প্রায় পরিত্যক্ত নগরীর নির্জন পথে পথে কয়দিন সে ভ্রমণ করলো। চোর দস্যু এবং পথকুক্কুর ব্যতীত আর জনপ্রাণী গোচরে আসে না। যারা নগরীতে তখনও আছে, তারা গৃহের বাহির হয় না।
তথাপি সংবাদ পাওয়া যায়। এখন আর অবিদিত নয় কিছু। মহারাজ লক্ষ্মণ সেন নওদীয়ার প্রাসাদ থেকে পলায়ন করেছেন। নওদীয়ার প্রাসাদ ধ্বংস হতে বিলম্ব হয়নি। লক্ষ্মণাবতীও হয়েছে যথেচ্ছ লুণ্ঠিত। সেনাপতিরা পলায়ন করেছেন। সৈন্যরা কেউ পলায়িত, কেউ নিহত আর অবশিষ্টরা এখন যবন সেনাদলের সহযোগী। তারা সদলে এখন নগরের পর নগর লুণ্ঠন করে চলেছে। যে কোনোদিন পুন্ড্রনগরীতেও তারা এসে যেতে পারে।
একাকী ভ্রমণ করতে করতে সে নগরপ্রান্তে সদ্ধর্মীদের প্রাচীন বিহারের দিকে গেলো একদা। তার জনরব শোনা ছিলো যে সদ্ধর্মী ভিক্ষুদের নাকি যবনদের সঙ্গে মিত্রতা হয়েছে এবং ভিক্ষুদের কোনো ভয় নেই। কিন্তু দেখলো, বিহারটি প্রায় পরিত্যক্ত। কয়েকজন তরুণ তখনও অপেক্ষা করছে।
একজন তাকে দেখে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করে, কি মহাশয়, আপনি নগর ত্যাগ করেননি?
না, সকলেই নগরী ত্যাগ করলে অতিথিদের অভ্যর্থনা কে করবে?
উত্তম, ভিক্ষুটি হাসলো। বললো, উত্তম বলেছেন, জিজ্ঞাসিত হলে আমরাও ঐ উত্তরই। দিই।
ভিক্ষুরা ঐ একই সংবাদ জানে। এবং তাদেরও ধারণা, ভিক্ষুদের যবনেরা কিছু বলবে। একজন বললো, কেন বলবে, বলুন? আমরা তো তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনোভাবেই নই। এক হতে পারতো ধন-সম্পদের কারণ, ধন-সম্পদের লোভে আমাদের আক্রমণ করতো–কিন্তু সে গুড়ে তো এখানে বালি–অধিক হলে আমরা ভিক্ষাপাত্রটি দিয়ে দিতে পারি।
যেন কৌতুকের বিষয়। শ্যামাঙ্গ বললো, এ কি কৌতুকের সময়?
বাহ্, কৌতুক ব্যতিরেকে কী করবো বলুন? রোদন করবো? রোদনের কোনো কারণ আছে কি? রক্তপাত, লাঞ্ছনা, অপমান ইত্যাদি আমরা পূর্বেও দেখেছি, এখনও দেখছি। অন্ধের কি বা রাত্রি, কি বা দিন। তখন ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়রা নির্যাতন করতো, এখন যবনেরা করবে–একই ব্যাপার।
শ্যামাঙ্গ সমস্ত দিন বিহারে অবস্থান করে।
অবস্থানের কারণ ছিলো। বিহারের প্রাচীন গাত্রের মৃৎপটগুলি দেখছিলো সে। প্রস্তর মূর্তিগুলিও কম আকর্ষণীয় নয়। দেখতে দেখতে তার দিন অতিবাহিত হয়ে যায়। কিন্তু মন রয়ে যায় অতৃপ্ত। সে রাত্রিযাপন করলো বিহারে, পরদিন পুনরায় সে শিল্পকর্মগুলি দেখতে গেলো। কি অদ্ভুত কাজ–কঠিন প্রস্তর, কিন্তু লাবণ্যের যেন শেষ নেই। স্থবির প্রস্তর থেকে সম্পূর্ণ মানুষটি আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি–কিন্তু যতোটুকু এসেছে, ততোটুকুই কতো জীবন্ত। গুরু বসুদেব এই জন্যই বলেছিলেন গৌড়ীয় রীতিটির কথা। তার মনে পড়ে–গৌড়ীয় রীতি কোনো রীতি নয়–এ হলো রীতি ভঙ্গের রীতি–জগতের সত্য রূপটি, শাশ্বত রূপটি যে রীতিতে ধারণ করা যায়, সেইটিই গৌড়ীয় রীতি। সে একটি প্রস্তর মূর্তি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলো। তার অনুমান ওটি গৌতম পত্নী গোপার মূর্তি, মস্তকটির ভার বাম হস্তে বিন্যস্ত, ভঙ্গিটি অর্ধশায়িত, পদযুগলে দাসী পরিচর্যারতা, সম্মুখে শিশু রাহুল শায়িত। দেহের বঙ্কিম ভঙ্গিটিতে কি মাধুরী, কি লালিত্য–গ্রীবা দেখো, স্কন্ধ দেখো, বস্ত্রাচ্ছাদিত স্তনযুগল দেখো, কটিদেশ দেখো। সে যতোবার দেখে, ততোবার তার আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। এবং হঠাৎ তার মনে হয়, এই নারী যেন তার পরিচিত–হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তার পরিচিত। এবং পরিচয় আবিষ্কার করে সে স্তম্ভিত হয়ে যায়। এ কেমন করে সম্ভব। এ যে অবিকল লীলাবতী, নারীর পরিপূর্ণ যৌবনময় দেহে একইসঙ্গে শক্তির দৃঢ়তা এবং মাতৃত্বের কোমল সুষমা। অহঙ্কার এবং বিনয়, ছলনা এবং স্নেহ–এমন যে একত্রে মূর্ত হতে পারে সে কল্পনাও করতে পারে না।
সন্ধান নিতে গেলে জানলো, মূর্তিটির নির্মাতা কে, কেউ জানে না। তবে কিংবদন্তী এইরূপ যে, এক তরুণ ভিক্ষু মূর্তিটি নির্মাণ করেছিলেন। এবং নির্মাণ করেই তিনি বিহার ত্যাগ করে চলে যান, প্রত্যাগমন করেননি।
শ্যামাঙ্গের মনে হয়, তার পুত্তলিগুলির সঙ্গে এ মূর্তিটির কোথায় যেন গভীর সাদৃশ্য আছে। তবে কি শিল্পী, শিল্পের উপাদান এবং শিল্পের বিষয় মূলত চিরন্তন? বস্তু ভেদে, ব্যক্তি ভেদে, কাল ভেদে–মূলগতভাবে তার কোনোই ব্যত্যয় হয় না?
সে স্থির করে, এই বিহারেই সে অবস্থান করবে–এখানেই সে মৃৎমূর্তি নির্মাণ করবে একটি। ঐ প্রস্তর মূর্তিটিরই পার্শ্বে সে স্থাপন করবে তার মৃন্ময় মূর্তিটি। মূর্তিটিতে বিধৃত থাকবে একটি নারীর গমন ভঙ্গি–-নারী তার নিজ শক্তিতে ক্রমেই অনন্তের দিক অগ্রসর হয়ে চলেছে–এই ভাবটি সে প্রকাশ করবে তার শিল্প নির্মাণের মধ্য দিয়ে।
তৃতীয় দিন প্রত্যুষে নগরীর দিক থেকে কোলাহল শোনা গেলো। একটি তরুণ ভিক্ষু সংবাদ নিয়ে এলো যে, যবন সেনারা নগরীতে প্রবেশ করেছে–আজ অপরাহ্নে সেখানে তাদের বিজয়োৎসব। নগরবাসী প্রত্যেককে সে উৎসবে যোগ দিতে হবে, না হলে বিপদ অবশ্যম্ভাবী।
কি ভ্রাতঃ, বিজয়োৎসব দেখতে যাবেন না কি? একটি ভিক্ষু জানতে চাইলো।
হ্যাঁ, যাবো, শ্যামাঙ্গ জানায়। তারপর বলে, আপনারা?
আমরা, আমরা তো উপদ্রব বিশেষ, ভিক্ষুটি হাসে। বলে, দেখি সংবাদ নিয়ে, প্রকৃত অবস্থাটি কী দাঁড়িয়েছে।
যবন দলটি রাজধানী থেকে আসেনি। এরা প্রথমে ছিলো তঙ্গন নদীর পশ্চিম তীরে, তারপর এরা পূর্বাভিমুখে অগ্রসর হয়। সেনাপতি কাফুর খান এই ক্ষুদ্র দলটির সেনাপতি। দুইশত সৈন্য ছিলো প্রথমে–এখন হয়েছে দুই সহস্র–এদের অধিকাংশই দেশীয় সৈন্য। অবাধ লুণ্ঠনের লোভে এরা কাফুর খানের বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
প্রথমে এরা কয়েকটি গ্রাম লুণ্ঠন করে। প্রথম সামন্তপতিদের সৈন্যদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় দুএকটি–তারপর প্রায় সকল সামন্তপতির সঙ্গেই কাফুর খানের মিত্রতা হয়েছে মিত্র সামন্তদের সেনাদল এবং যবন সেনাদল এখন প্রায় একাকার। পথিমধ্যে একত্রেই এখন তারা গ্রাম লুণ্ঠন করছে।
উজুবটে এলে মহাসামন্ত হরিসেন এদের বিপুল সমাদর করেন। তথাপি দলটি উদয়পুরে প্রথমে, তারপর মদনপুরে, এই দুটি গ্রামে অবাধে লুণ্ঠন ও নরহত্যা চালায়। তখন থেকে অভিমন্যুদাস কিছু সংখ্যক সৈন্যের কৃপাদৃষ্টিতে পড়ে। সে এখন প্রায় সর্বক্ষণই তাদের সঙ্গী। উদয়পুরে দীনদাসকে সে এবারও পায়নি। তবে হ্যাঁ, সোমজিতের গৃহে সে নিজ হস্তে অগ্নিসংযোগ করেছে। প্রফুল্লদাসকে অবশ্য সে নিজে হত্যা করেনি তবে করতো–সেরূপ একটি সংকল্প ছিলো তার। অবশ্য তার কন্যাটির উপযুক্ত শাস্তিই হয়েছে–ঐ শূকরপুত্রী এক পাত্র উত্তপ্ত জল তার উপর নিক্ষেপ করে। ঐ জল চক্ষে এসে লাগলে আর রক্ষা ছিলো না–তার সৌভাগ্য, চক্ষু দুটি রক্ষা পেয়েছে।
পুন্ড্রনগরীতে উপনীত হয়ে সে উল্লাস বোধ করলো। একেকটি গৃহের দ্বার ভঙ্গ করে ভিতরে প্রবেশ করো এবং যথেচ্ছ দ্রব্যাদি নাও, কেউ তোমাকে বাধা দিচ্ছে না।
ইতোমধ্যে সে একটি অশ্বও সংগ্রহ করেছে এবং কয়দিনের চেষ্টায় সে এখন অশ্ব চালনাও করতে পারে। ফলে তার গতি এখন দ্রুত। যথেচ্ছ সে গমনাগমন করে।
সে লোকমুখে শুনেছিলো যে পুন্ড্রনগরীতে সদ্ধর্মী পাষণ্ডদের একটি বিহার আছে। নগরীতে প্রবেশ করেই সে বিহারটির সন্ধান করে। কিন্তু অদ্ভুত কাণ্ড, নগরীর লোকেরা এমন ভাব করে, যেন তারা বিহার নামক স্থানের নাম জন্মেও শোনেনি। একজন তো একেবারে মূক হয়ে রইলো। যতোই তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ততোই সে নিজ মুখে অঙ্গুলি স্পর্শ করে যুগপৎ হস্ত এবং মস্তক আন্দোলন করে। বোঝাতে চায় যে সে মূক ও বধির। অভিমন্যুদাস কৌতুক বোধ করে। সে স্থির করে, যে লোকই অসহযোগিতা করবে তারই পশ্চাদ্দেশে বংশদণ্ড প্রবেশ করানো হবে। ঐ সিদ্ধান্ত কার্যকর করার আয়োজনে বিলম্ব হলো না। মূক লোকটির পশ্চাদ্দেশের নিকট বংশদণ্ডটি নিয়ে যেতেই সে ওরে বাবারে বলে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলো এবং সমস্ত সংবাদই যন্ত্রবৎ বলতে আরম্ভ করে দিলো।
তার কাণ্ড দেখে যবন সেনারা দারুণ কৌতুক উপভোগ করে। তারা বুদ্ধিতে একেবারে বলীবর্দের মতে, এবং তাদের শাস্তিদানও সেই প্রকার। লোকটি দুর্বিনয় প্রকাশ করছে, দাও তার শিরটি ছেদন করে। কেন বাপু, অন্য কৌশল প্রয়োগ করলে তো তোমার কাজও উদ্ধার হয়, আবার লোকটির প্রাণও বাঁচে। অভিমন্যুদাসের নতুন নতুন শাস্তি উদ্ভাবনের ক্ষমতা তাকে সেনাবাহিনীর মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলেছে। সে দ্বিপ্রহরে দুই তিনজন সঙ্গী অশ্বারোহী নিয়ে বিহারের উদ্দেশে যাত্রা করলো।
না, অভিমন্যুদাসের কার্য সমাধা করতে বিলম্ব হয়নি–উৎসব আরম্ভ হওয়ার পূর্বেই সে নগরে ফিরে এসেছিলো।
তরুণ ভিক্ষু দুটিকে তারা পায় দ্বারদেশেই। যবন সৈন্যদের দিকে তারা সহাস্যে অগ্রসর হয়েছিলো কয়েক পদ। তারপর আর পারেনি। কবন্ধ দেহ দুটি ঐ স্থানেই পপাত হয়। তবে ছিন্ন হয়ে ভূমিতে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পরও মুণ্ডু দুটির মুখে হাসি ছিলো। আর তৃতীয় লোকটিকে যবনেরা পশ্চাদ্দিক থেকে শূলে বিদ্ধ করে। কিঞ্চিৎ ক্ষোভ রয়েছে অভিমন্যুর। লোকটিকে সে চিনেছে–এ হলো সেই কুম্ভকার, যে লীলাবতীর হাত ধরে পলায়ন করেছিলো। আহা, লোকটিকে সে ঐভাবে হত্যা করতো না। লোকটির মুখে লীলা নামটি উচ্চারিত হয়েছে কয়েকবার। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। শূকরপুত্রটা ছিলো নিতান্ত ক্ষীণজীবী। অন্য কিছু বলবার আগেই তার প্রাণ পক্ষীটি দেহপিঞ্জর ত্যাগ করে শূন্যে উড়াল দেয়। কপাল মন্দ তার–এখন কোথায় সে লীলাবতীর সন্ধান করবে? আর্ত চিৎকারে দীর্ণ দিগন্তরেখায় ধূম্রকুণ্ডলী এবং অগ্নিশিখার দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে অভিমন্যুদাসের চিন্তা হয়। লীলাবতীকে নিজ অধিকারে তাকে পেতেই হবে, মৃত অথবা জীবিত, যেভাবেই হোক।