একদশ পরিচ্ছেদঃ যুদ্ধ
রাত্রি অর্ধ প্রহরের পর মহররম-উৎসব শেষ হইলে, নবাব ঈসা খাঁ মস্নদ-ই-আলী যখন জগদানন্দ মিত্রকে ডাকাইয়া স্বর্ণময়ীর সহিত দেখা করিতে চাহিলেন, তখন চারিদিকে তাজিয়া-ঘাটায় স্বর্ণের অনুসন্ধান হইল। কিন্তু স্বর্ণ এবং তাঁহার নৌকার কোনও খোঁজ-খবর কোথায়ও পাওয়া গেল না। সকলেই মহাব্যস্ত এবং উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল। চতুর্দিকে বণ্ড নৌকা, লোকজন এবং গুপ্তচর প্রেরিত হইল। শ্রীপুর হইতে রাজা কেদার রায় চতুর্দিকে গুপ্তচর ও সন্ধানী পাঠাইলেন। নবাব ঈসা খাঁও অনেক লোকজন পাঠাইলেন। হেমদাকান্ত তাঁহার গুরু অভিরাম স্বামীকে লইয়া এই সুযোগে স্বর্ণময়ীকে খুঁজিবার ছলে সাদুল্লাপুর পরিত্যাগ করিল। স্বর্ণময়ীর পিনীসের মাঝি-মাল্লাদিগকে তিন দিন পর সংজ্ঞা-শূন্য অবস্থায় এক জঙ্গলের ভিতর পাওয়া গেল। নানা ঔষধ প্রয়োগে তাহাদের চৈতন্যবিধান করা হইল বটে, কিন্তু তাহারা তাজিয়া-ঘাটে উপস্থিত হইবার পরে কোনও ঘঁনাই বলিতে পারিল না। কতিপয় ভদ্রলোক ঈসা খাঁ অনুচররূপে হেমদার নিকট উপস্থিত হইয়া তাজিয়া-ঘাটে নৌকা লইতে আসে, হেমদাকান্তের আদেশেই তাহারা নৌকা লইয়া তাজিয়া ঘাটে উপস্থিত হয়। এই পর্যন্ত মাঝি-মাল্লাদিগের নিকট সন্ধান পাওয়া গেল। যে সন্ধান পাওয়া গেল, তাহা হইতে সকলে। স্থির সিদ্ধান্ত করিল যে, রাজা প্রতাপাদিত্যের লোকেরাই ঔষধ প্রয়োগে নৌকা-বাহকদিগের সংজ্ঞা হরণ করিয়া স্বর্ণময়ীকে হরণ করিয়াছে। প্রতাপাদিত্যের রাজধানী যশোর নগরে বণ্ড সুদ চর প্রেরিত হইল, কিন্তু স্বর্ণময়ীর কোন সন্ধানই পাওয়া গেল না। কেদার রায়, তাঁহার ভ্রাতা চাঁদ রায়, জগদানন্দ মিত্র এবং ঐসা খাঁ সকলেই স্বর্ণময়ীর জন্য বিষয় ব্যাকুল ও উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিলেন। সকলে মিলিয়া প্রতাপের রাজ্য আক্রমণ এবং প্রতাপের ধ্বংস সাধনের পরামর্শ করিতে লাগিলেন। প্রতাপের বরে উপর মৃত্যুর শূল বসাইতে না পারিলে স্বর্ণময়ীর যে কোন সন্ধানই পাওয়া যাইবে না ইহাই সকলের বিশ্বাস। ঈসা খাঁ তাঁহারা হৃদয়-আকাশের প্রেম-চন্দ্রমা, তাঁহারা জীবন-বসন্তের গোলাপ-মঞ্জরী, যৌবন-ঊষার কোকিল-কাকলী, মানস-সরসীর প্রীতির কমল, অনুরাগ-বীণার মোহর মূর্ছনা, চিরসাধনের স্বর্ণময়ীর জন্য একান্ত বিচলিত হইয়া উঠিলেন। তিনি কি করিবেন, তদ্বিষয়ে একান্ত উদ্বিগ্ন হইয়া পড়িলেন। এদিকে কেদার রায় কন্যা-শোকে একান্ত বিচলিত এবং অভিভূত হইয়া ঈসা খাঁর সাহায্যে প্রতাপের রাজ্য আক্রমণের সংকল্প করিলেন। ঈসা খাঁও এ বিষয়ে অনুমোদন করিলেন। প্রথমতঃ প্রতাপকে ভয় প্রদর্শনের দ্বারা স্বর্ণময়ীর উদ্ধার মানসে এক পত্র দেওয়া হইল। তাহাতে লেখা হইল যে, প্রতাপাদিত্য এই পত্র পাইয়া তেলে-বেগুণে জ্বলিয়া উঠিলেন। প্রতাপাদিত্য স্বর্ণময়ীর অপহরণের বিষয় কিছুই অবগত ছিলেন না। অকারণে তাঁহার উপর স্বর্ণময়ী-হরণের দোষারোপ, অধিকন্তু রাজ্য ও জীবন বিনাশের ভীতি-প্রদর্শনে প্রতাপ ক্রোধে ও অপমানে গর্জিয়া উঠিলেন। প্রতাপ অত্যন্ত তীব্র ও অপমানজনক ভাষায় কেদার রায়কে প্রত্যুত্তর প্রদান করিলেন। যে প্রত্যুত্তরের তীব্র-তীক্ষ্ণ বাক্য-শেল রাজা কেদার রায় এবং নবাব ঈসা খাঁকে তখন বিষম ব্যথিত ও উত্তেজিত করিয়া তুলিল। তখন উভয় পরে মধ্যে যুদ্ধ অনিবার্য হইয়া দাঁড়াইল।
প্রতাপাদিত্য সত্বরতাপূর্বক একদশ পর্তুগীজ গোলন্দাজ এবং পাঁচ হাজার পদাতিক ও তিনশত অশ্বারোহী সৈন্য লইয়া সহস্রাধিক নৌকা সাহায্যে নদীপথে কেদার রায়ের রাজ্যে অতর্কিত অভিযান করিলেন। কেদার রায়ের রাজ্যের প্রান্তপাল সৈন্যগণ প্রবল-প্রতাপ প্রতাপাদিত্যের সৈন্যদলকে প্রতিরোধ করিতে পারিল না। প্রতাপ শাহবাজপুর হইতে স্থলপথে অতি দ্রুতবেগে বজ্র-বহ্নি-বিদ্যুৎ-সংঙ্কুল ঝটিকাবর্তের ন্যায় রাজা কেদার রায়ের রাজধানী শ্রীপুরাভিমুখে অশ্ব ধাবিত করিলেন। সহসা প্রতাপের এতাদৃশ অগ্রগতি শ্রবণে কেদার রায় প্রথমতঃ বিচলিত, পরে রাজধানী শ্রীপুরের সমস্ত সৈন্য-সামন্ত বরকন্দাজ ও লাঠিয়াল লইয়া প্রবল তেজে প্রতাপাদিত্যের অগ্রগতি রুদ্ধ করিলেন এবং দূত পাঠাইয়া ঈসা খাঁর নিকট সাহায্যপ্রার্থী হইলেন। তিন দিবস অভিরাম যুদ্ধের পরে রাজা কেদার রায় পরাস্ত হইয়া শ্রীপুরের দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। প্রতাপাদিত্য, গোলন্দাজ সৈন্যের সাহায্যে গোলাবর্ষণ করিয়া দুর্গপ্রাকার ভগ্ন করিতে দুর্জয় চেষ্টা করিতে লাগিলেন। সপ্তম দিবস প্রাতে ঈসা খাঁ চারি হাজার পদাতিক, পাঁচ শত অশ্বারোহী সৈন্য লইয়া শ্রীপুরের নিকটবর্তী হইলেন। প্রতাপাদিত্যের খ্যাতনামা সেনাপতি ঢালী সাত হাজার পদাতিক এবং নয়শত অশ্বারোহী সৈন্য লইয়া উদয়গড় নামক স্থানে ব্যুহ-বিন্যাস ঈসা খাঁ সেনাদলের উপর আপতিত হইলেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত ভীষণভাবে যুদ্ধ চলিল। লাঠি, তরবারি, বন্দুক ও তীর সমানভাবে সংহার-কার্য সাধন করিল! উভয় সেনাদল মরিয়া হইয়া বুঝিতে লাগিল। ঈসা খাঁ বিপুল প্রতাপে যুদ্ধ করিয়া প্রতাপ-বাহিনীকে পর্যদুস্ত ও বিচ্ছিন্ন করতঃ গভীর ণ্ডঙ্কারে বিঙ্মণ্ডল চমকিত করিয়া শ্রীপুরের অভিমুখে ধাবিত হইলেন। কালিদাস-পরিচালিত সেনাদল যাহাতে পুনরায় একত্র হইয়া পশ্চাদ্দিক হইতে আক্রমণ করিতে না পারে, তজ্জন্য আজিম খাঁ শূর নামক জনৈক সুদ বীর-পুরুষের অধীনে আড়াইশত অশ্বারোহী সেনা রাখিয়া নিজে ঝঞ্জাগতিতে শ্রীপুরের দিকে ধাবিত হইলেন। সমস্ত দিন ভীষণভাবে যুদ্ধ করিয়া সন্ধ্যার প্রাক্কালে উদয়গড় হইতে কুচ করিয়া রাত্রি এক প্রহরের মধ্যে পাঁচ ক্রোশ দূরবর্তী শ্রীপুরে উপস্থিত হইলেন। তিনি শ্রীপুরের নিকটবর্তী হইয়া নিঃশব্দে রণকান্ত সৈন্যদিগকে আহারও বিশ্রাম-সুখ উপভোগ করিতে আদেশ দিলেন। কিঞ্চিৎ রাত্রি থাকিতেই দুইশত অশ্বারোহী এবং এক সহস্র পদাতিক লইয়া বজ্রের ন্যায় ভীষণ গতিতে শক্র-সেনার উপরে পতিত হইবার জন্য কুচ করিলেন। অবশিষ্ট সৈন্যদলকে সমর-সজ্জায় প্রস্তুত এবং আহবানমাত্রেই ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের শক্রকুলে আপতিত হইবার জন্য আদেশ করিয়া গেলেন।