তা হলে তারা মজা পায়, বইয়ের কাটতি বাড়ে। কিন্তু কোনো একটা গোয়েন্দাকাহিনিকে যদি একজন গোয়েন্দার দৃষ্টিভঙ্গিতে বর্ণনা করতে শুরু করি, তা হলে কেমন হবে ব্যাপারটা, ভেবে দেখেছেন? কোথায় কোথায় গেলেন আপনি, সেসব লিখতে হবে আমাকে। কী কী দেখলেন, কার কার সঙ্গে কী কী কথা বললেন, লিখতে হবে সেসবও। ওসবে মজা পাবে না পাঠক।’ মাথা নাড়লাম। ‘আমি দুঃখিত, মিস্টার হোথর্ন। আপনার প্রস্তাবে আগ্রহ পাচ্ছি না।’

সিগারেটের যে-অংশটা পুড়ছে, সেটার উপর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে হোথর্ন। আশ্চর্য হয়নি সে, অপমানিতও হয়নি। ওকে দেখে মনে হচ্ছে, ওর প্রস্তাবের জবাবে কী বলবো আমি, তা যেন আগে থেকেই জানত।

‘তার মানে আপনি আসলে বইয়ের কাটতি নিয়ে ভাবছেন। কিন্তু যে-কাহিনি শোনাবো আমি আপনাকে, সেটার বিক্রি যদি দারুণ হয়, তা হলে? কোন্ কেস নিয়ে কাজ করছি আমি এখন, সেটা কি শুনতে চান না?’

ওর মুখের উপর সরাসরি বলে দিতে চাইছিলাম, না, চাই না; কিন্তু আমাকে সুযোগটা না-দিয়ে সে বলে চলল, ‘কেসটা একজন মহিলার। একটা ফিউনারেল পার্লারে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন তিনি। পার্লারটা লন্ডনের আরেক প্রান্তে, দক্ষিণ কেনসিংটনে। নিজের শেষকৃত্যানুষ্ঠান কীভাবে করতে চান তিনি, তা নিয়ে বিস্তারিত কথা বললেন ওই পার্লারের ফিউনারেল ডিরেক্টরের সঙ্গে। এবং সেদিনই, ঘণ্টা ছয়েক পর, কেউ একজন খুন করেছে তাঁকে… ঢুকে পড়েছিল তাঁর বাড়িতে, গলায় ফাঁস লাগিয়ে শেষ করে দিয়েছে তাঁকে। এবার বলুন, পুরো ঘটনা কি স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে আপনার কাছে?’

আরও একবার টের পেলাম, কৌতূহল মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে আমার ভিতরে। ‘কে ওই মহিলা?’

‘এই মুহূর্তে তাঁর নামটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। তবে কথা হচ্ছে, তিনি ধনী একজন মানুষ ছিলেন। তাঁর একটা ছেলে আছে, সে-লোক আবার নিজনামে পরিচিত। আরেকটা কথা। যতদূর জানতে পেরেছি, এই পৃথিবীতে শত্রু বলে কেউ ছিল না ওই মহিলার। যে-ক’জনের সঙ্গে কথা বলেছে পুলিশ, সবাই পছন্দ করত তাঁকে। কেসটা জটিল, আর সে কারণেই তলব করা হয়েছে আমাকে।’

লোভ জাগল আমার মনে।

একটা হত্যারহস্য নিয়ে যদি কোনো কাহিনি লিখতে হয়, তা হলে সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে প্লট দাঁড় করানো। যে-সময়ের কথা বলছি, তখন আমার মাথায় ও-রকম কোনো প্লট নেই। কারণ টেলিভিশনের জন্য ধারাবাহিকভাবে নাটক লিখে- লিখে প্রায় সব রকমের প্লট ‘শেষ’ করে ফেলেছি আমি। টাকার জন্য কেউ কাউকে খুন করছে… লিখে ফেলেছি। অন্যের স্ত্রী বা চাকরি হাতিয়ে নিতে চায় কেউ… তা- ও লেখা হয়ে গেছে। কেউ কাউকে ভয় পাচ্ছে, আর সে-কারণে ঘটে গেছে একটা হত্যাকাণ্ড; সেটাও দেখে ফেলেছে আমার দর্শকরা। কেউ কারও গোপন কোনো কথা জেনে ফেলেছে, ফলে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দেয়া হয়েছে তাকে… এ-রকম কাহিনিও উপহার দিয়েছি আমার পাঠকদের। বদলা নেয়ার জন্য খুন করা, অথবা দুর্ঘটনাক্রমে খুন করে ফেলা… লিখেছি ওসব নিয়েও।

আরও কথা আছে। মৌলিক কোনো কাহিনির জন্য অপরিহার্য একটা শর্ত হচ্ছে রিসার্চ বা গবেষণা। আমি যদি কোনো হোটেলের বাবুর্চিকে খুনি বানাতে চাই, তা হলে আগে ওই হোটেলটা ভালোমতো দেখতে হবে আমাকে। তাদের ক্যাটারিং বিযনেসটা ভালোমতো বুঝতে হবে। উদ্ভাবন করতে হবে আরও বিশ কি ত্রিশটা চরিত্র। তারপর আমাকে বুঝতে হবে পুলিশি তদন্ত কীভাবে চলে–ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ফরেনযিক সাইন্স, ডিএনএ… এবং এ-রকম আর যা-যা আছে তার সব। অর্থাৎ মৌলিক কোনো উপন্যাসের প্রথম শব্দটা লেখার আগে কয়েক মাস ধরে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে আমাকে। কিন্তু যে-সময়ের কথা বলছি, তখন অত উদ্যম ছিল না আমার ভিতরে…. টিভি সিরিয়ালের জন্য দিনের-পর-দিন পরিশ্রম করে আমি যারপরনাই ক্লান্ত। দ্য হাউস অভ সিল্ক শেষ করার পর হোমসকে নিয়ে নতুন কী লিখবো, তা-ও ছিল না আমার মাথায় তখন। হোমসকে নিয়ে নতুন কিছু লেখার মতো উদ্যম ছিল কি না আমার ভিতরে তখন, সন্দেহ ছিল তা নিয়েও।

অর্থাৎ সোজাসুজি যদি বলি, শর্টকাট একটা পদ্ধতির প্রস্তাব দিচ্ছে আমাকে হোথর্ন। পুরো খাবারটা প্লেটে তুলে দিয়ে পরিবেশন করছে সে আমাকে। তা ছাড়া একটা কথা ঠিকই বলেছে সে– অজ্ঞাতনামা সেই মহিলার কেসটা ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে আমার কাছে। কথা নেই বার্তা নেই, একটা ফিউনারেল পার্লারে গিয়ে হাজির হলেন তিনি। উপন্যাসের শুরুটা যদি ওভাবেই করতে পারি… নাহ্, মন্দ হয় না তা হলে। বরং সত্যি বলতে কী, একেবারেই ব্যতিক্রমী কিছু-একটা দেয়া যায় পাঠকদের।

টের পেলাম, ওই উপন্যাসের প্রথম চ্যাপ্টার যেন চলে এসেছে আমার মাথায় ি বসন্তের এক রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল। শহরের একটা ঝকঝকে-তকতকে এলাকা। রাস্তা পার হলেন ওই মহিলা…

‘আপনি জানলেন কীভাবে?’ হুট করে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

‘কী?’

‘একটু আগে বললেন, আমি গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। বললেন, একটা কুকুরছানা পেয়েছি। এসব কথা আপনি জানলেন কী করে? কে বলেছে আপনাকে ওসব?’

‘কেউ বলেনি।’

‘তা হলে জানতে পারলেন কীভাবে?’

চোখমুখ কুঁচকে ফেলল হোথর্ন… জবাবটা যেন দিতে চাইছে না আমাকে। কিন্তু একইসঙ্গে বুঝতে পারছে, নিজের কাহিনি যদি আমাকে দিয়ে লেখাতে চায়, তা হলে আমার কথামতো কিছু-না-কিছু করতে হবে ওকে। বলল, ‘আপনার জুতোর তলায় বালি লেগে আছে। পায়ের উপর পা তুলে যখন বসলেন আপনি, তখন খেয়াল করলাম ব্যাপারটা। ঘটনাটার দুটো ব্যাখ্যা হতে পারে। নির্মাণকাজ চলছে, এমন কোনো বিল্ডিঙের নিচ দিয়ে হেঁটে এসেছেন। অথবা কোনো গ্রামাঞ্চলে গিয়েছিলেন, কারণ লন্ডনের পথেঘাটে বালির অস্তিত্ব বলতে-গেলে নেই। এখানে যে-জায়গায় থাকেন, সেখান থেকে সোজা পথে এই রেস্টুরেন্টে আসতে নির্মাণাধীন কোনো বাড়ি আছে বলে মনে পড়ে না আমার। আর অনেক আগে একবার শুনেছিলাম, অরফোর্ডে আপনাদের যে-গ্রামের বাড়ি আছে, মাঝেমধ্যেই সেখানে যান। তাই দুইয়ে দুইয়ে যোগ করে অনুমান করে নিলাম, সেখানেই গিয়েছিলেন আপনি।’

মনে মনে হোথর্নের পর্যবেক্ষণশক্তির প্রশংসা না-করে পারলাম না। সে দেখছি শার্লক হোমসের পদ্ধতি প্রয়োগ করতে শুরু করেছে!

বললাম, ‘আর কুকুরছানার ব্যাপারটা?’

‘খেয়াল করে দেখুন, আপনার জিন্সের হাঁটুর ঠিক নিচে কুকুরছানার থাবার দাগ লেগে আছে। তার মানে আপনাকে আদর করার জন্য, অথবা আপনার কাছ থেকে আদর পাওয়ার জন্য আপনার-গায়ে পা তুলে দিয়েছিল সেটা।’

তাকালাম আমার জিন্সের হাঁটুর দিকে। সত্যিই, কুকুরছানার থাবার অস্পষ্ট দাগ লেগে আছে সেখানে। দাগটা এত হালকা যে, আমি খেয়ালই করিনি। কিন্তু হোথর্ন ঠিকই খেয়াল করেছে।

একটা কথা মনে পড়ে গেল। ‘দাঁড়ান… দাঁড়ান… এক মিনিট! আপনি কী করে জানলেন ওটা কুকুরছানা? ওটা তো কোনো ছোট জাতের কুকুরও হতে পারে? তা ছাড়া… ওটা যে দেয়া হয়েছে আমাকে, মানে… রাস্তায় কোনো কুকুরের সঙ্গে যে মোলাকাত হয়নি আমার, নিশ্চিত হলেন কীভাবে?’

হতাশ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল হোথর্ন। ‘আপনার বাঁ পায়ের জুতোর ফিতাটা চিবানো হয়েছে। কাজটা যদি আপনার না-হয়ে থাকে, তা হলে সেটা কার, বলতে পারেন? পূর্ণ বয়স্ক কোনো কুকুর কি করবে ওই কাজ?’

ফিতাটার দিকে তাকালাম না আমি। সন্তুষ্ট হয়েছি, মনে মনে আরেকদফা প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছি হোথর্নের। একইসঙ্গে বেজার হয়েছি নিজের উপর- ব্যাখ্যা দুটো এত সহজ ছিল, অথচ ওগুলো আমার মাথায় আসেনি!

বললাম, ‘দুঃখিত। আপনি যে-কেসের কথা বলতে চাইছিলেন, সেটা আসলেই ইন্টারেস্টিং লাগছে আমার কাছে। তারপরও… যেমনটা বলেছি… কোনো একজন সাংবাদিক অথবা ও-রকম কাউকে খুঁজে বের করলেই ভালো হবে আপনার জন্য। আমি চাইলেও করতে পারবো না আপনারকাজটা। কারণ অন্য আরও কিছু কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে আমাকে আগামী বেশ কিছু দিন।’

‘কী আর করা’ ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে উঠে দাঁড়াল হোথর্ন, হাত ঢুকিয়ে দিল ট্রাউজারের পকেটে। ‘দাম দিয়ে দেবো?’

চা আর কেকের কথা বোঝাচ্ছে সে। ‘না, না, লাগবে না,’ ভদ্রতা করলাম, ‘আমিই দিয়ে দেবো। ধন্যবাদ।’

‘আমি এক কাপ কফি খেয়েছি।’

‘ঠিক আছে, ওটার দামও দিয়ে দেবো।’

‘যদি সিদ্ধান্ত বদল করেন, তা হলে যোগাযোগ করতে পারেন। কীভাবে খোঁজ পাওয়া যাবে আমার, জানা আছে আপনার!

‘হ্যাঁ, অবশ্যই। আমি আমার এজেন্টের সঙ্গে কথা বলে দেখবো। আপনাকে সাহায্য করতে পারবে, এমন কারও খোঁজ দিতে পারবে মেয়েটা।’

‘না, থাক। যদি দরকার হয়, আমি নিজেই খুঁজে নিতে পারবো কাউকে।’ ঘুরে চলে গেল হোথর্ন।

কেকটা শেষ করলাম আমি। ভেবে খারাপ লাগছে, শুধু শুধু অপচয় করলাম কিছু টাকা। বাসায় ফিরে গেলাম, যে-উপন্যাসটা পড়ছিলাম সেটা নিয়ে বসলাম আবার। হোথর্নকে ভুলে থাকার চেষ্টা করছি, কিন্তু ওর কথা মনে পড়ছে বার বার।

কেউ যদি ফুল-টাইম লেখক হয়ে যায়, তা হলে কোনো কাজ প্রত্যাখ্যান করাটা তার জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ। কোনো কাজ প্রত্যাখ্যান করার মানে হচ্ছে, এমন কোনো দরজা লাগিয়ে দেয়া, যেটা আর কখনও খুলবে না। এবং লাগিয়ে-দেয়া সেই দরজার ওপাশে কী আছে, তা সম্পূর্ণ মিস করবে ওই লেখক।

প্রশ্ন হচ্ছে, সে-রকম কোনো কিছু কি মিস করছি আমি?

একজন মহিলা গিয়ে হাজির হলেন একটা ফিউনারেল পার্লারে। ওই ঘটনার ছ’ঘণ্টা পর তাঁরই বাড়িতে খুন করা হলো তাঁকে। ধাঁধায় পড়ে গেল পুলিশ। ডাক পড়ল ড্যানিয়েল হোথর্নের। অদ্ভুত আর জটিল চরিত্রের একজন মানুষ সে, কিন্তু গোয়েন্দাগিরিতে ওর মেধা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই! কনসালটেন্সির দরকার হয়ে পড়ল পুলিশের। তারপর?

তারপর কী হলো?

টের পাচ্ছি, অদ্ভুত এক উৎকণ্ঠা পেয়ে বসেছে আমাকে।

হোথর্নের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে কি ভুল করলাম?

অনিশ্চয়তায় ভুগতে ভুগতে আবারও তুলে নিলাম উপন্যাসটা, ডুবে গেলাম সেটাতে।

দু’দিন পর গিয়ে যোগ দিলাম সেই সাহিত্য-উৎসবে।

সারা পৃথিবীতে এ-রকম উৎসব ক’টা হয় প্রতি বছর, ভাবলে মজা লাগে আমার। এ-রকম অনেক লেখককে চিনি আমি, যাঁরা ওসব উৎসবে যোগ দেন হরহামেশা, অথচ তাঁদের লেখালেখি বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বই সংক্রান্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেয়াটাই তাঁদের কাজ এখন।

যা-হোক, ভালোই হলো আমার সেশনটা। ছোট ছোট অনেক বাচ্চা এসেছে এই অনুষ্ঠানে, অনুষ্ঠানটা প্রাণবন্ত করে রেখেছে তারা। তাদের কেউ কেউ চমৎকার কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল আমাকে। কথা বলতে গিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা সময় নিয়ে ফেললাম আমি। সঞ্চালকদের একজন ইশারায় বক্তৃতা শেষ করতে বললেন আমাকে। আর ঠিক তখনই ঘটল অদ্ভুত এক ঘটনা।

দর্শকের মধ্যে একেবারে সামনের সারিতে বসে আছে একজন মহিলা। প্ৰথম দেখায় তাকে একজন শিক্ষিকা অথবা লাইব্রেরিয়ান বলে মনে করেছিলাম। দেখতে একেবারে সাদামাটা, চল্লিশের কাছাকাছি বয়স, চেহারাটা গোলগাল। মাথায় লম্বা লম্বা সাদাটে চুল। ঘাড় থেকে একটা চেইনের মাধ্যমে ঝুলছে চশমা। দুটো কারণে তাকে লক্ষ করেছি। এক, তাকে একা বলে মনে হয়েছে আমার। আর দুই, আমি এতক্ষণ ধরে যা বলেছি সেসবের একটা শব্দের প্রতিও তার কোনো আগ্রহ আছে বলে মনে হয়নি। বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে কৌতুক করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু একবারের জন্যও হাসতে দেখিনি তাকে। মহিলা কোনো সাংবাদিক কি না, ভেবে একটুখানি হলেও শঙ্কা জাগল আমার মনে। শুনেছি আজকাল নাকি পত্রপত্রিকা থেকে সাহিত্য-বিষয়ক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সাংবাদিক পাঠানো হয়, সেসব সাংবাদিক নাকি লেখকদের বিভিন্ন বেফাঁস কথা টুকে নিয়ে গিয়ে ছাপিয়ে দেয় পত্রিকায়, পরে ওই উক্তি ব্যবহৃত হয় ওই লেখকের বিরুদ্ধেই। কাজেই মহিলাটা যখন আমাকে কিছু-একটা জিজ্ঞেস করার জন্য হাত তুলল, মনে মনে সতর্ক না-হয়ে পারলাম না। অ্যাটেন্ডেন্টদের একজন এগিয়ে গিয়ে মাইক তুলে দিল মহিলার হাতে।

‘একটা কথা ভাবছিলাম,’ বলল মহিলাটা। ‘আপনি সব সময় কল্পকাহিনিই লেখেন কেন? বাস্তব কোনো ঘটনা নিয়ে কিছু লেখেন না কেন?’

এ-রকম কোনো প্রশ্ন কখনও জিজ্ঞেস করা হয়নি আমাকে। সচরাচর যেসব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হয় আমাকে সেগুলো হলো, নিত্যনতুন এত আইডিয়া কোত্থেকে পাই আমি? আমার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র কোনটা? একটা বই লিখতে কতদিন সময় লাগে আমার?

ওই মহিলার প্রশ্ন করার ভঙ্গিতে আক্রমণাত্মক কিছু নেই, তারপরও কেন যেন দমে গেলাম খানিকটা।

ব্যাখ্যা দেয়ার ভঙ্গিতে বললাম, ‘ফয়েল’স ওয়ার নামের যে-টিভি সিরিয লিখেছি, সেটার প্রতিটা পর্ব বাস্তব ঘটনার উপর ভিত্তি করে রচিত। ‘

‘আমি নিশ্চিত সত্যি ঘটনার উপর ভিত্তি করে অনেক কিছু লিখেছেন আপনি, কিন্তু আসলে যা বলতে চাইছি তা হলো, আপনি যে-অপরাধজগতের বর্ণনা দিয়েছেন বা দিচ্ছেন, সেটা তো বাস্তব কোনো কিছুর উপর ভিত্তি করে লেখা হচ্ছে না। উদাহরণ হিসেবে আপনার দুটো টিভি সিরিয়ালের নাম বলি… পোয়ারো এবং মিডসামার মার্ডার্স। দুটো ধারাবাহিকই সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসূত। আবার যদি অ্যালেক্স রাইডারের কথা বলি, চোদ্দ বছর বয়সী ওই ছেলেকে নিয়ে একের-পর-এক গুপ্তচর- কাহিনি লিখছেন আপনি। আমি জানি, অনেক ছেলেমেয়েই ওই কাহিনিগুলো পড়ে মজা পায়। কিন্তু সেখানেও সেই একই কথা… কল্পনা। আমি যা জানতে চাইছি তা হলো, বাস্তবজীবনের উপর কোনো আগ্রহ কেন নেই আপনার?’

‘বাস্তবজীবন বলতে ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন?’ পাল্টা প্রশ্ন করলাম।

‘বোঝাতে চাইছি আমাদের আশপাশের রক্তমাংসের মানুষদের, এবং তাদেরকে ঘিরে যে-অপরাধজগত আবর্তিত হয়, সেটা।’

অস্থির হয়ে উঠেছে কোনো কোনো ছেলেমেয়ে। প্রশ্নোত্তর পর্ব দ্রুত শেষ করার জন্য আরও একবার তাগাদা দেয়া হলো আমাকে।

বললাম, ‘কল্পকাহিনি লিখতে ভালো লাগে আমার।’

‘আপনার কি কখনও মনে হয় না, এমন একটা দিন আসতে পারে, যখন অপ্রাসঙ্গিক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে আপনার-লেখা বইগুলো?’

‘আমার মনে হয়, কোনো লেখকের লেখা যদি প্রাসঙ্গিক হিসেবে বিবেচিত হতে হয়, তা হলে তাঁকে যে বাস্তবজীবনের উপর ভিত্তি করেই লিখতে হবে, এমন কোনো কথা নেই।’

‘কিছু মনে করবেন না… একমত হতে পারলাম না আপনার সঙ্গে। আপনার লেখা ভালো লাগে আমার, তারপরও বাধ্য হয়ে বললাম কথাটা।’

দু’দিন আগে হোথর্ন কী প্রস্তাব দিয়েছিল আমাকে, মনে পড়ে গেল হঠাৎ করেই।

অনুষ্ঠান থেকে চলে আসার আগে এদিক-ওদিক তাকিয়ে খুঁজলাম ওই মহিলাকে, কিন্তু কোথাও দেখতে পেলাম না। আমার লেখা কোনো বইয়ে অটোগ্রাফ নেয়ার জন্যও আমার সামনে আসেনি সে।

ট্রেনে চেপে যখন লন্ডনে ফিরছি, নাম-না-জানা সেই মহিলা যেন ভূতের মতো সওয়ার হলো আমার চিন্তাভাবনার ঘাড়ে। তার কথাগুলো বার বার না-ভেবে পারলাম না। সে কি ঠিক কথাই বলেছে? আমার লেখালেখি কি আসলেই বেশি মাত্রায় কল্পনানির্ভর হয়ে যাচ্ছে? কিশোর-সাহিত্যিক থেকে একজন অ্যাডাল্ট- রাইটারে পরিণত হতে চলেছি আমি, আমার জন্য দ্য হাউস অভ সিল্ক বইটা হয়তো পরিণত হতে যাচ্ছে একটা টার্নিং পয়েন্টে, তারপরও… যে-সময়কালের উপর ভিত্তি করে ওই কাহিনি লিখেছি, সেটা এখনকার আধুনিক পৃথিবী থেকে যোজন যোজন দূরে। টেলিভিশনের জন্য যেসব কাহিনি লিখেছি… উদাহরণ হিসেবে ইনজাস্টিস- এর কথাই ধরা যাক… একবিংশ শতাব্দীর লন্ডনের কথা মাথায় রেখে লেখা হয়েছে সেটা, কিন্তু সেটাতেও প্রয়োগ করেছি নিজের কল্পনাশক্তি।

তার মানে ওই মহিলা কি ঠিক কথাই বলেছে?

এমন একটা দিন কি আসলেই আসতে পারে, যখন অপ্রাসঙ্গিক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে আমার-লেখা বইগুলো?

প্যাডিংটন স্টেশনে পৌঁছাতে অনেকক্ষণ সময় লাগল। যতক্ষণে বাসায় পৌঁছালাম, ততক্ষণে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে আমার। তাই বাসায় ঢুকেই তুলে নিলাম ফোনটা।

‘হোথৰ্ন?’

‘টনি!’

‘আমি রাজি। বখরা আধাআধি। আছি আমি আপনার সঙ্গে।’

৩. প্রথম অধ্যায়

আমার লেখা প্রথম অধ্যায়টা পছন্দ হয়নি হোথর্নের।

ওটা প্রথমে দেখাইনি ওকে। ইনজাস্টিস নামের সেই টিভি সিরিযের সময় কী কাণ্ডটা সে করেছিল, ভালোমতোই মনে আছে আমার। তাই ওই চ্যাপ্টার লুকিয়ে রেখেছিলাম নিজের কাছে। কিন্তু ওটা দেখতে চাইল হোর্থন… রীতিমতো জোরাজুরি শুরু করে দিল। যেহেতু আধাআধি বখরার চুক্তিতে রাজি হয়েছি, সেহেতু ওর দাবি অগ্রাহ্য করি কী করে?

বরাবরের মতো একটা রেস্টুরেন্টের বাইরে বসে আছি আমরা দু’জন। প্ৰথম চ্যাপ্টারটা ই-মেইলের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ওর কাছে। সঙ্গে করে আনা অ্যাটাচি কেসের ভিতর থেকে আমার সেই ই-মেইলের প্রিন্ট-করা কপি যখন বের করল সে, বুঝে গেলাম কপালে খারাপি আছে আমার। লাল কালিতে অঙ্কিত অনেকগুলো কাটা চিহ্ন আর বৃত্ত দেখতে পাচ্ছি আমার সে-লেখায়।

নিজের লেখালেখির ব্যাপারে যদি মন্তব্য করতে বলা হয় আমাকে, তা হলে নিজেকে খুব সতর্ক বলবো আমি। লেখার আগে প্রতিটা শব্দ নিয়ে চিন্তা করি। হোথর্নের প্রস্তাবে যখন রাজি হয়েছিলাম, তখন ভেবেছিলাম, কেসের দায়িত্ব ওর কাঁধে থাকার পরও কাহিনির-বর্ণনার-সময় সে থাকবে ‘ব্যাক সিটে’। ভুল ধারণাটা থেকে আমাকে মুক্তি দিল সে।

‘সব ভুল করে বসে আছেন আপনি, টনি,’ বলল হোথর্ন। ‘আসলে পাঠকদের বিশ্বাস করাতে চাইছেন এমন কিছু একটা, যা সত্যি না।’

‘মানে?’

‘প্রথম বাক্যটার কথাই ধরুন। সম্পূর্ণ ভুল ওটা।’

যা লিখেছি, পড়তে শুরু করলাম:

বসন্তের এক উজ্জ্বল সকাল। ঘড়িতে মাত্র এগারোটা বেজেছে। প্রায় সাদা সূর্যের- আলো যেন প্রতিজ্ঞা করেছে, আজ এমন এক উষ্ণতা বিলিয়ে দেবে, যা সচরাচর দেয় না। ফুলহ্যাম রোড পার হলেন ডায়ানা ক্যুপার, গিয়ে ঢুকলেন ফিউনারেল পার্লারে।

‘ভুলটা কোথায় হয়েছে,’ বললাম আমি, ‘বুঝলাম না। মিসেস ক্যুপার তো এগারোটার দিকেই গিয়ে ঢুকেছিলেন ওই ফিউনারেল পার্লারে, নাকি?’

‘হ্যাঁ, ঢুকেছিলেন, কিন্তু আপনি যেভাবে বর্ণনা দিয়েছেন, আসল ঘটনা সেভাবে ঘটেনি।’

সেভাবে ঘটেনি মানে? তিনি তো বাসে চেপেই সেখানে গিয়েছিলেন!’

‘তাঁর বাসার সামনের রাস্তা থেকে বাসে উঠেছিলেন তিনি। ব্যাপারটা জানতে পেরেছি, কারণ সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে তাঁকে। ড্রাইভারকে যখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, মিসেস ক্যুপারকে চিনতে পেরেছে লোকটা। এমনকী ওই ব্যাপারে পুলিশের কাছে বিবৃতিও দিয়েছে সে। কিন্তু আসল সমস্যা কোথায়, জানেন? আসল সমস্যা হচ্ছে, আপনি লিখেছেন রাস্তা পার হয়ে ফিউনারেল পার্লারে গিয়েছিলেন মিসেস ক্যুপার। এই কথা কেন লিখলেন?’

‘কেন, অসুবিধা কী?’

‘অসুবিধা একটাই… ডায়ানা ক্যুপার রাস্তা পার হননি। আমরা আসলে কথা বলছি ১৪ নম্বর বাস নিয়ে। তিনি ওই বাসে উঠেছিলেন চেলসি ভিলেজ থেকে। ব্রিটানিয়া রোডের ঠিক উল্টোদিকে অবস্থিত জায়গাটা। যা-হোক, বাসটা মিসেস ক্যুপারকে নিয়ে হাজির হয়েছিল চেলসি ফুটবল ক্লাবের সামনে… মানে, হর্টেনশিয়া রোডে। তারপর সেখান থেকে যায় ওল্ড চার্চ রোডে। ওখানেই ওই বাস থেকে নেমে পড়েন তিনি।’

‘বুঝতে পারছি, লন্ডনের বাস রুট সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান আছে আপনার। তারপরও… ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন, বুঝতে পারছি না।’

‘বোঝাতে চাইছি, ১৪ নম্বর বাসে চড়ে ওই ফিউনারেল পার্লারে এলে রাস্তা পার হওয়ার দরকার হবে না মিসেস ক্যুপারের। কারণ বাস থেকে রাস্তার যে-পাশে নামবেন তিনি, পার্লারটা সে-পাশেই।’

‘তাতে এমন কী আসে-যায়?’

‘আসে-যায়। কারণ আপনি যদি উপন্যাসে লেখেন রাস্তা পার হয়েছিলেন মিসেস ক্যুপার, তা হলে সেটার মানে দাঁড়ায়, অন্য কোনো একটা কাজে কোথাও গিয়েছিলেন তিনি ফিউনারেল পার্লারে ঢোকার আগে। তখন পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কী কাজে কোথায় গিয়েছিলেন তিনি? কেউ কেউ ভাবতে পারে, তিনি কি ব্যাংকে গিয়েছিলেন? একগাদা টাকা তুলে নিয়েছেন সেখান থেকে? নাকি কারও সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন বাকবিতণ্ডায়, যার ফলে, পরে, সেদিনই মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে তাঁকে? খুনি কি তাঁকে অনুসরণ করে রাস্তা পার হয়েছিল? দেখেছিল কোথায় কোথায় যাচ্ছেন তিনি? …কী হলো, আমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? … যা-হোক, মোদ্দা কথা, ব্রেকফাস্ট সারার পর বাসা থেকে বেরিয়ে ওই বাসে উঠে পড়েছিলেন মিসেস ক্যুপার। এবং সেদিন সকালে ওই কাজই করেছিলেন তিনি অন্য সব কিছুর আগে।’

‘আচ্ছা, ঠিক করে বলুন তো, আপনি আসলে কী লেখাতে চান আমাকে দিয়ে?’

এক তা কাগজে কিছু-একটা লিখে এনেছিল হোথর্ন; সেটা বাড়িয়ে ধরল আমার দিকে।

হাতে নিয়ে পড়লাম কী লিখেছে সে:

ঠিক এগারোটা সতেরো মিনিটে ১৪ নম্বর বাস থেকে ওল্ড চার্চ স্ট্রীটে নেমে পড়লেন ডায়ানা জেইন ক্যুপার। ফুটপাত ধরে হাঁটলেন পঁচিশ মিটারের মতো। তারপর ঢুকে পড়লেন কর্নওয়ালিস অ্যান্ড সন্স নামের ফিউনারেল পার্লারটাতে।

.

‘এসব লেখা সম্ভব না আমার পক্ষে,’ সোজা জানিয়ে দিলাম। ‘কারণ আপনি যা লিখে এনেছেন, সেসব কোনো গল্পের মতো শোনাচ্ছে না। বরং সেসব পড়ে মনে হচ্ছে, কোনো পুলিশ-রিপোর্ট পড়ছি।’

‘পড়ে যা-ই মনে হোক, আমি যা লিখেছি তা একেবারে সঠিক। ও… আরেকটা কথা মনে পড়ে গেছে… ঘণ্টার ব্যাপারে এসব কী লিখেছেন?’

‘কীসের ঘণ্টা?’

‘কেন… এই যে দেখুন…’ প্রিন্ট করে নিয়ে আসা কাগজগুলো উল্টিয়ে একজায়গায় থামল হোথর্ন। পড়তে লাগল, ‘সদর দরজাটা খুললেন মিসেস ক্যুপার। দরজার পুরনো-ধাঁচের স্প্রিং মেকানিযমের সঙ্গে যুক্ত একটা ঘণ্টা বেজে উঠল জোরে, একবার।’ ওই ফিউনারেল পার্লারে ঘণ্টা কোথায় পেলেন আপনি, বলুন তো? এতবার গেলাম আমি সেখানে, কোনো ঘণ্টার ‘ঘ’-ও তো দেখলাম না! কারণ সেখানে আসলেই কোনো ঘণ্টা নেই।’

নিজেকে শান্ত রাখার জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমি। যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় বললাম, ‘দেখুন, বাস্তব ঘটনার উপর ভিত্তি করে যেসব কল্পকাহিনি লেখা হয়, সেগুলোতে ও-রকম কোনো-না-কোনো বর্ণনা জুড়ে দেয়া হয়। বাস্তব ঘটনার উপর ভিত্তি করে লেখার মানে এ-ই না, ঠিক যা-যা ঘটেছিল, তা-ই লিখতে হবে আমাকে, তার বাইরে একটা-কথাও লেখা যাবে না। দয়া করে মনে রাখবেন, পাঠক একটা গল্প পড়ার জন্য আপনার বইটা হাতে নেবে, বাস্তব জীবনের কোনো বিবরণ পড়তে চাইবে না তারা। মনে রাখবেন, বই আর সংবাদপত্র এক জিনিস না। এবার আসুন কাজের কথায়। কন্সওয়ালিস অ্যান্ড সন্স-এর ব্যবসাটা যে পুরুষানুক্রমিক আর সেকেলে, সেটা বোঝানোর জন্য ওই ঘণ্টার বর্ণনা জুড়ে দিয়েছি আমি।’

‘তা হয়তো দিয়েছেন, কিন্তু ঝামেলা তো লাগিয়ে দিয়েছেন অন্য জায়গায়।‘

‘ঝামেলা?’

‘হুঁ। ধরুন কেউ একজন মিসেস ক্যুপারকে অনুসরণ করে ঢুকে পড়েছিল ওই পার্লারে। সেখানে সেদিন যা-যা বলেছিলেন তিনি, কেউ একজন আড়ি পেতে শুনে ফেলেছিল সেসব। ওই ঘণ্টা যদি রেখে দেন আপনি উপন্যাসে, তা হলে পরে পাঠক প্রশ্ন করবে, আড়ি-পাতা লোকটা যখন ঢুকল ওই পার্লারে, তখন ঘণ্টার আওয়াজ শুনতে পেল না কেন অন্য কেউ?’

‘কিন্তু কেউ একজন আসলেই অনুসরণ করেছিল কি না মিসেস ক্যুপারকে, জানি না আমরা। তাঁর সেদিনের কথোপকথন আসলেই আড়ি পেতে শুনেছিল কি না কেউ, তা-ও জানি না। …আপনি আসলে ঠিক কী ভাবছেন, বলুন তো?’

অনিশ্চিত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল হোথর্ন। ‘যে বা যারা বলছে, মিসেস ক্যুপারের নিজের-শেষকৃত্যের-আয়োজন-করা এবং একইদিনে তাঁর খুন হওয়ার মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে, আমার মনে হয় আপনি তাদের দলে। অন্ততপক্ষে আপনি চাইছেন পাঠকরা যাতে সেটাই মনে করে। কিন্তু বিকল্প ব্যাখ্যাগুলোও মাথায় রাখতে হবে আপনাকে। নিজের শেষকৃত্যের জন্য যেদিন আলোচনা করতে গিয়েছিলেন মিসেস ক্যুপার, সেদিনই খুন হয়েছেন তিনি… ব্যাপারটা সম্পূর্ণ কাকতালীয়ও হতে পারে। তবে একটা সত্যি কথা বলি আপনাকে… কাকতালীয় কোনো কিছু একেবারেই পছন্দ করি না আমি। খুনখারাপি নিয়ে কাজ করছি গত বিশ বছর ধরে। কাকতালীয় কোনো কিছু ঘটেনি আমার কোনো কেসে… সোজাসুজি যদি বলি, সব কিছুসব সময় জায়গামতোই পেয়েছি। যা-হোক, মিসেস ক্যুপার হয়তো জানতেন, মরতে চলেছেন তিনি। তাঁকে হয়তো হুমকি দেয়া হয়েছিল। এবং হয়তো সে-কারণে তিনি নিজেই গিয়েছিলেন ফিউনারেল পার্লারে, আলাপ করেছেন নিজের শেষকৃত্যানুষ্ঠান নিয়ে। হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, বাঁচার কোনো উপায় নেই তাঁর। ব্যাপারটা সম্ভব, কিন্তু একইসঙ্গে গোলমেলেও বটে। কারণ মিসেস ক্যুপার যদি সত্যিই টের পেয়ে থাকেন বাঁচার কোনো উপায় নেই তাঁর, তা হলে পুলিশের কাছে গেলেন না কেন? তা ছাড়া আমিই যে বার বার বলছি কেউ একজন জেনে গিয়েছিল কী করতে যাচ্ছেন তিনি, সেটাতেও ঘাপলা আছে… সেই কেউ একজনটা যে-কেউ হতে পারে। এবং যদি সত্যিই তা-ই হয়… যদি সত্যিই কেউ একজন মিসেস ক্যুপারের পিছু পিছু ঢুকে থাকে ওই ফিউনারেল পার্লারে, তা হলে অন্য কেউ টের পায়নি ব্যাপারটা। অর্থাৎ আপনার সেই ঘণ্টা বাজেনি।’

‘ঠিক আছে,’ বললাম আমি, ‘ঘণ্টাটা বাদ দিয়ে দেবো।’

‘আর ওই মন্ট ব্ল্যাঙ্ক কলমও বাদ দিতে হবে।’

‘কেন?’ কিন্তু হোথর্নকে কিছু বলার সুযোগ না-দিয়ে বলে চললাম, ‘ঠিক আছে, ওটাও বাদ দিয়ে দেবো। ওই কলম না-থাকলে তেমন কিছু যাবে-আসবে না।

পাতা উল্টাচ্ছে হোথর্ন। ভাবখানা এমন, এ-রকম কোনো বাক্য খুঁজছে, যা পছন্দ হতে পারে ওর। কিছুক্ষণ পর বলল, ‘দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু তথ্য নিজস্ব কায়দায় বাছাই করে নিয়েছেন।’

‘মানে?’

‘আপনি লিখেছেন, মিসেস ক্যুপার গণপরিবহন ব্যবহার করতেন। কিন্তু কেন করতেন তিনি কাজটা, সেটা বলেননি।’

‘বলেছি। একজায়গায় লিখেছি, খামখেয়ালি স্বভাবের ছিলেন তিনি।’

‘তাঁর শেষকৃত্যানুষ্ঠান নিয়েও প্রশ্নের অবকাশ রয়ে গেছে। ঠিক কোন্ সার্ভিসটা চেয়েছিলেন তিনি জানেন আপনি, কিন্তু সেটা লেখেননি।’

‘লিখেছি। পবিত্র একটা স্তবক অথবা বিটলসের কোনো একটা গান…’

‘কোন্ স্তবক? বিটলসের কোন্ গান? ব্যাপারটা কি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়নি আপনার?’ নোটবুক বের করল হোর্থন, খুলল। ‘স্তবক নম্বর চৌত্রিশ। আই উইল রেস দ্য লর্ড অ্যাট অল টাইমস: হিজ প্রেইজ শ্যাল কন্টিনিউয়ালি বি ইন মাই মাউথ। আর গানটা ছিল: ‘এলিনররিগবি’… লিখেছিলেন খুব সম্ভব সিলভিয়া প্লাথ। টনি, এই ব্যাপারে মনে হয় আপনার সাহায্য লাগবে আমার। কারণ গানের কথাগুলো পড়েছিলাম আমি, কিন্তু মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারিনি। আরেকটা কথা। মিসেস ক্যুপার চেয়েছিলেন, প্রশংসাসূচক উক্তিটা যেন লিখে দেয় তাঁর ছেলে। কী যেন বলা হয় ওই টার্মটাকে?’

‘ইউলোজি।’

‘হবে হয়তো। যা-হোক, ক্যাফে মুরানোতে লাঞ্চ করেছিলেন মিসেস ক্যুপার। তখন কে সঙ্গ দিয়েছিলেন তাঁকে, সেটা লেখা উচিত ছিল আপনার। লোকটার নাম রেমন্ড কুন্স… মঞ্চনাটক প্রযোজনা করেন।’

‘তাঁকেও কি সন্দেহ করা হচ্ছে?’

‘ক্লন্স প্রযোজনা করেছিলেন, এ-রকম একটা নাটকে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড খুইয়েছিলেন মিসেস ক্যুপার। আমার অভিজ্ঞতা বলে, টাকা আর হত্যাকাণ্ড হাত ধরাধরি করে চলে।

‘আর কোনো কিছু কি মিস করেছি আমি?’

‘যেদিন খুন করা হয়েছে মিসেস ক্যুপারকে, সেদিনই গ্লোব থিয়েটারের বোর্ড থেকে পদত্যাগ করেছেন তিনি। ব্যাপারটা কি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়নি আপনার? অথচ গত ছ’বছর ধরে ওই বোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তিনি। যেদিন সিদ্ধান্ত নিলেন ছেড়ে দেবেন কাজটা, সেদিনই শেষ করে দেয়া হলো তাঁকে। …ক্লিনার আন্দ্রিয়া কুভানেকের বর্ণনাও অতিরঞ্জিত বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে। পা টিপে টিপে বেরিয়ে এসেছিল সে মিসেস ক্যুপারের বাড়ি থেকে, তারপর ফোন করেছিল পুলিশে… কোত্থেকে পেলেন আপনি এই খবর?’

‘পুলিশের কাছে যে-বিবৃতি দিয়েছিল সে, সেটা থেকে জানতে পেরেছি।

ওই বিবৃতি আমিও পড়েছি। কিন্তু আপনি নিশ্চিত হলেন কী করে, মিথ্যা কথা বলেনি সে?

‘মিথ্যা কথা কেন বলবে?’

‘জানি না। কিন্তু এটা জানি, একটা ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে তার। কাজেই যা বলেছে সে সেটা যে এক শ’ ভাগ সত্যি, সে-রকম ধরে নেয়ার কোনো কারণ নেই। ‘

‘ওই মেয়ের ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে… জানলেন কী করে?’

চেক করেছি। যা-হোক, সবশেষে বলতে হয় মিসেস ক্যুপারের ছেলে ড্যামিয়েন ক্যুপারের কথা। মায়ের মৃত্যুতে আড়াই মিলিয়ন পাউন্ডের মালিক হয়ে গেছে সে রাতারাতি। অথচ আমার কাছে পাকা খবর আছে, টাকাপয়সার টানাটানি চলছিল তার।’

স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। চুপসে যাওয়ার মতো কোনো একজাতের অনুভূতি হচ্ছে আমার পেটের ভিতরে।

কিছুক্ষণ পর জানতে চাইলাম, ‘টাকাপয়সার টানাটানি? যেমন?’

‘আকণ্ঠ ঋণে জর্জরিত বলে একটা কথা আছে না? ড্যামিয়েন ক্যুপারের হয়েছিল সে-অবস্থা। হলিউড হিলসে বিলাসবহুল একটা বাড়ি কিনেছে সে। এমনকী সুইমিংপুলও আছে সেখানে। চলাফেরার জন্য ব্যবহার করত পোর্শে ৯১১। ইংরেজ এক বান্ধবী জুটিয়ে নিয়েছিল, লিভ টুগেদার করে মেয়েটার সঙ্গে। অথচ তাকে খুব একটা পছন্দ করে না ওই মেয়ে। কারণ তার মতো মানুষদের জীবনে মেয়েদের আনাগোনা চলতেই থাকে।’

সাহস করে জানতে চাইলাম, ‘আপনি যদি এই রহস্যের সমাধান করতে না- পারেন, তা হলে কী হবে? এ-রকমও তো হতে পারে, ডায়ানা ক্যুপারের খুনিকে আপনার আগেই পাকড়াও করে ফেলল পুলিশ?’

দেখে মনে হলো, কথাটা শুনে অপমানিত হয়েছে হোথর্ন। ‘পুলিশ? তাদের কাছে যদি কোনো একটা ক্লু-ও থাকত, এই রহস্য সমাধানের জন্য আমার সাহায্য চাইত না। কথাটা আগেও বোধহয় বলেছি আপনাকে। ইদানীং খুন হওয়ার আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যেই সমাধান হয়ে যাচ্ছে বেশিরভাগ হত্যারহস্য। কেন হচ্ছে, ভেবে দেখেছেন কখনও? কারণ বেশিরভাগ খুনি জানে না, কী করছে তারা। ইদানীং বেশিরভাগ খুন করা হচ্ছে রাগের মাথায়। একই ঘটনা বার বার ঘটছে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটছে। রক্তের ছিটা, গাড়ির নম্বর প্লেট, সিসিটিভি… ইত্যাদি নিয়ে যতক্ষণে চিন্তিত হয়ে পড়ছে ইদানীংকালের খুনিরা, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে তাদের জন্য। কেউ কেউ অবশ্য গোপন করার চেষ্টা করছে তাদের চিহ্ন বা আলামত, কিন্তু সব চেষ্টাই শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে আধুনিক অপরাধবিজ্ঞানের কারণে।’

‘কিন্তু…’

‘জানি কী বলবেন আপনি,’ আমাকে কথা শেষ করতে দিল না হোথর্ন। ‘শতকরা প্রায় দুই ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, হত্যাকাণ্ডটা পূর্বপরিকল্পিত। অথবা দেখা যাচ্ছে, পেশাদার কোনো খুনিকে ব্যবহার করা হচ্ছে ওসব কাজে। কখনও আবার উদ্ভব ঘটছে বাতিকগ্রস্ত বা উন্মত্ত কোনো কোনো সিরিয়াল কিলারের… নিছক মজা পাওয়ার আশায় একের-পর-এক খুন করে যাচ্ছে তারা। মোদ্দা কথা হলো, সব খবরই আছে পুলিশের কাছে। তারা জানে, ঠিক কখন সাহায্য চাইতে হবে আমার মতো লোকদের কাছে। জানে, সাহায্য চাইতেই হবে তাদেরকে। কাজেই আমি আপনাকে যা বলতে চাই তা হলো, আমার উপর ভরসা রাখুন। বিস্তারিত কিছু যদি জানার থাকে আপনার, আগে আমাকে জিজ্ঞেস করুন। অন্যথায় যা দেখতে পাচ্ছেন বা পাবেন, ঠিক সে-কথাই লিখুন। দয়া করে মনে রাখবেন, টিনটিনের কোনো কাহিনি লিখছেন না আপনি আমাকে-নিয়ে। ঠিক আছে?’

‘এক মিনিট! আমি তো আপনাকে বলিনি টিনটিনের কোনো কাহিনি লিখছি আমি, তা হলে আপনি কী করে…’

‘আপনি বলেছিলেন, স্পিলবার্গের হয়ে একটা কাজ করছেন। এবং স্পিলবার্গ এই মুহূর্তে কী পরিচালনা করছেন, জানি আমি।’

‘পরিচালনা না, প্রযোজনা করছেন তিনি।’

‘ওই একই কথা।

টের পেলাম, রেগে গেছি। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। তারপর বললাম, ‘ঠিক আছে, আপনার ব্যাপারে লিখবো আমি। লিখবো এই কেসের ব্যাপারে। কেসটা যখন সমাধান করবেন… যদি সমাধান করতে পারেন আর কী… তা হলে আমার প্রকাশকের সঙ্গে কথা বলে দেখবো এই কাহিনি ছাপাতে তিনি আগ্রহী হন কি না। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে। যখন যা খুশি তা-ই বলবেন আমাকে, মুখে যা আসবে তা-ই শুনিয়ে দেবেন… এসব চলবে না। যত যা-ই হোক এই বইয়ের লেখক আমি। কাজেই কাহিনি কীভাবে এগোবে, সে-সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ আমার।’

বড় বড় হয়ে গেল হোথর্নের চোখ। ‘শান্ত হোন, টনি। আমি শুধু সাহায্য করতে চাইছি আপনাকে।’

আলাপ-আলোচনা করে শেষপর্যন্ত একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারলাম আমরা।

এই বই লেখার কাজ যতদিন চলতে থাকবে, ততদিন আর একটা পৃষ্ঠাও দেখাবো না আমি হোথর্নকে। যা-খুশি তা-ই লেখার স্বাধীনতা থাকবে আমার। যদি প্রয়োজন বোধ করি, হোথর্নের সমালোচনাও করতে পারবো। এমনকী নিজস্ব চিন্তাভাবনাও ঢুকিয়ে দিতে পারবো বইয়ের ভিতরে। কিন্তু ক্রাইমসিনের বর্ণনা অথবা জিজ্ঞাসাবাদের প্রসঙ্গ যদি আসে, তা হলে ঠিক যা ঘটেছিল অথবা ঘটছে, তা-ই লিখতে বাধ্য থাকবো। এসব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করবো না নিজের কল্পনাশক্তি, অনুমানসাপেক্ষে কিছু লিখবো না, অথবা অতিরঞ্জিত কোনো বর্ণনাও দেবো না। মোদ্দা কথা, এসব ক্ষেত্রে এমন কিছু লিখবো না, যার ফলে ভুল পথে পরিচালিত হতে পারে পাঠক

সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো প্রথম চ্যাপ্টারের ব্যাপারেও। যেমন, ওই ঘণ্টা আর মন্ট ব্ল্যাঙ্ক কলমের ব্যাপারটা ভুলে যেতে হবে আমাকে। লিখতে হবে, যেদিন খুন হয়েছেন ডায়ানা ক্যুপার, সেদিন তিনি লাঞ্চ করেছেন রেমন্ড কুন্সের সঙ্গে। আন্দ্রিয়া ক্লুভানেকের বর্ণনাও বদল করতে হবে কিছুটা… এমনভাবে লিখতে হবে, যাতে পাঠকের মনে হয়, মেয়েটা হয়তো সত্যি কথা বলছে না।

আর, খুনির পরিচয় ফাঁস হয়ে যাবে, এ-রকম কোনো ক্লু যদি দিতে চাই, তা হলে সেটা সম্পূর্ণ নির্ভুল হতে হবে।

৪. ক্রাইম সিন

সোমবার সকালে গিয়ে হাজির হলাম ডায়ানা ক্যুপারের বাসার বাইরে।

ইউনিফর্ম পরিহিত এক পুলিশ-অফিসার দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। ‘পুলিশ লাইন ডু নট ক্রস’ লেখা নীল-সাদা প্লাস্টিকের একটা টেপ ঝুলছে সদর দরজায়। কিন্তু আমি যে যাবো, সেটা কেউ একজন বলে রেখেছিল ওই অফিসারকে। কারণ আমাকে ভিতরে ঢুকতে দিল লোকটা, আমার নামটা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করল না। যেদিনের কথা বলছি, তার ঠিক পাঁচ দিন আগে খুন হয়েছেন ডায়ানা ক্যুপার। পুলিশের আরও কিছু ফাইল আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে হোথর্ন ইতোমধ্যে, কয়েকজনের ইন্টারভিউ রেকর্ডও পাঠিয়েছে। উইকএন্ডের পুরোটা খরচ করে ওসব পড়েছি আমি। নথিপত্রের সঙ্গে ছোট একটা নোটও পাঠিয়ে দিয়েছিল সে। বলেছিল, আজ এখানে সকাল ন’টার সময় যেন দেখা করি ওর সঙ্গে। যা-হোক, বাসার ভিতরে ঢুকে পড়লাম।

এর আগে যেসব ক্রাইমসিন পরিদর্শন করেছি, সেগুলো আমার তৈরি-করা। অর্থাৎ, কোনো নাটক বা সিনেমার জন্য ওই ঘটনাস্থলের বর্ণনা লিখেছি আমি; ডিরেক্টর, লোকেশন ম্যানেজার, ডিজাইনার আর প্রন্স ডিপার্টমেন্টের সবাই মিলে সেটা বানিয়ে দিয়েছেন আমার জন্য। কোন্ আসবাবটা কোথায় কীভাবে রাখতে হবে, এমনকী দেয়ালের রঙ কী হবে… সব ঠিক করে দিয়েছেন তাঁরা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডিটেইলগুলোর উপর সব সময় জোর দিয়েছি আমি– ভাঙা আয়না, জানালার গোবরাটে রক্তমাখা আঙুলের ছাপ, অথবা আমার কাহিনির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ যে-কোনো কিছু। যে-কু’র কথা উল্লেখ করতে চেয়েছি, সেটা যে থাকতেই হবে ক্রাইমসিনে, এমন কোনো কথা নেই। ব্যাপারটা আসলে নির্ভর করে ক্যামেরা কোন্‌দিকে তাক করা হচ্ছে সেটার উপর।

ধীর পায়ে হাঁটছি আমি, এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি; গিয়ে হাজির হলাম মিসেস ক্যুপারের লিভিংরুমে। জুতোর নিচে পুরু কার্পেটের অস্তিত্ব টের পাচ্ছি। মাথার উপর ঝুলছে স্ফটিকের একটা ঝাড়বাতি। আশপাশে দেখতে পাচ্ছি নকল- অ্যান্টিকের কিছু আসবাব। কফি টেবিলের উপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কান্ট্রি লাইফআর ভ্যানিটি ফেয়ার ম্যাগাজিনের বেশ কয়েকটা সংখ্যা। একটা বিল্ট-ইন বুকশেল্ফে দেখা যাচ্ছে আধুনিক ফিকশনের উপর হার্ডব্যাক কয়েকটা বই। কোনোটাই আমার লেখা না। নিজেকে একজন অনধিকারপ্রবেশকারী বলে মনে হচ্ছে আমার। আর এই জায়গা মনে হচ্ছে এমন একটা জাদুঘর, যেখানে কিছু দিন আগেও কেউ একজন থাকতেন।

পুলিশের তদন্তকারী অফিসাররা হলুদ প্লাস্টিকের কতগুলো ট্যাগ লাগিয়ে দিয়েছে কিছু কিছু জিনিসের গায়ে। তবে ওসব ট্যাগের সংখ্যা খুব বেশি না। অর্থাৎ, বোঝা যাচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ তেমন কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি এখানে। পানিভর্তি একটা গ্লাসের (গ্লাসের ভিতরের ওই তরল আপাতদৃষ্টিতে পানি বলেই মনে হচ্ছে) গায়ে লাগানো ট্যাগের নম্বর ১২। অ্যান্টিক একটা সাইডবোর্ডের উপর রাখা আছে ওই গ্লাস। ওটার পাশে যেন নিতান্ত অবহেলায় পড়ে আছে একটা ক্রেডিট কার্ড। খেয়াল করলাম, কার্ডের গায়ে ডায়ানা ক্যুপারের নাম লেখা। এবং সেটার সঙ্গে যুক্ত-করা ট্যাগের নম্বর ১৪।

এসব কি কোনো ক্লু?

বলা মুশকিল।

তিনটা জানালা আছে এই ঘরে। মখমলের দুটো করে পর্দা ঝুলছে প্রতিটা জানালায়। পর্দাগুলো এত লম্বা যে, মেঝে ছুঁই ছুঁই করছে। রেশমি ঝুলওয়ালা লাল রঙের আলাদা আলাদা ফিতার সাহায্যে বেঁধে রাখা হয়েছে পাঁচটা পর্দা। দরজার সবচেয়ে কাছে যে-পর্দা আছে, সেটা বেঁধে রাখা হয়নি। এই পর্দার গায়ে দেখা যাচ্ছে আরেকটা ট্যাগ: ৬। পর্দাটা দেখে মনে পড়ে গেল, এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি আমি, সেখানে গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করা হয়েছে এক মহিলাকে, এবং ঘটনাটা বেশিদিন আগের না। দৃশ্যটা কেন যেন ভেসে উঠল আমার চোখের সামনে… বড় বড় হয়ে গেছে মিসেস ক্যুপারের চোখ, আতঙ্কিত আর পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তিনি, বাতাসে নিষ্ফল খামচি মারছে তাঁর হাতের আঙুলগুলো।

নিচের দিকে তাকালাম। কার্পেটের একজায়গায় একটা দাগ দেখা যাচ্ছে। সেখানে আরও দুটো নম্বর দিয়ে রেখেছে পুলিশের অফিসাররা। মারা যাওয়ার আগে, খুব সম্ভব, নিজের অন্ত্রের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন মিসেস ক্যুপার… মল নির্গত হয়েছিল তাঁর।

একটা আওয়াজ শুনতে পেয়ে চোখ তুলে তাকালাম। ঘরে ঢুকেছে হোথর্ন। বরাবরের মতো একই স্যুট পরে আছে। স্যান্ডউইচ খাচ্ছে। বুঝতে একটু সময় লাগল আমার, মিসেস ক্যুপারের খাদ্যসামগ্রী ব্যবহার করে তাঁরই রান্নাঘরে ওই স্যান্ডউইচ বানিয়ে নিয়েছে সে নিজের জন্য। তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে।

‘কী?’ জিজ্ঞেস করল সে, মুখ ভর্তি হয়ে আছে খাবারে।

‘কিছু না,’ বললাম আমি।

‘নাস্তা খেয়েছেন?’

‘হ্যাঁ, ধন্যবাদ।’

আমার কণ্ঠ শুনে যা বুঝবার বুঝে নিল হোথর্ন। ‘শুধু শুধু এসব খাবার নষ্ট করে কোনো লাভ আছে, বলুন? তা ছাড়া এখন আর এসব দরকারও নেই মিসেস ক্যুপারের।’ স্যান্ডউইচটা নাড়িয়ে সারা ঘর দেখিয়ে দিল ইশারায়। ‘কী ধারণা আপনার, বলুন।’

কী বলবো, বুঝতে পারছি না। এই ঘর খুবই সাজানোগোছানো। শুধু একটা ফ্ল্যাটস্ক্রীন টেলিভিশন বেখাপ্পা ঠেকছে আমার কাছে। আজকাল লোকে দেয়ালে ঝুলিয়ে দেয় ওসব জিনিস, কিন্তু তা না করে ওটা দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে স্ট্যান্ডের উপর। আশপাশে যা-ই দেখতে পাচ্ছি, কেন যেন সব সেকেলে ঠেকছে আমার কাছে। মনে হচ্ছে, সুশৃঙ্খল একটা জীবন যাপন করতেন ডায়ানা ক্যুপার। এমনকী তাঁর মৃত্যুটাও কেন যেন পরিপাটি বলে মনে হচ্ছে। ধ্বস্তাধ্বস্তি করেননি তিনি, বাধা দেয়ার চেষ্টা করেননি খুনিকে… কোথাও উল্টে পড়ে নেই কোনো আসবাব। খুনি শুধু একটা চিহ্ন রেখে গেছে নিজের: দরজার কাছে, কার্পেটের এককোনায় অর্ধেকটা জুতোর-ছাপ। লোকটা মিসেস ক্যুপারকে খুন করার আগে তাঁকে নৃশংসভাবে পেটায়নি, এমনকী তাঁকে ধর্ষণও করেনি। কেন যেন মনে হচ্ছে, লোকটা ঠাণ্ডা মাথায় শেষ করে দিয়েছে তাঁকে।

‘খুনিকে চিনতেন মিসেস ক্যুপার,’ বলল হোথর্ন। ‘তবে তাঁর বন্ধু ছিল না ওই লোক। আমার ধারণা, লোকটা কমপক্ষে ছ’ফুট লম্বা, সুঠাম দেহের অধিকারী। তবে তার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ। মিসেস ক্যুপারকে খুন করার উদ্দেশ্য নিয়েই এই বাড়িতে হাজির হয়েছিল সে। এবং খুব বেশিক্ষণ ছিল না এখানে। তাকে একা রেখে এই ঘর ছেড়ে কোনো একজায়গায় গিয়েছিলেন মিসেস ক্যুপার… খুব সম্ভব রান্নাঘরে। হয়তো ভেবেছিলেন, চলে যাবে লোকটা। যা-হোক, মিসেস ক্যুপারকে খুন করার পর এই বাড়িতে… কী বলবো… তল্লাশি চালায় ওই লোক, টুকটাক কয়েকটা জিনিস নিয়ে যায় নিজের সঙ্গে, কিন্তু আসলে ওসব জিনিস নেয়ার জন্য আসেনি। আমার ধারণা, ব্যক্তিগত কোনো কারণে খুন করেছে সে মিসেস ক্যুপারকে।

‘এসব কথা আপনি জানলেন কী করে?’

প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করামাত্র নিজেই বিরক্ত হলাম নিজের উপর। কারণ আমি জানি, হোথর্ন চেয়েছিল, ওই প্রশ্ন যেন জিজ্ঞেস করি। ওর ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছি।

‘লোকটা যখন এই বাড়িতে আসে,’ বলল হোর্থন, ‘তখন বাইরে অন্ধকার ঘনাচ্ছে। এবং, জানেন কি না জানি না, ইদানীং এই এলাকায় চুরিচামারির ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকটা। কাজেই শহরের ব্যয়বহুল একটা এলাকায় একা থাকেন এ- রকম একজন মহিলা যদি জানতে পারেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে একজন আগন্তুক, দরজা খুলবেন না তিনি। অর্থাৎ, খুনি মিসেস ক্যুপারের পূর্বপরিচিত। সে পুরুষ নাকি মহিলা, সে-প্রসঙ্গে আসুন এবার। আমি যা বলছি মেনে নিন– খুনি একজন পুরুষ। মেয়েরাও যে মেয়েদেরকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে, জানি আমি; তারপরও… মিসেস ক্যুপারের বেলায় ঘটনাটা অস্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে। তাঁর উচ্চতা ছিল পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি। গলায় ফাঁস লাগিয়ে প্রচণ্ড শক্তিতে টেনে ধরে রাখার কারণে ভেঙে গেছে তাঁর হায়োইড অস্থি। কাজেই তাঁর চেয়ে লম্বা এবং অত্যন্ত শক্তিশালী কেউ যদি খুনি না-হয়, তা হলে ঘটত না ওই ঘটনা। তবে স্বীকার করে নিচ্ছি, বয়স হয়েছিল মিসেস ক্যুপারের, দুর্বল হয়ে গিয়েছিল তাঁর হায়োইড অস্থি, এবং সেটা ভেঙে ফেলার জন্য অসুরের মতো শক্তিশালী কাউকে দরকার নেই।’

‘লোকটা যে মিসেস ক্যুপারকে খুন করার জন্যই হাজির হয়েছিল এখানে, জানলেন কীভাবে?’

‘তিনটা কারণে। এই বাড়ির কোথাও কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায়নি খুনির। আজ থেকে পাঁচ দিন আগে মোটেও ঠাণ্ডা ছিল না আবহাওয়া, বরং বেশ গরমই ছিল; তারপরও গ্লাভস পরে ছিল লোকটা… আসলে নিশ্চিত হতে চেয়েছে কোথাও যেন আঙুলের ছাপ না-পড়ে তার। বেশিক্ষণ এখানে ছিলও না সে। কোথাও কোনো কফির কাপ নেই, জিন অ্যান্ড টনিকের খালি গ্লাস নেই। ওই লোক যদি মিসেস ক্যুপারের বন্ধু হতো, তা হলে তারা দু’জনে একসঙ্গে কোথাও বসে গলা ভেজাত।’

‘হয়তো তাড়াহুড়ো ছিল লোকটার।’

‘কুশনগুলোর দিকে একবার তাকান, টনি। লোকটা এমনকী বসেওনি।

একটু আগে যে-গ্লাস দেখেছি, এগিয়ে গেলাম সেটার দিকে। ওটা হাতে নিয়ে দেখতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু সংবরণ করলাম নিজেকে। পুলিশ আর ফরেনযিকের অফিসাররা এসেছিল এখানে, প্রমাণ হিসেবে নিশ্চয়ই কিছু-না-কিছু নিয়ে গেছে; কিন্তু এই গ্লাস কেন নিল না, ভেবে আশ্চর্য হলাম কিছুটা।

কথাটা বললাম হোথৰ্নকে।

‘ওটা নিয়ে গিয়েছিল ওরা,’ বলল হোথর্ন, ‘কিন্তু আবার রেখে গেছে।’

‘কেন?’

‘আমার জন্য,’ একটুখানি হাসল হোথর্ন, মুখের ভিতরে চালান করে দিল স্যান্ডউইচের বাকিটা।

‘তার মানে কেউ একজন ড্রিঙ্ক করেছিল।’

‘গ্লাসের ওই তরল পানি ছাড়া আর কিছু না,’ স্যান্ডউইচটুকু চিবিয়ে নিয়ে গিলে ফেলল হোথর্ন। ‘আমার কী ধারণা, জানেন? আমার ধারণা, চলে যাওয়ার আগে খুনি একগ্লাস পানি চেয়েছিল মিসেস ক্যুপারের কাছে। এবং সেটা আনতেই এই ঘর ছেড়ে বাইরে গিয়েছিলেন তিনি। সময়টা কাজে লাগিয়েছে খুনি, হুক থেকে খুলে নিয়েছে পর্দার ফিতা। ঘটনাটা ঘটার সময় এখানে যদি উপস্থিত থাকতেন মিসেস ক্যুপার, তা হলে সেটা করতে পারত না ওই লোক।’

‘কিন্তু খুনি পানি খায়নি।

‘নিজের ডিএনএ রেখে যেতে চায়নি সে আসলে।’

‘ক্রেডিট কার্ডের ব্যাপারটা কী?’ ওই জিনিসের গায়ে প্রিন্ট-করা নামটা পড়লাম: মিসেস ডায়ানা জে. ক্যুপার। কার্ডটা ইস্যু করা হয়েছে বাসে ব্যাংক থেকে। মেয়াদ শেষ হবে নভেম্বর মাসে। মানে আরও ছ’মাস বাকি।

‘ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং,’ বলল হোখন। ‘জিনিসটা অন্য সব কিছুর সঙ্গে তাঁর পার্সের ভিতরে পাওয়া গেল না কেন? ওটা কি পার্স থেকে বের করেছিলেন তিনি নিজেই? কেন করেছিলেন? কোনো কিছুর দাম চুকাতে চাইছিলেন? আর সেজন্যই কি দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতে দিয়েছিলেন খুনিকে? ওই কার্ডে তাঁর ফিঙ্গারপ্রিন্ট ছাড়া অন্য কারও আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়নি।’

‘তার মানে…’

‘তার মানে সম্ভাব্য একটা ব্যাখ্যা চলে আসছে আমাদের সামনে,’ আমার মুখের কথা কেড়ে নিল হোথর্ন। ‘কেউ একজন কিছু-একটার দাম চেয়েছিল মিসেস ক্যুপারের কাছে। তখন ক্রেডিট কার্ডটা বের করতে চাইছিলেন তিনি পার্সের ভিতর থেকে। ওটা যখন খুঁজছিলেন তিনি, তখন সুযোগ বুঝে তাঁর গলায় ফাঁস লাগিয়ে দেয় খুনি। এখন কথা হচ্ছে, কারও হাতে ক্রেডিট কার্ড থাকা অবস্থায় তার গলায় যদি ফাঁস লাগানো হয়, তা হলে কার্ডটা মেঝেতে পড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেটা ঘটেনি… মানে, কার্ডটা মেঝেতে পাওয়া যায়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন?’ মাথা নাড়ল সে। ‘আবার এ-রকমও হতে পারে, মূল ঘটনার সঙ্গে ওই কার্ডের কোনো যোগসূত্রই নেই। …দেখা যাক শেষপর্যন্ত কী জানতে পারি।’

‘আপনি বলেছেন খুনির দৃষ্টিশক্তি নাকি দুর্বল।’

‘হ্যাঁ…’

‘কেন বলেছেন কথাটা? মিসেস ক্যুপারের একহাতের আঙুলে হীরার একটা আংটি ছিল, অথচ সেটা নজরে পড়েনি ওই লোকের… সেজন্য? আংটিটা সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারলে অনেক টাকায় বেচতে পারত সে।’

‘না, আংটির কারণে বলিনি কথাটা। ভুল বুঝেছেন। ওই আংটির উপর বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না খুনির। আগেও বলেছি আবারও বলছি, যে-লোকই খুন করে থাকুক না কেন মিসেস ক্যুপারকে, হত্যাকাণ্ডটা চুরি বা ডাকাতি হিসেবে চালিয়ে দিতে চেয়েছে সে। ওই মহিলার কিছু গহনা আর একটা ল্যাপটপ নিয়ে গেছে সে। তবে হীরার ওই আংটি নেয়নি। ওটার কথা হয় ভুলে গেছে, নয়তো সঙ্গে স্যাকেটার্স (শক্ত ধাতব পদার্থ কাটার জন্য ব্যবহৃত বিশেষ একজাতের কেঁচি) ছিল না বলে কোনো ঝামেলা করতে চায়নি। …পেছন থেকে গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করবে সে মিসেস ক্যুপারকে, অথচ তাঁর হাতের আংটিটা দেখতে পাবে না– এটা এককথায় অসম্ভব।’

‘তা হলে ওই লোকের দৃষ্টিশক্তি যে দুর্বল, জানলেন কী করে?’

‘এই বাড়ির সদর দরজার বাইরে কাদায় ভরা একটা জায়গা ছিল, দৃষ্টিশক্তি দুর্বল বলেই সেখানে পা দিয়ে ফেলেছিল। আর সে-কারণেই তার জুতোর তলার ছাপ বসে গেছে কার্পেটের এককোনায়। যা-হোক, সে-ছাপ দেখে তাকে পুরুষলোক বলেই মনে হয়েছে আমার। ওই ছাপ বাদ দিয়ে যদি বলি, অন্য সব বিষয়ে খুব সতর্ক ছিল সে। …এসব কথা লিখবেন তো আপনি বইয়ে?’

‘লিখবো। মোটামুটি সব কিছুই মনে আছে আমার।’ বের করলাম আমার আইফোনটা। ‘কোনো সমস্যা না-থাকলে কয়েকটা ছবি তুলতে চাই।’

‘সমস্যা নেই। তুলুন।’ সাইডবোর্ডের উপর একজন লোকের সাদা-কালো একটা ফটোগ্রাফ রাখা আছে, লোকটার বয়স চল্লিশের ঘরে; ইঙ্গিতে ছবিটা দেখিয়ে দিল হোথর্ন। ‘ওটার ছবি তুলে নিতে ভুলবেন না যেন।’

‘কে ওই লোক?’

‘আমার ধারণা মিসেস ক্যুপারের স্বামী। লরেন্স ক্যুপার।’

‘ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল তাঁদের দু’জনের?

এমন এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল হোথর্ন যে, দেখে মনে হলো, কথাটা শুনে চোট পেয়েছে মনে। ‘ডিভোর্স হয়ে গেলে ওই লোকের ছবি নিজের বাড়িতে রাখতেন না মিসেস ক্যুপার। যা-হোক, আজ থেকে বারো বছর আগে মারা গেছেন লোকটা। ক্যান্সার।’

কথা আর না-বাড়িয়ে নিজের আইফোনে মিসেস ক্যুপারের স্বামীর ছবি তুলে নিলাম। টুকটাক আরও কিছু ছবি তুললাম।

তারপর ঘুরে বেড়াতে লাগলাম হোথর্নের পিছু পিছু। আমাকে নিয়ে এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যাচ্ছে সে। দেখিয়ে দিচ্ছে এটা-সেটা, ছবি তুলতে বলছে আমাকে। ওর কথামতো কাজ করছি।

আমাদের এই ঘুরে বেড়ানোর কাজটা শুরু হলো কিচেন থেকে। রান্নাঘরটা, প্রথম দেখায়, কোনো শো-রুম বলে মনে হলো আমার কাছে… প্রয়োজনীয় এবং দামি সব জিনিসপত্রে ঠাসা, অথচ ব্যবহৃত হয়েছে খুব কম। অর্থাৎ রান্নার কাজ খুব একটা করতেন না মনে হয় মিসেস ক্যুপার। রাতে হয়তো একটা সেদ্ধ ডিম আর দু’টুকরো টোস্ট খেয়ে শুয়ে পড়তেন।

ফ্রিজের গায়ে চুম্বক দিয়ে সাঁটা আছে অনেক কিছু: ক্ল্যাসিকাল আর্ট, শেক্সপিয়ারের উক্তি। নার্নিয়া সিনেমার প্রিন্স ক্যাস্পিয়ান চরিত্রটার ছবিওয়ালা একটা টিনের-কৌটা রাখা আছে ফ্রিজের উপর

যাতে আঙুলের ছাপ বসে না-যায় সেজন্য একটা কাপড় দিয়ে ধরে ফ্রিজের দরজাটা খুলল হোথর্ন। ভিতরটা বলতে গেলে খালি। দরজাটা লাগিয়ে দিল সে। এবার খুলল টিনের কৌটাটা। কিছুক্ষণ দেখার পর আগের জায়গায় রেখে দিল সেটা।

এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি আমি। যেটা যেখানে রাখা দরকার, সেটা ঠিক সেখানেই রাখা আছে বলে মনে হচ্ছে। জানালার গোবরাটের উপর রাখা আছে রেসিপির কয়েকটা বই। টোস্টারের পেছনের একটা র‍্যাকে রাখা আছে কয়েকটা নোটবুক আর সাম্প্রতিক কিছু চিঠি। এই সপ্তাহে কী কী কেনাকাটা করতে হবে সেটার ছোট একটা তালিকা লেখা আছে একটা ব্ল্যাকবোর্ডে।

এগিয়ে গিয়ে চিঠিগুলো তুলে নিল হোথর্ন, ঘাঁটাঘাঁটি করল কিছুক্ষণ, তারপর রেখে দিল আগের জায়গায়। কাউন্টারের উপর, দেয়ালের গায়ে আটকানো আছে কাঠের একটা মাছ; সেটার সঙ্গে যুক্ত আছে পাঁচটা হুক, আলাদা আলাদা কয়েকটা চাবি ঝুলছে ওসব হুকে… ব্যাপারটা আগ্রহী করে তুলল হোথর্নকে। প্রতিটা চাবির গায়ে সাঁটা আছে লেবেল। আগ্রহ জাগল আমার মনেও, ছবি তুলে নিলাম চাবিগুলোর। ওসব লেবেলের উপর চোখ বুলিয়ে জানতে পারলাম, কোনো চাবি সদর-দরজার, কোনোটা আবার পেছনের দরজার অথবা সেলারের। চতুর্থ চাবির গায়ে সাঁটা লেবেলে লেখা আছে: স্টোনার হাউস।

‘এটা কী?’ জানতে চাইলাম আমি।

‘একটা বাড়ি… একসময় সেখানে থাকতেন মিসেস ক্যুপার। পরে লন্ডনে চলে আসেন তিনি। বাড়িটা কেন্টের ওয়ালমারে অবস্থিত।’

‘ওই বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছেন তিনি, তারপরও রেখে দিয়েছেন সেখানকার চাবি… ব্যাপারটা অদ্ভুত।’

কোনো মন্তব্য করল না হোথর্ন।

খুঁজতে খুঁজতে একটা ড্রয়ারে পাওয়া গেল আরও কিছু পুরনো চিঠি এবং বিল। প্রায় সবগুলোই ঘেঁটে দেখল হোথর্ন। মরোক্কান নাইটস নামের একটা গীতিনাট্যের ব্রশিউর পাওয়া গেল আরেকটা ড্রয়ারে। প্রথম পৃষ্ঠায় দেখা যাচ্ছে কয়েকজন প্রযোজকের নাম; তাঁদের মধ্যে রেমন্ড কুন্সের নামটাও আছে।

রান্নাঘর থেকে আমরা গেলাম উপরতলায়। করিডর ধরে হাঁটছি। ফ্রেমে বন্দি অবস্থায় মঞ্চনাটকের কিছু দৃশ্য ঝুলছে ওয়ালপেপার-সাঁটা দু’ধারের দেয়ালে হ্যামলেট, দ্য টেম্পেস্ট, হেনরি ফাইভ, দ্য ইম্পর্টেন্স অভ বিইং আর্নেস্ট, দ্য বার্থডে পার্টি। প্রতিটা নাটকেই অভিনয় করেছে ড্যামিয়েন ক্যুপার।

করিডর ধরে সামনের দিকে এগিয়ে গেল হোথর্ন, কিন্তু আমি ঢুকে পড়লাম মিসেস ক্যুপারের বেডরুমে। অনধিকার-প্রবেশের সেই অস্বস্তিকর অনুভূতি আরও একবার জেগে উঠল আমার মনে, এবং ব্যাপারটা বিস্মিত করল আমাকে। হয়তো সপ্তাহখানেক আগেও একজন মহিলা কাপড় ছেড়েছেন এই ঘরে, হয়তো কিছু সময়ের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি প্রমাণ আকৃতির আয়নার সামনে, হয়তো স্টিগ লারসনের দ্য গার্ল হু প্লেইড উইথ ফায়ার বইটা নিয়ে শুয়েছেন কুইন-সাইজ বিছানায়। বইটা এখন পড়ে আছে বেডসাইড টেবিলের উপর।

দুটো বালিশ দেখা যাচ্ছে বিছানায়। একটাতে একটুখানি গর্ত হয়ে আছে… অর্থাৎ ওটাতে মাথা রেখে শুয়েছিলেন মিসেস ক্যুপার।

যেখানেই গিয়ে থাকুক না কেন হোথর্ন, ফিরে এসে ঢুকে পড়েছে বেডরুমে তল্লাশি চালাচ্ছে ওয়ার্ডরোব, বেডসাইড কেবিনেট আর বিভিন্ন ড্রয়ারে। ড্যামিয়েন ক্যুপারের ফ্রেমে-বন্দি একটা ছবির উপর নজর বুলিয়ে নিল দ্রুত। ছবিটা রাখা আছে মিসেস ক্যুপারের মেকআপ টেবিলের উপর। আমিও তাকালাম ওটার দিকে একনজরেই যে চিনতে পারলাম লোকটাকে, এমনটা দাবি করবো না… কারণ লোকের চেহারা ঠিকমতো মনে থাকে না আমার; বিশেষ করে ড্যামিয়েনের মতো যুবক বয়সী, সুদর্শন, ইংরেজ অভিনেতাদের ব্যাপারে প্রায়ই তালগোল পাকিয়ে ফেলি। আর যারা হলিউডের ছবিতে অভিনয় করে, তাদের কথা তো বলাই বাহুল্য।

মিসেস ক্যুপারের শু র‍্যাকের পেছনে একটা সিন্দুক খুঁজে পেল হোথর্ন। ওটা লক-করা বুঝতে পেরে ভ্রূ কুঁচকে গেল ওর। কিন্তু পরমুহূর্তেই যেন ভুলে গেল ব্যাপারটা।

যে-পদ্ধতিতে ক্লু খুঁজছে সে, মুগ্ধ না-হয়ে পারছি না। খোঁজাখুঁজির এই সময়টাতে একটা কথাও বলেনি আমার সঙ্গে। এমনকী ওর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়নি, আমি যে আছি এখানে, সেটা মনে আছে ওর। কোনো কোনো বিমানবন্দরে গন্ধ শুঁকবার কাজে ব্যবহৃত হয় কুকুর; হোথর্নের কাজ দেখে ওসব জন্তুর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে আমার। যাত্রীদের প্রতিটা সুটকেসেই যে ড্রাগস বা বোমা থাকবে এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই, তারপরও… কুকুর তো কুকুরই… প্রতিটা সুটকেস আর ব্যাগ শুঁকবেই ওগুলো। এবং ওগুলোর মতোই অনিশ্চয়তা দেখতে পাচ্ছি হোথর্নের চেহারায়। ওগুলো যেভাবে নিশ্চিত হতে চায়, সেভাবে যেন নিশ্চিত হতে চাইছে সে বিশেষ কোনো একটা ব্যাপারে।

বেডরুম থেকে বাথরুমে গিয়ে ঢুকল হোথর্ন। বাথটাবের ধারে গোটা বিশেক বোতল দেখতে পাচ্ছি। অনুমান করলাম, হোটেল থেকে নিজের জন্য শ্যাম্পু আর বাথ-জেল আনিয়ে নিতেন মিসেস ক্যুপার। বেসিনের উপর একটা কেবিনেট দেখতে পেয়ে সেটা খুলল হোথর্ন। টেমাজেপামের তিনটা প্যাকেট বের করল। এটা আসলে একজাতের ঘুমের ওষুধ। আমার দিকে ঘুরে প্যাকেট তিনটা দেখাল।

‘ইন্টারেস্টিং,’ এতক্ষণে কথা ফুটল ওর মুখে।

‘কিছু একটা নিয়ে উদ্বেগে ভুগছিলেন মিসেস ক্যুপার,’ বললাম আমি। ‘হয়তো… ঠিকমতো ঘুম হচ্ছিল না তাঁর।’

মন্তব্য করল না হোথর্ন। প্রথমে বের হলো বাথরুম থেকে, তারপর বের হলো বেডরুম থেকে। ওর পেছন পেছন রওয়ানা হলাম।

এই বাড়ির উপরতলায় দুটো গেস্টরুম আছে। তবে একনজর দেখেই বোঝা গেল, সাম্প্রতিক সময়ে কোনো অতিথি থাকতে আসেনি এখানে। খুবই পরিপাটি করে সাজানো আছে দুটো ঘরই, এবং দু’জায়গার বাতাসই কেমন ঠাণ্ডা। অনুমান করে নিলাম, বিদ্যুতের খরচ বাঁচানোর জন্য এই দু’ঘরের সেন্ট্রাল হিটিং সিস্টেম বন্ধ করে রাখা হয়েছে।

এদিক-ওদিক তাকাল হোথর্ন, তারপর বেরিয়ে এসে দাঁড়াল করিডরে। ‘বিড়ালটার কী হয়েছে বলে ধারণা আপনার?’ জিজ্ঞেস করল আমাকে

‘কীসের বিড়াল?’

‘মিসেস ক্যুপারের একটা বিড়াল ছিল। পার্শিয়ান গ্রে। মেডিসিন বল দেখেছেন না? বড় বড় লোমওয়ালা ওসব বিড়াল দেখলে ওই জিনিসের কথা মনে পড়ে যায় আমার।’

‘কই, কোথাও কোনো বিড়ালের ফটোগ্রাফ দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না?’

‘আমিও দেখিনি।’

দেখেনি যখন, তখন বিড়ালের ব্যাপার জানল কী করে হোথৰ্ন?

কিন্তু ওই ব্যাপারে আর কিছু বলল না সে। হঠাৎ করেই বদলে গেছে ওর মুখভাব… বিরক্ত বলে মনে হচ্ছে ওকে।

বললাম, ‘আপনাকে নিয়ে যদি লিখি, তা হলে আপনার কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত বলতে হবে আমাকে।’

‘যেমন?’

‘বিড়ালের ব্যাপারটা। বলা নেই কওয়া নেই, হুট করে বলে বসলেন ওটার কথা। অথচ পুরো বাড়ির ভিতরে ওই প্রাণীর একটা ছবিও নেই।

আমার কথা শুনে হোথর্নের বিরক্তি আরও যেন বাড়ল। ‘কিচেনে একটা ফিডিং বোল আছে… দেখেননি? আর বেডরুমের ওই বালিশটা… ওটাও কি নজর এড়িয়ে গেছে আপনার?’

‘বেডরুমের বালিশটা? আমি তো ভেবেছিলাম মিসেস ক্যুপার ওটাতে মাথা রেখে শুয়েছিলেন বলেই…’

‘আরে না! তাঁর মাথায় বিড়ালের লোমের মতো ছোট ছোট রেশমি চুল নেই। তা ছাড়া ওই বালিশ থেকে মাছের মতো গন্ধ পেয়েছি। আরও একটা ব্যাপার নজর এড়িয়ে গেছে আপনার… বুঝতে পারছি। বিছানার বাঁ দিকে শুতেন মিসেস ক্যুপার, কারণ বেডসাইড টেবিলটা সেদিকেই, আর ওই টেবিলের উপরই দেখতে পেয়েছি আমরা স্টিগ লারসনের বইটা। বিড়ালটা শুত বিছানার অন্য পাশে। বালিশে যে- রকম গর্ত তৈরি হয়েছে সেটা দেখলেই বোঝা যায়, ওই বিড়াল বেশ নাদুসনুদুস এবং বড়সড়। আগেও বলেছি আবারও বলছি, আমার ধারণা ওটা একটা পার্শিয়ান গ্রে। কিন্তু…’ আরও একবার এদিক-ওদিক তাকাল হোথর্ন, ‘কোথাও দেখতে পাচ্ছি না কেন ওটাকে?’

‘হয়তো… পুলিশ নিয়ে গেছে।’

‘হয়তো।’

নিচতলায় হাজির হলাম আমরা দু’জন। আবার ঢুকলাম লিভিংরুমে। দেখতে পেলাম, আরও একজন লোক উপস্থিত হয়েছে কখন যেন। তার পরনে সস্তা স্যুট। দু’পা ফাঁক করে বসে আছে সোফায়, একটা ফাইল খুলে মেলে রেখেছে কোলের উপর। বাঁকা হয়ে আছে পরনের টাই, লাগানো হয়নি শার্টের দুটো বোতাম। কেন যেন মনে হলো, লোকটা ধূমপায়ী। অসুস্থতার ছাপ তার সব কিছুতে: চামড়ার রঙে, পাতলা হয়ে-আসা চুলে, ভাঙা নাকে, এমনকী ট্রাউজারের ওয়েস্টব্যান্ডের সঙ্গে লেপ্টে-থাকা পেটে। তার বয়স হোথর্নের সমানই, কিন্তু হোথর্নের চেয়ে বড়সড় আর থলথলে। দেখে মনে হচ্ছে, কিছু দিন আগে অবসর নিয়েছে বক্সিং-রিং থেকে। অনুমান করলাম, লোকটা নিশ্চয়ই পুলিশের কোনো অফিসার। এ-রকম লোকদের টেলিভিশনে অনেক দেখেছি… নাটকে না, আদালতকক্ষের বাইরে– ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আগে-থেকেই তৈরি-করে-রাখা কোনো বিবৃতি পড়ার সময়।

‘হোথর্ন,’ বলে উঠল লোকটা, উৎসাহের ছিটেফোঁটা নেই কণ্ঠে

‘ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মিডোস!’ আনুষ্ঠানিক উপাধিটা হাস্যকর ভঙ্গিতে উচ্চারণ করল হোথর্ন; ভাবখানা এমন, মিডোসের নামের সঙ্গে যেন মেলে না সেটা। তারপর বলল, ‘হ্যালো, জ্যাক।‘

বুঝে নিলাম, সোফায় বসে-থাকা ওই লোকের পুরো নাম জ্যাক মিডোস।

‘আমাকে যখন বলা হলো আপনাকে খবর দিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে এই কেসের ব্যাপারে, বিশ্বাসই করতে পারিনি।’ আমার উপর নজর পড়ল মিডোসের। ‘আপনি কে?’

সহসা কোনো জবাব দিলাম না। কারণ ঠিক কী পরিচয় দেবো নিজের, বুঝতে পারছি না।

‘তিনি একজন লেখক,’ বলল হোথর্ন। ‘আমার সঙ্গে আছেন।’

‘কী! কী নিয়ে লেখালেখি করছেন তিনি?’

‘এই কেস নিয়ে।’

‘বাইরের কাউকে জড়িয়ে ফেলছেন আপনি এসবের সঙ্গে … ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েছেন তো? যা-হোক, আপনার জন্য যা-যা করতে বলা হয়েছিল আমাকে, সব করেছি। প্রমাণ হিসেবে কিছু জিনিস নিয়ে গিয়েছিলাম আমরা সঙ্গে, সব আবার ফিরিয়ে এনে যেটা-যেখানে-ছিল সেটা সেখানে রেখে দিয়েছি সময়ের অপচয় আর কী। …ক্রাইম সিন পরিদর্শনের কাজটা মনে হচ্ছে শেষ করেছেন?’

‘করেছি মোটামুটি। চলে যাচ্ছিলাম, আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ভালোই হলো। মিসেস ক্যুপারের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে কী ধারণা আপনার, বলুন তো?’

‘কিছু মনে করবেন না… এ-ব্যাপারে আমার যা-ধারণা, সেটা ভাগাভাগি করতে চাইছি না আপনার সঙ্গে।’ অলস ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল মিডোস। যতটা ভেবেছিলাম, তার চেয়েও লম্বাচওড়া সে। মনে হচ্ছে, একটা টাওয়ার যেন দাঁড়িয়ে আছে আমার আর হোথর্নের সামনে। ফাইলের কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়ে সেটা বাড়িয়ে ধরল হোথর্নের দিকে। ‘এটা আপনার হাতে দিতে বলা হয়েছে আমাকে।’

ইতোমধ্যে নজর বুলিয়ে নিয়েছি আমি ওই ফাইলের উপর। ওটার ভিতরে বিভিন্ন ফটোগ্রাফ, ফরেনযিক রিপোর্ট, সাক্ষীদের বিবৃতি, এবং এই বাড়ির টেলিফোন আর ডায়ানা ক্যুপারের মোবাইল থেকে করা গত দু’সপ্তাহের সমস্ত কলের রেকর্ড আছে।

ফাইলটা হাতে নিল হোথর্ন, নজর বোলাল প্রথম পৃষ্ঠার উপর। ‘সন্ধ্যা ছ’টা একত্রিশ মিনিটে একটা টেক্সট মেসেজ পাঠিয়েছিলেন মিসেস ক্যুপার।’

‘ঠিক। আর সে-সময়ের কিছুক্ষণ পরই তাঁর গলায় ফাঁস লাগানো হয়। খুনি … কিছু একটা বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিল মিডোস, হাসল। ‘ওই মেসেভ পড়েছি আমি। এবং সেটা পড়ে তেমন কিছুই মনে হয়নি আমার। এমনক মেসেজটা আদৌ গুরুত্বপূর্ণ কি না, তা-ও বুঝতে পারিনি। আপনি চেষ্টা করে দেখুন ওটার কোনো মানে বের করতে পারেন কি না।’ সাইডবোর্ডের উপর, ক্রেডিট কার্ডের পাশে রাখা পানির গ্লাসটার দিকে এগিয়ে গেল। ‘এবার এই জিনিস নিয়ে যেতে চাই… যদি কোনো আপত্তি না-থাকে আপনার।’

‘না, আপত্তি নেই।’

প্রথমবারের মতো খেয়াল করলাম, গ্লাভস পরে আছে মিডোস। কোনো একজাতের প্লাস্টিকের-ক্যাপ ব্যবহার করে গ্লাসটা সিল করে দিল সে, তারপর তুলে নিল।

‘ওই গ্লাসে ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে,’ বলল হোথর্ন, ‘তবে সেটা শুধু মিসেস ক্যুপারের। কিন্তু কোনো ডিএনএ পাওয়া যায়নি ওটা থেকে। তার মানে কেউ পানি খায়নি ওই গ্লাসে।’

‘মানে?’ দ্বিধা দেখা দিয়েছে মিডোসের চেহারায়। ‘রিপোর্টটা কি আগেই পড়ে ফেলেছেন?’

‘যা বললাম, সেটা বলার জন্য রিপোর্ট পড়ার দরকার হয় না আমার… দেখলেই বোঝা যায়। ফ্রিজের উপর রাখা টিনের ওই কৌটা দেখেছেন?’

‘দেখেছি। কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায়নি ওটাতেও

‘ক্রেডিট কার্ডের ব্যাপারটা কী?’

‘কোন্ ব্যাপার?’

‘শেষ কবে ব্যবহার করা হয়েছিল ওটা?’

ইঙ্গিতে ফাইলটা দেখিয়ে দিল মিডোস। ‘ওই মহিলার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে আছে পনেরো হাজার পাউন্ড। আর তাঁর সেভিংস অ্যাকাউন্টে আছে আরও দুই লক্ষ পাউন্ড। …কী যেন জানতে চেয়েছিলেন? ও… মিসেস ক্যুপার শেষ কবে ব্যবহার করেছেন ওই কার্ড, তা-ই তো? সপ্তাহখানেক আগে। হ্যাঁরোস্-এ। সেখান থেকেই মুদি সামগ্রী কিনতেন তিনি।’

‘কী কী কিনেছিলেন তিনি, তা-ও জানি। স্মোক্ড স্যামন আর ক্রীম-লাগানো পনির।’

‘কীভাবে জানতে পারলেন?’

‘কিচেনে দেখেছি ওসব। এবং ওসব কাজে লাগিয়েই নিজের জন্য ব্রেকফাস্ট বানিয়ে নিয়েছিলাম।’

‘কী! স্বেচ্ছায়-সজ্ঞানে ক্রাইমসিনের প্রমাণ ধ্বংস করেছেন?’

‘হ্যাঁ, করেছি। কারণ আমার খিদে পেয়েছিল অনেক।’

ভ্রূ কুঁচকে গেছে মিডোসের। ‘আর কিছু জানার আছে আপনার?’

‘আছে। বিড়ালটার কী হয়েছে?

‘কীসের বিড়াল?’

‘আমার প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেছি।’

হোথর্নের বলার কায়দায় বুঝতে পারলাম, মিসেস ক্যুপারের বিশেষ সেই বিড়ালের ব্যাপারে কিছুই জানে না মিডোস।

গ্লাসটা চোখের সামনে ধরে কী যেন দেখছে পুলিশের ডিটেক্টিভ ইন্সপেক্টর। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, সে যেন কোনো জাদুকর… এখনই এমন কোনো ভেল্কিবাজি দেখাবে, যার ফলে ওই গ্লাসের ভিতরে হাজির হবে কোনো গোল্ডফিশ। কিন্তু, বলাই বাহুল্য, সে-রকম কিছু ঘটল না।

গ্লাসের উপর থেকে চোখ না সরিয়ে আমার উদ্দেশে মাথা ঝাঁকাল লোকটা। ‘আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভালো লাগল। তবে… আপনার জায়গায় যদি আমি থাকতাম, এ-রকম কোনো ক্রাইমসিনে এলে সাবধান থাকার চেষ্টা করতাম। বিশেষ করে যদি সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতাম, তা হলে।’

জবাবে কিছু বলার সুযোগ দিল না আমাকে। নজর সরিয়ে নিল গ্লাসের উপর থেকে, এদিক-ওদিক তাকাল, তারপর গ্লাসটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *