১১. নৌকায় নৌকায়
জিতু মিয়া নৌকাটাতে হাত দিয়ে বলল, “আলকাতরা শুকিয়ে গেছে।”
মতি নৌকাতে হাত না দিয়েই বলল, “শুকায় নাই। আলকাতরা মোটেও শুকায় নাই। আলকাতরা এত সহজে শুকায় না।”
রাশা বলল, “যথেষ্ট শুকিয়েছে, এখন পানিতে নামাই। নৌকা টেস্টিং করি।”
মতি বলল, “আলকাতরা না শুকালে নৌকাতে পানি উঠবে।”
রাশা বলল, “নৌকাতে আমরা একটা বাটি রাখব, পানি উঠলে পানি সেঁচব।”
জয়নব বলল, “কাঁচা আলকাতরা শরীরে লেগে যাবে। জামা-কাপড়ে লেগে যাবে।”
রাশা বলল, “শরীরে একটু আলকাতরা লাগলে কিছু হয় না।”
জিতু বলল, “কেরোসিন দিলেই আলকাতরা উঠে যায়।”
রাশা বলল, “হ্যাঁ, কেরোসিন দিলেই আলকাতরা উঠে যায়।”
জয়নব বলল, “তার মানে তুই নৌকায় উঠবিই?”
রাশা দাঁত বের করে হাসল, বলল, “হ্যা! আমার আর ধৈর্য হচ্ছে না। চল।”
কাজেই চারজনের ছোট দলটা নৌকাটাকে ঠেলে খালের পানিতে নামিয়ে ফেলল। গৌরাঙ্গ ঘরামি নৌকার সাথে দুইটা বৈঠা তৈরি করে দিয়েছেন। মতি দুটো লম্বা বাঁশ নিয়ে এলো লগি হিসেবে ব্যবহার করার জন্যে। জিতু খুঁজে একটা ছোট প্লাস্টিকের বালতি নিয়ে এলো নৌকায় পানি সেঁচার জন্যে।
নানি খালের পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন, দেখলেন একজন একজন করে নৌকায় উঠে বসল। মতি বৈঠা হাতে নিয়ে পিছনে বসেছে, তারপর ধাক্কা দিয়ে নৌকাটাকে খালের মাঝামাঝি নিয়ে আসে। নৌকাটা একবার ঘুরে যেতে যাচ্ছিল, মতি বৈঠা দিয়ে নৌকাটাকে থামায় তারপর সামনের দিকে বেয়ে নিতে থাকে। রাশা আনন্দে হাত নেড়ে চিৎকার করে বলল, “ফ্যান্টাস্টিক!”
আনন্দে রাশা দাঁড়িয়ে যেতেই নৌকাটা দুলে উঠল, সাথে সাথে সে আবার বসে পড়ে। মতি বলল, “নৌকার মাঝে দাঁড়ালেই বিপদ!”
রাশা বলল, “তাই তো দেখছি।”
মতি বৈঠা দিয়ে নৌকাটাকে বেয়ে নিয়ে যেতে থাকে, রাশা আগ্রহ নিয়ে দেখে, কাজটাকে তার মোটেও কঠিন মনে হলো না, বৈঠাটা তাকে দিলে সেও নিশ্চয়ই পারবে। পানিতে ডুবিয়ে সামনে থেকে পিছনে টেনে আনা, সেটা না পারার কী আছে? রাশা বলল, “মতি! আমাকে বৈঠাটা দিবি? আমি একটু চালাই।”
“তুমি আগে নৌকা বেয়েছ?”
“নাহ। তাতে কী হয়েছে, মোটেও কঠিন মনে হচ্ছে না।”
“দেখে কোনো কাজ কঠিন মনে হয়? সাইকেল চালানো দেখে কি কঠিন মনে হয়? কিন্তু যে চালানো জানে না সে চেষ্টা করলে কী রকম আছাড় খায় তুমি জানো?”
“তা ঠিক।”
“খালটা তো সরু, এইখানে ঠিক করে না বাইলে ডানে-বাঁয়ে লেগে যাবে। আরেকটু সামনে গিয়ে জলা জায়গায় পড়ব সেইখানে চারিদিকে পানি। তুমি সেইখানে চালিও যেদিকেই যাও সমস্যা নাই।”
“কিন্তু তোকে দেখে আমার যে লোভ হচ্ছে।”
মতি তার ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে হাসল। বলল, “আরেকটা বৈঠা আছে সেইটা দিয়ে বাইতে থাকে, তাহলে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাব।”
রাশ তখন আরেকটা বৈঠা নিয়ে বাইতে থাকে, নৌকাটা ঘুরে যেতে যাচ্ছিল, মতি পিছনে বসে সোজা করে রাখল। দুজনে মিলে বৈঠা বাওয়ার কারণে নৌকাটা এবার আরেকটু জোরে ছুটতে থাকে।
জয়নব বলল, “আলকাতরা শুকানোর আগে নৌকাটা নামিয়েছি। এখন দেখেছ কী হচ্ছে?”
রাশা জিজ্ঞেস করল, “কী হচ্ছে?”
“নৌকাতে পানি উঠছে।”
সত্যি সত্যি ধীরে ধীরে নৌকার নিচে পানি জমতে শুরু করেছে। রাশ বলল, “বসে আছিস কেন? পানি সেঁচতে শুরু কর।”
কাজেই জয়নব আর জিতু পানি সেঁচতে লাগল।
.
কিছুক্ষণের মাঝেই খালটা একটা জলা জায়গার সাথে এসে মিশে গেল। শুকনোর সময় চারপাশে ধানক্ষেত থাকে তার মাঝ দিয়ে খালটী আলাদা করে বোঝা যায়, এখন চারিদিকে পানি, কোথায় খাল আর কোথায় ধানক্ষেত বোঝার কোনো উপায় নেই। মাঝে মাঝে পানি থেকে গাছ বের হয়ে এসেছে, কোথাও কোথাও ঝোঁপঝাড়ের মাথা দেখা যাচ্ছে তাই বোঝা যায় পানি খুব বেশি গভীর নয়। পানি ঝকঝকে পরিষ্কার, নিচে তাকালেও পানিতে ডুবে থাকা ক্ষেত মাটি চোখে পড়ে।
রাশা বলল, “মতি, এবারে আমাকে দে, আমি নৌকা বাই।”
মতি বলল, “ঠিক আছে, আমি সরে যাই, তুমি এসে বসো।”
মতি সরে গেল, রাশা এসে তার জায়গায় বসল, নৌকাটা একটু বিপজ্জনকভাবে দুলে উঠল, কিন্তু তারা দুজনে মিলে সেটা সামলে নেয়।
রাশা বৈঠা হাতে নিয়ে নৌকাটা বাইতে শুরু করে–কী আশ্চর্য, সত্যি সত্যি নৌকাটা এগিয়ে যেতে থাকে! বেশ খানিক দূর গিয়ে রাশা সবার দিকে তাকাল, বলল, “দেখলি?”
কোনো একটা কারণে তখন জয়নব আর জিতু হেসে কুটি কুটি হচ্ছে, মতির মুখ দেখে মনে হলো তারও হাসি পাচ্ছে, কিন্তু সে ভদ্রতা করে হাসছে না। রাশা একটু অবাক হয়ে বলল, “কী হলো, তোরা হাসছিস কেন?”
জিতু বলল, “তোমার নৌকা চালানো দেখে!”
“আমার নৌকা চালানোতে হাসির ব্যাপারটা কোন জায়গায়।”
“তুমি কি জানো, তুমি এক জায়গায় ঘুরছ!”
“আমি? এক জায়গায় ঘুরছি?”
“হ্যাঁ।”
রাশা এবার একটু সামনে তাকাল এবং আবিষ্কার করল সত্যি সত্যি নৌকাটা সামনে যাচ্ছে না, এটা এক জায়গায় ঘুরে যাচ্ছে।
রাশা বলল, “কী আশ্চর্য! মতি, তুই যখন বৈঠা চালাস তখন দেখি নৌকাটা সোজা যায়। আমি চালালে ঘুরে যাচ্ছে। ব্যাপারটা কি?”
মতি হাসল, “এই জিনিসটাই শিখতে হবে। এইটাই হচ্ছে নৌকা চালানো! এমনভাবে বৈঠা চালাবে যেন তুমি চাইলে নৌকাটা সোজা যাবে, চাইলে ডান দিকে যাবে, আবার চাইলে বাম দিকে যাবে।”
রাশা বলল, “দেখে মনে হয় কত সোজা, কিন্তু কাজটা তো দেখি কঠিন!”
মতি বলল, “যতক্ষণ না জানো ততক্ষণ কঠিন। যখন জানবে তখন দেখবে কাজটা পানির মতো সোজা!”
রাশা তখন মুখ শক্ত করে নৌকা চালানো শিখতে শুরু করল, তার মুখ দেখে মনে হতে থাকে, এর ওপরেই বুঝি তার জীবন-মরণ নির্ভর করছে!
.
রাত্রিবেলা রাশা আর নানি খেতে বসেছে, রাশা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল, “নানি, তুমি কোনোদিন নৌকা চালিয়েছ?”।
নানি চোখ কপালে তুলে বললেন, “আমি কোন দুঃখে নৌকা চালাতে যাব? একটু পরে জিজ্ঞেস করবি, নানি তুমি কোনোদিন রিকশা চালিয়েছ?”
রাশা হাসল, বলল, “না সেটা জিজ্ঞেস করব না।”
“না করলেই ভালো।”
“বুঝলে নানি, তোমার দেখে মনে হবে নৌকা চালানো বুঝি খুব সোজা। আসলে এত সোজা না, তুমি যদি ঠিক করে বৈঠা না বাইতে পার তাহলে নৌকাটা এক জায়গায় ঘুরতে থাকবে।”
“তোর ব্যাপারস্যাপার আমি খুব ভালো বুঝি না। স্কুলে যাবার জন্যে একটা নৌকা দরকার সেটা না হয় বুঝলাম। সেই নৌকা তোর কেন বাইতে হবে?”
“আমি একা বাইব কে বলেছে, সবাই বাইব।”
“এই যে ঢ্যাং চ্যাং করে একশ রকম কাজ করে বেড়াস, কোনদিন যে কোন বিপদে পড়বি খোদাই জানে।”
রাশা কিছুক্ষণ চোখের কোনা দিয়ে তার নানিকে দেখল, তারপর আস্তে আস্তে বলল, “ননি।”
“কী হলো?”
“আমি যে এইরকম উল্টাপাল্টা কাজ করি, তুমি কি সে জন্যে আমার ওপরে বিরক্ত হও!”
নানি হাসলেন, বললেন, “ধুর বোকা মেয়ে, বিরক্ত হব কেন?” একটু থেমে বললেন, “আসলে কী হয়েছে জানিস?”
“কী হয়েছে নানি?”
“এই যে তুই আমার সাথে থাকিস, দিন-রাত পাগলামি করিস, আমার সাথে বকবক করিস, আমার সময়টা তখন কেটে যায়। আগে মনে হতো সময়টা হচ্ছে একটা বোঝা, কিছু একটা চিন্তা করলেই মনে হতো মাথাটা বুঝি আউলে যাচ্ছে। এখন আর হয় না। প্রায় প্রত্যেক দিন আমি শান্তিতে ঘুমাই!”
রাশা তার ঝোল মাখা হাত দিয়ে নানিকে জড়িয়ে ধরে বলল, “সত্যি নানি? তোমার এখন শান্তিতে ঘুম হয়?”
“হ্যাঁ। গত রাতে আমি তোর নানাকে স্বপ্নে দেখলাম। আগে যখনই স্বপ্ন দেখেছি মনে হচ্ছে তোর নানাকে কেউ অত্যাচার করছে, গুলি করছে, চিৎকার করছে, আমি লাফ দিয়ে উঠে সারারাত বসে থেকেছি। ভয়ে চোখ বন্ধ করতে পারিনি।”
রাশা কিছু না বলে নানির দিকে তাকিয়ে রইল। নানি বললেন, “গত রাতে প্রথমবার তোর নানাকে স্বপ্নে দেখলাম, ধবধবে সাদা একটা কাপড় পরে এসেছে, মুখে একটু একটু হাসি। আমাকে জিজ্ঞেস করল, কী জোবেদা! নাতনিকে পেয়ে আমাকে ভুলে গেছ! আমি বললাম, ওমা! এটা কী বলছ? তোমাকে আমি ভুলব কেমন করে? তোমার শরীরটা ভালো? তোমার নানা বলল, হ্যাঁ ভালো। আমাকে বলল, এক গ্লাস পানি দেবে বউ। আমি কলসি থেকে ঢেলে পানি দিলাম, সে এক চুমুক করে খায় আর আমার দিকে তাকিয়ে হাসে! তারপর ঘুম ভাঙল, দেখি ঘরের মাঝে কী সুন্দর ফুলের গন্ধ। বুঝলি রাশা, বুকের ভিতরটা একবারে ভরে গেল আমার।” নানি রাশার দিকে তাকিয়ে হাসলেন কিন্তু তার চোখ থেকে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল।
পরদিন অস্ট্রেলিয়া থেকে রাখার একটা চিঠি এলো। বিদেশি চিঠি তাই পিয়নকে বখশিশ দিতে হলো, রাশার চিঠিটা খুলতে ভয় হচ্ছিল, তারপরেও তাকে খুলতে হলো। চিঠির ভেতরে একটা কার্ড, একটা মাঠের মাঝে অনেকগুলো ক্যাঙারুর ছবি! সাথে আম্মুর লেখা একটা চিঠি, সেই চিঠিতে অস্ট্রেলিয়ার নানারকম বর্ণনা। দোকানগুলো কত সুন্দর, সেখানে কতরকম জিনিস পাওয়া যায়। রাস্তাঘাট কত পরিষ্কার, মানুষজন কত দ্র–এইসব নানা কথা লেখা। বাংলাদেশে এখন গরম কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় এখন শীতকাল সেটাও লেখা আছে। তার বাইরে কোনো কথা নেই। নিজের সম্পর্কেও নেই, রাশার সম্পর্কেও নেই। এটি যেন কোনো মেয়ের কাছে লেখা তার মায়ের চিঠি নয়, এটি যেন খবরের কাগজে লেখা একজন মানুষের চিঠি!
চিঠিটা পড়ে রাশার যেটুকু না মন খারাপ হলো তার থেকে অনেক বেশি লজ্জা হলো। কার জন্যে লজ্জা সেটা সে বুঝতে পারল না।
.
নৌকার ব্যবস্থা হওয়ার পর সবাই বেশ আগ্রহ নিয়ে স্কুলে যেতে শুরু করেছে। নৌকাতে কেউ বসে থাকে না, হয় বৈঠা বাইছে না হয় লগি দিয়ে ঠেলাঠেলি করছে। কাজেই ছোট নৌকাটা রীতিমতো বাইচের নৌকার মতো ছুটে যায়। শুধু তাই নয় নদীতে ওঠার পর নদীর একটা বাঁক মাঝে মাঝে শর্টকাট মেরে দেয়া হয়। নদীতীরে নৌকা চালানোর মতো যথেষ্ট পানি নেই, সেখানে হাঁটুপানি এবং কাদা, সেই অংশটাতে নৌকা থেকে নেমে ধাক্কা দিয়ে সেটাকে শুকনোর ওপর দিয়ে ঠেলে আবার নদীতে নামিয়ে দেয়া হয়। স্কুলে পৌঁছানোর পর তাদের গা, হাত, পা কাদা এবং পানিতে মাখামাখি থাকে, বই-খাতা ভিজে জবজবে হয়ে থাকে কিন্তু সেসব নিয়ে কেউ-ই খুব বেশি মাথা ঘামায় বলে মনে হয় না! বেশ চলে যাচ্ছে দিন। স্কুলে কম্পিউটার ল্যাবটা তৈরি হয়েছে, টেবিল-চেয়ার বসানো হয়েছে, এখন যে কোনোদিন কম্পিউটারগুলো চলে আসবে। রাশা খোঁজ নিয়ে জেনেছে চিঠি চালাচালি হচ্ছে।
দেখতে দেখতে বর্ষাকাল চলে এসেছে। প্রথম প্রথম বৃষ্টি হতো ছাড়াছাড়াভাবে। আজকাল একেবারে নিয়মিত বৃষ্টি হয়। আর সে কী বৃষ্টি, রাশা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। টিনের ছাদে যখন ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ে তার চাইতে সুন্দর কোনো শব্দ পৃথিবীতে হতে পারে কিনা রাশার জানা নেই। চারপাশের গাছপালাগুলো ঘন সবুজ। পাতাগুলো সতেজ আর পুরুষ্ট। যেদিকেই তাকায় মনে হয় মাটি ফেটে সবুজ লকলকে গাছ বের হয়ে আসবে। গাছগুলো যেন গাছ নয়, যেন এরা জীবন্ত প্রাণী। সামনের খাল পানিতে ভরে গেছে, সেখানে এখন রীতিমতো স্রোত, পানি খলখল শব্দ করে বয়ে যায়। সামনে তাকালে দেখা যায় আগে যেখানে মাঠ ছিল সৰ পানিতে ডুবে আছে, দেখে মনে হয় যেন একটা সমুদ্রের মাঝে নানি বাড়িটা ছোট একটা দ্বীপ।
যে জায়গা পানিতে ডোবেনি সেখানে কাদা। প্যাঁচপ্যাঁচে আঠালো কাদা, অনেক চেষ্টা করেও রাশা এই কাদাতে অভ্যস্ত হতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে সে বাড়ির ভেতরে আশ্রয় নিয়েছে। বাইরে যখন ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ে তখন সে জানালার কাছে বসে বৃষ্টি দেখতে দেখতে লেখাপড়া করে। জাহানারা ম্যাডাম তাকে যে বইগুলো পাঠিয়েছিলেন সে সেগুলো মাঝে মাঝে উল্টেপাল্টে দেখেছে। এখন সে সেগুলো পড়তে শুরু করেছে। প্রথম প্রথম একটু কঠিন লেগেছে, যখন সে ঠিক করে মনোযোগ দিয়েছে হঠাৎ করে সে একটা অন্যরকম মজা পেতে শুরু করেছে। গণিতের ভেতর যে এত বিচিত্র ব্যাপার লুকিয়ে ছিল সে জানত না। তার কাছে সবচেয়ে অবাক লাগছে পদার্থবিজ্ঞান, আইনস্টাইন তার স্পেশাল রিলেটিভিটি দিয়ে সময়ের এমন সব বিচিত্র ব্যাপার ঘটিয়ে ফেলেছেন যে সে পড়ে হতবাক হয়ে যায়। পড়েও তার বিশ্বাস হয় না, মানুষ যেভাবে ডিটেকটিভ বই পড়ে রাশা সেভাবে তার বিজ্ঞানের বইগুলো পড়ছে।
নানি তাকে দেখেন আর মাথা নেড়ে বলেন, “তোর রকমসকম বুঝি! একজন মানুষ দিন নাই রাত নাই মাথা গুঁজে পড়ে কেমন করে? এমন যদি হতো যে পরীক্ষা আছে তাহলেও বুঝতে পারতাম।”
রাশা বলে, “নানি তুমি আমার কাছে বসো। আমি তোমাকে স্পেশাল রিলেটিভিটি বোঝাই, তুমি অবাক হয়ে যাবে।”
নানি বললেন, “রক্ষা কর আমাকে অনেক কষ্ট করে মাথাটা একটু ঠিক করেছি। তুই এখন আবার পুরোটা আউলে দিবি?”
.
এর মাঝে একদিন একটা মজার ঘটনা ঘটল। ঘরে বসে ঘাড় খুঁজে গুঁজে লেখাপড়া করতে করতে একদিন রাশা আবিষ্কার করে তার সব খাতা শেষ হয়ে গেছে। বাজারে যাওয়া এখন সোজা কথা নয়, সে মতিকে কিছু টাকা দিয়ে বলল, কেউ যদি বাজারে যায় তাহলে তার জন্য যেন কয়টা খাতা কিনে নিয়ে আসে।
দুইদিন পর মতি চারটা খাতা এনে দিল। খবরের কাগজ দিয় মুড়ে সুন্দর করে বেঁধে-হেঁদে দিয়েছে। রাশা বাধন খুলে খাতাগুলো বের করল, খবরের কাগজটা ফেলে দিতে গিয়ে হঠাৎ সে থেমে যায়, সেখানে খুব পরিচিত একটা ছবি। একজন থুরথুরে বুড়ো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, তার মাথার উপর দিয়ে রকেট উড়ে যাচ্ছে, রকেটের মানুষটি কমবয়সী। থিওরি অব রিলেটিভিটি বর্ণনা করতে হলেই দুই ভাইয়ের এই কাহিনীটা থাকে, এক ভাই রকেটে করে ঘুরেফিরে এসে দেখে অন্য ভাই থুরথুরে বুড়ো হয়ে গেছে। রাশা আগ্রহ নিয়ে লেখাটি পড়ল, খবরের কাগজের বিজ্ঞানের পাতায় কোনো একজন থিওরি অব রিলেটিভিটি নিয়ে লিখেছে, রাশা পুরোটা পড়ল, বেশ ভালোই লিখেছে। যে লিখেছে সে কঠিন জিনিস সোজা করে লিখতে পারে!
রাশা খবরের কাগজটা উল্টায়, অন্য পৃষ্ঠায় খবরের কাগজের কোনায় বড় বড় করে লেখা, “সায়েন্স অলিম্পিয়াড” নিচে বিজ্ঞানের দশটি প্রশ্ন। এই দশটি প্রশ্নের উত্তর লিখে পাঠাতে হবে, যারা শুদ্ধ উত্তর দেবে তাদের নিয়ে ঢাকায় একটা জাতীয় অলিম্পিয়াড হবে। তবে ছাত্র বা ছাত্রীরা প্রশ্নের উত্তরগুলো নিজে দিয়েছে সেটা স্কুলের হেডমাস্টারকে সত্যায়িত করে দিতে হবে। প্রশ্নের উত্তর দিতে একসপ্তাহ সময় দেয়া হয়েছিল, খবরের কাগজটি তিনদিনের পুরনো, উত্তর পাঠানোর জন্যে আর মাত্র চারদিন সময় বাকি আছে।
রাশা খবরের কাগজটা নিয়ে তার বিছানায় বসে পড়ে। প্রথম তিনটার উত্তর পানির মতো সোজা। পরের তিনটার উত্তরটা কেমন করে বের করতে হবে সে জানে তবে সে জন্যে তাকে কাগজ-কলম নিয়ে বসতে হবে। পরের চারটার উত্তর কী হবে সে সাথে সাথে বুঝতে পারল না। চিন্তা করতে হবে।
রাশা পেন্সিলটা কামড়াতে কামড়াতে চিন্তা করতে থাকে।
খেতে খেতে নানি জিজ্ঞেস করলেন, “কী এত চিন্তা করিস রাশা?”
“একটা মানুষ রকেটে করে মহাকাশে গেছে সেখান থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসার সময়—”
“তোর খেতে খেতে এটা চিন্তা করতে হবে?”
রাশা নানির দিকে তাকিয়ে বোকার মতো একটু হাসল, বলল, “মাথার মাঝে ঢুকে গেছে, বের করতে পারছি না।”
“বের করে ফেল। না হলে আমার মতো অবস্থা হবে। মাথা আউলে যাবে।”
রাশা হি হি করে হাসল, কিন্তু মাথা থেকে বের করতে পারল না, চিন্তা করতেই থাকল। খেতে খেতে সে এটা চিন্তা করল, খাওয়ার পর বাসনপত্র তুলে নানিকে সাহায্য করার সময় সেটা চিন্তা করল, দাঁত মাজার সময় চিন্তা করল, বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে চিন্তা করল, ঠিক যখন চোখে ঘুম নেমে আসছে তখন হঠাৎ সে তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে বসল! সমস্যাটা কেমন করে করতে হবে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো হঠাৎ করে সেটা সে বুঝতে পেরেছে। তখনই বাতি জ্বালিয়ে কাগজ-কলম নিয়ে বসে বসে তার অঙ্কটা করার ইচ্ছে করছিল কিন্তু সে করল না। নানি নিচে গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছেন, সে এখন বাতি জ্বালালে নানি উঠে পড়বেন। আগে নানি সারা রাত শুয়ে ছটফট করতেন, আজকাল শাস্তিতে ঘুমান, রাশা তাই তাকে একটুও ডিস্টার্ব করতে চায় না!
পরের পুরো দিনটা রাশা ভেবে ভেবে আরো দুটো অঙ্ক করে ফেলল, এখন বাকি আছে মাত্র একটা সেটা সে কিছুতেই করতে পারল না। যতবার চেষ্টা করেছে ততবার আটকে গেছে, তার কাছে মনে হছে নতুন একধরনের গণিত না জানলে সে মনে হয় এটা করতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত সে হাল ছেড়ে দিয়েছে, এখন পর্যন্ত যে কয়টা করতে পেরেছে সেগুলোই সে লিখে পাঠিয়ে দিবে। এটা বাজার থেকে কুরিয়ার করে পাঠাতে হবে, পাঠানোর আগে হেডমাস্টারের একটা সাইন নিতে হবে। হাতে মোটেই সময় নেই।
সকাল থেকে ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে, স্কুল বন্ধ তাই হেডমাস্টারকে তার বাসায় গিয়ে ধরতে হবে। এখন যদি রওনা দেয় তাহলে সবকিছু শেষ করে সন্ধে হওয়ার আগে ফিরে আসতে পারবে, তাই রাশা আর দেরি করল না, তখন তখনই বের হয়ে গেল।
জয়নব তার খালার বাড়ি গিয়েছে, মতির কোনো হদিস নেই, জিতুর জ্বর–কাঁথা মুড়ি দিয়ে কে কে করছে। রাশা এই গ্রামের আরো কিছু বাচ্চাকাচ্চাকে চিনে কিন্তু তাদের কাউকেই খুঁজে পেল না, যার অর্থ তার একাই যেতে হবে। সেটা এমন কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়, স্কুল যখন খোলা ছিল তখন সে এক-দুইবার একা একা নৌকা চালিয়ে গিয়েছে।
রাশা তাই একটা পলিথিনের ব্যাগের ভেতর তার কাগজপত্রগুলো ভরে নৌকা করে রওনা দিল। খালটা পার হয়ে সে বিলে এসে পড়ল, বিলের মাঝামাঝি দিয়ে পাড়ি দিয়ে ছোট নদীটাতে হাজির হলো। বর্ষায় পানিতে ছোট নদীটা অবশ্য এখন আর ছোট নেই বেশ ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। নদীর তীর ঘেঁষে রাশা তার ছোট নৌকাটা বেয়ে নিয়ে যায়। ব্রিজের কাছাকাছি এসে সে নদীটা পাড়ি দিয়ে অন্য পারে আসে, বাজারের গোড়ায় নৌকাগুলো থাকে, সেখানে সেটাকে বেঁধে ওপরে উঠে আসে। এই ঘাটে তাদের পরিচিত মাঝি আছে, কাজেই কেউ তার এই ছোট নৌকা নিয়ে চলে যাবে সেরকম আশঙ্কা নেই।
রাশা ভিজে চুপসে গেছে কিন্তু আজকাল সে এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। আগে সে জানত বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর হয়, এখানে এসে সে আবিষ্কার করেছে সেটা একেবারেই বাজে কথা। একজন মানুষ যতক্ষণ খুশি বৃষ্টির পানিতে ভিজতে পারে, তাতে কিছুই হয় না! এই দেশের বেশির ভাগ মানুষ বৃষ্টির পানিতে ভিজে ভিজে কাজ করে, সে জন্যে কারো জ্বর উঠে না, কারো শরীর খারাপ হয় না।
রাশা তাদের হেডমাস্টারের বাসায় এলো, বাসাটা সে চিনে কিন্তু আগে আসেনি! ভয় ছিল গিয়ে দেখবে হেডমাস্টার বাসায় নেই, তখন একটা মহাঝামেলা হয়ে যাবে, কিন্তু সে হেডমাস্টারকে পেয়ে গেল।
রাশাকে দেখে হেডমাস্টার চোখ কপালে তুলে বললেন, “সে কী? তুমি এরকম ভিজে ভিজে কোথা থেকে আসছ? কী ব্যাপার?”
রাশ হেডস্যারকে পুরো ব্যাপারটা বোঝাল, হেডস্যার পরিষ্কার বুঝতে পারলেন বলে মনে হলো না। খানিকক্ষণ মুখ হাঁ করে থেকে বললেন, “তুমি এই অঙ্কগুলো করে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আমার কাছে নিয়া আসছ আমাকে দিয়ে সাইন করানোর জন্যে?”
“জি স্যার।”
“তাহলে কী হবে?”
“তাহলে আমি যাদের কাছে পাঠাব তারা বুঝবে যে আসলে আমিই সেগুলো করেছি, অন্য কেউ আমাকে করে দেয় নাই।”
“তাতে লাভ?”
“যারা করতে পারবে তাদের ডেকে একটা অলিম্পিয়াড হবে। সায়েন্স অলিম্পিয়াড। বিজ্ঞানের অলিম্পিয়াড!”
“সেটা কী জিনিস?”
রাশা মাথা চুলকাল, “আমি ঠিক জানি না স্যার।”
“তুমি ঠিক জানো না?”
“না স্যার।”
“না জেনেই তুমি এইসব করছ?”
“আমার মনে হয় একটা পরীক্ষার মতো কিছু হবে।” হেডমাস্টার ভুরু কুঁচকালেন, “বৃত্তি পরীক্ষা?”
“হতে পারে স্যার। বৃত্তি পরীক্ষার মতো কিছু একটা হতে পারে।”
হেডমাস্টার তখন কাগজগুলোতে সাইন করে দিলেন। তার বাসাতেই সিল ছিল, সাইনের নিচে সিলও মেরে দিলেন। রাশ হেডমাস্টারের বাসা থেকে বের হয়ে একটা কুরিয়ারের দোকানে গেল, সেটা যেন কালকেই পৌঁছে দেয় সেটা নিয়ে খানিকক্ষণ অনুরোধ করে সে খবরের কাগজের ঠিকানায় তার অঙ্কগুলো কুরিয়ার করে দিল।
সেখান থেকে বের হয়ে সে একটা দোকান থেকে তার নানির জন্যে একটা নারকেল তেলের ছোট বোতল কিনল। নিজের জন্যে কিনল আরো কয়েকটা খাতা আর দুইটা বলপয়েন্ট কলম। তার নানি কারণে-কারণে তাঁর মাথায় নারকেল তেল মাখেন, নানির ধারণা মাথায় নারকেল তেল মাখলে মাথা ঠাণ্ডা থাকে। তাই সুযোগ পেলেই রাশা নানির জন্যে নারকেল তেল কিনে নিয়ে যায়।
খাতা, কলম আর নারকেল তেলের বোতলটা নিয়ে সে তার নৌকায় বসে বাড়িতে রওনা দেয়। ব্রিজের কাছাকাছি এসে নদীটা পার হয়ে তীর ঘেঁষে সে নৌকা বাইতে থাকে। এতক্ষণ ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছিল, এখন ঝমঝম করে বৃষ্টি হতে থাকে। নদীর পানিতে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো একটা বিচিত্র শব্দ তৈরি করছে। রাশা দ্রুত বৈঠা টানতে থাকে, নদীর তীরে তীরে ছোট ছোট গ্রাম, সেখানে মানুষজন থাকে। যখন সে বিলের মাঝে ঢুকবে তখন সেখানে কোনো জনমানুষ থাকে না। পুরো বিলটা আড়াআড়িভাবে পার হতে হবে, জিতু যখন থাকে তখন সারাক্ষণই সে এই বিল নিয়ে বিচিত্র সব ভৌতিক ইতিহাস বলতে থাকে। রাশা মোটেও সেগুলো বিশ্বাস করে না কিন্তু এই মুহূর্তে তার সবগুলো গল্প মনে পড়ে গেল। ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে, তার মাঝে রাশা ছোট খালটা দিয়ে বিলের মাঝে এসে ঢুকল। যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। বৃষ্টির জন্যে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না, এখন সে জানে কোনদিকে যেতে হবে, একটু পর যখন কোনোদিক তীর দেখা যাবে না তখন সে কেমন করে বুঝবে কোনদিকে যাবে? যদি এই বিলে সে হারিয়ে যায়? যদি অন্ধকার নেমে আসে? যদি এই বিল থেকে সে আর কোনোদিন বের হতে না পারে? রাশার বুকের ভেতরটা হঠাৎ ধক করে ওঠে।
আড়াআড়ি বিলটা পার হতে হবে, রাশা যতটুকু সম্ভব সোজা নৌকা চালিয়ে নিতে থাকে। সে চেষ্টা করে যেন নৌকার মাথাটা ডানে-বাঁয়ে ঘুরে যায়। তাহলে জনমানবহীন এই নির্জন বিলটাতে সে আটকা পড়ে যাবে। যদি বৃষ্টি না থাকত তাহলে দূরে গ্রামগুলো দেখা যেত, কোনো সমস্যা হতো না।
ঠিক এরকম সময় সে ঝুনঝুন একটা শব্দ শুনল, মনে হলো কেউ যেন নূপুর পায়ে নাচছে, রাশা ভয়ানক চমকে উঠেছিল, ঠিক তখন সে দেখল কিছু একটা ভেসে ভেসে তার দিকে আসছে। চার কোনায় চারটা লাল পতাকা, ভেতরের অংশটা রঙিন কাপড় দিয়ে ঘিরে রাখা। রাশা কৌতূহলী হয়ে তাকাল, চোখ থেকে বৃষ্টির পানি সরিয়ে ভালো করে দেখে বুঝল এটা আসলে একটা ভেলা। ভেলায় কেউ নেই কিন্তু সেটা সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এর মাঝে নিশ্চয়ই ঘণ্টা বেঁধে রাখা হয়েছে, বাতাসে সেগুলো ঝুনঝুন শব্দ করে নড়ছে।
রাশা তার নৌকাটা ভেলাষ্টার কাছে নিয়ে যায়, ভেলাটাকে ধরে সে উপরে তাকাল এবং সাথে সাথে ভয়ঙ্কর আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল। ভেলার উপর একটা মেয়ের মৃতদেহ। রাশা এর আগে কখনো একটা মৃতদেহ দেখেনি, কিন্তু তবু তার বুঝতে একটুও দেরি হলো না যে এটা একটা মৃতদেই। মেয়েটিকে সুন্দর কাপড় পরে সাজিয়ে দেয়া হয়েছিল বৃষ্টির পানিতে সব ভেসে গেছে। মেয়েটার চোখ অল্প একটু খোলা, মুখের, ফাঁক দিয়ে দাঁতগুলো দেখা যাচ্ছে। মনে হয় এক্ষুণি উঠে বসবে। রাশা ভেলাটাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে নৌকাটাকে প্রাণপণে বাইতে শুরু করে কিন্তু সে অবাক হয়ে লক্ষ করল ভেলাটা তার নৌকার পিছু পিছু আসতে শুরু করেছে। রাশা ভয়াবহ আতঙ্কে কাঁপতে থাকে, তার মনে হতে থাকে এক্ষুণি বুঝি মৃতদেহটা ভেলার মাঝে উঠে দাঁড়াবে, তারপর মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে খলখল করে হাসতে শুরু করবে। কিংবা খপ করে তার নৌকাটা ধরে ফেলবে, তারপর তার নৌকায় উঠে বসবে। রাশা জানে একটা মৃতদেহ কখনোই সেটা করতে পারবে না কিন্তু তারপরেও একধরনের অবর্ণনীয় ভয়ে সে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সমস্ত শক্তি দিয়ে নৌকাটা বাইতে থাকে।
তার পিছনে তাকাতে ভয় হচ্ছিল, সে শুনতে পেল ঘণ্টার ঝুনঝুন শব্দটা আস্তে আস্তে কমতে কমতে মিলিয়ে গেল। তখন সে ভয়ে ভয়ে পিছনের দিকে তাকাল, দেখল বহুদুরে ভেলাটি ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে! কী আশ্চর্য। কী ভয়ঙ্কর।
রাত্রিবেলা রাশা আজ তার নানিকে ধরে ঘুমাতে গেল। নানি তার গায়ে-মুখে আয়াতুল কুরসি পড়ে ফুঁ দিয়ে বললেন, “তোকে নিয়ে মাঝে মাঝে চিন্তাতেই পড়ে যাই রে।”
রাশ মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিকই বলেছ নানি। আমিও মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে যাই!”
“তোর একা একা এই বিল পাড়ি দেয়ার দরকারটা কী পড়েছিল?”
“আমি একা একা যেতে চাচ্ছিলাম না, কাউকে পেলাম না তাই একাই গেলাম।”
“আর যাবি না।”
“ঠিক আছে নানি। আর যাব না।”
“পৃথিবীতে কত রকম বিপদ হতে পারে।”
“নানি, একটা মরা মানুষ আর কী করবে?”
“আমি মরা মানুষকে ভয় পাই না। আমি ভয় পাই জ্যান্ত মানুষকে। পৃথিবীতে কত বজ্জাত মানুষ আছে তুই জানিস?”
“একটু একটু জানি।”
“কাজেই সাবধান থাকবি।”
“থাক নানি।”
রাশা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “নানি।”
“কী হলো?”
“ঐ মেয়েটাকে ভেলায় করে ভাসিয়ে দিয়েছে কেন?”
“মেয়েটাকে নিশ্চয়ই সাপে কামড়েছে। সাপে কামড়ালে এভাবে ভেলায় করে মরা মানুষটাকে ভাসিয়ে দেয়।”
“কেন নানি?”
“তারা বিশ্বাস করে মরা মানুষটা ভেলায় করে সাপের ওঝার বাড়ির ঘাটে এসে লাগে। ওঝা তখন মানুষটাকে বাঁচিয়ে তোলে।”
“এটা কেমন করে হবে? মরা মানুষ কী বাঁচতে পারে?”
নানি একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “পারার কথা না। তবু আপন মানুষেরা এটা বিশ্বাস করতে চায়। মৃত্যুকে কেউ মেনে নিতে পারে না। কেউ না।”
নানি হঠাৎ চুপ করে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
.
গভীর রাতে রাশা চমকে ঘুম থেকে জেগে উঠল। তার মনে হলো, ভেলার মাঝে ভেসে থাকা মেয়েটি উঠে তার হাত ধরে টানছে, বলছে, “আমায় ফেলে চলে এসেছিস কেন? আয় আমার সাথে। আয়।”
রাশা নানিকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে শুয়ে রইল।