১০. যখন সবাই আতংকিত

১০. যখন টিটন আর মিঠুনকে কিডন্যাপ করে সবাইকে আতংকিত করে ফেলেছে

রিতু মনে মনে আশা করেছিল যে মিঠুন আর টিটন আসলে ইব্রাহীম চাচার সাথেই আছে, অশিক্ষিত একটা মানুষ মিছি মিছি তাদের ভয় দেখাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু যখন সে দেখল গেস্টহাউজ থেকে ইব্রাহীম চাচা একা লম্বা লম্বা পা ফেলে প্রায় ছুটে আসছে তখন সে বুঝল আসলে তারা সত্যি সত্যি বড় বিপদে পড়েছে। তাদের আল্লু আম্মুরা যে তাদের প্রথমে আসতে দিতে চাননি তার কারণটা এখন সে হঠাৎ করে বুঝতে পারে।

ইব্রাহীম রিতু তিতু আর টিয়ার কাছে এসে তাদের কাছ থেকে খবর নিল, তারপর ভুল বানানে লেখা অশিক্ষিত মানুষের চিঠিটা কয়েকবার পড়ল। রিতু দেখতে পেলো দেখতে দেখতে ইব্রাহীমের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। গ্রামের রাস্তায় মানুষজন খুব কম, যে কয়জন এসেছে ইব্রাহীম তাদের সবাইকে জিজ্ঞেস করল তারা আট বছর আর বারো বছরের দুইজন কমবয়সী ছেলেকে দেখেছে কী না। কেউ দেখেনি। কথা শেষ করে কোনো মানুষই চলে গেল না, তারা সবাই দাঁড়িয়ে রইল এবং দেখতে দেখতে গ্রামের অনেক মানুষের ভীড় হয়ে গেল। দুইজন বাচ্চাকে কিডন্যাপ করে অন্যদেরকে গ্রাম ছেড়ে চলে দেওয়ার জন্য হুমকি দিয়েছে ব্যাপারটা গ্রামের কোনো মানুষ মেনে নিতে পারছে না। গ্রামের মানুষেরা এটা তাদের গ্রামের জন্য একটা কলংক হিসেবে মনে করছে।

তখন তখনই কম বয়সী অনেকেই গ্রামের এদিকে সেদিকে গিয়ে টিটন আর মিঠুনকে খোঁজাখুজি শুরু করল। তবে বেশিরভাগ মানুষই কী করা উচিৎ ছিল সেই ব্যাপারে বড় বড় লেকচার দিতে থাকল। বয়স্ক কয়েকজন মানুষ এখন কী করা উচিৎ সেটা নিয়ে নিজেদের মাঝে কথা বলে ঠিক করল সবার আগে তাদের মাস্টার সাহেবের সাথে পরামর্শ করা দরকার। মাস্টার সাহেব এই গ্রামের মান্যগণ্য মানুষ, কাছাকাছি একটা প্রাইভেট কলেজে বাংলা পড়ান। তখন তখনই একজন মাস্টার সাহেবকে খবর দেওয়ার জন্য ছুটে গেল। অন্যরা রিতুদের নিয়ে মাস্টার সাহেবের বাড়ির দিকে রওনা দিল।

গাছের নিচে চায়ের দোকান এবং যেটা একই সাথে একটা মনোহারী দোকান। সেখানে গিয়ে দেখা গেল মাস্টার সাহেব এর মাঝে দোকানটাতে পৌঁছে গেছেন। মাস্টার সাহেবের চোখে চশমা এবং চুলে পাক ধরেছে। দোকানের বাঁশের মাচায় বসেছিলেন, রিতুদের দেখে উঠে এলেন। এর মাঝে তিনি পুরো ঘটনাটি শুনেছেন এবারে রিতুর মুখ থেকে আরেকবার শুনলেন, তারপর মুখ কঠিন করে বললেন, এইটা রাজাকার কমান্ডার আজহার আলীর কাজ।

ভীড় করে থাকা মানুষগুলো নিজেদের মাঝে কথা বলছিল হঠাৎ করে সবাই একেবারে চুপ করে গেল। মনে হয় একটা মশা উড়ে গেলেও শোনা যাবে। মাস্টার সাহেব চোখ থেকে চশমা খুললেন, তার পাঞ্জাবির কোনা দিয়ে চশমা পরিষ্কার করলেন তারপর থমথমে গলায় বললেন, আমি যখন কালকে খবর পেয়েছি ঢাকা থেকে কয়েকজন ছেলে মেয়ে এসে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজছে ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য তখনই মনে হয়েছে এই আজহার আলী এইটা নিশ্চয়ই পছন্দ করবে না। এই লোক আমাদের গ্রামে কিছু করতে দেয় না, কেউ একটা গান গাইলে ও বলে ইসলাম গেল ইসলাম গেল।

ভীড়ের অনেকে মাথা নাড়ল। কয়েকজন বিড় বিড় করে কিছু একটা বলল, কী বলল ঠিক বোঝা গেল না।

মাস্টার সাহেব আবার গম্ভীর গলায় বললেন, কালকেই আমার মনে হয়েছিল এই বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলারে একটু সাহায্য করি, গ্রামের মানুষ তাদের সাথে থাকি যেন কেউ কিছু করতে না পারে। কিন্তু তার আগেই দেখো কী হয়ে গেল।

রিতু অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকে রেখে বলল, এখন কী হবে?

মাস্টার সাহেব রিতুর মাথায় হাত রেখে বললেন, তুমি চিন্তা করো না মা। আমরা আছি। গ্রামের মানুষ মিলে আমরা তোমার ভাইদের খুঁজে বের করব।

ভীড় করে থাকা মানুষেরাও মাথা নাড়ল। গলা উঁচিয়ে বলল, খুইজা বার করুম। খোদার কসম।

মাস্টার সাহেব বললেন, মাথা গরম করে লাভ নাই। সবাই বের হয়ে যাও, ভাগাভাগি করে খুঁজতে থাকো। এই গ্রামের এক ইঞ্চি জায়গা বাকি রাখবা না। যদি খুঁইজা না পাই তখন আজহার আলীর বাড়িতে যাব। সবাই রেডি থেকো।

রেডি। আমরা রেডি।

যাও। খুঁজতে থাকো। দেরি করো না।

.

ততক্ষণে অবশ্য দেরি হয়ে গেছে। মতি আর খলিল মিলে মিঠুন আর টিটনকে আজাহার আলীর চিনির বস্তা বোঝাই মহাজনী নৌকার মাঝে আটকে ফেলেছে। গ্রামের মানুষ পুরো গ্রাম তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে কারো মাথায় আসে নাই নদীর মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা বড় বড় মহাজনী নৌকার মাঝে খুঁজে দেখা।

তবে কাজটা মোটেও সহজ হয় নাই। প্রথমত কথা ছিল শুধু মিঠুনকে নিয়ে আসা হবে। ভয় দেখানোর জন্য একটা বাচ্চাই যথেষ্ট। কিন্তু রিতু জোর করে মিঠুনের সাথে সাথে টিটনকে দিয়ে দেওয়ার জন্য মতি আর খলিলের হিসাবে একটু গোলমাল হয়ে গেছে। যে মানুষটা মিঠুন আর টিটনকে ইব্রাহীমের কথা বলে ডেকে নিয়ে গেছে সে এই গ্রামের কেউ না। এই গ্রামের মানুষ হলে তাকে চিনে ফেলতে পারে সেইজন্য অন্য গ্রাম থেকে মানুষ আনা হয়েছে।

যখন জঙ্গলের ভেতর শর্টকাট মারার কথা বলে প্রায় জোর করে টিটন আর মিঠুনকে রাস্তার পাশে জংলা জায়গায় ঢুকিয়ে দেওয়া হলো তখন মতি খপ করে মিঠুনকে আর খলিল টিটনকে ধরে ফেলল। তারা যেন শব্দ করতে পারে সেইজন্য প্রথমেই তাদের মুখ চেপে ধরা হলো। টিটন বেশি ছটফট না করলেও মিঠুন মতিকে ছেড়ে দিল না। লাথি কিল ঘুষি থেকে শুরু করে খামচি কিংবা টান মেরে লুঙ্গি খুলে ফেলা থেকে শুরু করে কামড় দিয়ে কবজি থেকে এক খাবলা গোশত তুলে ফেলা কিছুই বাকি থাকল না। হুটোপুটির সময় মিঠুন যে তার মুখের চিউয়িংগামটা মতির চুলে লাগিয়ে দিয়েছে মতি সেটা তখনো জানে না। শেষ পর্যন্ত খলিল একটা রামদা বের করে টিটনের বুড়ো আঙুল কোপ দিয়ে ফেলে দেবে ভয় দেখানোর পর মিঠুন শান্ত হলো।

মতি তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হাত বুলাতে বুলাতে পাশের গ্রামের ভাড়া করে আনা মানুষটাকে বলল, তোরে না কইলাম একজনরে আনতে, দুইজন আনলি কোন আক্কেলে?

আমি কী আনতে চাইছি? হেই মাতবর মেয়ে জোর করে পাঠাইছে।

খলিল ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল। একদিক দিয়া তো ভালোই হইছে। এইটার আঙুল কাইটা ফালামু বলার পর ইবলিশটারে ঠাণ্ডা করানো গেছে।

মতি তার কনুইয়ের ছাল ওঠা জায়গায় হাত বুলাতে বুলাতে মিঠুনের দিকে বিষ দৃষ্টিতে তাকাল। বলল সেইটা খুব ভুল কথা কইস নাই।

খলিল জিজ্ঞেস করল, এখন কী করুম?

আগে একটা চিঠি লেখ। সেই চিঠিটা ঐ ছেমড়ির হাতে দিতে হইবে। কে লিখব চিঠি?

খলিল বলল, আমার লেখাপড়া হয় নাই, চিঠিপত্র লেখার পারি না।

মতি বলল, একটা চিঠি লিখতে আর কতো লেখাপড়া জানতে হবে?

খলিল বলল, তয় তুমি লিখো না কেন?

 মতি বলল, লেখাপড়া করলে তো লিখেই ফেলতাম।

মিঠুন বলল, কাগজ দেন আমি লিখে দেই।

মানুষগুলো মিঠুনের কথা শুনে চোখ কপালে তুলে বলল, এই ছেমড়া তুমি যদি আবার মুখ খুলো দাঁত ভাইঙ্গা দিমু।

মিঠুনের আরো কিছু বলার ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু বলল না। পাশের গ্রামের মানুষটা বলল, ঠিক আছে কাগজটা দেও, আমি লিখে দেই।

তখন সে চিঠিটা লিখল, মিঠুন এবং টিটন বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনলো চিঠিতে কি লিখছে। লিখা শেষ হলে মিঠুন বলল, আমারে একটা কাগজ দিবেন? আমিও একটা চিঠি লিখি।

মতি আবার খেঁকিয়ে উঠল, বলল, খবরদার। কইছি না মুখ খুলবি না।

পাশের গ্রামের মানুষটা চিঠি এবং একটা লজেন্স নিয়ে চলে যাবার পর মতি আর খলিল টিটন এবং মিঠুনকে নিয়ে রওনা হলো। জংগলের ভিতর দিয়ে নদীর তীরে এসে ছোট একটা নৌকাতে মতি প্রথমে মিঠুনকে তুলে রওনা দিল। তাকে বলা হয়েছে সে যদি একটু চিৎকার করে সাথে সাথে টিটনের একটা বুড়ো আঙুল কেটে ফেলা হবে। টিটনের বুড়ো আঙুলের জন্যে মায়া করে মিঠুন চুপচাপ রইল। তা নাহলে সে মোটেও চুপ করে থাকার মানুষ না। মিঠুনকে আজহার আলীর মহাজনী নৌকায় শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে মতি নৌকা নিয়ে ফিরে এল, টিটনকে নৌকায় নিয়ে যাওয়া মোটামুটি সহজ হলো, তাকে ভয় দেখানো হলো একটু খানি শব্দ করা হলে মহাজনী নৌকায় মিঠুনের একটা আঙ্গুল কোপ দিয়ে কেটে ফেলা হবে। যদি কোনো গোলমাল না করে চুপচাপ বসে থাকে তাহলে ঘণ্টাখানেকের মাঝে তাদের দুজনকে ছেড়ে দেওয়া হবে এবং তখন সবাই মিলে ঢাকা চলে যেতে পারবে।

মহাজনী নৌকাতে দুইজনকে শক্ত দড়িতে বেঁধে পাটাতনের নিচে শুইয়ে রাখল। মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে রেখেছে যেন চিৎকার করতে না পারে। তারপর মতি আর খলিল ছোট নৌকাটাতে করে তীরে নেমে গেল।

যখন মতি বৈঠা বেয়ে তীরে যাচ্ছে তখন খলিল বলল, মতি তোর মাথায় কী?

 মতি মাথায় হাত দিয়ে মিঠুনের চটচটে চিউয়িংগামটা আবিষ্কার করে। এটাকে টেনে সরানোর চেষ্টা করল এবং যতই চেষ্টা করতে থাকল সেটা ততই ছড়িয়ে যেতে থাকল। নদীর পানিতে ধোওয়ার চেষ্টা করার পর সেটা আরও পাকাপাকি ভাবে চুলে লেগে গেল। তীরে নামার পর খলিল সেটাকে কেরোসিন তেল দিয়ে সরানোর বুদ্ধি দিল। একটু কেরোসিন তেল দেওয়ার পর মাথা থেকে এক ধরনের দুর্গন্ধ বের হওয়া ছাড়া অন্য কোনো লাভ হলো না। খলিল তখন তাকে একটা নাপিতের কাছে নিয়ে গেল। নাপিত পরীক্ষা করে বলল, চুল কেটে ফেলা ছাড়া এটাকে সরানোর কোনো উপায় নেই এবং যত দেরী করা হবে সেটা ততই তার মাথায় ছড়িয়ে যেতে থাকবে। মতি কেন তার মাথায় এই জিনিসটি লাগিয়েছে নাপিত দুর্বল ভাবে সেটা জানতে চেয়েছিল কিন্তু মতির প্রচণ্ড ধমক খেয়ে সে চুপ করে গেল।

মাথা থেকে এক খাবলা চুল চেছে ফেলার পর মতিকে অত্যন্ত অদ্ভুত দেখাতে থাকে। মতি মাথার অন্য অংশ থেকে চুল এনে এই অংশটা ঢেকে রাখার চেষ্টা করল কিন্তু কোনো লাভ হলো না। মতির ধমক খাওয়ার কারণে নাপিত আর কোনো পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করল না। তখন খলিল নিজেই বলল, মতি তুই বরং মাথাটা কামিয়েই ফেল।

মাথা কামিয়ে ফেলব?

এক খাবলা চুল নাই, দেখে মনে হয় চুরি করে ধরা পড়েছিস সেইজন্য কেউ জোর করে চুল কেটে দিয়েছে।

মতি শুনে মেঘ স্বরে বলল, চুপ কর হারামজাদা।

গ্রামের লোকেরা সারা গ্রাম খুঁজেও টিটন আর মিঠুনকে খুঁজে না পেয়ে আবার মাস্টার সাহেবের বাড়িতে একত্র হয়েছে। তার বাড়ির সামনে বড় পুকুর সেই পুকুরের ঘাটে রিতু তিতু এবং টিয়াকে নিয়ে দুশ্চিন্তিত মুখে বসে আছে। কিছুক্ষণ হলো টিয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে। টিয়াকে দেখে তিতুর চোখে পানি টলটল করছে এবং তাদের দুজনকে এভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখে রিতুও কী করবে বুঝতে পারছে না। ঢাকায় তাদের বাবা মাকে জানানো উচিৎ কী না রিতু ঠিক বুঝতে পারছে না। মাস্টার সাহেব তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন, গ্রামের মানুষেরা মিলে টিটন আর মিঠুনকে বের করে ফেলবে, তার কথার উপর ভরসা করে রিতু এখনো তাদের আবু আম্মুদের জানায়নি।

গ্রামের মানুষদের কথা শুনে মাস্টার সাহেব বললেন, সবাই চল, আমরা আজহার আলীর বাড়ি যাই।

গ্রামের মানুষ বলল, চলেন।

তখন প্রায় শখানেক মানুষ দল বেধে আজহার আলীর বাড়িতে রওনা দিল। মিনিট দশেকের মাঝেই তারা আজহার আলীর বাড়ি পৌঁছে যায়।

.

বাড়ির সামনে শদুয়েক মানুষের হই চই শুনে আজহার আলী বের হয়ে এল এক সাথে এত মানুষ দেখে সে ঘাবড়ে যায় কিন্তু মুখে সে সাহসের একটা ভাব ধরে রেখে বলল, কী ব্যাপার, এইখানে এত চিল্লাফাল্লা কিসের?

মাস্টার সাহেব কঠিন মুখে বলল, আপনি খুব ভালো করে জানেন চিল্লাফাল্লা কিসের। উল্টাপাল্টা কথা না বলে সোজাসুজি বলেন ছেলে দুইটারে কোথায় রাখছেন?

আজহার আলী অবাক হবার ভান করল, ছেলে পিলে? কোন ছেলে পিলে? কার ছেলে পিলে?

আপনি জানেন কোন ছেলে পিলে। কার ছেলেপিলে।

আজহার আলী বলল, না আমি কিছু জানি না।

রিতু হাতের চিঠিটা সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল, এই চিঠিটা কে লিখেছে?

আজহার আলী চিঠিটাতে চোখ বুলিয়ে বলল, আমি জানি না, এই চিঠি কে লিখেছে।

রিতু হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিয়ে নিল, তখন আজহার আলী বলল, চিঠি যেই লেখুক অনায্য কথা তো লেখে নাই। আমাগো গেরামে ঝামেলা পাকানোর দরকার কী? অন্যগ্রামে যায় না কেন?

উপস্থিত মানুষেরা চাপা স্বরে প্রতিবাদ করল। মাস্টার সাহেব বললেন, ঝামেলা? এইখানে কোন জিনিসটা ঝামেলা?

আজহার আলী বলল, চিঠিতে লিখেছে পোলাপান চলে গেলেই ছেলে দুইটারে ছেড়ে দিবে। তাহলে পোলাপান যায় না কেন? আমাগো গেরামে কী এমন মধু যে এইখানে থাকতে হবে?

টিয়া তখন হঠাৎ তার রিনরিনে গলায় বলল, আপনি তো চিঠিটা পড়েন নাই, খালি হাতে নিয়ে ফেরত দিয়েছেন। চিঠিতে কী লেখা আছে সেইটা কেমন করে জানলেন?

গ্রামের লোক হই হই করে উঠল, বলল, এই মেয়েতো সত্যি কথাই বলেছে। চিঠি তো পড়েই নাই কেমন করে জানে এইখানে কী লেখা? কেমন করে জানে?

আরেকজন বলল, নিজে লিখেছে জানবে না কেন?

আরেকজন বলল, লেখাপড়া জানে কিনা দেখো। মনে হয় লিখতেও জানে না পড়তেও জানে না।

মানুষজন এতো জোরে হই চই করতে থাকে যে আজহার আলী ভয় পেয়ে যায়। মাস্টার সাহেব হাত তুলে সবাইকে শান্ত করলেন, তারপরে মেঘ স্বরে বললেন, এক্ষুণি বলেন, ছেলে দুইটা কোথায়?

আজহার আলী বলল, আমি জানি না।

তাহলে কে জানে?

গ্রামের একজন বলল, এর দুইজন সাঙ্গাত আছে মতি আর খলিল, তাগো ডাকেন। তারা নিশ্চয়ই জানে।

মাস্টার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ। মতি আর খলিল কই?

আজহার আলী বলল, মতি আর খলিল কই আমি কেমন করে জানুম। হেরা থাকে তাদের মতন।

আজহার আলী কথা শেষ না করতেই ভীড় ঠেলে মতি আর খলিল এগিয়ে আসে। গলা উঁচিয়ে মতি আজহার আলীকে জিজ্ঞেস করল হুজুর কুনো সমস্যা? এইখানে ফালতু মানুষের ভীড় কিসের লাইগা?

মতির বেয়াদপের মতো কথা শুনে সবাই আরো রেগে ওঠে। একজন হুংকার দিয়ে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল তখন হঠাৎ আরেকজন হি হি করে হেসে উঠে বলে, আরে মইত্যা তুই কী চুরি কইরা ধরা পড়ছস নাকী? খালি চুলের গোছা কাটছে নাকী ধইরা মাইরও দিছে?

মতি চোখ পাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই তিতু চিৎকার করে বলল, চিউয়িংগাম! চিউয়িংগাম! মিঠুন নিশ্চয়ই এর মাথায় চিউয়িংগাম লাগিয়ে দিয়েছে! মিঠুন সব সময়ে এই ভাবে মাথায় চিউয়িংগাম লাগিয়ে দেয়।

সাথে সাথে রিতু আর টিয়াও চিৎকার করতে লাগল, নিশ্চয়ই এরা মিঠুনকে ধরে নিয়ে গেছে। মিঠুন তখন চিউয়িংগাম খাচ্ছিল, এর মাথায় চিউয়িংগাম লাগিয়েছে! এরা মিঠুন আর টিটনকে ধরেছে!

মিঠুন আর টিটনকে ধরার মাঝে মাথার এক খাবলা চুল না থাকার কী সম্পর্ক কেউ ভালো করে বুঝতে পারল না কিছু সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামালো না। গ্রামের লোক ঝাঁপিয়ে পড়ে মতি আর খলিলকে ধরে ফেলল।

এরপর কী হতো কেউ জানে না, কিন্তু পৃথিবীর সপ্তমাশ্চর্যের এক আশ্চর্য ঘটে যাওয়ার কারণে সবাই থেমে গেল। সবাই অবাক হয়ে দেখল মিঠুন আর টিটন হেলতে দুলতে আসছে। মিঠুনের ঘাড়ে একটা বন্দুক। তাদের বয়সী একটা ছেলে পথ দেখিয়ে মিঠুন আর টিটনকে আজহার আলীর বাড়িতে আনছে।

আজহার আলী মিঠুনের ঘাড়ের বন্দুকটা চিনতে পারল এটা তার বেআইনী অস্ত্র। তাই বাড়িতে রাখে না, তার মহাজনী নৌকায় ছইয়ের নিচে লুকানো থাকে। এই ছেলে দুইটা যেহেতু বন্দুকটা খুঁজে পেয়েছে তার সাথে আরো অনেক কিছু নিশ্চয়ই খুঁজে পেয়েছে। সর্বনাশ!

আজহার আলী ঘামতে থাকে। গ্রামের মানুষজন যে হঠাৎ করে ভয়ংকর উত্তেজনায় চিৎকার শুরু করেছে সেটাও সে ভালো করে শুনতে পায় না।

হঠাৎ করে আজহার আলীর বাথরুম পেয়ে যায়।

টিটন এবং মিঠুন তার মহাজনী নৌকায় কী করে এসেছে সেটা জানলে সে নিশ্চিত ভাবেই বাথরুম করেই ফেলতো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *