১৩. যখন জন্মদিনের উপহার

১৩. যখন রাহেলা খাতুনকে তার জন্মদিনের উপহার দেওয়া হলো।

রাহেলা আমার আদরের রাহেলা

তুমি এই চিঠি পড়ছ তার মানে কী জান? তার মানে হচ্ছে আমি আর বেঁচে নাই। তার মানে হচ্ছে এই পৃথিবীতে তুমি একলা। দেশটা কী স্বাধীন হয়েছে? মনে হয় হয়েছে। এই দেশ স্বাধীন না হয়ে যায় না। তোমার পেটে যে বাচ্চাটা ছিল তার কী জন্ম হয়েছে? তার কী নাম রেখেছ?

মাসুদ, মিলি আর মতিন কতো বড় হয়েছে? মিলিটা কিন্তু খুবই দুষ্টু, তারে একটু দেখে শুনে রেখো।

তোমার নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট হচ্ছে। একলা একলা তুমি কেমন করে সংসার চালাবে? আমার ছেলেমেয়েগুলোরও নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছে। ওদেরকে বলো এই দেশের মানুষের অনেক কষ্ট হয়েছে। রাহেলা তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না আমি কী দেখেছি। ছেলেমেয়েগুলোর তুমি মানুষ করো ওদেরকে বলল ওরা যেন তার বাপকে মাপ করে দেয়। আমি জানি কষ্ট হলেও তুমি আমার ছেলেমেয়েগুলোর মানুষ করবা। তোমার অনেক তেজ আছে আমি জানি। ছেলেমেয়েরা যখন বড় হবে তাদের বিয়েশাদী হবে বাচ্চা কাচ্চা হবে তাদের আর কষ্ট করতে হবে না। তখন দেশ স্বাধীন থাকবে। থাকবেই থাকবে।

রাহেলা গো রাহেলা। তোমার কথা খালি মনে হয়। আমি ভুলতে পারি না। খালি মনে হয় যদি এক হাতে বাচ্চাগুলোরে আরেক হাতে তোমারে একবার ধরতে পারতাম তাহলে আর কিছুর দরকার নাই। কিছুর দরকার নাই।

খোদা আমারে আগে নিয়া গেল। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব। তুমি আস। ধীরে সুস্থে আস। বাচ্চাগুলোরে বড় করো। নাতি-নাতনিদের সাথে থাকো। তারপর যখন সময় হবে তখন আসো আমার কাছে। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব। তোমার সাথে আমার কতো কী বলার আছে। তোমারও নিশ্চয়ই আমারে কতো কী বলার আছে। আছে না?

ভালো থেকো ভালো থেকো ভালো থেকো।

 সবাইরে নিয়ে ভালো থেকো।

দেশটারে নিয়ে ভালো থেকো। দেশের মাটিটারে নিয়ে ভালো থেকো।

আসাদ

.

রাহেলা খাতুন চিঠিটা পড়ে সেটা খুব সাবধনে সেটার ওপর হাত বুলালেন, যেন এটা একটা জীবন্ত মানুষ। যেন এটাকে আদর করা যায়। বুকে চেপে ধরা যায়। চিঠির এক কোণায় কালচে রং। একসময় এটা নিশ্চয়ই রক্তের দাগ ছিল এতদিনে বিবর্ণ হয়ে কালচে হয়ে গেছে। রাহেলা খাতুন সেই রক্তের চিহ্নটার ওপর হাত বুলালেন। তারপর খুব সাবধানে চিঠিটা ভাজ করলেন, প্লাস্টিকের প্যাকেটের ভেতর ঢোকালেন। তারপর খুব সাবধানে আসাদ রহমানের কবরের সবুজ ঘাসের উপর রাখলেন। তারপর শাড়ির আঁচলটা টেনে এনে নিজের সুখ ঢাকলেন তারপর আকুল হয়ে কাঁদতে লাগলেন।

তার পাঁচ নাতি-নাতনি তার চারপাশে বসে আছে। তারা কখনো তাদের দাদিকে তাদের নানিকে কাঁদতে দেখে নাই। তাদের হাসি খুশি দাদি, হাসি খুশি নানির চোখে যে পানি আছে তারা কখনো সেটা জানতো na। রিতু তিতু টিটন টিয়া আর দুষ্টু মিঠুন শক্ত করে রাহেলা খাতুনকে ধরে রাখল।

নদীর তীরে তখন অনেক মানুষ। অনেক অনেক মানুষ। তারা সবাই আসতে চায়। মাস্টার সাহেব তাদের ঠেকিয়ে রেখেছেন। এখন শুধু তার আপন জনেরা এখানে। রাহেলা খাতুন তার ছেলেমেয়ে, তার বউ জামাই তার নাতি-নাতনি।

আসাদ রহমানের কবরের ওপর একটা বকুলগাছ। বাতাসে তার পাতাগুলো নড়ছে। টুপ করে একটা ফুল কবরের ওপর ঝরে পড়ল। যেন একজনের এক ফোঁটা চোখের পানি। কার চোখের পানি?

Leave a Reply to Ismail Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *