১৩. সায়েন্স অলিম্পিয়াড
কলেজের মেয়েটি একটু অবাক হয়ে রাশার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “তুমি এখানে কী করছ?”
“আমি সায়েন্স অলিম্পিয়াডে এসেছি।”
“সায়েন্স অলিম্পিয়াডে?” কলেজের মেয়েটি অবাক হয়ে তার বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে বলল, “বাচ্চাদেরও একটা অলিম্পিয়াড হচ্ছে নাকি?”
“জানি না তো। একটাই তো অলিম্পিয়াড।”
কলেজের মেয়েটি রাশাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কীসে পড়?”
“ক্লাস এইটে?”
“ক্লাস এইটে পড়লে তুমি অলিম্পয়াডে কেমন করে চান্স পেলে? অলিম্পিয়াডের সব প্রশ্ন তো ইন্টারমিডিয়েট লেভেলের!”
ঝকঝকে চেহারার একটা মেয়ে হি হি করে হেসে বলল, “বুঝিস না? বাড়িতে একজন ইন্টারমিডিয়েট ইউনিভার্সিটির থাকলেই তো হয়! অঙ্ক করে দেবে–পাঠিয়ে দেবে!”
“কিন্তু তাহলে এখানে এসে ধরা খাবে না?”
ঝকঝকে চেহারার মেয়েটা বলল, “ধরা মনে করলেই ধরা! একটু দুই নম্বরি করে মাগনা ঢাকা থেকে বেড়িয়ে যেতে পারলে ক্ষতি কী?”
রাশার কানটা একটু লাল হয়ে উঠল, কিন্তু সে কিছু বলল না। ঝকঝকে চেহারার মেয়েটা রাশার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপু, তুমি কাজটা কিন্তু ঠিক করলে না!”
রাশা মাথা নাড়ল, বলল, “এখন মনে হচ্ছে হয়তো ঠিক করলাম না।”
“বড় মানুষদের দিয়ে অঙ্কগুলো করিয়ে”
“উঁহু। আমি সেটার কথা বলছি না।”
“তাহলে কোনটার কথা বলছ?”
“এখানে আসার কথাটা বলছি। মনে হচ্ছে এখানে এসে ঠিক করলাম, যদি কোনোভাবে আপনারা জানতে পারেন যে অঙ্কগুলো আমি নিজেই করেছি তাহলে না জেনে আমাকে এই খারাপ কথাগুলো বলছেন সেটা চিন্তা করে আপনাদের খারাপ লাগবে না?”
কলেজের মেয়েগুলো হঠাৎ করে চুপ করে গেল।
.
রাশাকে হেডমাস্টার নিজেই নিয়ে এসেছেন। মেয়েদের এই হোস্টেলে তুলে দিয়ে তিনি উধাও হয়ে গেছেন। কাল অলিম্পিয়াডে থাকতেও পারেন নাও থাকতে পারেন। পরশু দিন পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের পর রাশাকে নিয়ে ফিরে যাবেন। রাশাকে বলেছেন ঢাকায় তার নানা কাজকর্ম আছে, সেগুলো করতে করতেই সময় চলে যাবে। রাশা আপত্তি করেনি, তার রাতে ঘুমানোর জায়গা আছে, খাওয়ার জায়গা আছে। তাকে এখান থেকে বাসে করে নিয়ে যাবে আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাবে কাজেই দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
রাতে মেয়েদের হোস্টেলে ঘুমানোর আগে আগে সে আবিষ্কার করল হোস্টেলের আলোগুলো অসম্ভব তীব্র, রীতিমতো চোখে লাগে। গ্রামে রাতের বেলা কুপি বাতি না হয় হ্যারিকেনের আলোতে থাকতে থাকতে তার চোখ এখন ইলেকট্রিক বাল্বের প্রখর আলো সহ্য করতে পারছে না। কী আশ্চর্য!
রাশা খুব ভোরবেলা প্রস্তুত হয়ে নিল, ঢাকার বাইরে থেকে যারা এসেছে তাদের বেশির ভাগই আত্মীয়স্বজনের বাসায় উঠেছে। তাই হোস্টেলের মেয়ে খুব বেশি নেই। সাত সকালে সে গোসল করেছে, কাপড় পরেছে, ক্যান্টিনে নাস্তা করেছে তারপর নিচে এসে বসে আছে। তার ভেতরে একটা ভয়, যদি তাকে এখানে ফেলে রেখে বাস চলে যায় তখন কী হবে?
ঠিক নয়টার সময় বাস এলো, তাকে ফেলে রেখে যেতে পারল না, সে সবার আগে বাসে গিয়ে উঠে বসল। বাসটা তাদের সায়েন্স অলিম্পিয়াড ভেনুতে নিয়ে গেল, বিশাল একটা মাঠ, সেখানে বিশাল একটা প্যান্ডেল। প্যান্ডেলের এক পাশে বড় স্টেজ, পিছনে চকচকে ডিজিটাল ব্যানার। একপাশে রেজিস্ট্রেশনের জায়গা সেখানে ছেলেমেয়েরা লাইন ধরে রেজিস্ট্রেশন করছে। সবাই কলেজের বড় বড় ছেলেমেয়ে। তার বয়সী ছেলেমেয়ে খুব কম। রাশাও লাইনে দাঁড়িয়ে রেজিস্ট্রেশন করে নিল, সেখান থেকে গলায় ঝুলিয়ে নেয়ার জন্যে তার নাম লেখা একটা কার্ড দেয়া হলো, সাথে সায়েন্স অলিম্পিয়াডের নিয়ম-কানুন লেখা কিছু কাগজপত্র আর হাতখরচ আর ভাড়ার টাকা। একপাশে ফ্রি নুডল খাওয়াচ্ছে সেখানে ছেলেমেয়েদের খুব ভিড়।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হতে এখনো প্রায় আধঘণ্টা বাকি, রাশা মোটামুটি উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখন হঠাৎ করে সে জাহানারা ম্যাডামকে দেখতে পেল। রাশা ছুটে ম্যাডামের কাছে গিয়ে প্রায় চিৎকার করে বলল, “ম্যাডাম! ম্যাডাম!”
জাহানারা ম্যাডাম ঘুরে তাকালেন, রাশাকে দেখে তার এক মুহূর্ত সময় লাগল চিনতে, প্রথমে তার চোখে বিস্ময়, তারপর সেখানে আনন্দের ছাপ পড়ল! রাশাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “রাশা! তুমি? এই অলিম্পিয়াডে?”
“জি ম্যাডাম!”
“তুমি না মাত্র ক্লাশ এইটে পড়। এটা তো কলেজের কম্পিটিশন!”
“মনে নাই আপনি আমাকে কতগুলো বই পাঠিয়েছেন বসে বসে সেগুলো পড়েছি তো”।
জাহানারা ম্যাডামের মুখে বিশাল একটা হাসি ফুটে উঠল, “তুমি সেগুলো পড়েছ?”
“পুরোটা শেষ হয় নাই।”
“এখনই শেষ হবে কেমন করে? তোমার বয়সে শুরু করাই তো কঠিন!”
“সবকিছু বুঝি না, মাঝে মাঝে ডি ওয়াই ভাগ ডি এক্স লেখে–”
“ক্যালকুলাস। ওটাকে ক্যালকুলাস বলে।”
“ওটা জানি না তো তাই একটু ঝামেলা হয়।”
“আর ঝামেলা হবে না, আমি তোমাকে ফ্যান্টাস্টিক একটা ক্যালকুলাস বই কিনে দেব।” জাহানারা ম্যাডাম রাশার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “আমি কখনো চিন্তা করিনি তুমি সত্যি সত্যি সিরিয়াসলি ওই বইগুলো পড়বে
“আসলে বর্ষাকালে যা বৃষ্টি আপনি চিন্তা করতে পারবেন না। চারিদিকে পানি, ঘর থেকে বের হওয়া যায় না! তখন ঘরে বসে বসে পড়েছি। কুপি বাতি জ্বালিয়ে-”
“ইলেকট্রিসিটি নাই?”
“কিছু নাই।”
“কিন্তু রাশা তোমাকে দেখে কিন্তু খুব ফ্রেস লাগছে, গায়ের রংটা একটু পোড়া পোড়া। কিন্তু খুব ফ্রেশ লাগছে। তেজি তেজি ভাব!”
রাশা মাথা নাড়ল, বলল, “জি ম্যাডাম, তেজি না হলে পারতামই না। বর্ষার সময় নৌকা করে স্কুলে যাই। নিজেরাই নৌকা বেয়ে যাই!”
জাহানারা ম্যাডাম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন, “তুমি নৌকা বাইতে পারো?”
“আরো অনেক কিছু পারি ম্যাডাম!”
“কী কী পারো?”
“সাঁতার দিতে পারি। গাছে উঠতে পারি। একটু একটু রান্না করতে পারি। স্যারদের মার খেতে পারি। ঝগড়া করতে পারি–”
জাহানারা মমি হাসতে হাসতে বললেন, “তোমার স্কুলটা কেমন?”
রাশা গলা নামিয়ে বলল, “খুব খারাপ। লেখাপড়া হয় না। স্যার ম্যাডামরা কিছু জানেন না, পড়াতেও পারেন না–সব নিজেরা নিজেরা পড়তে হয়।
“সেটা একদিক দিয়ে ভালো, নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস বাড়বে।”
রাশা এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, “আমাদের ক্লাসের কেউ আসে নাই?”
“না। কলেজ সেকশনের কয়েকজন এসেছে।”
“তাদেরকে তো আমি চিনব না।”
“না চিনবে না।”
জাহানারা ম্যাডাম রাশাকে প্রায় ধরে রেখে তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন, একসময় ইতস্তত করে বললেন, “তোমাকে কি তোমার আম্মুর কথা জিজ্ঞেস করব রাশা?”
রাশা জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “জিজ্ঞেস না করলেই ভালো ম্যাডাম।”
“ঠিক আছে তাহলে জিজ্ঞেস করব না।”
“আম্মু অস্ট্রেলিয়া থেকে মাঝে মাঝে ভিউকার্ড পাঠান।”
“ও।” জাহানারা ম্যাডাম একটু থেমে বললেন, “আর তোমার নানি?”
“নানি খুব ভালো আছেন। আমার নানি খুব সুইট।”
“গুড! সবার জীবনে এক-দুইজন সুইট মানুষ থাকতে হয়।” রাশা একটু হেসে বলল, “আমার বন্ধুরাও সুইট।”
“চমৎকার! দ্যাটস ওয়ান্ডারফুল-” জাহানারা ম্যাডাম আরো কিছু বলতে চাইছিলেন কিন্তু ঠিক তখন মাইকে ঘোষণা করে সবাইকে তাদের জায়গায় বসতে বলা হলো, এক্ষুণি উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হবে। জাহানারা ম্যাডাম তখন রাশাকে নিয়ে প্যান্ডেলের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন।
রাশা ভেবেছিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে লম্বা, একজনের পর একজন বক্তৃতা দিতে থাকবে, সে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু সেরকম কিছুই হলো না, কয়েকজন ছেলেমেয়ে মিলে আমার সোনার বাংলা গান গাইল, তারপর কয়েকজন একটা খোলা জায়গায় এসে দাঁড়ায়, একটা ব্যানারের ওপর অনেকগুলো গ্যাস বেলুন বেঁধে রাখা হয়েছে, সেটা ছেড়ে দেয়া হলো, একটা ঝাঁকড়া আমগাছের গা ঘেঁষে সেটা আকাশে উড়ে গেল, সবাই তখন জোরে জোরে হাততালি দিতে থাকে।
মাইকে তখন সবাইকে নিজেদের রুমে যেতে বলা হলো, কত রেজিস্ট্রেশন নম্বর কোথায় বসবে সেটা মাইকে বলে দিতে লাগল, কিন্তু কেউ সেটা শুনল না, সবাই নিজের মতো করে নিজেদের রুম খুঁজে বের করতে শুরু করে দিল।
রাশাও নিজের রুমটা খুঁজে বের করল, তার সিট পড়েছে দোতলায় বেঞ্চের এক কোনায়, ঠিক জানালার পাশে। দেখেই তার মনটা ভালো হয়ে যায়। জানালা দিয়ে নিচে একটা গলির মতো জায়গা দেখা যাচ্ছে, দুইপাশে ছোট ছোট টিনের ঘর। গলিতে একটা কমবয়সী মা ছোট একটা বাচ্চাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাশা গভীর মনোযোগ দিয়ে কমবয়সী মার্টিকে লক্ষ করে, একজন মানুষ যখন জানে না তখন তাকে এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করা মনে হয় অনুচিত কাজ। কিন্তু রাশা সেই অনুচিত কাজটি গভীর মনোযোগ দিয়ে করতে থাকল।
একসময় কিছু মানুষ এসে তাদের কিছু সাধারণ কথাবার্তা বলল, তারপর কী করা যাবে আর কী করা যাবে না সেই বিষয়ে কিছু উপদেশ দিল। তখন টং করে কোথায় জানি একটা ঘণ্টা পড়ল সাথে সাথে তাদের প্রশ্ন আর খাতা দিয়ে দেয়া হলো।
রাশা প্রশ্নটা মন দিয়ে পড়ে অবাক হয়ে গেল, ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য, কিন্তু তার কাছে মনে হতে থাকে সে সবকয়টি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে। রাশা সোজা হয়ে বসে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে শুরু করে।
যারা প্রশ্নগুলো করেছে তারা নিশ্চয়ই অসম্ভব বুদ্ধিমান, প্রশ্নগুলো এমনভাবে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে গেছে যে কেউ যদি সত্যি সত্যি বিষয়টা বুঝে না থাকে কোনোভাবেই তার উত্তর দিতে পারবে না। শেষের প্রশ্ন দুটো সবচেয়ে মজার, প্রশ্নের শুরুতে নতুন একটা জিনিস তাদের শেখানো হয়েছে তারপর যেটা শেখানো হয়েছে সেটা থেকে প্রশ্ন করা হয়েছে। সুপারনোভার বিস্ফোরণ কিভাবে হয় সে জানত না, এই প্রশ্ন পড়ে সেটা শিখেছে। শুধু যে শিখেছে তা নয়–সেটার একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। আরেকটা প্রশ্ন প্রোটিন নিয়ে, প্রথমে কেমন করে প্রোটিন তৈরি হয় সেটা বোঝানো হয়েছে, তারপর অ্যামিনো এসিড সম্পর্কে বলা আছে, সবশেষে কয়েকটা জিনের কোড, কোনটা প্রোটিন খুঁজে বের করতে হবে এমন মজার প্রশ্ন যে রাশা মুগ্ধ হয়ে গেল।
একসময় পরীক্ষা শেষের ঘণ্টা পড়ল, পরিদর্শকরা খাতা নিতে আসছে। রাশা লক্ষ করল সে খাতার উপরে তার নাম, রেজিস্ট্রেশন নম্বর লিখতে ভুলে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি করে তার নাম লিখল, রেজিস্ট্রেশন নম্বর লিখল, নিচে স্কুলের নাম লিখতে হবে। আহাদ আলী উচ্চ বিদ্যালয় লিখতে গিয়ে রাশা থেমে যায়, এই খাতাটাতে সে কেমন করে একটা রাজাকারের নাম লিখবে, যেই রাজাকার তার নানাকে মেরেছে! রাশা কিছুক্ষণ চিন্তা করে স্কুলের নামটা না লিখেই তার কলমটা বন্ধ করল, সে তার এই হাত দিয়ে তার খাতায় একটা রাজাকারের নাম লিখতে পারবে না। তাছাড়া স্কুলের নামটা নিশ্চয়ই এত গুরুত্বপূর্ণ না, রেজিস্ট্রেশন নম্বরটা থেকেই সব কিছু বের করে ফেলতে পারবে।
রাশা ক্লাসঘর থেকে বের হয়ে আসতে থাকে, তার ঠিক সামনে দিয়ে দুজন হেঁটে যাচ্ছে, তাদের কথা শুনতে পেল। একজন বলল, “প্রশ্নের কোনো মাথামুণ্ডু নাই!”
অন্যজন বলল, “মানুষগুলোর আক্কেল বলে কিছু নাই! প্রশ্নের মাঝে আমাদের জ্ঞান দেয়ার চেষ্টা করেছে। দেখেছিস?”
“আরে বাবা, কার এত সময় আছে বসে বসে পড়ার? কী জিজ্ঞেস করার আছে ঝটপট জিজ্ঞেস কর, উত্তর দিই।”
“এই রকম পাগলামির মাঝে আমি আর নাই। খালি খালি সময় নষ্ট।”
“তুই কয়টা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিস?”
“পাঁচটা। তিনটা হলেও হতে পারে–অন্যগুলো বুঝিই নাই। তুই?”
“আমি ছয়টা। আমারও এক অবস্থা–প্রথম তিনটা মনে হয় হবে। অন্যগুলো জানি না।”
রাশা শুনতে পেল, দুইজন তারপর সায়েন্স অলিম্পিয়াডের আয়োজকদের মুখ খারাপ করে গালাগাল করতে থাকে।
রাশা পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে আসা ছেলেমেয়েদের ভেতর একটু হাঁটাহাঁটি করে দেখল, কান পেতে শোনার চেষ্টা করল কে কী বলছে। রাশা বেশ অবাক হয়ে আবিষ্কার করল যে বেশিরভাগ ছেলেমেয়ের ধারণী প্রশ্নটা খুবই খারাপ হয়েছে, তাদের ভাষায় রীতিমতো “আউল ফাউল” প্রশ্ন।
মাঠের এক কোনায় সবাইকে লাঞ্চের প্যাকেট দিচ্ছে, রাশা লাইনে দাঁড়িয়ে লাঞ্চের প্যাকেটটা নিয়ে মাঠের এক কোনায় খেতে বসে। হঠাৎ করে তার একটু মন খারাপ হয়ে যায়। এখানে যারা এসেছে সবাই একজনের সাথে আরেকজন তা নাহলে কয়েকজন মিলে গল্প করছে। অনেকের বাবা-মা এসেছে, অনেকের স্যার-ম্যাডামরা এসেছেন, তারা মিলে গল্প করতে করতে খাচ্ছে। শুধু সে একা, মাঠের এক কোনায় বসে খাচ্ছে। একা একা খাওয়া কী মন খারাপ করা একটা ব্যাপার–এর মাঝেই মনে হয় একধরনের দুঃখী দুঃখী ভাব আছে। রাশা সেই দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে খেতে থাকে, তেল জবজবে খানিকটা বিরিয়ানি, একটা সেদ্ধ ডিম আর মোরগের শুকনো একটা রান, কী ভয়ঙ্কর খাবার!
বিকেলের দিকে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল, ভালো ভালো কয়েকজন শিল্পী গান গেয়ে শোনাল, একটা নাচের অনুষ্ঠান, সবার শেষে ছোট একটা নাটক। রাশা অনেক দিন পর এরকম একটা অনুষ্ঠান দেখছে, আগের স্কুলে তারা নিজেরাই কতবার এরকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে তার বুক থেকে একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। প্রায় সাথে সাথেই রাশা ভুরু কুঁচকে ভাবল, মন খারাপ হলে মানুষ দীর্ঘশ্বাস কেন ফেলে? দীর্ঘশ্বাস হচ্ছে ফুসফুঁসের ভেতর আটকে থাকা সব বাতাস জোর করে বের করে দেয়া শুধু মন খারাপ হলে এটা করে, অন্যসময় কেন করে না? রাশা ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে গেল।
সন্ধেবেলা বাসে করে তাদের মেয়েদের হোস্টেলে নিয়ে যাওয়া হলো, সকালে যে কয়জন ছিল এখন তারাও নেই। পুরো বাসে তারা মাত্র তিনজন। ঢাকা শহরে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব নেই সেরকম মানুষ খুব কম। এই বাসে বসে থাকা তিনজন হচ্ছে এরকম তিনজন হতভাগী! রাশা চোখের কোনা দিয়ে এই হতভাগীদের দেখল, চেহারা দেখেই বোঝা যায় মফস্বল থেকে এসেছে, তাদের মাঝে ঢাকা শহরের মেয়েদের মতো চকচকে ভাবটা নেই।
রাতে ক্যান্টিনে খেতে বসে রাশা অন্য দুটি মেয়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু আবিষ্কার করল মেয়ে দুটো কথা বলতে খুব আগ্রহী নয়, তাদের ভেতর কী নিয়ে যেন একটা ভয় ভয় ভাব!
পরদিন সকালে ছাত্রছাত্রীদের জন্যে প্রশ্নোত্তর পর্ব। মঞ্চে কিছু বুড়ো বুড়ো মানুষ বসেছে, দেখেই রাশা বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বুড়ো মানুষেরা কেন যেন একটু বেশি কথা বলে, এই মানুষগুলোও নিশ্চয়ই বকবক করে কানের পোকা নাড়িয়ে দেবে। তারপরেও রাশা একটু আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকল কে কী প্রশ্ন করে আর তার উত্তরে বুড়ো বুড়ো মানুষেরা কী বলে সেটা শোনার জন্যে।
প্রথম প্রশ্নটা হলো মহাকাশে মানুষ কেন ভরশূন্য হয়। একজন প্রশ্নটার উত্তর দিলেন অনেক ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে, কী বললেন কিছু বোঝা গেল না। কোনো মানুষ যখন একটা প্রশ্নের উত্তর ঠিক করে জানে না তখন এভাবে উত্তর দেয়। স্টেজে যারা বসেছিলেন তার মাঝে একজনের মনে হলো উত্তরটা পছন্দ হলো না, সেই মানুষটা তখন মাইক নিয়ে প্রশ্নটার উত্তর দেয়া শুরু করলেন। এই মানুষটার উৎসাহ অনেক বেশি কাজেই এমনভাবে কথা বলতে লাগলেন যে কথা আর শেষ হয় না! একসময় শেষ হলো তখন একটি মেয়ে প্রশ্ন করল, পৃথিবীর কেন্দ্রে মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণ শূন্য কেন? তারা যে ফর্মুলা শিখে এসেছে সেটা ব্যবহার করলে তো অসীম হওয়ার কথা।
রাশা একটু সোজা হয়ে বসল, এই প্রশ্নটার উত্তর সে নিজে অনেক কষ্ট করে বের করেছে, সে দেখতে চায় তার উত্তরটার সাথে মিলে কিনা। স্টেজে বসে থাকা মানুষগুলো বড় বড় বিজ্ঞানী, সবকিছুই জানে কিন্তু বোঝাতে পারে না! রাশা দেখল তারা কয়েকভাবে ব্যাখ্যা করল কিন্তু কেউ ঠিক করে বুঝতে পারল না! এরপরের প্রশ্নটা ছিল বিবর্তন নিয়ে, স্টেজে কমবয়সী একজন মহিলা খুব সুন্দর করে উত্তরটা দিলেন। এরপরে যে প্রশ্ন করতে দাঁড়াল সে প্রশ্ন না করে বিজ্ঞান এবং ধর্মের সাথে সম্পর্ক নিয়ে ছোটখাটো একটা বক্তৃতা দিয়ে ফেলল। স্টেজে বসে থাকা বুড়ো মানুষটা মাথা নেড়ে বলল, “ধর্মের মূল হচ্ছে বিশ্বাস আর বিজ্ঞানের মূল হচ্ছে যুক্তিতর্ক। দুটো ভিন্ন ভিন্ন ধারার জ্ঞান। তাই ধর্ম দিয়ে বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করতে হয় না আবার বিজ্ঞান দিয়ে ধর্ম ব্যাখ্যা করতে হয় না!”
যে প্রশ্নটা করেছিল সে কঠিন মুখে আবার তর্ক করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু স্টেজে বসে থাকা বুড়ো মানুষটা তাকে সুযোগ না দিয়ে আরেকজনের কাছে চলে গেল। এবারের প্রশ্নটা ছিল বিগ ব্যাং নিয়ে, প্রশ্নটা ছিল সুন্দর, উত্তরটাও দেয়া হলো সুন্দর করে। রাশারও একটা প্রশ্ন ছিল, জাহানারা ম্যাডাম তাকে বিজ্ঞানের যে বইটা দিয়েছেন সেখানে কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলে বিচিত্র একটা বিজ্ঞানের কথা বলা আছে, সেখানে ওয়েভ ফাংশন বলে আরো বিচিত্র একটা কথা আছে, সেটা নিয়ে সে প্রশ্ন করতে চাইছিল। প্রথম প্রথম খুব বেশি ছেলেমেয়ে প্রশ্ন করছিল না, তখন হাত তুললে তাকে নিশ্চয়ই প্রশ্ন করার সুযোগ দেয়া হতো। এখন সবাই হাত তুলে বসে আছে, সবাই কিছু না কিছু জিজ্ঞেস করতে চায়। তাই রাশা আর চেষ্টা করল না চেয়ারে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে রইল।
প্রশ্নোত্তর পর্ব যখন শেষের দিকে সেছে তখন রাশা কমবয়সী একটা মেয়ে একটা কাগজ নিয়ে স্টেজে এস বুড়ো মানুষদের একজনের সাথে একটু কথা বলে তার কাছ থেকে মাইক্রোফোনটা হাতে নিয়ে বলল, আমরা একটা মেয়েকে খুঁজছি। সে যেন এক্ষুণি আমার অফিসে চলে আসে। তার রেজিস্ট্রেশন নম্বর হচ্ছে দুই হাজার তিনশ সাতাশ। আর তার নাম হচ্ছে–মেয়েটা নামটা দেখার জন্যে কাগটার দিকে তাকাল। রাশা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। তার রেজিস্ট্রেশন নম্বর দুই হাজার তিনশ সাতাশ, আর সত্যি তখন মেয়েটি মাইক্রোফোনে তার নাম ধরে ডাকল।
রাশা একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়, এত হাজার হাজার ছেলেমেয়ের ভেতরে তাকে আলাদা করে কেন ডাকছে। কোনো একটা সমস্য নিশ্বয়ই। হয়েছে, কিন্তু কী সমস্যা? তবে একটা জিনিষ অনুমান করা যাচ্ছে।
অফিম্পিয়াডের অঙ্কগুলো মনে হয় ঠিক হয়েছে, তা নাহলে আলাদা করে তাকে ডাকবে কেন? রাশার একই সাথে একধরনের আনন্দ আবার অন্য ধরনের ভয় হতে থাকে।
.
কমবয়সী মেয়েটির পিছু পিছু রাশা যেতে থাকে। মেয়েটা বলল, “আমার নাম মিমি। আমি সায়েন্স অলিম্পিয়াডের কো-অর্ডিনেটর।”
রাশা জিজ্ঞেস করল, “মিমি আপু, আমাকে কেন ডেকেছেন?”
“আমি ঠিক জানি না, পরীক্ষার কন্ট্রোলার খবর পাঠিয়েছে! চলো গিয়ে দেখি।”
রাশা মিমি নামের মেয়েটার পিছনে পিছনে একটা তিনতলা বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে একটা রুমে গিয়ে ঢুকল। সেই রুমে খিটখিটে ধরনের একটা মানুষ বসে আছে, রাশাকে দেখে চশমার উপর দিয়ে তার দিকে তাকাল, তারপর খসখসে গলায় বলল, “তুমি সেই মেয়ে?”
রাশা যেহেতু আগে-পিছে কিছু জানে না তাই কোনো কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
মানুষটা খসখসে গলায় বলল, “পরীক্ষা তো খুবই ভালো দিয়েছ, একেবার ফার্স্ট কিন্তু এত কেয়ারলেস হলে কেমন করে হবে?”
রাশা জিজ্ঞেস করল, “কেয়ারলেস?”।
“হ্যাঁ। খাতায় নাম লিখেহু, রেজিস্ট্রেশন নম্বর লিখেছ, স্কুলের নাম লেখ নাই।” মানুষটি রাশাকে তার খাতাটা দেখিয়ে বলল, “এই দেখছ না, এখানে বড় বড় করে লেখা আছে স্কুলের নাম লিখতে হবে?”
রাশা কিছু বলল না। খিটখিটে মানুষটা বলল, “পরীক্ষার নিয়মে স্পষ্ট বলা আছে ভুল কিংবা মিথ্যা তথ্য দিলে কিংবা সব তথ্য না দিলে খাতা ক্যান্সেল হয়ে যাবে! বুঝলে মেয়ে আমি ইচ্ছে করলে তোমার খাতা ক্যান্সেল করে দিতে পারতাম। বুঝেছ?”
রাশা মাথা নেড়ে বলল যে সে বুঝেছে। খিটখিটে মানুষটা বলল, “কিন্তু তুমি এইটুকুন মেয়ে পরীক্ষায় এত ভালো করেছ খাতা ক্যান্সেল করি কেমন করে? তাই তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি। নাও স্কুলের নাম লেখ। ফিউচারে এরকম কেয়ারলেস হবে না।”
রাশা ইতস্তত করে বলল, “আসলে আমি কেয়ারলেস হইনি। আমি আসলে ইচ্ছা করে স্কুলের নামটা লিখি নাই।”
খিটখিটে মানুষটার মুখটা হঠাৎ কঠিন হয়ে গেল, সরু চোখে বাশার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি তাহলে কেয়ারলেস না, তুমি হচ্ছ আইন অমান্যকারী! নিয়ম কানুনের প্রতি তোমার কোনো সম্মান নেই–”
“না, না, তা নয়।” রাশা একটু ব্যস্ত হয়ে বলল, “আসলে আমার স্কুলটার নাম একটা রাজাকারের নামে। খাতায় রাজাকারের নামটা লিখতে ইচ্ছে করে না তো–”
মানুষটার মুখটা এবারে কেমন যেন থমথমে হয়ে গেল। সে রাশার খাতাটা টেবিলে রেখে সোজা হয়ে বসে রাশার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কী বলেছ?”
“বলেছি যে স্কুলটার নাম একটা রাজাকারের নামে, সেই নামটা লিখতে ইচ্ছে করে না।”
“রাজাকার?”
“জি।”
“তোমার বয়স কত?”
“চৌদ্দ।”
“তোমার বয়স চৌদ্দ আর এই বয়সে তুমি রাজাকার মুক্তিযুদ্ধের পলিটিক্সে ঢুকে গেছ?”
“ঠিক পলিটিক্স না–”
মানুষটা ধমক দিয়ে রাশাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আমি কী বলি শোনো। এই দেশে রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে অনেক পলিটিক্স হয়েছে, আর না। বুঝেছ? যে জিনিস দেখ নাই সেই জিনিস নিয়ে কথা বলবা না।”
“কিন্তু—”
মানুষটা ক্রুদ্ধ মুখে বলল, “বড় বড় লম্বা লম্বা কথা অনেক শুনেছি। আমার বয়স তো কম হয় নাই। লম্বা লম্বা কথা বললে সেই লম্বা কথা এক সময়ে গিলতে হয়। তুমি এখন যেভাবে গিলবে।”
মানুষটা কী বোঝাতে চাইছে রাশা অনুমান করতে পারল, তারপরও সে বলল, “আপনি কী বলছেন আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।”
“তুমি ঠিকই বুঝতে পারছ আমি কী বলছি। খুব বড় গলায় বলেছ, রাজাকারের নাম লিখতে ইচ্ছা করে না! এখন ফার্স্ট প্রাইজটার জন্যে তুমি এসে ঠিকই রাজাকারের নাম লিখবে। যদি না লেখো তাহলে আমি তোমার খাতা ক্যান্সেল করে দেব।”
এতক্ষণ মিমি নামের মেয়েটা চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল, এবারে সে একটু অস্থির হয়ে বলল, “স্যার আমি ওর রেজিস্ট্রেশন ফর্ম খুঁজে বের করে স্কুলের নামটা নিয়ে আসি স্যার। আমি লিখে দিই—”
খিটখিটে মানুষটা চিৎকার করে বলল, “না! এই মেয়ের নিজের লিখতে হবে। তাকে শিখতে হবে থুথু ফেলা সোজা। সেই থুথু চেটে খাওয়া কঠিন।”
রাশার মনে হলো তার মাথার ভেতরে বুঝি আগুন ধরে গেছে। মনে হলো সে পরিষ্কার করে কিছু চিন্তা করতে পারছে না তার নানি যখন দুই মাথা চেপে ধরে বিড়বিড় করে বলেন, মাথাটা মনে হয় আউলে গেছে তখন তার মনে হয় ঠিক এরকম লাগে!
“লেখো।” খিটখিটে মানুষটা খাতাটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “রাজাকারের নামে দেওয়া তোমার স্কুলের নাম লেখো।”
ব্লাশী বলল, “আমি লিখব না।”
মানুষটা মনে হয় চমকে উঠল, বলল, “কী বললে?”
“আমি বলেছি, আমি আমার খাতায় কোনো রাজাকারের নাম লিখব না।”
মানুষটা মনে হলো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। কিছুক্ষণ চেষ্টা করে বলল, “তুমি তোমার স্কুলের নাম লিখবে না?”
“তাহলে আমি তোমার খাতা ক্যান্সেল করে দেব। সবচেয়ে বেশি মার্কস পেয়েও তুমি কোনো পুরস্কার পাবে না।”
“জানি?”
“তারপরেও তুমি তোমার খাতায় তোমার স্কুলের নাম লিখবে না?”
রাশা মাথা নাড়ল, বলল, “না। আমি থুথু ফেলেছি, সেই গুথু আমি চেটে খাব না।”
খিটখিটে মানুষটা দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, “বেয়াদব মেয়ে।” কিছুক্ষণ হিংস্র চোখে সে রাশার দিকে তাকিয়ে রইল তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “তুমি আমাকে চেনো না! আমি তোমাকে ভয় দেখানোর জন্যে কোনো কথা বলি নাই, আমি সত্যি সত্যি তোমার খাতা ক্যান্সেল করব। এই দেখো—”
মানুষটি টেবিল থেকে একটা লাল মার্কার হাতে তুলে নেয়, তখন মিমি নামের মেয়েটা ছুটে এসে রাশার খাতাটা আড়াল করার চেষ্টা করল, কাতর গলায় বলল, “প্লিজ স্যার। প্লিজ! ওর খাতাটা ক্যান্সেল করবেন না–আমাকে পাঁচটা মিনিট সময় দেন আমি ওর স্কুলের নাম নিয়ে আসছি! প্লিজ!”
খিটখিটে মানুষটি প্রায় ধাক্কা দিয়ে মিমিকে সরিয়ে দিয়ে রাশার খাতার ওপর লাল কালিতে বড় বড় করে ইংরেজিতে লিখল ক্যান্সেল! তারপর খাতাটা ছুঁড়ে দিয়ে রাশার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি এবারে যেতে পারো। যদি আমাকে জিজ্ঞেস করো তাহলে বলব, ইচ্ছে হলে জাহান্নামেও যেতে পারো।”
রাশা ঘর থেকে শান্ত মুখে বের হয়ে এলো, সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় তার চোখ দিয়ে পানি বের হতে থাকে। কাঁদবে না, সে কিছুতেই কাদবে না প্রতিজ্ঞা করেও সে নিচে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঝরঝর করে কাঁদতে থাকে। বিল্ডিংয়ের একটা বড় পিলারের আড়ালে দাঁড়িয়ে সে অনেক কষ্টে নিজের কান্না থামানোর চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুতেই থামাতে পারল না, সে দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল, কেউ দেখে ফেললে সেটা ভারি লজ্জার ব্যাপার হবে।
রাশা অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করল, তারপর বের হয়ে এলো। এখন আর এখানে থাকার কোনো অর্থ নেই। সত্যি কথা বলতে কী যখন পুরস্কার দেয়া হবে তখন যখন ফাস্ট প্রাইজ দেয়া হবে তখন মনে হয় দুঃখে তার বুকটা একেবারে ফেটে যাবে। সে তখন কেমন করে সেই দৃশ্য সহ্য করবে? রাশা টের পায় তার ভেতরে ভয়ঙ্কর একধরনের রাগ ফুঁসে উঠছে, অনেক কষ্ট করে সে নিজেকে শান্ত করল।
হেডস্যার বলেছেন এখানে থাকতে, পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের শেষে তাকে এখান থেকে নিয়ে যাবেন। তাই তাকে এখানে থাকতেই হবে। একটা কাজ করা যায়, সে এখন এখান থেকে বের হয়ে যাবে, যখন পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শেষ হবে তখন সে ফিরে আসবে। অনুষ্ঠান শেষ হবে বিকেল পাঁচটায়, ফিরে আসবে তারপর।
রাশা হেঁটে হেঁটে গেট খুলে বের হয়ে গেল। বাইরে ব্যস্ত রাস্তা, বড় বড় বাস-ট্রাক গাড়ি যাচ্ছে। রাশা ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকে, ফুটপাথে নানারকম দোকানপাট। একটা বড় ওভারব্রিজ, ওভারব্রিজের নিচে ছোট একটা খুপচিতে একটা আস্ত পরিবার থাকে। ছোট একটা বাচ্চা হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে। চার-পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা রাস্তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে, তার নাক ঘষে বড় বড় বাস যাচ্ছে, বাচ্চাটির কোনো ভয়ডর নেই। রাশা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল, তারপর আবার হাঁটতে শুরু করল। ফুটপাথে একজন নানা রকম বই বিক্রি করছে, রাশা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বইগুলো দেখল। একটু পরে সে আবিষ্কার করল আসলে সে শুধু তাকিয়ে আছে, কিছু দেখছে না। তার এত অস্থির লাগছে যে সে কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। মনে হচ্ছে লাফিয়ে একটা চলন্ত বাসের নিচে চাপা পড়ে যায়।
“না, আমি পাগলামো করব না।” রাশ নিজেকে বোঝাল, “আমি যেটা করেছি, ঠিকই করেছি। আমি বলেছিলাম আমি রাজাকারের নাম লিখব না, আমি নাম লিখি নাই। যে রাজাকার আমার নানাকে খুন করেছে, আমি মরে গেলেও তার নাম লিখব না। আমার নানা ছিলেন মুক্তিযাদ্ধা, আমি নানার সম্মানের জন্যে ফাইট করেছি। কেউ এই ফাইটের কথা জানবে না। না জানলে নাই–আমি তো জানব!” রাশা বিড়বিড় করে বলল, “আমি জানব। আমি জানব। আমি জানব।”
রাশা ইতস্তত হাঁটে, একটা বাসস্ট্যান্ডে অনেক মানুষ বসে ছিলো একটা বাস আসতেই সবাই বাসে উঠে যেতেই বাসস্ট্যান্ড খালি হয়ে গেল। রাশা তখন চুপচাপ বাসস্ট্যান্ডে বসে থাকে। বেঞ্চের অন্যপাশে একটা পাগল বসে আছে, তার খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখগুলো লাল, দাঁতগুলো হলুদ। পাগল মানুষটা রাশার দিকে তাকিয়ে এমনভাবে হাসল, যেন সে কত দিনের পরিচিত। রাশা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে রাস্তার দিক তাকিয়ে থাকে।
পাঁচটা বাজার পরও রাশা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, তারপর সে হেঁটে গণিত অলিম্পিয়াডের মাঠের দিকে রওনা দিল। এতক্ষণে নিশ্চয়ই পুরস্কার দেয়া হয়ে গেছে। তার যে ফার্স্ট প্রাইজটা পাওয়ার কথা ছিল সেটা অন্য একজন নিয়ে নিচ্ছে তাকে নিশ্চয়ই এখন আর সেই দৃশ্যটা দেখতে হবে না।
সায়েন্স অলিম্পিয়াডের মাঠের কাছে এসে রাশা গেট খুলে ভেতরে ঢুকল, সে ভেবেছিল দেখবে পুরো মাঠ ফাঁকা, কিন্তু অবাক হয়ে দেখল প্যান্ডেল বোঝাই মানুষ। রাশা আরেকটু এগিয়ে গেল তখন দেখতে পেল একটা মানুষ বক্তৃতা দিতে উঠেছে। নিশ্চয়ই শেষ বক্তৃতা, রাশা নিজেকে বুঝিয়ে আরেকটু এগিয়ে গেল। অনেক মানুষ, বসার জায়গা বলতে গেলে নেই, একটু সামনে একটা চেয়ার ফাঁকা, রাশা সেখানে গিয়ে বসল। পাশে তাকিয়ে দেখে হোস্টেলে প্রথম দিন দেখতে পাওয়া ঝকঝকে চেহারার মেয়েটি, যে মেয়েটি সন্দেহ করেছিল যে সে বড় কোনো মানুষকে দিয়ে অঙ্কগুলো করিয়ে পাঠিয়েছে। রাশা অস্বস্তিবোধ করতে থাকে, কিন্তু কিছু করার নেই। মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, “তুমি এখন এসেছ?”
“না। আগেই এসেছিলাম একটু বাইরে গিয়েছিলাম।”
“ও।“
রাশা ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, “প্রাইজ দিয়ে দিয়েছে তো, তাই না?”
“না। এখনো দেয়নি।”
রাশা চমকে উঠল, “এখনো দেয়নি?”
“নাহ্। সবাই লম্বা লম্বা বক্তৃতা দিচ্ছে।”
“এখনো প্রাইজ দেয়নি?”
“এক্ষুণি দেবে, ঐ যে দেখো প্রাইজ আনছে।”
রাশা দেখল স্টেজে টেবিলের ওপর অনেকগুলো মেডেল এনে রাখা হচ্ছে। একটি মেয়ে হাতে কিছু কাগজপত্র নিয়ে স্টেজে উঠে ব্যস্তভাবে অন্য একজনের সাথে কথা বলছে। রাশার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল, তার লাফ দিয়ে উঠে ছুটে পালিয়ে যাবার ইচ্ছে করছিল কিন্তু সে উঠতে পারল না। এখন আর উঠে পালিয়ে যাবার উপায় নেই। যে দৃশ্যটা দেখার জন্যে সে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল এখন তাকে বসে সেই দৃশ্যটি দেখতে হবে। সে ঘুরে ঘুরে সেই দৃশ্যটি দেখার জন্যেই ফিরে এসেছে। খোদা এত নিষ্ঠুর কেন কে জানে! রাশ মাথা নিচু করে বসে রইল।
মেয়েটি মাইকে একজন একজন করে নাম ডাকতে থাকে, যার নাম ডাকা হয়েছে সে আনন্দে চিৎকার করে নাচতে নাচতে স্টেজে যায়। আধা পাকা চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, খোঁচা খোঁচা গোঁফ একজন মানুষ পুরস্কার দিতে থাকে। এই মানুষটা নিশ্চয়ই একজন মন্ত্রী হবে, সে শুনেছিল পুরস্কার দেয়ার জন্য একজন মন্ত্রী আসবেন।
বারোজনকে সেকেন্ড রানারআপ পুরস্কার দেয়া হলো। তারপর আরো বারোজন পেল রানারআপ পুরস্কার। শেষে ছয়জন পেল চ্যাম্পিয়ন পুরস্কার। যারা পুরস্কার পেয়েছে তাদের বেশিরভাগই ছেলে, হাতেগোনা। অল্প কয়জন মাত্র মেয়ে। যতটুকু যন্ত্রণা হবে বলে ভেবেছিল রাশা আবিষ্কার করল তার ততটুকু যন্ত্রণা হলো না, ভেতরটা কেমন যেন ভোঁতা হয়ে আছে, মনে হচ্ছে কিছুই টের পাচ্ছে না। সে নিঃশব্দে বসে আছে, এক্ষুণি অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে ঘোষণা করা হবে তখন সবার সাথে সাথে সে উঠে দাঁড়াবে তারপর হেঁটে চলে যাবে। কিন্তু ঘোষণাটি করা হলো না আর রাশা ভেতরে ভেতরে অধৈর্য হয়ে বসে রইল।
পাশে বসে থাকা ঝকঝকে চেহারার মেয়েটা বলল, “কিছু একটা ঘাপলা হয়েছে।”
রাশা মাথা তুলে তাকাল, “কী ঘাপলা?”
“ঐ দেখো। একটা মেয়ে হাতে একটা কাগজ নিয়ে চেঁচামেচি করছে। সবাই তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।”
রাশা চোখ তুলে তাকাল, মিমি নামের মেয়েটা হাতে একটা খাতা নিয়ে কথা বলছে, অন্যেরা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। রাশা সাথে সাথে বুঝে গেল কী হয়েছে, মিমির হাতে যে খাতাটা, সেটা হচ্ছে তার পরীক্ষার খাতা, সে এই খাতাটা নিয়ে স্টেজে চলে এসেছে, সবাইকে নিশ্চয়ই বলছে যে একটা খুব বড় অবিচার করা হয়েছে। হঠাৎ করে রাশার দুই চোখে পানি চলে এলো।
মন্ত্রী চেঁচামেচি শুনে খুব বিরক্ত হলেন মনে হলো, হাত দিয়ে ইঙ্গিত করে বললেন মিমিকে তার কাছে পাঠাতে। মিমি মন্ত্রীকে খাতাটা দেখাল, হাত-পা নেড়ে উত্তেজিতভাবে কিছু বলল, মন্ত্রীও খাতাটা দেখলেন তারপর মাথা নাড়লেন। বুড়ো মানুষগুলোও মন্ত্রীর কাছে চলে এসেছে, তারাও কিছু একটা বোঝাচ্ছে, মন্ত্রী মনে হয় তাদের কথাও শুনলেন, তারপরে মাথা নাড়লেন।
পাশে বসে থাকা মেয়েটা বলল, “কী হচ্ছে বলে মনে হয়?”
রাশা বলল, “একটা খাতা পাওয়া গেছে যেখানে একজন অনেক মার্কস পেয়েছে কিন্তু তাকে কোনো পুরস্কার দেয় নাই।”
“তুমি কেমন করে জানো?”
“জানি না। আন্দাজ করছি।”
রাশা দেখল হঠাৎ মন্ত্রী উঠে দাঁড়ালেন, হাতে মাইকটা নিয়ে বললেন, “আমি একটা ছোট ঘোষণা দিতে চাই। এই যে আজকে সায়েন্স অলিম্পিয়াড হলো, দেশের বড় বড় বৈজ্ঞানিক, প্রফেসর মিলে সেটা আয়োজন করেছেন, তাদের নিয়ম-কানুনমতো খাতা দেখা হয়েছে পুরস্কার দেয়া হয়েছে। তারা সবাই জ্ঞানী-গুণী মানুষ, আমার থেকে অনেক বেশি লেখাপড়া জানেন, তারা যেভাবে এটা করেছেন সেভাবেই সবকিছু হয়েছে।”
মন্ত্রী রাশার খাতাটা দেখিয়ে বললেন, “এখন আমার কাছে একটা খাতা এসেছে, অলিম্পিয়াডের নিয়ম-কানুন মানে নাই দেখে এই খাতাটা বাতিল হয়েছে। ঠিকই আছে–আমার কিছু বলার নাই। তবে যে জিনিসটা খুবই ইন্টারেস্টিং সেটা হচ্ছে, এইটা যার খাতা সেই মেয়েটা সবচেয়ে বেশি মার্কস পেয়েছে। সবার চেয়ে বেশি।”
প্যান্ডেলের নিচে বসে থাকা সবাই বিস্ময়ের মতো শব্দ করল!
মন্ত্রী বললেন, “সায়েন্স অলিম্পিয়াড কমিটি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমি সেটাকে পুরোপুরি সম্মান দেখাচ্ছি, যে খাতাটা বাতিল সেটা বাতিলই থাকুক। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে এই মেয়েটাকে একটা পুরস্কার দিতে চাই। আপনারা কী বলেন?”
সামনে বসে থাকা হাজার খানেক ছেলেমেয়ে আর তাদের বাবা-মা চিৎকার করে বলল, “পুরস্কার! পুরস্কার!”
মন্ত্রী বলল, “তাহলে মা তুমি আসো!” মন্ত্রী খাতাটা দেখে রাশার নামটা পড়লেন।
প্যান্ডেলের নিচে বসে থাকা হাজার খানেক ছেলেমেয়ে, তাদের বাবা-মা আর শিক্ষকেরা নিশ্বাস বন্ধ করে মানুষটিকে দেখার জন্যে বসে রইল।
রাশা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে বসে রইল, তার চোখে পানি এসে গিয়েছে, সে সাবধানে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ দুটো মুছে নিল। তারপর সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। তার পাশে বসে থাকা ঝকঝকে চেহারার মেয়েটির মনে হলো একটা হার্ট অ্যাটাক হলো, চিৎকার করে বলল, “তুমি?”
রাশা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”
মেয়েটার তখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, আবার জিজ্ঞেস করল, “সত্যি?”
“হ্যাঁ সত্যি!”
তখন মেয়েটি একটা গগনবিদারি চিৎকার দিল যেন রাশা নয় আসলে তাকেই স্টেজে ডাকা হচ্ছে। সে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল তারপর রাশাকে জাপটে ধরে প্রায় কোলে তুলে নিয়ে চিৎকার করতে করতে স্টেজের দিকে ছুটতে থাকে। রাশা অপ্রস্তুত হয়ে মেয়েটার কবল থেকে ছোটার চেষ্টা করল কিন্তু মেয়েটি তাকে ছাড়ল না, একেবারে স্টেজের সামনে তাকে নামিয়ে দিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল। দৃশ্যটি দেখার জন্যে প্যান্ডেলের প্রায় সবাই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এবার তারা বসতে শুরু করে।
মন্ত্রী রাশার হাত ধরে স্টেজে নিয়ে এসে বললেন, “মা, আমি তোমাকে একটা পুরস্কার দিতে চাই। তুমি বলো কী পুরস্কার চাও।”
মন্ত্রী মাইক্রোফোনটা রাশার মুখে ধরলেন, রাশা বলল, “আমি আমার পুরস্কার পেয়ে গেছি। এই যে আপনি আমাকে এখানে ডেকে এনেছেন এটাই আমার পুরস্কার।”
“তারপরেও তোমাকে একটা পুরস্কার দিতে চাই। বলো।”
“আপনি আমার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে দেন।”
সামনে যারা বসেছিল কোনো একটা কারণে সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠল। মন্ত্রী বলল, “অবশ্যই মা, অবশ্যই আমি তোমার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে দেব।”
রাশা দেখল বুড়ো বুড়ো প্রফেসর মন্ত্রীর পিছনে এসে ভিড় করে উসখুস করছে। একজন গলা উঁচিয়ে বলল, “স্যার আসলে একটা মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেছে, আমরা আসলে মেয়েটাকে একটা স্পেশাল প্রাইজ দিতে চাই।”
মন্ত্রী মহোদয় হাত দিয়ে পুরো ব্যাপারটি উড়িয়ে দিয়ে বললেন, “কোনো প্রয়োজন নাই! এই মেয়েটি আপনাদের পুরস্কার ছাড়াই অনেকদূর যাবে বলে মনে হচ্ছে!”
বুড়ো প্রফেসর বলল, “কিন্তু স্যার–”
মন্ত্রী হাত নেড়ে বুড়ো প্রফেসরকে বাতিল করে দিয়ে রাশার দিকে তাকালেন, বললেন, “মা, আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না। তুমি এইটুকুন বাচ্চা মেয়ে এই রকম কঠিন কঠিন অঙ্ক করে ফেল, কিন্তু খাতার উপরে স্কুলের নাম লিখতে ভুলে গেলে এটা কী রকম কথা?”
রাশা বলল, “আমি ভুলি নাই।”
“তাহলে?”
“আমি ইচ্ছা করে লিখি নাই।”
“কেন?”
“আমাদের স্কুলের নামটা একটা রাজাকারের নামে। আমার নানা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, এই রাজাকার আমার নানাকে মেরেছে। আমি মরে গেলেও কোথাও এই রাজাকারের নাম লিখব না।”
মন্ত্রী কেমন যেন একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে রাশার দিকে তাকিয়ে থাকলেন, এতক্ষণ হাতের মাইক্রোফোনে কথা বলছিলেন, এখন মাইক্রোফোনটা টেবিলে রেখে রাশাকে কাছে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “মা, আমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা। সেভেন্টি ওয়ানে আমার অনেক বন্ধু মারা গেছে। রাজাকাররা মেরেছে–আমি মূর্খ মানুষ, লেখাপড়া করি নাই। আমার বন্ধুরা সব ট্যালেন্টেড ছেলে ছিল, বেঁচে থাকলে আজকে কত বড় বড় মানুষ হতো!”
মন্ত্রী রাশার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “মা, আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, একসপ্তাহের মাঝে আমি তোমার স্কুলের নাম বদলে দেব। রাজাকারের নাম সরিয়ে একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম দিব। এই স্কুলের সবচেয়ে কাছাকাছি এলাকায় শহীদ হয়েছে সে রকম একজন মুক্তিযোদ্ধার নামে। ঠিক আছে?”
মন্ত্রী এমনভাবে রাশাকে জিজ্ঞেস করলেন, যেন তার কথার উপরেই সবকিছু নির্ভর করছে।
রাশা বলল, “ঠিক আছে। আপনাকে থ্যাংকু। অনেক থ্যাংকু।” তারপর কাজটা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারল না তারপরও করে ফেলল, মন্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলল, “আমার মনে আর কোনো দুঃখ নাই?”
স্টেজে যারা উপস্থিত ছিল, সামনে যারা বসে আছে তারা সবাই বুঝতে চাইছিল ঠিক কী হচ্ছে। মন্ত্রী তাই মাইকটা হাতে নিয়ে বললেন, “আমি এই মায়ের কাছে ছোট একটা ওয়াদা করেছি। তার স্কুলের নামটা আমি বদলে দিব। সেই নামটা দেয়া হবে একটী শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামে। আমার এই ছোট মা তখন বুক ফুলিয়ে সবার কাছে তার স্কুলের নামটা বলতে পারবে।”
.
স্টেজ থেকে নামার পর অনেকগুলো টেলিভিশন ক্যামেরা রাশাকে ঘিরে ধরল, রাশা দেখল তাদের হেডস্যার সবাইকে ঠেলে রাশার পিছনে দাঁড়িয়ে গেলেন। একজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করল, “তুমি যে সবচেয়ে ভালো করেও সায়েন্স অলিম্পিয়াডে পুরস্কার পেলে না সে জন্যে তোমার কি মন খারাপ হয়েছে?”
রাশা মাথা নাড়ল, “না একটুও মন খারাপ হয়নি। আমার স্কুলে আর রাজাকারের নাম থাকবে না এইটা আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার।”
হেডস্যারকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেনি কিন্তু তিনি নিজে থেকে যোগ করলেন, “আমাদের স্কুলের নাম নিয়ে একটু সমস্যা আছে কথা সত্যি কিন্তু স্কুলটা খুব হাইফাই। তিরিশটা কম্পিউটার আছে। আমি হচ্ছি হেডমাস্টার কফিলউদ্দিন বি.এড।”
সাংবাদিকরা রাশাকে ঘিরে তাকে প্রশ্ন করতে লাগল, রাশা চেষ্টা করল শান্তভাবে উত্তর দিতে। মাঝে মাঝে তার একটু নার্ভাস লাগছিল, কিন্তু সে লক্ষ করল কাছেই জাহানারা ম্যাডাম দাঁড়িয়ে আছেন, তার পাশে মিমি। এই দুজনকে দেখেই তার সাহস বেড়ে গেল, সে তখন বেশ গুছিয়েই সব প্রশ্নের উত্তর দিল।
সাংবাদিকরা চলে যাবার পর রাশা ছুটে গিয়ে মিমির হাত ধরে বলল, “মিমি আপু! আপনাকে যে আমি কিভাবে থ্যাংকু দিব! ইস!”
মিমি হি হি করে হেসে বলল, “আচ্ছা শিক্ষা হয়েছে শামসু মিয়ার।”
“শামসু মিয়াটা কে?
“ঐ যে তোমার খাতা ক্যান্সেল করে দিল। ব্যাটা রাজাকারের বাচ্চা রাজাকার। এখন চাকরি চলে যাবে দেখো। কত বড় সাহস।”
জাহানারা ম্যাডাম রাশাকে বুকে জড়িয়ে বললেন, “বুঝলে রাশা, তোমাকে দেখে গর্বে আমার বুক ফুলে যাচ্ছে। তোমার মতোন দুই-একজন ছাত্রী পেলেই আমাদের জীবনটা কমপ্লিট হয়।”
হেডমাস্টার বললেন, “রাশা আসলে আমাদের স্কুলের ছাত্রী। আমি হচ্ছি হেডমাস্টার। আমাদের স্কুলের নামটা নিয়ে একটু সমস্যা আছে কথা সত্যি। কিন্তু স্কুল ভালো। কম্পিউটারই আছে তিরিশটা। বি.এস.সি. শিক্ষক তিনজন। আমার নাম কফিলউদ্দিন বি,এড।”
জাহানারা ম্যাডাম হাসলেন, বললেন, “আপনার স্কুল নিশ্চয়ই খুব ভালো, তা না হলে এরকম ছাত্রী কোথা থেকে তৈরি হয়?”