পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ নিরাশা
প্রতাপের সহিত যুদ্ধের পরে কয়েক দিনের মধ্যে দেখিতে দেখিতে ভাদ্র মাস প্রায় অতিবাহিত হইতে চলিল। ঈসা খাঁ ভাদ্র মাসের শেষে অনুরাগাতিশয্যে কেদার রায়ের নিকট দূত পাঠাইয়া স্বর্ণময়ীকে বিবাহের প্রস্তাব করিয়া পাঠাইলেন। ঈসা খাঁ স্বর্ণময়ীকে বিবাহ করিতে চান, এ প্রস্তাবে কেদার রায় যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাইলেন। কণিষ্ঠ ভ্রাতা চাঁদ রায়, অন্যান্য আত্মীয় স্বজন এবং অমাত্যবর্গের সহিত এ বিষয়ে পরামর্শ করিলেন, কিন্তু কুলগুরু এবং চাঁদ রায় সম্পূর্ণ অমত প্রকাশ করিলেন। ইদিলপুরের শ্রীনাথ চৌধুরীর সহিত স্বর্ণময়ীর বিবাহের পাকাপাকি কথা হইয়া গিয়াছে। এক্ষণে সেই বাগদত্তা কন্যাকে ভিন্ন-ধর্মাবলম্বী মুসলমান হস্তে সমর্পণ করা অপেক্ষা মহাপাতক আর কি আছে? ইহা দ্বারা কুল অপবিত্র ও কলঙ্কিত হইবে। এবম্বিধ নানা আপত্তি উত্থাপন করিয়া চাঁদ রায় এবং কুলগুরু যশোদানন্দ ঠাকুর কেদার রায়ের অমত করিয়া ফেলিলেন। আজকাল যেমন বিধবা-বিবাহ লইয়া হিন্দু পণ্ডিতমণ্ডলীর মধ্যে দুই প্রকার মত পরিলক্ষিত হয়, তখন মুসলমানকে কন্যাদান সম্বন্ধে ব্যবস্থাদাতা পণ্ডিতদিগের মধ্যেও সেই প্রকার দুই মত ছিল। মুসলমানকে কন্যাদানের পক্ষে একদশ এবং অন্যদশ ইহার বিপক্ষে বলা বাণ্ডল্য, পক্ষ অপেক্ষা বিপক্ষেই পণ্ডিত সংখ্যা খুব বেশী ছিল।
স্বর্ণময়ীর মাতা রাণী হিরুন্ময়ীও সম্পূর্ণ অমত প্রকাশ করিলেন। ইতিমধ্যে ঈসা তাঁর জননী আয়েশা খানম, স্বর্ণময়ীকে বিবাহ করিবার জন্য তাঁহার পুত্র কেদার রায়ের নিকট ঘটক পাঠাইয়াছেন, ইহা শুনিয়া যার-পর-নাই দুঃখিত এবং ক্ষুন্ন হইলেন। ঈসা খাঁকে একটু মিষ্ট তিরস্কারও করিলেন। স্বর্ণময়ীকে পুত্রবধূরূপে বরণ করিতে যেন তাঁহার সম্পূর্ণ অমত, বিশ্বস্ত লোক পাঠাইয়া সে কথাও গোপনে কেদার রায়কে জানাইয়া দিলেন। কিন্তু গোপনে জানাইলেও ঈসা খাঁ অবিলম্বেই তাহা জানিতে পারিলেন। তিনি আশায় নিরাশার আশঙ্কা করিতে লাগিলেন। কেদার রায় কি অভিপ্রায় প্রকাশ করেন, তাহা ভাবিয়া তিনি আকুল হইতে লাগিলেন। এমন সময় যথাকালে ঘটক আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কেদার রায় ব্যতীত সকলেরই ঘোর আপত্তি, বিশেষতঃ পূর্বেই স্বর্ণের বিবাহের কথা ইদিলপুরের শ্রীনাথ চৌধুরীর সহিত পাকাপাকি হইয়া গিয়াছে বলিয়া কেদার রায় সম্মতি প্রকাশ করিতে না পারিয়া নিরতিশয় দুঃখিত হইয়াছেন ইত্যাদি সমস্ত ব্যাপার ঘটক আদ্যোপান্ত বিবৃত করিলেন।
ঘটকের কথা শুনিয়া বীরপুরুষ ঈসা খাঁর স্ফীত বক্ষ যেন দমিয়া গেল। আলোকময় আনন্দকোলাহলপূর্ণ পৃথিবী যেন স্মশানে পরিণত হইল। স্বর্ণময়ীর প্রেমের মোহিনী আশার কনককিরণ-রাগে তাঁহার যে চিত্ত বিচিত্র জলদ-কদম্ব শোভিত ঊষার আকাশের ন্যায় শোভিত ছিল, তাহা হতাশার কৃষ্ণ-মেঘে সমাচ্ছন্ন হইয়া গেল! বিস্তৃত রাজ্য, অখণ্ড প্রভুত্ব, প্রফুল্ল যৌবন, অগাধ ধন, যাহা এতদিন সুখ ও আনন্দের কারণ ছিল, এখন তাহা জীবনপথের কণ্টক বলিয়া মনে হইতে লাগিল। ঈসা খাঁ ভাবিতে লাগিলেন, “হায়! কি কুক্ষণেই আমি স্বর্ণময়ীকে উদ্ধার করিয়া ছিলাম! আর কি কুক্ষণেই বা স্বর্ণময়ী আমাকে আত্মডালি দিয়া পত্র লিখিয়াছিল! স্বর্ণকে আমি নির্মম দস্যুর হস্ত হইতে উদ্ধার করিয়া শেষে কি অশুল সাগরে ভাসাইয়া দিব? হায়! যে সরলা যুবতী আমাকে সম্পূর্ণ প্রাণের সহিত বসন্তের নবলতিকার ন্যায় জড়াইয়া ধরিয়াছে, তাহাকে কিরূপে বিচ্ছিন্ন করিব? বিচ্ছিন্ন করিলে, তাহার জীবন-কুসুম যে অকালে বিশুস্ক হইবে! আমিই বা বিশেষ বিবেচনা না করিয়া স্বর্ণকে হৃদয়-সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করিলাম কেন? বাগদত্তা কন্যাকে কেদার রায়ই বা কি করিয়া পুনরায় অন্যত্র সমর্পণ করেন? হায়! স্বর্ণ আমাতে কেন মজিল? কি বিষম সমস্যা! এ সমস্যা মীমাংসা করা মানব-বুদ্ধির অসম্য। হায়! হৃদয় যে এক মুণ্ডর্তের জন্যও স্বর্ণকে ভুলিতে পারিতেছে না। স্বর্ণকে পাইব না, ইহা চিন্তা করিতে-কল্পনা করিতেও হৃদয় চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া যায়। হায়! আমার স্বর্গ! আমাতে উৎকৃষ্টপ্রাণা স্বর্ণ,-আমাতে মুগ্ধ স্বর্ণ, আমার প্রেম-বারিদের আকাঙ্খিণী তৃষ্ণার্ত-চাতকী স্বর্ণ, সে অন্যের পাণিপীড়ন করিবে, উঃ! এ-চিন্তা কি অসহ্য! কি মর্মন্তুদ!! কি ভীষণ!! হায়! আমি যদি স্বর্ণকে না পাই, তবে প্রেমের ব্যভিচার করিয়া এ-জীবনকে আর কলঙ্কিত করিব না। শুধু তাই কি? এ জীবন লইয়া সংসারে যে কি করিব, তাহাও ত খুঁজিয়া পাইতেছি না। কি আশ্চর্য! যদি স্বর্ণকে না পাই তাহা হইলে সংসারে আমার আর কিছুই কার্য নাই-অনুরাগ নাই-প্রয়োজন নাই। কিন্তু যদি স্বর্ণকে পাই, তাহা হইলে এ-সংসারে যেন কর্তব্যের শেষ নাই-অনুরাগের সীমা নাই-কর্মের ইতি নাই-আনন্দের ইয়ত্তা নাই। হায় যৌবন! হায় রমণীর সৌন্দর্য! হায় প্রেম! তোমাদের কি অঘটন-ঘটন-পটিয়সী শক্তি! কি অদ্ভুদ প্রয়াস!! ধন্য প্রেম! তোমার প্রভাবে মরুভূমিতে মন্দাকিনী বহে, শুস্ক তরুতে কুসুম ফোটে, অমাবস্যায় চন্দ্রোদয় হয়, হেমন্তে কোকিল গায়, অন্ধ নত্র দর্শন করে, পঙ্গু গিরি লঙ্ঘন করে! তুমি বাহুতে শক্তি, হৃদযে আনন্দ, নেত্রে জ্যোতি, শরীরে স্বাস্থ্য, কর্মে উৎসাহ, মস্তিকে বুদ্ধি, মানসে কল্পনা। তুমি যেখানে, সেখানেই স্বর্গ! তোমার যেখানে অভাব, তাহাই নরক! তোমার প্রাপ্তিই জীবন, তোমার অভাবই মরণ!”
ঈসা খাঁ প্রেমাস্পদের প্রেম-সৌরভে চিরবঞ্চিত হইবার ক্ষোভে নিতান্ত বিমনায়মান-চিত্ত হইয়া পড়িলেন; চঞ্চল মনকে প্রকৃতিস্থ করিবার জন্য বহু চেষ্টা করিলেন; কিন্তু পূর্বের শান্তি আর ফিরিয়া আসিল না। ঠিক এই উদ্বেগ ও মানসিক অস্থৈর্যের মধ্যে আলীম দাদ খানের জেহাদের নিমন্ত্রণ-পত্র লইয়া শেখ ইয়াকুব খিজিরপুরে উপস্থিত হইল। পত্রপাঠে ঈসা খাঁর সর্বশরীরে বিদ্যুৎতরঙ্গ প্রবাহিত হইল। কাপুরুষ শয়তান কাফেরের হস্তে মুসলমানের এতাদৃশ শোচনীয় ও নৃশংসা হত্যাকাণ্ড পাঠে, তেজীয়ান পাঠান বীর ক্রোধে ও ক্ষোভে প্রোজ্বলিতপ্রায় হইয়া উঠিলেন। জেহাদের উন্মাদয়ায় তাঁহার বীর-হৃদয় উদ্দীপিত হইয়া উঠিল। হৃদয়বান পাঠান বীরের জ্বালাময় বিস্ফারিত নেত্রযুগল হইতে নিহত নরনারী ও বালক-বালিকাদিগের জন্য সহ-মর্মিতা এবং শোকের তরল মুক্তাধারা নির্গত হইতে লাগিল। যে পুণ্য অশ্রু-প্রবাহে তাঁহার হৃদয়ের আহবান করিয়া সেই পত্র পাঠ করিয়া শুনাইলেন। পত্র শ্রবণে সকলের চক্ষুতেই ভ্রাতৃ-শোকের এবং জাতীয় সহানুভূতির অশ্রুবিন্দু উঞ্ছগত হইল। এ জেহাদে যোগদান করা যে অপরিহার্য কর্তব্য, সে-বিষয়ে সকলেই একমত প্রকাশ করিলেন। সম্ভ্রান্ত বংশের একশত যুবক জেহাদের জন্য রণক্ষেত্রে যাইতে স্বেচ্ছায় প্রস্তুত হইলেন। ঈসা খাঁ, মাহতাব খাঁকে প্রতিনিধি-স্বরূপ রাজ্যে রাখিয়া পবিত্র জেহাদে যোগদান করিবার জন্য সমস্ত আয়োজন ঠিক করিতে লাগিলেন। অল্পদিনের মধ্যের রাজ্য রক্ষা এবং রাজকার্য পরিচালনার সমস্ত বন্দোবস্ত করতঃ দুই সহস্র উৎকৃষ্ট রণদক্ষ যোদ্ধা লইয়া জলপথে দাক্ষিণাত্যে যাত্রা করিলেন। একশত স্বেচ্ছাসেবক বীর যুবকও রণোৎসাহে উৎসাহিত হইয়া তাঁহার সহিত গমন করিলেন। ঈসা খাঁর প্রেম-পিপাসিত হৃদযের নিদারুল উদ্বেগ এবং স্বর্ণময়ী লাভের ব্যাকুল ও অবিরাম চিন্তা, জেহাদের উত্তেজনায় এবং জাতীয় সহানুভূতির উদ্দীপনায় যে ঢাকা পড়িয়া গেল। ঈসা খাঁ ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র কর্তব্যকে জাতীয় বৃহত্তর কর্তব্যের নিকট বলিদান করিলেন। নারী-প্রেম, জাতীয়-প্রেমের নিকট ডুবিয়া গেল। ধন্য ঈসা খাঁ! ধন্য তোমার জাতীয় প্রেম!! তুমি যথার্থ বীরপুরুষ!!