১৪. মরুদ্বীপের (Desert Island) রেকর্ড : একটি সাক্ষাৎকার
ডিসকের অর্থ চাকতি। সাধারণ গ্রামোফোন রেকডকে চাকতি বলা হয়। বিবিসি’র (ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন) মরুদ্বীপের রেকর্ড ১৯৪২ সালে বেতারে প্রচার শুরু হয়। রেডিও-তে সবচাইতে দীর্ঘস্থায়ী রেকর্ডের প্রোগ্রাম এটাই। এতদিনে এ প্রোগ্রাম হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা জাতীয় রীতির মতো। এত বছরে অতিথিদের সংখ্যা এবং পাল্লা (range) হয়ে দাঁড়িয়েছে বিরাট। এই কার্যক্রমে সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে লেখক, অভিনেতা, সঙ্গীতবিদ, সিনেমার অভিনেতা এবং পরিচালক; ক্রীড়াজগতের গুরুত্বপূর্ণ লোক, হাস্যকৌতুকে বিখ্যাত, বঁধুনি, উদ্যানপালক, শিক্ষক, নৃত্যশিল্পী, রাজনৈতিক নেতা, রাজবংশের লোক, ব্যঙ্গচিত্র শিল্পী এবং বৈজ্ঞানিকদের। তাদের একটা বিলাস দ্রব্য (সেটা জীবন্ত কিছু হতে পারবে না) এবং একটা বই সঙ্গে নিতে বলা হয় (ধরে নেওয়া হয় বাইবেল, কোরান কিংবা ঐরকম একখানা বই সেখানে আগে থেকেই রয়েছে এবং তার সঙ্গে রয়েছে শেক্সপিয়রের একটা রচনাবলি)। এছাড়া ধরে নেওয়া হয়, রেকর্ড বাজানোর একটা ব্যবস্থা তাদের রয়েছে। প্রথম দিকে এই কর্মসূচি উপস্থিত করার শুরুতে ঘোষণা করা হত অনুমান করা হচ্ছে একটা গ্রামোফোন এবং সেটা বাজানোর জন্য অফুরন্ত পিন রয়েছে। আজকাল একটা সৌরশক্তিচালিত C.D. (কম্প্যাক্ট ডিস্ক) হাতের কাছে রয়েছে এবং চালানো সম্ভব বলে ধরে নেওয়া যায়। এই বেতার প্রচার প্রতি সপ্তাহেই হয়। অতিথিদের সাধারণত ৪০ মিনিট চলে। তবে স্টিফেন হকিং এর সঙ্গে এই সাক্ষাঙ্কার প্রচারিত হয়েছিল ১৯৯২ সালের বড়দিনে। এই সাক্ষাৎকার ছিল একটা ব্যতিক্রম। কারণ এটা চলেছিল ৪০ মিনিটের বেশি। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন সু ললি (Sue Lawley)
স্যু : স্টিফেন, আপনি অবশ্য অনেকরকমভাবেই মরুদ্বীপে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকার সঙ্গে পরিচিত। ভৌতজীবদের সঙ্গে স্বাভাবিক যোগসূত্র আপনার ছিন্ন এবং যোগাযোগ রক্ষার স্বাভাবিক ব্যবস্থা থেকে আপনি বঞ্চিত। এই একাকিত্ব আপনার কিরকম মনে হয়?
স্টিফেন : আমি নিজেকে স্বাভাবিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে করি না। আমার মনে হয় আমার পারিপার্শ্বিক লোকজনও সে রকম মনে করেন না। আমি নিজেকে প্রতিবন্ধী মনে করি না। আমি শুধু মনে করি আমার দেহের মোটর নিউরনগুলোর কাজকর্মে কিছু গোলমাল হচ্ছে–যাঁরা রঙ বুঝতে পারে না, আমার অবস্থা অনেকটা তাদের মতো। মনে হয় আমার জীবনকে ঠিক স্বাভাবিক বলা যায় না। তবে আমি বোধ করি, মনের দিক দিয়ে আমি স্বাভাবিক।
স্যু : আপনি নিজের কাছে এর আগেই প্রমাণ করেছেন, মরুদ্বীপ রেকর্ডের অধিকাংশ দ্বীপান্তরবাসীদের মতো আপনি নন। মানসিক এবং বৌদ্ধিকভাবে নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ রাখার মতো যথেষ্ট তত্ত্ব এবং প্রেরণা আপনার রয়েছে।
স্টিফেন : আমার মনে হয় স্বভাবত আমি একটু অন্তর্মুখী। যোগাযোগ ক্ষমতার অসুবিধার জন্য আমার নিজের উপর বিশ্বাস করতে হয়েছে। কিন্তু বাল্যকালে আমি প্রচুর কথা বলতাম। নিজেকে উদ্দীপ্ত করার জন্য অন্যের সঙ্গে আলোচনা আমার প্রয়োজন। আমার চিন্তাধারার বিবরণ অন্যকে দিলে আমার খুবই সহায়তা হয় বলে দেখতে পাই। তারা যদি কোন অনুভাষণ (suggestion) আমাকে নাও দান করেন তাহলেও অন্যকে ব্যাখ্যা করার জন্য আমার যে নিজের চিন্তনকে সংগঠিত করতে হচ্ছে, তার ফলে অনেক সময়ই আমি অগ্রগতির নতুন পথ দেখতে পেয়েছি।
স্যু : কিন্তু স্টিফেন, মনের ভাবাবেগের পূর্ণতা আপনি কিভাবে পান? খুব প্রতিভাবান পদার্থবিদেরও এই পূর্ণতার জন্য আন্য মানুষ প্রয়োজন হয়।
স্টিফেন : পদার্থবিদ্যা খুবই ভাল জিনিস, তবে সম্পূর্ণ ভাবাবেগবর্জিত। শুধুমাত্র পদার্থবিদ্যা নিয়ে আমি বেঁচে থাকতে পারতাম না। অন্য সবার মতোই আমার প্রয়োজন উষ্ণতা, প্রেম এবং ভালবাসা। তবে আমার মতো অসামর্থ্য যাদের আছে, তাদের চাইতে আমি অনেক বেশি ভাগ্যবান। প্রচুর প্রেম এবং ভালবাসা আমি পাই। আমার কাছে সঙ্গীতেরও খুব গুরুত্ব আছে।
স্যু : বলুন তো, কিসে আপনি বেশি আনন্দ পান–পদার্থবিদ্যায় না সঙ্গীতে?
স্টিফেন : আমি বলতে পারি পদার্থবিদ্যায় যখন সবকিছু ঠিক ঠিক হয় তখন আমি যে তীব্র আনন্দ পাই সঙ্গীতে আমি সেরকম আনন্দ কখনও পাইনি। কিন্তু একজনের কর্মজীবনে পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে সেরকম ঘটনা কয়েকবারই ঘটে। কিন্তু রেকর্ড খুশিমতো। বাজানো যায়।
স্যু : আপনার মরুদ্বীপে কোন রেকর্ডটা আপনি প্রথম বাজালেন?
স্টিফেন : পুলেঙ্ক (Poulenc) এর গ্লোরিয়া (Glora)। আমি এটা প্রথম শুনেছিলাম কলোরাডো (Colorado)-র অ্যাসপেন (Aspen) এ। অ্যাসপেন মূলত একটি স্কী খেলার জায়গা। কিন্তু গ্রীষ্মকালে সেখানে পদার্থবিদ্যার সভা হয়। পদার্থবিদ্যা কেন্দ্রের পাশেই একটা বিরাট তাঁবু রয়েছে। সেখানে হয় তাদের সঙ্গীত উৎসব। কৃষ্ণগহ্বরগুলো যখন উবে যায়, তখনকার সমস্যা তাদের সঙ্গীত উৎসব। কৃষ্ণগহ্বরগুলো যখন উবে যায়, তখনকার সমস্যা ভাবতে ভাবতে আপনি সঙ্গীতের মহড়া শুনতে পাবেন। ব্যাপারটা আদর্শ। পদার্থবিদ্যা এবং সঙ্গীত আমার এই দুটি আনন্দ এক্ষেত্রে সংযুক্ত হয়। দুটিই যদি আমি মরুদ্বীপে পাই, তাহলে আমি চাইব না কেউ আমাকে উদ্ধার করুক। অন্তত তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় যতদিন না আমি এমন আবিষ্কার করছি যে সম্পর্কে আমি সবাইকে বলতে চাই। আমার মনে হয় পদার্থবিদ্যার গবেষণাপত্রগুলো ইলেকট্রনিকভাবে পাওয়ার জন্য একটা উপগ্রহের ডিশ (Satellite dish) থাকা নিয়মবিরুদ্ধ।
স্যু : বেতার ভৌত দৈহিক খুঁত লুকিয়ে রাখতে পারে কিন্তু এ ক্ষেত্রেও আড়াল করা হবে অন্য কিছু। সাত বছর আগে আপনি নিজের কণ্ঠস্বর হারিয়েছিলেন। বলতে পারেন কি হয়েছিল?
স্টিফেন : ১৯৮৫ সালে গ্রীষ্মকালে আমি জেনেভার সার্ন (Cern) এ বৃহৎ কণিকা ত্বরণ যন্ত্রের কাছে ছিলাম। আমার ইচ্ছে ছিল ওয়াগনার এর রিং সাইকেল নামে অপেরাগুলো (Wagner’s Ring Cycle of Operas) শুনতে জার্মানির বেরুথ (Bayruuth) যাওয়া। কিন্তু আমার নিউমোনিয়া হল। ফলে আমাকে তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হল। জেনেভার হাসপাতাল আমার স্ত্রীকে বলল, জীবন রক্ষার যন্ত্রটা চালিয়ে কোন ভাল নেই। কিন্তু আমার স্ত্রী রাজি হলেন না। আমাকে বিমানে করে কেব্রিজে এ্যাডেব্রুকস্ (Addenbrookes) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে রজার গ্রে (Roger Grey) নামে একজন সার্জেন আমার উপর ট্রাকিওস্টমি অপারেশান করেন। এই অপারেশানে আমার জীবন বাঁচল কিন্তু আমার কণ্ঠস্বর চলে গেল।
স্যু : কিন্তু যাই হোক না কেন, ততদিনে আপনার কথা জড়িয়ে গিয়েছিল এবং বোঝাও খুব কষ্ট ছিল–তাই না? অনুমান করা যায় আপনার কথা বলার ক্ষমতা শেষ পর্যন্ত চলেই যেত–তাই হত না?
স্টিফেন : আমার কণ্ঠস্বর যদিও জড়ানো ছিল এবং বোঝাও ছিল শক্ত, তবুও আমার কাছাকাছি যারা ছিল তারা আমার কথা বুঝতে পারত। ব্যাখ্যা করার একজন লোকের মাধ্যমে আমি সেমিনার (seminer) এ বক্তৃতাও দিতে পারতাম। তাছাড়া বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রগুলো লিখে নেওয়ার জন্য আর এক জনকে বলতে পারতাম কিন্তু অপারেশানের কিছুদিন পর পর্যন্ত আমার সর্বনাশ হয়ে গিয়েছিল। আমার মনে হত, আমি যদি কথা বলার ক্ষমতা ফিরে না পাই তাহলে আমার বেঁচে থাকার কোন অর্থ নেই।
স্যু : তারপর ক্যালিফোর্নিয়ার একজন কম্পিউটার বিশারদ আপনার দুরবস্থার কথা পড়ে আপনাকে একটি কণ্ঠস্বর পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেটি কি রকম কাজ করছে?
স্টিফেন : তার নাম ছিল ওয়াল্ট ওলটোজ (Walt Woltosz)। তার শাশুড়ির আমার মতো অবস্থা হয়েছিল। শাশুড়ির কথা বলার জন্য তিনি একটি কম্পিউটার বানিয়েছিলেন। একটি পর্দায় একটি কারসর (cursor)* [*Cursor (কারসর) একটি গাণিতিক যন্ত্রের অংশ। যন্ত্রটি অন্য একটি যন্ত্রের উপরে সামনে-পিছনে চলাচল করে—অনুবাদ] ঘোরাফেরা করে। আপনি যা চাইছেন এটা যখন তার উপরে আসে তখন আপনি মাথা দিয়ে কিংবা চোখ নেড়ে কিংবা আমার ক্ষেত্রে হাত দিয়ে একটা সুইচ চালিয়ে দেওয়া হয়। এইভাবে পর্দাটির নিচের অর্ধাংশের যে শব্দগুলো ছাপা আছে তার থেকে শব্দ নির্মাণ করতে পারে। যা বলতে চাইছেন সেটা যখন তৈরি হল তখন তিনি সেটাকে বাক্য সংশ্লেষণ (speech synte sizer) রেকর্ডে ধরে রাখতে পারেন।
স্যু : কিন্তু ব্যাপারটার গতি বড় ধীর।
স্টিফেন : ধীর বটে। স্বাভাবিক কথা বলার যে গতি তার প্রায় এক দশমাংশ। কিন্তু আমি যা আগে ছিলাম তার চাইতে বাক্য সংশ্লেষক অনেক বেশি স্পষ্ট। ইংরেজরা বলে এর টানটা আমেরিকানদের মতো কিন্তু আমেরিকানরা বলে টানটা স্ক্যান্ডেনেভিয়ান কিংবা আইরিশ। সে যাই হোক, কথাগুলো সবাই বুঝতে পারে। আমার সন্তানদের ভিতর যারা বড় তারা আমার স্বাভাবিক কথা যেমন মন্দ হয়েছে তার সঙ্গে তেমনি মানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আমার ছোট ছেলের বয়স আমার অপারেশানের সময় ছিল ছয় বছর। আগে সে আমার কোন কথাই বুঝতে পারত না, এখন তার কোন অসুবিধা নেই আমার কাছে এটা অনেক।
স্যু : তাছাড়া এর অর্থ যে কোন সাক্ষাৎপ্রার্থীর প্রশ্ন সম্পর্কে আপনি আগে থেকে জানতে চাইতে পারেন। এবং আপনি যখন ভাল আছেন এবং উত্তর দিতে প্রস্তুত তখনই উত্তর দিতে পারেন।
স্টিফেন : এরকম দীর্ঘ রেকর্ড করা কর্মসূচিতে প্রশ্নগুলো সম্পর্কে আগে থেকে খবর পেলে সুবিধা হয়। তাহলে আমি আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা টেপরেকর্ডার ব্যবহার করি না। এক কথায় ব্যাপারটা অনেক বেশি আমার হাতে থাকে। কিন্তু আসলে আমি তাৎক্ষণিক উত্তর দিতে পছন্দ করি। সেমিনার কিংবা সাধারণ লোকের কাছে দেওয়া বক্তৃতাতে আমি তাই করি।
স্যু : কিন্তু আপনি বলছেন এই পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ আপনার হাতে থাকবে। আমি জানি আপনার কাছে এর গুরুত্ব অনেক বেশি। আপনার পরিবারের লোকেরা এবং বন্ধুরা অনেক সময় বলেন আপনি একগুয়ে আর একটু কর্তাগিরি করতে ভালবাসেন– আপনি কি এই দোষগুলো স্বীকার করেন?
স্টিফেন : যার কিছু কাণ্ডজ্ঞান আছে, তাকেই লোকে অনেক সময় একগুয়ে বলে।
আমার পছন্দ নিজেকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলা। আমি যদি যথেষ্ট দৃঢ়প্রতিজ্ঞ না হতাম তাহলে । আমি আজকে এখানে থাকতাম না।
স্যু : আপনি কি সবসময় এরকমই ছিলেন?
স্টিফেন : আমি শুধুমাত্র চাই আমার নিজের জীবনের উপরে, অন্য লোকের যেমন আছে, তেমনি নিয়ন্ত্রণ আমারও থাক। বেশিরভাগ সময়েই প্রতিবন্ধীদের জীবন অন্য লোক নিয়ন্ত্রণ করে। সুস্থদেহী কেউই এটা পছন্দ করবে না।
স্যু : আপনার দ্বিতীয় রেকর্ডটা সম্পর্কে আমাদের বলুন।
স্টিফেন : ব্রাম (Brahm) এর ভায়োলিন (violin-বেহালা) কনসার্টো। এটাই আমার প্রথম কেনা লং প্লেয়িং রেকর্ড। তখন ১৯৫৭ সাল। মিনিটে তেত্রিশ বার ঘোরে (33 pm) এরকম রেকর্ড তখন সবে ব্রিটেনে এসেছে। আমার বাবা একটি রেকর্ডপ্লেয়ার কেনাকে অসাবধানতা এবং নিজেকে আস্কারা দেওয়া মনে করতেন। আমি তাকে বোঝালাম, যন্ত্রাংশগুলো সস্তায় কিনে আমি নিজেই তৈরি করতে পারি। আমার বাবা ইয়র্কশায়ারের নোক তিনি এতে খুশি হলেন। মিনিটে আটাত্তর বার ঘোরে (7৪ rpm) রেকর্ড ঘোরানোর এরকম যন্ত্রের বাক্সে রেকর্ড ঘোরানোর একটি চাকতি আর একটি অ্যামপ্লিফায়ার বানালাম। ওটা যত্ন করে রেখে দিলে এখন তার দাম অনেক হত।
রেকর্ডপ্লেয়ারটা তৈরি হল। কিন্তু তাতে বাজানোর একটা কিছু চাই। স্কুলের একজন বন্ধু দিল ব্রামের ভায়োলিন (বেহালা) কনসার্টো। স্কুলে আমাদের দলের কারও ঐ রেকর্ড ছিল না। আমার মনে আছে, তখন ওর দাম ছিল পঁয়ত্রিশ শিলিং। তখনকার দিনে পঁয়ত্রিশ শিলিং অনেক টাকা বিশেষ করে আমার কাছে। রেকর্ডের দাম এখন অনেক বেড়েছে কিন্তু হিসাব করলে এখন অনেক কম।
দোকানে যখন প্রথম এই রেকর্ডটা শুনেছি তখন আওয়াজটা অদ্ভুত মনে হয়েছিল এবং আমার ভাল লাগছে কিনা সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম না। কিন্তু মনে হয়েছিল আমার ভাল লেগেছে বলা উচিত। তবে এত বছরে ঐ রেকর্ডের দাম এখন আমার কাছে অনেক ধীরগতি সুরের শুরুটা বাজাতে আমার ভাল লাগে।
স্যু: পুরানো এক পারিবারিক বন্ধু বলেছেন, আপনি যখন বালক ছিলেন আপনাদের পরিবার তখন তাঁর ভাষাতেই বলি– ‘অত্যন্ত বুদ্ধিমান, খুব চতুর এবং খুবই ছিটগ্রস্ত’। আগের কথা ভেবে আপনার কি মনে হয় এ বিবরণ ঠিক?
স্টিফেন : আমাদের পরিবার বুদ্ধিমান ছিল কিনা সে বিষয়ে আমি কোন মন্তব্য করতে পারি না, কিন্তু আমি কিছুতেই বলব না আমরা ছিটগ্রস্ত ছিলাম। তবে মনে হয় সেন্ট অ্যালবান্স এর মানদণ্ডে আমাদেরই বোধ হয় সেইরকমই মনে হত। আমরা যখন সেখানে ছিলাম জায়গাটি ছিল বেশ সেকেলে (staid) আর অনগ্রসর।
স্যু : আর আপনার বাবা ছিলেন ট্রপিক্যাল (গ্রীষ্মমগুলের) ব্যাধি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ।
স্টিফেন : আমার বাবা গ্রীষ্মমণ্ডলের ব্যাধি নিয়ে গবেষণা করতেন। কার্যক্ষেত্রে নতুন ওষুধ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তিনি প্রায়ই আফ্রিকায় যেতেন।
সু : তাহলে আপনার মায়ের প্রভাবই কি আপনার উপর বেশি ছিল? তাই যদি হয়, তাহলে সে প্রভাবের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আপনি বলবেন?
স্টিফেন : না, আমি বলব আমার বাবার প্রভাবই আমার উপর বেশি ছিল। তাঁরই আদর্শে আমি নিজেকে গড়েছি। যেহেতু তিনি ছিলেন বৈজ্ঞানিক গবেষক সেজন্য মনে হত বড় হলে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করাই স্বাভাবিক। একমাত্র পার্থক্য ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞান কিংবা জীববিজ্ঞানে আমার আকর্ষণের অভাব। তার কারণ আমার মনে হত এগুলো অত্যন্ত অযথাযথ (inexact) এবং বর্ণনামূলক। আমি এমন জিনিস চেয়েছিলাম যা আরও মূলগত। পদার্থবিদ্যায় আমি তাই পেয়েছি।
স্যু : আপনার মা বলেছেন, যাকে বলা হয় আশ্চর্য হওয়ার মতো শক্তিশালী বোধ–আপনার তাই ছিল। ‘আমি দেখতাম তারকাগুলো ওকে আকর্ষণ করত’–আপনার মা এই কথা বলেছেন– আপনার কি সে কথা মনে আছে?
স্টিফেন : আমার মনে আছে এক রাত্রিতে আমি লন্ডন থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। তখনকার দিনে পয়সা বাঁচানোর জন্য রাস্তার আলো মাঝরাত্রিতে নিভিয়ে দেওয়া হত। আমি রাতের আকাশ দেখতাম– যা আমি আগে কখনও দেখিনি দেখলাম আকাশের এপাশ থেকে ওপাশ অবধি স্বর্গগঙ্গা (milky way)। আমার মরুদ্বীপ কোন রাস্তায় আলো থাকবে না সুতরাং তারাগুলোকে আমি ভাল করে দেখতে পাব।
স্যু : স্পষ্টতই শৈশবে আপনি খুবই মেধাবী আর বুদ্ধিমান ছিলেন। বাড়িতে বোনের সঙ্গে খেলায় আপনার প্রতিযোগী মনোভাবও ছিল খুব বেশি কিন্তু স্কুলে আপনি প্রায় নিচে থাকতেন এবং ব্যাপারটা গ্রাহ্য করতেন না– তাই না?
স্টিফেন : সেটা ছিল সেন্ট অ্যালবান্স স্কুরের প্রথম বছরে। আমার বলা উচিত সে ক্লাসের ছেলেরা খুবই মেধাবী ছিল। আমি ক্লাসে যা করতাম পরীক্ষায় তার চাইতে অনেক ভাল করতাম। ভাল করতে পারি বলে আমি নিশ্চিত ছিলাম কিন্তু আমার হাতের লেখা এবং সাধারণ অবিন্যস্ত স্বভাবের জন্য আমার স্থান নিচে নেমে যেত।
স্যু : তৃতীয় রেকর্ড?
স্টিফেন : অক্সফোর্ডে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ক্লাসে আমি আলডুস হাক্সলির উপন্যাস ‘পয়েন্ট কাউন্টারপয়েন্ট (Point Counterpoint by Aldous Huxley) পড়েছিলাম। এর উদ্দেশ্য ছিল ১৯৩০ দশকের চরিত্র চিত্রণ। এ বইয়ে পাত্র-পাত্রীর সংখ্যা ছিল বিরাট। অধিকাংশই ছিল কার্ডবোর্ডের মতো। একজনের ছিল অনেক বেশি মানবতাবোধ। স্পষ্টতই ইনি ছিলেন হাক্সলির নিজের প্রতিরূপ। ইনি ব্রিটিশ ফ্যাসিস্টদের নেতাকে হত্যা করেছিলেন। এই চরিত্র চিত্রণ করা হয়েছিল স্যার অসওয়াল্ড মোসূলের ঢঙে। হত্যা করে তিনি পার্টিকে জানালেন– কাজটি তিনি করেছেন। তারপর তিনি প্রামোফোনে বীঠোফেনের স্ট্রিং কোয়ার্টেটের ওপাস ১৩২ (Beethoven’s String Quartet, Opus 132) চালিয়ে দিলেন। থার্ড মুভমেন্টে একজন দরজায় ঘা দিল– তিনি দরজা খুললেন। তখনই ফ্যাসিস্টরা তাকে গুলি করল।
উপন্যাসটা ছিল খুবই খারাপ কিন্তু হাক্সলির সুর নির্বাচনটা ঠিক হয়েছিল। আমি যদি জানতে পারি একটি সামুদ্রিক জলোচ্ছাস আমার মরুদ্বীপকে ডুবিয়ে দিতে আসছে তাহলে আমি এই কোয়ার্টেটের থার্ড মুভমেন্ট বাজাব।
সু : আপনি অক্সফোর্ড অবধি গিয়েছেন, ইউনিভার্সিটি কলেজে গেছেন, গণিতশাস্ত্র আর পদার্থবিদ্যা পড়েছেন। আপনার নিজের গণনা অনুসারে আপনি গড়ে দিনে ঘণ্টাখানেক পড়াশোনা করেছেন। যদিও বলা উচিত আপনি নৌকা চালিয়েছেন, বীয়ার খেয়েছেন, অনেকের সঙ্গে আজেবাজে খুনসুটি করে আনন্দ পেয়েছেন। অবশ্য এগুলো আমি পড়ে জেনেছি। সমস্যাটি কি ছিল? কেন আপনার পড়াশোনা করতে ইচ্ছা করত না?
স্টিফেন : তখন পঞ্চাশের দশকের শেষ। অধিকাংশ তরুণদেরই সমাজের কর্তাদের সম্পর্ক (Establishment) মোহভঙ্গ হয়েছিল। মনে হয়েছিল ভবিষ্যৎ কিছু নেই– আছে শুধু সমৃদ্ধি–আরও সমৃদ্ধি। রক্ষণশীল দল তৃতীয়বার ভোটে জিতেছে। তাদের জিগির ছিল ‘এত ভাল আপনারা কখনও থাকেননি। আমি আর আমার সমকালীনদের সবারই জীবনকে ক্লান্তিকর আর একঘেয়ে মনে হত।
স্যু : কিন্তু তবুও আপনি কয়েক ঘণ্টায় যে সমস্যা সমাধান করেছিলেন আপনার সহপাঠীরা তা কয়েক সম্পাহেও করতে পারেননি। পরে তারা যা বলেছেন তা থেকে স্পষ্টই মনে হয় তারা জানতেন আপনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। আপনার কি মনে হয় আপনি সেটা জানতেন?
স্টিফেন : অক্সফোর্ডের পদার্থবিদ্যার পাঠক্রম তখন উপহাস করার মতো সহজ ছিল। কোন লেকচারে না গিয়ে সপ্তাহে দুই-একটা টিউটোরিয়ালে গিয়েই পরীক্ষায় পাস করা যেত। খুব বেশি তথ্য জানবারও প্রয়োজন ছিল না– কয়েকটি সমীকরণ জানলেই চলত।
স্যু : কিন্তু অক্সফোর্ডেই আপনি প্রথম লক্ষ্য করলেন আপনি নিজের হাত-পা দিয়ে যা করাতে চান, আপনার হাত-পা ঠিক তা করছে না–তাই না? নিজের কাছে আপনি এর কি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন?
স্টিফেন : আসলে আমি প্রথম লক্ষ্য করলাম, দাঁড় টানা নৌকা আমি ঠিকমতো চালাতে পারছি না। তারপর একদিন জুনিয়র কমনরুমের সিঁড়ি থেকে বিশ্রীভাবে পড়ে যাই। মস্তিষ্কের ক্ষতি হয়ে থাকতে পারে এই ভয়ে আমি পড়ে যাওয়ার পর কলেজের ডাক্তারের কাছে গেলাম। তিনি ভেবেছিলেন আমার কিছু হয়নি তবে আমাকে বীয়ার খাওয়া কমাতে বললেন। অক্সফোর্ডের ফাইনাল পরীক্ষার পর গ্রীষ্মে আমি গিয়েছিলাম পারস্যে। ফিরে এসে আমি সত্যিই দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম কিন্তু আমি ভেবেছিলাম আমার পেটের গোলমাল হয়েছিল সেজন্যই শরীর খারাপ।
স্যু : কিন্তু কোন্ সময় আপনি হার স্বীকার করলেন আর মেনে নিলেন সত্যিই একটা কিছু গোলমাল হয়েছে– ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার?
স্টিফেন : আমি তখন কেমব্রিজে। বড়দিনে বাড়ি গিয়েছিলাম। তখন ৬২/৬৩ সাল। সে বছর খুব শীত পড়েছিল। মা আমাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সেন্ট অ্যালবান্সের লেকে স্কেটিং করতে যেতে রাজি করেছিলেন। আমার তখন সত্যিই অতটা ক্ষমতা ছিল না। আমি পড়ে গিয়েছিলাম। তারপর উঠতে খুবই কষ্ঠ হয়েছিল। মা বুঝতে পারলেন কিছু একটা গোলমাল হয়েছে বাড়ির ডাক্তারের কাছে আমাকে নিয়ে গেলেন।
স্যু : তারপর তিন সপ্তাহ হাসপাতালে আর তারপর ওরা সব চাইতে খারাপ খবরটা দিল?
স্টিফেন : আসলে সেটা ছিল লন্ডনের বার্টস হাসপাতাল (Barts Hospital, London), কারণ আমার বাবা ছিলেন বার্টসের মানুষ। আমি ভর্তি ছিলাম দুসপ্তাহ। নানারকম পরীক্ষা হল কিন্তু গোলমালটা কি ছিল সেটা তারা কেউই বলেননি। শুধু বলেছিলেন এটা এম. এস. নয়। আর বলেছিলেন, রোগটা জাতিরূপে (typical) নয়। ভবিষ্যৎ কি সেটা তারা বলেননি। তবে সেটা যে খুবই খারাপ আমি সেরকমই অনুমান করেছিলাম। সুতরাং আমি জিজ্ঞাসা করতে চাইনি।
স্যু : আর পরিণামে আপনাকে আসলে বলেই দেওয়া হয়েছিল, আপনি আর মোটে বছর দুয়েক বাঁচবেন। স্টিফেন, আপনার গল্পের এখানে একটু থামা যাক। আপনার পরের রেকর্ডটা নিন।
স্টিফেন : ভালকিরি (The Valkyrie), প্রথম অঙ্ক। এটা প্রথম যুগের আর একটা L.P. (লংপ্লেয়িং রেকর্ড)। এতে মেলকিওর (Melchior) এবং লেমান (Lemann) আছেন। এটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে রেকর্ড করা হয়েছিল ৭৮ এ (আগেকার রেকর্ড, যেগুলো মিনিটে ৭৮ বার চলত)। ৬০ এর দশকের প্রথম দিকটায় এটা L.P.তে করা হয়। ১৯৬৩ সালে যখন আমার রোগ মোটর নিউরন ডিজিজ বলে নির্ণয় করা হল, তখন আমি ওয়াগনারের (Wanger) দিকে ঝুঁকলাম (আমি যে ঘন কৃষ্ণ ভবিষ্যম্মুখী মেজাজে ছিলাম– ওয়াগনারই ছিলেন তার উপযুক্ত)। দুর্ভাগ্যক্রমে, আমার বাক্য সংশ্লেষক (speech synthe-sizer) খুব সুশিক্ষিত নয়। সেজন্য আমি যদি মোটামুটি সঠিক শব্দের কাছাকাছি যেতে চাই তাহলে বানান করতে হয় V-A-R-G-N-E-R ওয়াগনারের নাম উচ্চারণে নরম একটা w ব্যবহার করে যন্ত্রটা।
রিং সাইকেলের (Ring cycle) চারটি অপেরা ওয়াগনারের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। ১৯৬৪ সালে বোন ফিলিপ্পা (Philippa)-র সঙ্গে জার্মানির বেরুথে (Bayreuth) অপেরাগুলো দেখতে গিয়েছিলাম। সে সময় আমি রিং ভাল জানতাম না। সাইকেলের দ্বিতীয় অপেরা ভালকিরি (Valkyrie) আমার উপর প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করেছিল। এটা ছিল উলফগ্যাঙ ওয়াগনারের (Wolfgang Wagner) পরিচালনা। রঙ্গমঞ্চ ছির সম্পূর্ণ অন্ধকার। এটা সিগমুন্ড (Siegmund) এবং সিগলিন্ডে (Sieglinde) নামে একজোড়া যমজের কাহিনী। শৈশবে তারা আলাদা হয়ে গিয়েছিল। তাদের আবার দেখা হয় যখন সিগমুন্ড হান্ডিঙের (Handing) বাড়িতে আশ্রয় নেন। হাডিঙ ছিলেন সিগলিভের স্বামী এবং সিগমুণ্ডের শক্র। যে উদ্ধৃতিটি আমি বেছে নিয়েছি, সেটি হান্ডিঙের সঙ্গে সিগলিন্ডেকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার কাহিনী। উৎসবের মাঝে এক বৃদ্ধ হলে প্রবেশ করলেন। অর্কেস্ট্রাতে ভালহালা (Valhalla) বাজতে লাগল। রিঙের সবচাইতে মহান কাহিনীগুলোর নেতা ওটান (Wotan)। তাছাড়া তিনি ছিলেন সিগমুন্ড এবং সিগলিন্ডের বাবা। একটি তরোয়াল তিনি গাছের গুঁড়িতে ঢুকিয়ে দিলেন। তরোয়ালটি ছিল সিগমুন্ডের জন্য। অঙ্কের শেষে, সিগমুন্ড তরোয়ালটি বার করে এবং দুজনে জঙ্গলে পালিয়ে যায়।
স্যু : স্টিফেন, আপনার সম্পর্কে পড়ে মনে হয় যেন আপনার বছর দুইয়ের মতো বাঁচার কথা ছিল অর্থাৎ আপনার মৃত্যুদণ্ড আপনাকে জাগিয়ে তুলেছিল। আপনার পছন্দ হলে বলা যায়, আপনার দৃষ্টি সম্পূর্ণভাবে জীবনের দিকে ফিরিয়ে দিয়েছিল।
স্টিফেন : এর প্রথম ক্রিয়া ছিল আমাকে বিষাদগ্রস্ত করা। মনে হয়েছিল, আমার অবস্থা বেশ দ্রুত খারাপ হয়ে চলেছে। কিছু করার, কিংবা পি. এচি. ডি-র জন্য কাজ করার কোন অর্থ ছিল বলে মনে হয়নি। তার কারণ, টটো শেষ করতে যতদিন লাগবে ততদনি বাঁচব কিনা আমি জানতাম না। তারপর কিন্তু একটু উন্নতি হতে শুরু করল। রোগ আরও ধীরে অগ্রসর হতে লাগল এবং আমার কাজও এগোতে লাগল। বিশেষ করে, মহাবিশ্বে নিশ্চয়ই একটা বৃহৎ বিস্ফোরণ শুরু হয়েছিল–এটা প্রমাণের ব্যাপারে।
স্যু : একটি সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছেন, আগে যা ছিলেন এখন আপনি তার চাইতে সুখী।
স্টিফেন : সত্যিই আমি আগের চাইতে সুখী। আমার অসুখ করার আগে জীবনটা একঘেয়ে হয়ে গিয়েছিল কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে মৃত্যুর আশঙ্কার ফলে আমি বুঝতে পারলাম বেঁচে থাকার মূল্য আছে। করার মতো কজ আছে–যে কোন লোকই কত কাজ করতে পারে। আমার একটি সত্যিকারের কৃতিত্ববোধ আছে–আমার এরকম অবস্থা সত্ত্বেও আমি মানুষের জ্ঞানভাণ্ডারে সামান্য হলেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন করতে পেরেছি। অবশ্যই আমি ভাগ্যবান তবে কঠোর চেষ্টা করলে সবাই কিছু না কিছু করতে পারে।
স্যু : আপনি কি এরকম বলবেন–মোটর নিউরন ব্যাধি না হলে আপনি যতটা কৃতিত্ব অর্জন করেছেন, ততটা কৃতিত্ব অর্জন করতে পারতেন না? নাকি এরকম বলা অতি সরলীকরণ?
স্টিফেন : না, মোটর নিউরন ব্যাধি কারও কোন সুবিধা করতে পারে না। তবে অন্য লোকের যতটা অসুবিধা হয় আমার ততটা অসুবিধা হয়নি। তার কারণ, আমি যা করতে চেয়েছিলাম এ রোগ সেটা বন্ধ করেনি। আমি চেষ্টা করেছিলাম মহাবিশ্বের কর্মপ্রণালী বোঝার।
স্যু : যখন আপনি রোগের সেঙ্গ একটা সমঝোতায় আসতে চেষ্টা করছিলেন তখন আপনার প্রেরণা ছিল জেন ওয়াইল্ড নামে একজন তরুণী। তার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল একটা পার্টিতে (ভোজসভা)। আপনি তার প্রেমে পড়েন এবং পরে তাকে বিয়ে করেন। আপনার মতে নিজের সাফল্যের জন্য জেনের কাছে কতটা ঋণী?
স্টিফেন : সে না থাকলে এ কাজ আমি নিশ্চয়ই করতে পারতাম না। ওর সঙ্গে বিয়ে স্থির হওয়াতে আমি যে হতাশার পাঁকে ডুবেছিলাম তা থেকে উঠে আসতে পারলাম। বিয়ে করতে হলে আমার একটা কাজ পাওয়া দরকার ছিল এবং দরকার ছিল পি. এইচ. ডি.-টা শেষ করা। আমি খুব খাটতে শুরু করলাম। তখন দেখলাম কাজ করতে আমার ভালই লাগছে। আমার অবস্থা যখন খারাপ হতে লাগল তখন একা জেন আমার দেখাশোনা করেছে। সেই সময় কেউই আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি। পয়সা দিয়ে লোক রাখার ক্ষমতা তখন আমাদের ছিল না।
স্যু : আপনারা দুজনে মিলে ডাক্তারকে অগ্রাহ্য করলেন –শুধুমাত্র আপনারা বেঁচে রইলেন বলেই নয়, আপনাদের সন্তান হল সেজন্যও। আপনাদের রবার্ট হল ১৯৬৭ তে, লুসি ১৯৭০ এ, তারপর টিমথি হল ১৯৭৯-তে। ডাক্তাররা কি রকম ধাক্কা খেয়েছিলেন?
স্টিফেন : আসলে যে ডাক্তার আমার রোগ নির্ণয় করেছিলেন তিনি আমার দায়িত্ব। ত্যাগ করলেন। তিনি ভেবেছিলেন করবার মতো আর কিছু নেই। প্রাথমিক রোগনির্ণয়ের পর আমার সঙ্গে তাঁর আর দেখা হয়নি। ফলে বাবা-ই আমার ডাক্তার হলেন, আমি তাঁর কাছ থেকেই উপদেশ নিতাম। তিনি বলেছিলেন, রোগটা যে বংশানুক্রমিক এ রকম কোন প্রমাণ নেই। জেন আমার আর দুই বাচ্চার দেখাশোনা করত। ১৯৭৪ সালে যখন আমরা ক্যালিফোর্নিয়া গেলাম তখনই আমাদের বাইরের লোকের সাহায্য নিতে হয়েছে। প্রথমে একটি ছাত্র আমাদের সঙ্গে থাকত, তারপর থাকত একজন নার্স।
স্যু : কিন্তু এখন আপনি আর জেন একসঙ্গে নেই।
স্টিফেন : আমার ট্রাকিওস্টমি অপারেশানের পর আমার চব্বিশ ঘণ্টা নার্স লাগত। তার ফলে বিয়েটার উপর ক্রমশ বেশি বেশি চাপ পড়ছিল। শেষে আমি বেরিয়ে এলাম। এখন আমি থাকি কেমব্রিজে একটি নতুন ফ্ল্যাটে। আমরা এখন আলাদা থাকি।
স্যু : আরও কিছু গান-বাজনা শোনা যাক।
স্টিফেন : বীটলদের প্লিজ প্লিজ মি (Please please Me)। চার-চারটি গুরুগম্ভীর রেকর্ড নির্বাচনের পর এখন আমার একটু হাল্কা হওয়া প্রয়োজন। আমার জন্য এবং অন্য অনেকের জন্য অসুস্থ বাসি পপ-এর জায়গা বীলরা স্বাগত বিশুদ্ধ বাতাস নিয়ে এসেছিল। রবিবার সন্ধ্যায় আমি রেডিও লুক্সেমবুর্গে শ্রেষ্ঠ কুড়িজন বীটলের গান শুনতাম।
স্যু : স্টিফেন হকিং, আপনার উপর এত সম্মান বর্ষিত হওয়া সত্ত্বে– আমি বিশেষ করে উল্লেখ করব, আপনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতশাস্ত্রের লুকেসিয়ান অধ্যাপক অর্থাৎ স্যার আইজাক নিউটনের চেয়ারে রয়েছেন –আপনি নিজের গবেষণার বিষয়ে সাধারণ মানুষের জন্য একটি বই লেখার সিদ্ধান্ত করলেন। আমার মনে হয় তার সহজ কারণ –আপনার অর্থের প্রয়োজন ছিল।
স্টিফেন : আমি ভেবেছিলাম সাধারণ মানুষের জন্য একটি বই লিখলে আমি সামান্য কিছু টাকা পেতে পারি কিন্তু কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লেখার প্রধান কারণ ছিল লিখতে আমার ভাল লাগত। গত পঁচিশ বছরে যে সমস্ত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হয়েছে সে সম্পর্কে আমার উত্তেজনা ছিল– আমি চেয়েছিলাম সাধারণ মানুষকে এ কাহিনী জানাতে। বইটা যত ভালভাবে গৃহীত হয়েছে সেরকম হবে বলে আমি কখনও আশা করিনি।
স্যু : সত্যিই বইটা সমন্ত রেকর্ড ভেঙেছে। তাছাড়া সবচাইতে বেশি বিক্রিত বইয়ের তালিকায় থাকার জন্য এটা গিনেস বুকে স্থান পেয়েছে এবং এখনও সেই স্থানে রয়েছে। সারা পৃথিবীতে কতগুলো বই বিক্রি হয়েছে নিশ্চয়ই। স্পষ্টতই বইটা লোকে কিনছে কিন্তু লোকে প্রশ্ন করছে –বইটা কি তারা পড়ছে?
স্টিফেন : আমি জানি বার্নার্ড লেভিন (Bernard Levin) ঊনত্রিশ পাতায় এসে আটকে গিয়েছিলেন। তবে আরও অনেকটা এগিয়েছেন এরকম অনেকের কথা জানি। সারা পৃথিবীতেই লোকে আমার কাছে এসে বলে বইটা তাদের কত ভাল লেগেছে। তাঁরা হয়ত বইটা সম্পূর্ণ পড়েননি কিংবা যতটা পড়েছেন তার সবটা বুঝতে পারেননি। কিন্তু তাঁরা অন্তত এই ধারণা করতে পেরেছেন যে আমরা যে মহাবিশ্বে বাস করি সেটা যৌক্তিক বিধি দ্বারা শাসিত এবং চেষ্টা করলে সে বিধি আবিষ্কার করা যায় এবং বোঝ যায়।
স্যু : কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কীয় কল্পনই প্রথম জনসাধারণের কল্পনাকে উদ্দীপ্ত করে এবং মহাবিশ্ব তত্ত্ব সম্পর্কে আকর্ষণ পুনরুজ্জীবিত করে। ঐ সমস্ত স্টার ট্রেকস (star treks তারকার পথ) দেখেছেন, যেখানে কোন মানুষ এর আগে কখনও যায়নি, সেখানে সাহসের সঙ্গে যাওয়া এবং ঐ প্রকার। যদি দেখে থাকেন তাহলে সেগুলো কি আপনার ভাল লেগেছে?
স্টিফেন : ১৩/১৪ বছর বয়স থেকে ১৯/২০ বছর বয়স অবধি আমি অনেক বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী পড়েছি। কিন্তু এখন আমি নিজেই ঐ ক্ষেত্রে কাজ করছি, সেজন্য মনে হয় বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীগুলো একটু সহজ সরল। যদি সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি চিত্রণের অংশ না হয় তাহলে মহাস্থান (hyper space) যাওয়া কিংবা লোকের উপর আলোকরশি ফেলা সম্পর্কে লেখা খুবই সহজ। বাস্তব বিজ্ঞান অনেক বেশি উত্তেজক, কারণ, ঘটনাগুলো সত্যিই ঘটছে। পদার্থবিদরা চিন্তা করার আগে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর লেখকেরা কখনও কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে অভিভাবন (suggestion) করেননি। কিন্তু এখন আমাদের কাছে কয়েকটি কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে প্রমাণ রয়েছে।
স্যু : কেউ কৃষ্ণগহ্বরে পড়লে কি হবে?
স্টিফেন : যারা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী পড়েন তারা সবাই কৃষ্ণগহ্বরে পড়লে কি হয় সেটা জানেন, আপনি একটা সেমাই (spaghetti) হয়ে যাবেন। কিন্তু আরও বেশি আকর্ষণের ব্যাপারটা হল কৃষ্ণগহ্বরগুলো সম্পূর্ণ কৃষ্ণ নয়। তারা কণিকা এবং বিকিরণ স্থির হারে বাইরে প্রেরণ করে (send out), এর ফলে কৃষ্ণগহ্বরগুলো ধীরে ধীরে উবে যায় কিন্তু পরিণামে কৃষ্ণগহ্বর এবং তার আধেয়গুলোর কি হয় সেটা জানা নেই। এটা গবেষণার একটা উত্তেজক ক্ষেত্র। কিন্তু বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর লেখকরা এখনও ঐ অবধি পৌঁছাতে পারেননি।
স্যু : আপনি যে বিকিরণের কথা উল্লেখ করলেন নিশ্চয়ই তার নাম হকিং বিকিরণ। কৃষ্ণগহ্বর আপনি আবিষ্কার করেননি তবে কৃষ্ণগহ্বর যে কৃষ্ণ নয় সেটা প্রমাণ করার জন্য আপনি গবেষণা করেছেন, কিন্তু তাঁদের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর লেখকরা) আবিষ্কারের ফলে আপনি মহাবিশ্বের উৎপত্তি সম্পর্কে আরও গভীরভাবে চিন্তা করতে শুরু করেছিলেন, তাই না?
স্টিফেন : একটা তারকা চুপসে গিয়ে কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হওয়া অনেক দিক থেকে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের কালে পশ্চাৎগামী হওয়ার মতো। একটা তারকা যথেষ্ট স্বল্প ঘনত্বের অবস্থা থেকে চুপসে গিয়ে অতি উচ্চ ঘনত্বের অবস্থায় পৌঁছায়। একটা গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে–আমরা কৃষ্ণগহ্বরের বাইরে কিন্তু মহাবিশ্বের ভিতরে। দুটিরই বৈশিষ্ট্য তাপীয় বিকিরণ।
স্যু : আপনি বলছেন পরিণামে কৃষ্ণগহ্বর এবং তার আধেয়গুলোর কি হয় তা জানা নেই, কিন্তু আমি ভেবেছিলাম তত্ত্বটি হল, যাই ঘটুক না কেন কৃষ্ণগহ্বরের ভিতরে যা অদৃশ্য হবে সেটি মহাকাশচারী হলেও পরিণামে হকিং বিকিরণরূপে আবার বেরিয়ে আসবে (recycled)।
স্টিফেন : মহাকাশচারীর ভরশক্তি কৃষ্ণগহ্বর কর্তৃক বাইরে প্রেরিত বিকিরণরূপে পুনরাবর্তিত হবে। কিন্তু মহাকাশচারী নিজে কিংবা যে কণিকাগুলো দিয়ে তারা গঠিত সেগুলো কৃষ্ণগহ্বর থেকে বেরিয়ে আসবে না। সুতরাং প্রশ্ন হল–সেগুলোর কি হয়? তারা কি ধ্বংস হয়ে যায়? না কি তারা অন্য একটি মহাবিশ্বে চলে যায়? আমি যদিও কৃষ্ণগহ্বরে লাফ দিয়ে পড়ার কথা ভাবছি না তবুও কি হয় সেটি জানতে আমি খুবই ইচ্ছুক।
স্যু : স্টিফেন, আপনি কি স্বজ্ঞার (intuition) ভিত্তিতে কাজ করেন? অর্থাৎ আপনি কি পছন্দসই একটা তত্ত্বে উপনীত হন? সে তত্ত্ব আপনাকে উদ্দীপিত করে এবং আপনি সেটাকে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন, নাকি বৈজ্ঞানিক হিসেবে একটা সিদ্ধান্তের দিকে যৌক্তিকভাবে অগ্রসর হন এবং আগে থাকতে অনুমান করতে সাহস করেন না?
স্টিফেন : আমি স্বজ্ঞার উপরে খুবই নির্ভর করি। একটা ফল আমি অনুমান করতে চেষ্টা কির তবে সে ফলটা আমায় প্রমাণ করতে হবে। তবে এই অবস্থায় আমি অনেক সময়ই দেখি যা আমি ভেবেছিলাম সেটা সত্যি নয়। কিংবা ব্যাপারটা হল এমন একটা কিছু যার কথা আমি চিন্তাও করি না। সেইভাবেই আমি আবিষ্কার করেছিরাম কৃষ্ণগহ্বর সম্পূর্ণ কৃষ্ণ নয়। আমি চেষ্টা করছিলাম অন্য কিছু প্রমাণ করতে।
স্যু : আরও গান-বাজনা।
স্টিফেন : মোজার্ট আমি চিরকাল পছন্দ করি। তিনি অবিশ্বাস্য পরিমাণ সুর রচনা করে গেছেন। এই বছরে কিছুদিন আগে, আমার ৫০ বছরের জন্মদিনে আমাকে CD-তে তাঁর সম্পূর্ণ রচনাবলি উপহার দেওয়া হয়েছিল। ওগুলো বাজাতে প্রায় ২০০ ঘণ্টা লাগে। আমি এখনও সেগুলো শুনছি আর এগিয়ে যাচ্ছি। সবচাইতে ভালগুলোর মধ্যে রেকুইম (Requiem) একটি। রেকুইম শেষ করার আগেই মোজার্টের মৃত্যু হয়। মোজার্টের একজন ছাত্র, তিনি যে টুকরোগুলো রেখে গিয়েছিলেন, তার ভিত্তিতে ওটা শেষ করেন। যে ইন্ট্রয়েট (introit সঙ্গীতের প্রথম অংশ) আমরা শুনতে যাচ্ছি সেটাই একমাত্র অংশ যা মোজার্ট কর্তৃক সম্পূর্ণভাবে লিখিত এবং ঐকতান নির্দেশিত।
স্যু : আপনি আমাকে মাফ করবেন স্টিফেন, আপনার তত্ত্বগুলোর আমি অতিসরলীকরণ করছি। আমি বুঝতে পারছি এক সময় আপনি বিশ্বাস করতেন সৃষ্টির একটা বিশেষ মুহূর্ত ছিল অর্থাৎ একটা বৃহৎ বিস্ফোরণ, কিন্তু এখন আর আপনি সেটা বিশ্বাস করেন না। এখন আপনার বিশ্বাস কোন আরম্ভও নেই, কোন অন্তও নেই। তার অর্থ কি কোন সৃষ্টিকর্ম হয়নি? সুতরাং ঈশ্বরের কোন স্থান নেই?
স্টিফেন : হ্যাঁ, আপনি একটু অতিসরলীকরণ করেছেন। আমি এখনও বিশ্বাস করি বাস্তব কালে মহাবিশ্বের একটা আরম্ভ আছে। সেটা বৃহৎ বিস্ফোরণ। কিন্তু আর একরকম কাল আছে সেটা বাস্তব কালের সমকোণে (right angle), এ কালে মহাবিশ্বের কোন আরম্ভও নেই, অন্তও নেই। এর অর্থ হবে মহাবিশ্ব কিভাবে শুরু হয়েছিল সেটা নির্ধারিত হবে পদার্থবিদ্যার বিধিগুলো দিয়ে। এ কথা বলা যাবে না যে, ঈশ্বর একটি যাদৃচ্ছিক পদ্ধতিতে মহাবিশ্বকে চালু করেছিলেন। সেই যাদৃচ্ছিক পদ্ধতি আমাদের বোঝা সম্ভব নয়। ঈশ্বর আছেন কি নেই তা নিয়ে এ তথ্য কিছু বলে না। শুধু বলে তিনি যাদৃচ্ছিক নন।
স্যু : কিন্তু ঈশ্বরের অস্তিত্বের যদি কোন সম্ভাবনা থাকে তাহলে যে সমস্ত ঘটনা বিজ্ঞানের অতীত সেগুলো আপনি কি করে ব্যাখ্যা করবেন? যেমন প্রেম এবং আপনার সম্পর্কে লোকের যে বিশ্বাস ছিল এবং আছে কিংবা উদ্দীপনায়?
স্টিফেন : প্রেম, বিশ্বাস এবং নীতিবোধ পদার্থবিদ্যার বাইরে অন্য শ্রেণীতে পড়ে। পদার্থবিদ্যার বিধিগুলো থেকে অবরোহী পদ্ধতিতে (deduce) মানুষের আচরণ কি হবে নির্ধারণ করা যায় না। কিন্তু আশা করা যায় পদার্থবিদ্যা এবং গণিতশাস্ত্রের সঙ্গে যে যৌক্তিক চিন্তা জড়িত সেটা ব্যক্তির নৈতিক আচরণের নির্দেশ দেবে।
স্যু : কিন্তু অনেকেই মনে করেন আপনি কার্যকরভাবে ঈশ্বরকে বাদ দিয়েছেন, তাহলে কি আপনি সেটা অস্বীকার করছেন?
স্টিফেন : আমার গবেষণা যা দেখিয়েছে সেটা হল মহাবিশ্ব কিভাবে শুরু হয়েছিল সেটা ঈশ্বরের ব্যক্তিগত খেয়াল–এ কথা বলার কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু তবুও আপনার পছন্দ হলে আপনি বলতে পারেন এই প্রশ্নের উত্তরই ঈশ্বরের সংজ্ঞা।
স্যু : এবার সাত নম্বর রেকর্ডটা নেওয়া যাক।
স্টিফেন : আমার অপেরা খুব পছন্দ। আমি ভেবেছিলাম গ্লুক (Gluck) এবং মোজার্ট থেকে ওয়াগনার, তার থেকে ভারডি (Verdi) এবং পুচ্চিনি (Puccini)। কিন্তু শেষে আমি কেটে-হেঁটে দুইয়েতে নামিয়েছিলাম। একটা হতে পারে ওয়াগনার এবং আমি ঠিক করেছিলাম শেষে পুচ্চিনি। টুরান্ডট (Turandot) তার সবচাইতে ভাল অপেরা। কিন্তু তিনিও এটা শেষ করার আগে মারা যান। যে উদ্ধৃতি আমি বেছে নিয়েছি সেটা একজন প্রাচীন চীনা রাজকুমারীকে কী করে মোঙ্গলরা বলাৎকার করে অপহরণ করে নিয়ে যায়–টুরান্ডটের লেখা সেই কাহিনী । প্রতিশোধ হিসেবে টুরান্ডট রাজকুমারী বিবাহ প্রার্থীদের তিনটি প্রশ্ন করবেন। তারা উত্তর করতে না পারলে তাদের প্রাণদণ্ড হবে।
স্যু : আপনার কাছে বড়দিনের অর্থ কি?
স্টিফেন : এটা অনেকটা আমেরিকানদের ধন্যবাদজ্ঞাপন উৎসবের মতো। বড়দিন একটা সময় যখন পরিবারের সবাই মিলিত হয় এবং অতীত বছরের জন্য ধন্যবাদজ্ঞাপন করেন, আস্তাবলে শিশুর জন্মটা আগামী বছরের দিকে আশার সঙ্গে দৃষ্টিপাত করার প্রতীক।
স্যু : এবার বস্তুবাদী প্রশ্ন। আপনি কি উপহার চেয়েছেন? নাকি আপনি এখন এত অবস্থাপন্ন যে আপনার সবকিছুই আছে?
স্টিফেন : আমি সহসাপ্রাপ্তি পছন্দ করি। কেউ যদি বিশেষ একটা কিছু প্রার্থনা করেন তাহলে তিনি দাতাকে কোন স্বাধীনতা দিচ্ছেন না। কিংবা তার কল্পনাকেও কোন স্বাধীনতা দিচ্ছেন না। কিন্তু আমি চকোলেট ছত্রাক (চকোলেট ছত্রাকchocolate truffles) পছন্দ করি। এটা লোককে জানাতে আমার খারাপ লাগে না।
স্যু : স্টিফেন, যা ভবিষ্যদ্বাণী করা ছিল আপনি তার চাইতে ত্রিশ বছর বেশি বেঁচেছেন। আপনি তিন সন্তানের জনক হয়েছেন। আপনাকে বলা হয়েছিল, কখনও জনক হতে পারবেন না। আপনি সর্বাধিক বিক্রিত একটি বই লিখেছেন, স্থান-কাল সম্পর্কে বহু যুগের বিশ্বাসকে আপনি উল্টে দিয়েছেন। এ গ্রহ পরিত্যাগ করার আগে আপনার আর কি করার পরিকল্পনা আছে?
স্টিফেন : এসবই সম্ভব হওয়ার কারণ অনেক সাহায্য পাওয়ার মতো সৌভাগ্য আমার ছিল। আমার কৃতিত্বের জন্য আমি সুখী কিন্তু মৃত্যুর আগে আমি আরও অনেক কিছু করতে চাই। আমার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আমি কিছু বলব না। কিন্তু বৈজ্ঞানিক হিসেবে বলব, আমি জানতে চাই মহাকর্ষের সঙ্গে কণাবাদী বলবিদ্যার এবং প্রকৃতির অন্যান্য বলের ঐক্য কিভাবে করা যাবে? বিশেষ করে আমি জানতে চাই কৃষ্ণগহ্বর উবে গেলে কি ঘটে?
স্যু : এবার শেষ রেকর্ডটা।
স্টিফেন : এবার উচ্চারণটা আপনাকে করতে হবে। আমার বাক্য সংশ্লেষকটা আমেরিকান এবং ফরাসী ভাষা উচ্চারণে একেবারে যাচ্ছেতাই। এটা হল আডিথ পিয়েফের (Edith Piaf) গান। ‘Je me regrette riem’* এই গানটাই আমার জীবনের সংক্ষিপ্তসার।
[*Nissen hut–A barrel shaped per-fabricated hut of corrogated iron with cement floor–করোগেটেড টিনের তৈরি পিপের মতো চেহারার আগে থাকতে তৈরি করা একটা বাড়ি, এর মেঝেটা সিমেন্টের।]
স্যু : এবার স্টিফেন, ঐ আটখানা রেকর্ডের একটিমাত্র যদি আপনাকে নিতে দেওয়া হয় তাহলে আপনি কোন্টা নেবেন?
স্টিফেন : সেটা হবে মোজার্টের রেকুইম (Requiem)। আমার রেকর্ড বাজানোর ওয়াকম্যানের ব্যাটারি যতক্ষণ না শেষ হয় ততক্ষণ আমি এটা শুনতে পারি।
স্যু : আর আপনার বই? অবশ্য সেক্সপীয়রের সম্পূর্ণ রচনাবলি এবং বাইবেল আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।
স্টিফেন : আমার মনে হয় আমি জর্জ ইলিয়টের Middlemarch নেব। আরও মনে হয়, ভার্জিনিয়া উলফ কিংবা ঐরকম কেউ বলেছিলেন বইটা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। আমি বড় হয়েছি কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত নই, তবে বইটা পড়তে চেষ্টা করব।
স্যু : এবং আপনার বিলাস?
স্টিফেন : আমি চাইব অনেকটা ক্রেম ক্ৰলে creme brulee)।
সু : তাহলে চকোলেট ছত্রাক (chocolate truffles) নয়? অনেকটা ক্রেম লে? ড. স্টিফেন হকিং, আপনার মরুদ্বীপের রেকর্ড আমাদের শুনতে দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। বড়দিন আপনার আনন্দের হোক।
স্টিফেন : আমাকে নির্বাচন করার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ। আমার মরুদ্বীপ থেকে আমাদের সবার জন্য আনন্দময় বড়দিন প্রার্থনা করি। আমি বাজি ধরে বলতে পারি, আপনাদের চাইতে আমার আবহাওয়া ভাল।
———
* জীবন সম্পর্কে আমার কোন অনুতাপ নেই–অনুবাদক।