১০. গ্রেট সাউদার্ন এন্ড ওয়েস্টার্ন মেইন ট্র্যাকে

অধ্যায় ১০

বিম্যানের মাঠ পেরিয়ে গ্রেট সাউদার্ন এন্ড ওয়েস্টার্ন মেইন ট্র্যাকে উঠে আসতে আসতে আমাদের একেবারে ঘেমে নেয়ে একাকার যাকে বলে, সেই অবস্থা। শার্ট খুলে আগেই কোমরে বেঁধে নিয়েছি যাতে কষ্ট একটু কম হয়, তারপর সিন্ডারি দিয়ে বানানো খাড়া ঢাল বেয়ে উঠে এসেছি। ওখানে দাঁড়িয়ে ট্র্যাকের যেদিকে যাব, সেদিকে তাকিয়ে ছিলাম।

ওই মুহূর্তটুকুর কথা আমি এক জীবনে কখনো ভুলতে পারব না। একমাত্র আমার হাতেই ঘড়ি ছিল, আগের বছর ক্লোরিন ব্র্যান্ডের মলম বিক্রি করে প্রিমিয়াম হিসেবে সস্তা এই টাইমেক্স ঘড়িটা পেয়েছিলাম। ঘড়ির কাঁটা দুটো তখন সোজা বারোর ঘরে মাথা কুটছিল। এদিকে সূর্য মাথার ওপর থেকে উন্মত্ত ক্রোধে আগুন আর তাপে ভাসিয়ে দিচ্ছে সমস্তকিছু। মাথার খুলি ভেদ করে এই তাপ যে মস্তিষ্ক পুড়িয়ে দিচ্ছে, সেটা স্পষ্ট অনুভব করা যায়।

পেছনে তাকালে চোখে পড়বে ক্যাসল ভিউ পাহাড়ের ছায়ায় বিস্তৃত ক্যাসল রক শহর, চোখ জুড়ানো অপূর্ব সবুজের হাতছানি। আরেকটু পেছনে তাকালে চোখে পড়বে ক্যাসল নদী এবং নদীর তীর ধরে গড়ে ওঠা সারি সারি উল কারখানা। ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় ওপাশটার আকাশের রং কেমন ধাতব পিস্তলের রঙের মতো হয়ে গেছে। এদিকে নদীর পানিতে মিশে যাচ্ছে কারখানার বর্জ্য। আমাদের বামে আছে জলি ফার্নিচার বার্ন। বাম দিয়ে ক্যাসল নদীর যে অংশটা বয়ে চলেছে, তার সমান্তরালে সামনের দিকে যতদূর চোখ যায়, রেললাইন ট্র্যাক চলে গেছে দূরে, বহুদূরে ধাতব পাতে প্রতিফলিত হচ্ছে সূর্যের আলো, চমকাচ্ছে। ডানে আছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে ওঠা ঝোঁপঝাড়ের জঙ্গল (এখন সেখানে একটা মোটর সাইকেল চলার পথ হয়েছে)। একটা পরিত্যক্ত ওয়াটার টাওয়ার মাথা তুলেছে দিগন্তে। মরচে ধরে গেছে, দেখে ভয়ে গা কেমন শিরশির করে ওঠে।

ওই জায়গাটায় আমরা মুহূর্তখানেকের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম। তারপরেই ক্রিস অস্থিরভাবে বলল, চল চল, সামনে আগাই।

আমরা হাঁটছিলাম রেললাইনের পাশ দিয়ে। প্রতি কদমে ধুলার কালো মেঘ উড়ছে। কিছুক্ষণের মাঝেই আমাদের মোজা আর স্নিকার্স ময়লা হয়ে গেল। ভার্ন গান ধরেছিল, রোল মি ওভার ইন দ্য ক্লোভার, কিন্তু একটু পরেই থেমে গেল কেন যেন, তবে সেটা আমাদের কানের জন্য ভালোই হয়েছিল। টেডি আর ক্রিসই কেবল আসার সময় পানির বোতল এনেছিল। একটু পরপরই ওদের বোতল থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি খাচ্ছিলাম।

আমরা চাইলে ডাম্পের ওখান থেকে বোতলগুলো আবার ভরে নিতে পারব। আমি বললাম, আব্বু আমাকে একবার বলেছিল ওখানে নাকি প্রায় একশ নব্বই ফিট গভীর একটা কুয়ো আছে।

দলনেতার মতো কিছুটা কড়া স্বরে ক্রিস বলল, তাহলে তো ভালোই হয়। ওখানে চাইলে বসে মিনিট পাঁচেক জিরিয়ে নেয়া যাবে।

কিন্তু খাওয়ার কিছু তো আনা হয়নি, টেডি মনে করিয়ে দিল। আমি নিশ্চিত কেউই খাওয়ার জন্যে কিছু আনেনি। আমার নিজেরও মনে ছিল না।

ক্রিস থমকে দাঁড়িয়ে গেল। হায় খোদা! আমিও তো আনিনি। গর্ডি?

মাথা নাড়লাম। নিজেকে মনে হচ্ছে গাধার গাধা।

ভার্ন?

আমারো মনে ছিল না। সরি।

আচ্ছা, আমাদের কাছে টাকা কীরকম আছে, দেখা যাক, বলে কোমরে বেঁধে রাখা শার্ট খুলে মাটিতে বিছিয়ে দিলাম, সাথে নিজের পকেটের আটষট্টি পয়সাও বের করে রাখলাম। সূর্যের আলোয় কয়েনগুলো ঝলমল করে উঠল। দলামোচড়া করা এক ডলার এবং দুই পেনি যোগ করল ক্রিস, সাথে টেডির কাছ থেকে পাওয়া গেল দুটো কোয়ার্টার এবং দুই নিকেল। ভার্নের কাছে ছিল সাত সেন্ট।

দুই ডলার সাঁইত্রিশ সেন্ট, খারাপ না! আমি বললাম। ডাম্পের ওদিকে যে একটা ছোট গলি গেছে, ওর শেষ মাথায় একটা দোকান আছে। একজন গিয়ে কিছু হ্যামবার্গার আর কোক কিনে নিয়ে এলে মোটামুটি হয়ে। যাবে।

ভার্ন জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু যাবে কে?

ডাম্পের কাছাকাছি গেলে নাহয় দেখা যাবে। আগে তো ওখানে গিয়ে নেই, চল।

সব টাকা এক করে পকেটে রেখে শার্টটা যেই কোমরে বাঁধব, এমন। সময় ক্রিস চিৎকার করে উঠল, ট্রেন!

আমি রেললাইনের উপরে হাত রেখে বোঝার চেষ্টা করছিলাম ব্যাপারটা, কিন্তু এরইমাঝে শব্দ শুনেই বুঝতে পারলাম ক্রিস ভুল বলেনি। রেললাইনটা একেবারে জীবিত প্রাণির মতো কাঁপছিল, এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো ট্রেনটাকেই বুঝি ধরে রেখেছি।

সৈন্যরা সবাই একপাশে সরে যাও! চিৎকার করে মুহূর্তের মাঝে হাস্যকর ভঙ্গিতে এক লাফে ঢাল বেয়ে অর্ধেক পথ নেমে গেল ভার্ন। সৈন্য সৈন্য খেলায় খুব আগ্রহ ছিল ওর। নরম মাটি, ঘাসজমি কিংবা ঢাল পেলেই হয়েছে! ওর পেছনে ক্রিসও লাফ দিল। এতক্ষণে ট্রেনের শব্দ প্রচন্ড হয়ে উঠেছে, যথাসম্ভব লিউস্টনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে সরাসরি আমাদের এদিকেই আসছে। এদিকে লাফ দেয়ার বদলে টেডি উল্টো ট্রেনের দিকে আরো এগিয়ে যেতে লাগল। সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে ওর মোটা কাঁচের চশমা চকচক করছিল, ঘর্মাক্ত দ্রুর উপরে লম্বা এল চুল নেমে এসেছে।

টেডি, এখন পাগলামি করিস না, প্লিজ!

না না, আমি শুধু ট্রেনটার কাছে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। কাছে আসলেই দেব লাফ! উত্তেজিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আবার বলল, লরিগুলো তো আসলে কিছুই না। এটা একটা ট্রেন, বুঝলি?

তুই একটা বদ্ধ উন্মাদ। মরতে চাস নাকি?

মনে হচ্ছে নরম্যান্ডির সমুদ্র সৈকতে আছি! চিৎকার করে বলতে বলতে টেডি আরো কিছুটা এগিয়ে গেল রেললাইনের মাঝ দিয়ে। তারপর রেললাইনের মাঝে বিছানো একটা কাঠের তক্তা আর লাইনের লোহার পাতের উপরে পা দিয়ে ভারসাম্য ঠিক করে দাঁড়াল।

এক মুহূর্তের জন্যে আমি নড়তে ভুলে গিয়েছিলাম, এরকম অসুস্থ স্টুপিডিটির কোনো মানে আমার মাথায় ঢুকছিল না। পরমুহূর্তে আমি ছুটে গিয়ে ওকে ধরলাম, তারপর ঢালের কিনারায় টেনে এনে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলাম কিনারা থেকে। সেই সাথে নিজেও লাফ দিলাম। মাটিতে পড়ার আগেই টেডি আমার পেটে ঘুসি বসিয়ে দিল। বুক থেকে সবটা বাতাস বের হয়ে গেল, খাবি খেতে খেতেই ওর বুকের মাঝের হাঁড়ে হাঁটু বসিয়ে দিলাম। মাটিতে পিঠ দিয়ে সটান হয়ে পড়ল সে, ঢাল বেয়ে গড়িয়ে নামছে। ওঠার আগেই মাটিতে পা দিলাম আমি, তখনো বাতাসের অভাবে হাঁসফাঁস করছি। এ সময় টেডি এসে আমার ঘাড়ের কাছে ধরল, আর কোনো উপায় না পেয়ে শরীর গড়িয়ে দিলাম। ঢালের বাকিটুকু নেমে এলাম গড়াতে গড়াতে, সুযোগ পেলেই কিল-ঘুসি-খামচি বসিয়ে দিচ্ছি অপরজনের গায়ে। ক্রিস আর ভার্ন আমাদের দিকে বোকার মতো তাকিয়ে ছিল, সম্ভবত বুঝতে পারছিল না কী করবে।

হারামজাদা! তুই যদি আমার সাথে বড়ভাইগিরি দেখাতে আসিস, খুন করে ফেলব একেবারে!

এতক্ষণে ঠিকভাবে নিশ্বাস নিতে পারছি, পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। টেডিকে এগিয়ে আসতে দেখে পিছিয়ে গেলাম কিছটা, ওর আঘাত ঠেকানোর জন্য হাতদুটো তুলে রেখেছি; হাসছি নার্ভাস ভাবে। টেডি ক্ষেপে গেলে ওর সাথে লাগতে যাওয়া কোনো কাজের কথা না। এরকম অবস্থায় বয়সে বড় এবং বিশালদেহী কেউ প্রতিপক্ষ হলেও সে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর প্রতিপক্ষ যখন ওর হাতদুটো ভেঙে দেবে, তখনো দেখা যাবে কামড়ে দিয়ে হলেও লড়াই করার চেষ্টা করছে।

টেডি, আমরা যা দেখতে এসেছি, সেটা দেখার পরে তুই যেটাকে ইচ্ছে ফাঁকি দিয়ে সামনে থেকে শেষ মুহূর্তে লাফ দিতে পারিস, কিন্তু… কাঁধে একটা ধাক্কা লাগল, প্রবল বেগে মুঠিটা সরে গেল, আমি তখনো বলে যাচ্ছি, এর আগ পর্যন্ত আমাদেরকে কেউ দেখে ফেললে সমস্যা হয়ে যাবে… এবারে ঘুসিটা এসে লাগল মুখের একপাশে। হয়তো সেই মুহূর্তে একটা ভীষণ মারামারি লেগে যেত, কিন্তু ক্রিস আর ভার্ন গালাগালি করতে করতে এসে আমাদেরকে ধরে সরিয়ে দিল। মাথার উপরে ট্রেনটা গর্জন করে একগাদা ডিজেল পোড়া ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে এবং ভারি বক্সকার হুইলের ক্লিক-ক্ল্যাক শব্দ করতে করতে পেরিয়ে গেল আমাদেরকে। কয়েক টুকরো সিন্ডার পাথর ছিটকে এসে পড়ল। ঝগড়া আপাতত থেমে গিয়েছিল, কেউ কারো কথা পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছিলাম না। ছোট্ট মালগাড়ি ছিল ট্রেনটা, অনেকটা দূরে চলে যাওয়ার পরে টেডি আবার শুরু করল, আমি ওকে খুন করে ফেলব। অন্তত পিটিয়ে ঠোঁট যদি না ফাটাই… গা মোচড়ালেও ক্রিস আরো শক্ত করে ধরল ওকে। মৃদু স্বরে বলল, শান্ত হ, টেডি, শান্ত হ। টেডি ছাড়া পাওয়ার জন্য জোরাজুরি না থামানো পর্যন্ত বারবার এ কথাটাই বলছিল ক্রিস। মোটা কাঁচের ভাঙা চশমা এক কান থেকে অদ্ভুতভাবে ঝুলছে, এদিকে হিয়ারিং এইডের তার খুলে চলে এসেছে বুকের কাছে, জিনসের পকেটে রাখা ব্যাটারির দিকে নেমে আসতে চাইছে শেষ পর্যন্ত শান্ত হয়ে এল টেডি। এ সময় ক্রিস আমার দিকে ঘুরে জানতে চাইল, কী ছাতা নিয়ে মারামারি করছিলি তোরা?

ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে শেষ মুহূর্তে ডজ করে লাফ দিয়ে সরে যেতে চাইছিল। ইঞ্জিনিয়ার ওকে দেখে ফেললে তো গিয়ে রিপোর্ট করবে, ওরা আবার পরে চেক করার জন্য পুলিশ পাঠাতে পারে, সেজন্য…।

আহ! দেখ গে, সেও তোর মতো চেক করার কথা বলে ড্রয়ার খুলে চকলেট খুঁজছে কিনা! বললেও টেডির গলার স্বরে রাগ নেই। ঝড় কেটে গেছে।

ভার্ন মৃদু গলায় বলল, ও শুধু ঠিক কাজটা করার চেষ্টা করছিল রে। আর রাগ করে থাকিস না, এবার একটু শান্ত হ।

হ্যাঁ, তোরা আর রাগ করে থাকিস না, একমত হলো ক্রিস।

হ্যাঁ, ঠিক আছে, বলে টেডির দিকে তালু উপরে দিয়ে হাত এগিয়ে দিলাম। আয়, হাত মেলা?

আমি ডজ করে সরে যেতে পারতাম, তুই জানিস?

হ্যাঁ, জানি। বললাম ঠিকই, বুঝতে পারলাম, ব্যাপারটা কল্পনা করেই ভেতরটা অসাড় হয়ে উঠছে।

আচ্ছা, তাহলে ঠিক আছে।

হাত মেলা তো! আদেশ দিল ক্রিস, ছেড়ে দিয়েছে ওকে।

টেডি আমার হাতে জোরে বাড়ি মেরে নিজেই ব্যথা পেয়ে আঁউ করে উঠল। হাত ঝাড়া দিয়ে, তালু উপরে রেখে বাড়িয়ে দিল। আমিও বাড়ি মারলাম হাই ফাইভের ভঙ্গিতে। শান্তিচুক্তি।

তুই তো একটা মেয়ে মানুষের…!

টেডির কথার জবাবে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে মিয়াঁও করে উঠলাম।

ভার্ন বিরক্ত স্বরে বলে উঠল, আরে, চল তো তোরা!

যেখানেই যাস, মেয়েদের ওখানে চলে যাস না যেন! ক্রিস মৃদু গলায় খোঁচা মারল। আঘাত করার কৃত্রিম ভঙ্গি করে এক পা পিছিয়ে এল ভার্ন।

অধ্যায় ১১

ডাম্পে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দেড়টা বেজে গেল। একদল সৈন্যের মতো করে ঢাল থেকে নামার সময় আমাদের নেতৃত্ব দিল ভার্ন। জায়গায় জায়গায় খানাখন্দ, কাদাপানি জমে আছে। লাফ দিয়ে দিয়ে সব পেরিয়ে নেমে এলাম। কাদাটে জলা জায়গাটা পেরোলেই ডাম্পের কিনারা, বালির মাঝে এলোমেলোভাবে ময়লা ছড়িয়ে আছে।

ডাম্পের চারপাশ ঘিরে ছয়ফুটি কাঁটাতারের বেড়া। প্রতি বিশ ফিট পরপর একটা করে সাইনবোর্ড ঝুলানো, আবহাওয়ার ফলেই হোক কিংবা অযত্ন, রং জ্বলে গেছে। ওতে লেখা:

ক্যাসল রক ডাম্প
সময়: বিকেল ৪-৮টা,
সোমবার বন্ধ
বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ

বেড়ার মাথায় উঠে আস্তে করে এপাশে এসে লাফ দিয়ে নেমে এলাম। টেডি আর ভার্ন সামনে সামনে হাঁটতে লাগল, কুয়োর দিকে যাচ্ছে। আগের দিনের যে চাপকলগুলো দিয়ে পানি ওঠাতে গিয়ে ঘাম ঝরাতে হতো, অমন এক চাপকল দিয়ে পানি ওঠানোর ব্যবস্থা। চাপকল চালু করার জন্য হ্যাঁন্ডেলের পাশে একটা ছোট্ট বালতিতে কিছু পানি রেখে দেওয়া আছে। পরবর্তীতে যে আসবে, তারজন্য কেউ যদি এই বালতি পুরিয়ে রাখতে ভুলে যায়, তাহলেই হয়েছে। এরচেয়ে বড় পাপ আর হয় না। হাতলটা কেমন কোণাকোণি হয়ে আটকে গেছে, দেখে মনে হয়, একডানার কোন পাখি বুঝি উড়তে চেষ্টা করছে, পারছে না। কোনো এক কালে এতে সবুজ রঙ করা হয়েছিল, কিন্তু সেই ১৯৪০ সাল থেকে নিয়ে শত-সহস্র হাতের ঘষায় এর প্রায় পুরোটাই উঠে গেছে। ক্যাসল রক নিয়ে আমার স্মৃতিগুলোর মাঝে ডাম্পের স্মৃতিগুলো এখনো জ্বলজ্বলে। এ নিয়ে ভাবতে গেলে আমার পরাবাস্তব চিত্রশিল্পীদের কথা মনে পড়ে যায়। যারা অদ্ভুতসব ছবি আঁকে। গাছের ডালের জায়গায় ঝুলন্ত ঘড়ির মাঝে নিস্তেজ মুখের মতো কিছু কিংবা সাহারা মরুভূমির মাঝে ভিক্টোরিয়ান লিভিংরুম, কিংবা ফায়ারপ্লেস থেকে বেরিয়ে আসতে চাওয়া স্টিম ইঞ্জিন। আমার শিশুদৃষ্টিতে তাকিয়ে ক্যাসল রক ডাম্পে যেসব জিনিস পড়ে থাকতে দেখেছি, তার কোনোটাই ওখানে থাকা উচিত বলে মনে হয়নি। ঢুকেছিলাম পেছন দিয়ে। সামনে থেকে ঢুকলে দেখা যায়, গেটের মাঝ দিয়ে একটা প্রশস্ত ময়লা, ধুলোমলিন রোড ঢুকে গেছে। একটা অর্ধবৃত্তাকার জায়গায় এসে শেষ হয়েছে রোডটা। বিস্তৃত এই অংশটুকুতে ময়লা নামানোর জন্য ট্রাকগুলো এসে যেন দাঁড়াতে পারে, সেজন্য বুল্ডোজার ব্যবহার করে সমান করে হয়েছে জায়গাটা। এর শেষ মাথার এবড়ো-থেবড়ো অংশটা থেকে শুরু হয়েছে ডাম্পিং-পিট। চাপকলটা পিটের ওপাশে, যেখানে এখন টেডি আর ভার্নকে তর্কযুদ্ধরত অবস্থায় দেখা যাচ্ছে–কে হাতল নিয়ে কাজ করবে আর কে কল চালু করার চেষ্টা করবে, এই নিয়ে তর্ক। পিটটা প্রায় আশি ফিট গভীর। যেসব জিনিসের মেয়াদ ফুরিয়ে যায় কিংবা আর কাজে লাগে না, কিংবা যেসব জিনিস খালি করার প্রয়োজন দেখা দেয়, অর্থাৎ, আমেরিকার প্রায় সমস্ত ময়লা এবং বাতিল মাল এখানে এসেই জড়ো হয় শেষ পর্যন্ত। এমন অনেক কিছু পড়ে ছিল, যেগুলোর দিকে তাকালেও আমার চোখ ব্যথা করছিল। কিংবা হয়তো চোখ না, মস্তিষ্ক ব্যথা করছিল! এত কিছুর মধ্যে কোন জিনিসটার উপরে যে দৃষ্টি স্থির হওয়া উচিত, সে ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে না পারার কারণেই হয়তো এই অবস্থা। তারপর আপনার দৃষ্টি স্থির হবে, আসলে বাধ্য হবে; কারণ, ওই ঝুলন্ত নিস্তেজ ঘড়িমুখ কিংবা মরুর মাঝের লিভিংরুমের মতো অদ্ভুত, বিচিত্র এবং অপ্রাসঙ্গিক কিছু একটা চোখে পড়বে আপনার, যেটার কোনোভাবেই এখানে থাকার কোনো অর্থ নেই। একটা পিতলের খাট সূর্যের আলোয় মাতালের মতো পড়ে আছে, আর ক্ষণে ক্ষণে ঝিকিয়ে উঠছে। একটা ছোট্ট মেয়ের পুতুল নিজের দুপায়ের মাঝখানে এমন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে, যেন এই মুহূর্তে তার বাচ্চা হবে। একটা স্টাডবেকার গাড়ির ক্রোমিয়ামের নাক সূর্যের আলোয় এমন ঝিলিক দিচ্ছে যেন, বাক রজার মিসাইলের মতো এক্ষুণি ছুট দেবে। অফিসে যেসব দৈত্যাকার বোতল থাকে, অমন একটা বোতল সূর্যের আলোয় পুড়ে পুড়ে এমন রুপ নিয়েছে যে, দেখে মনে হয় স্যাফায়ার!

অনেক বনজ প্রাণীও ছিল ওখানে। কিন্তু ওয়াল্ট ডিজনির প্রকৃতি নিয়ে বানানো চলচ্চিত্রে যেসব প্রাণী দেখা যায় কিংবা চিড়িয়াখানায় লোকে যেসব প্রাণী পোষে, অমন কোনো প্রাণী ছিল না। নধরসব ইঁদুর আর পুষ্টসব স্কোয়ারেল পড়ে থাকা দারুণ জিনিসপত্রে এমনভাবে কামড় বসাচ্ছে যে দেখে মনেই হচ্ছে না, এগুলো সব পচা-বাসি হ্যামবার্গার কিংবা নষ্ট সবজি তরকারি। হাজার খানেকের মতো চিল উড়ে বেড়াচ্ছে, নেমে আসছে, আবার উড়ে যাচ্ছে; আর এদের মাঝে চিন্তাশীল, চুপচাপ পাদ্রীর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে বিশাল এক কাক। শহরের ছুটো কুকুরগুলোও শহরের ভেতরের কোনো ময়লার ঝুড়িতে খাওয়ার মতো কিছু না পেলে এখানে চলে আসে। এদের অবস্থা ছিল দুর্বিষহ, খাদ্যের অভাবে ক্ষিপ্ত, কোনো কোনোটা সংকর জাতের, বিভৎস চেহারা; পড়ে থাকা একটুকরো পঁচা সসেজ কিংবা মুরগির টুকরো নিয়ে মুহূর্তে মারামারি-কামড়াকামড়ি বাঁধিয়ে একাকার করে ফেলত।

কিন্তু এরা কখনো ডাম্প-কিপার মাইলো প্রেসম্যানকে আক্রমণ করত না। কারণ, মাইলো এদিকে হাঁটতে বের হলেই চপারকে সাথে নিয়ে বের হতো। প্রায় বিশ বছর পরে ক্যাম্বারের কুকুর কুজো যখন জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়ে উন্মাদ হয়ে গেল, তার আগ পর্যন্ত এই চপারই ছিল ক্যাসল রকের সবচেয়ে বড় আতঙ্ক। ওকে বলতে গেলে দেখাই যেত না। তাই ওর ব্যাপারে অনেক ধরনের গল্প দানা বেঁধেছিল। শোনা যেত, চারপাশের চল্লিশ মাইলের মধ্যে চপারই সবচেয়ে বাজে কুকুর। এত বীভৎস যে, ওর উপস্থিতিতে একটা ভালো ঘড়ির কাঁটা পর্যন্ত সামনে এগোতে চাইত না, জমে যেত। এলাকার ছেলে-মেয়েদের মুখে মুখে ঘুরে বেড়াত বিচিত্রসব কিংবদন্তী। কারো কারো মতে আধা জার্মান শেফার্ড প্রজাতির ছিল সে, কারো মতে ছিল মূলত বক্সার প্রজাতির। ক্যাসল ভিউয়ের হ্যারি হর নামে এক দূর্ভাগার মতে, চপার ছিল ডোবারম্যান পানিশার। সার্জারি করে নাকি ওর গলার ভোকাল কর্ড সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, যেন আক্রমণের সময় শিকার কোনো শব্দ শুনতে না পায়। আবার কিছু ছেলে দাবি করেছিল, চপার হচ্ছে উন্মাদ এক আইরিশ উলফহাউন্ড, যাকে মাইলো বুটের স্পেশাল মিক্সচার এবং মুরগির রক্ত খাওয়াতো। আরো বলেছিল, শিকারি বাজের মতো ক্ষিপ্ত না হয়ে উঠলে মাইলো কখনো চপারকে ওর ঘর থেকে বেরই \করত না। সবচেয়ে পরিচিত গল্পটা ছিল, মাইলো ওকে শরীরের নির্দিষ্ট অংশ লক্ষ্য করে আক্রমণ করতে শিখিয়েছে, ট্রেনিং দিয়েছে। তাই কোনো অভাগা যদি ডাম্পের বেড়া ডিঙ্গিয়ে মূল্যবান কিছুর আশায় ভেতরে ঢোকে, সে হয়তো মাইলোকে বলতে শুনবে, চপার! হাত! হাতটা ছিঁড়ে নিয়ে আয় তো! চপার হয়তো ছুটে এসে ওই বেচারার হাত কামড়ে ধরবে, এবং মাইলো থামতে বলার আগেই ছিঁড়ে নেবে চামড়া এবং টেন্ডন, কামড়ে হাড়গোড় চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলবে। কথিত ছিল, সে চাইলে নির্দিষ্টভাবে যে কারো চোখ, কান, পা…কিংবা দেহের নির্দিষ্ট কোনো অংশ আক্রমণ করে ছিঁড়ে নিতে পারে। আর ওই দুর্ভাগার সঙ্গী যদি এসব দেখে আতঙ্কে জমে যায়, সে হয়তো মাইলোকে বলতে শুনবে, চাপার! ওর নুনুটা ছিঁড়ে নিয়ে আয় তো! হয়তো ওকে বাকী জীবন ওভাবে খোঁজা হয়েই কাটাতে হবে।

মাইলোকে শহরে প্রায় নিয়মিতই দেখা যেত। সবাই ওকে ভালোভাবেই চিনত। আর দশজন খেটে খাওয়া লোকের সাথে তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না ওর। অল্প বেতনে পোষাত না দেখে কাজের পাশাপাশি মানুষ যেসব জিনিস ফেলে দিত, ওসব সংগ্রহ করে ঠিকঠাক করে ফেরি করত। কিন্তু আজকে চপার বা মাইলোর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। ক্রিস আর আমি ওদেরকে দেখছিলাম, ভার্ন কলটাকে ঠিকঠাক করার চেষ্টা করছিল, আর টেডি হাতল ধরে টানাহ্যাঁচড়া করছিল। শেষ পর্যন্ত কাঙ্খিত পুরস্কার জুটল, স্বচ্ছ পানিতে ভেসে গেল সে। এক মুহূর্ত পর দেখা গেল, দুজনেই কুয়ো থেকে বেরিয়ে আসা নালায় মাথা ডুবিয়ে রেখেছে। টেডি একটু পরপর এত জোরে কলে চাপ দিচ্ছে, মনে হচ্ছে ওর গতিবেগ প্রতি মিনিটে অন্তত এক মাইল হবে। আমি মৃদু গলায় বললাম, টেডি একটা পাগল।

হ্যাঁ, ক্রিসের গলা শুনে মনে হলো, নির্মোহ সত্য আউড়াচ্ছে, ওর এখন যে বয়স, এর দ্বিগুণ বয়স পর্যন্ত ও আদৌ বাঁচবে বলে আমার মনে হয় না। ওর বাবা যে কান পুড়িয়ে দিল, সেই থেকেই সম্ভবত ওর মাথায় এই পাগলামিগুলো বসে গেছে। ট্রাককে ডজ করে শেষ মুহূর্তে লাফ দিয়ে যে সরে যেতে চায়, নিজের বেঁচে থাকার কোনো অর্থ সে চশমা দিয়েও দেখতে পায় বলে মন হয় না।

আর, সেবারের গাছ নিয়ে সেই কান্ডের কথা মনে আছে?

আছে।

গতবছরের ঘটনা। টেডি আর ক্রিস আমাদের বাসার পেছনে বিশাল এক পাইন গাছে চড়েছিল। দুজনে মিলে গাছের মাথার একেবারে কাছাকাছি চলে গেছে, এমন সময় ক্রিস বলল, আর উপরে যাওয়া যাবে না, কারণ উপরের দিকের বাকি ডালগুলো শুকিয়ে পঁচে গেছে। টেডির মাথায় পাগলামি চেপে গেল, চোখ-মুখ খিচে বলল, যা হয় হবেদুই হাতে পাইনের কষ যেহেতু লেগেছেই, মাথায় না পৌঁছে সে থামবে না। ক্রিস যাই বলুক, কোনো লাভই হচ্ছিল না। উঠেছিল, প্রায় মাথায় পৌঁছেও গিয়েছিল, তাছাড়া শরীরের ওজনও ছিল কেবল পঁচাত্তর পাউন্ডের মতো। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ওখানে দাঁড়িয়ে পাইনের আঠালো কষ লাগা হাতে একটা ডাল ধরে একেবারে চূড়ায় ওঠার চেষ্টা করতে করতে চিৎকার করে সে আই এম দ্য কিং অফ দ্য ওয়ার্ল্ড কিংবা এরকম কোনো ফালতু ডায়ালগ ঝাড়ছিল, ঠিক এসময় অসুস্থ এক ধরনের শব্দ করে ওর পায়ের নিচের ডালটা ভেঙে গেল। নিচে পড়ে যাচ্ছিল টেডি, এ সময় যা হল, সেটাকে এক শব্দে বলা যায় অতিলৌকিক; এমন কিছু দেখলে স্রষ্টা বলে কেউ যে আছেন, এ নিয়ে আপনার মনে আর কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। পুরোপুরি রিফ্লেক্স বশতঃ হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ক্রিস এবং কেমন করে যেন ও টেডির এক গোছা চুল ধরে ফেলেছিল। ওর কবজি ফুলে গিয়েছিল, এবং পরবর্তী দুই সপ্তাহেও ডান হাত ব্যবহার করতে পারেনি, কিন্তু চুল ছাড়েনি ক্রিস। টেডি ব্যথায় চিৎকার করে গালাগাল দিচ্ছিল ওকে, শেষ পর্যন্ত একটা জীবিত ডালে পা রাখার পরেই কেবল সে ওর চুল ছেড়েছিল। সেদিন যদি ক্রিস অন্ধের মতো হাত বাড়িয়ে ওকে ধরত, উল্টে-পাল্টে ডালে বাড়ি খেতে খেতে একশ বিশ ফুট গাছের গোড়ায় এসে পড়ত টেডি। নামার পরে ভয়ে ক্রিসের মুখ পুরো ধুসর ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল, বমি করে দিচ্ছিল আরকেটু হলেই। আর টেডি? টেডি উল্টো ক্রিসের সাথে মারামারি বাঁধিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল চুল টেনে ধরার জন্য! আমি না থাকলে হয়তো লেগেও যেত, অনেক কষ্টে থামিয়েছিলাম ওকে।

আমি প্রায়ই এই নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখি, অসহায় চোখে আমার দিকে তাকিয়েছিল ক্রিস, বলছিল, পার্থক্য হচ্ছে, স্বপ্নে ওকে আমি আর ধরতে পারি না। কোনোভাবে ওর কয়েকটা চুল ধরতে পারলেও সে চিৎকার করতে করতে, ডালগুলোর মধ্যে বাড়ি খেতে খেতে মাটিতে আছড়ে পড়ে। কী অদ্ভুত, তাই না?

হ্যাঁ, আমি বলেছিলাম, এবং এক মুহূর্তের জন্যে আমাদের চোখাচুখি হয়ে গিয়েছিল। কী যেন দেখেছিলাম আমরা একে অন্যের চোখে–কিছু একটা–সেই থেকেই আমাদের খাঁটি বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। ভার্ন আর টেডির দিকে তাকিয়ে দেখি একে অন্যের দিকে পানি ছুঁড়ছে, হাসছে এবং চিৎকার করে মেয়েমানুষের ইয়ে বলে গালি দিচ্ছে।

আমি স্থির গলায় ক্রিসকে বললাম, হ্যাঁ, কিন্তু তুই ওকে ধরতে পেরেছিলি, মিস করিসনি। ক্রিস চেম্বার কখনো মিস করে না। ভুল বললাম?

মোটেও না। মেয়েরা যখন সিট নিচে নামিয়ে রেখে যায়, সে অবস্থাতেও মিস হয় না! আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল ক্রিস, হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনি দিয়ে গোলাকৃতি তৈরি করে মুখ নামিয়ে এনে থুথু ছুঁড়ে দিল।

আমি মেয়েলি গলা অনুকরণ করে বললাম, আমাকে কাঁচা খেয়ে নাও, চেম্বার্স!

তোমার ওই দারুণ ঐটা দিয়ে ক্রিসের কথা শুনে দুজনেই হেসে উঠলাম।

এ সময় ভার্ন চিৎকার করে বলল, পানি আবার নেমে যাওয়ার আগেই এসে খেয়ে যা।

আয়, দৌড় দেই, দেখি কে আগে যেতে পারে, ক্রিস প্রস্তাব দিল। এই রোদে? তোর মাথা গেছে। কাম অন। আমি গো বললেই দৌড় দিবি, বুঝেছিস? এখনো হাসছে। সে।

আচ্ছা।

গো!

দৌড় দিলাম। তপ্ত জমাট বালুতে স্নিকার্স ডেবে যাচ্ছিল। নীল জিন্সে মোড়া পা পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল কাঁধ, হাত মুঠো হয়ে গেছে। ওপাশে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দেখি ক্রিসের পাশে ভার্ন আর আমার পাশে টেডি এসে মধ্যাঙ্গুলি বের করে দেখাচ্ছে আমাদেরকে। প্রচণ্ড দুর্গন্ধের মাঝেও হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ছিলাম। ক্রিস ওর ক্যান্টিনটা ভার্নের দিকে ছুঁড়ে দিল। দুজনে পানি খেলাম ইচ্ছেমতো। তৃপ্ত হওয়ার পরে উঠে চাপকলের দিকে এগিয়ে গেলাম। প্রথমে ক্রিস কল চেপে আমাকে সাহায্য করল, তারপর আমি চেপে ওকে সুযোগ করে দিলাম। অসম্ভব ঠান্ডা পানি। নিমিষেই শরীরে লেগে থাকা সব গরম, ময়লা এবং ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। মনে হলো যেন গরম পেরিয়ে জানুয়ারির প্রবল শীতের মাঝে এসে পড়েছি। ক্যান্টিন ভরে পানি নিয়ে সবাই মিলে ডাম্পের একমাত্র গাছটির ছায়ায় এসে বসলাম। বিশাল আকারের এই অ্যাশ গাছটি মাইলো প্রেসম্যানের শ্যাক থেকে চল্লিশ ফিট দূরে। গাছটা কিছুটা বাঁকা হয়ে পশ্চিমে ঝুঁকে আছে। দেখে মনে হয়, বৃদ্ধারা যেমন মাটি থেকে স্কার্ট তুলে নেয়, গাছটাও সেভাবে নিজের শেকড় তুলে নিয়ে ডাম্প থেকে কেটে পড়তে চাইছে।

আহ! কী শান্তি! হাসছে ক্রিস, মাথা ঝাঁকিয়ে কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো সরাতে চেষ্টা করছে।

আসলেই দারুণ লাগছে, নড় করে সম্মতি জানালাম, হাসছি।

এই সময়টা আসলেই বেশ ভালো যাচ্ছে, ভার্ন সরল গলায় বলল। ওর কথাটা অনুভব করতে পারছিলাম ভালোভাবেই। সে যে শুধু আমাদের বাবা-মাকে ফাঁকি দিয়ে এভাবে বেরিয়ে পড়া বা এখানে এই গাছের নিচে বসে থাকা কিংবা রেললাইনের ওপর দিয়ে হেঁটে আসাটাকে বুঝায়নি, সেটা বুঝেছি। এগুলো শুধু ছোট্ট একটা অংশ, এবং ও যে আসলে আরো বড় কিছু বোঝাতে চাচ্ছিল, সবাই বুঝতে পারছিলাম। আসলে আমাদের জীবনের ওই সময়টুকু বেশ চমৎকার যাচ্ছিল। আমরা জানতাম, জীবনের ঠিক কোথায় আছি এবং কোনদিকে যাচ্ছি। এই ব্যাপারগুলো বুঝতে পারা আসলেই বিশাল কিছু। কয়জন বুঝতে পারে এভাবে?

গাছের নিচে অনেকটা সময় বসে ছিলাম আমরা। সবসময় যেসব নিয়ে কথাবার্তা হয়, সেরকম কথা বলছিলাম সবাই মিলে। কাদের বলটিম সবচেয়ে ভালো (ম্যান্টল আর ম্যারিসকে নিয়ে ইয়াংকিদের দলটা নির্দ্বিধায় তালিকার প্রথমে ছিল), কোন গাড়িটা সবচেয়ে চমৎকার (আমাদের হিসেবে ৫৫ থান্ডারবার্ড, কিন্তু টেডি বারবার গোঁয়ারের মতো ৫৮ করভেট্টির কথা বলছিল) কিংবা আমাদের গ্যাংয়ের কথা বাদ দিলে পুরো ক্যাসল রকে সবচেয়ে টাফ কে আছে (জেমি গ্যালান্টের ব্যাপারে সবাই একমত ছিল। মিসেস ইউইংকে মধ্যাঙ্গুলি দেখিয়ে দুই হাত পকেটে পুরে ধীরে-সুস্থে ওনার ক্লাস থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, পেছন থেকে বেচারি চিৎকার করছিলেন) কিংবা সবচেয়ে ভালো টিভি শো কোনটা (সবার হিসেবেই হয় দি আনটাচেবলস অথবা পিটার গান, এলিয়ট নেস হিসেবে রবার্ট স্ট্যাক এবং গান হিসেবে ক্রেগ স্টিভেনস, দুজনেই দারুণ ছিলেন)। আড্ডা জমে গিয়েছে, সময়ের কথা কারোই মনে ছিল না।

সবার প্রথম টেডি খেয়াল করল ব্যাপারটা, অ্যাশ গাছের ছায়া অনেকটা দীর্ঘ হয়ে গেছে। আমাকে জিজ্ঞাসা করল, কয়টা বাজে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম, সোয়া দুইটা বেজে গেছে।

ভার্ন বলল, তাহলে? কাউকে তো গিয়ে খাবার আনতে হবে। চারটার দিকে ডাম্প খুলে দেয়। মাইলো আর চপার যখন আসবে, সে সময় আমি ভুলেও এখানে থাকতে চাই না।

এমনকি টেডিও একমত হলো। মাইলোকে সে ভয় পেত না। স্বাভাবিক, ভুড়িওয়ালা চল্লিশের কাছাকাছি কাউকে ভয় পাওয়ার কোনো মানে নেই। কিন্তু চপারের নাম শুনলে ক্যাসল রকের সব ছেলেপেলেরই পেটে চিপ দিত।

ওকে, আমি বললাম, যার সবার চেয়ে আলাদা পড়বে, সে যাবে, ঠিক আছে?

ক্রিস আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোরই পড়বে, বুঝলি?

দেখাই যাক! আমি হাসতে হাসতে প্রত্যেকের হাতে একটা করে কয়েন ধরিয়ে দিয়ে বললাম, স্পিন!

চারটা কয়েন ঘুরতে ঘুরতে বিকেলের সূর্যের আলোয় চকচক করে উঠল। বাতাসে ভর করে নিচে নেমে আসার পথেই চারটা হাত লুফে নিল কয়েনগুলোকে। তারপর চারটা চাপড় পড়ল ধুলি ধুসরিত কবজিতে। কয়েনগুলো শুয়ে আছে আমাদের হাতের ওপর। সবাই একসাথে কয়েন থেকে উপরের হাতটা সরিয়ে নিলাম। দুটো হেড আর দুটো টেল। আবার ছুঁড়ে দিলাম শূন্যে। সব কয়টা টেল।

ভার্ন আস্তে করে বলল, হায় জিশু, গুচার উঠেছে। আমাদের কপাল খারাপ মনে হচ্ছে। আমরাও জানি এটা, চারটা হেড মানে মুন, যার অর্থ অসম্ভব সৌভাগ্য, আর চারটা টেল মানে গুচার, দুর্ভাগ্য।

জাহান্নামে যাক! ক্রিস বলল, এসব কিছুই মিন করে না। আবার মার তো।

না রে, ভাই, ভার্নের গলা করুণ শোনাল, গুচার আসলেই দুর্ভাগ্য বোঝায়। ডুরহ্যামের সিরয় পর্বতে যে ক্লিন্ট ব্র্যাকেন আর ওর বান্ধু-বান্ধবের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল, তোদের মনে আছে? বিলি আমাকে বলেছে, ওরা সেদিন বিয়ারের জন্য এমন কয়েন ঘুরিয়ে দেখেছিল। ওদেরও গুচার এসেছে। তারপরে গাড়িতে উঠতেই, ব্যাং! শেষ হয়ে গেল ওরা একেবারে। আমার আসলেই পছন্দ হচ্ছে না এসব, ভাই!

জবাব দিল টেডি, ধুর, এসব কুসংস্কারে কে বিশ্বাস করে? এগুলো বাচ্চাদের জিনিস, ভার্ন। তুই এখন কয়েন মারবি কি না বল?

প্রবল অনিচ্ছায় কয়েন ছুঁড়ে দিল ভার্ন। এবারে বাকি তিনজনের উঠল টেল, আমার হেড। আমি হঠাৎ কেমন যেন ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হচ্ছিল যেন, মাথার ভেতরে সূর্যের সামনে একটা ছায়া এসে পড়েছে। ওদের তিনজনের এখনো প্রচার রয়ে গেছে, যেন নির্বোধ ভাগ্য দ্বিতীয়বারের মতো আঙুল তুলে ওদের বলতে চাইছে, সামনে বিপদ আছে। হঠাৎ করেই ক্রিসের সেই কথাটা মনে পড়ে গেল আমার, কোনোভাবে টেডির কয়েকটা চুল ধরতে পারলেও সে চিৎকার করতে করতে, ডালগুলোর মধ্যে বাড়ি খেতে খেতে মাটিতে আছড়ে পড়ে। কী অদ্ভুত, তাই না?

তিনটা টেল, একটা হেড, এটাই ভাবছিলাম।

পরমুহূর্তে টেডি যখন আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে ওর উন্মাদ হাসিটা দিল, অনুভূতিটা গায়েব হয়ে গেল সাথে সাথে।

শুনেছি, পেত্নিরাই কেবল এভাবে হাসে, বলে ওকে মধ্যাঙ্গুলি দেখালাম।

ইইই-ইইই-ইইই, গর্ডি, যা যা, গিয়ে খাবার নিয়ে আয়, শালা হিজড়া! টেডি পাগলের মত হাসতে লাগল।

যাওয়া নিয়ে আসলে আমার কোনো সমস্যা ছিল না। ভালোই জিরিয়েছি, ফ্লোরিডা মার্কেটের দিক থেকে একটু হেঁটে আসলে বরং মন্দ হয় না।

তোর মায়ের ডাকনামে আমাকে ডাকিস না তো!

ইইই-ইইই-ইইই, হাসতে হাসতেই টেডি বলল, তুই শালা একটা মাদারচোদ!

ক্রিস বলল, তুই যা, গর্ডি। আমরা রেললাইনের ধারে তোর জন্য অপেক্ষা করব।

আমাকে রেখে সামনে আগালে ভালো হবে না বলে যাচ্ছি, বলে খাবার আনার জন্য পা বাড়ালাম।

ভার্ন হাসতে হাসতে বিয়ারের সাথে তুলনা দিয়ে ছন্দ মিলিয়ে কিছু একটা বলছিল।

বললাম, চুপ!

ভার্ন আর টেডি একসাথে তাল মেলাল, তোর দিকে তাকালে, দেব বমি করে ভাসিয়ে।

দেখ গে, তোদের মায়েরাই ওসব নিয়ে আড়ালে গিয়ে চেটে খাবে, বলে আর দাঁড়ালাম না, উল্টো ঘুরে হাঁটতে শুরু করলাম, কাঁধের ওপর দিয়ে ওদেরকে মধ্যাঙ্গুলি দেখাচ্ছি।

বারো বছর বয়সে আমার যে চমৎকার সব বন্ধু ছিল, বাকি এত বছরের জীবনে অমন কাউকে আর খুঁজে পাইনি আমি। আপনারা পেয়েছেন?

অধ্যায় ১২

লোকে বলে, একেক শব্দ একেকজনের কাছে একেকরকম অর্থ বহন করে। এটাই স্বাভাবিক আসলে। তাই, আমি যদি গ্রীষ্ম শব্দটা বলি, আপনার মাথায় একান্ত নিজস্ব কিছু ছবি ভেসে উঠবে, আমার মাথায় খেলে যাওয়া ছবিগুলোর সাথে যাদের কোনো মিল নেই। স্বাভাবিক। কিন্তু আমার কাছে গ্রীষ্ম মানে মাথার উপরে উন্মত্ত সূর্য এবং পকেটে কয়েন নিয়ে কেডস পরা পায়ে ফ্লোরিডা মার্কেটের রাস্তা ধরে দৌড়ে যাওয়া। একই সাথে মাথার মাঝে জিএস অ্যান্ড ডব্লিউএম রেলরোড ট্র্যাকের ছবি ভেসে ওঠে, সোজা তাকালে মনে হয়, দূরে, বহুদূরে কোথাও গিয়ে রেললাইনের ট্র্যাক দুটো একবিন্দুতে মিলে যাবে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে সূর্যের প্রচন্ড উত্তাপে ট্র্যাক দুটোকে এক সময় এত সাদা মনে হতে থাকে যে, চোখ বন্ধ করে ফেললেও এর একটা প্রতিচ্ছবি রয়ে যায়, কেবল সাদার বদলে অন্ধকারে নীল মনে হতে থাকে।

রে ব্রাওয়ারকে দেখার জন্য নদীর তীর ধরে আমাদের এই অভিযাত্রা যদিও সেই গ্রীষ্মের স্মৃতির বড় একটা অংশ, তবে এর সাথে আরো কিছু জিনিস মনে পড়ে যায়। যেমন, দ্য ফ্লিটউডের গাওয়া কাম সফটলি ডার্লিং, কিংবা রবিন লুকের গাওয়া সুজি ডার্লিন এবং লিটল অ্যান্থনির গলায় আই র‍্যান অল দ্য ওয়ে হোম। সবগুলোই কি ১৯৬০ সালের গ্রীষ্মের হিট গান ছিল? উত্তর একই সাথে হ্যাঁ এবং না, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হ্যাঁ। দীর্ঘ রক্তিম আভায় মোড়ানো বিকেলের হাত ধরে ডব্লিউএলএএম থেকে ভেসে আসা রক এন্ড রোল গান যখন সন্ধ্যার চাঁদড়ে মোড়া ডব্লিউসিসিইউ-এর বেসবলের মাঝে আবছা হয়ে মিশে গেছে, তখনই সময়ের হিসেব এলোমেলো হয়ে গেছে। আমার মনে হয়, স্মৃতির এসবই ১৯৬০-এর ঘটনা, যেন কেবল সেই গ্রীষ্মটাই অনেকগুলো বছর জুড়ে চলেছে, শেষ হয়নি। যেন নানা ধরনের শব্দের জালে আটকে গিয়েছিল–ঝিঁঝির গুনগুন গান, এক কিশোরের অনেক রাতে বাসায় ফেরার পথে তাসের কার্ড সাইকেলের স্পকের সাথে আটকে যাওয়ায় মেশিন গানের মতো শব্দ, বাড়ি নক্সের সরল টেক্সান সুরে গাওয়া কাম অ্যালং এন্ড বি মাই পার্টি ডল, এন্ড আল মেক লাব টু ইউ গানের সাথে মিশে ভেসে আসা বেসবল ঘোষকের গলা এবং নতুন কেটে নেওয়া ঘাসের গন্ধ। এখন স্কোর তিন বনাম দুই…হোয়াইটি ফোর্ড ঝুঁকে পড়ল…আবার উঠে দাঁড়াল গা ঝাড়া দিয়ে…বল ওর কাছে…থেমে গেছে সে…পিচ করল, এবং…কাজ হয়ে গেছে! এই পয়েন্টটা উইলিয়াম একাই নিয়ে নিল! প্রতিপক্ষের গুডবাই বলে বাসায় ফেরার সময় হয়ে গেছে। রেড সক্স এগিয়ে গেছে খেলায়, তিন বনাম এক! কিন্তু টেড উইলয়াম কি ১৯৬০ সালেও রেড সক্সের হয়ে খেলেছিলেন? অবশ্যই না। কিন্তু আমার স্মৃতিতে এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ। এখনো স্পষ্ট দেখতে পাই আমি মানুষটাকে, খেলছেন। গত কয়েক বছর ধরে আমি যখন থেকে বুঝতে শিখেছি বেইসবল খেলোয়াড়েরাও আমার মতো রক্তমাংসের মানুষ–খেলাটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রয় ক্যাম্পানেলা যখন গাড়ি নিয়ে মোড় ঘুরতে গিয়ে একটু বেশিই ঘুরিয়ে ফেলেছেন এবং খেলার পাতার বাইরে, প্রথম পাতায় জাগতিক খবরের মাঝে উঠে এসেছে ওনার ক্যারিয়ার শেষ, বাকি জীবন তাকে হুইলচেয়ারে বসে কাটাতে হবে, এর মাঝ দিয়েই আমি ব্যাপারটা বুঝতে শিখেছিলাম। দুই বছর আগের এক সকালে যখন এই টাইপরাইটার নিয়ে বসে রেডিও ছেড়ে কাজ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, শুনতে পেলাম, থারম্যান মানসন তাঁর বিমান ল্যান্ড করাতে গিয়ে মারা গেছেন। রয় ক্যাম্পানেলার মৃত্যুর স্মৃতির সবটা কী অসহ্য অসুস্থতা নিয়ে যে মাথার ভেতরে ফিরে এসেছিল।

গ্রীষ্মের কথা আমাকে সে কালের জেম সিনেমা হলের কথা মনে করিয়ে দেয়। কত মুভি যে ছিল তখন দেখার মতো! রিচার্ড এগান অভিনীত সায়েন্স ফিকশন মুভি গগ কিংবা অডি মারফি অভিনীত ওয়েস্টার্ন (টেডি অডি মারফির সব মুভি অন্তত তিনবার করে দেখে ফেলেছিল, ওর কাছে অডি ছিল দেবতার মতো) এবং জন ওয়েইনের করা যুদ্ধনির্ভর সব চলচ্চিত্র। সেই হলটা এখন আর নেই, ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেই গ্রীষ্ম জুড়ে আরো ছিল নানা ধরনের গেমস, ইচ্ছেমতো খাওয়া দাওয়া করার সুযোগ, ঘাস নিড়ানোর মতো লন। ইচ্ছে হলে ছুটে যাওয়ার জায়গা ছিল, দেয়ালের ধারে গুপ্তধনের মতো করে পয়সা লুকিয়ে রাখার সুযোগ ছিল এবং পিঠ চাপড়ে দেওয়ার মানুষ ছিল আমার।

আর এখন, এখানে বসে একটা আইবিএম কিবোর্ডে হাত রেখে আমি যখন সে সময়টুকু ফিরে দেখার চেষ্টা করি, সেই সবুজ আর বাদামি গ্রীষ্মের সবচেয়ে ভালো আর খারাপ সময়গুলো মনে করতে চাই; সেই শুকনো কিশোরকে আমি এখনো আমার এই বয়স্ক দেহের মাঝে লুকনো দেখতে পাই, শুনতে পাই পুরনো সেসব শব্দ। কিন্তু সব শেষে স্মৃতি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেদিনের গর্ডন লুশ্যান্সের কাছে, ঠিক ওই মুহূর্তে, যখন সে পকেটে পয়সা নিয়ে ফ্লোরিডা মার্কেটের দিকে ছুটে যাচ্ছিল আর পিঠ বেয়ে অঝোরে ঘাম ঝরছিল। আমি কিছু হ্যামবার্গার রোল নিয়ে নিলাম এবং তিন পাউন্ডের মতো হ্যামবার্গার চাইলাম। সাথে নিলাম চার বোতল কোক এবং বোতল ভোলার জন্য দুই সেন্ট দামের একটা চার্চ-কী। দোকানের মালিক জর্জ ডুস্যে মাংস নিয়ে ক্যাশ রেজিস্টারের পাশে ঝুঁকে বসল। একহাত কাউন্টারের উপরে সেদ্ধ ডিমের বোতলের পাশে রাখা, দাঁতের ফাঁকে একটা টুথপিক উঁকি দিচ্ছে। সাদা টি-শার্টের মধ্যে থেকে বিয়ার ভর্তি থলথলে হুঁড়ি গোল হয়ে বেরিয়ে আছে। দেখে মনে হয় বাতাসে পাল ফুলে উঠেছে, যেকোনো সময় ছিঁড়ে যেতে পারে। আমি দোকান ঘুরে জিনিসপত্র নেওয়ার পুরোটা সময় সে ওখানেই স্থির হয়ে ছিল, আমি যেন কিছু মেরে দিতে না পারি সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাইছে। হ্যামবার্গার মাপার সময় মুখে বুলি ফুটল, তুমি ড্যানি লুশ্যান্সের ভাই না? টুথপিকটাকে দেখে মনে হলো বল বিয়ারিং, কথার ফাঁকে মুখের একপাশ থেকে অন্যপাশে সরে যাচ্ছে। ক্যাশ রেজিস্টারের পেছনে ঝুঁকে লোকটা এক বোতল এসওকে ক্রিম সোডা তুলে নিয়ে হাতের তালুতে বাড়ি মেরে ঝাঁকাতে লাগল।

আমি উত্তরে বললাম, হ্যাঁ, স্যার। কিন্তু ড্যানি—

হ্যাঁ, আমি জানি। দুঃখজনক ব্যাপার, বুঝলে? বাইবেলে আছে, বেঁচে থেকেও আমরা আছি মৃত্যুর ছায়ায়। তুমি জানতে এটা? হ্যাঁ, আমারও এক ভাই কোরিয়ায় মারা গেছে। কেউ কি তোমাকে আগে বলেছে কথাটা?

তোমাকে দেখতে একেবারে ড্যানির মতো লাগে। মনে হয়, প্রতিচ্ছবি।

আমি মৃদু গলায় বললাম, হ্যাঁ, স্যার, মাঝে মাঝে বলে।

সে যে বছর অল কনফারেন্স করল, আমার মনে আছে। হাফব্যাক হিসেবে খেলত। আর যা দৌড়াতে পারত! হায় খোদা! হাঁ করে তাকিয়ে থাকার মতো যাকে বলে। তোমার মনে থাকার কথা না, পিচ্চি ছিলে তো।

আমার মাথার ওপর দিয়ে কাঁচের বাইরে, রোদের দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল লোকটা, যেন আমার ভাইকে চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।

আমার মনে আছে। আহ, মিস্টার ডুস্যে?

কী হলো, বাবু? ঘোলা চোখে এখনো স্মৃতির ঘোর, ঠোঁটের মাঝে টুথপিকটা একটু যেন কেঁপে উঠল।

মাপার স্কেলের উপরে আপনার বুড়ো আঙুল পড়েছে।

কী? বলতে বলতে নিচে তাকাল সে, থতমত খেয়ে গেছে। দেখল, বুড়ো আঙুলের মাথা লেগে আছে স্কেলের গায়ে, মৃদু চাপ পড়ছে। লোকটা ড্যানিকে নিয়ে কথা বলা শুরু করার পর আমি যদি একটুখানি সরে না যেতাম, কখনো দেখতে পেতাম না এটা। রেখে দেওয়া মাংসের কারণে আড়ালেই রয়ে যেত। হ্যাঁ, লেগে গেছে আরকি। তোমার ভাইয়ের কথা ভাবতে গিয়ে একটু আনমনা হয়ে পড়েছিলাম তো, তাই মনে হয়। ঈশ্বর ওকে ভালোবাসুন, ওর মঙ্গল করুন। বলতে বলতে আঙুলের ইশারায় ক্রস চিহ্ন আঁকল।

স্কেলের ওপর থেকে আঙুল সরিয়ে নেওয়ার পর সুইয়ের মাথা লাফ দিয়ে ছয় আউন্স উঠে গেল। উপরে খানিকটা মাংস বাড়িয়ে দিয়ে সাদা বুচারস পেপারে মুড়িয়ে দিল সে।

ওকে, বলে মুখের এমাথা থেকে টুথপিকটাকে চালিয়ে দিল আবার। কী কী হলো তাহলে, দেখা যাক। তিন পাউন্ড হ্যামবার্গার, এক ডলার চুয়াল্লিশ সেন্ট। হ্যামবার্গার রোল, সাতাশ সেন্ট। চারটা টনিক চল্লিশ সেন্ট, একটা চার্চ-কী, দুই সেন্ট। যে প্যাকেটে দিবে, সেটার উপরে লিখেই হিসেব করল সে, বলল, দুই ডলার ঊনত্রিশ সেন্ট।

তেরো।

ভ্রু কুঁচকে ধীরে ধীরে মুখ তুলে চাইল লোকটা। হ্যাঁ?

আপনার যোগে একটু ভুল হয়েছে, দুই ডলার তের সেন্ট হবে।

তুমি কি বলতে চাচ্ছ–

আপনি যোগে ভুল করেছেন, আমি স্পষ্ট গলায় বললাম, প্রথমে একবার স্কেলের উপরে বুড়ো আঙুল রাখলেন, এখন আবার দাম বেশি চাচ্ছেন। মি. ডুস্যে, আমি হয়তো কিছু বাড়তি টিপ দিয়ে যেতাম, কিন্তু এখন আর সে ইচ্ছে নেই। পকেট থেকে ঠিক দুই ডলার তেরো পয়সা বের করে কাউন্টারের ওপর রাখলাম। একবার টাকার দিকে তাকিয়ে পরমুহূর্তে আমার দিকে চোখ ফেরাল লোকটা, ভ্রু দুটো ততক্ষণে ভয়াবহভাবে বেঁকে গেছে, মুখের চামড়ার ভাঁজ দেখে মনে হচ্ছে, ফাটল ধরেছে।

তুমি কী মনে করো নিজেকে? চাপা, প্রায় ফিসফিসে শোনাল কথাগুলো, নিজেকে অতিচালাক ভাব, না?

না, স্যার। কিন্তু আমার সাথে এরকম করে পার পেয়ে যাবেন, এটা কেমন কথা? আপনি পিচ্চিদের থেকেও টাকা মেরে দিতে চান, এটা শুনলে আপনার মা কী ভাববে?

সবকিছু একসাথে ধরে ঠেসে প্যাকেটে ঢুকিয়ে দিল সে, কোকের বোতলগুলো বাড়ি খেয়ে শব্দ করে উঠল। বাজে ভাবে প্যাকেটটা আমার দিকে ঠেলে দিল; ধরতে পারব না পড়ে যাবে, এ নিয়ে একদমই চিন্তিত না। শ্যামলা মুখ রাগে জ্বলজ্বল করছে, কোঁচকানো আগের জায়গায় জমে গেছে। নে, নিয়ে যা নিয়ে আমার দোকান থেকে বেরিয়ে যা তুই। আর কখনো তোকে যদি আমি এখানে আসতে দেখি, ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব একেবারে। শালা নষ্টার বাচ্চা, আমাকে হিসাব শেখাতে এসেছে!

আসবও না আর, বলতে বলতে ধাক্কা দিয়ে কাঁচের দরজা খুলে ফেললাম। তপ্ত বিকেলের ক্লান্ত বাতাস গায়ে আছড়ে পড়ল। আমার আর কোনো বন্ধুও আসবে না, অন্তত পঞ্চাশ জন তো হবেই; আমি নিষেধ করে দেব।

জর্জ ডুস্যে চিৎকার করে বলল, তোর ভাই তো এমন পাকনা ছিল না!

ফাক ইউ! আমিও পাল্টা চিৎকার করলাম, তারপর ঝেড়ে দৌড় দিলাম ফিরতি পথে।

পেছনে কাঁচের দরজাটা গুলির মতো খুলে গেল, শুনলাম, লোকটা পাগলা ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছে, আর কোনোদিন যদি ধারে কাছেও পাই তোকে, ঠোঁট দুটো আলু না বানিয়ে ছাড়ব না আমি, মনে রাখিস!

প্রথম পাহাড়টায় ওঠার আগ পর্যন্ত ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়েছিলাম, মনে আছে। একইসাথে ভয়ে গা কাঁপছিল, আবার হাসিও পাচ্ছিল খুব। হৃদপিন্ড হাতুড়ির মতো পেটাচ্ছিল বুকের খাঁচায়। তারপর দৌড় থামিয়ে জোরে হাঁটা শুরু করলাম, বারবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখছিলাম, গাড়ি বা কিছু নিয়ে তাড়া করছে কি না।

করেনি। যাই হোক, ডাম্পের গেটে বেশ দ্রুতই পৌঁছে গেলাম। শার্টের ভেতরে প্যাকেটটা রেখে বেড়া ডিঙ্গিয়ে নেমে এলাম এপারে। অর্ধেক পথ পেরিয়ে আসার পরে দেখলাম জিনিসটা, দেখেই অপছন্দ হয়ে গেল। মাইলো প্রেসম্যানের শ্যাকের পাশে ওর পোর্টহোলযুক্ত ৫৬ বুইক গাড়িটা পার্ক করে রাখা। সে যদি আমাকে দেখে থাকে, সোজা বাংলায়, কপালে খারাপি আছে আমার। যদিও এখন পর্যন্ত কুখ্যাত চপার বা মাইলোর কোনো চিহ্ন চোখে পড়েনি, কিন্তু পেছনে তাকাতেই মনে হলো, বেড়াটা বড় বেশি দূরে। বাইরে দিয়ে ঘুরে না যাওয়ার জন্য নিজেকে থাপ্পড় লাগাতে ইচ্ছে হচ্ছিল, কিন্তু এতদূর চলে এসেছি যে, ফিরে গিয়ে বেড়া ডিঙ্গিয়ে ঘুরে যাওয়ার চেষ্টা করেও কোনো লাভ নেই। মাইলো যদি আমাকে বেড়া ডিঙ্গাতে দেখে, বাসায় ফিরে বকা খেতে হবে। তা হোক, এ নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা ছিল না আমার। কিন্তু চপারকে চিৎকার করে সে কিছু বলছে, এটা ভাবলেই গা অবশ হয়ে যাচ্ছিল। মাথার মাঝে ভয়ংকর সুরে ভায়োলিন বাজতে শুরু করেছে। জোর করে এক পায়ের সামনে আরেক পা ফেলছি, চেষ্টা করছি যেন দেখে অস্থির মনে না হয়। যেন মনে হয়, শার্টের মাঝ থেকে উঁকি দেওয়া প্যাকেট নিয়ে ডাম্প আর রেলরোড ট্র্যাকের মাঝের বেড়ার দিকে আমার এখান দিয়েই যাওয়ার কথা।

বেড়ার মোটামুটি পঞ্চাশ ফিটের মধ্যে চলে এসেছি আর মনে মনে ভাবতে শুরু করেছি, যাক, সবকিছু ভালোয় ভালোয়…ঠিক এসময়ই পেছন থেকে মাইলোর চিৎকার ভেসে এল। এই! কে তুমি? বের হও এখান থেকে এখনি! বের হও বলছি!

বুদ্ধিমান কেউ হলে নিশ্চয়ই এ কথার সাথে একমত হয়ে সম্মতি জানাতে এবং ঘুরে বেরিয়ে যেত। কিন্তু সে সময় আমার মাথা এত এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল যে, বুদ্ধিমানের কাজ না করে আমি পাগলের মতো চিৎকার করে ঝেড়ে দৌড় দিলাম। ভার্ন, টেডি আর ক্রিসকে দেখলাম বেড়ার ওপার থেকে উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছে।

এই, তুমি এদিকে আসো! এদিকে আসো, নইলে কিন্তু আমি আমার কুকুরকে লেলিয়ে দেব বলছি!

গলা শুনে আমার কাছে ঠিক স্বাভাবিক মনে হলো না কেন যেন, কাজেই, আমার দৌড়ের গতি আরো বেড়ে গেল। পাগলের মতো হাত নেড়ে বাতাস কেটে এগোতে লাগলাম, টের পেলাম বুকের ওখানে রাখা খাবারের প্যাকেট বারবার চামড়ায় ঘসা খাচ্ছে। আর ওদিকে টেডির মুখে বিচিত্র হাসি ছড়িয়ে পড়ল, ইইই-ইইই-ইইই, যেন কোনো বদ্ধ উন্মাদ বীভৎস কোনো যন্ত্র বাজাতে শুরু করেছে।

আরো জোরে, গর্ডি! আরো জোরে! ভার্নের চিৎকার শুনতে পেলাম।

তারপরেই মাইলোর চিৎকার, ওকে ধর, চপার! যা, ওকে ধরে নিয়ে আয়!

বেড়ার ওপর দিয়ে ব্যাগটা ছুঁড়ে দিলাম। ভার্ন কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে টেডিকে সরিয়ে দিয়ে ক্যাচ ধরল। পেছনে শব্দ শুনতে পাচ্ছি, আসছে… ধেয়ে আসছে চপার। পুরো পৃথিবীটা কাঁপছে ওর দৌড়ের সাথে সাথে আর নিঃশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসছে বরফ আর প্রচন্ড আগুন, মুখে থেকে লালার সাথে ঝরছে তপ্ত সালফার। দৌড়ের বেগের উপরে ভর করে নিজেকে বেড়ার দিকে ছুঁড়ে দিলাম। চিৎকার করতে করতে এক লাফেই পেরিয়ে এলাম অর্ধেকটা উচ্চতা। তিন সেকেন্ডের মাথায় বেড়ার মাথায় পৌঁছে গেলাম এবং কোনোরকম দ্বিধা ছাড়াই লাফিয়ে পড়লাম ওপারে। ভেবেচিন্তে লাফ দেইনি, এমনকি কীসের উপরে পড়ছি, সেটা খেয়াল করার কথাও মাথায় আসেনি। আরেকটু হলে টেডির উপরেই পড়তাম, তাকিয়ে দেখি ও তখনো পাগলের মতো হাসছে। হাসির চোটে কুঁজো হয়ে গেছে একেবারে। চশমাটা পড়ে গেছে কখন যেন, আর চোখ থেকে হাসির দমকের সাথে পানি বেরিয়ে আসছে। কয়েক ইঞ্চির জন্য বেঁচে গেছে, ওর একটুখানি বামের ঢালের উপরে এসে পড়েছি আমি। ঠিক সেই মুহূর্তেই চপার ছুটে এসে আমার পেছনে বেড়ার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল, যন্ত্রণা আর হতাশায় প্রচন্ড এক চিৎকার বেরিয়ে এল মুখ থেকে। ঘুরে তাকালাম, একহাতে ছিলে যাওয়া হাঁটু ধরে রেখেছি এবং প্রথমবারের মতো নিজের চোখে কুখ্যাত চপারকে দেখলাম। জীবনে প্রথমবারের মতো কিংবদন্তী আর বাস্তবতার পার্থক্য বুঝতে পেরেছিলাম সেদিন।

আগুন লাল চোখ আর ঠোঁটের ফাঁকে বীভৎসভাবে বেরিয়ে থাকা তপ্ত লোহার মতো ভয়ঙ্কর দাঁত বিশিষ্ট বিশাল কোনো নারকীয় দানবের কথা ভাবছিলাম আমি। কিন্তু তাকিয়ে দেখি একটা মাঝারি আকৃতির সাদাসিধে কুকুর বেড়ার ওপর বারবার লাফিয়ে পড়ে আমাদেরকে ধরতে চাচ্ছে। পেছনের দুপায়ে ভর দিয়ে পারলে বেড়া বেয়ে এপারে চলে আসে, এমন অবস্থা। টেডি আবার ইচ্ছে করেই একহাতে চশমা ঘোরাতে ঘোরাতে একবার সামনে এগিয়ে, আবার কিছুটা পিছিয়ে এসে আরো ক্ষেপিয়ে তুলছে চপারকে। আমাকে ধর তো পারলে, চপি! নোংরা একটা গালি দিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বেড়ার গায়ে পশ্চাদ্দেশ ঠেকিয়ে আমন্ত্রণ জানাল সে। চপারও সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করল, প্রচন্ড রাগ নিয়ে প্রথমে পিছিয়ে গেল কিছুদূর। তারপর দৌড়ে এসে লাফিয়ে পড়ল বেড়ার উপরে। টেডিকে ধরার বদলে নাকে ব্যথা পেয়ে আরো ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল কুকুরটা। ঘেউ ঘেউ করতে লাগল উন্মত্ত ভাবে, নাক দিয়ে শ্লেষা বেরুচ্ছে। টেডি বারবার একই কাজ করতে লাগল, আর চপারও প্রচন্ড ক্রোধে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল বেড়ার গায়ে। চেষ্টা করেও ধরতে তো পারছেই না, বরং নাকে আরো বেশি ব্যথা পাচ্ছে, রক্ত বের হচ্ছে নাক থেকে রক্ত দেখে টেডি যেন আরো পাগল হয়ে গেল, বারবার চপি বলে ডাকত লাগল কুকুরটাকে। এদিকে, ঢালের ওখানে শুয়ে ভার্ন আর ক্রিস সবকিছু দেখে গা কাঁপিয়ে হাসছিল।

এমন সময় মাইলো প্রেসম্যান ছুটে এলো। মাথায় নিউ ইয়র্ক জায়ান্টের বেসবল ক্যাপ, গায়ের জামা ঘামে ভিজে একসা হয়ে আছে। প্রচন্ড রাগে চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে।

চিৎকার করে উঠল, আমার কুকুরের সাথে এই নির্মমতা বন্ধ করো! এই মুহূর্তে!

কামড়ে দে, চপি! আয় না, আমাকে ধরবি না? কিরে? বেড়ার এপাশ থেকে টেডির উন্মত্ত হাসি শোনা গেল।

এই পর্যায়ে এসে চপারের রাগ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল, যাকে বলে, দিশেহারার মতো হয়ে গেল কুকুরটা। গোল করে খানিকটা জায়গা নিয়ে দৌড়ে এল, ঘেউ ঘেউ করছে, শ্লেষায় ভরে গেছে নাকের চারপাশ। সামনের পা দুটো দিয়ে মাটি খুঁড়ে চারদিকে ছিটাচ্ছে। এভাবে তিনবার বড় করে গোল করে দৌড়ে এল, যথাসম্ভব নিজেকেই সাহস দিচ্ছিল, তুই পারবি! তারপর সবটুকু শক্তি নিয়ে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল বেড়ার উপরে। ঘন্টায় অন্তত ত্রিশ মাইল বেগ তো হবেই। আমি মোটেও কথার কথা বলছি না, ঠোঁট দুটো বেঁকে গিয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছিল প্রায়, কান দুটো শাঁ শাঁ করে বাতাস কাটছিল, এমন অবস্থা।

আর্তনাদ করে উঠল বেড়াটা, কেঁপে উঠল প্রচন্ডভাবে। গোঙ্গানোর মতো শব্দ ভেসে এল, কুকুরটার চোখ দুটো শূন্য হয়ে গেল হঠাৎ, তারপর শব্দ করে পিঠ দিয়ে আছড়ে পড়ল মাটিতে। ধুলোবালির মেঘে এক মুহূর্তের জন্য ঢাকা পড়ে গেল কুকুরটার শরীর। ওভাবেই পড়ে থাকল কিছুক্ষণ। উঠে দাঁড়ানোর পরে দেখা গেল, জিহ্বা ঝুলে পড়েছে।

মাইলো এবার আসলেই প্রচন্ড ক্ষেপে গেছে। রাগে মুখ জলপাই রং ধারণ করেছে, এমনকি বিচিত্রভাবে সমতল করে কাটা চুলের নিচে খুলির যেটুকু দেখা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে বেগুণি হয়ে গেছে। আমি তখনো জায়গায় বসে হাঁ করে তাকিয়ে আছি, হাঁটুর কাছে জিন্স ছিঁড়ে একাকার, হৃৎপিন্ড হাতুড়ির মতো পেটাচ্ছে; সেই মুহূর্তে মাইলোকে দেখে মনে হলো চপারের মানব রূপ, কোনো পার্থক্য নেই দুজনের মধ্যে।

আমি তোকে চিনি, টেডি ডুশ্যাঁ! আমি তোদের সবাইকে চিনি! তোদের প্রত্যেকের খবর না করে আমি ছাড়ব না!

দেখি, কী করেন আপনি! টেডির পাল্টা চিৎকার শোনা গেল। বেড়াটা টপকে আগে এদিকে এসেই দেখান না, ফ্যাট-অ্যাস!

কী? কী বললি তুই আমাকে?

ফ্যাট-অ্যাস! টেডি আনন্দে চিৎকার করছে, লাফাচ্ছে, হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেছে অজান্তেই, চুল থেকে লাফের সাথে সাথে ঘাম ছিটকে পড়ছে। কুকুরকে মানুষের উপরে লেলিয়ে দেওয়া শেখাচ্ছি, দাঁড়ান! না না, আগে চেষ্টা করেন, ওই হোগাটা নিয়ে এদিকে আসতে পারেন কি না!

পাগলের বাচ্চা পাগল! তোর আম্মুকে যেন কোর্টের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়, আমি সেই ব্যবস্থা করব। আমার কুকুরকে নিয়ে তুই যা করেছিস, সেজন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে।

কী বললেন? কী বললেন আপনি আমাকে? এবারে টেডির পালা, মাইলোর দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে, রাগে ওর চামড়া সীসার রং ধারণ করেছে। লাফঝাঁপ থেমে গেছে এরইমাঝে।

মাইলো অনেক কিছুই বলেছে, কিন্তু টেডি ঠিক কোন কথাটা শুনে এমন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, সেটা বুঝতে এক মুহূর্তও লাগল না। বুঝল, একেবারে জায়গামতো হাত দেওয়া গেছে। পরেও আমি অনেক অনেকবার দেখেছি, পাগল শব্দটাই যে ব্যবহার করতে হবে সুইচ হিসেবে কাজ করবে মানুষ কীভাবে কীভাবে যেন এমন পরিস্থিতিতে সেটা ঠিকঠিক খুঁজে বের করে ফেলে। আর, ওরা সুইচটায় কেবল আস্তে করে চাপ দেয় না, হাতুড়ি দিয়ে পেটাতে থাকে একটানা।

তোর বাপ একটা পাগল, সে বলল, হাসছে। পাগল মানে, উন্মাদ, টোগাস হসপিটালের বিশিষ্ট উন্মাদ। আবর্জনার মধ্যে আটকে পড়া পাগলা ইঁদুর দেখেছিস না? ওইরকম। বদ্ধ উন্মাদ। তুই ঠিকই বলেছিস, পাগলের ছেলের কাছ থেকে এরচেয়ে ভালো ব্যবহার আশা করাটা আসলেও বোকামি।

তোর মা তো মরা ইঁদুরের ধন চোষে! টেডি চিৎকার করছিল, আর তুই যদি আমার বাবাকে আর কখনো ভুলেও পাগল বলিস, খুন করে ফেলব একেবারে, শালা!

তোর বাবা পাগল! মাইলোকে দেখে তৃপ্ত মনে হলো, বোতামটা ঠিকঠাক ভাবেই খুঁজে পেয়েছে। আর তুই একটা পাগলের বাচ্চা, পাগলের বাচ্চা, বুঝেছিস?

এতক্ষণে ভার্ন আর ক্রিস ঘটনার গভীরতা বুঝতে পেরে হাসা থামিয়েছে। সবকিছু অনেক সিরিয়াস হয়ে গেছে, ক্রিস হয়তো ভাবছিল টেডিকে বুঝিয়ে শুনিয়ে কোনোভাবে থামানো যায় কি না। কিন্তু যেই মুহূর্তে টেডি মাইলোর মাকে ইঁদুরের ধন চোষে বলে গালি দিল, ওরা দুইজন আবারও হিস্টিরিয়াগ্রস্থের মত হাসতে শুরু করল, মাটিতে শুয়ে পড়েছে, পেটে হাত চাপা দিয়ে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

আর না, ক্রিস দুর্বলভাবে বলতে চেষ্টা করল। আর না, প্লিজ, আরেকটু হলে আমার পেট এবার ফেটেই যাবে!

মাইলের পেছনে অনেকটা জায়গা নিয়ে চপার ঘুরঘুর করছিল, রেফারির ম্যাচ শেষের ঘোষণা পরবর্তী পরাজিত যোদ্ধার মতো মাথা নিচু করে রেখেছে। এদিকে টেডি আর মাইলো টেডির বাবাকে নিয়ে কথা বলেই যাচ্ছে। বেড়ার দুপাশে হলেও দুজনের নাকে নাকে সংঘর্ষ লেগে যাওয়ার জোগাড়, মাইলো কেবল বিশাল দেহটা নিয়ে এপারে আসতে পারছে না বলে রক্ষা।

আমার বাবা নিয়ে কিছু বলার আগে একশবার চিন্তা করা দরকার তোর। ওই মানুষটা নরম্যান্ডি সমুদ্র সৈকতে যুদ্ধ করেছে।

হ্যাঁ, কিন্তু এখন? এখন কী করে? আরে পাগলের বাচ্চা, তোর বাপ এখন টোগাসে পাগলামি করে বেড়ানো ছাড়া আর কোনো ছাতাও তো করে না, তাই না? সেকশন আট হয়ে গেছে দেখেই তো টোগাসে পাঠিয়েছে!

যথেষ্ট হয়েছে। আমি তোকে একেবারে খুন করে ফেলব, বলেই টেডি তারকাটার বেড়া বেয়ে উঠতে শুরু করল।

আয় না, ইঁদুরের বাচ্চা! চেষ্টা করেই দেখ পারলে, মাইলো একটু পেছনে সরে দাঁড়াল, হাসছে, অপেক্ষা করছে টেডি কখন ওপাশে পৌঁছাবে।

না! চিৎকার করে টেডির প্যান্ট টেনে ধরে ওকে নামালাম বেড়া থেকে। দুজনেই পিঠ দিয়ে পড়লাম, কিন্তু ও পড়ল আমার গায়ের উপরে। অণ্ডকোষে ভয়াবহ ছ্যাঁচা খেয়ে আর্তনাদ করে উঠলাম। এরকম যন্ত্রণা আর কোনোভাবে হওয়া সম্ভব না আসলে। কিন্তু তারপরেও দুই হাতে টেডিকে জোর করে ধরে রেখেছিলাম।

ছাড় আমাকে ছাড়! দুই হাতে আমার হাত সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল, আমাকে ছেড়ে দে, গর্ডি। আমার বাবাকে নিয়ে এমন কথা বলে কেউ পার পাবে না। আমি খুন করে ফেলব হারামজাদাকে! তুই খালি ছাড়!

সেও তো এটাই চাচ্ছে, তোকে ছেড়ে দেই, কানের কাছে মুখ নিয়ে চিৎকার করে বললাম, ও চায়, তুই বেড়ার ওপাশে গেলে তোকে মেরে তারপর পুলিশের কাছে নিয়ে যাবে। বুঝছিস না কেন তুই?

কী? টেডি অবাক চোখে আমার দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল।

তুই কি মনে করিস, তুই অনেক চালাক? মাইলো আবার এগিয়ে এসে বেড়া ঘেসে দাঁড়াল, আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ওরটা ওকেই করতে দে না?

একটা বাচ্চার বিপরীতে পাঁচশ পাউন্ডের এক বুড়ো হাবড়া! ভালো তো?

মাইলো জবাব দিল, আমি তোদেরকেও চিনি, তোর নাম শ্যান্স। তারপর উঠে প্যান্ট বাড়তে থাকা ক্রিস আর ভার্নের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওটা ক্রিস চেম্বারস আর ওই গাধাটা টেসিও ভাইদের কোনো একটা। এই পাগলের বাচ্চা ছাড়া আমি তোদের প্রত্যেকের বাবাদের সাথে কথা বলব, বেয়াদপের দল। তোদের প্রত্যেককে আমি যদি রিফর্মেটরিতে ঢুকিয়ে ছেড়েছি!

মাইলো স্থিরভাবে চোখ সরু করে তাকিয়ে ছিল। রোমশ হাতগুলো এমনভাবে রেখেছে, দেখে মনে হয়, ওয়ান পটোটো টু পটেটো খেলতে চাচ্ছে। জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে, সম্ভবত ভেবেছিল আমরা কেঁদে-কেটে ওর কাছে মাফ চাইব, কিংবা টেডিকে দিয়ে যাব ওর কাছে।

ক্রিস ওর বুড়ো আঙুল আর তর্জনী গোল করে বৃত্ত বানাল, তারপর থুঃ করে থু থু ফেলল ওর মাঝ দিয়ে।

এদিকে ভার্ন আকাশের দিকে চোখ তুলে দাঁড়িয়ে আছে, আপনমনে গুনগুন করছে।

টেডি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, চল তো, যাই। এই হারামজাদার চেহারা আর কিছুক্ষণ দেখতে হলে আমি বমি করে দেব।

তোকে আমি ধরব, ইঁদুরের বাচ্চা কোথাকার! ধরে তোকে পুলিশে না দিয়ে আমি থামব না, তুই দেখিস।

আপনি ওর বাবাকে নিয়ে কী বলেছেন, সেটা তো আমরা শুনেছি, তাই? আমি বললাম। আমরা সবাই সাক্ষী আছি। তার ওপর আপনি আবার আপনার কুকুরকে আমার দিকে লেলিয়ে দিয়েছিলেন। যেটা অবশ্যই বেআইনি।

মাইলোকে হঠাৎ করেই খুব অনিশ্চিত দেখাচ্ছিল। তারপরেও বলার চেষ্টা করল, কিন্তু তুমি অন্যায়ভাবে ডাম্পে ঢুকেছ।

অন্যায়ের কী দেখলেন আপনি? ডাম্প কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি না, পাবলিক প্রোপার্টি।

কিন্তু তুমি বেড়া ডিঙ্গিয়েছ।

অবশ্যই, কিন্তু সেটা করেছি কারণ, আপনি আমার পেছনে কুকুর লেলিয়ে দিয়েছেন। আমার কী করা উচিত ছিল? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কামড় খেতাম, না? প্রার্থনা করছিলাম, আমার কথার ফাঁক যেন ধরতে না পারে। আমি যে ঢোকার সময়ও বেড়া ডিঙ্গিয়েছি, সেটা যেন ওর মনে পড়ে না যায়। দ্রুত বলে উঠলাম, চল, সবাই চল। দুর্গন্ধ ছাড়া এখানে আর কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে না আমার।

ফর্মেটরি, মাইলো চিৎকার করে প্রতিজ্ঞা করছিল, তোদের প্রত্যেককে আমি ফর্মেটরিতে ঢোকাবো।

পুলিশকে আমি বলব তো, আপনি কেমন করে একজন বীরযোদ্ধাকে পাগল বলে গালি দিচ্ছিলেন। ক্রিস পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে চিৎকার করে পাল্টা জবাব দিল, যুদ্ধের সময় আপনি কী করেছেন, মিস্টার প্রেসম্যান?

ওটা তোদের জানার দরকার নেই, পেছন থেকে মাইলোও চিৎকার করল। তোরা আমার কুকুরকে ব্যথা দিয়েছিস!

ভার্ন বিড়বিড় করে যে কথাটা বলল, সেটা সাধারণত সেনাবাহিনীর ছিচকাঁদুনে সদস্যদের অভিযোগের জবাবে বলা হয়, অভিযোগ ফরম পূরণ করে গিয়ে আপনার পূরোহিতের কাছে জমা দিয়ে আসেন।

ঢাল ধরে হেঁটে উপরে উঠছিলাম, রেলরোড-ট্রাকের দিকে যাচ্ছি। এ সময় পেছন থেকে শেষবারের মতো স্পষ্টভাবে মাইলোর চিৎকার শোনা গেল, তোরা যাস কই? এদিকে আয়! গলায় আগের সেই জোর আর নেই।

জবাবে টেডি পেছনে ফিরে মধ্যাঙ্গুলি দেখিয়ে দিল। ঢালের মাথায় এসে আমি আবার পেছনে ফিরে তাকালাম। মাইলো তখনো বেড়ার ওপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। বেসবল ক্যাপ পরা বিশালদেহী এক মানুষ, পাশে একটা কুকুর বসে আছে। দুই হাতে বেড়া আঁকড়ে ধরে রেখে চিৎকার করছিল বেচারা। আমার কেন যেন হঠাৎ করে খুব কষ্ট হতে লাগল ওর জন্য। দেখে মনে হচ্ছিল, ক্লাস থ্রির কোনো কিশোর বুঝি দুর্ভাগ্যক্রমে খেলতে গিয়ে স্কুলের প্লেগ্রাউন্ডে আটকা পড়ে গেছে, আর বারবার চিৎকার করে কাউকে ডাকছে একটু ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য। আরো কিছুক্ষণ অস্পষ্টভাবে ওর চিৎকার শোনা গিয়েছিল। তারপর হয় সে ফিরে গেছে, অথবা আমরা দূরে চলে এসেছিলাম।

সেদিনের মত মাইলো আর চপার অধ্যায়ের এখানেই সমাপ্তি।

অধ্যায় ১৩

আমরা যে মাইলো প্রেসম্যানকে দেখিয়ে দিয়েছি যে, আমরা মোটেও ভীতুর ডিম না–এ নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা হলো। যদিও শুনে মনে হচ্ছিল, সবাই একরকম জোর করেই কথা বলছে। ফ্লোরিডা মার্কেটের সেই লোক কেমন করে আমাদের ছিনতাই করতে চেয়েছিল, সে কথা বললাম। তারপর আমরা সবাই চুপ করে গেলাম, ভাবছি। আমি সেই গুচারের কথা ভাবছিলাম, কিছু একটা ঝামেলা হয়তো আছে আসলেই। এরচেয়ে খারাপ আর কী হবে–ভাবতে গিয়ে একবার এও ভাবলাম যে, হাঁটতে হাঁটতে কোনো একদিকে চলে যাওয়াই হয়তো ভালো হবে আমার জন্য। এক ছেলে এমনিতেই ক্যাসল ভিউ কবরস্থানে শুয়ে আছে, আরেক ছেলেও যদি দক্ষিণ উইন্ডহ্যাম কিশোর সংশোধনাগারে গিয়ে পড়ে, আমার বাবা-মায়ের জন্য ব্যাপারটা খুব সুখকর হবে না। যে মুহূর্তে ঘটনার সময় ডাম্পের গেট বন্ধ থাকা আর আমার কথার ফাঁক মাইলো প্রেসম্যানের মোটা মাথায় ঢুকবে, সে বুঝতে পারবে, পাবলিক প্রোপার্টি হোক আর না হোক, আমি বেআইনিভাবে বেড়া ডিঙ্গিয়েই ঢুকেছি। সে যে সাথে সাথে পুলিশের কাছে ছুটে যাবে, এ ব্যাপারে আমার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। হয়তো আসলেই আমার দিকে কুকুর লেলিয়ে দেওয়ার অধিকার তার ছিল। আর চপার নারকীয় দানব তোক আর না হোক, সেই দৌড়ে জিতে বেড়া ডিঙ্গাতে না পারলে সে যে অন্তত কামড়ে আমার জিন্স ছিঁড়ে ফেলত, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। পুরো ব্যাপারটা সেদিনের স্মৃতিতে কেমন একটা কালো দাগ ফেলে দিয়েছিল। সেই সাথে আরেকটা ব্যাপার আমার মাথায় উঁকি দিচ্ছিল। আমরা যে মজা করার জন্য রোমাঞ্চ অভিযানে বেড়িয়ে পড়েছি, এটা হয়তো এমন হালকা কিছু না। এজন্য হয়তো এটুকু দুর্ভাগ্য আমাদের প্রাপ্যই ছিল, হয়তো স্রষ্টা এসবের মাঝ দিয়ে বারবার আমাদেরকে ফিরে যেতে ইশারা করছেন। তাছাড়া, আমরা আসলে করছিটাই বা কী? ট্রেনের আঘাতে ভেঙেচুরে যাওয়া একটা মৃতদেহ দেখে কী হবে আসলে? কিন্তু যত যাই হোক, পুরো ব্যাপারটা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের কেউই থামতে রাজি হবে বলে মনে হয় না।

আমরা তখন ব্রিজের একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছি এই ব্রিজ দিয়েই নদীর ওপর দিয়ে রেললাইন সামনে এগিয়ে গেছে–ঠিক সেই মুহূর্তে টেডি হঠাত কান্নায় ভেঙে পড়ল। যে ঝড় ওর বুকের মাঝে পাক খেয়ে খেয়ে বেড়ে উঠেছে, তার সবটুকু বেরিয়ে এল প্রবল দাপটে। কথার কথা না, কান্নার দমকে কুঁজো হয়ে গিয়ে থেকে থেকে ওর শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছিল। প্রচন্ড ধাক্কা সামলাতে না পেরে মাটিতেই বসে পড়ল ও, পেটের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে পোড়া কানের যেটুকু বাকি আছে, সেখানটা চেপে ধরল, সামলাতে চেষ্টা করছে। আমরা কেউই বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কী করা উচিত। ফুটবল ট্যাকেল করতে গিয়ে পড়ে মাথায় ব্যথা পেলে কিংবা সাইকেল চালাতে গিয়ে পড়ে ভেঙে ফেললে কী করতে হয়, সে ব্যাপারে তাও আমাদের কিছুটা ধারণা ছিল। কিন্তু শারীরিকভাবে ঠিকঠাক একটা মানুষ এমনভাবে আকুল হয়ে কাঁদলে কী করতে হয়, এ ব্যাপারে আমাদের আসলেই কোনোরকম ধারণা ছিল না। পকেটে হাত রেখে একটু দূরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিলাম ওকে।

এই শোন… ভার্ন কোমল গলায় বলল। আমি আর ক্রিস খুব আশা নিয়ে ওর দিকে তাকালাম। এই শোন শুরু হিসেবে বেশ ভালোই বলতে হবে। কিন্তু ওখানেই শেষ, ভার্ন আর কিছুই বলতে পারেনি। রেললাইনের কাঠের তক্তাগুলোর একটার উপর ঝুঁকে বসে এক হাতে চোখ ঢেকে রেখেছিল সে। রাস্তার পাশে বসে থাকা মানুষজন এভাবে বসেই সুর করে গাইতে থাকে, একটা কিছু দিয়ে যান…, কথাটা মনে পড়ে গেল। পার্থক্য হচ্ছে, পুরো ব্যাপারটার মাঝে হাস্যকর কিছুর বদলে ভয়াবহ মন খারাপ করে দেওয়া কিছু একটা ছিল।

শেষ পর্যন্ত যখন কান্নার দমকটুকু আস্তে আস্তে কমে আসতে লাগল, ক্রিস এগিয়ে গেল ওর কাছে। ক্রিস আমাদের গ্যাংয়ের সবচেয়ে পোড় খাওয়া শক্ত মানুষ হলেও (মনে মনে ভাবছিলাম, জেইমি গ্যালান্ট থেকেও সম্ভবত বেশি) যে কাউকে শান্ত করার জন্য ওরচেয়ে ভালো আর কেউ হতেই পারে না। সহজাত একটা কিছু ছিল ওর ভেতরে। এমনও দেখেছি যে, অচেনা একটা বাচ্চাছেলে খেলতে গিয়ে হাঁটুতে ব্যথা পাওয়ার পর ক্রিস ওর পাশে গিয়ে বসেছে এবং কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, সে ওই বাচ্চাটার সাথে দিব্যি গল্প জুড়ে দিয়েছে। সে গল্পের বিষয়বস্তু দ্য শ্রাইন সার্কাসের শহরে আসা থেকে শুরু করে টিভিতে প্রচারিত হাকলবেরি হাউন্ড পর্যন্ত ঘুরপাক খেত। গল্প করতে করতে একসময় দেখা যেত, ব্যথার কথা বাচ্চাটার আর মনে নেই। ক্রিস খুব ভালো পারত ব্যাপারটা, ভালো পারার মতো যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ছিল ওর ঝুলিতে।

শোন টেডি, তোর বাবার ব্যপারে অমন বুড়ো হাবড়া কী বলল, তাতে কি আসলে কিছু আসে যায়, বল? যাওয়া উচিত? তোর বাবা তো তোের বাবাই, ওই হারামজাদার কথায় তো ওনার সবকিছু মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছে না, তাই না?

টেডি মাথা ঝাঁকাল। না, কিছু যায় আসে না, কিছু পাল্টাচ্ছেও না। কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে, অনেক নিষ্ঠুম, দীর্ঘ একাকি রাত জেগে জানালা দিয়ে আকাশের চাঁদের পানে চেয়ে টেডি অনেক অনেকবার এই ব্যাপারগুলো নিয়ে ভেবেছে। অনেক অনেকদিন সকাল-সন্ধ্যা ওর কানের ভেতরে প্রতিধ্বনি তুলেছে এই ভাবনাগুলো। এমন দিনের বেলায় এতগুলো মানুষের সামনে এই কথাগুলোই যখন আরেকজন মানুষ স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেছে, বুকের ভেতরে কোথাও কিছু একটা হয়তো ভেঙেচুরে গেছে ওর, এলোমেলো হয়ে গেছে সবকিছু। ও ছাড়া বাকিরাও যে ওর বাবাকে উন্মাদ মনে করে, এই ভাবনাটা একেবারে নাড়িয়ে দিয়েছে ওকে। কিন্তু হ্যাঁ, এতে কিছুই পাল্টে যাচ্ছে না। কিছু না।

যত যাই হোক, তোর বাবা নরম্যান্ডির সৈকতে যুদ্ধ করেছিলেন, এটাই সত্যি, তাই না? বলতে বলতে টেডির ময়লা, ঘর্মাক্ত এক হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে মৃদু চাপ দিল ক্রিস। টেডি মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিল, এখনো কাঁদছে। নাক থেকে সর্দি বেরিয়ে এসেছে কান্নার দমকে।

তোর কি মনে হয় ওই ময়লার বালতি নরম্যান্ডিতে যুদ্ধ করেছে?

টেডি পাগলের মতো মাথা নেড়ে বলল, না না! করেনি!

তোর কি মনে হয় ওই বুড়ো হাবড়া আদৌ তোকে চেনে?

না! কিন্তু—

তোর বাবাকে চেনে, বল? সে কি তোর বাবার কাছের কেউ?

না! চিৎকার করে উঠল টেডি, মাইলো ওর বাবার কাছের কেউ হতে পারে, এই ভাবনাটাই ক্ষেপিয়ে দিয়েছে ওকে। বুক কেঁপে উঠল, সাথে আরেকদফা অশ্রু বেরিয়ে এল চোখ থেকে।

এক হাতে কানের ওপর থেকে চুল সরিয়ে দিল সে। ডান কানে বসে থাকা হিয়ারিং এইডের বাদামি প্লাস্টিকের বোতামটাও দেখা যাচ্ছিল। সত্যি কথা বলতে, ওর পোড়া কানের আকারের চেয়ে হিয়ারিং এইডের আকার দেখেই বরং মানবিক মনে হয়।

ওসব ফালতু কথা তো চাইলেই বলা যায়। কিন্তু কাজের বেলায় করতে পারে কয়জন, বল?

টেডি মাথা ঝাঁকাল, চোখ তুলে তাকাচ্ছে না।

আর, তোর আর তোর বাবার মধ্যে যে সম্পর্ক, ওসব ফালতু কথা দিয়ে তো আর সেটা রাতারাতি বদলে যাবে না, তাই না? আবারো অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল, সম্ভবত বুঝতে চেষ্টা করছে, কথাগুলো কতটুকু সত্যি। একজন মানুষ মাত্র কিছুক্ষণ আগে ওর ভেতরের ক্ষতটায় আবারো আঘাত দিয়েছে। সরল ভাষায়, টেডি ঠিক যা যা ভাবত, সে কথাগুলোই স্পষ্ট করে উচ্চারণ করেছে সে। আবারো নিঘুম রাত আসবে ওর জীবনে, এবং এইবেলা শুধু ওর ভাবনা না, সাথে কথাগুলোও বাজতে থাকবে মাথার ভেতরে। বারবার বুঝে দেখতে চেষ্টা করবে, ওর বাবা

আসলেই পাগল কি না এবং সেকশন আটের আওতায় কতটুকু পড়েন।

ক্রিস ওর মন ভালো করে দেওয়ার জন্য আরেকটু ব্যাখ্যা করল, ওই হারামজাদা শুধু তোকে বেড়ার ওপাড়টায় নিতে চাচ্ছিল বাগে পাওয়ার জন্য। তোর বাবার ব্যাপারে ও কিছু জানে না। কিছু না। ওই ব্যাটা যাদের সাথে মেলো টাইগার বারে মদ-টদ খেয়ে বেড়ায়, ওসব আড্ডার কোনোটায় লোকমুখে যা শুনেছে, তোকে ক্ষেপানোর জন্যে সেসবই কেবল টানা বলে যাচ্ছিল…বুঝতে পারছিস আমার কথা? হ্যাঁ?

টেডির কান্না মোটামুটি থেমে গেছে বলা যায়। উঠে দাঁড়িয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, আমি ঠিক আছি। গলা শুনে বোঝা গেল নিজেকেই বোঝাচ্ছে, হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি। তারপর চশমাটা টেনে চোখে বসিয়ে দিল, মনে হলো যেন খালি মুখটা কিছু দিয়ে ঢেকে ফেলতে চাইছে। হালকাভাবে হাসার চেষ্টা করতে করতে একহাতে উপরের ঠোঁটের কাছে লেগে থাকা সর্দিটুকু মুছে নিয়ে বলল, আমি একেবারে ছিচকাঁদুনে, তাই না?

মোটেও না, ভার্নের গলায় অস্বস্তি, কেউ যদি আমার বাবার ব্যপারে অমন কিছু বলতো–

তাহলে তোর ওকে খুন করে ফেলতে হতো, তাই না, ক্রিস? ভয়ঙ্কর একগুঁয়ে এবং আত্মম্ভরী শোনাল টেডির গলা, যেন সত্যিকার অর্থেই খুন করার কথা ভাবছে।

হ্যাঁ, বলতে বলতে ক্রিস আলতো করে টেডির পিঠ চাপড়ে দিল।

গর্ডি, তুইও তাই করতি, না?

তাই তো মনে হয়। বলার সময় ভাবছিলাম, যে বাবা ওকে প্রায় খুনই করে ফেলেছিল, সেই মানুষটাকে ও এত বেশি ভালোবাসে কেমন করে? আর, তিন বছর বয়সে সিঙ্কের নিচ থেকে নিয়ে ব্লিচিং পাউডার খাওয়া শুরু করেছিলাম দেখে যে মেরেছিল, এর পর বাবা জীবনে কখনো গায়ে হাত তোলেননি। অথচ ওই মানুষটাকে নিয়ে এভাবে ভাবতে পারি না কেন যেন।

রেললাইনের পাশ ধরে আরো প্রায় দুইশ গজ মতো হেঁটে এসেছি, এমন সময় মৃদু গলায় টেডি বলল, তোদের দিনটা নষ্ট করার জন্য আমি দুঃখিত রে। বেড়ার ওখানে যা হলো, পুরো ব্যাপারটাই অনর্থকভাবে হলো আমার জন্য।

এত ভালো সময় চেয়েছিলাম বলে তো মনে হচ্ছে না।

ভার্নের কথা শুনে ক্রিস ওর দিকে ফিরে তাকাল, কী বলতে চাচ্ছিস? ফিরে যেতে চাস?

না। যেটা ভাবছে, সেটা কীভাবে ঠিক করে বুঝিয়ে বলবে বুঝতে না পেরে হিমশিম খাচ্ছিল ভার্ন। ওর মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল সেটা। আমরা কিন্তু কোনো পার্টি করতে যাচ্ছি না, যাচ্ছি একটা মৃতদেহ দেখতে। লাশ! ব্যাপারটা তো অমন আনন্দের কিছু হওয়ার কথা না, তাই না? একটু ভয় পাওয়াটাই তো স্বাভাবিক। তোরা কি বুঝছিস, কী বলতে চাচ্ছি?

কেউ কিছু বলল না। ভার্ন বলে গেল, মানে, আমি মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখি। যেমন, ড্যানি নটন যে সেবার বেশ কিছু পুরনো বইপত্র রেখে গেল, মনে আছে? ওই যে, ভ্যাম্পায়ার, মানুষ কাটাকুটি–এসব ছিল। মাঝরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যেত আমার। স্বপ্নে দেখতাম, একটা লোক কোনো এক বাসায় গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েছে, মুখের রং কেমন যেন সবুজ মতোন। এরকম স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেলে মনে হতো, খাটের নিচে বুঝি কিছু একটা লুকিয়ে আছে, আর আমি যদি ভুলেও খাটের পাশ দিয়ে হাত নামিয়ে দেই, ওই জিনিসটা আমাকে ধরে ফেলবে, টেনে নিয়ে যেতে চাইবে।

সবাই একসাথে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলাম। রাতের অন্ধকারে ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে যাওয়ার এই অনুভূতির সাথে আমরা ভালোই পরিচিত। সে সময় যদি কেউ আমাকে বলত, কয়েক বছর পরে এসব দুঃস্বপ্নের গল্প বিক্রি করেই আমি মিলিয়ন ডলার আয় করতে পারব, হেসেই উড়িয়ে দিতাম।

আর আমি কিছু বলতেও পারতাম না। কাকে বলব? আমার ভাই বিলিকে তো তোরা চিনিসই। সে জানলে পুরো দুনিয়া জুড়ে ঘোষণা দিয়ে বেড়াবে। অসহায়ভাবে কাঁধ ঝাঁকাল ভার্ন, কাজেই, হ্যাঁ, ওই ছেলের লাশ দেখা নিয়ে আমি ভয় পাচ্ছি। মনে হচ্ছে, যদি অবস্থা বেশি খারাপ হয়।

ঢোঁক গিলে ক্রিসের দিকে তাকালাম। তীক্ষ্ণ চোখে ভার্নের দিকে তাকিয়ে আছে সে, মাথা নেড়ে বলে যেতে বলছে।

তাই ওই লাশটা যখন দেখব, ওটার অবস্থা যদি ভালো না হয়, আমি হয়তো বাকি জীবন রাতের বেলা বিছানার নিচে ওর কথা ভেবে ঘেমে নেয়ে উঠব। মনে হবে রক্তের পুকুরে ক্ষত-বিক্ষত কেউ একজন পড়ে আছে। টিভিতে রান্নার অনুষ্ঠানে যেসব সালাদ কাটার মেশিন দেখায়, অমন কিছু একটার মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এলে যেরকম ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কথা, শুধু চোখের মনি আর গোছা গোছা চুল ছাড়া আর কিছু নেই, তারপরও বিচিত্র কোনো উপায়ে নড়ছে, এগিয়ে এসে ধরতে চাইছে–

হায় জিশু! টেডি ভারি গলায় বলল, তুই দেখি একেবারে বাচ্চাদেরকে ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ানোর গল্প ফেঁদে বসছিস!

কী করব, মাথার ভেতরের চিন্তাভাবনা তত আমি চাইলেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। তারমানে এই না যে, আমি ফিরে যেতে চাই। দুঃস্বপ্ন দেখি আর যাই দেখি, ওকে না দেখে আমি ফিরতে চাই না। কিন্তু দেখতে যে যাব, এই সময়টুকু যে ভালো সময় হবে, এমনটা আশা করাটা আমার কাছে ঠিক মনে হয় না।

ঠিক বলেছিস। ক্রিস কোমল গলায় বলল, হয়তো এই সময়টুকু ভালো সময় না হওয়াটাই ঠিক আছে।

ভার্ন আকুল গলায় বলল, আমি তোদেরকে যা বললাম, তোরা নিশ্চয়ই আর কাউকে বলবি না, তাই না? কারণ, বললে না, কেউ বুঝবে না, জানিস? মানে, দুঃস্বপ্নের কথা বলছি না, ওসব সবাই দেখে। কিন্তু এই যে মাঝরাতে জেগে বসে থাকা, খাটের নিচে কেউ বুঝি আছে, এমন ভাবতে থাকা–এসব। বুগিম্যানের কথা ভেবে ভয় পাওয়ার মতো বয়স নেই যে আমার।

আমরা সবাই কথা দিয়েছিলাম, কাউকে বলব না। তারপর আবার নিরবতা, চুপচাপ অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে হাঁটছিলাম। ঘড়িতে তখনো তিনটাও বাজেনি, কিন্তু মনে হচ্ছিল অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। সময়ের সাথে সাথে সূর্যের তাপ বেড়েছে, তাছাড়া কত কিছু ঘটে গেছে এর মাঝে! অথচ আমরা তখনো হারলোতেও পৌঁছাতে পারিনি। বুঝতে পারছিলাম, সন্ধ্যার আগে গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে হলেও আরো অনেক জোরে হাঁটা লাগবে।

রেলরোড জাংশনে একটা লম্বা, মরচে পড়া থামের মাথায় সিগন্যাল লাগানো। সিন্ডারের ছোট ছোট টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে সিগন্যালের উপরে লাগানো স্টিলের ছোট্ট পতাকাটার উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে মেরেছিল সবাই, কিন্তু কেউই লক্ষ্যভেদ করতে পারেনি। জাংশন পেরিয়ে সাড়ে তিনটার দিকে ক্যাসল নদী আর জিএসঅ্যান্ডডব্লিউএম ব্রিজের কাছে এসে পৌঁছালাম। এই ব্রিজ ধরেই আমাদেরকে এবারে নদীটা পেরিয়ে যেতে হবে।

অধ্যায় ১৪

১৯৬০ সালের সে সময় নদীটা একশ গজের চেয়েও বিস্তৃত ছিল। এরপরেও দেখতে গিয়েছি, মাঝের বছরগুলোতে অনেক সরু হয়ে গেছে নদীটা। মানুষজন বারবার ঝামেলা করেছে, আশেপাশের কল-কারখানাগুলোর সুবিধার কথা ভেবে ইচ্ছেমতো যেখানে-সেখানে বাঁধ দিয়েছে, এর ফলে ধীরে ধীরে চুপসে গেছে নদীটা। সে সময় পুরো নদী জুড়ে কেবল তিনটা বাঁধ ছিল, পুরো নিউ হ্যাঁম্পশায়ার আর মেইনের অর্ধেকটা মিলে নদীটা দাপিয়ে বেড়াত। ক্যাসল রকে সে সময় এত ঘনবসতি ছিল না। দেখা যেত, প্রতি তিন বছর পরপর নদীর দুকুল উপচে উঠে হারলোর দিকে কিংবা ডেনভারস জাংশনের দিকে, কিংবা দুই জায়গাতেই রুট একশ ছত্রিশ পুরো তলিয়ে গেছে।

মহামন্দার পর থেকে এখন পর্যন্ত পশ্চিম মেইনের সবচেয়ে শুষ্ক গ্রীষ্মের শেষাশেষি। পানি কম হলেও নদীটা তখনো দারুণ প্রশস্ত ছিল। যে পাড়ে ক্যাসল রক, সেখানে দাঁড়িয়ে ওপাশে হারলোর বিশাল বনের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল বুঝি নতুন কোনো দেশ। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হচ্ছে, আবছায়া রোদের পরশে পাইন আর স্পাউস গাছগুলোকে মনে হচ্ছে নীলাভ। পানির পঞ্চাশ ফিটের মতো উপর দিয়ে গেছে রেললাইনটা, জায়গায় জায়গায় কাঠের থাম এবং কাঠের ক্রস-বিম কাঠামোটাকে ধরে রেখেছে। অগভীর পানিতে তাকালে নদীর বুকে দশ ফিট গভীর করে পোঁতা সিমেন্টের প্লাগগুলোর মাথা চোখে পড়ে। এই প্লাগগুলোই কাঠের কাঠামোটার ভিত্তি ব্রিজটাকে ধরে রেখেছে।

ব্রিজের অবস্থাও খুব একটা ভাল না। ছয় বাই চার ফিটের সরু কাঠের তক্তা দিয়ে বানানো প্ল্যাটফর্মের ওপর দিয়ে চলে গেছে রেললাইনের ট্র্যাকগুলো। তক্তাগুলোর মধ্যে আবার চার ইঞ্চি করে ফাঁকা আছে, যার মধ্যে দিয়ে তাকালে চোখে পড়ে বয়ে চলা নদী। দুই পাশে, রেললাইনের ট্র্যাক আর ব্রিজের কিনারার মধ্যেকার দূরত্ব কেবল আট ইঞ্চি। ট্রেন চলে আসলে চাপা পড়া থেকে হয়তো কোনোরকমে রক্ষা পাওয়া সম্ভব, কিন্তু ট্রেনের যে বাতাস, এইটুকু জায়গার মাঝে দাঁড়ানো যে কাউকে একেবারে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। আর একবার কোনোভাবে ছিটকে যেতে পারলে হয়েছে, অগভীর পানির নিচে পাথরের কঠিন মেঝে মৃত্যু বুকে নিয়ে দুহাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করবে।

ব্রিজের দিকে তাকাতেই পেটের মাঝে কেমন যেন পাক দিয়ে উঠল। ভয়, প্রচন্ড ভয় সাঁড়াশি দিয়ে চেপে ধরতে চাইছে। কিন্তু এর সাথে অদ্ভুত এক উত্তজেনাও আছে। এমন একটা কিছু করতে পারলে বাড়ি ফিরে যদি আদৌ বাড়ি ফেরা হয় আরকি-বন্ধু-বান্ধবদের বলার মতো বিশাল একটা জিনিস হবে আসলে। সারাজীবন গল্প করা যাবে এ নিয়ে। টেডির চোখ এরই মাঝে উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করতে শুরু করেছে। আমি ভাবছিলাম, সে নিশ্চয়ই জিএস অ্যান্ড ডব্লিউএম রেললাইনের ব্রিজ দেখতে পাচ্ছে না, বরং লম্বা বালুময় সমুদ্র সৈকতের ছবি চোখে ভাসছে ওর। তীরে আছড়ে পড়া ঢেউ ছুঁয়ে যাচ্ছে হাজার খানেক ট্যাংক ল্যান্ডিং শিপের ধাতব দেহ। দশ হাজার সৈন্যের বুট জুতোর আঘাতে বালু উড়ছে, ছাপ পড়ছে জুতোর। সৈন্যদলের হাতে মুহূর্মুহূ গর্জে উঠছে মেশিন গান, গ্রেনেড বৃষ্টিতে ছেয়ে যাচ্ছে পুরো সমুদ্র সৈকত, জায়গায় জায়গায় জমে উঠছে প্রতিপক্ষ জার্মান সেনাদের মৃতদেহ!

আমরা ব্রিজের মাথার কাছে, রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। এখানে এসে সরু উঁচু রাস্তা কিংবা বলা যায় নদী-তীরের বাঁধ–শেষ হয়ে নেমে গেছে নদীর বুকে এবং ব্রিজ শুরু হয়েছে। উঁকি দিয়ে খাড়া নেমে যাওয়া ঢালটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। সিন্ডার্সের বুকে জায়গা করে নিয়েছে ধূসর পাথরের স্ল্যাব, ফাঁকে ফাঁকে মাথা বের করে উঁকি দিচ্ছে নানা ধরনের রুক্ষ আগাছা। আরো কিছুটা নিচে স্ল্যাবের ফাঁকে বেশ কিছু দেবদারু গাছ দেখা যাচ্ছে, দেহের ভারে যাদের শেকড় বেরিয়ে চলে এসেছে, মাথা ঝুঁকে পড়েছে নিচের দিকে, যেন গভীর মনোযোগে পানির বুকে নিজেদের করুণ দশা দেখছে।

ক্যাসল রকের ভেতরে ক্যাসল নদীর যে অংশটুকু দেখা যায়, মেইন-এর বিভিন্ন কলকারখানার হাতে পড়ে সে অংশটুকুর পানির বারোটা বেজে গেছে। অথচ এখানে নদীর পানি বেশ পরিস্কার। যদিও এখানেও পানির বুকে কোনো মাছকে ঝাঁপাঝাঁপি করতে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু অন্তত নদীর মেঝেটুকু স্পষ্ট দেখা যায়; মাছ দেখতে চাইলে অবশ্য নিউ হ্যাঁম্পশায়ারের দিকে আরো দশ মাইলের মতো এগিয়ে যেতে হবে। ক্যাসল রকের ভেতরের পানিতে মাছ তো নেই-ই, বরং নদীর তীরে, পাথরের ফাঁকে ফাঁকে নোংরা, পুরনো আইভরি রংয়ের ফোম ভাসতে দেখা যায়। সাথে আছে দুর্গন্ধ। মনে হবে, হাজার বছরের নোংরা জামাকাপড় বুঝি লন্ড্রিতে দেওয়া হয়েছে। সেই পানিতে গঙ্গা ফড়িংয়ের দল আবার খুশি মনে ডিম পেড়ে রাখে। ট্রাউট তো দূরের কথা, গুড়ো গুঁড়ো যে শাইনার মাছ সবখানে থাকে, সেসবও নেই যে এসব ডিম খেয়ে কিছু একটা বিহিত করবে।

ম্যান! ক্রিসের কোমল গলা শোনা গেল।

কাম অন! টেডি গোঁয়ারের মত চেঁচিয়ে উঠল, চল চল! এরই মাঝে ব্রিজে উঠে গেছে, ছয় বাই চার ফিটের কাঠের তক্তায় পা ফেলতে শুরু করে দিয়েছে।

পরের ট্রেন কখন আসতে পারে, কেউ কি জানিস? ভার্নের গলায় অস্বস্তি। সবাই কাঁধ ঝাঁকিয়ে ত্যাগ করলাম, জানি না।

আমি মৃদু গলায় বললাম, আরেকটা রাস্তা আছে, রুট একশ ছত্রিশ এটা মোটেও ঠিক হবে না! টেডি আকুল গলায় বলল। ওদিক দিয়ে যেতে হলে নদীর পাশ দিয়ে একবার পাঁচ মাইল ঘুরে প্রথমে ওখানে পৌঁছাতে হবে, তারপর পাঁচমাইল উল্টো ঘুরে আবার এখানে আসতে হবে। সন্ধ্যা হয়ে যাবে একেবারে! অথচ এদিক দিয়ে ব্রিজ পেরিয়ে ওখানটায় যেতে লাগবে মোটে দশ মিনিট!

কিন্তু এর মাঝে যদি ট্রেন চলে আসে, তাহলে কিন্তু আর কোথাও যাওয়াই হবে না। ভার্ন জবাব দিল। টেডির দিকে ফিরেও তাকায়নি, ওর চোখ তখনো সম্মোহিতের মতো নদীর বুকে আটকে আছে।

কে বলল এ কথা? বলেই টেডি হুট করে ব্রিজের কিনারার একটা কাঠ ধরে ঝুলে পড়ল। ও যেহেতু এখনো ব্রিজের একেবারে মাথার কাছে আছে, তাই ওর পায়ের নিচে কিছুটা মাটি আছে এবং স্নিকার্সগুলো মাটি ছুঁই ছুঁই। করছে। অর্থাৎ হাত ছুটে গেলে মাটিতে পড়বে। কিন্তু মাথার উপরে ঝড়ের বেগে ছুটে চলা বিশাল এক ট্রেন আর পায়ের পঞ্চাশ ফিট নিচ দিয়ে বয়ে চলা ক্রুদ্ধ এই নদীর উপরে ব্রিজের মাঝামাঝি গিয়ে যদি এভাবে ঝুলে পড়তে হয়, তার ওপর সম্ভাবনা আছে, এমন অবস্থায় ট্রেন ছুটে যাওয়ার ফলে যে ভীষণ স্পার্ক হবে, ওসব ছুটে এসে পড়বে চুলে আর ঘাড়ের পেছনে–এইটুকু চিন্তা করেই আমার কেমন যেন অসুস্থ বোধ হতে লাগল।

কঠিন কিছু তো না, দেখ! বলে হাত ছেড়ে দিয়ে টেডি মাটিতে নেমে এল। তারপর হাত ঝাড়তে ঝাড়তে আবার উঠে এসে দাঁড়াল আমাদের পাশে।

ট্রেনটা যদি ২০০ বগির হয়?

ক্রিস চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকাল টেডির দিকে, তুই কি ওর মাঝে ওভাবে পাঁচ থেকে দশ মিনিট ধরে ঝুলে থাকতে পারবি?

ভয় পাচ্ছিস? টেডি পাল্টা চেঁচিয়ে উঠল।

শুধু জানতে চাচ্ছি কী করবি, আর কিছু না, ক্রিস হাসছে। ক্ষেপে যাস না, মাথা ঠান্ডা কর, বাপ।

চাইলে তোরা ওদিক দিয়ে পুরো রাস্তা ঘুরে যেতে পারিস, কিন্তু আমি এদিক দিয়েই যাব। সমস্যা নেই, ওপাশে গিয়ে তোদের জন্য অপেক্ষা করব, চিন্তা করিস না! লাগলে একপাক ঘুম দিয়ে উঠলাম, আমার জন্য বরং ভালোই হবে!

এদিক দিয়ে দিনে এক-দুইটার বেশি ট্রেন যায় বলে তো মনে হয় না, আমি বললাম। একটা তো এর মাঝে চলেই গেছে। আর দেখ, রেললাইনের মাঝ দিয়ে কেমন জায়গায় জায়গায় ঘাস উঠেছে। এর মানে, এই রেললাইনটা খুব বেশি ব্যবহৃতও হয় না আসলে। ক্যাসল রক আর লিউইস্টনের মধ্যেকার রেললাইনের কথা ভাবছিলাম, ওখানে কখনো কোনো ঘাস চোখে পড়েনি।

দেখলি? তর্কে জিতে গেছে ভেবে টেডির পুরো মুখ আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠল।

কিন্তু আজকে অন্তত আরো একটা ট্রেন আসার সম্ভাবনা আছে।

হ্যাঁ, সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে জবাব দিল ক্রিস। ওর চোখ দুটোও হঠাৎ উত্তেজনায় জ্বলতে শুরু করেছে। আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, তুই পারবি যেতে, সুশ্যান্স? আমি তোকে ডেয়ার দিচ্ছি।

যে ডেয়ার দেয়, তার আগে যাওয়ার কথা না?

আচ্ছা, বলে ক্রিস সবাইকে একবার চোখে ঘুরিয়ে দেখে নিল। এদিকে কোনো ভীতুর ডিম আছে কি?

না! টেডি চিৎকার করে জানাল।

ভার্ন বার দুয়েক গলা খাঁকারি দিয়ে নিস্তেজ গলায় ছোট্ট করে বলল, না। তারপর দুর্বলভাবে একটুখানি হাসার চেষ্টা করল।

ঠিক আছে।

তারপরেও সবাই, এমনকি টেডিও, কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করছিল। বিবর্ণ মুখে রেললাইনের যতদূর চোখ যায়, ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম কিছুক্ষণ। তারপর নিচু হয়ে ট্র্যাকে হাত রেখে বোঝার চেষ্টা করলাম। তপ্ত ট্র্যাক হাতের তালু পুড়িয়ে ফেলছে, সেজন্য একদমই কিছু মনে হচ্ছে না। কেবল ভাবছিলাম, যদি কিছু টের পাওয়া যায়। কিছু না!

আচ্ছা, শেষ পর্যন্ত বলতেই হলো।

বলেই বুঝতে পারলাম, পাকস্থলির ভেতরে কেউ একজন গর্ত খুঁড়ে নিচে নেমে যেতে চাইছে। খুঁড়তে খুঁড়তে অণ্ডকোষে নেমে গেল সে, তারপর গর্ত দিয়ে সাঁড়াশি হাতে আমার হৃৎপিন্ডটা টেনে নামিয়ে নিয়ে চড়ে বসল।

একে একে সবাই ব্রিজে উঠে পড়লাম। ওদেরকে বলেছিলাম, যারা ডেয়ার দেয়, তারা আগে করে দেখায়। তাই সবার আগে আছে ক্রিস, তারপর টেডি, তারপর ভার্ন আর আমি সবার শেষে।

ট্র্যাকের মাঝের কাঠের তক্তাগুলোতে সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। উচ্চতাভীতি থাকুক বা না থাকুক, সারাক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়েই হাঁটতে হচ্ছে, এক মুহূর্তের জন্যেও চোখ ভোলার উপায় নেই। পা ফেলার আগে নিশ্চিত হতে হবে তো, আদৌ কাঠে পা ফেলছি নাকি বাতাসে। ভুলক্রমে বাতাসে এক পা ফেললেই হয়েছে, দুই পাশে দুই পা ঢুকে গিয়ে ধাঁ করে উরুসন্ধিতে বাড়ি খেতে হবে, কিংবা ভাঙা গোড়ালি নিয়ে বাকি পথ হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করে মাশুল দিতে হবে।

তাই, যখন হঠাৎ করে পায়ের নিচে মাটি আর পাথরের জায়গায় নদী দেখা গেল, থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এখন থেকে যে কয় পা সামনে আগাবো, আমাদের বোকার মতো নেওয়া প্রায় আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত ততই শক্তভাবে ঘাড়ে চেপে বসবে। পায়ের নিচে নদীর বুকে পাথরের অসহায় আত্মসমর্পনের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে না পেরে চোখ ফিরিয়ে নিলাম।

তাকিয়ে দেখি ক্রিস আর টেডি অনেকটা সামনে চলে গেছে। দেখে মনে হলো বুঝি অর্ধেক ব্রিজ পেরিয়ে গেছে এরইমধ্যে। ওদের আর আমার মাঝখানে আছে ভার্ন, প্রতিবার পা ফেলার আগে রাতারাতি গবেষণা করে নিচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে কোনো বুড়ির কিছু একটা বুঝি পড়ে গেছে, জীবন বাজি রেখে সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। পিঠ বেঁকে গেছে, ভারসাম্য রক্ষার ভঙ্গিতে হাত দুটো ছড়িয়ে রেখেছে দুপাশে। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম একবার, অনেক দূর! দ্রুত আগানো দরকার। যেকোনো সময় একটা ট্রেন চলে আসতে পারে। মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আছে আত্মসম্মান বোধ। আজকে যদি না যাই, সারাজীবনের জন্য ওদের কাছে। কাপুরুষ হয়ে যাব।

নিচের দিকে তাকিয়ে এগোতে শুরু করলাম। একের পর এক কাঠের তক্তা আর ফাঁকে ফাঁকে পানির ছুটে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে মাথা ঘোরাচ্ছিল। প্রতিবার পা ফেলার আগে যদিও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, কাঠের উপরেই ফেলছি–আমার মস্তিষ্ক নিশ্চিত করতে চাইছে পা শেষ পর্যন্ত শূন্যে গিয়েই পড়বে।

শরীরের ভেতরে-বাইরে, চারপাশের সবরকম শব্দ স্পষ্ট শুনতে। পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল, কোনো এক উন্মাদ অর্কেস্ট্রা বাজতে শুরু করেছে। হৃৎপিন্ডের ঢাক ঢাক শব্দ শুনতে পাচ্ছি, কানের মধ্যে রক্ত এত জোরে বাড়ি মারছে যে, মনে হচ্ছে, কেউ বুঝি হাতুড়ি দিয়ে ড্রাম বাজাচ্ছে। সাইনাসে চাপ পড়ছিল, যেন ভায়োলিনে কেউ একজন একটানা উঁচু থেকে আরো উঁচু লয়ে ওঠার চেষ্টা করেই যাচ্ছে। নদীর হিস হিস, গাছের গুঁড়ি খোঁড়ার চেষ্টারত পোকাদের গুনগুন, চিকাড়ি পাখির একঘেয়ে কান্না এবং দূরে, বহুদূরে কোথা ঘেউ ঘেউ করে চলা একটা কুকুর হয়তো চপারই হবে, কে জানে?–সবকিছু স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। ক্যাসল নদীর স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ প্রবলভাবে নাকে বাড়ি মারছে। উরুর লম্বা পেশিগুলো কাঁপছে থরথর করে। বোঝার চেষ্টা করছি, চার হাত-পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে আগানোটাই কি বেশি নিরাপদ হবে নাকি। নিঃসন্দেহে সময়ও কম লাগবে। কিন্তু এ কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব না, আমাদের কারো পক্ষেই আসলে সম্ভব না। জেম থিয়েটারের শনিবারের ম্যাটিনি শোয়ের সিনেমাগুলো আমাদেরকে আর কিছু না শেখালেও একটা জিনিস ভালোই শিখিয়েছে, হামাগুড়ি দেয় কেবল কাপুরুষেরা। এটি হলিউডের পবিত্র গসপেলের মৌলিক কথাগুলোর একটি। নায়কেরা স্বাভাবিকভাবে হেঁটেই এগোবে। হাঁটতে গিয়ে শরীরের ভেতরে অ্যাড্রেনালিন নিঃসরণের জন্য তোমার সাইনাসে চাপ পড়ে ভায়োলিনের তার টান খেয়ে যতই উঁচুগ্রামে উঠুক, উরুর পেশিগুলো যতই পাগলের মত থরথর করে কাঁপতে থাকুক, কিছু করার নেই।

প্রায় অর্ধেক ব্রিজ পেরিয়ে এসে আরেকবার থেমে চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকালাম। মাথা ঘোরানোটা ধীরে ধীরে অসহ্য হয়ে উঠছে। আবিষ্কার করলাম, শূন্য বাতাসের মধ্যেও নাকের ঠিক সামনেই কাঠের তক্তাগুলো ভাসছে। অনেকটা সময় উপরের দিকে তাকিয়ে থাকার পরে ভাসমান তক্তাগুলো চোখের সামনে থেকে সরে গেল। বুঝতে পারছি, মাথা ঘোরানো কিছুটা কমে এসেছে। চোখ নামিয়ে সামনে তাকালাম। ভার্নকে ধরেই ফেলেছি বলতে গেলে। ও খুব সাবধানে একটু একটু করে আগাচ্ছিল। ওদিকে ক্রিস আর টেডি ব্রিজের ও মাথায় প্রায় পৌঁছেই গেছে।

আমি এ পর্যন্ত সাতটির মতো অতিপ্রাকৃত গল্প লিখেছি, যেখানে মূল চরিত্ররা মানুষের মনের কথা পড়তে পারে এবং ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। কিন্তু সেবারই প্রথম এবং শেষবারের মতো অমন কিছু একটা অনুভব করেছিলাম আমি। হ্যাঁ, অতিলৌকিক-এছাড়া ব্যাপারটাকে ব্যাখ্যা করার মতো আর কোনো শব্দ আমার জানা নেই। কোনো শব্দ শুনিনি, কিছু না, কিন্তু কী মনে করে যেন আমি নিচু হয়ে রেললাইনের গায়ে হাত দিলাম। টের পেলাম, হাতের মধ্যে লাইনগুলো প্রচণ্ড বেগে কাঁপছে। মনে হচ্ছে যেন ধাতব একদল বিষাক্ত সাপকে জোর করে ধরে রেখেছি। ছুটে যেতে চাইছে, কিন্তু একটুও শব্দ করছে না।

লোকে বলে, প্রচণ্ড ভয়ে পায়খানা পানির মতো হয়ে তরল হয়ে গেছে–আপনিও হয়তো কাউকে কথা প্রসঙ্গে বলতে শুনে থাকবেন। কিন্তু সে কথার অর্থ যে আসলে কী, সেটা আমি ওই মুহূর্তে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম। এরকম আক্ষরিক অর্থে কোনো প্রবাদের মানে অনুভব করা কারো হয়ে ওঠে বলে মনে হয় না। এক জীবনে অসম্ভব ভয়ের মুহূর্ত আরো এসেছে, কিন্তু সেদিন সেই মুহূর্তে যে ভয় পেয়েছিলাম, এর কোনো তুলনা হয় না আসলে।

আমার পুরো শরীর একেবারে জমে গিয়েছিল। কিছু কাজ করছিল না। উরু বেয়ে প্রস্রাবের চিকন ধারা নেমে যাচ্ছে। মুখ হাঁ হয়ে গেছে। আপনাতেই, যেন গোপন কোনো দরজার চাবিকাঠি উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় ঝট করে খুলে গেছে। জিহ্বা জমে গেছে, নাড়াতে পারছিলাম না। শুধু তাই না, পুরো শরীরের সবকিছুই যেন জায়গায় স্থির হয়ে গেছে। নড়াচড়া করার মতো একবিন্দু শক্তিও পাচ্ছিলাম না। কিন্তু কোনো এক বিচিত্র উপায়ে চারপাশের সবকিছু ঠিকই দেখতে পাচ্ছিলাম, শুনতে পাচ্ছিলাম এবং অনুভব করতে পারছিলাম। বুঝতে পারছি কিছু একটা হচ্ছে আমার ভেতরে, কিন্তু সেই হিসেবে শরীর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছে না–এরচেয়ে অসহায় অবস্থা আর হয় না আসলে। বাস্তবের হিসেবে হয়তো কেবল কয়েক সেকেন্ড ওভাবে ছিলাম, কিন্তু মাথার ভেতরে মনে হচ্ছিল বুঝি হাজার বছর পেরিয়ে গেছে।

সবরকম অনুভূতি অনেকগুণ বিবর্ধিত হয়ে অনুভূত হচ্ছে। মনে হচ্ছিল যেন, মস্তিষ্কের মাঝের ইলেকট্রনিক সিগন্যালটা পাওয়ার সার্জের কারণে এলোমেলো হয়ে গেছে, একশ দশ ভোল্টের সবকিছু যেন মুহূর্তের মাঝে হয়ে গেছে দুইশ বিশ ভোল্ট। এ সময় কাছাকাছি কোথাও একটা প্লেন উড়ে গেল। সবটুকু ইচ্ছেশক্তি দিয়ে আশা করছিলাম, যদি প্লেনটার ভেতরে থাকতে পারতাম! জানালার ধারে বসে কোকের বোতলে চুমুক দিয়ে বহুদূরে, নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া অচিন নদীটার তটরেখার দিকে চেয়ে থাকতে পারতাম অলস চোখে! প্রস্রাবের ধারা নিচে নেমে যাওয়ার সময় ব্রিজের যে কয়টি কাঠের তক্তাকে ভিজিয়ে দিয়ে গেছে, এদের প্রত্যেকের প্রতিটা স্প্রিন্টার, প্রতিটা ক্রুসহ খুঁটিনাটি সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। চোখের এক কোণা দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম, এখনো একহাতে রেললাইনের একটা ট্র্যাক ধরে আছি, আর হাতটা কাঁপছে। সেই কম্পন আমার হাতের গভীরে এমনভাবে ঢুকে গিয়েছিল যে, হাত সরিয়ে নেওয়ার পরেও অনেকক্ষণ ধরে রক্তের মাঝে অনুভব করতে পারছিলাম, কাঁপছে। টান পড়ছে স্নায়ুতে, ঝিমঝিম করছিল সবকিছু, যেন ঘুম থেকে জেগে ওঠার জন্য যুদ্ধ করছে। মুখের ভেতরে নিজের থুথুর স্বাদও আলাদা করে অনুভব করতে পারছিলাম।

সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে, এখনো ট্রেনের কোনোরকম শব্দ শুনতে পাচ্ছি না। বুঝতে পারছি না, সামনে থেকে নাকি পেছন থেকে ধেয়ে আসছে মরণঘাতি ট্রেনটা, কিংবা কতটা কাছে চলে এসেছে। যেন অদৃশ্য কেউ ধেয়ে আসছে, কোনো সাড়াশব্দ নেই–ওঁৎ পেতে এগিয়ে আসছে চুপিচুপি। শুধু আমি হাতের মাঝে লাইনের কম্পনটুকু অনুভব করে জেনে গেছি, আসছে। মাথার মাঝে এক মুহূর্তের জন্য রে ব্রাওয়ারের ছবি ফুটে উঠল। যেন দলামোচড়া করে ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে ওকে, রাস্তার ধারের কোনো এক ঝোঁপের মাঝে ভোলা লজ্বিব্যাগের মতো করে ছড়িয়ে গেছে ভেতরের সবকিছু। মনে হলো, ভার্ন আর আমি মিলে শীঘ্রই ওর দলে গিয়ে যোগ দেব। অন্তত, আমি তো অবশ্যই। নিজের শেষকৃত্যে নিজেরাই নিজেদেরকে দাওয়াত করে নিয়ে এসেছি।

এই শেষ চিন্তাটা আমার জমে যাওয়া দেহের সবটুকু জড়তা ভেঙে-চুরে ফেলল একেবারে। পাগলের মতো লাফিয়ে উঠলাম। কিছু খেলনা আছে না, বাক্সের ঢাকনা সরালে স্প্রিংয়ের ধাক্কায় ভেতরের পুতুলটা ছিটকে বেরিয়ে আসে? কেউ তাকিয়ে থাকলে তার নিশ্চিত এমন কিছুই মনে হতো আমাকে দেখে। কিন্তু নিজের কাছে মনে হচ্ছিল, পানির নিচে ধীর ভঙ্গিতে হাত-পা নাড়াচ্ছি। আসলে বাতাসের মাঝে লাফ দিয়ে অনেক দূর উঠে গিয়েছিলাম, পাঁচ ফিটের মত তো হবেই, কিন্তু মনে হচ্ছিল যেন, পাঁচশ ফিট গভীর পানি ঠেলে একটু একটু করে এগোনোর চেষ্টা করছি।

শেষ পর্যন্ত পৃষ্ঠতলে মাথা তোলার মতো অনুভূতি হলো।

ট্রেন! বলে চিৎকার করে উধ্বশ্বাসে ছুট দিলাম।

চিৎকার শুনে ভার্ন ওর কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকাল। অবাক হয়ে গেছে, মুখভঙ্গি পাল্টে গিয়ে কেমন হাস্যকররকম বিবর্ণ হয়ে উঠেছে। ওর মুখের প্রতিটা ভাঁজ স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম। উদ্ভট এবং বেখাপ্পা ভঙ্গিতে নাচের মতো করে কাঠের এক তক্তা থেকে আরেক তক্তায় পা ফেলে দৌড়াতে দেখেই যা বোঝার বুঝে নিল সে, মুহূর্তখানেক পরে নিজেও ছুটতে শুরু করল।

সামনে ক্রিসকে দেখলাম, ব্রিজ পেরিয়ে নিরাপদ মাটিতে পা দিল। যাক, অন্তত নিরাপদ জায়গায় তো আছে–এটুকু ভেবে ভাল লাগল খুব। পরমুহূর্তে তীব্র হিংসায় একেবারে জ্বলে উঠল সবকিছু। শালা নিরাপদ জায়গায় আছে! দেখলাম, হাঁটু গেড়ে বসে রেললাইনে হাত রেখেছে। পিছলে গিয়েছিলাম, আরেকটু হলেই আমার বাম পা ফাঁকায় ঢুকে যেত। হাত দিয়ে ধরে কোনোমতে ভারসাম্য ঠিক করলাম। মেশিনারি যন্ত্রের ভেতরে অবিরাম ঘর্ষণের ফলে বিয়ারিং বলগুলো যেমন প্রচন্ড উত্তপ্ত হয়ে যায়, চোখ দুটোকে মনে হচ্ছে সেরকম কিছু। পা টেনে আবার ছুটতে শুরু করলাম। ততক্ষণে ভার্নের একেবারে পেছনে চলে এসেছি, পেরিয়ে এসেছি ব্রিজের অর্ধেক পথ। ঠিক এ সময় প্রথমবারের মতো ট্রেনের শব্দ শুনতে পেলাম; আমাদের পেছনে, নদীর যে পাশে ক্যাসল রক শহর, ওদিক থেকে ধেয়ে আসছে। প্রথমে নিচু গর্জনের মত শোনাচ্ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল শব্দটা। একটু পরেই ডিজেল ইঞ্জিনের শব্দ আর রেললাইনের সাথে বিশালকায় খাঁজকাটা ধাতব চাকাগুলোর ঘর্ষণের ভয়ংকর গর্জন স্পষ্ট বোঝা যেতে লাগল, প্রতিমুহূর্তে আরো ভীতিকর হয়ে উঠছে।

ও-ও-ও-হ, শিট! ভার্ন আর্তনাদ করে উঠল।

দৌড়া, হারামজাদা! পেছন থেকে হাত দিয়ে বাড়ি মারলাম ওর পিঠে।

পারছি না! পড়ে যাব!

তুই আগে দৌড়া!

ও-ও-ও-ই! শিট! বললেও দৌড়ানোর গতি বেড়ে গেল। দেখে মনে হচ্ছিল, রোদে পোড়া এক কাকতাড়ুয়া জোর করে টেনেহিঁচড়ে ছুটছে। কোমরে বাঁধা শার্টের কলার দুলছে, গায়ের সাথে বাড়ি খাচ্ছে বারবার। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম, নগ্ন দুই কাঁধের মধ্যে দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে, পেছনে রেখে আসছে ফোঁটা ফোঁটা জলকনা। ঘাড়ের প্রতিটা ভাঁজ বোঝা যাচ্ছে, ফুলে ফুলে উঠছে বারবার। শরীরের প্রতিটা পেশি দৌড়ের তালে তালে শক্ত হয়ে যাচ্ছে, আবার ছেড়ে দিচ্ছে মুহূর্তের মাঝে। আবারো শক্ত, আবারো ঢিলে–এভাবেই চলছে, মেশিনের মতো। মেরুদন্ড দেখে মনে হচ্ছে এক সারি বোম, ঘাড়ের কাছাকাছি এসে বোতামের সংখ্যা ঘন হয়ে গেছে–প্রতিটা বোতামের নিচে আলাদা আলাদা করে অর্ধগোলকের মতো ছায়া পড়েছে। এত কিছুর মাঝেও বেডরোলটা ধরা আছে ওর হাতে। খেয়াল করে দেখলাম, আমিও নিজেরটা ধরে রেখেই ছুটছি। এ সময় ভার্নের পা প্রচন্ড জোরে কাঠের তক্তার সাথে বাড়ি খেল। আরেকটু হলে মিস করেই যেত, ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য সামনে ঝুঁকে পড়ল সে, দুই হাত খুলে গেছে। আবার বাড়ি মারলাম পিঠে, সামনে এগিয়ে যেতে বলছি।

গর্ডি, আমি পারব না রে। অ-ও-ও-হ! শি-ই-ই-ট!

তুই পারবি, হারামজাদার বাচ্চা! দৌড়া! গলার সবটুকু জোর দিয়ে চিৎকার করলাম। আমি কি মজা পাচ্ছিলাম চিৎকার করে? হ্যাঁ, নির্মম বীভৎস এক ধরনের আনন্দ পাচ্ছিলাম, এটা সত্যি; মানুষ পুরোপুরি মাতাল অবস্থায় আত্মধ্বংসী কাজকর্ম করে যেমন বিকৃত আনন্দ পায়। রাখাল যেমন গরুকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়, সেভাবে ভার্ন টেসিওকে তাড়িয়ে নিয়ে ছুটছিলাম। সম্ভবত সে নিজেও সে সময়ের প্রবল ভয়টাকে নিজের মতো করে উপভোগ করছিল, সেই গরুর মতো ছুটছে, চিৎকার করছে, ঘামছে দরদর করে। কর্মরত কামারের মতো বুকের ছাতি প্রবল বেগে ওঠানামা করছে, কোনোমতে পা ফেলেই আবার উঠিয়ে নিচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে সামনে।

ট্রেনের শব্দ এখন অনেক জোরে শোনা যাচ্ছে। ইঞ্জিনের গর্জন আগের মতো আর কাঁপছে না; স্থির, একঘেয়ে, একই সুরে জানান দিচ্ছে নিজের অস্তিত্বের কথা। যেখানে থামের কাছে দাঁড়িয়ে রেলের পতাকায় নিশানা করে পাথর মেরেছিলাম, সেই জায়গাটা, অর্থাৎ জাংশন পেরিয়ে আসার সময় ট্রেনের বাঁশি বেজে উঠল। যতই এড়াতে চেষ্টা করি, নারকীয় হেলহাউন্ড আমার পিছে লেগেছে। মনে মনে ভাবছি, এই বুঝি পায়ের নিচে ব্রিজটা থরথর করে কাঁপতে শুরু করবে। আর যখন শুরু করবে, ট্রেনটা তখন আমাদের একেবারে পেছনে পৌঁছে যাবে।

আরো জোরে, ভার্ন! আরো জোরে!

গর্ডি! আর পারছি না আমি, গর্ডি-ই-ই-ই! অ-ও-ও-হ! শি-ই-ই-ট!

হঠাৎ করেই ট্রেনের ইলেকট্রিক হর্ন প্রচন্ড শব্দে আর্তনাদ করে চারপাশের বাতাস কাঁচের মত চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলল। মনে হচ্ছিল, শখানেক টুকরো হয়ে চারপাশে ছিটকে যাচ্ছে সবকিছু। যত মুভি, কমিক্স কিংবা দিবাস্বপ্নের ভেতরে যত আশা, জীবনের যত চিহ্ন ছিল–সবকিছু যেন উড়ে চলে গেল মুহূর্তের মাঝে। নায়কই হোক কিংবা কাপুরুষ, মৃত্যু ধেয়ে আসলে সবাই যে শব্দটা শুনতে পায়, সেটাই শুনতে পাচ্ছিলাম সেই মুহূর্তে:

হ-অ-অ-অ-অ-অ-ং-ক!
হ-অ-অ-অ-অ-অ-ং-ক?

ঠিক তখনি দেখতে পেলাম ক্রিসকে। আমাদের নিচে, ডান পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে টেডি, ওর চশমায় সূর্যের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। দুজনেই একই সাথে মুখ নেড়ে একটা শব্দই বলে যাচ্ছে বারবার, জাম্প! ট্রেনের প্রচন্ড গর্জন ভ্যাম্পায়ারের মতো ওদের কথার সবটা রক্ত-শব্দ–শুষে নিয়েছে, কেবল হাড়গোড়ের মত মুখ নাড়ানোর আকৃতিটুকু রয়ে গেছে, দেখা যাচ্ছে। এ সময় ট্রেনটা ব্রিজে উঠে পড়ল। পায়ের নিচে কম্পন শুরু হয়ে গেছে, টের পাচ্ছিলাম।

লাফ দিলাম। ধুলো আর পাথরের উপরে গিয়ে পড়লাম আমরা। আমি আরেকটু হলে ভার্নের গায়ের উপরেই পড়তাম। এই পুরো সময়ে ট্রেনটাকে একবারের জন্যেও দেখতে পাইনি। জানি না, ওই ট্রেনের ইঞ্জিনিয়ারদের কেউ আমাদেরকে দেখেছিল কি না। কয়েক বছর পরে কথার পিঠে ক্রিসকে বলেছিলাম এই কথাটা। সে জবাব দিয়েছিল, অকারণে জনমানবহীন রাস্তায় এভাবে ইলেকট্রিক হর্ন বাজায় না ওরা, গর্ডি। হয়তো। কিন্তু হতেও তো পারে, কেবল বাজানোর জন্যেই বাজিয়েছিল। অকারণেই। সে সময় আসলে এসব যুক্তিতে কিছু এসে যায়নি।

পুরোটা সময় কানে হাত দিয়ে মুখ গুঁজে ছিলাম মাটিতে। শব্দ, শুধু শব্দ ভেসে আসছিল। ধাতুতে ধাতুতে সংঘর্ষের শব্দ। মাথার ওপর দিয়ে ছুটে যাওয়া প্রবল বাতাসের শব্দ। কিন্তু তাকানোর কোনো ইচ্ছেই আমার ছিল না। যথেষ্ট বড় ছিল ট্রেনটা, কিন্তু একবারের জন্যেও তাকাইনি। তখনো ট্রেনটা আমাদের মাথার উপরে, এসময় আমার ঘাড়ে একটা উষ্ণ হাতের ছোঁয়া পেলাম। না তাকিয়েও বুঝতে পারছিলাম, ক্রিস।

যখন বুঝলাম, পুরোপুরি চলে গেছে-একশ ভাগ নিশ্চিত হওয়ার পরেই কেবল মাথা তুললাম, ভীত-সন্ত্রস্ত যোদ্ধারা যেমন যুদ্ধ শেষে লুকানো গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। ভার্ন তখনো মাটিতে মাথা গুঁজে শুয়ে আছে। আর আমাদের দুজনের মাঝখানে, এক হাত ভার্নের কাঁধে, আরেক হাত আমার কাঁধে দিয়ে পা ভাঁজ করে বসে আছে ক্রিস।

শেষ পর্যন্ত ভার্ন মুখ তুলে তাকালো। ওর সারা শরীর তখনো কাঁপছে। মুখ থেকে লালা বেরিয়ে ঠোঁট ভিজে গেছে, জিহ্বা দিয়ে বারবার ভেজা ঠোঁট আরো ভেজাতে চেষ্টা করছে সে।

এ সময় ক্রিস মৃদু গলায় বলল, আচ্ছা, কোকগুলো যে আনলাম, এখন একটু খেয়ে নিলে মন্দ হয় না, কী বলিস?

আমাদের সবারই তাই মনে হলো। মন্দ হয় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *