০৮. আমাদের শনিবাসরীয় বৈঠকে

আমাদের শনিবাসরীয় বৈঠকের মাঝে মাঝে যে ছেদ ঘটত না তা নয়, তবে সেটা ছিল আকস্মিক ব্যাপার। এমনও হয়েছে যে কোন সভা-সমিতি বা সিনেমা-থিয়েটারের আমন্ত্রণে শনিবার দপ্তরে আমি অনুপস্থিত, কিন্তু তাতে কী এসে যায়। সহকর্মীরা সাহিত্যিক বন্ধুদের জুটিয়ে জটলা জমিয়েছেন, আমার অনুপস্থিতিতে চা-সিগরেট-পান-বিড়ি সহযোগে বৈঠকীদের আপ্যায়ন করেছেন পাছে এ-কথা ওঠে যে আমার অবর্তমানে লেখকদের আদরআপ্যায়নে কোন ত্রুটি ঘটেছে। আমার সহকর্মীরা আমাদের আসরের গল্পগুজবের ছিলেন নীরব শ্রোতা। কিন্তু আড্ডা জমিয়ে তোলার যোগানদারিতে তাঁর এক-একজন কেউ-কেটা।

বলছিলাম তা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে বৈঠকে ছেদ ঘটত। এই যেমন ঘটছে, গত সংখ্যার জলসায় সম্পাদকের বৈঠকের। কারণটা আকস্মিক। আমার বৈঠকের দুই বন্ধুকেই কথা দিয়েছিলাম যে নিশিকান্তর খাওয়ার গল্প আর নিশিকান্তর শান্তিনিকেতন ছেড়ে পণ্ডিচেরী চলে যাওয়ার কাহিনী দুইই বলব। একজনের কথা রেখেছি খাইয়ে নিশিকান্তর গল্প বলে, অপরজনের কথা রাখতে গিয়েই বিভ্রাট। ভোজনরসিক নিশিকান্তর কথা যে-সংখ্যায় লিখেছিলাম সেই সংখ্যাটি কোন সময়ে জলসা-সম্পাদক নিশিকান্তকে পণ্ডিচেরীর ঠিকানায় পাঠিয়ে বসে আছেন। পরবর্তী সংখ্যার জন্য নিশিকান্তর শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে যাওয়ার বিরাট-ট্রাজেডি ফলাও করে লিখছি এমন সময় পণ্ডিচেরী থেকে নিশিকান্তর পত্রাঘাত। অগত্যা নিশিকান্ত-প্রসঙ্গর সেইখানেই ইতি, সম্পাদকের মাসিক বৈঠকও জলসায় বসল না। কারণ কী? নিশিকান্তর সেই চিঠির কিয়দংশ উদ্ধৃতি থেকে আপনারা বুঝতে পারবেন :

শ্রীঅরবিন্দ আশ্রম
পণ্ডিচেরী
৪/৮/৫৯

ভাই সাগর,

জলসা পত্রিকা পেয়েছি।…আমি মাঝে মাঝে ভাবতাম, সাধক-কবি নিশিকান্ত সম্বন্ধে অনেকে লেখে। খাদক লোভী নিশিকান্তকে নিয়ে কেউ লেখে না কেন? এই কথা ভেবে আমার আফসোসের অন্ত ছিল না, এতদিনে সে-ভাবনা ঘুচল। লিখে যাও, ভাই সাগর লিখে যাও। এখনও তোজনরসিক নিশিকান্তকে নিয়ে অনেক, অনেক লিখবার আছে। দেদার লেখ, প্রচুর লেখ, এন্তার লেখ। শুধু সেই ট্রাজেডিটা চেপে রেখে দাও। আমার স্বরূপ এতদিনে পাচ্ছি। এখানে আমার বান্ধবরা বলছে, তোমার লেখায় আমার ভাব-ভঙ্গি কথা বলার ধরন খুব স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।…

কালি কলম কল্লোলে আমার কোন কবিতা প্রকাশ হয় নি। কবিকর্তার কঠোর আদেশ ছিল, আমি যেন আমার কবিতা কোন পত্রিকায় না দিই। বিচিত্রায় আর পরিচয়ে তিনিই আমার কবিতা প্রকাশ করেছিলেন এবং তার দরুন কিছু অর্থপ্রাপ্তিও ঘটেছিল।

ইতি–
তোমাদের নিশিকান্ত

 

ট্রাজেডিটা চেপে রেখে দাও এই অনুরোধের মধ্যে নিশিকান্তর মনের আরেকটা দিক আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। যে-নিশিকান্ত চিরদিনের মত শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে যাবার সময় তিন-তিনখানা কবিতার খাতা আমার সামনেই টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলেছিল, যে-নিশিকান্ত তার শিল্পী-জীবনের আঁকা এক বাণ্ডিল ছবি ডাকটিকিটের উপর সই করে লিখে দিয়েছিল আমার এই অস্থাবর সম্পত্তি শ্ৰীসাগরময় ঘোষকে দান করিয়া গেলাম, সেই নিশিকান্ত আজ লিখছে ট্রাজেডিটা চেপে রেখে দাও। তাই রাখলাম। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি কেন সে এই পরম দুঃখের ঘটনাকে আজও চেপে রাখতে চায়। যে-বেদনার জন্য তাকে তার জীবনের শিল্পকীতিকে ছিয় বস্ত্রের মত পরিত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে চলে যেতে দিয়েছিল, সে-বদনা হয়তো সে বিধাতার দান বলেই মেনে নিয়েছে এবং সেই কারণেই বোধ হয় সে প্রেমে প্রাণে গানে রূপে রসে ভরা সংসারের বন্ধন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে সাধক-জীবনের মধ্যে সেই পরম বেদনার পরমা শান্তি খুঁজে পেয়েছে। আজ প্রায় পঁচিশ বৎসর হল নিশিকান্তর সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ নেই। দুর থেকে সাধক নিশিকান্তর পরিচয় পাই তার গানে কবিতায়, কিন্তু সে-পরিচয় আর কতটুকু? আমি শিল্পী-সাহিত্যিক নিশিকান্তকেই চিনতাম আর চিনতাম মানুষ নিশিকান্তকে। সাধক নিশিকান্ত আমার কাছে তাই আজও রহস্য হয়েই আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *