১৫. ভারতবর্ষ-সম্পাদক জলধর সেন

আমাদের জলধরদা, ভারতবর্ষ-সম্পাদক জলধর সেনের কথাই বলছি, তিনি ছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর খাঁটি বাঙালী ভদ্রলোক। তাই, খাওয়াদাওয়ার নেমন্তন্ন এলে ভদ্রতা রক্ষার জন্যই তাঁকে যেতে হত, এ-কাজটাকে উনি কর্তব্য বলেই মনে করতেন। আসলে জলধরদা আর সব বিষয়েই নির্লোভ মানুষ হওয়া সত্ত্বেও তার একটিমাত্র দুর্বলতা ছিল, তিনি ছিলেন সত্যিকারের ভোজনবিলাসী। তার এই দুর্বলতার পরিচয় তাঁর সম্পাদিত পত্রিকার পাঠক ও লেখক মহলে অজানা ছিল না। যশোপ্রার্থী লেখকরা তাই ছেলের অন্নপ্রাশন, বোনের পাকা দেখা, মেয়ের জন্মদিন ইত্যাদি নানা উপলক্ষে জলধরদাকে আমন্ত্রণ জানাতেন, তাঁদের কোন সামাজিক অনুষ্ঠানই জলধরদাকে বাদ দিয়ে হত না হলে এবং লোক পরম্পরায় সে-খবর যদি জলধরদার কানে আসত, তিনি মর্মান্তিক আঘাত পেতেন, ক্ষুণ্ণও হতেন। লেখকমহলের যে-কোন পারিবারিক ক্রিয়ানুষ্ঠানে তাই জলধরদার ছিল নিত্য আনাগোনা।

সম্পাদকরূপে জলধরদার একটি মস্ত গুণ ছিল, যা সমসাময়িক বা পরবর্তী কালের পত্রিকা-সম্পাদকদের মধ্যে কদাচ দেখা যেত। যে-কোন নেমন্তন্নবাড়ি থেকে ওঁকে আমন্ত্রণ জানালে উনি কিছুতেই না বলতে পারতেন না, পাছে ফিরিয়ে দিলে ওরা মনে দুঃখ পায়।

প্রবাসী সম্পাদক রামানন্দবাবু পারতপক্ষে কোন নেমন্তন্ন-বাড়িতে যেতেন না। কত ব্যবোধে গেলেও আহারাদি করতেন না। সে-বিষয়ে উনি ছিলেন অত্যন্ত নিয়ম-নিষ্ঠ মানুষ। আর প্রমথ চৌধুরী? সামাজিক ক্রিয়াকর্মে যাওয়া তো দূরের কথা, সভাসমিতিতে সভাপতি সেজে বক্তৃতা দেওয়া পর্যন্ত ছিল ওঁর স্বভাব বিরুদ্ধ।

জলধরদা এব্যাপারে ছিলেন আশ্চর্য ব্যতিক্রম। একদিনে যদি একাধিক নেমন্তন্ন থাকে—উনি কোনোটাতেই গরহাজির থাকতেন না এবং প্রত্যেকটিতেই সমপরিমাণ আগ্রহ নিয়েই আহারাদি করতেন। নেমন্তন্ন রক্ষা করে যখন উনি বাড়ি ফিরতেন তখন দেখা যেত তার উদরের সঙ্গে গলাবন্ধ কোটের বুকপকেটটাও ফুলে ঢােল। কোনও বাড়ি থেকে ছোটগল্প, কোনও বাড়ি থেকে প্রবন্ধ, কিন্তু বেশীরভাগ রচনাই থাকত কবিযশোপ্রার্থীদের কবিতা।

এক বাড়িতে প্রচুর আহারাদির পর বিদায় নেবার সময় বাড়ির কর্তা একটি কবিতা এনে জলধরদার হাতে দিয়ে বললেন– আমার মেয়ে পটদ্য লেখে এবং ভালই লেখে। আপনি পড়ে দেখুন, আপনারও ভালই লাগবে। প্রবাসী-ট্রবাসী কাগজে পাঠালেই ছেপে দেবে। তবে আমার মেয়ের ইচ্ছে আপনার পত্রিকাতেই এটা যেন ছাপা হয়।

উল্লসিত হয়ে উঠলেন জলধরদা। যেন কী অমুল্য বস্তু হাতে পেলেন। আগ্রহের সঙ্গে লেখাঁটি হাতে নিয়েই উনি উচ্চৈঃস্বরে পড়তে শুরু করে দিলেন আর সঙ্গে সঙ্গে ডান পা দিয়ে মাটিতে তাল ঠুকতে লাগলেন, ছন্দ ঠিক আছে কিনা পরখ করবার জন্যে। পড়া শেষ হতেই প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠলেন জলধরদা।

–অপূর্ব! অপূর্ব হয়েছে কবিতাটি। ছন্দে, ভাবে, ভাষায় অনবদ্য। লিখে যাও মা, লিখে যাও। এ ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা, থামতে নেই লিখে যাও।

বলতে বলতে কবিতাটি ভাঁজ করে বুক পকেটে রাখলেন, পকেটটা আরেকটু ফুলে উঠল। জলধরদার ক্ষেত্রে এ-ব্যাপারটা একটা রেওয়াজে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, কিন্তু কোনদিন তিনি এরজন্য লেশমাত্র বিরক্তি প্রকাশ করতেন না।

এর উল্টো ঘটনাও ঘটেছে। ভারতবর্ষ পত্রিকার এক গ্রাহকের পিতৃশ্রাদ্ধানুষ্ঠানের নিয়মভঙ্গে আমন্ত্রিত হয়ে জলধরদা গেলেন। আরও বহু পরিচিত বিশিষ্ট ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত। প্রচুর পরিমাণে আহারাদির পর জলধরদা পরিচিতজনদের সঙ্গে শিষ্টালাপ করছেন এমন সময় মুণ্ডিত মস্তকে পরলোকগত পিতার একমাত্র পুত্র এসে বিনীতভাবে জলধরদাকে বললেন–খাওয়া-দাওয়ায় আপনার কোন অসুবিধা হয় নি তো? আমি একা মানুষ, ঠিক মত আপনাদের দেখাশুনো করতে পারি নি। কোন ক্রটি ঘটলে, মার্জনা করবেন।

ছেলেটিকে বুকের কাছে টেনে এনে জলধরদা স্নেহমাখা কণ্ঠে বললেন–পিতৃদেবের পারলৌকিক কাজে অনুষ্ঠানের কোন ত্রুটিই তুমি রাখ নি। কিন্তু আমি এতক্ষণ বসে বসে ভাবছিলুম বাড়ি ফেরার সময় হয়ে গেল, অথচ কিছুই তত দিলে না আমাকে।

ছেলেটি অপ্রস্তুত। তাই তো। জলধরবাবু নিশ্চয় ভুল করেছেন। ব্রাহ্মণভোজন আর ব্রাহ্মণ-বিদায়ের কোন ব্যবস্থাই তো সে করে নি। একটু ইতস্তত করে ছেলেটি বললে—আমার বাবা আপনার সম্পাদিত পত্রিকার একজন নিয়মিত পাঠক ছিলেন। প্রথম সংখ্যা থেকেই ভারতবর্ষর তিনি গ্রাহক এবং তা তিনি সযত্নে বাঁধিয়ে রেখেছেন। সেই কারণেই আমার বাবার পারলৌকিক কাজে আপনার উপস্থিতিই আমাদের একান্ত কাম্য ছিল। আপনি এসেছেন, আমরা ধন্য।

জলধরদা ছেলেটিকে আর বিব্রত অবস্থায় ফেলে না রেখে সহাস্যে বললেন–আমি তা জানি। তবে কি জানো, এ-ধরনের অনুষ্ঠানে যখনই আমার ডাক পড়ে তখনই বাড়ি ফেরার সময় কিছু-না-কিছু আমাকে নিয়ে ফিরতেই হয়—এই যেমন গল্প প্রবন্ধ বা কবিতা। একমাত্র এখানেই তার ব্যতিক্রম দেখে আশ্চর্য হয়ে তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম।

কথাটা জলধরদা সেদিন সরল চিত্তেই বলেছিলেন, আশপাশের লোকেরা কিন্তু কথাটা একটা মস্ত রসিকতা মনে করে হেসে উঠেছিল। আমি জানি এবং আজ মর্মে মর্মে অনুভব করতে পারছি যে, জলধরদার সেদিনের এই কথায় কি শানিত বিদ্রুপ প্রচ্ছন্ন ছিল।

এ-কাহিনী শুনে আপনাদের মনে একটা প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, পকেটভতি যে-সব লেখা তিনি নিয়ে আসতেন তার সবই কি পত্রিকার ছাপা হত?

না। তা হত না। এ-বিষয়ে জলধরদার কতকগুলো পদ্ধতি ছিল অভিনব। উদাহরণস্বরূপ ধরুন সেই মেয়ের লেখা কবিতা, যা তার বাবা জলধরদার হাতে তুলে দিয়েছিল। বেশ কয়েকমাস অপেক্ষা করার পর মেয়ের বাবা একদিন সকালে জলধৱদার বাড়ি গিয়ে হাজির।

কন্যার কবিতাটির কথা জিজ্ঞাসা করতেই জলধরদা সলজ্জ হয়ে বললেন—

আর বলেন কেন। সেদিন আপনার বাড়ি থেকে ফিরে এসে কোটটা আলনায় রেখেছিলাম। পরদিন খোঁজ করতে গিয়ে দেখি সেটা পোপাবাড়ি চলে গেছে।

এই সময়ে একটু থেমে, দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে জলধরদা বললেন–যতদিন গৃহিণী ছিলেন ততদিন পান থেকে চুনটি খসবার জো ছিল না। আর এখন? বাড়ি তো নয়, সরাইখান।

এ-কথার পর আর কোন মেয়ের বাপ চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে মেয়ের কবিতার জন্য দরবার করে।

জলধরদার দ্বিতীয় পদ্ধতির কথা এ-বৈঠকে বহুকাল আগেই বলেছি, ভারতবর্ষ অফিসে লেখার খোঁজে গিয়ে প্রশ্নকারীই বিব্রত হয়ে চলে আসতেন

এই জন্যে যে, জলধরদা কানে খুবই কম শুনতে পেতেন।

নেমন্তন্নবাড়ি থেকে নিয়ে-আসা রচনার পরিণতি সম্পর্কে দীর্ঘকাল অপেক্ষার পর যদি কেউ চিঠি লিখে জানতে চাইতেন, তার উত্তরে তিনি লিখতেন-প্রেসে দিয়াছি, যথাসময়ে উহা পত্রস্থ হইবে।

যথারীতি সে-লেখা পত্রস্থ হত না। জলধরদার ভাষায় যথাসময়ের ব্যাপ্তি যে অনন্তকাল এবং প্রেস যে অবাঞ্ছিত কাগজের ঝুড়ি তা দীর্ঘকাল অপেক্ষার পর পত্ৰলেখক উপলব্ধি করতে পারতেন।

 

বাংলার অন্যতম সাহিত্য-পত্রিকা প্রবাসীর সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি। তিনি ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। যে-লেখায় সাহিত্যিক কোন মূল্য নেই তা তার হাত দিয়ে প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশ করা ছিল দুঃসাধ্য ব্যাপার। যতই খাতির থাকুক, যে-লেখা তার পছন্দ হয় নি তা তিনি সোজাসুজি জানিয়ে দিতেন, কোন লেখককে মিথ্যা স্তোক দিয়ে ঝুলিয়ে রাখতেন না। এ বিষয়ে তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্পষ্টবাদী। তার জীবনের একটি ঘটনা আপনাদের বলি।

একবার এক সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষে তাঁকে কাশী যেতে হয়েছিল। তিনি ছিলেন সম্মেলনের প্রধান অতিথি। তিনি স্থির করলেন প্রাতঃকালে গঙ্গাস্নান করবেন। পূণ্যলোভাতুর ছিলেন কি না জানি না। কিন্তু মণিকর্ণিকার ঘাটে দাঁড়িয়ে কাশীর গঙ্গা দেখলে যেকোন ব্যক্তির মনেই অবগাহনের বাসনা জন্মায়।

একদিন ভোরবেলায় কাউকে না জানিয়ে স্নানার্থী হয়ে মণিকর্ণিকার। ঘাটে এসে উপস্থিত। দশাশ্বমেধ ঘাটের তুলনায় মণিকর্ণিকার ঘাট অপেক্ষাকৃত জনবিরল। লোকচক্ষুর অগোচরে স্নান করতে আসার কারণও ছিল। রামানন্দবাবু সম্পর্কে একটা ধারণা প্রচলিত ছিল যে, উনি কট্টর ব্রাহ্ম। হিন্দুসমাজের প্রধান তীর্থক্ষেত্রে ওঁর এই গঙ্গাস্নান নিয়ে পাছে কোন রকম কদর্থ হয় এই কারণে একাই চুপচাপ স্নান করতে এসেছেন। জলে নেমে কিছুদুর মাত্র গিয়েছেন, হঠাৎ দেখলেন পায়ের তলায় মাটি নেই। আশ্বিনের ভরা গঙ্গার কুটিল আবর্ত তাকে টেনে নিয়ে চলেছে নিচের দিকে। আর উপায় নেই, এবার মৃত্যু অবধারিত। হঠাৎ অনুভব করলেন দুই অদৃশ্য বলিষ্ঠ বাহু তাকে জড়িয়ে ধরেছে। মুহূর্তের মধ্যে জলের উপর ভেসে উঠে বুক ভরে দম নিলেন। বুঝতে পারলেন, এ মৃত্যুর করাল গ্রাস নয়। একটি যুবক তার অসহায় দেহটাকে নিয়ে প্রাণপণ চেষ্টায় সাঁতরে চলেছে ঘাটের দিকে। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি ফিরে আসতে পারলেন। ঘাটে এসে বিদায় নেবার সময় কৃতজ্ঞচিত্তে যুবকটিকে রামানন্দবাবু বললেন–আজ নিশ্চিত মৃত্যু থেকে তুমি আমার জীবন রক্ষা করেছ, বল আমি তোমার জন্য কী করতে পারি।

ছেলেটি বললে–এ আর কি এমন কাজ করেছি যার জন্যে আপনি এত সঙ্কোচ বোধ করছেন। আপনারা কাশীর গঙ্গায় ডুব দিয়ে পূণ্য করেন, আমরা পূণ্য করি ডুবে যাওয়া মানুষদের ডাঙায় তুলে।

রামানন্দবাবু বললেন—তা কি হয়? তুমি আমার প্রাণ রক্ষা করেছ, প্রতিদানে আমারও তো একটা কর্তব্য আছে। বল, তোমার জন্য কী আমি করতে পারি।

যুবকটি এবার যেন একটু কষ্ট হয়েই বললে-ভারি তো একটা তুচ্ছ জীবনকে ডুবজল থেকে ডাঙ্গায় টেনে তুলেছি। তার জন্য পুরস্কার নিতে হবে? আমাকে কি আপনি পুরীর স্বর্গদ্বারের নুলিয়া ঠাওরেছেন?

রামানন্দবাবু এবার একটু থমকে গেলেন। তবু বললেন–আমার জীবনটা তুচ্ছ হতে পারে। কিন্তু আজকের এই ঘটনাটা আমার কাছে তুচ্ছ নয়। অন্তত তোমার পরিচয়টা জানতে পারি কি?

যুবকটি এবার গর্বের সঙ্গে বুক ফুলিয়ে বললে—আমরা হচ্ছি কাশীর ঝাণ্টু ছেলে। জল থেকে টেনে তোলার কাজ আমাদের হরবখত করতে হয়। বলব কি মশাই, কলকাতার লোকগুলো কাশীয় গঙ্গাকে ভাবে কালীঘাটের বুড়িগঙ্গা।

প্রায়ই ডোবে আর আমাদের চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলতে হয়। বাড়ফাটাইয়ের আর জায়গা পায় না।

রামানন্দবাবু বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন-ওই যে কথাটা বললে তার অর্থ তো বুঝলাম না।

বাড়ফাট্টাই? নোয়াব মশাই, নোয়াব। কলকাতার রকবাজদের ভাষায়।

আরও অবাক হয়ে রামানন্দবাবু জিজ্ঞাসা করলেন-বোয়াব কথাটারই বা অর্থ কি।

যুবকটি এবার একটু তাচ্ছিল্যের সুরে বললেও, আপনি দেখছি কিস জানেন না। কোলকাতার নন বুঝি?

রামানন্দবাবু বললেন—এখন আমি কলকাতারই লোক। যে-বয়সে ওসব ভাষা জানবার বুঝবার ও শিখবার কথা সে বয়েসটা আমার কেটেছে এলাহাবাদে।

তাই বলুন। তবে আর এসব কথা জানবেন কোত্থেকে। বাঙালরা যাকে বলে ফুটানি, ঘটিরা যাকে বলে বোয়াব কাশীতে তাকেই বলে বাড়ফাটাই।

আর কালক্ষেপ না করে কোটের পকেট থেকে নোটবুক তুলে এনে এক পাতায় শব্দ দুটি টুকে নিলেন। উদ্দেশ্য বোধ হয় আভিধানিক রাজশেখর বসু অথবা ভাষাতান্ত্রিক সুনীতি চাটুজ্যের কাছ থেকে শব্দ দুটির উৎপত্তিগত অর্থ জেনে নেওয়া। অপর পাতায় নিজের নাম ও প্রবাসী কার্যালয়ের ঠিকানা লিখে পাতাটা ছিড়ে ছেলেটির হাতে দিয়ে বললেন—আমার নাম ঠিকানা দেওয়া রইল। ভবিষ্যতে যদি কোন দিন আমি তোমার কোন প্রয়োজনে সাহায্য করতে পারি নিজেকে কৃতার্থ মনে করব।

 

এই ঘটনার পর মাস ছয় পার হয়ে গেছে। একদিন দুপুরে প্রবাসী অফিসের দোতলার ঘরে বসে রামানন্দবাবু গভীর মনোনিবেশ সহকারে কড়া সম্পাদকীয় মন্তব্য লিখছেন। বিষয় হচ্ছে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা। টেবিলের উপর সেন্সস রিপোর্ট, ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়র ইত্যাদি ইতস্তত ছড়ানো। এমন সময় একটি যুবকণ্ঠের আওয়াজ কানে এল—আসতে পারি স্যার?

লেখার প্যাড থেকে চোখ তুলে দেখলেন একটি বলিষ্ঠদেহ যুবক দরজার চৌকাঠটার ওপারে দাঁড়িয়ে।

যুবকটি বিনয়জড়িত হাসি হেসে বললে-চিনতে পারলেন স্যার? সেই কাশীর মণিকর্ণিকার ঘাট?

বিলক্ষণ, চিনতে পারব না? গঙ্গায় ডুবে যাচ্ছিলাম, তুমিই তো আমাকে উদ্ধার করেছিলে। ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? এস এস, ভিতরে এস। উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন রামানন্দবাবু।

সন্তর্পণে ঘরে ঢুকে টেবিলের পাসে ছেলেটি সসম্ভ্রমে দাঁড়িয়ে রইল, চেয়ারে বসতে বলা সত্ত্বেও বসল না।

রামানন্দবাবু বললেন—আমি খুব খুশী হয়েছি তুমি এসেছ। এবার বল আমি তোমার জন্য কী করতে পারি।

যুবকটি যেমন সন্তর্পণে ঘরে ঢুকেছিল ততোধিক সন্তর্পণে বুক পকেট থেকে একটি ভাজ করা কাগজ বার করে রামানন্দবাবুর হাতে দিল।

রামানন্দবাবু ভাবলেন নিশ্চয় চাকরির দরখাস্ত, একটা রেকমেণ্ডেশন বা কার্যাক্টার সার্টিফিকেট চায়। এ আর এমন কি কাজ, প্রয়োজন হলে সঙ্গে করে নিয়েও যেতে পারি। একথা ভাবতে-ভাবতে কাগজের ভাজ খুলেই চম্‌কে উঠলেন। বলা ভালো আঁতকে উঠলেন, যেমন ওঠে পায়ের কাছে আচমকা সাপ দেখলে। সেই হর্ষোৎফুল্ল মুখ নিমেষের মধ্যে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অপটু হস্তাক্ষরে লিখিত একটি কবিতা, নাম—এক নৌকোয় তুমি আর আমি।

গম্ভীরমুখে আদ্যোপান্ত কবিতাটি পড়লেন। পড়ার পর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন ছেলেটির দিকে। অবশেষে করুণকণ্ঠে বললেন—এ-কবিতা তো ছাপতে পারব না। তার চেয়ে যে-গঙ্গা থেকে আমাকে তুমি উদ্ধার করেছিলে সেই গঙ্গায় আবার আমাকে ফেলে দিয়ে এস।

 

ভারতবর্ষ-সম্পাদক জলধর সেন ও প্রবাসী-সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের নামে প্রচলিত দুটি গল্প আপনাদের শোনালাম। এ-ঘটনা সত্যি কি না আমার জানা নেই। শোনা-গল্পই আপনাদের কাছে বললাম। সত্যি যদি না-ও হয় ক্ষতি নেই। বাংলার সাময়িক পত্রিকার দুই দিকপাল সম্পাদকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরাই এ কাহিনীর উদ্দেশ্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *