অধ্যায় ১৫
জিএস অ্যান্ড ডব্লিউএম ট্র্যাক ধরে হার্লোর দিকে আরো মোটামুটি কোয়ার্টার মাইল এগোলে বন। বনের মাঝে কিছুদূর এগিয়ে গেলে জলাভূমি। কাঠ গাছে ঘেরা জায়গাটা একটু ঢালু হয়ে নেমে গিয়ে কাদাটে মাটির সাথে মিশেছে। চারপাশে শুধু পোকা আর পোকা। মনে হয়, পুরো এলাকার সবটা বাতাস বুঝি এরাই দখল করে নিয়েছে। উপরি হিসেবে আছে মশার দল, একেকটার আকার আবার যুদ্ধ বিমানের মতো! মন্দের ভালো বলতে, জায়গাটা দারুণ শীতল, যাকে বলে স্বর্গীয় আবহাওয়া।
গাছের ছায়ায় বসে সবাই একসাথে কোকের বোতল হাতে তুলে নিয়েছি, ধীরেসুস্থে চুমুক দিচ্ছি। মশা এবং পোকামাকড়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য ভার্ন আর আমি কাঁধের উপরে শার্ট মেলে দিয়েছিলাম। ক্রিস আর টেডি খালি গায়েই বসেছে, শার্ট কোমরের কাছে বাঁধা। দেখে মনে হচ্ছে, দুই এস্কিমো আইসহাউজে বসে জীবন উপভোগ করছে। পাঁচ মিনিটও হয়নি, এমন সময় ভার্ন হঠাৎ উঠে একটা ঝোঁপের দিকে এগিয়ে গেল। প্রকৃতির ডাক। যখন ফিরে এল, আমরা সবাই একে অন্যের উপরে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছি।
ট্রেন দেখে ভয় খেয়ে গেছিস নাকি, ভান?
না রে, বাপ। ব্রিজে ওঠার সময়ই যেতে চাচ্ছিলাম। যাই হোক, আমার যেতে হতোই, কাজেই…
তাই, না?
কাম অন! আসলেই আমার…কী করব আমি?
ওর কথার মাঝেই ক্রিস আর টেডি গলা মিলিয়ে গেয়ে উঠল, ভা-আ আ-ন!
এমন করিস না ওর সাথে, আমি বোঝানোর ভঙ্গিতে বললাম।
তাহলে, তোর প্যান্ট চেক করে দেখলে কিছু মনে করবি না তো, না? টেডি জিজ্ঞাসা করতে করতেই ভার্ন হেসে ফেলল, বুঝতে পারছে, ঠাট্টা করা হচ্ছে।
জাহান্নামে যা!
এমন সময় ক্রিস আমার দিকে ফিরে তাকাল। তোর কী অবস্থা, গর্ডি? ভয় পেয়ে গিয়েছিলি খুব?
একদম না, বলতে বলতে কোকের ক্যান তুলে চুমুক দিলাম।
আসলেই?
আসলেই। একদমই ভয় লাগেনি আমার।
একদমই লাগেনি? আসলেই? টেডি আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল।
হ্যাঁ, আসলেই। ভয় না, আমার যাকে বলে, কলিজা কেঁপে গেছে একেবারে।
সবাই একসাথে শব্দ করে হেসে উঠল। স্নায়ুক্ষয়ী উত্তেজনা কেটে গেছে, সবাই ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসছে; এমনকি ভার্নকে দেখেও বোঝা যাচ্ছে, আগের সেই বিবর্ণ ভাবটা আর নেই। হাসাহাসি থামার পর সবাই গা এলিয়ে দিলাম। কেউ কাউকে খোঁচাচ্ছে না, চুপচাপ কোকে চুমুক দিচ্ছে। উষ্ণতা অনুভব করছিলাম। পরিশ্রম শেষে যেমন শান্তি শান্তি লাগে, মনে হয়, নিজের সাথে ভালো একটা বোঝাপড়া হয়ে গেছে, সেরকম। একটু আগের সেই টানাহ্যাঁচড়া আর নেই। বেঁচে আছি এবং সেজন্য অন্যরকম এক ভালো লাগায় ছেয়ে গেছে সবকিছু। এরকম ভয়াবহ সাহসী এবং ঝুঁকিপূর্ণ কিছু করার পরে সবকিছু কেমন যেন অন্যরকম ভালো লাগায় ছেয়ে যায়। একটা কথা আমি কখনো মুখ ফুটে উচ্চারণ করিনি, আসলে মনেই হয় নি কাউকে বলা প্রয়োজন হয়তো এরকম ঝুঁকিপূর্ণ কিছু করাটা আমার নিজের জন্যেই দরকার ছিল।
সেদিন আমি কিছুটা বুঝতে পেরেছিলাম, মানুষ কেন দুঃসাহসী ও ঝুঁকিপূর্ণ সব কাজের নেশায় মেতে ওঠে। কয়েক বছর আগে স্নেক রিভার ক্যানিয়নের চূড়া থেকে ইভেল কেনেইভ্যালের লাফ দেওয়া দেখতে বিশ ডলারের টিকেট কেটে গিয়েছিলাম। আমার স্ত্রী খুব আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল আমার এই আচরণে। বলছিল, রোমান হয়ে জন্মালে আমি নিশ্চয়ই কলিসিয়ামের গ্যালারিতে বসে আঙুর চিবুতে চিবুতে সিংহ আর মানুষের খেলা দেখতাম, কেমন করে সিংহ মানুষটাকে ছিন্নভিন্ন করে ভেতরের সব কিছু টেনে বের করে আনে। কথাটা ঠিক বলেনি সে, কিন্তু ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করাটা আমার জন্য একটু কঠিন (আমি নিশ্চিত, কথা শুনে সে ভাবছিল, উল্টোপাল্টা বকে ওকে বুঝ দিতে চাচ্ছি)। বিশ ডলার খরচ করে আমি মোটেও মানুষটাকে মরতে দেখতে যাইনি–যদিও সে যে মরবে, এ ব্যাপারে একরকম নিশ্চিতই ছিলাম বলা যায়–আমি আসলে গিয়েছিলাম ওর চোখ দেখতে। আমাদের চোখের পেছনে কোথাও না কোথাও অন্ধকারের ছায়া লুকিয়ে থাকে। ব্রুস স্প্রিংসটিন তাঁর এক গানে একে বলেছিলেন, শহরের কিনারায় জেঁকে বসা অন্ধকার। আর জীবনের কোনো এক পর্যায়ে মানুষকে দেওয়া স্রষ্টার নশ্বর, বুড়িয়ে যাওয়া দেহের বাধা ভুলে গিয়ে সে এই অন্ধকারের সাথে ভয়ংকর ঝুঁকিপূর্ণ কোনো খেলায় মেতে উঠতে চায়। নিজের জন্যেই।
ক্রিস উঠে বসতে বসতে হঠাৎ বলে উঠল, ওই গল্পটা বল না!
কোন গল্প? জিজ্ঞাসা করলেও আসলে এমনিতেই বুঝতে পারছিলাম, কিসের কথা বলছে।
যদিও সবাই বেশ পছন্দই করত, তবু বন্ধুদের আড্ডায় আমার লেখালেখি নিয়ে কথাবার্তা হলে খুব অস্বস্তি বোধ হততা। সবাই চাইত আমি গল্প শোনাই, এমনকি সেসব যেন লিখেও রাখি–কিন্তু ব্যাপারটা কেমন উদ্ভট লাগত আমার। যেন, সবাই মিলে একজনকে গ্র্যান্ড প্রি-র মেকানিক কিংবা সুয়ারেজ ইন্সপেক্টর হওয়ার ইচ্ছেকে উৎসাহ দিচ্ছে। রিচি জেনার নামের একটা ছেলে ছিল, ৫৯ সালের দিকে ওর পরিবার নেব্রাস্কায় চলে যাওয়ার আগে আমাদের সাথেই থাকত সারাদিন। আমি যে বড় হয়ে পুরোদস্তুর লেখক হতে চাই, সেটা সে-ই প্রথম আবিষ্কার করেছিল।
আমার রুমে সবাই মিলে মজা করছিলাম। এমন সময় আমার আলমারিতে কমিক্স বইগুলোর নিচে একটা বাক্সে রাখা বেশ কিছু হাতে লেখা পৃষ্ঠা খুঁজে পায় সে। এগুলি কী?
কিছু না, বলেই পৃষ্ঠাগুলো কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। নিতে পারিনি, রিচি পৃষ্ঠাগুলো আমার নাগালের বাইরে সরিয়ে রেখেছিল। সত্যি বলতে, খুব যে চেষ্টা করেছি, তাও না। একইসাথে একদিকে মনে হচ্ছিল পড়ুক, আবার মনে হচ্ছিল, না পড়লেই ভাল। গর্ব, ভাল লাগা এবং লজ্জার মিশ্র অনুভূতি হচ্ছিল। এখনও কেউ যখন আমার লেখা দেখতে চায়, একইরকম অনুভব হয়। লেখালেখির কাজ করতে হয় একান্ত গোপনে, একাকি মাস্টারবেশনের মতো। হ্যাঁ, আমার এমন এক বন্ধুও ছিল, যে গল্প লিখে লিখে বইয়ের দোকান এবং ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের কাঁচের জানালায় টাঙিয়ে দিত। এরকম কাউকে সরল কথায় অত্যুৎসাহী উন্মাদ ছাড়া আর কিছু বলার উপায় নেই আসলে। হয়তো অচেনা কোনো শহরে গিয়ে হার্ট অ্যাটাকের খপ্পরে পড়লে আপনি এমন কাউকে সাথে চাইবেন। কিন্তু রোজকার জীবনে?
আমার জন্য লেখালেখি জিনিসটা সবসময়ই ছিল প্রচন্ড গোপন এবং দ্রুত সেক্স করার মতো, বাথরুমের দরজা বন্ধ করে প্রথম কৈশোরের প্রবল উত্তেজনা উপভোগ করার মতো। দশজনকে বলে বেড়ানোর কথা আমি এখনো ঠিক ভাবতে পারি না।
রিচি সেদিন আমার খাটের এক মাথায় বসে প্রায় পুরো বিকেল ধরে লেখাগুলো পড়েছে। যে কমিক্স বইগুলো পড়ে ভার্ন রাতে দুঃস্বপ্ন দেখত, আমার সে সময়ের লেখাগুলোর বেশিরভাগই ছিল ওসব থেকে অনুপ্রাণিত। যাই হোক, পড়া শেষে রিচি এমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল যেন, সে আমার পুরো ব্যক্তিত্বকে নতুন ভাবে মেপে দেখছে, বুঝতে চেষ্টা করছে। ভয়াবহ অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। এ সময় সে বলল, তুই আসলেই দারুণ লেখিস তো! ক্রিস কে দেখাসনি কেন এগুলি?
বলেছিলাম, দেখাতে চাই না, গোপন রাখতে চাই। রিচি জবাব দিল, কিন্তু কেন? তুই তো আর অদ্ভুত কিছু লিখছিস না। এগুলি তো কবিতা না যে, সবাই দেখে হাসাহাসি করবে।
তারপরেও ওকে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলাম, যাতে কাউকে না বলে। এবং প্রথম সুযোগেই সে বলে দিয়েছিল। দেখা গেল, দলের বেশিরভাগেরই আমার লেখা বেশ পছন্দ হয়ে গেছে। বিষয়বস্তুও তো ছিল সেরকম কাউকে জ্যন্ত পুঁতে ফেলা কিংবা মৃত্যুর ওপাশ থেকে ফিরে আসা প্রেতাত্মা তার মৃত্যুদন্ডাদেশ দেওয়া বিচারককে খুঁজে বের করে প্রতিশোধ নেওয়ার গল্প। কিংবা নায়ক কার্ট ক্যাননের সামনেই কোনো উন্মাদ অনেক মানুষকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলার পরে .৪৫ অটোমেটিকের রাউন্ডের পর রাউন্ড গুলি চালিয়ে উন্মাদ ভিলেনকে একহাত দেখে নেওয়ার গল্প। সে সময় আমার গল্পে নায়ক সবসময় রাউন্ডের পর রাউন্ড গুলি চালিয়েই ঝামেলা মিটমাট করত, এক-দুটো বুলেট ছুঁড়ে কাজ চালানোর মধ্যে ভুলেও যেত না।
একঘেয়েমি কাটাতে আমি মাঝে মাঝে লা ডিও নিয়ে সিরিজ গল্প লিখতাম। গল্পে ফ্রান্সের এক শহরের নাম ছিল লা ডিও। একদল ভয়ংকরদর্শন কুকুর-মুখো আমেরিকান ১৯৪২ সালে নাজি জার্মানদের কাছ থেকে শহরটা পুণরুদ্ধার করার চেষ্টায় যুদ্ধে নেমেছিল (আরো দুই বছর পরে সত্যিটা জানতে পেরেছিলাম, ৪৪ সালের আগে মিত্রবাহিনী ফ্রান্সে যেতেই পারেনি)। নয় থেকে উনিশ বছরের মধ্যবর্তী সময়ে প্রায় চল্লিশটার মতো গল্প লিখেছিলাম আমি এ নিয়ে, যেখানে কুকুর-মুখো আমেরিকান দলটি অলিতে গলিতে, রাস্তা ধরে ধরে যুদ্ধ করে শহরটি একটু একটু করে পুণরুদ্ধার করতে থাকে। টেডি এই গল্পগুলোর জন্য পাগল ছিল খুব। যথাসম্ভব শেষের দিকের ডজনখানেক গল্প আমি কেবল ওকে খুশি করার জন্যেই লিখেছিলাম–ততদিনে লা ডিওর উপরে আমি নিজেই ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে গেছি, এবং সঙ্গত কারণেই গল্পে নতুন নতুন নামের আমদানী ঘটেছে। যেমন, মন ডিউ, শেরসে লা বোস কিংবা ফার্মে লা পর্তে। এগুলো সবই ছিল লা ডিওর অংশবিশেষ। ফ্রান্সের অধিবাসীরা ফার্মে লা পর্তে কিংবা কুকুর-মুখো সেনাদের গায়ে আরেকটু হলেই পেশাব করে দেয়, এমন অবস্থা। কিন্তু টেডি এই সিরিজের নতুন কোনো গল্প পেলে একরকম ঝাঁপিয়ে পড়ত, উল্টে যেত পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। চোখ বড় বড় হয়ে যেত, ঘামে ভিজে যেত। এমনও সময় গেছে, আমার কাছে মনে হতো, ওর মাথার ভেতরে ব্রাউনিং অটোমেটিক মেশিন গানের গুলির শব্দ এবং আনন্দ হুইসেল স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। যেভাবে সে নতুন লা ডিও গল্পের চাহিদা জানান দিত, সেটা একদিক থেকে যেমন তীব্র আনন্দদায়ক ছিল, তেমনি ছিল দারুণ ভীতিকর।
এখন লেখালেখি করাটা আমার পেশা কিন্তু সেই আনন্দ আর আগের মতো পাই না। মাথার ভেতরে সেই অপরাধী, মাস্টারবেশনের মতো গোপন এবং নিষিদ্ধ কিছু করার আনন্দের বদলে বেশিরভাগ সময় যে শীতল অনুভতি হয়, একে বরং কত্রিম গর্ভধারণের সাথে তুলনা করা যায়। নিয়ম কানুন মেনে লেখি এবং পাবলিশিং কন্ট্রাক্ট অনুযায়ী সেটা প্রকাশিত হয়, ব্যাস। বাড়তি কোনো আনন্দ নেই। যদিও আমাকে কেউ এই প্রজন্মের থমাস উলফ বলে ডাকবে না, তারপরও, সেই প্রতারণা করার আনন্দ এখন খুব কমই পাই। আর যাও পাই, যতদ্রুত সম্ভব ঝেড়ে ফেলি মাথা থেকে। এই ব্যাপারটা আজকাল খুব কষ্ট দেয়। নিষিদ্ধ আনন্দের অভাব এত বেশি অনুভব করি যে, মাঝে মাঝে খুব ভয় লাগে আমার। লেখালেখিটা যে এত অসম্ভব চমৎকার একটা অনুভূতি দেয়–সে সময় এটা ভেবে মাঝে মাঝে নিজের উপরেই বিরক্ত বোধ করতাম। আর এখন টাইপরাইটারের দিকে তাকিয়ে ভাবি, শব্দের পর শব্দ বেরিয়ে আসার এই স্রোত কবে থামবে? না।, আমি চাই না এটা থেমে যাক। এই স্রোত থেমে না গেলে এটুকু কষ্ট আমি হয়তো সহ্য করে নিতে পারব।
ভার্ন অস্বস্তি নিয়ে বলল, কী গল্প, গর্ডি? কোনো হরর গল্প না তো? এখন কোনো হরর গল্প শোনার মত অবস্থা নেই রে।
না, হরর না, মজার গল্প। কিছুটা লেইম যদিও, তবে মজার। শুরু কর তো, গর্ডি।
লা ডিও সিরিজের গল্প নাকি রে? টেডির জিজ্ঞাসা।
এটা লা ডিও সিরিজের গল্প না, শালা সাইকো! বলতে বলতে ওর ঘাড়ের পেছনে হালকা এক রদ্দা বসিয়ে দিল ক্রিস। পাই খাওয়ার প্রতিযোগীতা নিয়ে গল্প।
আরে বাবা, আমি এখনো লেখিওনি এটা।
বুঝলাম, এখন বল তো।
আসলেই শুনতে চাস?
ইয়েস, বস! টেডি বলল।
আমার বানানো গ্ৰেতনা নামের এক শহরের গল্প এটা। গ্ৰেতনা, মেইন।
গ্রেনা? ভার্ন দাঁত বের করে হাসছে। কোনো নাম হলো এটা? তেনা, মেইন নামে কোনো শহর নেই।
চুপ কর, গাধা কোথাকার! এই মাত্রই না বলল, বানানো? ক্রিসের গলায় ঝাঁঝ?
হ্যাঁ, কিন্তু তাই বলে গ্রেনা? কেমন হাস্যকর–
বাস্তব অনেক শহরের নামও হাস্যকর। যেমন ধর, আলফ্রেড, মেইন। কিংবা স্যাকো, মেইন। কিংবা জেরুজালেমস লট হাস্যকর না? আরে শালার, ক্যাসল রকের কথাই ধর না, এখানে কোনো ক্যাসল আছে আদৌ? বেশিরভাগ শহরের নামই এমন হাস্যকর। তোর কাছে এমন লাগে না, কারণ তুই বলতে বলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছিস। কী, ভুল বললাম, গর্ডি?
ক্রিসের কথায় সায় দিলেও মনে মনে ভার্নের সাথে একমত হয়ে গেলাম, শহরের নাম হিসেবে গ্রেতনা আসলেই হাস্যকর। আসলে আমার মাথায় ভাল কোনো নাম আসছিল না।
যাই হোক, ক্যাসল রকের মতোই ওরাও বাৎসরিক পাইওনিয়ার ডে উদ্যাপন করছিল
হ্যাঁ, পাইওনিয়ার ডে দারুণ ছিল, ভার্ন মন থেকে বলল, আমার পুরো পরিবারকে সেই জেলখানার মতো গাড়িটায় ঢুকিয়েছিলাম, এমনকি শালার বিলিও ছিল। আধাঘন্টার ভেতরে আমার যা টাকা-পয়সা ছিল, সব শেষ। তারপরও ওই শালা কোথায় আছে, এটা জেনে
টেডি চিৎকার করে উঠল, তুই চুপ করে ওকে একটু বলতে দিবি?
হ্যাঁ, অবশ্যই। আচ্ছা। ভার্ন থমকে গিয়ে চোখ পিটপিট করছে।
তুই বল, গর্ডি, ক্রিস বলল।
তেমন কিছু না–
জবাব দিল টেডি, তোর মত কচি বাচ্চার কাছ থেকে আমরা আর তেমন কী-ইবা আশা করব, বল? যাই হোক, তুই এখন গল্পটা বল।
গলা পরিস্কার করে নিলাম। যাই হোক, পাইওনিয়ার ডের উৎসব চলছিল। শেষ রাত উপলক্ষ্যে তিনটা বড় ইভেন্ট রাখা হয়েছে। একেবারে পিচ্চিদের জন্য আছে এগ-রোল, আট-নয় বছরের বাচ্চাদের জন্য আছে বস্তায় দুই পা ঢুকিয়ে স্যাক-রেস দৌড়, আর আছে একটা পাই খাওয়ার প্রতিযোগিতা। আর, এই গল্পের মূল চরিত্র হচ্ছে ডেভ হোগান নামের এক মোটু, যাকে কেউ পছন্দ করে না।
চার্লি হোগানের ভাই থাকলে যেমন হতো আরকি, ঘাড়ে ক্রিসের রদ্দা খেয়ে আবারো চুপ হয়ে গেল ভার্ন।
তো, এই ছেলেটা হচ্ছে আমাদের বয়সি, কিন্তু অনেক মোটা। প্রায় একশ আশির মতো ওজন, আর এজন্য নিয়মিত মার খেতে হতো ওকে, এবং কেউ কোনো কিছুতে নিতেও চাইত না। আর, বাকি সবাই ডেভ না বলে বলত পাছা মোটা কলসি-হোগান, এবং সুযোগ পেলেই অনেক যন্ত্রণা দিত।
সবাই মাথা ঝাঁকিয়ে সমবেদনা জানাল হোগানের জন্য। যদিও এমন কেউ যদি ক্যাসল রকে থাকত, নিশ্চিত সবাই মিলে যন্ত্রণা দিয়ে চৌদ্দগুষ্টিসহ উদ্ধার করে ফেলতাম।
তো, সে সিদ্ধান্ত নিল, প্রতিশোধ নেবে। বুঝতেই পারছিস, কতদিন আর এভাবে সহ্য করা যায়, তাই না? সে কেবল পাই খাওয়ার প্রতিযোগিতাটাতেই অংশ নিয়েছে, কিন্তু সেটা হচ্ছে পাইওনিয়ার ডের উৎসবের একেবারে শেষ প্রতিযোগিতা এবং সবাই এটা বেশ উপভোগও করত। পুরষ্কার ছিল পুরো পঞ্চাশ ডলার–
টেডি বলে উঠল, প্রতিযোগীতায় জিতে সবাইকে একেবারে মধ্যাঙ্গুলি দেখিয়ে দিয়েছে, না? সেরা!
জবাব দিল ক্রিস, না, এরচেয়েও দারুণ কাজ করেছে। চুপ করে শোন আগে।
তো, কলসি হোগান চিন্তা করল, পঞ্চাশ ডলার আর কী? দুই সপ্তাহ পরে তো এর কথা কেউ মনেও রাখবে না। কেউ যদি আদৌ কিছু মনে রাখে, সবাই বরং একটা কথাই মনে রাখবে–সে সবার চেয়ে বেশি খেয়ে বাকিদেরকে হারিয়ে দিয়েছে। সবাই বরং আগের চেয়ে যন্ত্রণা দেওয়া আরো বাড়িয়ে দেবে। দেখা যাবে, বাসায় এসেও জ্বালাতন করছে। পার্থক্য বলতে, কলসির বদলে এবার হয়তো নতুন নাম পড়বে, পাইথোর হোগান।
সবাই মাথা ঝাঁকিয়ে আরেক দফা একমত হলো, ডেভ হোগান ঠিকই ভেবেছে। এতক্ষণে গল্প বলাটা উপভোগ করতে শুরু করেছি, নিজের গল্প নিজের কাছেই ভাল লাগছে।
এদিকে, সবাই আশা করছে, সে অবশ্যই প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে। এমনকি ওর বাবা-মাও, বরং তারা সেই পঞ্চাশ ডলার খরচ করার উপায়ও ভেবে ফেলেছে এরমাঝে।
একদম ঠিক। ক্রিস বলল।
তো, সে যতই ভাবছে, ততই রাগে-ক্ষোভে মন বিষিয়ে উঠছে। কারণ, মোটা হওয়াটা তো আর ওর দোষ না। কী এক অদ্ভুত গ্ল্যান্ড আছে না, সেজন্য।
আমার এক আত্মীয়েরও আছে এমন! ভার্ন উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলতে লাগল, আসলেই, প্রায় তিনশ পাউন্ডের মতো ওজন! কী যেন, হাইবয়েড গ্ল্যান্ড না কিসের জন্য নাকি এমন হয়। যদিও আমি নিশ্চিত না, আসলেই হাইবয়েড গ্ল্যান্ড আছে কি না, কিন্তু কী যে মোটার মোটা! দেখলে মনে হয়। শালার থ্যাংকসগিভিংয়ের আস্ত টার্কি মুরগি, আর একবার–
হারামজাদা, তুই চুপ করবি? ক্রিসের গলা প্রচন্ড রাগে কাঁপছে। কোক খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল, খালি কাঁচের বোতলটা উল্টো করে ভার্নের মাথার উপরে ধরে বলল, শেষবারের মত বলে দিচ্ছি, খোদার কসম!
ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি দুঃখিত। তুই বল, গর্ডি।
কথা শুনে হাসলাম। ভার্নের এসব টুকটাক বাগড়া দেওয়ায় আমি কিছু মনে করিনি। কিন্তু ক্রিসকে সেটা বলা সম্ভব ছিল না, সে ছিল, যাকে বলে, স্বনিয়োগকৃত শিল্পের রক্ষক।
মনে মনে সব কিছু ভেবে দেখছিল সে। প্রতিযোগিতার আগের পুরো সপ্তাহ জুড়ে সব ছেলেপেলেরা ওকে এসে এসে বারবার জিজ্ঞাসা করত, এই পাছা মোটা কলসির বাচ্চা, তুই কয়টা পাই খাবি রে? দশটা? বারোটা? নাকি আশিটা? শুনে সে বলত, কীভাবে বলব? পাইগুলি যে কেমন, তাই তো এখনো জানি না। তাছাড়া, প্রতিযোগিতাটা নিয়ে সবার মাঝে বেশ একটা আগ্রহও তৈরি হয়েছিল। আগেরবারের চ্যাম্পিয়ন ছিল এক বয়স্ক লোক, উম, বিল ট্রেনর সম্ভবত নাম। আর এই ট্রেনর সেরকম মোটাও ছিল না, কিন্তু পাই খেতে পারত নোকটা। মানে, পাই খাওয়ার জাদুকর বলতে পারিস–আগের বছর পাঁচ মিনিটে ছয়টা পাই খেয়ে ফেলেছিল।
পুরো ছয়টা? টেডির কথা শুনে মনে হলো আঁতকে উঠেছে।
ঠিক তাই। তার ওপর, আমাদের কলসি হোগান ছিল এই প্রতিযোগিতার ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ প্রতিযোগী।
টেডি উত্তেজনার চোটে বলে উঠল, তুই এগিয়ে যা, পাছা মোটা কলসি হোগান! সব পাই খেয়ে সাফ করে ফেল!
বাকি প্রতিযোগীদের ব্যাপারেও বল, আর কে কে আছে, ক্রিস বলল।
আচ্ছা। কলসি হোগান আর বিল ট্রেনর ছাড়া আরেকজন হচ্ছে কেলভিন স্পায়ার শহরের সবচেয়ে বড় মোটু আর স্থানীয় জুয়েলারি দোকানের মালিক।
গ্রেতনা জুয়েলস, ক্রিসকে রাগী চোখে তাকাতে দেখে কথার মাঝখানেই থেমে গেল ভার্ন।
আরেকজন ছিল লিউইস্টনের এক রেডিও স্টেশনের ডিস্ক-জকি। তেমন মোটা না হলেও ভালোই স্বাস্থ্যবান বলা যায়, বুঝিসই তো। আর, শেষ প্রতিযোগী হচ্ছে হিউবার্ট ঘেতনা দ্য থার্ড, কলসি হোগানের স্কুলের প্রিন্সিপাল।
নিজের স্কুলের প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় নেমেছে! টেডির গলায় বিষ্ময়।
দুই হাতে হাঁটু জড়িয়ে ধরে সামনে-পেছনে দুলতে দুলতে ক্রিস বলল, কী দারুণ না? বলে যা, গর্ডি!
এতক্ষণে ওদেরকে আমি আটকে ফেলেছি। সবাই সামনে ঝুঁকে এসেছে। নিজের ভেতরে প্রবল ক্ষমতার উৎসরণ টের পাচ্ছি। খালি কোকের বোতল বনের ভেতরে ছুঁড়ে দিয়ে একটু নড়েচড়ে আরাম করে বসলাম। মনে আছে, সে সময় আবার ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম, যদিও অনেক দূরে, বনের ভেতর থেকে ভেসে আসছিল। একঘেয়ে সুরে ডেকেই যাচ্ছে: ডিইই-ডিইই-ডিইই।
তো, ওর মাথায় একটা বুদ্ধি আসল, এর আগে কখনো কোনো কিশোরের মাথায় এরকম দারুণ প্রতিশোধের বুদ্ধি আসেনি। যাই হোক, পাইওনিয়ার ডের শেষ দিন এসে পড়ল। আতশবাজি ফুটানোর ঠিক আগের ইভেন্টটাই হলো পাই খাওয়ার প্রতিযোগিতা। গ্রেনা শহরের মূল রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মানে, গাড়ি চলবে না আরকি, মানুষ যেন ইচ্ছেমতো হেঁটে বেড়াতে পারে। তাছাড়া, রাস্তার মধ্যেই বিশাল এক মঞ্চ বানানো হয়েছে। দারুণভাবে সাজানো হয়েছে সবকিছু। মঞ্চের সামনে ব্যাপক ভিড় জমে গেছে। শেষ পর্যন্ত জানা গেছে, এ বছরের প্রতিযোগিতা হবে ব্লুবেরি পাই দিয়ে। পত্রিকার এক ফটোগ্রাফারও চলে এসেছে, বিজয়ীর পুরো চেহারায় মেখে যাওয়া ব্লুবেরিসহ একটা ছবি তুলে নেবে। আরেকটা কথা বলতে ভুলে গেছি, পাই খাওয়ার সময় প্রতিযোগীদের হাত পেছনে বেঁধে দেওয়া হয়, সেজন্যেই খেতে গিয়ে পুরো মুখে মাখামাখি হয়ে যায়। যাই হোক, প্রতিযোগীরা মঞ্চে উঠে পড়েছে–
অধ্যায় ১৬
কলসি হোগানের প্রতিশোধ, লেখক: গর্ডন লুশ্যান্স। ১৯৭৫ সালে ক্যাভালিয়ে ম্যাগাজিনের মার্চ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল গল্পটি। লেখকের অনুমতি সাপেক্ষে গল্পটি এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হলো।
.
একে একে মঞ্চে উঠে এল সবাই, লিনেনের টেবিল ক্লথ বিছানো একটা টেবিলের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। পাই ভর্তি টেবিলটা মঞ্চের এক পাশে রাখা। মাথার উপরে নেকলেসের মতো করে দড়িতে একটু পরপর একশ ওয়াটের বাল্ব ঝোলানো হয়েছে। মথ এবং আরো কিছু পোকা উড়ে বেড়াচ্ছে, ডাকছে এবং মৃদু বাড়ি মারছে লাইটের গায়ে। মঞ্চের উপরে আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে একটা সাইনবোর্ড। ওতে লেখা: দ্য গ্রেট গ্রেতনা পাই-ইট অফ ১৯৬০। দ্য গ্রেট ডে এপ্লায়েন্স শপের চাক ডের আনুকূল্যে সাইনবোর্ডের দুইপাশে বেশ কিছু স্পিকার ঝোলানো হয়েছে। গতবারের বিজয়ী বিল ট্রেভিস চাকের আত্মীয় হয়। প্রতিযোগীরা একে একে এগিয়ে এলে প্রত্যেকের হাত পেছনে বেঁধে শার্টের সামনের বোতাম খুলে দেওয়া হল। দেখে সিডনি কার্টনের কথা মনে পড়ে গেল। গিলোটিনে ওঠার পথে মেয়র শারবোন যেমন মাইকে নাম ঘোষণা করে কার্টনের গলায় মোটা সাদা রঙের দড়ি পরিয়ে দিয়েছিল, সেরকম। বিশ গ্যালনের পানির ড্রামের আকারের বিশাল বপু থাকা সত্ত্বেও মঞ্চে ওঠার পর কেভিন স্পায়ার ভদ্রতাসূচক হাততালি পেল। হোগানের পরে ওকেই সবচেয়ে বেশি আন্ডারডগ বলে ভাবা হচ্ছে (যদিও অনেকেই আমাদের কলসিকে বেশ সম্ভাবনাময় বলে মনে করছে, তবে কম বয়স আর অনভিজ্ঞতার কারণে এ বছর সে তেমন কিছু করতে পারবে না বলে ধরে নেওয়া হয়েছে)। স্পায়ারের পর বব কর্নিয়ারকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো: পেশায় ডিস্ক জকি, লিউইস্টনের ডব্লিউএলএএম-এ বিকেলের দিকে একটা বেশ জনপ্রিয় অনুষ্ঠান করত। তুলনামূলকভাবে বেশি তালি পেল সে, সাথে দর্শকদের মাঝের কিশোরীদের কাছ থেকে বেশ কিছু চিৎকারও শোনা গেল ওর নামে। মেয়েদের কাছে ওকে নাকি কিউট লাগছিল। পরবর্তী প্রতিযোগী হিসেবে এল গ্রেনা এলিমেন্টারি স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল জন উইগিন্স। বয়স্কদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাওয়া গেল এ সময়, সাথে উপস্থিত ওনার ছাত্র ছাত্রীদের কাছ থেকে ভাঙা ভাঙা বু-ধ্বনি ভেসে এল। কীভাবে কীভাবে যেন মঞ্চ থেকে দুটোরই জবাব দিল উইগিন্স, ভদ্র চাহনির সাথে কড়া চাহনিও জুটল দর্শকদের। এরপরেই মেয়র শারবোন কলসি হোগানের সাথে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিল।
বাত্সরিক গ্ৰেতনা পাই-ইটের নতুন প্রতিযোগী, যার কাছ থেকে আমরা ভবিষ্যতে দারুণ কিছু আশা করি, আমাদের তরুণ তুর্কী ডেভ হোগান! ব্যাপক তালি পড়তে লাগল, এর মাঝেই মেয়র ওর হাত বেঁধে দিল। তালি পড়ে আসতেই আলো যেখানে শেষ হয়ে গেছে, তার একটু পেছন থেকে রিহার্সেল দিয়ে আসা গ্রিক কোরাসের মতো ভেসে এল।
ওদের খেয়ে দে, কলসি হোগান!
হাসির রোল পড়ে গেল, শোনা গেল সরে পড়তে থাকা পদধ্বনি। বেশ কিছু ছায়াও সরে গেল, যাদেরকে পরে আর কেউ চিহ্নিত করতে পারবে না (আসলে চাইবেও না)। বিচারকদেও ভ্রু কুঁচকে যেতে দেখা গেল (মেয়র হিজোনার শারবোনরটাই বেশি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, বিচারকদের মাঝে ওনাকেই সবচেয়ে প্রকটভাবে চোখে পড়ে। তবে কলসি হোগানকে দেখে মনে হচ্ছে না, এসব কিছুকে সে আদৌ পাত্তা দিচ্ছে। পুরু ঠোঁট এবং ভারি চোয়ালের ফাঁকে লেগে থাকা মৃদু হাসি একটুও পাল্টায়নি। এদিকে মেয়রের ভ্র তখনো কুঁচকে আছে। উষ্ণ নিশ্বাস, বিয়ারের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। হাত বেঁধে দিতে দিতে হোগানকে বলছেন, সে যেন বোকাদের কথায় কিছু মনে না করে (ভাবটা এমন, হোগানকে এক জীবনে কী ভয়াবহ সব যন্ত্রণা এদের থেকে সহ্য করতে হয়েছে এবং বাকি জীবনভর জার্মানদের টাইগার ট্যাংকের মতো এগিয়ে যেতে যেতে আরো কতটা সহ্য করতে হবে, এ নিয়ে যেন ওনার বিন্দুমাত্রও ধারণা আছে!)।
মঞ্চে উঠে আসা শেষ প্রতিযোগী সবচেয়ে বেশি এবং দীর্ঘস্থায়ী তালি পেল। বিল ট্র্যাভিস, জীবন্ত কিংবদন্তী ছয় ফিট পাঁচ ইঞ্চি লম্বা, সদর্পে পা ফেলে এগোচ্ছে। রেলইয়ার্ডেও পাশের স্থানীয় এমোকো অয়েল স্টেশনে মেকানিক হিসেবে কাজ করত, এখানকার কর্মীদের মাঝে সে-ই একমাত্র পছন্দনীয় ছিল সবার কাছে। এলাকায় একটা কথা প্রচলিত ছিল, গ্রেট গ্রেতনা পাই-ইট প্রতিযোগিতায় কেবল পঞ্চাশ ডলার পুরষ্কার ছাড়াও আরো কিছু আছে, অন্তত বিল ট্রেভিসের জন্য তো অবশ্যই। এর পেছনে দুটো কারণ ছিল। এক, বিল প্রতিযোগিতায় জেতার পর অনেক মানুষ অভিবাদন জানাতে স্টেশনে আসত। আর যারা আসত, এদের বেশিরভাগই গ্যাস ট্যাংক না পুরিয়ে যেত না। এমনকি কখনো কখনো প্রতিযোগিতার পর একদম পুরো মাসের জন্য দুই গ্যারেজ-বের সবটা বুক হয়ে থাকত। গাড়ির সাইলেন্সর বদলানোর জন্য কিংবা হুইলের বিয়ারিংয়ে তেল দেওয়ার জন্য মানুষ আসত এবং একপাশের দেয়ালের পাশে রাখা থিয়েটার চেয়ারে বসে (৫৭ সালে জেম থিয়েটার ভেঙে ফেলার পর এমোকোর মালিক জেরি মেটিং ওদের চেয়ারগুলো কিনে নিয়েছিল) কোক খেতে খেতে বিলের সাথে প্রতিযোগিতা নিয়ে গল্পে মেতে উঠত। স্পার্ক প্লাগ বদলাতে বদলাতে কিংবা ক্ৰল-হুঁইলে শুয়ে কারো আন্তর্জাতিক হারভেস্টার পিকআপের নিচে ঘুরে ঘুরে এক্সহস্ট সিস্টেমে ফুটো খুঁজতে খুঁজতে বিলও সাগ্রহে অংশ নিত আলোচনায়। ঘেতনার সবাই ওকে পছন্দ করার পেছনে এটাও একটা বড় কারণ, কথা বলায় কোনো অনীহা ছিল না ওর। শহর জুড়ে এমন একটা কথাও প্রচলিত ছিল যে, জেরি মেলিং বিলকে একটা মোটা অংকের বোনাস দিত বাৎসরিক এই বাড়তি ব্যবসার জন্য, কিংবা প্রতিনিয়ত ওর বেতন বাড়াত। বাস্তবতা যেটাই হোক, বিল ট্রেভিস যে ছোট শহরের অন্যান্য মেকানিকদের চেয়ে অনেক বেশি আয় করত, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। স্যাটাস রোডের পাশে ওর দারুণ একটা দোতলা র্যাঞ্চ ছিল, এবং অনেকেই এর কথা বলতে গিয়ে বলত, পাই দিয়ে বানানো বাড়ি! এটা হয়তো একটু বাড়িয়েই বলা, কিন্তু অন্যদিক থেকে হলেও বিলের হাতে বাড়তি পয়সা আসতই। সেই যে বলেছিলাম, লোকে বলত, অন্তত বিলের অবশ্যই এতে পঞ্চাশ ডলারের বেশি আছে, এর পেছনের দ্বিতীয় কারণও এটাই। পাই খাওয়ার প্রতিযোগিতাটার দারুণ চাহিদা ছিল গ্ৰেতনায়। হ্যাঁ, বেশিরভাগ মানুষই হয়তো মন খুলে হাসার জন্যই আসত, কিন্তু পাই খাওয়া উপলক্ষ্যে বাজি ধরার মানুষও নিতান্ত কম আসত না। ঘোড়দৌড়ের দালালরা যেমন ঘোড়াগুলোকে পর্যবেক্ষণ করে এবং বিস্তর আলাপ আলোচনা করে, এই জুয়াড়িরাও প্রতিযোগীদের নিয়ে তাই করত। প্রতিযোগীর পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং সামান্য পরিচয় আছে, এমন সবার সাথে কথা বলত। প্রতিযোগীর খাদ্যাভ্যাস নিয়ে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর কোনো তথ্য বের করার উপায় থাকলেও, সেটা না করে ছাড়ত না ওরা। আর সবসময়ই বছরের নির্বাচিত পাই নিয়ে দারুণ কথাবার্তা হতো সবার মাঝে। এপলপাইকে ধরা হতো ভারি পাই, এপ্রিকট হালকা( যদিও তিন-চারটা এপ্রিকট খাওয়ার পর ডায়েরিয়ার জন্য অন্তত দিন দুয়েকের মতো হাতে রাখতে হত প্রতিযোগীকে)। সে বছরের নির্বাচিত পাই ছিল ব্লুবেরি–মধ্যম ধরনের পাই। কাজেই সে বছর জুয়াড়িরা প্রতিযোগীদের ব্লুবেরিসহ যেকোনো পদের খাবার খাওয়ার ব্যাপারে জানতে আগ্রহী ছিল। ব্লুবেরি বাকল কীরকম খেতে পারে? স্ট্রবেরি প্রিজার্ভের চেয়ে ব্লুবেরি জ্যামকে কি বেশি প্রাধান্য দেয়? সকালের নাস্তায় সিরিয়ালের সাথে ব্লুবেরি মিশিয়ে খায় বলে কেউ কি শুনেছে? নাকি খালি কলা আর ক্রিম দিয়ে নাস্তা সেরে ফেলে?
আরো কিছু প্রশ্ন উঠত সময়ে সময়ে। লোকটা কি এমনিতে দ্রুত খায়, কিন্তু পরের দিকে এসে ধীর হয়ে যায়? নাকি এমনিতেই ধীরে খায়, কিন্তু সিরিয়াস পরস্থিতিতে দ্রুত খেতে পারে? নাকি অলরাউন্ডার? সেন্ট ডোমস বেসবল ফিল্ডের গ্যালারিতে বেইব রুথ লিগ গেম দেখতে দেখতে কয়টা হটডগ সাবাড় করতে পারে সে? অনেক বিয়ার খায় নাকি? খেলে, এক বিকেলে কয় বোতল শেষ করে সাধারণত? খেয়ে-দেয়ে ঢেঁকুর তোল তো? লোকে বিশ্বাস করত, দীর্ঘ সময় ধরে চলমান খাবার প্রতিযোগিতায় সেঁকুর তোলে–এমন কাউকে হারানো কঠিন।
যতদূর পর্যন্ত জানা সম্ভব, সব টুকরো টুকরো তথ্য এক করে প্রতিযোগীর জেতার সম্ভাবনা নির্ধারণ করার পরে বাজি ধরা হতো। পাই-ইট প্রতিযোগিতা পরবর্তী সপ্তাহব্যাপী কত টাকা যে হাতবদল হতো, সেটা জানার আমার কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু মাথায় পিস্তল ধরে কেউ যদি আমাকে আনুমানিক একটা সংখ্যা বলতে বলে, আমি বলব, অন্তত হাজার ডলারের কাছাকাছি হবে। সংখ্যাটা শুনে বর্তমানের হিসেবে নিতান্ত সামান্য মনে হতেই পারে, কিন্তু পনের বছর আগের অমন ছোট এক শহরের জন্য এটা ছিল অনেক বড় অংকের টাকা।
যেহেতু দশ মিনিটের এই প্রতিযোগিতাটা সৎ এবং বেশ কড়াকড়িভাবে পরিচালনা করা হতো, তাই কোনো প্রতিযোগী যদি নিজের উপরেও বাজি ধরে, তাতে কেউ কোনো আপত্তি করত না। সেজন্যে বিল ট্র্যাভিস প্রতি বছরই নিজের ওপর বাজি ধরত।
লোকে বলে, ১৯৬০ সালের সেই গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় সে যে দর্শকদের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে না করে হাসছিল, সেবারও সে নিজের ওপর বাজি ধরেছিল–তবে সে বছর বিলের সর্বোচ্চ বাজির দর ছিল এক বনাম পাঁচ। আপনার যদি বাজি ধরার ব্যাপারে কোনোরকম অভিজ্ঞতা না থাকে, তাহলে বলি: ৫০ ডলার জেতার জন্য ওকে ২৫০ ডলারের রিস্ক নিতে হয়েছিল। খুব ভালো কিছু না হলেও সফল হওয়ার জন্য এটুকু রিস্ক নিতেই হতো। সবকিছুর একটা মূল্য আছে না? বাজি জেতা, খ্যাতি অর্জন এবং সফলতার পেছনের মূল্য ছিল এটা। মঞ্চে দাঁড়িয়ে হেসে হেসে এত তালি গ্রহণ করার সময়ও মনে হচ্ছিল না, সে আদৌ চিন্তিত।
মেয়র শারবোন ঘোষণা দিলেন, এবং গতবারের বিজয়ী, ঘেতনার অমূল্য সম্পদ বিল ট্রাভিস!
হো-ও-ও, বিল!
আজকে কয়টা সাবাড় করবে, বিল?
দশটার আগে থেমো না কিন্তু, বিলি!
তোমার উপরে আমি দুটো বাজি ধরেছি, বিল! আমাকে ঝামেলায় ফেলো না!
আমার জন্য একটা পাই নিয়ে এসো তো, ট্র্যাভিস!
মাথা ঝাঁকিয়ে, মৃদু হেসে সব ধরনের কথাবার্তা এবং করতালি ভদ্রভাবে বরণ করে নিল বিল ট্র্যাভিস। মেয়রকে হাত বাঁধার সুযোগ দিল, তারপর টেবিলের একেবারে ডান পাশে বসে পড়ল। প্রতিযোগিতা চলার সময় মেয়র শারবোন ঠিক ওর পাশেই দাঁড়াবেন।
যথাক্রমে ডান থেকে বামে, প্রতিযোগীরা হচ্ছে: বিল ট্র্যাভিস, ডেভিড কলসি হোগান, বব কর্মিয়ার, প্রিন্সিপ্যাল জন উইগিন্স এবং সবার বামে কেলভিন স্পায়ার।
এবারে মেয়র শারবোন্যু সিলভিয়া ডজের সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রতিযোগিতার জন্য উনি সবার কাছে বিল ট্র্যাভিসের চেয়ে বেশি পরিচিত। ভদ্রমহিলা দীর্ঘকাল ধরে গ্রেতনা লেডিস অক্সিলারির প্রেসিডেন্ট। দীর্ঘকাল মানে, কবে যে তিনি প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, সে কথা লোকের ঠিক মনেও নেই (এ নিয়ে একটা রসিকতা প্রচলিত আছে শহরে–১৮৬১ সালের সিভিল ওয়ারের প্রথম ম্যানাসাস যুদ্ধের সময় থেকেই উনি এই পদে আছেন!)। প্রতিবছর পাই বানানোর পুরো প্রক্রিয়াটি ওনার তত্ত্বাবধানেই হয় এবং বেশ শক্ত হাতে পাইয়ের মান নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। প্রক্রিয়ার একটা পর্যায় অনুষ্ঠিত হয় ফ্রিডম মার্কেটে। মিস্টার বাংকিচেকস বুচারস স্কেলে প্রতিটা পাইয়ের ওজন মেপে দেখা হয় এবং নিশ্চিত করা হয়, এক আউন্সের বেশি ওজনের পার্থক্য যেন কোনোভাবেই না থাকে।
দর্শকদের দিকে তাকিয়ে অভিজাত ভঙ্গিতে হাসলেন, লাইট বাল্বের আলোয় তাঁর নীল চুলগুলো ঝিলিক দিচ্ছিল। সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিতে গিয়ে বললেন, শহরের প্রায় সবাই পাইওনিয়ার ডের উৎসব পালনে এভাবে অংশগ্রহণ করায় ওনার বেশ ভাল লাগছে। যাঁরা এই দেশটাকে বর্তমান অবস্থানে নিয়ে এসেছে, তাঁদের অবদানকে এভাবে স্মরণ করাটা দারুণ ব্যাপার, এবং এটা করাটা প্রয়োজন। স্থানীয় রিপাবলিকানদের নিয়ে মেয়র শারবোন যে আগামী নভেম্বরে স্থানীয় সরকারের মিটিংয়ে বসে বিভিন্ন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন–শুধু এটুকু স্মরণ করলেই তো হবে না, নিক্সন এবং লজ যে তাঁর দল নিয়ে গণতন্ত্র এবং মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন–এটাও মনে রাখতে হবে। এ সময় কেলভিন ম্পিয়ারের পেট শব্দ করে উঠল-গোয়িং-ং?
হাসির রোল উঠল, তালিও পড়ল কিছু। সিলভিয়া ডজ ভালো করেই জানতেন কেলভিন একই সাথে ডেমোক্রেট এবং ক্যাথলিক (যে কোনো একটা হলে তাও ক্ষমা করা যায়, দুটো একসাথে হলে ক্ষমা করা কোনোভাবেই সম্ভব না)। বিব্রত সিলভিয়ার মুখ আরক্তিম হয়ে উঠল। কিন্তু কোনো এক বিচিত্র উপায়ে হাসার সাথে সাথে তিনি যে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে আছেন, সেটাও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। গলা পরিস্কার করে নিয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করলেন সবার, এবং বক্তৃতার শেষে দর্শক সকল কিশোর কিশোরীদের উপদেশ দিয়ে বললেন, লাল-সাদা-নীলের পতাকাকে সবাই যেন হাতে এবং হৃদয়ে দুইখানেই সমুন্নত রাখে। সাথে এও বললেন, ধুমপান খুবই বাজে এবং নোংরা স্বভাবে পরিণত হতে পারে, যার ফলে নিয়মিত কাশি লেগেই থাকে। দর্শকদের মাঝের বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই যারা আগামী আট বছরের মাঝে গলায় শান্তির মেডাল ঝোলাবে এবং সিগারেটের জায়গায় টানবে মারিজুয়ানা–-পায়ের ভর বদল করে দাঁড়াল, মূল আকর্ষণ শুরুর প্রতীক্ষায় আছে।
পেছন থেকে কেউ একজন বলেই বসল, কথা কম, খাওয়া বেশি! সাথে সাথে সমর্থনসূচক প্রচন্ড করতালিতে ছেয়ে গেল সবকিছু। মেয়র শারবোন সিলভিয়ার হাতে একটা স্টপওয়াচ এবং পুলিশ হুইসেল ধরিয়ে দিলেন, দশ মিনিট শেষ হলে এই হুইসেল বাজানোর মাধ্যমেই প্রতিযোগিতা শেষ হবে। তারপর মেয়র এগিয়ে এসে বিজয়ীর হাত উঁচু করে ধরবেন।
আর ইউ রেডি? সাউন্ড সিস্টেমে হিজোনারের গলা ভেসে এল, ছড়িয়ে পড়ল মূল রাস্তায়।
পাঁচ পাইখাদক সম্মতি দিলে হিজোনারের পরবর্তী প্রশ্ন ধেয়ে এল, আর ইউ সেট?
গর্জন করে সম্মতি জানাল পাঁচ প্রতিযোগী। রাস্তায় এক পিচ্চি আতশবাজির সুতায় আগুন দিয়েছে। এরই মাঝে মেয়র শারবোন তার মোটা থামের মতো হাত তুলে ধরলেন। পরমুহূর্তেই নামিয়ে এনে বললেন, গো!
ঝপ করে পাঁচটা মাথা পাইয়ের প্লেটে আছড়ে পড়ল, শব্দ শুনে মনে হলো, পাঁচ জোড়া থামের মতো পা কাদার মধ্যে দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। রাতের মৃদু বাতাসে ভেজা থকথকে এক ধরনের শব্দ ছড়িয়ে পড়ল, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই জুয়াড়ি আর দর্শকদের পছন্দের প্রতিযোগীর নামে সোৎসাহ চিল্কারের মাঝে হারিয়ে গেল তা। প্রথম পাইটা শেষ হতেই যা দেরি, সাথে সাথেই উপস্থিত সবাই বুঝে গেল, একটা কিছু উল্টোপাল্টা হতে চলেছে।
অল্প বয়স এবং অনভিজ্ঞতার ফলে বাজির হিসেবে এক বনাম সাত দরের প্রতিযোগী পাছা মোটা কলসি হোগান ভূতগ্রস্থের মতো খাচ্ছিল। ওর চোয়াল মেশিন গানের মতো পাইয়ের উপরের ক্রাস্ট ছিন্নভিন্ন করে ফেলল (প্রতিযোগিতার নিয়মানুযায়ী, উপরের আবরণটা খাওয়া বাধ্যতামূলক, কিন্তু নিচেরটা আবশ্যক না)। ক্রাস্ট অদৃশ্য হতেই ওর দুই ঠোঁটের ফাঁক থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের মতো সবকিছু ভেতরে টেনে নেওয়ার শব্দ ভেসে এল। মুহূর্তখানেক পরে দেখা গেল, ওর পুরো মাথা পাইয়ের প্লেটের ভেতরে ডুবে গেছে। পনের সেকেন্ড পর মাথা তুলে ইশারা করল সে, শেষ। গাল-কপাল পুরোটা ব্লুবেরির রসে মাখামাখি হয়ে গেছে, দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো কৌতুকাভিনেতা। কিংবদন্তী বিল ট্র্যাভিস তখনো প্রথম পাইয়ের অর্ধেকও শেষ করতে পারেনি, অথচ সে এর মাঝেই আস্ত পাইটা সাবড়ে দিয়েছে।
মেয়র এসে পাইয়ের প্লেট পরীক্ষা করে ঘোষণা দিলেন, আসলেই শেষ। স্তম্ভিত দর্শক তালি দেওয়া শুরু করল। দ্বিতীয় আরেকটা পাই দেওয়া হলো ওর সামনে। কলসি হোগান মাত্র বেয়াল্লিশ সেকেন্ডের মধ্যে আস্ত একটা রেগুলেশন-সাইজের পাই শেষ করে ফেলেছে গড়েছে নতুন রেকর্ড। কিন্তু কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ না করেই দ্বিতীয় পাইটার উপরে আরো নির্দয়ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে, আবারো মাথাটা ডুবে গেল ব্লুবেরির ভেতরে। বিল ট্র্যাভিস দ্বিতীয় পাই চেয়ে নেওয়ার সময় উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়েছিল কিছুক্ষণ। পরবর্তীতে বন্ধু-বান্ধবকে সে বলেছে, ১৯৫৭ সালের পরে প্রথমবারের মতো ওর কাছে মনে হয়েছিল, একটা সত্যিকার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সেবার জর্জ গ্যামেশ চার মিনিটে তিনটা পাই সাবড়ে দিয়েছিল, কিন্তু তারপরেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায়। সেই সাথে এই প্রথম সে ভাবছিল, কোনো কিশোরের সাথে পাল্লা দিচ্ছে, নাকি স্বয়ং শয়তান নেমে এসেছে পাই খাওয়ার জন্য। যে পরিমাণ বাজি ধরা হয়েছে ওকে নিয়ে, সে কথা ভেবে দ্বিগুণ উদ্যমে পাই খাওয়ায় লেগে পড়ল বিল ট্র্যাভিস। এদিকে দ্বিগুণের বিপরীতে কলসি হোগান তিনগুণ উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ল পাইয়ের ওপর, প্লেট থেকে ব্লুবেরি ছিটকে উঠতে লাগল, জ্যাকসন পোলোকের পেইন্টিংয়ের মতো ভরে উঠল চারপাশের টেবিল ক্লথ। চুলে, গালে, কপালে, ঘাড়ে–সবখানে ব্লুবেরি মাখামাখি হয়ে গেছে, অবস্থাদৃষ্ঠে মনে হচ্ছে, ঘামছেও ব্লুবেরিই। এ সময় দ্বিতীয় পাইয়ের প্লেট থেকে মাথা তুলে চিৎকার করল সে, শেষ! অথচ বিল ট্র্যাভিস নতুন পাইটার ক্রাস্টও খেয়ে শেষ করতে পারেনি এখনো।
হিজোনার বিড়বিড় করে বললেন, এখন তোমার আরেকটু আস্তে-ধীরে খাওয়া উচিত। আসলে মেয়র শারবোন নিজেও বিলের ওপর দশ ডলার বাজি ধরেছেন। বললেন, শেষ পর্যন্ত নিজেকে ধরে রাখতে চাইলে একটু স্থির হতে হবে।
হোগানকে দেখে মনেই হচ্ছে না, আদৌ কিছু শুনেছে। তৃতীয় পাইটার ওপর প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়ল, চোয়ালদুটো যেন আলোর গতিতে চলছে। এই পর্যায়ে একটু থেমে কিছু জিনিস বলে নেওয়া দরকার। কলসি হোগানের বাসায় মেডিসিন কেবিনেটে একটা খালি বোতল পড়ে ছিল। বোতলটার তিন-চতুর্থাংশ আগে গোলাপি-হলুদ রঙের ক্যাস্টর অয়েলে ভর্তি ছিল। এই ক্যাস্টর অয়েলকে বলা যায় পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ এবং অস্বাস্থ্যকর তরল, স্রষ্টা তাঁর অসীম প্রজ্ঞা ব্যবহার করে এরচেয়ে ভয়াবহ আর কিছু এই পৃথিবীতে পাঠাননি। তো, কলসির বাচ্চা স্বেচ্ছায় এই বোতল পুরোটা খালি করে মাথাটা পর্যন্ত যতটা সম্ভব চেটেপুটে খেয়েছে। গলা মোচড়াচ্ছিল, পেট হাঁসফাঁস করছে, উগরে দিতে চাইছে সবকিছু, কিন্তু মাথাভর্তি মধুর প্রতিশোধ চিন্তার কারণে এসব কিছুকে একদমই পাত্তা দেয়নি সে।
মূল গল্পে ফেরা যাক। তৃতীয় পাইয়ের উপরে হামলা চালিয়েছে কলসি হোগান। এদিকে যেমন ধারণা করা হয়েছিল, কেলভিন স্পায়ার প্রতিযোগীতা থেকে পুরোপুরি ছিটকে গেছে, একটা পাইও এখনো শেষ করতে পারেনি। কলসি এখনো নিজের ওপর অত্যাচার করেই যাচ্ছে, পাইকে আর পাই মনে হচ্ছে না ওর, গোবরের সাথে স্বাদের কোনো পার্থক্য নেই যেন। আসলে পাই হিসেবে তো খাচ্ছেও না সে। সামনে যাই থাকুক, মরা ইঁদুর কিংবা পঁচা-গলা নাড়িভুঁড়ি হলে সেটাই খেত, কিংবা কাঠপোকার গায়ে ব্লুবেরি সস মাখিয়ে দিলে গপাগপ গিলে যেত একটানা।
তৃতীয়টা শেষ করে চতুর্থটা চাইল সে, কিংবদন্তীর বিল ট্র্যাভিস থেকে পুরো এক পাই এগিয়ে আছে। দর্শকরা অস্থির হয়ে উঠেছে, বুঝতে পারছে, নতুন এক চ্যাম্পিয়ন পেতে যাচ্ছে তারা। উত্তেজনা চেপে বসেছে, সবকিছু ভুলে চিৎকার করে কলসি হোগানকে উৎসাহ দিচ্ছে সবাই মিলে।
কিন্তু যাকে নিয়ে এত কিছু, তার জেতার কোনো ইচ্ছেই নেই। যে গতিতে সে খেয়ে যাচ্ছে, নিজের মায়ের জীবন পুরষ্কার থাকলেও এই গতিতে খাওয়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না। আর, জেতা মানে তো ওর জন্য হেরে যাওয়া। শুধু প্রতিশোধ নিতে চায় সে, আর কিছু না। পেটের মাঝে ক্যাস্টর অয়েল চ্যাঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে, গলা অসুস্থভাবে বন্ধ হয়ে আসছে– এর মাঝেও চতুর্থটা শেষ করে আরো একটা পাই চাইল সে। এই পর্যায়ে এসে যে ব্লুবেরি-পাই দেওয়া হয়, সেগুলো আগেরগুলোর তুলনায় অনেক বড় এবং ভারি হয়, এদেরকে বল হয় ইলেক্টা। আবারো প্লেটে মাথা ঢুকিয়ে দিল, ক্রাস্ট ভাঙছে, নিশ্বাসের সাথেও বেরিয়ে আসছে ব্লুবেরি।
শার্টও নীল হয়ে গেছে। পাকস্থলী প্রচন্ড ভারি হয়ে উঠেছে। কোনোরকমে ক্রাস্টটুকু চিবিয়ে গিলে নিল, নাকে-মুখে ব্লুবেরি সাবড়ে যাচ্ছে।
অবশেষে প্রতিশোধের সময় এসেছে। পাতলা এবং পিচিছল কোনো রাবার গ্লাভসের মধ্যে বড় মাপের হাত ঢুকিয়ে দিলে সবকিছু যেমন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়, গ্লাভসটা যেমন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে; ওর পাকস্থলীও তেমনি বিদ্রোহ করতে চাচ্ছে। আর নিতে পারছে না।
যেন আপনা থেকেই গলাটা খুলে গেল।
প্লেট থেকে মাথা তুলে বিল ট্র্যাভিসের দিকে তাকিয়ে নীলচে দাঁত বের করে মুখ খুলে হাসল কলসি হোগান।
ছয়টনি পিটারবিল্ট ট্রাক ঊর্ধ্বশ্বাসে কোনো টানেলের মধ্যে দিয়ে ছুট দিলে যেমন হয়, সেভাবেই ছুটে এল বমির প্রচন্ড স্রোত। নীল এবং হলুদের মিশ্র তরল প্রবল গর্জনে বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে। উষ্ণ তরল আছড়ে পড়ল বিল ট্র্যাভিসের ওপর–এর আগে একটামাত্র অর্থহীন শব্দ উচ্চারণের সময় পেয়েছিল সে, যেটা শুনে মনে হলো বলেছে, গগ! দর্শকদের মধ্যেকার মহিলারা চিৎকার করে উঠল। বোকা বোকা এবং অবাক চোখে তাকিয়ে অঘোষিত নির্মম রসিকতাটুকু দেখছিল কেলভিন স্পায়ার। হঠাৎ পেছনে ফিরে দর্শকদের দিকে ঘুরে বসল সে, যেন একটু দূরে দাঁড়ানো সবাইকে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে চাচ্ছে, কী ঘটছে; এবং মুহূর্তের মাঝে মেয়রের স্ত্রী, মার্গারেট শারবোর মাথায় বমি করে দিল। প্রচন্ড চিৎকারে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে পিছিয়ে এলেন ভদ্রমহিলা, প্রবলভাবে মাথা ঝাঁকাচ্ছেন, চুলে লেগে থাকা সবকিছু ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন। তাঁর চুল এখন চিবোনো ব্লুবেরি, বেক করা শিমের বীচি এবং সসেজ আর গরুর মাংস দিয়ে বানানো ফ্রাঙ্কফুর্টে মাখামাখি হয়ে গেছে (ব্লুবেরি ছাড়া বাকিসব আসলে কেলভিনের রাতের খাবার থেকে এসেছে)। বান্ধবী মারিয়া লেভিনের দিকে ফিরে বাকস্কিনের জ্যাকেটের ওপর বমি করে দিলেন বেচারী।
তারপরে সবকিছু এত দ্রুত ঘটল, একে বরং মূল ঘটনার চেয়ে সেটার রিপ্লে বললেই বেশি মানাবে। দর্শকদের প্রথম দুই সারির ওপর প্রচণ্ডভাবে এবং ব্যাপক পরিমাণে বমি উগরে দিল বিল ট্র্যাভিস। মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যেন বলতে চাইছে: আমি এমন কিছু করছি, সেটা আমার কোনোভাবেই বিশ্বাস হচ্ছে না! বিল ট্র্যাভিসের কাছ থেকে সারপ্রাইজ গিফট পাওয়াদের একজন, চাক ডে, নিজেরই পায়ের দামি হাসপাপিস জুতোর উপরে বমি করে দিল। তারপর সেদিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করতে লাগল, বুঝতে পারছে, এই দাগ জীবনেও উঠবে না। ঘেতনা এলিমেন্টারি স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল জন উইগিন্স নীলে মাখামাখি মুখ খুলে অসন্তুষ্ট গলায় বলছিলেন: এটা আসলেই, ইয়া-র-ক! ভাগ্য ভালো, নিজের মান রেখে নিজেরই পাইয়ের প্লেটে উগরে দিলেন সবকিছু। হিজোনার শারবোন অবাক হয়ে দেখলেন, জায়গাটাকে পাই খাওয়ার প্রতিযোগীতার চেয়ে বরং পাকস্থলীর ফ্লু-এর চিকিৎসা করে, এমন কোনো হাসপাতালের ওয়ার্ড বলে মনে হচ্ছে। আনুষ্ঠানিকভাবে পুরো ব্যাপারটার সমাপ্তি ঘোষণা দিতে মুখ খুলেছিলেন, তাঁর মুখ থেকে হড়হড় করে বেরিয়ে আসা সবকিছু গিয়ে পড়ল মাইক্রোফোনের উপরে। সিলভিয়া ডজ আর্তনাদ করে বললেন, জিশু, রক্ষা করো! ব্যাস, ওইটুকুই। তার পেটের ভেতরে ফুঁসতে থাকা রাতের খাবার-ঝিনুক ভাজা, বাঁধাকপি, ভুট্টা, মাখন এবং মুরিয়েল হ্যারিংটনের বস্কো চকলেট কেক-জরুরি বহির্গমন পথ ধরে সবকিছু একসাথে বেরিয়ে এল এবং মেয়রের রবার্ট হল স্যুট-কোটের পেছনে সজোরে হামলে পড়ল। কৈশোরের সবচেয়ে দারুণ মুহূর্তে পৌঁছে গেছে কলসি হোগান, দর্শকদের দিকে তাকিয়ে হাসছে। পুরো এলাকা ভরে গেছে বমিতে। এর মাঝেই আরো মানুষকে দেখা যাচ্ছে, মাতালের মতো টলছে। গলা চেপে ধরেছে অনেকে, কাশি আর দুর্বলভাবে গলা খাঁকারি দেওয়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে সবখানে। কার যেন একটা পোষা পাপি-কুকুর স্টেজের একপাশে দাঁড়িয়ে পাগলের মতো ঘেউ ঘেউ করছিল, জিন্স আর পশ্চিমা স্টাইলের সিল্কশার্ট পরা একজন ওর উপরেই বমি করে ভাসিয়ে ফেলল। স্থানীয় মন্ত্রীর স্ত্রী, মিসেস ব্রকওয়ে খাবি খাওয়ার ভঙ্গিতে প্রকান্ড এক ঢেঁকুর তোলার মতো শব্দ করলেন, পরক্ষণেই তাঁর মুখ থেকে গরুর মাংস, আলুভর্তা এবং কুচি কুচি কাটা আপেলের ডেজার্টের বদহজম বেরিয়ে এল। আপেলের ডেজার্ট দেখে মনে হচ্ছিল, খাওয়ার সময় জিনিসটা আসলেই দারুণ ছিল। জেরি মেলিং তাঁর পোষা মেকানিকের জয় দেখতে এসেছিলেন, এই ভয়াবহ অবস্থা দেখে পাগলের আড়া থেকে কেটে পড়ার সিদ্ধান্ত নিতে তার মুহূর্তখানেকের বেশি লাগেনি। পনের গজের মতো ভালই এগিয়েছিলেন, তারপর এক পিচ্চির লাল ওয়াগনে পা পড়ে গেল। সেই মুহূর্তে মেলিং উপলব্ধি করলেন, একগাদা বমির মাঝে পা ফেলেছেন, এবং নিজের গায়েই উগরে দিলেন নিজের সবটুকু। পরে তিনি বলেছিলেন, কোম্পানির কাজের জন্য কভারঅল পরে থাকায় স্থানীয় ম্যানেজারকে মন থেকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। এদিকে ঘেতনা কনসোলিডেটেড হাই স্কুলের লাতিন এবং ইংরেজি-শিক্ষিকা মিস নরম্যান নিজের মানসম্মান বাঁচানোর শেষ উপায় হিসেবে আটকে রাখতে না পেরে নিজের পার্সেই কাজ সারতে বাধ্য হয়েছিলেন।
এসবই দেখতে পাচ্ছিল কলসি হোগান। শান্ত মুখে উপভোগ করছিল, পুরো চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। পাকস্থলী জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে মিষ্টি এবং উষ্ণ শান্তির অনুভূতি–এক জীবনে এমন শান্তি আর কখনো হয়তো অনুভব করবে না। পরিপূর্ণ তৃপ্ত সে। উঠে দাঁড়িয়ে মেয়র শারবোর কাঁপা হাত থেকে মাইক্রোফোনটা নিয়ে নিল, কোনোরকমে ধরে বলল…
অধ্যায় ১৭
আমি এই প্রতিযোগীতা ডু ঘোষণা করলাম। তারপর মাইক্রোফোনটা নামিয়ে রেখে মঞ্চের পেছন দিক দিয়ে নেমে হাঁটা শুরু করল বাড়ির উদ্দেশ্যে। ওর মা বাড়িতেই ছিলেন, কলসির দুই বছর বয়সের ছোট বোনের জন্য বেবিসিটার খুঁজে না পাওয়ায় থেকে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। বমি আর পাইয়ের রসে মাখামাখি হয়ে বাসায় পৌঁছাতেই তিনি জানতে চাইলেন, তুমি জিতেছ, ডেভ?
একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি সে, বুঝলি? সোজা ওপর তলায় নিজের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে সটান বিছানায় শুয়ে পড়েছিল।
ক্রিসের কোকের বোতলের তলানীটুকুতে শেষ চুমুক দিয়ে বোতলটাকে বনের দিকে ছুঁড়ে মারলাম।
দারুণ! কিন্তু তারপর কী হলো? টেডির গলায় প্রবল কৌতূহল।
আমি জানি না।
মানে কী?
মানে, গল্পটা এখানেই শেষ। গল্পের যে পর্যায়ে এসে তারপর কী হয়েছে, তা আর জানা যায় না–সেটাই শেষ।
কী? ভার্নকে দেখে মনে হলো কেঁদে ফেলবে। ওর মুখে সন্দেহের ছায়ার সাথে প্রচন্ডরকম আশাহত হওয়ার ছাপও দেখা যাচ্ছিল, যেন টপসহ্যামের মেলায় কেউ ওকে কার্ড খেলায় হারিয়ে শেষ পয়সাটাও হাতিয়ে নিয়েছে।
কিন্তু কী যেন দারুণ শেষ হওয়ার কথা বলল, সেটার কী হলো?
জবাব দিল ক্রিস, নিজের কল্পনা শক্তিটা একটু ব্যবহার করতে হবে
আমি কেন করব? রাগান্বিত গলায় ভার্ন বলছিল, কল্পনা শক্তি ব্যবহার করার কথা ওর! শালা নিজে গল্পটা বানিয়েছে!
হ্যাঁ, তাই তো, টেডিও তাল মেলাল, কী হলো তারপর ওর, বল। বল, গর্ডি।
যথাসম্ভব ওর বাবা পাই-ইট প্রতিযোগিতা দেখতে গিয়েছিল এবং বাসায় এসে ওকে পিটিয়ে একশেষ করেছে।
ক্রিস সমর্থন দিল আমাকে, আমি নিশ্চিত, এটাই হয়েছে।
আর, সবাই ওকে পাছা মোটা কলসি হোগান তো বলতই, সাথে কেউ কেউ ওকে বমির ঢেলা বলেও ডাকতে শুরু করেছিল।
শেষটা একদম ফালতু। টেডির গলায় দুঃখ।
সেজন্যই বলতে চাচ্ছিলাম না।
তুই তো অন্যরকমও বানাতে পারতি শেষটা। হয়তো সে বাবাকে গুলি করে দিয়ে পালিয়ে গেছে এবং পরে টেক্সাস রেঞ্জারদের দলে যোগ দিয়েছে। কেমন হয়, বলতো?
টেডির কথা শুনে ক্রিস আর আমি দৃষ্টি বিনিময় করলাম। এক কাঁধ তুলে ত্যাগ করল ক্রিস, সম্ভব।
আচ্ছা, গর্ডি, তোর কাছে আর কোন লা ডিও সিরিজের গল্প আছে?
এখন নেই। পরে আবার বানাব হয়তো। টেডিকে আপসেট করতে ইচ্ছে হচ্ছিল না, সেজন্যেই এভাবে বলা। আসলে লা ডিও শহরের কোথায় কী হচ্ছে, এ নিয়ে কোনো আগ্রহ ছিল না আমার। তোর এটা ভালো লাগেনি, সরি।
না, শেষের আগ পর্যন্ত তো ভালই ছিল। বিশেষ করে, এই যে সবার বমি করে দেওয়া, এটা আসলেই দারুণ ছিল।
হ্যাঁ, আসলেই দারুণ ছিল। যাকে বলে, জটিল, কঠিন, উরাধুরা! কিন্তু শেষের ব্যাপারে টেডি ঠিকই বলেছে, একমত হলো ভার্ন, কেমন যেন।
হাই তুলতে তুলতে সায় দিলাম, হুম।
কিছুক্ষন পরে ক্রিস উঠে দাঁড়াল। বলল, চল, একটু হাঁটা যাক।
তখনো দিনের আলো জ্বলজ্বল করছে। সূর্যের উত্তাপ গায়ে এসে হামলে পড়ছে আর আকাশটাকে মনে হচ্ছে গাঢ় নীল পেইন্টিং। কিন্তু আমাদের ছায়া এরই মাঝে কিছুটা লম্বা হয়ে পড়তে শুরু করেছে। মনে আছে, যখন আরো ছোট ছিলাম, সেপ্টেম্বরের দিনগুলো কেমন তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গিয়ে আমাকে প্রতিনিয়ত চমকে দিত। মনে হতো যেন বুকের ভেতরে একটা অদ্ভুত কিছু আছে, যেটা সবসময় চায়, দিনগুলো কেবল জুনের মতোই হোক সাড়ে নয়টা পর্যন্ত দিনের কোমল মৃদু আভা ঝুলে থাকুক আকাশে।
কয়টা বাজে, গর্ডি?
ক্রিসের কথা শুনে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম, পাঁচটার বেশি বেজে গেছে।
হ্যাঁ, চল তাহলে। আবার হাঁটা শুরু করা যাক, টেডি বলল, কিন্তু অন্ধকার নামার আগেই ক্যাম্প করে ফেলতে চাই। তাহলে কাঠসহ যা যা লাগে, সব জোগাড়যন্ত্র করা যাবে ঠিক করে। আর, আমার খিদেও পাচ্ছে
তাহলে সাড়ে ছয়টার দিকে থামব, ঠিক আছে? ক্রিস কথা দিল। ক্রিসের প্রশ্নের জবাবে সবাই মাথা ঝাঁকালাম। ঠিকই আছে। তারপর আবার হাঁটতে শুরু করলাম সবাই মিলে। রেললাইনের পাশের নুড়িগুলোর পাশ দিয়ে এগোতে লাগলাম। কিছুক্ষণের মাঝেই নদী অনেকটা পেছনে পড়ে গেল। স্রোতের আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছিল না। মশার গান আর শুধু চাপড়ের শব্দ। পিঠে আর ঘাড়ে থাপ্পড় মেরে মেরে পোকা তাড়াতে হচ্ছিল। ভার্ন আর টেডি আগে আগে হাঁটছে আর গভীর মনোযোগ দিয়ে কমিক্স বইয়ের জটিল কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছে। ক্রিস দুই হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে আমার পাশে পাশে আসছিল। বাতাসে ওর শার্ট উড়ছে অ্যাপ্রনের মতে, হাঁটু আর উরুতে বাড়ি খাচ্ছে একটু পরপর।
আমার কাছে কিছু উইনস্টন আছে, সে বলল। বাবার ড্রেসার থেকে মেরে দিয়েছি। রাতের খাবার খেয়ে সবাই একটা করে খেতে পারবে।
তাই? গ্রেট!
হ্যাঁ, ওই সময় ধুমপান করতে সবচেয়ে ভালো লাগে। মানে, রাতের খাবারের পর।
হুম।
কিছুক্ষন চুপচাপ হাঁটার পরে হঠাৎ বলে উঠল, গল্পটা আসলে ভালো, কিন্তু সেটা বোঝার মতো বোধ তৈরি হয়নি ওদের এখনো।
অত ভালোও না, বলার জন্য বলা আরকি।
তুই সবসময়ই এসব বলিস। নিজে যেটা বিশ্বাস করিস না, ওসব ফালতু কথা বলিস কেন, বলতো? আচ্ছা, তুই লিখবি না গল্পটা?
হয়তো, কিন্তু এখনই না। বলার সাথে সাথে লিখতে পারি না আমি। একটু সময় লাগে।
ভার্ন যে শেষটুকুর ব্যাপারে বলল না? ফালতু, মানে, ঠিক জুতসই না?
হ্যাঁ?
ক্রিস হেসে ফেলল, জীবন খুব ফালতু জিনিস রে, কখনোই জুতসই হয় না। আমাদের কথাই ভাব।
কেন? সময়টা তো ভালোই যাচ্ছে।
অবশ্যই! কী যে দারুণ সময় গেছে এতগুলো বছর!
আমি হেসে ফেললাম। ক্রিসও হাসছে।
একটুখানি চুপ থাকার পর আবার বলল, সোডার বোতল থেকে যেমন বুদবুদ ওঠে না, তোর থেকেও ওভাবে বের হয়ে আসে এগুলো।
কী? জিজ্ঞাসা করলেও বুঝতে পারছিলাম, কী বলছে।
গল্প। জিনিসটা কেমন অদ্ভুত লাগে আমার কাছে। মনে হয়, তুই লাখ লাখ গল্প বলে ফেললেও কেবল সামান্য কিছুই বলা হবে, অনেক কিছু না বলাই থেকে যাবে শেষ পর্যন্ত। গর্ডি, তুই কোনোদিন অনেক ভালো লেখক হবি, বুঝলি?
মনে হয় না।
হ্যাঁ, হবি। হয়তো গল্পে টান পড়লে কোনোদিন আমাদেরকে নিয়েও লিখবি।
কথা শুনে কনুই দিয়ে তো দিলাম, সেজন্য ভালো টান পড়া লাগবে!
আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ হেঁটে যাওয়া। তারপর আবার প্রশ্ন করল, তুই কি স্কুলে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত?
শ্রাগ করলাম। কিন্তু স্কুলে যাওয়ার জন্য কে প্রস্তুত থাকে আসলে? হ্যাঁ, ফিরে গিয়ে বন্ধুদের সাথে দেখা করার কথা ভেবে হয়তো মনে মনে বেশ একটু উত্তেজনা বোধ করা যায়। কিংবা নতুন শিক্ষকরা কেমন হবে, সেটা ভেবে কিছুটা আগ্রহ তৈরি হয় যেমন, এরা কি সদ্য টিচার্স কলেজ পাশ করা তরুণ শিক্ষক হবে, যাদের সাথে একটু মজা নেওয়া যায়; নাকি বুড়ো হাবড়া টাইপ কেউ হবে। হয়তো বিরক্তিকর ওসব দীর্ঘ ক্লাসের কথা ভেবে অদ্ভুত কোনো কারণে ভালোও লাগতে থাকে। কারণ যথা সম্ভব, গ্রীষ্মের দীর্ঘ ছুটি শেষ হতে হতে কিছুটা বিরক্তি চলে আসে, মনে হতে থাকে, হয়তো এবারে স্কুলে গিয়ে নতুন কিছু শেখা হলেও হতে পারে। কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে, গ্রীষ্মের এই বিরক্তি আর স্কুলের দ্বিতীয় সপ্তাহে পড়াশোনা নিয়ে তৈরি হওয়া বিরক্তিবোধের মধ্যে পার্থক্য আছে। আর, ওর হাত ধরে তৃতীয় সপ্তাহের শুরুতে আসল জিনিস শুরু হয়েই যায়: স্যার যখন ব্ল্যাকবোর্ডে দক্ষিণ আমেরিকার বড় বড় শহরের নাম লেখায় ব্যস্ত, সে সময় ওই দুর্গন্ধের রাজা ফিস্কের মাথার পেছনে পেপার বুলেট মারা যাবে তো? হাত ঘেমে গেলে ডেস্কের মধ্যে বাড়ি মেরে জোরে শব্দ করা সম্ভব? কটা মেয়ে দুপুরের খাবারের ছুটিতে তাদেরকে ধরার, অনুভব করার সুযোগ দেবে? উচ্চশিক্ষা বলে কথা!
বুঝলি গর্ডি, আগামী জুন আসতে আসতে আমাদের মধ্যে আর কোনো যোগাযোগ থাকবে বলে মনে হয় না।
কী বলিস? কেন?
কারণ, আমরা জুনিয়র হাইস্কুলে ভর্তি হব। এটা সেই পিচ্চিকালের গ্রামার স্কুলের মতো হবে না অবশ্যই। আমি, টেডি আর ভার্ন যে কোর্স করব, তুই সেটা করবি না। তুই করবি কলেজ কোর্স, আর আমরা করব দোকানের কোর্স। কীভাবে পাখির বাসা বানাতে হয় কিংবা পট-ওসব শিখব। কাজের ফাঁকে ফালতু ছেলেপেলের সাথে পকেট পুল খেলে সময় যাবে। ভার্নকে হয়তো বিশেষ বাচ্চাদের জন্য বানানো রেমেডিয়াল স্কুলেও চলে যেতে হতে পারে। আর, তোর সাথে কত নতুন মানুষের পরিচয় হবে! তোর মত বুদ্ধিমান, স্মার্ট! এমনই হয়, বুঝলি। শালারা সিস্টেমটাই এমন বানিয়ে রেখেছে।
বলতে চাচ্ছিস, একগাদা ফার্মের মুরগির সাথে আমার পরিচয় হবে, তাই তো?
না রে, এভাবে বলিস না। ক্রিস আমার কাঁধে মৃদু ঝাঁকি দিল। ভুলেও এভাবে চিন্তা করিস না, প্লিজ। তোর মধ্যে কত কত গল্প যে জমে আছে! ভার্ন আর টেডি হয়তো গল্প শুনে সবসময় বুঝতে পারত না, কিন্তু কলেজের ওরা ঠিকই বুঝবে, দেখিস।
গল্প জাহান্নামে যাক। আমি ওসব ফার্মের মুরগির সাথে ভুলেও কোনো কোর্স নিচ্ছি না।
না নিলে তুই একটা গাধা।
কেন? বন্ধুদের সাথে থাকতে চাওয়াটা গাধামী হবে কেন? ক্রিস তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকাল। মনে হচ্ছিল, কিছু একটা নিয়ে ভাবছে। বুঝতে পারছে না, আমাকে বলবে কী বলবে না। এর মাঝেই আমরা অনেকটা পেছনে পড়ে গেছি। ভার্ন আর টেডি প্রায় আধা মাইলের মতো সামনে এগিয়ে গেছে। আমাদের মাথার উপরে গাছের ভাঙা ডালের ফাঁক দিয়ে অস্তগামী সূর্যের আলো ভেসে আসছে। শেষ বিকেলের আলোয় সবকিছুকে মনে হচ্ছে সোনালী কিন্তু ঠিক অভিজাত স্বর্ণালী না, শুষ্ক, সস্তা দোকানগুলোয় যেমন দেখা যায়, সেরকম। ব্যাপারটা ঠিক বলে বোঝানোর না, কেমন যেন। আমাদের সামনে রাস্তাটা এগিয়ে গেছে, দূরে, বহুদূরে নিঃসঙ্গ বিষণ্ণতা জমাট বাঁধছে বলে মনে হচ্ছে। এর মাঝে গাছের পাতা, ভাঙা ডালের ফাঁক দিয়ে জায়গায় জায়গায় তারকাকৃতির আলো এসে পড়ছে, যেন খুব ধনী কেউ মিস্ত্রীর ছদ্মবেশে এসে ষাট গজ পরপর ইস্পাতের মধ্যে একটি করে হীরে বসিয়ে দিয়ে গেছে। তারপরও গরম কমেনি সেভাবে। ঘাম গড়িয়ে পড়ছে, জবজবে দেহ পিচ্ছিল হয়ে গেছে।
বন্ধুরা যদি তোকে টেনে নিচে নামায়, তাহলে এটা তো বোকামিই, ক্রিসের গলা শুনে মনে হলো, শেষ পর্যন্ত বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তোর বাবা-মার ব্যাপারটা আমি জানি। জানি, ওরা তোর ব্যাপারে ওভাবে কেয়ার করে না। ওরা আসলে তোর বড় ভাইয়ের ব্যাপারে অনেক বেশি যত্নশীল ছিল। ঠিক আমার বাবার মতো, বুঝলি? ডেভ যখন জেলে গেল, আব্বা তখন থেকে সারাক্ষণ আমাদের ওপর ক্ষেপে থাকত আর আমাদের কাউকে সামনে পেলেই মার দিত। তোর বাবা তোকে মারে না, আমি জানি, কিন্তু এটা মনে হয় আরো বেশি কষ্ট দেয়, তাই না? মনে হয় যেন, তোকে নিজেদের জীবনে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। হয়তো তোর বাবাকে যখন বলতে যাবি, আব্বু, আমি দোকান নিয়ে কোর্স করতে চাই, তোর বাবা হয়তো পত্রিকার পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলবে, ভালোই তো। আচ্ছা, তোমার মাকে জিজ্ঞাসা কর তো, আজকে রাতের খাবারের কী আয়োজন করেছে? বলিস না, আমি ভুল কিছু বলছি। তোর বাবার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। আমি জানি।
আমি ক্রিসকে একবারও বলার চেষ্টা করিনি, সে ভুল কিছু বলছে। বরং কিছুটা সিঁটিয়ে গিয়েছিলাম। আপনার নিজের সাথে ভয়াবহ যেসব জিনিস ঘটছে, সে ব্যাপারে আর কারো স্পষ্ট ধারণা আছে–হোক সে আপনার বন্ধু–ব্যপারটা প্রচন্ড ধাক্কা দেবে আপনাকে। কেমন যেন ভয় পাইয়ে দেবে।
তুই এখনো কেবল একটা বাচ্চা, গর্ডি–
ধন্যবাদ, আব্বু!
আমি তোর বাবা হলেও এরচেয়ে ভাল হত! ক্রিসের গলায় স্পষ্ট রাগ। তখন তুই ভুলেও ওসব দোকানের কোর্স নেওয়ার কথা ভাবতেও পারতি না। ব্যাপারটা এমন যে, স্রষ্টা নিজে তোকে ওই গল্পগুলো দিয়ে বলেছে, এই যে নাও। হারিয়ে ফেলো না, বুঝেছ? আর তুই সেগুলো ইচ্ছে করে হারিয়ে ফেলতে চাচ্ছিস। বোকা ছেলেপেলেরা যেমন করে, কারো সাহায্য না পেলে, যত দামি জিনিসই হোক রাখতে পারে না। হারিয়ে ফেলে। আর, তোর বাবা-মা যদি তোর খেয়াল না রাখার মতো স্টুপিড হয়ও, আমি তো আর স্টুপিড না, তাই না? আমি ঠিকই খেয়াল রাখতাম।
দেখে মনে হচ্ছিল, ক্রিস বুঝি নিজে থেকেই চাচ্ছে যাতে আমি ওকে আঘাত করি। শেষ বিকেলের সোনালী-সবুজ আলোয় ওর করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, আমার কথা ভেবে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে ওর। অলিখিত একটা নিয়ম ভেঙেছে সে। পছন্দের কাউকে যা ইচ্ছে বলো, চাইলে কুকুর লেলিয়ে দাও, গালিগালাজ করো, কিন্তু ওর বাবা-মার ব্যাপারে ভুলেও উল্টাপাল্টা কিছু বলতে যেও না। সে সময়ের ভাষায় এসব অলঙ্নীয় নিয়মকে বলত দ্য ফ্যাবল অটোমেটিক। যেমন, ক্যাথলিক কোনো বন্ধুকে শুক্রবার বাসায় দাওয়াত না দেওয়া ছিল ফ্যাবল অটোমেটিক। তারপরেও, যদি দিতেই হয়, আগে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে, বাসায় যেন ভুলেও মাংস রান্না না হয়। ফ্যাবল অটোমেটিক নিয়ে সবাই খুব সতর্ক থাকত। কেউ যদি ভুলেও বাবা-মাকে নিয়ে কিছু বলে, এক কথায়, পিটিয়ে ছাতু বানানোর আগে কোনো ছাড়াছাড়ি নেই।
তুই যে গল্পগুলো আমাদের বলিস, ওগুলো তুই ছাড়া আমাদের কারো কাছেই তেমন কোনো অর্থ বহন করে না, গর্ডি। গ্যাং ছাড়তে চাস না, শুধু এজন্যেই যদি আমাদের সাথে থেকে যাস, ক্রিস বলে যেতে লাগল, তাহলে তুই ফালতু একটা মানুষ হিসেবে বড় হবি। মেধা থাকার পরেও পাড়ার মাস্তানদের সাথে মেশার জন্য যারা পরীক্ষায় সি-গ্রেড পায়, সেরকম। নেশা করে হাই হয়ে থাকবি, দোকানের কোর্স নিয়ে সময় নষ্ট করবি, এবং বাকিদের সাথে তাল মিলিয়ে ক্লাসে ঝামেলা করতে গিয়ে শেষে ডিটেনশন খাবি। হয়তো এক সময় সাসপেন্ডই করে দেবে তোকে। এক জীবনে তোর আর ক্যাসল রকের বাইরের জীবনের ব্যাপারে কিছু জানা হবে না। কয়দিন পর ভাবতে থাকবি, কখন একটা গাড়ি কেনা যায়, যাতে ধরেটরে মোটামুটি একটা মেয়ে জুটানো যায়। তারপর বিয়ে করে, কোনো কারখানা বা জুতার দোকানে কাজ করে এক জীবন কাটিয়ে দেওয়া। সেই পাই খাওয়ার গল্প আর লেখা হবে না তোর। কিছুই লেখা হবে না। মেধাবী হয়েও যারা গোবর দিয়ে মাথা ভর্তি করে ফেলে, তাদের মত আরেকজন হয়ে উঠবি কেবল। তুই কি তাই চাস?
এই কথাগুলো যখন আমাকে বলেছিল, ক্রিস চেম্বার্সের বয়স তখন বারো। কিন্তু গলায় এমন কিছু একটা ছিল, যেজন্য মনে হচ্ছিল সে বুঝি অনেক বয়স্ক। অনন্তকাল ধরে জীবনের স্রোতে ভাসতে থাকা এক নাবিক। অনেক দূর থেকে ভেসে আসা একঘেয়ে, রংহীন সুরে বলে যাচ্ছিল সে, তারপরও কেমন একটা ভয় এসে কাঁপিয়ে দিয়েছিল আমাকে। মনে হচ্ছিল যেন, ও এরই মধ্যে অমন একটা পুরো জীবন পার করে এসেছে। এমন একটা জীবন, যেখানে ওরা আপনাকে বলে সর্বস্ব বাজি ধরে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেখতে। ঘোরালে দারুণ ভাবে ঘুরতে থাকে, এবং শেষ পর্যন্ত ফলাফল নির্ধারণী কাঁটাটা ডাবল জিরোতে এসে থামে। সবাই হেরে যায়। ওরা তখন আপনাকে সৌজন্যবোধ থেকে রেইন মেশিনের ফ্রি টিকেট ধরিয়ে দিয়ে বলবে, একটু উপভোগ করে যান। ধন্যবাদ! কী হাস্যকর, না? এমন এক কৌতুক, যেটা এমনকি ভার্ন টেসিও পর্যন্ত বুঝতে পারত।
ক্রিস এত শক্তভাবে আমার বাহু চেপে ধরেছিল যে, আঙুলের ছাপ বসে যাচ্ছিল। একজন পরাজিত মানুষের জীবনের ব্যাপারে সেই বয়সেই বেশ ভালো ধারণা ছিল ওর। আমার হাড্ডির সাথে লেগে যাচ্ছিল চেপে বসা আঙুল, চোখ দুটো দেখে মনে হচ্ছিল ফ্যাকাশে, মৃত–যেন এই মাত্র কফিন থেকে পড়ে গেছে। ও বুঝতে পারছিল, আমি ঠিক কী ভাবছি।
আমি জানি, এই শহরের মানুষজন আমার পরিবারের ব্যাপারে, আমার ব্যাপারে কী ভাবে, কী আশা করে। কেউ এমনকি জিজ্ঞাসাও করেনি যে, আমি ওই দুধের টাকাটা আসলেই নিয়েছিলাম কি না। শুধু আমাকে তিন দিনের ছুটি দিয়ে দিয়েছিল।
নিয়েছিলি তুই? আসলেই? আগে কখনো জিজ্ঞাসা করিনি, এবং কেউ আমাকে যদি অমন কিছু জিজ্ঞাসা করতে বলত, আমি তাকে পাগল ছাড়া আর কিছু ভাবতাম না। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে…কেমন করে যেন আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল প্রশ্নটা।
হ্যাঁ, নিয়েছিলাম। ক্রিসের গলা খুব ক্লান্ত শোনাল, নিয়েছিলাম আমি। এক মুহূর্ত চুপ থেকে দূরে, টেডি আর ভার্নের দিকে তাকিয়ে বলল, তুই জানতি, আমি নিয়েছিলাম। টেডি জানতো, সবাই জানতো। আমার ধারণা, এমনকি ভানও জানতো, আমি টাকাটা নিয়েছিলাম।
একবার ভাবলাম অস্বীকার করব। কিন্তু মুখ খুলেও আবার চুপ করে গেলাম। বাবা-মার সাথে এই নিয়ে এমনকি তর্কও করেছিলাম আমি। ওনাদেরকে বলেছিলাম, দোষী প্রমাণ হওয়ার আগ পর্যন্ত সব মানুষই নির্দোষ। যত যাই বলি, মনের গভীরে কোথাও ঠিক ঠিক সত্যটা জানতাম।
কিন্তু তারপরে হয়তো আমার খারাপ লাগতে শুরু করায় টাকাটা ফিরিয়েও দিয়েছিলাম। ক্রিসের কথা শুনে ফিরে তাকালাম, তুই ফিরিয়ে দিয়েছিলি?
হয়তো বলেছি, হয়তো। হয়তো আমি বুড়ি সিমনসের কাছে টাকাটা নিয়ে গিয়ে ওনার কাছে সব স্বীকার করেছিলাম এবং ওনাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম পুরো টাকাটা। আর, হয়তো তারপরেও স্কুল থেকে তিন দিনের জন্যে বহিষ্কৃত হয়েছিলাম, কারণ, যত যাই করি, ওই টাকাটা আর কখনো স্কুলে ফিরে যায়নি। এবং সপ্তাহখানেক পর যখন বুড়ি সিমনস স্কুলে এসেছিলেন, হয়তো ওনার পরনে একটা নতুন ওড়না দেখেছিলাম।
হতভম্বের মতো ক্রিসের দিকে তাকিয়ে ছিলাম আমি। পুরো ব্যাপারটা এত নিমর্ম যে, একেবারে বাক্যহারা হয়ে গিয়েছিলাম। কী-ইবা বলার আছে আমার? ক্রিস আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। চোখ দুটোতে নিষ্প্রাণ সে হাসির ছোঁয়াটুকুও ছিল না।
হয়তো, বুঝলি? সে ওভাবে বলছিল ঠিকই, কিন্তু ওই নতুন স্কার্টটা আমার চোখে ভাসছিল সে সময়। উজ্জ্বল, আঁকাবাঁকা নকশা করা ওড়নাটার কথা মনে পড়ে গেছে। মনে আছে, সেবার ওড়নাটা দেখে ভেবেছিলাম, বুড়িকে এতে অনেকটা তরুণী লাগছে।
ক্রিস, কত টাকা ছিল ওখানে?
প্রায় সত্তর ডলারের মতো।
আমি ফিসফিস করে বললাম, হায় খোদা!
কিন্তু ধর, আমি যদি টাকাটা চুরি করেই থাকি, আর মিসেস সিমনস যদি আমার থেকে টাকাটা চুরি করে নিয়ে যায়, আর আমি যদি সবাইকে এ কথা বলি, কী মনে হয় তোর, কী হতো তাহলে? আমি, ক্রিস চেম্বার্স, যার একভাই ফ্র্যাঙ্ক চেম্বার্স, আর আরেক ভাই আইবল চেম্বার্স-কে বিশ্বাস করত আমার কথা?
কেউ না, আমি ফিসফিসিয়ে বললাম, হায়, জিশু!
বিষণ্ণ ম্লান হাসল ক্রিস, আর যদি দ্য ভিউ থেকে পড়তে আসা কোনো বড়লোকের ছেলে টাকা চুরি করে ফেরত দিত, তাহলে ওই কুত্তী এমন কিছু করার চিন্তাও করত বলে মনে হয় তোর?
না।
হ্যাঁ, ওদের কেউ হলে সিমনস বলত, আচ্ছা, আচ্ছা, এসব কথা
আমরা এবারের মত ভুলে যাব, তবে এক হাতে বেতের বাড়ি খেতে হবে কিন্তু। আর কখনো যদি করো, তাহলে দুহাতেই খেতে হবে। কিন্তু মানুষটা যেহেতু আমি ছিলাম, ওয়েল, মহিলার হয়তো স্কার্টটার দিকে আগে থেকেই নজর ছিল। সুযোগ পেয়ে একদম লুফে নিয়েছিল আরকি। আর আমি গাধার গাধা, টাকা ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করতে গেছি। কিন্তু আসলে আমি কোনোদিন কল্পনাও করতে পারিনি, একজন শিক্ষক হয়ে…ওহ, হেল! এখন আর কী হবে এসব বলে? প্রচন্ড রাগে সে যখন একহাতে জোরে জোরে চোখ ঘসছিল, আমি আবিষ্কার করলাম, ক্রিস কাঁদছে।
ক্রিস, মৃদু গলায় বললাম, তুই তো কম মেধাবি না, কলেজ কোর্সে যাচ্ছিস না কেন তুই?
কারণ, আমাদের স্যার-ম্যাডামেরা সেভাবেই সিদ্ধান্ত নেয়। এরা সবাই মিলে বিশাল এক টেবিলের চারপাশে গোল হয়ে বসে, আর কথায় কথায় গাধার মতো মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিকই তো। আসলে গ্রামার স্কুলে ব্যবহার কেমন ছিল আর পরিবারের ব্যাপারে শহরের লোকজন কী ভাবে এসব ছাড়া আর কোনো ব্যাপারে ওদের কোনো মাথাব্যথাই নেই। ওরা চায়, যাতে কেউ ওদের সবচেয়ে ভালো ফার্মের মুরগিগুলিকে নষ্ট করে। ফেলার সুযোগ না পায়। বড়লোকের ছেলেমেয়েদের সাথে আমাদের মতো কেউ যেন মিশতে না পারে। জানি না পারব কি না, কিন্তু আমি হয়তো চেষ্টা করব। কারণ, আমি আর এই ক্যাসল রকে থাকতে চাই না। কলেজে ভর্তি হয়ে দূরে চলে যেতে চাই, যাতে আমার বাবা বা ভাইদেরকে একজীবনে আর কখনো দেখতে না হয়। আমি এমন কোথাও চলে যেতে চাই, যেখানে কেউ আমাকে চিনবে না। যেখানে আমি কিছু করার আগেই সবাই আমার ব্যাপারে খারাপ ধারণা করে বসে থাকবে না। জানি না, পারব কি না, কিন্তু চেষ্টা অবশ্যই করব।
কেন পারবি না??
মানুষ। মানুষ তোকে টেনে নামিয়ে ফেলতে চাইবে সবসময়, বুঝলি?
কে? জিজ্ঞাসা করার সময় ভাবছিলাম, নিশ্চয়ই স্যার-ম্যাডামদের কথা কিংবা বুড়ি সিমনসের মতো রাক্ষসদের কথা ভাবছে, একটা নতুন স্কার্টের জন্য যারা একজন মানুষের জীবন ধ্বংস করে দিতে পারে। কিংবা বড় ভাই আইলের কথা, যে সবসময় এইস, বিলি, চার্লিদের সাথে ঘুরে ঘুরে জীবনটা নষ্ট করল। কিংবা সে হয়তো নিজের বাবা-মায়ের কথা ভাবছে।
কিন্তু ক্রিস বলল, তোর বন্ধুরা সবসময় তোকে টেনে নামাতে চাইবে, গর্ডি। জানিস না তুই? বলে ভার্ন আর টেডিকে আঙুল দিয়ে দেখাল। ওরা কিছুটা সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল আর হাসছিল কিছু একটা নিয়ে।
তোর বন্ধুরাই তোকে টেনে নামাবে। ওরা এমন মানুষ, যারা পানিতে ডুবে যেতে যেতে তোর পা টেনে ধরেছে। তুই ওদেরকে বাঁচাতে পারবি না কোনোভাবেই। খুব বেশি হলে কেবল ডুবে মরতে পারবি একসাথে।
কাম অন! এত আস্তে হাঁটলে চলবে? ভার্ন চিৎকার করে উঠল, হাসছে।
হ্যাঁ, আসছি, ক্রিস জবাব দিল। তারপর আমি কিছু বলার আগেই দৌড়াতে শুরু করল ওদের দিকে। পিছে পিছে ছুট দিয়েছিলাম, কিন্তু আমি ওকে ধরার আগেই সে পৌঁছে গিয়েছিল ওদের কাছে।
অধ্যায় ১৮
আরো প্রায় মাইলখানেক হাঁটার পর আমরা ভাবলাম, রাতের মতো ক্যাম্প করা যাক। তখনো আকাশে সামান্য দিনের আলো রয়ে গেছে, কিন্তু কেউ আর সামনে এগোতে চাচ্ছিল না। বিজ আর ডাম্পে আমাদের উপর দিয়ে যা গেছে, সবাইকে এক কথায় বলা যায় ক্লান্ত এবং বিধ্বস্ত। তবে সামনে এগোতে না চাওয়ার পেছনে আরেকটা বড় কারণ আছে। আমরা এরইমাঝে হার্লোতে এসে পৌঁছেছি, বনের ভেতরেই বলা চলে। আর, এই বনের কোনো এক জায়গায় একটা বাচ্চাছেলের লাশ পড়ে আছে। মৃত্যুর সময় ছেলেটার শরীর হয়তো দুমড়ে মুচড়ে গেছে। তাছাড়া, যে পরিমাণ সময় পেরিয়ে গেছে, এতক্ষণে যথাসম্ভব লাশের আশেপাশের সবটা মাছিদের দল দখল করে নিয়েছে। এই রাতের বেলা কেউই এরকম একটা কিছুর খুব কাছে যেতে চাচ্ছিল না। আলজানোন ব্ল্যাকউডের কোনো একটা গল্পে পড়েছিলাম সম্ভবত, মারা যাওয়ার পর খাঁটি খ্রিস্টান নিয়মে মরদেহ দাফন করার আগ পর্যন্ত এক লোকের প্রেতাত্মা নিজের লাশের কাছে কেবল ঘুরঘুর করত। পরে দেখা যাবে, হাওয়ায় ভেসে ভেসে রে ব্রাওয়ারের দেহ বিচ্ছিন্ন, জ্বলজ্বলে এবং ধোঁয়াটে ভূতুড়ে এক অবয়ব কান্নাকাটি করছে আর উল্টোপাল্টা বকাবকি করছে। রাতদুপুরে ঘুম ভেঙে গেলে অমন কিছুর সামনে পড়তে চাই না ভুলেও। তাই, এখানে থামার সময় সবাই একটা কথাই ভাবছিলাম, ছেলেটার লাশ আর আমাদের মধ্যে নিশ্চয়ই অন্তত দশ মাইলের মতো দূরত্ব আছে। হ্যাঁ, আমরা সবাই জানতাম ভূত বলে কোনোকিছুর অস্তিত্ব নেই। কিন্তু যদি দেখা যায়, আমাদের জানা আসলে ভুল ছিল? ধরে নিয়েছিলাম, তারপরেও দশ মাইল দূরত্বকে মোটামুটি নিরাপদ বলা যায়।
ভার্ন, টেডি আর ক্রিস মিলে ক্যাম্পফায়ারের জন্য কাঠ জোগাড় করল। ক্রিস ক্যাম্পফায়ারের কাঠগুলোকে কিছু পাথরের উপরে রেখে চারপাশে কিছুদূর পর্যন্ত সব পরিস্কার করে ফেলল। বনের সবকিছু বেশ শুকনো এবং
ভালোরকমের দাহ্য, আর ক্রিস এ নিয়ে কোনোরকম ঝুঁকি নিতে রাজি ছিল না। সব ঠিকঠাক হয়ে গেলে ছোট্ট করে আগুন জ্বালানো হলো। ওদিকে ওরা যখন কাজ করছিল, আমি তখন কিছু কাঠি চোখা করে চেঁছে, আমার ভাই ড্যানির ভাষায় পাইওনিয়ার ড্রামস্টিকস বানাচ্ছিলাম। বানানো শেষ হলে কাঠির চোখা মাথায় হ্যামবার্গারের জন্য মাংস ঢোকানো হলো।
তিনজনই নিজেদের উডক্র্যাফট নিয়ে হাসাহাসি, খোঁচাখুঁচি করছিল (ওদের দক্ষতা ছিল আসলে শূন্যের কাছাকাছি। যদিও ক্যাসল রক বয়স্কাউট নামে একটা সংগঠন ছিল, আমাদের ট্রি হাউজে যারা আড্ডা দিতাম, সবার হিসেবে ওটা ছিল ফার্মের মুরগির দল)। তারপর, আগুনের শিখায় রান্না করা ভালো, নাকি কয়লার উপর–তা নিয়ে তর্ক বেঁধে গেল (অর্থহীন তর্ক। আমরা যা ক্ষুধার্ত ছিলাম, কাঠ পুড়ে কয়লা তৈরি হওয়ার মতো সময় অপেক্ষা করা মোটেও সম্ভব ছিল না)। শুকনো মস গাছকে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা যাবে কি না, তা নিয়েও কথা হলো কিছুক্ষণ। পরবর্তী বিষয় ছিল, সব ম্যাচের কাঠি শেষ হয়ে গেলেও যদি আগুন ধরানো না যায়, তাহলে কী হবে। টেডি বলল, দুটো কাঠিকে একসাথে ঘষে আগুন জ্বালাতে পারবে সে। অতকিছু করতে হয়নি অবশ্য, দ্বিতীয় কাঠি দিয়েই শুকনো ডাল-পাতা-মসে আগুন ধরিয়ে ফেলল ভার্ন। প্রকৃতি একেবারে শান্ত। প্রবল বাতাস নেই, তাই আগুন নিভে যাওয়ার সম্ভাবনাও নেই। একসাথে নয়, একজন একজন করে আগুনের দিকে খেয়াল রাখছিলাম। বারবার জ্বালানী দিয়ে চিকন আগুনের শিখাকে বাড়িয়ে তোলা হলো। মোটামুটি জ্বলে উঠতেই পাইওনিয়ার ড্রামস্টিকগুলো একটু বাঁকা করে মাটিতে গেঁথে দিলাম, যাতে মাথায় ঢোকানো হ্যামবার্গারের মাংসটুকু কৌণিকভাবে আগুনের কিছুটা উপরে থাকে। বসে বসে দেখছিলাম, মাংসের টুকরোগুলো চকচক করছে এবং মাঝে মাঝে এক-দু ফোঁটা রক্ত ঝরে পড়ছে। কিছুক্ষণ পর পুড়ে বাদামি হতে শুরু করল। এদিকে, পেটের মাঝে ছুঁচোর নাচ পাগলামির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
পুরোপুরি রান্না হওয়ার জন্য অপেক্ষা করাটা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সবাই এক টুকরো করে নিয়ে রোলের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেললাম। রুটির ওপর চেপে ধরে হ্যাঁচকা টানে গরম কাঠিটা বের করে আনলাম মাংসের ভেতর থেকে। বাইরে পুড়ে বাদামি হয়ে গেলেও মাংসগুলোর ভেতরের দিকটা তখনো কিছুটা কাঁচা এবং লাল রয়ে গিয়েছিল। কিন্তু খেতে গিয়ে সেসময় ওই মাংসকেই মনে হয়েছে অসম্ভব সুস্বাদু। গপাগপ করে গিলেছি কেবল, আর মুখে লেগে থাকা সবকিছু খালি হাতেই মুছে নিয়েছি।
খাওয়া শেষে ক্রিস ওর ব্যাকপ্যাক খুলে টিনের একটা ব্যান্ড-এইড বক্স বের করল। সেটা খুলে সবাইকে একটা করে কিছুটা দুমড়ে যাওয়া উইন্সটন ধরিয়ে দিল। আগুন থেকে শুকনো ডাল জ্বালিয়ে নিয়ে সিগারেট ধরিয়ে নিলাম। কেউ মাটিতে শুয়ে আবার কেউবা গাছে হেলান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছিল। দেখে মনে হবে, একেকজন পুরো পৃথিবীর রাজা বিশ্ব জয় করে এসে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিচ্ছে। রাতের মৃদু আলোয় ধোঁয়ার মিশে যাওয়া দেখছে আনমনে। সত্যিটা হচ্ছে, আমাদের কেউই ধোঁয়া ভেতরে নেয়নি। ধুমপানের অভ্যাস নেই, ধোঁয়া ভেতরে নিতে গেলে যদি কাশি আসে, তাহলে বাকিরা মিলে যা ধোলাই করবে, জীবন শেষ! তাছাড়া ওইটুকুতেই বেশ ভালো লাগছিল সেসময়। অবশ্য সেই গ্রীষ্মে আমি প্রথম বুঝতে শিখেছিলাম, নতুন ধুমপায়ীদেরকে কীভাবে চিহ্নিত করতে হয়। এরা একটু পরপর থু থু ফেলতে থাকে। দেখলেই বোঝা যায়, নিতে পারছে না।
ফিল্টারের মাথা পর্যন্ত টেনে শেষ করে ফিল্টারগুলো আগুনে ছুঁড়ে দিলাম। ভাল লাগছিল খুব।
খাবারের পরে ধুমপান করার সাথে আর কিছুর তুলনাই হয় না।
টেডির কথা শুনে ভার্ন পাশ থেকে বলল, খাঁটি কথা।
সবুজের মধ্যে থেকে জোনাকির গান ভেসে আসছে। খাড়া উঠে যাওয়া ঢালের ওপর রেলরোড যেখানে আকাশকে ঢেকে দিয়েছে, সেদিকে তাকিয়ে ছিলাম। নীলক্ষা নীলের ওপর বেগুনি ছোপ পড়েছে, আরো গাঢ় হচ্ছে ধীরে ধীরে। সন্ধ্যার আবছায়া আলোর দিকে তাকিয়ে শান্তি লাগছে খুব, একই সাথে জেঁকে বসতে চাইছে বিষণ্ণতা। আমি, সাহসী হলেও কিছুটা ভীরু এক কিশোর, আরামদায়ক নিঃসঙ্গতা ছেয়ে ফেলছিল যার সবটা অস্তিত্ব।
ঢালের নিচে ঝোঁপঝাড়ের মাঝে কিছুটা সমতল জায়গা খুঁজে নিয়ে নিজেদের বেডরোল বিছিয়ে ফেললাম। তারপর ঘন্টাখানেক ধরে আগুনের মধ্যে ডালপাতা দিয়ে জ্বালিয়ে রাখলাম। গল্প করছিলাম, পনের পেরুনোর পর মেয়েদেরকে আবিষ্কার করে ফেললে যেসব গল্প আর মনে থাকে না। ক্যাসল রকের সবচেয়ে শক্তিশালী ট্রলার কোনটি, টানাহ্যাঁচড়ার কাজটা কে সবচেয়ে ভালো পারবে–এসব নিয়ে বেশ একদফা আড্ডা হয়ে গেল। ফুরিয়ে আসা গ্রীষ্ম নিয়েও কথা হলো কিছুক্ষণ। ব্রুনসউইকের হোয়াইট বিচে থাকার অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলছিল টেডি সাঁতার কাটার সময় একটা ছেলে ডাইভ দিতে গিয়ে মাথায় বাড়ি খেয়ে আরেকটু হলে ডুবেই যেত। আমাদের এতদিনের শিক্ষকদের কার কতটুকু মুরোদ আছে, সেসব নিয়েও অনেকক্ষণ কথা হলো। ক্যাসল রক এলিমেন্টারি স্কুলের মিস্টার ব্রুক যে সবচেয়ে বড় ডরফুক, সে ব্যাপারে সবাই একমত হলাম। কথার পিঠে উত্তর দিলে প্রায় কেঁদেই ফেলতেন বেচারা। ওদিকে মিসেস কোট (আমরা বলতাম, কোডি) নামের একজন ছিল–পৃথিবীতে এরচেয়ে খারাপ কোনো মহিলা আজ পর্যন্ত এসেছে বলে মনে হয় না। ভার্ন বলছিল, সে শুনেছে, দুই বছর আগে মহিলা এক পিচ্চিকে এমন মারা মেরেছে যে, আরেকটু হলে অন্ধই হয়ে যেত সে। ক্রিসের দিকে তাকালাম, ভাবছিলাম, মিস সিমনসের ব্যাপারে কিছু বলবে কি না। কিছুই বলেনি সে। আমি যে তাকিয়ে ছিলাম, সেটা খেয়ালও করেনি–ব্যস্ত-সমস্ত ভঙ্গিতে ভার্নের কথায় মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিচ্ছিল।
রে ব্রাওয়ারকে নিয়ে আমরা কেউই কিছু বলিনি। কিন্তু আমি ওর কথা খুব ভাবছিলাম। এই যে বনের চারপাশ থেকে অন্ধকার ঘনিয়ে এসে গিলে নেয় সবকিছু, এর মাঝে কেমন যেন নির্মম একটা ব্যাপার আছে। কোনো ল্যাম্পপোস্ট বা নিওন সাইনবোর্ড কিংবা কোনো বাসার জানালা দিয়ে ভেসে আসা মৃদু আলো, এমনকি কোনো গাড়ির আলোও নেই যে, এই অন্ধকারটাকে একটু নরম করে তুলবে। কোনো মায়ের গলা এখানে সন্তানকে ডেকে ডেকে ঘরে ফিরতে বলে না। শহরের মাঝে জীবন-যাপন করে অভ্যস্ত কেউ যদি বনের ভেতরে এই অন্ধকারে এসে পড়ে, তার কাছে এই সবকিছু সাধারণ প্রাকৃতিক ঘটনার চেয়ে বরং দুর্যোগ বলেই বেশি মনে হবে। বর্ষায় ক্যাসল নদী যেমন উত্তাল হয়ে ওঠে, হামলে পড়ে চারপাশের সবকিছুর ওপর, তেমনি অন্ধকারও ঝাঁপিয়ে পড়ে, গ্রাস করে নেয় সবকিছু।
আর আমি যখন রে ব্রাওয়ারকে নিয়ে ভাবছিলাম, ভূত হয়ে হামলা করবে, এমন কিছু কেন যেন মনে হচ্ছিল না। কেন যেন ভয় লাগছিল না ওর কথা ভেবে। মনে হচ্ছিল না, সবুজ কোনো প্রেতাত্মার মতো এসে যে পথে এসেছি, সে পথেই আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে যাবে, যাতে ওর চিরনিদ্রা নষ্ট করতে না পারি। বরং এই নির্মম অন্ধকারে একা শুয়ে আছে ভেবে খুব খারাপ লাগছিল ওর জন্য। যদি কোনো বন্যপ্রাণি এসে বেচারার শরীরটা খেয়ে ফেলতে চায়, ওর বাবা-মাতো নেই বাঁচানোর জন্য। কোনো বন্ধুও নেই। এমনকি জিশু কিংবা তার সাথের কোন সাধুওতো নেই ওর সাথে। মৃত ছেলেটা এই নির্মম অন্ধকারে এত একা হয়ে পড়ে আছে! রেলরোড থেকে ছিটকে পড়ে গেছে নিঃসঙ্গ নির্জনে। বুঝতে পারছিলাম, ওকে নিয়ে এই ভাবনাটা যদি থামাতে না পারি, আমি নিজেও কান্না করে ফেলব।
কাজেই, আমি সবাইকে লা ডিও শহরের একটা গল্প বলতে শুরু করলাম। সেই মুহূর্তেই বানিয়ে বলছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই, খুব একটা ভালোও হয়নি। এই গল্পটাও সেভাবেই শেষ হলো, যেভাবে আমার অন্য লা ডিও-এর গল্পগুলো শেষ হয়। একজন নিঃসঙ্গ আমেরিকান সৈন্য মৃত্যুর সময় কাশতে কাশতে মরে যাওয়ার সময় ভাবতে থাকে আমেরিকার জন্যে তার ভালোবাসার কথা। ভাবতে থাকে সেই মেয়েটার কথা, যাকে সে ফিরে আসার কথা দিয়ে এসেছে। কিন্তু এবারে গল্পটা বলার সময় কেন যেন একজন সৈনিকের মুখ ভেসে ওঠেনি আমার মনে ভেসে উঠছিল কোননা এক মৃত কিশোরের মুখ, যার চোখ দুটো বুজে এসেছে। ঠোঁটের বাম কোনা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। আর তার পেছনে লা ডিও শহরের ভাঙাচোরা দোকানপাট আর যুদ্ধ বিধ্বস্ত চার্চের বদলে আমার চোখে ভেসে উঠল একটা অন্ধকার বনের ছবি। প্রাগৈতিহাসিক যুগের কবরস্থানের মতো যার একপাশে তারা ভরা নীল আকাশের পট ধরে একটা রেললাইন চলে গেছে।
অধ্যায় ১৯
মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কোথায় আছি। সবার প্রথমেই মনে হলো, এত শীত! মাঝরাতে আমার রুমের জানালাটা আবার কে খুলে দিয়ে গেল? ড্যানি নাকি? ড্যানিকেই স্বপ্ন দেখছিলাম। হ্যারিসন স্টেট পার্কে সার্ফিং করা নিয়ে কিছু একটা। কিন্তু সেটা তো চার বছর আগের ঘটনা।
তারপর বুঝলাম, এটা আসলে আমার রুম না। অন্য কোথাও। এর মাঝে দেখি, কে যেন আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। আরেকজন আমার পিঠের সাথে লেপ্টে আছে। তৃতীয় আরেকজন দেখি আমার পাশে হাঁটুগেড়ে মাথা এমনভাবে এক পাশে দিয়ে আছে যে, মনে হচ্ছে বুঝি কিছু শুনছে।
কী হচ্ছে এসব? আসলেই হতভম্ব হয়ে গেছি।
দেখি, আমাকে যে ধরে আছে, সে কেমন যেন একটা শব্দ করে উঠল। শুনে মনে হলো ভার্নের গলা। এটা বুঝতে পারার পর ঘুম বিদায় নিল, বুঝতে পারলাম, কোথায় আছি। কিন্তু সবাই এত রাত ধরে জেগে কী করছে? নাকি সামান্য ঘুমিয়েই উঠে পড়লাম? উঁহু, সেটা সম্ভব না। কালি গোলা আকাশে একফালি রুপালি চাঁদ দেখা যাচ্ছে।
ভার্ন বিড়বিড় করে বলল, আমাকে নিয়ে যেতে দিও না ওটাকে। আমি আসলেই ভালো হয়ে যাব, সত্যি। আর কক্ষনো খারাপ কিছু করব না। আমি, আমি–
অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম প্রার্থনার শব্দ শুনছি, কিংবা প্রার্থনার মতো কিছু একটা ভার্ন টেসিও সে হিসেবে যতটা করতে পারে আরকি।
ধড়মড় করে উঠে বসলাম। একটু ভয় নিয়েই ডাক দিলাম, ক্রিস?
চুপ কর, ভার্ন। ওটা কিছু না। কী যেন শুনছিল বলে যাকে মনে হচ্ছিল, বুঝলাম সেটা আসলে ক্রিস।
কিছু একটা অবশ্যই। সামথিং। টেডির ভারি গলা শুনে আমি প্রশ্ন করলাম, কোনটা কী?
তখনো ঘুমের রেশ লেগে আছে, পুরোপুরি ধাতস্ত হতে পারিনি। স্থান কাল নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। যা-ই হচ্ছে, এর মাঝে এত পরে এসেছি যে, নিজেকে কীভাবে বাঁচাব, সেটাও ঠিক করে বুঝতে পারছিলাম না।
এমন সময় আমার প্রশ্নের উত্তর হিসেবে তীক্ষ্ণ, দীর্ঘ এক চিৎকার ভেসে এল জঙ্গলের গভীর থেকে। প্রচন্ড যন্ত্রণা আর অসম্ভব ভয়ে মরতে বসলে কোনো মহিলার গলা থেকে যেরকম চিৎকার বেরিয়ে আসার কথা, ঠিক তেমন।
ভার্নের গলা শুনে মনে হলো ভয়ে কেঁদেই ফেলেছে, হায় জিশু!
আমাকে এত শক্ত করে ধরেছে যে, দম বন্ধ হওয়ার যোগাড়। এদিকে আমি নিজেই ভয়ে শেষ, তার ওপর ওর ভয়টাও জাপটে ধরতে চাইছে। আমাকে। গা ঝাড়া দিয়ে ছাড়াতে চেষ্টা করলাম একবার। লাভের লাভ কিছুই হলো না, উল্টা ও আমাকে আরো জোরে জাপটে ধরলো। বাচ্চা পাপি কুকুরগুলো কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকলে যেমন করে।
টেডির ফ্যাঁসফাঁসে গলা শোনা গেল, এটা নিশ্চয়ই ব্রাওয়ার। ভূত হয়ে বনে ঘুরতে বেরিয়েছে।
এ কথা শুনে ভার্ন এবার চিৎকার করে উঠল। খোদা! আমি এখন থেকে জীবনে আর কখনো ওসব বাজে ম্যাগাজিন কিনব না। সত্যি! এখন থেকে সবসময় আমার সব ফল-টল ঠিক করে খাব, গাঁজরগুলো কুকুরকে দিয়ে দেব না। আমি, আমি স্রষ্টাকে যথাসম্ভব ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা করছিল ভার্ন, কিন্তু প্রচণ্ড ভয়ে গুলিয়ে ফেলছিল সব কিছু। জীবনে আর কখনো ফিল্টারবিহীন সিগারেট খাব না! ভুলেও খারাপ কিছু বলব না আর কখনো!
জীবনেও…– চুপ কর, ভার্ন। ক্রিসের কথা শুনে ভার্নের গলা ফিসফিসানিতে নেমে এল। শক্ত থাকার ভাব করলেও ক্রিসের গলার ভেতরের ভয়টা ঠিকই বুঝতে পারছিলাম। ভাবছিলাম, আমার মতো ওরও গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেছে কি না। ঘাড়ের কাছের দাঁড়িয়ে যাওয়া চুলগুলো দেখে মনে হচ্ছিল, সেগুলো আমারই। বুঝতে পারছি, আমারও অমনটাই হচ্ছে। ওদিকে ভার্ন তখনো ফিসফিসিয়ে শুধু রাতটা বেঁচে থাকার জন্য স্রষ্টাকে সব কিছু ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ক্রিসকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোর কী মনে হয় রে? আমার কাছে তো পাখি ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না।
মনে হয় না। আমার ধারণা, জংলী বিড়াল হতে পারে। আব্ব আমাকে একবার বলেছিল, বছরের কিছু কিছু সময় ওরা যখন সঙ্গী খোঁজার জন্য পাগল হয়ে ওঠে, একেবারে উন্মত্ত চিৎকার করতে থাকে। শুনে কোনো মহিলার চিৎকার বলে মনে হচ্ছিল, তাই না?
হ্যাঁ, এটুকু বলতে গিয়েই গলা ভেঙে আসছিল।
ক্রিস আবার বলতে শুরু করল, কিন্তু কোনো মহিলার পক্ষে এত জোরে চিৎকার করা সম্ভব না। এক মুহূর্ত থেমে আবার যখন মুখ খুলল, কেমন কাতর শোনাল ওর গলা, সম্ভব, বল?
এটা নিশ্চিত ওর ভূত, টেডি আবার ফিসফিস করে উঠল। চশমায় চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়ে কেমন স্বপ্নিল লাগছিল চোখগুলো, আমি ওটাকে খুঁজতে যাচ্ছি।
শুনে যদিও মনে হচ্ছিল না যে, আসলেই যাওয়া সম্ভব, কিন্তু রিস্ক নেওয়ার কোনো মানেই হয় না। তাই সে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই আমি আর ক্রিস মিলে টেনে বসালাম। হয়তো একটু বেশি শক্তি খাঁটিয়ে ফেলেছিলাম, কিন্তু সেটা আমাদের দোষ না। ভয়ে হাত-পায়ের পেশিগুলো তারের মত হয়ে গিয়েছিল।
আমাকে যেতে দে, কাপুরুষের দল! ডরফুক কোথাকার! টেডি এবারে চিৎকার করতে শুরু করেছে। একবার যখন বলেছি ওটাকে খুঁজে বের করব, আমি করবই। আমি দেখতে চাই সেই ভূতের বাচ্চাকে! আমি–
রাতের অন্ধকার ভেদ করে আবারো তীক্ষ্ণ চিৎকারটা ভেসে এল। মনে হচ্ছিল বুঝি চারপাশের বাতাসকে ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে ফেলা হচ্ছে। আমাদের হাত তখনো টেডির হাতে, ঠিক ওভাবেই জায়গায় জমে গেলাম আমরা। আওয়াজটা বাড়তে বাড়তে তীক্ষ্ম থেকে তীক্ষ্ণতর হতে লাগল, যতটুকু হওয়া সম্ভব, তারপর যেন এক মুহূর্ত ওভাবেই ঝুলে রইল বাতাসে। এক মুহূর্ত, তারপরেই নামতে থাকল চিৎকারটা, আওয়াজ কমতে থাকল এবং নামতে নামতে যতটা নামা সম্ভব, নেমে গেল। ওভাবেই কেটে গেল একটা মুহূর্ত, তারপর যে প্রচণ্ড শব্দটা ভেসে এল, মনে হচ্ছিল বুঝি কোনো উন্মাদ হা হা করে হাসছে। তীব্র, ভয়াবহ, বীভৎস এক হাসি মুহূর্তখানেকের মধ্যেই চুরমার করে দিয়ে গেল রাতের নিস্তব্ধতা। তারপর আবার চুপ। সব চুপ।
অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করে উঠল টেডি, হায় জিশু! এইটুকুই, ব্যাস। জঙ্গলে যাওয়ার কথা সে আর ভুলেও মুখে আনেনি। ওই শব্দ কে করছিল, সেটা দেখার শখ ওখানেই মিটে গিয়েছিল। একসাথে গায়ে গা ঘেঁসে বসেছিলাম সবাই। মনে মনে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছিলাম, কিন্তু আমি একাই ভাবছিলাম বলে মনে হয় না আমার। আমরা যদি ভার্নদের মাঠে আসলেই ক্যাম্প করতাম মানে, আমাদের বাবা-মায়েরা যেমনটা ভাবছে আরকি–তাহলে আসলেই ঘুরে দৌড় দিতাম। কিন্তু এখন যেখানে আছি, এখান থেকে ক্যাসল রক অনেক দূরের পথ। আর, রাতের অন্ধকারে সেই ব্রিজটা পাড়ি দেওয়ার কথা ভেবে আমার রক্ত একেবারে বরফ হয়ে গিয়েছিল। আবার উল্টো পথে হার্লোর দিকে যাওয়াও সম্ভব ছিল না। রে ব্রাওয়ারের লাশটা সেদিকেই কোথাও পড়ে আছে। এই রাতের অন্ধকারে ওদিকে ছুটে যাওয়ার কথা কল্পনা করাও অসম্ভব। আমরা আসলে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম। যদি আসলেই জঙ্গলে কোনো প্রেতাত্মা থাকত–আমার বাবার ভাষায় গুজালুম আর সেটা যদি আমাদেরকে ধরতে চাইত, আমাদের তাহলে কিছু করার থাকত না।
ক্রিস পরামর্শ দিল, পাহারা রাখা উচিত। কেউ দ্বিমত না করায় কয়েন বের করা হলো, ঘুরিয়ে দেখা হবে, কে আগে পাহারা দেবে আর কে পরে। সবার প্রথমে ভার্নের পালা। আমার পড়েছে একেবারে সবার শেষে। ভার্ন গিয়ে পা ভাঁজ করে ক্যাম্পফায়ারের পাশে বসে পড়ল। ভেড়ার মতো গাদাগাদি করে আমরা বাকিরা পাশাপাশি শুয়ে পড়লাম। মাথায় একটা কথাই ঘুরছিল, এই অবস্থায় কোনোভাবেই ঘুমানো সম্ভব না। কিন্তু কীভাবে যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। একটা পাতলা, অস্বস্তিকর ঘুম। আধো ঘুম, আধো জাগরণে সেই অস্বাভাবিক বুনো চিৎকারটা বারবার ফিরে আসছিল। ওটা স্বপ্ন ছিল, নাকি বাস্তবেই আবারো চিৎকার শোনা গিয়েছিল, ঠিক জানি না। মনে হচ্ছিল, আকৃতিহীন সাদা, কেমন ধোঁয়াটে একটা কিছু ভেসে আসছে গাছের ফাঁক দিয়ে। আসলেই দেখেছিলাম নাকি পুরো ব্যাপারটাই আমার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের ভেতরে ঘটছিল, বুঝতে পারছিলাম না।
শেষ পর্যন্ত অন্য একটা ঘটনার মাঝে ঢুকে গেলাম। এতক্ষণে বুঝতে পারছিলাম, স্বপ্ন দেখছি। স্বপ্নে ক্রিস আর আমি হোয়াইটস বিচে সাঁতার কাটছিলাম। ব্রুনসউইকের এই জায়গাটি একসময় গ্র্যাভেল বা নুড়ি পাথরের খনি ছিল। খনন শ্রমিকেরা খুঁড়তে খুঁড়তে যখন পানির উপস্থিতি টের পেল, তারপর খনন কাজ বন্ধ হয়ে যায় এবং খনিটিকে একটি ছোট লেক বানিয়ে ফেলা হয়। টেডি এখানেই সেই ছেলেটাকে মাথায় আঘাত খেয়ে পানিতে প্রায় ডুবে যেতে দেখেছিল।
স্বপ্নে আমরা দুজন গভীর পানিতে আয়েশ করে অলস সাঁতার কাটছিলাম। মাথার উপরে তখন জুলাইয়ের উষ্ণ সূর্য, মনে হচ্ছে, আলতো করে পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। আমাদের পেছন থেকে বিভিন্ন গলার হাসি কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। এদিকে স্যান্ডি বিচে মানুষজন কম্বল বিছিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে আর ছোট ছোট বাচ্চারা পানির কিনারার নরম বালুতে বসে প্লাস্টিকের বালতি দিয়ে খেলছে। মুহূর্মুহূ বালু তুলে এনে খুশি খুশি ছড়িয়ে দিচ্ছে নিজেদের চুলে। কিশোর-কিশোরীরা দল বেঁধে মেতে উঠেছে গল্পে। আর ছেলেরা মেয়েদেরকে দেখছে, দেখছে সুইমস্যুটে ঢাকা তাদের দেহের গোপন ভেজা অংশগুলো। কোন মেয়েকেই একা দেখা যাচ্ছে না। দুই থেকে তিনজন মেয়ে একসাথে হয়ে বারবার নামছে পানিতে, তারপর উঠে আসছে আবার, হাসছে প্রাণ খুলে। গরম বালুর ওপর দিয়ে লোকজন স্ন্যাক্সবারের দিকে হেঁটে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে যন্ত্রণায় কুঁচকে ফেলছে মুখ। ফিরে আসছে চিপস, ডেভিল ডগস এবং রেড বল পপসিকলস নিয়ে।
আমাদের স্কুলের ইংরেজির ম্যাম মিসেস কোট একটা রবারের নৌকায় আমাদেরকে পাশ কাটিয়ে গেলেন। সোজা হয়ে শুয়ে আছেন, গায়ে ধূসর রঙের স্যুট। বছরের সেপ্টেম্বর থেকে জুন মাসের সময়টায় তিনি স্কুলে এই স্যুটটাই পরে আসেন। টু-পিস স্যুটটার সাথে জ্যাকেটের নিচে ব্লাউজের বদলে থাকে মোটা সুয়েটার। বুকের একপাশে একটি ফুল পিন দিয়ে লাগানো। কানাডা মিন্ট রঙের হাঁটু পর্যন্ত লম্বা মোজা পায়ে। সাথে কালো হাই-হিল জুতোগুলো পানিতে ছোট ভি-আকৃতির ট্রেইল তৈরি করছে। শক্ত করে বাঁধা কোঁকড়া চুলে আমার মায়ের মতো হালকা নীল রং করা। চোখের চশমায় তীব্রভাবে বোদ প্রতিফলিত হচ্ছে।
সাবধান! উনি আমাদের দিকে ফিরে বললেন, নিজেদের কাজ-কর্মের দিকে খেয়াল রেখো, নাহলে এমন থাপ্পড় দেব যে একেবারে অন্ধ হয়ে যাবে। হ্যাঁ, আমি করতে পারব, স্কুল বোর্ড থেকে আমাকে এটুকু করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তো, মিস্টার চেম্বার্স, মেন্ডিং ওয়াল কবিতাটা আবৃত্তি কর তো দেখি।
আমি টাকাটা ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা করেছি, ক্রিস বলছিল। আর বুড়ি সিমনস আমাকে বলেছেন যে, ঠিক আছে। কিন্তু তারপর উনি নিজেই টাকাটা নিয়ে গেল! আপনি শুনছেন আমার কথা? উনি নিয়ে গেছে! টাকাটা নিয়ে গেছে! এই ব্যাপারে কী করবেন আপনি? অন্ধ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত মারতে পারবেন ওনাকে?
মেন্ডিং ওয়াল, মিস্টার চেম্বার্স, দয়া করে কবিতাটা আবৃত্তি করো।
ক্রিস আমার দিকে ব্যাকুল চোখে তাকাল। যেন বলতে চাচ্ছিল, বললাম না এমনই হবে? দেখেছিস? রাগে ক্ষোভে পানিতে পা ছুঁড়ল একটুক্ষণ, তারপর শুরু করল, কী যেন একটা ছিল, দেয়ালটাকে ভালোবাসেনি, পাঠিয়েছিল–আর, হঠাৎ করে ওর মাথাটা পানিতে ডুবে গেল। এরমাঝেই সে বারবার কবিতাটা আবৃত্তি করার চেষ্টা করছিল আর প্রতিবার মুখের সবটা ভরে যাচ্ছিল পানিতে।
অনেক কষ্টে মাথাটা পানি থেকে উঠিয়ে চিৎকার করল সে, আমাকে সাহায্য কর, গর্ডি! আমাকে সাহায্য কর!
তারপর আবার কে যেন টেনে নিয়ে গেল ওকে পানির নিচে। পরিস্কার পানিতে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম, দুটো নগ্ন, পানিতে ফুলে ওঠা লাশ ওর গোড়ালি ধরে টেনে ডুবিয়ে ফেলছে। ভার্ন আর টেডি। চোখগুলো কেমন সাদাটে হয়ে আছে ওদের। শূন্য দৃষ্টি। যুদ্ধ করে ক্রিস আবারো মাথা উঠিয়ে আনল পানির উপরে, আমার দিকে একহাত বাড়িয়ে দিয়েছে। মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে আর্তনাদ। এই উষ্ণ গ্রীষ্মের রোদ্দুর বাতাসের মাঝে ওর গলাটা কেমন মেয়েলি শোনল, যেন কোনো মহিলা অমানবিকভাবে চিৎকার করছে। তারপর গলাটা চড়তে লাগল, চড়ছে…চড়ছে…আমি পাগলের মতো সমুদ্র সৈকতের দিকে তাকালাম, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে, কেউ যেন এই চিৎকার শুনতেই পায়নি। পোড় খাওয়া পাকানো দেহ নিয়ে লাইফগার্ড ক্রুশ আকারের কাঠের টাওয়ারটার উপরে দাঁড়িয়ে লাল বেদিং স্যুট পরা এক মেয়ের দিকে তাকিয়ে হেসেই যাচ্ছে। তারপর হঠাৎ করেই চিৎকার থেমে গেল, আবার ওকে টেনে পানির নিচে নামিয়ে ফেলেছে। ওকে যখন আরো গভীর কালো পানিতে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম ক্রিস আমার দিকে অসহায়, আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে পাগলের মতো ফ্যাকাশে হয়ে আসা হাত ছুঁড়ছে। সাহায্য চাইছে আমার কাছে। কিন্তু ওকে বাঁচানোর বদলে আমি তীরের দিকে সাঁতার কাটতে শুরু করলাম। এমন একটা জায়গা চাই আমার, যেখানে পানি অন্তত মাথার উপরে উঠতে পারবে না। কিন্তু তীরে পৌঁছানোর আগেই, এমনকি কাছাকাছিও যেতে পারিনি তখনো, বুঝতে পারলাম একটা কোমল, পঁচে গলে যাওয়া হাত আমার পা দুটোকে পেঁচিয়ে ধরেছে, টানছে। গলা দিয়ে একটা তীব্র চিৎকার বেরিয়ে আসছিল, কিন্তু তার আগেই স্বপ্নটা ভেঙে গেল, নিখাদ বাস্তবতা জাপটে ধরল আমাকে। দেখলাম, টেডি আমার পা ধরে টানছে, ঝাঁকাচ্ছে। আসলে জাগিয়ে তুলতে চাইছে। আমার পাহারা দেওয়ার পালা চলে এসেছে।
তখনো স্বপ্নের রেশ কাটেনি, ঘুমের ঘোরেই জিজ্ঞাসা করলাম, তুই বেঁচে আছিস, টেডি?
না, মরে ভূত হয়ে গেছি। আর, তুই নিগ্রো হয়ে গেছিস। বিদ্রূপ করে বললেও কথা শুনে স্বপ্নের রেশটুকু কেটে গেল। উঠে ক্যাম্পফায়ারের পাশে গিয়ে বসলাম। টেডি শুয়ে পড়ল।