১৫. আশ্রমবাসিকপর্ব

আশ্রমবাসিকপর্ব

॥ আশ্রমবাসপর্বাধ্যায়॥

১। যুধিষ্ঠিরের উদারতা

যুদ্ধজয়ের পর পাণ্ডবগণ ছত্রিশ বৎসর রাজ্যপালন করেছিলেন। প্রথম পনর বৎসর তারা ধৃতরাষ্ট্রের সম্মতি নিয়ে সকল কার্য করতেন। বিদুর সঞ্জয় যুযুৎসু ও কৃপাচার্য ধৃতরাষ্ট্রের নিকটে থাকতেন, ব্যাসদেব সর্বদা বৃদ্ধ কুরুরাজকে দেবতা ঋষি পিতৃগণ ও রাক্ষস প্রভৃতির কথা শোনাতেন। বিদুর ধর্ম ও ব্যবহার (আইন) বিষয়ক কার্য দেখতে লাগলেন। তার সুনীতির ফলে সামন্ত রাজাদের কাছ থেকে অল্প ব্যয়ে নানাবিধ অভীষ্ট কার্য আদায় হত। তিনি কারারুদ্ধ বা বদদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীকে মুক্তি দিলে যুধিষ্ঠির কোনও আপত্তি করতেন না। কুন্তী বধদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীকে মুক্তি দিলে যুধিষ্ঠির কোনও আপত্তি করতেন না। কুন্তী দ্রৌপদী সুভদ্রা উলূপী চিত্রাঙ্গদা, ধৃষ্টকেতুর ভগিনী (১), জরাসন্ধের কন্যা (২) প্রভৃতি সর্বদা গান্ধারীর সেবা করতেন। ধর্মরাজ তার ভ্রাতাদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন, পুত্রহীন ধৃতরাষ্ট্র যেন কোনও দুঃখ না পান। সকলেই এই আজ্ঞা পালন করতেন, কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের দুবুদ্ধির ফলে পূর্বে যা ঘটেছিল ভীম তা ভুলতে পারলেন না।।

যুধিষ্ঠির তাঁর ভ্রাতা ও অমাত্যগণকে বললেন, বৃদ্ধ কুরুরাজ আমাদের সকলেরই মাননীয়; যিনি তাঁর আজ্ঞা পালন করবেন তিনি আমার সুহৃৎ, যিনি করবেন না তিনি আমার শত্রু। ইনি আমাদের জন্যই পুত্রপৌত্রাদির শোকে কাতর হয়ে আছেন, অতএব এঁর সকল অভিলাষ পূর্ণ করা আমাদের কর্তব্য। মৃত আত্মীয়সুহৃঙ্গণের শ্রাদ্ধাদির জন্য এঁর যা আবশ্যক সবই যেন ইনি পান।

যুধিষ্ঠিরের আচরণে ধৃতরাষ্ট্র অতিশয় তুষ্ট হলেন, গান্ধারীও পুত্রশোক ত্যাগ করে পাণ্ডবগণকে নিজপুত্রতুল্য মনে করতে লাগলেন। ধৃতরাষ্ট্র প্রতিদিন প্রাতঃকালে পাণ্ডবগণের মঙ্গলের নিমিত্ত স্বস্ত্যয়ন ও হোম করাতে লাগলেন। তিনি পাণ্ডুপুত্রদের সেবায় যে আনন্দ পেলেন তা পূর্বে নিজের পুত্রদের কাছে পাননি।

** (১) নকুলপত্নী করেণুমতী।

(২) সহদেবপত্নী

২। ভীমের আক্রোশ-ধৃতরাষ্ট্রের সংকল্প

এইরূপে পনর বৎসর কেটে গেল। ভীম অপ্রকাশ্যভাবে ধৃতরাষ্ট্রের অপ্রিয় কার্য। করতেন এবং অনুচর দ্বারা তার আজ্ঞা লঙ্ঘন করাতেন। একদিন ভীম তার বন্ধুদের কাছে তাল ঠুকে বললেন, আমার এই চন্দনচর্চিত পরিঘতুল্য ৰাহুর প্রতাপেই মূঢ় দুর্যোধনাদি পুত্র ও বান্ধবসহ নিহত হয়েছে। এই নিষ্ঠুর বাক্য শুনতে পেয়ে ধৃতরাষ্ট্র অত্যন্ত ব্যথিত হলেন, বুদ্ধিমতী গান্ধারী কালধর্ম বুঝে নীরবে রইলেন। যুধিষ্ঠির অর্জুন নকুল সহদেব কুন্তী ও দ্রৌপদী এ বিষয়ে কিছুই জানতে পারেননি। ধৃতরাষ্ট্র বাষ্পকুলকণ্ঠে তাঁর সুহৃদ্গণকে বললেন, আমার দুর্বুদ্ধির ফলেই কুরুকুল ক্ষয় পেয়েছে। পুত্রস্নেহের বশে আমি ব্যাসদেব কৃষ্ণ ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ বিদুর সঞ্জয় ও গান্ধারীর উপদেশ শুনিনি, পাণ্ডবগণকে তাদের পিতৃরাজ্য ফিরিয়ে দিইনি। এই অপরাধ সহস্র শল্যের ন্যয়া আমার হৃদয়ে বিদ্ধ হয়ে আছে। এখন আমার পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য আমি দিনের চতুর্থ ভাগে বা অষ্টম ভাগে যৎকিঞ্চিৎ আহার করি, গান্ধারী ভিন্ন আর কেউ তা জানেন না। আমি ও গান্ধারী মৃগচর্ম পরে কুশশয্যায় শুয়ে নিত্য জপ করি। যুধিষ্ঠির শুনলে অনুতপ্ত হবেন সেজন্য এ কথা আমি কাকেও জানাইনি।

তারপর ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে বললেন, বৎস, তোমার আশ্রয়ে প্রতিপালিত হয়ে আমি সুখে আছি, দান ও শ্রাদ্ধকর্মাদি করে পুণ্যসঞ্চয়ও করেছি; পুত্রহীনা গান্ধারীও আমাকে দেখে ধৈর্যধারণ করেছেন। যে নৃশংসগণ দ্রৌপদীর অপমান ও তোমাদের ঐশ্বর্যহরণ করেছিল তারা ক্ষত্ৰধর্মানুসারে যুদ্ধে হত হয়ে স্বর্গে গেছে। এখন আমার ও গান্ধারীর পক্ষে যা শ্রেয় তাই আমার করা উচিত। তুমি ধর্মনিষ্ঠ সেজন্য তোমাকে বলছি, গান্ধারী ও আমাকে বনগমনের অনুমতি দাও। বৃদ্ধ বয়সে পুত্রকে রাজ্য দিয়ে বনে বাস করাই আমাদের কুলোচিত ধর্ম। আমি গান্ধারীর সঙ্গে বনবাসী হয়ে তোমাকে আশীর্বাদ করব, চীরবল্কল ধারণ করে উপবাসী হয়ে তপস্যা করব। সেই তপস্যার ফল তুমিও পাবে, কারণ, রাজার অধিকারে শুভাশুভ যে কর্ম অনুষ্ঠিত হয় রাজাও তার ফলভোগী হন।

যুধিষ্ঠির বললেন, কুরুরাজ, আপনি দুঃখভোগ করলে এই রাজ্য আমার প্রীতিকর হবে না। আমাকে ধিক, আমি অতি দুবুদ্ধি রাজ্যাসক্ত ও প্রমাদগ্রস্ত। আপনি অসুখী হলে আমার রাজ্যভোগে কি প্রয়োজন? আপনি আমাদের পিতা ও পরম গুরু, আপনি চলে গেলে আমরা কোথায় থাকব? আপনার ঔরসপুত্র যুযুৎসু বা আপনার মনোনীত অন্য কেউ এই রাজ্য গ্রহণ করুন, আমিই বনে যাব। অথবা আপনি স্বয়ং রাজ্যশাসন করুন, অযশ দ্বারা আমাকে দগ্ধ করবেন না। আমি রাজা নই, আপনিই রাজা। দুর্যোধনাদির কার্যের জন্য আমার মনে কিছুমাত্র ক্রোধ নেই, দৈববশেই আমরা সকলে মোহগ্রস্ত হয়েছিলাম। আমরাও আপনার পুত্র, গান্ধারী ও কুন্তীকে সমান জ্ঞান করি। আমি নতশিরে প্রার্থনা করছি, আপনি মনের দুঃখ দূর করুন।

ধৃতরাষ্ট্র বললেন, বৎস, আমি বনে গিয়ে তপস্যা করতে ইচ্ছা করি। তুমি আমার যথোচিত সেবা করেছ, এখন বনগমনের অনুমতি দাও। ধৃতরাষ্ট্র সহসা কম্পিতদেহে কৃতাঞ্জলিপুটে বললেন, বার্ধক্য ও অধিক কথা বলার ফলে আমার মন অবসন্ন ও মুখ শুষ্ক হচ্ছে, আমি সঞ্জয় আর কৃপাচার্যকে বলছি, এঁরা আমার হয়ে ধর্মরাজকে অনুনয় করুন। এই বলে ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীর দেহে ভর দিয়ে সংজ্ঞাহীন হলেন।

যুধিষ্ঠির বললেন, হায়, যিনি শত সহস্র হস্তীর ন্যায় বলশালী, যিনি লৌহভীম চূর্ণ করেছিলেন, তিনি এখন অচেতন হয়ে অবলা স্ত্রীকে অবলম্বন করলেন! এইরূপ বিলাপ করে যুধিষ্ঠির জলার্ম হস্ত দিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের মুখ ও বক্ষ মুছিয়ে দিলেন। সংজ্ঞালাভ করে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, বৎস, আমাকে আলিঙ্গন কর, তোমার স্পর্শে আমি পুনর্জীবিত হয়েছি। আজ আমি দিবসের অষ্টম ভাগে আহার করব এই স্থির করেছিলাম, এখন তার সময় হয়েছে; দুর্বলতার ফলে আমার চেতনা লুপ্ত হয়েছিল। বার বার কথা বললে আমার ক্লান্তি হয়; তুমি আর কষ্ট দিও না, আমাকে বনগমনের অনুমতি দাও।

যুধিষ্ঠির বললেন, কুরুরাজ, আপনাকে প্রীত করার জন্য আমি রাজ্য বা জীবনও ত্যাগ করতে পারি। আপনি এখন আহার করুন, বনগমনের কথা পরে হবে।

৩। ধৃতরাষ্ট্রের প্রজাসম্ভাষণ

ব্যাসদেব এসে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, কুরুনন্দন ধৃতরাষ্ট্র যা বলছেন তাতে তুমি সম্মত হও, আর বিচারের প্রয়োজন নেই। ইনি বৃদ্ধ ও পুত্রশোকাতুর, গান্ধারীও অতি কষ্টে ধৈর্য ধরে আছেন; এঁদের বনে যেতে দাও, যেন এখানে এঁদের মৃত্যু না হয়। অন্তকালে রাজাদের অরণ্যবাসই শ্রেয়। যুদ্ধে অথবা যথাবিধি অরণ্যে প্রাণত্যাগ করাই রাজর্ষিদের পরম ধর্ম। ধৃতরাষ্ট্রের তপস্যা করবার সময় হয়েছে, তোমার উপর এখন এঁর কিছুমাত্র ক্রোধ নেই।

ব্যাসদেব চলে গেলে যুধিষ্ঠির বিনীত হয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, আপনার যা অভিলাষ ব্যাসদেব তাতে সম্মতি দিয়েছেন। কুরুরাজ, আমি নতমস্তকে অনুনয় করছি, এখন আহার করুন, পরে অরণ্যাশ্রমে যাবেন। জরাজীর্ণ গজপতির ন্যায় ধৃতরাষ্ট্র ধীরে ধীরে নিজ গৃহে গেলেন এবং আহ্নিকাদির পর আহার করলেন। গান্ধারী কুন্তী ও বধূগণ তাঁর পরিচর্যা করতে লাগলেন। ভোজনের পর ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরের পিঠে হাত রেখে রাজ্যপালন সম্বন্ধে বহু উপদেশ দিলেন, তারপর শ্রান্ত হয়ে গান্ধারীর গৃহে গেলেন।

ধৃতরাষ্ট্রের অনুরোধে যুধিষ্ঠির কুরুজাঙ্গলের প্রজাগণকে ডেকে আনালেন। পুরবাসী ও জনপদবাসী ব্রাহ্মণাদি এবং নানা দেশ হতে আগত নরপতিগণ সমবেত হলে ধৃতরাষ্ট্র সকলকে সম্বাোধন করে বললেন, আপনারা বহুকাল কুরুকুলের সঙ্গে একত্র বাস করেছেন, আমরা পরস্পরের সুহৃৎ ও হিতৈষী। ব্যাসদেব ও রাজা যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে আমি গান্ধারীর সঙ্গে বনে যেতে ইচ্ছা করেছি, আপনারাও বিনা দ্বিধায় আমাকে অনুমতি দিন। আমি মনে করি, আমাদের সঙ্গে আপনাদের যে প্রীতির সম্বন্ধ আছে, অন্য দেশের রাজাদের সঙ্গে সে প্রকার নেই। গান্ধারী ও আমি পুত্ৰবিরহে কাতর হয়ে আছি, বয়স এবং উপবাসের জন্য দুর্বলও হয়েছি। যুধিষ্ঠিরের রাজত্বে আমরা প্রচুর সুখভোগ করেছি। এখন এই পুত্রহীন অন্ধ বৃন্ধের বনগমন ভিন্ন আর কি গতি আছে? বৎসগণ, শান্তনুর পরে ভীষ্মপরিপালিত বিচিত্রবীর্য এবং পাণ্ডু এই রাজ্য পালন করেছিলেন; তার পর আমিও আপনাদের সেবা করেছি। যদি আমার ত্রুটি হয়ে থাকে তবে আপনারা ক্ষমা করবেন। মন্দবুদ্ধি দুর্যোধনও এই নিষ্কণ্টক রাজ্য ভোগ করেছে, কিন্তু আপনাদের কাছে সে কোনও অপরাধ করেনি। তার দুর্নীতির ফলে এবং আমার দোষে অসংখ্য মহীপাল যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন। আমার কার্য ভাল বা মন্দ যাই হ’ক, আমি কৃতাঞ্জলি হয়ে বলছি-আপনারা তা মনে রাখবেন না। এই পুত্রহীন শোকাতুর অন্ধ বৃদ্ধকে পূর্বতন কুরুরাজগণের বংশধর বলে ক্ষমা করবেন। আমি ও দুঃখিনী গান্ধারী আপনাদের কাছে প্রার্থনা করছি আমাদের বনগমনের অনুমতি দিন। সম্পদে ও বিপদে কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠিরের প্রতি আপনারা সমদৃষ্টি রাখবেন। লোকপাল তুল্য চার ভ্রাতা যাঁর সচিব সেই ব্রহ্মার ন্যায় মহাতেজা যুধিষ্ঠির আপনাদের পালন করবেন। ন্যস্ত ধনের ন্যায় আমি যুধিষ্ঠিরকে আপনাদের হস্তে দিচ্ছি, আপনাদের সকলকেও যুধিষ্ঠিরের হস্তে দিচ্ছি। আপনারা কখনও আমার প্রতি ক্রুদ্ধ হন নি, এখন আমি ও গান্ধারী কৃতাঞ্জলি হয়ে প্রার্থনা করছি আমার অস্থিরমতি লোভী স্বেচ্ছাচারী পুত্রদের অপরাধ ক্ষমা করুন।

ধৃতরাষ্ট্রের অনুনয় শুনে নগরবাসী ও গ্রামবাসী প্রজাবৃন্দ বাষ্পকুলনয়নে পরস্পরের দিকে চাইতে লাগলেন এবং দুঃখে অচেতনপ্রায় হলেন। পরিশেষে শাম্ব নামে এক বাগ্মী ব্রাহ্মণ ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, মহারাজ, প্রজাদের প্রতিনিধিরূপে আমি আপনাকে বলছি-আপনার কথা যথার্থ, আপনি ও আমার পরস্পরের সুহৃৎ। আপনি ও আপনার পূর্বপুরুষগণ পিতা ও ভ্রাতার ন্যায় আমাদের পালন করেছেন, রাজা দুর্যোধনও আমাদের প্রতি কোনও দুর্ব্যবহার করেন নি। আমরা তাকে পিতার ন্যায় বিশ্বাস করে সুখে ছিলাম তা আপনি জানেন। এখন কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠির সহস্র বৎসর আমাদের পালন করুন। আমরা অনুনয় করছি, জ্ঞাতিবধের জন্য আর দুর্যোধনের দোষ দেবেন না। কুরুকুলনাশের জন্য আপনি দুর্যোধন কর্ণ বা শকুনি দায়ী নন,

দৈবই এর কারণ। মহারাজ, আমরা অনুমতি দিচ্ছি, আপনি বনে গিয়ে পুণ্যকর্ম করুন, আপনার পুত্রগণও স্বর্গলোক লাভ করুন, যুধিষ্ঠির হ’তে আপনি যে মানসিক দুঃখ পেয়েছেন তা অপনীত হ’ক। পুরুষশ্রেষ্ঠ, আপনাকে নমস্কার।

ব্রাহ্মণের কথা শুনে সকলে সাধু সাধু বললেন, ধৃতরাষ্ট্রও প্রীত হলেন। প্রজারা অভিবাদন করে ধীরে ধীরে চলে গেল, ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীর সঙ্গে নিজ ভবনে গেলেন।

৪। ধৃতরাষ্ট্র প্রভৃতির বনযাত্রা

পরদিন প্রভাতকালে বিদুর যুধিষ্ঠিরের কাছে এসে বললেন, মহারাজ, ধৃতরাষ্ট্র স্থির করেচেন যে আগামী কার্তিক-পূর্ণিমায় বনে যাবেন। ভীষ্ম দ্রোণ সোমদত্ত বাহ্বীক দুর্যোধনাদি জয়দ্রথ এবং মৃত সুহৃঙ্গণের শ্রাদ্ধের জন্য তিনি কিঞ্চিৎ অর্থ প্রার্থনা করছেন। যুধিষ্ঠির সানন্দে অর্থ দিতে স্বীকৃত হলেন, অর্জুনও অনুমোদন করলেন, কিন্তু ক্রোধী ভীম সম্মতি দিলেন না। অর্জুন তাকে নম্রভাবে বললেন, আমাদের বৃদ্ধ পিতা (জ্যেষ্ঠতাত) বনে যাবার পূর্বে ভীষ্ম প্রভৃতির শ্রাদ্ধ করতে চান; আপনার বাহুবলে যে ধন অর্জিত হয়েছে তারই কিঞ্চিৎ তিনি চাচ্ছেন। কালের কি বিপর্যয় দেখুন, পূর্বে যাঁর কাছে আমরা প্রার্থী হয়ে গেছি এখন অদৃষ্টবশে তিনিই আমাদের কাছে প্রার্থনা করছেন। পুরুষশ্রেষ্ঠ, আপনি আপত্তি করবেন না, তাকে অর্থ না দিলে আমাদের অধর্ম ও অপযশ হবে।

ভীমসেন সক্রোধে বললেন, ভীষ্মদ্রোণাদি এবং সুহৃঙ্গণের শ্রাদ্ধ আমরাই করব, কর্ণের শ্রাদ্ধ কুন্তী করবেন। শ্রাদ্ধের জন্য ধৃতরাষ্ট্রকে অর্থ দেওয়া উচিত নয়, তার কুলাঙ্গার পুত্রগণ পরলোকে কষ্টভোগ করুক। অর্জুন, পূর্বের কথা কি তুমি ভুলে গেছ? আমাদের বনবাসকালে তোমার এই জ্যেষ্ঠতাতের স্নেহ কোথায় ছিল? দ্রোণ ভীষ্ম ও সোমদত্ত তখন কি করেছিলেন? দূতসভায় এই দুর্বুদ্ধি ধৃতরাষ্ট্রই বিদুরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন—আমরা কোন্ বস্তু জিতলায়? এসব কি তোমার মনে নেই?

যুধিষ্ঠির ভীমকে বললেন, তুমি ক্ষান্ত হও। তার পর তিনি বিদুরকে বললেন, আপনি কুরুরাজকে জানান যে তার প্রয়োজনীয় অর্থ আমি নিজের কোষ থেকে দেব, তাতে ভীম অসন্তুষ্ট হবেন না। বনবাসকালে ভীম অনেক কষ্ট ভোগ করছেন, তার কর্কশ আচরণে কুরুরাজ যেন রুষ্ট না হন। আমার ও অর্জুনের সমস্ত ধনের তিনিই প্রভু।

বিদুরের মুখে যুধিষ্ঠিরের বাক্য শুনে ধৃতরাষ্ট্র প্রীত হলেন এবং আত্মীয় ও বান্ধবগণের শ্রাদ্ধ করে ব্রাহ্মণগণকে প্রভূত ধন দান করলেন। তারপর তিনি কার্তিক-পূর্ণিমায় যজ্ঞ করে অগ্নিহোত্র সম্মুখে রেখে বনযাত্রা করলেন। যুধিষ্ঠির শোকে অভিভূত হয়ে ভূপতিত হলেন, অর্জুন তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। পাণ্ডবগণ বিদুর সঞ্জয় যুযুৎসু কৃপাচার্য ও ধৌম্য প্রভৃতি ব্রাহ্মণগণ সজলনয়নে কুরুরাজের অনুগমন করলেন। বন্ধনেত্রা গান্ধারী কুন্তীর স্কন্ধে এবং অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীর স্কন্ধে দুই হস্ত রেখে চলতে লাগলেন। দ্রৌপদী সুভদ্রা উত্তরা উনূপী চিত্রাঙ্গদা প্রভৃতিও সরোদনে অনুগমন করলেন। পাণ্ডবদের বনগমনকালে হস্তিনাপুরের প্রজারা যেমন দুঃখিত হয়েছিল, ধৃতরাষ্ট্রের যাত্রাকালেও সেইরূপ হল। বিদুর ও সঞ্জয় সংকল্প করলেন যে তাঁরাও বনবাসী হবেন। কিছুদূর যাবার পর ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরাদিকে ফিরে যেতে বললেন। গান্ধারীকে দৃঢ়ভাবে ধরে কুন্তী বললেন, আমি বনে বাস করব, তপস্বিনী গান্ধারীর ও কুরুরাজের পদসেবা করব। যুধিষ্ঠির, তুমি সহদেবের উপর কখনও অপ্রসন্ন হয়ো না, সে তোমার ও আমার অনুরক্ত। কর্ণকে সর্বদা স্মরণ করো, তার উদ্দেশে দান করো, সর্বদা সকলে দ্রৌপদীর প্রিয়সাধন করো। কুরুকুলের ভার তোমার উপরেই পড়েছে।

যুধিষ্ঠির কাতর হয়ে কুন্তীকে নিবৃত্ত করবার চেষ্টা করলেন। ভীম বললেন, আমাদের ত্যাগ করে বনে যাওয়াই যদি আপনার ইচ্ছা ছিল তবে আমাদের দিয়ে লোকক্ষয় করালেন কেন? কুন্তী পুত্রদের অনুনয় শুনলেন না, অশ্রুরোধ করে বললেন, তোমরা পাণ্ডুর পুত্র এবং দেবতুল্য পরাক্রমশালী; জ্ঞাতির হস্তে নির্জিত হয়ে যাতে তোমাদের দুঃখভোগ করতে না হয় সেজন্যই আমি তোমাদের যুদ্ধে উৎসাহিত করেছিলাম, তোমাদের তেজোবৃদ্ধির নিমিত্ত বাসুদেবের নিকট বিদুলার উপাখ্যান বলেছিলাম। স্বামীর রাজত্বকালে আমি বহু সুখ ভোগ করেছি, এখন পুত্রের বিজিত রাজ্য ভোগ করতে চাই না। আমার পতি যেখানে আছেন সেই পুণ্যলোকে আমি যেতে ইচ্ছা করি; ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর সেবা এবং তপস্যা করে শরীর শুঙ্ক করব। কুরুশ্রেষ্ঠ, ভীমসেন প্রভৃতির সহিত গৃহে ফিরে যাও, তোমার ধর্মে মতি থাকুক, মন মহৎ হ’ক।

ধৃতরাষ্ট্র বললেন, যুধিষ্ঠিরের জননী ফিরে যান, পুত্র ও ঐশ্বর্য ত্যাগ করে ইনি কেন দুর্গম বনে যাবেন? রাজ্যে থেকেই ইনি দান ব্রত ও তপস্যা করুন। গান্ধারী, তুমি এঁকে নিবৃত্ত হতে বল। ধর্মপরায়ণা সতী কুন্তী বনগমনের সংকল্প ত্যাগ করলেন না; তখন দ্রৌপদী প্রভৃতি বন্ধুগণ সরোদনে পাণ্ডবদের সঙ্গে হস্তিনাপুরে ফিরে গেলেন।

৫। ধৃতরাষ্ট্র-সকাশে নারদাদি

বহু দূর গিয়ে ধৃতরাষ্ট্র ভাগীরথীতীরে উপস্থিত হলেন। সন্ধ্যাকালে সূর্যের আরাধনার পর বিদুর ও সঞ্জয় কুশশয্যা প্রস্তুত করে দিলেন; ধৃতরাষ্ট্র এক শয্যায় এবং কুন্তীর সহিত গান্ধারী অন্য শয্যায় রাত্রিযাপন করলেন। প্রাতঃকালে যথাবিধি আহ্নিক ও হোমের পর তারা উত্তর দিকে যাত্রা করলেন এবং কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে রাজর্ষি শত্যুপকে দেখতে পেলেন। ইনি কেকয় দেশের রাজা ছিলেন, বৃদ্ধাবস্থায় জ্যেষ্ঠপুত্রকে রাজ্য দিয়ে বনবাসী হয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্র ব্যাসের আশ্রমে গিয়ে দীক্ষা নিলেন এবং জটা অজিন ও বল্কল ধারণ করে শতযুপের আশ্রমে বিদুর সঞ্জয় গান্ধারী ও কুন্তীর সহিত কঠোর তপস্যায় নিরত হলেন।

একদিন নারদ পর্বত ব্যাস প্রভৃতি ধৃতরাষ্ট্রকে দেখতে এলেন। কথাপ্রসঙ্গে নারদ বললেন, শতযুগের পিতামহ সহস্রচিত্য তপস্যার ফলে ইন্দ্রলোক লাভ করেছেন। আরও অনেক রাজা এই বনে তপঃসিদ্ধ হয়ে স্বর্গে গেছেন। ধৃতরাষ্ট্র, আপনিও ব্যাসের অনুগ্রহে গান্ধারীর সহিত উত্তম গতি লাভ করবেন। রাজা পাণ্ড ইন্দ্রলোকে বাস করে নিত্য আপনাকে স্মরণ করেন; আমরা দিব্যনেত্রে দেখছি, সৎকর্মের ফলে কুন্তীও তার কাছে যাবেন। বিদুর যুধিষ্ঠিরে প্রবেশ করবেন, সঞ্জয় স্বর্গে যাবেন।

রাজর্ষি শতকূপ বললেন, দেবর্ষি, ধৃতরাষ্ট্র কোন্ লোকে যাবেন তা তো আপনি বললেন না। নারদ বললেন, আমি ইন্দ্রের কাছে শুনেছি রাজা ধৃতরাষ্ট্র আর তিন বৎসর জীবিত থাকবেন, তার পর গান্ধারীর সহিত দিব্য বিমানে কুবেরভবনে গিয়ে ইচ্ছানুসারে দেব গন্ধর্ব ও রাক্ষসলোকে বিচরণ করবেন। ধৃতরাষ্ট্রকে এইরূপে আশ্বাসিত করে নারদাদি প্রস্থান করলেন।

৬। ধৃতরাষ্ট্র-সকাশে যুধিষ্ঠিরাদি

ধৃতরাষ্ট্র প্রভৃতি বনে গেলে পুরবাসিগণ শোকার্ত হয়ে বলতে লাগলেন, পুত্রহীন বৃদ্ধ কুরুরাজ এবং মহাভাগ্য গান্ধারী ও কুন্তী নির্জন বনে কি করে বাস করছেন? পুত্রগণ ও রাজশ্রী ত্যাগ করে কুন্তী কেন দুষ্কর তপস্যা করতে গেলেন?

কুন্তীর বিরহে পাণ্ডবগণ কাতর হয়ে কালযাপন করতে লাগলেন, কোনও বিষয়ে। তারা মন দিতে পারলেন না। কয়েক দিন পরে তারা স্থির করলেন যে বনে গিয়ে সকলকে দেখে আসবেন, দ্রৌপদীও গমনের জন্য উৎসুক হলেন। যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞায় রথ হস্তী অশ্ব ও সৈন্য সজ্জিত হল , বহু পুরবাসী তার সঙ্গে যাবার জন্য প্রস্তুত হল। পাঁচ দিন নগরের বহির্ভাগে বাস করে ষষ্ঠ দিনে যুধিষ্ঠির সদলে যাত্রা করলেন। কৃপাচার্য সৈন্যদলের নেতা হয়ে চললেন; যুধিষ্ঠির ও অর্জুন রথে, ভীম হস্তীতে, নকুল-সহদেব অশ্বে, এবং দ্রৌপদী প্রভৃতি নারীগণ শিবিকায় যাত্রা করলেন। নগর ও গ্রামবাসী প্রজাগণ বিবিধ যানে যুধিষ্ঠিরের অনুগমন করলেন। যুযুৎসু ও ধৌম্য পুররক্ষার জন্য হস্তিনাপুরে রইলেন।

পাণ্ডবগণ যমুনা পার হয়ে কুরুক্ষেত্রে এসে শতযুপ ও ধৃতরাষ্ট্রের আশ্রম দেখতে পেলেন এবং যান থেকে নেমে বিনীতভাবে পদব্রজে আশ্রমে প্রবেশ করলেন। যুধিষ্ঠির সজলনয়নে তাপসগণকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমাদের জ্যেষ্ঠতাত কুরুবংশপতি কোথায় ? তারা বললেন, মহারাজ, তিনি পুষ্প ও জল আনতে এবং যমুনায় স্নান করতে গেছেন।পাণ্ডবগণ সত্বর যমুনার দিকে চললেন এবং কিছুদূর গিয়ে দেখলেন, গান্ধারী ও ধৃতরাষ্ট্রকে নিয়ে কুন্তী আগে আগে আসছেন। সহদেব উচ্চস্বরে রোদন করে কুন্তীর পায়ে পড়লেন। তারপর পাণ্ডবগণ ধৃতরাষ্ট্রাদিকে প্রণাম করে তাদের জলপূর্ণ কলস বয়ে নিয়ে আশ্রমের দিকে চললেন।

নানা স্থান থেকে তাপসগণ পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদী প্রভৃতিকে দেখতে এলেন। সঞ্জয় এইপ্রকারে তাঁদের পরিচয় দিলেন। যাঁর দেহ বিশুদ্ধ স্বর্ণের ন্যায় গৌরবর্ণ, মহাসিংহের ন্যায় সবল, যাঁর নাসিকা উন্নত এবং চক্ষু দীর্ঘ ও তাম্রবর্ণ, ইনি কুরুরাজ যুধিষ্ঠির। এই মত্তগজেন্দ্রগামী তপ্তকাঞ্চনবর্ণ দীর্ঘবাহু স্থূলস্কন্ধ পুরুষ বৃকোদর। এঁর পার্শ্বে যে মহাধনুর্ধর শ্যামবর্ণ আয়তলোচন হস্তিযূথপতিতুল্য যুবা রয়েছেন, ইনি অর্জুন। কুন্তীর নিকটে বিষ্ণু ও মহেন্দ্রের ন্যায় অনুপম রূপবান ও বলবান যেন দুজন রয়েছেন, এঁরা নকুল-সহদেব। এই নীলোৎপলবর্ণা মধ্যবয়স্কা পদ্মপলাশাক্ষী মূর্তিমতী লক্ষ্মীর ন্যায় নারী কৃষ্ণা। এঁর পার্শ্বে যে কনকবর্ণা চন্দ্রপ্রভার ন্যায় রূপবতী রমণী রয়েছেন ইনি চক্রপাণি কৃষ্ণের ভগিনী সুভদ্রা; এই সুবর্ণগৌরাঙ্গী নাগকন্যা উলূপী, এবং আর্দ্র মধূকে মধূক পুষ্পের ন্যায় যাঁর কান্তি, ইনি রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা; এঁরা অর্জুনের ভার্যা। যিনি কৃষ্ণের সহিত স্পর্ধা করতেন সেই রাজসেনাপতি শল্যের ভগিনী এই নীলোৎপলবর্ণা রমণী ভীমসেনের পত্নী (কালী)। এই চম্পকগৌরী জরাসন্ধকন্যা সহদেবের পত্নী। এঁর নিকটে যে ইন্দীবরশ্যামবর্ণা রমণী ভূমিতে বসে আছেন, ইনি নকুলের পত্নী (ধৃষ্টকেতুর ভগিনী করেণুমতী)। এই প্রতপ্তকাঞ্চনবর্ণা সুন্দরী যিনি পুত্রকে কোলে নিয়ে আছেন, ইনি বিরাটকন্যা উত্তরা; দ্রোণ প্রভৃতি এঁর পতি অভিমন্যুকে রথহীন অবস্থায় বধ করেছিলেন। এই এক শত নারী, যাঁরা শুক্ল উত্তরীয় ধারণ করে আছেন, যাঁদের সীমন্তে অলংকার নেই, এঁরা ধৃতরাষ্ট্রের অনাথা পুত্রবধূ।

৭। বিদুরের তিরোধান

তাপসগণ চলে গেলে ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরাদির কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। কিছুক্ষণ আলাপের পর যুধিষ্ঠির বললেন, মহারাজ, বিদুর কোথায়? তাকে তো দেখছি না। সঞ্জয় তপস্যায় নিরত থেকে কুশলে আছেন তো? ধৃতরাষ্ট্র বললেন, পুত্র, বিদুর কেবল বায়ু ভক্ষণ করে ঘোর তপস্যা করছেন, তার শীর্ণ দেহ শিরায় আচ্ছাদিত হয়ে গেছে। এই বনের নির্জন প্রদেশে ব্রাহ্মণরা কখনও কখনও তাকে দেখতে পান।

এই সময়ে যুধিষ্ঠির দূর থেকে শীর্ণদেহ দিগম্বর বিদুরকে দেখতে পেলেন, তাঁর মস্তকে জটা, মুখে বীটা (১), দেহ মললিপ্ত ও ধূলিধূসর। বিদুর আশ্রমের দিকে দৃষ্টিপাত করেই চলে যাচ্ছিলেন, যুধিষ্ঠির বেগে তার পশ্চাতে যেতে যেতে বললেন, ভো ভো বিদুর, আমি আপনার প্রিয় যুধিষ্ঠির, আপনাকে দেখতে এসেছি। বিদুর এক বৃক্ষে ঠেস দিয়ে অনিমেষ নয়নে যুধিষ্ঠিরকে দেখতে লাগলেন, এবং তার দৃষ্টিতে নিজের দৃষ্টি, গাত্রে গাত্র, প্রাণে প্রাণ এবং ইন্দ্রিয়গ্রামে ইন্দ্রিয়সকল সংযোজিত করে যোগবলে যুধিষ্ঠিরের দেহে প্রবিষ্ট হলেন। যুধিষ্ঠিরের বোধ হল তার বল পূর্বাপেক্ষা বহুক্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদুরের বৃক্ষাশ্রিত স্তব্ধলোচন প্রাণহীন দেহ দেখে তিনি ব্যাসের বাক্য (2) স্মরণ করলেন এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ইচ্ছা করলেন। এমন সময়ে তিনি দৈববাণী শুনলেন—রাজা, বিদুরের দেহ দগ্ধ করো না, এঁর কলেবর যেখানে আছে সেখানেই থাকুক; ইনি যতিধর্ম প্রাপ্ত হয়ে সান্তানিক লোক লাভ করেছেন, এঁর জন্য শোক করো না। তখন যুধিষ্ঠির আশ্রমে ফিরে গিয়ে সকল বৃত্তান্ত জানালেন, ধৃতরাষ্ট্র প্রভৃতি অত্যন্ত বিস্মিত হলেন।

পরদিন প্রভাতকালে ব্যাসদেব শতকূপ প্রভৃতির সঙ্গে আশ্রমে উপস্থিত হলেন। কুশলপ্রশ্নের পর ব্যাস ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, কুরুরাজ, তুমি বিদুরের পরিণাম শুনেছ। ধর্মই মাণ্ডব্যের শাপে বিদুর রূপে জন্মেছিলেন (৩)। ব্রহ্মার আদেশে বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রে তোমার এই ভ্রাতাকে আমি উৎপাদন করেছিলাম। এই তপস্বী সত্যনিষ্ঠা ইন্দ্রিয়দমন শমগুণ অহিংসা ও দানের ফলে বিখ্যাত হয়েছেন। যুধিষ্ঠিরও ধর্ম থেকে উৎপন্ন হয়েছেন, যিনি ধর্ম তিনিই বিদুর, যিনি বিদুর তিনিই যুধিষ্ঠির। এই পাণ্ডুপুত্র যুধিষ্ঠির, যিনি তোমার আজ্ঞাবহ হয়ে আছেন, এঁর শরীরেই বিদুর যোগবলে প্রবিষ্ট হয়েছেন। পুত্র, আমি তোমার সংশয় ছেদনের জন্যই এখানে এসেছি। তোমার যদি কিছু প্রার্থনা থাকে, যদি কিছু দেখতে বা জানতে চাও, তো আমাকে বলল, আমি তোমার অভীষ্ট পূরণ করব।

**

(১) পুলির আকার কাষ্ঠখণ্ড, গুলিডাণ্ডা খেলার গুলির তুল্য। বাক্য ও আহার বর্জনের চিহ্ন।

(২) বিদুর ও যুধিষ্ঠির দুজনেই ধর্মের অংশ।

(৩) আদিপর্ব ১৮-পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।

।। পুত্রদর্শনপর্বাধ্যায়।।

৮। মৃত যোদ্ধৃগণের সমাগম

পাণ্ডবগণ ধৃতরাষ্ট্রের আশ্রমে সুখে বাস করতে লাগলেন। এক মাস পরে ব্যাসদেব পুনর্বার এলেন, সেই সময়ে মহর্ষি নারদ পর্বত ও দেবল, এবং গন্ধর্ব বিশ্বাবসু তুম্বুরু ও চিত্রসেনও উপস্থিত হলেন। নানাপ্রকার ধর্মকথার পর ব্যাস ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, রাজেন্দ্র, তোমার মনোভাব আমি জানি, তুমি এবং গান্ধারী কুন্তী দ্রৌপদী সুভদ্রা প্রভৃতি পুত্রবিয়োগের তীব্র শোক ভোগ করছ। তোমার কি কামনা বল, তপস্যার প্রভাবে আমি তা পূর্ণ করব। – ধৃতরাষ্ট্র বললেন, আপনার ও এই সাধুগণের সমাগমে আমি ধন্য হয়েছি, আমার জীবন সফল হয়েছে। আমার আর পরলোকের ভয় নেই, কিন্তু যার দুর্নীতির ফলে পাণ্ডবগণ নির্যাতিত এবং বহু নরপতি বিনাশিত হয়েছেন সেই দুর্বুদ্ধি হতভাগ্য দুর্যোধনের জন্য আমার হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে। পিতা, আমি শান্তি পাচ্ছি না। গান্ধারী কৃতাঞ্জলিপুটে তার শ্বশুর ব্যাসকে বললেন, মুনিপুংগব, ষোড়শ বৎসর গত হয়েছে তথাপি কুরুরাজের পুত্রশোক শান্ত হচ্ছে না। আপনি তপোবলে নানা লোক সৃষ্টি করতে পারেন, আমাদের পরলোকগত পুত্রগণকে কি দেখাতে পারেন না? আমাদের এই প্রিয়তমা পুত্রবধু দ্রৌপদী, কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রা, ভূরিশ্রবার এই ভার্যা, আপনার যে শত পৌত্র যুদ্ধে নিহত হয়েছে তাদের পত্নীগণ—এঁদের শোকের জন্য অন্ধরাজ ও আমার শোক বারবার বর্ধিত হচ্ছে। এমন উপায় করুন যাতে আমরা এবং আপনার এই পুত্রবধূ কুন্তী শোকশূন্য হ’তে পারি।

গান্ধারী এইরূপ বললে কুন্তী তার প্রচ্ছন্নজাত পুত্র কর্ণকে স্মরণ করলেন। তার ভাবান্তর দেখে ব্যাস বললেন, তোমার মনে যা আছে তা বল। কুন্তী লজ্জিতভাবে বললেন, ভগবান, আপনি আমার শ্বশুর, দেবতার দেবতা; আমি সত্য কথা বলছি শুনুন। তার পর কুন্তী কর্ণের জন্মবৃত্তান্ত বিবৃত করে বললেন, আমি মূঢ়তার যশে সজ্ঞানে সেই পুত্রকে উপেক্ষা করেছি, তার ফলে আমার হৃদয় দগ্ধ হচ্ছে। আমার কর্ম পাপজনক বা পাপশূন্য যাই হ’ক আপনাকে জানালাম। সেই পুত্রকে আমি দেখতে ইচ্ছা করি; মুনিশ্রেষ্ঠ, আমার হৃদয়ের কামনা আজ পূর্ণ করুন।

ব্যাস বললেন, তোমার কামনা পূর্ণ হবে। তোমার অপরাধ হয়নি; দেবতারা ঐশ্বর্যবান, তারা সংকল্প বাক্য দৃষ্টি স্পর্শ বা সংগম—এই পাঁচ প্রকারে পুত্র উৎপাদন করতে পারেন। তোমার মনস্তাপ দূর হ’ক। যাঁরা বলশালী তাদের পক্ষে সমস্তই হিতকর পবিত্র ধর্মসংগত ও স্বকীয়। তোমরা সকলেই সুপ্তোখিতের ন্যায় নিজ নিজ প্রিয়জনকে দেখতে পাবে। সেই বীরগণ ক্ষত্রধর্ম অনুসারে নিহত হয়েছেন, তারা দেবকার্য সাধনের নিমিত্ত অবতীর্ণ হয়েছিলেন। গন্ধর্বরাজ ধৃতরাষ্ট্রই কুরুরাজ রূপে জন্মেছেন। পাণ্ডু মরুগণ হতে উৎপন্ন হয়েছিলেন। বিদুর ও যুধিষ্ঠির ধর্মের অংশে জন্মেছেন। দুর্যোধন কলি, শকুনি দ্বাপর, দুঃশাসনাদি রাক্ষস, ভীমসেন বায়ু, অর্জুন নর-ঋষি, কৃষ্ণ নারায়ণ, নকুল-সহদেব অশ্বিনীকুমারদ্বয়, অভিমন্যু চন্দ্র, কর্ণ সূর্য, ধৃষ্টদ্যুম্ন অগ্নি, শিখণ্ডী রাক্ষস, দ্রোণ বৃহস্পতি, অশ্বত্থামা রুদ্র, এবং ভীষ্ম বসু হ’তে উৎপন্ন। দেবগণই মনুষ্যরূপে পৃথিবীতে এসে নিজ নিজ কার্য সম্পন্ন করে স্বর্গে ফিরে গেছেন। তোমরা সকলে ভাগীরথীতীরে চল, নিহত আত্মীয়গণকে সেখানে দেখতে পাবে।

ব্যাস এইরূপ বললে সমাগত জনগণ সিংহনাদ করে গঙ্গার অভিমুখে যাত্রা করলেন। ধৃতরাষ্ট্র, পঞ্চপাণ্ডব, অমাত্যগণ, নারীগণ, ঋষি ও গন্ধর্বগণ, অনুচরবর্গ, সকলেই গঙ্গাতীরে এসে অধীরভাবে রাত্রির প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। সায়াহ্নকাল উপস্থিত হলে তারা পবিত্রভাবে একাগ্রমনে গঙ্গাতীরে উপবেশন করলেন। অনন্তর মহাতেজা ব্যাসদেব ভাগীরথীর পুণ্যজলে অবগাহন করে মৃত কৌরব ও পাণ্ডব যোদ্ধা ও নরপতিগণকে আহ্বান করলেন। তখন জলমধ্যে কুরুপাণ্ডবসেনার তুমুল নিনাদ উঠল; ভীষ্ম দ্রোণ, পুত্রসহ বিরাট ও দ্রুপদ, অভিমন্যু ঘটোৎকচ কর্ণ, দুর্যোধন দুঃশাসন প্রভৃতি, শকুনি, জরাসন্ধপুত্র সহদেব, ভগদত্ত ভূরিশ্রবা শল্য বৃষসেন, দুর্যোধনপুত্র লক্ষ্মণ, সানুজ ধৃষ্টকেতু, বাহ্নীক সোমদত্ত চেকিতান প্রভৃতি বীরগণ দিব্য দেহ ধারণ করে গঙ্গাগর্ভ থেকে সসৈন্যে উখিত হলেন। জীবদ্দশায় যাঁর যেপ্রকার বেশ ধ্বজ ও বাহন ছিল এখনও সেইপ্রকার দেখা গেল। অপ্সরা ও গন্ধর্বগণ স্তবগান করতে লাগলেন। ব্যাসদেব ধৃতরাষ্ট্রকে দিব্যচক্ষু দান করলেন। সকলে রোমাঞ্চিত হয়ে চিত্রপটে অঙ্কিতের ন্যায় এই আশ্চর্য উৎসব দেখতে লাগলেন।

কুরু ও পাণ্ডব পক্ষের বীরগণ ক্রোধ ও দ্বেষ ত্যাগ করে নিস্পাপ হয়ে একত্র সমাগত হলেন। পুত্র পিতামাতার সহিত, ভার্যা পতির সহিত, ভ্রাতা ভ্রাতার সহিত এবং মিত্র মিত্রের সহিত সহর্ষে মিলিত হলেন। পাণ্ডবগণ কর্ণ অভিমন্যু ও দ্রৌপদীর পঞ্চ পুত্রের কাছে এলেন। মুনিবর ব্যাসের প্রসাদে সকলে আত্মীয় ও বান্ধবের সহিত মিলিত হয়ে সেই রাত্রিতে স্বর্গবাসের সুখ অনুভব করলেন, তাঁদের শোক ভয় দুঃখ অযশ কিছুই রইল না। তারা নিজ নিজ পত্নীর সহিত একরাত্রি সুখে যাপন করলেন।

রাত্রি প্রভাত হলে ব্যাসদেব সেই মৃতেখিত যোদ্ধৃগণকে প্রস্থানের অনুমতি দিলেন। ক্ষণমধ্যে তারা রথ ও ধ্বজ সহ গঙ্গাগর্ভে প্রবেশ করে নিজ নিজ লোকে ফিরে গেলেন। পতিহীনা ক্ষত্রিয় নারীগণকে ব্যাস বললেন, যাঁরা পতিলোকে যেতে চান তারা শীঘ্র জাহ্নবীর জলে অবগাহন করুন। তখন সাধ্বী বরাঙ্গনাগণ ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতি নিয়ে জলে প্রবেশ করলেন এবং দেহ ত্যাগ করে পতির সহিত মিলিত হলেন।

যিনি এই প্রিয়সমাগমের বিবরণ শোনেন তিনি ইহলোকে ও পরলোকে প্রিয় বিষয় লাভ করেন। যিনি অপরকে শোনান তিনি ইহলোকে যশ এবং পরলোকে শুভ-গতি লাভ করেন। যে বেদজ্ঞ সাধু মানব শুচিভাবে শ্রদ্ধাসহকারে এই আশ্চর্য পর্ব শোনেন তিনি পরমগতি প্রাপ্ত হন।

৯। জনমেজয়ের যজ্ঞে পরীক্ষিৎ-পাণ্ডবগণের প্রস্থান

জনমেজয় তাঁর পূর্বপুরুষদের এই পুনরাগমনের বিবরণ শুনে বললেন, যাঁরা। দেহত্যাগ করেছেন তাদের দর্শনলাভ কি করে সম্ভবপর হল ? ব্যাসশিষ্য বৈশম্পায়ন উত্তর দিলেন, মহারাজ, মানুষের কর্ম থেকেই শরীর উৎপন্ন হয়। শরীরের উপাদান মহাভূতসমূহ, ভূতাধিপতি মহেশ্বরের অধিষ্ঠানের ফলে দেহ নষ্ট হলেও মহাভূত নষ্ট হয় না, জীবাত্মা মহাভূতকে ত্যাগ করেন না, মহাভূত আশ্রয় করে তিনি পূর্বরূপে প্রকাশিত হতে পারেন।

তারপর বৈশম্পায়ন বললেন, জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্র পূর্বে তার পুত্রদের কখনও দেখেননি, ব্যাসদেবের প্রসাদেই তিনি দেখতে পেয়েছিলেন। জনমেজয় বললেন, বরদাতা ব্যাসদেব যদি আমার পিতাকে দেখান তবে আপনার বাক্যে আমার শ্রদ্ধা হবে, আমি প্রীত ও কৃতার্থ হব। ব্যাসের প্রসাদে আমার অভিলাষ পূর্ণ হ’ক। জনমেজয় এইরূপ বললে ব্যাসের তপস্যার প্রবাবে পরীক্ষিৎ তার পূর্বের বয়সে ও রূপে অমাত্যগণ সহ আবির্ভূত হলেন, তার সঙ্গে মহাত্মা শমীক (১) ও শৃঙ্গীও এলেন।

জনমেজয় অতিশয় আনন্দিত হলেন এবং যজ্ঞসমাপন ও যজ্ঞান্তস্নানের পর জরৎকারুপুত্র আস্তীককে বললেন, আমার এই যজ্ঞ অতি আশ্চর্য; আমি পিতার দর্শন পেয়েছি, তার আগমনে আমার শোক দূর হয়েছে। আস্তীক বললেন, মহারাজ, যাঁর যজ্ঞে মহর্ষি দ্বৈপায়ন উপস্থিত থাকেন তিনি ইহলোক ও পরলোক জয় করেছেন। পাণ্ডুর বংশধর, তুমি বিচিত্র আখ্যান শুনেছ, পিতাকে দেখেছ, সর্পসকল ভস্মসাৎ হয়েছে, তোমার সত্যবাক্যের ফলে তক্ষকও মুক্তিলাভ করেছেন। তুমি ঋষিদের পূজা করেছ, সাধুজনের সহিত মিলিত হয়েছ, এবং পাপনাশক মহাভারত শুনেছ; এর ফলে তোমার বিপুল ধর্ম লাভ হয়েছে।

বৈশম্পায়ন বলতে লাগলেন।-সকলে গঙ্গাতীর হতে আশ্রমে ফিরে এলে ব্যাসদেব ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, তুমি ধর্মজ্ঞ ঋষিদের মুখে বিবিধ উপদেশ শুনেছ, শুভগতিপ্রাপ্ত পুত্রগণকেও দেখেছ। এখন শোক ত্যাগ কর, যুধিষ্ঠিরকে ভ্রাতাদের সঙ্গে রাজ্যে ফিরে যেতে বল; এঁরা মাসাধিক কাল এখানে রয়েছেন। ব্যাসের বাক্য শুনে ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে বললেন, অজাতশত্ৰু, তোমার মঙ্গল হ’ক, তোমরা এখন হস্তিনাপুরে ফিরে যাও, তোমরা এখানে থাকায় স্নেহের জন্য আমার তপস্যার ব্যাঘাত হচ্ছে। তুমি আমার পুত্রের কার্য করেছ, আমাদের পিণ্ড কীর্তি ও কুল তোমাতেই প্রতিষ্ঠিত আছে। আর আমার শোক নেই, জীবনেরও প্রয়োজন নেই, এখন কঠোর তপস্যা করব। তুমি আজ বা কাল চ’লে যাও।

যুধিষ্ঠির বললেন, আমি এই আশ্রমে থেকে আপনার সেবা করব। সহদেব বললেন, আমি মাতা কুন্তীকে ছেড়ে যেতে পারব না। ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী ও কুন্তী বহু প্রবোধ দিয়ে তাদের নিরস্ত করলেন। তখন পাণ্ডবগণ বিদায় নিয়ে ভার্ষা বান্ধব ও সৈন্য সহ হস্তিনাপুরে প্রস্থান করলেন।

** (১) আদিপর্ব ৮-পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।

।। নারদাগমনপর্বাধ্যায়।।

১০। ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী ও কুন্তীর মৃত্যু

পাণ্ডবগণ হস্তিনাপুরে ফিরে যাবার দুবৎসর পরে একদিন দেবর্ষি নারদ যুধিষ্ঠিরের কাছে এলেন। তিনি আসন গ্রহণ করে কথাপ্রসঙ্গে বললেন, আমি গঙ্গা ও অন্যান্য তীর্থভ্রমণ করে তোমাকে দেখতে এসেছি। যুধিষ্ঠির বললেন, ভগবান, যদি আমার পিতা ধৃতরাষ্ট্রকে দেখে থাকেন তবে তিনি কেমন আছেন বলুন।

নারদ বললেন, তোমরা আশ্রম থেকে চলে এলে ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী কুন্তী ও সঞ্জয় গঙ্গাদ্বারে গেলেন, অগ্নিহোত্র সহ পুরোহিতও তাদের সঙ্গে ছিলেন। সেখানে ধৃতরাষ্ট্র মুখে বীটা (১) দিয়ে মৌনী ও বায়ুভূক হয়ে কঠোর তপস্যায় রত হলেন, তার দেহ অস্থিচর্মসার হয়ে গেল। গান্ধারী কেবল জলপান করে, কুন্তী এক মাস অন্তর এবং সঞ্জয় পাঁচ দিন অন্তর আহার করে জীবনধারণ করলেন। তাদের যাজকগণ যথাবিধি অগ্নিতে আহুতি দিতে লাগলেন। ছ-মাস পরে তারা অরণ্যে গেলেন। সেই সময়ে চতুর্দিকে দাবানল ব্যাপ্ত হল , বৃক্ষ ও পশু সকল দগ্ধ হয়ে গেল। ধৃতরাষ্ট্র প্রভৃতি অনাহারের ফলে অত্যন্ত দুর্বল হয়েছিলেন, সেজন্য পালাতে পারলেন না। তখন ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে বললেন, তুমি পালিয়ে আত্মরক্ষা কর, আমরা এই অগ্নিতে প্রাণত্যাগ করে পরমগতি লাভ করব। সঞ্জয় বললেন, মহারাজ, এই বৃথাগ্নিতে প্রাণ-ত্যাগ করলে আপনার অনিষ্ট হবে। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, আমরা গৃহ। ত্যাগ করে এসেছি, এখন মরলে অনিষ্ট হবে না, জল বায়ু অগ্নি বা অনশন দ্বারা প্রাণত্যাগই তাপসদের পক্ষে প্রশস্ত; সঞ্জয়, তুমি চলে যাও। এই বলে ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী ও কুন্তীর সহিত পূৰ্বাস্য হয়ে উপবেশন করলেন, সমাধিস্থ হওয়ায় তাদের দেহ কাষ্ঠের ন্যায় নিশ্চল হল। এই অবস্থায় তারা দাবানলে আক্রান্ত হয়ে প্রাণত্যাগ করলেন। সঞ্জয় গঙ্গাতীরের মহর্ষিগণকে সকল বৃত্তান্ত জানিয়ে হিমালয়ে চলে গেলেন । তারপর নারদ বললেন, আমি গঙ্গাতীরে তাপসদের নিকটে ছিলাম, সঞ্জয়ের কথা শুনে তোমাদের জানাতে এসেছি। আমি ধৃতরাষ্ট্রাদির দেহ দেখেছি। তারা স্বেচ্ছায় প্রাণত্যাগ করেছেন, সদ্গতিও পেয়েছেন, তাদের জন্য শোক করা উচিত নয়।

পাণ্ডবগণ দুঃখে অভিভূত হলেন এবং ঊধ্ববাহু হয়ে নিজেদের ধিক্কার দিয়ে রোদন করতে লাগলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, আমরা জীবিত থাকতে মহাত্মা ধৃতরাষ্ট্রের অনাথের ন্যায় মৃত্যু হল ! অগ্নির তুল্য কৃতঘ্ন কেউ নেই, অর্জুন খান্ডবদাহ করে ভিক্ষার্থী ব্রাহ্মণবেশী অগ্নিকে বৃথা তৃপ্ত করেছিলেন। সেই অর্জুনের জননীকেই তিনি দগ্ধ করলেন! রাজর্ষি ধৃতরাষ্ট্র সেই মহাবনে মন্ত্রপূত অগ্নি রক্ষা করতেন, তথাপি বৃথাগ্নিতে কেন তাদের মৃত্যু হল ?

নারদ বললেন, তারা বৃথাগ্নিতে দগ্ধ হননি। ধৃতরাষ্ট্র বনপ্রবেশের পূর্বে যে যজ্ঞ করেছিলেন যাজকগণ তার অগ্নি এক নির্জন বনে নিক্ষেপ করেছিলেন; সেই অগ্নিই বর্ধিত হয়ে সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়। ধৃতরাষ্ট্র নিজের যজ্ঞাগ্নিতে জীবন বিসর্জন দিয়ে পরমগতি পেয়েছেন। তোমার জননীও গুরুশুশ্রুষার ফলে সিদ্ধিলাভ করেছেন তাতে সংশয় নেই। এখন তুমি ভ্রাতাদের সঙ্গে তাঁদের তর্পণ কর।

যুধিষ্ঠির তাঁর ভ্রাতা ও নারীগণের সঙ্গে গঙ্গাতীরে যাত্রা করলেন, পুরবাসী ও জনপদবাসিগণ একবস্ত্র পরিধান করে তাঁদের সঙ্গে গেলেন। পাণ্ডবগণ যুযুৎসুকে অগ্রবর্তী করে যথাবিধি ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী ও কুন্তীর তর্পণ করলেন। দ্বাদশ দিনে যুধিষ্ঠির তাদের শ্রাদ্ধ করলেন এবং প্রত্যেকের উদ্দেশে উদ্দেশে ব্রাহ্মণগণকে শয্যা খাদ্য যান মণিরত্ন দাসী প্রভৃতি দান করলেন। তার আজ্ঞায় মৃতজনের অস্থি সংগ্রহ করে গঙ্গায় ফেলা হল।

দেবর্ষি নারদ যুধিষ্ঠিরকে সান্ত্বনা দিয়ে চলে গেলেন। কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের পরে হতপুত্র ধৃতরাষ্ট্র এইরূপে হস্তিনাপুরে পনর বৎসর এবং বনবাসে তিন বৎসর যাপন করেছিলেন।

**

(১) ৭-পরিচ্ছেদ পাদটীকা দ্রষ্টব্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *