দূর কোন পরবাসে তুমি চলে যাইবারে বন্ধুরে
কবে আইবারে…
আমার জীবনের একটি প্রধান অধ্যায় অতিবাহিত করেছি আমি লিবিয়ায়। আফ্রিকা মহাদেশের অন্যতম বৃহৎ তেলসমৃদ্ধ এক ইসলামিক রাষ্ট্র লিবিয়া। অবিসংবাদিত জননেতা মোয়ামের আল গাদ্দাফী ছিলেন সরকার প্রধান তখন।
মাত্র তিন বছর ছিল আমার ওই অধ্যায়ের স্থায়িত্ব। কিন্তু অনেক কিছুই দেখা-শোনা হয়েছে, উপলদ্ধি হয়েছে জীবন সম্বন্ধে।
সেই লিবিয়া তো আজ আর নেই, কিন্তু আমার মনটা আজও আপ্লুত হয় সেই লিবিয়ার স্মরণে। অনেক লেখা লিখেছি আমি লিবিয়ার জীবনের ঘটনা প্রবাহ নিয়ে।
এসো নীপবনে চারখণ্ড বই-এ সেসব মলাটবদ্ধ হয়েছে ইতোমধ্যে।
লিবিয়া যাবার প্রধান উদ্দেশ্য অবশ্য চাকরি, এবং সেই সূত্রে কিছু ডলার উপার্জন করে আপাত টানাপোড়েনের সংসারে স্বাচ্ছন্দ আনয়ন। মন আমার কখনো দেশ ছেড়ে যেতে চায়নি। কিন্তু যেতে বাধ্য হই আর্থিক অনটনে।
শানে নজুলটা তাহলে কিঞ্চিৎ বয়ান করা যাক। উনিশ’ আটাত্তর সাল। আমি দেশে চাকরি ছাড়াও রেডিও, টেলিভিশন, মঞ্চ এবং চলচ্চিত্রে মহা ব্যস্ত। সিনেমাতে ব্যাগার খাটতাম, মঞ্চে তো পকেটের পয়সা খরচ করতে হতো। রেডিওর চেক দেখলে লজ্জা পাওয়া ছাড়া উপায় ছিলনা। (আজও তাই)।
একমাত্র ভালো কিছু পেতাম টিভিতে কাজ করে। মাসে একটি দুটি নাটক নিয়মিত করতে সুযোগ পেতাম বিধায় সরকারি অফিসের কম বেতনের নির্বাহী প্রকৌশলীর জীবন যাপন সম্ভব হতো কোনোক্রমে।
চাকরিতে প্রবেশ করার সময় থেকে সংসারের সদস্য সংখ্যা ছিল বেশ। এদিকে ক্যান্সার আক্রান্ত বাবা, মা, দুই অবিবাহিত বোন, এবং এক ভাগ্নী ও দুই ভাগ্নে।
আব্বা চলে গেলেন ১৯৬৯ সেপ্টেম্বরে। ৭০এর জানুয়ারি মেজো দুলাভাইয়ের মৃত্যুর পর পারিবারিক সিদ্ধান্তেই ঝটপট বিয়েটা করতে হলো দুলাভাইয়ের বোনকে। যদিও আমাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক ছিল। তবু বিয়েটা করতে হয়েছিল তড়িঘড়ি করে। আব্বার ক্যান্সারের চিকিৎসায় তাঁর পেনশনের টাকার সাথে ধারদেনাও করতে হলো বেশ কিছু। ভাগ্নে ভাগ্নিরা তাদের পরিবারে চলে গেল একসময়। বিপাশা-নাতাশা এল। ছোট দুই বোনের বিয়ে দিলাম-তেমন কিছুই করতে পারিনি তাদের জন্য। সে কথা আজও মনের মধ্যে খচখচ করে। ৭৪ এ আম্মা প্রয়াত হলেন লিভার সিরোসিসে।
টানা পোড়েন আগে থেকেই লেগে থাকতো সংসারে। পাশ ফেরার আয়েশ তো দূরের কথা। চিৎ হয়ে শুয়েও দু:শ্চিন্তায় ঘুম নষ্ট হতো।
দেশে এই সময়টায় বিদেশ যাবার এক হিড়িক চলছিল। বিভিন্ন পেশার লোকজন মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছে চাকরি নিয়ে। বেশ জোয়ার চলছিল প্রবাস গমনের। আমার এসব দিকে খেয়াল ছিল না কখনো।
কারণ দেশ ছেড়ে যাওয়া, আমি ভাবতেও পারি নি। এখনও বাইরে গেলে দুদিন পরই বাড়ি ফেরার জন্য ছটফট করে ওঠে মনটা।
.
এক রাতে সংসারের টানাপোড়েনের আলাপকালে শিরীই হঠাৎ বলে উঠলো-তুমি বিদেশ যেতে পার না?
বিদেশ? কেন?
চাকরি করতে, কত লোক যাচ্ছে।
বিষয়টি যদিও আমার মনোঃপূত না, না বললাম না সরাসরি। শুধু বলেছিলাম-
দেখি।
অফিসেও খেয়াল করলাম বন্ধু-বান্ধব প্রকৌশলীরা অফিস থেকে বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে NOC নিচ্ছে। আমিও সেই ফাঁকে একটা দরখাস্ত করে বসলাম মাননীয় চেয়ারম্যানের বরাবরে।
তখন আমাদের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী বজলুর রহমান। অত্যন্ত সরল সাদাসিধে একজন ভালো মানুষ। হ্যাংলা পাতলা মানুষটা পাবলিক হেলথ থেকে এসেছিলেন প্রেষনে। ধুমপান করতেন খুব। তাও আবার Star Brand.
ডাক পেলাম তাঁর কাছ থেকে। ভয়ে ভয়ে রুমে ঢুকে মাথা চুলকে দাঁড়ালাম সামনে। বিদেশ যেতে চাও?
জি স্যার।
কেন, এখানে ভালো লাগে না?
ভালো লাগে স্যার, কিন্তু সংসার তো চলে না।
হুঁ। নাটক বাদ দিবে?
উত্তর দিই নি।
সবাই চলে গেলে ওয়াসা চলবে কী করে?
নিরুত্তর আমি। জানি অনেক প্রকৌশলীই NOC চেয়েছে, এবং পেয়েছেও।
যাও। এখানে থেকেই বা কী হবে!
ঘস ঘস করে সই দিলেন দরখাস্তে। হেসে বললেন নাটকটা ছেড়ো না। খুব ভালো লাগে তোমার অভিনয়।
স্যারের আর্শীবাদ নিয়ে বেরিয়ে এলাম তাঁর চেম্বার থেকে।
কদিন পর অফিসিয়াল NOC পেলাম। এরপর আর খেয়াল নেই আমার বিষয়টাতে। শিরীই একদিন মনে করালো-
কী হলো, বিদেশ যাবে না?
হ্যাঁ হ্যাঁ চেষ্টা করছি।
আমার মন তখনও বলছে-যাব না। মিডিয়ার তুঙ্গ-অবস্থান ছেড়ে যাই কী করে। তারপরও ঠিক আছে—দরখাস্তটা তো করি তারপর দেখা যাবে। তাছাড়া চাকরি যে হবেই তারও তো কোনো গ্যারান্টি নেই।
একদিন ম্যানপাওয়ার অফিসে হাজির হলাম কাকরাইলে। তখন ছিল না কোনো বেসরকারী ম্যানপাওয়ার প্রতিষ্ঠান। দেখি পরিচিত এক ব্যক্তি (আমার খুব বড় ভক্ত) চৌধুরী সাহেব সেখানকার একজন পরিচালক।
কাজের কথা পাড়তেই, ভদ্রলোক যেন হুঙ্কার দিলেন-
নো। আপনাকে দেশ ছেড়ে যেতে দেব না। তাহলে নাটক দেখবো কার?
প্রশংসায় আপ্লুত হলেও হেসে বললাম-
বড়ই প্রয়োজন। এভাবে জীবন চলে না। তারপর সুযোগ যখন রয়েছে!
শেষপর্যন্ত তাঁকে রাজী করানো গেল। পেটভরে চা নাস্তা খাইয়ে বললেন-লিবিয়া যাবেন? একটা টিম আসছে next উইকে।
বেশ তাই সই।
বেশ জোর দিয়ে বললাম।
আপনি তো স্যানিটারি ইঞ্জিনিয়ার, ইরিগেশনের কাজ পারবেন না।
কেন পারবো না। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংই তো।
ওকে ডান।
ডান মানে?
আগামী সপ্তাহের মধ্যে Interview Letter পেয়ে যাবেন।
ঠিকই সপ্তাহান্তে চলে এল ইন্টারভিউ কার্ড। লিবিয়ার জেনারেল কোম্পানি ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট। যদিও কোম্পানি। তবে সরকারি। মন্দের ভালো। ইন্টারভিউ হলো যথাসময়ে। দুদিনপর দেখি ম্যানপাওয়ারের বোর্ডে নাম ঝুলছে আমার। ছয়জন প্রকৌশলী আর সাতজন সার্ভেয়ার মনোনীত হলো। সপ্তাহের মধ্যে পাসপোর্ট ভিসা, টিকেট সব হাজির, এবার যাবার পালা।
এই যে NOC নেয়া থেকে পাসপোর্ট ভিসা চূড়ান্ত হওয়া পর্যন্ত সময়ে ওয়াসাতে এসেছে পরিবর্তন। চেয়ারম্যান বজলুর রহমান স্যার অবসরে চলে গেলে চেয়ারম্যান হয়ে আসেন মেজর (অব:) রফিক সাহেব। প্রবীনের হাত থেকে প্রতিষ্ঠান চলে গেল নবীনের হাতে। ওয়াসার কাজকর্মের মধ্যে বেশ গতির সঞ্চার হলো, বিস্তার লাভ করলো প্রতিষ্ঠান। এক দল ব্যক্তির প্রমোশন হলো কিছু সময়ের মধ্যে। তারমধ্যে আমিও এক জন। আমাকে দায়িত্ব দেয়া হলো সিউয়ার প্রজেক্ট ডিভিশন দুই এর। আগে সামান্য আলাপ প্রয়োজন মেজর (অব:) রফিক সম্পর্কে। উনি যখন চেয়ারম্যান হয়ে এলেন-আমি তখন অতি ক্ষুদ্ৰ কর্মকর্তা-সহকারী প্রকৌশলী। বয়সের খুব একটা হেরফের নেই দু’জনের। নানান আলোচনা চলছিল তাঁকে নিয়ে ওয়াসার মানুষজনের মধ্যে। এরমধ্যেই ডাক পড়লো একদিন আমার।
একটু চিন্তিত হয়েই গিয়ে হাজির হলাম চেয়ারম্যানের রুমে।
বসেন।
জড়োসড়ো হয়ে বসলাম।
বজলুর রহমান স্যার যেমন আমাদের অত্যন্ত আপন ছিলেন—ইনি তো নিশ্চয় তেমন নন-এটা ধারণা ছিল আমার।
হাতের কাজ সেরে টেবিলের একপাশ থেকে একটা ডাইরী বের করে কিছু নোট করে-আমার দিকে ফিরলেন।
হায়াত সাহেব।
জী স্যার।
আপনার সম্পর্কে আমি অনেক শুনেছি, নাটক দেখেছি আপনার। আর্মিতে আমার বন্ধু আছেন তাদের কেউ কেউ আপনারও বন্ধু। আপনি একজন সৎ এবং নিষ্ঠাবান অফিসার। আমি খবর নিয়েছি।
নিজের প্রশংসা শুনে বেশ ভালোই লাগছিল।
কত বছর কাজ করছেন ওয়াসায়?
তা প্রায় আট ন’বছর স্যার।
প্রমোশন হলো না?
সুযোগ নেই স্যার।
ও! একটা কাজ করতে পারবেন?
বলেন স্যার!
শুনেছি এখানে মানে ওয়াসায় একটা বেশ দুর্নীতির ঘাঁটি আছে।
ঠিক বুঝতে পারছিলাম না উনি কী বলতে চাইছেন। চুপ করে থাকাটাই উত্তম মনে হলো। কিছু বলছেন না যে!
কী বলবো স্যার!
আমতা আমতা করছি তখন আমি।
আমি চাই আপনি আমাকে দুর্নীতিবাজ অফিসারদের একটা লিস্ট দেবেন। গোপনে। আমি এটা কখনোই প্রকাশ করবো না।
আমি চুপ।
রফিক স্যার আমাকে দেখছেন।
অনেকক্ষণ পর আমি মুখ খুললাম অভয়ে।
স্যার, এটা কি ঠিক হবে? যাঁদের কথা আমাকে বলতে হবে তাঁরা তো আমার কাছের মানুষ সবাই। আমার জন্য খুব বিব্রতকর এবং হয়তো কখনো জানাজানি হলে শত্রুতারও সৃষ্টি হবে।
হাসলেন মেজর সাহেব।
ঠিক আছে। আপনাকে আমি একটু অতিরিক্ত দায়িত্ব দিতে চাই। Officially. অসুবিধা নেই তো?
না, না স্যার।
আমি তখনও সুয়ারেজ ডিভিশন-১ এর সহকারী প্রকৌশলী। পরদিন কি দুদিন পর অফিস অর্ডার জারি হলো আমাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে Land and Procurement ডিভিশনেরও সহকারী প্রকৌশলী করা হলো।
চেয়ারম্যানের এ সিদ্ধান্তও অনেকের মনে নানান প্রশ্নের উদ্রেক করলো কিন্তু চুপচাপ সবাই। ওই বিভাগের কর্তাব্যক্তিটি বেশ নাখোশ হয়েছিলেন এ সিদ্ধান্তে তাতে সন্দেহ নেই কিছু।
এ রকম একটি সময়ে চেয়ারম্যান সাহেব একদিন নির্দেশ দিলেন কারোয়ান বাজারে গিয়ে ডিআইটি (রাজুক)র কাছ থেকে ওয়াসার জন্য জমিটা বুঝে নিতে
আমার এখনও মনে আছে। বেশ বিরানভূমি কারোয়ান বাজার তখন। একটি খালি প্লট আমাদের জন্য বরাদ্দ। খুব সম্ভবত একটি আম গাছের তলায় বসে ডিআইটির কাছ থেকে ওয়াসার জমি বুঝে নিয়েছিলাম আমি।
এর কদিন পর আবার আমার অবস্থান পরিবর্তন হলো। চেয়ারম্যান বুঝতে পেরেছিলেন ওখানে আমার অস্বস্তির বিষয়টি। সত্যি আমি ছিলাম খুবই বিব্রত।
এবার আমাকে নির্বাহী প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) করা হলো। ওয়াটার প্রজেক্ট বিভাগে। আমার এত বছরের বিভাগ ছেড়ে গেলাম আমি। নতুন দায়িত্ব নিতে বিদায় অনুষ্ঠানে সহকর্মীদের নিয়ে বেশ কান্নাকাটি হয়েছিল মনে পড়ছে।
এর কিছুদিন পরই পদোন্নতি হলো। পুরোপুরি নির্বাহী প্রকৌশলী হলাম। সুয়ার প্রজেক্ট ডিভিশন-২ এর। সেটা ১৯৭৭ সনের সেপ্টেম্বরের দিকে বোধ করি।
এই প্রমোশনের ক’দিন আগেই ১৩ সেপ্টেম্বর জন্ম নিয়েছিল আমার কনিষ্ঠ কন্যা নাতাশা। তখন থেকেই আমি মানি ১৩ সংখ্যা আমার জন্য লাকি। ভাগ্যবহনকারী সংখ্যা। প্রসঙ্গে ফিরি।
আমার লিবিয়ার চাকরির চুক্তিপত্র ইত্যাদিসহ এক বছরের লিয়েনের জন্য দরখাস্ত উপস্থাপন করলাম অফিসে যা এক সময় চেয়ারম্যান মহোদোহয় অর্থাৎ মেজর (অব: ) রফিকের টেবিলে হাজির হলো।
ডাক পড়লো স্বাভাবিক নিয়মে।
সত্যি যেতে চান?
জি স্যার।
কেন যাবেন, আপনার Extracurricular activities ছেড়ে?
সংসার চালানো কঠিন হয়ে গেছে স্যার। ঘুরে আসি কিছুদিন।
যান দেখেন, যতদিন পারেন থেকে আসেন। এখনই বয়স এবং সুযোগ ও প্রচুর। ঘস ঘস করে সই করে দিয়ে খোঁজ খবর নিলেন আমার অফিসের কাজ কর্মের। দরখাস্ত চলে গেল আব্দুল গনি রোডে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে।
সেকশন অফিসার থেকে শুরু করে সেক্রেটারি পর্যন্ত সবার কাছে আমার নামটা পরিচিত। কেউ কেউ ফোন করে জানতে চেয়েছেন কেন যাচ্ছি জনপ্রিয় অবস্থান ছেড়ে-তারপরও ফাইল চলে যায় সচিব সাহেবের দপ্তরে। সেকশন অফিসারের কাছ থেকে জানতে পারি খরবটা।
মনটা খারাপ হয়ে গেল খবরটা পেয়ে। কারণ আমার কখনই ইচ্ছা ছিল না আমি দেশ ছেড়ে যাবো। শুধু স্ত্রীর মন রক্ষায় এই এতদূর পর্যন্ত গেছি আমি। ভাবতে বসলাম কী করবো যদি অনুমোদনটা পেয়েই যাই।
না যাবো না। এটাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আমার। শিরী হয়তো একটু কষ্ট পাবে, তারপরও সে কখনো আমাকে আমার কোনো সিদ্ধান্তের জন্য নেগেটিভ প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। আজ অবধি নয়। স্ত্রী বলে নয়, আসলে সে একজন দারুণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। আমার আজকের এই অবস্থান (যেটুকুই যাই হোক) তার একশ শতাংশই তার কারণে। এটা আমি স্বীকার করি দ্বিধাহীন ভাবে।
আবার ভাবতে বসলাম যাদের সাথে চুক্তি সই করলাম—যারা চিঠি পাঠালো, ভিসা দিলো সেই লিবিয়ান কোম্পানিকে কী বলবো।
.
আর আমার ম্যানপাওয়ার অফিসের চৌধুরী সাহেবকেই বা কি জবাব দেব? শুধু শুধু একজনের স্থান নষ্ট করলাম বিদেশ যাওয়ার।
তারপরও মনস্থির করে ফেললাম—অনুমোদনটা পকেটে পূরে দুঃখিত বলে একটি চিঠি দেব ম্যান পাওয়ারকে। জানিয়ে দেবো মন্ত্রণালয়কেও।
কিন্তু ঘটনা ঘটে গেল তার আগেই। মন্ত্রণালয়ের সেকশন অফিসার সাহেব আমাকে জানালেন—আমার বিরুদ্ধে সচিব বরাবর কেউ বেনামী চিঠি দিয়েছে যাতে বলা হয়েছে আমি ঠিকাদারদের অতিরিক্ত বিল পরিশোধ করে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছি। সেই কারণে সচিব সাহেব আমার ফাইল নো করে ফেরৎ পাঠিয়েছেন।
এই খবর পেয়ে আমার মেজাজ হয়ে গেল তিরিক্ষি। এত বড় মিথ্যা অপবাদ আমি তো মেনে নিতে পারি না। ছুটলাম মন্ত্রণালয়ে-অতিরিক্ত সচিব, সজ্জন মানুষ, আমাকে জানালেন তিনি অনেক চেষ্টা করেছেন সচিবকে বোঝাতে যে বেনামী চিঠির কোনো দাপ্তরিক মূল্য নেই, এবং স্বয়ং চেয়ারম্যান যেখানে সুপারিশ করেছে সেখানে তো কথাই নেই। কিন্তু না, সচিব সাহেব ফাইলে লিখে দিয়েছেন A man without integrity can not be allowed to go in lien.
চিঠি এল ওয়াসায়। আমার মন খুব খারাপ কিন্ত একটা জেদ চেপে গেল এই ‘না কে ‘হ্যাঁ’ করাতে হবে, নইলে আমি তো অন্যায়ভাবে পরাজিত হলাম।
চেয়ারম্যান সাহেব ডেকে পাঠালেন আমাকে।
চিঠি দেখেছেন সচিবালয়ের?
জী স্যার।
আপনি ভাববেন না। সেক্রেটারি তো আপনাকে আমার চেয়ে ভালো জানেন না। আপনি তৈরি হোন যাওয়ার জন্য। ব্যবস্থা আমি করছি।
দু-তিন দিনের মধ্যে ডি.ও লেটার চলে গেল চেয়ারম্যানের কাছ থেকে সেক্রেটারি বরাবর। চিঠির বক্তব্যে আমার যত রকম গুনাগুণ সম্ভব বর্ণনা দেওয়া হয়েছিল এবং ব্যক্তিগত ফোনালাপও ছিল বলে শুনেছি চেয়ারম্যানের P.S -এর কাছ থেকে।
অবশেষে অনুমোদন এল আমার লিয়েনের। কার্য-চুক্তিপত্র, বিমান টিকেট, পাসপোর্ট, ভিসা, লিয়েনপত্র সবই যখন আমার হাতে। তখনই বেঁকে বসলাম আমি।
আমি যাবো না।
আবার আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব বোঝালেন নানান যুক্তি দিয়ে-যে অবশ্যই আমার যাওয়া উচিৎ। সব চেয়ে বড় যুক্তি ছিল-এরকম সুযোগ কয়জনের ভাগ্যে জোটে।
শিরী বললো-এত ঝুটঝামেলা করে অনুমোদন পেলে যখন যাও না। গিয়ে দেখ, কেমন লাগে। ভালো না লাগলে চলে এসো।
ওই সময়টা আমার সংসারের কোনো পিছুটান ছিল না। আম্মা সিরোসিসের কারণে ইন্তেকাল করেছেন চুয়াত্তরে। ছোট বোনটির বিয়েও দিয়েছি আমরা। বিপাশা ক্লাস থ্রিতে পড়ছে, আর নাতাশার বয়স মাত্র এক বছর।
নানান চিন্তা ভাবনা করে শিরী বলেছিল-গিয়ে দেখ না।
গেলাম শেষ পর্যন্ত।
হাতে টাকাপয়সার টানাটানি। ধার করলাম স্যুট বানাবার জন্য। একটা ভালো স্যুটকেসও কেনা হলো।
বাড়িঘরের দায়দায়িত্ব শিরীর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে এক সুন্দর সকালে চোখের পানি মুছতে মুছতে উড়াল দিলাম ত্রিপোলীর উদ্দেশ্যে।
১৯৭৮ সালের ৩০ শে নভেম্বর বাংলাদেশ বিমানের একটি চার্টার্ড প্লেনে ছিল আমাদের যাত্রা। ছয় জন প্রকৌশলী ৪ জন সার্ভেয়ার সহ প্রায় দু’শো জন শ্রমিক।
তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে ওই আমার শেষ বিমান যাত্রা। লোকে লোকারণ্য বিমান বন্দর। বেশিরভাগই এসেছে আপনজনদের বিদায় জানতে-তারই মধ্যে আমি হয়ে গেলাম সবার মধ্যমনি।
সিভিল এভিয়েশন এবং বিমানের প্রায় প্রতিটি কর্মকর্তা কর্মচারি আমাকে ঘিরে ধরলেন-যেতে নাহি দিব বলে-।
এরপর তো কান্না থামে না আমার। ভক্তদের হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে বিমানে আরোহন করলাম।
বিমান ছাড়লো সকাল আটটায়। দুবাইয়ে ঘন্টা খানেক কিংবা দুয়েক থেমে ত্রিপোলী বিমান বন্দরে পৌঁছুলাম রাত দশটায় (বাংলাদেশ সময়)। তখন ত্রিপোলীতে সন্ধে হয় হয়-অবাক হয়ে চেয়ে দেখি ভূমধ্যসাগরের তীরে, মরুভূমির অস্তিত্ব পাইনে। কেবল গাছ আর গাছ, জয়তুন গাছের সারি, লাল মাটিতে সবুজের সমারোহ। কনে দেখা আলোয় প্রথম দেখা লিবিয়াকে ভালো লেগে গেল।
এলেম নতুন দেশে।
নতুন কোনো দেশে যাওয়া ওই আমার প্রথম। যথেষ্ট উত্তেজনা নিয়েই পৌছুলাম ত্রিপোলী বিমানবন্দরে। চিরকাল ঘরকুনো মানুষ মনের দুর্বলতা নিয়েই গিয়েছিলাম-এতজন বাঙালির সাথে—তাই ভয় কিছুটা কমেছিল। তারপরও ভাষার যে ভিন্নতা সেটাই মনটাকে নড়বড়ে করে দেয়। হাতে নিয়ে গিয়েছিলাম আরবিতে কথা বলার বই। তার সাহায্য নিতে গিয়ে বুঝলাম-এ একেবারে বেকার। ওরা সম্পূর্ণ আঞ্চলিক আরবিতে কথা বলে, আর বইগুলো সব ক্লাসিক আরবিতে লেখা।
নতুন পরিচ্ছেদে কিছু বলবো এবার লিবিয়ায় বসবাস নিয়ে।