০৫. যখন সমস্যার শুরু

৫. যখন বাচ্চাদের অপেক্ষা শেষ হয়েছে কিন্তু যখন সমস্যার মাত্র শুরু।

ছয়দিন পর সকাল বেলা রিতু তিতু তার আম্মু আব্দুর সাথে নাস্তা করছে তখন তার আব্ব তার টেলিফোনটা দেখতে দেখতে হঠাৎ থেমে গিয়ে বললেন, রিতু তোর জন্যে একটা এস.এম.এস।

রিতু খাওয়া থামিয়ে তার আব্দুর দিকে তাকালো, আমার জন্যে?

 হ্যাঁ, মুশতাক নামে একজন লিখেছে আর্ট ক্লাস ক্যান্সেলড।

রিতু এবং তিতু এক সাথে গগন বিদারী চিৎকার করে উঠল, আর্ট ক্লাশ ক্যান্সেলড!

রিতুর আম্মু আব্ব খুবই অবাক হলেন। আর্ট ক্লাশ বাতিল হওয়ার জন্যে তারা আগে কখনো কাউকে এত উত্তেজিত হতে দেখেননি। জিজ্ঞেস করলেন, কী হলো?

রিতু লাফ দিয়ে তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে, আর্ট ক্লাশ ক্যান্সেলড, আর্ট ক্লাশ ক্যান্সেলড বলে চিৎকার করতে করতে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল, আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছিস?

অন্যদের বলে আসি। বলে রিতু ঘর থেকে বের হয়ে গেল, পিছন পিছন তিতু।

আম্মু আর আব্ব কিছুই বুঝতে পারলেন না। শুধু যে রিতু তিতুর আম্মু আব্ব কিছু বুঝতে পারলেন না তা নয় রাহেলা খাতুনের জন্য ছেলে মেয়েরাও কিছু বুঝতে পারলেন না, শুধু অবাক হয়ে দেখলেন আর্ট ক্লাস বাতিল হয়ে গেছে শুনে বাসার সবগুলো বাচ্চা চিৎকার করে ছোটাছুটি করতে লাগল। তারা কারণটা কী জানার জন্যে চেষ্টা করতে পারত কিন্তু এই বাসার এতরকম বিচিত্র ঘটনা ঘটে যে এটাকে সে রকম একটা বিচিত্র ঘটনা বোঝার কোনো কারণ নাই।

.

বিকেল বেলা আবার পাঁচ ভাই বোনকে রাহেলা খাতুনের মেয়ে মিলির কাছে দেখা গেল। রিতু বলল, আম্মুআব্দুর বাসায় আসতে দেরী হবে সেই জন্যে তোমার কাছে এসেছি।

মিলি পরীক্ষার খাতা দেখছিল, চশমাটা ঠেলে নাকের উপরে তুলে বলল, কী ব্যাপার? এক সাথে একেবারে পাঁচজন হাজির?

মিঠুন বলল, থ্যাংকু।

কেন? মিলি জানতে চাইল, থ্যাংকু কেন?

তুমি আমাদের পঞ্চ তাণ্ডব বল নাই সেই জন্যে। আমরা যখন বড় চাচ্চুর কাছে গিয়েছিলাম, বড় চাচ্চু আমাদেরকে পঞ্চ তাণ্ডব বলেছিল।

নিশ্চয়ই টাকা পয়সার জন্যে এসেছিস। কত চাই এবং কেন চাই? টিটন বলল, কত চাই বলা যাবে কিন্তু কেন চাই বলা যাবে না।

মিলি বলল, কেন টাকা দিতে হবে না জানা পর্যন্ত আমি টাকা পয়সা দিতে রাজী না।

রিতু বলল, ঠিক আছে, রিকশা ভাড়া।

মিঠুন বলল, আর ফুচকা।

রিকশা করে কই যাবি?

 সেটা বলা যাবে না।

গন্তব্য না জানা পর্যন্ত রিকশা ভাড়া দেওয়া যাবে না।

তিতু বলল, আম্মু, আমরা খুবই ভালো একটা জায়গায় যাব, তুমি যদি শোনো তাহলে অবাক হয়ে যাবে।

গুন্ডা। আমি শুনতে চাই, আমি অবাক হতে চাই।

কিন্তু এটা এখন সিষ্ট্রেট। আমরা কাউকে বলছি না। বড় মামা না শুনেই রিকশা ভাড়া দিয়েছিল দিয়েছিল না?

সবাই জোরে জোরে মাথা নাড়ল। মিলি তবুও নরম হলো না, বলল ভাইজান বোকা সোকা মানুষ, সবকিছু বিশ্বাস করে। আমি এতো বোকা না।

রিতু বলল, আম্মু আমরা এক সময় তোমাদের সবাইকে বলব। তখন যদি তোমাদের মনে হয় আমরা ভুল জায়গায় গিয়েছি তখন তুমি তোমার টাকা ফেরৎ চাইতে পার। কিংবা আমাদেরকে যা ইচ্ছা শাস্তি দিতে পারবে।

মিঠুন বলল, ফাঁসি দিতে পারবে।

মিলি বলল, শুধু আমাকে বল, জায়গাটা কী সেফ?

একশ ভাগ সেফ। আমাদের প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আমাকে এই জায়গাটার কথা বলেছেন।

মিলি এবারে নরম হলো। তারপর জোর করে মুখ শক্ত করে বলল, অন্ধকার হওয়ার আগে ফিরে আসতে হবে। যদি এক মিনিট দেরি হয় তাহলে এর পর থেকে সব সিক্রেট প্রজেক্ট বন্ধ।

ঠিক আছে আম্মু। রিতুর কথার সাথে সাথে সবাই জোরে জোরে মাথা নাড়তে লাগল।

বাসা থেকে বের হওয়ার সময়, টিয়া একটা বই নিয়ে বের হলো, মিলা দেখলো, বইটার নাম যুদ্ধের শুরু যুদ্ধের শেষ। টিয়ার হাতে সব সময়েই কোনো-না-কোনো বই থাকে, কিন্তু এত মোটা একটা বই নিয়ে বের হতে দেখে মিলা কিছু একটা আন্দাজ করার চেষ্টা করল, খুব একটা লাভ হলো না।

.

মুশতাক আহমেদের বাসার দারোয়ান আজকে তাদের থামাল না। বরং হাসি হাসি মুখে বলল, যাও, স্যার বাসাতেই আছেন। মনে আছে তো, দুইতলা বাম দিকে।

বাচ্চারা বলল, জী, মনে আছে। থ্যাংকু।

দরজায় বেল বাজানোর পর আজকে একটা মেয়ে দরজা খুলে দিল। দেখে মনে হয় কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। টেবিলে মোশতাক আহমেদের সামনে বিশ একুশ বছরের একটা ছেলে বসে আছে, মুশতাক আহমেদ কিছু একটা বলছিলেন ছেলেটা শুনছিল। সবাইকে ঢুকতে দেখে মুশতাক আহমেদ কথা বন্ধ করে ওদের দিকে তাকালেন।

রিতু বলল, স্যার, আপনার এস.এম.এস পেয়ে চলে এসেছি।

গুড। কী খবর তোমাদের?

ভালো স্যার। আপনার এস.এম.এস পাওয়ার পর আরো অনেক বেশি ভালো।

আগেই বেশি আশা করে বসে থেকো না, দেখা যাক কী হয়। তোমরা একটু অপেক্ষা করো আমি এর সাথে একটা জরুরি কথা সেরে নিই।

ঠিক আছে স্যার। বলে সবাই খালি চেয়ারগুলোতে ভাগাভাগি করে বসল। মুশতাক আহমেদ ছেলেটার সাথে মামলা মোকদ্দমা নিয়ে কথা বলতে থাকলেন। কোথায় উকিল পাওয়া যাবে, কম টাকায় কীভাবে কাজ করা যায় এরকম কথাবার্তা।

কথা শেষ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে মুশতাক আহমেদ বাচ্চাদের দিকে তাকালেন।

রিতু জিজ্ঞেস করল, স্যার, আমাদের জন্যে কোনো খবর আছে?

একটু খানি খবর আছে, কিন্তু ঠিক তোমরা যেভাবে চাইছ সেরকম খবর এখনো নেই।

মানে?

তোমার নানা-কিংবা দাদা, যে এলাকাতে যুদ্ধ করেছেন আমরা সেই জায়গাটা মোটামুটি বের করেছি, কিন্তু ঠিক কোথায় মারা গেছেন বা তাকে কোথায় কবর দেওয়া হয়েছে, কিংবা আসলে কবর দেওয়া হয়েছেই কিনা সেটা এখনো বের করতে পারিনি।

টিটন জিজ্ঞেস করল, দাদা কোথায় যুদ্ধ করেছেন?

পঞ্চগড় জগদল রৌমারী ঐ এলাকায়।

মিঠুন টিয়ার পেটে চিমটি কেটে জিজ্ঞেস করল, এই জায়গাগুলো কোনখানে? পাকিস্তানে নাকি?

টিয়া পেটে হাত বুলাতে বুলাতে ফিসফিস করে বলল, ধুর গাধা। পাকিস্তানে কেন হবে? নর্থ বেঙ্গলে।

রিয়া জিজ্ঞেস করল, আপনি কেমন করে জায়গাটা বের করলেন?

মুক্তিযোদ্ধাদের লিস্ট আছে, কে কোথা থেকে ট্রেনিং নিয়েছে কে কোথায় যুদ্ধ করেছে। সেখানে নাম দিয়ে খুঁজেছি। অনেকে তালিকায় আছে, অনেকে তালিকায় নাই। যারা ঐ এলাকায় যুদ্ধ করেছে তাঁদের অনেকে যুদ্ধে মারা গেছে, অনেকে বয়স হয়ে মারা গেছে, অনেকে রোগে শোকে মারা গেছে, অনেককে আবার পরে মেরে ফেলেছে। যারা বেঁচে আছে তাঁদের সাথে আমাদের ভলান্টিয়াররা কথা বলেছে। সেই কথাবার্তা থেকে আমরা জেনেছি সেখানে আসাদ নামে একজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ছিল- তাই অনুমান করছি।

দুর্ধর্ষ যোদ্ধা? আমার নানা দুধর্ষ যোদ্ধা ছিলেন?

মুক্তিযোদ্ধা মানেই দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। তোমার নানা-

মিঠুন বাধা দিয়ে বলল, এবং দাদা।

হ্যাঁ এবং দাদা তার মাঝে আলাদাভাবে সাহসী যোদ্ধা ছিলেন। যার নাম আসাদ সে তো সাহসী হবেই। আসাদ নামের মানে জানো তো?

টিয়া মাথা নাড়ল, জী, সিংহ।

হ্যাঁ। কাজেই তাঁর সিংহের মতো সাহস ছিল। এখন পর্যন্ত আমরা যেটুকু জানি সেটা হচ্ছে তোমার নানার দলটা সেখানে অক্টোবরের শুরু থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি যুদ্ধ করেছে। প্রচণ্ড যুদ্ধ। পাকিস্তানি আর্মিকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে। তারপর দলটা দক্ষিণে সরে এসেছে। আমরা ডিটেল্স এখনো জানি না।

তিতু জিজ্ঞেস করল, কীভাবে জানব আমরা? কীভাবে জানব?

এই জায়গাটা একটুখানি ট্রিকি। ঐ এলাকাতে গিয়ে খোঁজাখুজি করতে হবে। একজন মুক্তিযোদ্ধার খোঁজ পেয়েছি, তার নাম হচ্ছে ইদরিস। ইদরিস মিয়া। তাকে খুঁজে বের করতে হবে। সে তোমার নানার সাথে ছিল। সে তোমার নানার খবর দিতে পারবে। কিন্তু মুশকিল হলো- মুশতাক আহমেদ মুশকিলের কথাটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন।

সবাই ধৈৰ্য্য ধরে অপেক্ষা করল এবং মুশতাক আহমেদ শেষ পর্যন্ত বললেন, মুশকিল হচ্ছে ইদরিস মিয়াকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সে ঐ এলাকাতেই আছে, কিন্তু কোথায় আছে কেউ জানে না। কয়েকটা গ্রাম আছে সেখানে, তার মাঝেই থাকার কথা। কোনো কিছু নিয়ে তার ভিতরে অনেক বড় ক্ষোভ কিংবা দুঃখ তাই সে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছে। সবার চোখের আড়ালে চলে গেছে। তাকে যদি খুঁজে বের করতে পারি আমার ধারণা আমরা তোমাদের নানার,–কিংবা দাদার খোঁজ পেয়ে যাব।

টিটন জানতে চাইল, আমরা কেমন করে ওনার খোঁজ পাব?

ওখানে যেতে হবে। আমাদের ভলান্টিয়ার টিম সেখানে গিয়ে খুঁজে বের করবে?

কখন যাবে তারা?

সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন। আমাদের অনেক ভলান্টিয়ার। স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির ছেলে মেয়েরাই বেশি। তারা নানারকম কাজ করে। মুশতাক আহমেদ তার ঘরের ছেলেটিকে এবং মেয়েটিকে দেখিয়ে বললেন, এই যে, এই দুইজন ভলান্টিয়ার। একটু পরে আরো কয়েকজন আসবে। সবাই কাজ করে যাচ্ছে। এরকম একটা টিম যাবে, ওখানে থেকে খুঁজে বের করবে। কিন্তু

রিতু সোজা হয়ে বসে বলল, কিন্তু কী?

কিন্তু এই মুহূর্তে সবাই ব্যস্ত। এই সরকার এসে আমাদের বিপদে ফেলে দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে মামলা মোকদ্দমা দিয়ে তাদের জীবনটা নষ্ট করে দিচ্ছে। অনেককে জেলে পাঠিয়েছে। অনেকের চাকরি বাকরি নেই। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ। কাজেই তাদেরকে সাহায্য করতে করতে পুরো এনার্জী চলে যাচ্ছে। আমাদের কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। মাস দুয়েক পরে আমরা একটু ফ্রি হব। তখন মনে হয় ইদরিস মিয়াকে খুঁজে বের করতে পারব।

বাচ্চারা সবাই একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল। রাহেলা খাতুনের জন্মদিন ততদিনে পার হয়ে যাবে। তারা ঠিক করে রেখেছিল এটা হবে নানির জন্মদিনের ওপরে।

ছেলেমেয়েদের মুখ দেখে মুশতাক আহমেদ বুঝতে পারলেন, জিজ্ঞেস করলেন, ততদিনে তোমার দাদির জন্মদিন চলে আসবে?

জি, জি- সবাই জোরে জোরে মাথা নাড়ল।

রিতু বলল, দাদির জন্মদিন সামনের মাসের একুশ তারিখ। আমরা এর আগে বের করতে চাচ্ছিলাম।

মুশতাক আহমেদ চেয়ারে হেলান দিয়ে দাড়ির ভেতর আঙুল দিয়ে বিলি কাটতে কাটতে চিন্তা করতে লাগলেন। ঠিক তখন টিয়া বলল, রিতু আপু?

কী হলো?

আমরা কী ঐ জায়গাতে গিয়ে ঐ মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে বের করতে পারি না?

রিতু অবাক হয়ে বলল, আমরা?

হ্যাঁ। আমরা।

মিঠুন হাত ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ইয়েস।

টিটন বলল, টিয়া ঠিকই বলেছে, আমরা ঐ গ্রামে গিয়ে খুঁজে খুঁজে বের করে ফেলব।

শুধু তিতু লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, দিবে না! আমাদের যেতে দিবে না।

টিয়া বলল, আমরা স্যারের ভলান্টিয়ার হয়ে যাব। বাসায় গিয়ে বলব, আমরা মুক্তিযুদ্ধের ওপর গবেষণা করব।

রিতু চুপ করে চিন্তা করল, তারপর বলল, সেটা একটা আইডিয়া হতে পারে। তারপর মুশতাক আহমেদের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার, আমরা কী ভলান্টিয়ার হতে পারি?

মুশতাক আহমেদ বললেন, যে কেউ ভলান্টিয়ার হতে পারে। তোমরা বয়সে একটু ছোট, কিন্তু কে বলেছে বয়স কমে হলে মুক্তিযুদ্ধের ভলান্টিয়ার হতে পারবে না। কম বয়সে যদি মুক্তিযুদ্ধ করা যায় তাহলে ভলান্টিয়ারও হওয়া যায়।

টিয়া বলল, আমরা শুধু স্যারের কাছ থেকে একটা চিঠি নিয়ে যাব। স্যার লিখে দিবেন আমরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণার ভলান্টিয়ার।

মুশতাক আহমেদের ঘরে যে মেয়েটি তাদের দরজা খুলে দিয়েছিল, সে বলল, স্যার যদি রাজি থাকেন তাহলে আমি তোমাদের ভলান্টিয়ার কার্ড তৈরি করে দিতে পারি।

সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠল। মুশতাক আহমেদ হেসে বললেন, অবশ্যি তৈরি করে দাও। লেমিনেটিং করে দিও যেন দরকার হলে গলায় ঝুলিয়ে ঘুরতে পারে। সবাই দেখুক আমাদের কত ছোট ছোট ভলান্টিয়ার আছে।

বাসায় ফিরে আসার আগে টিয়া তার বইটিতে মুশতাক আহমেদের অটোগ্রাফ নিয়ে এল।

.

সেদিন রাত্রি বেলাতেই পাঁচ ভাইবোনের দলটি তাদের গলায় ভলান্টিয়ারের লেমিনেটিং করা কার্ড নিয়ে তাদের বাবা মা চাচা চাচি মামা মামির কাছে। যাওয়া শুরু করল।

প্রথমে গেল রাহেলা খাতুনের সবচেয়ে বড় ছেলে মাসুদের কাছে, বাচ্চাদের এই বড় চাচা কিংবা বড় মামাকে তাদের নানা ধরনের আবদার খুব সহজে মেনে নেন। সেইজন্যে তাকে নিয়ে তারা শুরু করল। কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রামে কোনো এক মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে বের করে তার ইন্টারভিউ নেওয়ার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা দায়িত্ব পেয়েছে বিষয়টা খুব ভালো করে বোঝানোর পর তারা এক সপ্তাহের জন্যে সেই গ্রামে থাকার অনুমতি চাইল।

কারো বাবা, কারো বড় চাচা এবং কারো বড় মামা মাসুদ সব কিছু শুনে গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলল, কাজটি খুবই মহৎ সন্দেহ নাই, কিন্তু এটি তোদের উপযোগী কাজ নয়। তাছাড়া একজন মানুষের ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য পাঁচজন যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তোরা কী প্রশ্ন করতে চাস একটা কাগজে লিখে দে, আমি অফিস থেকে একজনকে পাঠিয়ে দেই, সে উত্তরগুলো লিখে আনবে।

টিটন বলল, কিন্তু আব্ব কিন্তু কিন্তু

তারপর কী বলবে বুঝতে পারল না। টিয়া বলল, আগে সেই মুক্তিযোদ্ধাটাকে খুঁজে বের করতে হবে।

একটা গ্রামে কাউকে চিনিস না জানিস না সেইখানে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে তোরা খুঁজে বের করবি? তোরা?

খুবই সহজ একটা বাক্য কিন্তু বড় চাচা এমনভাবে সেটা বলল যে শুনে মনে হলো আসলেই এটা বুঝি খুবই অবাস্তব এবং হাস্যকর একটা কাজ।

বড় চাচা মাসুদের সাথে কথা বলার সময় বড় চাচি সীমা এসে এক সাথে সবাইকে দেখে বলল, কী হচ্ছে এখানে? কীসের ষড়যন্ত্র?

টিয়া মুখ গম্ভীর করে বলল, মোটেই ষড়যন্ত্র না আম্মু। আমরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করতে চাচ্ছি।

টিয়ার মুখ থেকে সবকিছু শুনে সীমা ফিক করে হেসে ফেলল। তারপর বলল, তোরা একা একা গ্রামে গিয়ে থাকবি? রাত্রে শেয়ালের ডাক শুনে যখন ভয়ে চিৎকার করতে থাকবি, তখন তোদের দেখে রাখবে কে?

টিটন গম্ভীর হয়ে বলল, আমরা মোটেও শেয়ালের ডাক শুনে ভয়ে চিৎকার করব না।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা কত গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার তবুও বড় চাচি পুরো ব্যাপারটা নিয়ে খিল খিল করে হাসতে থাকলেন, কোনো গুরুত্বই দিলেন না।

বড় চাচা এবং বড় চাচির সাথে কথা বলাটা পুরোপুরি বৃথা যাওয়ার পর তারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। তারপরেও তারা অন্যদের সাথে একটু চেষ্টা করল কিন্তু কোনো লাভ হলো না। রিতু তিতুর আম্মু মিলা বলল, এর চাইতে আমি প্লেনের টিকেটের ভাড়া দিই, ঐ মুক্তিযোদ্ধাকে এখানে নিয়ে আয়। বাসায় থাকবে, যত খুশি ইন্টারভিউ নিতে পারবি।

রিতু তিতুর আব্ব বলল, আমি খুবই হতাশ হলাম যে তোরা ভাবিস আমাদের কোনো দায়িত্ববোধ নেই, আমরা তোদেরকে এক সপ্তাহের জন্যে এভাবে একটা গ্রামে একা একা ছেড়ে দেব।

এরপর আর কারো সাথে কথা বলার আর কোনো উৎসাহ থাকার কথা না। তারপরও তারা মিঠুনের আব্ব আম্মুর সাথে একটু চেষ্টা করল। দুইজনেই ডাক্তার, দুইজনই ব্যস্ত তারপরও তারা একটা গ্রামে এক সপ্তাহ থেকে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে বের করে তার ইন্টারভিউ নেওয়ার বিষয়টা শুনল। মিঠুনের আব্দু গম্ভীর হয়ে বলল, যখন তোরা আরো বড় হবি, নিজের দায়িত্ব নিজেরা নিতে পারবি তখন দেখা যাবে।

মিঠুনের আম্মু বলল, মাথাটা খারাপ হয়েছে?

তখন বাকি থাকল শুধু ছোট চাচা কিংবা ছোট মামা তাকে পেতেই অনেক সময় লাগল। যখন তাকে পাওয়া গেল, তখন সে খুবই মনোযাগ দিয়ে একটা মোটা ইংরেজি বই পড়ছে। সবকিছু শুনে সে বলল, ও আচ্ছা, ভেরি গুড। ভেরি গুড।

তারপর আবার বইটা পড়তেই শুরু করল। যার মানে তারা কী বলছে সেটা ছোট চাচা কিংবা ছোট মামা ভালো করে শুনে নাই পর্যন্ত। অন্য সময় হলে যতক্ষণ ঠিক করে না শুনছে ততক্ষণ চেষ্টা করে তারা শুনিয়ে ছাড়তো, কিন্তু আজকে তাদের এতটাই মন খারাপ হলো যে তাদের সেটা করারও ইচ্ছা করল না।

পাঁচজন তাদের গলা থেকে লেমিনেটেড করা ভলাটিয়ার কার্ড খুলে মুখ কালো করে বসে রইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *